সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় দু-বছরেরও বেশি কাল ধরে ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল ‘দূরবীন, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জোরালো, সংবেদনশীল কলমে অন্যতম মহৎ সৃষ্টি। চলমান শতাব্দীর দুইয়ের দশকের শেষ ভাগ থেকে শুরু করে আটের দশক পর্যন্ত বিস্তৃত সময়ের প্ৰেক্ষাপটে সামাজিক জীবনের যাবতীয় পরিবর্তনকে এক আশ্চর্য কৌতুহলকর বিশাল কাহিনীর মধ্য দিয়ে ধরে রাখার প্রয়াসেরই অভিনন্দিত ফলশ্রুতি ‘দূরবীন উপন্যাস। তিন প্রজন্মের এই কাহিনীতে প্রথম প্রজন্মের প্রতিভূ জমিদার হেমকান্ত। এ-উপন্যাসের সূচনায় দেখা যায়, হেমকান্তের হাত থেকে কুয়োর বালতি জলে পড়ে গেছে, আর এই আপাততুচ্ছ ঘটনায় হেমকান্ত আক্রান্ত হচ্ছেন মৃত্যুচিন্তায়। বিপত্নীক হেমকান্ত ও রঙ্গময়ী নামের প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক পুরোহিত্যকন্যার, গোপন প্রণয়কাহিনী ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য পারিবারিক কাহিনী নিয়ে এ-উপন্যাসের প্রথম পর্যায়। দ্বিতীয় প্রজন্মের নায়ক কৃষ্ণকান্ত। দেবোপম রূপ ও কঠোর চরিত্রবল বালক কৃষ্ণকান্তকে দাঁড় করিয়েছে পিতা হেমকাস্তের বিপরীত মেরুতে। স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ কৃষ্ণকাস্তের ব্ৰহ্মচর্য-গ্রহণ ও দেশভাগের পর তাঁর আমূল পরিবর্তন-এই নিয়ে এ-উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্য়ায়ের কাহিনী। তৃতীয় ও শেষ প্রজন্মের নায়ক ধ্রুব, বিশ শতকের উপান্তপর্বে এক দিগভ্ৰষ্ট, উদ্ধত বিদ্রোহী যুবা। ধ্রুবর স্ত্রী রেমি, যার সঙ্গে এক অদ্ভুত সম্পর্ক তার। কখনও ভালবাসা, কখনও উপেক্ষা, কখনও-বা প্রবল বিরাগ। অথচ রেমির ভালোবাসা শাত-আঘাতেও অবিচল। একদিকে রেমির সঙ্গে সম্পর্ক অন্যদিকে পিতা কৃষ্ণকাস্তের মধ্যে সেই ব্ৰহ্মচারী ও স্বদেশের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণসত্তাটিকে খুঁজে না-পাওয়ার ব্যর্থতায় ক্ষতবিক্ষত ধ্রুবর আশ্চর্য কাহিনী নিয়েই শেষ পর্ব। শুধু তিন প্রজন্মের তিন নায়কের ব্যক্তিগত কাহিনীর জন্যই নয়, এ-উপন্যাসের বিশাল প্রেক্ষাপটে আরও বহু বিচিত্র ও কৌতুহলকর শাখা-কাহিনী, এবং এর চালচিত্রে স্বদেশী আন্দোলন, দেশভাগ ও স্বাধীনতা পরবর্তী উত্তাল দিনরাত্রির এক তাৎপর্যময় উপস্থাপনার জন্যও ‘দূরবীন’ চিহ্নিত হবে অবিস্মরণীয় সৃষ্টিরূপে। শুধুদূরকেই কাছে আনে না, উল্টো করে ধরলে কাছের জিনিসও দূরে দেখায় দূরবীন। ‘দূরবীন’ উপন্যাসের নামকরণে যেমন সূক্ষ্মতা, রচনারীতিতেও তেমনই অভিনবত্ব এনেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। দ্বিস্তর এই উপন্যাসে সেকাল ও একাল, অতীত ও বর্তমান এক অনন্য কৌশলে একাকার।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একজন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক।
তিনি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত ময়মনসিংহে (বর্তমানে বাংলাদেশের অংশ) জন্মগ্রহণ করেন—যেখানে তাঁর জীবনের প্রথম এগারো বছর কাটে। ভারত বিভাজনের সময় তাঁর পরিবার কলকাতা চলে আসে। এই সময় রেলওয়েতে চাকুরিরত পিতার সঙ্গে তিনি অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে তাঁর জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। শীর্ষেন্দু একজন বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত।
তাঁর প্রথম গল্প জলতরঙ্গ শিরোনামে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাত বছর পরে সেই একই পত্রিকার পূজাবার্ষিকীতে তাঁর প্রথম উপন্যাস ঘুণ পোকা প্রকাশিত হয়। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি।
শীর্ষেন্দুর লেখাতে সময় হচ্ছে মুখ্য বিষয়। তাঁর এই অসাধারণ কীর্তি ‘দূরবীন’ এ লেখক উনিশ শতকের ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রজন্মগত ব্যাবধান(জেনারেশন গ্যাপ) খুবসাবলীল ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে উপন্যাস টা । উপন্যাসটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মূলত হেমকান্ত এবং ধ্রুবর (আমি না গল্পের ক্যারেক্টার :p ) জবানীর মাধ্যমে। কিন্তু আসলে এদের দুজনের কেউ ই এই উপন্যাসের মূল নায়ক নন।আসল নায়ক হচ্ছেন কৃষ্ণকান্ত ।উপন্যাসটা দুইটা অংশে বিভক্ত, আর দুই অংশের বর্ণনাই লেখক চমৎকার ভাবে লিখে গিয়েছেন। একশোর উপরে অধ্যায় উপন্যাসটায়। কিন্তু কোথাও খারাপ লাগে নাই । বিজোড় অধ্যায় গুলো(১,৩,৫.........) প্রথম কাহিনীর অন্তর্গত এবং জোড় অধ্যায় গুলো দ্বিতীয় কাহিনীর অন্তর্গত। কেউ যদি প্রথম অংশ গুল(১,৩,৫...) পড়ে শেষ করে, তবে দ্বিতীয় অংশে সে প্রথম অংশের পরথেকে ধারাবাহিক বর্ণনা পাবে!!!! আর গল্পের প্রয়োজনেই এখানে রেমি এবং ধ্রুবর যে মধ্যে যে ভালোবাসার টানাপড়েনের চিত্র আকা হয়েছে তার মধ্যেও অনেক সময় আবেগে ডুবে গিয়েছি। কখনো মনে হয়েছে যে রেমি ই ঠিক আবার কখনও মনে হয়েছে যে ধ্রুবই ঠিক। গল্পের প্রয়োজনে অনেক চরিত্রেরই আগমন ঘটেছে যার প্রত্যেকটিই উপোভোগ্য।
এছাড়াও উপন্যাসটিতে ইংরেজদের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতার চিত্র খুব বড় ভাবে না হলেও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। স্বাধীন হওয়ার আগের ও পরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার একটা চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম অংশের ঘটনাস্থল আমাদের বাংলাদেশ এই এবং দ্বিতীয় অংশের ঘটনাস্থল পশ্চিমবঙ্গ।প্রথম অংশটুকুতে কৃষ্ণকান্তের সংগ্রাম এবং সাফল্য এবং দ্বিতীয় অংশে এর পরিণতি এবং কৃষ্ণকান্ত ও ধ্রুব এর মধ্যে ব্যাবধান তুলে ধরা হয়েছে।
সবার জন্যই অবশ্য পাঠ্য একটা বই। না পড়লে পড়তে পারেন। সব রুচির পাঠক এর ই ভালো লাগবে আশা করি ।
হেমকান্তের প্রবাহটা নিঃসন্দেহে ভাল লেগেছে।কিন্তু ধ্রুব রেমির অধ্যায়গুলা এতটাই বিরক্তিকর লেগেছে যে পড়ার সময় মনে হয়েছে তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারলেই বাচি।নায়িকা জান দিয়ে ভালবাসবে আর নায়ক হেয়ালি করে বেড়াবে,পাত্তা দিবেনা এই থিমটুকুর উপর অর্ধেক বই নিয়ে গেছেন লেখক।অনেকটা লুতুপুতু টাইপ উপন্যাস হয়ে গেছে। ত্যানাপ্যাচানী,ত্যানাপ্যাচানী,ত্যানাপ্যাচানী.....
আমার পড়া এখন পর্যন্ত সবচে বিরক্তিকর বই-চরিত্র হচ্ছে ধ্রুব। ধ্রুব-রেমির প্রবাহটা কারো ভাল লাগলে আমি জোর গলায় তাকে বলবো,আপনি ভাই জি বাংলা,জলশা,স্টার প্লাসের সিরিয়াল দেখুন।আপনার ভাল লাগবে।
এই অংশটা এতটাই বিরক্তিকর যে বাকি বইটা যথেষ্ট ভাল লাগলেও শেষ পর্যন্ত বইটাকে অপছন্দের তালিকায় ফেলে দিলাম।
রেমি আর ধ্রুব'র সম্পর্কের দারুণ উঠানামা, তবুও "কেমন জানি" ভালোবাসার কমতি না থাকা। কৃষ্ণকান্ত ও হেমকান্তের সম্পর্ক, আবার ধ্রুব আর কৃষ্ণকান্তের। মোটকথা তিন প্রজন্ম কে ঘিরে এই উপন্যাসের পটভূমি। প্রায় ১২বার এর মতো পড়লাম বোধই, এবং এই বইখানি আরো ১২বার পড়তে কখনোই ধৈর্য হারাবো না, এটুকু নিশ্চিত।
লিখে কী আসলেই সবটা বোঝানো যায়? নাহ... আর সেই অব্যক্ত অনুভূতিটা প্রকাশ করতে না পেরে কেমন ছটফট লাগছে। শেষটা সাদামাটা হয়েও আমাকে এমন ধাক্কা দিল কেন?
সামন্তকাল, ইংরেজ শাসন, রাজনীতি, প্রবহমান বংশধারা এবং মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব নিয়ে 'দূরবীন'.. প্রথম থেকেই ডুবে গিয়েছি। গল্পের ধারাবাহিকতা নাটকীয়তাময়। মনে হচ্ছে, এখনো হয়তো ভেসেই বেড়াচ্ছি, ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। কাজেই কাহিনি-ক্যাঁচাল না করে শুধু চরিত্র নিয়ে বলি।
শুরুতে রঙ্গময়িকে ভালো লাগছিল তার বিচক্ষণতার জন্য। কিন্তু যেই পড়লাম হেমকান্ত বিয়ে করার পর থেকে রঙ্গময়ি কী কী করেছিল, তাতে শ্রদ্ধা একটু কমে গেল বইকি! হেমকান্তের চিন্তাগুলো প্রথমে অহেতুক বোধ হলেও পরে অবশ্য মজা পাচ্ছিলাম– বলা যায়, একটু অন্যভাবে দেখার দৃষ্টিটা উপভোগ্যই ছিল। তারপর ... রেমি। এই চরিত্রটা মোটামুটি বিরক্তিকর ছিল। কারণ, ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা কোনো মেয়ে এমন কীভাবে হয়– যদিও বারবার তার কম বয়সের দোহাই দিয়ে ব্যাপারটা অ্যাডজাস্ট করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে, বিশাখা, শচীন ও চপলা– এই ত্রিভুজকাহিনীও কম উপাদেয় নয়!
উপন্যাসটা মূলত কৃষ্ণকান্ত এবং তার ছেলে ধ্রুবকে নিয়ে। এই দুই চরিত্রের ভেতর ঢুকে গিয়ে তাদের মনো-রহস্য বিচরণেই বুঁদ হয়ে ছিলাম। দ্বিধা নেই– সব ছাড়িয়ে কৃষ্ণকান্তই বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। একপ্রকার তার প্রেমেই পড়ে গিয়েছিলাম।
ঘটনাবলী বলে পড়ার মজা নষ্ট করতে চাই না। আমার মনে হয়েছে, রিডিং ব্লক কাটানোর জন্য এই ধরনের বই-ই ভালো। কেউ চাইলে শুরু করে দেখতে পারেন। 😊
ধ্রুবর চেয়ে জঘন্য কোন ফিকশনাল ক্যারেক্টার বাংলা সাহিত্যে আছে কিনা জানিনা, আর তার ব্যক্তিত্বহীন বউ রেমি; ক্ষমতা, সামাজিক স্ট্যাটাসের প্রতি কারও প্রচণ্ড লোভ না থাকলে "ওকে আমি ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ করে তুলবো" টাইপ প্রেম থাকা সম্ভব না।
হেমকান্তর অংশটা মোটামুটি পড়া যায়, আকর্ষণীয় কিছু না।
ছয়শ পৃষ্ঠার বইয়ের প্রায় দেড়শ পৃষ্টা অনেক বিরক্তি নিয়ে পড়লাম। অনেক ধৈর্য ধরেছি। কয়েকজন পাঠকের রিভিউ দেখলাম কয়েক দফা চেষ্টা করে এই বই শেষ করেছে। আমার অত তেল নাই, বই ভালো না লাগলে ফেলায় দিতে হবে, পৃথিবীতে সময়ের অভাব, পড়ার যোগ্য বইয়ের অভাব নাই।
একটা পরিবারের তিন প্রজন্মের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সামাজিক সাংসারিক জটিলতা, রাজনৈতিক জীবনযাপন, জেনারেশনের টানাপোড়নের প্রেক্ষাপটে রচিত এই দীর্ঘ উপন্যাসটি। শীর্ষেন্দু এই বইতে ভিন্ন ভিন্ন সময়কে যে কৌশলে একসাথে বেঁধে রেখেছেন তা সত্যি প্রশংসনীয়। হেমকান্ত একজন দুর্বল চিত্তের মানুষ, বিপত্নীক। পৃথিবীর ঝঞ্জাট ঝামেলা তিনি পছন্দ করেন না, তার চিন্তা জগতের সাথে পৃথিবীর ঝঞ্জাট এর কোনো সম্পর্ক নেই। কৃষ্ণকান্ত কে দেখা যায় ছোট বেলা থেকেই বিপ্লবী, বুদ্ধিবৃত্তিক, ছোটবেলাতেই কৃষ্ণকান্ত স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হয়, জেলে যায় এবং পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্ত্রীত্ব পদ অর্জন করেন। তার মধ্যে আত্মীয়তা রক্ষা বা রক্তের সম্পর্কের প্রতি একটা দুর্বলতা থাকে। ধ্রুব চরিত্রটা কেমন খাপছাড়া। কিছুটা বিরক্তিকর। ধ্রুব জীবনে অনেক কিছুই করতে চেয়েছে, কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারে নি৷ ধ্রুব শৃঙ্খলা ভাঙতে চায়৷ তার বাবার বিরুদ্ধে কাজ করাই যেন তার লক্ষ্য! তার এই নিরাপদ, ঘটনা হীন জীবন নিয়ে ধ্রুবর মধ্যেও হতাশা কাজ করে। আমি ধ্রুবকে একটা অংশ পরিমাণও বুঝতে পারি নি। কৃষ্ণকান্তকে যখনই একটু বুঝে উঠতে চেষ্টা করছি তখন ই ধ্রুব কিছু একটা করে সেটাকে বিগড়ে দিয়েছে। হেমকান্ত বড় সহজ সরল। হেমকান্ত কে বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি। কৃষ্ণকান্ত কে যতটুকু বুঝে উঠেছিলাম শেষে এসে সব ঘোলাটে করে দিয়েছেন।
হেমকান্ত তার বউ সুনয়নী কে কখনো কষ্ট দেয় নি, আবার খুব বেশি ভালোওবাসে নি, আছে থাক চলছে চলুক এমন৷ কৃষ্ণকান্ত যিনি পরের জন্য প্রাণটা দিতে পারে, বুকে কত সাহস, কত তেজ, তবু নিজের বউয়ের চোখের জল কোনোদিন ঘোচাতে পারে নি। ধ্রুব! সে তো তার স্ত্রী কে পুরোপুরিই অবহেলা করে। অস্বীকার করে! এটা যেন বংশের ধারা, ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে! মনে হচ্ছে এরা তিন প্রজন্ম ধরেই হয়তো পাগল!
উপন্যাসের অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে রেমি, ধ্রুবর স্ত্রী। রেমি চরিত্র টা একটু কেমন। স্বামীর উপেক্ষা, স্বামীর প্রণয়িনীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার, স্বামীর মাতলামো, স্বামীর নীচতা ও হীনতা এতো কিছুর পরেও নিঃস্বার্থ ভাবে স্বামীকে ভালোবাসা! সবটা কেমন রেমিকে একটা ব্যক্তিত্বহীন চরিত্র তৈরি করেছে, রেমি চরিত্র টা বড় অসহায়, বড় দুঃখী! একটু মায়াও তৈরি হয়ে যায়। উপন্যাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হচ্ছে রঙ্গময়ী। এই বইয়ে আমার সবথেকে পছন্দের চরিত্র রঙ্গময়ী। রঙ্গময়ীর মধ্যে কি যেন একটা আছে, সকলকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে নিতে জানেন। দৃঢ়, সচেতন, মমতাময়ী। উপন্যাসে রঙ্গময়ী আর হেমকান্তের মধ্যে একটা সুন্দর পরিণতি দেখতে পাওয়া যায়, যেটা আমার বেশ লেগেছে।
শীর্ষেন্দুর লেখায় ক্ষণিকের জন্য তৈরি করা চরিত্র গুলোও এতো মুগ্ধ করে।।
পুরো বইটা কীভাবে সম্পর্ক গুলো একে অপরের সাথে জড়িয়ে থাকে সেটা নিয়েই। তিন প্রজন্মের জীবনযাপন, চিন্তা চেতনা এবং প্রজন্ম গত দূরত্ব এখানে মুখ্য । এই তিন প্রজন্ম কে আমি বারবার চেষ্টা করেও ঠিক বুঝতে পারি নাই। কিংবা হয়তো বুঝতে চাই ই নি। পুরো বই এ যেন কী একটা সত্য ধরা পড়বে পড়বে করছে। ধ্রুবর ভেতর একটা অনুতাপ একটা অনুশোচনা কিছুই তেমন পেলাম না৷ এই দীর্ঘ বইটি আমার কাছে যথার্থ লাগছে না। মনে হচ্ছে আরও কিছু বাকি রয়ে গেলো। আর একটুও কি আগানো যেত না? এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো কেনো! এতো দীর্ঘ একটা বই তবুও যেন পরিপূর্ণ নয়। এটা কেমন শেষ? এরকম হুট করে শেষ করলেন কেনো লেখক! শেষটা কেমন সব জলঘোলা করে দিলো। আরও একটু বিস্তারিত তো আশা করাই যায় শীর্ষেন্দুর থেকে!
সাধারণ জনজীবনে দূরবীনের কাজ কী? দূরের বস্তুকে কাছে নিয়ে আসা, তাই না? অথচ এই দূরবীনকেই যদি উল্টো করে ধরি, তাহলে কী হবে? কাছের বস্তু মিলিয়ে যাবে দূরে! আমাদের জীবনটাও এক অর্থে দূরবীন। এমন এক ধরণের দূরবীন আমাদের জীবন, যাকে উল্টো করে ধরলে খুঁজে পাওয়া যায় অতীতের হাতছানি। আবার সোজা করে ধরলে হঠাৎ করেই ধাক্কা দেয় বর্তমানের বাস্তবতা! কিন্তু অতীত আর বর্তমানের এই টানাপোড়েনের মধ্যে কাকে বেছে নেবেন আপনি? অতীত নাকি বর্তমান?
তিনটি প্রজন্মের দীর্ঘ কলেবরের কাহিনি - এই নিয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় রচিত বিশাল উপন্যাস, দূরবীন। প্রথম প্রজন্মের কাহিনিতে চিত্রিত হয়েছে জমিদার হেমকান্তের জীবনের জটিল আখ্যান। যে আখ্যান বহু ঘাত-প্রতিঘাতের শেষে এসে পরিপূর্ণতা লাভ করে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী নারী, রঙ্গময়ীর স্পর্শে।
দ্বিতীয় প্রজন্মের কাহিনির মূলে রয়েছে হেমকান্তের পুত্র, কৃষ্ণকান্ত। ছোট্ট কৃষ্ণকান্তের ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা, বেড়ে উঠে রাজনীতির ময়দানে মহীরুহে পরিণত হওয়া - কৃষ্ণকান্তের জীবনের নানা ওঠাপড়ার গল্প প্রাধান্য পেয়েছে দ্বিতীয় প্রজন্মের কাহিনীতে। বাকি রইল তৃতীয় প্রজন্মের কাহিনী।
তৃতীয় তথা শেষ প্রজন্মের কাহিনী গড়ে উঠেছে কৃষ্ণকান্তের পুত্র, ধ্রুবকে কেন্দ্র করে। ধ্রুব আর তার স্ত্রী, রেমির সুখ কিংবা দুঃখের কথা চিত্রিত হয়েছে কাহিনির শেষ আখ্যানে।
দূরবীন একটি বিশাল পরিসরের উপন্যাস। বিভিন্ন ধরণের ছোট ছোট অথচ অর্থবহ ঘটনাকে ডালপালা মেলতে দেখা যায় পুরো কাহিনী জুড়ে। স্বদেশী আন্দোলন আর দেশভাগ থেকে শুরু করে জমিদারী প্রথার নানা তাৎপর্যময় দিক উঠে এসেছে দূরবীনের হাত ধরে। কিন্তু হ্যাঁ, দূরবীনের এত সব জটিল বিষয়াবলীর মাঝে লেখক চিত্রিত করেছেন মানবজীবনের সুখ কিংবা দুঃখের কথা; যার ফলে উপন্যাসের কাহিনির বর্ণনায় যুক্ত হয়েছে একটি নতুন মাত্রা। বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে কাহিনির বর্ণনা।
দূরবীনের বিচিত্র সব কাহিনির গতির ব্যাপারটা অসাধারণ। যেখানে যতটুকু গতি প্রয়োজন, সেখানে ততটুকু টার্ন করেছে কাহিনির বর্ণনা। বর্তমানের প্রতিনিধিত্বকারী, তরুণ প্রজন্মের ধ্রুব আর রেমির কাহিনির গতি স্বাভাবিকভাবেই বেশি হবে - হয়েছেও তাই। দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়া ধ্রুব আর রেমির সুখ-দুঃখের কাহিনি ছিল বেশ উপভোগ্য। অন্যদিকে অতীতের প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যায় হেমকান্ত আর কৃষ্ণকান্তকে...উভয়ের কাহিনিই একটু ধীর গতির, যা উপন্যাসের প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কিন্তু দূরবীন উপন্যাসের সবচেয়ে সুন্দর দিক হচ্ছে, তিনটি ভিন্ন ধারার প্রজন্মকে একটি সুতোয় গেঁথে ফেলা! আর গাঁথুনির এই কঠিন কাজটিকে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে দেখিয়েছেন লেখক - এখানেই মূলত দূরবীনের কালজয়ী হয়ে ওঠার প্রাসঙ্গিকতা।
১১/১১/২০১৯ আপডেট: গতরাতে আবার পড়া শুরু করেছি ১৬/১৭ বছর পরে। টিন এজার পাঠিকা আর বয়সের দিক দিয়ে পরিণত (!) পাঠিকার তুলনামূলক মূল্যায়ন করাটাই আসল উদ্দেশ্য। খুবই বাজে ধরনের রিডার্স ব্লক চলছে, যা জীবনে প্রথম। কয়েকদিন ধরেই এই বইয়ের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিলো বলেই শুরু করলাম পড়া, দেখা যাক কি হয়।
আপডেট ২৬/১১/২০১৯ ২০১৬ সালে ফেসবুকে লিখে রেখেছিলাম নিচের এই কথাগুলো! খুব বেশী বদল কি হবে শব্দ বা বাক্যের আবার পড়া শেষ হলে!? দেখা যাক!
আজ দুইদিন ধরেই মাথায় ঘুরছে কথাগুলো। পরশু অফিসে আসার জন্য রেডি হচ্ছি হঠাৎ আমার বইয়ের স্তুপের ভিতরে থাকা 'দূরবীন'- এর দিকে চোখ গেলো। আমি বইটা পড়েছিলাম ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার আগে। সদ্য তরুণী আমি ভেবেছিলাম বাঁকিদের মতো আমিও ধ্রুবর প্রেমে পড়বো। কারণ এই বই নিয়ে যা শুনেছিলাম তখন পর্যন্ত তা ঐ এক ছেলের নামটাই। কিন্তু বই পড়তে পড়তে আমার অনুভূতি যা এলো তা হলো, এই মহান প্রেমিকের প্রতি সীমাহীন বিরক্তি! মুগ্ধ হলাম কৃষ্ণকান্ত চরিত্রটিতে। বালক কৃষ্ণকান্তকেও বরং ঐ ছেলের চেয়ে পরিণত লেগেছিলো। বাপকে কষ্ট দিতে নিজের বউকে কষ্ট দিতে থাকে যে, আর যাই হোক তার প্রেমে পড়া আমার পক্ষে অন্তত সম্ভব ছিলো না। এখন পড়লে কেমন লাগবে জানি না। তখন যেহেতু ভালো লাগেনি ছেলেটাকে এখন আরোই লাগবে না। তবে বইটা অসাধারণ। প্রথম, তৃতীয় আর দ্বিতীয় প্রজন্মের গল্প এগিয়েছে সমান গতিতে। হেমকান্ত, ধ্রুব আর বইটার প্রাণ কৃষ্ণকান্ত! যদিও তাঁর ছেলেটা আমড়া কাঠের ঢেঁকিই ছিলো।
মানুষের ওপর কোনো বই কতটা প্রভাব রাখে, সেটা বিবেচনায় পাঠকালের বয়সটা অবশ্যই বিচার্য- আবারও বুঝলাম। ক্লাস টেনে প্রথম পাঠে তীব্র ভালো লাগার যে অনুভূতিটা ছিলো, অনেকদিন পরে আবার পড়ে সেই আবেশটা পেলাম না আর। মূলত উপন্যাসটার গঠন প্রক্রিয়া একটু ভেঙে দেখবো বলেই আবার হাতে নিয়েছিলাম, সেইটের অভিনবত্ব অনস্বীকার্য- কিন্তু বাদবাকিটা বড় সাধারণত্ব ফিরিয়ে দিলো।
উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত তিন প্রজন্মকে ঘিরে। প্রথম প্রজন্মের জমিদার হেমকান্ত। অত্যন্ত উদারমনা এবং নরম স্বভাবের একজন মানুষ। তার একটি বাতিক - জগতসংসার সম্পর্কে উদাসীনতা। মধ্যবয়সেই তাকে আঁকড়ে ধরে বার্ধক্যচিন্তা। উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায় হেমকান্তের হাত থেকে জল তোলার বালতি কুয়োতে পড়ে যায় আর তিনি সেটিকে নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু করে দেন। ঘটনাটিকে তিনি নিজের বার্ধক্যের ছাপ এবং আসন্ন মৃত্যুর লক্ষণের একটি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেন।
হেমকান্ত বিপত্নীক, স্ত্রী উপস্থিত থাকতেও তার সাথে গভীর ভালোবাসার টান কখনো গড়ে উঠতে পারে নি। হেমকান্তর দার্শনিক মনোভাব তার মূলে ছিল। এতোকিছুর পরেও বহুকাল ধরে তার আরাধনা করে আসছে বাড়ির পুরোহিতের প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্না দায়িত্বশীলা কন্যা রঙ্গময়ী। রঙ্গময়ীর ভালোবাসা ফুরোয় নি কখনোই। হেমকান্তের টালমাটাল মন, তার রঙ্গময়ী, প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন পুত্র কৃষ্ণকান্তের শৈশবকাল ও প্রাসঙ্গিক পরিবেশ নিয়েই প্রথম প্রজন্মের গল্প।
দ্বিতীয় প্রজন্মে রয়েছে কৃষ্ণকান্ত৷ সৌন্দর্য-সৌষ্ঠবে অনন্য এবং তারচেয়েও বেশি সাহসে টগবগ স্বদেশী আন্দোলনে সোচ্চার ব্যক্তিত্বটি শুরু থেকেই ছিল তার পিতার চেয়ে বহুভাবে আলাদা। দেশভাগের পর তার ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পরিবর্তন যা পরবর্তীতে তার জীবন ও পরবর্তী প্রজন্মকে প্রভাবিত করে নেতিবাচকভাবে।
তৃতীয় প্রজন্মের নায়ক ধ্রুব। বাবার মতোই সুপুরুষ ধ্রুবর জীবনের প্রধান লক্ষ্য তার পিতার সাম্রাজ্য থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকা। পিতাকে সে ঘৃণা করে মনেপ্রাণে, তার সাথে জড়িত সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চায় সে। তার মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব পাহাড়ের মতো অটল। স্ত্রী রেমির সঙ্গেও অদ্ভুত উদাসীনতার সম্পর্ক তার। রেমিকে সে ভালোবাসে না, ঘৃণাও করে না, কখনো উপেক্ষা করে, কখনো কাছে টেনে নেয়। রেমি তাকে ভালোবাসে উন্মাদের মতো। আঘাত-অপমান-উপেক্ষা-তিরস্কার সত্বেও।
তিন প্রজন্মের কাহিনী মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে নিপুণ একটি শিল্পের মতো। সাংসারিক আলোকপাতটির সাথে সাথেও স্বদেশী আন্দোলন, দেশভাগের উত্তাল জীবনযাত্রায় দিনাতিপাতের সময়গুলো ফুটে উঠেছে দক্ষ হাতের ছোঁয়ায়।
পাঠ-প্রতিক্রিয়া - প্রিয় বই নিয়ে আমি খুব বেশি বলে থাকি এবং "খুব বেশিই" বলে থাকি। তাই এতেও বলবো। বইয়ের এক তৃতীয়াংশে থাকতেই কোনো বইকে আমি "প্রিয় বই" ফ্ল্যাগ দিয়ে ফেলেছি এই রেকর্ড বারো বছরে এই প্রথম। শেষ অব্দি আসতে আসতে ভালো লাগাটা গাঢ়তর হয়েছে ক্রমাগত।
পিতার বিরুদ্ধে মারাত্মক ধরণের রিবেলিয়াস, ব্যক্তিজীবনে উদাসীন ধ্রুব চরিত্রটির আকর্ষণ কাটাতে সম্ভবত কয়েক সপ্তাহ সাধনা করা লাগবে। এতো সুন্দরভাবে শীর্ষেন্দু এই চরিত্রটি কিভাবে রূপায়ন করেছেন আমার কল্পনাতেও আসে না। বই তো পড়ছি প্রত্যহ, পড়েই যাচ্ছি পড়েই যাচ্ছি রোবটের মত, কিন্তু লেখায় ভালোবাসা, ডেডিকেশন, শিল্প - খুঁজে পাওয়া যেখানে দুষ্কর সেখানে এমন বই রত্নসম। ধ্রুবর উপরে একই সাথে মাথায় রক্ত উঠে যাবার মতো রাগ আবার কিছু পরেই দুর্নিবার একটা আকর্ষণ যে রোলার কোস্টারে আপনাকে ফেলবে সেটা যেকোনো থ্রিলার ডিটেকটিভ উপন্যাসকেও হার মানিয়ে দেয়। তার উপরে কারো ছায়া যদি দেখতে পান ধ্রুবর মধ্যে, চমকে চমকে উঠবেন আমার মতোই।
রেমি চরিত্রটি আমাকে কল্পনাতীতভাবে ধাক্কা দিয়েছে। একটা বই তখন খুব হৃদয়ে আঘাত হানে যখন সেটা আপনার মনের অবস্থা, আপনার ব্যক্তিগত জীবনের ছায়ার সাথে কিছু মেলে। কেউ কখনো অনেক আবেগে পড়ে কাউকে ভালোবেসে থাকলে রেমির সাথে নিজেকে বেশ মেলাতে পারবেন। সে পবিত্র নারীমূর্তি ❤ তার অনুভূতির কথাগুলো পড়লাম, অনুভব করলাম।
হেমকান্তর বাল্যসুলভ ভাবভঙ্গী, রঙ্গময়ীর তাকে দায়িত্বশীল করে তোলার চেষ্টা, সমাজের বাঁধা কাটিয়ে ভালোবাসাকে স্বীকার করা, হেমকান্তর ছেলেমেয়ের প্রতি রঙ্গময়ীর মাতৃস্নেহ, কৃষ্ণকান্তর উজ্জ্বল বাল্যবেলাটি বেশ লাগছিল!
পরিবর্তিত কৃষ্ণকান্তর ব্যক্তিত্ব বুঝতে সময় লেগে গেলো। পুত্র তার বিপরীতে থাকলেও পুত্রবধূর তার উপর অগাধ বিশ্বাস। ধ্রুব বাবাকে ন্যূনতম সম্মান দিতেও রাজি নয়, কিন্তু রেমিকে কৃষ্ণকান্ত মেনে নিয়েছেন "মা" বলে, রেমিও তাকে শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলে রেখেছে সকলের উপরে। সেটি নিয়েও ধ্রুবর তিরস্কার কম নয়। রেমি-ধ্রুবর খুনসুটিগুলো বড় উপভোগ্য।
রিভিউ লিখতে বসে কখনো এত আটকে আটকে যাই নি। কিভাবে ভালো লাগার উচ্ছ্বাসটা প্রকাশ করবো সেটা বুঝতে পারছি না, যারা পড়েছেন তারা হয়তো বুঝবেন। যারা পড়েন নি, তাদেরকে বলবো কিছু সত্যিকার অসাধারণ মুহূর্ত উপভোগ করতে চাইলে পড়ে ফেলুন।
বই শেষ করে আমার নিজেকেই মনে হচ্ছে পৃথিবীতে নই। অন্যকোথাও আছি। এই বইয়ের সৌন্দর্য অন্য ডাইমেনশনের। আরকিছু বলে রিভিউ-পড়ুয়াদের মাথা খারাপ নাই করি! আমার মাথাটা খাওয়া হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। বইপড়ুয়া সত্বাটার সাথে সাথে আবেগ অনুভূতির গোড়া ধরে নাড়া দিয়ে গেলে পাগল পাগলই লাগে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বইপড়ুয়া প্রায় সকলেরই খুব পছন্দের একটি বই "দূরবীন"। মূলত সেই উৎসাহ থেকেই শুরু করা। বইটা আমার পড়ুয়া জীবনের আরো একটি রেকর্ড ভেঙেছে। সকালে বইটা শুরু করেছিলাম, ৫০৪ পৃষ্ঠার বই সাতঘন্টার মাথায় শেষ করেছি। তাও - অনেক লাইন দু'বার করে পড়া পরও। জীবনে আর ক'টা বই এতোটা মনোযোগ দিয়ে পড়েছি গুণে বলে দেয়া যাবে। আজ বহুদিন পর আক্ষরিক অর্থে নাওয়া-খাওয়া ভুলে কিছু পড়া।
আমার আসন্ন রিডারস ব্লক টের পাচ্ছি। মনের মধ্যে সাইক্লোন চালিয়ে যাওয়া বই পড়লে ঠিক এমনই হয়। আগামী ক'দিন চোখের সামনে পন্থা - হয় একদমই শীর্ষেন্দু নিয়ে পড়ে থাকা, নয়ত বইটা রিপিট করা, নয়ত একদমই কিছু পড়তে না পারা। এরমধ্যে দ্বিতীয় অপশনটিই সবচেয়ে লোভনীয়।
আবারো পড়লে আবারো রিভিউ দেবো। যতোবার পড়বো ততোবারই। এ বই নিয়ে মাইলকে মাইল লেখা যায়।
এই বই সম্পর্কে যা-ই বলব, কম বলা হবে। বইটির ময়নাতদন্ত করার ইচ্ছে বা সামর্থ্য কোনটাই আমার নেই, আর সাহসও করব না। তবে একটা কথা স্পষ্ট করে বলতে পারি, আমাকে খুব অদ্ভুতভাবে নাড়া দিয়েছে এই বই। একজন মানুষ কতরকম হতে পারে এবং তাকে দেখার চোখের ওপর ভিত্তি করে যে আরও কতরকম হতে পারে, এই বইটা না পড়লে বুঝতে পারতাম না। অসাধারণ!
আমার এই পথ পানেই আনন্দ, যদি না পাই শান্তি তবে থাক আনন্দ যাত্রার আনন্দে। আমার এই পায়ে চলা তেই আনন্দ, যদি না পাই গন্তব্য তবে থাক ভ্রমণ,ভ্রমণের আনন্দে।
তিনটি প্রজন্ম - একজন শিকড় নিভৃত আলোয় নত মাথা, আরেকজন শক্ত ডাল যার ছায়ায় সকলে বাঁধা। পরেরজন তো সময়ের বাতাসে উড়ে নিজের মনের সত্যতার খুঁজে। জীবন মূলত সাদা পাতার মতো কোনো মূল্য নেই যতক্ষণ না কালো কালির ছোঁয়া তাতে না লাগছে, আর সেই কালো কালি হচ্ছে আমাদের জীবনের কর্ম।
trigeminal neuralgia যা একটা অসুখ, যেখানে মনে হবে কানের কাছে সবসময় কিছু একটার আওয়াজ হচ্ছে, এর চিকিৎসা হয়, সারানো যায়। বাট হোয়াট এবাউট মন থেকে নিজের অন্তরাত্মা থেকে আসা আওয়াজ। এই আওয়াজে হয় মানুষ অপরাধ বোধের তাপে মরে নয় জ্বলন্ত শিখার মতো উজ্জ্বল প্রতিমা হয়ে জ্বলতে থাকে।
দূরবীন আমাদের কতোটা দূরের জিনিস দেখায়? আকাশের চাঁদ, তারা,সুদুর নক্ষত্র....... আর সেই দূরের অতীত?
এই দূরবীন শুধু অতীত নয় তার সাথে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে থাকা স্মৃতি, কৃতকর্ম, আদর্শকেও প্রদর্শন করে।
এই দূরবীন দিয়ে তৃতীয় প্রজন্মের কাছে বাকি প্রজন্মগুলোর প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে। প্রথম প্রজন্ম হলো হেমকান্ত কে নিয়ে। এই চরিত্র হলো মাথা উচু করে দাড়িয়ে থাকা ফাঁপা একটি গাছের মতো, যা সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে বটে তবুও দমকা হাওয়ায় নিচের দিকে ঝুঁকে পরে।
তবে একদিন এক বালিকার নেত্রের গহ্বরে অমৃত ও নিজের সবলতার দেখা পেয়ে শান্ত ঢেউ হঠাৎ অশান্ত হয়ে ধাক্কা দেয় কিনারার শৈবালে। তখন সরোদের সুরে বাজে হেমকান্তের বেদনা,অতীতের ছায়ায় ভেসে যায় তার মনোজলা।
মুন্ডক উপনিষদে একটা শ্লোক আছে- 'পরিক্ষ্য লোকান নির্বেদমায়াস্তি,তমেব শরনং গচ্ছ'
অর্থাৎ আত্নবিশ্লেষনের মাধ্যমে দুনিয়ার মোহ কাটিয়ে নির্জনতা ও দর্শনের পথে চলে যাওয়া,,যা হেমকান্তের ছোট পুত্র কৃষ্ণকান্ত করেছিলো।
বাড়ির মায়া, পিতার ছায়া,বোনের স্নেহ, বিশাল রাজত্ব ছেড়ে যোগ দেয় অজানা বিপদের আবরণে,,যোগ দেয় স্বদেশীদের দলে।
ঘরকুনো, বিলাসবহুল সুখী জীবন আলোর মতো,তবে কোনো কোনো আলো গভীর অন্ধকারের চেয়েও অন্ধকার সে অন্ধকার আলোর ভিতরেই লুকিয়ে থাকে।হেমকান্ত তা বুঝেছিলেন বিধায় ছেলেকে নিজের মতো গুটিয়ে নেই দেখে খুশির অশ্রুতে ভেসে যায়।
কৃষ্ণ সব ধকল পেরিয়ে একসময় দেশের গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়,হয় আত্মীয়দের ভরসার স্থল। আর সন্তানের সাথে পরিবারের সাথের দূরত্ব সে ঘুচিয়ে উঠতে পারে নি। ধ্রুব অর্থাৎ তার মেঝো ছেলের সাথে তৈরি হয় "freudian conflict"
এটি একটি অভ্যন্তরীন মানুষিক দ্বন্দ্ব, যা মানুষের মনের বিভিন্ন স্তরে বা চাহিদার মধ্যে সংঘাতের ফলে তৈরি হয়।
জড়বস্তু কে ভালোবাসা যায় সহজেই, কারন তারা প্রতিবাদ,প্রতিরোধ, অবিশ্বাস করতে পারে না তবে মানুষ পারে, সবকিছুর পিছনের মানুষ স্বার্থ,কারণ খুঁজতে থাকে।
একটা অতীতের বিস্মৃতি,নিজের অস্তিত্বের সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়া মানুষকে বিরক্ত করে তুলে জীবনের প্রতি, এলোমেলো করে দেয় সব কাজের পিছনের যুক্তিগুলোকেও।
তখন কেউ এসে ধরা দিলে, একজনের সীমাহীন অন্তজগৎ আরেকজনের নির্বাক আকাঙ্ক্ষা কে ছুতে চায়,কিন্তু পৌছায় না।
তবে মনের অজান্তেই ভালোবাসা তৈরি হলে বোধহয় অনেকটা Jazbaa মুভিতে দেখানো ইরফান খানের বলা কথাটার মতো হয়ে- " আব্বে মোহাব্বত হ্যা ইস লিয়ে যানে দিয়া, জিদ হতি তো বাহুমে হতি"
ভালোবাসা অনেক সময় শীবের গলায় ধারন করা গরলের মতো হয়ে ওঠে। বের করাও যায়না আবার নিজের মধ্যেও নেওয়া যায় না। তাই তো ভালোবাসায় মানুষ বলে যদি সম্মতি দাও আমি অষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো,আমি বিষ পান করে মরে যাবো।
উপন্যাসটিতে সাহসিকতার, ভীরুতা, ছন্নছাড়া বৈশিষ্ট্য সহ দেশভাগ,স্বদেশী আন্দোলন, হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা সহ বেশ কয়েকটি জিনিস কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি একটি দীর্ঘ সামাজিক উপন্যাস। এখানে প্রেম,বিরহ,অপেক্ষা, বিপথগামী হওয়া সহ রাজনৈতিক কিছু ব্যাপার তো আছেই। আমার ব্যাক্তিগতভাবে উপন্যাসটি আমার বেশ প্রিয়।সম্পূর্ণ বইটিই পাঠককে ফ্যাসিনেট করার মতো।
হুমায়ুন ফরিদীকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ঘটা আপনার জীবনে স্মরণীয় বিষয় কোনটি- উনি বলেছিলেন,,,, আমার এক বন্ধু ছিলো ইতিহাস নিয়ে পড়তো। তার আমার রুমে শিফট হওয়ার কথা ছিলো কিছু বই ও ট্রান্সফার করেছিলো আমার রুমে,আমি গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি যাই এর আগে সে বলেছিলো আমাই সে কিছু বলতে চায়, আমি ফিরলে বলবে। আর ছুটির মাঝেই আরেক বন্ধু ফোন দিয়ে বলে সে সুইসাইড করেছে, আমার আজও জানা হয়নি সে কি বলতে চেয়েছিল,আর এখনো এই জিনিস আমাই কষ্ট দেয়। দূরবীনের শেষটাও এমন কিছু বিষয় রেখে যায় পাঠকদের জন্য, তবে এটা সুখের নাকি বিষাদের তা নির্ধারণ করাও পাঠকের হাতেই।
এতো এতো প্রশংসা শুনেছি এ বইয়ের বলার মতো না। তাই বোধহয় বেশ চড়া এক্সপেক্টেশন নিয়েই পড়া শুরু করি। বহুবার শুরু করলেও কেন জানি প্রথম পঞ্চাশ পেজের বেশি এগোতে পারিনি। এবার এক ধাক্কায় তিন দিনে শেষ করেই ফেললাম।
এই দুটো রেটিং শুধুমাত্র হেমকান্তের অংশটুকুর সম্মানে। ছয়শ চৌদ্দ পেজ ধরে যতো ঘটনা, ইতিহাস কিংবা দর্শন ব্যাখ্যা করা যেতো, তার সিকিভাগও করা হয়নি। একই ঘটনা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চলছেই। "ধ্রুব" নামের এক বিরক্তিকর চরিত্র আর তার চেয়েও তিন কাঠি ওপরে বিরক্তিকর, আত্মসম্মানহীন তার সিম্প ও স্ত্রী রেমি এর বাংলা সিরিয়ালের মতো ফ্ল্যাকচুয়েটেড সস্তা ত্যানাপ্যাচানি মাথা ধরিয়ে দিচ্ছিলো। স্বামীকে রেমি যতবার "আমায় ভালোবাসো না কেন?" বলে গিরগিরিয়ে কেঁদেছে তার বদলে স্বদেশী আন্দোলনকে আরো বিস্তরভাবে ব্যাখ্যা করা যেতো, কৃষ্ণকান্তের প্রতি ধ্রুবর ক্রোধটা আরো জাস্টিফায়েড করার জায়গা পাওয়া যেতো, কৃষ্ণকান্তের স্ত্রী এর আত্মহত্যাকে ভাঙা যেতো, মনু এর সাথে স্বদেশীকে কানেক্ট করার একটা ভালো প্ল্যাটফর্ম করা যেতো-- আরো কতো কি। খুবই DISAPPOINTED!
দূরবীন: সন্তানেরা, পিতারা, ও অনুপস্থিত মায়ের ছায়া
আত্মার ইতিহাস: একটি উপন্যাস, একটি আয়না:
I am neither the mind, nor the intellect, nor the ego, nor the mind-stuff; I am neither the body, nor the changes of the body; I am neither the senses of hearing, taste, smell, or sight, Nor am I the ether, the earth, the fire, the air; I am Existence Absolute, Knowledge Absolute, Bliss Absolute —
"আমি শরীর নই, আমি একটা আত্মা—এই আত্মার ইতিহাস কোথায়?"
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের দূরবীন এই প্রশ্নের গভীর আর্তিতে শুরু হয়, আর শেষ হয় এক ধ্রুব অস্তিত্বসন্ধানে। আমি যখন উপন্যাসটি পড়ি, তখন বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। কলকাতার এক পুরোনো দুপুরে, চায়ের কাপ হাতে আমি দেখি—এই উপন্যাস ঠিক আমার মতোই পথ খুঁজছে, অতীতের প্রতিচ্ছবির মধ্যে বর্তমানে নিজেকে খুঁজে নিতে।
তিন প্রজন্ম—হেমকান্ত, কৃষ্ণকান্ত ও ধ্রুব—তিনটি আলাদা মেরুতে দাঁড়িয়ে, তবুও যেন একটি অভিন্ন বিন্দুর দিকে এগিয়ে চলেছে। সেই বিন্দু—‘নিজেকে’ জানা।
হেমকান্ত: মায়ার মাপজোক
প্রথম প্রজন্মের হেমকান্ত, যেন এক পদত্যাগী জমিদার, যিনি “পিতা” চরিত্রটির ভেতরে কেবলই শূন্যতা ও ক্লান্তির স্তর জমা করে গেছেন। তাঁর স্ত্রীবিয়োগ, তাঁর মৃত্যু-চিন্তা, রঙ্গময়ীর সঙ্গে তার সম্পর্ক—সব কিছু যেন এক রকম “afterlife before death”-এর আভাস। হেমকান্ত যেন সেই মানুষ, যিনি জীবনকে কেবলই বাইরে থেকে দেখেন, কিন্তু কখনো ছুঁতে চান না।
রঙ্গময়ীকে নিয়ে সমাজ বলতে পারে “পরকীয়া”, কিন্তু শীর্ষেন্দুর ভাষায় এই সম্পর্ক আত্মার ঐক্য, শরীরের নয়। হেমকান্ত যেন Albert Camus-র The Fall-এর সেই Jean-Baptiste Clamence-এর মতো—যিনি নিজের বিচারক নিজেই।
কৃষ্ণকান্ত: ত্যাগের অন্তর্গত নিষ্ঠুরতা
দ্বিতীয় প্রজন্মের কৃষ্ণকান্ত। মুখে দেশের কথা, অন্তরে নিষ্ঠার আগুন, কিন্তু পিতৃত্বে এক চূড়ান্ত ব্যর্থতা। Nietzsche-এর Übermensch হতে চেয়েছিলেন তিনি—পিতার দুর্বলতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি হয়ে উ��লেন অনমনীয় নীতির প্রতিমা। তিনি এমন একজন যিনি বলতেই পারেন:
“One must still have chaos in oneself to give birth to a dancing star.” —Nietzsche
কিন্তু সেই ‘dancing star’ হয়ে ওঠেনি ধ্রুব। তার চোখে কৃষ্ণকান্ত নিছক এক ছায়ামূর্তি, যে আছে, কিন্তু আদর দিতে জানে না। ধ্রুবর চোখে তিনি যেন Dostoevsky-র Fyodor Karamazov—উপস্থিত, কিন্তু অপমানজনকভাবে অনুপস্থিত।
ধ্রুব: এক দ্রোহী পুত্র, এক অস্থির আত্মা
তৃতীয় প্রজন্মের ধ্রুব হলেন এই উপন্যাসের Stephen Dedalus, Ivan Karamazov এবং Kafka-র Letter to His Father-এর হালকা সমান্তরাল এক চরিত্র।
Stephen যেমন ঘোষণা করে: “I will not serve that in which I no longer believe,” —Joyce, A Portrait of the Artist as a Young Man
তেমনই ধ্রুব, নিজের বাবার আদর্শ, আদর, অভিমান—কোনোকিছুতেই বিশ্বাস রাখতে পারে না। কিন্তু ধ্রুবর বিদ্রোহটা কখনও একরৈখিক নয়। তিনি কখনো ঘৃণা করেন, কখনো প্রেমে পড়েন, কখনো নিজেকে নিয়ে তীব্র দ্বন্দ্বে জর্জরিত হন। তিনি কখনো Sartre-এর existentialism-এর ছায়ায় দাঁড়িয়ে বলেন:
“Man is nothing else but what he makes of himself.” —Sartre
আসলে ধ্রুব তার বাবাকে ঘৃণা করে, কারণ সে ভালোবাসে। মায়ের অভাব, বাবার শুষ্কতা, নিজের মধ্যে জমে ওঠা মৌন রাগ—এসবেরই একটি কাফকাসম পরিণতি।
অনুপস্থিত মায়েরা, এবং যাঁরা মায়ের ছায়া হয়ে ওঠেন
এই উপন্যাসে একদম কেন্দ্রীয় থিম: অনুপস্থিত মায়ের ছায়া। রেমি, রঙ্গময়ী, নলিনী—এরা শুধু প্রেমিকা, স্ত্রী বা মাতা নন। এরা ওই স্নেহের উৎস, যা হেমকান্ত বা কৃষ্ণকান্ত দিতে পারেননি।
Kafka বাবাকে লেখে: "You were for me the measure of all things." —Kafka, Letter to His Father
এই অনুভূতি ধ্রুবর মধ্যেও বিদ্যমান, কিন্তু তার ‘measure’ মানসিকভাবে ছিল রঙ্গময়ী বা রেমি—পিতার অনুপস্থিতির বিকল্প।
অতীত ও বর্তমানের দ্বিস্তরীয় বিন্যাস
শীর্ষেন্দুর লেখার সবচেয়ে বড় শক্তি, অতীত ও বর্তমানের সেই ‘দূরবীন’-দৃষ্টি। “শুধু দূরের জিনিসই নয়, উল্টে ধরলে কাছের জিনিসকেও দূরে দেখায়”—এই দৃষ্টিভঙ্গি উপন্যাসের কাঠামোতেই বাসা বেঁধেছে।
একদিকে হেমকান্ত—যার কাছে দূরবীন মানে স্মৃতি, অন্যদিকে ধ্রুব—যার কাছে দূরবীন মানে নিষ্ঠুর নির্মোহতা।
আমি, পিতা, এবং এক অনুচ্চারিত ক্ষোভ
এই উপন্যাস পড়ে আমার নিজের বাবার সঙ্গে দূরত্বের কথা মনে পড়ে যায়। এমন নয় যে ভালোবাসা ছিল না, ছিল না কথা। কিন্তু ছিল এক ধরণের “unsaid sorrow”—একটি মৌন শূন্যতা, যা ভাষায় আসে না। দূরবীন পড়ে যেন সেই দূরত্বকে দেখা গেল। আমি ধ্রুবর মতো আমার বাবার মুখে রাগ জমিয়ে রেখেছিলাম, অথচ এখন বুঝি, আমার বাবাও ছিল কৃষ্ণকান্ত—যে নিজের পথ খুঁজতে গিয়ে একলা হয়ে গিয়েছিল।
শেষের ধ্বনি: আত্মার দিকে ফেরা
দূরবীন শুধু আমাদের দূরের জিনিস দেখায় না, বরং আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে নতুন চোখ দেয়। পিতা-পুত্র সম্পর্ক, মাতৃত্বের অভাব, রাজনৈতিক আদর্শ বনাম ব্যক্তিগত সংকট—সব মিলিয়ে দূরবীন এক বাংলা উপন্যাসিক ক্যাননের অন্তর্গত মাইলফলক।
“মানুষ যত বড় হয়, তত একা হয়।” —একটি নিরবিচারে সত্যবাক্য
শীর্ষেন্দুর এই উপন্যাস সেই একাকীত্বকে শুধুই ভাষা দেয় না, তাকে একটি অন্তরাত্মার পোর্ট্রেট বানিয়ে তোলে।
বই শেষ করলাম,আর কেমন যেনো দিশাহারা হয়ে আশেপাশে তাকাতে লাগলাম। বেশ কিছু মুহূর্তের জন্য মাথাটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে রইল। এভাবেও মানুষ লেখতে পারে! ! ! গল্প বলার কী আশ্চর্যরকম সুন্দর ভঙ্গি! অসাধারন!
অবশেষে শেষ হলো ১২ দিনের এক পাঠযাত্রা। এই ১২ দিনে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ পৃষ্ঠা করে পড়েছি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা এই বৃহৎ সাইজের উপাখ্যান। তবে পড়তে নেওয়ার আগে যে উদ্দীপনা ছিলো, শুরু থেকেই সেই উদ্দীপনায় কিছুটা ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। কাহিনির সাথে নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না, বারবার মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলো, তবুও যেহেতু এটি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা তাই বোধহয় বইটি পড়ে শেষ করতে পেরেছি। তবে এটা বলতে হয়, এর আগে শীর্ষেন্দু স্যারের যত বই পড়েছি, তার ভিতর এই কাহিনিটাই একটু স্লো মনে হয়েছে। কাহিনি এত বৃহৎ না করে আরো আগেই শেষ করে দিতে পারতেন।
বিংশ শতাব্দীর দুইয়ের দশকের শেষ ভাগ থেকে শুরু করে আটের দশক পর্যন্ত বিস্তৃত সময়ের প্ৰেক্ষাপটে সামাজিক জীবনের যাবতীয় পরিবর্তনকে এক আশ্চর্য কৌতুহলকর বিশাল কাহিনীর মধ্য দিয়ে ধরে রাখার প্রয়াসেরই অভিনন্দিত ফলশ্রুতি এই ‘দূরবীন উপন্যাস। তিন প্রজন্মের এই কাহিনীতে প্রথম প্রজন্ম হলো জমিদার হেমকান্ত। এ-উপন্যাসের সূচনায় দেখা যায়, ১৯২৯ সালের এক প্রত্যুষে হেমকান্তের হাত থেকে কুয়োর বালতি জলে পড়ে গেছে, আর এই আপাততুচ্ছ ঘটনায় হেমকান্ত আক্রান্ত হচ্ছেন মৃত্যুচিন্তায়। মনে করছেন তার বুঝি বার্ধক্য এসে গেছে। হেমকান্ত অতিশয় কল্পনাপ্রবণ ও বাস্তববুদ্ধি বর্জিত একজন চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছেন। কিশোরী রঙ্গময়ী হেমকান্তর উপর খবরদাড়ি করে,তার ঘরে ভোর বেলায় উকি দেয়, আর হেমকান্তও তা মেনে নেয় কেমন ব্যাক্তিত্বহীনের মত। যাইহোক, বিপত্নীক হেমকান্ত ও রঙ্গময়ী নামের প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক পুরোহিত্যকন্যার গোপন প্রণয়কাহিনী ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য পারিবারিক কাহিনী নিয়ে এ-উপন্যাসের প্রথম পর্যায় রচিত। দ্বিতীয় প্রজন্মের নায়ক কৃষ্ণকান্ত। যদিও তার শৈশব এবং কৈশোর শেষে সদ্য যৌবনের পা রাখার কাহিনি প্রথম পর্যায়ের সাথেই রচিত।দেবোপম রূপ ও কঠোর চরিত্রবল বালক কৃষ্ণকান্তকে দাঁড় করিয়েছে পিতা হেমকাস্তের বিপরীত মেরুতে। স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ কৃষ্ণকাস্তের ব্ৰহ্মচর্য-গ্রহণ ও দেশভাগের পর তাঁর আমূল পরিবর্তন-এই নিয়ে এ-উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্য়ায়ের কাহিনী।
তৃতীয় ও শেষ প্রজন্মের নায়ক ধ্রুব, বিশ শতকের উপান্তপর্বে এক দিগভ্ৰষ্ট, উদ্ধত বিদ্রোহী যুবা। ধ্রুবর স্ত্রী রেমি, যার সঙ্গে এক অদ্ভুত সম্পর্ক তার। কখনও ভালবাসা, কখনও উপেক্ষা, কখনও-বা প্রবল বিরাগ। অথচ রেমির ভালোবাসা শাত-আঘাতেও অবিচল। মুলত দুইটি পর্যায়ে এ কাহিনি রচিত হয়েছে। এক পুরুষের ব্যবধানে হেমকান্ত আর ধ্রুবর কাহিনি সমান্তরাল ভাবে এগিয়ে গেছে। দুই পর্যায়ের দুই প্রধান চরিত্র হেমকান্ত আর ধ্রুব। আর এই দুই পর্বেই অন্যতম প্রধান অথচ সহযোগী চরিত্র হিসেবে কৃষ্ণকান্তকে দেখতে পাই। ধ্রুবর কাহিনি শুরু হয় রেমির বাচ্চা হওয়ার সময় থেকে,তারপর কাহিনি ফ্ল্যাশব্যাক করে ধারবাহিক ভাবে চলতে থাকে। এই ফ্ল্যাশব্যাকের পর্যায় থেকে বর্তমান সময়ে আসা পর্যন্ত বর্তমান সময়ে আসার পার্টটুকুই আমার সব থেকে বিরক্ত লেগেছে। রেমি প্রানপণ দিয়ে ধ্রুবকে ভালবসে আর ধ্রুব তাকে সবসময় উপেক্ষা করতে চায়, অন্য পুরুষদের কাছে রেমিকে যেতে বলে। বইয়ের ২২ নাম্বার চাপ্টারে এসে আমার ধ্রুবর প্রতি সত্যিই মেজাজ গরম হয়ে যায়, কেন যেনে শুনে সে রেমির বাচ্চাটাকে নষ্ট করলো। আমার পড়া বাংলা সাহিত্যের সবথেকে ফালতু ক্যারেক্টর এই ধ্রুব। সজ্ঞানে মানুষ কখনো এত বাস্তববর্জিত হতে পারেনা। যাই হোক রেমি ধ্রুবর এই অবাস্তব বাংলা সিরিয়ালের থিমের উপরই প্রায় অর্ধেক কাহিনি লিখে গেছেন লেখক। ধ্রুবর এত উপেক্ষার পড়েও রেমি সংসারে টিকে থাকে একমাত্র তার শ্বশুর কৃষ্ণকান্তর অত্যাধিক স্নেহের কারনে। রেমির প্রতি কৃষ্ণকান্তর স্নেহ সত্যিই ছিলো,তাতে কোন খাদ ছিলো না।
ধ্রুবর দাদু হেমকান্ত। শেষ বয়সের হেমকান্তর কিছু দার্শনিক চিন্তা ধ্রুবর ভিতরও দেখতে পাই। "কেবল মনে হয় যথেষ্ঠ বেশিদিন বেঁচে আছি,এবার বিদায় নেওয়ার পালা"- এই এক জায়গাতে ধ্রুব আর হেমকান্তর মনে একই সুরের দেখা মিলে। আবার কৃষ্ণকান্ত আত্মহুতি দিয়ে এই ভাবনারই যেন প্রতিফলন ঘটায়। বইয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তার নিজস্ব ধর্মীয় দর্শন হেমকান্তের ভাষ্যে বর্ণনা করেছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ছিলেন অনুকুল ঠাকুরের মন্ত্র শীষ্য, সেই ঠাকুরের কথাও বারবার উঠে এসেছে এই বইতে।
শুধু দূরকেই কাছে আনে না, উল্টো করে ধরলে কাছের জিনিসও দূরে দেখায় দূরবীন। ‘দূরবীন’ উপন্যাসের নামকরণে যেমন সূক্ষ্মতা, রচনারীতিতেও তেমনই অভিনবত্ব এনেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। একবার অতীতের কাহিনি পড়ছি তো পর মুহুর্তেই বর্তমান সময়, যেন অনেকটা দূরবীনের মতোই, দ্বিস্তর এই উপন্যাসে স��কাল ও একাল, অতীত ও বর্তমান এক অনন্য কৌশলে একাকার। আমি বইটি পড়ার জন্য কাউকে রেকোমেন্ড করবো না, কারন আমার আশানুরূপ ভালো লাগেনি।
একটি পরিবারের তিন পুরুষের জীবনে নিয়ে যে ৬০০ পৃষ্ঠার বই লেখা যায় সেটাই এক আশ্চর্যের বিষয় মনে হয়েছে আমার কাছে। এক অধ্যায় অন্তর অন্তর হেমকান্ত আর তার পুত্র কৃষ্ণকান্ত + পৌত্র ধ্রুব এর কাহিনী খুব একটা যে সুখপাঠ্য মনে হয়েছে তা বলা যায় না তবে কিছু কিছু ঘটনা ভাল লেগেছে যেমন বিশাখা-শচীন-চপলার ত্রিভূজ প্রেম, রঙ্গময়ীর 'রঙ্গ', কৃষ্ণকান্তের জীবনের উত্থান-পতন ইত্যাদি। ধ্রুব চরিত্র কে এক ক্ষমতাশীল মন্ত্রীর মানসিক ভাবে অস্থিতিশীল পুত্র ছাড়া কিছু মনে হয়নি। বিপ্লবের নামে যেসব ফিলোসোফির কথা সে বলে বেড়ায় তা 'ভূতের মুখে রাম নাম' ছাড়া কিছু মনে হয়নি। সবকিছু মিলিয়ে হেমকান্ত চৌধুরীর জীবন কাহিনীটুকুই মোটামুটি উপভোগ্য ছিলো। ডাম্প না করলেও জীবনে একবারই পড়া যায় এমন বই। রিপিট করার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়।
তিন পুরুষের অনন্যসাধারণ এক উপন্যাস - যার প্রতিটি পাতায় ছড়িয়ে আছে তৎকালীন ও বর্তমান সমাজ বাবস্থার খণ্ড খণ্ড ছবি; আছে পারিবারিক নানা সুখ-দুঃখ, কোলাহল-কলহল, প্রেম-বৈরাগ্য এর কাহিনী; আছে স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী বাঙালীর সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন, চিন্তা-চেতনা; আছে গভীরভাবে অঙ্কিত ইহলৌকিক ও পারলৌকিক, সাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-বিধি ও মূল্যবোধের সংঘর্ষ।
হেমকান্ত < কৃষ্ণকান্ত > ধ্রুব(কান্ত)
তিন পুরুষের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম বাক্তিত্তের অধিকারী 'কৃষ্ণকান্ত'- তিনি হেমকান্ত বা ধ্রুব এর মত অলস চিন্তা-চেতনার চাইতে শরীর-মন-আত্মা সর্বস্ব কাজে বিশ্বাসী। উপন্যাসের উভয় পর্যায়ে পরিবারের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা ও চিন্তাধারা - অসাধারণ। হেমকান্ত, একজন দুর্বল আত্মার হীরক মনের মানুষ। রঙ্গময়ি এর মত চমৎকার ব্যাক্তিত্ত পড়ে সত্যি মুগ্ধ। প্রথম পর্যায়ের বাকি বিশেষ চরিত্র যেমন বিশাখা ও শচীন এবং তাদের happy ending সেইসাথে হেমকান্ত ও রঙ্গময়ির মধ্যকার রসায়ন ভালো লেগেছে :) ধ্রুব, ... নাহ, আরও জানতে ইচ্ছা করছিল :( .. ধ্রুব রেমিকে নিজের সঙ্গিনী হিসেবে পরবর্তীতে মেনে নেয় কিনা,রেমিকে confession দিলেও তার সাথে রেমির সেই আত্মার সম্পর্ক কি সত্যি হয়? ফিরে পায় বেঁচে থাকার আনুপ্রেরনা? পিতার শিকল থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেকে নিয়োজিত করে তার স্বপ্নের নানা কাজে?
অনেকদিন পর একটা উপন্যাস পড়লাম যা ছোটগল্পের মতই আমার তেষ্টাটা জাগিয়ে রেখেছে ..... ধন্যবাদ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় :)
My both elder sisters recommended this book ages ago but for some weird reason, i could not cross a certain hurdle which would be page 40-45. Few days ago I retook it and take an oath that this time I am gonna finish it, no matter what happens. few minutes ago I finished it. Immediate reaction would be, "Why the heck I didn't read it long before?" what i was thniking before? I am allergic to fat books but I guess this book gave me the thrill to read more fat books in future. About this book, the way the writer portrait the 3 generations, 3 time lines story which gives you the chill to understand, "no matter in which age or time you are born, the only thing mattered and matters is 'how you take everything around you'. Hemakanto was from English period but he possess a liberal mind, same goes for Dhrobho, he is new gen kid with liberal mind except Krishnokanto, he is bit fundamentalist but than again, all of them posses something which kind of shows they are from the same root.
১৯২৯ সালের শীতকালের এক ভোরে হেমকান্ত চৌধুরির হাত থেকে দড়ি সমেত কুয়োর বালতি জলে পড়ে গেল। ... নেশা ধরে গিয়েছিল প্রথম লাইন থেকেই। মধ্যবয়সী বিপত্নীক আত্মভোলা জমিদার হেমকান্ত চৌধুরির হাত থেকে কুয়োর বালতি পড়ে যাওয়া এবং তা থেকে উদ্ভূত মৃত্যুচিন্তার মধ্য দিয়েই প্রথম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি। ভারতবর্ষের ক্ষয়িষ্ণু জমিদারীর প্রথার আবছা আভাসও পাওয়া গেল এখানে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুতেই চমক! ১৯২৯ সালের অবিভক্ত ভারতবর্ষ থেকে এক লাফে গল্প চলে এসেছে আশির দশকের আধুনিক কলকাতায়! মহানগরীতে গভীর রাত্রে রাস্তায় মাতলামী করতে থাকা এক বোহেমিয়ান (সুপুরুষ এবং একই সাথে খানিকটা মাথামোটাও বটে) যুবক ধ্রুবর গল্প এবার। পুলিশের গাড়ি মাতাল ধ্রুবর পিছু পিছু আসছে কিন্তু তাঁকে স্পর্শ করার স্পর্ধা তাঁদের নেই। কারণ তার বাবা দেশের প্রভাবশালী ক্যাবিনেট মন্ত্রী। যে বাবাকে ধ্রুব মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। ওদিকে ধ্রুবর অন্তঃসত্তা স্ত্রী রেমি শহরের সবচেয়ে আধুনিক হসপিটালের মৃত্যুশয্যায় কাতরাচ্ছে। পরের অধ্যায়ে গল্প আবার ফিরে আসে তিরিশের দশকের অবিভক্ত ভারতবর্ষে। জমিদার হেমকান্ত এবং তার কনিষ্ঠপুত্র কৃষ্ণকান্তের গল্প এটা। রঙ্গময়ীরও। স্ত্রী সুনয়নীর মৃত্যুর পর সংসারবিরাগী জমিদারের সন্তানেরা বিবাহ কিংবা জীবিকার তাগিদে দূরে থাকে, কাছে থাকে শুধু ছোট দুই সন্তান, বিশাখা আর কৃষ্ণকান্ত। সংসারের প্রতি বেখেয়ালী হেমকান্তের সংসার আগলে রেখেছেন রঙ্গময়ী, সময়ের চেয়ে মানসিকতায় অনেক এগিয়ে থাকা এক পুরোহিত কন্যা। যার সাথে বিপত্নীক হেমকান্তের সম্পর্কটা রহস্যময় কুয়াশার চাদরে ঢাকা। গল্প এগোতে থাকে, কুয়াশার চাদরও কিছুটা হালকা হতে থাকে, তবে পুরোপুরি স্পষ্ট হয়না কখনোই। সংসারের প্রতি বিবাগী হলেও কনিষ্ঠ পুত্র, পনেরো বছর বয়সী কৃষ্ণকান্তের প্রতি পিতা হেমকান্তর ভালবাসা সীমাহীন। যদিও সেই ভালবাসা তিনি গোপনই রাখেন বেশির ভাগ সময়। বালক কৃষ্ণকান্তের চোখেও বাবা হেমকান্ত এক মহাপুরুষ, বাবা সাথে কাটানো অতি অল্প কিছু সময় কাটানও তার জন্য অতি আনন্দের ব্যাপার! গল্প এগিয়ে চলে, ক্ষয়িষ্ণু জমিদারী আরও ক্ষয়ে যেতে থাকে। বালিকা বিশাখার বিয়ে নিয়ে নানা রকম ঘটনা ঘটতে থাকে। এর মাঝেই দেশে লাগে স্বদেশী আন্দোলনের হাওয়া! হেমকান্তের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া স্বদেশী আন্দোলনের ফেরারি শশীভূষন কতৃক প্রভাবিত হয়ে স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে পরে কৃষ্ণকান্ত। এক পর্যায়ে হত্যাকান্ডে জড়িয়ে পড়ে বাড়ি থেকে পালায় কৃষ্ণকান্ত। প্রিয় পুত্রের অন্তর্ধানে একেবারে ভেঙ্গে পড়েন হেমকান্ত। জমিদারী ছেড়েছুঁড়ে চলে যান তীর্থস্থান কাশীতে, দিবারাত্র শুধু প্রার্থনা করতে থাকেন প্রিয় পুত্রকে আরেকবার দেখতে পাওয়ার আশায়। কিন্তু আর দেখা কি হয়েছিল পিতাপুত্রতে? এদিকে কী ঘটছে আশি আশির দশকের কলকাতায়? দেশের অতি প্রভাবশালী এবং সম্মানিত ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পুত্র হয়েও ধুরব কেন প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে বাবার সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার? কেনই বা চেষ্টা করছে যাতে তার বাবা আসন্ন নির্বাচনে হেরে যান সেটা নিশ্চিত করতে? যে ধ্রুব মৃতা মায়ের প্রতি সীমাহীন আবেগ বুকে ধারন করে, সেই একই ধ্রুব কেন ঘৃনার আগুনে জ্বালিয়ে দিতে চায় বাবার সাম্রাজ্য? তার বাবা কৃষ্ণকান্তের সাম্রাজ্য! হ্যাঁ, হেমকান্তের অতি আদরের কনিষ্ঠ পুত্র কৃষ্ণকান্ত, স্বদেশী আন্দোলনে গৌরবময় ভূমিকা ��াখা কৃষ্ণকান্ত, কেন্দ্রীয় সরকারের অতি প্রভাবশালী ক্যাবিনেট মন্ত্রী কৃষ্ণকান্ত। যে কৃষ্ণকান্ত একই রকম অন্ধের মত ভালবাসে পুত্র ধ্রুবকে, ঠিক যেরকম তাঁকে ভালবাসত তার বাবা হেমকান্ত! গল্প এগিয়ে চলে তরতর করে। ধ্রুবকে বোহেমিয়ান জীবন থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য বিয়ে করানো হয়েছিল রেমি নামের মমতাময়ী (এবং রুপবতীও) এক তরুনীর সাথে। কিন্তু তাতে ফল যেন হয় উল্টো! বাবাকে আঘাত করার জন্য ধ্রুব পেয়ে যায় আরেক অস্ত্র। কৃষ্ণকান্তের চোখের মনি পুত্রবধু রেমি অবহেলা-অনাদরে সে ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে। সীমাহীন ভালবাসা দিয়ে রেমী যতই বশ করতে চায়, ততই যেন দূরে সরে যায় ধ্রুব। গল্প এগিয়ে চলে আপনগতিতে! গল্প আবার চলে আসে হেমকান্তের সময়ে... আবার ধ্রুবর সময়ে....। এভাবেই চলে উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হল্প? হেমকান্তের? রঙ্গময়ীর? কৃষ্ণকান্তের? ধ্রুবর? রেমির? এক অধ্যায়ে প্রথম প্রজন্ম (হেমকান্ত) আর পরের অধ্যায়ে তৃতীয় প্রজন্ম, (ধ্রুব) -এভাবেই এগিয়েছে অসাধারণ এই উপন্যাসটি। আর দুই প্রজন্মের মাঝখানে সেতু হিসেবে কাজ করে গেছেন দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি কৃষ্ণকান্ত। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার এই সুবৃহৎ উপন্যাসে অবধারিতভাবেই উঠে এসেছে ইংরেজ শাসন, স্বদেশী আন্দোলন, দেশভাগ সহ নানা প্রাসঙ্গিক বিষয়। ক্লাস নাইনে থাকতে প্রথম পড়েছিলাম দূরবীন, মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেই মুগ্ধতার রেশ এখনও রয়ে গেছে। কাহিনীর পাশাপাশি উপন্যাসের অভিনব গঠনশৈলিও চমকে দিয়েছিল। কারণ থ্রিলারধর্মী উপন্যাসে দুই অধ্যায়ে দুইটা টাইমলাইন ধরে চলা গল্পের সাথে পরিচয় থাকলেও, সামাজিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটাই ছিল প্রথম অভিজ্ঞতা। অবিভক্ত ভারতবর্ষের পটভূমিতে লেখা যে কোন উপন্যাসই আমার অতি পছন্দের। আর সেই ভাললাগা শুরু হয়েছিল শীর্ষেন্দুর দূরবীন থেকেই।
বিশের দশকের শেষ দিকে কোনো এক শীতের ভোরে হেমকান্তের হাত থেকে কুয়োর বালতি পড়ে যাওয়ার মত তুচ্ছ ঘটনার মাধ্যমে শুরু হয় 'দূরবীন' উপন্যাসটি। তুচ্ছ ঘটনা হলেও মধ্যবয়স্ক হেমকান্তকে এই ঘটনায় মৃত্যুচিন্তা পেয়ে বসে। এরপর তিন পুরুষ ধরে এগিয়েছে উপন্যাসটি। হেমকান্ত সংসারের প্রতি অনেকাংশেই উদাসীন। তার চিন্তাভাবনায় দার্শনিকতার ছাপ রয়েছে। যখন বিবাহিত ছিলেন, তখন কেন জানি স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার টান গড়ে উঠেনি। এর বদলে গোপন প্রণয় গড়ে উঠে বাড়ি আশ্রিত পুরোহিতকন্যা রঙ্গময়ীর সাথে। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে সেই প্রণয় বেড়েছে বৈ কমেনি।
তারই ছেলে কৃষ্ণকান্ত, কিন্তু পিতার সাথে ছেলের মিলের চাইতে অমিলের পাল্লাই ভারি। তবুও ছেলের মানসপটে পিতা উচ্চাসনে আসীন। ছোটবেলা থেকেই অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং সাহসের দিক দিয়েও অনন্য। জড়িয়ে পড়েন স্বদেশীদের সাথে, এবং রাজনীতিতেও। যদিও তার এই ঝোঁকের জন্য তার মানুপিসি অর্থাৎ রঙ্গময়ী প্রচ্ছন্নভাবে দায়ী। কৃষ্ণকান্ত ছিলেন অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনকারী। উপন্যাসে কৃষ্ণকান্তের ছোটোবেলা এবং বড়োবেলার যে চিত্র ফুটে উঠেছে তাতে বৈসাদৃশ্য চোখে পড়ার মত। দেশবিভাগের আগে এবং পরে একই মানুষের দুরকম চিত্র মনকে নাড়া দেয়। অবশ্য কৃষকান্তকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে তারই ছেলে ধ্রুব কোনো ত্রুটিই রাখেনি!
ধ্রুব এই উপন্যাসের তৃতীয় পুরুষের প্রতিনিধি। ধ্রুবর সাথেও ধ্রুবর পিতার বড়ো রকমের অমিল বিদ্যমান। যেখানে কৃষ্ণকান্তের চোখে তার পিতা দেবতুল্য ছিলেন সেখানে ধ্রুব নিজের পিতাকে দু চক্ষেই দেখতে পারে না। খুব বেপরোয়া জীবন তার। নিজের পিতাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখতে এমন কিছু বাকি নেই যা সে করেনি। কিন্তু এত কিছুর পরেও পিতার প্রভাব ছিন্ন করতে পারেনি সে। পারেনি নিজের কোনো আলাদা পরিচয় তৈরি করতে। বরং পিতার প্রভাব প্রতিপত্তির ছায়াতলে থেকেই পিতার অবাধ্যতা করে গিয়েছে। এই চরিত্রটা ভীষণ কনফিউজিং! এক এক সময় মনে হয় সে যা করছে ঠিকই করছে আবার কখনো বা এর প্রতি ঘৃণার উদ্রেক ঘটে।
এই তিন পুরুষের বাইরে আরেকটা মন ছুঁয়ে যাওয়া চরিত্র হলো রেমি। রেমি কি আসলে বোকা, নাকি প্রেমে অন্ধ? রেমির সাথে হয়ত অনেক পাঠকই নিজেদের মিল খুঁজে পাবেন। কাউকে প্রচন্ড ভালোবেসেও তাকে না পাওয়ার যে হাহাকার তা রেমির মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। রেমির সাথে বিয়ে হয় ধ্রুবর। ধ্রুবকে প্রথম দিকে মেনে নিতে না পারলেও এক সময় তার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করে রেমি। অথচ ধ্রুব যে রেমির প্রতি উদাসীন! রেমিকে অনেকটা গিনিপিগের মত মনে হয়। নিজের কোনো ইচ্ছা বা স্বাধীনতা নেই। যে যেভাবে পারছে চালিয়ে নিচ্ছে। কৃষ্ণকান্ত চাচ্ছেন রেমির মাধ্যমে অবাধ্য পুত্রকে বশে আনতে। উল্টোদিকে ধ্রুব রেমিকে কষ্ট দিয়ে কৃষ্ণকান্তের উপর প্রতিশোধ নিতে চায়। জানি না এত অবহেলা কষ্ট আর বঞ্চনা পাওয়ার পরেও কীসের আশায় রেমি ধ্রুবর কাছেই থেকে গেল! একটুখানি ভালোবাসার আশায়? অল্প একটু সুখের আশায়? নাকি সবই কৃষ্ণকান্তের পরিকল্পনার ফসল? সব মিলিয়ে বেশ কষ্টের জীবন ছিল রেমির। এজন্যই হয়ত কৃষ্ণকান্তের কাছে সে এতটা প্রিয় ছিল।
এসব চরিত্র ও পার্শ্বচরিত্রদের নিয়ে এগিয়েছে উপন্যাসটি। দূরবীনে যেরকম দুটি কাঁচ থাকে, দুটি আলাদা কাঁচে দুটো আলাদা বিম্ব গঠিত হয় এবং দুটো আলাদা বিম্ব মিলে একটা ছবি তৈরি করে; সেরকমই দুটো আলাদা সময় একইসাথে একই সমান্তরালে চলার মাধ্যমে মিলেমিশে এই সুন্দর উপন্যাসের সৃষ্টি করেছে।
এটা আমার পড়া প্রথম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কোনো বই। কিনেছিলাম পুরনো বইয়ের দোকান থেকে। পাতা উলটে দেখি এক অপরিচিতার নাম লেখা! বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার! তারিখটাও বেশ ইন্টারেস্টিং! আজ থেকে ঠিক একুশ বছর আগের তারিখ! (নোট: নীলক্ষেত থেকে একটি পুরনো বই কিনেছিলাম যেটার প্রথম পাতায় জনৈক অপরিচিতার স্বাক্ষরসম্বলিত তারিখ দেওয়া ছিল, সে কথাই ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলাম!মূল ছবিটি ফেসবুক পোস্টে এড করেছিলাম। গুডরিডসে ছবি এড করা যায় না কেন?)
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর সুদীর্ঘ উপন্যাস "দূরবীন" বৈচিত্রতায় পূর্ণ মানবিক সম্পর্কের এক অনন্য সুন্দর আখ্যান। তিন প্রজন্মের এই গল্পের এক প্রান্তে দাড়িয়ে জমিদার হেমকান্ত, আর অন্যপ্রান্তে দাড়িয়ে তারই নাতি ধ্রুব৷ আর মাঝখানে আখ্যায়িত হয়েছে হেমকান্ত'র পুত্র এবং ধ্রুব'র পিতা কৃষ্ণকান্তের গল্প। দুইদিকে দুইজনের দৃষ্টিতে কৃষ্ণকান্তের সুদীর্ঘ জীবনের এক অনন্য মধুর বিশ্লেষনই যেনো এই উপন্যাসের মূল সূর৷
শান্ত প্রকৃতি আর ভাবুক স্বভাবের কিন্তু অসাধারন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ জমিদার হেমকান্ত৷ গল্পের প্রথম ভাগ বলে যায় হেমকান্তের কথা৷ জমিদার হেমকান্ত আর পুরোহিত কণ্যা অথচ প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা রঙ্গময়ীর এক অন্য রকম প্রনয়ের গল্প ফুটিয়ে তুলেছে প্রাপ্তি, কাম, হিসাব-নিকাশের উর্ধ্বে এক গভীর ভালোবাসার জয়গান৷ দূর্বল মানসিকতার হেমকান্তের শক্তিই যেনো নিহিত থাকে রঙ্গময়ীর মাঝে।
দ্বিতীয় প্রজন্মে আমরা দেখতে পাই হেমকান্তের পুত্র কৃষ্ণকান্তকে৷ যে অল্প বয়সেই তার নিষ্ঠা, একাগ্রচিত্ততা, মূল্যবোধ আর সাহসীকতার সংমি��্রনে হয়ে উঠে এক দেব শিশুর সমতূল্য আদর্শবাদী এক শিশু৷ ব্রক্ষাচার্য গ্রহন আর স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি প্রীতি তাকে এগিয়ে নিয়ে যায় এক বৃহত্তর জীবনের পানে৷ দেশভাগের পূর্বের নিষ্ঠাবান স্বদেশী কৃষ্ণকান্ত দেশভাগের পর হয়ে উঠে তুখোর এবং প্রচুর ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ।
আর গল্পের শেষ প্রজন্মে দাড়িয়ে ধ্রুব দেখতে পায় তার আর তার স্ত্রী রেমির মাঝে বিদ্যমান অদ্ভুত এক সম্পর্ককে৷ ভালোবাসা, অবজ্ঞা, অপরিনামদর্শীতা, অবহেলা আর মায়ার সংমিশ্রনে গড়ে উঠা এক অদ্ভুত সম্পর্ক। অন্যদিকে এই অংশে রুপমান হয় ধ্রুব'র ভাবুক এমন এক সত্তা যে নিজের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করে নিজের পিতা কৃষ্ণকান্তকে৷ পিতার প্রতি গভীর ঘৃণা তাকে নিয়ে যায় অন্য এক জীবনের দিকে যার ফল সবচেয়ে বেশি ভোগ করতে হয় তার নিজের স্ত্রী রেমীকে৷
তিন প্রজন্মের এই গল্পের বাকি সবকিছু একদিকে রাখলে যেই জিনিসটা সবচেয়ে বেশি গভীর আর স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে তা হলো পিতা পুত্রের মধ্যকার গভীর সম্পর্ক। একদিকে হেমকান্ত তার বিপরীত স্বভাবের পুত্র কৃষ্ণকান্তকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন৷ তাদের এই পিতা পুত্রের সম্পর্কে স্পষ্টভাবে দেখা যায় একজন পিতা তার পুত্রকে কতটা ভালোবাসতে পারেন সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে৷ অন্যদিকে কৃষ্ণকান্ত আর ধ্রুব'র সম্পর্ক থাকে ঠিক তার বিপরীত। পিতার প্রতি ধ্রুব'র থাকে অসামান্য ঘৃণা। যা দুই পিতাপুত্রের সম্পর্ক নামিয়ে আনে বৈচিত্র৷
তিন প্রজন্মের গল্পের আখ্যান বাদ দিলেও এই বিশাল উপন্যাস জুড়ে চিত্রায়িত হয়েছে স্বদেশী আন্দোলন, জমিদারী প্রথা, দেশভাগ এবং দেশভাগের পরবর্তী অবস্থার এক দারুন উপাখ্যান। বহু চরিত্রের এই বিশাল গল্পে একেক চরিত্র বলে যায় একেকটা গল্প। তবুও সবকিছু ছাপিয়ে পিতা পুত্রের সম্পর্ক আর প্রজন্মের পর প্রজন্মে যে জেনারেশন গ্যাপ সৃষ্টি হয় তারই এক বিষন্ন সুন্দর আখ্যানই যেনো "দূরবীন" এর মূল উপজীব্য।
ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে মুগ্ধ করেছে কৃষ্ণকান্ত, হেমকান্ত আর রঙ্গময়ীর চরিত্রত্রয়৷ আর বহু মেয়ে যেখানে ধ্রুব'র প্রেমে হাবুডুবু খায় সেখানে আমার সত্যি বলতে ধ্রুব'র চরিত্রটাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত একটা চরিত্র মনে হয়েছে৷ কিছু কিছু জায়গায় বেশ বিরক্ত লেগেছে ধ্রুবকে। অন্যদিকে কৃষ্ণকান্তের প্রবল ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছি বেশ।
আমাদের কলেজে বাংলা পড়াতেন বিচিত্রা ম্যাডাম। একদিন কথা প্রসংগে ম্যাডাম বললেন, উনার বড় ছেলের নাম উনি রেখেছেন ধ্রুব! যেই ধ্রুব দূরবীন উপন্যাসের নায়ক। ততোদিনে আমি দূরবীন পড়েছি- বারকয়েক- বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে নিয়ে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- দূরবীন একসপ্তাহে নিয়ে পরের সপ্তাহে ফেরত দিলে, সেই বই কমপক্ষে তিনমাসের জন্য হাওয়া হয়ে যায়! এবং দূরবীনের দাম অনুযায়ী এটা আমার দুইটা কার্ড কাভার করে ফেলে, এবং আমি অন্য বই নিতে পারিনা আরেকটা। দূরবীন নিয়ে এই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বিষয়ক ঘটনার কারণে আমার এই উপন্যাসের প্রতি দ্বিমাত্রিক অনুভূতি তৈরি হয়ে গেলো! না ভালোবাসা- না ঘৃণা :P যেমনটা তৈরি হয়েছিলো ধ্রুব'র জন্য। ধ্রুবকে আমি ভালোবাসতে পারিনা- আবার এই অদ্ভুত আর উদ্ধত-দিগভ্রান্ত যুবকের এতো বৈপরীত্যমূলক স্বভাব থাকার পরেও তাকে ছাড়া উপন্যাসটা লবণ ছাড়া- এবং তার প্রতি একটা আকর্ষণ ও তৈরি হয়ে যায়- যেই আকর্ষণ আমি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি কখনোই,পুরোপুরিভাবে!একটা দোলাচালে ভুগেছি সবসময়ই- ধ্রুব'র জন্য। ধ্রুবর উপর রাগ উঠেছে সবচে' বেশি, ভুল বুঝেছি সবচে' বেশি, এবং ভালোবাসাও সবচে' বেশি-সেই ধ্রুব'র জন্যই! এই যেমন এই ক্যাপশনের সবচে' বেশি জায়গা নিয়ে নিলো ধ্রুব- তেমনই!
একদিকে ছোট কৃষ্ণচন্দ্রের বেড়ে উঠা- একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নিজের গঠন, অন্যদিকে ধ্রুব'র একতরফা আঙুল তুলে যাওয়া কৃষ্ণচন্দ্রের দিকে! তার বাবা হেমচন্দ্রের ভাবুক ভাবুক ভাবটাও আকর্ষণ করছিলো যথেষ্ট! এই হেমচন্দ্র-কৃষ্ণচন্দ্র-ধ্রুব এই তিন পুরুষের আখ্যান উপন্যাস টি বরাবরই আমার ফেভারিট লিস্টে ছিলো,আছে,থাকবে❤ এবং "রঙ্গময়ী কতো রঙ্গই না জানো!" এই বাক্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তেজী এই মহিলা কিন্তু আমার বেশ পছন্দের ছিলো সবসময়! বিশাখা-শচীন-চপলা এই তিনজনের কাহিনীও ভাল্লাগছিলো অনেক! আর রেমির প্রতি ধ্রুব উদাসীনতায় তখন কষ্ট পেতাম, এখনো পাই! :) যাই হোক, বক্তব্য আর দীর্ঘ না করি! খুব আগের পড়া এই উপন্যাস আবার পড়ে শেষ করেছি- এবং হ্যাঁ, এই বই আমার আর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বাস থেকে বের করতে হয় না- এটা আমি কিনে ফেলেছি!🙄
বইটি বর্ননা করার মতো কোনো ভাষা আমার জানা নেই। নিঃসন্দেহে আমার পড়া শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। লেখনি অসাধারণ, অতুলনীয়। কৃষ্ণকান্ত চরিত্রটি বড় দাগ কেটেছে মনে। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব৷
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'দূরবীন' বইটা অনেকদিন থেকেই সংগ্রহে ছিলো। ধরবো ধরবো করেও ধরা হতো না কোনো এক অজানা কারণে। এখন বুঝতে পারছি এতোদিন কি মিস করেছি! 'দূরবীন' এক অনন্যসাধারণ উপন্যাস।
দূরবীন উপন্যাসে মূলত তিনটা প্রজন্মের উল্লেখ আছে। জমিদার হেমকান্ত চৌধুরী, উনার ছেলে কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী ও কৃষ্ণকান্তের বখে যাওয়া ছেলে ধ্রুব চৌধুরী। একটা খুব শক্তিশালী নারী চরিত্রও বইয়ে দেখা যায়। যিনি আমারও খুব খুব পছন্দের। তিনি হচ্ছেন রঙ্গময়ী। আমি উপন্যাসের কাহিনীর দিকে যাচ্ছি না। প্লট বিশাল। এক লাইনে বলতে গেলে বলবো, উনিশ শতকের ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর প্রজন্মগত ব্যবধান নিয়েই মূলত প্লট।
তিনটি প্রজন্মকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যেভাবে এক সুঁতোয় বেঁধেছেন তা দেখলেই অবাক লাগে। এতো চমৎকার লেখনী, এতো সুন্দর সব চরিত্র। বাহ! উপন্যাসের ভেতর দিয়েই যেমন বাস্তব জীবনের টানাপোড়ন ধরা দিয়েছে, তেমনই রয়েছে কল্পনার দিগন্ত উন্মোচন। পড়ার সময় মনে হচ্ছিলো, আমি যেনো চরিত্রগুলার সাথে আছি। তাদের সুখ-দু:খের অংশ আমি নিজেই।
বইয়ের ভাষা একেবারেই সহজ আর সাবলীল। তবে তার ভেতরেই আছে এক ধরনের মায়া, যা পাঠককে আটকে রাখে।
সবমিলিয়ে বলবো, আমার কাছে 'দূরবীন' শুধু একটা বই নয়, এই এক অনন্য অনুভূতির যাত্রা। যারা এখনও পড়েননি, পড়ে ফেলুন। এই বই একবার হলেও জীবনে পড়া উচিত। একদম অবশ্যপাঠ্য।
ধ্রুব চরিত্রের কথা প্রথমে শুনি আমার খালাতো বোনের কাছে।সে ধ্রুবর খুব বড় একজন ভক্ত।তারপরেই অনেকদিন ধরে এই বিশেষ চরিত্র নিয়ে অনেক পোস্ট,স্ট্যাটাস দেখে মূলত ধ্রুব চরিত্রটা আসলেই ঠিক কেমন সেটা জানার জন্য এই বই অতি আগ্রহ নিয়ে পড়া।কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি ধ্রুবর প্রেমে পড়তে পারলাম না! অদ্ভুত ছিলো বইটা!খুব বেশি ভালো লেগেছে তা না ক��ন্তু পড়ার আকর্ষণটা খুব ভালোভাবে ধরে রেখেছিলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।অনেকদিন পর একদিনে ৪০০ পেজ পড়ে ফেলছি! কেন যেন আমার কাছে সবচাইতে ভালো লেগেছে রঙ্গময়ীকে।অদ্ভুত বর্ণিল এই চরিত্রটা। শেষটায় হুট করে খুব বেশি ড্রামার মধ্যে দিয়ে বইটা শেষ হয়েছে।এই ব্যাপারটা পুরো বইয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়নি।
খুব প্রবলেম্যাটিক একটা বই। শীর্ষেন্দু মশাইয়ের লেখা এমনিতে আমার খুবি ভালো লাগে। তাঁর যত উপন্যাস পড়লাম,তার মধ্যেই এই বইটি-ই একটু বেশি রিগ্রেসিভ আর কেমন যেন খাপছাড়া।
এই বইটি সম্বন্ধে আসলেও আমার কাছে বলার মত কিছু নাই। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় খুব সুন্দর করে তিনটা জেনারেশন সম্পর্কে তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসটিতে একাল ও সেকাল, অতীত ও বর্তমান এক অন্যান্য কৌশলে একাকার। এই উপন্যাসে তাদের তিনজনের জীবন তিন রকমের হেমকান্ত থেকে শুরু হয়ে ধ্রুবর মাধ্যমে এই শেষ হয়। এবং মাঝে হেমকান্ত জীবনের প্রতি উদাসীনতা, বেঁচে থাকার না ইচ্ছা তার সাথে রঙ্গময়ীর মত প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন নারীর প্রভাব তার জীবনে পরবর্তীতে আসে। কৃষ্ণকান্তের বড় হয়ে ওঠার পুরো কাহিনী কি কিভাবে সেই ছোট্ট কৃষ্ণ থেকে দেশের প্রতি তার ভালোবাসা জন্মায় দেশভাগের পর আমূল পরিবর্তন সাথে স্বদেশী হয়ে ওঠার রূপ অবশেষে ধ্রুব।বিশ শতাব্দীর খুবই অবাক করা একটা চরিত্র এই গল্পের। ক্ষতবিক্ষত এক আশ্চর্য চরিত্র নিয়ে কাহিনী তার, কারো সাথে থাকতে পছন্দ করে না, কারো প্রতি ভালোবাসা নেই, সারা জীবন সে স্যাডিস্ট হয়ে থাকে, তার সব কিছুর প্রতি অনুভূতি খুব কম থাকে। সবকিছু তুচ্ছ তার কাছে, সবকিছুর দাম অনেক কম থাকে এবং তার কাছে সম্পর্কের দাম সবচেয়ে কম ছিল । নিজের বাবার প্রতি কোনো রকমের ভালোবাসা, কোনো রকমের আবেগ, কোনো রকমের সম্মান প্রকাশ করে না প্রতিমুহূর্ত তাকে তুচ্ছ করে যায়। কৃষ্ণকান্ত শেষ বয়সে রেমি তার মা হয়ে তার কাছে ফিরে আসে এবং শ্বশুর মশাইকে সবচেয়ে স্নেহের সাথে গ্রহণ করে। এত কিছুর পরও কৃষ্ণকান্ত তার শেষ পর্যায় পর্যন্ত চেষ্টা করে বাবা ডাকটা শোনার যদিও তার শুনতে পারার ভাগ্য থাকে না তবুও ধ্রুব ভুলটা বুঝতে পারে গল্পের শেষে। যদিও সেটি কষ্টদায়ক। তবুও ইতিটি সবচেয়ে সুন্দর।
প্রাক-স্বাধীনতার এক সকালে জমিদার হেমকান্তর মনে হলো তিনি সংসার-জগৎ থেকে নিজেকে বড়ো আলাদা করে রেখেছিলেন। আর বাকি ছেলে মেয়েরা সাংসারিক হয়ে গেলেও ছোট মেয়ে বিশাখা আর ছোট ছেলে কৃষ্ণকান্তকে এবার একটু নজর দিতে লাগলেন, তাও প্রচ্ছনে, রঙ্গময়ীর তত্ত্বাবধানে। বিপত্নীক হেমকান্তর একটি খুঁটি।
হাসপাতালে প্রসবোদ্যাতা রেমি। স্বাধীনতা পরবর্তী অধ্যায়ে দুঁদে নেতা আর স্বদেশী করা কৃষ্ণকান্ত পুত্রবধূর চিন্তায় মুহ্যমান। ছেলে ধ্রুবকে সর্বসমক্ষে কুলাঙ্গার বললেও ভালো তাকেই বেশি বাসেন। ধ্রুব আর রেমির বনিবনা নেই, রেমির কাছে ধ্রুব অমূল্য, তার ঠিক উল্টোটা রেমি ধ্রুবর কাছে।
কাহিনীর শেষে কৃষ্ণকান্ত হয়তো বাবা হেমকান্তের অতীত জীবনের এক ঝলক দেখতে পেয়েছিলেন ধ্রুবর জীবনে, তাই হয়তো সমস্ত দায়-দায়িত্ব ধ্রুবর ওপর দিয়ে বাড়ি ছাড়া হয়েছিলেন।
এইরকম এক কাঠোমোতে দূরবীন উপন্যাস। দুটো কাহিনী সমান্তরালভাবে চলছে। প্রথমদিকে স্বাধীনতা-পরবর্তী গল্পটা ভালো লাগছিলো, তারপর একঘেয়ে লাগতে শুরু করলো। ধ্রুবর হামবড়া ভাব আর রেমির সহ্যক্ষমতা repetitive লাগলো, কোনো গল্প নেই। বরং কাহিনী যত এগিয়েছে প্রাক-স্বাধীনতা পর্বটি ধারালো, ঘটনাবহুল হয়ে উঠেছে।
কয়েকটি চরিত্র বেশ ভালো, কিন্তু সেরকম depth পাইনি।
ধ্রুব চরিত্রটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এক ঘৃণ্য অথচ বাস্তবিক উদাহরণ।
এটার মতোন কাটখোট্টা (এটা কি আদৌ কাটখোট্টা!) বই শেষ করে আমার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার কথা ছিলো।কিন্তু একগাদা frustration জমা হয়ে আছে!এই শব্দ ছাড়া অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য অন্য কোনো শব্দ পাচ্ছিনা।কারণ এই বিশাল উপন্যাস আমাকে সেই জায়গাতেই রেখে দিয়েছে যেখানে শুরু করেছিলাম।বিশাল একটা বই ছোটগল্পের শেষ হয়েও হলোনা শেষ এ আচরণ করলে রাগ হবেনা! এটা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করবে এমন লোক কম আছে। তবে কিনা আমার সমস্যা অন্যখানে! লেখক ধ্রুব নামের এই জঘন্য চরিত্র নিয়ে বইয়ের এক-তৃতীয়াংশ লিখে ফেললেন! অনেকে রেমিকে মেরুদণ্ডহীন,আত্মসম্মানহীন বলবে। অথচ আমার বরং ওর জন্য কষ্টই হয়েছে। এই যুগেই মেয়েদের নিজেদের গলা থাকে না, সমাজ একটা গণ্ডি কেটে রাখে,সে যুগে সে বিদ্রোহী হয়ে কী কচু ফেলতো? ক্ষমতার খেলায় ঘুটি হতো। বাপ-বেটার ঠাণ্ডা যুদ্ধে আরেকটা বলি মাত্র।