সত্তর দশকের অগ্নিস্রাবী রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমার শেষ পর্বে কালবেলার নায়ক অনিমেষ আশা করেছিল তার পুত্র অর্ক তার সমাজতান্ত্রিক আদর্শের নিশানটি শক্ত হাতে বহন করে নিয়ে চলবে। কিন্তু সমকালীন অন্তঃসারহীন কুটিল রাজনীতি এবং পঙ্কিল সমাজব্যবস্থা অর্ককে করে তুলেছিল অন্ধকার অসামাজিক রাজত্বের প্রতিনিধি। কিন্তু যেহেতু তার রক্তের মধ্যে ছিল অনিমেষের সুস্থ আদর্শবাদ এবং তার মা মাধবীলতার দৃঢ়তা ও পবিত্রতার সংমিশ্রিত উপাদান, সেই হেতু তার বোধোদয় ঘটতে বিলম্ব হয়নি। এক ভিন্ন মানসিকতায় সে আহ্বান শুনেছিল চিরকালীন মানবতার। একদিকে সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক দল এবং অপরদিকে সুবিধাবাদী সমাজব্যবস্থার যূপকাষ্ঠে নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত কিছু মানুষকে একত্র করে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল নতুন ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। তাদের সামনে তুলে ধরেছিল আগামী পৃথিবীর সুন্দরতম এক মানচিত্র। কিন্তু ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দল ও সমাজ অর্ককে অর্গলবদ্ধ করে সেই পবিত্র পৃথিবীর স্বপ্নটি ভেঙে চুরমার করতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু অর্ক—যার অপর নাম সূর্য— তার আবির্ভাবকে কি চিরকালের মতো রুদ্ধ করে রাখা যায়?কালপুরুষ উপন্যাসের সমাপ্তিতে সে মানবতার আহ্বানের প্রতিধ্বনি স্পষ্টতর।
Samaresh Majumdar (Bangla: সমরেশ মজুমদার) was a well-known Bengali writer. He spent his childhood years in the tea gardens of Duars, Jalpaiguri, West Bengal, India. He was a student of the Jalpaiguri Zilla School, Jalpaiguri. He completed his bachelors in Bengali from Scottish Church College, Kolkata. His first story appeared in "Desh" in 1967. "Dour" was his first novel, which was published in "Desh" in 1976. Author of novels, short stories and travelogues, Samaresh received the Indian government's coveted Sahitya Akademi award for the second book of the Animesh series, 'Kalbela".
সমরেশ মজুমদার-এর জন্ম ১০ মার্চ ১৯৪৪। শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের চা-বাগানে। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলের ছাত্র। কলকাতায় আসেন ১৯৬০-এ। শিক্ষা: স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স, পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ। প্রথমে গ্রুপ থিয়েটার করতেন। তারপর নাটক লিখতে গিয়ে গল্প লেখা। প্রথম গল্প ‘দেশ’ পত্রিকায়, ১৯৬৭ সালে। প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’, ১৯৭৫-এ ‘দেশ’ পত্রিকায়। গ্রন্থ: দৌড়, এই আমি রেণু, উত্তরাধিকার, বন্দীনিবাস, বড় পাপ হে, উজান গঙ্গা, বাসভূমি, লক্ষ্মীর পাঁচালি, উনিশ বিশ, সওয়ার, কালবেলা, কালপুরুষ এবং আরও অনেক। সম্মান: ১৯৮২ সালের আনন্দ পুরস্কার তাঁর যোগ্যতার স্বীকৃতি। এ ছাড়া ‘দৌড়’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার হিসাবে বি এফ জে এ, দিশারী এবং চলচ্চিত্র প্রসার সমিতির পুরস্কার। ১৯৮৪ সালে ‘কালবেলা’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার।
অর্ককে অনিমেষের তুলনায় আমার তেমন একটা পছন্দ হয়নি। অনিমেষ ছিল শান্ত, সুন্দর আর স্থির। সেখানে অর্ক একটু কেমন যেন। অনিমেষ আর মাধবীলতার ভালোবাসার ফুল মনে হয় একটু অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল। ছোটমা আর পিসামার অসহায়ত্ব খুব কস্ট দিয়েছে । আমাদের দেশের একসময় মেয়েদের অবলম্বন বলে তেমন কিছু ছিলনা। কতটা অসহায় ছিলেন তারা। ভাগ্য ভাল আমাদের যে দিন পাল্টেছে। মাধবীলতার কথাই বলি। স্বামী সন্তানকে নিয়ে কখনো অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়নি তাকে।
তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে দিন আসে দিন যায়। এরমাঝেই একটু একটু করে বেড়ে ওঠছে অর্ক। অর্ক মানে সূর্য। অনিমেষ আর মাধবীলতার ভালোবাসার ফুল অর্ক। নামটা মাধবীলতার দেয়া। তাদের নিস্তব্ধ জীবনের সূর্য যেন অর্ক। যদিও পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে সব সময় কি একটা ভয়ে থাকে মাধবীলতা। ঈশ্বরপুকুর লেনের এই ঘুপচি ঘরে আশেপাশের শত কদর্যতার মাঝে বেড়ে ওঠা অর্ককে নিয়ে তাই সবসময়ই ভয় করে মাধবীলতা। বস্তিতে থাকার মাশুল অবশ্য দিতেই হয় অনিমেষ আর মাধবীলতার। স্কুল আর ঋণের চাপে জর্জরিত মাধবীলতা আর পুলিশের অত্যাচারে পঙ্গু অসহায় অনিমেষের শত সতর্কতার পরও অর্ক আস্তে আস্তে বস্তির পরিবেশে আসক্ত হতে থাকে। মুখের ভাষা হয়ে যায় খিস্তি মেশানো আর বন্ধু-বান্ধবদের প্ররোচনায় ভুল পথে পা বাড়ায় অর্ক। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি আর খিস্তি খেউড় যাদের নিত্য নৈমিত্তিক কাজ তাদের থেকে ভাল কিছু আর কিভাবে আশা করা যায়। কিলা, খুরকি, বিলা এরাই হয়ে ওঠে অর্কর নিত্যদিনের সঙ্গী। অন্য একটা ঘটনায় সমাজের উচু তলার কিছু মানুষগুলোর আসল চেহারাটা সামনে আসে অর্কর। ঘটনার তীব্রতায় জ্বর চলে আসে তার। এতবড় ছেলে মায়ের আচলে মুখ গুজে খালি বলে চলে বমি পাচ্ছে মা। কতটা নোংরা কদর্যতা দেখলে একটা ছেলে এমন কথা বলতে পারে একটু ভাবুন তো। এইসব দেখেশুনে তীব্র প্রতিবাদে মুখরিত হয়ে ওঠে অর্ক। নিজের সাথে নিজেই প্রতিজ্ঞা করে সমাজের এসব অসঙ্গতির সাথে কখনোই তাল মেলাবে না। সত্যকে সত্য, অন্যায়কে অন্যায়ই বলবে। বস্তির লোকজনকে সাথে নিয়ে নতুন এক আন্দোলনে সামিল হয় সে। এক পরিবার এক হাড়ি হিসেব করে পুরো বস্তিকে সাথে নিয়ে শুরু করে এক বিরল ধরনের কাজ। নির্দিষ্ট একটা অর্থের বিনিময়ে সারা মাস তিনবেলা সবাইকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নেয় সে। এসব দেখেশুনে আশার সঞ্চার হয় অনিমেষ মাধবীলতার মনে। অর্কর এই প্রচেষ্টা কি সফল হবে? নাকি ঘুণে ধরা সমাজের ততোধিক নষ্ট মানুষগুলোর আতে ঘা লাগবে এভাবে?
রাজনীতি আসলে ঠিক প্রতিদিনকার কড়া লিকারের এক কাপ চায়ের মতোন।গ্রামগঞ্জের টং দোকানের বৈঠক থেকে শুরু করে শহুরে আপিস আদালত —একমুহূর্তের জন্য একটু "পলিটিক্স" এর আলাপ না হলে যেন রাতে শান্তির ঘুম হয় না।স্থান-কাল-পাত্রে বিস্তর বিভেদের দেয়াল গড়ে উঠলেও যেন এই "রাজনীতি" এর ঐক্যগীতিতে সেই দেয়াল টপকানো কোনো ব্যাপার নাহ!বাঙলাদ্যাশের সক্কল মুরুব্বিদের রক্তে-শিরায় যেন মিশে আছে এই রাজনীতির নাম।
বিভিন্ন মতাদর্শ,পার্টিগিরি,ইত্যাদি নিয়ে নানা চর্বিযুক্ত মশলাদার আলাপচারিতা হোক বা সহসা ক্লাইম্যাক্সে জমে ওঠা মেলোড্রামার মতো আন্দোলন দাঙ্গা—কেন জানিনা এই নানা মুনির নানা মত যেন সেই এক সুরেই সুর মেলায়— নিজের ট্যাকে আখের গোছানো কিংবা পাহাড়সমান ক্ষমতা-প্রতিপত্তির তুমুল "রোলার কোস্টার রাইড"।উপরমহল-নিম্নমহল-মধ্যমহল সবাই স্বার্থে "অন্ধ" ভেড়ার পালের মতো একে অপরের পিছু পিছু ছোটাছুটি করছে,And it's the only eternal truth of the universe!
রাস্তার পাশে পড়ে থাকা দুর্গন্ধময় ভাগাড়ের চেয়েও নোংরা এই রাজনীতি নিয়ে সেই জনগণের চায়ের বৈঠকে কলরব পড়ে; বড্ড অনুশোচনা আর করুণার চাপা কণ্ঠস্বরে যেন মাঝবৈঠকে হাহাকার জাগে–হা ঈশ্বর!হা আল্লা!
কিন্তু?কিছুই পরিবর্তন হয় না।সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত।সবকিছু সয়ে গেছে,তেমন সমস্যা হয় না।ডারউইনের তত্ত্বের মতো সবাই ঠিকই Adjust করছে।এতো আদর্শ-বিপ্লবে কাজ কী!কী এমন সুবিধা হবে?বরং মিছিল-প্রতিবাদের চক্করে ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে দেরি হবার নিমিত্তে নিশ্চয়ই চাকরি খোয়া যাবে!বউ-বাচ্চা খাবে কী?
কী লাভ?
সাধারণ আম-জনতা এই লাভের হিসাব কষুক, আর হাজারো অনিমেষেরা নিরীহ হয়েও পুলিশে পিটুনি খেয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকুক। আমার ভোলা মন একতারে এসব দেখে দেখে উদাস হয়ে গায়,,,
"আমি কতই রঙ্গ দেখি দেখি দুনিয়ায়,ও ভাইরে... ও ভাই..."
নীলক্ষেতে পুরনো বইয়ের লট থেকে কম দামে ছেড়ে দিচ্ছিল। ৬০ টাকায় কিনেছিলাম বইটা বছর দেড়েক আগে। অবশেষে পড়তে শুরু করলাম। অর্ধেক এগিয়েই জানলাম এটা সমরেশ মজুমদারের অনিমেষ সিরিজের বই। তাও আবার একলাফে তিন নম্বরটা! ভাবলাম কি আর করা, পড়েই ফেলি। এটা তো জীবন নয়, যে শেষটা আগে জেনে ফেললে বাঁচার আনন্দ হারিয়ে যাবে। অবশেষে শেষ করলাম। লেখকের সাতকাহন ও গর্ভধারিণী পড়েছি আগে। তাঁর লেখা বোধ হয় এমনই। বয়স কম ছিল বলে কি আগে এতোটা বুঝতে পারিনি? অথচ এই বইটা পড়ে তাঁর লেখনীর ধাঁচে মুগ্ধ হয়ে গেছি। মনে হচ্ছিলো, ঠিক এমনটাই হয় জীবনে। চরিত্রগুলো আফসোস করে, রেগে ওঠে, মনে মনে ভাবে, জেদ করে। কিছু কথা বলে ফেলে ভুলে, তারপরে অনুতাপে মরে যায়। মানুষের চিন্তাগুলোকে এত সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা যায়? পনেরো বছরের একটা ছেলে কত কিছু নতুন করে শিখছে, জীবনের দর্শনগুলো আবিষ্কার করে আস্তে আস্তে বড়দের মত চিন্তা করতে শুরু করেছে। এতো সুন্দর করে কিভাবে লেখা যায় এসব? ইশ! কাহিনী অনেক বিশদ। খুব পরিপাটি করে সাজানো। নকশাল আন্দোলন নিয়ে কিছুটা ধারণা হল। সোজা কোথায়, ভালো লেগেছে খুউব :)
এইটা কালবেলার পরের পার্ট। কালবেলার নায়ক অনিমেষের পুত্র অর্ককে নিয়ে ঘটনা। অর্ক তার নামের সার্থকতা প্রমাণ করেই সূর্যের মত জ্বলজ্বল করেছে। অর্ককে আমার খুব ভাল্লাগার কারণ হিসেবে বলা যায় অর্কর চরিত্রে তার মা বাবার শক্তিশালী দিকগুলা এসেছে। বস্তিতে থেকে নষ্ট হতে হতেও অর্কের মাঝে তার বাবার মূল্যবোধ আর মায়ের তেজস্বীতা ঠিক সময় মতেই জেগে উঠেছে। অবশ্য গল্প উপন্যাসে অনেক কিছুই করা গেলেও বাস্তবতা আসলে আরো কঠিন। তাও বেশ থ্রিল পেয়েছিলাম বইটা পড়ে।
বইটা পড়ে অনেকটুকু এগিয়ে যাওয়ার পর মনে মনে ভাবছিলাম যে উপন্যাসত্রয়ের প্রথম ২টা (উত্তরাধিকার এবং কালবেলা) রেখে শেষের টা আগে শুরু করে ভুল করে ফেললাম নাকি। কিন্তু শেষ করার পর মনে হচ্ছে য��ন ভালই করেছিলাম। অর্ক চরিত্রটিকে এতো ভালো করে অনুভব করতে পেরেছি যে ওর সামনে অনিমেষ চরিত্রটিকে আমার নিত্যান্ত দুর্বল মনে হয়েছে। যাই হওক, এবার আরম্ভ করলাম "কালবেলা "। দেখি কার পাল্লা ভারী, অর্ক না অনিমেষের।
উপন্যাোসের শেষটা অসম্ভব সুন্দর। দীপ্তিমান সূর্যের মতো অর্ক জ্বলে উঠে। মাধবিলতার আদর্শ অরককে ভুল পথে যেতে দেয়নি। কিন্তু খারাপ লাগে অনিমেষের চরিত্রের কথা ভেবে। কালবেলা আর উত্তরাধিকার এর গড়ে তুলা অনিমেষ চরিত্রটাকে এভাবে দূরবল করাটা মেনে নেওয়া কষ্ট। বাস্তবতা হয়তো এইরকমই নিষঠুর। অনিমেষ চরিত্রটা আমার অন্যতম প্রিয় চরিত্র। তাই বইটা শেষে আক্ষেপটা রয়েই গেলো।
যেহেতু এই উপন্যাসত্রয় একটি বিশেষ পরিস্থিতি ও সময়ে লেখা। এ পরিপ্রেক্ষিতে এর পরিসমাপ্তি আমার কাছে ভাল লাগেনি। [ this novel is good, but it's finishing is not good for me. ]
উত্তরাধিকার আর কালবেলার উত্তরাধিকারী ঠিক হয়ে উঠতে পারে নি কালপুরুষ। অনিমেষ নায়ক ছিলো, কালের নায়ক। হয়ত ব্যর্থ, তবু ব্যর্থতা অনিমেষকে মহত্ত্বের সোপান থেকে সরিয়ে রাখতে পারে নি। মনে করিয়ে দিতে চাই, স্পার্টাকাসও শেষ অবধি একজন পরাজিত নায়ক। জয়ের চেয়ে পরাজয় অনেক সময় মহান ও গৌরবময়।
অর্ক অনিমেষ আর মাধবীলতার সন্তান, কালপুরুষের নায়ক। কালবেলা আর উত্তরাধিকারের তুলনায় যেমন কালপুরুষ ম্রিয়মান, তেমনি অনিমেষের তুলনায় অর্কও ম্লান। যে কাদামাটিকে গড়ে তোলার আশাবাদ আমরা কালবেলার শেষে অনিমেষের হৃদয়ে উচ্চারিত হতে শুনি, তার প্রতিফলন কালপুরুষে নেই। অবশ্য এখানে গল্প অনিমেষকে সে সুযোগ দেয় না। অনিমেষকে আবির চক্রবর্তী বা পরমব্রত মনে হলে, অর্ককে মনে হয়েছে দেব। আর কালপুরুষকে মনে হয়েছে টিপিকাল ভারতীয় বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। লেখক আরো এফোর্ট দিলে ট্রিলজির শেষ বইটা সন্তুষ্টিজনক হতে পারতো, আক্ষেপ থেকে গেল।
সমরেশ মজুমদারের “কালবেলা” এমন একটি উপন্যাস যেখানে প্রেম এবং বিপ্লব একসাথে মিলেমিশে হয়েছে একাকার । “কালবেলা” । যার মানে অশুভ সময় । “কালবেলা” আসলেই একটি অশুভ সময়ের চিত্র উপস্থাপন করেছে । যেই চিত্রে আদর্শের পথে হাঁটতে গিয়ে বিপথগামী হয়েছে তৎকালীন অসংখ্য ভারতীয় তরুণ । তাদের মধ্যে অনিমেষও একজন । মূলত অনিমেষের হাত ধরেই সমগ্র উপন্যাসে সমরেশ মজুমদার তুলে ধরেছেন তৎকালীন সময়টিকে । আর অনিমেষের সঙ্গী হিসেবে জুড়ে দিয়েছেন মাধবীলতাকে। অনিমেষ আর মাধবীলতার যে প্রেমের সম্পর্ক তা এই উপন্যাসের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে টপকিয়ে খুব সহজেই এটিকে একটি প্রেমের উপন্যাসে পরিণত করেছে । সুতরাং, “কালবেলা” যেমন একটি রাজনৈতিক উপন্যাস তেমনি একটি প্রেমের বা ভালোবাসারও উপন্যাস হিসেবেও এটি সম্পূর্ণ সার্থক । অবশ্য সমরেশ মজুমদার এটিকে রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে দেখতে নারাজ । তিনি এটিকে একটি ভালোবাসার উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি দিতেই আগ্রহী । এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হল অনিমেষ । প্রথমবারের মতো কলকাতায় এসেই অনিমেষ পায়ে গুলি খায় পুলিশের । এরপর ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়ে কলেজের বাম রাজনীতির সঙ্গে কিন্তু তাতে কেমন যেন খটকা থেকে যায় তার মনে । ফলে অস্ত্র হাঁতে বিপ্লবের পথে হাঁটতে শুরু করে । বিপ্লবের আগুনে ঝাপিয়ে পড়ে অনিমেষ বুঝতে পারে যে দাহ্যবস্তুর কোন সৃষ্টিশীল ক্ষমতা নেই । এই বিপ্লবে জড়িয়ে যাবার আগেই অনিমেষের জীবনে জড়িয়ে পড়ে একজন রমণী । যার নাম মাধবীলতা । অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী এই মাধবীলতা । যে জীবনের সবকিছু দিয়ে ভালোবেসে গিয়েছে অনিমেষকে । তার জন্য ভালোবাসাটিই মনে হয় আসল বিষয় । বিনিময়ে আশা করেনি কিছুই কিন্তু ছেঁড়ে আসে সব অতীত, সব বন্ধন এবং পেছনের সব সম্পর্ককে শুধুমাত্র এই ভালোবাসার টানে । উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে যেমন অবাক হয়েছি অনিমেষের ব্যক্তিত্ব নিয়ে তেমনি অবাক হয়েছি মাধবীলতার ক্ষেত্রেও । মাধবীলতার ক্ষেত্রে আমি হয়তো আরও একধাপ এগিয়ে ছিলাম । কারণ এই চরিত্রটিকে যতই আবিস্কার করেছি ততই আমার কাছে মনে হয়েছে এ মাধবীলতা যেন আমারই কাঙ্ক্ষিত প্রেমিকা । বারবার প্রেমে পড়েছি আমি এই মাধবীলতার । নিজের সর্বস্ব দিয়ে এবং দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির বলে মাধবীলতা শত প্রতিকূলতার মাঝেও নিজের মাথা উঁচু রাখে, নিজের ভালোবাসাকে সমুন্নত রাখে । ভালোবাসার মাঝে যেন বিপ্লবের আরেক নাম এই মাধবীলতা । সমরেশ মজুমদারের লেখা “আট কুঠুরি নয় দরজা” এবং “গর্ভধারিণী” বেশ অনেক আগেই পড়েছিলাম । এ দুটো উপন্যাসই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল উনার ভক্ত হবার জন্য । বিশেষ করে “গর্ভধারিণী” উপন্যাসটি ছিল অসাধারণ একটি সৃষ্টি । একই ধারায় উনার “কালবেলা” উপন্যাসটিকেও আমি সম্পূর্ণ একটি সার্থক উপন্যাসের মর্যাদা দিব । কারণ উনার এই উপন্যাসে যেমন উঠে এসেছে সত্তরের দশকের স্বাধীন ভারতবর্ষের চিত্র, তেমনি উঠে এসেছে সেই সময়টি । একই সাথে তৎকালীন ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে সাথে উঠে এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যক্রমের চিত্র । একদিকে যেমন প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করা হয়েছে তেমনি আরেক দিকে তুলে ধরা হয়েছে শ্রেণীহীন নতুন ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখা একদল তরুণের আন্দোলনের চিত্র । রাজনীতির পথগুলো কতটা তির্যক তা এই উপন্যাসটি পড়লেই বুঝা যায় । রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের পাশাপাশি একজন নারীর জন্য তৎকালীন সময়ের প্রতিবন্ধকতাগুলো তুলে ধরা হয়েছে এখানে । নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজের উঁচু, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মানসিকতার একটি পূর্ণাঙ্গ ��িত্র উঠে এসেছে এই সমগ্র উপন্যাসে । বাদ যায়নি একজন নর এবং নারীর পারস্পারিক বিশ্বাসে ভালোবাসার চিত্রটিও ।
সমরেশ মজুমদারের অসাধারণ একটি সৃষ্টি এই “কালবেলা” । এই “কালবেলা” উপন্যাসটির জন্য তিনি ১৯৮৪ সালে সাহিত্যে আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন । ২০০৯ সালে গৌতম ঘোষের পরিচালনায় এবং পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও পাউলি দাম অভিনীত একই শিরোনামে একটি সিনেমাও মুক্তি পায় এই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে । সুতরাং, নির্দ্বিধায় পড়ে ফেলতে পারেন এই অসাধারণ বইটি ।
মাস্ট রিড একটা বই! এই বই নিয়ে অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে,আবার ঠিক গুছিয়ে বলতে ও পারছিনা। তবে এটুকুনি বলবো 'কালবেলা' তে অনিমেষ কে ঠিক যতটা ভালো লেগেছিলো 'কালপুরুষ' এ এসে ঠিক ততটাই কিংবা তার চেয়েও বেশি অসহ্য লাগছিলো! লেখকের 'অনিমেষ' কে এমন স্বার্থপর হিসেবে উপস্থাপন করার কারণেই হয়তো এমন লেগেছে কিনা জানিনা! আরেকটা কথা না বললেই না! প্রথমদিকে অর্ক কে মেনে নিতে ভীষণ ধাক্কার মতো খাচ্ছিলাম! এযে অনিমেষ আর মাধবীলতার ছেলে তা মেনে নিতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছিল বইকি!
তবে অনিমেষ এবং মাধবীলতার আদর্শ অর্কর রক্তে ও রয়েছে কিনা! অর্ক যেন একটু একটু করে বদলে যেতে শুরু করলো! এবং সেই সাথে ইশ্বরপুকুর লেনের সবার প্রিয় 'অক্কদা' এই বইয়ে আমার সবচে পছন্দের চরিত্র হয়ে গেলো। অার মাধবীলতা! 'মাস্টারনি' কি ভীষণ ভালোবাসায় অনিমেষ আর অর্ককে আগলে রেখেছে! মাধবীলতার নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ মনে দাগ কাঁটার মতো!
এই বইয়ে 'কালবেলা' র মতো গাঢ় রাজনীতি ছিলোনা,তবে যেটুকু অংশ ছিলো সেটুকুই ভালো লেগেছে! মনে হয়েছে এরচে বেশি হলে ভালো লাগতোনা!
বেশ বড় বই,কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন? এই বই পড়তে গিয়ে একটুও বিরক্তি লাগেনি এবং আমার বিশ্বাস আপনাদেরও লাগবেনা! পড়া শুরু করলে থামতেই মন চাইতোনা,একনাগাড়ে এতো সময় ধরে কোনো বই এর আগে পড়েনি! এই বইটা অনিমেষ সিরিজের সবচেয়ে প্রিয় তালিকায় থাকলো!
অর্ক এবং মাধবীলতা ছাড়াও ছোটমা,হেমলতা,বিলু,পরমহংস,সৌদামিনী আমার পছন্দের চরিত্র!
কালবেলার মতো বিরক্তিকর রাজনৈতিক মতাদর্শেত ছোড়াছুড়ি নেই দেখে ভাল লেগেছে। 'উত্তরাধিকার' এ যেমন সরিৎশেখর, 'কালবেলা' তে যেমন অনিমেষ, 'কালপুরুষ' এ তেমনি অর্ক আর মাধবীলতা ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল পুরো উপন্যাস জুড়ে। শৈশবের পরিবেশগত কারনে স্বাভাবিকভাবেই স্বর্গছেড়ার নিরিবিলি, ঝামেলাহীন পরিবেশে বড় হওয়া অনিমেষের তুলনায় ঈশ্বরপুকুর লেন বস্তির অর্কর বয়স অনুপাতে যথেষ্ট পরিপক্ক ও বাস্তববাদী হওয়ার কথা ছিল। সমরেশ মজুমদার এ কথা ভুলে নি, বরং পড়ার সময় মনে হচ্ছিলো এর থেকে বাস্তব আর কিছু হয়না। উপন্যাসের শুরুর দিকের মাধবীলতার জীবনের স্ট্রাগলগুলো দেখে খারাপ লাগছিলো, একই সাথে অনিমেষের নির্বুদ্ধিতার জন্য রাগ ও হচ্ছিলো। কিন্তু আস্তে আস্তে তা গা সওয়া হয়ে উঠেছিল। আগে একবার পড়া ছিলো, তবে তার প্রায় কিছুই মনে ছিলো না (শুধু জলপাইগুড়ি যাওয়ার প্রথমদিক চা-দোকানের সামনের মারামারির অংশটুকু ছাড়া)। তাই প্রথমবার পড়ার মতোই ভাল লেগেছে। বরং বলা যায় 'উত্তরাদিকার' আর 'কালবেলা' পড়ার পর নতুন করে পড়ার দরুন আরো বেশি ভাল লেগেছে।
কালবেলা পড়ার পর রিভিউ লেখার সময় মনে হয়েছিলো, 'অনেক কিছু বলার আছে' 'এই বই নিয়ে বলতে থাকলে শেষ হবে না' মোটামুটি বড়সড় একটা রিভিউ লেখার পরও মনে হয়েছিল, 'একি! আমি তো কিছুই লেখলাম না..'
কিন্তু আমি জানিনা এই বই নিয়ে কি বলবো! এই বই পড়তে যেয়ে কতবার যে বুকে পাথর চেপে আসছিল, কতবার ইচ্ছে করেছে দূরে সরিয়ে রাখি, সেই অনিমেষের সাথে 'উত্তরাধিকার' থেকে শুরু করে 'কালবেলা' যে চিত্র দেখেছি, 'কালপুরুষে' এসে কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না, সবকিছু কেমন অপরিচিত! কিন্তু জীবন তো এমনই..
এই প্রথম কোনো বই পড়তে যেয়ে আমার কষ্ট হচ্ছিল, আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। কিন্তু আবারো বলতে হয়, 'জীবন তো এমনই!' এখানে সুখ থাকবে, থাকবে অভিমান, দুঃখ, ভুল বোঝা, নিজেকে সবার মাঝে রেখেও মনে হতে থাকে আমি কি দূরের কেও? নিজেকে চিনতে পারা যায় না! বুকে চেপে রাখা কথা চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়.. নিংড়ে দিতে ইচ্ছে হয় নিজেকে!
অনিমেষ, মাধবীলতা, অর্ক! আমি কতটা অনুভব করতে পেরেছি জানিনা, তবে কতটা অনুভব করা সম্ভব তাও আমার অজানা..
সমরেশ মজুমদারের ত্রিরত্ন সিরিজের তৃতীয় সৃষ্টি "কালপুরুষ"।
একটা পরিবার, কলকাতার বিখ্যাত বস্তি তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুরে থেকেও যারা ঠিক সে বস্তির বাসিন্দা নয়৷ পরিবারে বাবা অনিমেষ, ক্রাচে ভর দেয়া ছাড়া এক কদম যে হেঁটে যেতে পারে না। এরপর রয়েছে মাধবীলতা, পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি। যাকে দেখে মনে হয়, আবেগ একে স্পর্শ করে না ঠিক! একজীবনে মাধবীলতা কি পেয়েছে তা হিসেব না করে কতটা উজাড় করে দিয়েছে তা ভাবতে বসলে সে হিসেব আর শেষ হবে না। কিন্তু তাতেও বিন্দুমাত্র আক্ষেপ বা আফসোস ছিল না তার। ভালোবাসাই বোধহয় মানুষকে বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়। শেষ মুহূর্তে এসেও বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। তার চিন্তা কেবল তাদের ছেলে অর্ক'কে নিয়েই। তাকে মানুষের মতো মানুষ করা নিয়ে। তবে কয়েক কলম পড়াশুনা করে কে কতটা মানুষের মতো মানুষ হতে পারে এ ব্যাপার নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান অর্ক। সঙ্গদোষে অর্ক কিছুটা বখে গিয়েছিল শুরুতে। বস্তির ছেলেদের সাথে খিস্তি না করে শুদ্ধভাবে কথা বলে ক'দিনই বা নিজে না পালটে মেশা যায়? কিন্তু এরপরই পনেরো বছরের ছেলেটা হুট করেই একদিন থেকে বয়সের আগেই বড় হওয়া শুরু করল কেমন যেন। এইটুকু বয়সে জানার চেয়ে বেশি দেখে ফেলেছে সে। তবে তার মায়ের শান্ত সাহস আর বাবা অনিমেষের বারুদের মতো তেজী রক্ত যার শরীরে বইছে সে তো কখনোই পিছু হটবার নয়।
🌼সবথেকে পছন্দের লাইন-
জনতা চেঁচাল "অর্কর মুক্তি চাই।" চোখ বন্ধ করে হাসলো মাধবীলতা। তারপর বিড়বিড় করলো নিজের মনে, 'অর্ক মানে কি ওরা জানে? সূর্যকে কি বন্দী করতে পারে?' অদ্ভুত শান্তি নিয়ে মাধবীলতার শরীর পৃথিবীর মাটির গায়ে নেমে আসছিল। যেমন করে পাখিরা টানটান ডানা মেলে বাসায় ফিরে আসে নিশ্চিন্তে। ❤
‘কালপুরুষ’ নামটাই যেন একটা আকর্ষণ অনুভব করায়। বইটি ‘অনিমেষ সিরিজ’ এর তৃতীয় খন্ড। এই সিরিজের দ্বিতীয় বই ‘কালবেলা’ এর সম্প্রসারণ ‘কালপুরুষ’। বইটি মূলত অনিমেষ এর ছেলে অর্ক মিত্র কে নিয়ে। . সিরিজ টি অনিমেষের নাম এ হলেও এই গল্পে প্রধান চরিত্র হিসেবে অর্ক কে দেখতে পাওয়া যায়। ছোট থেকে অভাবের সংসারে, বস্তিতে বড়ো হয়ে ওঠা অর্ক এর পড়াশোনা এ খুব একটা মন নেই, কিন্তু তার রক্তে বইছে অনিমেষ এর জেদ আর মাধবীলতার সহনশীলতা, নিঃস্বার্থপরতা ও সাহস। ওর চোখ দিয়ে পাঠক যেন বর্তমান সমাজের একটি জলের মতো স্বচ্ছ ছবি দেখতে পায়। মাত্র পনেরো বছর বয়সে দাপিয়ে বড়ো হয়ে ওঠা অর্ক এখানে বোধশক্তি এবং চিন্তধারায় অনিমেষ কে ছাপিয়ে গেছে। অনিমেষ যা করতে পারেনি অর্ক তা বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছে কিন্তু সমাজ এবং দেশের অরাজনৈতিকতা শেষ পর্যন্ত তাকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। বাবার মতো একই ভাবে তাকেও কারাগারবন্দী হতে হয়েছে। . ‘কালবেলা’ বইটি পড়ে সত্যিই ভালো লাগায় তার পরে কি হল জানতে খুব উদগ্রীব ছিলাম, তাই এই বইটি পড়া। গল্পে অনেক জায়গায় অ��িমেষকে নিতান্তই স্বার্থপর বলে মনে হয়েছে, অনেক জায়গায় নির্বুদ্ধিতা তাকে একজন শিকড়হীন স্বামী তে পরিণত করেছে যা ‘কালবেলা’ এর অনিমেষের সাথে মেলেনা এবং সেটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। গল্পে অর্ক এর মধ্যে সেই আগুন খুঁজে পাওয়া যায় না যা ‘কালবেলা’এ অনিমেষের মধ্যে দেখা গেছে। মাধবীলতা চরিত্র টি অনন্য। তাকে ছাড়া এ সিরিজ অর্থহীন আর ফিকে হয়ে যেতো। তার সাহসীকতা আর সহ্যশক্তি যেভাবে ‘কালবেলা’ কে কালজয়ী করেছে তেমনি ‘কালপুরুষ’ গল্পটিকে দাঁড় করিয়েছে। নিজের সাহসের পরিচয় দিয়েছে বারংবার, ছেলে যখন জেলে তখন তাকে বলেছে, “একদম ভয় পাবি না। তুই হলি সূর্য। সূর্যের কোন ভয় নেই।” অজস্র উদ্বিগ্ন মানুষের মুখ গুলো যখন ওর দিকে চেয়ে ছিল অর্ক এর মুক্তির আশায়, তখন হেসে নিজের মনেই বলেছে, “অর্ক মানে কি ওরা জানে? সূর্যকে কি কেউ বন্দী করতে পারে?”
যেখান থেকে নিজের নাম পেয়েছি সেই বইয়ের প্রতি একটা আলাদা টানতো থাকবেই। 😇 অনিমেষ মাধবীলতার সন্তান অর্ক বেরে ওঠে নিজের মেজাজে, কারুর কাছে সে গুরু, কারুর কাছে সে ওস্তাদ আবার কারুর কাছে সে ত্রাস। মাধবীলতার পর এই সিরিজের আমার অন্যতম পছন্দের চরিত্র অক্বোদা।❤️
কালবেলা'র শেষে যখন অনিমেশ বিধ্বস্ত, হতাশ এবং ক্লান্ত তখনই অবার বিস্ময়ে মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে তার উপলব্দি হয়-- বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা। পঙ্গু অনিমেশকে হৃদয় দিয়ে আগলে রেখে জীবনের সবটুকু শক্তি নিঃশেষ করে তিল তিল করে অর্ককে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা মাধবীলতার। অনিমেশের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র অর্ক প্রথম দিকে চলার সঠিক পথ খুজে না পেলেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ, সাহসীকতা নিঃসন্দেহে যেকোন পাঠকের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। কালপুরুষ আমি একাধিকবার পড়েছি এবং হয়তো আরো পড়ব। তবে অনিমেশের ছোটমা এবং পিসিমা'র অসহায়ত্ব মনকে বিষন্নতায় ভরিয়ে দেয়। কেন জানি এখানে এসে লেখককে কিছুটা নিষ্ঠুর মনে হয়েছে আমার। কালপুরুষের একেবারে শেষে যে নতুন সূর্য ওঠার স্বপ্ন দেখানো হয়েছে তা হৃদয়ে একটা তৃপ্তির ছোঁয়া লেগে থাকে।
মাধবীলতা আর অনিমেষের একমাত্র ছেলে অর্ক। তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুরলেনের বস্তির এক ছোট ঘরে তাদের বাস। চারপাশের নোংরা পরিবেশ থেকে অর্ককে আগলে রাখাই তাদের একমাত্র চাওয়া। অনিমেষের চিকিংসায় খরচ হওয়া অর্থের ঋণে জর্জরিত মাধবীলতা কখনো অন্যায়কে গ্রহণ করেনি। দুহাতে আগলে রেখেছিলো স্বামী আর ছেলেকে। চারপাশের অনেক রকম নোংরামি দেখে পনেরো বছরের কিশোর যেনো যুবক হয়ে উঠে। বস্তির পরিবেশে যেখানে খিস্তি, মাতলামো আর গুন্ডামি করা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল সেখানে হঠাৎই যেনো এসব বিষের মত নাড়া দেয় অর্কর মনে। কোনো রাজনৈতিক দল বা সাহায্য ছাড়া বস্তির সকল মানুষকে এক করে শুরু হয় নতুন লড়াই। অনিমেষ যেটা কখনোই একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া ভাবতে পারি নি, অর্ক যেনো চট করেই সেটা করে ফেলেছিলো। কিন্তু এখানেও ষড়যন্ত্রের ভীড়ে জেলে যেতে হয় অর্ককে। সকল সাধারণের মুখে তখন একই চিৎকার, "অর্কর মুক্তি চাই"। অর্ক তার নামের অর্থের মতই অন্ধকারে জর্জরিত বস্তির সকলের কাছে সূর্যের আলো হয়ে উঠেছিলো।
কালবেলার পর কালপুরুষ- দুটি ভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় বেড়ে উঠা দুটি প্রতিবাদী চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোথাও যেনো মনে হয়েছে অর্ক চরিত্রটিকে আরেকটু যাচাই করা যেত। অনিমেষের তুলনায় অর্ককে যথেষ্ট হালকা মনে হয়েছে।
প্রথম দুই খন্ডের সাথে এই বইয়ের তুলনা করা বেমানান।এই বই স্বর্গছেড়ার স্নিগ্ধতা,জলপাইগুড়ির ছেলেবেলা কিংবা স্কটিশচার্চের তারুণ্যের ফাঁকে ফাঁকে সমাজকে তুলে ধরেনি যেখানে জীবন আর সম্পর্ক স্থির,অস্থির কেবল ব্যবস্থা আর রাজনীতি।'কালপুরুষ' একইসাথে ছিন্নভিন্ন সম্পর্ক আর কালো গ্রহণ ঘিরে থাকা বস্তিজীবনের রূপ রঙ এঁকে গিয়েছে পাকা হাতে।
অর্ক মিত্র অনিমেষ আর মাধবীলতার একমাত্র ছেলে।সংগদোষে কিছুদিন বখে গেলেও অনিমেশের শিরায় শিরায় বয়ে চলা বারুদ আর মাধবীলতার শান্ত সাহস অর্ককেও করে তোলে সমাজের বিষ উপড়ে তোলার কারিগর।সময়ের সাথে সাথে ভারত বদলাচ্ছে,বদলাচ্ছে অপরাধের ধরন।সকালে যে বন্ধু রাতে সেই বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে শরীর।চোরাচালান, পতিতাবৃত্তি,খিস্তি,মাস্তানি সব চলে চোখের সামনে।মানুষ এখন বিপ্লবে নামেনা, শুধু চোখ ঢেকে রাখে মিথ্যে পর্দায়।অর্ক মাঠে নামে প্রত্যাশার হল্কা নিয়ে।সময়ের সাথে সাথে বদলেছে প্রতিবাদের ধরণ। নিম্ন সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে অসমতার ছবি,তার সাথে পারিবারিক মনস্তাত্বিক দ্বন্দ মিলিয়ে আমার বেশ লেগেছে।মনে হচ্ছে চিত্কার করে বলি,"প্রতিটা মানুষ হয়ে উঠুক একেকটা সূর্য যাদের বন্দী করা অসাধ্য।"
অসাধারণ একটি উপন্যাস পড়ে শেষ করলাম। এই উপন্যাসটি প্রথম পড়া শুরু করেছিলাম ক্লাস এইটে। কিছুদুর পড়ে আর পড়া হয়নি। প্রায় এক যুগ পর আবার শুরু করলাম প্রীতুর মুখে এত প্রশংসা শুনে। অর্ক, মাধবীলতা, অনিমেষ এই নামগুলো ওর মুখে এত শুনেছি আর এত মুগ্ধতা জড়িয়ে ছিল যে কালপুরুষ পড়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। আবারো প্রমাণিত হল যে আমাদের পছন্দ একি রকম। অর্ক চরিত্রটি এতই প্রভাবশালী যে মাধবীলতা ছাড়া অন্য কেউ প্রকাশ পায়নি এতটা। উপন্যাস জুড়ে অনিমেষকে এত দোষারোপ করার কারণ জানি না , হয়ত কালবেলা পড়লে এর উত্তর পাব। কমিউনিজম কে ইশ্বরপুকুর লেনে বাস্তবায়ন করা হয়ত সম্ভব , কিন্তু একটা দেশকে কি সম্ভব ? আমি জানিনা , হয়ত সম্ভব । যাই হোক না কেন , এককথায় খুব ভাল লেগেছে উপন্যাসটি । উপন্যাসের কিছু জায়গায় তারল্য ভাব থাকলেও লেখকের সংযম ছিল অসাধারণ ।