পড়াশোনায় হরিবন্ধুর মন ছিলো না মোটেও। ক্লাস সেভেনে তিনবার ফেল করার পর তাকে পাঠানো হলো মোতিগঞ্জের এক স্কুলে, গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করায় নামডাক আছে তাদের। কিন্তু পাকেচক্রে মোতিগঞ্জের এক অদ্ভুত কিংবদন্তীর সঙ্গে হরিবন্ধু জড়িয়ে যায়। দয়ালু এক পাগলাটে সাহেব অনেক আগে ডাকাতদের হাতে খুন হয়েছিলেন। সেই সাহেব নাকি এখনো মাঝে মাঝে দেখা দেন। তাঁর কবরটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে অনেকে। কিন্তু কেন?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একজন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক।
তিনি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত ময়মনসিংহে (বর্তমানে বাংলাদেশের অংশ) জন্মগ্রহণ করেন—যেখানে তাঁর জীবনের প্রথম এগারো বছর কাটে। ভারত বিভাজনের সময় তাঁর পরিবার কলকাতা চলে আসে। এই সময় রেলওয়েতে চাকুরিরত পিতার সঙ্গে তিনি অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে তাঁর জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। শীর্ষেন্দু একজন বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত।
তাঁর প্রথম গল্প জলতরঙ্গ শিরোনামে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাত বছর পরে সেই একই পত্রিকার পূজাবার্ষিকীতে তাঁর প্রথম উপন্যাস ঘুণ পোকা প্রকাশিত হয়। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি।
পর পর তিনবার ফেল করেছে ক্লাস সেভেনে। স্কুল থেকে হরির বাবা গগন ডাক্তার কে ডেকে নিয়ে বলল, আপনার ছেলেকে রাখা আর সম্ভব নয়, স্কুলের বদনাম হচ্ছে। গগন ডাক্তার মন খারাপ করে চেম্বারে গেলেন। হরি যে শুধু পড়ালেখাতেই খারাপ তা নয়, ওর অন্য কোনও গুনও নেই। তখন হঠাৎ গগন বাবুর এক রোগী দুখিরাম নাম, সে বলল মোতিগঞ্জ নামে একটা জায়গায় চারুবালা বেঙ্গলি স্কুল নামে একটা স্কুল আছে। ওদের কাজই হচ্ছে গাধা পিটিয়ে মানুষ করা। ওখানে আমার একটা বাড়িও কেনা আছে। তুমি চাইলে হরি সেখানে থেকে লেখাপড়া করতে পারে। অতএব হরিকে জোড় করে মোতিগঞ্জ পাঠিয়ে দেয়া হল। ছোট ভাইবোন, ঠাম্মা, মা কে ছেড়ে যেতে হরির খুব কষ্ট হচ্ছিল।
কিন্তু বাবার উপর কথা বলার ক্ষমতা এ বাড়ির কেউ নেই। মোতিগঞ্জ জায়গা টা ভালই। পাহাড়ঘেরা একটা ছোট্ট গঞ্জ এলাকা। খুবই স্বাস্থ্যকর জায়গা। তবে স্কুল দেখে হরির মনটাই দমে গেল। জেলখানার মত দেখতে দুতলা বিল্ডিং উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। নিয়মকানুনও অনেক কড়া। প্রথম ক্লাসেই দামড়া দামড়া ছেলেদের মার খেতে হল, ওদের সব কথা শুনতে হল। মাঠে গরু সেজে ঘাস খাওয়ার অভিনয় করতে হল। তবে এতকিছুর মধ্যেও গোপাল নামে একজন বন্ধুও জুটে গেল। গোপালকে এমনকি বাকি দামড়া ছেলেরাও সামঝে চলে। কেন, সেটা অবশ্য হরি জানেনা। হরি যে বাড়িতে থাকে সেখানে হঠাৎ পটল দাস নামে এক চোরের সাথে পরিচয় হল হরির। পটল দাস এখন আর চুরি করেনা, বয়স হয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে বিদ্যেটা ঝালাই দিতে এর বাড়ি ওর বাড়ি ঢুকে। এর সাথেও হরির বন্ধুত্ব হয়ে গেল। গোপাল এবং পটল দাসের কাছে হরি জানতে পারল পাগলা সাহেবের কথা।
আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে পাগলা সাহেব এ অঞ্চলে ব্যবসা করে দুহাতে কামিয়েছেন। এবং সেটা খরচও করেছেন মোতিগঞ্জের মানুষের জন্য। সবাই পাগলা সাহেব কে ভক্তি শ্রদ্ধা করে চলত। সেই সাহেব হঠাৎ করে মারা গেলে তাকে তার শিষ্যরা গোপনে কবর দিয়ে দেয়। কথিত আছে পাগলা সাহেব নাকি এখনও ঘোড়ায় চেপে মোতিগঞ্জের রাস্তায় ঘুড়ে বেড়ান। মানুষের বিপদ আপদে সাহায্য করেন। এমনকি গোপালের সাথে বন্ধুত্ব করায় যখন বাকি ছেলেরা একদিন হরিকে মারছিল, তখন পাগলা সাহেব ঘোড়া নিয়ে ছুটে আসতেই তারা পালিয়ে যায়। লোকজন বলে পাগলা সাহেবের কবর যদি অপরিচিত মানুষের গোচরে চলে আসে তাহলে আর পাগলা সাহেব দেখা দেবেন না। এদিকে শহরে কিছু অচেনা মানুষ ঘুরাঘুরি করছে। তারা পাগলা সাহেবের কবর খুঁজছে।
পাগলা সাহেবের কফিনে একটা সোনার যীশুর ক্রস আছে যেটার দাম কয়েক লক্ষ টাকা। সেটার জন্যই তারা উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের হাত থেকে পাগলা সাহেবের কবর কে বাচাতে হলে শহরের মানুষের আগে খুঁজে পেতে হবে কবর। তারপর তারা পাহারা দেবে। কিন্তু কিভাবে খুঁজে পাবে? কবরটা খুঁজে পাওয়ার একটা সঙ্কেত আছে। দেখুন আপনারা খুজে বের করতে পারেন কিনা। হরি কিন্তু ঠিক পারবে। ছুটেও নয়, হেটেও নয়, সাপের মত কাছেও নয়, দূরেও নয়, গভীর কত আলোও নয়, অমাও নয়, যায় যে দেখা আজও নয়, কালও নয়, ভাগ্যে লেখা|
'মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি' বনাম 'পাগলা সাহেবের কবর' - অদ্ভুতুড়ে সিরিজের সবচেয়ে প্রিয় কোনটা তা নিয়ে মনে মনে দীর্ঘ লড়াই চলে। একসময় ক্ষান্ত দেয় মন। স্বীকার করে নেয় না বাপু, 'পাগলা সাহেবের কবর' একমেবাদ্বিতীয়ম গোত্রের লেখা। এখানে মনোজদের বাড়ির মতো ছবি খোঁজার রহস্য নেই। কিন্তু যা আছে তা রহস্যের চাইতে বেশি কিছু। শুরুতে কৌতূহল ও শেষ পর্যন্ত টানটান একটা উত্তেজনা বইটার সবচেয়ে বড়ো সম্পদ।
'পাগলা সাহেবের কবর'কে অনেকেই ধ্রুপদী কিশোরসাহিত্য বলে কবুল করতে চাইবেন না। আমার কাছে এই বই কালজয়ী কিশোরসাহিত্যের কম না। বারবার পড়ার মতো। এত ভয় ও উত্তেজনার পর চমৎকার আশাজাগানিয়ার বার্তার মাধ্যমে সমাপ্তি আমার অন্যতম প্রিয় বই 'পাগলা সাহেবের কবর'-এর।
ওরে মহিষাসুর, ছোটবেলার পড়া বই ভুলে মেরে দিলে আনতাবড়ি ভুলভাল রেটিং দিতে নেই। গাম্বাট, পাপ পুন্য বুঝিস? পাগলা সাহেবের কবরকে ৫/৫ এর কম কিছু দেয়া হলো মহাপাপ , ঘোর অনাসৃষ্টি। সেকেন্ড বেস্ট এভার। না, ভুল হলো. বেস্ট অদ্ভুতুড়ে এভার। কারণ ' বক্সার রতন ' অদ্ভুতুড়ে নয়।
গল্পের সাসপেন্স নষ্ট হয় নি কখনো, পড়ার সময় শুধু মনে হলো এরপর কি হতে পারে? তবে আসলেই কি হতে পারে তা গল্প না পরলে বুঝা দায়। এই রচনা পড়তে পড়তে কেউ বোর হবে না আমার বিশ্বাস। চারিত্রিক বর্ণনা,হাস্যরস, এসবের দিক দিয়েও নিখাদ রচনা।উপন্যাসিকার মোরাল দিকও বহন করে। সব শেষে কাহিনীর জট খোলার ব্যাপারটি ছিল দারুণ!
এই ধাঁধার সমাধা হলেই,মিলবে "পাগলা-সাহেবের করব"। হেথায় আছে মণিরত্নাদি। তবে আর দেরি কেন,মগজ খাটান আর খুঁজতে থাকুন। হিহি..
❝অদ্ভুতুড়ে সিরিজ❞ এর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, "গাদা খানেক ভূত থাকবে,একজন হাবাগোবা ভুলোভালা লোক থাকবে,ছিঁচকে চোর থাকবে, আর পুরো গল্প জুঁড়ে থাকবে রম্যের ছড়াছড়ি "। এই মূলত অদ্ভুতুড়ে। কিন্তু " পাগলা সাহেবের কবর" সে দিক থেকে বেশ ভিন্ন। এই গল্পের শুরু রহস্য ডালপালা মেলতে থাকে। ধীরে ধীরে জমাট কুয়াশার মত জমে যায় রহস্য। হাসির খোরাক একটু কম বটে। পটলদাস না থাকলে সেটুকু ও থাকতে না। পটল দাসের নাম যখন নিলাম,তার একটা উক্তি বলে যাই ❝ঠান্ডা খিঁচুড়ি আর গোবরে তফাত নেই❞। হাহাহা।
এই যে আগাগোড়া রহস্যে মোড়ানো, এটাই গল্পটাকে বিশেষ ভাবে আলাদা করল। শুধু মাত্র এই কারণেই, সিরিজের প্রথম সারিতে থাকবে "পাগলা সাহেবের কবর" ।
"জুড়িয়ে গেলে খিচুড়ি আর গোবরে তফাৎ থাকে না।" -কেবল এই একটি উক্তির জন্যই বইটাকে পাঁচ তারা দেওয়া যেত। তার উপর এসে জুটেছে পটল দাস! একেবারে সেরা চরিত্র। তার উপর একটা গোছানো সমাপ্তি। আর কি চাই! পাগলা সাহেবের কবর এক কথায় দারুন লাগল।
অদ্ভুতুড়ের বই পড়া হিসেবে এ-ই প্রথম। পিডিএফ পড়া ধাতে সয় না, আবার আনন্দের গলাকাটা দামের জন্য পুষিয়েও ওঠে না। তারজন্য সিরিজ শুরু করতে এতোটা দেরি। যদিও শেষেরদিকে এসে মনে হচ্ছিল হররের দিকে মোড় নেবে না, কিন্তু ওটাই হোলো। তবুও বেশ উপভোগ্য লেগেছে। এরপর 'মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি' পড়ার ইচ্ছে আছে।
উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে এক ধরনের নস্টালজিয়া এবং শিহরণ তৈরি হয়। ব্যক্তিগত নস্টালজিয়ার কারণ এইটাই যে এটি আমার জীবনের সর্বপ্রথম পঠিত পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। আমি তৃতীয় শ্রেণীতে তখন। কাহিনির বাঁক পরিবর্তন, রহস্যময় চরিত্র এবং অতিপ্রাকৃততার সূক্ষ্ম উপস্থিতি বইটিকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তবে যারা শুধুমাত্র যুক্তিনির্ভর বাস্তবধর্মী কাহিনি পছন্দ করেন, তাদের জন্য এটি কিছুটা অবাস্তব মনে হতে পারে। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেন এক রহস্যময় ইংরেজ সাহেব, যিনি ভারতের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে আশ্চর্যজনক কিছু ঘটনার সূত্রপাত করেন। তাঁর আশ্চর্য জীবনযাত্রা, রহস্যময় ব্যবহার এবং স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কাহিনি এগিয়ে চলে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উপস্থিতি এক কিংবদন্তিতে রূপ নেয়, এবং মৃত্যুর পরও তাঁকে ঘিরে নানা গুজব ও অলৌকিক কাহিনি প্রচলিত হয়ে পড়ে। এই উপন্যাসটিতে শীর্ষেন্দু বাবু একদিকে যেমন ঔপনিবেশিক শাসনের ছায়া তুলে ধরেছেন, তেমনি মানুষের কুসংস্কার, বিশ্বাস এবং ইতিহাসের বিকৃতির বিষয়গুলোও দারুণভাবে উপস্থাপন করেছেন। ইংরেজদের ভারতীয় সমাজে প্রভাব, স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সংঘর্ষ এবং সাধারণ মানুষের চোখে এক বিদেশির রূপান্তর—এসব উপন্যাসের মূল থিম হয়ে উঠেছে। উপন্যাসে অতিপ্রাকৃত ও বাস্তবতার মিশ্রণ লক্ষণীয়। শীর্ষেন্দু তাঁর স্বভাবসুলভ শৈলীতে অতিপ্রাকৃত কাহিনির আবরণে বাস্তবতার গভীর সত্য প্রকাশ করেছেন। মানুষের মানসিকতা, ভয়ের মনস্তত্ত্ব এবং রহস্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ এখানে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। উপন্যাসটি রহস্যপ্রিয় পাঠকদের জন্য এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। ইতিহাস, কুসংস্কার, অতিপ্রাকৃততা ও সমাজমনস্তত্ত্বের এক অসাধারণ সংমিশ্রণ এই উপন্যাস, যা পাঠককে এক অন্য জগতে নিয়ে যাবেই যাবে। না পড়া থাকলে পড়ে ফেলুন অনতিবিলম্বে।
গগন ডাক্তারের বড় ছেলে হরিবন্ধু। বেচারা পড়ালেখায় এক্কেবারে গবেট। প্রত্যকটা ক্লাসে দুই তিন বার করে থেকে তারপর টপকাতো। কিন্তু ক্লাস সেভেনটা সে কোন রকম টপকাতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত স্কুল থেকে তাকে বের করে দিল।
তখন গগন ডাক্তার তাকে মোতিগঞ্জ নামক একটা স্কুলে পাঠিয়েছেন। কারণ সে স্কুল গাধা পিটিয়ে ভালো বানানো হয় বলে সুনাম আছে।
বেচারা হরির হলো দুঃখ। সব ছেড়ে তাকে চলে আসতে হল মোতিগঞ্জ। জায়গাটা বড্ড সুন্দর, তবে কেমন যেন সন্দেহজনক। এইরকম একটা জায়গায় হরিকে থাকতে হবে একা! সেই দুঃখে বেচারা একেবারে কাহিল!
এক দুঃখে হরি বাঁচে না,তার উপর জুটল আরেক মহা দুঃখ। এলাকার কিংবদন্তি আছে, এখানে এক পাগলা সাহেবের কবর আছে। সে কবরে আছে মহামূল্যবান রত্ন। সেই রত্নের খোঁজের ব্যাপার নিয়ে বিরাট একটা ঝামেলায় পড়ে গেল নিরপরাধ হরি!
শ্রদ্ধেয় শীর্ষেন্দু মুখুজ্জের কিশোর উপন্যাস গুলোর পড়ার অন্যতম ভালো দিক হচ্ছে, মুহূর্তের জন্য যেন চারপাশের সব কাঠিন্য ভুলে থাকা যায়। এ এক অপার্থিব আনন্দ। যত দিন পড়া লেখা করব ততদিন আমি শীর্ষেন্দু বাবুর "কিশোর উপন্যাস " পড়ব,এই অপার্থিব আনন্দ আস্বাদনের লোভে।
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ এর বইগুলোতে প্রায়শয়ই প্রেডিক্টেবল কাহিনী থাকে। আমার অবশ্য তাতে কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু এই বইটিতে কিন্তু ওই "এই তো কাহিনী বুঝে ফেললুম" ব্যাপারটা নেই। শুরু থেকে শেষ অব্দি কি হতে পারে কি হতে পারে ভেবে এগোলাম। মনোজ এর পর এইটাই বোধহয় আমার দেয়া পাঁচ তারকা।
অদ্ভুতুড়ে সিরিজের বইগুলোর একটা সাধারন বৈশিষ্ট্য বলতে চাইলে প্রথমেই আসে হাস্যরস, এবইতে কিন্তু সেটা অনুপস্থিত। তবে, হাস্যরসের এই অভাব ষোল আনা পুষিয়ে দিয়েছে সাসপেন্স। টানটান উত্তেজনা ছিল পুরোটা বই জুড়ে। শীর্ষেন্দুর সাবলীল লেখনী ভালো লাগার মাত্রা অনেকগুন বাড়িয়ে দেয়।
এই ধরনের "কিশোর" উপন্যাস পড়ার বয়স বোধ হয় পেরিয়ে এসেছি। যতটা প���রত্যাশা ছিল, ততটা ভালো লাগেনি। হয়তবা ছোটবেলায় পড়লে অনুভূতি অন্যরকম হতো, আরও বেশি ভালো লাগত।
পড়ালেখায় মন নেই হরিবন্ধুর। পর পর তিনবার ফেল করেছে ক্লাস সেভেনে। স্কুল থেকে হরির বাবা গগন ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে বলল, আপনার ছেলেকে রাখা আর সম্ভব নয়, স্কুলের বদনাম হচ্ছে। গগন ডাক্তার মন খারাপ করে চেম্বারে গেলেন। হরি যে শুধু পড়ালেখাতেই খারাপ তা নয়, ওর অন্য কোনও গুনও নেই। তখন হঠাৎ গগন বাবুর এক রোগী দুখিরাম নাম, সে বলল মোতিগঞ্জ নামে একটা জায়গায় চারুবালা বেঙ্গলি স্কুল নামে একটা স্কুল আছে। ওদের কাজই হচ্ছে গাধা পিটিয়ে মানুষ করা। ওখানে আমার একটা বাড়িও কেনা আছে। তুমি চাইলে হরি সেখানে থেকে লেখাপড়া করতে পারে।
অতএব হরিকে জোড় করে মোতিগঞ্জ পাঠিয়ে দেয়া হল। ছোট ভাইবোন, ঠাম্মা, মা'কে ছেড়ে যেতে হরির খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু বাবার উপর কথা বলার ক্ষমতা এ বাড়ির কারো নেই। মোতিগঞ্জ জায়গাটা ভালই। পাহাড়ঘেরা একটা ছোট্ট গঞ্জ এলাকা, খুবই স্বাস্থ্যকর জায়গা। তবে স্কুল দেখে হরির মনটাই দমে গেল। জেলখানার মত দেখতে দুতলা বিল্ডিং উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। নিয়মকানুনও অনেক কড়া। প্রথম ক্লাসেই দামড়া দামড়া ছেলেদের মার খেতে হল, ওদের সব কথা শুনতে হল। মাঠে গরু সেজে ঘাস খাওয়ার অভিনয় করতে হল।
তবে এতকিছুর মধ্যেও গোপাল নামে একজন বন্ধুও জুটে গেল। গোপালকে এমনকি বাকি দামড়া ছেলেরাও সমঝে চলে। কেন, সেটা অবশ্য হরি জানে না। হরি যে বাড়িতে থাকে সেখানে হঠাৎ পটল দাস নামে এক চোরের সাথে পরিচয় হল। পটল দাস এখন আর চুরি করে না, বয়স হয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে বিদ্যেটা ঝালাই দিতে এর বাড়ি ওর বাড়ি ঢুকে। এর সাথেও হরির বন্ধুত্ব হয়ে গেল। গোপাল এবং পটল দাসের কাছে হরি জানতে পারল পাগলা সাহেবের কথা।
আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে পাগলা সাহেব এ অঞ্চলে ব্যবসা করে দুহাতে কামিয়েছেন। এবং সেটা খরচও করেছেন মোতিগঞ্জের মানুষের জন্য। সবাই পাগলা সাহেবকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে চলত। সেই সাহেব হঠাৎ করে মারা গেলে তাকে তার শিষ্যরা গোপনে কবর দিয়ে দেয়। কথিত আছে পাগলা সাহেব নাকি এখনও ঘোড়ায় চেপে মোতিগঞ্জের রাস্তায় ঘুড়ে বেড়ান। মানুষের বিপদ-আপদে সাহায্য করেন। এমনকি গোপালের সাথে বন্ধুত্ব করায় যখন বাকি ছেলেরা একদিন হরিকে মারছিল, তখন পাগলা সাহেব ঘোড়া নিয়ে ছুটে আসতেই তারা পালিয়ে যায়। লোকজন বলে পাগলা সাহেবের কবর যদি অপরিচিত মানুষের গোচরে চলে আসে তাহলে আর পাগলা সাহেব দেখা দেবেন না।
এদিকে শহরে কিছু অচেনা মানুষ ঘুরাঘুরি করছে। তারা পাগলা সাহেবের কবর খুঁজছে। পাগলা সাহেবের কফিনে একটা সোনার যীশুর ক্রস আছে যেটার দাম কয়েক লক্ষ টাকা। সেটার জন্যই তারা উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের হাত থেকে পাগলা সাহেবের কবরকে বাঁচাতে হলে শহরের মানুষের আগে খুঁজে পেতে হবে কবর। তারপর তারা পাহারা দেবে। কিন্তু কিভাবে খুঁজে পাবে?
কবরটা খুঁজে পাওয়ার একটা সঙ্কেত আছে। দেখুন আপনারা খুজে বের করতে পারেন কিনা। হরি কিন্তু ঠিক পারবে।
ছুটেও নয়, হেটেও নয়, সাপের মত কাছেও নয়, দূরেও নয়, গভীর কত আলোও নয়, অমাও নয়, যায় যে দেখা আজও নয়, কালও নয়, ভাগ্যে লেখা
এখন পর্যন্ত যে কটা অদ্ভুতুড়ে পড়েছি তার মধ্যে এটাই বেস্ট। প্রাচীন কবর, পাগলা সাহেবের ঘোড়া, সুড়ঙ্গ, খুঁজে পাওয়ার সংকেত, ওফ ভাবতেই আবার থ্রিল হচ্ছে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “অদ্ভুতুড়ে” সিরিজের নবম কিস্তি পাগলা সাহেবের কবর একটি রহস্যে মোড়ানো, রোমাঞ্চকর এবং খানিকটা ভৌতিক ছোঁয়াযুক্ত কিশোর উপন্যাস। এই সিরিজের অন্যান্য গল্পের মতো এটিতেও রয়েছে এক রহস্যময় আবহ, স্মার্ট বাচ্চা চরিত্র, এবং বাস্তব-অবাস্তবের মাঝে এক দারুণ টানটান উত্তেজনা।
গল্পটি ঘোরে একটি পুরনো জমিদারবাড়ি ও তার চত্বরে অবস্থিত এক রহস্যজনক কবর ঘিরে, যেটি স্থানীয়রা “পাগলা সাহেবের কবর” নামে চেনে। লোককথা ও ভয়ের গল্পে মোড়ানো সেই কবরকে ঘিরে ছড়িয়ে আছে বহু গুজব—কেউ বলে সেখানে রাত হলে অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়, কেউ বা দেখেছে ছায়ামূর্তি ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু, এইসব গুজব সত্যিই কি ভৌতিক? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোন সত্য? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই কাহিনিতে হাজির হয় আমাদের প্রিয় কিছু পরিচিত চরিত্র—তরুণ তদন্তকারী, তাদের জ্ঞানী গাইড এবং স্থানীয়দের মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
প্রতিটি চরিত্র স্বতন্ত্র ও জীবন্ত। শিশু ও কিশোর পাঠকদের মানসিকতায় গল্পটি দারুণভাবে মিশে যায়। সাহস, কৌতূহল আর যুক্তিবোধ মিলিয়ে গল্পের চরিত্রগুলো একেবারে বাস্তব মনে হয়। শুরু থেকেই লেখক পাঠককে একটি অদ্ভুত আবহে নিয়ে যান। রহস্য ও ভয়ের মিশ্রণে গড়ে ওঠা কাহিনি একবার শুরু করলে শেষ না করে রাখা মুশকিল। এই গল্পে শীর্ষেন্দুবাবুর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ভৌতিক ঘটনাগুলোও যুক্তিবাদী রূপ পায়, যা কিশোর পাঠকদের ভাবতে শেখায়—সব ভয়ের পেছনেই হয়তো কোনো কারণ থাকে।
গল্পের ভাষা সহজ, সাবলীল, এবং হাস্যরসের ছোঁয়া রয়েছে মাঝে মাঝে। শীর্ষেন্দুর গল্প বলার ধরনে যে মনকে টেনে রাখার জাদু থাকে, সেটি এই গল্পেও বর্তমান। কিশোর পাঠক তো বটেই, বড়রাও গল্পে টেনে পড়ে যেতে বাধ্য।
গল্পটি কেবলমাত্র ভয়ের উপাদান নয়, বরং এতে রয়েছে—কুসংস্কার বনাম বিজ্ঞান, সত্য উদ্ঘাটনের কৌতূহল এবং বন্ধুত্ব ও সাহসের উদাহরণ। যাদের অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ভালো লেগেছে বা যারা কিশোর রহস্য ও হালকা ভৌতিক গল্প পছন্দ করেন, তাদের জন্য পাগলা সাহেবের কবর নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার পছন্দ।
“পাগলা সাহেবের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে রাতের নিস্তব্ধতায় কেউ যেন ফিসফিস করে কিছু বলছিল। কিন্তু আশেপাশে তো কেউ নেই!”
এই ধরনের বর্ণনায় গল্পটি পাঠককে ঠান্ডা হাওয়ার মতো শিহরণ জাগাতে সক্ষম।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “পাগলা সাহেবের কবর” পাঠককে একটি টানটান রহস্যযাত্রায় নিয়ে যায়, যেখানে ভয় আর বুদ্ধিমত্তার দোলাচলে কাহিনির আসল রূপ উন্মোচিত হয় ধীরে ধীরে। কিশোর পাঠকদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি মনে রাখার মতো পড়া।
গগন ডাক্তারের বড় ছেলে হরিবন্ধু তিন বছর ধরে ফেল করে একই ক্লাসে পড়ছে। তার ছোট ভাই বোনেরা তার চেয়ে উঁচু ক্লাসে পড়ে। স্কুলের রেকর্ড যাতে খারাপ না হয় তাই হেডস্যার গগনবাবুর সাথে কথা বলে হরিকে টি. সি দেন। মনের দুঃখে নিজের রোগী প্রবীণ ব্যবসায়ী দুখিরামবাবুর সাথে এ নিয়ে আলোচনা করেন গগন বাবু। দুখিরামবাবু তাঁকে পরামর্শ দেন সাঁওতাল পরগণার মোতিগঞ্জ এলাকার স্কুলে ভর্তি করে দিতে কেননা সেখানে ছাত্রদের 'গাধা পিটিয়ে ঘোড়া' বানানোর জন্য কড়া পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। মোতিগঞ্জে পৌঁছে হরি এক ��াগলা সাহেবের কথা শুনতে পায় যিনি কবরস্থ হয়েছিলেন একশ বছর আগে কিন্তু এখানকার লোকের কোন বিপদ হলেই তিনি ঘোড়া নিয়ে সেখানে পৌঁছে যান। এই পাগলা সাহেবের গলায় রয়েছে মুক্ত খচিত সোনার ক্রস যার মূল্য লাখ টাকা। ঐ ক্রসকেই হস্তগত করতে চায় অনেকে। আর একবার পাগলা সাহেবের কবর খুঁড়লে মোতিগঞ্জে আর দেখা যাবে না তাকে। কিন্তু পাগলা সাহেবের কবর কোথায়? সেটাই তো কেউ জানেনা।
"হেঁটেও নয়, ছুটেও নয়, সাপের মত। দূরেও নয়, কাছেও নয়, গভীর কত। আলোও নয়, অমাও নয়, যায় যে দেখা। আজও নয়, কালও নয়, ভাগ্যে লেখা।"
এই সাংকেতিক ছড়া মেনেই পাগলা সাহেবের কবর এর কাছাকাছি পৌঁছোনো সম্ভব। হরি কি পাবে পাগলা সাহেবের কবর এর খোঁজ? আর তার লেখাপড়ার ই বা কি হবে? জানতে গেলে পড়তে হবে এই নাতিদীর্ঘ উপন্যাসটি।
কিশোর উপন্যাস পড়তে আমার খুবই ভালো লাগে। আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজ তো খুবই জনপ্রিয়। তাই এই সিরিজের একটা বই প্রথমবার পড়লাম। পড়ে বেশ ভালো লাগলো। ছোটবেলায় পড়লে হয়তো আরও ভালো লাগতো। ভবিষ্যতে এই সিরিজের অন্যান্য অন্যান্য বইগুলো পড়ার ইচ্ছে রইলো। যারা কিশোর উপন্যাস পড়তে ভালোবাসেন, তারা অবশ্যই একবার পড়ে দেখুন।
অদ্ভুতুড়ে সিরিজের দি-বেস্ট বললেও অত্যুক্তি হবে না, অন্তত আমার মতে তো তাই! ৮৭ পাতার মিনি-বই হলে কী হবে? আস্ত একটা অ্যাডভেঞ্চার গজিয়ে উঠেছে বইটিতে। কী নেই? - একটা রহস্যময় জায়গা আছে। - একটা গোবেচারা প্রোটাগনিস্টের সবার সেরা হয়ে ওঠার গল্প আছে। - ভূত আছে। - চোর আছে। - রহস্য আছে। - ভয়ানক ভিলেন আছে। কাতুকুতু দেওয়া হাসির খোরাক অবশ্য কম আছে কিন্তু পড়ে মজা তো হবেই। হতেই হবে। পাগলা সাহেবের কবর কি আর চাট্টিখানি কথা? একটা ছোট্ট বিষয়ই শুধু ভালো লাগেনি। একটামাত্র বাক্য, যেখানে কিনা সেই ব্রাহ্মণ মানেই সম্মানীয় বলার ফিকির রয়েছে। এই বিষয়টি আজকাল একদম ভালো লাগে না। বাদবাকি কোনো অভিযোগের জায়গা নেই এইবারে! ও হ্যাঁ, দেবাশীষ দেবের অলংকরণ নেই — সেটাও একটা অভিযোগ বটে! প্রচ্ছদটা তাঁর আঁকা হলেও ঠিক জমল না...।
Hari, a simpleton who's not very bright finds himself in a strange village, enrolled in a new class because he couldn't keep his grades up. While getting accustomed to the new place, he makes a mysterious new friend, who's mere association becomes a nightmare. Hari gets to learn about Pagla Shaheber Kobor, a mystical grave which would reward the finder thousands worth of gold. Enter a gang of robbers who are looking for the grave themselves.