কেন লিখতে এসেছিলাম কবিতা? ছেলেবেলা থেকেই জীবন আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করত। সকলেরই যেমন থাকে, আমার জীবনের পাশেও একটা আলো জ্বলত, মায়াবি এক আলো। আমার মতো—গরিব বাড়ির—এক পাঠবিমুখ ছেলের কাছে, কবিতা এসেছিল এক মুক্তির আশা নিয়ে। মহৎ কবিতা লিখতে পারলেআঠারো-উনিশ বছর বয়সে বেশ একটু ভুলই ভেবেছিলাম যে-ভালো চাকরি-বাকরি পাওয়া যাবে একটা। নিদেনপক্ষে, কোনো খবরের কাগজে। দারিদ্র্য অবশ্য কোনোকালেই ঘোচেনি। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার এই, কবিতার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ভালোবাসার এমনই এক অলৌকিক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, চাকরি-বাকরি নিয়ে আমি তারপর কখনোই আর সেরকম মাথা ঘামাইনি। যেমন, আকাশছোঁয়া খ্যাতির জন্যে আমারও একটা মোহ ছিল একসময়। কিন্তু কবিতার সঙ্গে তীব্রভাবে জড়িয়ে এমনভাবেই কেটেছে আমার গত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর, এমন মনে হয়, বিখ্যাত বিখ্যাত আর বিখ্যাত হতে চাওয়ার মধ্যে একটা অশ্লীলতা আছে।
ভাস্কর চক্রবর্তী (Bhaskar Chakraborty, কোথাও কোথাও Bhaskar Chakrabarti) (১৯৪৫-২০০৫) একজন বাঙালী কবি, এবং গদ্যকার।
জন্ম দেশভাগের দুই বছর আগে, কোলকাতার বরানগরে। পড়েছেন ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র কলেজে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১০, প্রথম কাব্যগ্রন্থ বহুল আলোচিত শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা (১৯৭১)। লেখালেখির শুরু ষাটের দশকের মাঝখানে, লিখেছেন টানা চল্লিশ বছর, মৃত্যুর আগ অব্দি। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন স্কুল শিক্ষক।
তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে এসো , সুসংবাদ এসো (১৯৮১), রাস্তায় আবার (১৯৮৩), দেবতার সঙ্গে (১৯৮৬), আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে (১৯৮৯), স্বপ্ন দেখার মহড়া (১৯৯৩), তুমি আমার ঘুম (১৯৯৮), নীল রঙের গ্রহ (১৯৯৯), কীরকম আছো মানুষেরা (২০০৫), জিরাফের ভাষা (২০০৫)। গদ্যগ্রন্থের মাঝে প্রিয় সুব্রত, শয়নযান উল্লেখযোগ্য।
উপন্যাস কিংবা কবিতার চাইতেও আত্মজীবনী বা স্মৃতিচারণমূলক বইগুলো অনেকবেশি টানে আমাকে। খানিকটা দূর্লভ((আউট অফ প্রিন্ট বলে), খানিকটা দূর্বোধ্য (কাব্যিকতা দোষে দুষ্ট বলে) তবুও অতি,অতি পছন্দের...কদিন পরপর-ই নিয়ম কিংবা সময় না মেনে ওল্টানো হয়-- এরকম একখানা পুস্তকের নাম শয়নযান। শয়নযানের প্রকাশক কলকাতার, উর্বী প্রকাশন। ভাস্কর দাসের রূপায়ন ও অলঙ্করণে প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮তে।
মূলত আত্মকথামূলক ছোট্ট একটা বই শয়নযান। নিজের সঙ্গে নিজের টুকরো টুকরো কথা বলা। লেখক নিজে ভূমিকায় লিখেছেন এভাবে– ''কোনও গল্পও নয়, উপন্যাসও নয়। তবে কি স্মৃতিকথা কোন? জার্নাল? ঐরকমই হবে কিছু একটা। লেখার কথা ছিল কবিতা, লিখে ফেললাম প্রেম আর ছেলেবেলার কথা…''
ছেলেবেলা। বাধা আর বিপত্তিহীন, বল্গাহীন স্বপ্ন আর ভালবাসার লালনীলবেগুনি রঙের দিনগুলি। যে রঙে কৃত্তিমতা নেই, ভাল- খারাপের কষ্টিপাথরে যাচাই হওয়ার ভয় নেই। পিছিয়ে পড়ে মুখ লুকোনোর যাতনা নেই, ছিলোও না.. দীর্ঘশ্বাসের উতল হাওয়া। তাই 'মুখ ফিরিয়ে যখনই দেখি, দেখি এক স্থির, নিস্তব্দ্ধ কুয়াশাঘেরা বাল্যকাল-- যেখানে সহজেই সাঁতার দেওয়া যায়।'
''আমি ঠিক আমার মতোই। আমার থেকে আমি একটুও ভাল নই, একটু খারাপও নই। ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি উড়িয়ে- পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি আমি।''
''ভাবনা জিনিসটাই বড় অদ্ভুত! কখন যে মাথায় এসে ঢোকে, তুমি তার কিচ্ছুটি বুঝতে পারবে না। এরকম যে দু- একটা বই তুমি ভালবেসে জেনেছিলে একদিন, যে দু-একটা নাম- মুখ তুমি ভালবেসে রেখে দিয়েছিলে জীবনে– ভুলেই তো যাচ্ছ সেসব। আর একবার ফের, ফের খেয়াল রাখো মেঘের দিন আর নীল আকাশের দিন… দেখো তো, মেঘগুলোকে কি ছেলেবেলার সিগারেটের প্যাকেটের রাংতার মতো মনে হচ্ছে না?''
দুঃস্বপ্নের ভাষাসমেত চিরনির্লিপ্ত কিছু মুখ আঁকা শয়নযানের পাতায়। যেন এক দোতলা বাড়ির জালে ঘেরা বারান্দা, বেঞ্চি পাতা, যেখানে পাথরে গড়া অদ্ভুত কিছু মানুষ বসে.. যেন একটা অলসযানে কিছু না করেই একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া।
আছে বইয়ের প্রতি নিখাদ নিঃশর্ত ভালবাসার কথাও। ''বই থেকে কী না জানা যায়! একদিন পড়ব, এমন ভাবনায়, আমি কত বই যে কিনে এনেছি! সেসবের পড়া হলো না তো কিছুই… একটা ভাল বই, আমি যতটুকু বুঝতে পারি, আমাদের ভালবাসতে শেখায়। কিন্তু ‘ভাল‘ বই? সেটা লেখা খুব শক্ত, আবার সহজও বটে! আমি যখনই কোন বই স্পর্শ করি, তখনই সেই বইয়ের লেখককেও স্পর্শ করি। স্পর্শ করি তাঁর দেশ, তাঁর সময়কেও…''
এইরকম কিছু বই, শুধু বই-ই কি আমাদের ভাবতে শেখায় না-- ভাগ্যিস ঘাসফড়িং কিংবা পানকৌড়ি নই, মানুষ হয়ে জন্মেছি! বলে--
'বেঁচে থাকো বাপু, দ্যাখো জীবন কী রহস্যময়..কী অবিশ্বাস্য রকমের আনন্দের!'
'বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন যে ট্যাক্স দিতে হয় তার নাম নিঃসঙ্গতা।' সেই নিঃসঙ্গ আমার স্নায়ুকে, কেবল কবিতা-ই বোধহয় শান্ত রাখে (নিজে অবশ্য জীবনেও লেখার সাহস করিনি)। সেজন্যই বোধহয় সবচেয়ে মন টেনেছে কবিতা নিয়ে স্বগতোক্তির অংশটুকু। ''কবিতা কি স্তব্দ্ধতার ভাষা? কবিতা কি জানার মাঝে অজানার সন্ধান? জীবন আর মৃত্যুর আলোছায়াময় খেলা? শেষ নেই এমন এক পাহাড়ে অনবরত চড়তে থাকার সঙ্গে কবিতার তুলনা করা যায় কিছুটা। আচ্ছা, বলছি আমি। আলোয় ভর্তি একটা পাহাড়, যে আলো শুধুই হাজার মোমবাতির। মোমবাতিগুলো সব জ্বলছে আর পাহাড়টা আস্তে আস্তে ডানা ভাসিয়ে শূন্যে উড়ছে আর ভেসে যাচ্ছে…কবিতা আমার কাছে ঠিক সেইরকম। আলোয় সাজানো একটা পাহাড়ের ভেসে যাওয়ার মতোই। এরথেকে বেশিকিছু আমি এখনো জানি না। শুধু এই একটা ছবিই দেখি, দেখতে পাই।''
তবু একেকদিন ক্লান্তি আসে। ক্ষিপ্রতা যায় হারিয়ে। আসে অবসন্নতা। ইচ্ছে করে ভুলে যাই সব, স-ব। ভুলে যাই আমার ডাক-নাম, শিউলিফুল, নদীর পাশের শহরটাকে, আমার গান, সন্ধেবেলা রঙের ফিঙে পাখি.. যদি ভুলে যাই আমি আমার ঘরে ফেরার পথ?
'' বিখ্যাত এক কবির লেখায় পড়েছিলাম : জীবনে একটা ভুল মানেই হাজার বছর বরফের ওপর হেঁটে বেড়ানো। আমি তো ভুলে ভর্তি এক মানুষ! কত হাজার বছর আমাকে হেঁটে বেড়াতে হবে বরফের ওপর?''
সেই আত্মকেন্দ্রিক কাপুরুষতার সহজ সমাধান পাওয়া যায় শয়নযানে। ''শেষ পর্যন্ত আমার জীবনে যদি কোন লক্ষ্য থেকে থাকে, তা হলো আত্মহত্যা না করা। এই মহাশূন্যতা যেমন পৃথিবীটাকে ছুঁয়ে আছে, সেইরকমভাবে কি ছুঁয়ে থাকা যায় না এই জীবনটাকে? ''
"বেঁচে থাকার জন্য আমাদের প্রতিদিন যে ট্যাক্স দিতে হয়, তার নাম নিঃসঙ্গতা।"-- এই লাইনটা কালকে রাত থেকে এখনো বারবার পড়তেছি। আরো এমন অনেক কথাই বলেছেন। আমার কাছে ফিজিক্যাল কপি থাকলে আমি মনেহয় পুরো বইটা দাগিয়ে ফেলতাম।
ভাস্কর চক্রবর্তী নিজের মনের ভাবনাগুলো ডায়েরি লেখার মত করে লিখেছেন, আমার মনে হল যেন আমি আমার ভাবনাগুলোই পড়তেছিলাম।
কয়েকবছর আগে বইটা দিশা আপুর রেকমেন্ডেশনে পড়েছিলাম, কিন্তু খুব একটা মনে ধরেনি তখন, আর এখন পড়ে মনে হচ্ছে লেখকরা আসলেই অন্যের মনের কথা খুবই সহজভাবে লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেন, যদিও এটা শুধুই লেখকের নিজস্ব ভাবনা। কিন্তু এত্তো মিল!
এখন থেকে বইটা একটা ভালবাসা আমার কাছে। সবার পড়া উচিত।
অনেকটা ডাইরি লিখার মত করে লিখা। নিজের মনের চিন্তা ভাবনা, মাঝে মাঝে কিছু স্মৃতিচারণ। সবকিছু বুঝি না, আবার কিছু কিছু বুঝি। যা বুঝি তা মাঝে মাঝে মনে হয় আমার মনের এক টুকরা ভাবনা, নাহয় আমি যদি আকাশ বাতাস নিয়ে ভাবতে বসতাম তাহলে এরকম কিছু একটা ভাবতাম কি? পড়তে বেশ লাগল।
কখনো কখনো লেখকেরা কথক সেজে এক মনোযোগী শ্রোতা খুঁজেন৷ সেই শ্রোতাকে হৃদয়ের সমস্ত কথা, গৎবাঁধা নয়, এলোমেলো শুনিয়ে দিতে চান। মনোযোগী শ্রোতাটির একমাত্র কাজ হচ্ছে মন দিয়ে তাঁর ভাবনাগুলো শোনা। বইটি ঠিক তেমনি।
২৯ পৃষ্ঠার আত্মজীবনী। কতটুকু জানা যাবে বলুন তো লেখকের জীবন সম্পর্কে? অনেকখানিই জানা গেলো। এবং অসাধারণ ভাবে। লেখা পড়ে মনে হচ্ছিলো, কবিতা পড়ছি৷ মুগ্ধতা।
একজন কবি যখন তার মৌলিক ভাবনাগুলোকে গদ্যে প্রকাশ করেন তখন শয়নযানের মতো লেখা তৈরি হয়ে ওঠে। কবি ভাস্কর চক্রবর্তী এই বইয়ে তার জীবনকে ঘিরে তৈরি হওয়া প্রহেলিকার কথা লিখেছেন। বিষাদ বা নিঃসঙ্গতা বইয়টাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। কিন্তু শুধু তাই নয়, জীবনের চরম মুহূর্তে দাঁড়িয়ে একজন যুবক কবি আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছিলেন তাকে জীবন সম্পর্কে কী সুন্দর উপদেশ দিলেন! তিনি বলছে���, "মৃত্যুর চেয়েও জীবন আরও রহস্যময়"। সেই তরুণ কবির আত্মহত্যাকে তিনি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, "ব্যাপারটায় যতটা নির্মমতার ছোঁয়া আছে, তার থেকেও বেশি ছোঁয়া আছে হয়তো অপ্রকাশিত কোনো দুঃখ-বেদনার, কোনো হিম জটিল সমস্যার।... কোনো নারী আমাকে কখনো মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়নি। বরং জীবনের প্রবল ঘূর্ণির ঠিক মধ্যিখানে ছুঁড়ে দিয়েছিল। আমি সেই ঘূর্ণির ভেতরে বসেই খুঁজে দেখতাম জীবন, খুঁজে দেখতাম কবিতা।" কী অসম্ভব সুন্দর তার কথাগুলো। 'শয়নযান' বইটিকে জার্নাল কিংবা স্মৃতিকথা বলা যায় তবে স্মৃতির ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়ার বিষয়টা অনুপস্থিত। এক একটা অধ্যায় যেন স্মৃতির আঁধার থেকে তলিয়ে পাওয়া জীবনের জীবনবোধের গল্প বলে যায়। শয়নযান পড়ার আগে থেকেই মৃত্যু সম্পর্কে তার দর্শন কিংবা ছোট দুইটি ছত্র আমার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে শয়নযান পড়ার আগে থেকেই। "শেষ পর্যন্ত আমার জীবনে যদি কোনো লক্ষ্য থেকে থাকে, তা হলো, আত্মহত্যা না করা। এই মহাশূন্যতা যেভাবে পৃথিবীটাকে ছুঁয়ে আছে, সেইরকমভাবে কি ছুঁয়ে থাকা যায় না এই জীবনটাকে?"
ভাস্কর চক্রবর্তীর কথা শুনে আসছি দীর্ঘ দিন। এরপর দেখলাম সবাই হু-হু করে "শয়নযান " পড়ে ফেলছে। এবং সবার মন্তব্য ভালোর ঘরে। কাজেই আমাকেও পড়তে হলো।
শয়নযানকে আসলে কোন ঘরানার মধ্যে ফেলা যায় না। তবে মোটের উপর বলা যায়, এটা দিনলিপি ধাঁচের লেখা। লেখক তাঁর মধ্যে বয়সে এসে, নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করছেন। বিপরীতে সেখানে কখনো থাকে নিঃসঙ্গতা,কখনো নিজের মনের বৈরী অবস্থাসল, কখনোওবা দারিদ্র্যতা। আবার কখনো চার পাশে পরিস্থিতির সাথে । এই যে লেখক সব কিছুর সাথে সমরে লিপ্ত হয়েছেন,সে কথা গুলো উঠে আসে লেখাতে।
গদ্য গুলো আকারে ছোট। ভীষণ স্বাদু। সুন্দর বাংলায় বললে "মন কেমন করা গদ্য "। পড়তে পড়তে লেখকের অনেক গুলো মন্দ পরিস্থিতির সাথে বিলকুল নিজের টা মিলে যায়। কি অদ্ভুত!
❝ শয়নযান ❞ ভালো বই। ভাস্কর বাবুর কবিতা পড়তে হবে এবার....
" কবিতা কি স্তব্ধতার ভাষা? কবিতা কি জানার মাঝে অজানাকে সন্ধান? জীবন আর মৃত্যুর আলোছায়াময় খেলা?
কবিতা কী, আচ্ছা, আমি বলছি। —আলোয় ভর্তি একটা পাহাড়, যে আলো শুধুই হাজার মোমবাতির। মোমবাতিগুলো সব জ্বলছে, আর পাহাড়টা আস্তে আস্তে ডানা ভাসিয়ে শূন্যে উড়ছে, আর ভেসে যাচ্ছে। কবিতা আমার কাছে ঠিক এইরকম।
আলোয় সাজানো একটা পাহাড়ের ভেসে যাওয়ার মতো । কবিতা সম্পর্কে এর থেকে বেশিকিছু আমি এখনও জানি না, শুধু এই একটা ছবিই দেখি, দেখতে পাই ৷
আর একথাও মনে হয়, জীবনে এই সৌন্দর্যটুকু অনুভব করতে হলে জীবনটাকে ছোট্টো একটা পাখির মতো হাল্কা করে নিতে হবে যাতে তা নীলিমার মধ্যে হারিয়ে গিয়েও মুহূর্তের মধ্যে, ঘরবাড়ির চালে এসে বসে পড়তে পারে।
কবিতা মহাকাশের মতোই রহস্যময় । যে যুগই পৃথিবীতে আসুক না কেন, কবিতা তার নিজস্ব পথ তৈরি করে নেবে । মহাকাশে চলতে চলতেও মানুষ একদিন কবিতা পড়বে।"
- অপূর্ব !! কবিতা সম্পর্কে কোন কবির কাব্যিক বয়ান। এইসব বইয়ের রিভিও এক কথায় দেয়া যায় - মাস্ট রিড।
' যদি না-জিততে পার তো জিতো না, কিন্তু হেরেও যেও না তা' বলে' - এভাবেই 'শয়নযান'-এর সূচনা করেছেন কবি ভাস্কর চক্রবর্তী। এই বইকে কী বলব? স্মৃতিকথা, জার্নাল, উপন্যাস, স্বগোতক্তি অথবা কিছুই না। যে কোনো পাঠক পড়তে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে যাবেন। এমন মধুমাখা গদ্যের বুননে মোহময় এক শব্দের জগৎ নির্মাণ করেছেন ভাস্কর চক্রবর্তী। মাত্র ২৯ পাতায় শব্দের কারিগরের নৈপুণ্যের স্বাক্ষর শত শত পাতায় লেখার সমতুল্য।
পদ্যকারদের গদ্যে সব সময় পদ্যের রূপ, রস ও সুগন্ধ মাখা থাকে। তাতে সুবাসে ভরে ওঠে পাঠকের মন। এবারও ব্যত্যয় হয়নি।
ভাস্কর চক্রবর্তীর লেখা আরও পড়ব। কবি মাতিয়ে দিলেন।
গোগ্রাসে গেলার নয়, প্রতিদিন একটু একটু করে তারিয়ে তারিয়ে পড়ার মতো বই। 'বেঁচে থাকার জন্য আমাদের প্রতিদিন যে ট্যাক্স দিতে হয়, তার নাম নিঃসঙ্গতা', এই বাক্যই তো পড়া যায় বার বার
"শয়নযান'' মূলত ভাস্কর চক্রবর্তীর নিজের সঙ্গে নিজের এক দীর্ঘ আলাপচারিতার কথামালা। লেখক বলছেন " কোন গল্পও নয়, উপন্যাসও নয়। তবে কি স্মৃতি কথা কোন? জার্নাল? ঐরকম হবে কিছু একটা। লেখার কথা ছিল কবিতা, লিখে ফেললাম প্রেম আর ছোটবেলার কথা...."
কবির এই জীবনের বর্ণনা অনেকটা কবিতার মতো। এই বই যেন তাঁর নিজের সঙ্গে নিজের এক দীর্ঘ আলাপচারিতা।
ছেলেবেলা নিয়ে বলছেন " আমি ঠিক আমার মতোই। আমার থেকে আমি একটুও ভালো নই, একটুও খারাপ নই। ছেলেবেলা থেকেই আমি শুধু নিজেকে নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি আমি''
"বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন যে ট্যাক্স দিতে হয় তার নাম নিঃসঙ্গতা''
এই লাইনটা সম্ভবত আমাকে খুব বেশি ছুয়ে গেছে। পুরো বই জুড়ে যেন এক নিঃসঙ্গ, আত্মবীক্ষণের গদ্য, যেখানে লেখকের ব্যক্তিগত দহন, হীনমন্যতা, অসহায়তা ও আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান উঠে এসেছে নিঃসংকোচে।
লেখক তার লেখনিতে বই প্রেমের কথাও টেনে আনছেন বারবার।
"বই থেকে পড়ে জেনেছিলাম, এরকম অন্তত দুটো অসাধারণ কথা এখনও আমার ছবির মত মনে আছে। একটা হলো আশাবাদী ও নৈরাশ্যবাদী এই দু'দলই সমাজকে কিছু দিয়ে-থুয়ে থাকে। আশাবাদীরা এরোপ্লেন আবিষ্কার করল তো নৈরাশ্যবাদীরা আবিষ্কার করল প্যারাসুট। আরেকটা কথাও এখনও আমি দিব্যি মুখস্ত বলে যেতে পারি ক্লান্তি থেকে পুরুষরা বিয়ে করে - আর কৌতূহল থেকে বিয়ে করে নারীরা। দু'দলই, শেষমেষ পস্তায়।''
"মহৎ একটা বইয়ের আয়ুও নাকি আজ খুব জোর আড়াই বছর। কথাটা বিশ্বাস করতে ভালো লাগেনা। আমি যখনই কোন বই স্পর্শ করি, তখনই সেই বইয়ের লেখককেও স্পর্শ করি। স্পর্শ করি তার দেশ,তার সময়কেও''
আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে হীনমন্যতার প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে লেখকের এই লাইনে।
"শেষ পর্যন্ত আমার জীবনে যদি কোন লক্ষ্য থেকে থাকে, তা হলো আত্মহত্যা না করা।''
২৯ পাতার আত্মজীবনী! কিছু কিছু যায়গা পড়ে মনে হচ্ছিলো ভিনসেন্ট ভ্যান গগের আত্মহত্যার আগ মুহূর্তের জীবন সংগ্রামী লড়াইয়ের অনূভুতি তুলে ধরেছে।
বই থেকে —
পৃথিবীবিখ্যাত বক্সার জো লুই একবার বলে ছিলেন: টাকা আমি পছন্দ করি না, কিন্তু টাকা আমার স���নায়ুগুলোকে শান্ত রাখে।
আমি ঠিক আমার মতোই। আমার থেকে আমি একটু ভালোও নই, একটু খারাপও নই। মহান হতে চাওয়ার একটা ধান্দা শুধু মাঝে-মধ্যে আমাকে পেয়ে বসে। আমার এই গোলমেলে ইচ্ছেটাকে এবার একটু ছেঁটে দিতে হবে।
চড়ুইদের কাছ থেকে শিখতে চেয়েছিলাম কীভাবে বেঁচে থাকতে হয় জীবনে। বড়ো বেশি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল জীবন, বড়ো বেশি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল সবকিছু। এই চেল্লামেল্লি, দারিদ্র্য, এই নিষ্ঠুরতার মধ্যে আমিও শেষ পর্যন্ত জুতে দিয়েছি নিজেকে। চালিয়ে দিচ্ছি দিনগুলো। আমার জীবনের প্রতিটি চেষ্টাই বোধহয় মৃত্যু থেকে শুধু জীবনের দিকে যাওয়ার। চেয়েছিলাম কিছু-একটা করি। আরো দ্রুত। বেলা বড়ো তাড়াতাড়ি সরে যায় এখানে। দেখতে না দেখতেই।
বাহান্নটা তাস যদি আমার জীবনটাকেও ওইরকম পাল্টে দিতে পারত, আমার দুঃখ থাকত না কোনো।
নিবিড় সব ভালোবাসা থেকে, দৃশ্য থেকে, আনন্দ থেকে আমাকেও যে একদিন বিচ্ছিন্ন হতে হবেই।
“একদিন মৃত্যু হবে যেহেতু জন্ম হয়েছে” এই সহজ সত্যি কথাটা জানার পরেও, আশ্চর্য, কেন যে আমি মৃত্যুর দাসত্ব থেকে মুক্তি পাইনি? আমাকে বইতে হয়েছে এই নগ্ন খোলামেলা মৃত্যু, বিশ বছর তিরিশ বছর চল্লিশ বছর।
জীবনটা খুব দামি ভাবলে, মৃত্যু বিশালতর হয়ে, হাজার মুখোশে, আমাদের ভয় দেখায়। খুব সস্তা ভাবলেও রাস্তার কুকুর এসে জীবনটাকে মুহূর্তেই গিলে ফেলে।
জীবনকে এত প্রবলভাবে ভালোবাসি বলেই কি মৃত্যু এসে বারবার ধাক্কা দিয়ে যায় আমাদের?
শেষ পর্যন্ত আমার জীবনে যদি কোনো লক্ষ্য থেকে থাকে, তা হলো, আত্মহত্যা না করা। এই মহাশূন্যতা যেমনভাবে পৃথিবীটাকে ছুঁয়ে আছে, সেইরকমভাবে কি ছুঁয়ে থাকা যায় না এই জীবনটাকে? :')
ভাস্কর চক্রবর্তী প্রিয় কবি। তিনি স্বর্গের নরকের নাগরিক নন, কেবল বাংলা ভাষা। শীতকাল কবে আসবে, নাকি সুপর্ণা আসবে এইসব ভাবতে ভাবতেই তো তাকে চিনে গেছিলাম। অথচ আমি বছর বছর তিন মাস করে ঘুমিয়ে কাটাই। এই যে কবিতায় তিনি সাবলীলভাবে বলে দেন, "চলে যেতে হয় বলে চলে যাচ্ছি, নাহলে তো আরেকটু থাকতাম", কিংবা "আছো কি আমারই মতো? কুকুরের হলুদ বমির মত একা?" এইসব কেবল তার পক্ষে সম্ভব হয়, কেমন করে জানি ফাঁকতালে কীরকম একটা ডিপ্রেসিং ধূসর রঙ এর বিষণ্ণ ভাষা পেয়ে গেছিলেন ভদ্রলোক যা দিয়ে কুপোকাত করে দিয়েছেন যে তাকে পড়েছে, তাকেই। তিনি কি খুব বইপড়ূয়া পাঠককূলের বাইরে খুব একটা পরিচিত? না, মোটেও না। কিন্তু তার বই একবার যে ধরবে, সে উঠবার পর ভাস্কর চক্রবর্তী নাম শুনলে বাদুড়ের মতন কুচকাওয়াজ শুরু করে দিতে বাধ্য।
শয়নযান তার গদ্যের বই। এই বই পড়ার সময় মহৎ কিছু দেখবেন বলে পড়বেন না। এটা গল্পও না, সম্পুর্ণ স্মৃতিকথাও না। এটা জাস্ট একটা ঊনত্রিশ পাতার প্রজাপতি, যার পিছনে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে ধরতে না পেরে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়বেন, কিন্তু পরে আপনার ছোট ভাই বা বোন যেয়ে সেটা ধরে আনবে। কবিতা নাকি একটা প্রচুর মোমবাতি জ্বলা পাহাড়, যা উড়ে চলেছে। এরকম মায়ার ক্যালিপসো তৈরির ক্ষমতা বাংলা ভাষায় তো খুব কম লোকের আছে, তার মাঝে ভাস্কর চক্রবর্তী একজন। বইটা বারবার পড়বেন, বারবার ডুবে যাবেন, কিছুই মনে থাকবে না, হাওয়াই মিঠাই যেন, কিন্তু দারুণ সুস্বাদু, তাই আপনি আবার খাবেন।
এরকম নরম, হাতে নিলে গলে যাবে বইটা আউট অফ প্রিন্ট, এইটা কেবল বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলেই সম্ভব। ইলেক্ট্রনিক কপিটা যে বানিয়েছে, তাকে ভালবাসা। মেইল করেছে মানব, তাকে ধন্যবাদ।
'বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিদিন যে ট্যাক্স দিতে হয়, তার নাম নিঃসঙ্গতা।' এই নিঃসঙ্গতার বিপদ্দজনক রুপ দেখেছেন যিনি তিনিই কেবলমাত্র জানেন কবিতার ভার কতটুকু।
বোধহয় ভাস্কর চক্রবর্তী জানতেন, সবটুকুই। নাহলে কি করে তিনি বললেন? 'জীবন কি কচ্ছপের পিঠে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা?' অথবা
'আমি চোখ বুজি, চোখে খুলে যায় আমার ভেতর থেকে— একলা থাকতে থাকতে, থাকতে থাকতে আমার গায়ে সবুজ শ্যাওলা গজিয়ে উঠবে একদিন পোড়ো বাড়ির মতো আমি অদ্ভুত দাঁড়িয়ে থাকবো একদিন গম্ভীর জঙ্গলের মধ্যে—'
জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে মানুষ পেছলে ফেলা আসা সময় ও স্মৃতিো হাতড়ে ফেরে। তাতে জমে থাকে নানা সুখ স্মৃতি, না পাওয়া, হারিয়ে যাওয়া বন্ধু, সুখের সময় আবার ক্ষতের চিহ্ন।
লেখক অবসরে বা নিজের খেয়ালে লিখেছেন সেই পিছনের কাল থেকে। তাতে অভিজ্ঞতার ঝাঁপির সাথে মধুর স্মৃতি তুলে এনেছেন।
লেখকের চমৎকার এক উপলব্ধি যা পাঠকের অনুভূতিকেও তোলপাড় করে দেয়।
আমি কবি ভাস্করকে চিনি যিনি আমাদের অমর কবিতা উপহার দিয়েছিলেন। যিনি সুপর্ণাকে প্রশ্ন করতেন শীতকাল কবে আসবে? লিখেছিলেন,
'এই সেদিনও বিস্মিত এক কিশোর ছিলাম, আজ বিরক্ত একটা লোক হয়ে দাঁড়িয়েছি'।
যিনি জীবন ও নিসঙ্গতাকে মুদ্রার একই পিঠ মনে করতেন। বলতেন,
'বেচেঁ থাকার জন্যে প্রতিদিন যে ট্যাক্স দিতে হয় তার নাম নিঃসঙ্গতা'।
শয়নযানে তার কাছে পড়ে থাকা কিছু দিন ও রাত্রিতে তিনি তার কবিতার ভাষাকে গদ্যে তুলে ধরেছেন। শয়নযান তার জীবনী আবার তার স্মৃতিচারণও বটে। পুরাণ কলকাতার আনাচে কানাচে যার স্মৃতি এখন লোপ পায়। ভুলে যাওয়া কলকাতায় যার আকচার শুনতে হয় 'তুমি আদমি না পাজামা?' কিন্ত তার স্মৃতিচারণে আমাদের তার কবিতার মতো উপদেশ উপহার দিয়েছেন। লিখেছেন,
'ঠিক সময়ে ঠিক কথা বলার দাম এক টাকা, ঠিক সময়ে চুপ করে থাকার দাম দু'টাকা'।
এই বইয়ের পাতায় পাতায় তার গল্প। পাতায় পাতায় তার একলাপনা। যিনি লিখতে ভালোবাসতেন, কবিতা ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন রঙ্গ বেরঙ্গের শার্ট কিনতে। যার দার্শনিক হওয়ার বেশ সম্ভবনা ছিল,
চমৎকার লিখেছেন কবি ভাস্কর চক্রবর্তী । এই সময়টা এই বইটা পড়ার জন্যে সঠিক ছিল না । এই মুহূর্তে আমার মাইন্ডের পেসের সাথে বইটা ঠিক পাশাপাশি গেল না । ৫ বছর আগে ২০১২ তে এই বইটা পড়লে আমার ভাল লাগত আরও বেশি । এখন আর এত এবস্ট্রাক্ট পড়তে ভালো লাগে না ~
" শেষ পর্যন্ত আমার জীবনে যদি কোনো লক্ষ্য থেকে থাকে, তা হলো আত্মহত্যা না করা "
শয়নযান যখন লিখতে বসেছেন, কবি�� বয়স তখন পঞ্চাশ পেরিয়েছে। সময়ের জলছাপে হারিয়ে যেতে বসা দুরন্ত কৈশোরের স্মৃতি-বিস্মৃতি, ভুলে ভরা যৌবনের অশান্ত সময়, আর অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর সাথে চিরন্তন বোঝাপড়া ; কবি একে একে ছুঁয়ে গেছেন জীবনের প্রায় সকল স্মৃতিবেদনার হাতগুলি। শূন্য আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘেদের মাঝে খুঁজেছেন নস্টালজিয়ার সেই বিষন্ন সুন্দর রঙ।
"বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত যে ট্যাক্স দিতে হয়, তার নাম নিঃসঙ্গতা"
নিঃসঙ্গতার এরকম সহজ সরল অথচ অর্থপূর্ণ সংজ্ঞা কেবল ভাস্কর চক্রবর্তীই দিতে পারেন। যিনি এক জীবনে নিঃসঙ্গতার বিপজ্জনক রূপ দেখে, ক্লান্ত কবি আশ্রয় খুঁজেছেন কবিতার মাঝে। স্তব্ধতার ভাষা কবিতার মাঝেই চিনেছেন বেঁচে থাকার আনন্দ।
জীবন ঘনিষ্ঠতার উত্তর পেতে চেয়েছেন নিজের করা প্রশ্নের মধ্যেই," এই মহাশূন্যতা যেমনভাবে পৃথিবীটাকে ছুঁয়ে আছে, সেইরকমভাবে কি ছুঁয়ে থাকা যায় না এই জীবনটাকে?"
শয়নযান কবির দ্বিধা আর শঙ্কার মাঝে টলতে থাকা পূর্ববতী জীবনের অ্যাখান। কোনো কবিতার কিংবা উপন্যাসের বই নয়। আবার ঠিক জার্নাল-স্মৃতিকথাও বলা যায় না। শয়নযান কেবল কবির 'কাহিনী ছাড়া গদ্য' লেখার তীব্র ইচ্ছের একটি বিভ্রান্ত প্রতিফলন।
একবার পড়ার পরে আবারও পড়বার ইচ্ছে করেছে এরকম অভিজ্ঞতা খুব কমই হয়েছে। কিন্তু ভাস্কর চক্রবর্তীর গদ্য এত সুস্বাদু যে শেষ করার পরে আবারও শুরু করতে মন চায়।
বিষয়বস্তু ছাড়া কি গদ্য সম্ভব? যেখানে খোদ গদ্যই একটা জীবনের বিষয়। জীবনের প্রতিটা থরে সাজানো থাকে রঙ বেরঙের নানা রকমের গদ্য। তবুও সম্ভব। যেমন সম্ভব, সাদা আকাশের মেঘ থেকে হাতড়িয়ে বের করা ছোটবেলায় দেখা সিগারেটের প্যাকেটে রাংতা টিপ। কবিতার লাইনের মাঝে আবিষ্কার করা বিস্তর ফারাক তবুও তারা গুটিয়ে থাকে একে অন্যের খুব কাছে।
ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছেন জীবনের সেসব সাধারণ কথা যা অসাধারণ ভাবে ধরা দিবে পাঠকের কাছে। ছোট কিন্তু গভীরভাবে লেখা একটা উপন্যাস যেন।
লেখক ভূমিকায় লিখেছেন, 'কোনও গল্পও নয়, উপন্যাসও নয়। তবে কি স্মৃতিকথা কোন ? জার্নাল ? ঐরকমই হবে কিছু একটা। লেখার কথা ছিল কবিতা, লিখে ফেললাম প্রেম আর ছেলেবেলার কথা..'
কি সুন্দর সাবলীল লেখনি! আত্মজীবনী মনেই হলো না।মনে হলো কেউ রোজ দিনকার দিনলিপি লিখেছে নিজের মনের মতো করে।কিছু কিছু লাইন কিছু কিছু কথা মন ছুঁয়ে গেলো।এইতো!
'মুখ ফিরিয়ে যখনই দেখি, দেখি এক স্থির, নিস্তব্ধ, কুয়াশাঘেরা বাল্যকাল যেখানে সহজেই সাঁতার দেওয়া যায়। যদিও বিস্মৃতির এক ঢল নামছে জীবনে, কুয়াশার মায়াজালে আমি এখনো দেখতে পাই এক কিশোরের স্বপ্ন আর তার সমাধি, অবাধ্যতা আর নষ্টামি চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। ভুল দিক থেকে এসে পৌঁছানো, একঘেয়ে আর ক্লান্তিকর জীবনের সেই নিরীহ কিশোরকে, সেই তরুণকে আমি বাঁচিয়ে তুলেছিলাম। তাকে বেঁচে থাকতে শিখিয়েছিলাম। তার দু'চোখে এঁকে দিয়েছিলাম রূপ, সৌন্দর্য আর ভালোবাসা। স্বাভাবিকতাই সৌন্দর্য, এ-কথা আমি কতবার যে আউড়েছি তাকে।'
' ভাবনা জিনিসটাই বড় অদ্ভুত! কখন যে মাথায় এসে ঢোকে, তুমি তার কিচ্ছুটি বুঝতে পারবে না। এরকম যে দু- একটা বই তুমি ভালবেসে জেনেছিলে একদিন, যে দু-একটা নাম- মুখ তুমি ভালবেসে রেখে দিয়েছিলে জীবনে– ভুলেই তো যাচ্ছ সেসব। আর একবার ফের, ফের খেয়াল রাখো মেঘের দিন আর নীল আকাশের দিন… দেখো তো, মেঘগুলোকে কি ছেলেবেলার সিগারেটের প্যাকেটের রাংতার মতো মনে হচ্ছে না ?'
'যদি না-জিততে পার তো জিতো না, কিন্তু তুমি হেরেও যেয়ো না তা’বলে।'
'আচ্ছা, আবছা স্মৃতিগুলোকে নিয়ে এবারে তুমি কী করবে? অবশ্য, সবকিছুই তুমি ভুলে যাচ্ছ আস্তে আস্তে। বছর বারো-তেরো আগেই তোমার ডাক্তারবাবু বলেছিলেন তোমাকে, “কিছু কিছু জিনিস তুমি ভুলে যাবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না যেন।”—কিন্তু এই ভয়াবহ বিস্মৃতি! যে দু-একটা বই তুমি ভালোবেসে জেনেছিলে একদিন, যে দু-একটা নাম,মুখ তুমি ভালোবেসে রেখে দিয়েছিলে জীবনে-ভুলেই তো যাচ্ছ সেসব। তাহলে?—তুমি খেয়াল রাখো এবার মেঘের দিন আর নীল আকাশের দিন-দেখো তো, মেঘগুলোকে কি ছেলেবেলার সিগারেট প্যাকেটের রাংতার মতো মনে হচ্ছে না?'
'জীবন যেন কাছে এসে বলছে আমাকে বেঁচে থাকো বাপু, দ্যাখো, জীবন কী রহস্যময়, কী অবিশ্বাস্য রকমের আনন্দের।'
'আমি ঠিক আমার মতোই। আমার থেকে আমি একটু ভালোও নই, একটু খারাপও নই। মহান হতে চাওয়ার একটা ধান্দা শুধু মাঝে-মধ্যে আমাকে পেয়ে বসে। আমার এই গোলমেলে ইচ্ছেটাকে এবার একটু ছেঁটে দিতে হবে। আমি সত্যিই একটা নিরুপদ্রব পৃথিবীর কথা ভেবেছিলাম, স্বপ্ন দেখেছিলাম একদিন, আর আরো একটু ঝুঁকে পড়েছিলাম কাগজ-কলমের দিকে। হিংসা আর প্রতিহিংসা যেখানে প্রতিমুহূর্তেই নাচ দেখায়, সেখানে সেই ছুঁচের ডগায় দাঁড়িয়ে এর থেকে মূর্খতা আর কী হতে পারে? কিন্তু সত্যিই কী এটা মূর্খতা? কে জানে!'
'কোথায় ছুটছেন? দৌড়চ্ছেন কোথায়? দাঁড়ান তো এক মিনিট। চারপাশের মানুষজনদের দিকে তাকিয়ে এরকমই সব হাজার কথা ভেসে ওঠে আমার মনে। কী করুণ এই দৌড়, এই দৌড়োতে থাকা। মুহূর্তের জন্যেও চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখার কোনো অবসরই আর নেই মানুষের। বাড়ির বারান্দার যে জায়গাটায় গুটিগুটি ব্যাঙ্ক এসে হাজির হয়েছে, মনে হচ্ছে আমাদের নিশ্বাসগুলোও একদিন ব্যাঙ্কের লকারে চাবি দিয়ে রেখে দেবেন কেউ। হাসিঠাট্টাগুলো সব গেল কোথায়? কী গম্ভীর হয়ে গেছেন আপনারা! দেখুন তো একবার নিজেদের দিকে তাকিয়ে।'
'জীবনকে এত প্রবলভাবে ভালোবাসি বলেই কি মৃত্যু এসে বারবার ধাক্কা দিয়ে যায় আমাদের?'
ভাস্করের গদ্য এত মর্মস্পর্শী! কিছুদিন আগে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গদ্য পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। জীবনানন্দ দাশের গদ্যও অন্যান্য গদ্য লেখকের চেয়ে সুপাঠ্য; আনন্দের; কেননা আমার মতো পাঠকের কাছে যন্ত্রণা আনন্দের উৎস।
কবিদের যেকোনো গদ্যের বই আমার মতো দুঃখিত পীড়িত প্রতারিত বিরহিত পাঠকের যথার্থ বন্ধু হতে পারে। যারা বিষণ্ণ বিরহের নদীতে প্রতিদিন স্নান করে তাদের জন্য কবিদের গদ্য অবশ্যপাঠ্য।
"আমরা কুকুর-বিড়ালের মতো বেঁছে আছি' কথাটা উড়তে উড়তে একটু উঁচু নারকেল গাছের মাথায় ধাক্কা খেল। 'তুমি আমার ঘুম' প্রেমিক বলছে তার প্রেমিকাকে, আর উড়ে চলেছে। ধুলিমুখোশ পরা একটা লোক আমার সামনে দিয়ে উড়ে যেতে যেতে বলল : চললাম।
যে কবিতাটা আমি লিখছিলাম, কোথায় আরম্ভ হয়েছিল আমি ভুলে গেছি, কোথায় শেষ হবে তাও আমি জানি না। রাজ্যের সইসাবুদগুলো এখন উড়ে চলেছে, করমর্দনগুলো ধন্যবাদগুলো উড়ে চলেছে। চীনেমাটির পুতুলগুলো উড়তে উড়তে বলছে : আম���দের ধরো। মহাসর্বনাশ একটা ঘটতে চলেছে বলে যদিও মনে হচ্ছে, তেমন কিছুই নয় ব্যাপারটা। বাচ্চারা আনন্দে চীৎকার করছে। হাসছে। ভয় পাওয়ার নেই কিছুই।"
ভাস্করের জার্নাল। দুর্দান্ত না হয়ে উপায় আছে? এমনিতে কবিদের গদ্যের পড়ে অন্যরকম আনন্দ পাওয়া যায়। তাদের লেখা জার্নাল বা আত্মকথনও আলাদা মাত্রা পায়। আত্মোপলব্ধির ব্যাপারগুলো অকপটে ধরা দেয় নতুন আবহে। পড়তে গিয়ে মনে হয় কেউ নিজের ভাবনা এভাবেও প্রকাশ করতে পারে নাকি? এক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। বইটাতে কোট করার মতোন, মনে রাখার মতোন প্রচুর উক্তি চোখে পড়েছে। কবিতার মতো "শয়নযান"ও তাই বারবার পড়া যায়।
(বহুদিন পর গুডি তে কিছু লিখলাম। মাস দুয়েক তো হবেই। এই বইটাও পড়েছি আন্দোলনের আগে। এরপর তো এক মাসে আমাদের বয়স বাড়িয়ে দিয়ে গেল এক যুগ! উথাল পাথাল সে সময়টার পর থেকে পড়ায় আর মনোযোগ দিতে পারিনি। মাঝেমধ্যে এদিকটায় এসে ঘুরেফিরে চলে যেতাম। কিছু পরীক্ষার ঝামেলা শেষ করে আবার পুরোনো উদ্যমে ফেরার আশা রাখছি। আলাদা করে পোস্ট দেয়ার উপায় জানিনা তাই রিভিউ এর সাথেই লিখলাম। পরে ইডিট করে কেটে দিবো।)
খুবই ছোট বই। আধ ঘন্টার বেশি সময় লাগার কথা না। সেটা পড়েছি ৪/৫ দিন ধরে। প্রতিটা লাইন প্রতিটা শব্দ প্রতিটা অক্ষর অনুভব করে পড়েছি। এভাবেই পড়ুন ভালো লাগবে। ফিল করতে পারবেন। এগুলো যেন আপনার-আমারই কথা।
হয়ত, এই বৎসরের শেষ বই এইটা! হয়ত না। ভাস্কর চক্রবর্তীর লেখার হাত বেশ ভাল। কবিতা লেখায় বিশেষ পারদর্শী বলেই হয়ত তার গদ্যরচনাতেও সুরেলা শব্দচয়ন এসে পরে। আত্মজীবনীর ছলে লেখা "শয়নযানে" ফুটে উঠেছে তার মৃত্যু নিয়ে ভাবনা, কবিতার প্রতি তার একান্ত ভালবাসা, টুকরো টুকরো স্মৃতি কথা। নিঃসঙ্গতা নিয়েও লেখক দৃষ্টিপাত করেছেন বিচক্ষণতার সাথে, এমন শব্দ কে তিনি বুনট আকারে লিখেছেন যা হয়ত সাধারণ দৃষ্টিতে প্রত্যেক মানবের সাথেই সম্পৃক্ত। হয়ত নাতিদীর্ঘ হয়ে গেল, মেলোডিয়াস রচনাটি আরেকটু দীর্ঘ হলে জমতো কিন্তু!