হরিপুর গাঁয়ে একটা সময়ে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মাঝে অনেক রেষারেষি ছিলো, কিন্তু কালক্রমে তারা সবাই পরস্পরের খুব ভালো সঙ্গী হয়ে ওঠে। গাঁয়ের একপ্রান্তে একটেরে জঙ্গুলে বাড়িতে সরলাবুড়ির আশ্রিত ছিলো শূলপাণি নামের এক খ্যাপাটে লোক। বুড়ি মারা যাবার পর সে একাই থাকতো সেই বাড়িতে, কারো সাথে বড় মিশতো না। প্রতিরাতে ঠিক আটটায় সে বিকট শব্দে হেসে উঠতো, আর গোটা গাঁ সেই শব্দ শুনতে পেতো। কিন্তু কে জানে কেন, এক রাতে শূলপাণি হাসলো না। কী হয়েছে শূলপাণির?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একজন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক।
তিনি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত ময়মনসিংহে (বর্তমানে বাংলাদেশের অংশ) জন্মগ্রহণ করেন—যেখানে তাঁর জীবনের প্রথম এগারো বছর কাটে। ভারত বিভাজনের সময় তাঁর পরিবার কলকাতা চলে আসে। এই সময় রেলওয়েতে চাকুরিরত পিতার সঙ্গে তিনি অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে তাঁর জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। শীর্ষেন্দু একজন বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত।
তাঁর প্রথম গল্প জলতরঙ্গ শিরোনামে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাত বছর পরে সেই একই পত্রিকার পূজাবার্ষিকীতে তাঁর প্রথম উপন্যাস ঘুণ পোকা প্রকাশিত হয়। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি।
হরিপুর গ্রামটার বিশেষত্ব কি? এখানে প্রতিদিন রাত আটটার সময় শূলপানি বিকট শব্দে খ্যা খ্যা করে হেসে ওঠে। বন্দুকের গুলি মিস হতে পারে, কিন্তু তার হাসি মিস হবে না। আপনার ঘড়ি স্লো হয়ে গেছে? সমস্যা নেই, তার হাসির সাথে মিলিয়ে নিন, একদম ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু একদিন হলো কি, শূলপানির হাসি শোনা গেল না। গ্রামের সবাই আতঙ্কিত। এ কি অলুক্ষণে কাণ্ড। খোঁজ নিতে জড়ো হলো গাঁ-সুদ্ধ মানুষ। কিন্তু শূলপানিকেও পাওয়া গেল না। এরপরই ঘটতে শুরু করলো একের পর এক ঘটনা।
পুরো উপন্যাস জুড়ে হাসির খোরাকের কোন অভাব নেই। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে বিশাল ভুড়িখানা নিয়ে আমি শূলপানির মত খ্যা খ্যা করে হাসছি। আবার একই লাইনটা পড়ছি, আবার হাসছি। তবে এটাকে শুধু হাসির উপন্যাস ভাবলে ভুল হবে। আগাগোড়া ছোট ছোট রহস্যে ভর্তি, একদম শেষ অবধি। রীতিমত ট্রেজার হান্টিং। ভারি ভারি বইয়ের ফাঁকে এরকম দুই একটা উপন্যাস অনায়াসে পড়ে ফেলা যায়। মনে ভালো থাকবে।
এরপর মনোজদের অদ্ভুত বাড়ী পড়বো। রিজওয়ান ভাইয়ের মতে ওটাই অদ্ভুতুড়ে সিরিজের সেরা উপন্যাস। প্রান্ত ভাইকে ধন্যবাদ এই বইটা উপহার দেয়ার জন্যে।
কি আজব! দুইজন জলজ্যান্ত মানুষ উধাও? এ কি করে সম্ভব! শূলপাণির ঘর থেকে একটা কাঠের বাক্সও সেই রাতে গায়েব হয়ে যায়। তাও আবার নগেন দারোগা, গদাই নস্করের নাকের সামনে দিয়ে। সেই বাক্সে আছে সাতটি কড়ি আর সাতটি পুরানো পয়সা। কিন্তু কি এর রহস্য? কোন গুপ্তধন??
গ্রামের নাম হরিপুর। শান্ত আরর নির্ঝঞ্ঝাট একটা গ্রাম এই হরিপুর। একটা সময় যার সাথে যার অমিল ছিলো, সম্পর্ক খারাপ ছিলো এখন তাদের মাঝেই গলায় গলায় মিল। কি অদ্ভূত গ্রামের এই মানুষগুলা। এই যেমন গ্রামের দারোগা নগেন একটা সময় নাওয়া খাওয়া ভুলে ডাকসাইটে ডাকাত সর্দার গদাই নস্করকে ধরার জন্য পাগল হয়ে ছিলো। আর এখন দুজন প্রতি সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে দাবা খেলেন। এক সনয় হরিপুর গ্রামের জমিদার ছিলেন মহেন্দ্র রায় (এখন অবশ্য সেই জমিদারি নেই) আর তখন তার রাজদ্রোহী ছিলেন পবনকুমার। পবনকে তখন ধরার জন্য উঠে পড়ে ছিলেন মহেন্দ্র। আর এখন দুজন একসাথে আড্ডা দেন। গ্রামের এলোপ্যাথি ডাক্তার শহিদলাল, হোমিওপ্যাথি বিশু দত্ত আর কবিরাজ রামহরি। একটা সময় তিনজন কেউই কাউকে দেখতে পারতেন না। আর এই বৃদ্ধ বয়সে এসে যেকোন অসুখে তিনজনই তিনজনের কাছে ছুটে যান। এরা ছাড়াও গ্রামে আছে শূলপাণি নামের একজন পাগল। কারো কাছে সে পাগল, কেউ বলে বিজ্ঞানী। একেকজন একেক কথা বলে। সেই শূলপাণি গত ত্রিশ বছর ধরে ঠিক আটটা বাজে এক অট্টহাসি দেয়। কেউ জানে না কি কারণ তার। কখনো এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় নি।
কিন্তু আজ হলো! শূলপাণি ঠিক আটটায় হাসি দেয় নি। গ্রামের সব লোক গিয়ে জড়ো হলো তার ঘরে। অদ্ভূত! শূলপাণি ঘরে নেই। ঠিক তার পরদিন সকালে গ্রামের লোক জানতে পারলো গ্রামের পরঞ্জয় বাবুও ঘরে নেই।
নিঃসন্দেহে আমার পড়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ শীর্ষেন্দুর লেখনিতে অদ্ভুতুড়ে সিরিজের উপন্যাস। সম্ভবত আনন্দের গড়পড়তার নির্দিষ্ট ১০০-১২০ পেজের পকেটবুক সাইজের টেমপ্লেটে আটকে না থেকে দে'জের পূর্ণদৈর্ঘ্যের বইয়ের আকারে ছোট ছোট অক্ষরে অপেক্ষাকৃত বৃহদাকায় কাহিনিতে ডেভেলপ করতে পারাতেই অতীব সুস্বাদু রহস্যময় রোমাঞ্চকর সরেস একটি অদ্ভুতুড়ে রহস্যোপন্যাস হিসেবে যথাযথ আঙ্গিকে ঠিক যেমনটা দরকার ছিল তেমন ভাবে এগিয়ে গিয়ে ঠিক যেখানে দরকার ছিল সেখানেই থেমেছে। জাস্ট পার্ফেক্ট। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ী চিরকালই আমার পড়া শীর্ষেন্দুর শ্রেষ্ঠ অদ্ভুতুড়ে কিশোর-উপন্যাস হয়ে থাকবে, তবে 'হরিপুরের হরেক কাণ্ড' খুব বেশি দূরেও থাকবে না।
হরিপুরের হরেক বাসিন্দাদের মধ্যে এক অদ্ভুত বাসিন্দা হলো শূলপাণি।গত ত্রিশ বছর ধরে ঠিক রাত ৮ টা বাজলে সে অট্টহাসি হেসে উঠে।তার এই হাসির উপর নির্ভর করে অনেক গুরুত্বপূর্ন বিষয়াদি যেমন- প্রিয়নাথ বাবু এই হাসি শুনেই ফটিককে পড়ানো ক্ষ্যান্ত দেন,মহেন্দ্র বাবু তার মুদি দোকানের ঝাঁপি ফেলেন,অন্নদাপিসী তার পূজা-আহ্নিক সেরে ফেলেন,কেউবা আবার নিজের ঘড়ির সময় মিলিয়ে নেন- ইত্যাদি ইত্যাদি। তা একদিন শূলপাণি হাসলোনা।হরিপুরের মানুষের দৈনিক রুটিনে ঐদিন বেশ গোলমাল হয়ে গেলো। খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো,শূলপাণি হাপিস হয়ে গেছে।সাথে খোয়া গেছে তার ঘরের সাত কড়ি সাত পয়সার বাক্সটাও। বাক্স খোঁজার জন্যে পিছে লাগলো চোর। সেই চোরের পিছে আরেকদল চোর। তাদের পিছে আরেকদল চোর। এত চোরের কাহিনী কি?আর ওই বাক্সই বা কই আছে?শূলপাণি ই বা কই লাপাত্তা হলো? সবকিছু মিলিয়ে ভজঘট পাকিয়ে মজার বই হরিপুরের হরেক কাণ্ড!
অদ্ভুতুড়ের ভাল ভাল বইগুলিরই রেটিং কম নাকি রে, জগুয়া?
- কা জানতে রামপ্রসাদ ভায়া, লোকে বোধহয় হাইপ দেখে পড়ে।
কিন্তু এই বইটার মত পিওর এডভেঞ্চার বই কি অদ্ভুতুড়েতে আছে? এখানে কোন ভূত নেই, তবে পাত্র পাত্রীর প্রায় সবার বয়সই ৭০+। ৭০+ বয়সের লোকরা এত কুল, আর ফিট, এটাই অদ্ভুত।আর অদ্ভুতুড়ের অন্যান্য গল্পগুলির চেয়ে এই উপন্যাসটা বেশ গোছানো। আর আছে ভরপুর চোর।
একটা লিমেরিক লিখেছি এই বইটা নিয়ে:
"ধাঁধা আছে, গুপ্তধন ভি আছে, আউর আছে হাসি, রাত ৮টায় পড়িতে বসবেন, শূলপাণি বলে হাসি।"
চোর রামপ্রসাদের হিন্দি বুলি মারাত্মক হাইস্যকর।
আর বেশি বললে রামু চোর হামার কোঠিমে চোরি করেগা,এইখানেই থামি উইথ স্ট্রং রিকমেন্ডেশন।
বেশ জমে উঠেছিল। কেমন একটা টান টান ভাব। অদ্ভুতুরের সব গুন বরাবরের মতই বিদ্যমান। তবে শেষ টা কেমন তাড়াতাড়ি ই হয়ে গেল। শেষ টা যদি আরেকটু জমতো,তাহলে দারুণ একটা পাঠ্য হতো। এখন ও যে খারাপ তা না,তবে অন্য অদ্ভুতুরের তুলনায় একটু কম মনে হয়েছে।
হরিপুর একটা অদ্ভুত গ্রাম। যেখানে প্রতিদিন রাত ৮ টার সময় শূলপানি নামে একজন হেসে উঠে। ঝড় বৃষ্টি যাই হোক না কেন। সে ঠিক রাত ৮ টার সময় ই হেসে উঠবেই। প্রথম সবাই ভয় পেলেও পরে সবার গাসহা হয়ে যায়। এবং অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে মানুষ তাদের ঘড়ির টাইম মিলাতে শূলপানির হাসির জন্য অপেক্ষা করে। কারণ শূলপানি যে ঠিক ৮ টায় হাসি দেয়। হঠাৎ একদিন শূলপানির হাসি শুনতে না পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যায়। এবং গ্রামের সকল মানুষ শুলপানির বাড়ি গিয়ে দেখে শূলপানি নেই। আর এখান থেকেই রহস্যের শুরু।
প্রচুর হাসি আর রহস্য দিয়ে সম্পূর্ণ বইটি ভরপুর। আর শীর্ষেন্দু অদ্ভূতুরে সিরিজ মানেই অসাধারণ কিছু। অদ্ভূত সব ক্যারেক্টর আর তাদের অদ্ভুত সব কাজকারবার আপনাকে একটু হলেও অদ্ভুত অনুভূতি দিতে বাধ্য করবে।
বইটা গেলবার পুজোর সময়ে অর্ডার দিয়ে ষষ্ঠী নাগাদ হাতে পেয়েছিলাম। সবাই বলছিল পরে অর্ডার দিস, কিন্তু মনে ভয় ছিল যদি আউট অফ স্টক হয়ে যায়? পুজোর দিনগুলোতে বাড়ির কিছুদূর থেকে আসা ঢাকের মৃদু আওয়াজের কোরাসে এই বইটা পড়ার সুখস্মৃতি অনেকদিন মনে থাকবে। পড়ার অনুভূতি এতই ভালো যে, প্লট নিয়ে সমালোচনা করার নেই এবারে।
It's engaging but not that entertaining. আমি আমার আগের একটি রিভিউতে বলেছিলাম যে আমার মতে অদ্ভুতুড়ে সিরিজের কোনো গল্পকেই "খারাপ" বলা যায় না। কোনোটা হয়তো অনেক ভালো, আর কোনোটা হয়তো একটু কম ভালো। অর্থাৎ, ভালো বিশেষণটি সর্বদা বিদ্যমান। এমনই গুণধর লেখক শ্রদ্ধেয় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। "হরিপুরের হরেক কান্ড" গল্পটি ওই একটু কম ভালো-এর কাতারে পড়লেও সামগ্রিকভাবে আকর্ষণপূর্ণ ছিল।
এই ছোট্ট বইটা শেষ করতে অনেক সময় লেগে গেল। যা হোক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যয়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজ বরাবরই আমার খুব প্রিয়। এই বইটাও তার ব্যতিক্রম ছিল না তবে শেষ দিকে মনে হল অহেতুক কাহিনীকে টেনে লম্বা করা হয়েছে।