এই সেই সময় যখন কলকাতার বাবুসমাজ সুরা, নারী ও বুলবুলি-বিলাসে মগ্ন, যখন নব্যশিক্ষিত যুবকেরা প্রাণপণে ইংরেজ-অনুকরণে মত্ত, গ্রাম নিঃস্ব করে প্রজাশোষণের অর্থে চলেছে সংস্কৃতি চর্চা, সমাজ ও ধর্মসংস্কার, তরুণ বিদ্যাসাগর রাত্রি জেগে রেড়ির তেলের আলোয় রচনা করছেন বাংলা গদ্যভাষা, জেগে উঠছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী, এই সেই সময়—
হ্যাঁ, একটি বিশেষ সময়ই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই সুকীর্তিত উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র। তিনি নিজেও এ-উপন্যাস সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন—“আমার কাহিনীর পটভূমিকা ১৮৪০ থেকে ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দ। এবং এই কাহিনীর মূল নায়কের নাম সময়।” লিখেছেন, “সময়কে রক্ত-মাংসে জীবিত করতে হলে অন্তত একটি প্রতীক চরিত্র গ্রহণ করতে হয়। নবীনকুমার সেই সময়ের প্রতীক। তার জন্মকাহিনী থেকে তার জীবনের নানা ঘটনার বৈপরীত্য, শেষ দিকে এক অচেনা যুবতীর মধ্যে মার্তৃরূপ দর্শন এবং অদ্ভুত ধরনের মৃত্যু, সবই যে সেই প্রতীকের ধারাবাহিকতা, আশা করি তা আর বিশদভাবে এখানে বলার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনীয় কথা শুধু এই যে, নবীনকুমারের চরিত্রে এক অকাল-মৃত অসাধারণ ঐতিহাসিক যুবকের কিছুটা আদল আছে। অন্য কোনো প্রসিদ্ধ পুরুষের নাম বা জীবনকাহিনী আমি বদল করিনি....”।
সত্যিই তাই। নাটকের শুরুতে যেমন দেওয়া থাকে পাত্রপাত্রীর নাম ও পরিচয়, তেমনভাবে এই বিপুল বর্ণাঢ্য উপন্যাসের গোড়াতেই যদি দেওয়া থাকত নবীনকুমারের সমকালীন চরিত্রাবলির নাম, বস্তুতই বিস্ময়কর মনে হত সেই তালিকা। মাইকেল, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, হেয়ার সাহেব, দেবেন ঠাকুর—কে নেই। সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীই যেন নানান চরিত্র হয়ে চোখের সামনে জীবন্ত।
যেটুকু তফাৎ তা হল, গবেষকের রচনায় প্রাণ থাকে না, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই প্রাণটি প্রতিষ্ঠা করেছেন।
এক দুরন্ত সময়ের জীবন্ত চলচ্চিত্র ‘সেই সময়’। বঙ্কিম ও আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত এই গ্রন্থের দুটি খণ্ডকে এক মলাটের মধ্যে এনে সম্পূর্ণ নতুন আকারে প্রকাশিত হল এই রাজসংস্করণ। এ-গ্রন্থের বিপুল সমাদর ও স্থায়ী কীর্তিমূল্যের কথা ম্ননে রেখে এ-এক আনন্দ-শ্রদ্ধাঞ্জলি।
Sunil Gangopadhyay (Bengali: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) was a famous Indian poet and novelist. Born in Faridpur, Bangladesh, Gangopadhyay obtained his Master's degree in Bengali from the University of Calcutta, In 1953 he started a Bengali poetry magazine Krittibas. Later he wrote for many different publications.
Ganguly created the Bengali fictional character Kakababu and wrote a series of novels on this character which became significant in Indian children's literature. He received Sahitya Academy award in 1985 for his novel Those Days (সেই সময়). Gangopadhyay used the pen names Nil Lohit, Sanatan Pathak, and Nil Upadhyay.
Works: Author of well over 200 books, Sunil was a prolific writer who has excelled in different genres but declares poetry to be his "first love". His Nikhilesh and Neera series of poems (some of which have been translated as For You, Neera and Murmur in the Woods) have been extremely popular.
As in poetry, Sunil was known for his unique style in prose. His first novel was Atmaprakash (আত্মপ্রকাশ) and it was also the first writing from a new comer in literature published in the prestigious magazine- Desh (1965).The novel had inspiration from ' On the road' by Jack Kerouac. His historical fiction Sei Somoy (translated into English by Aruna Chakravorty as Those Days) received the Indian Sahitya Academy award in 1985. Shei Somoy continues to be a best seller more than two decade after its first publication. The same is true for Prothom Alo (প্রথম আলো, also translated recently by Aruna Chakravorty as First Light), another best selling historical fiction and Purbo-Paschim (পূর্ব-পশ্চিম, translated as East-West) a raw depiction of the partition and its aftermath seen through the eyes of three generations of Bengalis in West Bengal, Bangladesh and elsewhere. He is also the winner of the Bankim Puraskar (1982), and the Ananda Puraskar (twice, in 1972 and 1989).
Sunil wrote in many other genres including travelogues, children's fiction, short stories, features, and essays. Though he wrote all types of children's fiction, one character created by him that stands out above the rest, was Kakababu, the crippled adventurer, accompanied by his Teenager nephew Santu, and his friend Jojo. Since 1974, Sunil Gangopadhyay wrote over 35 novels of this wildly popular series.
Death: Sunil Gangopadhyay died at 2:05 AM on 23 October 2012 at his South Kolkata residence, following a heart attack. He was suffering from prostate cancer for some time and went to Mumbai for treatment. Gangopadhyay's body was cremated on 25 October at Keoratola crematorium, Kolkata.
Awards & Honours: He was honored with Ananda Award (1972, 1979) and Sahitya Academy Award (1984).
এ্যানির ভাষায়, এই বই পড়তে হয় খায়া না খায়া, উন্মাদের মত। গুটি গুটি করে ছাপা ছশো শব্দের পৃষ্ঠায় সাতশো পৃষ্ঠার একটা বই, মোটামুটি ঝড়ের গতিতে শেষ হয়ে যায়।
এবং ব্যক্তিগতভাবে এই বইগুলো দিয়ে আমি সুনীলকে সংজ্ঞায়িত করি। কাকাবাবু লেখার ধরন একরকম ছিল, অরণ্যের দিনরাত্রির মত উপন্যাসগুলো আরেকটা অস্থির (মানে, আক্ষরিক অর্থেই স্থির না—এমন) ধাঁচে লেখা, কিন্তু সুনীল আসলে কী করতে পারেন—সেটা এই উপন্যাস তিনটা (সেই সময়, প্রথম আলো, পূর্ব-পশ্চিম) পড়লে বোঝা যায়। বিদ্যাসাগর কিংবা লর্ড বিটনের মত চরিত্রগুলো টাইমফ্রেমে ঠিক জায়গাতে রেখেও যে এত সাবলীলভাবে উপন্যাস লেখা সম্ভব—সেটা সুনীলের লেখা পড়েই প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম। ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার এই ধরনটা আমার ভালো লেগেছে, কয়েকটা কাল্পনিক চরিত্রকে ব্যবহার করে ইতিহাসের চরিত্রগুলোকে একসাথে জোড়া লাগিয়ে দেয়া।
আমার ভালো লাগে এই দেখে, এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে সুনীল কীভাবে সেই সময়ের একেকটা উপাদান সংগ্রহ করেছেন! সব হয়তো টেরও পাইনি, কিন্তু দু-একটা যখন চোখে পড়েছে, মুগ্ধ-বিস্ময়ে থমকে থেকেছি। সেই যে কলকাতায় বসে রাইমোহন আবেগভরে বলছে পাড়াগেঁয়ে এক ছোকরার বাঁধা গানের কথা, এরপর গেয়ে উঠছে মৈমনসিংহ গীতিকার ‘কোথায় পাবো কলসি কইন্যা, কোথায় পাবো দড়ি—’ভোলা যায় সেই দৃশ্য!
সেই সাথে মুগ্ধ হয়েছি মুখের ভাষা ব্যবহারে সুনীলের এমন কট্ঠিন নিয়ন্ত্রণ দেখে! উফ, একটা জায়গা পাওয়া মুশকিল যেখানে লেখকের স্খলন ঘটেছে। ইংরেজি কথাগুলো সাধুভাষায় লেখার ব্যাপারটা তো দারুণ ছিলই, কিন্তু আশ্চর্য হয়েছি অন্য একটা জিনিস দেখে। শ্রদ্ধেয় শামসুল হক লিখেছিলেন, গ্রামের মানুষ কথার মাঝে প্রচুর বাগ্ধারা বা প্রবাদ ব্যবহার করে, সুতরাং তাদের ভাষায় প্রাণ দেয়ার জন্য গ্রাম্য ভাষার পাশাপাশি এ জিনিসটাও রাখতে হবে। থাকোমণির সংলাপ লেখার সময় সুনীল ঠিক ঠিক তাই করেছেন। সত্যিকারের বড় লেখকদের মধ্যে কি একই চিন্তাধারা কাজ করে?
কেবল ভাষা না, শব্দ ব্যবহার করতে গিয়েও কতবার যে ঝংকার দিয়েছেন সুনীল! একেকটা চরিত্র আসে ‘চটি ফটফটিয়ে’, চতুর্দিকে প্রচুর মানুষ জড় হলে ‘চিলুবিলু অবস্থা’ হয়ে যায়, আর নেশা? হুম, নেশার রঙটা হয় গোলাপী! তাছাড়া ভরদুপুরে ফেরিঅলার ডাকের সাথে যে পাখির ডাকের বস্তুত পার্থক্য নেই—এই সুন্দর কথাটাই বা ক’জন লিখেছেন?
তবে মধুসূদনের নেশা করা কিংবা হরিশ মুখুজ্যের পতিতালয়ে যাওয়ার ব্যাপারগুলো লেখার পরেও আমি নিশ্চিত না, সুনীল তার প্রিয় চরিত্রদের বড় করে দেখিয়েছেন কিনা। কেননা ঈশ্বরচন্দ্র কিংবা রাজা রামমোহন রায় এই উপন্যাসে দেবতুল্য চরিত্র, আসলেই কি তারা তাই ছিলেন? রাজা রামমোহন রায়ের ওপর তো আবদুর রাজ্জাক স্যারকে বিশাল খ্যাপা দেখেছি, স্যার নাকি বলতেন, বাংলায় রেনেসাঁর কৃতিত্ব কোনোভাবেই রামমোহন রায়ের না (সিরাজ স্যার অবশ্য এক কাঠি বাড়া, তার মতে বাংলায় রেনেসাঁই হয়নি)!
সেই সাথে দ্বিতীয় খণ্ডে দু-একটা অধ্যায় এসেছে খাপছাড়াভাবে, অর্থাৎ বই থেকে কুচকুচ করে কেটে ফেললেও উপন্যাসের কাহিনীটা আটকে যায় না। যেমন রূপচাঁদ পক্ষীর গল্পটা দেখে মনে হয়েছে, উপন্যাস লিখতে লিখতে সুনীল হঠাৎ জিভ কেটে স্মরণ করেছেন, রূপচাঁদের কথাই তো লিখলাম না মাইরি—এবং তৎক্ষণাৎ গল্পটা লিখে পাণ্ডুলিপির ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। সময়ের দলিল হিসেবে গ্রাহ্য, তবে উপন্যাসের কাহিনী হিসেবে খুবই দুর্বলভাবে ঝুলছে বইটার সাথে।
শেষত, এই বইটা খুব প্রোভোকিং। চাবুক দিয়ে সপাং সপাং শব্দ করে বলে, যাও মেঘনাদবধ কাব্য পড়, নীলদর্পণের তো কিছুই পড়া হয় নাই তোমার, বেদব্যাসের অপূর্ব উপমা সম্পর্কে ঘোড়ার ডিমটা জানো, রামায়ণ পড়সো জীবনে কখনো—ইত্যাদি, ফলে ধড়ফড় করতে করতে একের পর এক বই পড়তে ইচ্ছে হয়।
Methodologically, both authors have approached the writing in the same way: an influential historical period is chosen — the Bengal Renaissance starting in the 1820s, all the way up to the 1870s in Those Days and the Napoleonic Wars in War and Peace — and characters [both historical and fictional] are used to give a sense of the period. Both authors take licence with putting words in the mouths of real people but do it so skilfully that one doesn't question whether that person would really have behaved in that way. The fictional characters are likewise constructed with such skill that one doesn't feel them to be out of place.
Along with weaving a story that keeps the reader from putting his book down Gangopadhyay, like Tolstoy, provides sharp historical analysis that one can't help agreeing with. Particularly striking is Gangopadhyay's unstinting nationalism. He isn't afraid to criticise his countrymen, be they Hindu, Muslim or Christian for their tacit support, passive inaction or active support, respectively, of the colonial British government. Likewise, Gangopadhyay is fair in praising those British he sees as being positive role models.
Where the comparison ends between Tolstoy and Gangopadhyay is on the question of the narratorial "Voice". Tolstoy's narrator is infamous for declaring, in a "Voice of God", that Nikolai Rostov experienced the happiest moment of his life in the middle of a fox hunt. The same narrator makes numerous claims to truth that no ordinary narrator would be able to make. Gangopadhyay shows restraint in such portions. Certainly, this being a realist novel with touches of modernism, the narrator is timeless and omniscient, but nowhere does he exhibit the arrogant self-confidence in proclaiming certain view points to be "Truth," a literary sin of which Tolstoy was and is often accused.
Clearly as much credit goes to the translator, Aruna Chakravarthy, as the author himself. I don't know Bengali so I can't evaluate the accuracy of the translation. However, a difficult task in any translation is to render the idiom, especially of the language of a previous century with such vast differences in social convention, in such a way as to make the dialogue both believable and engaging. In this latter task, I feel confident in saying that Chakravarthy has done a wonderful job. Not once did I want to put the book down while I was reading it, nor did ever feel that something that came from a character's mouth was jarring or out of place.
All in all, this is a wonderful read and it is an absolute must for anyone who is teaching a course on Indian history or the Indian historical novel. I would recommend anyone with the patience for a historical novel to read this; you won't regret it.
This is the book that made me understand and appreciate my heritage in a way nothing else ever did. Brilliant translation by Aruna Chakraborty! I just wish I had the reading skills to read the original :)
সুনীলের টাইম ট্রিলজীর তিনটি উপন্যাসই অসাধারণ!শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। এই উপন্যাসের প্রতিটি পৃষ্ঠা পড়তে পড়তে আমিও যেন চলে গিয়েছি সেই সময়ে, এ যেন এক ভ্রমন উপন্যাস! “নবীনকুমার বিভ্রান্তিকর আলোর স্বরূপ চিনে যেতে পারলো না। জীবনের শেষ কথাটি উচ্চারন করে অপরাহ্ণে তার চৈতন্য বিলুপ্ত হয়েছিল, তার হৃদস্পন্দন থেমে গেল পরদিন প্রত্যূষে। তার সৌন্দর্য-পিপাসু মন পূর্ণ যৌবনে এসে একটা বাঁক নিয়েছিল, অকস্মাৎ তাকে চলে যেতে হল।”
"সেই সময়"- অসামান্য এক ঐতিহাসিক উপন্যাস। এক উপন্যাসে, এক টাইম ফ্রেমে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রানী রাসমণি, প্যারীচাঁদ মিত্র, দীনবন্ধু মিত্র, ডিরোজিও, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ঐতিহাসিক চরিত্রকে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন অসীম নিপুণতায়। কলকাতার জমিদার-বাবুদের উত্থান পতন, ভোগ, লালসা, অন্দরমহল- ভৃত্যমহলের নানাবিধ ঘটনা, সিপাহী বিদ্রোহ, বিধবা বিবাহ প্রচলন, ব্রাহ্ম ধর্মের বিস্তৃতি, কোম্পানি শাসনের অবসান, নীলকরদের অত্যাচার জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই বইয়ের দুই খণ্ডে। প্রখর মেধাবী নবীনকুমার সিংহ ওরফে কালীপ্রসন্ন এর বিচিত্র জীবনযাপন এই বইয়ের অনেকটা জুড়ে থাকলেও এ উপন্যাসের মূল চরিত্র নবীনকুমার নন। লেখক উপন্যাসের শুরুতেই বলে দিয়েছেন এ উপন্যাসের মূল চরিত্র হলো "সময়"। সময়ের হাত ধরেই লেখক পাঠকদের নিয়ে গেছেন জোড়াসাঁকোর সিংহ বাড়ি, ঠাকুর বাড়ি, নিষিদ্ধ পল্লীতে।
অনেকটা সময় নিয়ে উপভোগ করলাম আঠারো শতকের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে রচিত এ সুদীর্ঘ রচনা। ২২শে আগস্ট শুরু করে শেষ করলাম আজ ৭ই সেপ্টেম্বর, সুনীলের ৮৬ তম জন্মবার্ষিকী তে এসে। শেষ অংশে অসীম হাহাকার আর শুন্যতা তৈরী করে আজকের মেঘলা দিনের বিষণ্ণতা যেন আরো বাড়িয়ে তুলল নবীনকুমারের অকাল মৃত্যু। প্রিয় বই এর তালিকায় খুব সহজেই স্থান করে নিলো "টাইম ট্রিলজি" এর প্রথম এই উপন্যাস।
কিছু বই আছে যেগুলোকে আসলে কখনোই রেটিং দিয়ে হিসেব করা যায় না। ওগুলো রেটিং এর ঊর্ধ্বে। এইটাও তেমনই একটা বই।
১৮৪০-১৮৭০ - এই ৩০ বছরের সময়রেখা ছিল বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কালের রথী মহারথীদের উত্থানের সময়কাল। 'সেই সময়' এ আমরা এই ৩০ বছরের কাহিনী শুনতে পাই। সুনীলের মনোমুগ্ধকর ঝরঝরে লেখনীর মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই ইতিহাসের চরিত্র গুলো কিভাবে রক্তমাংসের মানুষের মতো আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয়।
কালীপ্রসন্ন সিংগী থেকে শুরু করে মধুসূদন দত্তের খ্রিস্টান হয়ে বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করে ইংরিজি নিয়ে মাতামাতি এবং পরবর্তীতে আবার ভুল বুঝতে পেরে বাংলায় ফিরে এসে মহাকাব্য ও নাটক লিখে বাজিমাৎ করে দেওয়া, বিদ্যাসাগর, প্যারিচাঁদ মিত্র ও তাঁর 'আলালের ঘরের দুলাল', রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী,হেমচন্দ্র, হরিশ মুখুজ্যে, দীনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রাহ্ম সমাজের উত্থান,রাজা রামমোহন রায়ের চেষ্টায় সতীদাহ প্রথা বিলুপ্তকরণ, বিদ্যাসাগরের আপ্রাণ চেষ্টায় বিধবা বিবাহ প্রচলন,বেথুন সাহেব ও বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় নারী শিক্ষার প্রসার ও প্রচার ,সংস্কৃত কলেজ বনাম হিন্দু কলেজ, পাদ্রী লঙ,হেয়ার সাহেব, ক্যাপ্টেন রিচার্ডসন, লর্ড ক্যানিং, লর্ড মেয়ো, নীলকর সাহেবদের বাঙালি চাষীদের উপরে অত্যাচার, নীল বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ,মঙ্গোল পান্ডে, নানা সাহেব,সর্বশেষ মোঘল বাদশা বাহাদুর শাহ, রামায়ণ, মহাভারত, মেঘনাদবধ কাব্য, হুতোম প্যাঁচার নক্সা, নীল দর্পন,কলকাতা বন্দর,তৎকালীন হিন্দু সমাজের গোঁড়ামি, জাতভেদ ও ছুঁৎমার্গ, জমিদার, ভন্ড সাধুবাবা, মোসাহেব, মদ, বেশ্যা, বাঈজী - কি নেই এই কাহিনী তে!!
এতো সব ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঘটনার এরকম ৭০৯ পৃষ্ঠা ব্যাপী বিশাল এক জলজ্যান্ত উপাখ্যান এক মলাটের মধ্যে টেনে এনে, তাও ইতিহাস সম্পূর্ণ অবিকৃত রেখে বর্ননা করা একমাত্র গুরু সুনীলের পক্ষেই সম্ভব। 💓
বইঃ সেই সময় লেখকঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রচ্ছদঃ পুর্ণেন্দু পত্রী
অনেকদিন পরে আমার রিডার্স ব্লক কাটলো এবং এই বন্ধে আমি প্রচুর বই পড়ে কাটিয়েছি! আমি বেশ স্যাটিসফাইড আমার এই ভ্যাকেশন নিয়ে। এই বইটির কথা প্রায়ই শুনতাম, কিন্তু বই এর সাইজ দেখে বোধ হয় ভয় পেতাম বলে বইটা ধরা হচ্ছিলো না সেভাবে। ইতিহাস আমার সবসময় প্রিয়। হিস্টোরিক্যাল ফিকশন বলে বই এর একটি ঘরানা আছে, এই বইটি সেই ঘরানার।
সেই সময় একটি বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাস যার উপজীব্য ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ শাসনামলের বিকাশমান কলকাতা নগরীর সমাজ এবং মানুষ।
উপন্যাসের নায়ক নবীনকুমার সিংহ। যার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়ের নানা উত্থান পতন এখানে দেখানো হয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকে।
সমাজের প্রথম চরিত্রের সময়কালে ধনী ব্যাক্তিদের একাধিক বারবণিতা রাখাটাও খারাপ চোখে দেখতোনা হিন্দু রক্ষণশীল ধণী পরিবারগুলো। মেয়েদের পড়াশোনা দূরের কথা, স্বামীর মৃতদেহের সাথে চিতায় উঠাই ছিলো তাদের নিয়তি। এসময় বিধবা বিবাহের প্রচলন বিদ্যাসাগরের হাত ধরে এবং অল্পবয়সী মেয়েদের সেই ভয়ানক বৈধব্য থেকে মুক্তি দেয়ার যে চিন্তাভাবনা তা নাড়া দিয়েছিলো গোটা সমাজ। একজন বারবণিতার প্রচণ্ড মেধাবী পুত্রের সাথে এক স্কুলে পড়বে না বলে দিনের বেলায় সে স্কুল প্রায় বন্ধ করে দেয় যে সমাজের গোষ্ঠী, সেই লোকগুলোকে সন্ধ্যার পরে সেই বারবণিতাদের ঘরে বুঁদ হয়ে থাকতে দেখা যায়, তখন কেউ ছি ছি করে না! ধনীদের দু'হাতে টাকা উড়ানো আর অপরদিকে গরীবদের নিঃস্ব চালচুলোহীন অবস্থা- এই হলো সমাজ কাঠামো! ধর্মীয় গোড়ামি আর কুসংস্কার যখন খেয়ে নিচ্ছিলো মানুষকে তখন কতিপয় মানুষ আসলেন এই জাতিকে নবজাগরণের আশ্বাস দিতে- সমাজ সংস্কারক হিসেবে, সাহিত্যিক হিসেবে, কবি হিসেবে, নাট্যকার হিসেবে, হিতৈষী হিসেবে।
বিধবাবিবাহের পেছনে বিদ্যাসাগর নামক মানুষটির পরিশ্রম, ইংরেজদের হাতে বাংলার কৃষকদের নিপীড়ন, কলকাতায় বেথুন স্কুলের উদ্ভব নারী শিক্ষার জন্য, এখানে আছে মাইকেল মধূসুদন দত্তের এক বিখ্যাত ধণী পরিবারের ছেলে হয়ে অধঃপতনের করুণ অবস্থার প্রেক্ষাপট-তার হিন্দুধর্মের প্রতি অবজ্ঞা আর খ্রিস্টধর্ম এবং ইংরেজদের প্রতি অসামান্য আনুগত্য বোধ-বাংলায় ফিরে আসা এবং মদ্যপানে আসক্ত হয়ে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়া, এখানে জোড়াসাকোর ঠাকুর পরিবারের দ্বারকানাথ ঠাকুর আছেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আছেন, দীনবন্ধু মিত্র আছেন, আছেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, একজন ইংরেজ কতোখানি ভালোবাসা লালন করতে পারে কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাঙালদের জন্য সেটা বোঝা যাবে ডেভিড হেয়ার কে দেখলে আবার একজন ইংরেজ বাংলার মানুষকে কতোখানি নিপীড়িত করেছে তার উদাহারন ম্যাকগ্রেগর!
নবীনকুমারের অকালমৃত্যু আর বিন্দুবাসিনীর পরিণতি আমাকে কষ্ট দিয়েছে খুবই :')
বেশ কয়েকদিন ধরে আমি ছিলাম ঘোরের মধ্যে।বর্তমান থেকে বারবার ফিরে যাচ্ছিলাম অতীতে।রঙিন পৃথিবী শুধু সাদা-কালো কল্পনায় হারিয়ে যাচ্ছিল।পড়ছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস "সেই সময়"।সময়ের তরঙ্গে আমার পরিচিত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বগুলোকে যেন স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছিলাম।তাঁদের জীবনের জানা অজানা অধ্যায়গুলো ধরা দিচ্ছিল চোখের সামনে।উপন্যাসটি শেষ করে আমাদের মধ্যে শুধু কাজ করছিল মুগ্ধতা এবং লেখকের প্রতি অম্লান শ্রদ্ধা।
'সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়' নামটার সাথে আমার পরিচয় 'কাকাবাবু' চরিত্রটার মাধ্যমে।তখন বয়সটা কম ছিল।স্কুলে পড়তাম।একদিন টিফিন পিরিয়ডে ক্লাস থেকে বের হয়ে দেখি বই ভর্তি একটা পিক আপ ট্রাক স্কুলের আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছে।আমি তো অবাক।এত বই তাও আবার গাড়ির ভেতর! একটা লোক ট্রাকের পাশে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল।তাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন এটি 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে'র ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। মফস্বলে বসবাস করার অন্যতম সমস্যা হল পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বই খুঁজে পাওয়াই মুশকিল।যেখানে দেশী বই পাওয়া যায��� না সেখানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের বইও পড়ার সুযোগ করে দিচ্ছিল। আমি কোন সাত-পাঁচ না ভেবেই লাইব্রেরির সদস্য হয়ে গেলাম।এবং প্রথম যেই বইটা নিলাম সেটার নাম ছিল " কাকাবাবুর প্রথম অভিযান" এবং পড়া শেষে ইমিডিয়েটলি কাকাবাবু এবং সন্তুর ফ্যান হয়ে গেলাম।একে একে পড়ে ফেললাম "ভয়ঙ্কর সুন্দর", "সবুজ দেশের রাজা", " পাহাড়চুড়ায় আতঙ্ক", "মিশর রহস্য" এবং বাকি বইগুলোও।কাকাবাবু এবং সন্তুর এডভেঞ্চারগুলো তখন প্রচুর পরিমাণে শিহরণ জাগিয়েছিল।বই পড়ে শুধু আনন্দই পাই নি, অনেক কিছু জানতেও পেরেছি।শিশু-কিশোরদের জন্য প্রতিটা বই তো মণিমুক্তা বটেই,বড়রাও সমানভাবে উপভোগ করতে পারবে। যাক মূল কথায় আসা যাক,এই ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিতে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রায় সবগুলো বই পড়ে ফেললাম।অবশেষে লাইব্রেরির বুকশেল্ফের সবচেয়ে উপরের তাকে মোটা মোটা তিনটি বই আবিষ্কার করলাম যার উপরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম প্রিন্ট করা।বই তিনটার নাম ছিল "সেই সময়", "প্রথম আলো", "পূর্ব-পশ্চিম"।বই তিনটিকে ঘিরে জাগল অজস্র কৌতুহল।এত বড় ফিকশন হতে পারে কখনো? লাইব্রেরিয়ান আঙ্কেলকে বললাম বইগুলো বের করতে।কিন্তু তিনি বললেন,একটু বড় হও তারপর পড়ো। আশাহত হলাম।
তবে কয়েক বছর পর বইগুলো পড়ার বয়স এবং সাহস দুটোই হল।শুরু করে দিলাম 'সেই সময়'।বইটার আকার দেখে ভয় পাওয়ার কোনো কারণই আসলে নেই।সাবলীল ভাষায় লেখা অত্যন্ত সুখপাঠ্য একটি বই।যে কোনো পাঠক একবার শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারবে না এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। শ্রদ্ধেয় কালীপ্রসন্ন সিংহের জীবনকে ঘিরে তৎকালীন কলকাতার ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং ব্যক্তিত্বগুলোর জীবনকে অসামান্য অবদানে সাহিত্যরূপ দিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যদিও কালীপ্রসন্ন সিংহের প্রতিকীরূপে ব্যাবহার করেছেন নবীনকুমার সিংহ নামটি। প্রত্যেকটা চরিত্রই ছিল মনে জায়গা করে নেয়ার মত।সেই সময়ের প্রথম পর্বের বেশির ভাগ জায়গা জুড়েই ছিল নবীনকুমারের অগ্রজ গঙ্গানারায়ণ সিংহ।নির্মল স্বভাবের গঙ্গানারায়ণের জীবনের ওঠানামা আমাকে ইমোশনালি ইমব্যালান্স করেছে। বড়কর্তা বিধুশেখর মুখুজ্যের সাথে গঙ্গানারায়ণের রেষারেষি, বাড়ির গিন্নী বিম্ববতীর সাথে স্নেহময় সম্পর্ক,প্রথম পত্নী লীলাবতীর সাথে সম্পর্ক,বন্ধু বান্ধবের সাথে হিন্দু কলেজের জীবন সবই যেন বিমোহিত করেছে আমায়।কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বিন্দুবাসিনীর সাথে গঙ্গানারায়ণের মিলনই যেন দেখতে চেয়েছিলাম বারবার।জীবনের গতিময়তা গঙ্গানারায়ণকে বিভিন্ন এবং বিচিত্র জায়গায় নিয়েছে,নীলকরদের বিরুদ্ধে পর্যন্ত লড়িয়েছে।তাই গঙ্গানারায়ণ চরিত্রটা খুবই টেনেছে আমায়। তাছাড়া ঘুরে ফিরে এসেছে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক চরিত্র।মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিচিত্র জীবনকে এর চেয়ে সুন্দরভাবে জানতে পারতাম না কখনোই। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছায়া ছিল পুরো উপন্যাস জুড়েই।বাংলা সাহিত্য,বাঙালী মেয়েদের শিক্ষা,বিধবা বিবাহের মত কঠিন সমাজকর্মে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নির্মোহ অবদান এবং কঠিন অধ্যবসায়ের পরিচয় পেয়ে মনে শুধুই নির্ভেজাল শ্রদ্ধার জন্ম নিয়েছে। তাছাড়া রামমোহন রায় কর্তৃক প্রোনীত ব্রাহ্ম ধর্মের উত্থানপতন,ব্রাহ্ম ধর্মের সাথে যুক্ত ব্যক্তিত্বগুলো যেমন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর,দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর,কেশবচন্দ্র সেনের জীবন সম্বন্ধেও স্বল্প পরিসরে জানতে পেরেছি। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের ব্যাপারটাও বাদ যায় নি,ইংরেজদের বিরুদ্ধে মঙ্গল পান্ডে,তীতুমীর,বাহাদুর শাহের সৈন্যদের আপ্রাণ চেষ্টাও বুকে গেঁথে গেছে আমার। তাছাড়াও রানী রাসমণি দ্বারা কলকাতার বিখ্যাত কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার গল্পও জানতে পেরেছি পড়ার ছলে। বাংলাভাষায় লেখা প্রথম উপন্যাস "আলালের ঘরে দুলাল" খ্যাত প্যারীচাঁদ মিত্র, এভারেস্টের উচ্চতা নির্ণয়কারী বাঙালী রাধানাথ শিকদার, "নীলদর্পণ" নাটক খ্যাত দীনবন্ধু মিত্র এমন অনেক বিখ্যাত মানুষের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো এমন সুন্দর করে গল্পে বেধেছেন যে লেখকের প্রশংসা না করে উপায় নেই। বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ও উঁকি দিয়েছেন পরোক্ষভাবে।রবি ঠাকুরের জন্ম পর্যন্ত বাদ যায় নি। কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্রিটিশও স্থান পেয়েছেন এই উপন্যাসে।শিক্ষাবিস্তারে ব্রতী ডেভিড হেয়ার এবং "বেথুন সাহেব" হিসেবে পরিচিত জন বিটনের চরিত্রও মুগ্ধ করেছে আমায়। তবে উপন্যাসটির মূল চরিত্র নবীনকুমারই।দূরন্ত জেদী বালক কিভাবে একের পর এক দুঃসাধ্য কাজ করে বড় হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম।মাত্র পনেরো বছর বয়সে 'বিদ্যোতসাহিনী সভা' প্রতিষ্ঠা,বিধবাবিবাহে দান,নাটক রচনা,মহাভারত অনুবাদ, হুতোমপেঁচা ছদ্মনামে স্যাটায়ার রচনা,কৃষি বিদ্যালয়-হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা সবকিছুই তীব্রভাবে অনুপ্রেরিত করেছে আমায়। নবীনকুমারের জীবনে আসা প্রতিটি নারীচরিত্রই আকর্ষন করেছে,কৃষ্ণভ্রামিনী,সরোজিনী,বনজ্যোৎস্না কুসুমকুমারী,সুবালা সকলেই নবীনকুমারের জীবনে যথার্থ কারণে এসেছে।প্রত্যেকটা নারীচরিত্রের সাথে নবীনকুমারের প্রতিক্রিয়া উপভোগ করেছি খুব। তাছাড়াও আশেপাশের মাইনর চরিত্রগুলোও মনে দাগ কেটে গেছে। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশ মুখার্জী,নায়েব ভুজঙ্গধর,নবীনকুমারের ভৃত্য দুলালচন্দ্র,দুলালের মা থাকোমণি,গোমাস্তা দিবাকর,দিবাকরের স্ত্রী সোহাগবালা,পতিতা কমলাসুন্দরী সকলের জীবনের খুটিনাটি বর্ণনা উপন্যাসটির সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বই কমায় নি। আমার অন্যতম পছন্দের চরিত্র রাইমোহন ঘোষাল।হিরামণি, চন্দ্রনাথ এবং রাইমোহনের সম্পর্কের টানাপোড়েনগুলো আমাকে নাড়িয়েছে খুব। কয়েকদিন যাবত নবীনকুমার এবং এইসব অসংখ্য চরিত্রগুলোর জীবনের অংশে আবিষ্কার করছিলাম নিজেকে।তৎকালীন সমাজের সংস্কারের বেড়াজাল ভেঙে নতুন আঙ্কিকে সমাজকে গড়ে তোলার সময়টাকে অদ্ভুত মুন্সীয়ানায় মলাটবন্দী করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলার নবজাগরণকে যেন প্রত্যক্ষ করলাম অসামান্য সাহিত্যের হাত ধরে। বাংলা সাহিত্যে অমর এক কীর্তি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "সেই সময়"। ইতিহাসকে,ইতিহাসের অমর ব্যক্তিত্বগুলোকে এমন শিল্পরূপ দেওয়ার জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতি।আমার মত সহস্র পাঠকের জীবন সম্মোহিত করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। অনেক কিছু বলার ছিল,জানি না কতটুকু বলতে পেরেছি।যতই বলা হয় এই বই নিয়ে,আসলে কম বলা হয়।
এক মাসের অধিক সময় নিয়েও বইটা শেষ করতে পেরে তৃপ্তি লাগছে এই ভেবে,এর আসলে কোনো শেষ নেই। যেই গল্পের মূল চরিত্র ' সময় ' তার শেষ মানব জীবনের দেখা সম্ভব না। তবে খুব বিশদভাবে এবং প্রাণ সঞ্চারিত ইতিহাস লেখা হয়েছে ।অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক চরিত্র এবং তাদের সমসাময়িক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে তাদের বিখ্যাত কেতারদুস্তের বাইরে, এবং সামাজিক কাঠামো ফুটে উঠেছে যা কেবল পশ্চাৎ না বর্তমাকালের নানান অবস্থার প্রতিফলন ঘটায়।
সেই সময় জানার জন্য 'সেই সময়' পড়া। উপন্যাস পড়তে আমার বেশ কষ্ট হয়, তবে সেই সময় টানা পড়ছি। সেই সময়ের কবিগান-পুঁথিগান, হিন্দু কলেজ, কলকাতার বাবুসমাজ, সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে নীলকরদের অত্যাচার- এই সব কিছুই আছে। ভাবছিলাম কোন মূল চরিত্র থাকবে না, থাকলেও সেটা হবেন ঈশ্বরচন্দ্র বা মধুসূদন, তবে এই বইতে মূল চরিত্র ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। কালীপ্রসন্ন মাত্র ২৩ বছর বয়সেই ১৮ খন্ড মহাভারত সংস্কৃত থেকে প্রাঞ্জল বাংলায় অনুবাদ করছিলেন, তার অনুবাদের উচ্চমান দেখে ঈশ্বরচন্দ্র নিজের মহাভারত অনুবাদ বাদ দেন। সংক্ষিপ্ত মহাভারত আমার পড়া হইলেই অনেকদিন থেকেই আমার মূল মহাভারত পড়ার অনেক শখ, মহাভারতকে বলা হয় পৃথিবীতে যে সকল কাহিনী বলা হইছে তা��� মধ্যে শ্রেষ্ঠতম কাহিনী। ভাবতেছিলাম পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত ইংরেজি অনুবাদ পড়বো, তবে নেটে সার্চ দিয়া মাত্র কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ নামাইতে দিলাম। দেখি এইটা পড়তে পারি কিনা।
18th Century Calcutta!! An Extravagant Environment, with all Glory, Splendor, Grandeur and Magnificence, this is nothing but an EPIC!!
Featuring Powerful Personalities of Indian Renaissance :- Ishwarchandra Bidyasagar, Bankim Chandra Chatterjee, Michael Madhusudan Dutt, Debendranath Tagore, Rani Rashmoni, bit of Sepoy Mutiny, Dinabandhu Mitra, Mangal Pandey, Pramath Nath Bishi, Henri Derozio, John Bethun. . . . . . . . who isn't there!!??
Fact and Fiction mixed up to form an unique and magnanimous quanta of literature!!
Seriously, One should read this book at least once in her/his lifetime!! This can't be explained in mere words!!
Story - 9[i am cutting one for its lengthiness a bit]. Writing Style - 10[no choice. Its just brilliant] Environment - 8.5[vast and enormous] Characterization - 10[Again!]
আঠারশ শতকের বাংলাকে কেন্দ্র করে লেখা এক অসামান্য উপন্যাস "সেই সময়"। সেই সময়কালের বাংলার ঐতিহাসিক নানা চরিত্রের যেন পুনর্জন্ম ঘটেছে এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে।
কোনও নির্দিষ্ট চরিত্রকে ঘিরে নয়, এই উপন্যাসের পত্তন এবং বিকাশ নানা চরিত্রের মধ্য দিয়েই। যদিও নবীনকুমারের জীবনকালই এই উপন্যাসের সময় ব্যাপ্তি, কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বয়ং লেখকের মত করেই বলতে হয়, 'সময়ই এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র'।
যাদেরকে ঘিরে এই উপন্যাস, তাদের বেশিরভাগই নিজ কর্মগুণে অন্তত কিছুটা হলেও আমাদের চেনা, তবে তাদের সম্পর্কে আরও কিছুটা জানা হয় এই বইয়ের মধ্য দিয়ে। রাজা রামমোহন, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবা মাইকেল মধুসুদনের বিভিন্ন কীর্তি কিংবা মানুষ হিসেবে তাদের নানা দিক গল্পের ছলে উঠে এসেছে দারুণ মুনশিয়ানায়।
এই বইটি পড়েই সুনীলের লেখার ভক্ত হয়েছি। সবসময়ের প্রিয় বইয়ের তালিকায় থাকবে "সেই সময়"।
২.৫ জানি খুব বিখ্যাত উপন্যাস কিন্তু পড়ার পর একটা জিনিসই মনে হলো। কিছু খেয়ালি ধনবান বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন পুরুষ জাতিউদ্ধারের কাজে নেমেছেন কিন্তু তারা জানেনই না অর্ধেকের বেশী মানুষের জীবনযাত্রা কেমন। ঘুরে ফিরে ওই একই বিত্ত বৈভব আর ভোগের প্যাঁচাল খুবই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। শুধু একটা জায়গায় উপন্যাস টা সার্থক, সেই সময়ে মেয়েদের অবস্থা তুলে ধরায়। ধনী কিংবা গরীব মেয়েদের অবস্থা ও পরিনতি কম বেশী একই। ওই সময়ের মেয়েদের দূর্ভাগ্যর কথা ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়।
বইয়ের নাম : #সেই_সময় লেখক : #সুনীল_গঙ্গোপাধ্যায় প্রকাশক : #আনন্দ প্রথম অখন্ড সংস্করণ : ১ লা বৈশাখ ১৩৯৮ পৃষ্ঠা : ৭০৮ মূল্য : ৪০০/- বইয়ের শেষে গ্রন্থপঞ্জী রয়েছে।
কিছু লেখা পড়তে হয় না বরং পাঠককে পড়িয়ে নেয়, এই সেই গোত্রের উপন্যাস। উপন্যাস জুড়ে রয়েছে চরিত্রের ভীড়, মাইকেল, গৌর বসাক বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, হেয়ার সাহেব, বেথুন,ঈশ্বরগুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, প্যারীচাঁদ, কালীপ্রসন্ন, হেমচন্দ্র, রাসমণি, রামকৃষ্ণ ... কিন্তু মজার ব্যপার হল কোনও চরিত্রই ভীড়ে হারিয়ে যায়না বরং স্বমহিমায় ফিরে ফিরে এসে পাঠককের কাছে নিজের দাবী তুলে ধরেন। উপন্যাস জুড়ে আছে একটার পর একটা ঐতিহাসিক ঘটনা, বিধবা বিবাহ প্রচলন, সিপাহী বিদ্রোহ, নীলচাষ, মহারানীর রাজত্বকাল, সেই সময়ের বাবু সমাজের চিত্র, জাতের ভেদাভেদ, অন্দরমহলের নারীদের মনের খবর, পতিতালয় আরো কত কি... বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য ছুঁয়ে বঙ্কিমের কপালকুন্ডলা, আহা! উপন্যাসটিকে সেই সময়ের মানসভ্রমণ বলা যেতেই পারে। উপন্যাসের সময়কাল ১৮৪০-১৮৭০ খ্রীঃ আর এই সময়কে প্রতীক হিসেবে ধরে সুনীলবাবু এঁকেছেন নবীনকুমার চরিত্রটি, তাঁর জীবনের গতিধারা অনুসরন করতে করতে পাঠক উপন্যাসের উপাম্তে এসে পৌঁছায়। এক দুরন্ত সময়ের জীবন্ত চলচ্চিত্র হল উপন্যাসটি। পড়তে পড়তে অবাক হয়ে যেতে হয় এই উপন্যাস কখনই তথ্য ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেনি, লেখক এতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। যদি ইতিহাসই জানতে হয় তবে ইতিহাস বই পড়াই শ্রেয় কিন্তু এই উপন্যাসের মূল উপাদান বা নায়ক সময় হলেও রসের ভিয়ানে চাপিয়ে লেখক তা আমাদের কাছে পরিবেশন করেছেন তাই পাঠকের মনন ক্ষুধার নিবারণ ঘটে তাতে সন্দেহ নেই। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল 'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে আড়াই বছর ধরে। বঙ্কিম ও আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই গ্রন্থের দুটি খন্ড একমলাটে প্রকাশিত। পুনশ্চ : বইটি আমার ঘরে এসেছিল কুরিয়ারে গত জন্মদিনের উপহার হিসেবে। পাঁচমাস কেটে যাওয়ার পর পড়া শুরু করি, পড়তে সময় লেগেছে আটদিন। বইটির প্রতি আমার আকর্ষণ এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে নেট প্যাক শেষ হয়ে গেলেও ভরাই নি, অফিস থেকে ফিরে আর অফিস যাওয়ার আগে পর্যন্ত বইটা পড়েছি... একাকীত্বের আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে এমন উপন্যাসকে কাছে পাওয়ার থেকে সুখকর আর কিছু হতে পারেনা। ধন্যবাদ বন্ধু এত ভালো #উপহার দেওয়ার জন্য।
ঐতিহাসিক উপন্যাস আমার সবসময় ই পছন্দের। এর আগে জোছনা ও জননীর গল্প, মধ্যাহ্ন এগুলো পড়েছি। এরপর এই চমৎকার জিনিসটি হাতে পেলাম।
এই উপন্যাস টা পড়তে গিয়ে প্রতি পদে পদে রোমাঞ্চিত হয়েছি। ইতিহাস, রাজনীতি, রোমান্স লেখক সবকিছু অপূর্বভাবে মিশ্রিত করেছেন। লেখাটার পটভূমি আঠারো শতকের কোলকাতা। এই শহরটার জন্মই হয়েছিল ইংরেজদের হাত ধরে। আর শহরটা গড়ে ঊঠেছে ইংরেজদের আনুকূল্য পাওয়া হিন্দু জমিদারদের হাত ধরে। এই শহরের মাধ্যমে পাশ্চাত্য সভ্যতা/সংস্কৃতি যেমন আমাদের হাতে এসেছে, তেমনি জমিদারদের বিলাসব্যসন হেতু অনেক পাপও হয়েছে এই শহরকে ঘিরে। বাংলার জাত্মাভিমান এর শুরু এই শহর থেকেই। এই জাত্মাভিমান আস্তে আস্তে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে রূপ নিয়েছে।
সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। গল্পটা সময়ের। টিক টিক করে বয়ে চলা সময়ের গল্প নয় এটা। এই গল্প রক্ত-মাংসের সময়ের! এই সেই সময় যখন কলকাতার বাবু সমাজ সুরা, নারী ও বুলবুলী-বিলাসে মগ্ন, যখন ঘুণে ধরা সমাজের নব্য শিক্ষিত যুবকেরা প্রাণপণে ইংরেজ অনুকরণে মত্ত, চারিদিকে খ্রিষ্টান ধর্মের জয়জয়কার। এদিকে গ��রাম নিঃস্ব করে প্রাজাদের স্কন্ধ্রে খাজনা নামক অনায্য বোঝা চাপিয়ে সেই অর্থে চলছে সংস্কৃতি চর্চা, সমাজ আর ধর্ম সংস্কার। এই গল্প আমার গল্প। আমার অতীতের গল্প। আর কার? নবীনকুমার সিংহের গল্প। তা বেড়ে উঠার গল্প। তার আশে পাশের সমাজের গল্প। গল্পটা গঙ্গানারায়ণের। বিধুশেখর বাবুর। রাইমোহনও আছে এই গল্পে। বিম্ববতী নামে এক মমতাময়ী মায়ের গল্পে। যে সহস্র কষাঘাত সহ্য করে গিয়েছেন নিজের সংসারের জন্য। সময় বড়ই অদ্ভুদ। আর সুনীল বাবুর ‘সেই সময়’ আরো এক কাঠি সরেস। গল্পে থ্রিল চান? হয়তো পাবেন না কিন্তু বিস্ময়ে বাক্যহারা হতে চাচ্ছেন? সব রথীমহারথী দের জীবন্ত দেখতে চান দুই মলাটে বসে থাকা কালো হরফের মাঝে? তবে হাতে তুলে নিন সেই সময়। কেন বললাম ? মাইকেল মধুসূদন দত্ত কে চেনেন কি ভাবে? জানেন তার অতীত? উত্তর খুজে পাবেন সেই সময়ের পাতায়। ঈশ্বরচন্দ্র বি��্যাসাগর! বাংলা গদ্যের জনক হিসেবেই চেনেন! আর সমাজ সংস্কারক হিসেবে তার অবদান কতখানি? কতটুকু ধারণা আছে আপনার? নীলদর্পনের নাম শুনেছেন? শুনেছেন দীন বন্ধু মিত্রের কথা? বলুন তো সিপাহী বিদ্রোহ এর প্রথম সূতিকাগার কাকে বলা হয়? কে প্রথম সাহেবদের মুখে বন্দুক তাক করে? এমন অনেক জানা না জানা স্বর্ণাক্ষরে রচিত সময়ের সাক্ষী ‘সেই সময়’। বইটিতে লেখক তার সুনিপুণ লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন ১৮৪০-১৮৭০ এর সময়ে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাবলী। ঐতিহাসিক ঘটনার এত সাবলীল বর্ণনাও হতে পারে তা এই বই না পড়লে জানা সম্ভব হত না। উত্থান-পতন, জন্ম-মৃত্য নিয়ে আমাদের চারপাশ। জীবন বড়ই বৈচিত্র্যময়। আর ১৮ শতকের জীবনযাত্রা ছিল আরো বৈচিত্র্যময়। সেই বৈচিত্র্যময়তাকে উপজীব্য করেই সুনীল বাবুর ‘ সেই সময়’ এগিয়ে গিয়েছে সেই সময়ের বাঁকে বাঁকে কিছু কিছু বই আছে যা না পড়া থাকলে নিজেকে পাঠক বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে। কিছু কিছু বই থাকে যাতে বুঁদ হয়ে যেতে সময় লাগে না এক মুহর্তও । আবার বইটি শেষ করার পর ঘোর লেগে থাকে নিজের আশে পাশের পুরোটা জুড়ে। নিজেকে ওই দুই মলাটের মাঝে সুপ্ত এক চরিত্র হিসেবে কল্পনা করতে। নিজেকে মাঝে মাঝে নবীনকুমার, কখনো বা গঙ্গানারায়ণ কখনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধুর মাঝে হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে সময়ের অন্তরালে সেই সময়ের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে। বইয়ের মাঝে গন্ধ পাওয়া যায় জানেন? সেদো মাটির গন্ধ। বৃষ্টির ঘ্রাণ। নদীর তীরের দখিনা বাতাস। কিংবা সহধর্মিণীর সদ্য স্নান শেষে ভেজা চুলের গন্ধ সেই রমনীর চপলতা, ঝংকার তোলা হাসি। কিংবা ভোর রাতে (নাহ থাক বাচ্চাকাচ্চা আছে অফ যাই
৭০০ পৃষ্ঠার বিশাল কলেবরের (অতি ক্ষুদ্র ফন্ট স্বাভাবিক ফন্ট হলে হয়তো ১০০০ পেজ ছাড়াতো) লেখা বইটি গত এক মাস ধরে অল্প অল্প করে পড়ছিলাম।আজকে হঠাৎ শেষ করার মনে হচ্ছে যেনো জীবন থেকে কিছু একটা হারিয়ে গেলো।আরো ১০০০ পেজ হলেও বোধহয় মন্দ হতো না। এখানেই বোধহয় লেখকের সার্থকতা নিহিত। এই কয়েকদিন যতক্ষণ বইটি পড়ছি মনে হয়েছে যেনো টাইম মেশিনে চড়ে উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। অদ্ভুত এক অনুভূতি,মুগ্ধ হয়েছি।
অন্ততপক্ষে বাঙ্গালী হয়ে জন্মনিলে তার জীবনে একবার এই বইটি পড়া জরুরী বলে আমার মনে হয়েছে । কয়েকদিন বিরতি দিয়ে টাইম ট্রিলজি পরের বইটি শুরু করবো।এটির মত পরের গুলোও মুগ্ধ করে নাকি তাই এখন দেখার অপেক্ষা।
Can proudly say that this is the best historical fiction i have read so far. The society of the time is brilliantly depicted and one is completely immersed. The widow-remarriage act, child-marriages, education, 1857, indigo-farming etc have all been covered aptly. Also, hats-off to the translator Aruna Chakravarti. The reading experience was smooth and she almost made herself invisible ! Came to know later that she too has written books on the same era. Will be reading the sequel First Light soon.
আমার পড়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম বই। ঐতিহাসিক উপন্যাস সমসময়ই আমার প্রিয় জনরা। এই বইয়ে যে ঐতিহাসিক সব চরিত্রদের দেখা পাব সেটা না জেনেই পড়তে শুরু করেছিলাম, আস্তে আস্তে জেনেছি আর অবাক হয়েছি। এত ক্যাপটিভেটিং স্টোরি টেলিং, ৭০৯ পৃষ্ঠার এই বই পড়তে গিয়ে একবারও মনে হয়নি শুধু চোখ বুলিয়ে পড়ি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামমোহন রায় সবাই যেন আমার সামনেই ঘুরছিল, কথা বলছিল। পড়ার সময় বারবার মনে হয়েছে আমি কতকিছু জানতাম না, কতকিছু জানি না, কিছুই পড়া হয়নি! এটা অবশ্যাই আমার পড়া সবথেকে সেরা বাংলা উপন্যাসগুলোর তালিকায় থাকবে।
"সেই সময়" যে সময়ের কথা বলেছে, সেই সময়টা আমাদের পাঠ্যবই থেকে আড়াল হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন ইতিহাস থেকে আড়াল হবার পালা। আর মানুষের মনের কথা নাই বা বললাম.... ঐতিহাসিক ফিকশন হলেও আমাদের ব্রিটিশ ভারত এবং তারও আগে যে একটা সুখের বা দুঃখের ইতিহাস আছে সেই বিষয়ে আগ্রহ জাগাতে বইটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। অসাধারণ একটা সময় কাটলো সেই সময়ের সাথে।
কবি এবং কথা সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার একজন প্রিয় লেখক।এর আগে তাঁর কিছু কাব্যগ্রন্থ,গল্প এবং কাকাবাবুর বই গুলো পড়েছি যা সবই সুখপাঠ্য ছিল।“সেই সময়”বইটি যখন পড়তে নিলাম তখন এর আকার দেখে খানিকটা দ্বিধায় ছিলাম যে শেষ পর্যন্ত এটি ধৈর্য্য সহকারে শেষ করতে পারবো কিনা,কারন এত বৃহৎ আকারের উপন্যাস এর আগে কখনো পড়েনি। কিন্তু বইটি শুরু করার পর সেই আশংকা আর সত্যি হয়নি,প্রায় সাতশ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি পাঁচদিন ধরে পড়েছি,যতক্ষন উপন্যাসের মধ্যে ছিলাম মনে হয়েছে একটা ঘোরের মধ্যে আছি,পড়ার সময় কোন ক্লান্তি নেই,অবকাশ নেই এমনই আকর্ষনীয়,প্রানবন্ত গতিশীল ভাষা।
“সেই সময়”একটি গবেষণাধর্মী ঐতিহাসিক উপন্যাস।এই বইটি ১৮৪০ খিষ্টাব্দ থেকে ১৮৭০ খিষ্টাব্দ পর্যন্ত তৎকালীন কলকাতা কেন্দ্রীক বঙ্গ সমাজকে ধারণ করেছে।ঔপ্যনাসিক এই গ্রন্থে বাংলার নবজাগরণের উন্মেষকালের একটি চিত্র সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
উপন্যাসের মূল চরিত্র জমিদারপূত্র নবীনকুমার।তাঁর জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি এই উপন্যাসের পরিধি।এখানে বলা প্রয়োজন যে নবীনকুমার চরিত্রটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঐতিহাসিক চরিত্র কালীপ্রসন্ন সিংহ অবলম্বনে তৈরী করেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যলগ্নের কলকাতা এই উপন্যাসের পটভূমিকা।লেখক তৎকালীন সময়ের সামাজিক সমস্যাগুলো খুব করুন ভাবে এই উপন্যাসে তুলে ধরেছেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলন,দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার,মধুসূদন দত্তের ইংরেজ প্রীতি এবং পরবর্তীতে বাংলাভাষায় সাহিত্যচর্চা,সিপাহী বিপ্লব,নীলকরদের অত্যাচার এবং কৃষকদের সম্মিলিত প্রতিরোধ,ধনিক শ্রেনীর সমাজ সেবামূলক কার্যক্রমের আড়ালে তাঁদের বিলাসী জীবন যাপন,মদ্যপান,পরদার গমন ইত্যাদি নানারকম বিষয়াদিকে সমন্বয় করে সময়ের ধারাবাহিকতায় নির্মিত এই বৃহৎ পরিসরের উপন্যাস।
এই উপন্যাসের প্রায় সব চরিত্রই ঐতিহাসিক কিন্তু কাহিনীতে গতিশীলতা আনয়নের জন্য গ্রন্থাকারকে কিছু কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে যাতে মূল ঘটনার বা চরিত্রের একটুও অবক্ষয় হয়নি বরং চরিত্রগুলো এতে করে আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে।এই প্রসঙ্গে গ্রন্থাকারের বক্তব্য হলোঃ উপন্যাস উপন্যাসই, ইতিহাস নয়, বলাই বাহুল্য।ইতিহাসের সার্থকতা তথ্যনিষ্ঠায় উপন্যাসের উপজীব্য হলো তত্ত্ব এবং শিল্পরস। উপন্যাসের চরিত্রগুলি কথা বলে এবং ঘুরে ফিরে বেড়ায়,কিন্তু ইতিহাস সংলাপের ধার ধারে না,এবং জীবনীগ্রন্থগুলিতেও দু-চারটি টুকরো গল্প ছাড়া জীবিত মানুষটির কীর্তিগুলির আক্ষরিক বর্ণনা থাকে না। সুতরাং যতদূর সম্ভব তথ্য আহরণ করে এদের জীবন্ত করার জন্য কল্পনাশ্রয়ী সংলাপ বহুল পরিমাণে ব্যবহার করতে আমি বাধ্য হয়েছি।কারো কারো মনে হতে পারে এটা লেখকের পক্ষে বেশি স্বাধীনতা গ্রহণ,কিন্তু আমি মনে করি, লেখকের স্বাধীনতার সীমানা টানা উচিত নয়।কারন,পাঠকের স্বাধীনতা প্রকৃত পক্ষেই সীমাহীন।তবে,কোন ঐতিহাসিক চরিত্রকেই আমি স্বস্থান থেকে কিংবা জীবনপর্বের নির্দিষ্ট সময়গুলি থেকে বিচ্যুত করিনি।
পরিশেষে বলতে চাই ইতিহাস অনুসন্ধানী পাঠকদের কাছে এই গ্রন্থটি একটি বহুমূল্যবান দলিলের মত।একবার পড়তে শুরু করলে আর শেষ করতে ইচ্ছা করবে না।
আচ্ছা টাইম ট্রাভেল কি আসলেই অসম্ভব? কেউ কি কোনোদিন টাইম ট্রাভেল করেনি? তবে এই যে সময়ের ঘোড়ায় চড়ে উনিশ শতকের 'বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে' ঘুরে বেড়ানো তাকে কি বলা হবে? এ যেন এক ঘোরলাগা মিশ্র অনুভূতি, যাকে ব্যক্ত করা যায় না, বলা যায় না। ইতিহাস আর সমাজ বিবর্তনের দর্পণে তাকালে এক ধরনের অজানা অনুভূতিতে হাত পা এবং একযোগে হৃদয় অসার হয়ে যাওয়া আদৌ কোনো সিন্ড্রোম কিনা তা গবেষণার দাবী রাখে।যাকগে চলুন "সেই সময়" এর সেই সময় নিয়ে টুকটাক কথা বলি। উনিশ শতকের ৪০ এর দশক থেকে ৭০ এর দশক পর্যন্ত গঠিত ইতিহাসকে উপজীব্য করে করে লেখা হয়েছে "সেই সময়"। বলে রাখা ভালো ইতিহাসগ্রন্থ ও হিস্ট্রিক্যাল ফিকশনের মধ্যে বিস্তর এক পার্থক্য থাকে তা পাঠকমাত্রই জানার কথা। সুতরাং বইয়ের অনেক ঘটনাই হয়তো প্রকৃত ইতিহাসের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে যা ঔপন্যাসিক তার নিজের খেয়ালখুশি মতন স্থান দিয়েছেন বইয়ে, এনেছেন এক সিনেম্যাটিক আবহ। এই বইয়ের প্রধান চরিত্র " নবীনকুমার সিংহ" নামে এক জমিদারতনয়। ক্ষণজন্মা এই চরিত্রটিকে লেখক এক বিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব ও বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের পৃষ্ঠপোষকদের একজনের ছায়া অবলম্বনে নির্মাণ করেছেন। (সেই চরিত্রের মুখোশ উন্মোচন করে স্পয়লার দেয়ার ইচ্ছে মোটেও নেই। বইটি পড়লে সহজেই আপনারা বের করে নিতে পারবেন সেই চরিত্রটি।) তারপর ছুটিয়েছেন সময়ের ঘোড়া। সময়ের ঘোড়া ছুটতে ছুটতে কখনো এসেছে ঢুলতে ঢুলতে সুরার পাত্র নিয়ে বসে থাকা মধুসূদনের কাছে, কখনো বিত্ত বৈভব আর আভিজাত্যে মোড়া প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের কাছে। উনিশ শতকের মধ্যভাগের কথাই যেহেতু চলছে তাহলে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এরাই বা বাদ যাবে কেন? বরং দেখা যাচ্ছে "সেই সময়"-র ঘোড়া বেশিরভাগ সময় ভীড় করেছে বিদ্যাসাগর আর মধু-দের দোরগোড়ায়। দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় সে শতকের হেন কোনো বিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব নেই যার কথা বইয়ে লেখক আনেননি। উঠে এসেছে হিমালয় আবিষ্কারক রাধানাথ শিকদারের নাম, ইয়ং বেঙ্গলের লিবারেলিজম, হিন্দু কলেজ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বীটন প্রমুখরা। এই উল্লেখযোগ্য সময়টাকেই অনেকে আবার বলে থাকেন " বেঙ্গলী রেনেসাঁস" এর কাল। বিধবাদের সমাজে করুণ অবস্থা, ধর্মের দোহাই দিয়ে বিধবাদের সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং একসময় গোড়া হিন্দুদের নাগপাশ থেকে বিধবাদের উদ্ধার করে বিধবা বিবাহের প্রচার ও আইন পাশ,সতীদাহের মতন জঘন্য আর নিকৃষ্ট আচার দূর করা, ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা, সিপাহী বিপ্লব, বাংলা ভাষায় সার্থক উপন্যাস, মহাকাব্য, নাটক রচনার সূচনার যে কাল তাকে এক অর্থে রেনেসাঁস বলা অত্যুক্তি হয় না। সমান্তরালভাবে নীলকরদের অত্যাচার, ব্রিটিশ শাসনের কালো দিকগুলো তুলে ধরেছেন কলমের আঁচড়ে। গুছিয়ে লেখা আমার অভ্যেস না। তাই বইয়ের একটা কোটেশন দিয়ে শেষ করছি -
❝রানী এলিজাবেথ জলদস্যু দলপতিদের নাইট উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন, কারণ তারা এনেছিল ইংল্যান্ডের জন্য ধন-সম্পদ। বর্তমান মহারানী ভিক্টোরিয়া আগে থেকেই লর্ড বা ব্যারণ উপাধি দিয়ে নিজস্ব প্রতিনিধি প্রেরণ করেছেন ভারতভূমিতে।যাদের কাজ আরও অনেক বেশি ব্যাপক,লুণ্ঠন কার্যের সভ্য মার্জিত রূপ দেওয়া।❞
* আমরা কথায় কথায় পাকিস্তানিদের ধুয়ে দিয়ে ... হয়তো মনে করি, এরই নাম দেশপ্রেম। কিন্তু বৃটিশরা আমাদের উপমহাদেশে যা করে গিয়েছিল, তা কি গ্রহণযোগ্য? সেই পাপের জন্যে কতটুকুনই বা হৃদয়ে ঘৃণা জমা আছে আমাদের ? যা দিয়েছে, তার বিপরীতে কী পরিমাণ নিয়ে গিয়েছে, সে হিসাব কী আমাদের আছে ? এমন একটা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে গিয়েছে, যা শুধু কেরানীই বানায়, অফিসার আর হওয়া লাগে না। বাঙালীর মেরুদণ্ড অনেক আগে থেকেই ভাঙ্গা, আরো বেশি করে, কোমর ভেঙ্গে দিয়েছে তারা, তাদের শাসনের নামে শোষণের সময়কালে।
* জীবনে যারা বড় বড় কাজ করে, তাদের ব্যক্তিগত জীবন কেমন ? তারাও তো রক্ত মাংসের মানুষ। ভুল ত্রুটি তো তারাও কম বেশি করে, তা তো সব্বাই বলে না ...
* মুখে অনেক কিছুই বলা যায়... কিন্তু বাস্তবতা? সে তো বড্ড কঠিন... বড্ড পাথুরে এক পথ! অন্ধকার গুহার শেষ দেখার মনের শক্তির ক'জনেরই বা আছে!
* ঐতিহাসিক কাহিনীর বর্ণনার পাশাপাশি, কিছুটা ফিকশনের সাহায্য নেওয়া। অসাধারণ বর্ণনা করার ক্ষমতা। মনমুগ্ধ হয়ে পড়ে যাওয়ার মতোন বই ...যদিও আমি মাঝে অনেকটা সময় গ্যাপ দিয়েছিলাম বইটাতে... কিন্তু গত কয়েকদিন টানা পড়েছি আর? মুগ্ধতা!
ঐতিহাসিক উপন্যাস সবসময়ই আমার প্রিয়। আর তার মধ্যে এই বইটা আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বইটা আমাকে বিশাল বড় এক চুম্বকের মত আকর্ষণ করেছে। কি অসাধারণ লেখা! মন্ত্র মুগ্ধের মত শুধু পড়েই গেলাম। আমার কাছে এ যেন এক ভ্রমণ কাহিনী। মনে হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতায় সশরীরে বিচরণ করে আসলাম। চোখ বন্ধ করলেই যেন সব চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এই যেন জোড়াসাঁকোর সিংহবাড়ি, ঠাকুর বাড়ি, আর এদিক দিয়ে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে হিন্দু কলেজ, সংস্কৃত কলেজ। নবীনকুমারের জীবনের নানা বৈচিত্র্যময় ঘটনা বিমোহিত করে রেখেছে পুরোটা সময়। আর নবীনকুমারের সময়কালীন চরিত্রাবলী মাইকেল, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, হেয়ার সাহেব, দেবেন ঠাকুর, প্যারীচাদ, বঙ্কিম-কে নেই এই বইটাতে। পুরো ঊনবিংশ শতাব্দীটাই যেন নানান চরিত্র হয়ে চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠলো।
একদম ছোটবেলা থেকে বই না পড়লেও পাঁচতলা বিশিষ্ট বিশাল এক শেলফের বই দেখে দেখে বড় হয়েছি।বইপড়ুয়া আত্মীয়-পরিচিতদের বাসায় বেড়াতে গেলে তাই শেলফের বই মেলাতাম।তাদের কোনটা আছে,নেই আর আমাদের কোনটা আছে,নেই।আর পেতাম 'কমন' কিছু বই, সেই কমনদের মধ্যে বেশিরভাগ সময় থাকতো 'সেই সময়' এর দুই খন্ড। উপন্যাস শুরু করার ছয়���িনের দিন এসে দুটি খন্ড শেষ করেছি এইমাত্র।আর ভাবছি,কেনো কমন থাকবে না!থাকাটাইতো স্বাভাবিক,তাই না?
কেমন একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে এই মুহূর্তে! এত অসাধারণ একটা বই পড়া হলো, সেই মুগ্ধতা...আর তার সাথে যুক্ত হয়েছে শেষ হবার বিষণ্ণতা। যাই হোক, এ বছরের (এখন পর্যন্ত) পড়া সেরা বই সম্ভবত এটাই হতে চলেছে আমার জন্য। দেবাকে ধন্যবাদ, আমাকে এই অসাধারণ বইটি উপহার দেয়ার জন্য। এত চরিত্রবহুল বইয়ের কথা আমি আসলে কোন জায়গা থেকে শুরু করবো, সেটা নিয়ে আমি একটু দ্বিধায় আছি। তাই প্রথমে লেখককে দিয়ে শুরু করি। "সেই সময়" সাধারণত সবাই কলেজে উঠে পড়ে ফেলে। আমার বড় বোনকেও দেখেছিলাম পড়তে। কিন্তু কলেজে উঠে আমি আসলে পড়ালেখা নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত ছিলাম যে এত বড় উপন্যাস ধরার সময় হয়ে ওঠে নি। একটা সরকারি ভার্সিটিতে চান্স পেতে হবে, এই টেনশনে বই পড়া হয়ে ওঠে নি তেমন। যাই হোক, এখন জীবনের অনিশ্চয়তাগুলো একটু অন্যরকম। তবুও, দেরীতে হলেও এর মাঝেই পড়া হয়ে গেলো বইটা। লেখক যেভাবে পুরো ইতিহাসকে চোখের সামনে তুলে এনেছেন, তাঁর সেই দক্ষতাকে বাহবা না দিলেই নয়। যখন সমাজ বইয়ে এগুলো পড়তাম, কোনোদিন মাথায় আসে নি এভাবে পুরো ইতিহাসকে কল্পনায় রূপ দেয়া যায়! এই উপন্যাস পড়ে মনে হয়েছে, একজন লেখকের শক্তি অসামান্য! তিনি শুধু যে নিজে কল্পনা করেছেন, তা নয়। তিনি পাঠকের কল্পনাকেও সমৃদ্ধ করেছেন। পড়ার সময় মনে হচ্ছিলো, আমি সবকিছু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি! একদম নিখুঁতভাবে, যেন বইয়ের পাতা থেকে জীবন্ত হয়ে উঠছে প্রতিটি ইতিহাস! এমন অনুভূতি আমার আর কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না। এক কথায়, অসাধারণ! ইতিহাস পড়ার সময় যখন এই সতীদাহ প্রথা বাতিল, বিধবা বিবাহের প্রচলন, কিংবা ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে পড়তাম, সেগুলো ছিলো নিছকই পরীক্ষায় পাশ করার জন্য পড়া। আর এবার সবকিছু ছিলো জীবন্ত! আমি জানি, লেখক নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছেন ইতিহাসকে...কিন্তু পড়ার সময় বারবার মনে হচ্ছিলো আমি ঠিক ঐখানটাতেই আছি, সব আমার চোখের সামনে ঘটছে! আশ্চর্যের ব্যাপার, সিপাহি বিদ্রোহের কারণ হিসেবে যে কার্তুজের মধ্যে শূকরের চর্বি থাকার যে ব্যাপারটা ছিলো, তা আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম! বই পড়ে আবার কতকিছু যে নতুন করে মনে পড়লো! এবার চরিত্রগুলোতে আসি। নিঃসন্দেহে, আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র হচ্ছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর গঙ্গানারায়ণ। ঈশ্বরচন্দ্র যে তেজোদীপ্ত ছিলেন, তা আগে থেকেই জানতাম। এই উপন্যাসে লেখক তাঁকে যেভাবে দেখিয়েছেন, তাতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আরো কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। আজকের এই পৃথিবীতে এমন নীতিবান মানুষের বড়ই অভাব! যারা পুরো সমাজটাকে একাই ঢেলে সাজাতে কোনো কুণ্ঠাবোধ করে না। গঙ্গানারায়ণকে আমার ভালো লেগেছে তার ফিরে আসার কারণে। তিনি যে ফিরে আসবেন, আর সত্যিই নীলচাষীদেরকে নিয়ে বিদ্রোহ শুরু করবেন, সেটা আমার কল্পনাতীত ছিলো। তার সারল্য ভালো লেগেছে, তার বিনয় আরো বেশি ভালো লেগেছে। বিনয়ী মানুষ আমার খুব বেশিই পছন্দের, তাই উনাকেও আমার এত বেশি ভালো লেগেছে। সবচেয়ে অসহ্যকর লেগেছে বিধুশেখরকে। বিরক্তিকর লোক। মেজাজ চড়ে যেতো তার কথা পড়তে গিয়ে। সম্ভবত উনি আমার প্রিয় চরিত্র গঙ্গানারায়ণকে দেখতে পারতেন না বলে। যাই হোক, উনি বিরক্তিকর। উনি মারা গেলে খুশি হতাম -_- মনে হচ্ছে সব চরিত্র নিয়েই একটু একটু লিখি। মধুসূদন দত্তের দাম্ভিকতা, ব্রাহ্ম সমাজের উত্থান, পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আবিষ্কার, হিন্দু কলেজের কথা, তৎকালীন সময়ের অন্যায়-অবিচারের কথা, নীল বিদ্রোহ, সাহিত্য, সামাজিক আন্দোলন, পত্রিকা, সিপাহি বিদ্রোহ...কতকিছু আছে লেখার! কিন্তু আগামীকাল অ্যাডমিশন, এখন না ঘুমালে আর ঘুমানোর সময় হবে না, তাই আপাতত লিখছি না। কিন্তু সত্যিই, এমন অনবদ্য সৃষ্টি আর দ্বিতীয়টি নেই। অন্তত আমি পড়ি নি। একটা কথা না বললেই না। থাকোমণির আসল স্বামী যে আবার ফিরে আসবে, সেটা আমার কল্পনাতেও আসে নি। তার ফিরে আসাটা এতই নির্মম! ঠিক তার চলে যাওয়ার মতই। তার ফিরে আসার পর আমার নিজেকে এত পাষণ্ড মনে হয়েছে! কত বড়-বড় কাহিনী আমরা মনে রাখি, তাই না? ইতিহাস, পৌরনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান! অথচ একটা চরিত্রের জীবনটা পুরো তছনছ হয়ে গেলো কালের সাক্ষী এক অত্যাচারের গ্যাঁড়াকলে পড়ে। এমন কত মানুষের জীবনে হয়েছে তখন, কতজন তার খবর রেখেছে? চন্দ্রনাথ আর তার মায়ের চিরবিদায়ের দৃশ্য পড়ে আমি নিজেকে আটকে রাখতে পারি নি, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়েছে। কী অসাধারণ লেখনী! আর বিন্দুবাসিনীর শেষটাও! কেউ আমাকে কিছু দিলে না... আমার বুকের ভেতর এমন তীব্র হাহাকার আমি অনেকদিন অনুভব করি নি।
নবীনকুমারের শেষ লেখাটা আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছে।
"খুব বাসনা ছিল, পরবর্তী শতাব্দীটি দেখিয়া যাইবো। কতই বা দূর! সেই রাত্রে ঘনঘন তোপধ্বনির মাধ্যমে এ শতাব্দীর অবসান হয়ে বিংশ শতাব্দী আসবে। মনশ্চক্ষে দেখিতে পাই তাহা কত আলোকজ্জ্বল! কত আনন্দময়! হে অনাগত যুগ, তোমার জয় হউক।"
আমার স্পষ্ট মনে আছে, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যখন দশ থেকে এক গণনা করা হচ্ছিলো, সেই সময় আমি আমাদের রামপুরার বাসার ছাদে ছিলাম পুরো বিল্ডিংয়ের সবার সাথে। কী উচ্ছ্বাস সবার চোখেমুখে! পুরো আকাশ তখন আলো ঝলমলে, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম প্রহর বলে কথা! অথচ একবিংশ শতাব্দীর প্রায় রজতজয়ন্তীতে এসে আমি হতাশা ছাড়া আর কিছুই দেখি না! ব্যাপারটা কী কষ্টের! যাই হোক, অন্তত বিংশ শতাব্দীতে আসলেই আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। সেটাই বা কম কীসের? আর এখন অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে বেরোনোর পথ দেখি না খুব একটা। এখন কেবল সত্যিকারের স্বাধীন হওয়ার অপেক্ষা!
আবারও বলবো, এই বছরের সেরা বইটি পড়লাম। মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়েছি! হাইলি রেকমেন্ডেড!
This entire review has been hidden because of spoilers.