মানুষকে তার ভিতর থেকে এবং বাইরে থেকে কী, কে এবং কেন প্রতিদিন অংশে-অংশে উদরস্থ করছে, ‘জবরখাকি’র আটটি গল্প পাঠককে সেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাবে এবং একটা উদ্দীপক, অনুসন্ধানী যাত্রার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাবে। গল্পগুলির দুনিয়াতে আছে গণহিস্টিরিয়া, সন্ত্রাস, মারি, মাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, অপত্য ও বৈকল্য। বর্ণালী সাহার গদ্য শক্তিশালী ভাষা, সাঙ্গীতিক পরিমিতি আর চিত্রকল্পে ঋদ্ধ। ভাষা, কল্পনা ও নন্দনের পথ দিয়ে কালের সাথে বোঝাপড়ায় পৌঁছানোর রসদ রয়েছে এতে।
বর্ণালী সাহার জন্ম ১৯৮৩ সনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউট থেকে স্নাতক এবং মেলবোর্ন বিজনেস স্কুল (মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া) থেকে ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা সমাপ্ত করেন। শৈশব থেকে রাগসংগীতের চর্চা করছেন-শিক্ষার্থী এবং গবেষক হিসাবে কলকাতার আইটিসি সংগীত রিসার্চ একাডেমির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ঢাকা, লন্ডন এবং মেলবোর্নে একাধিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বস্থানীয় পরামর্শক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে মেলবোর্নে বসবাস করছেন।
‘আম্মা ও দূরসম্পর্কের গানগুলি’ (২০১৫) বর্ণালী সাহার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ, এটি একটি গল্পসংকলন। ‘দ্যা নর্থ এন্ড’ (২০২০) প্রথম উপন্যাস। ২০২৩ সালের বইয়ের প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘জবরখাকি’।
গল্পের শুরুতেই পাঠকের উদ্দেশ্যে লুজ বল ছুঁড়ে দিয়ে তাকে গল্পের একেবারে কেন্দ্রে নিয়ে ফেলার প্রবণতা বর্ণালী সাহার লেখাতে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রথম দেখায় ইতস্তত ছড়ানো ঘটনা, পারস্পারিক বিচ্ছিন্ন দৃশ্যপটে বেশ হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। একটা গল্পকে বৈঠকী চালে শোনাবার যে আয়েশী ভঙ্গি তাকে সার্থকভাবে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন তিনি। এখানেই বর্ণালী সাহার গল্প স্বতন্ত্র। এই নিজস্ব কণ্ঠস্বরে প্রচলিত শব্দের অপ্রচল প্রয়োগও গল্পগুলোকে আলাদা করে দিয়েছে বাকিদের থেকে। জবরখাকি এ কারণেই পাঠকের মনে রাবণ-কামড় বসিয়ে দেয়।
শুরুতেই দীর্ঘ গল্প লিম্বোর অনিশ্চিত অনির্দিষ্ট পরিস্থিতির জটাজালে পাঠক জড়িয়ে যান। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যদি দেখেন, গতরাতে যেখানে শুয়েছিলেন সেখানে আর নেই,অন্য কোথাও সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশে নিজেকে আবিষ্কার করেন, লিম্বোর সুরুয়াৎ ঠিক সেরকমভাবেই হয়। কোলুফুশি নামের এক দ্বীপে মধ্যবয়সী দম্পতির রৌদ্রস্নান করতে করতে সঙ্গম পরবর্তী দৃশ্য থেকে শুরু হয় গল্প। কিন্তু সেই দ্বীপে ছুটির দিনগুলোকে ঠিক উপভোগ করতে পারেন না আসমা-মনসুর দম্পতি। তাদের ধার্মিক পুত্র আবরার সেখান থেকে নাকি পালিয়ে সিরিয়া চলে গেছে, সে জঙ্গি হতে চায়। সে সিরিয়া গেছে কি যায় নি এমন পেন্ডুলামের দোলাচলে দুলতে দুলতে গল্পটা অসুখী এক দম্পতির মাঝের রসায়ন, আবরার তার খালার সঙ্গে শুয়েছে কি শোয় নি এমন এক কুহেলিকার সাথে সাথে সম-সাময়িক পৃথিবীর নানা সংকটকে ছুঁয়ে যায়। ক্রাইসিস ছাড়া ঠিক গল্প মানায় না,এই নিয়ম মেনেই লিম্বো গল্পের চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত জীবনের চিতাসমান সমস্যাকে দেখি। আবার তার সাথে জাক্সটাপজিশনে থাকা পৃথিবীর নানা প্রান্তের জটিলতা নিয়ে লিম্বো এক প্রবল ধাক্কা দেয়। লিম্বো গল্পে প্রত্যক্ষ করা হিন্দি,ইংরেজী শব্দের প্রয়োগ পরবর্তীতে অন্য গল্পেও খেয়াল করেছি। এটা সম্ভবত বর্ণালী সাহার সিগনেচার স্টাইল। শব্দের প্রচলিত অর্থে প্রয়োগকেও তোয়াক্কা করেন না। তার গল্পে দরদরিয়ে ঘাম ঝরার বদলে দরদরিয়ে পটকা মাছ সাঁতরে বেড়ায়।
নামগল্প জবরখাকি এক অর্থে সেই বহু পুরোনো লাভ ট্রায়াঙ্গলের টানাপোড়েনকে ঘেঁষে লেখা একটা ভীষণ আধুনিক গল্প। জবরখাকি একদিকে যেমন শৈশবের দুই বন্ধুর সাথে সমকামী এক মেয়ের মধ্যবয়সী জীবন পর্যন্ত উঠে আসা যৌনসম্পর্কের,কখনো কখনো যৌন ঈর্ষার নানা সাংসারিক জটিলতাকে ছুঁয়েছে,সাথে সাথে হাস্যরসের সাথে আলাপ করেছে দেশের এক ক্ষয়ে আসা রাজনৈতিক প্রসঙ্গকে নিয়ে। লিম্বো আর জবরখাকি এই দুই গল্প পড়েই লেখিকার হিউমার নিয়ে মোটামুটি একটা শক্ত অবস্থানকে চিহ্নিত করা যায়।
'জাঙ্গলিক' গল্পটা সেসব পাঠকেরা খুব ভালো বুঝবেন যারা সত্যজিৎ রায়ের 'অরণ্যের দিনরাত্রি' দেখেছেন। প্রথম দেখায় মনে হবে এটা সিনেমাপাড়ার পর্দার ভেতর আর বাহিরের গল্প,কিন্তু ক্রমে সেটা সত্যজিৎ রায়কে কেন্দ্র করে ঘূর্ণিপাক খায়। মানুষের মনের গভীরে লুকানো প্যান্ডোরার বাক্স থেকে একে একে ক্ষোভ, ঈর্ষার মতো আঁধার কালো দিকগুলোও অবয়ব ধারণ করে।
'শেষ অঙ্ক' আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, This is no country for old men এর কথা। বৃদ্ধদের জন্য এই পৃথিবী কখনোই ছিল না। গল্পটি পড়তে গিয়ে আমার বারবার মনে পড়ে গেছে মুহম্মদ রাফির লেখা গজল, 'না কিসি কি আঁখকা নূর হুঁ না কিসি কি দিল কা কারার হুঁ জো কিসি কি কাম না আ সাকে ম্যায় ও মুষ্ঠে গুবার হুঁ'
ওয়েস্ট ওয়ার্ল্ডের উত্তরাধুনিক ব্যবস্থায় বৃদ্ধদের স্থান যেমন নেই, সনাতনী সমাজেও তাদের জায়গা নেই। তারা বেশ ইনসিকিরউড,আনওয়ান্টেড অনুভব করেন। আবার সময়ের সাথে তাল মিলিয়েও চলতে বেশ স্ট্রাগল করতে হয়। এখানেও এসেছে বর্ণালী সাহার গল্পের সেই ছাঁচ— ব্যক্তিগত ক্রাইসিসে অন্যান্য ক্রাইসিসের প্রসঙ্গ চলে আসা। গল্পটি এপিসটোলারি ভঙ্গিতে লেখা। নেপালের এক বৃদ্ধ টেড লিখছেন কাল্পনিক এক চিঠি। করোনা মহামারীতে পর্যটন নির্ভর নেপাল এর আগে ভূমিকম্পে টালমাটাল হওয়া নেপাল, দুইয়ে মিলে বেশ শঙ্কায় ভুগছেন টেড। এদিকে জীবন্ত ভাইকে মাটিচাপার দৃশ্যও তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। ইতালির মৃত এক প্রজন্মের ঘুণপোকাও তার মনকে ঝুর ঝুরে করে দিচ্ছে।
'না কিসি আঁখ কা নূর হুঁ' গজল গেয়েছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর। তাঁরই আরেক অমর সৃষ্টি 'চশমে ক্বাতিল'। নৈরাশ্য আর অসহায়ত্বের ভাবটা ধরে রেখেছে বর্ণালী সাহার 'চশমে ক্বাতিল'। গল্পের পটভূমি পাকিস্তান আমল। মৃত্যু সম্পর্কে ভয়ে অস্থির দুই বন্ধুর গল্প। মৃত্যু ভয় বাড়তে থাকলে পুরোনো পাপের দীর্ঘ ছায়া তাদের গ্রাস করে নেয়। আর শেষ পর্যায়ে গিয়ে ঘটে ক্যাথারসিস। বর্ণালী সাহা দীর্ঘদিন রাগসঙ্গীতের চর্চা করেছেন বলেই লেখায় সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসার এই নজরানা।
সদগতি'র খানিকটা আমাদের খুব চেনা একটা গল্প। গল্পের কথক পরপর দুইদিন দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমাতে পারেন না। তৃতীয় দিন তার বাবার মৃত্যু ঘটে। কিন্তু অভিবাসন জটিলতার কারণে তিনি দেশে ফিরতে পারেন না। একটা সময় সবেধন নীলমণি চাকরিটাও চলে যায়। নৈরাশ্যের কালো মেঘে ঢেকে যায় চারপাশ। তারপর কী হয়? সেই নিয়ে চমৎকার একটা গল্প 'সদগতি'
পুরাণ আশ্রিত,লোকগাঁথা আশ্রিত গল্প লেখার প্রবণতা এখন অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু সবসময় যেটা থেকে গেছে সেসব গল্পের মান নিয়ে প্রশ্ন। এ ধরনের গল্পের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়,পর্বতের মূষিক প্রসব জাতীয় ঘটনা। পটভূমির সাপেক্ষে ওয়ার্ল্ড বিল্ডাপ, ঘটনাপ্রবাহকে একটা নির্দিষ্ট খাতে বইয়ে দেয়ার জন্য হাজার রকমের প্রস্তুতির পর দেখা যায় ড্রাগন কাশি দিলে আগুনের বদলে থুথু বের হয়। এই সমস্ত দুর্বলতাকে কাটিয়ে উৎকৃষ্ট মানের পুরান আশ্রিত গল্প রচনার জন্য একটা কেস স্টাডি হতে পারে 'মনোভূমি' গল্পটা। মনোভূমি হলো রামায়ণ কাহিনীর পুনর্কথন, সিমুলাক্রা(সিমুলেশন অব সিমুলেশন)। এই সিমুলাক্রার যুগে কোনো না কোনোভাবে গল্প রি-সার্কুলেট করে। সীমান্তবর্তী শহরে অপরাধ জগতের আঁধার মোড়া দিকের সাথে এই রি-সার্কুলেশন খুব ভালোভাবে মানিয়ে গেছে।
বরফস্নাত শহরের স্পিরিটকে খোঁজার কিসসা 'শাদা বরফ'। সেই অচেনা শহরে হাফসা স্যুটকেসে পোরা একটা লাশ গুম করতে চায়,তার স্বামীর লাশ। প্রকৃতপক্ষে 'শাদা বরফ' কে বলা যেতে পারে 'লিম্বো' গল্পটারই সিক্যুয়েল।
যে কোনো দৃশ্য,যে কোনো পরিস্থিতি থেকে গল্প শুরু করার একটা সহজাত প্রবণতা বর্ণালী সাহার মাঝে আছে যেখানে গল্পের চরিত্রেরা ঘরহীন ঘরের মতো। জাফর পানাহির সিনেমা যেমন। চরিত্রেরা নিয়মের তোয়াক্কা করে না।জাতিগত,ভৌগলিক বা আদর্শগত বেড়াজালে আটকে পড়ে না,নিয়মকে ভাঙতে চায়। নিজস্ব বিশ্বাস থেকে,সংকট থেকে তাড়িত হয়। উপস্থাপনা, ভাষার প্রয়োগের দিক থেকে তো বটেই জবরখাকির গল্পগুলো এই স্টেরিওটাইপ ভাঙার দিক থেকেও পাঠকের মনে রাবণ-কামড় বসিয়ে দেয়।
বর্ণালী সাহার "জবরখাকি " পাঠ এক অনুপম অভিজ্ঞতা। লেখিকা ব্যক্তিমানুষকে নিয়ে লেখেন কিন্তু সাথে সমাজ, রাষ্ট্র, প্রথা প্রভৃতিও ঢুকে পড়ে। তার গল্প বলার ভঙ্গি খুব একটা সহজবোধ্য নয়। পাঠককে রীতিমতো ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। বেশিরভাগ গল্পের নির্দিষ্ট কোনো শুরু নেই, নেই প্রথাগত কোনো পরিসমাপ্তিও। লেখিকা চরিত্রগুলোর মনস্তাত��ত্বিক অবস্থা ও গল্পের পরিবেশ এতো জীবন্তভাবে সৃষ্টি করেছেন যে তাদের কথন, চিন্তা ও সার্বিক অবস্থায় আমরা সর্বতোভাবে বিশ্বাস করতে পারি। একমুখী সুনির্দিষ্ট গল্প নয়, বর্ণালী সাহার গল্প যেন পরিকল্পনামাফিক অপরিকল্পিত যেখানে মানুষ বিপন্ন, আর্ত ও পরিত্রাণহীন। দীর্ঘতম গল্প "লিম্বো"য় আসমা ও মনসুরের সন্তান আবরার পালিয়ে সিরিয়া যাচ্ছে জঙ্গী হতে। ধর্ম, টাকা, প্রবাস আর সবকিছুর বৈপরীত্য পাঠশেষেও প্রবল অস্বস্তির সঞ্চার করে পাঠকের মনে। শেষ পর্যন্ত কী হয় পরিণতি আমরা জানি না। লেখিকার কোনো তাড়াও নেই জানানোর। নামগল্প "জবরখাকি" সম্ভবত বইয়ের সেরা গল্প। এখানে প্রচলিত নারীবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে( রাজনৈতিকভাবে যথার্থ না থেকে) লেখিকা যেভাবে দুই নারীর অবস্থা তুলে ধরেন তা অনেক বেশি বাস্তবানুগ। রামায়ণের পুনর্কথন "মনোভূমি" রীতিমতো থ্রিলার ও অনবদ্য একটি গল্প। প্রবাসজীবনকে কেন্দ্র করে লেখা "সদগতি " ও "শাদা বরফ" এর করুণাহীন সূক্ষ্ম বয়ান নাড়া দিয়ে যায়। সব মিলিয়ে "জবরখাকি "র মানুষজন ও পটভূমি এই অস্থির ও দ্বান্দ্বিক সময় এবং পৃথিবীর সার্থক বয়ান হয়ে ওঠে।
জাস্ট উড়ে গেলাম বইটা পড়ে। কী অসাধারণ! পাঠকের হাত ধরে পথ দেখানোর কোনো চেষ্টা নাই, পরিচিত কোনো কাঠামো আরোপের চেষ্টা নাই। শুধু বাস্তবতার মতো হুড়মুড় করে ছুটে আসা অস্বস্তি, সততা আর কাব্য। Goddamn, this is writing!
আরাম করে পড়তে চাইলে বর্ণালী সাহার ‘জবরখাকি’তে হাত না দেওয়াই হবে উত্তম। লেখিকার গদ্য এমন যেন ভাবনাটা এই—‘ভালো কিছু পেতে চাও তো কষ্ট করে নাও বাপু, এত সহজে সেটা চাচ্ছো কেন!’
প্রথম গল্প—‘লিম্বো’ (৬১ পৃষ্ঠার গল্পকে গল্প বলব না উপন্যাসিকা?) পড়তে আর বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল। লম্বা লম্বা বাক্যে বর্ণিত গল্পটিতে মনোযোগ ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল, আবার মনোযোগ ধরে না রাখলে স্বভাবতই খেই হারিয়ে যাচ্ছিল। নামগল্পটি আমার মতে বইয়ের শ্রেষ্ঠ গল্প। এরপর পছন্দের বিচারে আসবে ‘মনোভূমি’, রামায়ণ-আশ্রিত গল্পটিকে বেশ অভিনব মনে হলো। চিঠি আকারে রচিত গল্প দুটির—‘জাঙ্গলিক’ ও ‘শেষ অঙ্ক’—ভাষা বেশ সহজ। ‘জাঙ্গলিক’-এর শুটিং ইউনিটের গল্পটি যে আসলে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র এবং কমলেশ রায় যে সত্যজিৎ রায় তা বোঝা যায় সহজেই, ভিন্ন নামের হলেও বাদবাকি পাত্র-পাত্রীদেরও চেনা যায়, গল্পটি ইন্টারেস্টিং। ‘সদ্গতি’—মেলবোর্ন প্রবাসী পুত্রের মৃত পিতাকে শেষবার দেখতে না পারা এবং ভীনদেশে নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে মানসিক সমস্যায় ভোগার আখ্যানটি এক পর্যায়ে এমন একদিকে মোড় নেয়, অবাক না হয়ে পারা যায় না। ‘লিম্বো’ গল্পটিরই পরোক্ষ কিছু চরিত্র নিয়ে রচিত ‘শাদা বরফ’ গল্পটি ‘লিম্বো’র এক টুকরো অংশ, ভালো ছিল এ গল্পটিও। বইয়ের দ্বিতীয় গল্প, ‘চশমে ক্বাতিল’, পড়তে ভালো লাগছিল এটিও, কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই যেন এটির সমাপ্তি ঘটল।
বর্ণালী সাহার গদ্যে ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দি শব্দের ব্যবহার লক্ষ্যনীয়। এ ব্যাপারটি অনেকের ভালো না-ও লাগতে পারে। আমার কিন্তু বেশ লেগেছে।
সবমিলিয়ে বিষয় নির্বাচন, গল্প বলার ধরন, চরিত্র চিত্রণ, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও গদ্যশৈলীর চমৎকারিত্বে ‘জবরখাকি’র পাঠঅভিজ্ঞতা আমার জন্য খানিকটা নতুন, আর অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
How well she did আর how much I enjoyed reading these stories (1.5/5).. এই দুইয়ে যোজন যোজন দূর রয়ে গেল। The craft of her storytelling and my taste in stories are not compatible.
সাধারণ গল্পের এক বৈশিষ্ট্য গল্পের একটা শেষ টানা। গল্প শেষ করে দেওয়াকে আমার কাছে লাগে ন্যাকামি। বর্ণালী সাহার গল্পগুলোতে ন্যাকামি অনুপস্থিত। গল্প তো কখনো শেষ হয় না বলেই আমার ধারণা। সো এই গল্পগুলো পড়ে আমি তৃপ্তি পেয়েছি।
লিম্বো জবরখাকি বইয়ের সবচেয়ে লম্বা গল্প। এই গল্পের ভেতরের ধাক্কা সামলানো কঠিন। খালার সঙ্গে এক ছেলের শোয়া বা না শোয়ার এক অস্পষ্টতার ধাক্কা শেষ হতে না হতেই দেখা যায় এক আধুনিক পরিবার কীভাবে নানা গোঁড়ামিতে আটকে যাচ্ছে নানা সংস্কারে। সেই ভাগিনা সিরিয়ায় চলে গেছে বা যাইনির এক সন্দেহ । মনে হচ্ছে অতীতের পাপ কাটাতে কট্টর ধার্মিক হওয়ার পিছুই ছুটছে কী না এমন নানা প্রশ্ন তৈরি হয়। পৃথিবীর আধুনিক নানা সংকটপূর্ণ এক ভয়াবহ শক্ত গদ্যে লেখা লিম্বো।
চশমে ক্বাতিল-- এ দেখা যায় দুইজন ভয়ংকর লোক এসে উপস্থিত হয়ে ভয় দেখাতে থাকে। সেই ভয় মৃত্যুর ভয়। আর ভয় তাদের পুরনো পাপ মনে করাতে থাকে। কিন্তু ভয়ের পরিণতি আর কিছুই হয় না। গল্পটা পাকিস্তান আমলের ভয়ংকর কোনো দিনের। এইসব দিন যে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে তেমনও না। চশমে ক্বাতিল বাহাদুর শাহ্ জাফরের এক মায়াময় গজলের অংশ। জাফরকে নিয়ে বলা হয় সে যখন এই গজল লেখেন তখন খোদার খুব কাছে ছিলেন। আর বর্ণালী সাহাও যেন এই গল্পের চরিত্রগুলোকে ভয় দেখিয়ে শেষে নিজেই বাঁচিয়ে তুলেছেন।
জবরখাকি নাম গল্পটা তিন বান্ধবীর স্কুল জীবন থেকে সাংসরিক জীবনের নানা জটিলতা। এ গল্পটা দারুণ লেগেছে। সে দারুণ লাগাটা প্রকাশ ভাষা মোটামুটি সাইলেন্ট হয়ে আছে।
জাঙ্গলিক-- এটা সিনেমাপাড়ার গল্প। ভেতর আর বাহির। এখানে আমার বোঝাপড়া মুগ্ধতা পর্যন্তই। ঠিকঠাক রিলেট করতে পারার পর্যায়ে ঢুকতে পারিনি।
মনোভূমি ভালো লেগেছে বলা পর্যন্তই বলা যায়। কেমন ভালো লাগছে বোঝাতে গেলে আবার নিজের দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে ওই গল্পের কিছুই বললাম না। আবার পড়ে হয়তো কোনোদিন আলাদাভাবে শুধু মনোভূমি নিয়ে কিছু বলব।
আমার কাছে সদ্গতি গল্পটাই সম্ভবত বেশি ভালো লাগছে। অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখা ছেলেটা অভিবাসন জটিলতার কারণে যে বাপের মৃত্যুর সময় দেশে আসতে পারে না। যার চাকরিও চলে যায়। তখন সে একটা পাবলিক থেরাপি সেন্টারে যায়, মেন্টাল সাপোর্ট পেতে। সেখানে গিয়ে দেখে তাদের দেশের বাড়িতে কাজ করা কামরুল পাকিস্তানি তানজিদ হয়ে আগের মিথ্যা গল্প বলছে কী জানি কী উদ্দ্যেশ হাসিলের জন্য।
শেষ অঙ্ক এক নেপালের বৃদ্ধের কাল্পনিক চিঠি। করোনার সময় যিনি পর্যটন নির্ভর নেপাল নিয়ে নানা শঙ্কায় ভুগছিলেন। একই সাথে ইতালির এক প্রজন্মের মৃত্যু তাঁকে নাড়া দিচ্ছিল ভীষণভাবে। যে প্র���ন্ম তারই প্রজন্ম যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন সেই বুড়ো তবে এই করোনায় মরে যাওয়া বৃদ্ধদের কাউকে না কাউকে তো বুকে গুলি করে মারতেন। তিনি পশ্চিমা সমাজে বুড়োদের কষ্ট দেখাচ্ছেন। আর সাথে সাথে দেখাচ্ছেন সনাতন সমাজও ওত ভালো ছিল না বৃদ্ধদের জন্য। পৃথিবী যে বুড়োদের জন্য কখনোই ছিল না এই তাঁর ভাষ্য। জীবিত বৃদ্ধ ভাইয়ের ওপর মাটি চাপার দৃশ্যও তিনি বর্ণ্না করছেন।
শাদা বরফ লিম্বোর এক্সটেনশন কিংবা বলা যায় ওই গল্পের ভেতরেরই অন্য এক গল্প।
জবরখাকি। কিন্তু জবরখাকি মানে কি? গুগল ঘেটে যতটুক বুঝলাম,এর কোনো সুনির্দিষ্ট অর্থ নেই। "জবরখাকি" বইয়ের গল্পগুলোও অনেকটা অমন।একেকটি গল্প একেকটি ঝাপসা বিষয়ে,বা একেকটি বিষয়ের কিছু ঝাপসা খণ্ডিত অংশ নিয়ে একেকটি গল্পের দৃশ্যপট। তবে চরিত্রগুলোর চিন্তা-ভাবনা,আচরণ অনেক সুস্পষ্ট,কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশ উৎকটও। আর লেখনী লেখকের নিজের শব্দে বলতে গেলে 'অনির্দেশ্য,সংবদ্ধতা নেই'। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে মনোজগতের টানাপোড়েন তো এমন-ই। এতগুলো গল্পের মধ্যে 'জবরখাকি' নামগল্পটি আমার অদ্ভুত রকমের ভালো লেগেছে।এই যে female friendship,যে বন্ধুত্ব শৈশব-কৈশোর-যৌবনের চড়াই উতরায় পার করে,রাগ-অভিমান,হিংসা,রেষ,নানা ধরনের কমপ্লেক্স এর ভিতর দিয়ে পরিপক্ক হয় দীর্ঘদিন,নিজেদের কত শত গোপনীয়তা রক্ষা করে টিকে থাকে-সেই মেয়েলী বন্ধুত্ব এত স্বস্তির,এত আরামের।এক মুহূর্তে অভিমান করে,পর মুহুর্তেই লাইফ আপডেট নেয়া,বন্ধুকে জাজ করে দু'টো কটু কথা শুনিয়ে আবার সেই পুরনো দিনের হাস্যকর কিছু স্মৃতি মনে করে হাসা,বা গায়ের উপর পা তুলে হাইপড কোনো সিরিজের এপিসোড অমনোযোগী হয়ে দেখা- এমন অর্থহীন বা গুরুত্বপূর্ণ সব,সব কিছুই করা যায় খুব সহজে,নির্দ্বিধায়। সেই মেয়েলীপনার দিক থেকে জবরখাকি খুব কাছের গল্প ঠেকলো। এই গল্পের আরেকটি দিক উল্লেখ করে আর স্পয়লার দিলাম না।তবে গল্পটিকে অনন্য করার ক্ষেত্রে ঐ অংশের ও ভূমিকা আছে কিন্ত!
পুনশ্চ: অরণ্যের দিনরাত্রি কে জাংগলিক হতে দেখে বেশ মজা পেয়েছি।
মধ্যপ্রাচীন লোককাহিনীর সংকলন–আরব্য রজনীতে এমন একটা গল্প আছে যেখানে গল্পকথক শেহেরাজাদ অন্যায়ের প্রাপ্ত সাজা বিলম্বিত করতে রাতের পর রাত রাজা শাহরিয়ারকে কঠিন এবং প্রশ্নাত্মক সমস্ত গল্প শোনাতো। রাজার উৎসাহী মন সেসব গল্পের কূল কিনারা আদৌ পেত কিনা জানিনা তবে জবরখাকি পড়ার পরে এমন কঠিন দশা হবে অনেকেরই।
অনেকের মাঝে নিজেকে ফেলবোনা যখন ঠিক করেছি তখন ধরে নেওয়া যাক–জবরখাকি'র পথ মসৃণ না হলেও কিছুটা ল্যাদ খাওয়া হলেও–এঞ্জয় করেছি প্রচুর।
লেখায় কোন প্রচলিত বাঁধাধরা নিয়মের ধার ধারে না লেখিকা। খোদ নিজেই সৃষ্টি করেছেন লেখার অনন্য এক জগত; দেখিয়েছেন–কিভাবে শব্দকে ইফোর্টলেসলি যেকোন ছাঁচে গড়া যায়, গল্পকে স্রেফ 'কি-কেন-কিভাবে' প্রশ্নের মুখে ফেলতে হয় বারংবার আর খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মত অসাধারণ ডিটেইলিং এ দেখিয়েছেন বিশেষ মুন্সিয়ানা..
এলোমেলো করে রাখা রুবিক্স কিউব এর মত 'লিম্বো' আর 'শাদা বরফ' গল্পদুটো। তবে 'লিম্বো' গল্পটা পড়তে গিয়ে মাঝেমধ্যে কোনঠাসা লাগছিলো গল্প বলার কমপ্লেক্সিসিটির কারণে। তাই বর্ণালী সাহাকে কিছুটা রপ্ত করতে 'লিম্বো' গল্পটা দিয়ে না শুরু করে বরং আকারে ছোট কোন গল্প বেছে নেওয়া যেতে পারে।
'লিম্বো' গল্পটায় দেখানো হল পারিবারিক ডিপ্লোম্যাসির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা সমসাময়িক সঙ্কটে উপচে পড়া হুলস্থুল কান্ডকে। 'চশমে কাত্বিল' এর পরিণামগত ভয়াবহতা কিংবা 'শেষ অংক' এর দরদী গল্পের আবেশ অথবা আমার সর্বশেষ পড়া–'জবরখাকি' শিরোনামের গল্পটায় দরদর করে ঘেমেছি শেষে..
জীবনকে যদি নির্দিষ্ট এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেত, এত জটিল ক্যালকুলাস মেলাতে হত না কখনো। কোন জিনিসকে জীবনে কি কখনো আমরা একটা দিক থেকে দেখি? একটা জিনিসের চোখে আরেকটা জিনিসকে কেমন দেখায় তার উপরই নির্ভর করে জাগতিক বিবেচনা।
সম্ভবত আমার রুচির সাথে সামঞ্জস্য খাপ খায়নি ওনার লেখা। অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েও কোনোভাবেই ভালো লাগাতে ব্যর্থ হলাম বলা যায়। ভালো কিংবা খারাপের মানদণ্ডে যেতে চাই না। পাঠ প্রতিক্রিয়া হিসেবে বলতে চাই, আমার কাছে সুখপাঠ্য বলে মনে হয়নি। লেখার এলোমেলো ধরণটা মনের উপর প্রভাব ফেললেও সেটাই মূল কারণ নয়। ভাষার ব্যবহারে অযথা অনেক বিদেশি শব্দের ভুল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন যেটা একটা মাইনাস পয়েন্ট। প্রতিটা গল্পের ই কোনো শুরু বা শেষ নেই, যদিও এটা কোনো বিগ ইস্যু না। কোনো এঙ্গেল থেকেই আমার ভালো লাগলো না।
Barnali is such a rare breed, who goes out in the world, suffers, struggles and fails just to write the feeling of those experience for her readers, so that they can experience those in the comfort of bed, blanket and breakfast.
প্রথম বড়-গল্পটা পড়ে আমার মনে হয়েছে লেখিকার প্রকাশের ভোকাবুলারি অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং ধারালো। কোনো ভাষার ভোকাবুলারির কথা বলছিনা, প্রকাশের ভোকাবুলারি বিষয়টা আরও ব্যাপ্ত। লোকের 'পেট চুলকানো' থেকে কিচেনে সাজানো মিজ-অঁ-প্লা, যখন যেটা যেখানে যে ভাবের প্রয়োজনে, যে অর্থ প্রকাশে, যে রূপকে দরকার তা গালি-বুলি-আঞ্চলিক-অশ্রাব্য-নোবেলম্যান-সিরিয়াল এর ভাষা যা-ই হোক; ব্যবহার করে গেছেন অকপটে। ছাই দিয়ে ধরে সমালোচনা করেছেন মানুষের আখাস্তা স্বভাবের। ওই 'ইয়ের মতো দেখতে ইয়েটা' করে বাঙাল আলাপ টানেননি। তার গল্পে চা-চামচেরাও বলে তিঙিলিঙ-তিঙিলিঙ, সমুদ্রের পানি বলে আমি কি জানি? আমি কি জানি? তব��� উনি প্রথম গল্পের ভেতরেই জানিয়েছেন ভাষারও আছে সীমাবদ্ধতা- "...তবু আসমার মনের ভিতরের মনটা জানে যে, এক আগুনে এক ঘর একবারই পোড়ে। এতকাল ও ভাষাকে, শব্দকে যতটা পাওয়ারফুল ভেবে এসেছে, তত পাওয়ার আসলে শব্দের নাই। বারবার এক কথা বলতে থাকলে সত্যের গা থেকে শব্দ আলগা হয়ে খুলে আসে।"
তারপর অলমোস্ট সুখী হতে গিয়ে মনে পরে, সুখী হবার চাইতেও জরুরি কি যেন একটা দরকারি কাজ করার কথা; মনে পরে জিসান থেকে সালমানে রূপান্তরিত হওয়া এক পুরুষের কথা।