মহারাজ সাতকর্ণী সাতবাহন রাজ্যের সম্রাট। লোকে বলে তিনিই এই বংশের সবচেয়ে যোগ্য রাজা। রাজ্য চারিদিকে বেড়ে এখন পুরো মধ্য ভারতই তার আয়ত্তে এসে গেছে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্য জায়গায়। পুব থেকে লোকজন আসছে ভারতে বাণিজ্য করতে। তিনিও সেই বাণিজ্যে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তার বন্দরগুলোতে ভিনদেশী জাহাজগুলো আসছে না। খা খা করছে তার বন্দরগুলো। এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে। লক্ষ্মী বিদায় নিয়ে রাজা আর রাজ্য যে শ্রী হারিয়ে ফেলবে। নিজের মন্ত্রীর সাথে সেই পরিকল্পনাই করতে বসেছেন তিনি।
ঠিক সেই সময়ে যে রাজা ভারতে চুটিয়ে বাণিজ্য করছেন, তার নাম নাহাপনা। পশ্চিম শক রাজ্যের এই রাজা নিজের বাণিজ্য নিয়ে সন্তুষ্ট। তবে নিশ্চিন্ত থাকার উপায় নেই। তিনি জানেন, মধ্য ভারত অধিকার করে সাতবাহন রাজ্যের সীমা এখন তার রাজ্যের উপকণ্ঠে চলে এসেছে। আর তার এই ছোট কিন্তু অতুল সমৃদ্ধ রাজ্য অবশ্যই সাতকর্ণীর শকুন নজর এড়াবে না। তাই শত্রু আঘাত করার আগেই শত্রুকে পাকে ফেলতে হবে। নিজের মন্ত্রীর সাথে তিনিও ব্যস্ত সেই উপায় নির্ধারণে।
দক্ষিণ ভারত তিন রাজ্যে বিভক্ত। চেরা, চোলা আর পাণ্ড্য। তিন রাজ্যই একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে আসছে প্রাচীন কাল থেকে। তবে এখন চেরা রাজ্যের অবস্থা ভালো। তার বন্দর মুঝিরিস ব্যবসায় অনেক ভালো করছে। তারও ভয় মহারাজ সাতকর্ণীকে। চোলা রাজ্যে এসেছেন নতুন রাজা। তাকেও থাকতে হচ্ছে ভেতরের আর বাইরের শত্রুর ভয়ে। পাণ্ড্য রাজা বাণিজ্যিক চুক্তি করেছেন চেরাদের সাথে, তবে তিনিও চাচ্ছেন না অন্য কারো দয়ায় বেঁচে থাকতে।
এসব রাজ্যগত ঝামেলার ভেতরে নেই অসিত। সে এক সাধারণ কিশোর। নিজের খেলা দেখানোর বানর আর গ্রামের অন্য মানুষদের কখনো আদর আর কখনো শাসনে কেটে যাচ্ছে তার জীবন। বনের ধারে একটা কেবল কুটির, আর কিছু খেলা দেখানোর সামগ্রী, এই তার সম্বল। তারপর আচমকা একদিন নতুন এক সম্পত্তি হাতে চলে এলো তার। নতুন সম্পত্তির সাথে এলো নতুন সম্ভাবনা, আর সেই সাথে এলো নতুন বিপদও। জীবন বদলে গেলো তার।
এক অভিশপ্ত পুরুষ রাতের অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা মন্দিরে। দিনে কখনোই সে ঘর থেকে বের হয় না। নিত্য আরাধনা করে চলেছে সে, কিন্তু কিছুতেই নিজের শাপের হাত থেকে মুক্ত হতে পারছে না। তবু চেষ্টা করে চলেছে, মহাকাল কি তাকে দয়া করবে? তার শাস্তির মেয়াদ কি শেষ হবে?
বিন্দুমাত্র সম্পর্কহীন বিন্দুগুলো এক সময় এসে মিলে গেলো এক বিন্দুতে। মহাকাল দেখাতে শুরু করলো নিজের খেলা।
ঐতিহাসিক পটভূমিতে অনেকগুলো চরিত্র নিয়ে অত্যন্ত কৌশলী গল্প বুননের জন্য লেখককে প্রথমেই একটা সাধুবাদ দিতে হয়। লেখার মাঝে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। বোঝাই যাচ্ছে অনেক পড়াশুনা করে পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়েই তিনি লিখতে বসেছিলেন। ফলে বইয়ের লেখনশৈলি হয়ে উঠেছে অনবদ্য, যা কিনা কাহিনীর প্রেক্ষাপটের সাথে পুরোপুরিভাবে খাপ খাইয়ে যায়, আর পাঠক যেন সময়ের বাধা পেরিয়ে চলে যায় ইতিহাসের সেই মুহূর্তে। আর এই লেখনিই ছিলো এই বিশাল উপন্যাসের মূল আকর্ষণ। বেশ একটা ক্লাসিক আমেজ আছে এখানে, যা বর্তমান লেখকদের অনেকের মধ্যেই আর খুজে পাই না ইদানীং। এর আগে লেখকের আরেকটি বই 'দ্য নেস্ট অভ দ্যা স্পাইডার' পড়েছিলাম, বেশ ভালো লেগেছিল। ওখানের চেয়েও তার লেখনি আরো অনেক অনেক পরিণত হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে। আরেকটি আকর্ষন হচ্ছে, কাহিনীর ভেতরে রাজ্যগুলির ভেতরকার সুক্ষ্ম রাজনীতির খেল, বিশেষ করর চাণক্যনীতির উপযুক্ত ব্যবহার করেছেন লেখক। পুরোদমে উপভোগ করেছি সব রাজনৈতিক খেলা, এমনকি শেষ পর্যায়েও অনেক প্যাঁচ আছে যা আগে থেকে অনুমান করতে পারি নি। যারা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সাথে কূটনৈতিক বুদ্ধির খেলা পছন্দ করেন, তাদের জন্য উপভোগ্য বইটি। তবে লেখক এখানে যে যে বই থেকে রেফারেন্স টেনেছেন, তার একটা তালিকা সাথে দিলে বেশ ভালো হতো।
প্রশংসা তো অনেক করলাম, এবার আসা যাক সমালোচনায়। জগতের কোন কিছুই তো আর নিখুঁত নয়, তাই এই বইটিও সম্পূর্ণরূপে ত্রুটিমুক্ত নয়। আর পাঠক হিসেবেও আমি ভীষণ খুঁতখুঁতে। এত বড় প্রেক্ষাপট, এত আয়োজন, অথচ সবকিছুর মধ্যে আমি যে ব্যাপারটার অভাব অনুভব করেছি তা হলো চরিত্র নির্মান। একমাত্র গিরিধারী ছাড়া আর কোন চরিত্রই মনে তেমন দাগ কাটতে পারে নি। অসিতের সাথে প্রথম দিকে বেশ বন্ধন তৈরি হয়েছিল বটে, কিন্তু পরবর্তীতে কাহিনীতে তার ভূমিকা এতটাই গৌন ছিল যে, বন্ধনটা দৃঢ় হবার আর সুযোগ পায় নি। তাই প্রথমে তার প্রিয় বস্তুকে হারানোর দু:খে দু:খী হলেও, তার লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার ঘটনা মনে তেমন ছাপ ফেলেনি। একই ঘটনা ঘটেছে অপরাপর প্রধান চরিত্রসমূহের ক্ষেত্রেও। রুদ্রদেব, সাতকর্ণী, নাহাপনা- এদের কারোর সাথে বন্ধন তৈরি না হওয়ায় মনেও দাগ কাটেনি কেউ। তাই সিংহাসন দখলের যুদ্ধে তাদের বিজয় কিংবা মৃত্যুতে উল্লাসিত অথবা দু:খ কোনটাই অনুভব করি নি। ব্যতিক্রম অবশ্য ছিলো- কারিকালা আর উথিয়ান। অল্প সময়ের জন্য হলেও মনে দাগ কেটে যায় চরিত্রদুটি। মনে হয়, প্রধান চরিত্রদের জীবনের পেছনের কাহিনী এবং ব্যক্তিজীবনের দিকগুলি তুলে না ধরায় তাদেরকে আপন করে নিতে পারিনি, যা পেরেছি কারিকালা আর উথিয়ানের ক্ষেত্রে। বাকিদেরকে শুধু রাজনীতির মঞ্চেই দেখা গিয়েছে, কিন্তু ভেতরের মানুষগুলোকে আর চিনতে পারিনি বলে তাদের সাথে একাত্মও হতে পারি নি। আর এই কারনে দূর্দান্ত প্লট থাকা সত্তেও পুরো গল্পটা মনের ভেতর পর্যন্ত দাগ কাটতে পারে না৷ আবার কিছু কিছু চরিত্রের মধ্যে অসীম সম্ভাবনা থাকা সত্তেও ক্ষণকালীন উপস্থিতি দিয়েই মিলিয়ে গিয়েছে তারা। যেমন- রাহু আর আলেক। এই ব্যাপারটা আমার কাছে সম্ভাবনার অপচয় বলে মনে হয়েছে। আরেকটা ব্যাপার বেশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ লেগেছে, তা হলো শক্তিশালী নারী চরিত্রের উপস্থিতি। এমনকি রাধা চরিত্রটার ব্যাপ্তি বেশি নয়, মনে রাখবার মতও নয়। ফলে পুরুষপ্রধান হয়ে যাওয়ায়, বড্ড একপেশে লেগেছে কাহিনী।
ভারতীয় মিথ আর ইতিহাসের অসাধারণ সমন্বয় ঘটিয়েছেন লেখক। ওয়ার্ল্ডবিল্ডিং হিসেবে বলতে গেলে লেখক সার্থক, যদিও যুদ্ধকালীন সময়ে রাজ্যের অবস্থা কিংবা সাধারণ মানুষের ওপরে যুদ্ধের প্রভাব তেমনভাবে কাহিনীর মাঝে উঠে আসে নি। আবার হালকা মিথের ছোঁয়া আছে রুদ্রদেবের চরিত্রে। মহাভারতের এক বিখ্যাত চরিত্র সে। আসল নামটা নাহয় নাই বলি এখানে। এসব দিক বিবেচনা করলে লো-ফ্যান্টাসির গোত্রে ফেলা যায় উপন্যাসটিকে। আর যুদ্ধ কৌশল আর যুদ্ধের দৃশ্যগুলি অসাধারণ নৈপুণ্যর সাথে একেবারে ছবির মতন চোখের সামনে তুলে ধরেছেন লেখক। এক্ষেত্রে তার পরিশ্রম আর লেখনির বাহবা দিতেই হয়। কিন্তু ঐ যে, চরিত্রদের সাথে একাত্ম হতে না পারায় এসবের কোনকিছুই যেন মনে দাগ কাটে না। সম্ভবত, যুদ্ধের কৌশল আর রাজনীতির প্যাঁচের দিকে জোর দিতে গিয়ে, চরিত্র নির্মানের ওপর থেকে জোর কমে গিয়েছে।
তাই প্লট আর লেখনির হিসেবে সাড়ে চার তারা পাবার যোগ্য হলেও চরিত্র গঠনের দূর্বলতার জন্য আর অবশেষে তিন তারা দিয়েই ক্ষান্ত হতে হলো।
তবে মনে হচ্ছে লেখকের মনে দ্বিতীয় পর্ব লেখবার চিন্তা রয়েছে। তাই তিনি কাহিনীর শেষে কিছু কিছু সুতো ছেড়ে গিয়েছেন। হয়ত পরবর্তী পর্বে বাকি চরিত্রদের আরো গভীরভাবে পরিচিত হতে পারবো বলে আশা করি। ছয়শ পাতার শেষে কাহিনীর সমাপ্তি ঘটলেও আপাতত বইটিকে এক পূর্ণাঙ্গ গল্পের বদলে সিরিজের প্রথম বই বলেই বেশি মনে হয়েছে।
বি:দ্র: অনেকগুলি চরিত্র থাকায় প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। বইয়ের শেষে একটা চরিত্র পরিচিতি দিলে বেশ হতো।
এবছরের অন্যতম বৃহৎ উপন্যাস মহাকাল। পড়তে একটু দেরিই করে ফেললাম। ইতোমধ্যে লেখকের ফেসবুকে বইটার দ্বিতীয় পর্ব 'মহাযাত্রা' শেষ হওয়ার খবর পেয়েছি। সেটা আরো বড় পরিসরে। তাতে আমি বরং খুশিই হয়েছি। মহাকালের এই মহাযাত্রার প্রথম পর্বটা আমার মন কেড়ে নিয়েছে। দ্বিতীয় পর্বও যে মন কাড়বে সে ব্যাপারে আমি প্রচন্ড আশাবাদী। এখন শুধু অপেক্ষা ।
উল্লেখ্য: বইটিতে একটা মানচিত্রের অভাব বোধ করেছি খুব। পড়ার সময় নিজেকেই এঁকে নিতে হয়েছে সব। 'মহাযাত্রা' যেহেতু আরো বড় পরিসরে সেহেতু একটা মানচিত্র অবশ্যই থাকা উচিত। তাতে পাঠকরা আরো বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করবে পড়তে।
বইটার প্রথম গুণ এর ব্যপ্তি। এতো বড় বই লেখা প্রথমত সহজ না, দ্বিতীয়ত খেই হারিয়ে যায়। শুনছি প্রায় দুই লাখ শব্দের বই। নামের মতো বইটাও মহাকাল। বইটার দ্বিতীয় গুণ এর কাহিনী। দিবাকর দাস একটা কাহিনী তৈরি করেছেন যেটা পাঠককে টেনে নিয়ে যায়। তৃতীয় গুণ, দুই লাখ শব্দের মধ্যে বানান ভুল খুবই কম। ০.৫% হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই বড় ব্যপার।
ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ল্যাসিক ধারাটা অনুসরণ করেছেন লেখক তবে পুরোটা করেননি। শাহরুখ খানের ডন, একাধিক মাত্রার সিনেমা কিন্তু ডন টুয়ে একটাই মিশন ছিল। মহাকালের ধাঁচটা ডন টুয়ের। দুই লাখ শব্দে বহুমাত্রিক একটা উপন্যাস হওয়ার সুযোগ ছিল কিন্তু রাজনৈতিক কুটিলতায় একটা যুদ্ধ বা একটা উদ্দেশ্য সাধনেই উপন্যাসটা চলে গেল। সেখানে অবশ্য শাস্ত্র, পুরাণ, ইতিহাসের নানা যুদ্ধনীতি, রাজনীতির কথা এনেছেন লেখক। কূটনীতির বিষয়গুলো দারুণ হলেও বিস্তারের কারণে একটু হলেও বিরক্তি আনে। যুদ্ধের বর্ণণা, ব্যুহ তৈরি, অস্ত্র সবকথাই লেখক বড় বেশি বিস্তারে বললেন।
যে জায়গাটা সবচেয়ে বেশি খামতির, আমার কাছে, সেটা হলো উপন্যাসে দ্বিতীয় কি তৃতীয় শতাব্দীর ভারতের কথা বলা হয়েছে কিন্তু এতো বিস্তারিত বর্ণনার পরও সেই ভারতটাকে ভিজুয়ালাইজ করতে পারলাম না। ভারত, ভারতের ইতিহাস নিয়ে আমার আগ্রহ তুমুল। দিবাকর দাসের বর্ণনা, ভাষা ভালো তবু ঐ জিনিসটা হলো না। তারপর এই উপন্যাসে রাজা আছে, রানী নাই। কোনো নারী চরিত্র নাই। সত্যজিৎ রায় সিনড্রোম? আরেকটা ব্যপার, চোল সাম্যাজ্যকে বারবার চোলা বলাটা পছন্দ হয় নাই।
এত বড় একটা গল্প তৈরি করা কঠিন। সেটাকে লিখে ওঠা আরো কঠিন। যেটা শুরুতে বললাম, গল্পটা টানবে একটা পর্যায় পর্যন্ত। সেই ফ্লোতে পড়ে যাওয়া যায়, উপভোগও করা যায়। আরেকটা ভালো বিষয় ড্যান ব্রাউনের মতো অতীতের সাথে বর্তমানের গুপ্তধন বের করার গল্প নাই কিন্তু সেখানেও এমন একটা চরিত্রকে টেনে আনা হইছে যে, সে একটা ব্যক্তিগত গুপ্তধনই খোঁজে। পুরনো ভারতের যুদ্ধবিদ্যার অনেক কিছু আছে যা এখন বিশ্বাস করা কষ্ট। তবু সাপ দিয়ে যুদ্ধ না করালেও চলত। আর রুদ্রদেব একজন প্রৌঢ় যোদ্ধা হলেও পারতেন। তাকে কুরুক্ষেত্র থেকে আনার দরকার ছিল না। আনা যখন হলো, তখন আরো বেশি দার্শনিক হতে পারত উপন্যাসটা।
পরিশ্রমী একটা কাজ। সে হিসাবে সমালোচনা হয়ত বেশি হয়ে গেল। এতো দীর্ঘ উপন্যাস লেখার হ্যাপাটা বুঝি। তবে সে কারণেই আশাটা বেড়ে যায় অনেক সময়। তবু মহাকাল একটা গুড রিড হবে অনেকের জন্যই। যারা এই ধারায় লিখতে চান, তারাও গল্প বলার তরীকাটা দেখার জন্য বইটা পড়তে পারেন। পুরনো ভারতের অস্ত্র বা যুদ্ধনীতি নিয়ে আগ্রহ থাকলেও এ বই বেশ ভালো লাগবে। আর আশা করি, আমি তুমি, কী কেন সংলাপ দিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা বাড়ানোর চেয়ে কেমন করে জমাট গল্প বলে পৃষ্ঠা বাড়ানো যায় সেটাও অনেকে শিখতে পারবে।
মহাকাল এক সুবিশাল আখ্যানের প্রথমভাগ। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক লড়াইয়ের সুনিপুণ এক গল্পকথন। দিবাকর দাস বুনেছেন প্রাচীন ভারতবর্ষের রাজরাজড়াদের বুদ্ধির লড়াইয়ে জিতে অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের গাঁথা।
হিস্টোরিকাল ফিকশন আগে খুব বেশি পড়িনি। বলতে গেলে এক হাতের কয়েক আঙ্গুল সংখ্যক। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দু তিনটে উপন্যাস পড়েছি বটে। বার ভূঁঈয়াদের নিয়ে রাজদ্রোহীও পড়েছি৷ তবে একেবারেই কয়েক হাজার বছর আগের ইতিহাস নিয়ে লেখা এরকম সুবিশাল আখ্যান আগে পড়িনি৷
তাই প্লট আমার কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় লেগেছে।
সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে ভূমি বিজয় মানেই বড় রাজা হওয়া নয়৷ তাকে হতে হবে অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী এবং রাজনীতির মারপ্যাঁচে কূটনীতিক শক্তি হতে হবে।
সাতবাহনের রাজা সাতকর্ণী বিশাল জমির মালিক। তাঁর সেনাবাহিনী ভূভারতে অদ্বিতীয়। তবে অর্থনৈতিক ভাবে তিনি দুর্বল হয়েছেন। বাণিজ্যিক শক্তি নন তিনি। তার বন্দরে বিদেশি বণিকরা আসেন না৷ ফলে ব্যবসায়ীক দিক থেকে সাতবাহন পিছিয়ে পড়েছে অনেকটাই। অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে মহারাজ সাতকর্ণী নিয়োগ দিলেন মহামন্ত্রী গিরিধারীকে।
পশ্চিম শক রাজ্য এই মুহুর্তে অর্থনৈতিকভাবে ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য। তাদের সুসজ্জিত বন্দর বারিগাজাতে ভেড়ে সব জাহাজ। তাদের বাণিজ্য লক্ষী সোনায় মোড়ানো। কিন্তু শক রাজা নাহাপনা জানেন তার রাজ্যের উপরে নজর পড়বে সাতবাহনের। আর সাতবাহনের সাথে সম্মুখ লড়াইয়ে তার সেনাবাহিনী পারবে না। মহামন্ত্রী সারথীকে তাই তিনি নির্দেশ দিলেন কূটনীতিক তৎপরতা চালানোর।
শুরু হলো দুই রাজ্যের দুই ক্ষুরধার মন্ত্রীর কূটনীতিক লড়াই।
মহাকালে যেই বিষয়টা সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা হলো প্রত্যেক রাজার সাথেই একজন করে কূটনীতিপটু মন্ত্রীর সার্বক্ষণিক অবস্থান। তারা রাজনীতি এবং কূটনীতিতে দক্ষ। সাথে ধর্মগ্রন্থ বেদের উপরে অপরিসীম দখল।
দিবাকর দাস নিজে যে বেদ ভালো করে পড়েছেন, এবং যত্নের সাথে মন্ত্রী কিংবা রাজাদের সংলাপে পেশ করেছেন; এই বিষয়টায় আমি মুগ্ধ। লেখকরা সাধারণত অনেক পড়াশোনা করে ফিকশন লিখলে পাঠককে জ্ঞান দেয়ার লোভ সামলাতে পারেন না। ঠেসে ঢুকিয়ে দেন তথ্য। মহাকালে এরকম ইনফো ডাম্পিং নেই। গল্পের গতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটু একটু করে পরিবেশন করেছেন বেদের বাণী কিংবা অন্যান্য তথ্য। বইটা পড়ার সময়ে বার বার মুগ্ধ হয়েছি লেখকের গবেষণা এবং তার সুমিষ্ট পরিবেশন দেখে।
° রাজনীতি এবং কূটনীতির পাশাপাশি দুটো সাবপ্লটে দেখা যায় গুরুত্বপূর্ণ দুই চরিত্র অসিত এবং রুদ্রদেবকে। জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত এক কিশোর এবং হাজার বছর ধরে শাপ বয়ে বেড়ানো এক রহস্য মানব।
ঘটনাক্রমে দেখা হয়ে যায় দুজনের। শাপমুক্ত হয়ে এক জঙ্গল পাহারার দায়িত্ব পায় রুদ্রদেব। আর জীবন সংগ্রামের হাতিয়ার অঙ্গদ নামের বানরকে হারিয়ে, তাকে খুজতে প্রাণ বাজি রেখে উদ্ধার অভিযানে নামা অসিত সেই একই জঙ্গলে এসে দেখা পায় রুদ্রদেবের।
রুদ্রদেব অসিতকে গ্রহণ করে শিষ্য হিসেবে। শেখানো শুরু করে নিজের যাবতীয় বিদ্যা। অস্ত্রবিদ্যা, শাস্ত্রবিদ্যা, রণকৌশল; ১৮ বিদ্যা ৬৪ কলার মহারথী রুদ্রদেবের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে একের পর এক জ্ঞানের কথা। এবং এখানেও দিবাকর দাস শৃঙ্খলার সাথে পরিবেশন করেছেন সবগুলো তথ্য।
বাঘ মারতে বের হওয়া মহারাজ সাতকর্ণীর সাথে আরেকটা ঘটনাক্রমে দেখা হয় যায় রুদ্রদেবের৷ সে কথা থাক৷ এই ঘটনার জন্যই রুদ্রদেব আর অসিত জড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষের রাজনীতির সাথে।
চরিত্র:
দিবাকর দাস খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একেকটা চরিত্র বিল্ডআপ করেছেন৷ অনেকগুলো চরিত্র মহাকালে। মনে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। কিন্তু দিবাকর দাস সুনিপুণ ভাবে অল্প সময়ে দক্ষতার সাথে পোট্রে করেছেন সবগুলো চরিত্র৷ এক দুটো বাদে প্রায় সব চরিত্রই ভালো লেগেছে।
লিখনশৈলী:
একবারের জন্যও বিরক্ত হইনি কোথায়। ৬০৮ পৃষ্ঠার একটা বই স্লোবার্ন হওয়ার কথা ছিল। কিংবা মূল গল্পে ঢুকতে সময় লাগার কথা ছিল। তা হয়নি। মহাকাল অত্যন্ত ফাস্টপেসড একটা উপন্যাস।
মহাকালে তিনটে যুদ্ধ হয়৷ তিনটে যুদ্ধেই দিবাকর দাস উভয়পক্ষের সুনিপুণ রণকৌশল দেখিয়েছেন। প্রাচীন ভারতবর্ষের যুদ্ধনীতি, যুদ্ধকৌশল, যোদ্ধাদের বীরত্ব পড়ে বার বার মুগ্ধ হচ্ছিলাম। কোনপক্ষকেই খাটো করে দেখাননি লেখক। যুদ্ধে তো একপক্ষকে জিততে হবে, সেটাও তিনি এঁকেছেন সুকৌশলে। তবে যুদ্ধ বিগ্রহের ঘটনাপ্রবাহ আরেকটু বিস্তারিত লিখলে আরও বেশি তৃপ্তি পেতাম।
প্রডাকশন:
রিভিউতে আমি সাধারণত প্রডাকশন সম্পর্কে লিখি না। এটায় লিখতে বাধ্য হচ্ছি। এত্ত সুন্দর বাধাই এবং প্রচ্ছদ। শক্তপোক্ত একটা জ্যাকেট৷ হাতে নিলেই বারবার প্রিমিয়াম ফিল হচ্ছিলো। রাউন্ড বাইন্ডিং বলে এতবড় একটা বই পড়তে একদম অসুবিধা হয়নি। আমার কাছে চিরকুটের যেই কয়টা বই আছে, তার মধ্যে এটার প্রডাকশনই বেস্ট।
প্রচ্ছদটা সম্ভবত সজল ভাইয়ের বেস্ট ওয়ার্ক। অভিবাদন জানবেন সজল চৌধুরী।
পরিশিষ্ট:
মহাকাল এখনতক আমার পড়া বেস্ট উপন্যাস। এটাকে থ্রিলারে বেঁধে ফেলতে চাই না। এটা একটা ফিকশন হিসেবেই থাকুক আমার মগজে।
বইটি আমার ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া ছোট ভাইও পড়েছে! এর আগে সে এতবড় বই পড়েনি। সেও মুগ্ধ হয়েছে।
এই বছরের বইমেলার সবচেয়ে সেরা বইটার পাঠ প্রতিক্রিয়া হয়তো লিখছি এখন। এই গল্প প্রাচীন ভারতের। রাজাদের সম্রাট হয়ে ওঠার যাত্রার দিকের গল্প। ভূমি দখলের রাজনীতির বদলে বাণিজ্য দখলের যে আধুনিক রাজনীতি, তার গল্প। জটিল ষড়যন্ত্র, কূটনীতি আর যুদ্ধের গল্প। বীরত্ব, জয় অথবা পরাজয়ের গল্প।
প্রাচীন ভারতে এক রাজা অন্য রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন৷ যুদ্ধের ময়দানে নামছেন। পেছন থেকে তাদের মন্ত্রীরা দেখাচ্ছেন বুদ্ধির নানা কলাকৌশল। সেই থিম নিয়ে লেখক লিখে ফেলেছেন মহাকাল। সেইসাথে অসিত আর তার পোষা বানর অঙ্গদের যে যাত্রার শুরু সেটাও হয়ে উঠেছে এই বইয়ের অন্যতম মূল থিম৷ আমি রিভিউতে কাহিনি সংক্ষেপ বলার এর পক্ষে না। এতে স্পয়লার হয়ে যায়৷ তারচেয়ে বরং পাঠ প্রতিক্রিয়ায় মনোযোগ দেয়া যাক।
ইদানীং বই পড়তে গিয়ে যে ব্যাপারটা আমাকে ব্যথিত করে তা হলো, লেখক লেখা শুরুর সময়ই চিন্তা করেন 'এইবার আমার একখান বই বাইর করতেই হইবে।' এরপর তিনি যে বই লিখেন সেখানে প্রচুর তাড়াহুড়োর ছাপ দেখা যায়। মহাকাল পড়তে গিয়ে এই ব্যাপারটার অনুপস্থিতি দেখে ভালো লেগেছে৷ লেখক যত্নের সাথে বইটা লিখেছেন৷
বিস্তৃত প্লটে খেই না হারিয়ে যত্নের সাথে লেখক গল্পের সুতো ছড়িয়েছেন, জাল বুনেছেন দক্ষতায়, তারপর সেই সুতো গুটিয়ে এনেছেনও বেশ ভালোভাবেই৷ তবে এই বই নিয়ে সমালোচনা করতে গেলে আমি যেটা বলবো ফিনিশিং আরও বেশি কিছু এক্সপেক্ট করছিলাম। মহাকালের দ্বিতীয় পার্টে সেই ফিনিশিং হয়তো কমপ্লিট হবে৷
প্রোডাকশন অতি চমৎকার, বইয়ের ওপরের জ্যাকেটটা তো দারুণ। বই হিসেবে মূল্যও বেশি নয়, পড়ার পর সময় আর টাকা দুইটাই উসুল মনে হয়েছে৷ একজন লেখক সারাজীবনে এরকম একটা ভালো বই লিখলে তার আর বাকি জীবন কিছু না লিখলেও চলে। বাংলা সাহিত্যে দারুণ এক সংযোজন হয়ে গেলো মহাকাল। মহাকাল মহাকালের পাতায় ক্লাসিক হবে একদিন নিশ্চয়! বই পড়ে বেশি ভালো লাগলে এরকম উচ্ছ্বসিত রিভিউ দিয়ে ফেলি। পাঠকদের আমন্ত্রণ, ঠকবেন না৷ এই বই মিস দেয়ারও মানে হয় না।
আপাতত মহাকালের দ্বিতীয় পার্ট ছাড়া লেখকের কাছে আর কোনো দাবী নাই৷ অতি সত্বর দ্বিতীয় পার্ট চাই৷
বই - মহাকাল লেখক - দিবাকর দাস প্রকাশনী - চিরকুট মুদ্রিত মূল্য - ১০০০
রেটিং টা হয়তো আরেকটু বাড়তো। কিন্তু এতো বড় বইয়ে কোন ম্যাপ দেওয়া হয় নি, চরিত্রগুলোর একটা বিশ্লেষণধর্মী সূচিও দেওয়া উচিত ছিলো। ম্যাপের কারণে পুরো গল্পটা পড়ে আগাতে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। লেখক এতো বই লিখলেন অথচ আর্যাবতের ম্যাপ দিলেন না....
দিবাকর দাসের ‘মহাকাল’ এক কালের আখ্যান, এক বিস্মৃত প্রাচীনতার পুনর্জাগরণ। প্রত্যেক কালই একটি গল্প বলে—কখনো তা কালের বয়ে চলা স্রোতে বিকৃত হয়ে যায়, আবার কখনো হারিয়ে যায় ইতিহাসের গর্ভে। মহাকাল সেই হারিয়ে যাওয়া গল্পের পুনরুদ্ধার, প্রাচীন আর্যাবর্তের বুকে রচিত এক বিস্তৃত যুদ্ধ, কূটনীতি ও মানবসত্তার টানাপোড়েনের কাহিনি।
মহাভারতের যুদ্ধ শেষ, পেরিয়ে গেছে প্রায় তিন হাজার বছর। আধুনিক আর্যাবর্তে যুদ্ধবিগ্রহ পেছনে ফেলে রাজ্যগুলি মন দিয়েছে বাণিজ্যে, সমৃদ্ধিতে। কিন্তু যুদ্ধ কি সত্যিই শেষ হয়? টিকে থাকার সংগ্রামে, ক্ষমতা ধরে রাখার প্রতিযোগিতায়—যুদ্ধ আবার ফিরে আসে, কখনো ছদ্মবেশে, কখনো মুখোশ খুলে আবার কখনও বা কূটনীতির আড়ালে।
গল্প বা কাহিনী যেটাই হোক, প্রেক্ষাপটে মহাকাল দুর্দান্ত এক সৃষ্টি। চমৎকার এক কাহিনী, যেখানে ধাপে ধাপে জড়িয়ে আছে কূটনীতির সূক্ষ্ম চাল ও বুদ্ধির তীক্ষ্ণ খেলা। শুরুতে কাহিনী কিছুটা ধীরে আগালেও কিছুদূর যাওয়ার পরে কাহিনীর গতিশীলতায় পাঠককে ধরে রাখে। বিশেষ করে রাজা উথিয়ান আর রাজা কারিকালার মধ্যকার যুদ্ধের বর্ণনা ছিল চরম উত্তেজনাপূর্ণ—এই অংশটা আমি প্রায় রুদ্ধশ্বাসে পড়েছি । আমার কাছে এই কাহিনীর সব থেকে চমকপ্রদ অংশ এটা।
তবে কাহিনী যতটা দুর্দান্ত, লেখকের ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গি ততটা শক্তিশালী মনে হয়নি। বেশ দুর্বলতা ছিল, যা সামান্য হলেও আমার পাঠ-আনন্দে ভাঁজ ফেলেছে। এত বিশাল কলেবরের একটি উপন্যাসে ভাষার ব্যবহার, অলংকার ও বাক্যগঠনে আমি আরও মাধুর্য আশা করেছিলাম। লিখনশৈলী তাই বেশকিছুটা শুষ্কই লেগেছে আমার কাছে।
এই কাহিনীতে রাজ্য আছে, রাজা আছে, প্রজা আছে, সৈন্য আছে —সবই আছে; কিন্তু রানী নেই, রাজপুত্র - রাজকন্যা নেই, এমনকি কোনো উল্লেখযোগ্য নারী চরিত্রও নেই। এত বড় কলেবরের কাহিনীতে রাজার অন্দরমহল জায়গা পাবে না এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। পুরো উপন্যাস তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও কোনো নারী চরিত্র চোখে পড়ে না—শুধুমাত্র শুরুতে রাধা আর উমা পিসির ক্ষণিক উপস্থিতি ছাড়া। আর এদুটো চরিত্রের ও মনে রাখার মত তেমন গ্রহণযোগ্যতা নাই। এই রানীহীন রাজ্য লেখকের কল্পনাশক্তির এক বড় সীমাবদ্ধতা বলেই আমার মনে হয়।
উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র রুদ্রদেব, অসিত, গিরিধারী, মহারাজ সাতকর্নি—সবাই কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও আমার সাথে গভীর সখ্যতা গড়ে তুলতে পারেনি। বরং রাজা কারিকালার চরিত্রে যে দৃঢ়তা আর রুক্ষ সৌন্দর্য, সেটিই আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। আবার রাজা উথিয়ানের শেষ মুহূর্তটুকুও হৃদয়ে একটা জায়গা করে নিয়েছে। গিরিধারীর মত তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার চরিত্রও কেন জানি তাদের পাশে ম্লান হয়ে গেছে আমার কাছে এসে।
লেখক যে পরিমাণ গবেষণা এবং কৌশলী বর্ণনার মাধ্যমে চাণক্য নীতি, বুদ্ধির খেলা, রাজনীতি, এবং যুদ্ধ-রণকৌশলের গঠন উপস্থাপন করেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। কিছু ষড়যন্ত্র আগাম ধারণা করতে পারলেও বই পড়ায় এর কোনো প্রভাব পরেনি। তবে প্রথম যুদ্ধের পরে উপন্যাস যতটা শক্তিশালীভাবে সামনে আগাচ্ছিলো, শেষ যুদ্ধটি তার তুলনায় অনেকটা ম্রিয়মাণ বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে, যুদ্ধের মধ্যে সাপ টেনে আনার অংশটা কল্পনার দিক থেকে আকর্ষণীয় হলেও কাহিনির আবহের সঙ্গে ঠিক খাপ খায়নি। লেখক চাইলে যুদ্ধকে আরও বাস্তবধর্মী করে তুলে কাহিনীর জোরালো একটি পরিসমাপ্তি দিতে পারতেন। আসলে প্রত্যেক পাঠকই উপন্যাসের শেষ অংশ থেকে একটু বেশি প্রত্যাশা করে। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। শেষটা যদি আরও ভারসাম্যপূর্ণ হতো, তাহলে পুরো উপন্যাসের ছন্দটি বজায় থাকতো।
সব মিলিয়ে বলতে গেলে, শুধুমাত্র কাহিনী হিসেবে মহাকালের সাথে আমার সময়টা ভালো কেটেছে—গল্পের গতি, ঐতিহাসিক আবহ, রাজনৈতিক কূটচাল সব মিলিয়ে উপভোগ্য ছিল। কিন্তু পাঠক হিসেবে আমি যখন একটি উপন্যাসকে শুধু কাহিনী নয়, একটি সম্পূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিচার করি, তখন এর কিছু ত্রুটি ও অসঙ্গতি চোখে পড়ে যায়। চরিত্রায়নের অসমতা, লিখন শৈলীর দুর্বলতা, আর শেষের দিকে কাহিনির ম্রিয়মাণতা বইটির সামগ্রিক গ্রহণযোগ্যতাকে আমার কাছে অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে।
#পাঠ_অনুভূতি_১৫_২০২৩ বই : মহাকাল লেখক : দিবাকর দাস প্রকাশনা : চিরকুট পৃষ্ঠা : ৬০৭ অবশেষে মহাকাল এর পরিক্রমা থেকে বের হতে পারলাম। নামের সাথেই বই এর পরিব্যপ্তি বিশাল। এই যুগে এসেও মহাকালের রাজা মহারাজাদের যুদ্ধের তলোয়ারের ঝলকানি যেনো চোখের সামনে দেখছিলাম, নাহ এতোটুকুও একঘেয়ে লাগেনি। গ্রামের সহজ সরল এক বালকের নিজের কাছে নিজের প্রতিজ্ঞায় নিজেকে রাজবাড়ির যোদ্ধা হিসেবে তৈরী করা নিজের ভিতরে যেনো আর একগ্রতা যুক্ত করলো। যুদ্ধনীতি এর সাথে রাজনীতি ও ��ূটনীতি যে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে এই বইয়ে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বেশ বড়ো একটা বই কিন্তু এই বই ধরলে না শেষ করে শান্তি পাওয়া যায়না। যুদ্ধ জেতা হলো কিন্তু ঘটনা শেষ হোইয়াও হইলো না। বরং শেষে এসে কি অদ্ভুত কিছু প্রশ্ন রেখে গেলেন লেখক। আবারও কিছুদিন অপেক্ষা। বই পড়ুন, সময়কে কাজে লাগান।
সাতবাহন রাজার কপালে চিন্তার ভাঁজ। সবচেয়ে বড় রাজ্য নিয়েও ব্যবসায় সফল হতে পারছে না। মসলার ব্যবসায় একসময় একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও সেই আধিপত্য কমেছে সময়ের সাথে সাথে। বিশাল রাজ্য সাতবাহন। অমরাবতী রাজ্যের রাজধানী হলেও রাজ্যের প্রধান বন্দর প্রাতিষ্ঠানা এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবুও যেন গুরুত্ব কমছে প্রতিনিয়ত। বন্দরে যদি বিদেশি জাহাজের দেখা না পাওয়া যায়, তাহলে ব্যবসা করবে কী করে? এত বড় রাজ্য চালানো তো মুখের কথা নয়। আয় না হলে রাজ্যের প্রজাদের ব্যয় তো কমছে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে প্রজাদের কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। অর্থবিত্তে নিম্নসীমায় জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে কতদিন। তাই নতুন কিছু করতে হবে। ব্যবসায়ে আবারও আলোর মুখ না দেখলে বিশাল রাজ্য নিয়ে কী হবে? একে একে অনেক অঞ্চল জয় করা হলেও ব্যবসার জন্য উপযুক্ত অঞ্চল জয় করা হয়নি। সাতবাহন রাজার তাই নজর ভিন্নদিকে। আর সে কারণেই নতুন করে শুরু হচ্ছে প্রস্তুতি।
সাতবাহন যেখানে আয়ের উৎস খুঁজতে মরিয়া, সেখানে শক রাজ্য চুটিয়ে ব্যবসা করছে। তাদের বিশেষ রত্ন ব্যবসা টিকিয়ে রাখছে তাদের বন্দর বারিগাজাকে। প্রতিনিয়ত আয়ের পরিধি বাড়ছে। ব্যবসা করতে আসা বণিকরা যখন এক বন্দরে সবকিছু খুঁজে পায়, সেখানে অন্য কোনো বন্দরে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। তাই ধীরে ধীরে বারিগাজা বন্দর অর্থ-প্রাচুর্যে ভারতের যেকোনো রাজ্যকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। লোভ খুব ভয়াবহ জিনিস। আর এই লোভেই বনিকের ছদ্মবেশে গ্রীক গুপ্তচরের আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু যার রাজ্যে রত্নের ছড়াছড়ি, সে কী করে অসচেতন হয়? ফলে গ্রীক হোক বা অন্য কেউ, ব্যর্থ হতে হয়েছিল। যেখানে মধুর চাক বিদ্যমান, মৌমাছি তো ছুটে আসবেই। আর যাদের ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে, তাদের নজর পড়বে এই রঙিন প্রাচুর্যের দুনিয়ায়। তবে সেই নজর কাটাতে হবে। আর কাটাতে হলে, ভিন্ন কিছু করতে হবে। কূটচালে জয়ী হলে তবেই রাজ করা যাবে। আর প্রাচুর্য যার শক্তি, সবকিছু জয় করা তার কাছে খুব সহজ।
গল্পটা যেখানে দুই বড় রাজ্যের, গল্পটা সেখানে অসিতেরও। অসিতের পরিবারে কেউ নেই। মা অনেক আগেই গত হয়েছে। বাবাও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে অনেকদিন আগে। কাছের বলতে এক বানর রয়েছে। যার নাম অঙ্গদ। বাবা আগে বানরের খেলা দেখাত। সেই খেলার পথ এখন অসিতেরও। একদিন এক খেলা দেখাতে গিয়ে যুবরাজের খেয়ালের বশে অঙ্গদের শরীর পুড়ে যায়। তারপর অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে। যে বৈদ্য অঙ্গদের চিকিৎসা করে, বিশেষ এক পাতার রস দেওয়ার পর অঙ্গদের চামড়ার স্বাভাবিক রং বদলে রংবেরঙের অঙ্গে পরিণত হয়। যা বদলে দে অসিতের ভাগ্য। একই সাথে নজর পড়ে অর্থলোভী কারো! আর সেখানেই অঙ্গদ হারিয়ে যায়। ভালো মানুষের মুখোশ পরে কেউ নিয়ে যায় অঙ্গদকে। কিন্তু অঙ্গদকে ছাড়া অসিত তো ভালো থাকবে না। একমাত্র সঙ্গী বানরকে খুঁজতে তাই সে বের হলো। যতদিন না খুঁজে পায়, গ্রামে ফিরবে না। যাত্রা শুরু হলো অনিশ্চয়তার পথে।
দক্ষিণ ভারতের দিকে নজর দেওয়া যাক। যেখানে তিনটি রাজ্যের অবস্থান থাকলেও কোনো বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব নেই। চোলা রাজ্যের অবস্থা সঙ্গীন। সম্প্রতি রাজার মৃত্যুর পর যখন যুবরাজের রাজ্যাভিষেক হয়, তখন থেকেই বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করে। ক্ষমতার লোভে মন্ত্রীরা নবীন রাজাকে বন্দী করে। সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া, নতুন করে ফিরে আসা! তারপর এক গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে রাজ্য পুনরুদ্ধার। তবুও শান্তিতে থাকা হয় না। ক্ষমতাচ্যুত মন্ত্রীবর্গ আবারও ষড়যন্ত্র শুরু করে। হাত মেলায় শত্রুপক্ষের সাথে। আর সেই শত্রুপক্ষ বাকি দুই রাজ্য চেলা ও পাণ্ড্য। গৃহযুদ্ধের ধকল সামলে উঠতে না উঠতেই আবারও নতুন প্রতিপক্ষ! কিন্তু এবার সামাল দেওয়া যাবে কীভাবে? ভরসা শুধু মিত্রপক্ষের আশ্বাসে। কিন্তু সময় মতো যদি সাহায্য না আসে?
শত্রুর শত্রু মিত্র হিসেবেই গণ্য হয়। কলিঙ্গ রাজ্য অনেককাল আগে একবার সাতবাহন রাজ্যকে হারিয়েছিল। সেই ভরসা আবারও ফিরে এসেছে। আয়তন বা প্রাচুর্য— কিছুতেই শান ধরে রাখলেও বিশাল সেনাবাহিনী আছে। সেই সেনাবাহিনীর ভরসাতেই সাতবাহনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া! সাথে প্রচুর অর্থপ্রাপ্তির আশ্বাস। কিন্তু কূটচালে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে সময় লাগে না। কলিঙ্গ রাজ্যের আগুনে ঝাঁপ দেওয়া হয়তো সফলতা এনে দিবে, কিংবা ব্যর্থতা। কী হবে তা সময়ই বলে দিবে!
হাজার বছর পেরিয়ে এই পৃথিবীর বুকে তার বিচরণ। এক কঠিন অভিশাপে তার জীবন পুরোপুরি বদলে গিয়েছিল। মৃত্যুও যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। হাজার হাজার বছর পেরিয়েছে সময়ের পরিক্রমায়। মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছিল। কিন্তু পাওয়া হলো এক অসহায় নারীকে সাহায্য করার নিমিত্তে। পাপ পরিণত হলো পুণ্যে। নতুন জীবনে হয়ে উঠল রুদ্রদেব। পুরনো অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজেকে আরো শাণিত করছে। লক্ষ্য তো একটা আছেই। পথে অসিতের সাথে দেখা। আর ওরা দুইজন জানে না, দুইজনের লক্ষ্যই এক দিকে নিয়ে যাবে। বদলে যাবে ভবিতব্য।
ভারতের এই মাটিতে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। প্রতিটি রাজ্য একে অপরের মুখোমুখি। শত্রু-মিত্রের বিভেদ করা এখানে বাতুলতা। যে যোগ্যতার প্রমাণ দিবে, কূটচালের তীক্ষ্ণতা যেখানে বেশি, রাজনীতির গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করবে; সেই বিজয়ীর মুকুট পড়বে। মহাকালের চক্রে এই যুদ্ধ কেবল সময়ের ব্যাপার। আর এই চক্রে ভারতের সকল রাজ্যের পাশাপাশি বাঁধা পড়েছে রুদ্রদেব ও অসিতও। এভাবেই হয়তো মানুষের ভাগ্য লেখা হয়। লক্ষ্যের পথে এগিয়ে যায়। এখানে কার লক্ষ্য কী, তা সময়ই বলে দেবে।
◾পাঠ প্রতিক্রিয়া :
শেষ হলো মহাকালের যাত্রা। এই যাত্রায় এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া কাজ করছে। যদিও ভালো লাগার পাল্লাটা ভারী। তারপরও কিছু বিষয় মনমতো হয়নি। সেসব নিয়ে আলোচনা করব। “মহাকাল” মূলত ইতিহাসভিত্তিক ফ্যান্টাসি উপন্যাস। ঐতিহাসিক বলা হলেও সবকিছুই এখানে কাল্পনিক। এর সাথে মিশেছে রাজার রাজনীতি, মন্ত্রীর মন্ত্রণা, সেনাবাহিনীর যুদ্ধ। এছাড়াও ছিল ছলনা, গভীর দর্শন, মনস্তত্ত্ব। বিশাল এক মহাযজ্ঞ এই “মহাকাল”। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে ভারতীয় পুরাণ। শস্ত্র ও শাস্ত্র মিলে দারুণ এক রূপরেখা তৈরি করে তুলেছে। যাতে ডুব দিতে পারলে তৃপ্তি পাওয়া যায়।
একটি ফ্যান্টাসি জাতীয় উপন্যাসের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকে। সবার প্রথম ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং। যে কাল্পনিক রাজ্য বা বিশ্বের কথা বলা হবে, তার উপাদানগুলো কতটা দক্ষতার সাথে লেখক পরিপূর্ণ করেন, এখানে সেই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ার্ল্ড বিল্ডিংয়ের দক্ষতার পাশাপাশি লেখককে নজর দিতে হয় চরিত্র গঠনের দিকে। এমন বইয়ে এক বা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র থাকে। এখানেও ব্যতিক্রম নয়। সেসব চরিত্রের গভীরতা ফ্যান্টাসি উপন্যাসকে প্রাণ দিতে পারে।
আর থাকে যাদুবিদ্যা। “মহাকাল” যেহেতু রাজা ও রাজ্যের বিষয়, এখানে যাদুবিদ্যা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখানে যুদ্ধ ও এর কলাকৌশল প্রাধান্য। প্রতিটি বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা থাকলে তবেই একটা ফ্যান��টাসি উপন্যাস দারুণ কিছু হতে পারে। লেখক এখানে কেমন করল? সে বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে।
◾ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং :
আমাদের তো ভারতবর্ষের মানচিত্র মনে আছে? এই মানচিত্রই আমাদের গল্পের মূল উপজীব্য। এই অংশটিকে লেখক ছয়ভাগে ভাগ করেছেন। ছয়টি ভিন্ন রাজ্য এখানে প্রবল বিক্রমে রাজত্ব করার চেষ্টায় মত্ত।
একটু ভুল হলো, যে রাজ্যের জোর বেশি, সেই রাজ্যই এখানে প্রতাপের সাথে রাজত্ব করে। আর বাকিরা তার অনুগ্রহ গ্রহণ করে। এখানে সাতটি রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে রাজ্য, তার নাম সাতবাহন। একে একে বিভিন্ন অঞ্চল জয় করে নিজেদের রাজ্যকে প্রসারিত করেছে। কিন্তু অঞ্চল জয় করলেই তো হয় না, তার ফলাফল নিয়েও ভাবতে হয়। রাজ্যের বিস্তৃতি বাড়লেও খুব একটা লাভবান হয়নি সাতবাহন রাজা। কেননা ব্যবসার জন্য তার অঞ্চলকে নির্ভর করতে হয় কেবল মশলা জাতীয় উপাদানের দিকে।
অন্যদিকে শক রাজ্যের বিস্তৃতি বড় না হলেও অর্থ-বৈভবে বাকিদের সমীহ আদায় করে নিচ্ছে তারা। বিশাল কর্মযজ্ঞ চলে তাদের বন্দর ঘিরে। আর কর্মযজ্ঞের মায়াতেই হয়তো মৌমাছির আনাগোনা বাড়ে।
একটি অঞ্চলের একাধিক রাজ্য থাকলে ক্ষমতা, সামর্থ্য বা অর্থের বিষয়ে সবার সমতা থাকে না। সাতবাহনের বিস্তৃতি আর শকের প্রাচুর্য যেমন বিশাল, কলিঙ্গের সেনাবাহিনী তেমন বিশাল। যদিও দরিদ্র রাজ্য হিসেবে তাদের ধরে নেওয়া যায়। তবে কলিঙ্গের রাজধানীকে সৌন্দর্যের প্রতীক বলা হলেও, সে সৌন্দর্যের বর্ণনা পাইনি।
অন্যদিকে বাকি তিন রাজ্য দক্ষিণ ভারতের। যাদের মধ্যে সদ্ভাব নেই। রাজ্যের মধ্যে অন্তর্কোন্দল যেমন বিদ্যমান, তেমনই বাইরের রাজ্যের সাথেও রেষারেষি সম্পর্ক। প্রতিটি রাজ্যই কোনো না কোনো ভাবে একে ওপরের চেয়ে ভিন্ন। প্রতিটি রাজ্যের মধ্যেই বিশেষ কিছু বিষয় আছে, যা আমলে নেওয়ার মতো। কেউ ছলনায় তা কুক্ষিগত করতে চায়, কেউ বা ক্ষমতার বশে।
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় লেগেছে রাজ্য গঠনের মতো করে এর সময় বা দূরত্ব নির্ধারণের মাপকাঠি লেখক নির্ধারণ করেছেন। ফলে এক ধরনের নিজস্বতা ছিল। একই সাথে প্রতিটি রাজ্যের গতিপ্রকৃতি কিংবা ব্যবস্থা, পরিবেশ খুবই যত্নের সাথে লেখক বিশ্লেষণ করেছেন। এখানে লেখকের পরিশ্রমই প্রতিফলিত হয়।
◾যুদ্ধকৌশল ও কূটনীতি :
যেহেতু রাজ্যে রাজ্যে বিভেদ ও বিরোধের ঘটনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে রাজনীতি ও কূটনীতি খুবই প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রতিটি মানুষ নিজেদের কথা ভাবে। নিজেদের সমৃদ্ধ করতে ছলনার আশ্রয় নিতে হয়। হয়তো নৈতিকতা এখানে খুব একটা প্রাধান্য পায় না। তবুও নিজেদের স্বার্থে একটু অনৈতিক হলে ক্ষতি কী?
তাছাড়া নিজেদের কর্মপন্থা নির্ধারণের পাশাপাশি প্রতিপক্ষকে নিয়ে চিন্তা করতে হয়। তাদের পরবর্তী চাল কী হবে সেই ঘটনাক্রম বিবেচনা করে নিজেদের ঘুঁটি সাজাতে হয়। সবসময় প্রতিপক্ষ থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকতে হয়। নাহলে এই কূটচালে নিজেদের বিসর্জন দিতে হয়। বিষয়টা যেমন ঘটেছে কলিঙ্গ সেনাদের সাথে। যুদ্ধক্ষেত্রে যতই বিজয় আসুক না কেন, কখনো নির্ভার থাকা যাবে না। নির্ভার হতে গেলে কখন পেছন থেকে আক্রমণ আসে কেই বা বুঝতে পারে!
লেখক তার লেখার মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছেন যুদ্ধের কলাকৌশলে। এই বিষয়টা খুবই দারুণ লেগেছে। বিভিন্ন পদ্ধতি, কর্মযজ্ঞ যেন বইটির মূল প্রাণ হয়ে উঠেছিল। এক পক্ষ আক্রমণ শানাতে ব্যস্ত, অপরপক্ষ প্রতিরোধে। আবার পরক্ষণেই পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট। প্রতিটি পক্ষকেই যুদ্ধের ময়দানে লেখক সমান সুযোগ দিয়েছেন। তবুও কাউকে তো জিততে হয়। আর বিজয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিজেকে সংযত রাখা। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কখনোই পরিপূর্ণ বিজয় আনতে পারে না। শেষ বেলায় বদলে যায় দৃশ্যপট। কখনো বিজয় ছিনিয়ে আনতে কিছুটা বিসর্জনও করতে হয়। আর এই বইয়ের প্রতিটি লড়াইয়ে সেই বিষয়গুলোই সামনে এসেছে বারবার।
একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো, যুদ্ধের ক্ষেত্রে লেখক অস্ত্রের ঝনঝনানি চেয়ে যুদ্ধের কৌশলে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এই বিষয়টি আমার ভালো লেগেছে। শস্ত্র ও শাস্ত্রের যে সমন্বয় লেখক ঘটিয়েছেন, এখানে লেখকের দক্ষতা প্রকাশ পায়। বিশেষ করে যুদ্ধের বুহ্য ও প্রতিরক্ষা বুহ্যের বর্ণনা বেশ উপভোগ্য ছিল। যুদ্ধ কেবল শক্তিমত্তার প্রদর্শন নয়। এখানে বুদ্ধিতেও শান দিতে হয়। পরিস্থিতি মোতাবেক লড়াইয়ের প্রকৃতি নির্ণয় করতে হয়। আর “মহাকাল” এই বিষয়গুলো ভালোমতোই ছিল।
◾গল্পবুনন ও বর্ণনাশৈলী :
লেখকের লেখার ধরন আমাকে বেশ হতাশ করেছে। তাছাড়া সংলাপ গঠনেও লেখককে বেশ দুর্বল মনে হয়েছে। এই জাতীয় বইয়ের ক্ষেত্রে সংলাপ ও বর্ণনা খুব বেশি দারুণ হতে হয়। যেন পাঠক অনেক বেশি আকৃষ্ট হয়। শুরুর দিকে সেই আকর্ষণ পাইনি। যদিও গল্পের বিস্তৃতি লেখকের সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছে। কিছু জায়গায় বেশ দারুণ বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। আবার কিছু অংশে খুবই দূর্বল মনে হয়েছে।
উপন্যাসের গতি খুব ধীর মনে হয়েছে। ফলে পড়তে গিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছিলাম। মনোযোগ ধরে রাখতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। ধীর হওয়ার অবশ্য কারণ আছে। যেহেতু সিরিজের প্রথম বই, সেক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড বিল্ডিংয়ের একটা বিষয় ছিল। ফলে বিস্তারিত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা খুব জরুরি ছিল বিষয়গুলো।
তবে লেখকের মোটিভেশন ও দর্শন দেওয়ার প্রবণতা একটু বেশি ছিল। আমি বলছি না সব জায়গায় এসবের দরকার নেই, তবে কিছুটা সীমিত করে ফেলা যেত। একই কথার পুনরাবৃত্তিও ঘটেছে এখানে। ফলে উপন্যাসের গতি আরও ব্যাহত হয়েছে। রাজা, মন্ত্রী তাদের আলোচনায় দর্শনের বাণী ছড়িয়ে দিবেন ঠিক আছে; কিন্তু এতটাও থাকার দরকার ছিল না।
“মহাকাল”-এ সাতবাহন ও শক রাজ্য বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তাদের ফাঁকে ফাঁকে চোলা আর কলিঙ্গ কিছুটা আকর্ষণ তৈরি করতে পারলেও বাকি দুই রাজ্য আড়ালেই থেকে গিয়েছে। পরিবেশ পরিস্থিতির চাপে হয়তো জায়গা দেওয়া সম্ভব হয়নি। হয়তো সিরিজের পরের বইটা কূটনীতিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। এছাড়া এক গ্রীক গুপ্তচর এসেছিল এই আর্যবতে। তাদের ভূমিকাও লেখক আড়ালে রেখে দিয়েছেন। হয়তো সময় মতন সে ভূমিকাও সামনে আসবে।
◾চরিত্র :
ফ্যান্টাসি উপন্যাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে চরিত্র। চরিত্রের যত গভীরে যাওয়া যায়, ততটা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এখানে রুদ্রদেব ও অসিতকে লেখক যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, প্রশংসা করার মতন। মানুষের সাথে প্রাণীর যে বন্ধন সেট অসিত ও অঙ্গদের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। আর রুদ্রদেবার বুদ্ধি, ক্ষমতা, দক্ষতার যে চিত্র বইটিতে চিত্রায়িত হয়েছে; গল্পের মূল কুশীলব হিসেবে ধরে নেওয়া যায়।
এখানে সাতবাহন রাজা সাতকর্নী ও শক রাজা নাহাপনাকে বেশ ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। একই সাথে চোলা রাজ্যের রাজা কারিকালাও বেশ জায়গা পেয়েছেন। বাকি রাজ্যের রাজারা সিরিজের এই বইয়ে তেমন স্থান পায়নি। তবে চেরা রাজ্যের রাজা উথিয়ানের শেষ পরিণতি তাকে সে জায়গা দেয়নি।
রাজাদের পাশাপাশি মন্ত্রীদের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যে রাজ্যের মন্ত্রী বুদ্ধিতে যতটা পটু, সে রাজ্যের রাজ্যের রাজা ততটা এগিয়ে থাকে। বুদ্ধির খেলায় মন্ত্রীদের যুদ্ধ “মহাকাল”-এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। আর যে মন্ত্রীর লোভ বেশি, সেই মন্ত্রীর কারণে রাজাকে বিসর্জন দিতে হয় নিজস্ব সত্তা। শেষ পরিণতি কখনোই ভালো হয় না। বইটা মন্ত্রীদের পাশাপাশি বিশেষ সেনাপতিও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বিশেষ করে অ্যালেক আর রিপুজিতের নাম উল্লেখ করতেই হয়।
তবে চরিত্রের দিকে দিয়ে সবচেয়ে দুর্বল বিষয় আমার মনে হয়েছে, বইয়ে শক্তিশালী নারী চরিত্র নেই। তাছাড়া রাজাদের অন্দরমহল এখানে জায়গা পায়নি। রানীদের বর্ণনা নেই। রাজাদের শুধু রাজ্যের দিক নিয়েই চিন্তা করলে হয় না, তাদেরও পরিবার আছে। অন্দরমহলের ঘটনা, রানী, যুবরাজ বা রাজকন্যা থাকলে আরো একটু আকর্ষণীয় হয়ে উঠত। সবসময় মূল গল্পে থাকলে হয় না, কিছু ক্ষেত্রে সাবপ্লটের মাধ্যমে ঘটনাপ্রবাহে বৈচিত্র্য আনতে হয়। এতে একঘেয়েমিতা দূর হয়।
◾বানান, সম্পাদনা ও অন্যান্য :
বিশাল কলেবরের এই বইয়ে চোখে পড়ার মতো বানান ভুল ও ছাপার ভুল ছিল না। যে কয়েকটা চোখে পড়েছে, সেগুলো আমলে না নেওয়াই যায়। তবে লেখক আফসোস বানান আপশোশ লিখেছেন সবক্ষেত্রে। এমন বানান আছে কি না আমার জানা নেই।
প্রোডাকশন কোয়ালিটি নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। এর বড় বই খুলে পড়তে অসুবিধা হয়নি। তবে বেশি বড় বলে হাতে ধরে রাখতে রাখতে হাত ব্যথা হয়ে গিয়েছিল।
এই প্রচ্ছদ আমার ভী��ন পছন্দ হয়েছে। রাজনৈতিক প্রচ্ছদ ঐতিহাসিক, ঐতিহাসিক একটা ভাব আছে। যেটা প্রথম মুদ্রণের প্রচ্ছদে ছিল না।
◾পরিশেষে, শেষের দিকের গল্পটা একটু অন্যরকম হয়ে গেল। যে রুদ্রদেবকে আমরা জেনে এসেছি, তার মধ্যে অসংখ্য রহস্য দানা বাঁধছে। অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। কিছু ঘটনা অসমাপ্ত থেকে গিয়েছে। কিছু লক্ষ্য পূরণ হয়নি। সব থেমে আছে, যায় সূচনা হবে মহাযাত্রার মধ্য দিয়ে। আর এই মহাযাত্রার অপেক্ষায় থাকা সূচনাপর্বের শুরুটা কোথায়? গন্তব্য বা কোথায়?
রাজনীতি, কূটনীতি আর যুদ্ধে পরিপূর্ণ আর্যাবতের রাজরাজড়াদের অ্যাখান, মহাকাল।
বাণিজ্যের মৌসুম চলছে, পুবের পৃথিবী থেকে একের পর এক আসতে শুরু করেছে বাণিজ্য তরী। অথচ খা খা করছে ভারতবর্ষের বিশাল রাজ্য সাতবাহন । তাতেই মহারাজ সাতকর্ণী চিন্তিত, এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে। লক্ষ্মী বিদায় নিলে রাজা আর রাজ্য যে শ্রী হারিয়ে ফেলবে, তাই মন্ত্রীর সাথে পরিকল্পনায় বসেছেন তিনি।
সাতবাহন রাজ্যে যখন বাণিজ্যে দুর্ভিক্ষ চলছে, তারই পশ্চিমে শক রাজ্যে চলছে বাণিজ্যের জোয়ার, তাতেও অবশ্য সন্তুষ্ট নয় রাজা নাহাপনা। সমৃদ্ধ রাজ্যে নজর যেকোনো সময় পড়তে পারে শকুনের নজর তাই রাজ্য রক্ষায় তিনিও বসেছেন মন্ত্রীর সাথে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায়।
দক্ষিণ ভারতে আরো আছে চেরা, চোলো আর পাণ্ড্য নামের ছোটো তিন রাজ্য, যাদের নিজেদের মাঝেই কোন্দল লেগে থাকে নিত্যদিন। চেরা রাজ্যের বাণিজ্য অবস্থা ভালো। বাইরের আর ভিতরের বিদ্রোহ, শত্রুকে পরাস্ত করে চোলা রাজ্যে সদ্য বসেছেন নতুন রাজা, এখনো রাজ্যের পরিস্থিতি টালমাটাল। ঐদিকে পান্ড্য রাজ্য ভাঙ্গতে চায় চেরাদের সাথে বাণিজ্যে চুক্তি, থাকতে চায় না কারো দয়ার নিচে।
এসব রাজরাজড়া নানান ঝামেলার সাথে সম্পর্ক নেই অসিত নামক চালচুলোহীন সাধারণ কিশোরের, তার বানর অঙ্গদকে নিয়ে ভালোই দিনপাত করছিলো সে। তারপর বদলে গেলো সব, অজানায় বেরিয়ে পড়তে হলো হারানো সম্পদের খোঁজে। এদিকে রাতের আধাঁরে ঘুরে বেরাচ্ছে এক অভিশপ্ত যোদ্ধা, মহাকালের পথে অভিশপ্ত জীবন নিয়ে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সেই আগন্তুক, মহাকাল কি ক্ষমা করবে তাকে!!
মহাকাল, দিবাকর দাসের লেখা কল্পনা আর বাস্তবতার মিশেলে এক ভারতবর্ষের কাল্পনিক উপাখ্যান তথা ফ্যান্টাসি উপন্যাস। যেখানে হিন্দু পুরানের আলোকে লেখক এক অন্য ভারতবর্ষকে তুলে এনেছেন। যেখানে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে আছে সাতবাহন, শক, চেরা, চোলা, পাণ্ড্য নামক নানান রাজ্যে শাসিত হচ্ছে নানান সব রাজাদের দ্বারা। যেখানে গল্পের পারায় পারায় বর্ণিত হয়েছে রাজনীতি, কূটনীতি, যুদ্ধের মিশ্রণে এক অনবদ্য গল্প। যেখানে গল্পের পাশাপাশি লেখকের শব্দ নিয়ে খেলা উপভোগ করেছি দারুণ ভাবে।
মহাকালের রাজা সাতকর্ণী, রাজা নাহাপনা, গীরিধারি, অসিত, রুদ্রদেব সহ প্রতিটি চরিত্রই চোখে পড়ার মতো। লেখক মহাকাল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পের আবহ, প্রতিটি ঘটনা, দৃশ্যপটকে পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে উপস্থাপন করেছেন। বিশেষ করে প্রাচীন যুদ্ধাস্ত্র সংবলিত যুদ্ধগুলোর বর্ণনা, যুদ্ধ রীতি বেশ চমৎকার ভাবে বর্ণনা করেছেন। সাথে গল্পের সবথেকে হাইলাইটস এ থাকা রাজনীতি আর কূটনীতির বর্ণনাও উপভোগ্য ছিলো।
গল্পে সবথেকে উপভোগ করেছি অসিত এবং রুদ্ধদেবকে, সাথে গিরিধারীর কূটনৈতিক কৌশলগুলোও চমকে দেওয়ার মতো।
এধরণের গল্প বর্ণনায় দর্শনও গল্পের বিষয়বস্তু, মহাকালেও তার উপস্থিত ছিলো। তবে মাঝেমধ্যে লেখক তার পরিমাণ এতো বেশি দিয়েছেন যে বিরক্তবোধ করেছিলাম। বিশেষ করে প্রতিটি চরিত্রের দার্শনিক চিন্তা দৃষ্টিকটু লেগেছে। গল্প বর্ণনার ক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় লক্ষ করেছি। লেখকের 'তবে' এবং এ জাতীয় শব্দ বিশেষ করে 'এই' শব্দটা মাঝে মাঝে অনেক প্যারাতে এতো বেশি পেয়েছি যে যা পড়তে ভালো লাগেনি।
মহাকাল ধীরস্থির ফ্যান্টাসি উপন্যাস, এখানে লেখক পৃষ্ঠাতে পৃষ্ঠাতে থ্রিল রাখেননি, জাদুবাস্তবতারও উপস্থিত ছিলো খুবই নগণ্য। মহাকালের বিশেষত্ব এর বর্ণনার শব্দ প্রয়োগে, গল্পে সবথেকে বেশি জায়গা জুড়ে ছিলো রাজনীতি আর কূটনীতি। তাই ধীরস্থির রাজরাজড়াদের রাজনীতি, কূটনীতি, যুদ্ধ যারা পছন্দ করেন তারা বইটি পড়তে পারেন, তবে খুব বেশি গতিশীল কাহিনির আশা করলে হতাশ হতে হবে। অবশ্য এই ধরনের বইয়ের ক্ষেত্রে গতিশীল হলেই গল্প উপভোগে ব্যাঘাত ঘটায়।
সুবিশাল বইখানা পড়তে গিয়ে একটা বিষয় খেয়াল করেছি যে বইটিতে বানান ভুল প্রায় নেই বললেই চলে, সাথে বইটার প্রোডাকশন, প্রচ্ছদ বরাবরই দারুণ হয়েছে। বিশেষ করে বইটি রাউন্ড বাইন্ডিং করায় পড়তে আরাম বোধ করেছি, এই ধরনের বড়ো বইয়ের ক্ষেত্রে রাউন্ড বাইন্ডিং আমার খুবই পছন্দের।
আর হ্যাঁ, মহাকালের সমাপ্তি টানটান উত্তেজনাকর হলেও 'শেষ হয়েও হইলো না শেষ' ধরনের অনূভুতি দিয়ে দিয়েছে।
ঔপন্যাসিক দিবাকর দাসের সুবিশাল উপন্যাস "মহাকাল"। ৬০৮ পৃষ্ঠার ঢাউস বইটা এক মহাকাব্যিক আখ্যান। প্রাচীন ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা এই উপন্যাসের নায়ক হলো " সময়"। সব চরিত্রেরা যেন কালের নিয়তি। রাজ্য জয়ের চেয়ে যখন পশ্চিম থেকে আসা ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যবসা করা ও তার নিয়ন্ত্রণ করা রাজ্যের আধিপত্য বিস্তারের মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে, ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রবল হয়ে ওঠে। সময়কাল তখন দুশো কিবা তিনশো শতক। সময়কাল বোঝা যাচ্ছিল লেখকের আবহ সৃষ্টির মাধ্যম দেখে৷ সময়, দূরত্ব, খাদ্যাভাস, পরিচ্ছদ এসব নিয়ে খুব যত্নের সাথে পুরনো সময়কে ধারণ করেছেন, এবং পুরনো একক বা নামগুলো ব্যবহার করেছেন। লেখক বইয়ে অনেকগুলো ট্রিবিউট করেছেন বা অনুপ্রাণিত হয়েছেন প্রাচীন ভারতের ইতিহাস থেকে। সাতবাহন রাজ্যের মন্ত্রী গিরিধারীকে লাগছিল চাণক্য'র মতো। তার কূটচাল মনে করিয়ে দেয় চাণক্যের কথা। বইয়ে অসংখ্য সমরনীতি, কূটনীতি, রাজনীতি, যুদ্ধ জ্ঞান, যুদ্ধাস্ত্র- এসব নিয়ে সূক্ষ্মভাবে লেখা লেখকের পূর্বপ্রস্তুতি জানান দেয়। এই বইটা যেন মহাভারতের জানালা। সুবিশাল উপন্যাসে এত এত চরিত্রের সমাগম এবং তাদের পরিণতির জন্য লেখককে সাধুবাদ জানাই। তবে, উপন্যাসে অসিত চরিত্রকেই খুব কাছের লেগেছে। তার ব্যক্তি জীবনের আশা আকাঙ্খা, প্রেম-কাম, হতাশা, দুঃখ জানতে পেরেছি। অসিত ইন্দ্রপুর গ্রামে বানর দেখিয়ে উপার্জন করে। তার কাছে পৌঁছানোর জন্য কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। কিন্তু উপন্যাসের বাকি চরিত্ররা যেন রাজপ্রাসাদ আর যুদ্ধের ঘেরাটোপে বাধা পড়ায় তাদের স্পর্শ করতে পারিনি। তাদের ব্যক্তিগত জীবনের গল্প জানতে পারিনি। ছিল না কোনো রানী বা অন্য কোনো নারী চরিত্রের কথা, কেবল রাঁধা ছাড়া। তাও দেখেছি অসিতের চোখে। লেখকের স্টোরি টেলিং অপূর্ব। কোনো ফাঁকি নেই৷ তার ন্যারেটিভগুলো উপভোগ করেছি। তবে, উপন্যাসের মাঝে অনেকখানি সমরনীতি, কূটচালে একঘেয়েমি চলে এসেছিল। তাই খুব দ্রুত পাতা উল্টিয়ে পড়তে হয়েছে। বইয়ের শেষ তৃতীয়াংশ দ্রুত গতিতে পড়েছি। যুদ্ধ, ব্যুহ, সমরাস্ত্রের গল্পে জমজমাট হয়ে উঠেছিল বইটা যেন ��ক টুকরো কুরুক্ষেত্র। তবুও শেষ হয়েও যেন শেষ হয় না। কিছু কিছু চরিত্রের পরিণতি অসম্পূর্ণ থাকায় আরও জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পটা। বইয়ের প্রচ্ছদ, বাঁধাই সর্বোপরি বইয়ের প্রোডাকশন চমৎকার।। এ সময়ে এত বড় উপন্যাস লেখার ধৈর্য ও সেই কাজ সম্পাদনের জন্য ভালোবাসা রইল লেখকের প্রতি। আশা করছি আরও চমৎকার সব কাজ পেতে যাচ্ছি। বইটা পড়ার জন্য রেকমেন্ডেশন রইল।
বই পরিচিতি:
বইয়ের নাম- মহাকাল লেখক- দিবাকর দাস পৃষ্ঠা সংখ্যা - ৬০৭ মুদ্রিত মূল্য- ১০০০/ প্রকাশনী- চিরকুট
পর্যালোচনা: "মহাকাল" যেন এক মহাকাব্যিক আখ্যান, যেখানে সময় নিজেই নায়ক। প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই উপন্যাস পাঠককে ফিরিয়ে নিয়ে যায় দুই থেকে তিন শতকের প্রাচীন পৃথিবীতে। এখানে রাজ্যজয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বাণিজ্যের আধিপত্য। যুদ্ধের ময়দানে রাজাদের দ্বন্দ্ব, মন্ত্রীর ষড়যন্ত্র, আর বুদ্ধির খেলা—সব মিলিয়ে এটি শুধু গল্প নয়, বরং এক ঐতিহাসিক চিত্রকল্প।
উপন্যাসটি শুরু থেকেই টানটান উত্তেজনা তৈরি করে। সাতবাহন রাজার চিন্তার গভীরতা, অমরাবতীর মতো রাজ্যের বন্দরের ক্রমহ্রাসমান গুরুত্ব, এবং বিদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা পাঠককে প্রাচীন ভারতের বাণিজ্যকেন্দ্রিক রাজনীতির এক জটিল জগতে প্রবেশ করায়। লেখক দিবাকর দাস অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সময়, দূরত্ব, খাদ্যাভ্যাস, এবং জীবনযাত্রার বর্ণনা তুলে ধরে উপন্যাসটিকে জীবন্ত করে তুলেছেন।
তবে, উপন্যাসটির সবচেয়ে বড় শক্তি এর সময়ের নিখুঁত উপস্থাপন। লেখকের বর্ণনায় কালের প্রবাহ যেন পাঠকের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। বইটিতে ষড়যন্ত্র, কূটনীতি, বীরত্ব আর পরাজয়ের গল্প একসূত্রে গাঁথা।
যদিও বইটি অসাধারণ, একটি মানচিত্রের অভাব অনুভূত হয়েছে (আমার বইটা প্রথম সংস্করণ, নতুন যেটা কয়দিন আগে বাজারে এসেছে এখানে হয়ত আছে)।
"মহাকাল" পড়ার অভিজ্ঞতা কেবল একটি বই পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি ঐতিহাসিক সময়কে অনুভব করার সুযোগ।
মহাকাল বই পরিচিতি বই- মহাকাল (পলিটিকাল, মিথলজিক্যাল, হিস্টোরিক্যাল ফিকশন) লেখক- দিবাকর দাস প্রচ্ছদ- Riajul Islam Xulian (এতো চমৎকার প্রচ্ছদের জন্য বিশেষভাবে প্রশংসার দাবীদার লোকটা) প্রকাশনা- চিরকুট ( মাফিউল কাদির আদন কেও ধন্যবাদ জানাতে চাই এতো বিশাল কলেবরের বইটা ছাপানোর গাটস দেখানোর জন্য) মলাট মূল্য- ১০০০ পৃষ্ঠা সংখ্যা – ৬০৮ (বইটি সম্ভবত অনায়াসেই ৮০০ পৃষ্ঠায় ছাপা সম্ভব হতো। পাঠকের পকেটের কথা চিন্তা করেই হয়তো লেখক প্রকাশক ৬০৮ পৃষ্ঠায় ছেপেছেন) প্রকাশকাল - বইমেলা ২০২৩
কাহিনী সংক্ষেপ
মহাকালের সময়কালটা হলো প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার সময়। আমাদের থ্রিলার সাহিত্যের বেশ কিছু ফিকশনে আমরা অনেক পূর্ববর্তী সময়কালের গল্প পড়েছি। সেসব গল্পে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পূর্ববর্তী সময়ের সাথে বর্তমান সময়ের সমন্বয় করে একসূত্রে গাঁথা হয়েছে। কিন্তু মহাকালে তা করা হয়নি। মহাকালে ২০০০ বছর আগেকার সময়ের রাজা রাজরার রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে সেই সময়কালের কিছু চরিত্রের জীবনের উত্থান পতন দেখানো হয়েছে।
মহাকাল খুব সাধারণ একজন বালক অসিতের গল্প। যে ক্ষত্রিয় হলেও যুদ্ধবিদ্যার কিছুই জানতো না। অনাথ এই ছেলেটির জীবনের লক্ষ ছিলো খুবই সাধারণ, আটপৌরে। যে তার পোষা বানর অঙ্গদের মাধ্যমে খেলা দেখিয়ে জীবন যাপন করে। গ্রামের অতি সাধারণ একটা মেয়ে রাঁধাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার সময়েই তার জীবনে ঘটে গেল বিপর্যয়। অঙ্গদ হারিয়ে গেল তার জীবন থেকে। কী এমন ঘটলো, যাতে গ্রামের সাধারণ একটা ছেলের ভাইসম বানর অঙ্গদকে হারিয়ে ফেলতো হলো? কেন তাকে পাড়ি দিতে হলো মহাকালের পথ?
এই গল্প মহারাজ সাতকর্ণীর। দুই হাজার বছর আগের ঐ সময়ে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বেশি অংশের মহারাজ ছিলেন সাতকর্ণী, তিনি ছিলেন সাতবাহনদের সম্রাট। মহারাজ সাতকর্ণীর নিজেকে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, এবং এই বংশের সবচেয়ে যোগ্য রাজা হয়ে উঠেছিলেন। তবে তার রাজ্য চারিদিকে বেড়ে এখন পুরো মধ্য ভারতই মহারাজের আয়ত্তে চলে এলেও, ভারতে বাণিজ্য করতে আসা ভিনদেশী জাহাজগুলো তার বন্দরগুলোতে আসছে না। এই সমস্যার সমাধান করার জন্য যা করার দরকার, তার সবই করতে চান তিনি। তাই নিজের বহুদিনের মন্ত্রীকে পরিবর্তন করে নতুন মন্ত্রীপদ দিলেন রাজনীতির কূটনীতিতে দক্ষ ব্রাহ্মণ গিরিধারীকে।
এই গল্প মহারাজ সাতকর্ণীর মন্ত্রী গিরিধারীর। ব্রাহ্মণ হলেও তার ভালো লাগতো শাস্ত্রের নীতি আর কূটনীতির অংশগুলো। মহারাজ সাতকর্ণীর রাজ্য চালনা এবং যুদ্ধ পরিচালনায় প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার পরিচয় তিনি দেখিয়েছিলেন। তবে তার সেসব বুদ্ধিমত্তা কি শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছিলো? মহারাজা সাতকর্ণীকে কি তিনি সফল করতে পেরেছিলেন?
পশ্চিম শক রাজ্যের রাজা নাহাপনারও গল্প এটি। মহারাজ সাতকর্ণী আলো বাণিজ্য করতে না পারলেও রাজা নাহাপণা ভারতে চুটিয়ে বাণিজ্য করছেন তখন। তবে তিনি নিজের এবং শক রাজ্যের নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকেন। যেমন করে জানেন, গুপ্তঘাতকের কাছ থেকে নিজেকে কীভাবে রক্ষা করতে হয়, তেমনি এও জানেন, মধ্য ভারত অধিকার করে থাকা সাতবাহন রাজ্যের সীমা এখন তার রাজ্যের উপকণ্ঠে চলে এসেছে। তাই শত্রু আঘাত করার আগেই শত্রুকে পাকে ফেলার জন্য নিজের মন্ত্রী সারথীর সাথে পরিকল্পনা করতে শুরু করেছেন। শত্রুর শত্রু কলিঙ্গ রাজ্যকে নিজেদের মিত্রে পরিণত করার চাল চাললেন তিনি। সেক্ষেত্রে কতটা সফল হলেন তিনি?
দক্ষিণ ভারত তিন রাজ্যে বিভক্ত। চেরা, চোলা আর পাণ্ড্য। তিন রাজ্যই একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে আসছে প্রাচীন কাল থেকে। চেরা রাজ্যের বন্দর মুঝিরিস ব্যবসায় অনেক ভালো করছে। ফলে এই রাজ্যের মন্ত্রী ভেরাপ্পন রাজা উথিয়ানকে তার মহারাজ সাতকর্ণীর শত্রুতা সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে তারা পাণ্ড্য রাজ্যের সাথে সন্ধি করে নিয়েছেন নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। তবে পাণ্ড্য রাজা বাণিজ্যিক চুক্তি চেরাদের সাথে বাণিজ্যিক চুক্তি করলেও তিনিও চাচ্ছেন না অন্য কারো দয়ায় বেঁচে থাকতে। তারও চাই নিজস্ব স্বাধীনতা।
চোলা রাজ্যের তরুণ রাজা কারিকালারও গল্প এটি। বাইরের শত্রুর ভয় আছে তো বটেই, চোলা রাজ্যের সাবেক মন্ত্রী পরিষদও আঘাত হানতে পারে যেকোনো সময়ে। এক্ষেত্রে তার জন্যই বা সঠিক পরিকল্পনা কোনটি হবে?
এই গল্প রুদ্রদেবেরও। ৩০০০ বছরের পুরনো অভিশাপ কাটিয়ে যে জীবনে সে ফিরেছে, সেই জীবনে সে কি তার দায়িত্ব পালন করতে পারবে? সে যে এক নাদান মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার ভার নিয়েছে, সেই দায়িত্বই কি পূরণ করতে পারবে?
পাঠ প্রতিক্রিয়া
দিবাকর দাস সম্ভবত তার জীবনের সেরা বইটি লিখে ফেলেছেন, এই জীবনে যদি আর কোনো বই তিনি না লেখেন তাও মহাকাল তাকে মনে রাখবে; মহাকাল তাকে মনে রাখতে বাধ্য করবে। এক কথায় যদি বইটিকে ব্যাখ্যা করতে চাই, তাহলে আমি এই লাইনটিই বলবো। একজন লেখক যখন তার জী���দ্দশার শেষ প্রান্তে পৌঁছান, তখন এনালাইসিস করা যায়, তিনি লেখক হিসেবে ঠিক কতটা সফল। কিংবা তার লেখা বইগুলোর মধ্যে কোন লেখাটি তাকে অমর করে রাখবে। দিবাকর দাসের ক্ষেত্রে এই কথাটি আমি এখনই অনায়াসে বলতে পারি।
আগেই বলেছি, এটা ২০০০ বছর আগেকার ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে রচিত বই। আমার কাছে শুরুতেই যেটা চমকপ্রদ লেগেছে, তা হলো বইয়ের ভাষাশৈলী। লেখক চেষ্টা করেছেন বর্ণনাভঙ্গী থেকে শুরু করে কথোপকথনেও ২০০০ বছর আগেকার সময়ের ভাষাশৈলীর ব্যবহার করতে। (যদিও আমি জানি না, ২০০০ বছর আগের ভাষা শৈলী আসলেই কেমন ছিল। তবে বইয়ে দিবাকর দাসের লেখনীশৈলী পড়ে প্রাচীন কোনো লেখকের লেখা বলেই মনে হয়েছে।) শব্দচয়ন করা হয়েছে খুবই সাবধানে, যেটা অনেক বেশি ভালো লেগেছে।
ইতিহাস, পুরাণ, হিন্দু মিথলজি মিলেমিশে একাকার হয়েছে এই বইয়ে। ভারতবর্ষের এমন একটা ইতিহাস নিয়ে লেখা হয়েছে বইটা, যে ইতিহাসের খবর আমরা বেশিরভাগ পাঠক জানিই না। লেখক চেষ্টা করেছেন, সেই ইতিহাসটিকে মহাকালের মাধ্যমে ধরে রাখতে। দুই লাখ শব্দের এই মহাগল্পটা বলতে গিয়ে লেখক খেই হারাননি। কোথাও মনে হয়নি গল্পটার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। পাঠককে গল্পের দিকে ধরে রাখতে পেরেছেন চমৎকারভাবে।
মহাকালের একমাত্র যে ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি, সেটা হলো, বইয়ের প্রতিটি চরিত্রই ভীষণ মাত্রায় দার্শনিক। বর্ণনায় বার বার দার্শনিকতা উঠে এসেছে। দিবাকর দাসের অন্যান্য বইয়েও এই ফ্লেভারটা আছে, সেসব বইয়ে এই দার্শনিক ভাবটা ভালোই লেগেছে আমার। কিন্তু বিশাল কলেবরের বই হওয়ায় এই বইয়ে প্রতিটি ক্যারেক্টারের দার্শনিকতার বয়ান পড়তে ভালো লাগেনি আমার। যা বুঝলাম, কলেবর বড় বলেই এই বিরক্তিটুকু এসেছে, তবে এটা নিতান্তই আমার মত। অন্যান্য পাঠকের কাছে এটা ভালো লাগতে পারে।
পুরান, মিথোলজি আর ঐতিহাসিক উপন্যাসে আগ্রহ থাকলে এই বইটির অবশ্যই আপনার বাকেটলিস্টে থাকা উচিৎ।
খুব একটা টানতে পারেনি বইটা। লেখকের লেখনী খুব একটা ভালো নয়। তারপর 'বজ্রাসনে দাঁড়িয়েছে' এরকম টাইপের ভুলভাল কথা কাহাতক সহ্য করা যায়? তাই ৭৯ পৃষ্ঠার বেশি আর এগানো যায়নি।
🖇️📜সদ্য পড়ে শেষ করলাম সাহিত্যিক দিবাকর দাসের লেখা ‘মহাকাল’ উপন্যাসটি। রাজায় রাজায় যুদ্ধ, তাদের রাজনীতি, তাদের রাজ্য জয় এসব আমরা ছোট থেকেই ইতিহাসের পাতায় পড়ে আসছি। সে সব নিয়ে বিশেষ কিছু না বলে, আমার নজরে ভালোলাগার দিকটা তুলে ধরছি রিভিউ এর মাধ্যমে। গল্পের বিশেষ চরিত্র গ্রামের ছেলে ‘অসিত’ আর তার বানর ‘অঙ্গদ’। আর আছে রুদ্রদেব.....
🪔এই বই শুরু করার সময় বেশ ভয় পেয়েছিলাম, কেমন হবে না হবে। মোটাসোটা একটা বই হাতে নেওয়ার আগে যেমন চিন্তা ভাবনা আসে আর কি। তবে শুরু করার প্রথম দিনই ১০০ পেজ Complete হয়ে যায়। এই উপন্যাসের গতি ভীষন ভালো, এতটুকু বোর করেনি বরং ভীষন Enjoy করে পড়েছি।
🪔একটা মানুষ যে কিনা তিন হাজার বছর অভিশাপ নিয়ে বেঁচে আছে। তিন হাজার বছর পর মহাদেবর আশীর্বাদে সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়। স্বয়ং মহাদেব তার নামকরণ করে “রুদ্রদেব”! উপন্যাসে রুদ্রদেবের চরিত্র ভীষন গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একজন দক্ষ তিরন্দাজ এবং একজন গুরু। উপন্যাসের শেষের দিকে এসে তিনি একজন যোগ্য সেনাপতি। আশা রাখছি পরবর্তী অংশে রুদ্রদেবের রহস্য সম্পূর্ণ প্রকাশ পাবে।
🪔 গ্ৰামের ছেলে অসিত। তার বাবা মা কেউ আর বেঁচে নেই, রয়েছে শুধু তার বানর ‘অঙ্গদ’। যাকে নিয়ে সে বিভিন্ন গ্ৰামে ঘুরে ঘুরে খেলা দেখায়। সেই বানর একদিন খেলা দেখাতে গিয়ে আগুনে পুড়ে যায়, গ্ৰামের বৈদ্য তাকে চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলে। এর পরই অঙ্গদের সর্বাঙ্গ রামধনু রং এ পরিনত হয়। এর পর অসিত অঙ্গদকে নিয়ে বেশ দূরে দূরে যায় খেলা দেখাতে যেতো এবং বানর সর্বাঙ্গ রামধনু রং হওয়ার কারণে তার রোজগার ও বৃদ্ধি পায়। ঠিক এমন সময় রাহুর চোখ পরছ অঙ্গদের উপর, অসিতের বিশ্বাস অর্জন করে রাহু অঙ্গদকে নিয়ে পারি দেয় অন্য রাজ্যের উদ্দেশ্য। এর পর থেকেই শুরু হয় অসিতের সংগ্ৰাম ........ এই সংগ্ৰামে অসিতের জন্য ঠিক কী অপেক্ষা করে আছে? অসিত কি পারবে তার অঙ্গদ কে উদ্ধার করতে?
📚💐 গল্পের বুনন ভীষন ভালো। ইতিহাসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এমন সুবৃহৎ উপন্যাস এর আগে কখনো পড়া হয়নি। এক কথায় বলতে গেলে অসাধারণ একটি উপন্যাস। যে সকল পাঠক ইতিহাস সম্পর্কিত উপন্যাস পড়তে পছন্দ করেন তারা এই বই অবশ্যই পড়বেন। সেই সময়ের নিখুঁত বর্ননা, বিশেষ করে যুদ্ধের বর্ননা.... লেখকের ভাষার ব্যবহার ভীষন সুন্দর যা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেই কারণে এই সুদীর্ঘ উপন্যাস পড়তে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি, মাএ ৫ দিনেই complete করে ফেলেছি। এছাড়াও বইটির বাঁধাই ও Page Quality ভীষন সুন্দর। উপন্যাসের শেষটা টানটান উত্তেজনাকর হলেও, শেষ হলো না। পরবর্তী অংশের অপেক্ষায় রইলাম। লেখকে অসংখ্য ধন্যবাদ এতো সুন্দর একটা বই পাঠকদের উপহার দেওয়ার জন্য!
📌রাজাকে অহংকার কখনোই শোভা পায় না। অহংকারী এমন এক প্রজাতির মানুষ, যাকে মারতে যমের প্রয়োজন হয় না। অহংকারী ব্যক্তিকে নিজের অহংকারেই মারে। যেখানে সতর্ক থাকার সুযোগ আছে সেখানে শুধুশুধু বিপদের সামনে যাওয়া নির্বুদ্ধিতা।’
📌মানুষ মাত্রই জীবনে ভয়ের নানা বস্তু থাকবে। আর সেই ভয়গুলোকে অতিক্রম করেই পূর্ণ সাহস অর্জন করে নিতে হয়!
📌মানুষের মনে কোনো অনুভূতিই বেশিদিন তীব্র অবস্থায় থাকে না। ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক যে-কোনো অনুভূতির ক্ষেত্রেই এই কথা সত্য। কারো প্রতি তীব্র ঘৃণা, রাগ, হিংসা পুষে রাখা অনেক কঠিন আবার কারো প্রতি তীব্র ভালোবাসা, আকর্ষণ বজায় রাখাও অনেক শক্ত কাজ!
২০২৪ এ পড়া প্রথম বই। দিবাকর দাসের লেখা ' মহাকাল'। যেখানে সমরনীতি, ষড়যন্ত্র, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি প্রদর্শনের এক অসাধারণ মেলবন্ধন রয়েছে। প্রাচীন ভারতে নিজের রাজ্য শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য বা কোনো কোনো সময় অন্য রাজ্য দখলের জন্য প্রায়ই যুদ্ধ করতে হতো। সেখানে রাজনৈতিক নানা কূটকৌশল, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা সব দেখা যেত। ঠিক এমনকিছুর সংমিশ্রণে তৈরি দিবাকর দাসের মহাকাল বইটি। যেখানে রাজনীতি, সমরনীতি বাদেও দেখা যাবে এক কিশোরের জীবনযাত্রা,সে কীভাবে এসব রাজ-রাজারের যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে যায় এবং তার পাশাপাশি দেখা যাবে সনাতনী এক চরিত্রকে।
কাহিনি সংক্ষেপ: সাতবাহন রাজ্যের সম্রাট মহারাজ সাতকর্ণী একজন যোগ্য রাজা হিসেবে বিবেচিত।কিন্তু সমস্যা একজায়গায়,তা হচ্ছে বাণিজ্য। তার বন্দরগুলোতে কোনো বিদেশি জাহাজ আসছে না। অন্যদিকে শক রাজ্যের রাজা চুটিয়ে বাণিজ্য করছেন। এই কারণে শত্রুদের নজরেও ভালোভাবে পরেছেন তিনি। শুরু হলো বুদ্ধি, কূটকৌশল, ষড়যন্ত্রের সংমিশ্রণে এক অভাবনীয় যুদ্ধ। যেখানে যুক্ত হয় দ���্ষিণ ভারতের অন্যান্য রাজ্যও। এখন এই যুদ্ধে কে জিতবে, কে হারবে তা তো সময়-ই বলবে। অসিত পনের-ষোলো বছরের এক কিশোর,যার কাজ হচ্ছে বানর নাচ দেখিয়ে আয় রোজগার করা। আবার,দেখা যায় বনের অন্ধকারে ঘুরতে থাকা এক রহস্যময় যুবককে। কি উদ্দেশ্য তার? অসিত ও এই রহস্যময় যুবক কীভাবে একে অপরের দেখা পায় এবং কীভাবেই তারা এই যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে পরে?
পাঠ প্রতিক্রিয়া: মহাকালের এক অসাধারণ জার্নি এনজয় করলাম বিগত কয়েকদিন যাবত। শুরুর দিকে একটু কষ্ট হচ্ছিল সব চরিত্রগুলো বুঝতে। কিন্তু যত এগোচ্ছিলাম ততবেশি স্মুথ হচ্ছিল। লেখকের লেখার গাঁথুনি বেশ প্রশংসনীয়। প্রতিটি যুদ্ধের বর্ণনা পড়ার সময় খুব ভালোই থ্রিল পেলাম। পড়েই ভালোভাবে ভিজুয়ালাইজ করা যাচ্ছিল যে ঐ সময়ে সিনগলো কেমন চলছিল। এছাড়াও অসিত ও তার অঙ্গদের কাহিনি থেকে শুরু করে রুদ্রদেব, সাতকর্ণী,নাহাপনা, চেরা,পাণ্ড্য,চোলাসহ আরও নানা ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে একের পর এক সাজিয়েছেন তা প্রশংসার যোগ্য। মোটকথা,পাঠক এই বইটি পড়ে বেশ আরাম পাবে। অসিত,রুদ্রদেব বাদে সবচেয়ে মজাদার চরিত্র হিসেবে মন্ত্রী গিরিধারী পাঠকের মনে ভালোই জায়গা করে নিবে।ওঁকে নিয়ে সম্রাট সাতকর্ণীর মন্তব্যটি একেবারে যথার্থ। রুদ্রদেব যাঁকে আমরা ছোটবেলা খলচরিত্র হিসেবে পড়ে বা দেখে এসেছি সে রীতিমতো নায়ক বনে গেছে। পড়ার সময় সত্যিই মনে হচ্ছিল মহাকাল আসলেই কি তাঁর উপর কৃপা করেছিলেন না কি এখনও অবধি অভিশপ্ত জীবন কাটাচ্ছেন তিনি? আর বেশি কিছু লিখছি না,মনে হচ্ছে আরও কিছু লিখলে স্পয়লার হয়ে যাবে। সবশেষে বলবো, ২৪ এর শুরুতে এরকম একটা বই পড়ে আত্মিক শান্তি পেলাম এবং এই বই দিয়ে-ই নিজের রিডিং ব্লক কাটালাম। আশা করি মহাযাত্রা যাত্রাও দারুণ উপভোগ করবো। লেখকের জন্য শুভকামনা।
অনেকদিন পর বিশাল কলেবরের একটা বই পড়লাম। ইতিহাস আশ্রিত এই উপন্যাসটি এক কথায় অনন্য। ভারতবর্ষের ইতিহাসনির্ভর গতানুগতিক কাহিনীগুলোয় যু্দ্ধ ও রাজ্যজয় ছাড়া সচারচর আর কিছুর দেখা মেলে না। মহাকালে রাজা মহারাজাদের দুঃসাহসিক কর্মকান্ডের সাথে সাথে তাদের মন্ত্রিদের কূটনিতীর খেলাও খুব সুনিপূন ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সাতকর্নির মন্ত্রি গিরিধারীর বুদ্ধি ও কূটচাল দেখে আশ্চর্যান্বিত হতে হয়েছে বার বার। বলতে গেলে কাহিনীর সিংহভাহ টুইস্ট ই তার কূটনিতীর ফল। প্রাচীন ভারতে রাজা মহারাজাদের শাসনে একজন বুদ্ধিমান মন্ত্রনাদানকারিদের যে কি গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা ছিলো তা লেখক তার গল্পে গিরিধারী, ভেরাপ্পন, সারথি এদের চরিত্রের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন। মন্ত্রনাদানকারী যদি দুরদর্শি ও বিশ্বস্ত না হয় তাহলে বড় বড় প্রতাপশালীরও ধুলায় লুটিয়ে পড়তে সময় লাগে না।
গল্পের আরেকটা আকর্ষনিয় দিক ছিলো রুদ্রদেব ও অসিতের চরিত্র। যদিও গল্পের মূল অংশে তাদের ভূমিকা বেশ কম। গল্পের আলংকারিক চরিত্র হিসেবেই তাদের দুজনের আবির্ভাব বলা যায়। গোখরা সম্মোহন ছাড়া রুদ্রদেবের আর এমন কোন গুনের দেখা মেলেনি যা কোন পৌরানিক চরিত্র বিনা সম্ভব ছিলোনা। আশা করছি পরবর্তি সিক্যুয়েলে রুদ্রদেব ও অসিতকে অপরিহার্য কোন ভূমিকায় দেখা যাবে।
কাহিনীতে লেখক লেখনির মাধ্যমে যুদ্ধকলার যে স্বরূপ ফুটিয়ে তুলেছেন সেটা প্রশংসার দাবিদার। খুটিনাটি বিষয়গুলো এত বিশদভাবে বর্নণা করা হয়েছে যে পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিলো চোখের সামনেই ঘটছে সব। বুহ্য, যুদ্ধক্ষেত্র, সমরসজ্জা, সেনাদলের কার্যক্রম সবটাই ফুটে উঠেছিলো পরিস্কারভাবে। তবে বিশেষ কিছু অস্ত্র যেমন ভল্ল, উরুমি এসবের বর্ননা না থাকায় এগুলোর স্বরুপ বোঝা যায়নি। আমাকে গুগুল করে দেখতে হয়েছে। বইয়ের সাথে তখনকার সময়ের রাজ্যগুলোর অবস্থান চিহ্নিত করা একটা মানচিত্র থাকলে পাঠকদের জন্য আরো সহায়ক হতো। গল্পের মাঝামাঝি খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম, তখন গুগুল করে সেই সময়ের একটা মানচিত্র দেখে নেয়ায় আমার বেশ সুবিধা হয়েছিলো। তবে একটা কথা ঠিক বইটা বিরতি দিয়ে পড়ে গল্পের খেই হারিয়ে ফেললে টুইস্টগুলো বেশি ধাক্কা দিবে।
এই লেখাটি লেখকের লেখকজীবনের একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এতবড় কলেবরে বিশাল এক উপখ্যান লেখা চাট্টিখানি কথা নয়। যে পরিমান ধৈর্য, গবেষনা, পরিশ্রম দরকার হয়েছে এই কাহিনীর রুপায়নে তা কল্পনাতীত। পরের সিক্যুয়েলে আরো চমকের অপেক্ষায় রইলাম।
৭৩৩ পৃষ্ঠার ফিকশন, তাও আবার প্রাচীন ভারতীয় পটভূমিতে। বেশ সময় নিয়েই বইটা নিয়েছিলাম। বইটির অনেকগুলো ভালো দিক আছে। ১। বইটির কাহিনীর কলেবর, ভারতের মধ্য এবং দক্ষিণাংশ নিয়ে এরকম বিশাল ফিকশন লিখা দারুণ ব্যাপার। ২। বই এর শুরুতে প্রাচীন ভারতের মানচিত্র এবং রাজা+মন্ত্রীদের তালিকা দিয়ে দেয়া। প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত আমি কিছুক্ষণ পরপর ভুলে যাচ্ছিলাম কোন রাজ্যের অবস্থান কোথায় এবং কে কোথাকার রাজা। পরে অবশ্য মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। ৩। গল্পকথন বেশ চমৎকার। কোথাও হোঁচট খেতে হয় না। একটু স্থির হয়ে বসলে দীর্ঘক্ষণ পড়া যায়। ইদানিং অনেকে ঐতিহাসিক থ্রিলারের নামে 'যা-তা' লিখে চলেছেন। তাদের উচিত দিবাকর দাস এর কাছ থেকে শেখা। বইটির যে বিষয়গুলো আমার পছন্দ হয় নিঃ ১। বই এর মানচিত্রে রাজ্যগুলোতে বর্তমান বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান নেই। কলিঙ্গ রাজ্য বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে শেষ কিংবা শকরাজ্যগুলো ঠিক পাঞ্জাব এবং সিন্ধু সিমান্তে গিয়েই সমাপ্ত হয়েছে - এরকমটা দেখতে বিরক্ত লেগেছে। ২। সাতবাহন রাজ্যকে জয়ী করতে গিয়ে বাকি রাজ্যগুলোর বুদ্ধিমত্তা এবং গুপ্তচরবৃত্তিকে যেভাবে অথর্ব বানানো হলো তা বাজে লেগেছে আমার কাছে। সাহতবাহন রাজ্যের গুপ্তচররা সঠিক সময়ে সঠিক খবর আনে বাকি রাজ্যগুলোর গুপ্তচররা কোন খবরই আনে না সেটা খানিকটা লেম। এখন যুক্তি দিতেই পারেন যে সাতকর্ণীর গুপ্তচররা সেরা হওয়াই তার সাফল্যের কারণ; কিন্তু নাহাপনার মতো বুদ্ধিমান এবং সতর্ক রাজার গুপ্তচররা এতটা দুর্বল হবে সেটা মানা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি। ৩। কলিঙ্গ সেনারা অমরাবতিতে যা খুশি তা করলো অথচ বাড়িঘরগুলোতে লুকিয়ে থাকা সাতবাহন সেনাদের উপস্থিতি টের পেলো না এটা হাস্যকর। মোটের উপর সাতবাহন রাজ্যকে জেতাতে গিয়ে শেষ দিকে এমনভাবে সবকিছু তাদের পক্ষে ঘটছিলো যে আমি নাহাপনা দ্বন্দ্বযুদ্ধে নিহত হবার পর আমি বইটির জাস্ট পাতা উল্টে উল্টে কী কী ঘটে তা জেনে বইটি শেষ করেছি। *** আমার উপরের মতামত যথেষ্ট পরিমাণ সাবজেকটিভ। তাই আমার বইটি পড়ার অভিজ্ঞতা শেষ পর্যন্ত ভালো হয় নি মানে এটা না যে আপনারও ভালো লাগবে না। আমার পরামর্শ থাকবে যারা সনাতন ধর্মাবলম্বি না তারা এই বইটা পড়ার আগে রামায়ণ এবং মহাভারতের অন্ততঃ উপেন্দ্রকিশোর রায়ের লেখা সংক্ষিপ্ত ভার্সন হলেও পড়ে নিন।
This entire review has been hidden because of spoilers.
‘মহাকাল’ বইটি এক কথায় হিস্টোরিক্যাল আর মিথোলজিক্যাল ফ্যান্টাসির মিশ্রণ। সাতবাহন রাজ্য, শক রাজ্য, কলিঙ্গ রাজ্য এবং দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ভেত���কার রাজনীতি এবং কুটনীতি এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। এই রাজায় রাজায় যুদ্ধের ভেতরে অসিত এবং রুদ্রদেবের কাহিনিও মিশে যায়।
‘মহাকাল’ উপন্যাসের মূল আখ্যান বিল্ড আপ হতে বেশ সময় নেয়। উপন্যাসের অর্ধেকের পরে গিয়ে কাহিনি বেশ গতি পায় আর শেষ অংশ বিশেষ করে সে সময়ের যুদ্ধের ব্যপারগুলোর বর্ণনা বেশ ভালো লাগলো। মূল কাহিনির পটভূমি মহাভারতের কয়েক হাজার বছর পরে হওয়ায় নানা সময়ে সেই উপাখ্যানের রেফারেন্স এসেছে। উপন্যাসটির সংলাপ এবং বর্ণনাভঙ্গি সেই সময়কালের সাথে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খাপ খেলেও কয়েক জায়গায় মনে হলে একটু বেশিই আধুনিক হয়ে গিয়েছে। চরিত্রায়নের দিক থেকে সাতবাহন রাজ্য ব্যতিত থেকে প্রতিটি রাজা এবং তাদের মন্ত্রীর ভেতরে জেনারালাইজড ব্যপারটা চলে এসেছে। গ্রাম্য বালক অসিতের ক্যারেকটার ডেভেলপমেন্ট অবশ্য ভালোমতোই হয়েছে। বইয়ের রহস্যময় এক লোকের অতীতের ব্যাপারে যাদের মহাভারত সম্পর্কে জানাশোনা রয়েছে তাদের অনেক আগেই বুঝে ফেলার কথা।
‘মহাকাল’ বইতে বিশাল বিশাল রাজ্য, তাদের ভেতরে যুদ্ধনীতি আর কূটনীতি ভালোভাবে দেখালেও আমার মনে হয় ভৌগোলিকভাবে তাদের ভেতরে অনন্যতা খুব একটা ফুটে উঠাতে পারেনি বইটি, শুধুমাত্র বানিজ্যের ভেতরেই ঘুরপাক খেয়েছে। প্রথমদিকে কোন রাজ্যে কে রাজা আর কে মন্ত্রী তা বুঝতে একটু সমস্যাই হয়েছে, বইয়ের প্রথমে নির্ঘন্টের মাধ্যমে প্রতিটি রাজ্য এবং সে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম থাকলে পড়তে আরো সুবিধা হতো। তাছাড়াও বইতে একটি ম্যাপের অভাবও লক্ষ্য করেছি যা থাকলে খুবই ভালো হতো। এ ব্যাপারগুলো বাদে প্রোডাকশন খুবই ভালোমানের হয়েছে, প্রচ্ছদ থেকে কাগজ এবং সম্পাদনা সবকিছুই। যাই হোক, যারা প্রাচীন ভারতের প্রেক্ষাপটে বিশাল কলেবরের রাজনীতি, কুটনীতি এবং যুদ্ধনীতির মিশেলে এক ঐতিহাসিক আখ্যান পরতে চান তাদের জন্য বইটা হাইলি রিকমেন্ড করা থাকলো। বইয়ের শেষে সিক্যুয়েলের আভাস থাকায় সেটিও পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
শ্রেষ্ঠ হওয়ার দৌড়ে 'শ্রেষ্ঠ' কাউকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্য রাখাটা আপাতদৃষ্টিতে সঠিক মনে হলেও আদতে ভুল। একজন কেবল তখনই এগিয়ে যান যখন তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন।
দিবাকর দাস দাদার লেখা প্রত্যেকটা বই পড়েছি। এতদিন মনে হতো 'অভিমন্যু' তার শ্রেষ্ঠ। কিন্তু মহাকাল সেটাকেও হারিয়ে দিয়েছে। বিস্তৃত প্লটে লেখা এই উপন্যাস আমার পড়া বাংলা মৌলিক ফিকশনের তালিকায় 'শ্রেষ্ঠ' ক্যাটাগরিতেই রাখবো। কেবল মৌলিক কেন, অনুবাদ বা ভীনদেশী সাহিত্যের তালিকাতেও অনেক উপরের দিকে থাকবে এই বই।
সাতবাহন, শক, কলিঙ্গ, চেরা, চোলা, পাণ্ড্য - প্রাচীন ভারতের মোট ছয়টি রাজ্যের রাজনীতি আর কূটনীতির মায়াজাল উপজীব্য করে গড়ে উঠেছে এই মহাকাল। যুদ্ধের প্রান্তরে শস্ত্রের ঝনঝনানি থেকে শুরু করে বন্দরের বণিকদের গোপন লালসা; গ্রাম্য হাটের বাদরনাচ থেকে শুরু করে গভীর রাতে মন্ত্রণাকক্ষের সভা; বিদ্রোহী মন্ত্রীর কূটচাল থেকে শুরু করে গভীর বনে নরখাদক বাঘের হানা- কী নেই এই আখ্যানে? মহাভারতের যুদ্ধের শাস্ত্রীয় যুদ্ধবিদ্যার সাথে মিশেল ঘটেছে মুহাম্মাদের জন্মের আগের মক্কার যুদ্ধকৌশল।
আট-দশটা সম্পূর্ণ ভিন্ন কাহিনীকে একই সাথে এনে মিলিয়ে দিয়েছেন দিবাকর দাস। আমার মতে লেখকের সার্থকতা এখানেই।
কিছু ছোটখাটো মুদ্রণপ্রমাদ ছিল। কিন্তু ছয়শো আট পৃষ্ঠাব্যাপী এই বইয়ের কাহিনিতে পাঠক এতটাই মগ্ন হয়ে যাবে যে এসব তার চোখেই পড়বে না। আর চিরকুটের প্রোডাকশনের কথা বলাই বাহুল্য। এত বড় একটা বই কিন্তু পৃষ্ঠা খোলা রেখে পড়তে বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়নি।
ব্যাক্তিগত রেটিং: ৯/১০
মহাকাল দিবাকর দাস চিরকুট প্রকাশনী প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৬০৮ মুদ্রিত মূল্য: এক হাজার টাকা (বইটি সংগ্রহ করেছি ধী থেকে)
বই : মহাকাল লেখক : দিবাকর দাস রেটিং: ৪.৫/৫.০০ জনরা : পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক থ্রিলার প্রকাশনা : চিরকুট পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৬০৮ মলাট মূল্য : ১০০০ ৳ প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৩
মহাকাল দিবাকর দাসের এক অনবদ্য সৃষ্টি। লেখক তার লেখনিতে সর্বোচ্চটাই দিতে চেয়েছেন। তিনি তাঁর লেখনিতে প্রাচীন ভারতের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। নি:সন্দেহে মহাকাল লেখকের এক শ্রেষ্ঠ লেখনি।
◾মহাকালের মাঝে রুদ্রদেবের চরিত্র আমাকে কৌতুহলী করে তুলেছে। রুদ্রদেবের চরিত্রের মাঝে একরকম রহস্যময়তার সন্ধান পাওয়া যায়। যুগ যুগ ধরে একটি মানুষ অভিশাপের বুঝা বয়ে বেরিয়েছে। কতশত রাজ্যের অধ:পতন ঘটেছে তার সামনেই। সে নিজেও ছিলো রাজ্যের রাজা। কিন্তু মহাকালের চক্র তাকে সাধারনের কাতারে নিয়ে এসেছিলো। একসময় রুদ্রদেব তার কর্মের কারনে ঠিকি তার অভিশাপ থেকে মুক্ত পেয়েছিলো।
◾অন্যদিকে গল্পের মাঝে অসিতের চরিত্রটাও আমি খুবই উপভোগ করেছি। সাধারন এক ভীতসন্ত্রস্ত বালক কিভাবে এক যোদ্ধায় পরিনত হলো সেই গল্পটাও উপভোগ্য ছিলো। একদিকে তার পোষা বানর অঙ্গদকে খোঁজে পাওয়ার ইচ্ছা অন্যদিকে ভালোবাসার মানুষটিকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
অসিত কি পেরেছিলো অঙ্গদকে খোঁজে বের করতে? পেরেছিলো কি তার ভালোবাসার মানুষটিকে আপন করে নিতে? রহস্যময় সেই রুদ্রদেবের রহস্যময়তার কারণ কি?. সবকিছু জানতে হলে অবশ্যই আপনাকে "মহাকাল" পড়তেই হবে।
দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়া 'মহাকাল'। মনের তৃপ্তি মিটিয়েছে এই উপন্যাস। প্রায় ৭৩০+ পেইজের প্রতিটি অধ্যায়ে লেখক এত চমক দিয়েছে যা পড়ে আমি রীতিমতো অবাক। কোনটা নাই এই উপন্যাসে? রাজনীতি, রাজা,রাজত্ব, থ্রিল, মিথ, দেবতা , যুদ্ধ, বুদ্ধির খেল সব কিছু মিলিয়ে পারফেক্ট প্যাকেজ। বাংলাদেশী সাহিত্যে এমন উপন্যাস আরো প্রশংসার দাবিদার।
'মহাকাল' ঐতিহাসিক থ্রিলার। ইতিহাসের একটা বড় অংশে রাজা-সম্রাটের যুদ্ধ, সম্পদের নেশার কথা দেখা যায়। এইখানেও একই। তবে লেখক যেই ভাষায়, একের পর এক চরিত্র, কাহিনী নিয়ে এসেছে তা অতি চমৎকার। প্রথম থেকেই 'রুদ্রদেব' চরিত্রটা ভালো লেগেছে। এবং আস্তে আস্তে তা বেড়েছেই । এত দারুণ এক চরিত্র! তার পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতাও জোস। সাতকর্ণী' সম্রাট এর পাশাপাশি নাহাপনার কৌশল চোখে পড়ার মতো। এখন অব্ধি গিরিধারী মন্ত্রীকে গিরিঙ্গিবাজ মনে হচ্ছে! জানিনা পরবর্তী খন্ডে তার আরো কত মতলব দেখবো! তবে এক কথায় এই সিরিজের প্রথম খন্ড অতি জোস। জোস এবং জোস।
৬০০ পেজের বিশাল বই মহাকাল।তাই ছোট রিভিউ দিয়ে বইটার মাহাত্ম্য বো��ানো যাবে না।তবে বিস্তারিত রিভিউ অনেকেই দিয়েছেন, আমি শুধু বইটির পজিটিভ নেগেটিভ দিক নিয়ে বলি।বইটির প্রধান ইতিবাচক দিক বর্ণনাশৈলী।লেখক দিবাকর দাস এইক্ষেত্রে ভালোই মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। মহাকাল দারুণ পেজ টার্নার।দ্বিতীয় ইতিবাচক দিক এর প্লট।প্রাচীন ভারতের রাজনীতি,কূটনীতি ও যুদ্ধকৌশল ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন লেখক।তৃতীয়ত বিশালাকার বই হলেও ছোট ছোট অধ্যায়ে ভাগ করা থাকায় বিরক্তি আসেনি পড়ার সময়। এবার একটু নেতিবাচক দিক নিয়ে বলি।মেজর কোনো নেগেটিভ দিক মহাকালে নেই।তবে মহাকালের এক বিন্দুতে এসে যখন অসিত,রুদ্রদেবের লক্ষ্য এক হয়ে গেলো, এমন সময় আচমকা এন্ডিং ভালো লাগে নি।যদিও পরবর্তী বই মহাযাত্রা বেড়িয়ে গেছে, সেটাও পড়ার ইচ্ছে রইলো।সবশেষে বলা যায় যারা হিস্টরিকাল ফিকশন,বিশেষ করে প্রাচীন ভারত ভিত্তিক কাহিনি পছন্দ করেন তাদের জন্য অত্যন্ত সুখপাঠ্য মহাকাল।
বাংলাসাহিত্য এমন লেখা আছে বলে আমার মনে হয় না, বা থাকলেও আমার জানা নাই। এটারে কি বলবো? ম্যাজিক রিয়ালিজম? ওয়ার ফিকশন? হিন্দু মিথোলজিক্যাল ফিকশন? থ্রিলার? হিস্টোরিক্যাল ফিকশন? যাস্ট যৌনতা আর প্রেমের অতি গভীর কাহিনী যুক্ত করলে আরেক গেইম অফ থ্রোনস হয়ে যাইতো...
দিবাকর দাস দাদা, আপনি গুরু! প্রতিটার অধ্যায়ের শুরু যেভাবে করছেন তাতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছি। এক কাহিনী শেষ করতে আরেক কাহিনীতে চুম্বকের মতো ঢুকেছি। ক্যারেক্টর ডেভেলপমেন্ট অসাধারণ ছিলো। সবথেকে মিস করেছি একটা ম্যাপ, আর বূহগুলোর ছবি। আর প্রথম দিকে স্টোরি আস্তে আস্তে গেলেও শেষের দিকে অনেক দ্রুত গিয়েছে বলে মনে হয়েছে।
আমার মনে এখনো গেথে আছে রুদ্রদেব। তার অনেক ভেলকি এখনো দেখি নাই। মহাযাত্রা রুমে পরে আছে, ছুটিতে পড়া শুরু করবো। আর পরিশেষে,
গিরিধারীর জন্য Vinland Saga এর একটা Quote এর কথা মনে পরছে,
অসাধারণ লেখনীতে লিখা এই বইটা আমাকে একদম নিজের ভেতর আঁটকে রেখেছে। চরিত্র গুলা যেন একদম জীবন্ত আমি বের হতে পারিনি এখনো কাহিনির ভিতর থেকে।
রুদ্রদেব,অসিত, গীরিধারি চরিত্রে এখনো ঘুরপাকই খাচ্ছি শুধু। মহাকালের ২য় কিস্তির অপেক্ষায় বসে আছি। যারা এখনো এই বইটি পড়েননি তারা পড়তে পারেন নিশ্চিন্তে। টাকা এবং সময় কোনটাই লস হবেনা বলতে পারি।
লেখক চাইলে শুধু রুদ্রদেব কে নিয়েই আলাদা একটা সিকুয়েল করতে পারেন, রুদ্রদেবের আদি অন্ত সবকিছু নিয়ে।
আমার এই অগোছালো লেখায় বইয়ের পুরো রিভিউ দেয়া সম্ভব নয় তাও নিজের ভালো লাগা থেকে একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা অনুভূতি বোঝানোর। লেখকের প্রতি রইলো ভালোবাসা ও শুভকামনা ❤️
গত কয়েকবছরে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন অপরিপক্ক জনরায় শক্তিশালী মৌলিক কিছু কাজ হয়েছে। মহাকাল এমনই একটি কাজ।
প্রেক্ষাপট: মহাভারত যুগের ৩০০০ বছর পরে। প্রাচীন ভারতবর্ষ।
ফ্ল্যাপ বইয়ের ছবির সাথে আছে।
লেখনী: শব্দচয়ন এবং গাঁথুনি অনেক সুন্দর। লেখনী আকর্ষণীয়। বেশ সহজ-সরল।
উপস্থাপন: এটা এ বইয়ের আরেকটা শক্তিশালী দিক। বইয়ের ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন আমার ভীষণ পছন্দের। মহাকালের ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনে লেখক দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। একঘেয়েমি আসার প্রশ্নই আসে না।
বর্ণনা: উপন্যাস আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে বর্ণনার কারণে। এটা উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য। আর মহাকালে এর অভাব বোধ করি নি। যুদ্ধের বর্ণনাগুলো এমনভাবে দেয়া চোখ বন্ধ করলেই যুদ্ধগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। যারা বলে থাকেন যুদ্ধ সিনেমার পর্দায় দেখার বিষয়, বইয়ে তেমন বোঝা যায় না__ তাদের মহাকাল অবশ্যই পড়া উচিত। তবে বর্ণনার ক্ষেত্রে লেখক কিছুটা কার্পণ্যতা করেছেন গল্প ঝুলে পড়ার ভয়ে।
প্লট টুইস্ট: মহাকালে প্লট টুইস্টের সংখ্যা অনেক। এসব প্লট-টুইস্ট বইয়ের প্রতি ভালোলাগা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিবে। কয়েক পরিচ্ছেদ পরপরই মাথা ঘোরানো প্লট-টুইস্ট।
বয়সসীমা: গল্পটা যেকোনো বয়সেরই পাঠক উপভোগ করবেন। ভাষার ব্যবহার এমনই। গল্পের প্রয়োজনে মাঝে মাঝে ছোটখাটো অ্যাডাল্ট টপিক আসলেও লেখক খুব সাবধানে দায়সারাভাবে লিখে তা এড়িয়ে গেছেন।
প্রোডাকশন: চিরকুটের বাইন্ডিং এবং পৃষ্ঠার কোয়ালিটি দুটোই ভালো লাগে। গুণী শিল্পী সজল চৌধুরীর করা প্রচ্ছদটাও যথেষ্ট সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। স্পেস কম এবং ফন্ট ছোট করে প্রকাশনী চেয়েছে বইটিকে সাধ্যের মাঝে পাঠকের হাতে তুলে দিতে। এটা প্রশংসার দাবিদার। তবে টাইপিং মিস্টেকে আরো মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল।
নস্টালজিয়া: ছোটবেলায় যারা মহাভারত পড়েছেন তারা একটা নস্টালজিয়া অনুভব করবেন।
নামকরণ: মহাকাল নামটির মাহাত্ম্য অনেক। যেমন মাহাত্ম্য এ বইয়ের। নামকরণ যথার্থ।
গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পরিচিতি: অসিত: চরিত্রটা আপনাকে মুগ্ধ করবে। বিভূতিভূষণের অপু'র মতই শূন্য থেকে পূর্ণ হবে এ চরিত্রটা। রুদ্রদেব: ভিলেন থেকে নায়ক হওয়ার চরিত্র এটা। লেখক পুরো গল্পে মাঝে মাঝে রুদ্রদেবের ফ্ল্যাশব্যাক দেখালেও চরিত্রটার আসল নাম সরাসরি উল্লেখ করেননি। এক্ষেত্রে কেবল সাংকেতিক বাক্য ব্যবহার করেছেন। রহস্যসৃষ্টিকারী সুন্দর কৌশল। মন্ত্রী গিরিধারী: সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র। তার কূটনীতি একটা ঘোরের মাঝে রাখে। এখান থেকে��� লেখকের কল্পনা কতটা শক্তিশালী এবং পরিশ্রমের পরিমাণ বোঝা যায়। মন্ত্রী গিরিধারী আসলে মামা শকুনি। নাকি কৃষ্ণ? সাতকর্ণী: সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য সাতবাহনের ষষ্ঠ সম্রাট। সাহসী এবং সৎ। কিন্তু বিরূপ পরিস্থিতিতে সবই করতে পারেন। নাহাপনা: সবচেয়ে ধনী রাজ্যের রাজা। ভীষণ কৌশলী এবং সচেতন। মহারাজ উথিয়ান: উপন্যাসে এ চরিত্রটার উপস্থিতি খুব বেশি সময় না হলেও এ চরিত্রটায় সবচেয়ে বেশি ছাপ ফেলবে পাঠকের মনে। মহারাজ উথিয়ান ছল, কপটতা আর ষড়যন্ত্রের শিকার।
যা জানা প্রয়োজন: এক ধনু = চার হাত এক গব্যুতি = ১২০০০ ফুট
সুন্দর কিছু কথা: ১. দিব্যাস্ত্র কখনোই দিব্যাস্ত্রের জ্ঞানহীন কোন যোদ্ধার উপর প্রয়োগ করা য়ায় না। ২. কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কেবল অর্জুনের গাণ্ডীবই লড়ে নি, কানাইয়ার মাথাও লড়েছিল। ৩. ইতিহাস ভবিষ্যতকে ঠিক ততটুকুই জানবে, যতটুকু আমরা তাকে সংরক্ষণ করার অনুমতি দেবো। তার বাইরে ইতিহাস কাউকে কিছু বলবে না। ৪. একজন রাজা তিনি যদি ঋষিও হন, তবু তাকে মনে রাখতে হবে, তিনি কখনোই শত্রুহীন নন।
নিজস্ব মতামত:
অশ্বত্থামা এমন একটা চরিত্র, যেটা নিয়ে আমার সবসময়ই মনে হত এ চরিত্রটার সাথে কল্পনা মিশিয়ে সাহিত্য এবং সিনেমায় অনেক আগেই ব্যবহার করা যেত। এতদিন কেন করা হয় নি জানি না। যদিও ভিডিও গেমে অনেক আগেই পেয়েছি। এবার সাহিত্যে পাওয়ার ইচ্ছাটাও পূর্ণ হল।
মহাভারত পড়া থাকলে গল্পটার সাথে বেশি কানেক্ট করতে পারবেন। না থাকলেও সমস্যা নেই। এক্ষেত্রে গুগল থেকে অশ্বত্থামা চরিত্রটা সম্পর্কে একটু ধারণা নেয়া উচিত।
আমার মায়ের সাথে যখনি মহাভারত নিয়ে কথা হয়, তখন অশ্বত্থামার প্রসঙ্গ আসলেই মা জিজ্ঞেস করত__ "আচ্ছা, অশ্বত্থামা কখনো অভিশাপমুক্ত হবে না? একেবারে যতদিন পৃথিবী আছে ততদিন তাকে কষ্ট ভোগ করতে হবে? ভগবান তো এত নিষ্ঠুর নন।" আমি এই প্রথম গতকাল রাতে দিবাকর দাসের চিন্তাভাবনার সাথে আমার চিন্তাভাবনা মিশিয়ে একটা ব্যাখ্যা দিতে পারলাম। মহাকালের গল্পটা মাকে শুনালাম।
বাংলা সাহিত্যের মিথলজিক্যাল জনরায় ছাপ ফেলতে না পারলেও হিস্টোরিক্যাল থ্রিলার জনরাকে সমৃদ্ধ করেছে মহাকাল। তবে মিথলজিক্যাল জনরার দ্বার খুলে দিয়েছে।
অনেকের মতে লেখক দিবাকর দাস তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বইটি লিখে ফেলেছেন। আমি তা মনে করি না। উনার থেকে আরো ভালো ভালো লেখা পাঠক হিসেবে আমি আশা করি। তবে, মহাকাল এর থেকে ভালো হত না। এছাড়াও লেখকের প্রুফ-সংশোধনে আরো যত্নবান এবং মনোযোগী হওয়া উচিত।
অসম্পূর্ণ কিছু দিক:
১. মহাকালে মিথলজির ব্যবহার যেরকম আশা করেছিলাম সেরকম পাইনি। অবশ্য এর কারণ সুস্পষ্ট এ বক্তব্যটিতে, "তবে তোমার আগের জীবনের কথা মনে রেখো। সেই ভুল আর করো না। দিব্যাস্ত্র কখনোই দিব্যাস্ত্রের জ্ঞানহীন কোন যোদ্ধার উপর প্রয়োগ করা য়ায় না।" (৯৬পৃ)
২. মহারাজ নাহাপণার বংশে অশ্বত্থামার সেই মণিরত্ন আসল কীভাবে? (এটার উত্তর বিস্তারিত লেখা উচিত।)
৩. কিছু চরিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড আরো গভীর হতে পারত। বিশেষ করে মন্ত্রী গিরিধারী চরিত্রটা।
৪. রুদ্রদেবকে দিয়ে আরো কিছু গুজবাম্পস মোমেন্ট ক্রিয়েট করা যেত।
৫. বানানভুল, বাহুল্যদোষ এবং অসংগতি: মহাকালের মত বিশাল একটা বইয়ে বানানভুল থাকবে না এটা অস্বাভাবিক। মাঝখানের অংশে টাইপিং মিস্টেক বেশি। কয়েকজায়গায় এক অনুচ্ছেদে একই শব্দ একইভাবে দুবার ব্যবহৃত হয়েছে। বেমানান বাক্য সংখ্যা ১টি। এমনকি এক স্থানে একই অনুচ্ছেদ দুবার রিপিট হওয়ার মত ঘটনাও ঘটেছে। এসব ভুল না হলে মহাকাল আরো পূর্ণ হত।
৬০৮ পৃষ্ঠার বইটা পড়ে, ৬০৮ পৃষ্ঠা পড়ার ক্লান্তি একটুও আসে নি। মনে হচ্ছে এইমাত্র ৬০ পৃষ্ঠার কোনো ডিটেকটিভ জনরার বই পড়লাম। মহাকালের সাথে কিছু কাল আনন্দে কাটল।
অবশেষে মহাকালের সাথে যাত্রাটা শেষ হল। যথেষ্ট তৃপ্তি পেয়েছি। তারপরও কেমন জানি - 'শেষ হইয়াও হইল না শেষ।'
সবমিলিয়ে মহাকাল সার্থক একটি উপন্যাস। মহাকালের মত বইয়ের দ্বিতীয় পর্ব আসবে এটাই সব প্রত্যাশার পূরণ। আর কোনো প্রত্যাশা নেই।
এত বড় কলেবরের গল্প খুব কমই পড়া হয়,গল্প বড় কিন্তু টেনে লম্বা করা না। বই এর প্রথম ৪০০পেইজ আমি ৪দিনে পড়েছি, এত ভালো গল্প এত তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে চাইনি,তাই পরে কিছুদিন ব্রেক দিয়ে আবার শুরু করি। একটা সুন্দর সময় দিবে মহাকাল আপনাকে,প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, যুদ্ধ, শাস্ত্র নিয়ে ভাবতে পারবেন অনেক লম্বা একটা সময়।। রাজনৈতিক মারপেঁচ, যুদ্ধের আতঙ্ক নিয়ে ভালোই কাটলো। মহাকাল আমার সেরা একটা এক্সপেরিয়েন্স,বাংলা সাহিত্যে এরকম আরো বই আসুক।
হিস্টোরিকাল থ্রিলার ভালো লাগলে, এটা অবশ্যই মাস্ট রিড একটা বই।
এই বই এর সিকুয়েল আসবে কিনা জানিনা,তবে লেখকের নেক্সট বই এর অপেক্ষায়...
ইতিহাসের নগর-বন্দরে লেখক দিবাকর দাস যে সরল বর্ণনায় পাঠকদের নিয়ে যাত্রা করেন, সে মহাযাত্রার শুরু মহাকাল। সদ্য কৈশোর পেরোনো এক তরুণ অসিত, তার ভাত্রসম বানর অঙ্গদ দিয়ে শুরু হয়ে কখন যে মহাভারতের সেই বিস্মৃতির অতলে হারানো বীরের গল্পে মিশে যায় ভারতবর্ষের এক অসামান্য রাজ্য আর তার রাজনীতিতে দক্ষ এক মন্ত্রীর কুটনৈতিক পাশাখেলার ছকে, গড়ে ওঠে ভারতবর্ষের ইতিহাসের অন্যতম বিশাল সাম্রাজ্য, তার অদ্ভুত আখ্যান মহাকাল।
মহাযাত্রায় কি শেষ হবে রুদ্রদেব আর তার শিষ্যের পথ পরিক্রমা, অপেক্ষায় রইলাম...