মালাগা সফর- এপ্রিল ২০২৪

 


এককালে তাঞ্জিয়ারকে বলা হত আফ্রিকা মহাদেশের প্রবেশপথ। উত্তর আফ্রিকার সর্ববৃহৎ বন্দর, আমেরিকা ইউরোপের বাণিজ্য জাহাজ এসে নোঙর করত মরক্কোর এই শহরে। সেই বন্দর এখনও চালু আছে যদিও, কিন্তু আগের মতো রমরমা নেই। হাফ দিনের মধ্যে দেখে যা বুঝলাম, তাঞ্জিয়ার বেশ বড় শহর। আধুনিক একটা কস্মোপলিটানে যা যা থাকতে পারে, এখানে সব কিছুই আছে, কিন্তু শহরটা মরক্কোর টুরিস্ট সার্কিটে নেই। এ হল আমজনতার শহর, জিনিসপত্র সস্তায় পাওয়া যায়, আবার টাকা ওড়ানোর ঠেকও আছে। যাই হোক, পোস্টটা তাঞ্জিয়ার নিয়ে নয়, যে শহর থেকে আগে সবাই আফ্রিকায় ঢুকত, সেই শহর থেকে ফ্লাইটে করে আমরা ইউরোপে ফিরে এলাম। 

কোথায় ফিরলাম? মরক্কোয় গেলে যেখানে না গেলেই নয়! জায়গাটা কাছে তো বটেই, আর আগের অভিজ্ঞতা থেকে জানা আছে, এই অঞ্চলের সঙ্গে আমাদের একটা নাড়ির যোগ আছে। বেশ কয়েক বছর আগে যখন স্পেনের দক্ষিণ মানে আন্দালুসিয়ায় আসা হয়েছিল, সেভিয়া, গ্রানাদা, রন্দা দেখলেও মালাগায় আসা হয়নি। এইবার সেই ভুল সুধরোতে চারদিনের মালাগা সফর। কোস্টা দেল সূরের সবচেয়ে বড় শহর, পিকাসো জন্মভূমি, অলিভ গাছের বন, টারকোয়ায়েজ সমুদ্র, কবিদের তীর্থস্থান আর অগুন্তি ছোট ছোট মন কেড়ে নেওয়া গ্রাম আর টাউন, আন্দালুসিয়ায় যাদের নাম পুয়েবলো ব্লাঙ্কোস। ১৯২৭ সালে যখন দেশে চরম অরাজকতা চলছে, সারা দেশ থেকে লেখক আর কবিরা এসে জড় হয়েছিলেন এই অঞ্চলে। শুরু হয়েছিল জেনারেশন অফ ২৭। কবিতা নাটক চিত্রনাট্য ছোটগল্প উপন্যাসের চিরাচরিত স্টাইল ভেঙে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট করতে আগ্রহী এই সাহিত্য আন্দোলনে কে ছিলেন না? লোরকা তো ছিলেনই, সঙ্গে ছিলেন নামকরা কবি আর ভাষাবিদ হোর্হে গুলিয়েন, রাফায়েল আলবের্তি, সুরিয়েলিস্টিক স্টাইলের ভক্ত কবি ভিসেন্তে আলিহেন্দ্রে, স্টাইলিস্টের প্রতিষ্ঠাতা আমাদো আলোনসো, পেদ্রো সালিনাস, ডামাসো আলোনসো, এমিলিও প্রাদোস প্রভৃতি। 

বছর ছয়েক আগে যখন এই অঞ্চলে এসেছিলাম, তখনই বুঝেছি, স্পেনের আত্মাকে বুঝতে হলে মাদ্রিদ বা বার্সেলোনার চেয়ে দক্ষিণে আসাই বেটার। মাদ্রিদ পুরোপুরি ইউরোপীয় ক্যাপিটাল, সেখানকার হিস্প্যানিক সংস্কৃতি বড়ই 'টেলার্ড' বা সাজানো, আর বার্সেলোনা তো একেবারেই কাতালান কালচারের জায়গা। আন্দালুসিয়ার সে দায় নেই, হিস্প্যানিক কালচারের গোটাটাই এখানে অনুভব করা যায়। সেক্ষেত্রে কথা হল, কী এমন আছে এই হিস্প্যানিক কালচারে? পেশাদারী সৌজন্য? আন্তরিক আতিথেয়তা? ফুর্তিবাজ জীবন?

হুমম। সে বলা কঠিন। স্পেনে তর্তিয়া বোকাদিয়া স্যান্ডউইচে দিয়ে খায়, মালাগার রেড সুইট ওয়াইন আইসক্রিমেও ব্যবহার হয় আর বাস্কেটবল টিম ম্যাচ জিতলে রাজ্যের লোক টিমকে সংবর্ধনা দিতে রাস্তায় নেমে পড়ে আর পুলিশ রাস্তা ব্লক করে নিজেরাও সেই উৎসবে শামিল হয়, শুধু এসব বললে কি আর বোঝা যাবে? লোরকা জিপসি ব্যালাডে লিখেছিলেন...

“It will be a long time, if ever, before there is born an Andalusian so true, so rich in adventure. I sing of his elegance with words that groan, and I remember a sad breeze through the olive trees."  

সব যদি বলে আর লিখেই বোঝানো যেত, তাহলে আর এত ঝক্কিঝামেলা নিয়ে ঘোরাঘুরির দরকারটাই কী ছিল? আসল কথা হল দেখা! নির্লিপ্তভাবে, বোঝার জন্য নয়, দেখার জন্যই দেখা! যেমন, মালাগার মেট্রো আর বাসে অসংখ্যবার দেখলাম, একজন মেয়ে বা ছেলে তার পার্টনারকে কথা বলে যাচ্ছে, অন্যজন মন দিয়ে শুনে যাচ্ছে। একান্ত মনযোগ তাদের চাহনিতে। একটা বিশালবপু মহিলার বয়ফ্রেন্ড তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে আর মহিলাটি তাকে নরম গলায় ওয়ার্কপ্লেসের ঘটনা জানাচ্ছে! বলছে তো বলছেই। কিংবা, সেলিব্রাল পালসি (বা পঙ্গু) আত্মীয়কে হুইলচেয়ারে বসিয়ে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে এসেছে একজন আর দুজনেই জোরে জোরে হাসছে, বা ব্যস্ত টুরিস্ট আওয়ারেও মাছদিদি বা পেসকাদো দাদা ফোনে কথা বলেই চলেছে, খামোনের স্লাইস কাটতে কাটতে সুর ভাঁজছে বুড়ো মাংসওয়ালা... এমন অজস্র ছোট ছোট দৃশ্য। এই সব নিয়েই আসল স্পেন।

একটা দেশের কালচার ফিল করতে হলে সেখানকার ইতিহাস, সমাজ আর বাঁকবদলের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় থাকাই সমীচীন, আমার অন্তত তাই ধারণা। সে সব লিখে বোঝানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাছাড়া  সেই চেষ্টা করলেও সবসময় পাঠকদের ধৈর্য থাকে না। সেবার ইউরোপ থেকে ঘুরে এসে এত সবকিছু এতটাই ডিটেলে লেখার চেষ্টা করেছিলাম যে অনেকেই হয়তো বোর হয়ে বইটা মাঝপথে ফেলে পালিয়েছে, 'ভ্রমণ সাহিত্য' কতটা সাহিত্য হবে কতটা ভ্রমণ (ভ্রমণও আবার নানাভাবে হয় পথে নামলে। একটা চলে বাইরে, একটা চলে মনে মনে) হবে সে ভাগাভাগি করা মহা ঝামেলা, আর সব কিছু ব্যালেন্স করতে হলেও সকলের অত ধৈর্য থাকে না। তাই আর বইফই নিয়ে মাথা ঘামাই না। যাই হোক, অবান্তর কথা না বলে এই ছোট্ট ট্রিপের কিছু কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করে রাখি বরং।

মালাগা শহরটা ছিমছাম, পাহাড় সমুদ্র গ্রিনারি সহ একেবারে টিপিকাল 'ট্রাংকিলো' মেজাজের শহর। এই ট্রাংকিলোই আসলে আন্দালুসিয়ার কালচারের সবচেয়ে বড় জিনিস, কিন্তু গুগলে মানে খুঁজলে কিছুই বোঝা যাবে না। কিন্তু আসলে ট্রাংকিলো হল একটা কালেকটিভ লাইফস্টাইল... 'কাম ডাউন। হ্যাভ আ ড্রিংক। নিঃশ্বাস নাও বাছা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো। আমরা আছি তো। চলো, প্লাজা থেকে একটু হেঁটে আসি। এই মেয়ে, স্প্যানিশে গিটারে একটা সুর তোল না! ওই ছেলে, কমলালেবুর রসটা খাও! ভালো লাগবে! কুল! হ্যাভ আ ব্রেথ!" এই মেজাজটাই হল আসলে ট্রাংকিলো। মালাগা, নেরহা বা ফ্রিগালানো... যেখানেই গেলাম এই যাত্রায়, সেই ট্রাংকিলো লাইফস্টাইলের ছাপ সর্বত্র! আসলে, এই স্বভাবটার জন্যই হিস্প্যানিকরা ফ্রাঙ্কোর মতো স্বৈরাচারী শাসনকে সার্ভাইভ করে গেছে। চল্লিশ বছরের ডিক্টেটরশিপ আর তুমুল সেনশরশিপও হিস্প্যানিক সাহিত্য সংস্কৃতিকে খুব একটা আটকাতে পারেনি, এখানকার শিল্পীরা, এই মাটিতে জন্মানো কবি লেখক চলচ্চিত্র পরিচালকরা নিজেদের কথা বলার উপায় ঠিকই খুঁজে নিয়েছেন। রুবেন দারিও থেকে হেমিংওয়ে, সারা দুনিয়া থেকে তাবড় তাবড় শিল্পীরা এসে প্রেমে পড়েছেন আন্দালুসিয়ার, অনেকে সব ছেড়েছুড়ে এই ট্রাংকিলো জীবনের স্বাদ পেতে এখানেই চিরস্থায়ী ঘর বেঁধে থেকে গেছেন। আমার ঘরবাড়ির বালাই নেই, তাই ভবিষ্যতের চিন্তা না করে দেখেই যাই। রাস্তাঘাট, গাছপালা, মানুষজন। গোটা শহরটাই বেগুনি জাকার‍্যান্ডা গাছে ছেয়ে আছে, শান্ত পাড়াগুলো যেন আরো রঙিন। সবুজে সবুজ। সাদা পাঁচিল থেকে নুয়ে পড়ছে আইভি লতা আর বাগানের বোগেনভিলিয়া গাছগুলোয় টুকটুকে লাল রঙ ধরেছে। গোলাপ আর হাজার রকম পুটুসের ঝাড় তো আছেই। আর আছে বেড়াল। যে পাড়ায় আমরা ছিলাম, সেখানে এক প্যান্থার সাইজের মিশমিশে কালো বেড়াল দেখলাম, মনে হল ব্রাউন সাহেবের বাংলোর সাইমন এর লতায়পাতায় পরিচিত হবে, যদিও এ ব্যাটা বাঘের মাসি নয়, সত্যিই বাঘ।

সকাল সকাল সেজেগুজে জুমোস, বোকাদিয়া আর কাফে কোন লেচে (মানে কমলার রস, স্যান্ডু আর কফি আর কি) খেয়ে 'চাউ চাউ' বলতে বলতে বেরিয়ে পড়ি, তারপর সারাদিনের টো টো কাহিনি। আগের চেয়ে স্পেনে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে মনে হল, যদিও অস্ট্রিয়ার মতো গলাকাটা নয়। তবে এখানে লোকজন আমুদে, কথা বলতে ভালোবাসে, আর আমাদের মধ্যে একজন স্প্যানিশ ভাষী বলে এক্সট্রা অ্যাডভান্টেজ তো আছেই। এইপাড়া সেই পাড়া করে বইয়ের দোকানে আশ্রয় নিই। মালাগার নবীন লেখক জাভিয়ের কাস্তিয়োর গল্প এখন সবাই জেনে গেছে, ফিনান্সে কাজ করতেন এই যুবক। কাজে যাওয়ার সময় বাসে মেট্রোয় মোবাইলে লিখে লিখে প্রথম বইটা সেল্ফ পাবলিশ করেছিলেন, তারপর সে বই এমন হিট হয় যে পেঙ্গুইন র‍্যান্ডম হাউস তাঁর সঙ্গে চুক্তি করে, নেটফ্লিক্সে ইতিমধ্যেই তাঁর বইয়ের ওপর নির্ভর করা সিরিজ এসে গেছে। কাসা দে লিবরোতে তুমুল প্রচার চলছে তাঁর নতুন বইয়ের, অন্যান্যদের পাশাপাশি আমাদের প্রিয় সেসার মাইয়োর্কির ছোটদের জন্য লেখা নতুন বইটাও দেখলাম। ওল্ড টাউনে রবিবার অনেকগুলো মিউজিয়াম ফ্রি থাকে, সেখানে পিকাসো মিউজিয়ামের সামনে এইসা লম্বা লাইন পড়েছে যে বলার নয়! লোকের হুজুগ দেখি আর হাসি পায়! পিকাসো এখানে জন্মেইছেন, তাঁর শিল্পজীবনের সঙ্গে এখানকার কোনওই সম্পর্ক নেই। বরং তাঁর বাবার কথা শুনে বেশ মজা লাগল। হোসে রুইজ ই ব্লাস্কো মানে তাঁর বাবার কাছ থেকেই আঁকায় হাতেখড়ি হয়েছিল পিকাসোর, কিন্তু কেন জানি না হোসে শুধুই পায়রার ছবি আঁকতেন সবচেয়ে বেশি। পিকাসোর মনে বাসা বেঁধে ছিল সেই সব ছবি। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া সাদা পায়রা। একাধারে পলিটিকাল এবং পার্সোনাল। সাদা পায়রাকে শান্তির প্রতীক হিসেবে এস্ট্যাবলিশ করার ক্রেডিটও পিকাসোরই। যাই হোক, ভিড়ের হাত থেকে রেহাই পেতে আমরা পিকাসোকে ভুলে পম্পডেই মিউজিয়ামে ঢুকে পড়লাম। প্রায় কেউই নেই সেখানে, সবাই মডার্ন আর্ট আর আর্টিস্টকে ভুলে পিকাসোকে নিয়েই মেতে আছে, তাই আমাদের মৌজ, যদিও মিউজিয়ামটা চমৎকার। বেশ কিছু সমসাময়িক আধুনিক শিল্পীদের কাজ দেখা হল, সে নিয়ে পারলে অন্য একটা পোস্ট দেওয়ার চেষ্টা করব।

মালাগা সহ দক্ষিণ স্পেনের সর্বত্র মুসলিম আর্কিটেকচার বা বারোক মুদেহার স্থাপত্যের আধিপত্য, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কাস্তিও দে জিব্রাল্ফোরো থেকে আল্কাজাবা বা শহরের অসংখ্য প্রাসাদোপম বাড়ি, গির্জা বা বাজারে সেই ছাপ দেখা যায়। তবে গ্রানাদায় আলহাম্ব্রা প্যালেস দেখা হলে আলাদা করে আর সে নিয়ে কিছু দেখার দরকার নেই, তাই এই যাত্রায় আমরা কেল্লা ফেল্লার টিকিট কাটতে যাইনি। তবে টিকিট না কাটলেও কেল্লার একপ্রান্ত অব্দি উঠতেই হয়, কারণ শহর-সমুদ্র- বন্দর- সিয়েরা নেভাভা মাউন্টেন মিলিয়ে যে তিনশো ষাট ডিগ্রি (নাহ, দুশো কুড়ি ফুড়ি হবে বোধহয়) প্যানারোমিক দৃশ্যটা সেখান থেকে দেখা যায়, সেটা দেখে মনমেজাজ নিজে থেকেই ফুরফুরে থুড়ি ট্রাংকিলো হয়ে যায়। উপরি পাওনা বৃষ্টি। এই সফরে ব্যাগের মধ্যে ছাতা ঢুকিয়েও বার করা হয়েছে, (আমিই বলেছিলাম। একটা হ্যান্ডস ফ্রি লাগেজ যেখানে সম্বল, সেখানে ছাতা কী হবে? মরক্কো বা স্পেনে কোথাওই বৃষ্টির কথা ছিল না ফোরকাস্টে, এমনিতেই এপ্রিলের শেষে এখানে বৃষ্টি হয় না, কিন্তু আমাকে মুখ ভেঙানোর জন্যই যেন দুই জায়গাতেই বৃষ্টি হল। আমার জন্মই বৃষ্টিলগ্নে যে!) তাই আমি ক্রমাগত চোখ রাঙানি সহ্য করছি। তবে বৃষ্টি যখন হয়েছে, তখন কি আর ম্যাজিক বাদ যাবে? তাই ভিজে জামা গায়ে দিয়ে যখন দূরের বুলফাইটিং এরিনা আর নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছি পাহাড়ের ওপর থেকে, তখন হুট করে কিছুটা মেঘ সরে গেল, আড়ালে থাকা সূর্যের আলো মেঘের ছাঁকনি থেকে তেরছা হয়ে গলে গোটা চরাচরকে উদ্ভাসিত করে তুলল, আর আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠল একটা প্রকাণ্ড রামধনুর অংশ। 

শীত বাই বাই করেছে, প্রায় সোয়া ন'টা পর্যন্ত আলো থাকে আকাশে। রাতে বাড়ি ফেরার সময় প্রতিদিন আকাশে রঙের খেলা শুরু হয়, আমরা সেদিকে চোখ রেখে ঘরের কাছের একটা কাফেতে ঢুকি। কাফে কাম রেস্তোরাঁ, নাম ono... পাশেই একটা হাসপাতাল আছে, সেখান থেকে সবুজ গাউন পরা ডাক্টার আর নার্সরাও এখানে কফি খেতে আসে, কেউ কেউ মথায় পট্টি বা পায়ে প্লাস্টার বেঁধে ওয়াকিং স্টিক নিয়ে হাজির হয়। রান্নাবান্না কিন্তু চমৎকার। সর্বক্ষণ ব্যস্ততার মধ্যেও বেয়ারারা যথাসম্ভব কী বলব মানে ট্রাংকিলোইস্ট... এদিকে কাউন্টারের ওপর কিছুক্ষণ চোখ রাখলেই বোঝা যায় কী স্পিডে কাজ হচ্ছে। একসঙ্গে চারটে মেশিন থেকে এসপ্রেসো বেরোচ্ছে, ভিতর থেকে রান্নার বাটি আসছে, জুস বের করছে দুজন, সবাই বিল কাটছে, নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। আমরা কফির সঙ্গে আপেল বা গাজর এর কেক অর্ডার করি, বা চুরোজ। চুরোজ কোন চকোলেট। তোহফা খেতে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখি, পিছনের বাগানে পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে বোগেনভিলিয়াকে স্নান করাচ্ছে, সাইমনের জ্ঞাতিভাই ম্যাও ম্যাও করতে করতে চক্কর মারছে।

মালাগায় খানিক হাওয়া লাগিয়ে একদিন নেরহায় চললুম। আলসার বাসের কদর আছে বলেই স্পেনে এখনও ফ্লিক্সবাস জাঁকিয়ে বসেনি, একঘণ্টায় পৌঁছে দিল নেরহায়। ইউরোপের বালকনি বলা হয় এই টাউনকে, টিপিকাল টুরিস্টি মফস্বল, চকচকে পাথরের রাস্তার দুইধারে স্যুভেনিরের দোকানপাট। স্কার্ফ, সুগন্ধি, রেশমের ওড়না, দামি পাব। যদিও সমুদ্রের ওপরের সেই প্রকাণ্ড বালকনি কাম ভিউ পয়েন্ট দেখে আঙুল কামড়াতে হয় বইকি। সুইমিং সিজন বা বিকিনির মরসুম এখনও আসেনি, জোর হাওয়া দিচ্ছে, এরই মধ্যে অনেকে ট্যান হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমাদের ভারতীয় চামড়া, ট্যান ফ্যান বুঝি না, বেশিক্ষণ রোদ লাগলেই পুড়ে যাওয়া বেগুনভাজার মতো মুখ হয়ে যায়। তা সেসব কথা থাক! স্প্যানিশ গিটার বাজিয়ে একদম মাশাল্লাহ পারফর্ম্যান্স দিচ্ছিলেন এক প্রৌঢ়, গান নির্বাচনের জন্যই তারিফ সহ তাঁকে এক্সট্রা ব্রাউনি পয়েন্ট দিয়ে দিলাম। নেরহা ছোট জায়গা হলেও পাহাড় দিয়ে ঘেরা, ফুরফুরে হাওয়ায় গরম তো লাগে না। ঘুরপথে এই গলি সেই গলি করে, রেদোন্দা বারে মিটবল ইন আমন্ড সস আর মালাগা ওয়াইন খেয়ে, কিছুক্ষণ ফুলে বোঝাই লাল গাছগুলোর দিকে মুগ্ধতার আবেশ কাটানো হল... তারপর আমরা চললাম ফ্রিগলিয়ানায়। 

ফ্রিগলিয়ানা দক্ষিণ স্পেনের ছোট্ট এক পাহাড়ি গ্রাম। সব বাড়িঘর সাদা, হোয়াইট ভিলেজ বা পুয়েবলো ব্লাংকো এই অঞ্চলে চারিদিকেই আছে, তাদের মধ্যেও ফ্রিগলিয়ানার একটা নিজস্ব চার্ম আছে। আমাদের বাড়িওয়ালা দানিয়েল বারবার করে বলে দিয়েছিল এখানে আসতে, আমি যদিও খানিকটা আন্ডারএস্টিমেট করছিলাম। এসব টুরিস্টি জায়গা আমাকে খুব একটা টানে না। কিন্তু এসে বুঝলাম, জায়গাটা ঠিক তথাকথিত ডে ট্রিপার প্যারাডাইজ নয়। বরং বলা যায়, হাওয়াবদল এর জন্য অনেকে এখানে আসে। অনেকটা সে যুগের শিমুলতলা বা মধুপুর এর মতোই। অনেক বাড়িই লং টার্ম এর জন্য ভাড়া নিয়ে থাকে অনেকে, কাজকর্মও করে। অনেক জায়গা থেকে কিবোর্ড বা টাইপরাইটারের শব্দ ভেসে আসছিল। হ্যাঁ, টাইপরাইটারই। এই যুগেও। তিন সত্যি করছি। 

ঘোরানো রাস্তা দিয়ে হাঁটি আর ভিউপয়েন্ট দেখে থমকে যাই। সত্যিই সুন্দর। হাইকার আর বাইকারদের জন্য অসংখ্য ট্রেইলও আছে এ পাহাড়ে, সে দু কিলোমিটার থেকে দুশ কিলোমিটার, যার যা ইচ্ছে। ছিমছাম প্লাজা, গোছানো কাফে, শান্ত পাড়া, খাড়াই উৎরাই রাস্তা, পাথরের সিড়ি, একটা সাজানো গোছানো পাহাড়ি গ্রামে যা হবে আর কি! হ্যাঁ, বাড়িগুলো একদম দুধসাদা, আর ভীষণ সুন্দর করে সাজানো। এক একটা বাড়ির সামনে এসে নিজেই পা থেমে যায়। টবের মধ্যে হরেক রকম ফুল, আর ফুলের লাল যে এমন রক্তিম হয় চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ঝকঝকে রোদ্দুর, তকতকে বাড়ি, ফুটফুটে ছেলেমেয়ে তাদের কুচকুচে কালো বেড়াল নিয়ে খেলা করছে টুকটুকে লাল ফুলগাছের কাছে৷  উজ্জ্বল হলুদ রঙের পুটুস ফুল, কমলালেবু ভর্তি গাছ, মানুষ হলে এসব দেখে মুখে হাসি ফুটবে না, এ আমি মানি না। নীল আকাশ বলেও যে কথাটা জানতাম, সে জিনিসটাও আমি প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। এখন চোখ খুলেছে। নীল আকাশ, সুন্দর নীল আকাশ, ভীষণ সুন্দর নীল আকাশ আর ভয়ংকর সুন্দর নীল আকাশের মধ্যে কিছুটা তফাত করা যায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, আকাশি বা স্কাই ব্লু রঙ বলেই প্রাথমিক পাঠ শেষ হলে চলবে না, সেলুরিয়ান ব্লু আর টিলের ব্যাপারটাও জেনে রাখা দরকার। 

হাঁটতে হাঁটতে চলি। যেমন ট্রাংকিলো মানুষ, তেমন ট্রাংকিলো বাড়ি, আর মজার কথা হল, প্রতিটা বাড়িরই একটা নাম আছে। কাসা লোর, কাসা আজুল... কয়েকটি বাংলা করে রেখেছিলাম। একটাও বানানো নয়, মেলাতে চাইলে গিয়ে দেখে আসতে পারেন। নীলবাড়ি, গল্পের বাড়ি, বিল্লি বাড়ি, সাদা গোলাপের বাড়ি, হলুদ মেয়ের বাড়ি, রূপকথার বাড়ি, ফুলের বাড়ি, স্বপ্নের বাড়ি, এবং... বাতাসবাড়ি। গল্প ভাবছেন? ঠিকই, আন্দালুসিয়ার জীবনে এমন গল্প বারবার ফিরে আসে।





























 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on May 02, 2024 14:42
No comments have been added yet.