edited by Niaz Zaman, with an introduction by Serajul Islam Choudhury. "Tree Without Roots" is the English translation/transcreation of Syed Waliullah's classic novel "Lal Shalu." With no land or skills to support himself otherwise, Majeed preys upon the simple rural folk by exploiting religion, becoming the self-appointed guardian of a mazar, which he claims is that of a saint. Not satisfied with his first wife, he marries again, this time to a woman who is not as amenable as his loving first wife. The protrait of the two women and their relationship to each other and Majeed balances Waliullah's portrait of the charlatan. In the English version, now generally believed to be by Syed Waliullah himself, Majeed acquires a certain grandeur at the end, returning alone to the mazar in the midst of raging flood waters. A picture of rural Bangladesh in the early forties, Tree Without Roots also provides a picture of eternal Bangladesh, subject to the ravages of nature, of storms and floods, of cyclones and dying rivers. Though critical of the exploitation of religion, Syed Waliullah looks sympathetically at Majeed for whom religion means food and shelter. Told in Syed Waliullah's simple, idiomatic, and occasionally lyrical English, Tree Without Roots is imperative reading for any one interested in knowing the Bengali mind and the impact of religion and superstition on the rural populace.
Syed Waliullah was born on 15 August 1922 at Sholashahar in Chittagong. After completing his Bachelor’s from Ananda Mohan College in Mymensingh, he enrolled at Calcutta University but did not complete his Master’s. Proficient in both Bangla and English, he worked for the Statesman during 1945-1947. After the Partition, he moved to Dhaka and joined Radio Pakistan as assistant news editor. In 1950 he was posted to Radio Pakistan, Karachi. From 1951 to 1960 he served as press attache at Pakistan missions in New Delhi, Sydney, Jakarta and London. It was in Sydney that Waliullah met Anne-Marie Thibaud, whom he later married and who translated Lal Shalu into French. In 1960 Waliullah moved to Paris where he served as first secretary at the Pakistan Embassy till 1967 when he joined UNESCO. Syed Waliullah did not live to see the liberation of his motherland, passing away in Paris on 10 October 1971.
Syed Waliullah (Bengali: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ) is often considered the pioneer of existential analysis of the characters psyche and root cause analysis of social-psychic conflicts in the literature of Bangladesh. The last two of his three novels, specially Kando Nadi Kando, show his mastery in revealing the inner depths of his characters. Contemporary writer Shahidul Jahir was influenced by him.
Novels: লালসালু(Tree without roots), ১৯৪৮ চাঁদের অমাবস্যা (Dark moon), ১৯৬৪ কাঁদো নদী কাঁদো (Cry, o river), ১৯৬৮ The Ugly Asian, 1959
Play: বহিপীর (১৯৬০) তরঙ্গভঙ্গ (The Breakers), ১৯৬৫ সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) উজানে মৃত্যু
Short story collection: নয়নচারা (১৯৫১) দুই তীর ও অনান্য গল্প (Akte Tulse Gaser Khine), ১৯৬৫
বইটা পড়ে আমার নিজের গ্রাম এবং মানুষের কথা মনে পড়ছে।
গত রোজার ঈদে আমার গ্রামের মসজিদে ফজরের নামায শেষ করার পর গল্পের বই পড়ছিলাম মসজিদের বারান্দায় বসে বসে। এজন্য গ্রামের কিছু মানুষের কাছে অপমানিত হয়েছিলাম। তারপর থেকে মসজিদ এবং নিজ গ্রামে আর যাইনি। আর কোনোদিন যাব না।
অসাধারণ ধর্ম ব্যবসা, ব্যবসার আড়ালে থাকা ছোট গল্প, মজিদের পিতৃবাসনা, একজন বিবাহিতা নারীর মা হবার আকুতি, প্রতীবাদী কিংবা সাংসারিক বাঙালি নারী সবমিলিয়ে গ্রামীণ সমাজচিত্রের এক কমপ্লিট প্যাকেজ। আমার মতে এমন একটা বই প্রত্যেকের শুধু এজন্যই পড়া দরকার কারণ, আধুনিক শহুরে সমাজ কখনোই জানবে না সভ্যতার বেঁচে থাকার জন্য একজন আক্কাস, একজন মজিদ কিংবা মহব্বতনগর গ্রাম কতকিছু করেছে। জানবে না একটুকরো লালসালু'র কতবড় ক্ষমতা থাকতে পারে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সবচেয়ে বেশি পঠিত এবং আলোচিত উপন্যাস হলো লালসালু। আমাদের উপমহাদেশীয় সমাজব্যবস্থায়, যেখানে রাজনীতি এবং ধর্ম— এই দুটি বিষয়কে অগ্রাহ্য করে জীবন কাটানো যায়না, সেখানে এইরকম একটি উপন্যাসের গুরুত্ব অপরিসীম। এই উপন্যাসের চরিত্ররা মুসলিম ধর্মাবলম্বী হলেও, উপন্যাসটির মূল বক্তব্য কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে নিয়ে নয়। চরিত্ররা মুসলমান না-হয়ে হিন্দু হলেও কোনো অসুবিধে ছিলো না। ধর্মকে যারা অসৎ উপায়ে ব্যবহার করে, প্রকৃত "বিধর্মী" আসলে তারাই। আস্তিক-নাস্তিকরা খামোখাই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-মারপিট করে মরে।
ওয়ালীউল্লাহর লেখা প্রথম উপন্যাস এটি। পরবর্তী উপন্যাসগুলোতে তাঁর যে বিশেষ গদ্যশৈলী প্রত্যক্ষ করি আমরা, এই উপন্যাসে সেটি নেই। খুব আটপৌরে এবং গতানুগতিক ভঙ্গিতে তিনি একজন ভন্ড মানুষের গল্প শুনিয়েছেন। ধর্মকে যারা "ধান্দা" হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের প্রত্যেকের চরিত্রে একটা বিশেষ লক্ষণ দেখা যায়। তারা নিজেরা খুব ভালো করেই জানে যে, তারা মিথ্যেবাদী। একজন হিন্দু বাবাজি খুব ভালো করেই বোঝেন : এই যে তিনি ভক্তদের হাতে মন্ত্রপূত মাদুলি বেঁধে দিচ্ছেন, সেই মাদুলি বস্তুটি একটি খাঁটি ভাঁওতাবাজি। তার মানে, মানুষ যাকে ভগবানের প্রতিনিধি হিসেবে মান্য করছে, সেই লোকটাই ভগবানের সঙ্গে (এবং ভগবানের নামে) সবচেয়ে বড়ো ঠাট্টা-মশকরা করছে। সবচেয়ে নির্ভেজাল খাঁটি নাস্তিক তো তারাই! "জাগো গ্রাহক জাগো!"
ধর্মবিশ্বাস জিনিসটা খারাপ নাকি ভালো সেই আলোচনায় আমি যাবো না। আলোচনাটা এতো সহজও নয়। আমি বরাবর মেনে এসেছি, ঈশ্বরবিশ্বাস একটি ব্যক্তিগত বিষয় (পাহাড় বেশি পছন্দ নাকি সমুদ্র নাকি অরণ্য? —এটা যেমন একটা ব্যক্তিগত বিষয়)। আমি দেখেছি, জাগতিক সিরিয়াস সমস্যাগুলোর প্র্যাক্টিক্যাল সমাধানের উপায় যারা মাথা থেকে বের করতে পারেনা, তারাই ঈশ্বরকে নিয়ে বেশি টানাটানি করে। দুই পক্ষের ক্ষেত্রেই দেখেছি। তুই নাস্তিক না মুই আস্তিক (or vice versa)— এইসব ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপারে তারা খুবই গর্বিত এবং নিজেদের বুক চাপড়ে চাপড়ে বুক ব্যথা করে ফ্যালে। খুব সহজেই তারা একে অপরকে নস্যাৎ করে দ্যায়। "ওহ, তুই ভগবান মানিস (কিংবা মানিস না)? ব্যাস ব্যাস আর কিছু বলতে হবে না, আমি যা বোঝার বুঝে গেছি।" এখন তো আবার ফেসবুক টুইটার আছে— বারোয়ারি মাছের বাজার। যেসব তর্কের সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হলো কে কাকে কতো বেশি হেনস্থা করতে পারে, অপমান করতে পারে, ছোটো করতে পারে— সেগুলো তর্ক নয়, টাইমপাস। ক্ষতিকর টাইমপাস। কাজ নেই খেয়ে দেয়ে, স্ট্যাটাস ছাড়ি ধেয়ে ধেয়ে।
এই টাইমপাসের ফাঁকেই, ফায়দা যাদের লোটার, তারা লুটে নেয়। লালসালু উপন্যাসেও লুটেছে। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো নিয়ে যখন সাধারণ মানুষরা ব্যতিব্যস্ত থাকে, সেই সুযোগে তারা চোরের মতো সিঁধ কেটে মানুষের মনের ভিতরে প্রবেশ করে। দেখে মনে হয় এদের অপকর্মের সবচেয়ে বড়ো সহায় হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। আসলে তা নয়। এদের সবচেয়ে বড়ো সহায় হলো মানুষের চেতনার মধ্যে ঢুকে থাকা ভয়, অসহায়তা, ভীরুতা, কাপুরুষতা, লজ্জা। লালসালু উপন্যাসে এই সবকিছুই খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আমার আপত্তি শুধু একটা বিষয়ে।
এই উপন্যাসের চরিত্র এবং ঘটনানির্মাণ আমার কাছে বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়নি। গ্রামের মানুষদের এতো বুদ্ধি-বিবেচনাহীন বলে মানতে রাজি নই আমি। গ্রামাঞ্চলের মানুষ শিক্ষায় দীক্ষায় পিছিয়ে আছে, ঠিক কথা। কিন্তু একজন মাত্র মানুষ একটি মাজারকে অবলম্বন করে গোটা গ্রামকে দীর্ঘকাল (১২ বছরেরও বেশি সময়) বোকা বানিয়ে রেখেছে, কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি, রুখে দাঁড়ায়নি, এমনকি তার ভন্ডামি ধরতেও পারেনি। এই বিষয়টা আমার কাছে বেশ আষাঢ়ে কল্পনা বলে মনে হয়েছে। মূল ভন্ড চরিত্রটির মধ্যে আমি এমন সাংঘাতিক কিছু খুঁজে পাইনি যার দ্বারা গোটা গাঁয়ের মানুষের এরকম দীর্ঘকালীন ল্যাজেগোবরে অবস্থা হবে। উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহকে কেমন যেন খাপছাড়া বলেও মনে হয়েছে। বিশেষ করে শেষের দিকের কাণ্ডকারখানার মর্ম আমার বোধগম্য হয়নি।
সুলিখিত এবং সুমার্জিত না হওয়া সত্ত্বেও উপন্যাসটি দীর্ঘকাল যাবৎ পাঠকদের ভাবিয়েছে। তার কারণ, উপন্যাসে বর্ণিত সমস্যার সমাধান আজ পর্যন্ত তো হয়নি বটেই, বরং এখনও বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে। আস্তিকরা নাস্তিকদের প্রতি এবং নাস্তিকরা আস্তিকদের প্রতি ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি করে এই সমস্যার সমাধান হবে না। হেনস্থা করে কাউকে নিজের দলে টানা যায়না। ভয় দেখিয়েও না। আমরা বোধহয় শত্রু নির্বাচনে ভুল করে ফেলছি। পৃথিবীর সর্বকালের সবচেয়ে সফল নাস্তিক যিনি ছিলেন, তিনি কিন্তু গরম-গরম বিপ্লবী ডায়লগ মেরে, প্রতিপক্ষকে অপমান করে, ফেসবুকে চালাক-চালাক স্ট্যাটাস পোস্ট করে, কিংবা হাতাহাতি করে নিজের কাজ হাসিল করেননি। তিনি নিজের কাজ হাসিল করেছিলেন করুণার দ্বারা, সহমর্মিতার দ্বারা, সমঝোতার দ্বারা, সহানুভূতির দ্বারা। তাঁর নাম সিদ্ধার্থ গৌতম। ওরফে বুদ্ধদেব। এইযুগের ফেসবুক-টুইটারের ভার্চুয়াল মাস্তানদের চেয়ে অনেক কঠিন মাস্তান ছিলেন তিনি।
লালসালু দিয়ে ঢাকা পীরের মাজার হোক কিংবা গেরুয়া নামাবলী দিয়ে ঢাকা "জাগ্রত" দেবতার থান। এইসব জায়গায় যারা ভন্ডামির রাজত্ব চালাচ্ছে, তাদের মুখোশ খুলতে হলে আগে আমাদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক চুলোচুলি বন্ধ করতে হবে। পরস্পরকে বুঝতে হবে। "যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।"
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'লালসালু' বাংলা সাহিত্যের এক অনন্যসাধারণ উপন্যাস, যা গ্রামীণ সমাজ ও ধর্মীয় কুসংস্কারকে কেন্দ্র করে রচিত। উপন্যাসটি মূলত ধর্মের নামে প্রতারণা, শোষণ, এবং সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষের নিরীহ জীবনযাত্রার বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। এটি একদিকে যেমন একটি সমাজমনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, তেমনি অন্যদিকে একজন মানুষের ক্ষমতার প্রতি লোভ এবং তার প্রভাবকে গভীরভাবে অনুধাবন করায়।
“Power corrupts, and absolute power corrupts absolutely.” – Lord Acton
'লালসালু' উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ, যে নিজেকে ধর্মের প্রচারক হিসেবে উপস্থাপন করে এবং এক পরিত্যক্ত কবরকে অলৌকিকতার মোড়কে ঢেকে গ্রামবাসীর বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। মজিদের চরিত্র শুধু একক ব্যক্তি নয়, বরং এটি ধর্মীয় স্বার্থান্বেষী শাসকদের প্রতিচিত্র। তার লালসালুতে ঢাকা কবর ধর্মীয় কুসংস্কার এবং সাধারণ মানুষের অন্ধবিশ্বাসের প্রতীক।
“সত্য মুক্তি দেয়, কিন্তু কুসংস্কার শৃঙ্খলিত করে।” – জন স্টুয়ার্ট মিল
উপন্যাসটি ধর্মীয় কুসংস্কারের ভয়াবহ পরিণতি তুলে ধরেছে। মজিদ সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে তাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তার ক্ষমতার বিস্তার সম্ভব হয় গ্রামের মানুষের অন্ধবিশ্বাস ও অজ্ঞতার কারণে। এটি দেখায় যে, অজ্ঞতা ও কুসংস্কার কীভাবে শোষকদের হাতিয়ার হয়ে ওঠে এবং কীভাবে নিরীহ মানুষেরা তা বিশ্বাস করে তাদের জীবন পরিচালিত করে।
“Fear is the foundation of most governments.” – John Adams
উপন্যাসে নারীদের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মজিদের স্ত্রী আমেনা ধর্মের নামে তার স্বামীর অত্যাচার সহ্য করে এবং সে নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে জমিলা চরিত্রটি আসে, যে তুলনামূলক স্বাধীনচেতা। কিন্তু মজিদ তাকে দমন করার চেষ্টা করে, যা ধর্মীয় পিতৃতান্ত্রিকতার প্রতিফলন।
“Education is the movement from darkness to light.” – Allan Bloom
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ভাষাশৈলী সহজ কিন্তু গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি গ্রামের কথ্য ভাষা এবং সাহিত্যিক ভাষার অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন। উপন্যাসের বর্ণনাভঙ্গি এবং প্রতীকী ব্যবহার এটিকে সাহিত্যিক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিশেষ করে লালসালুর রঙ ও প্রতীকী ব্যবহার গভীর ভাবার্থ বহন করে।
“যে সাহিত্য সমাজের আয়না হতে পারে, সেই সাহিত্যই কালজয়ী।” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পরিশেষে এটুকুই বলবো যে 'লালসালু' নিছক কোনো উপন্যাস নয়, এটি সমাজের গভীর অসঙ্গতির প্রতিবিম্ব। উপন্যাসটি আমাদের শেখায়, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তির আলো জ্বালানো কতটা জরুরি। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শুধুমাত্র ধর্মীয় আবরণে মোড়ানো যে কোনো শাসকের ক্ষমতা প্রশ্ন করা এবং সমাজের বোধকে জাগ্রত করা প্রয়োজন।
“No one is more hopelessly enslaved than those who falsely believe they are free.” – Johann Wolfgang von Goethe
লালসালু একটি সুন্দর বই যেখানে গ্রাম বাংলার মানুষের অজ্ঞতা এবং ধর্ম কে কেন্দ্র করে কিছু মানুষের ভন্ডামি আর ব্যবসা খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মজিদ, লালসালু উপন্যাসের মূল চরিত্র। লেখক মজিদের মাধ্যমে খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছেন একজন ধর্ম প্রতারক এর ছবি। আমাদের গ্রাম বাংলায় এমন অনেক মানুষ আছে যারা ধর্ম কে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষদের ঠকাচ্ছে। এই উপন্যাস একটি শিকড়হীন মানুষের গল্প যে কিনা নিজ স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করেছে এবং সময় এর সাথে সাথে একজন ভক্ষক হয়ে গেছে। আমেনার মত হাজারো মেয়ে রয়েছে গ্রাম বাংলায় যারা স্বামীদের অন্ধবিশ্বাস করে। জমিলার মত যারা প্রতিবাদ করতে চায় পুরুষশাসিত সমাজে তাদের পরিণতি খুব একটা ভালো হয় না। গ্রাম বাংলার চিরায়ত রূপ ফুটে উঠেছে, লালসালু উপন্যাসে।
এই বইয়ের পাতায় পাতায় মিশে আছে একগুচ্ছ সুখস্মৃতি আর অনেকখানি ভালোবাসা। উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যবই হিসেবে পড়া হয়েছে অনেকবার। গতকাল পড়লাম আরো একবার। এত বছর পরেও ভালোলাগার কমতি ছিল না একবিন্দুও।
উপন্যাসটা HSC তে থাকলেও পড়া হয়নি। প্রশ্নের উত্তর লেখার খাতিরে যা একটু আধটু সারমর্ম জানা ছিলো সেটুকুই। লেখকের প্রথম পড়া উপন্যাস "চাঁদের আমাবস্যা"। সেই এক উপন্যাসই তার লেখার প্রতি টান ধরাতে যথেষ্ট ছিলো। যদিও লেখক সেসময় একটু হলেও বয়জেষ্ঠ্য হয়েছিলেন লেখক হিসেবে। লালসালু লেখকের প্রথম উপন্যাস। হীরার, হীরার মতো গুণ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। দিনের শুরুটা যেমন পুরো দিনের ইঙ্গিত দেয় তেমনি লালসালুও লেখকের শক্ত-সামর্থ্য লেখনীর ইঙ্গিত দেয়।
লালসালু মুলতঃ কোনো ধর্ম নিয়ে না। কোনো ধর্মকে ছোট করা বা ধর্মের নামে বিভ্রান্তি ছাড়ানোও এই উপন্যাসের উদ্দেশ্য না। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়। এই উপন্যাস প্রধানত কাজ করেছে ধর্মের আগাছা নিয়ে। ধর্ম ব্যবসায়ীদের নিয়ে। হোক হিন্দুধর্ম, হোক খ্রিষ্টান, হোক ইসলাম বা অন্যান্য। অশিক্ষা, শিক্ষাহীনতা, অযথা ধর্মভীরুতা নিয়ে। শিক্ষার আলো না থাকলে মানুষকে কত ভাবে ঠকানো যায় তার একটা দিকে আলোকপাত করেছে শুধু। আজকের দিনেও যেমন ধর্মের নামে মানুষে মানুষে হানাহানি হয় সে হিসেবে লেখকের সময় এর চেয়ে বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। কোরআনের প্রথম শব্দই "পড়"। জ্ঞান ছাড়া যে উন্নতি নাই, জ্ঞান ছাড়া যে সত্য মিথ্যার তফাৎ ধরা যায়না, জ্ঞান ছাড়া যে ঠকতে হয় একথা আল্লাহ ছাড়া আর কে জানবেন! সেজন্যই হয়তো গ্রামে স্কুল দিতে চাওয়াটা অপরাধের সমতুল্য মনে করে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়া হয়। এখানে লেখকের "মজিদকে" দিয়ে কথাটা বলানোর ভঙ্গিটা যথেষ্ট ভালো লাগার মতো। যে জন্য বিচার সে কথা অল্প বলে অন্য কথাতে লোক ভুলানো এ-তো আজকের দিনেও অহরহ হচ্ছে।
পিউর একটা গ্রামীণ আবেশ, গ্রামীণ সভ্যতা, গ্রামীন আবহ, গ্রামীণ মানুষের জিবন নিয়ে এই উপন্যাস সবার ভালোলাগার জায়গায় থাকবে। আছেও তাই। গ্রামীণ মানুষদের সহজ-সরল ভাব, সহজ-সরল জীবনযাপন, ধর্মভীরুতা, সব যেন বাস্তবের মতো সত্য। কোনো নাটকীতা নেই, নেই কোনো ভণিতা। এক ধর্মের ব্যবহারের মাধ্যমে সকল ধর্মের আগাছাদের যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে চিনিয়ে দিয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। হোক যে ভন্ড পীর বা হোক সে ভন্ড বাবা।
স্কুল-কলেজে নতুন বই হাতে পাওয়ার পর প্রথম কাজই ছিল বাংলাসাহিত্য পাঠ ও আনন্দ পাঠের সব উপন্যাস, গল্প নাটক ও কবিতা পড়ে ফেলা। পাঠক্রমের জন্য লালসালু যে কতোবার পড়েছি তার হিসাব বলতে পারবো না। কিন্তু এতটুকু বলতে পারবো যে রাগে ব্রক্ষতালু জ্বলে যেতো যতবারই পড়তাম। কি জীবন্ত করে চরিত্রগুলোকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে!
প্রায় তেরো-চৌদ্দ বছর আগে পড়েছিলাম বইটা। ছোট ছিলাম, কিছু বুঝেছি, কিছু বুঝিনি, আর অনেক কিছুতেই না বুঝেই মাথা ঝাঁকিয়েছি। এত বছর পর আবার পড়লাম।
আমার সবসময়ই মনে হতো, আমরা আমাদের ক্লাসিক সাহিত্যিকদের যোগ্য উত্তরসূরী হতে পারিনি। সম্প্রতি বেশ কিছু ক্লাসিক পুনরায় পড়ার পর এই ধারণা নামের গাছটির শেকড় ততটাই গভীরে পৌঁছে গেছে, যতটা গেলে সেই গাছ উপড়ে ফেলার প্রচেষ্টা মাটিকেই মিলিয়ে দেয় মাটির সাথে। তারপর অবশেষে একদিন অবিচল গাছটা খুন হয়ে যায় গোঁয়ার্তুমির কাছে, কি���্তু একবারও ভাঙে না, মাথাটা এক ইঞ্চিও নোয়ায় না।
গল্পের কাহিনী কমবেশি সবাই জানি। আবার বলার দরকার আছে কি? শুধু অনুভূতি আর বিশ্লেষণটাই করবো এখন।
আমরা গল্প কেন পড়ি? মজা পাই তাই? তা, মজা কেন পাই? প্রধান চরিত্রকে পছন্দ করি তাই। তার সুখে হাসি, তাই। তার দুঃখে চোখে পানি আসে, তাই। সে যখন লক্ষ্যের দিকে ছুটে চলে, নখ কামড়াতে থাকা আমরা ভাবি, পারবে তো? এর আগেই ঝরে যাবে নাতো? যদি যায়?
এবার ভাবুন এমন গল্পের কথা, যার প্রটাগোনিস্ট নিজেই গল্পের এন্টাগোনিস্ট। যার চরিত্র আপনার ভেতর সহানুভূতি জাগানোর জন্য লেখা হয়নি, তার প্রতি আর তার কার্যকলাপের প্রতি ঘৃণা জাগানোর জন্যে লেখা হয়েছে। এবার? কীসের টানে পড়বেন এই গল্প?
এই ধরনের গল্প লিখে তা মানুষকে পড়িয়ে ফেলা, মানুষের মনে ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি করা, তাকে ভাবতে বাধ্য করা—একজন লেখক হিসেবে বলতে পারি, এ কাজ রুগ্ন শরীরে চার মাইল দৌড়ে এরপর একশটা বুকডন দিয়ে উঠে তৎক্ষণাৎ পুকুরে চার ডুব দেয়ার মতোই অসম্ভব। অথচ এই অসম্ভব কাজকে খুব নিপুণভাবে করে দেখিয়েছেন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ।
থিম বেসড গল্পে ‘তারপর কী হলো?’ মূখ্য নয়। গল্পের পরিণতি বা প্লটও মূখ্য নয়, মূখ্য হচ্ছে লেখক যে বার্তাটা দিতে চেয়েছেন তা মাথায় গেল কি না। তাই লালসালু গল্পের পরিণতি আপনি আন্দাজ করতে পারবেন, পারবেন জমিলার ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে তা বুঝতেও। লিটারারি ফিকশনের স্বার্থকতা এখানেই; সবই আগে থেকে জানবেন, বুঝবেন, অন্তত আন্দাজ করতে পারবেন, কিন্তু এরপরেও পড়ার পর মনটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠবে। মাথায় ঘুরতে থাকবে একটাই ব্যাপার—কিছু একটা পরিবর্তন দরকার, খুব খুব দরকার।
আফসোসের ব্যাপার কি জানেন? ১৯৪৮-এ যে গল্প পড়ে ‘কিছু একটা পরিবর্তন আসা দরকার’ অনুভূতি আসতো, সেই গল্প পড়ে ২০২০ সালেও যখন একই অনুভূতি জাগে, তখন মুখ ভর্তি নোংরা গালিতে ফেটে পড়তে ইচ্ছা করে। জানতে ইচ্ছা করে, ‘গত ৭২ বছরে কোন চুলের উন্নতি হয়েছে এই জাতির?’ কারো কাছে কি এর উত্তর আছে?
চরিত্রগুলোর ভেতর শুধু মজিদের চরিত্রকেই পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন তিনি। এই ব্যক্তি একজন স্বার্থবাদী, বিচক্ষণ এবং খুবই ম্যানিপুলেটিভ। মানুষের অজ্ঞতাকে কীভাবে পুঁজি করে ব্যবসা করতে হয়, তা সে এতই সুচারুভাবে দেখিয়েছে যে এই দৃশ্য দেখে স্বয়ং শেকলে বন্দি শয়তানও হিংসায় ছটফট করে ওঠে।
মজিদকে পুরোটা সময় লেখক রেখেছেন একজন স্ট্যাটিক ক্যারেক্টার হিসেবে। শেষদিকে এই বাক্যটা পড়ে অবশ্য ক্ষণিকের জন্য মনে হয়েছিলো, মজিদের চরিত্রে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে:
মুহূর্তের মধ্যে মজিদের ভেতরেও কী যেন একটা ওলটপালট হয়ে যাবার উপক্রম করে, একটা বিচিত্র জীবন আদিগন্ত উন্মুক্ত হয়ে ক্ষণকালের জন্য প্রকাশ পায় তার চোখের সামনে, আর একটা সত্যের সীমানায় পৌঁছে জন্মবেদনার তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করে মনে মনে।
এই আহ্বান তার বিবেকের, তার ভেতর যে ক্ষুদ্র মনুষ্যটা এখনো ধুকপুক ধুকপুক করে তার। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত খাঁচায় আবদ্ধ মনুষ্য সত্তাটা আর বেরোতে পারে না। জয় হয় লোভের, জয় হয় ক্ষমতার। মজিদেরও আর স্ট্যাটিক থেকে ডায়নামিক ক্যারেক্টার হয়ে ওঠা হয় না। হওয়াটা উচিতও হতো না। কারণ তখন মজিদের প্রতি ভালোলাগা কাজ করতো, যে ব্যবসায়ীক মনোভাবের প্রতি লেখক ঘৃণা তৈরি করতে চেয়েছেন তাতে ভাটা পড়তো।
বাকি চরিত্রগুলোর ভেতর আমার কারো প্রতিই বিশেষ আগ্রহ জাগেনি; উপন্যাসটা আসলে ঠিক ক্যারেক্টার ড্রিভেন না, থিম বেসড। এই জন্যই। তবে একজনের কথা না বললেই নয়। সারাজীবন দাপট দেখিয়ে বেড়ানো মানুষটাকে যখন মজিদের ক্ষমতার কাছে মাথা হেঁট করতে হয়, আজীবন সম্মানের সাথে কাটিয়ে এসে যখন একজন নিম্ন মানসিকতার লোকের কাছে আত্মসম্মান খোয়াতে হয়, তখন তার হাতে বোধহয় এছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকে না। বুড়োটার পরিণতিতে কষ্ট পেয়েছি, নিজের সাথে রিলেট করতে পেরেছি।
সেটিংসের কথা যদি বলি, গ্রামীণ সমাজ, তাদের অশিক্ষা, কুসংস্কার, সংস্কৃতি আর সমস্যাগুলোকে তিনি একদম জীবন্তভাবে তুলে ধরেছেন। ছোটবেলায় প্রচুর গ্রামে বেড়াতে যাওয়া হতো, এখন অত যাওয়া হয় না আর। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা থেকে জানি, গত ৭২ বছরে চোখে পড়ার মতো তেমন পরিবর্তন হয়নি। অবশ্য, শহুরে শিক্ষিত মানুষেরও কি হয়েছে?
বইয়ের প্রধান থিম বা ম্যাসেজ এরচেয়ে ভালো করে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব ছিলো না। তবে এর বাইরেও আরো কিছু সামাজিক সমস্যা তুলে ধরে সেগুলোরও যে পরিবর্তন দরকার, তা তিনি ভালোই বুঝিয়ে দিয়েছেন। বহুবিবাহ তার মাঝে একটি। নারীর প্রতি সহিংসতা বা তাদের ছোট করে দেখার মানসিকতা, এটাও আরেকটা।
প্রকৃত সাহিত্যিকের পরিচয় মেলে তার ভাষার প্রয়োগে, অলংকারের ছটায়। যে সাহিত্যে অলংকারের ভালো ব্যবহার নেই, তা সাহিত্য হয় বটে, তবে মেডিওকোরের গন্ডি পেরিয়ে ভালো সাহিত্যের কাতারে পৌঁছতে পারে না মোটেও। এখানে ‘আমার মনে হয়’ জাতীয় কথা বলে দ্বিমতের কোনো সুযোগই নেই। এখানে এটাই সত্য, শুনতে যতই তেতো শোনাক। এটা ইংরেজি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও যেমন সত্য, তেমনি রাশিয়ান সাহিত্যের বেলায়ও সত্য। আবার সত্য চাইনিজ সাহিত্যের বেলায়ও। যাদের মনে হয়, ‘না, এটা সত্য না। কারণ আমার মনে হয় আমাদের ভাষা আলাদা...’ ইত্যাদি, তারা বরং বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিকগুলো আরেকবার পড়ে আসুন। আবার বলবেন না 'ওগুলো তো পুরাতন'...না, কোনোকিছুই ‘পুরাতন’ না। এই ‘পুরাতন’ শুধু আপনার মাথায়। ওয়ালিউল্লাহ কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, এদেরকে আধুনিক সাহিত্যিকই বলা হয়। ওনাদের ভাষাও প্রমিত বাংলাই। এখনো পোস্ট মডার্ন যুগ বলার মতো কোনো যুগ আমরা তৈরি করতে পারিনি। যা তৈরি করেছি তাকে বরং ‘বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় অন্ধকার যুগ’-ই বলা যায়, এর বেশি কিছু নয়।
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ যখন লিখেন:
অন্য অঞ্চল থেকে গভীর রাতে যখন ঝিমধরা রেলগাড়ি সর্পিল গতিতে এসে পৌঁছয় এ দেশে, তখন হঠাৎ আগাগোড়া তার দীর্ঘ দেহে ঝাঁকুনি লাগে, ঝমঝম করে ওঠে লোহালক্কড়। রাতের অন্ধকারে লণ্ঠন জ্বালানো ঘুমন্ত কত স্টেশন পেরিয়ে এসে এইখানে আগুনের হল্কার মতো পুড়িয়ে দেয় দেহ।
একদম বুকের মাঝে গিয়ে লাগে, তাই না? এরকম অজস্র অলংকারিক বাক্যের ছড়াছড়ি আছে বইটিতে, আছে তাঁর অন্য সব লেখাতেও। যেমন আরেকটি বাক্য:
এ নিঃশব্দতার মধ্যে তার গলার অস্পষ্ট মিহি আওয়াজ কোনো আদিম সাপের গতির মতো জীবন্ত হয়ে থাকে। তার কণ্ঠে যদি সাপের গতি থাকে, তবে তার মনেও এক উদ্যত সাপ ফণা তুলে আছে ছোবল মারার জন্য।
সাহিত্যের ভাষা তো এমনই হয়। একটু কাব্যিক, একটু গুরুগম্ভীর, একটু অলংকারে পূর্ণ। ধরুন, এই ওয়ালিউল্লাহকেই যদি স্বাভাবিক কথোপকথনের সময় কেউ রেলগাড়ি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতো, এটি দেখে মনে কী অনুভূতি জাগে তোমার? তখন কি তিনি উপরের কথাটাই বলতেন?
‘ভাই, কেউই কি এভাবে কথা বলে?’
না, বলে না। ১৯৪৮ সালের বই এটা। সেসময়ও কি কোনো জনপ্রাণীর মুখের ভাষা এমন ছিলো? সাহিত্যের ভাষা কি আসলে মানুষের মুখের কথ্য/আঞ্চলিকতায় পরিপূর্ণ ভাষাই, নাকি তাতে ভিন্নতা থাকে? সাহিত্যের ভাষা কি আমাদের হাল আমলের ‘বলসো, গেসো, করসো, বাবু খাইসো?’ কেউ কি কখনো ভেবে দেখেছে একবার? নাকি ভেবে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেছে? সাহিত্যের ভাষা কি ‘আক্কাছ ঘুরলো। পকেট থেকে পিস্তল বের করলো। গুলি করলো। লাশ পড়লো’?
না, সাহিত্যের ভাষা কখনোই এমন ছিলো না। এটা আমাদের কথ্য ভাষা। আপনাকে যখন পুলিশ কোনো খুনের ঘটনা বর্ণনা করতে বলবে, আপনি এভাবেই বলবেন। তদন্তকারী কর্মকর্তার সামনে নিশ্চয়ই কাব্যিক বর্ণনা দেবেন না? চড়িয়ে গালের দাঁত ফেলে দেয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সাহিত্য চর্চা যখন করতে আসবেন, তখনও কি এভাবেই লিখবেন? জ্ঞানীরা কি একটু সময় নিয়ে ভেবে দেখবেন কথাটা?
না, আমি বলছি না আপনার প্রত্যেকটি বাক্য অলংকারের ভারে নুয়ে পড়তে হবে। আমি বলছি না প্রত্যেকটা বাক্য বড় বড় লিখতে হবে। কারণ অতিরিক্ত কারুকাজ করলে সেটা পার্পল প্রোজ হয়ে যাওয়ার ভালো সম্ভাবনা আছে (পার্পল প্রোজ মানে এমন অলংকারিক বাক্য যা দূর থেকে অসাধারণ মনে হয���, কিন্তু একটু কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায়, সে আসলে সত্তাহীন জড় পুতুল ছাড়া কিছুই না।)
আমি শুধু বলতে চাইছি, সাহিত্যের ভাষা আর মানুষের কথ্য ভাষার ভেতর বেশ পার্থক্য আছে। সাহিত্যের ভাষায় অলংকার থাকে, গুঢ় বার্তা থাকে, ভাবনার খোরাক থাকে। এই সত্যটা আমরা যত দ্রুত বুঝবো, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।
ব্যাপারটা আরেকটু বুঝাই।
ফেসবুকে আমরা কীভাবে স্ট্যাটাস লেখি? আমরা যেভাবে কথা বলি, সেভাবেই তো, না? এখন ধরুন, এই ওয়ালিউল্লাহই যদি ফেসবুক প্রজন্মের সাহিত্যিক হতেন, তবে ফেসবুকে রেলগাড়ি নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়ার সময় কি ঠিক ওভাবেই লিখতেন নাকি সরল ভাষায় লিখতেন: অনেক দূর থেকে এসেছে রেলগাড়িটা। সাপের মতো দীর্ঘ গাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। লোহালক্কড়ের ঝমঝম শুনছি। ইঞ্জিনের ধোঁয়ায় গরম লাগছে খুব। আচ্ছা, গাড়িটা নিশ্চয়ই অনেকগুলো স্টেশন পেরিয়েই এসেছে, না? ভাবছি, এর যদি জীবন থাকতো, তবে কি ক্লান্ত গলায় বলে বসতো, ‘ইয়ো, ব্রো, এক বোতল জ্যুস হবে? টাকা পরে দেবো। মানিব্যাগ ফালাই আসছি তো...’?
আমার ধারণা, ওয়ালিউল্লাহ যদি আমাদের প্রজন্মের সাহিত্যিক হতেন, তবে শুধু ফেসবুক স্ট্যাটাসে না, লালসালু নামের উপন্যাসেও ঠিক এভাবেই লিখতেন।
আর আমার দুঃখটা ঠিক এখানেই। কেউই কি খেয়াল করেনি যে আজ এই ২০২০ সালে, যেখানে আমরা ৪-জি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করি, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাঝে এক ঘণ্টা ডুব দিতে না পারলে আমরা পথ ভুল করে ডাঙ্গায় চলে আসা মাছের মতো হাঁসফাঁস করি, উঁচুমানের রেস্টুরেন্টে মাসে একবার না খেলে আমাদের জাত থাকে না, আধুনিক সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখার জন্য একে অপরকে পদদলিত করি, সেখানে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের একজন সাহিত্যিকও নিজের দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বকে চমকে দিতে পারিনি? অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত কিংবা পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক বিশ্ব দরবারে পৌঁছে গেছে, সম্মান পেয়েছে, দেশ ও জাতিকে সম্মানিত করেছে। আর ওদের হরদম গালিগালাজ করা এই আমরা কীইবা করতে পেরেছি? কেন করতে পারিনি? কেউ কি কখনো ভেবে দেখেছে? ইচ্ছা হয়েছে কখনো ভাবার যে সমস্যাটা আসলে কোথায়? ‘না ভাই, বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ হতে হবে বেশি বেশি।’ আসলেই? আপনার ধারণা, আমরা এখন যা লেখি তার অনুবাদ হলেই বিদেশিরা খুশিতে গদগদ হয়ে আমাদের ম্যান বুকার দিয়ে দেবে? তাহলে বলবো, এখনো সমস্যাটা ধরতেই পারেননি আপনি।
একটা গর্ব আর একটা আফসোস দিয়ে শেষ করবো।
গর্বটা হচ্ছে, ৯০ দশক পর্যন্ত আমাদের সাহিত্য বিদেশি সাহিত্যের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার যোগ্যতা রাখতো। কারণ তখন বা তারও অনেক আগে আমাদের ছিলেন একজন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, একজন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, একজন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, একজন শরৎ কিংবা বঙ্কিম।
কিন্তু আফসোস, ২০০০-এর পর থেকেই আমাদের সাহিত্যের প্লেনটা উড়তে ভুলে গেছে। তার নাক ঊর্ধ্বমুখী নয়, কুৎসিতভাবে নিম্নমুখী। অথচ যাত্রীদের কোনো ভাবান্তর নেই। দিব্যি কানে হেডফোন লাগিয়ে সিটে গা এলিয়ে চোখ মুদে আছে। তারা আনন্দিত, ভীষণ ভীষণ সুখী। কী এক অদ্ভুত অভিকর্ষ তাদের দিক সম্পর্কে ভুল বুঝিয়ে যাচ্ছে, ভাবতে বাধ্য করছে, তাদের নাক উপরের দিকেই খাড়া হয়ে আছে, নিচের দিকে নয়। যদি অভিকর্ষের সঠিক দিকটা বুঝতো, তবে জানতো যে প্লেনটা সেই কবেই রানওয়ে থেকে সরে গেছে, শীঘ্রই রানওয়ে থেকে শখানেক মাইল দূরের এক নোংরা বিলে লুটিয়ে পড়তে যাচ্ছে ১৭ কোটি যাত্রীকে পেটে নিয়ে।
আগে তারা লিখতেন: কিন্তু এমন সময় বৈশাখী মেঘের আকস্মিক আবির্ভাবের মতো কী একটা বৃহৎ ছায়া এসে আমেনা বিবিকে অন্ধকার করে দিলো।
আর এখন আমরা লেখি: আমেনা বিবির চারপাশ টলে উঠলো। চোখে আঁধার ঘনিয়ে এলো। পড়ে গেল আমেনা বিবি।
অনেক থ্রিলিং, ফাস্ট পেসড, তাই না? ................................................................................................................................................................................................................................................................................................................................................................................................................................................... আসলে, মাঝে মাঝে কথা বলার চেয়ে চুপ থাকাই শ্রেয়। কারণ কয়েক স্তরব্যাপী নিরবতার মাঝে যে অব্যক্ত কথাগুলো লুকোনো থাকে, তাদের জোর নিউক্লিয়ার বোমার চেয়েও বেশিই হয়।
দুঃখিত, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ। আমরা বর্তমান সাহিত্যিকেরা পারিনি আপনাদের যোগ্য উত্তরসূরী হতে। হয়তো কখনো পারবোও না। আমাদের ক্ষমা করে দেবেন।
ওহ! অসাধারণ! সেই কবেকার লেখা, তবু এখনকার যুগের সাথে খুব একটা অমিল বোধহয় নেই। খারাপ লাগছে এই ভেবে যে উপন্যাসটা এইচেসসিতে নাকি পড়তে হবে :3 পাঠ্যবই হিসেবে পড়ে আর ভালো লাগবে কি না কী জানি :3
হয়তোবা তখন ক্লাস টু কিংবা থ্রীতে পড়ি।আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটা টিভি ছিলো।সাদাকালো হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।স্পষ্ট মনে পড়ছে না। অনেকেই অবগত আছেন যে, আগে সপ্তাহে দুইদিন বিটিভিতে ছায়াছবি হতো।আমিও অধীর আগ্রহ নিয়ে দিন দুটির জন্য অপেক্ষা করতাম ও ছবি দেখতাম।
এর মধ্যে একটা ছবির কথা আমার অস্পষ্টভাবে মনে পড়ে।একটি মেয়ে রাতে নামাজ পড়তে গিয়ে জায়নামাজে ঘুমিয়ে পড়েছে।তা তার স্বামী দেখে ফেলে এবং মনে হয় গালমন্দ ও প্রহারও করে। এইটুকুই মনে আছে।আগে পরে আর কিছু মনে নেই।অনেক চেষ্টা করেও মুভিটা সম্পর্কে কিছু মনে করতে পারি নি।
এই উপন্যাসটা আবার সেই ছোটবেলার মধুর সময়টির কথা মনে করিয়ে দিলো।এই উপন্যাসটার আদলেই মুভিটা তৈরি করা হয়েছিলো।
বহুকাল আগে (প্রায় এক যুগ)- কিশোরবেলায়- সৈয়দ সাহেবের এই বিখ্যাত উপন্যাসের সাথে আমার সাক্ষাত ঘটেছিল। সে বেলা কতোটুকু বুঝেছিলাম তা জানি না, কিন্তু খুব একটা উপভোগ করিনি। স্বাভাবিক, করার কথাও না। 'লালসালু'র গভীরতায় ডুব দেবার জন্য যে অভিজ্ঞতা ও পঠনপাঠন প্রয়োজন তার ঘাটতি ছিল। এখন দ্বিতীয়বার পড়ার পর উপলব্ধি করলাম- কেন বেশিরভাগ আধুনিক লেখক-সমালোচক এই উপন্যাসের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে প্রশংসা উপন্যাসটির প্রাপ্য বটে। আমি অবশ্য ৭০ বছর পুরোনো উপন্যাসটির আজকের দিনের প্রাসঙ্গিকতার কথা ভেবেই অবাক হই। সৈয়দ ওয়ালীওল্লাহ সত্যিই এই ভূখণ্ডের মানুষকে হাড়ে হাড়ে চিনে ফেলেছিলেন।
শেষ করলাম সৈয়দ ওয়��লীউল্লাহ সাহেবের বিখ্যাত এবং আলোচিত উপন্যাস "লালসালু"। ধর্ম সবচাইতে উপরে। সেই ব্যাপারে কোনো দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নাই। এইটা এমন এক বস্তু যেখানে সকল বিশ্বাসী দুর্বল। সে বিশ্বাসী যতোই শক্তিশালী বা প্রতাপশালীই হোক না কেনো! আর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ধান্দা করে নেয় মুষ্টিমেয় কিছু ধান্দাবাজ।
" লালসালু"-তে ওয়ালীউল্লাহ সাহেব ঠিক সেই জায়গাটাই তুলে ধরেছেন। ধর্মের নামে ভন্ডাম�� আর গ্রাম বাংলার মানুষের অজ্ঞতা নিয়ে এক অনন্য উপন্যাস হচ্ছে এই "লালসালু"। ধর্মের পতাকা উড়িয়ে নিজের আখের গোছানোটা কি পর্যায়ে গেছে তা আপনি আমি সবাই জানি। এই উপন্যাসটা ঠিক সেরকমই একজন ভন্ডের গল্প দিয়ে তৈরি। যে নিজ স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করেছে আর সেই সাথে দুহাতে নিজের ফায়দা লুটেছে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও এহেন বহু মানুষ পাবেন যারা ধর্মের নামে বহিপীরের মতো নিজেদের সুবিধা তৈরিতে ব্যস্ত। যারা দুনিয়াবী স্বার্থের জন্যে ধর্মকে যত্রতত্র খেয়াল খুশিমতো ব্যবহার করেই চলেছে। "লালসালু" আপনাকে এইসব ধান্দাবাজদের নিয়ে আরো একবার ভাবতে বাধ্য করবে।
সবমিলিয়ে, খুব উপভোগ করেছি। এই উপন্যাসটা ক্লাস এইটে থাকতেও পড়েছিলাম। আজ বহু বছর পর আবার পড়লাম। বেশ ভালো লাগলো। পড়ে ফেলতে পারেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ'র এই বিখ্যাত উপন্যাস। আশা করি ভালো লাগবে।
আমাদের কথা ছিল সৃষ্টিকর্তাকে ভালবাসবো, তিনি যে আমাদের ভালোবাসার সেটা অনুভব করবো। কিন্তু ভালবাসলে কৃতজ্ঞতায় তার জন্য কাজ করবে এত সাধু তো কপট বাঙ্গালী মুসলমান নয়। আবার সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসার কথা প্রচার করলে ধর্মশিক্ষকদের কার্যোদ্ধার হয় না। কিন্তু ভয় সৃষ্টি করতে পারলে তাদের নিজেদের কার্যোদ্ধারও হয়ে যায় খুব সহজ। তাই ধর্মশিক্ষকেরা সেই পথই বেছে নিয়েছেন- আল্লাহকে ভয় করো, অমুক করলে আল্লাহ নারাজ, তমুক করলে জাহান্নাম। একারণেই সৃষ্টি হয় পীর-মুরিদের। আল্লাহকে নিজের আকুতি জানাবার মাধ্যম, যারা আবার কিনা নিজেরাই আল্লাহর বার্তাবাহক।
ভয় দেখিয়ে অর্থ, ক্ষমতা, শ্রদ্ধা সবই তারা পায়; আল্লাহকে ভয় করার সাথে সাথে সেই ভন্ড পীরকেও অশিক্ষিত জ্ঞানহীন জনতা ভয় পায়।
সেরকম ভন্ড পীরের কাহিনীর একাংশ এই লালসালু। আরও ২/৩ যুগ আগে থেকেই গ্রামের মানুষ আর ইসলামকে জানার জন্য মাধ্যমের প্রয়োজন অনুভব করে না। তারা নিজেরা বই পড়ে দেখেন তাতে কী লেখা আছে, আরও জানার আগ্রহ তাদের তৈরি হয়। যে কারণে পীর মুরীদের দৌরাত্ম্য বেশ অনেকটা কমে এসেছে। তার পরেও রয়ে গেছে অন্ধকার সমাজ, প্রত্যন্ত অঞ্চল বা অন্য জায়গার হতদরিদ্ররা; আর আছে বংপরম্পরায় অন্ধভক্তরা। তাই বেশ আগে লেখা উপন্যাস এখনো সময়োপযোগী। তবে উপন্যাস হলেও ছোট গল্পের আভাস রয়েছে। বড় ছোট গল্পও বলা যায়।
সত্যিই অনবদ্য একটা বই ছিল। বইটা ছোট হলেও আমার পড়তে কেন জানি যা লাগার তার চেয়ে একটু বেশিই সময় লাগছে। বইটা পড়ছিলাম আর আমাদের দেশের সেই আদ্দিকাল থেকে এখন পর্যন্ত চলে আশা ধর্ম বাণিজ্য নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলাম। ঘটনার শুরুতে আমাদের দেশের আর দশটা গ্রামের মত একটা গ্রাম যেখানে উপরওয়ালার রহমত এর কারণে বহু আগে থেকে মাঠে মাঠে সোনা ফলে। মজিদ নামে এক চতুর বাক্তি, নিজের ভাগ্য সন্ধানে এ গ্রামে আসে। সে এসে জংলার ভেতর একটি কবর কে কেন্দ্র করে সেই গ্রামে তার প্রতিপত্তি বাড়ানো শুরু করে। এক সময় গ্রামে তার কথার ওপর দিয়ে কথা বলার আর লোক থাকেনা । শালু কাপড় বিছানো মাছের পিঠের মতো চিরনিরব মাজার কে কেন্দ্র করে কাহিনি অগ্রসর হতে থাকে।
ওয়ালিউল্লাহ সাহেবের প্রথম থেকেই বাঙালির এই অতি মাত্রার পীরপ্রিতির বিপক্ষে বহু সৃষ্টিশীল রচনাায় আমাদের সাহিত্যকে উজ্জ্বল করেছেন। এখানেও তাঁর দৃষ্টিনন্দন পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করা আমার দ্বারা হবে না। তাঁর লেখার স্বকীয়তা খুব একটা অন্যদের মধ্যে দেখা যায় না। বাকিটা পরলে। :)
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের কালজয়ী সৃষ্টি "লালসালু", যেখানে মহব্বতনগর নামক এক ধর্মভীরু গ্রামীণ মুসলিম সমাজে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারকে পুঁজি করে মজিদের মতো ধূর্ত ও কপট প্রকৃতির ধর্মব্যবসায়ী সম্মোহিত করে রাখে গ্রামবাসীকে বছরের পর বছর, যার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি কল্পিত মাজার। এখানে মজিদ যে শুধু গ্রামীণ জনপদের সরলতা ও অজ্ঞতাকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে তাই নয়, বরং তার শঠতা ও অন্ধবিশ্বাসের মাধ্যমে সে আড়াল করেছে তার অস্তিত্ব সংকটকেও। যেখানে জ্ঞানের আলোকে সে উদ্ভাসিত হতে দেয়নি, বরং কুসংস্কারের অন্ধকারাচ্ছন্ন গহব্বরে সে অজ্ঞানতা ও মূর্খতার সংখ্যাবিহীন শেকড়কে সে ছড়িয়ে পড়তে দিয়েছে।
"লালসালু" তে আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র জমিলা, প্রতিবাদ ও অদম্য সাহসিকতা যার সহজাত বৈশিষ্ট্য। চঞ্চলা জমিলা যেন শৃঙ্খলমুক্ত এক বুনো পাখি, যাকে কোন শাসন বারণের বেড়ি পরিয়ে আটকে রাখা যায় না। সে শব্দহীন, অথচ বিদ্রোহের এক উজ্জ্বল প্রতিমূর্তি। আর এই জাজ্বল্যমান বিদ্রোহই ম্রিয়মাণ করে দিয়েছে মজিদের হাজারো কূটকৌশল ও ছলচাতুরীর প্রয়াসকে।
সবশেষে এটাই বলবো, মহব্বতনগরের মানুষ যদি একটু বুঝদার হতো, তাহলে তারা ঠিকই অনুধাবন করতে পারতো ছল মজিদের আসল উদ্দেশ্য, সে সৃষ্টিকর্তাকে সঠিকভাবে মন ও মননে ধারণ করতে নয়, বরং নিজের অস্তিত্ব সংকট মেটাতেই ধর্মকে পুঁজি করে ব্যবসা করে এসেছে এত বছর। একজন স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি কীভাবে বিভ্রান্তি ও ভীতির জাল বিস্তার করে নীরব শোষণের প্রক্রিয়া চালু রাখে তারই আখ্যান "লালসালু"।
উপন্যাসের নাম: লালসালু লেখক: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ধরন: চিরায়ত উপন্যাস (সামাজিক) প্রথম প্রকাশ: ১৯৪৮ প্রকাশনী : সূর্যোদয় প্রকাশন মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা : ১২৪
Lalshalu by Syed Waliullah is a classic Bengali novel set in a rural village in the 1940s. Through Lalshalu, Waliullah critiques how easily rural superstitious people can be manipulated by fake religious leaders. The novel highlights the villagers' ignorance, showing how Majid had taken advantage of it for his benefit. The author’s Milimanistic writing style is simple and easy to read, making the story engaging, though I found some parts repetitive.
Though the book does highlight issues like ignorance and exploitation, the biggest issue, however, is how Waliullah had said that religion is the tool of exploitation, apostasy means true freedom, these kinds of typical one-sided themes in this book. The story paints a picture where religion itself is the problem, which I found problematic. I didn’t appreciate how it portrayed religion in such a negative way. The novel’s critique of religious manipulation is important, but it overlooks the complexity of faith and religion, presenting it in a way that felt overly biased and unrealistic.
Another issue I had was with the portrayal of the villagers. Waliullah presents them as ignorant and easily fooled, which felt a bit like stereotypes. While the book addresses ignorant and superstitious aspects of a kind of people, it doesn’t offer a deep enough look at the villagers’ lives multidimensionally. Compared to the earlier novel in the college text book Padma Nadir Majhi, this one feels too simplistic.
Overall, Lalshalu highlights important social issues like religious exploitation and ignorance. But the one-sided view of the villagers and forcefully negative portrayal of religion make the story feel biased and unrealistic, much like the stereotypical Western approach to Eastern cultures. That's why I would say this book is very weak as a classic.
📚 Name of the book : Lalshalu
📚 Author : Syed Waliullah
📚 Book's Genres : Classic, Social Fiction, Text Book
সালু কাপড়ে জড়াইয়া একটি কবরকে এক ধুরন্ধর লোক সহজ-সরল গ্রামের মানুষদের ভয় দেখাইয়া ঠকাইয়া-ঠাকাইয়া ব্যক্তি চাহিদা হাসিল করিতেছে। বলিতেছে: এ কবর এক আউলিয়া লোকের; তিনি স্বপ্নে দেখেছেন অতএব গ্রামবাসীকে হুজুরানের খিদমদ করিতে হইবে। অর্থাৎ চাল-ডাল-তেল-নুন দাও।
এমনই যেন দিক উন্মোচনকারী, রাজ্য জয় করে যাওয়া অমর আত্তিলার বেশে পুস্তিকাটি রচিয়াছিলেন জনাব ওয়ালিউল্লাহ। সামাজিক কুসংষ্কারকে শাসন করিতে গিয়া যেন অবোধ বৃদ্ধের ক্ষোভে গত শতকের সেন্টিমেন্টে অতিরঞ্জিত এক চরিত্রের মধ্যে সমাজকেই প্রবিষ্ট করিবার প্রচেষ্টা করিয়াছেন। যাহা গল্পের প্লটে যেমন নাজুক, লজিকেও ঝুরঝুরে করিয়াছে।
এহেন পুস্তিকা রচনায় য়ুরোপিয় মক্সোবাদীদের বাহবা-করতালি মিলিলেও তাহা যে এই ফাটকাবাজির দেশে ধর্মান্ধতার জ্বলন্ত কুন্ডে আরো তুষ ছিটাইয়া বিদ্বেষ বাড়াইয়া দেয়, সেই পুনঃর্চিন্তা বুদ্ধিবৃত্তির অনুচরেরা করিয়া দেখিবেন আশা করি।
অনেকেই এটা পড়েছেন পাঠ্য হিসেবে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা আমাদের পাঠ্য ছিলনা। আমাদের ছিল 'পদ্মা নদীর মাঝি'। সেই কারনে এটা আর আমার পড়া হয়ে ওঠে নি।
এটার অনেক নাম শুনে এসছি এতো বছর যাবত। অনেককেই দেখেছি এটাকে মাথার উপরে তুলে নাচতে। আমিও তখন ভাবতাম যেদিন আমি এটা পড়বো, সেদিন আমিও এটা নিয়ে উল্লাস করবো, আনন্দ করবো। কিন্তু পড়ার পরে সেই আনন্দ উল্লাস আর করা হলো না। কাহিনী খুব সুন্দর ভাবেই টেনে নিয়েছেন লেখক। অনবদ্য বিশ্লেষণ ক্ষমতা আর চরিত্র নির্মাণের দক্ষতা দেখিয়েছেন অসাধারণ ভাবে। কিন্তু শেষটা মনে ধরলো না কোনভাবেই। কেমন যেন হুট করেই শেষ হলো! উপন্যাস হিসেবে ভালো। তবে মাথায় তুলে নিয়ে নাচার মতো না। কিছু ফ্যানাটিকের অতি মাত্রায় রেটিং এটাকে ওভাররেটেড বানিয়ে ছেড়েছে।
অনেক প্রত্যাশা নিয়ে পড়া শুরু করছিলাম কিন্তু ১ স্টারের বেশি দিতে পারলাম না, যদিও লেখকের লেখার হাত অনেক ভাল, সাহিত্যের গুনাবলীও লেখায় অটুট ছিল। নাস্তিকতাবাদের বেশ কিছু বীজ লেখক পাঠকের মনে দিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন খুবই সতর্কতার সহিত। নাস্তিকতা বললে সম্পূর্ণতা পায় না বলা উচিত খুজে খুজে ইসলামে ত্রুতি বের করতে লেখকের বেশ মনোযোগ ছিল। সাহিত্যের বই পড়ি নিশ্চয়ই ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্যে নয়, ইসলামিক সঠিক জ্ঞান দেয়ার জন্যে অজস্র ইসলামিক স্কলার রয়েছেন। খুবই খারাপ লাগে সাহিত্যের মধ্যে ইসলামকে ছোট করার জন্য কতিপয় লেখকদের এমন অপপ্রয়াশ দেখলে।
বাস্তবতায় অতিরঞ্জন দুর্লভ হলেও লেখনীতে ফুটিয়ে তোলা অতিব সহজ ফলস্বরুপ পাঠককে আচ্ছান্ন করে রাখা সহজ সাধ্য হয়ে যায়। লেখনীর হাত প্রশংসনীয় হলেও লালসালু উপন্যাস সামগ্রীক ভাবে ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছান্ন ব্যাক্তিকে ঘীরে অনেকটাই অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে বাস্তবতায় যা অসম্ভব না হলেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে হা স্বীকারোক্তি দিতেই হয় এ দেশে ধর্মীয় গোঁড়ামি অনুপস্থিত নয় বরং যথেষ্ট তার জন্য আমরা নিজেরাও কিন্তু ঢের দায়ী কারন দুনিয়ার তাবৎ জ্ঞান আমরা মাথা পর্যন্ত উঠিয়ে ফেললেও ধর্মীয় জ্ঞান ইচ্ছাকৃত হাঁটুর নিচেই ফেলে রাখি। এ দিকে লেখক নিজেও ধর্মের সাথে যে ধর্ম ব্যাবসায়ী বা গোঁড়ামির নাম মাত্র যোগসূত্র নেই সে কথা পরিস্কার করতে বেমালুম ভুলে গেলেন। কুসংস্কার দূরীকরণ যদি উদ্দেশ্যে হয় তাহলে ধর্মের সাথে তার যোগসূত্র কতদুর পাঠকের সামনে কিঞ্চিৎ হলেও পরিস্কার করলেন না কি করে, যেন সাধারন পাঠক অন্তত তার সঠিক বিশ্বাস ও কুসংস্কারে পার্থক্য গড়তে পারে। হা লেখককে সাধুবাদ যে তিনি বহুকাল আগেই ধর্মীয় গোঁড়ামির মুল দেখতে পেয়েছেন কিন্তু একই সাথে তার নিজ ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবও লেখনীর বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ পেয়েছে উদাহরণ স্বরূপ উপন্যাসের শুরুর দিকেই "ন্যাংটা ছেলেও আমসিপারা পড়ে, গলা ফাটিয়ে মৌলবির বয়স্ক গলাকে ডুবিয়ে সমস্বরে চেঁচিয়ে পড়ে। গোঁফ উঠতে না উঠতেই কোরান হেফজ করা সারা। সঙ্গে সঙ্গে মুখেও কেমন-একটা ভাব জাগে। হাফেজ তারা। বেহেশতে তাদের স্থান নির্দিষ্ট। "
এমন উদ্ভট কথা বলেন কি করে? উল্টো বরং শুধু হাফেজ হলে বেহেশত নিশ্চিত এমন গ্যারান্টি আল্লাহ কোথাও দেন নি। তাছাড়া সবে মাত্র গোঁফ উঠা কিশোরের মুখের ভাব দেখেই লেখক তা বুঝে ফেললেন? দেখা যাচ্ছে লেখক নিজেও কিছুটা কুসংস্কার পাঠকমনে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। বিভিন্ন স্থান ছাড়াও গল্পের শেষের দিকেও একই ধারা আমরা দেখতে পাই। যেমনটা তিনি বলেছেনঃ শ
একজন লেখকের ধর্মীয় জ্ঞান কেমন হলে এমনটা বলতে পারে আর এমন কথা সাধারন পাঠক মনে কতটা অজ্ঞতা ছড়াতে পারে। পুরো কুরআন জুড়ে এমন কথা খুঁজে দেখুনতো যে শয়তান তাড়াতে শিলা বৃষ্টি হয় বরং বৃষ্টি আল্লাহর এক নেয়ামত। তাই শুধু মাত্র লেখনী বিচারে একটি বই বিচার না করে তার প্রকৃত বার্তা কি বহন করে আর স্বল্প হলেও স্পর্শকাতর বিষয়ে কতটা প্রতিক্রিয়াশীল বার্তা রাখে একজন সচেতন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ তার কাম্য যেন এক দিক দিয়ে কুসংস্কার দূর করতে গিয়ে আরেক দিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে না পরি।
সত্যি বলতে একটু হতাশই হয়েছি। আসলে বহুদিন ধরে সিরিয়াস পাঠকদের থেকে 'লালসালু'র ভূয়সী প্রশংসা শুনে শুনে তাকে যতটা উঁচু আসনে আগাম বসিয়ে ফেলেছিলাম, লেখাটা ভালো হলেও ততটা ভালো মনে হলো না। আমি যদি সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক মন নিয়ে, কোনো পূর্ব ধারণা ছাড়া 'লালসালু' পড়তাম তাহলে কি বেশি ভালো লাগত? খুব সম্ভবত - হ্যাঁ। আরেকটা কারণ বোধহয়, কিছুদিন আগে পড়া 'খোয়াবনামা'র রেশ আমার মনের মধ্যে এখনো রয়ে গেছে। ফলে, না চাইতেও তুলনা করে ফেলেছি। পাঠক হিসাবে সে দোষ আমারই।
ভালো না লাগার জায়গাটা সংক্ষেপে বলি। প্রথমত, লেখক 'লালসালু'র শুরুতেই একটা পক্ষ নিয়ে নিয়েছেন। যেখানে ধর্মগুরু শ্রেণী খলনায়ক। তারা শোষক। বাকিরা শোষিত। আমার মনে হয় এরকম একটা অবস্থান লেখাকে দুর্বল করেছে। চরিত্রগুলোকে করেছে সাদা আর কালো; গল্পকে করেছে মেলোড্রামাটিক। 'খোয়াবনামা' প্রতিটি প্রতিনিধিস্থানীয় চরিত্রের যে ব্যক্তি রাজনীতি যা শ্রেণী রাজনীতিকে বুঝতে সাহায্য করে, সেটা ভীষণভাবে নেই এখানে। দ্বিতীয়ত, ভালো গল্প সংঘাত ছাড়া দাঁড়াতে পারে না। মজিদের বিরুদ্ধে পালটা কোনো চরিত্রকে দাঁড় করাত�� দেখলাম না। সবাই তার অনুগত। তুলনায় বেশি প্রসিদ্ধ পীরের সাথে একটা সংঘাতের জায়গা তৈরি করতে গিয়েও লেখক মাঝপথে রণে ভঙ্গ দিলেন। মনে হলো, তাঁর সচেতন সিদ্ধান্ত কোনো ধর্মগুরুর পক্ষ তিনি নেবেন না। তা ভালো। গ্রামের একটি অধুনা শিক্ষিত ছেলের চরিত্র আসাতে ভাবলাম এবারে একটা দ্বন্দ্ব প্রতিষ্ঠা পাবে। কিন্তু সেই সূত্রটাকেও লেখক বেশি দূর নিয়ে গেলেন না।
ভালো লাগার জায়গা অবশ্যই একাধিক। গদ্য অতিশয় স্বাদু। লেখকের লেখা প্রথম পড়ি স্কুল পাঠ্যবইয়ে - "একটি তুলসীগাছের কাহিনি"। অসাধারণ লেগেছিল তাঁর বাক্যের গঠন, সংলাপের ঋজুতা, চরিত্রের অভিব্যক্তির বর্ণনা। সেই রেশ এখানেও পেলাম। আমার মনে হয়, এই উপন্যাসে যা মালমশলা ছিলো তাতে একশো পাতার বড়গল্পের আয়তনে আবদ্ধ না করে আরেকটু ধীরলয়ে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস হিসাবে লেখা হলে হয়তো পাঠক হিসাবে আমার আরেকটু ভালো লাগত।
"লালসালু" পড়েছি পাঠ্য হিসেবে। খারাপ লাগেনি। চারতারা দিয়েছিলাম। কিন্তু সবাই এর এতো এতো প্রশংসা কেন করে বুঝতে পারতাম না ঠিকঠাক।
কদিন পরে এইচএসসি পরীক্ষা। তাই আবার উপন্যাসটা নিলাম। পরীক্ষার পড়ায় মন বসছে কিছুদিন। তাই পাঠ্য বিবেচনা থেকে সরে গিয়ে এমনি উপন্যাস হিসেবে পড়ার চেষ্টা করলাম। পড়তে গিয়েই অবাক হলাম। এতোদিন আমি একে এই অনাদরে ফেলে রেখেছি!
পাঠ্য করে দিলেই কেন যেন সাহিত্যের আবেদন কমে যায়। এসএসসিতে পাঠ্য ছিল জহির রায়হানের "হাজার বছর ধরে"। পরীক্ষার আগ পর্যন্ত ভালো লাগেনি, কিন্তু পরীক্ষার পরে আরেকবার পড়ে বুঝলাম, কী অসাধারণ ছিল উপন্যাসটা।
মজিদের চরিত্রকে কেন্দ্র করেই সব। ধর্মব্যবসার কাজে ব্যবহৃত হলেও তার সতর্ক দূরদর্শিতা মুগ্ধ করেছে আমায়। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে লেখকের লেখার ধরণ। লেখক নিজে সব বলেননি। ইঙ্গিত করে বাকিটা বুঝে নেয়ার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন পাঠকের উপর। মজিদের মনস্তত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিজে বলেননি তেমনকিছুই, শুধু ঘটনাপ্রবাহ এমনভাবে সাজিয়েছেন যাতে ঘটনাই তার মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে দেয়।
অতএব, আমি স্বীকার করছি, "লালসালু"কে চার তারা দিয়ে আমি অন্যায় করেছিলাম। সেই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত আজ করলাম পাঁচ তারা দিয়ে।