হাজার বছর ধরে :বাঙালির হাজার বছরের জীবনধারা "হাজার বছর ধরে" উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন যুগ-যুগান্তরের বিবর্তনহীন গ্রামীণ জীবনের ছায়াচিত্র।ক্ষুদ্র একটি গ্রামের একান্নবর্তী পরিবারের সংঘাতময় জীবনের কাহিনী তিনি বর্ণনা করেছেন এতে। পরিবারটির কর্তা বুড়ো মকবুল।তার এই পরিবার এবাড়িতে ৮ঘর লোকের বাস;সবাই নিম্নবিত্ত শ্রেণীর।জীবীকার তাগিদে নারী-পুরুষ সবাইকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।হাজার বছর ধরে চলে আসছে গ্রাম বাংলার মানুষের এ জীবনযুদ্ধ।এযুদ্ধে কখনও তারা জয়ী হয়;আবার কখনও হয় পরাজিত। জীবিকার তাগিদে বাড়ির পুরুষদের কাজ করতে হয় ঘরে বাইরে , দিন রাত যেন অক্লান্ত পরিশ্রম । বাড়ির নারী সদস্যরাও বাদ যায়না । তারা চাটাই বোনা,অন্যের ধান ভাঙা,শাপলা তোলা এরকম আরো অনেক কাজ করে যতটা পারা যায় তারা পরিবারের আয় উন্নতিতে সাহায্য করে । তবুও তাদের লড়তে হয় কঠিনতম জীবন সংগ্রামে । এরপরেও আছে নানারকম কুসংস্কার,নানাবিধ ধর্মীয় গোঁড়ামী আর বিধি নিষেধের বেঁড়া জাল । তবুও সবকিছু ছাপিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তাদের কঠিন সেই জীবন সংগ্রামের গল্প । লেখক এই উপন্যাসে আবহমানকালের গ্রাম-বাংলার প্রায় সব দিকই তুলে এনেছেন। এই উপন্যাসে বাল্য বিবাহের প্রসঙ্গ এসেছে, বহু বিবাহের কথা এসেছে। নারীদের অসম্মান করার ব্যাপার উঠে এসেছে, এমনকি বউকে পিটিয়ে মেরে ফেলাও যে তৎকালীন সময়ে এমন অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার ছিল না সেটাও লেখক অসাধারণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন। এই বইয়ে সামাজিক কুসংস্কারের কথা উঠে এসেছেন, পরকীয়া প্রেমের কথাও বাদ যায় নি.কেন্দ্রীয় চরিত্র টুনি আর মন্তুর মাধ্যমে লেখক তুলে ধরেছেন এই হাজার বছর বয়স্কা বাংলার হাজারো যুবক যুবতীর হৃদয়ের কথা, হৃদয় ভাঙার কথা। আর দশটা প্রেমের উপন্যাসের চেয়ে হাজার বছর ধরে'
Zahir Raihan (Bangla: জহির রায়হান) was a Bangladeshi novelist, writer and filmmaker. He is perhaps best known for his documentary Stop Genocide made during the Bangladesh Liberation War.
He was an active worker of the Language Movement of 1952. The effect of Language Movement was so high on him that he made his legendary film Jibon Theke Neya based on it. In 1971 he joined in the Liberation War of Bangladesh and created documentary films on this great event.
He disappeared on January 30, 1972 while trying to locate his brother, the famous writer Shahidullah Kaiser, who was captured and killed by the Pakistan army. Evidences have been found that he was killed by some armed Bihari collaborators and disguised soldiers of Pakistan Army.
উপন্যাসটি আমি ঠিক কতবার পড়েছি তার সঠিক কোনো হিসাব নেই। ক্লাস নাইন থেকে শুরু করে এস.এস.সি পরীক্ষা দেবার আগ পর্যন্ত কম করে হলেও ১৫ বার তো পড়েছিই। নৈর্বত্তিক এর জন্য তো দাগ দিয়েছিলাম প্রায় প্রতিটি শব্দের নিচে। উপন্যাস তো উপন্যাস, পাঠ্য বইয়ে লেখা বিশ্লেষণটাও প্রায় সমান সংখ্যক বার পড়েছি। খালি পড়তে বাদ ছিল এর মাধুর্য, ধরতে বাদ ছিল এর মমত্ববোধ। আগাগোড়া নিজের মমতার আচল দিয়ে উপন্যাসটিকে বেঁধে রাখা টুনি কই হারিয়ে গিয়েছিল কারণ আমার তো প্রমাণ করতে হবে কেন্দ্রীয় চরিত্র বুড়ো মকবুল, নায়িকা আম্বিয়া আর নায়ক মন্তু। কেটে টুকরো করবার অভিপ্রায় থাকলে মনে হয় মমত্ববোধ কাজ করে না। দৃষ্টি এড়িয়ে যায় ছোট ছোট সৌন্দর্য । “ওরা আসে ধল পহরের আগে, যখন পুবের আকাশে শুকতারা ওঠে”... হয়ে ওঠে শুধুই সময়নির্দেশক...ধলপহরের আগের শুকতারার মায়া আর পিছু নেয় না। যখন আমি চেষ্টায় থাকি শুধু এবং শুধুমাত্র আবহমান গ্রাম বাংলাকে খুঁজে বের করায় তখন আর প্রয়োজন পড়ে না “ইতিমধ্যে মন্তুর বুকের মধ্যে সিঁধিয়ে গেছে সে। মন্তু নিজেও জানে না কখন টুনিকে একেবারে কাছে টেনে নিয়েছে সে” লাইন দুটো উপলব্ধি করার। হাজার বছর ধরে চলে আসা নারী নির্যাতন আর কুসংস্কার আচ্ছন্ন সমাজের সার্থক চিত্রায়ন প্রমাণে ব্যস্ত থাকায় “শান্তির হাঁটের সেই রাতের পর টুনি তার অন্তর জুড়ে বসে আছে”...সেই রাত আর হয়ে ওঠে না হাজার বছরের মাঝে কোনো ব্যতিক্রমী রাত।
এতদিন এতবার পড়ার পর, আজ প্রথম বার আমি উপন্যাসটির মায়ার ঘোরে পড়লাম...
ক্লাস নাইনে পড়ুয়া একটা ছেলে টেবিলে বসে কাহিনী বলে যাওয়ার মতো শব্দ করে পড়ে যাচ্ছে একটা বই। দুই ঘর ছাড়িয়ে রান্না ঘর পর্যন্ত চলে গেছে তার শব্দ। শুনতে পেয়ে তার নানি রান্না ঘর থেকে অল্প সময়ের নোটিশে হাতের কাজ-টাজ সব গুছিয়ে গুটিগুটি পায়ে পানের বাটা হাতে নিয়ে এসে আয়েশ করে বসল ছেলেটার পড়ার টেবিল লাগোয়া খাটে। ছেলেটাকে দেখে যদিও মনে হচ্ছে এক মনে সে শুধু বই-ই পড়ে যাচ্ছে, তার নানির এই কার্যকলাপগুলোও কিন্তু তার দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে না। কোনো একদিন হয়তো ছেলেটার রুটিনে সহপাঠ বইটা নাই, সেদিন হয়তো তার নানি কাছে এসে জানতে চাইল, 'নানুরে, মকবুল বুইড়ার জ্ঞান কি পরে আর ফিরছিন না?'
অগত্যা ছেলেটিকে জটিল রসায়ন বই ছেড়ে আবার 'হাজার বছর ধরে' ঘটে চলা জীবনের রাস্তায় তার নানিকে নিয়ে হাঁটতে হয়। পরীর দীঘির ইতিহাস তাঁকে ভাবায়। মকবুলের বুড়োর মেয়ে হীরনের বিয়ের গীত তাঁর মুখে শোনা যায়। মকবুল বুড়োর মৃত্যু তাঁর হৃদয়কে মথিত করে। মন্তু-টুনির প্রেমের পরিণতিতে তাঁকে যারপরনাই খুশি হতে দেখা যায়। হাজার বছর ধরে বাড়তে থাকা রাতের অন্ধকার তাঁকে ভীত করে তোলে...
বাংলায় ভালো নম্বর তোলার থেকে নানুকে বুঝতে না দিয়ে নানুর জন্য অনেকবারই পড়েছি বইটা। বছর দুই হলো নানু নাই। নানুকে ছাড়া তাঁর প্রিয় বইটাও হয়তো আর কখনো পড়া হবে না। যেখানেই থাকুক হাজার বছর ধরে ভালো থাকুক নানু, ভালো থাকুক তাঁর এককালের মকবুল বুড়োরা।
ছোট একটি বইয়ে গ্রামের বিভিন্ন বিষয় যেন চলে এসেছে। যৌতুক প্রথা, গ্রামে নারীদের নির্যাতন, বিভিন্ন রোগ, কুসংস্কার, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, মানুষে মানুষে বিবাদের মতো গ্রামের বিভিন্ন নেতিবাচক দিক উঠে এসেছে।। আর গল্পের মাঝখানে মাঝখানে যে "পুঁথি" গুলো, আহা!! এক কথায় গ্রামের মানুষের মানসিকতা, তাদের জীবনযাপন, নেতিবাচক বিভিন্ন দিক, তাদের culture, নদী-নৌকা-জেলে সহ বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে এই একটি বইয়ে
কি এক বিষন্ন লাগছে বইটি শেষ করে! বুকটা কেমন শূন্য লাগছে! আর গল্পের চরিত্রগুলোর জন্য অশেষ মায়া আর খারাপ লাগা কাজ করছে
বাংলা সাহিত্যে এই উপন্যাস এক বিষ্ময়ে ভরা আবেগ হয়ে থাকবে হাজার বছর ধরে
কেমন ছিল ১১ বছর আগে পড়া বইটা পুনরায় পড়ার অভিজ্ঞতা!! তার আগে একটা কথা বলা দরকার। একটা জিনিস খেয়াল করলাম যে বই/মুভিটা আমার মনের সাথে কথা বলে বা প্রচন্ড ভাল লাগে সেটা বছরের পর বছর পরে পড়লে বা দেখলেও মনে থাকে। এই বইটাই ধরুন। প্রথম পাতাটা পড়ার পর আগের কাহিনি গুলো সব এসে ধরা দিচ্ছিলো। একসময় ভাবলাম সবই যখন মনে আছে তখন আর পড়বোনা এটা। অন্যটা পড়ি। তবু ছাড়তে পারলামনা।
এই হাজার বছর ধরে সেই কবে পড়া একটা বই। সেই ক্লাস ৭ এ থাকতে ১০ এ পড়া এক ভাই দিছিল পড়তে। তবুও মাঝে মধ্যেই মনে পড়ত সেই সরু রাস্তাটার কথা। সেই কলসি ভর্তি সোনা দানা নিয়ে ভেসে এসে জমি কিনে বাড়ি করার কথা টা। মনে পড়ত পরীরা দীঘি খনন করেছিলো এক রাতে সে সব কথা। আগেই বলেছি জহির রায়হানের বই পড়া আর সামনে বড় পর্দায় সিনেমা দেখা সমান কথা।
একটা গ্রাম্যজীবনের কী ছিলোনা এই গল্পে! কুসংস্কার, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, ঝগড়া, কানাকানি, কথা লাগানো, বউ পিটানো, সবাইকে মিলে বড় পরিবার। সব কিছুর সুন্দর চিত্র ফুটে উঠেছে এটাতে। কিছু কিছু গল্প একদম জিবনের সাথে কথা বলে। ( যদি জানা থাকে সে জিবন সমন্ধে )। ধরুন আপনি পড়লেন "তারা ঘাম মোছার জন্য ঢেকির সামনে রাখা বাঁশটা থেকে কাপড় নিয়ে ঘাম মুছল" আপনি কখনো ঢেকি দেখেননি। দেখেননি পা বরাবার উপরে আড়াআড়ি বাঁশ থাকে যেখানে হাত রেখে ঢেকিতে পা দিয়ে ধান ভাঙ্গে। তাহলে কিন্তু আপনি ওই লাইনটা মনের মধ্যে গেথে নিতে পারবেননা। এজন্যই গর্ব হয় মাঝে মধ্যে যে আমি এসব দেখেছি। অনুধাবন করতে সমস্যা হয়না তাই।
যাইহোক। এই উপন্যাস যে কতোটা বিখ্যাত সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সবারই প্রিয়। উপন্যাসে উপভোগ্য হবেনা এমন কোনো লাইন নেই। আবুল, মকবুল, মন্তু, টুনি, আম্বিয়া, ফকিরের মা সহ আরো সবাই যেন পুরো একটা দেশের কথা বলে। টুনির জন্য মায়া হয়। শান্তির হাটের ওই রাতের পর যেই মেয়েটা মন্তুর মনে জায়গা করে নিছিলো,যেই মেয়েটা একসময় মোহে পড়ে স্বামীর মৃত্যু চাইতো সে কেমন / কেন হটাৎ অনেক বড় হয়ে গেল, কেন কেউ গাছে ফাঁস লাগাতে গিয়ে পারলোনা, কেন সুযোগ থাকার পরো মন্তুর হাত ধরে সেদিন টুনি চলে গেলোনা, এসব কিছু একটু একটু করে গুছিয়ে যে কতোটা সুন্দর করে লিখেছেন লেখক কিছু বলার অবকাশ রাখেনা।
১১ বছর পরে পড়ে অনেক কিছু লিখব ভাবছিলাম। লিখতে এসে কিছু পাইনা। আসলে যা লিখব তা ই কম পড়ে যায়। তখনো ঠিক যতোটা উপভোগ করেছিলাম, আজও ঠিক ততোটাই করেছি। ভালোবাসার একটা বই। ❤️
বাংলা সাহিত্যে পরকীয়া শব্দটি পুরাতন। তবে ব্যবহৃত অত্যাধিক। এবং অভিযোগ এইযে সাহিত্যে পরকীয়ার ক��রনে সভ্য সমাজে অসভ্যরা এইসব অবৈধ প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ছে। পরকীয়া প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে অনেকেই হাজার বছর ধরে, পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস হিসেবে টানেন। এই দুইটাকে টানার একটা বড় কারণ দুইটা উপন্যাস ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্যে ছিল বা আছে।
তো সাহিত্য পড়ে আপনি পরকীয়াতে যদি জড়িয়ে পড়েন সেটা সাহিত্যের দোষ নাকি আপনার সেটা অন্য আলাপ। তো অনেককেই বলতে দেখি হাজার বছর ধরে উপন্যাস পড়ে পরকীয়াতে আসক্ত হয়েছেন। উপন্যাসটি উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের খারাপ করেছে। ইত্যাদি।
প্রতিটা উপন্যাসই আপনাকে ভাবাবে, তাড়িত করবে ভাবনার দিকে। কিংবা করবে প্রভাবিত। যদি না করে থাকে সেক্ষেত্রে আপনি উপন্যাসটি বুঝেননি কিংবা উপন্যাসে বোঝার মতো কিছু নেই।
প্রথমে যেটা জানা দরকার তা হলো নামকরণ। একটা উপন্যাসের নাম হাজার বছর ধরে কেন হলো। অন্য নামই বা কেন দিলেন না লেখক। সেটা জরুরী। উপন্যাসে যদি আপনি শুধু মন্তু এবং টুনির একটা সম্পর্ককেই অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন তাহলে আপনার কাজ সাহিত্য চর্চা না। বরং এটা বলতে পারেন অনেক গুলো বিষয়ের মধ্যে এটা একটা।
এইযে মকবুল বুড়া তার স্ত্রীদের দিয়া গরুর কাজ করায়। গরুর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে। আবহমান কালের বাংলাতে ঠিক এমনটায় ছিল স্ত্রীর মূল্য। হিরণকে বিয়ে দিল হাল বলদ জমি দেখে। সেই পিচ্চি হিরণ দুইদিন বাদে তালাক প্রাপ্তা হলো। আবুল পিটিয়ে পিটিয়ে বউদের মেরে ফেলে কোনো বিচার নেই। এইখানে নারীর যে হীনঅবস্থা, নারীর যে পরাধীনতা, নারীর যে অসহায়াত্ব, এসবই বিষয়। এসবই একেকটা পরিচয় এই উপন্যাসের।
এইযে কথায় কথায় বউ তালাক। গ্রাম্য কুসংস্কার। ওলার আক্রমনে গ্রাম শূণ্য। গ্রাম্য জীবনে এক কষ্ট, হতাশা। ফসলের চাষের জন্য বৃষ্টির অপেক্ষা। একজোড়া বলদ জীবনের চেয়ে যেখানে মূল্যবান।
তবে হ্যাঁ আকর্ষনীয় ব্যপারটা হলো মন্তু এবং টুনি। একটা কিশোরির মনের ভাব, মনের সংকল্প, মনের চঞ্চলতা, আবেগ, ভালোবাসা। যে বৃদ্ধের কাছে শুয়ে থাকলে মন পড়ে থাকে আরেকখানে। যে মন্তুকে পাবার জন্য যেভাবে চক্রান্ত করে। যে ভবিষ্যত পরিকল্পনা। কিংবা বাপের বাড়ি মন্তুকে নিয়ে রাতে খেজুর রসের সন্ধানে বের হওয়া। এসবই নারীর আরেক রূপ। নারী স্বার্থের জন্য যা করে আবার আবেগে তা পরিত্যাগও করে।
উপন্যাসে মকবুলের মৃত্যুর পর নদীর বুকে নৌকা ভাষানো অবস্থায় মন্তু যখন বিয়ের কথা বলে। তখন নারীর আরেক রূপ বের হয়। এ যেন কিশোরী থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক কোনো নারী। যে অসহায়ত্বের করুণ মুখোচ্ছবি ফুটে উঠে, বলে তা আর অয়না মিঞা তা আর অয়না। এইখানে পুরুষের আরেক অসহায়ত্ব প্রকাশ পায় মন্তুর হাত থেকে বৈঠা ছুটে গিয়ে।
এইযে একে একে চলে যাওয়া ওপারে। সেই একান্নবর্তী একটা সমাজের কর্তা হয়ে উঠে মন্তু। যে নন্তু শেখ সারাজীবন মানুষের জন্য কবর খুঁড়েছে সে দায়ীত্ব মন্তুর। যে মকবুল প্রতিনিধিত্ব করেছে সে দায়ীত্ব মন্তুর। দুজনকে পরামর্শ দিবে সে দায়ীত্ব মন্তুর। মানে এই যে একটা পরিবর্তন। এই শূণ্যতা পুরনের অভিযাত্রা। এ একদিনের নয়।
আবুল নেই, মকবুল নেই, সুরুত আলী নেই। কিন্তু রাত হয় দিন আসে। সূর্য উঠে। সুরুত আলীর জায়গাতে তার ছেলে পুঁথি পড়ে। রাত বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। পশ্চিম আকাশে চাঁদ হেলে পড়ে। রাত জাগা পাখির ডাঁনা ঝাপটানোর আওয়াজ পাওয়া যায়। এ হাজার বছর ধরে চলছে। হাজার বছর ধরে সেই পুরাতন চাঁদ, পুরাতন সময়, পুরাতন রাত।
কিছু কিছু বই পড়লে ভেতরের বোবাকান্নাগুলো দলা পেকে বের হয়ে আসতে চায়। বাক্যহারা হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা লাগে। এ বই নিয়ে কিছু বলার ভাষা আপাতত রপ্ত করতে পারছি না কেন যেনো!
মন্তু, টুনি, আম্বিয়া,সুরত আলী, মকবুল, ফকিরের মা, গনু মোল্লা এই চরিত্র গুলোর সাথে মনে হয় কত বছরের সখ্যতা আমার! আর কত দিনের হৃদ্যতা!
হাজার বছর ধরে এই বইয়ের কথা মনে রাখতে চাই। একটা ঘোর আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।
❝ধীরেধীরে রাত বাড়তে লাগলো। চাঁদ হেলে পড়লো পশ্চিমে। উঠোনের ছায়াটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলো। পরীর দীঘির পাড়ে একটা রাতজাগা পাখির পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ শোনা গেলো। রাত বাড়ছে। হাজার বছরের পুরনো সেই রাত...❞
বেশ কিছুদিন আগে আমাকে একজন বলেছিল গ্রামীণ জনপদে পরিবর্তন সহজে আসে না। যারা পরিবর্তন আনতে পারে তারা চায় না বা শহরমুখী হয়ে যায়। তাই গ্রামের মানুষদের চিন্তা ও জীবনযাপন বছরের পর বছর অপরিবর্তিত থেকে যায়। বইটা পড়ার সময় কথাটা বারবার মনে পড়ছিল। হাজার বছর পরও কি তেমন কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে?
পরী দীঘিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু গ্রাম। তবে এককালে এই দীঘি ছিল না। লোকমুখে শোনা যায় পরীরা এই দীঘি বানিয়েছিল। দীঘিকে ঘিরে রুপকথার গল্প প্রচলিত থাকলেও দীঘি কেন্দ্রিক মানুষগুলোর জীবন রুপকথার গল্পের মতো নয় বরং বড়োই কঠিন। ছোট গ্রামটার অতিপরিচিত ব্যক্তি মকবুল শিকদার। শিকদার বাড়িতে মোট আট ঘর লোকের বাস। আশি বা নব্বই বছর আগে বুড়ো কাশেম শিকদার ও বুড়ি ছমিরন বিবি বন্যাতে ভেসে এই গ্রামে এসেছিল। তারপর গড়ে তোলে স্বপ্নের বাড়ি। কিন্তু বুড়ির কপালে সুখ বেশিদিন ছিল না। নিজের দুনিয়া আরেকজনের হাতে গছিয়ে দিয়ে চরম বেদনা নিয়ে চলে যায় না ফেরার দেশে।
শিকদার বাড়ির কর্তা বুড়ো মকবুলের তিন বউ। বড় বিবি আমেনার ঘরে আছে তার একমাত্র কন্যা হীরন। মেজ বউ ফাতেমা অসুস্থ থাকে প্রায়। ছোট বউ টুনি ছটফটে কিশোরী। বাড়ির অন্যান্য ঘরে থাকে ফকিরের মা, আবুল, রশিদ ও মন্তু। মন্তুর সাথে টুনি মাছধরে, শাপলা তুলে আনে। দিনগুলো এভাবেই চলে যাচ্ছিল কিন্তু শান্তির হাটে কাটানো কিছু মূহুর্ত বদলে দিলো সব! ঘরবাঁধার কথা ভেবেছিল যার সাথে তার বদলে এখন যে হৃদয়ে অন্য কারো বাস! এক বিয়েতে শিকদার বাড়িতে আনন্দোৎসব শুরু হয়েছিল কিন্তু... আরেক বিয়ের কথা উঠতেই ধ্বংস হয়ে গেলো সব!
অনেক অল্পসময়ই নশ্বর পৃথিবীতে ছিলেন জহির রায়হান তবুও তিনি দিয়ে গেছেন অসাধারণ কিছু সাহিত্যকর্ম। "হাজার বছর ধরে" আমার পড়া জহির রায়হানের চতুর্থ বই। কলেবরে লেখার পরিসর ছোট হলেও মূলভাবের বিস্তৃতি ব্যাপক। এই বইও তার প্রমাণ। সাধারণ একটা গল্প তুলে ধরেছেন গ্রামীণ জনপদের কিন্তু কি জীবন্ত! বইয়ের প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক হলেও এমন চরিত্রের দেখা আমরা অহরহ পাই। চরিত্রগুলোর আছে নিজস্ব কাহিনি, আর এই কাহিনিগুলো জুড়ে গেছে একসাথে।
কী আছে এই বইয়ে?
বৃষ্টির সংস্পর্শে রুক্ষ জমিন আবারও যেন জীবন ফিরে পায়... মাটির সাথে যুক্ত মানুষগুলোও। তুমুল বর্ষনে তলিয়ে যায় চারিপাশের সব... মানুষের জীবন হয়ে যায় দুর্বিষহ। আছে কঠোর সংগ্রাম, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, নারী নির্যাতন, যৌতুক প্রথা, বাল্যবিহাহ, বহুব��বাহ, নিষিদ্ধ প্রেম, স্বপ্ন, কষ্ট, অপূর্ণতা তবে... সবকিছুকে ছাড়িয়ে যেটা চোখে পড়েছে সেটা হলো একতা। বুড়ো মকবুল, রশিদ, আবুল, মন্তুর মধ্যে যতই বিরোধ হোকনা কেন যখন প্রশ্ন আছে বংশের তখন সবাই আবারও এক হয়ে যায়। বইয়ের কোনো নির্দিষ্ট চরিত্রকে আমি মূল চরিত্র বলবো না। প্রতিটা চরিত্রই আমার কাছে কেন্দ্রীয় চরিত্র। আলোচনা কমবেশি আছে কিন্তু গুরুত্ব কারো কম মনে হয়নি।
❝এই দুনিয়া দুই দিনের মুসাফিরখানা ও ভাইরে। মইরলে পরে সব মিয়ারে যাইতে হইবো কবরে।❞
সমাপ্তি এভাবে হবে ভাবি নাই কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি, এমনটা নাহলেই বরং মানাতো না। অদ্ভুত সুন্দর একটা উপন্যাস। পড়তে যেয়ে এতটাই মজে গেছিলাম যে চরিত্রগুলোর কাজের জন্য আনন্দও হয়েছে তো আবার কখনও রাগ। আবুল যখন একে একে তার স্ত্রীদের মেরে কবরে পাঠানো শুরু করে রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে গেছিল। হালিমা যখন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে; কষ্ট হচ্ছিল। ফকিরের মা'র কান্ডকারখানা দেখে হাসিও পেয়েছে। হীরনের বিয়েতে যখন পুরো গ্রাম আনন্দে ভেসেছে আমারও আনন্দ লেগেছে। আবার টুনি যখন বুড়ো মকবুলকে আবার বিয়ের বুদ্ধি দেয় রাগে পড়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। টুনিকে আচ্ছামত সাজাও দিতে মন চাচ্ছিল। হুট করে সব শেষ হয়ে গেল! পুরো একটা পরিবার ভেঙে গেল! কিন্তু পরে টুনির জন্য খারাপও লেগেছে। পছন্দের মানুষকে পেয়েও যেতে দিয়েছে। বিবেকের দংশন নাকি লোকলজ্জায়? জানি না। তবে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে "ছমিরন বিবি"। হাসতে হাসতে নিজের একমাত্র প্রিয় মানুষকে তার সুখের জন্য অন্য কারো হাতে দেওয়া এতোই সহজ? কিছু মানুষ শুধু দিয়েই যায় কিন্তু প্রতিদানে কিছুই আশা করে না!
আমি সত্যিই দ্বিধান্বিত এই বইটি সম্পর্কে কিছু লিখতে। কিছু উপলদ্ধি থাকে যেগুলো শব্দের আশ্রয়ে প্রকাশ করা যায় না, অনুভূতির আশ্রয়ে প্রকাশ করতে হয়। তবুও আমি সেই অনুভূতি থেকে কিছু অভিব্যক্তি লেখার চেষ্টা করবো।
বইটির শেষ উক্তিদ্বয় ছিল, “রাত বাড়ছে। হাজার বছরের পুরনো সেই রাত”। উক্তিটি পড়তে যেয়ে আমার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস গনদেবতার একটি কোটেশন মনে পরে গিয়েছিলো।
সেখানে লেখক ভারতের গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে Sir Charles Matcalfe এর উক্তিটি তুলে ধরেছিলেন।
“They seem to last where nothing else last. Dyanasty after dynasty tumbless down. Revolution succeeds revolutions! Hindu, Pathan, Moghul, Maratha, Sikh, English are masters in turn, but the village community remains the same.’
হ্যা উপমহাদেশের সেই ভিলেজ কমিউনিটি একই রয়ে গেছে হাজার বছর ধরে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে থাকার নিয়ম পালন করে গেছে অভিন্ন রীতিতে হাজার বছর ধরে। আর সেই হাজার বছরের অকৃত্রিম বেঁচে থাকার ইতিহাসের দলিল হলো জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসটি।
উপন্যাসের নামঃ হাজার বছর ধরে লেখকঃ জহির রায়হান প্রকাশনীঃ অনুপম প্রকাশকালঃ অক্টোবর, ২০১২ পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৬৪ জনরাঃ সামাজিক পুরস্কারঃ আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪) চলচিত্রঃ হাজার বছর ধরে/Symphony of Agony (২০০৫)
আপাতদৃষ্টিতে এই কাহিনীর প্রেক্ষাপট বড্ড সাদামাটা। একটি দীঘিকে কেন্দ্র করে কয়েকটি গ্রামের পত্তন। নাম পরির দীঘি। সেই দীঘিকে ঘিরে কিছু রূপকথার গল্প। দীঘির পাড়ে একটি গ্রামের বাড়ির ছোট ছোট খুপরি ঘরে আটটি পরিবারের খেঁটে খাওয়া মানুষের বাস। সেই বাড়ির নাম শিকদার বাড়ি যেখানে কেউ নিজের স্ত্রীদের দিয়ে কায়িক শ্রম দিয়ে উপার্জন করে, কেউ অন্যের জমিতে চাষ করে, আবার কেউবা এত পরিশ্রমের মাঝেও পুঁথি পাঠ করে অন্যদের বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। অন্যদিকে তাঁদের পরিশ্রান্ত জীবনাচরণ যার অনেকটাই কুসংস্কার প্রভাবিত।
কিন্তু এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের জীবনবোধের গল্প একটুও সাদামাটা নয় বরং প্রজন্ম পর প্রজন্মকে তাঁদের এই জীবনবোধ নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে। আমি কাহিনীতে বিস্তারিত যাবো না। শুধু উপন্যাসে যেসব চরিত্র আমাকে প্রভাবিত করেছে তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা করবো।
এই উপন্যাসের নায়ক মন্তু। শিকদার বাড়ির একমাত্র অকৃতদার পুরুষ। বাড়ীর প্রধান অভিভাবক মকবুল বুড়োর কনিষ্ঠা স্ত্রী টুনি বয়সের কারণেই সম্ভবত মন্তুর মাঝে নিজের বন্ধু খুঁজে নিয়েছিলো। সেই নিদ্রাহীন মাছ ধরার রাত গুলো। বাপের বাড়ি থেকে ফিরে আসার নৌকাযাত্রায় মন্তু টুনিকে এতটা কাছে পেয়েও নিজের সীমা লঙ্ঘনের চিন্তা মনে ঠাই দেয়নি। একজন অশিক্ষিত গ্রামের খেঁটে খাওয়া যুবকের সহিষ্ণুতার মাঝে আমরা দেখতে পাই এদেশের লক্ষ মন্তুকে যাদের কাঁধে রেখে আজ নিঃশ্বাস ফেলে অর্জিত নব্য সভ্যতা। কিন্তু আজ তথাকথিত শিক্ষিত পুরুষেরা যখন নারীদের অসম্মান করে তখন ঐ হাজার বছরের পুরাতন মন্তুর কাছে তারা যে কিভাবে হেরে যায় তারা হয়তো সে খবর রাখেনা।
পরপর দুই স্ত্রীকে হত্যা করার পর আবুলের তৃতীয় স্ত্রী হালিমা যখন মৃত্যুর মুখে ঢলে পরে আমার খারাপ লাগেনি। কারণ হালিমার অতীত হয়নি তারা আজও বর্তমানকে দখল করে রেখেছে। হাজার বছর ধরে পশুরা পশুই রয়ে গেছে। তাই আজও প্রতিদিন কোন না কোন হালিমা কোন না কোন আবুলের হাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে নিঃশব্দে।
বুড়ো মকবুলের মৃত্যুর পর যখন মন্তু টুনিকে যখন শান্তির হাঁটে নিয়ে বিয়ে করতে চাইলো। তখন টুনি অতিচাপা স্বরে ফিসফিস করে বলেছিল, “না তা আর হয়না মিয়া। তা আর হয়না”। কেন টুনি তার আরাধ্য প্রেমকে প্রত্যাখান করেছিল যার জন্য সে প্রতিবেশী রশীদের স্ত্রী সালেহাকে নির্মমভাবে প্রহার করতেও দ্বিধা করেনি। হয়তো স্বামী বুড়ো মকবুলের মৃত্যু জন্য নিজের দায়বদ্ধতা এড়াতে পারেনি। তার বিবেক তাঁকে এক মূহুর্তে জন্য ভুলতে দেয়নি, সে আম্বিয়াকে বিয়ে করার মন্ত্রনা দিয়ে মকবুল বুড়োকে দিয়েছে সেখান থেকে উৎপন্ন বচসায় আবুলের আঘাতেই মকবুল বুড়োর মৃত্যু হয়। বিবেকের দংশনের একজন স্বল্প বয়সী তরুণী তার সমগ্র জীবন নিঃসঙ্গতার অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়। এমন প্রায়শ্চিত্তের যে জীবন দর্শন যে নারীরা বুকে ধারন করে গ্রাম, শহর, অতীত, বর্তমান দিয়ে তাঁদের কি আসলেই বিচার করা যায়?
ব্যক্তিগত অভিমতঃ
শীত যায়, আসে বসন্ত। আসে নতুন যুগ। হাজার বছরের পরম্পরায় ভাঁটা দিয়ে এসেছে একাবিংশ শতাব্দী। অন্ধকার রাত্রি পেরিয়ে এই শতাব্দীর নিজেকে আলোর স্বত্বাধিকারী দাবী করে। কিন্তু আলো মানে কি শুধু যন্ত্রের উৎকর্ষতা। মানে কি শুধু ভালো খাওয়া, ভালো পরা। নতুন শতাব্দীর আলো যদি তরুণের মাঝে মন্তুর মত সহিষ্ণুতা, সম্মানবোধ জাগ্রত করতে না পারে, টুনির মত জীবনকে বিবেকের দৃষ্টিতে না দেখতে না পারে, সুরত আলীর পুঁথি পাঠের মত স্বস্তি না দিতে না পারে সেই আলো ব্যর্থ।
সুখের সন্ধানের মানুষ আজ স্বস্তির অর্থ ভুলে গেছে। আজও মন্তুর ঐ ছাউনি দেয়া ছোট্ট নৌকাটায় টুনিকে নিয়ে কখনো স্রোতের অনুকূল আবার কখনো প্রতিকূলে ভেসে বেড়ানো, মাঝপথে মুঠো মুঠো শুকনো চিড়ে নিঃশেষ করার মাঝেই সুখ লুকিয়ে বাঁকা হাসে। আর সবাই তাঁকে দাম দিয়ে কেনা মানুষের ভিড়ে খুঁজে মরে।
ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগলো। চাঁদ হেলে পড়লো পশ্চিমে। উঠোনের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলো। পরীর দীঘির পারে একটা রাতজাগা পাখির পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ শোনা গেলো। রাত বাড়ছে। হাজার বছরের পুরনো সেই রাত।
কোনো ধরণের প্রত্যাশা ছাড়াই বই পড়লেই হয়ত সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে। "হাজার বছর ধরে" বইটা কোনো প্রত্যাশা না নিয়েই শুরু করেছিলাম। সেকারণেই হয়ত এতটা চমকে দিল।
বইটার গল্প খুবই সাধারণ। একটা গ্রামের কিছু মানুষের একদম সরল জীবনের গল্প। কিন্তু তার মধ্যে রয়েছে আরও গভীর বিষয়। তাদের মানসিক টানাপোড়েনের-নিজেদের মধ্যের সম্পর্কের গল্প। বইয়ের প্রত্যেকটি চরিত্র বিশেষ করে, মকবুল,আবুল,মন্তু,টুনি,সুরত আলী,আম্বিয়া,আমেনা, ফাতেমা,হীরন এদের সাথে যেন একদম জড়িয়ে গেছিলাম। হৃদয় ছুঁয়ে যাবার মত ছিল একদম। আর বর্ণনা! কী সুন্দর গ্রামের বর্ণনা দিয়েছেন জহির রায়হান। চোখের সামনেই সব ভেসে ওঠে,সব অনুভব করা যায়। আমার মতে, বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিকের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য এই বই। শেষে বইয়ের একটা জায়গার উদ্ধৃতি দিচ্ছি- "বুড়ো মকবুল,রশীদ,আবুল,সুরত আলী। কেউ নেই। জীবনের হাটে সকল বেচাকেনা শেষ করে দিয়ে একদিন অকস্মাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে ওরা।"
কিছু উপন্যাস জীবনের সাথে মিলেমিশে যায়। সেই ছোট বেলায় কারো সহপাঠ বইয়ে পড়েছিলাম হাজার বছর ধরে৷ বহুবছর পরে আজ আবার পড়লাম। আবেদন কমে নি, এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠে পরীদিঘী, মন্তু, টুনি, মকবুল, আম্বিয়া.... আবারো বহু বছর পরে পড়বো যদি বেঁচে থাকি।
হাজার বছর ধরে,উপন্যাসটি নবম-দশম শ্রেণীতে সহপাঠ বা আনন্দ পাঠের অংশ ছিল।তখন যে কতবার পড়েছি তার ইয়াত্তা নেই,খুব ভালো লাগতো। তখন ছোট ছিলাম সাহিত্য পড়ে তা নিয়ে খুব একটা ভাবনা -চিন্তা করা হতো না। টুনির কথা গুলো খুব ভালো লাগতো -বুড়ার নাক কাইটা দিমু না।মকবুলের তিন বউ এটা নিয়ে হাসাহাসি করতাম আমরা বান্ধবীরা।বড় বউয়ের দাঁতে পোকা,মেজটার পেটের ব্যামো এইগুলা তখন হাসির খোরাক জোগাতো। অনেকদিন পড় আবার পড়লাম এখন মকবুলের তিন বিয়ে পড়ে হাসি আসে না, বরং মনে ক্ষোভ হয়। টুনির -মন্তুর সম্পর্কটা এখন বুঝতে পারি।মকবুল-টুনির মধ্যে বয়সের ব্যবধান অনেক তাই স্বাভাবিকভাবেই টুনি মন্তুর প্রতি টান অনুভব করে। কিন্তু টুনি অনুতাপ বোধ থেকে হোক বা সমাজের কথা ভেবেই হোক মন্তুর সাথে আর ঘর বাঁধে নি। কোন এক সময় মকবুল আট ঘরের প্রধান ছিল,সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে মন্তু এখন প্রধান।মানুষ মারা যায় কিন্তু কোন কিছু থেমে থাকে না, হাজার বছর ধরে যেভাবে চলে এসেছিল সবকিছু এখনো সেভাবে চলছে সব।
আমার স্পষ্ট মনে আছে। অষ্টম শ্রেণীতে থাকতে আমার খালামণির কাছ থেকে বইটা নিয়ে এক বসায় পড়ে শেষ করেছিলাম জহির রায়হান এর অসাধারণ এই সৃষ্টি। পরবর্তিতে আরো কয়েকবার পড়লেও বইটি এখনো আমার কাছে নতুন।
উপন্যাস টি বটগাছে ঘেরা একটি পথের কথা বলা হয়েছে। কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা। আমার বাড়ি কুমিল্লা শহর থেকে কিছুটা দূরে। ১৭ টি বসন্ত পার করলেও কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার সৌভাগ্য এখনো হয় নাই। তাই ওই বটগাছ ঘেরা পথের কথা ও শুনি নাই।
উপন্যাস এ আসি। এটি দীর্ঘ একটা সময় ধরে ৯ম -১০ম শ্রেণীর পাঠ্য ছিল। যেই কারনে বলা যায় এই উপন্যাসখানি বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশিবার পঠিত উপন্যাস গুলোর একটি।
এই উপন্যাসের গুরুত্ব অন্য জায়গাতেও আছে। দারিদ্রের বাস্তবতা করুণ ভাবে উঠে এসেছে এতে। কিছুটা উল্লেখ করি,
❝ হাঁড়িপাতিলগুলো একপাশে টেনে নিয়ে বাসন-বাসন ভাত বাড়ছে আমেনা। হঠাৎ মন্তুকে সামনে পেয়ে আমেনা জিজ্ঞেস করিলো, মানুষ কয়জন? মন্তু বলল, আটজন। আটজন! আমেনার মাথায় রীতিমতো বাজ পড়লো। আটজনের কি ভাত রানছি নাকি আমি?আমি তো রানছি চাইরজনের। তোমার ভাইয়ে আমারে চাইরজনের কথা কইছিলো। বড় ঘর থেকে রান্নাঘরের দিকে আসছিলো মকবুল,কথা টা কানে গেল ওর। পরক্ষণে ভেতরে এসে রাগে ফেটে পড়লো সে। আমি কি জাইনতাম,আটজন আইবো ওরা? বারবার কইরা কইয়া দিছি চারজনের বেশি আইসেন না আপনারা।ওরা তহন মাইনা নিছে। আর এহন- বলে ঠোঁটজোড়া বিকৃত করে একটা বিশ্রী মুখভঙ্গি করলো মকবুল,হালার ভাত যেন এই জন্মে দেহে নাই হালারা। ❞
তার মেয়ের বিয়ের ফর্দ হওয়ার কথা ছিল ওইদিন। আর ওনারা তার বেয়াই পক্ষ। সুতরাং দারিদ্র্যতা কী পরিমাণে ছিল তা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন!
শুধু এটি নয়। পুরো বই জুড়ে নানা কথায়, নানা বর্ণণায়, নানা অবস্থানে দারিদ্র্যতার চিত্রটুকু ফুটে উঠেছে।
ছেলেবেলার প্রথম উপন্যাস। বাদলা দিনে মনে পড়ে। বড় ভাইয়ের সহপাঠ বই ছিল পুরনো ক্যালেন্ডারে মোড়ানো। একই রুমে আমরা পড়তাম। আমার রঙিন, তেল চকচকে আর সচিত্র বইয়ের পাশে ওর এসব বই পড়ে থাকত। নিয়ে পড়েছিলাম।
বাবার সাথে করে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে মহাসড়কের পাশে একটা ছোট্ট ক্ষেতে লাল শাপলা ফুটে থাকত। ওই জায়গা ক্রস করলেই বাবা বলতেন, দেখো কত শাপলা। টুনি মন্তুর শাপলা তুলতে যাওয়া তাই আমার ছোটবেলার কল্পনায় বেশ একটা দাগ কেটেছিল। বুড়ো মকবুলের বউকে কলুর বলদের মত খাটানোতে হাসি পেয়েছিল। ছোট ছিলাম, সোশ্যাল স্ট্র্যাটামের নির্লজ্জতা ঠাহর করতে পারিনি। রাত বিরেতের এডভেঞ্চার আমার কাছে নিষিদ্ধ লাগেনি। বরং মনে হয়েছিল বাকি সব কার্টুন ক্যারেক্টারের মতনই টুনি আর মন্তু। বোধহয় সব সামাজিকতার খোলস ঝেড়ে ফেললে, মানুষ নিছকই কার্টুন ক্যারেক্টার। যাদের অযাচিত র্যাশনালিটির আড়ালে সেই আদিম চিত্রকরের পুতুলনাচের সভায় নিরন্তর নড়ছি, চড়ছি, রঙ মেখে গাইছি। জীবনের হয়ত নেহায়েতই কোন মানে নেই।
কুশলী লেখকের খেলাই এখানে। যেকোন বয়সেই প্রাসঙ্গিকতা পাওয়া যায়।
এখনো হাজার বছরের পুরনো রাত বাড়ে। পাঠ্যবই ক্যালেন্ডারের গ্লসি কাগজে মোড়ানোর দিন শেষ। সবকিছু একটা শূন্যবিন্দুতে এসে ঠেকবে এই ভয়ে বুক ধুকপুকানি বেড়ে যায়। রাত ক্রমাগত বেড়েই চলে।
মাধ্যমিকে পাঠ্যবই হিসেবে থাকার সুবাদে এর আগে বহুবার পড়া হয়েছে এই বই। অনেকদিন পর আবারও পড়লাম। এতদিন পরে এসেও বইটার আবেদন একবিন্দুও কমে যায়নি আমার কাছে। প্রতিবারই যখন পড়ি, সেই একই ভালোলাগা কাজ করে যা প্রথমবার পড়ার পর হয়েছিল। শেষের পৃষ্ঠাগুলোতে এসে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় চেপে ধরে মন। আমার সবসময়ের প্রিয় বইগুলোর মধ্যে এটা একটা।
৪.৫/৫ অনেক আগে বইটি অবলম্বনে তৈরি সিনেমাটি দেখা হয়েছিল।মন্তু চরিত্রে রিয়াজ আর টুনি চরিত্রে শশী অভিনয় করেছিলেন।পড়ার সময় সিনেমার দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভাসছিল।
আমার কাছে যেকোনো উপন্যাসের বর্ণনাভঙ্গি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।শুধুমাত্র বর্ণনাভঙ্গির জন্যই একদম সাধারন কাহিনিই অসাধারন হয়ে উঠতে পারে।এই উপন্নাসটির বর্ণনাভঙ্গিতে খুব একটা বৈচিত্র্য পাইনি।একদম সহজ সাবলীলভাবেই কাহিনি এগিয়েছে।
পড়া শুরুর পর শেষ পৃষ্ঠার আগ পর্যন্ত একদমই সাধারণ মনে হয়েছিল উপন্নাসটিকে।সহজ সরল কাহিনির ভেতরের মর্মস্পর্শী আবেদনটিকে যে তখনো ধরতে পারিনি।শেষ পৃষ্ঠায় এসে উপন্যাসটির প্রতি অনুকল্পিত ধারণাটি আমূল বদলে যায়।আমি অবাক হয়ে জহির সাহেবের কালজয়ী এই সৃষ্টির মর্ম ধরতে সক্ষম হই।জহির সাহেব তাঁর সাহিত্যিক প্রজ্ঞা ব্যবহার করে কি নিপুণ হাতে মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠার ছোট্ট বইটিতে পুরো মানবজীবনের ইতিহাস টুকে ফেলেছেন ভাবতে গেলে অবাক না হয়ে পারা যায় না।
জন্ম-মৃত্যু, রোগ-শোক, হিংসা, ভালোবাসা, যৌবনের ব্যর্থ প্রেম, পৃথিবীতে উত্তরসূরী রেখে যেতে চাওয়ার তীব্র আকুলতা, সর্বোপরি মানবজীবনের ধারাবাহিকতা সবই উপস্থিত এতে।টুনি চরিত্রের একটি বিষয় অসাধারণ মনে হয়েছে।যে টুনি সবসময় বুড়ো মকবুলের মৃত্যু কামনা করতো, সে-ই বুড়োর মৃত্যুর পর কেদেঁ বুক ভাসিয়েছে।মানুষ আবেগি, সময়ে আবেগি, অসময়ে আবেগি।মানুষের আবেগের রূপায়নের মাধ্যমে হাজার বছরের ইতিহাস একে ফেলতে পারাতেই জহির রায়হানের এ উপন্যাসটির সার্থকতা।
'Hajar Bochor Dhorey' tells the tale that is a constant for thousand years. Must read for any Bangladeshi. I read it in school and still consider it as the most insightful novel that symbolize the lives of "Bangla Souls".
রাত বাড়ছে... হাজার বছরের পুরানো সেই রাত... কিছু উপন্যাস শুধু বইয়ের পাতায় নয় বরং মানুষের জীবনে মিশে থাকে। উপন্যাসগুলো পড়ে মনে হয় মানুষের জীবনের প্রতিফলন দেখা যায়। "হাজার বছর ধরে" এমনই একটি উপন্যাস
সাহিত্যিক মান বিচারে অসাধারণ হলেও , প্রত্যাশার পারদ নিয়ে পড়তে বসায় খুব বেশী ভালো লেগেছে তা বলবো না অন্যান্য বই এর তুলনায়। তবে অনেক সুন্দর ভাবে একটা সম্পূর্ণ গ্রাম তুলে ধরে তখনকার এক পল্লী গ্রাম এর সমাজের চিত্র খুব ই নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ।