দুই বাঙালী তরুণ সুরেশ্বর ও বিমল। তাদের পরিচয় রেঙুনের পথে এক স্টিমারে। দুজনেরই গন্তব্য সিঙ্গাপুর, নতুন পেশাজীবন আরম্ভের লক্ষ্যে। কিন্তু সিঙ্গাপুর থেকে তারা জড়িয়ে পড়লো চীন-জাপান যুদ্ধে। কনশেসন আর্মির হয়ে কাজ করতে লুকিয়ে হাজির হলো সাংহাই। তারপরে জড়িয়ে পড়লো জাপানি বোমারু বিমান আর যুদ্ধের দামামার মাঝে। কী হলো তারপরে তাদের সাথে?
Bibhutibhushan Bandyopadhyay (Bangla: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়) was an Indian Bangali author and one of the leading writers of modern Bangla literature. His best known work is the autobiographical novel, Pather Panchali: Song of the Road which was later adapted (along with Aparajito, the sequel) into the Apu Trilogy films, directed by Satyajit Ray.
The 1951 Rabindra Puraskar, the most prestigious literary award in the West Bengal state of India, was posthumously awarded to Bibhutibhushan for his novel ইছামতী.
১৯৪০-এ বাঙালী কেউ চীন-জাপান যুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন, যুদ্ধের বই; অতর্কিত এয়ার রেইড, বোমারু বিমানের হামলা, সম্মুখ যুদ্ধ, বেয়োনেটের ক্ষত, ছিন্নভিন্ন লাশ, ব্ল্যাক আউট, এতিম পথশিশু, বাস্তুহারা, দিশেহারা গ্রামের মানুষ, যুদ্ধ, একদম সামনে থেকে বাঙালীর চোখের সামনে, কিশোর-তরুণদের জন্যে উপস্থাপন, শুধু এই অদ্ভুত চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্যেই মনে হয় আমি বিভূতিভূষণের এই বইটাকে ৪ তারা দেব। ৫ তারাই দাগানো যেত, কিন্তু এখনকার হিসেবে কিছুটা জলো হয়ে গেছে অ্যাডভেঞ্চার, কিছু জায়গায় দিনক্ষণের অসংলগ্নতা আছে, আর আছে গণচীন আর ভারত উভয় রাষ্ট্রের প্রতিই পক্ষপাতিত্ব।
বিভূতিভূষণ বাংলা সাহিত্যে আমার প্রিয় লেখক। ছোট গল্প তো বটেই, 'আম আঁটির ভেঁপু' আমার স্কুল জীবনে পড়া একাধারে পছন্দের আর কষ্টের বই। যে সময়ে বাঙালী জাতি আর বাংলাদেশের (পশ্চিম-পূর্ববঙ্গ মিলিয়ে) মানুষের জগৎ ছিলো সীমাবদ্ধ, সেই সময়ে বিভূতিভূষণ বাংলা ভাষী তরুণ চরিত্রকে হাজির করেছেন আফ্রিকার বিপদসংকুল অরণ্য থেকে শুরু করে চীনের যুদ্ধে, এইটাই আমার কাছে বেশি সাবাশের মনে হয়। এই বইটা পড়তে গিয়ে আরেকবার টের পেলাম, বাক্যগঠন, সাবলীলভাবে গল্প এগিয়ে নেয়ার ক্ষমতা, এসব দিকে তার যে কৃতিত্ব, তাও এখনো ম্লান নয়!
জীবিকার তাগিদে সিঙ্গাপুরে উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় দুই যুবক বিমল ও সুরেশ্বর। চাকরি অবস্থা সংকীর্ণ থাকায় দুজন বেশ চিন্তিত। হঠাৎ খেয়াল করলো কেউ একজন লুকিয়ে নজর রাখছে তাদের উপর। তারপর জানা গেল চীনা চর তাদের চিকিৎসা পেশা জানার পর আগ্রহ দেখাচ্ছে তাদের যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের মানুষের চিকিৎসা করতে। এটি মূলত জাপান - চীন যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা কিশোর এডভেঞ্চার উপন্যাস। বিভূতিভূষণের অন্যান্য লেখার তুলনায় এটা কিছুটা ভিন্ন বলা যায়।
চীন জাপান যুদ্ধে সাংহাই শহরে যুদ্ধের বীভৎসতার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। যুদ্ধে পর্যায়ক্রমে এলিস, মিনি, প্রোফেসর লী এদের সাথে পরিচয় হয়। এদের মতো কিছু মানুষ আছে বলেই, পৃথিবীটা আজও বাসযোগ্য। এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে নানাভাবে তারা সাহায্য করেছেন।
ব্যাক্তি বিভূতিভূষণ ছিলেন খুব ভ্রমণপিপাসু একজন মানুষ। এডভেঞ্চার বিষয়টা তাঁর রক্তে ছিল। তাই বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় তাঁর গল্প উপন্যাসের চরিত্রেরা অভিযাত্রী হয়ে বিপদের টানে চলে গেছে একেবারে অজপাড়াগাঁ থেকে সুদূরের বিপদসংকুল কোন দেশে। অনেকটা সেই অলিখিত নিয়ম মেনেই মরণের ডঙ্কা বাজে বইতে দুই বাঙালী যুবক চলে গেছেন বাংলাদেশ থেকে দূরবর্তী চীনদেশে। যেখানে যুদ্ধের দামামা তাদের টানছিল।
মরণের ডঙ্কা বাজে চীন-জাপানের যুদ্ধকালিন দুঃসময়ের গল্প। শক্তিশালী জাপানের ভারী বোমা বর্ষণে একে একে গুড়িয়ে যাচ্ছে চীনের বড় শহর থেকে ছোট ছোট গ্রাম--- সেই দুঃসময়ের চিত্রই লেখক এঁকেছেন এই বইতে। বিভূতিভূষণের লেখা সবসময়ই এতোটা আন্তরিক আর ভালোমানুষি ধরনের হয় যে আমার ধারনা ছিল তিনি হয়ত একটা যুদ্ধের ধ্বংসলীলা ঠিকমতো ফুটিয়েই তুলতে পারবেন না। অথচ 'পথের পাঁচালী'র সেই সহজ সরল লেখক এখানে একেবারে ভিন্নধর্মী!
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যেকোন অদেখা দেশ বা স্থান নিয়ে লিখবার আগে সেই জায়গা নিয়ে বিস্তর লেখাপড়া করে নেন। এখানে লেখকের "অদেখা চীন" আর "জাপানের যুদ্ধের সরঞ্জামাদির" বর্ণনায় সেটাও চোখে পড়বে। তবে গল্পের কাহিনীটা আমার কাছে মাঝে মাঝে একটু ঢিমেতালের মনে হয়েছে। কোথাও কোথাও বর্ণনা চোখে উঠে আসতে পারেনি (না-কি আমিই আঁকতে পারিনি?)।
লেখকের দ্বিতীয় এই কিশোর উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে এক নব দম্পতীর হাসির মাধ্যমে। তাদের হাসি সেই সংকটময় মুহূর্তেও মনে হয় দানবীয় শক্তির ওপর--- মৃত্যুর ওপর মানুষের বিজয়ের হাসি।
১৯৪০ সালের চীন-জাপান যুদ্ধের মধ্যে পড়ে যায় দুই বাঙালি যুবক সুরেশ্বর আর বিমল।যুদ্ধের ভয়াবহতার এক জীবন্ত আখ্যান এই বই।সবকিছু ছাপিয়ে মানবতা আর মানুষেরই জয় হয়- তাই প্রকাশ করেছেন লেখক।
বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়(অসম্ভব সুন্দর একটা বই) এর পর মনে হল যেন আরেকটা রোমাঞ্চকর বই পড়লাম।
প্রত্যক্ষ যুদ্ধ যে কতটা ভীতিকর হতে পারে তার একটা মোটামুটি আভাস পেলাম এই বইয়ের কাহিনীতে। ফ্রন্টলাইনে জীবন কতটা অনিশ্চিত হতে পারে তাও খুব ভালোভাবেই বুঝলাম।
দুই বাঙ্গালী যুবক ভাগ্যান্বেষনে গিয়ে ঘটনাচক্রে চীন-জাপান যুদ্ধের কেন্দ্রে চলে আসে। তাদের সেই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা গুলো বইয়ের প্রতি পাতায় পাতায়। পাঠককে শিহরিত করে, যুদ্ধের ভয়াবহতা যে কি, তা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
Landmine Has taken my sight Taken my speech, Taken my hearing Taken my arms, Taken my legs Taken my soul, Left me with life in Hell
Hold my breath as I wish for death Oh please, God, wake me
Now the world is gone, I'm just one Oh God, help me Hold my breath as I wish for death Oh please, God, help me!
(One By Metallica)
বিভূতিভূষণ সব বিষয়ে লিখতে পারেন। তাকে শুধু একটা সিনারিও দিন। এমন জিনিস লিখে দেবেন যেন আপনি সামনে বসে ফুল সিনেপ্লেক্সের ফিল পাচ্ছেন। মাই গড!
বার্মায় জাপানিজ অভিযান আসলে ২য় বিশ্বযুদ্ধের এক বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায়। আর চীন জাপান যুদ্ধকে হয়ত মানুষ মনে রেখেছে রেপ অফ নানকিং এর জন্যই।
তবে কতটা ভয়ানক ছিল সেই যুদ্ধ? বিভূতির জাদুকরী কলমে তার আভাস দেওয়া আছে। যেন একদম চাক্ষুষ। আবার শেষে শোনানো হয়েছে ধ্বংসের মধ্যেও নতুন প্রাণের গান।
যুদ্ধ মানব সভ্যতার একটা অবিমিশ্র পার্ট। ভাঙবে, গড়বে। কখন এর সমাপ্তি, কেউ জানে না, ১৯৪০ এ বিভূতিভূষণও জানতেন না। তবে তাতে থেমে গেলে হবে না। যুদ্ধ মানুষকে যেমন নিষ্ঠুর করে, তেমনি মানবতাও শেখায়৷ যেমন ঘৃণার উল্টোপিঠে থাকে ভালবাসা।
আসুন, বিমল আর সুরেশ্বরের সঙ্গী হোন। দেখে নিন এই ভাঙাগড়া, ঘৃণা-প্রেম, অস্ত্র-সেবার হোলিখেলা।
গল্পটা গপ্পো মীরের ঠেকের থেকেই শুনে নেবেন, উপস্থাপনা চমৎকার।
বিভূতিভূষণের নাম শুনলেই পাঠক সাধারণত এক অন্তর্মুখী, গ্রামীণ বাংলার আবেগে ভেজা লেখাকে কল্পনা করেন। কিন্তু "মরণের ডঙ্কা বাজে" সম্পূর্ণ অন্য স্বরে কথা বলে। এখানে লেখক প্রকৃতি নয়, যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে মানবতার প্রতিমূর্তি আঁকেন — তা-ও কিশোর পাঠকের জন্য, এবং যুদ্ধকালীন পৃথিবীর তীব্র বাস্তবতা নিয়ে। নিঃসন্দেহে এটি তাঁর লেখকজীবনের অন্যত��� ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ।
দুই বাঙালি তরুণ—বিমল ও সুরেশ্বর—জীবিকার সন্ধানে সিঙ্গাপুরে রওনা হয়ে পড়ে চীন-জাপান যুদ্ধের কেন্দ্রে, সাংহাই শহরের বিভীষিকাময় বাস্তবতায়। পাঠককে চমকে দেয় যে, বিভূতিভূষণ যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা, বোমারু বিমানের ধ্বংস, ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষ, অনাথ শিশুদের আর্তনাদ—এসব অকপটে, অথচ এক অদ্ভুত মমতায় তুলে ধরেন। তাঁর কলমে এই দৃশ্যগুলো কখনো চিৎকার করে না—তারা ধীরে ধীরে গেঁথে যায় পাঠকের মনে, যেন ব্যথার মৃদু সুর।
এখানে যুদ্ধের পটভূমিতে গড়ে ওঠা চরিত্রগুলি—মিনি, এলিস, প্রফেসর লি—শুধু পার্শ্বচরিত্র নয়, বরং মানবতার প্রাণরস। তাদের উপস্থিতি পাঠককে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়, পৃথিবী আজও টিকে আছে কিছু অসীম সহানুভূতির মানুষদের জন্য।
লেখাটি পড়তে পড়তে বারবার মনে পড়ে গেল এর আন্তর্জাতিক প্রতিস্বরগুলি—এর বিন্যাস ও মনস্তাত্ত্বিক গাম্ভীর্যে হেমিংওয়ের A Farewell to Arms, রেমার্কের All Quiet on the Western Front, বা ইশিগুরোর When We Were Orphans-এর মতো বিশ্বসাহিত্যের যুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের কথা। তবে বিভূতিভূষণের ক্ষেত্রে পার্থক্য এই যে, তিনি কিশোর পাঠকের জন্য এই বীভৎসতাকে ব্যাখ্যা করেছেন স্নেহ ও সাহসিকতার মোড়কে—যা অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী ও মূল্যবান।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা বাংলা ভাষার এই অসামান্য কাজটি আজও প্রাসঙ্গিক—বিশ্বজুড়ে যখন যুদ্ধ-সংঘাত চলছেই, তখন এই বইটি তরুণদের সামনে দাঁড় করায় কিছু চিরন্তন প্রশ্ন: সহানুভূতি বনাম আত্মরক্ষা, মানবিকতা বনাম জাতীয়তাবাদ, স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা।
"মরণের ডঙ্কা বাজে" শুধু একটি অ্যাডভেঞ্চার নয়। এটি একটি মানবিক শিক্ষাগ্রন্থ। বিভূতিভূষণের সাহসিকতা শুধু ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে না—তাঁর ভাষা অতিক্রম করে কিশোর মনে যুদ্ধবিদ্ধস্ত পৃথিবীর আলো-অন্ধকার।
মূলত কিশোর পাঠকদের জন্য রচিত হলেও সকলেই উপভোগ করবেন এই বইটি। পড়ে দেখুন।
বিভূতিবাবুর রচনার অলঙ্কার হল 'বর্ণনাশৈলী'। বর্ণনার গভীরতায় উপন্যাসের ঘটনাবলী সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে যায়। এই কাহিনীও তেমনি সুদূরপ্রসারী। যুদ্ধের ভয়াবহ পরিবেশে সংকটের বাতাবরণে কল্পিত পাঁচটি কেন্দ্রীয় চরিত্রের সঙ্গে বর্তমান সময়ের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বহু অসহায় অথচ জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় লড়াকু যুবক-যুবতীর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কিশোর-কিশোরী বেলায় এই রচনা হয়তো যুদ্ধময় পরিস্থিতির বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও মানুষের নৃশংসতার সঙ্গে পরিচয় করাবে। তবে বড় হয়ে যদি আবারও এই উপন্যাসের স্বাদ গ্রহণ করা হয় বিশেষত বর্তমানে যদি এই কাহিনীর প্রতি মোড়কে একটুকু শ্বাসবায়ু খুঁজতে চান তাহলে একবিংশ শতকের দুই ভয়াবহ ঘটনার অভিজ্ঞতার সঙ্গে আশ্চর্য মিল খুঁজে পাবেন; এক, করোনা ভাইরাসের প্রকোপ; দুই, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
বিমল, সুরেশ্বর, মিনি, এ্যালিস ও প্রফেসর লি প্রত্যেকের জীবনসংকটের মধ্যেও একে-অপরের সঙ্গটুকু অবিচ্ছিন্নরূপে গড়ে তোলার মানবিকতা, কেন্দ্রীয় সংকট হতে উত্তরণের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। এখানে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত লড়াইয়ের মানসিকতা একটা গোটা প্রজন্মকে শিখিয়ে দেয় 'আত্মত্যাগ'-ও সাহসিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বিভূতিবাবুর কালজয়ী চরিত্রের তথা উপন্যাসের সার্থকতা এখানেই।
দুই বাঙালী তরুণ সুরেশ্বর ও বিমল। ভাগ্যান্বেষণ করতে রওনা হয়েছিলেন সাগরপথে। গন্তব্য সিঙ্গাপুর। জাহাজেই দেখা হয় দুজনেরই। আস্তে আস্তে পরিচিত হয়ে উঠেন এবং গন্তব্য পৌছে যান। কিন্তু বাধ সাদলো নিজের বিবেক। ঘটনাক্রমে সেই বিবেকের তাড়নায় ছুটে যান দুইজনই বিধ্বস্ত চীনে রোগীদের সেবা করতে। যেখানে চলছে চীন-জাপান যুদ্ধ(১৯৩৭-১৯৪৫)। জাপান একের পর এক বোমারু প্লেন নীল আকাশকে কালো করে যাচ্ছে চীনের উপর বোমাবর্ষণ করে।
বইটা পড়ে মনে হচ্ছিলো কোনো নরকে চলে গিয়েছি আমি। প্রত্যক্ষ যুদ্ধ যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা পাতায় পাতায় ফুটে উঠেছে। ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধাদের নিজের জীবন নিয়ে চিন্তা করা যে বোকামী তা দেখিয়ে দিয়েছে বইটা। সাধারণ মানুষের মানবেতর জীবনযাপন, পদে পদে ম*রার ভয় বাঙ্গালী যুবকদের মাধ্যমে লেখক পাঠকদেরও সেখানে নিয়ে গিয়েছেন।
লেখক যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই এই বইটা লিখেছেন। এ এক অন্য বিভূতিভূষণ এর লেখা বলা যায়। যেরকম সবসময় আমরা উনার বই পড়ে এসেছি এটা তার ভিন্ন। অনেক তথ্যবহুল বইটা। যুদ্ধ ও মানবতার একটা মিশ্রণ এই বইটা বলতে গেলে।
সতীর্থ প্রকাশনীর পেপারব্যাক এই এডিশনটার বাইন্ডিং আমার দারুণ লেগেছে। আরামসে খুলে পড়া যায়। প্রচ্ছদটাও সুন্দর। যারা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সাথে মানবতার গল্প পড়তে চান তাদের জন্য এই বইটা উপভোগ্য হবে।
স্তব্ধ আবহাওয়াতে যখন বজ্রপাত হয় তখন ভয়ে গুটিসুটি হয়ে যেমন করে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকি তেমনি 'মরণের ডঙ্কা বাজে'! ভয়ংকর মুহুর্ত গুলোতে লেখক যেমন করে মানুষকে বাঁচাতে পারেননি, অকাতরে দুঃখের বলিয়ান শক্তি বর্ণনা করেছেন তার তুলনা আমি কিসের সাথে দিব। যুদ্ধের বিভীষিকায় মনুষ্যত্বের স্থান কতটা নীচে লেখক শব্দ দিয়ে বর্ণনা করতে পারেন নি। নিষ্পাপ মানুষের রক্তে রঞ্জিত হওয়ার উৎসব চিরকাল ছিল যুদ্ধের ময়দানে।
লেখক মানবতাহীন হয়ে শুধু যুদ্ধের বাঁকের গল্প বলেন নি, বলেছেন মানবতার প্রতীক রুপে ডাক্তারদের আত্মত্যাগের কথা। মিস্টার. লি ছিল শাদা কুর্তা পরিহিত ধোপদুরস্ত চীনের উজ্জ্বলতার প্রতীক। তার নির্বিকার সাহায্য করার প্রতিমা মূর্তি সৌন্দর্যের অপরুপ। সুরেশ্বর, বিমল, মিনি, এ্যালিস সকলে একই সূত্রে গাঁথা নঁকশি কাথার বুনন। একে অপরের যেন বাঁধা সেতু।
বিমলের মানুষকে সাহায্য করার প্রবৃত্তি লেখকের সাহসিকতার দৃষ্টান্ত। তিনি এঁকেছেন ভারতীয় বাঙালির অদম্য মনোবলে বেড়ে উঠা এক মানবতার ফেরিওয়ালাকে! সে যেন ভাঙা চাউলের মত শত চাউলের জায়গা করে দেওয়া সুক্ষ্ম প্রতীক!
বইটির সারসংক্ষেপ হলো, দুজন বাঙালি সিঙ্গাপুর গিয়েছে নিজেদের উন্নতি সাধনে। কিন্তু ভাগ্যের কল্যাণে তারা চীনের সাহাংই শহরে আসে চীন জাপান যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সাহায্য করতে। এখানে নানান ঘাত প্রতিঘাতে, রক্ত, বোমা, মেশিনগানের শব্দে মানবতার চরম পরিণতীর কথা লেখক তুলে এনেছেন।
মাত্র শেষ করলাম "মরণের ডঙ্কা বা���ে"। শুরুটা জীবীকার খোঁজে সিঙ্গাপুরে রওনা হওয়া দুই তরুণ বিমল আর সুরেশ্বরের। ঘটনাক্রমে তারা চলে যায় চীনে,পরিচিত হয় প্রফেসর লি,এ্যালিস,মিনি সহ নানা চরিত্রের সাথে প্রত্যক্ষ করে যুদ্ধের হত্যালীলা, ধ্বংসাযজ্ঞ,ভয়াবহতা। এটি মূলত চীন - জাপান যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এক কিশোর অ্যাভেঞ্চার উপন্যাস। বিভূতিভূষণের অন্য সব লেখার সাথে এটাকে খাপ খাওয়াতে একটু কষ্ট হয়েছে বলতেই হবে। পুরো বইয়েই কাহিনীর মধ্যে কখনোই নিজেকে পুরোপুরি ডুবাতে পারিনি। বিভূতিভূষণের সব লেখা পড়ার ইচ্ছা আছে তাই শেষ করেছি। তবে অন্য সব লেখার মত এখানেও প্রকৃতির বর্ণনা যতটুকু ছিলো পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। সেই ৪০ এর দশকে, একটা জায়গায় না গিয়ে শুধু বই পড়ে এত নিপুণ কৌশলে সেখানকার বর্ণনা করা হয়তো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেই সম্ভব। বইটা কিশোর বেলায় পড়তে পারলে আরো ভালো লাগতো বলেই আমার বিশ্বাস।
রেটিং ৩ দিলে মনে হচ্ছে কম হয়ে যাচ্ছে আবার ৪ দিলে বেশি হচ্ছে। তাই ৩.৫/৫ দিতে হচ্ছে।
বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা অনেক ইংরেজি উপন্যাস পড়েছি। কিন্তু বাংলায় এনিয়ে যে এমন মর্মস্পর্শী উপন্যাস আছে, এ আমার অজানা ছিলো। বিভূতিভূষণ প্রণম্য! যে বিষয়ে হাত দিয়েছেন তাতেই সোনা ফলিয়েছেন। অথচ কি আশ্চর্য পরিমিতিবোধে সফল থিমের কাছে বারবার ফিরে ফিরে আসেননি। তবে শুধু যুদ্ধকালীন বীভৎসতার নয়, এ কাহিনি দুই বাঙালি যুবকের বিদেশবিভুইতে অ্যাডভেঞ্চারেরও। সেদিক থেকে ‘চাঁদের পাহাড়’ বা ‘হীরা মাণিক জ্বলে’র সাথে এক পঙক্তিতেও বসানো যায় হয়তো। মানুষের থেকে পরিপার্শ্বের বর্ণনা বিভূতিভূষণের কলমে যেন প্রাণ পায়। বাংলার শ্যামল গ্রাম হোক বা লবটুলিয়া বইহারের আদিমতা বা যুদ্ধবিধ্বস্ত স্যাংহাই — এরাই যেনো কাহিনিগুলোর মূল চরিত্র হয়ে ওঠে। আমার খুবই ভালো লেগেছে। এতদিন পড়িনি ভেবে খারাপও।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকে, মাথার উপর মরণের ডঙ্কা বাজে কিন্তু তার মধ্যেই উঁকি দেয় প্রেম, বেঁচে থাকে ভালোবাসা।
ভারতবর্ষের এক লেখক যিনি পাড়াগাঁয়ের গল্প লিখে মানুষকে মোহিত করতেন, সেই মানুষ নাকি জাপান ও চীনের যুদ্ধ নিয়েও একখানা বই লিখেছেন এবং তার মাঝেও ভালোবাসা দেখিয়েছেন--এটা ভাবতেও তো ভালো লাগে।
ব্যস্ত দিনে বিভূতিভূষণের একটা বই পড়ার সময় বের করাটাই তো কেমন আনন্দের ব্যাপার।❣️
গল্পের প্রেক্ষাপট চীন-জাপান যুদ্ধ। দুই ভারতীয় যুবক ঘটনাক্রমে হয়ে যায় এই যুদ্ধের অংশ। বইটি মূলত তাদের অভিজ্ঞতার বর্ননা। মনে হচ্ছিল আমিই যেন যুদ্ধক্ষেত্রে বর্তমান, এই বুঝি কোনো বোমা এসে পড়ল। বোমা, গোলাগুলি সাক্ষী দেয় যুদ্ধের ভয়াবহতা, মানুষের পৈশাচিক রূপ আর এ্যালিস, বিমলরা প্রমাণ করে মনুষ্যত্ববোধ।
This book reminded me of a scene from movie "the good the bad and the ugly" where captain said, "They're beginning their daily slaughter right on time".
চারিদিকে যুদ্ধের আবহ। এর চেয়ে উপযুক্ত সময় বোধহয় আর কোনোদিনই আসবে না এই উপন্যাসটি পড়ার। যদিও মন অশান্ত, ছোট্ট উপন্যাস পড়তে তাই সময়ও লাগল একটু বেশি। দুই বাঙালি যুবক সুরেশ্বর ও বিমল নিজ-নিজ কাজ (মেডিক্যাল ফিল্ডের) নিয়ে চলেছে সিঙ্গাপুর। সেখান থেকে ভাগ্যের ফেরে গিয়ে পৌঁছায় দু'জনে চিনদেশে, চিন বনাম জাপানের যুদ্ধের মাঝে। যোগ দেয় দু'জন চিকিৎসা ও ওষুধ সংক্রান্ত কাজে। সেই কাজের সূত্রেই বারংবার প্রত্যক্ষ যুদ্ধরোষের কবলে পড়া, যুদ্ধকালীন সমাজচিত্র অনুভব করা এবং যাযাবরবৃত্তি।
বিষয়বস্তু শুনে আকর্ষণীয় মনে হলেও আমার এটিকে অনেকাংশেই একটি দুর্বল উপন্যাস বলে মনে হয়েছে। তার মূল কারণ হল - ১) বাঙালি চরিত্রদের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নিয়ে গিয়ে ফেলার প্রচেষ্টা চাঁদের পাহাড়ের মতন এইবারে ততটা সার্থক মনে হল না। সবই যেন কেমন অতিরঞ্জিত। বাঙালি যুবকেরা হুট করে চিনে গিয়ে সাবলীলভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বিদেশিনী বান্ধবী জুটিয়ে স্নেহ-আদর পাচ্ছে, বুড়ো প্রফেসর ঈশ্বরীয়ভাবে সবজায়গায় গিয়ে কাব্যিক ছন্দ সার্থক করছে - সবই যেন বাস্তবের চেয়ে অনেক দূরে।
২) ঘটনাক্রম বড্ড বড্ড বড্ড বেশি রিপিটেটিভ। বারবার শুধু জাপানি বোমারু বিমান বোম ফেলছে মূল চরিত্রদের আশেপাশে আর প্রতিবারই সবাই উড়ে গেলেও আমাদের মূল চরিত্রেরা অক্ষত বেরিয়ে আসছে। একবার-দুইবার মানা যায়, তা-বলে এতবার?
৩) যুদ্ধ সংক্রান্ত সামাজিক দুঃখ প্রকটে লেখক স্টার মার্ক নিয়ে পাস করলেও যুদ্ধের খুঁটিনাটি অনেককিছু যেন বেশিই কল্পনাপ্রসূত কিংবা লজিক-বিচ্যুত। পাশে বোমা পড়ছে আর দোকানে এখনও চা খাচ্ছে সবাই - এটা কেমন কেমন না? শহরে এক জায়গাতে বোমা পড়লেও, বাকি শহর নিমেষে গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে পড়ার কথা। সেখানে বিন্দাস রিকশা অবধি মিলছে তারপরে।
৪) যুদ্ধের প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে বিশেষ আলোচনা নেই। হয়তো তৎকালীন সময়ে সেটার দরকার ছিল না কিন্তু এতদিন পরের কোনো পাঠকের কাছে দরকার আছে বইকি। হয়তো গুগলে খুঁজলেই মিলবে কিন্তু এতে করে একটা লেখা স্বয়ংসম্পূর্ণ হল না।
শেষের দুই পাতায় বেশ কাব্যি করা। পড়তে বেশ লাগে। কিন্তু সত্যি বলতে এই কাহিনির প্রপার এন্ডিং নেই। রিপিটেটিভ লুপে গল্প চালাতে চালাতে আরও আগে বা আরও কিছুটা টেনেও এই একই এন্ডিং বসিয়ে দেওয়া যেত। তাই উপসংহারের কোনো স্বতন্ত্রতা নেই এখানে।
কেবলমাত্র একমুঠো যুদ্ধের আবহ অনুভব করতে হলে তবেই এই কাহিনি পাঠ করা সার্থক। বাকিটুকু থ্রিলারের কায়দায় লেখা হলেও বিভূতিবাবুর বাকি উপন্যাসগুলির মতন মনে দাগ কাটবে না। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তাই!
পড়ে মন ভরলো না। বিভুতি অনেক বিনোদন দিয়ে লিখতে পারতেন, চাঁদের পাহাড় ধরণের লেখায় অনেক অভিযান আর উত্তেজনা ছিল। কিন্তু এটি পড়ে মনে হলো অল্প সময়ে তাড়াহুড়ো করে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছিল। কাজেই ২ তারা।
চীন জাপান যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত এই কাহিনী। গল্পের নায়ক দুই বাঙালি তরুণ,ভাগ্যচক্রে যারা চীনের সাংহাই শহরে চীনা মেডিকেল ইউনিটে যোগ দেয়। যুদ্ধের বীভৎস বর্ণনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো কাহিনীতেই, 'অল কোয়ায়েট অ্যাট দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট' উপন্যাসের সঙ্গে অনেকাংশেই তুলনা করা যায় গল্পটিকে।
সুরেশ্বর, পাঁড়াগাঁয়ের এক শিক্ষিত ছেলে, ভাগ্যের সন্ধানে ওষুধ কোম্পানির হয়ে জাহাজে চড়ে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে। সেই জাহাজেই সাক্ষাত হয় বিমলের সাথে ,যে কিনা সদ্য মেডিকেল পাশ করা বাঙ্গালি ছেলে প্র্যাকটিসের জন্য পাড়ি জমাচ্ছে সিঙ্গাপুর। একে তো বাঙ্গালি, তার ওপর ওষুধ আর রোগী নিয়ে কারবার বলেই ভাব হয়ে যায় দু’জনের। একসাথে সিঙ্গাপুরে কাজ করার ভাবনা করলেও বিধির ছিল অন্য পরিকল্পনা। ভাগ্যক্রমে, গিয়ে পড়লো যুদ্ধগ্রস্ত চীন দেশে। দু’জনেই জুড়ে গেল দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধের সাথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেভাবে ভারত উপমহাদেশকে প্রভাবিত করছে, তেমনটা চীন-জাপান যুদ্ধ প্রভাবিত করেনি বলেই হয়তো বাংলা সাহিত্যে এ নিয়ে লিখালিখি তেমন নেই। তাই বিভূতির এই লিখাটা আসলেই বেশ আলাদা। বিভূতির অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো পরিবেশের বর্ণনা দেয়া। ‘পথের পাঁচালী’, ‘আরণ্যক’ এর মতো এতেও চারপাশের পরিবেশ যেমন সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাতে যুদ্ধ পীড়িত এলাকা, সেখানকার মানুষজনের অবস্থা বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। ব্ল্যাকআউট,গোলাগুলি, ছিন্নভিন্ন লাশ, রক্তাক্ত-আহত মানুষ ইত্যাদি সব কিছুর বর্ণনায় যেন যুদ্ধের ভয়াবহতা চোখের সামনে ভেসে উঠে। এত কিছুর পরও কেন যেন মনে হয়েছে এট গল্পে লেখক ততটা আবেগ দেননি, যতটা আবেগের উপস্থিতি থাকলে মানুষের অবস্থাকে হৃদয় দিয়ে বুঝা যায়। এছাড়াও আরো কয়েকটা বিষয় খাপছাড়া এবং আবেগহীন মনে হয়েছে। যেমন- আশেপাশেই বোমা পড়ছে, মানুষ মারা যাচ্ছে, কিন্তু গল্পের প্রোটাগনিস্টদের কিছুই হচ্ছে না। ঠিক যেন সুপারহিরো গল্পের কোনো চরিত্র! আবার পাশের শহরে মৃত্যুর মিছিল চলছে, এদিকে এপারের শহরবাসীরা দিব্যি খেয়ে-ঘুরে বেরাচ্ছে। হাবভাব এমন যেন যুদ্ধ নিজের দেশে কিংবা নিজের আশেপাশে না হয়ে দূর কোনো মূলকে ঘটছে। কিংবা “পড়শির বাড়ি গেলে যাক, নিজের তো কিছু হচ্ছে না”- এমন মনোভাব। তবে নিঃসন্দেহে প্রফেসর লি, বিমল,সুরেশ্বর এবং বাকিদের সাহায্য করার মনোভাব বেশ ভালো লেগেছে। বিপদ জেনেও কত সুন্দরভাবে সবাই সাহায্য করতে এগিয়ে গিয়েছে! সবশেষে, একটুখানি খারাপ আর অনেকগুলো ভালো দিক মিলিয়ে এক বসায় পড়ে শেষ করার মতো চমৎকার একটি বই ‘মরণের ডঙ্কা বাজে’।
"মানুষ যখন দুঃখকষ্ট পায়, সব দেশে সর্বকালে তারা এক। চীন, ভারতবর্ষ, রাশিয়া, অবিসিনিয়া, স্পেন, মেক্সিকো- এদের মধ্যে দেশের সীমানা এখানে মুছে গিয়েছে ।" ~বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় ।
সুদূর ভারতবর্ষ থেকে চীন। গরিব পরিবার, গ্রাম থেকে যুদ্ধক্ষেত্র। বেকার যুবক থেকে সৈনিক। ভাগ্যের সন্ধানে রেঙ্গুন গামী জাহাজে পরিচয় হয় সুরেশ্বর আর বিমল র। সুরেশ্বর হুগলীর এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা বেকার যুবক। এক ওষুধ কোম্পানির চাকরি জোগাড় অন্যের সুপারিশে এবং তাদেরই নির্দেশে তার সিঙ্গাপুর যাত্রা। অন্যদিকে বিমল সদ্য ডাক্তারি পাস করা যুবক। এক পরিচিতি লোকের সুপারিশে তারই চিঠি নিয়ে যাচ্ছে সে সিঙ্গাপুর কর্মের সন্ধানে। গন্তব্য একই হওয়ায় জাহাজের পরিচয় আর ভাগ্যের ফেরে তাদের গভীর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। কিন্তু তাঁদের ভাগ্যে ছিল অন্যকিছু।
সেইসময় চীন আর জাপান এর মধ্যে শুরু হয় এক তুমুল যুদ্ধ। জাপানের আতর্কিত আক্রমণ, বোমা আর আধুনিক অস্ত্রের সামনে চীন টিকতে পারে না। সুরেশ্বর আর বিমলের এই সময় পরিচয় হয় এক চীনা লোকের সঙ্গে। উনি প্রস্তাব দেয় চীন যেয়ে রেড ক্রসের চিকিৎসা কর্মে যোগ দেবার। বিনিময়ে সে উচ্চ বেতনের লোভ ও দেখায়। সুরেশ্বর আর বিমল ভাবে তাঁদের বুঝি ভাগ্য দেবী সহায় হলেন। কিন্তু তারা তখন ও জানত না সামনে তাদের ভাগ্যে কি হতে যাচ্ছে। নানান ঘটনা, দুর্ঘটনায় শেষ পর্যন্ত সুরেশ্বর আর বিমলের কি হয় সেইটা পাঠকের জন্যে বরাদ্দ থাক।
এই যুদ্ধ কালীন সময়, জাপানি আক্রমণ, নিপীড়ন ও চীনের দুর্দশার কথায় এই উপন্যাসের মূল আলোচ্য। যুদ্ধের করুন কাহিনী, নারকীয়তা,অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, নির্বিচারে মানুষ হত্যা এসব কোনোদিনও কাম্য নয়। এই উপন্যাস এ আবার ও বিভূতিভূষণ মানব জীবনের করুণ অংশটিই যেন তুলে ধরেছেন।
বিভূতি-ভূষণ! নামটাই যথেষ্ট। বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতিতে এই মানুষটার ভূমিকা পরিমাপ করা অসম্ভব। অসাধারণ সব চরিত্রের অসাধারণ সব গল্পের স্রষ্টা তিনি। বিভূতিভূষণের লেখার একটা বিশেষত্ব হচ্ছে উনি উনার পাঠকদের বেঁচে থাকতে শিখিয়েছেন। উনি উপন্যাসের চরিত্রদের এমন সব প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝে ফেলেছেন যেখান থেকে বেঁচে ফেরা পুরাপুরি অসম্ভব মনে হতে পারে, মানুষ সাধারণত এই মুহুর্তগুলায় হার মেনে, নিয়তিকে ধিক্কার দিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু বিভূতি-ভূষণ দেখিয়েছেন, তুমি ভাঙবে, তুমি মোচড়াবে কিন্তু তুমি হার মানবে না। দৃঢ় মনোবলের জ্বোরে জীবনের সব প্রতিকূলতাযে দূর করা যায় তা আমি বিভূতিভূষণের উপন্যাস না পড়লে হয়ত সেই নজরে কখনোই জানতে পারতাম না। বিভূতিভূষণের মরণের ডঙ্কা বাজে উপন্যাসে উনি আমাদের নিয়ে গিয়েছেন চীন এবং জাপানের যুদ্ধের মধ্য স্থানে। আমি চীন জাপানের যুদ্ধ দেখি নাই কিন্তু এই বইটা পড়তে পড়তে আমি কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম জাপানিজ বাহিনীদের বর্বরতা। শুনতে পাচ্ছিলাম মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বোম্বার বিমানের আওয়াজ, মার্শালের শব্দ। এতটা নিখুঁত ভাবে প্রতিটা জিনিস উনি ফুটিয়ে তুলেছেন। এই বইটা, আমার মতে খুব আন্ডারেটেড। ওনার বাদ বাকি জনপ্রিয় বই যেমন পথের পাঁচালী, অপরাজিত, চাঁদের পাহাড়, আরণ্যকের মতন এটা তেমন অ্যাপ্রেসিয়েশন পায় নাই। কিন্তু বইটা সত্যিকার অর্থে আরো আরো রিকগনিশন ডিসার্ব করে।
আমার খুববববব করে ইচ্ছা আছে বিভূতি রচনাবলিটা নিজের সংগ্রহে রাখতে। আল্লাহ কী আমাকে সেই তৌফিক দিবেন?
#bookreview বিমল মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে সিঙ্গাপুর যাচ্ছে ডাক্তারি করতে। আর সুরেশ্বর ওষুধ ব্যবসায়ী ফার্মের ক্যানভাসার হয়ে যাচ্ছে । দুইজনের-ই পরিচয় জাহাজে৷ জাহাজ বিভিন্ন বন্দরে যাত্রা বিরতি করে পৌছাল সিঙ্গাপুর। তাঁরা সিঙ্গাপুর পৌছে একটি ভারতীয় হোটেলে উঠল। রাতে কে যেন তাদের রুমে একটি চিরকুট ফেলে যায়৷ তাতে লেখা থাকে, আপনারা বোটানিক্যাল গার্ডেনে আসুন এবং আমাদের সাথে দেখা করুন।
পরদিন দুইজন নির্দিষ্ট স্থানে যায়। দেখা পায়, সুব্বা রায় ও মি.আ-চিনের। মি.আ-চিন বলে, আমাদের দেশে (চীন) জাপানিরা হামলা করেছে। আপনারা যেহেতু ডাক্তার, আপনারা চীনে যাবেন আর চীনের মানুষদের চিকিৎসা সহায়তা করবেন৷ আপনাদের সহায়তা কামনা করছি, বিনিময়ে আপনারা মাসিক ২০০ ডলার করে পাবেন৷
দু'জনেই রাজি হয়ে গেল। যতটা পেশাদারিত্ব থেকে তার চেয়ে বেশি মানবিক দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় নিয়ে রাজি হয়েছে৷ তাদের জাহাজে করে চীন কর্তৃপক্ষ সাংহাই শহরে নিয়ে যায়। তারপর থেকে নিজ চোখে দেখেছে জাপান কর্তৃক চীনে চালানো ধ্বংসলীলা, হ' ত্যাকাণ্ড, বো*মা ইত্যাদি।
তাছাড়া চীনে দেখা হয়, প্রফেসর লিও, এলিস ও মিনি`র সাথে৷ তারাও এসেছে চীনের মানুষদের সহযোগিতা করতে৷
আমার কাছে এভারেজ লেগেছে। তবে চীন- জাপান যুদ্ধ সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়েছি৷ মূলত, এটা চীন-জাপান প্রথম যুদ্ধ নাকি দ্বিতীয় যুদ্ধ এটা লেখক স্পষ্ট করেননি। প্রথম যুদ্ধটা হয়েছিল ১৮৯৪- ৯৫ সালে। আর লেখকের জন্ম ১৮৯৪ সালে। দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৩৭- ৪৫ সালে। দ্বিতীয়টা হতে পারে৷
বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ সংক্রান্ত বই আমি এর আগে তেমন খুব একটা পড়িনি। হিটলার - নাৎসি - হলোকস্ট সম্পর্কে যা পড়েছি সবই ইংরেজিতে লেখা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের ভূমিকা নিয়ে ইংরেজিতেই বই কম। দুয়েকটা খুব বিখ্যাত রচনা ছাড়া জাপানের বর্বরতা এবং আগ্রাসন সম্পর্কে তেমন কোন আলোচনা হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খলনায়ক হিসেবে জার্মানি এবং ইতালিকেই চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু যে কাজটা ইংরেজি সাহিত্যিকরা করেননি, সেই কাজ আমাদের প্রিয় বিভূতি বাবু করে দিয়েছেন। বিমল ও সুরেশ্বর, দুই অতি সাধারণ বাঙালি তরুণ। তারা পাড়ি দিল সুদূর সিঙ্গাপুর চাকরির খোঁজে। কিন্তু সেই দেশে তখন যুদ্ধের দামামা বাজছে। দুজনেই ভাগ্যের ফেরে চিনাদের হয়ে জাপানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। চোখের সামনে দেখলো জাপানিদের নিষ্ঠুরতার নিদর্শন। শিউরে ওঠার মতো ভয়ংকর সেই বর্ণনা। যারা বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী বা চাঁদের পাহাড় পড়েছেন, তারা সম্পুর্ণ অচেনা এক লেখককে এই বইতে পাবেন। সত্যি বলতে আমি এই বইটার নাম শুনিনি আগে, গপ্পো মীরের ঠেকে দেখলাম আপলোড হয়েছে। তারপর সেখানেই শুনলাম। অভিভূত হয়ে গেছি।
সুরেশ্বর গ্রামের ছেলে। চাকুরী নিয়ে রেঙ্গুন-সিঙ্গাপুর চলেছে। যাত্রাপথে স্টিমারে সদ্যপাস করা ডাক্তার বিমলের সাথে আলাপ। বিমল সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে প্র্যাকটিস করতে। দুজনের ভাব জমে যায়। কিন্তু সিঙ্গাপুর অব্দি এসে সব উলটপালট হয়ে যায়। তখন চীন-জাপান যুদ্ধ চলছে। জাপানের আক্রমণে চীনের অবস্থা করুণ। সুরেশ্বর আর বিমল স্বেচ্ছাসেবক হয়ে চীনে চলে যায় চিকিৎসাসেবা দিতে। সেখানে তাদের সাথে দেখা হয় চৈনিক প্রফেসর লি, মার্কিন নার্স এ্যালিস ও মিনি'র সাথে। যুদ্ধের নৃশংসতা দেখতে থাকে তারা, সাথে চালিয়ে যায় তাদের সেবাব্রত। এদিকে ঘটে দুর্ঘটনা, এ্যালিস ও মিনি গুম হয়ে যায়। বিমল আটক হয় চীনাদের হাতে।
যুদ্ধের ভয়াবহতা সকরুণভাবে চিত্রিত করেছেন বিভূতিভূষণ তার এ উপন্যাসে। আর আছে কিছু সুন্দর সম্পর্কের গল্প।
সুরেশ ও বিমল দুইজন অপরিচিত মানুষ কিন্তু একই উদ্দেশ্যে একি দেশে তাদের যাত্রা। সেখান থেকেই তাদের পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে বাঙালি চরিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরেছেন তা হচ্ছে নিজ জাতির লোকদের ভালবাসা এবং অপরিচিত জাইগাতেও স্বদেশী লোক অপরিচিত হলেও তাকে একান্ত আপন বন্ধু বানিয়ে নেয়া। এরপর তিনি তুলে ধরেছেন দুই বন্ধুর দুঃসাহসিক অ্যাডভেনচার এর বর্ণনা। তবে উপন্যাসটির মুখ্য বিষয় হচ্ছে চীনা-জাপান ওয়ার এবং জাপানিসদের চালানো নির্মম গণহত্যার দৃশ্য চিত্রায়ন। একটি জাতি শুধু নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় প্রমান করতে কি নৃশংস ও অমানবিক রুপ ধারণ করতে পারে তা তিনি খুব ভালভাবে তুলে ধরেছেন। সর্বোপরি একটি ধ্বংস একটি নতুন কিছু গড়ার আশা দেখিয়ে যাই সেই দিকটাও তিনি উল্লেখ করতেও ভুলে যান নি।
সুন্দরপুরের এক তরুণ সুশীল, তার মামাত ভাই সনৎ, সঙ্গী জামাতুল্লা ও ইয়ার হোসেন যাত্রা করতে থাকে ভারত মহাসাগরের এক দ্বীপে এক অজানা ধনভান্ডারের খোঁজে। এই বইয়ের কাহিনীও বিস্তৃত হতে থাকে সুন্দরপুর থেকে কোলকাতা, রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর, সুরাবায়া, বোর্নিও অঞ্চলের দ্বীপপুঞ্জের মাঝে। অজানা শত্রু, শ্বাপদসংকুল অরণ্য, মৃত্যুফাঁদ, দুঃস্বপ্ন সবমিলিয়ে দুর্দান্ত এক অভিযান। ঘরে বসেও ঝড়-ঝঞ্ঝামুখর ভারত মহাসাগরের বুকে বিচরণ করতে খারাপ লাগার কথা নয়।
ব্যক্তিগত মতামত, বইয়ের শেষটা আরেকটু অন্যরকমভাবে হলেও হতে পারতো। একটু হুট করেই শেষ হয়ে যায়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই পড়া মানে ভ্রমণে বের হওয়া এবং সেটা অ্যাডভেঞ্চার ধরনের। চাঁদের পাহাড়, হীরামানিক জ্বলে’র মতো ‘মরণের ডঙ্কা বাজে’ বইটিও একই ধরনের। বইয়ের উপর হুমড়ি খেয়েই নিজেকে যুদ্ধ কবলিত সাংহাই নগরীর পথে প্রান্তে ঘুরিয়ে আনলাম। বইটি জাপান ও চীন যুদ্ধের কাহিনি অবলম্বনে রচিত। দুজন ভারতীয় বাঙালি ভাগ্য অন্বেষণে সিঙ্গাপুরে যায়। সেখান থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার জন্য চীনে যায়। এ কাজের সূত্রে দুজন মার্কিন তরুণীর সাথে তাদের দেখা হয়। পরবর্তীতে যুদ্ধ বিধ্বস্ত চীনে তারা পদে পদে বিপদের সম্মুখীন হতে থাকে। সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় সাবলীল ও সুখপাঠ্য একটি বই।