Zahir Raihan (Bangla: জহির রায়হান) was a Bangladeshi novelist, writer and filmmaker. He is perhaps best known for his documentary Stop Genocide made during the Bangladesh Liberation War.
He was an active worker of the Language Movement of 1952. The effect of Language Movement was so high on him that he made his legendary film Jibon Theke Neya based on it. In 1971 he joined in the Liberation War of Bangladesh and created documentary films on this great event.
He disappeared on January 30, 1972 while trying to locate his brother, the famous writer Shahidullah Kaiser, who was captured and killed by the Pakistan army. Evidences have been found that he was killed by some armed Bihari collaborators and disguised soldiers of Pakistan Army.
জুলাই ৩৩ বা অগাস্ট দুই। ঢাকা জুড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুসময়ের জন্য শান্ত হয়ে বসার চেষ্টা করলে হাহাকার গুলো কানে এসে বাজচ্ছে। সেগুলো তৈরী করছে জেদের, প্রতিবাদের আগুনকে। ❝ - পুলিশে ভয় নেই? --বলতে গিয়ে দু-চোখে আগুন ঠিকরে বেরুলো,আর পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ❝ আমার স্বামী জেলে। আমার ভাই জেলে। ছোট বোনটিও আমার জেলখানায়, আমার ভয় করার মতো কিছু আছে? ❞
সেদিন বের হইনি কোথাও, সামনে ৩ -৪-৫ অনেক বড় বড় কর্মসূচি। অস্থির মনে বার বার ফেসবুক, টেলিগ্রাম এ অথেন্টিক নিউজ সার্চ করতে করতে এক্সাইটির পিক লেভেলে। আর সেই সময়ই ভাবলাম কিছু সময়ের জন্য ব্রেন টা ডিসট্রাক্ট করি৷ বহুল পরিচিত একটা কোটেশন তখন ভার্চুয়াল দুনিয়ার দেওয়ালে দেওয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদিও প্রেক্ষাপট জানি তবুও ঘটা করে বসে কখনো পরা হয়নি জহির রায়হান এর আমর উপন্যাস। চিরায়ত বলি আর অমর বলি, যাই বলিনা কেন প্রায় ৭০ বছর আগে লেখা এই উপন্যাস পড়িতে গিয়ে মাঝে মাঝেই শরীরে কাটা দিয়ে উঠেছে৷ বুকের ভেতর যেন পাহাড় চেপে বসেছে।
❝ জেলখানা আরো বাড়ান সাহেব। এত ছোট জেলখানায় হবে না! আরো একজন বললো, এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনের আমরা কিন্তু দ্বিগুন হবো। ❞
যতই জহির রায়হানের বইগুলো পড়ছি, ততই কেমন যেন একটা দীর্ঘ শ্বাস বের হয়ে যাচ্ছে একেবারে মনের ভেতর থেকে। ভাষা আন্দোলন কতটা সপ্রতিভ ভাবে ফুটে উঠেছে তার লেখা গুলোতে। খালি মনে হয়, ইসস উনাকে যদি আমরা এত অল্প বয়সে না হারাতাম!! তাহলে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে কি কি উপাখ্যান রচনা করতেন তিনি। এই আক্ষেপটা থেকেই যাবে। বইটা সরাসরি ৫২ এর প্রেক্ষাপটে না লিখে তার কয়েক বছর পরের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে, কিন্তু ৫২ এর সেই আন্দোলন যে তখনো জীবিত তা প্রতিক্ষনে বোঝা গিয়েছে। আর সেই আন্দোলন এর সময় থেকেই সামনের সময়ের জন্যে যে একটা প্রতিবাদের বীজ যে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে তাও ফুটে উঠেছে। দেখলে অবাক হতেই হয় যে তখনকার ছাত্র রাজনীতি আর এখনকার ছাত্র রাজনীতিএ মাঝে কতটা তফাত!!
বাহ! শুরুটাই হয়েছে কি চমৎকার ভাবে। গায়ে ধবধবে সাদা শার্ট, প্যান্ট, হাতে হাতঘড়ি, বুকপকেটে কলম সবমিলিয়ে একটা আভিজাত্যের ছাপ। কিন্তু সবাই তাকাচ্ছে ওর পায়ের দিকে, জুতো নেই কেন? ও কি পাগল! নাকি এটা নতুন ফ্যাশন। ধীরে ধীরে ওরা ১০ জন হল.....
১৯৫৫ সাল। বিধি নিষেধ থাকা সত্ত্বেও ২১ শে ফেব্রুয়ারি পালনের প্রস্তুতি চলছে। এই প্রস্তুতির পাশাপাশি আলাদা করে নজরে আসে মুনিম-ডলি-বজলে, আসাদ-সালমা, মাহমুদ-সাহানার কাহিনী।
আরেক ফাল্গুন ১৯৫৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী পালনের গল্প। এই ১৯৫৫ সালেই আমাদের শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু তরুণ তরুণী এক সকালে হঠাৎ করেই খালি পায়ে বেড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। স্থাপন করে কাগজ আর বাঁশের শহীদ মিনার। ক্ষণস্থায়ী এই শহীদ মিনার খুব বেশী সময় টেকেনা পুলিশের তোপের মুখে। যাদের একান্ত চেষ্টা আর সংগ্রামে আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত, পেছনের সেই মানুষগুলোর গল্প আরেক ফাল্গুন। উঠে এসেছে তাঁদের বিদ্রোহী চেতনা আর পরিণয় এর মাঝের দ্বান্দ্বিকতা। বাদ যায়নি আন্দোলনের লাভের গুড় খাওয়া মানুষগুলোর কথাও।
শয়ে শয়ে প্রতিবাদী ছেলেমেয়েকে গ্রেপ্তার করে জেলে জায়গা দিতে না পেরে যখন ডেপুটি জেলার বিরক্তি প্রকাশ করে, ভিড়ের থেকে কেউ একজন বলে, 'এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।' আমাদের বুড়িয়ে যাওয়া রোগটা মনে হয় এই এক ভবিষ্যৎবাণীতেই পুরোপুরি উপশম হয়ে যায়!
"এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো!"❤
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা অসাধারণ একটা বই।বইটা পড়ার সময় আমার কেবলই মনে হচ্ছিল সালমা,মুনিম,আসাদ,ডলিদের ভীড়ে আমিও ছিলাম,কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে পুলিশদের ইট পাটকেল ছুঁড়ে মারছিলাম,হলের ছাদগুলোয় মাঝরাত্তিরে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিলাম! উপন্যাসের শেষের দিকে ওদের সাথে আমিও পুলিশভ্যানে চড়ে জেলে যাচ্ছিলাম,সেই ভ্যানে চড়তে চড়তে নীলা যখন "আমার সোনার বাংলা" গাইছিল,তখন আমার সব কটা ইন্দ্রিয় আবেগে অবশ হয়ে যাচ্ছিল!
লেখার কি ধার রে ভাই! এই লোক দেশকে অনেক কিছু দিতে পারতেন। 'আরেক ফাল্গুন' আমার অলটাইম ফেভারিট লিস্টে ঢুকে গেলো। ৭২ পৃষ্ঠার ছোট্ট বইটা পড়তে অবশ্যই মিস করবেন না।
ক্যালেন্ডারের হিসাবে আজ ৬ আগস্ট, ২০২৪, সময় রাত ২.৩০। আর ইতিহাসের নতুন অভিযাত্রায় ৩৭ জুলাই, ২০২৪। সময় রাত ২.৩০! বাংলা মাসের হিসাবে ফাল্গুন বাংলার মাটিতে পদার্পণ করতে এখনো বহু দেরি।। তবুও যেন বছরের মাঝভাগে সারা বাংলায় আরেক ফাল্গুন সুবাস ছড়াচ্ছে।। কিছুক্ষণ আগে জহির রায়হানের "আরেক ফাল্গুন" বইটা শেষ করলাম। লেখালেখি করার তাৎক্ষণিক ইচ্ছে তেমন ছিলো না, লিখতে বসেছি এলোমেলো চিন্তাগুলো গোছাতে নয় বরং মস্তিষ্ক অসম্ভব রকমের শান্ত হয়ে আছে,যার কুল কিনার খুঁজতে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছি। বইটা আগাগোড়া নিজে একটা জলন্ত চিত্রকর্ম। বইটা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার হয়তো নেই, বেশিরভাগ মানুষ বহু আগেই পড়ে ফেলেছেন। আমার কাছে বইটার জ্ঞানের আর তারুণ্যের ভার অনেক। বইটার শেষ পেজের লাইনগুলোর বাস্তব অনুভুতি ২৪ এ কিছুটা হলেও অনুভব করার সৌভাগ্য হলো। শিরদাঁড়া বরাবর বয়ে চলে তারুণ্যের অগ্নী তরঙ্গ উপেক্ষা করা বড্ড মুশকিল। বইয়ের বিভিন্ন লাইন তুলেই না হয় একটু উদাহরণ টানি,
" আকাশে মেঘ নেই। তবু,ঝড়ের সঙ্কেত। বাতাসে বেগ নেই। তবু,তরঙ্গ সংঘাত।"
বেশি কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না আসলে,ওই যে বললাম নতুন ইতিহাস রচিত হয়েছে দিনের হিসাবে গতকাল দুপুরে।৩৬ জুলাই ২০২৪ এ। এ অবস্থায় মস্তিষ্ক ঠিক কি কি ওয়েব সিগনাল দিয়ে সব অনুভুতিগুলো প্রকাশ করবে, মস্তিষ্ক ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছে না। বইটা পড়ে যেন প্রিজন ভ্যানের স্লোগানগুলোয় আওড়াচ্ছে নিউরনগুলো,বইয়ে কবি রসুল যেমন বলে উঠেছিলো, "জেলখানা আরো বাড়ান স���হেব,এতো ছোট জেলখানায় হবে না".....
বাংলার মাটিতে দ্বিতীয় জহির রায়হান জন্ম নেবে না, চায়ও না দ্বিতীয় জহির রায়হানের জন্ম হোক। আরেক ফাল্গুনের রুপকার জহির রায়হানই অমর হোক।......🌻
বইয়ের নাম : আরেক ফাল্গুন লেখক : জহির রায়হান প্রকাশনী : সন্ধানী প্রকাশনী মূল্য : ১০ টাকা (দ্বিতীয় সংস্করণ) :১০০ টাকা (অনুপম প্রকাশনী)
কাহিনী সংক্ষেপে::
ফাগুন মাস। গাছে গাছে সবুজের সমারোহ। ডালে ডালে ফাল্গুনের প্রাণবন্যা। সকালে কুয়াশায় ঢাকা পড়া আকাশে অনেক নিচে দিয়ে মন্থর গতিতে ভেসে চলছিল এক টুকরো মেঘ। সেই মেঘের মতো আসাদ হেঁটে যাচ্ছে নবাবপুরের দিকে। পরনে সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট। কিন্তু পা জোড়া খালি, জুতা নেই। রাস্তার দু'পাশের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বংশালের মোড় পেরিয়েই দেখা হলো মুনিম ভাই সহ আরো ৮-১০ জনের সাথে। কারো পায়ে জুতা নেই। কিছুক্ষণ পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে নগ্ন পায়ে রানু, বেনু, নিলা এবং সালমা আপা সবাই তাদের সাথে যোগ দিল। ঢাকা শহর জুড়ে ছাত্র-ছাত্রীদের এমন আচরণ দেখে সবাই অনুমান করতে পারছিল পূর্বের মত ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।কিন্তু পূর্বে কি ঘটেছিল?
আজ থেকে তিন বছর আগে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। কবি রসুলের চোখে ঐ দিনের সব ঘটনা স্পষ্ট ভাবে ভেসে ওঠে। মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য, ভাষা আন্দোলনে যোগদানের জন্য জন্য আম গাছ তলায় দশ হাজার ছাত্র-ছাত্রীদের সভা বসেছিল। ছাত্রদের রুখে দিতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সবাই একসাথে বের হতে না পেরে ১০ জনের এক একটি দল নিয়ে মুষ্টি বদ্ধ ভাবে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' বলে স্লোগান দিয়ে বের হয়। কিন্তু পুলিশ সব কয়টি দলকে গ্রেপ্তার করল। তার মধ্যেই হঠাৎ করে পুলিশ গ্যাস নিক্ষেপ এবং গুলি করতে শুরু করলো। তার মধ্যেই হঠাৎ পুলিশের গুলিতে একটি ছেলের মাথার ঠুলি চরকির মত ঘুরতে ঘুরতে প্রায় ৩০ হাত দূরে ছিটকে পড়ল। পেটে, হাতে, বুকে গুলি লেগে অনেকে মারা গিয়েছিল। বরকতের গুলি লেগেছিল গোড়ায়, সাদা পাজামাটা রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে বরকত রাতে হাসপাতালে মারা যায়। কবি রসুলের এখনো মনে হয় মধুর রস্তোরায় গেলে সে কালো রঙের লম্বা লিকলিকে ছেলেটা (বরকত) -কে দেখতে পাবে।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদদের হত্যার প্রতিবাদে এবং শহীদদের স্মরণ করে তিন দিন খালি পায়ে হেঁটে ও রোযা রেখে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হবে। যার নেতৃত্বে আছে মুনিম। মুনিমের এখনো স্পষ্ট মনে আছে বায়ান্নর ২২ শে ফেব্রুয়ারির কথা। কাক ডাকা ভোরে সবাই হাজির হয়েছিলেন মেডিকেল কলেজ এর পুরনো হোস্টেল একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদদের গাইবি জানাজা নামাজ পড়ার জন্য। গায়েবি নামাজ শেষ হলে আবারো জোয়ারের মতো মিছিল বেরিয়েছিল সেদিন। আরো অনেকের মত ফাহাদ ও গুলি খেয়েছিল হাইকোর্টের মোড়ে। চোখের সামনে ফাহাদকে মরতে দেখে মুনিম।
খালি পায়ে হাঁটার দ্বিতীয় দিন। সব ছাত্র রোজা রেখেছে, এমনি কি অনেক সরকারি কর্মচারীর চাকরি হারানোর ভয়ে রাতে না খেয়ে রোজা রেখেছে। বায়ান্নতে তৈরি করা শহীদ মিনারটিকে আবার কাগজ এবং বাঁশের বেড়া দিয়ে সংস্কার করা হয়। এবং সবশেষে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে ইউনিভার্সিটি এবং মেডিকেল কলেজের হোস্টেল থেকে অনেক ছাত্র ছাত্রীকে তুলে জেলে নেয়া হয়েছিল ঐদিন রাতে।
তৃতীয় দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি। মুসলিম হল, নুরপুর ভিলা, চামেলী হাউস, ফজলুল হক হল, বান্ধবী কুঠির, মেডিকেল হোস্টেল, ঢাকা হল, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, আরমানিটোলায় স্কুল সহ আরো অনেক স্কুল থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। সবার কণ্ঠে বিদ্রোহের সুর। ছাত্র ছাত্রী এবং সাধারণ জনগণকে ভাষা শহীদদের জন্য যেন কাঁদতেও দেবে না সরকার। আবার ও যেন ৩ বছর পর ২১ শে ফেব্রুয়ারীর সাথে নেমে এসেছে পুলিশের অত্যাচার। গ্রেফতার করা হয় আসাদকে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১০ জন করে বের হওয়া প্রথম দলটির নেতা ছিল আসাদ। আজকের মতো ঐদিনও তাকে প্রথম গ্রেফতার করা হয়। তার মধ্যে কোন দুঃখ বা হতাশা নেই, তবে কিছু একটা পাওয়ার গর্বে তার বুকটা যেন ফুলে উঠেছে।
ছাত্র-ছাত্রী সবাইকে প্রিজনভ্যানে করে জেল গেটে জড়ো করা হলো। আড়াইশোর উপর সংখ্যা তাদের। কারো মাথা ফেটে গিয়েছে, কারো হাতের হাড় ভেঙে গিয়েছে কিন্তু তাদের সকলের মুখে ছিল হাসি, চোখে ছিল শপথের কাঠিন্য। এতো লোককে জেলে জায়গা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জেল কর্তৃপক্ষকে। এই দেখে কবি রসুল চিৎকার করে উঠলো ‘জেলখানা আরো বাড়ানো সাহেব। এত ছোট জেলখানায় জায়গা হবে না।’ পিছন থেকে আরেকজন বলে উঠল, “এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব”।
পাঠ প্রতিক্রিয়া:: উপন্যাসটি ১৯৫৫ সালের পটভূমিতে রচিত। ভাষা শহীদদের স্মরণ করে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করতে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নির্মম অত্যাচারের চিত্র যেমন ফুটে উঠেছে সেই সাথে বায়ান্ন সালের ২১ ও ২২ শে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের চিত্রও ফুটে উঠেছে। উপন্যাসের একদিকে যেমন রয়েছে মুনিম, আসাদ, রাহাত, মাহের, রওশন, সালমা, রেণু, রেণু, নীলা কবি রসুলের ও চায়ের দোকানদার মতি ভাইয়ের মত দেশ প্রেমিক, তেমনি রয়েছে মাহমুদ, বজলে ও সবুরদের মত দেশদ্রোহী। শুধু ভাষা আন্দোলন নয়। লেখক জহির রায়হান এ উপন্যাসে বলেছেন ভালোবাসা, দু:খ, পুন:মিলনের গল্প।
এটা আমার পড়া লেখক জহির রায়হানের প্রথম বই। প্রথম বইয়েই লেখক জহির রায়হানের প্রেমে পড়ে গেলাম। উপন্যাসের ভাষায় অনেক সহজ সরল, অল্পতেই গল্পের ভিতর নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন, নিজেকে বইয়ের একটি চরিত্র ভাবতে শুরু করবেন।
ছোট এ পাঠক জীবনে যে কয়েকটি বই পড়েছি আমি বলব তাদের সব গুলির মধ্যে এই বইয়ের এন্ডিংটা ছিল শ্রেষ্ঠ। শেষ এক লাইনের মধ্যেই যেন লেখক পুরো উপন্যাসের গল্প বলে দিয়ে গেছেন, "আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব"।
ধন্যবাদ সবাইকে।
ফারুক ৩০.০৩. ‘১৯ ঢাকা।
This entire review has been hidden because of spoilers.
রাগ ওঠে যখন একটা সুন্দর গল্প হুট করেই শেষ হয়ে যায়। চরম উত্তেজনার মহুর্তে শেষ পাতাটা দেখলে বুকে ছ্যাৎ করে ওঠে। এমন না করলেও পারতেন জহির রায়হান। আজকে সত্যি রীতিমতো বুকটা কেপে উঠেছিলো যখন দেখলাম শেষ পৃষ্টা চলে এসেছে। কী যেন একটা আর্তনাদের মতো বয়ে গেলো বুকের ভেতর। কেন জানি অরো অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে হচ্ছিলো মুনিম, ডলি, সালমা, আসাদ, রসুলদের সম্পর্কে। কী আর করার। হতাশা নিয়ে শেষ হলো বইটা। প্রায় কয়েক মাস পর এতোটা নিবিড়ভাবে কোনো বই পড়লাম। এই বইটা যেন আমাকে ছাড়তেই চাইলোনা। আমি নিজেই অবাক এতোটা ইন্টেন্স ভাবে নিজেকে বই এর সাথে মিশে যেতে দেখে। জহিরদের আমরা রক্ষা করতে পারিনা। রক্ষা করতে পারলে হীরা পেতাম সাহিত্যে।
❝আকাশে মেঘ নেই। তবু, ঝড়ের সঙ্কেত। বাতাসে বেশ নেই। তবু, তরঙ্গ সংঘাত।❞
বাঙালিদের বছরের পর বছর সংগ্রাম আজও আমাদের আবেগি করে তোলে। গর্ব হয় অকুতোভয়ী বীরদের বীরগাথা শুনলে। তেমনি মনটা বিষিয়ে ওঠে দেশের হয়েও দেশকে যারা খুবলে খেয়েছে। আবার এমনও অনেকেই ছিল যারা এই দু'দলের কোনোটার মধ্যেই পড়ে না। এমনই বেশ কিছু চরিত্রের গল্প বলা হয়েছে বইয়ে।
হাতে গোনা অল্প কিছুই লিখেছেন তবুও যা লিখেছেন পাঠকদের ভাবনায় ফেলে দেওয়ার মতো। ছোট পরিসরের বই কিন্তু দেশপ্রেম, সম্পর্ক, আবেগের কিছু গল্প। কিছু চরিত্রের সাইকোলজি বেশ জটিল মনে হয়েছে। সমাপ্তি মনে অতৃপ্তির রেশ রেখে গেছে... কিছু গল্প তো জানা হলো না!
❝এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগু��� হবো।❞
শেষটা এতো সুন্দর! ডলিকে মুনিমের সুক্ষভাবে করা তাচ্ছিল্য নিয়ে বিরক্ত আমি শেষে এসে মুগ্ধতায় হারিয়ে গেলাম। চরিত্রগুলোকে নিপুনভাবে রক্তমাংসের করে তোলার কারিগরকে পর্দার তুলনায় বইয়ের পাতায় আরো স্বচ্ছন্দ মনে হল। সংলাপ মাপা এবং বর্ণনাও। এক রত্তি অত্যুক্তি নেই। জাহির করার চেষ্টা নেই। উপন্যাসটির কোথাও কোথাও গদ্য কবিতা হয়ে উঠছিল, যা বাড়তি পাওনা। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসে এতো সারল্য ধরে রাখা মুশকিল। বারবার অতীতের খুঁটিনাটি এনে বুঝিয়ে দেওয়ার লোভ সামলে জহির রায়হান পাঠককে সরাসরি সেই খোলা মাঠে বসা এবং পরের ফাল্গুনে দ্বিগুন হবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া বিপ্লবীদের একজন করে তোলেন। শহীদদের স্মৃতিতে উজ্জীবিত মানুষগুলোর প্রতি আমাদের মধ্যে অনায়াসে শ্রদ্ধা জাগিয়ে তোলেন।
নাহ, আমি যতই গলা উঁচিয়ে বলার চেষ্টা করি সব পরিবর্তনের মাঝে আমি একটি অপরিবর্তনশীল জিনিস, সেটা যে আসলে ততটা ঠিক না তা প্রমাণ করে দেবার জন্য পূর্বে পড়া একটা বই-ই যথেষ্ট।
গতবার এই বইটি পড়ার সাথে আর এবার এই বইটি পড়ার মাঝে পার্থক্যও আরেক ফাল্গুন... “ফাল্গুন-১৪১৯”। এর আগে এই বইটির দ্রোহের মন্ত্রে জ্বলে ওঠা ছাত্র-জনতা ছিল উপন্যাসের পাত্রপাত্রী, অনেক দূরের কেউ এবং অনুপ্রেরণা। ফাল্গুন-১৪১৯ বা তার আগ-পিছের বেশ কিছু ঘটনাবলী আমার নিজের জীবনকে নিয়ে এসেছে এদের অনেকটাই কাছাকাছি।
এই উপন্যাসটি কতটা সুলিখিত তা আর নতুন করে বলবার কিছু নেই। আমার নিজস্ব ভালোলাগা এবং একাত্ম হয়ে যাওয়াকে পাঁচতারা...
আজ থেকে প্রায় ৬৬ বছর আগের ঘটনা। একদল তরুণ বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে ছিল। মাতৃভাষার জন্য, বাংলাভাষার জন্য।
আজ থেকে ৬৬ বছর আগে বাঙালী কতটা অগ্রগামী ছিল, আধুনিক ছিল সেটি এই একটি ঘটনা দেখলে আমরা বুঝতে পারি। মাতৃভাষার অধিকার যে একটি ব্যক্তিসত্তার পরিচয় সেই চেতনা ধারন করেছিল বাঙালি অনেক বছর আগেই। ভাবলেই গর্বে ভরে ওঠে বুক।
আজ ২০১৮ সালে এসেও প্রতিবেশী দেশ ভারত কিংবা পাকিস্তানে ভ্রূণ হত্যা, অনার কিলিং সহ বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কারের হিংস্র রূপ দেখতে পাই সেখানে বাংলা দেশ ভাগের পূর্ব থেকে আজ পর্যন্ত চিন্তাচেতনায় অনেক বেশি আধুনিক।
স্বদেশী আন্দোলনের ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, প্রফুল্ল চাকী থেকে ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সালাম, শফিক, বরকত, জব্বার, মুক্তির মঞ্চে বলিদানে বাঙালী চিরকাল অগ্রগামী।
জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন উপন্যাসটি ৫২ প্রেক্ষাপটের উত্তরকালের ঢাকার পরিস্থিতির উপর লেখা। পাঠককে আন্দোলনের ইতিহাস নয়, আন্দোলনের ভাষা শিখতে বইটি পড়তে হবে। শুধু পড়ার সময় মনে রাখতে হবে এটা কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য লেখা চটকদার লেখা নয়। তাই এখানে প্রতিটি চরিত্রের হৃদপিন্ড থেকে মস্তিষ্কের গতিবেগ অনুধাবন করতে হবে। মুনিম, আসাদ, সালমা চরিত্রগুলোর মাঝে নিজেকে খুঁজতে হবে। ওদের সাথে চলে যেতে হবে অদেখা সেই অদ্ভুত মাতাল সময়ে।
ভাষা দিবস উপলক্ষে বুকস্টাগ্রামে এই বইটা নিয়ে একের পর এক রিভিউ আর অনুভূতি দেখে লোভ সামলাতে পারি নি। তাই ২১ এর প্রহর শেষ হওয়ার আগে বইটা শেষ করে ফেললাম। মুহূর্তে মুহূর্তে শিহরণ জাগিয়ে তোলা এই বইটা কে রেটিং দেওয়ার মত দুঃসাহস দেখানো টা অন্যায়। ৫ এর বেশি দেওয়া যায় না দেখেই ৫ দেওয়া। অন্যান্য ৫ রেটিং এর বইয়ের সাথে এর তুলনা হয় না।
❝আকাশে মেঘ নেই। তবু, ঝড়ের সঙ্কেত। বাতাসে বেশ নেই। তবু, তরঙ্গ সংঘাত।❞
বাঙালিদের বছরের পর বছর সংগ্রাম আজও আমাদের আবেগি করে তোলে। গর্ব হয় অকুতোভয়ী বীরদের বীরগাথা শুনলে। তেমনি মনটা বিষিয়ে ওঠে দেশের হয়েও দেশকে যারা খুবলে খেয়েছে। আবার এমনও অনেকেই ছিল যারা এই দু'দলের কোনোটার মধ্যেই পড়ে না। এমনই বেশ কিছু চরিত্রের গল্প বলা হয়েছে বইয়ে।
হাতে গোনা অল্প কিছুই লিখেছেন তবুও যা লিখেছেন পাঠকদের ভাবনায় ফেলে দেওয়ার মতো। ছোট পরিসরের বই কিন্তু দেশপ্রেম, সম্পর্ক, আবেগের কিছু গল্প। কিছু চরিত্রের সাইকোলজি বেশ জটিল মনে হয়েছে। সমাপ্তি মনে অতৃপ্তির রেশ রেখে গেছে... কিছু গল্প তো জানা হলো না!
❝এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।❞
এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত পড়লাম জহির রায়হানের এক অনবদ্য সৃষ্টি আরেক ফাল্গুন। বইটা মূলত ভাষা আন্দোলন নিয়ে হলেও আমাদের চিরচেনা ১৯৫২ নিয়ে না, এর বছর তিনেক পরের ঘটনা এবং তৎকালীন সামাজিক অবস্থা নিয়ে লেখা। বইটি আকারে ছোট হলেও এর আবেদন বিশাল। বাংলা তখনো রাষ্ট্রভাষা হয়নি, ৫২র শহীদদের স্মরণে ২১শে ফেব্রুয়ারী পালন করা হবে। এ জন্য আগে থেকেই বেশ কিছু কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে, তারমধ্যে আছে তিন দিন সর্বস্ব খালি পায়ে চলা, শহীদদের স্মরণে রোজা রাখা এবং শহীদদের স্মরণে কালো ব্যাজ পরা ইত্যাদি। এতেই ক্ষেপে উঠলো স্বৈরাচারী সরকার, বন্ধ ঘোষণা করল সব ধরণের মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ। কিন্তু জনতা তা মানবে কেন। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তাঁরাও শুরু করেছে ২১শে ফেব্রুয়ারী পালনের কর্মসূচি। এই দিকে পুলিশ হামলে পড়েছে জনতার উপর শুরু হল ধর-পাকড়। এবং জেলের মধ্যে জহির রায়হানের সেই তেজদিপ্ত সংলাপ "আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো" যেন তিনি জানিয়ে দিলেন এভাবে আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না, পরেরবার আমরা দ্বিগুণ উদ্যমে শুরু করব। এক বসাতেই শেষ কিন্তু মনে থাকবে আজীবন।
১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারির রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রদের মিছিলে যে দশ জনের দলটি সর্বপ্রথম ১৪৪ ধারা ভেঙেছিলো তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া জহির রায়হান। এই "আরেক ফাল্গুনের" মুনিম চরিত্রে তাই তার ছায়াই দেখছিলাম শুধু।
২১শে ফেব্রুয়ারির পেছনের সেই লড়াকু মানুষগুলোর সংগ্রাম আর তাদে��� জীবনের গল্প মিশে গেছে এই বইটাতে। শ'য়ে শ'য়ে তরুণেরা ১৯৫৫ এর আরেক ফাল্গুনে জড়ো হয়েছিল স্বৈরচারী শাসকের চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে ভাষা শহীদের শ্রদ্ধা জানাতে। তাদের ঠেকিয়ে দিতে শাসকদের সে কত প্রয়াস! কত ভীতি সঞ্চারের চেষ্টা!
নীলার পুলিশের ভ্যানে চেপে "আমার সোনার বাংলা" গেয়ে ওঠা বা ছেলেমেয়েগুলোর হাসতে হাসতে জেলে ঢুকে গিয়ে জেলারকে বলা ঘাবড়ে গেলে চলবে? "আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো" গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল বারবার! যাদের পূর্বসূরিরা অন্যায়কে চুল পরিমাণ প্রশ্রয় দিতেন না তাদের উত্তরসূরিদের আজ কি হল কে জানে!!
"এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুন আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।"
শনিবার, ৯ নভেম্বর রাত ১২:২৫।
শেষ করে ফেলেছি জহির রায়হানের বিখ্যাত বই 'আরেক ফাল্গুন'। না, এখন শেষ করিনি। বইটা শেষ করেছি কালকে। তবে, আজ লিখতে বসলাম আর কি!
'আরেক ফাল্গুন' ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লিখা হয়েছিলো। ভাষা আন্দোলন কতটা সপ্রতিভভাবে যে তার লেখায় ফুটে উঠেছে, সেটা আপনি নিজে না পড়লে অনুভব করতে পারবেন না। ১৯৫৫ সাল। বিধি নিষেধ থাকার পরেও ২১শে ফেব্রুয়ারি পালনের প্রস্তুতি চলছে। মুনিমরা সংঘবদ্ধভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে, আসছে একুশে ফেব্রুয়ারি তারা বায়ান্ন বা বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষার জন্যে প্রাণ দেয়া শহীদদের সম্মান জানাবে। তাই তারা খালি পায়ে কয়দিন ধরে হাঁটছে। সবাই এক হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারির জন্য।
বইয়ের চরিত্রগুলাও ছিলো খুব জীবন্ত। মুনিম, ডলি, বজলে, আসাদ, সালমা, মাহমুদ, সাহানাদের জীবনের কাহিনীও খুব অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রায়হান সাহেব।
সবমিলিয়ে, চিরায়ত বলেন আর যা-ই বলেন এই বই পড়তে গেলে এখনো শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠবে আপনার। দেশপ্রেমের নেশা যে কতো বড় নেশা তা আপনার সব কটা ইন্দ্রিয় অনুভব করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। যাইহোক, রাত অনেক হলো। শুভরাত্রি।
এত এত চরিত্র সব গুলিয়ে ফেলছিলাম। মনে হচ্ছিল মূল বিষয়ের চাইতে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ও যোগ করেছেন লেখক। আহামরি খুব একটা ভালো লাগেনি৷ আটকে গিয়েছি শুধু বইয়ের শেষের লাইনগুলোতে।
ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা চমৎকার একটি বই । জহির রায়হানের লেখার যে দিকটি সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে সেটি হচ্ছে তার গল্প বলার নিজস্ব স্টাইল। চরিত্র-গুলো এবং দৃশ্যগুলো যেন অনেক বেশি জীবন্ত ! উপন্যাসের শেষ লাইনটা বেশ চমৎকার। "আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো... "
জহির রায়হান আমার একজন পছন্দের লেখক।আরেক ফাল্গুন, উপন্যাসটি এত ভালো লেগেছে যে, এই বিষয়ে যায় বলি খুব কম বলা হবে। ভাষা-আন্দোলন কে কেন্দ্র করে রচিত এটি।মুনিমরা সংঘবদ্ধভাবে প্রচরণা করছে, আসছে একুশে ফেব্রুয়ারি তারা বায়ান্ন বা বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দেয়া ভাষা শহীদদের সম্মান জানাবে।তাই তারা খালি পায়ে কয়দিন ধরে হাঁটছে। বিভিন্ন কলেজ-ঢাকা মেডিকেল কলেজ,ইডেন কলেজ,জগন্নাথ কলেজ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরো সব জায়গা থেকে ছেলে মেয়েরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে একুশের ফেব্রুয়ারির জন্য। সালমা মেডিকেলে পড়ে,তার স্বামী -ভাই দেশের জন্য জেলে।তার স্বামী রওশন রাজশাহীর জেলে, গুলিতে তার দুহাত কাটা পড়ছে।এত কিছুর পরেও সালমা পিছু পা হয়নি,অন্যদের মত সেও একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের স্বপ্ন দেখে,সে খালি পায়ে কলেজে গেছে।বেনু, রাণুরা ও খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে,সবাই ওদের আড় চোখে দেখছে কিন্তু সবাইকে তোয়াক্কা না করে,তারা দেশ আর ভাষা শহীদের কথায় বারেবারে স্মরণ করছিল। এল কাঙ্ক্ষিত দিন,পুলিশ লাঠি পেটা করেও থামাতে পারে নি,বাংলার দামাল ছেলে-মেয়েদের। শীত, শত বাঁধা উপেক্ষা করে তারা সংঘবদ্ধ আজ। জেলে তাদের স্থান দেয়া যাচ্ছে না।কবি রাসুল বলেন-আসছে ফাল্গুন আমরা দ্বীগুণ হবো।অর্থাৎ আমাদের আন্দোলনের কেবল শুরু, এটা চলতেই থাকবে,যত দিন না পর্যন্ত আমরা স্বাধীন হবো। এত সুন্দর করে জহির রায়হান দেশের কথা তুলে ধরতে পেরেছেন, এটা পরে তার প্রতি শ্রদ্ধা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। আহারে আমরা যদি তাকে ১৯৭২ সালে না হারাতাম, তাহলে বাংলা সাহিত্য, চলচ্চিত্র আরো পরিপূর্ণ হতো তার হাতের ছোঁয়া পেয়ে।
ফাল্গুন যেমন বাঙালির কাছে ভাষার মাস। ঠিক তেমনই ভালোবাসার মৌসুমও। দখিনা বাতাসের সাথে ফাল্গুন যেনো একই সাথে দুটো বার্তা নিয়ে আসে। এই উপন্যাসে লেখক ভাষা আন্দোলন পরবর্তী ছাত্র জনতার অব্যাহত সংগ্রামের ইতিহাসের পাশাপাশি নারী ও পুরুষের মধ্যেকার সম্পর্কের জটিলতার গল্প বলে গেছেন খুব সুন্দরভাবে। জেলখানা ভর্তি হয়ে যাওয়ায় জেলারের উদ্বেগ দেখে একজন সংগ্রামী বলেছিলো -"আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো"। এই সংলাপ এখন সাধারণত প্রেম বিষয়ক ইঙ্গিত হিসাবেই বিখ্যাত।
নাম ডাকতে ডাকতে হাফিয়ে উঠেছিলেন ডেপুটি জেলার সাহেব। একসময় বিরক্তির সাথে বললেন,উহু,এত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়।জেলখানা তো এমনিতে ভর্তি হয়ে আছে।ওর কথা শুনে কবি রসুল চিৎকার করে উঠলো,জেলখানা আরো বাড়ান সাহেব।এত ছোট জেলখানায় হবে না।আর একজন বললো,এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি?আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।
একটি শিশু জন্ম নিয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে বুঝতে পারেনা পৃথিবীর সব বিচিত্র বিষয়ের কথা। জননী, জন্মভূমি কিংবা মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা বা ভাবনা একদিনে কি তৈরি হতে পারে কারো মনে? চিন্তাচেতনার বিকাশে শিশুটি একদিন নিজের বসবাসের জায়গাটাকে ভেবে নেয় জন্মভূমি। মায়ের থেকে শেখা ভাষাটাকে মাতৃভাষা বা মায়ের ভাষা বলে অনুধাবন করতে শেখে।
কাউকে জন্ম থেকে দেশপ্রেম শেখাতে হয় না। মানুষ নিজের আত্মউপলব্ধিতে , নিজের চিন্তা চেতনায় দেশপ্রেমকে লালন করতে শেখে। যে ভাষা শোনা হয়েছিল মায়ের মুখে। যে ভাষায় মা শিখিয়েছিল কত মধুর কথা। সেই ভাষাটাকে কেড়ে নিয়ে কেউ জোর কেনো বলাতে যাবে অচেনা এক ভাষা! না মেনে নেয়া যায় না। মানতে পারেনি কিছু দামাল ছেলের দল।
একটা ফাল্গুনের গল্প রচিত হয়েছিল সেদিন। লাল পলাশের মতো রক্তে রাঙানো এক ফাল্গুনের গল্প। আজকেও ফাল্গুনের দক্ষিণ হাওয়া বইছে বাতাসে। ১৯৫২ সালে ভাষা নিয়ে আজকের দিনের রক্তাক্ত গল্প ছিলো যেমন তেমনি এর পরবর্তী বছরের দিনগুলোও কিন্তু সহজ ছিলোনা। শহীদের রক্তে ভিজেছিল যে ২১ শে ফেব্রুয়ারি, সেই শহীদদের স্মরণে কি আজকের মতো এতো সহজে জানানো যেতো শ্রদ্ধা?
১৯৫৫ সাল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করে ছাত্র-ছাত্রীদের "শহীদ দিবস" পালন করতে দেবে না সরকার। রাস্তায় স্লোগান দেয়া নিষিদ্ধ সাথে মিছিল, শোভাযাত্রা সবটাই নিষিদ্ধ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যারা তিন ফাল্গুন আগে হারিয়েছে ভাষা আন্দোলনে তাঁদের সহযোদ্ধাদের তাঁরা কি এতো সহজে দমে যাবে? যে কোনো মূল্যে শহীদ দিবস পালন করতে প্রস্তুত তাঁরা।
সেজন্য তাঁরা আগে থেকেই ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। যেমন তিনদিন ধরে খালি পায়ে হাঁটা, শহীদদের স্মরণে কালো ব্যাজ ধারণ করা, ২১ ফেব্রুয়ারিতে কালো পতাকা উত্তোলন ইত্যাদি নানান প্রস্ততি চলতে থাকে। কিন্তু সেখানেও পুলিশ এসে বাঁধা দেয়।
এবং নির্বিচারে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি নির্যাতন, মিছিলে সংঘর্ষ এবং শেষে তাঁদের গ্ৰেফতার করে নিয়ে আসা হয় জেলগেটের সামনে। খুব ছোট আকারের এই উপন্যাসের কাহিনীর স্থিতিকাল মাত্র তিনদিন দুই রাত। অথচ অন্যায়ের প্রতিবাদে বলিষ্ঠ দৃঢ়ভঙ্গিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। আন্দোলনের মাঝে এগিয়ে চলে কিছু চরিত্রের একসাথে মিশে চলা কাহিনীগুলোও।
🥀চরিত্রায়ন🥀
🥀মুনিম: ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে একটি ছেলেকে হেঁটে যেতে দেখা গেলো নবাবপুরের দিকে। দক্ষিণ থেকে উত্তরে। পরনে তাঁর একটা সদ্য ধোঁয়ান সাদা শার্ট। সাদা প্যান্ট। পা জোড়া খালি। জুতো নেই। সব আছে তাঁর বলা যায় ধবধবে জামা। প্যান্ট। পকেটে কলম। কব্জিতে বাঁধা ঘড়ি। হাতে একটা খাতা। মুখের দিকে তাকালে, ভদ্রলোকের সন্তান বলে মনে হয়। কিন্তু, পায়ে জুতো নেই কেন? ওরা জুতো অবশ্য এ দেশের অনেকেই পরে না। মনে ক্ষণিক প্রশ্ন। ছেলেটির মাথায় কোন ছিট নেই তো? পাগল নয় তো ছেলেটা?
নাহ ছেলেটি পাগল নয়। এটা প্রতিবাদ তাঁদের পক্ষ থেকে। নির্বিচারে মিছিলে পুলিশের গুলি এবং ছাত্রদের গ্ৰেফতারে প্রতিবাদ। এই ছেলেটির অবশ্য এই আন্দোলনের বাইরে একটা জীবন আছে। সেখানে আছে ডলি। ডলির কী তাঁকে নিয়ে কোনো অনুভূতি আদৌও আছে?
🥀 আসাদ: মুনিমের সাথে সাথে এই ছেলেটিও আন্দোলনে যুক্ত আছে। গায়ের রঙ তাঁর রাতের আঁধারের মতো কালো। মসৃণ মুখ। খাড়া নাকের গোড়ায় পুরু ফ্রেমের চশমা। পরনে একটা ধবধবে পায়জামা। পা জোড়া কিন্তু তাঁরও নগ্ন। জুতো নেই।
প্রথমে একা একা আসতে ভয় পাচ্ছিল বাসা থেকে পরে মুনিমকে দেখে সাহস ফিরে আসে। সেও তাল মিলিয়ে চলেছে খালি পায়ে।
🥀সালমা: ক্লাশে মন বসছিলো না সালমার।প্রফেসর নার্ভাস সিসটেমের উপর বক্তৃতা দিচ্ছিলেন আর সে ভাবছিলো তাঁর কারারুদ্ধ স্বামীর কথা।মনটা খারাপ থাকলে অথবা কোনো আন্দোলনের সামনে এসে দাঁড়ালে, কোনো মিছিল দেখলে, কোনো সভা-সমিতিতে গেলে, স্বামীর কথা মনে পড়ে। বড় বেশি মনে পড়ে তখন। কে জানে এখন কেমন আছে স্বামী রওশন!
প্রথমে কিছুই জানতো না সালমা। শুনেছিলো রাজশাহী জেলে গুলি চলেছে। শুনে আর্তচিৎকারে কিংবা গভীর কান্নায় ফেটে পড়ে নি সে। বোবা দৃষ্টি মেলে শুধু আকাশের দিকে তাকিয়েছিলো। মুহূর্তের জন্য চারপাশের এই সচল পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল ভুলে গিয়ে, জানালার দুটো শিক দুহাতে ধরে নির্বাক দাঁড়িয়েছিলো সে। বুকের ঠিক মাঝখানটায় আশ্চর্য এক শূন্যতা। হয়তো মারা গেছে রওশন। পরে শুনলো মরে নি। ভালো আছে সে। সুস্থ আছে।
এই ঘটনার মাস দুয়েক পরে স্বামীর সাথে দেখা করতে গিয়ে সেদিন সহসা যেন মাথায় বাজ পড়েছিলো সালমার। যে বলিষ্ঠ হাত দুটো দিয়ে তাকে আলিঙ্গন করতো রওশন, সে দুটো হাত হারিয়েছে রওশন। শার্টের হাতা জোড়া শুধু ঝুলে আছে কাঁধের দুপাশে। নিজেও ঘরে বসে থাকার মতো মেয়ে নয় সালমা। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম অংশ সে। খালি পা তাঁরও। গ্ৰেফতার হয়ে জেলে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে।
🥀নীলা, রানু এবং রোকেয়া: ভাষা আন্দোলনে এই মেয়েগুলোও কম করেনি। তিন জনেই গ্ৰেফতার হয়েছে বাকি মেয়েদের সাথে। সব মেয়েরা তখন পাশের ভ্যান থেকে স্লোগান দিচ্ছিলো, বরকতের খুন ভুলবো না। শহীদের খুন ভুলবো না।
🥀কবি রসুল: তাঁর কবিতায় আগুন ঝরে প্রতিবাদের। পুলিশ নির্বিচারে ছাত্রদের উপর গুলি চালিয়েছে। কবি রসুল কেন সহ্য করবে এই অন্যায়!
সবার সাথে জেল গেটে দেখা হয় কবি রসুলের। ছেলেমেয়েগুলোর জন্য গর্বে বুক ভরে ওঠে তাঁর।
🥀ডলি: এই মেয়েটি খুব দোটানায় পড়ে আছে। মাহমুদ নাকি মুনিম সে কাকে বেছে নেবে। মুনিমের মনে ডলির জন্য অনুভূতি কাজ করে ডলি সেটা বোঝে কিন্তু মাহমুদ বেশ ধনী।
ডলির কাজকর্ম আসলেই রহস্যময়। শেষটা কাকে বেছে নেবে সে দেখা যাক।
🥀পাঠ প্রতিক্রিয়া🥀
বাংলা সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক উপন্যাস সম্ভবত জহির রায়হানের থেকেই সূচনা। আফসোস হয় উনি বেঁচে থাকলে এরকম আরো লেখা আমরা পেতে পারতাম ওনার কাছ থেকে। এই বইটাকে বলা যায় একটা অনবদ্য উপস্থাপনা। এতো ছোট বইটা কিন্ত এর ভাব তাৎপর্যপূর্ণ। এতো চমৎকার লেখনী যে মনেই হবে না এটা কোনো কল্পিত ঘটনা।
নিজেকে মনে হবে সেই উতপ্ত ছাত্র আন্দোলনের একজন সহযোদ্ধা। এতো পরিমিত চমৎকার সংলাপ উপস্থাপনা যে মুগ্ধ হতে হয়। এই বই পড়া উচিত প্রত্যেকটি পাঠকের। আমি রীতিমতো মুগ্ধ এবং আমার প্রিয় বইয়ের তালিকায় এই বই আছে সবসময়। কাউকে বইয়ের নাম বলতে গেলেও এই বইয়ের নামটা অবশ্যই বলি। খুব ছোট বই পড়তে সময় লাগে খুব কম।
২১ ফেব্রুয়ারীতে আরেক ফাল্গুনের গল্প হোক বারবার। অনবদ্য লেখনী এবং শব্দচয়নে এই বই প্রতিবাদের ভাষা।
"এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি?আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুন হবো।"
এই লাইনগুলো প্রতিটি ছাত্র আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছে বারবার। এটি কোনো সাধারণ অর্থ প্রকাশ করে না। নিগুড়ে লুকিয়ে আছে প্রতিবাদের ভাষা। যে ভাষায় হার মানবে যুগে যুগে সব শাসক শ্রেণী।
এই বইটা পড়েছিলাম এসএসসি পরীক্ষার আগের ফেব্রুয়ারিতে। আমার এক শিক্ষক ক্লাসে বইটা সম্পর্কে এমন আগ্রহ জাগানিয়া বক্তৃতা করেছিলেন, যে তখন বইটা না পড়ে পারলাম না। সেই পাঠ্য বইয়ের ভিতরে ডুকিয়ে আম্মুকে ফাঁকি দিয়ে পড়ে ফেলেছিলাম আরেক ফাল্গুন। এখন হিসেব করে দেখি বইটা পড়ার সময়ও ফাল্গুন মাসই ছিলো। কী তুমুল মুগ্ধতা নিয়ে বইটা শেষ করেছিলাম, তা মনে করে এখনো দারুণ রোমাঞ্চিত হই। আজকে জহির রায়হানের বইগুলো গোছাতে গিয়ে আরেক ফাল্গুন, শেষ বিকেলের মেয়ে, একুশে ফেব্রুয়ারী ইত্যাদি ইত্যাদি পড়ার ঘটনাগুলো মনে পড়ে গেল।