Kolkatar Kachhei written in 1957 brought Gajendra Kumar Mitra the Sahitya Akademi Award. Set in early twentieth century, it is the story of Rashamoni and her twin daughters, Shyama and Uma and their diverse yet cruel fate. In his portrayal of the lives of the protagonists Gajendra Kumar Mitra both explores and critiques ruthlessly the then society of Bengal, which treated women with inhuman callousness. Dr. Anasuya Guha, translator of the book, is professor and Head of the Department of English at Bethune College in Kolkata. She is the great granddaughter of the noted editor and journalist Ramananda Chatterjee.
Gajendra Kumar Mitra was born on 11 November 1908. He was a versatile writer. He wrote many novels, short stories, plays, essays and poems. Mitra also translated a few English novels into Bengali, such as Dickens's A Tale of Two Cities. He used to write with his left hand. His genuine love and concern for Bengali literature inspired him to co-found the famous Mitra and Ghosh Publishers. Mitra was childless. He died on 16 October 1994 in Calcutta (now Kolkata).
Mr Mitra along with his friend Sumathanath Ghosh established Mitra & Ghosh Publishers on 9 March 1934. Novels: Kanta Prem Pānchajanya Rai Jāgo Rai Jāgo Kolkatar Kāchei (Translated as A Stone's Throw from Kolkata) Paush Phāguner Pālā Upakanthe Bahnibanyā Rātrir Tapashyā Pashaner Khuda
একশো বছরেরও পুরনো প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস অথচ গল্পের মানুষজন আর পটভূমি খুবই চেনা,এখনো প্রাসঙ্গিক। শ্যামা,উমা,কমলা,রাসমণি, নরেন,দেবেন,মহা,রমেশরা আগেও ছিলো, আজো আছে।এ উপন্যাস বিংশ শতকের শুরুতে সাধারণ বাঙালি হিন্দু সমাজব্যবস্থার এক জীবন্ত দলিল।স্বামী খারাপ?মেনে নিতে হবে।স্বামী পতিতালয়ে যায়?মেনে নিতে হবে।দু'বেলা দু'মুঠো অন্ন জোটে না?মেনে নিতে হবে।সমাজ চোখ রাঙায়?মেনে নিতে হবে।সব মেনে নিতে হবে।এরই মধ্যে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে কীটের মতো দাঁত কামড়ে ধরে বেঁচে থাকতে হবে।শুধু বাঁচাটাই সত্য।বাঁচার জন্য আত্মসম্মান ভুলতে হবে সবার আগে।বাঁচার জন্য শ্যামার অধঃপতন দেখে শিউরে উঠেছি আর ভেবেছি এমন কতো মানুষ যে আমার চারপাশে!! মানুষ খুব একটা এগোতে পারলো কই?মেয়েরাও কি অনেক এগোতে পারলো?এখনো তো মেয়েদের কানে "মানিয়ে নাও,সবকিছু মেনে নাও" মন্ত্র বলার মহোৎসব। এখনো সেই আদিম অন্ধকার ঘিরে আছে আমাদের। প্রথমবার গজেন্দ্রকুমার মিত্রের লেখা পড়ে তার ভক্ত হয়ে গেলাম বলা যায়।দারুণ গতিশীল, স্বাদু গদ্য তার।
প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিকতা বা মানুষের অনুভুতিগুলির এত সুক্ষ বর্ণনা যে এত অসাধারণ হতে পারে এই বই না পড়লে সত্যিই জানা যাবে না । লেখাগুলো পড়তে পড়তে চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, সেই গহীন অরন্যসম দুর্ভেদ্য এবড়ো খেবড়ো, খানা-খন্দপূর্ণ দূর্গম পথ। সেই দুর্গম দূর্বিসহ স্থানে বসবাসকারী মানুষগুলি আর তাদের প্রস্তর কঠিন জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি বিষয়াবলী নিয়ে রচিত কথকতাই এই উপন্যাসের মূল বক্তব্য। আর উপন্যাসের নায়িকা এক অতিশীপর বৃদ্ধা "শ্যামা ঠাকরুন"।
শ্যামা- উমা কিংবা তাদের মা রাসমনি, শ্বাসুড়ী ক্ষমাসুন্দরী বা শ্যামা এর বড় জা রাধারাণী সকলের অনুভুতিগুলির সুক্ষ প্রকাশ কি করে সম্ভব, কি করে সম্ভব নরেণ, বড়ভাই দেবেন বা সরকার গিন্নী মঙ্গলার এত সুক্ষ চরিত্র বর্ণন, এই লেখকের লেখনীতে তা বুঝি একমাত্র জানা যায়। গজেন্দ্রকুমার মিত্রের এই বইটি তাই আমার হৃদয়ের কুঠুরীর অনেকটা জায়গা জুড়েই রয়ে থাকবে।
ভাগ্যাহত এক মা, এবং তার ভাগ্যাহত দুই মেয়ের গল্প। পড়তে পড়তে আপনার মনে হবে এদের অবস্থা বুঝি এর চেয়ে খারাপ হতে পারে না। কিন্তু তাও হয়। পুরো উপন্যাস জুড়ে তিন জন মানুষের দুর্ভাগ্যই শুধু দেখা যায়। এর বেশি কিছু নেই আসলে। কিন্তু তারপরও কি একটা আকর্ষণ আছে বইটার। শেষ না করে শান্তি হয় না। আর খুব সহজ ভাষায় লিখা। এক টানেই পড়ে ফেলা যায়।
তিন বোন কমলা,শ্যামা,উমা যেন কোনো এক স্বর্গীয় বৃক্ষের ফুটফুটে তিনটি ফুল। আর বৃক্ষমাতাটি হলেন রাশমনি।যেমন রাজেন্দ্রাণীর মতো তার রূপ,তেমন রাশভারী,দৃঢ় তার ব্যক্তিত্ব। স্বামীর মৃত্যুর পর সেই ইংরেজ আমলে-ই তিন কন্যাদের একলাই শক্ত হাতে মানুষ করেছেন,অল্প বিস্তর লেখাপড়া শিখিয়েছেন।জীবনের শত বিপদ-আপদেও একটুও টলেননি।শক্ত বৃক্ষের মতোই সর্বদা খাড়া,অটল থেকেছেন আর নিজের অর্জিত সব জ্ঞান-গরিমা,বিদ্যে,ধন-সম্পদ,আচার-বিচার-সংস্কার নিংড়ে পুষ্পসম মেয়েগুলোকে পুষ্ট করেছেন। সেই এত আদরের মেয়ে তিনজন কালের স্বভাবসিদ্ধ নিয়মে বৃক্ষ থেকে আলাদা হয়ে যখন স্বামীর ঘরকন্না করতে গেলো,পারলো কি পুষ্পার্ঘ্য হতে?নাকি হেলায় ফেলে দেয়া ফুলের মতো পদদলিত হলো?
শ্যামা ট্রিলজি আমার অনেকদিনের উইশলিস্টে ছিলো।কয়েকপাতা পড়ে চরিত্রগুলোর কার্যকলাপে বিরক্ত হলেও নিজেকে সংযত করেছি।আধুনিক জীবনের আলোকচ্ছটায় বসে,ভরপেট নিয়ে,শ্যামার অর্ধাহার,অনাহারের দারিদ্র্যক্লিষ্ট দিন যাপনের আমি কি বুঝবো?!কতখানি দৈনতার করালগ্রাসে পড়লে শ্যামার মতো নমনীয়,কোমল,সভ্য মানুষ লোভাতুর,উগ্র বৈষয়িক,অসভ্য হয়ে উঠে তা হয়তো ভেবেও কূল পাবো না। আর বাংগালী নারীর দুর্দশার চিত্র?পট পালটেছে,চিত্রটাও ভিন্ন,কিন্তু দুর্দশা চিরন্তন।এরবুঝি কোনো শেষ নেই।তবুও মনে আশা রাখি।হয়তো শ্যামা-উমা-কমলারা ঘুরে দাঁড়াবে।না হোক বইয়ের পাতাতেই।
কলকাতা শহর থেকে খুব কাছেই একটা জায়গা। আপাতদৃষ্টিতে শহর থেকে এতো কাছে হলেও সেটা গণ্ডগ্রাম। পথগুলো গ্রীষ্মে-শীতে ধুলোর সাগর আর বর্ষায় হাঁটু সমান কাদা নিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যায়। এই পথেরই পাশে কোথাও, অনেক গাছপালায় ঢাকা এক খণ্ড জমি। এখানে এলে মনে হবে যেন সূর্যের আলো কখনও প্রবেশ করে না। ভ্যাঁপসা গরমে দম বন্ধ হয়ে আসবে। এবং তখনই নিশ্চিত হতে পারবেন যে আপনি শ্যামা ঠাকরুনের বাড়িতে এসেছেন।
অনেকখানি জায়গা নিয়ে শ্যামা ঠাকরুনের বাড়ি। আর সেই বাড়ির চারপাশে এক বিঘৎ জমিও সে খালি রাখেনি। সব জায়গায় ঠেসে লাগানো গাছপালা। কিন্তু তাতে ফল ধরে না। সূর্যের আলো পায় না বলে গাছের ফলন নেই। কিন্তু বৃদ্ধা শ্যামা তা বুঝতে চান না। মনে মনে ভগবানের কাছে অভিযোগ জানায় শুধু। কত বয়স হল শ্যামার? আশি? হবে হয়ত। তার বয়সের গাছপাথর হিসেব করার কেউ নেই এখন। ছিটগ্রস্ত এই বৃদ্ধা এখন একাকি এক বিশাল বাড়িতে বাস করেন। ছেলে মেয়ে সব দূরে। দিনের বেলায় শ্যামা পাতা কুড়ান আর রাত কাটে নির্ঘুম। রাতে সে ভাবে তার অতীত।
শ্যামার মা রাসমনি। তার চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়। গঙ্গার ঘাটে রাসমনিকে দেখে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ জমিদারের উদ্বেল হৃদয়ের ফলাফল তার বিয়ে। বৃদ্ধ জমিদার মানুষটা ভালো ছিল। তরুণী ভার্যাকে ভালবাসত। কিন্তু সে বেঁচে রইল না বেশিদিন। আর জ্ঞাতিরা রাসমনির নামে কলঙ্ক তুলে বের করে দিলো ঘর থেকে। স্বামীর ভালবাসার উপহার গয়নাগুলো সম্বল করে রাসমনি কলকাতায় এলেন। এখানেই একা হাতে মানুষ করতে শুরু করলেন তিনটি মেয়ে। কমলা,শ্যামা আর উমা।
একা যুবতী রাসমনি বাস করেন কলকাতায়, তিনটি মেয়ে নিয়ে। কিন্তু তাই বলে তাকে গঞ্জনা খুব একটা সহ্য করতে হয়নি। কারন দুটো। প্রথমত তার ব্যক্তিত্ব, দ্বিতীয়ত পড়শিদের সাথে কখনও মিশতে যাননি। একা একাই থেকেছেন ভাড়ার বাড়িতে। বড় মেয়ে কমলাকে বিয়ে দেন। সোনার জামাই তার। মেয়ে সুখেই থাকে। এমন সময় ঘটকী আসে শ্যামার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে। খুব একটা খোঁজ খবর না করেই শ্যামাকে বিয়ে দেন রাসমনি।
শ্যামার গল্প শুরু হয় এখান থেকেই। কলকাতায় বসবাসকারী শ্যামা গিয়ে ওঠে এক গণ্ডগ্রামে। রাসমনি লেখাপড়া জানতেন। যেটুকু জানতেন তা দিয়েছিলেন মেয়েকেও। কিন্তু শ্যামার শ্বশুরবাড়ি তেমন না। আরও টের পেল,তার স্বামী নরেন একটা অমানুষ। ছিটগ্রস্ত এই লোকটা জানোয়ারের সমান। মাকেও সে গালাগালি করতে কসুর করে না। শাশুড়ি ক্ষমাদেবী অবশ্য শ্যামাকে মেয়ের মতই দেখেন। কিন্তু নরেনের অত্যাচারে জীবনটা বিষিয়ে যেতে শুরু করে।
নরেন যখন তখন তার শাশুড়ির ��াছে চলে আসে। টাকা চায়। কখনও শাশুড়ির গয়নার তলব করে। নরেনের সংসারে মতি নেই। সে তার গ্রামের বারো বিক্রি করে কলকাতায় যায় নতুন বাড়ি খুঁজ��ে। শ্যামা, ক্ষমাদেবী আর শ্যামার জা রাধারানীকে রেখে ওরা দুই ভাই যায় কলকাতায়। আর সেখানে গিয়ে বেশ্যা বাড়িতে দুই ভাই টাকা উড়িয়ে ফিরে আসে শূন্য হাতে, যৌন রোগ নিয়ে।
এরই মাঝে শ্যামার যমজ বোন উমাকে বিয়ে দেয় রাসমনি। উমার স্বামী শরৎ। সে নরেনের মত অমানুষ হয়। সুন্দর করে কথা বলে উমার সাথে। কিন্তু সে স্ত্রীর মর্যাদা দেয় না উমাকে। কেননা কলকাতায় তার এক রক্ষিতা আছে এবং সে তাকেই ভালবাসে। মায়ের জোরাজুরিতে সে বিয়ে করেছে। আর উমার শাশুড়ি চামার। সে বৌ এনেছে দাসী খাটানোর জন্য। মৃতপ্রায় উমাকে একদিন এক প্রতিবেশী নিয়ে এসে রেখে যায় রাসমনির কাছে। সেই থেকে উমা থাকে রাসমনির কাছে। সুখ শান্তি ঘুম-উমা শ্যামা আর রাসমনির জীবন থেকে বিদায় নেয়।
জীবন থেমে থাকে না। থেমে থাকে না গল্প। শ্যামার শাশুড়ি ক্ষমাদেবী মারা যায়। নরেন আসে-যায়। শ্যামা এক সন্তানের জননী। একদিন নরেন তার বৌ আর ছেলেকে নিয়ে এক যজমান বাড়িতে তোলে। সে ব্রাহ্মনের ছেলে, পৈতা আছে। মন্ত্র জানুক আর না জানুক, ওতেই চলে যায়। আর ধরিবাজ নরেনের জন্য এসব কোন ব্যপার না। বদলে যেতে থাকে শ্যামা। মায়ের কাছ থেকে পাওয়া আভিজাত্য গুড়িয়ে যেতে থাকে। জীবনের প্রয়োজনে সে হয় স্বার্থপর। কখনও চোর।
রাসমনি সুন্দরী ছিলেন। তার রূপ পেয়েছে প্রতিটি মেয়েও। সেই রূপের ডালি আর যৌবনের ঝাঁপি নিয়ে উমা বসে আছে। শরৎ তো নরেনের মত জানোয়ার না। তবু সে কেমন মানুষ...।!! এমন বৌকে যে ঘরে নেয় না। উমা তাদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তায় দৃষ্টি পাতে। যদি একবার শরতের দেখা মেলে...!!!
গজেন্দ্রকুমার মিত্রের বই ‘কলকাতার কাছেই’। উপন্যাস নয়, বরং একটা সময়ের মানুষদের মানসিক, সামাজিক আর পারিবারিক অবস্থানের ছবি। রাসমনি আর তার পরিবারের এই গল্প শুধু তাদের একার নয়। এমন গল্প সেই সময়ে কলকাতার অনেক পরিবারে দেখা যেত। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া, ব্রাহ্মণদের নাম-সর্বস্ব কৌলীন্য ধ্বংস করত জীবন। নষ্ট করত মানুষের সৌকুমার্য। বাঁচার জন্য বিকাতে হত আত্মসম্মান।
রাসমনির একটা মেয়েই শুধু সুখে ছিল,কমলা। সুযোগ সুবিধা মত সে উমা-শ্যামাকে সাহায্যও করত। কিন্তু রাসমনির কপালে বুঝি কোন অভিশাপ আছে। মারা যায় কমলার স্বামী। ছেলেকে নিয়ে সে এখন একা। স্বামীর সামান্য সঞ্চয় আর নিজের গয়নাকে পুজি করে বেঁচে থাকার শপথ নেয় সে।
উমাকেও বাঁচতে হবে। রূপের ডালি নিয়ে কলকাতায় একা যুবতীর বেঁচে ঢাকা বড় কঠিন। তবু তাঁকে পারতে হবে। সে সেই চেষ্টা করে। যেটুকু লেখাপড়া শিখেছিল তাঁকে পুজি করে মেয়ে পড়িতে কয়েকটা টাকা রোজগার করে।
শ্যামা তার মানসিকতা বদলে ফেলেছে। বাঁচার জন্য যে কন কিছু করতে রাজি সে। বিবেক বিসর্জন দিয়েছে অনেকটাই। বেহায়ার মত মায়ের গয়না আর বাসনে ভাগ বসায়। নরেনের স্বভাব তার মাঝেও ঢুকে গেছে। তার ছেলে হেম একটু বড় হয়েছে। সেই যজমান বাড়িতে নিয়মিত পূজা দেয়। মেয়ে মহাশ্বেতার বিয়েও দিয়ে ফেলল। মহাশ্বেতার জামাই অভয়পদ একটা অদ্ভুত মানুষ। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করার শপথ নিয়ে জন্মেছে এই অল্পভাষী মানুষটা।
রাসমনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সময় বুঝি শেষ। কমলার একটা সন্তান আছে, ছেলে। কমলাকে সে দেখবে। নরেন অমানুষ হলেও সে মাঝে মাঝে দেখা দেয়। শ্যামাকে মারুক তবু শ্যামা তার স্পর্শ পায়। শ্যামার ছেলেও আছে। উমা বড়ই একা। তার কেউই নেই। মা ছিল, সেও চলে যাচ্ছে। উমার কথা ভেবে রাসমনির বুক ফেটে যায়। যমের ডাকে তবু সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। মেয়েটাকে একা রেখে যেতে হয়। কিন্তু উমা যখন শ্মশানে যাওয়ার জন্য ছুটতে থাকে, তার পাশে শরতকে দেখা যায়।
গজেন্দ্রকুমার মিত্র দেখিয়েছেন সময়ের সাথে মানুষের বদলে যাওয়া। বেঁচে থাকার জন্য তাদের সংগ্রাম। মনের কুৎসিত দিক আর সৌকুমার্যের দ্বন্দ্ব। ‘কলকাতার কাছেই’ যে এমন কিছু ঘটনা এমন কিছু পরিবার থাকে তা মানুষের চোখে পড়েও পড়েনি। পড়লেও তাদের ঘরের খবর কে জানত...? এমনই একটি পরিবারের কথা তুলে এনেছেন তিনি আমাদের সামনে। যা আমাদের একটা সময়ের কথা বলে। কিছু মানুষের কথা বলে। আর তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথা বলে।
অতীতকে বদলের ক্ষমতা স্রষ্টার নেই ; কিন্তু কথাসাহিত্যিকদের ষোলআনা আছে। এই গজেনবাবুকেই ধরুন না, মাত্র চারজন নারীর জীবনকাহিনি লিখেছেন তিনি। বয়স্ক জমিদারের তরুণী ও রূপসী ভার্যা রাধারাণী। তার তিন মেয়ে কমলা, শ্যামা ও উমা। জমিদারের হঠাৎ মৃত্যুর পর ষড়যন্ত্রের কারণে এককাপড়ে বাড়ি ছাড়তে হয় রাধারাণীকে। সঙ্গে তিনি গহনা, কিছু টাকা ও বাসনকোসনের বাক্সটা নেন। এরপর আর ফিরতে ফিরতে পারেননি স্বামীর ভিটায়। তিন মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় বাসা ভাড়া করে থাকতেন। কমলার ভালো ঘরে বিয়ে হয়। শ্যামাকে দেখেই বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কপাল সইল না। নরেন নামে এক শতভাগ হারামজাদার হাতে পড়লো মেয়েটি। এই বইয়ে নরেন চরিত্রটি অসামান্য নয়। সংসারের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ অথচ বউয়ের ওপর চোটপাট করা, গাঁজাখোর লোকের অভাব নেই সংসারে৷ এত কিছুর পরেও গজেনবাবু নরেনের দলের লোক। যেন সবকিছুকে তিনি ভবিতব্য বলেই পুরো উপন্যাসে চালিয়ে দিতে চান।
শ্যামার বিয়ে ভালো হলো না দেখে রাধারাণী মনে মনে খুব চোট পান৷ কিন্তু তার কপাল সত্যিই মন্দ। উমার সংসার করা হলো না। স্বামী শরৎ তাকে গ্রহণ করেনি। তার রক্ষিতা আছে। মায়ের চাপে সে বিয়ে করেছিল। শ্বাশুড়ির নির্যাতন সইতে না পেরে উমা চলে এলো মায়ের কাছে।
বড়ো মেয়ে কমলার সংসারে সুখ ও শান্তি দুটোই ছিল। সেই ঘরও উজার হয়ে গেল।
দারিদ্র্য কাউকে মহান করে না। নজরুলকে করেনি। বরং দারিদ্র্যের তীব্রতায় মানুষের বিবেক লোপ পায়। কাণ্ডজ্ঞান নষ্ট হয়ে যায়। লাজ-শরমের বালাইটুকুও চলে গিয়ে যে কোনো প্রকারে টিকে থাকার মানসিকতা তৈরি হয়। তাতে ন্যায়-অন্যায়বোধ থাকে সামান্যই। তাই ভদ্রঘরের মেয়ে শ্যামাকে একেবারে ভেতর থেকে বদলে দেয় ক্ষুধার জ্বালা। শরীরে ও মননে অন্য এক শ্যামায় পরিণত হয় সে। গজেনবাবু শ্যামাকে লোভী করলেন, বিবেকশূন্য করলেন, দুঃখী করলেন। অথচ ন্যূনতম সাহস দিতে পারলেন না। তিনি যেন নারীকে পুরুষের অধস্তন ভাবতেই আনন্দ পান।
উমাকে মুক্তি জীবনের স্বাদ দিতে পারতেন গজেনবাবু। কারণ তিনি প্রবলভাবে সমাজমুখী। যে সমাজ অত্যন্ত রক্ষণশীল ও পুরুষতন্ত্রের দাপটে সদাই খাবি খায়।
রামপ্রসাদ বলতেন, 'আমি কি দুখেরে ডরাই? ' গজেনবাবু রামপ্রসাদীর একনিষ্ঠ ভক্ত সম্ভবত৷ তার উপন্যাসের কেউ-ই দুঃখকে বড়ো একটা ভয় খায় না। কপালং কপালং কপালং মূলং অর্থাৎ কপালই সবকিছুর মূলে - এই তত্ত্বে প্রবলভাবে আস্থাশীল। তাই প্রত্যেকের দুঃখ যেন অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রয়াস দেখতে পাই।
অতীতে যা ঘটে গেছে তা বদলযোগ্য নয়। কিন্তু কথাসাহিত্যিক তার কলমের মাধ্যমে অতীতকে ভিন্নভাবে আঁকতে পারেন। গজেনবাবু সেই কাজটি করেননি। তিনি এক টিপিক্যাল সমাজের কথা লিখেছেন যেখানে পতি গুরু, যেখানে নারীদের কোনো স্থান, যেখানে সাদিক এত উপকার করার পরেও রাধারাণীদের কাছে মুসলমান হয়েই থাকে ; মানুষ হতে পারে না।
দুঃখিত গজেনবাবু। আপনাকে মেনে নেওয়া গেল না। আপনি একপেশে, মমতাহীন ও প্রাচীনপন্থি। সিরিজের বাকি দুটো বই আপাতত পড়ব না। আর হ্যাঁ, গজেনবাবু ভালো লেখেন। এত দুঃখবিলাস থাকা সত্ত্বেও এই বই একবসায় পড়েছি।
আমি জানতাম পৌষ ফাগুনের পালা বইটা একটাই পর্ব, গুগল ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখি এটা ট্রিলজি৷
এটা শুধু উপন্যাস না, একটা জীবন! এক ভাগ্যহত মা আর তার মেয়েদের ঘটনা। পরতে পরতে উঠে এসেছে প্রাচীন কলকাতা আর সেই সময়কালটা। এতো মুগ্ধতা ছড়ানো বই খুব কমই পড়েছি। শুরুটা একটু স্লো লেগেছে। মাঝে বা শেষ দিকে এসে মনে হয়েছে, আহারে! মানুষের জীবনে এতো দুঃখ ক্যান! একটা একটা করে দিন পার করা! কী দুঃসহ!
একটা বিশাল ক্যানভাসে আঁকা মানুষের জীবন যাপন ❤ সিরিজটা মাস্ট রিড কিন্তু!
ত্রিপিটক উপন্যাস অর্থাৎ ইংরেজিতে 'ট্রিলজি' বলতে যেমনটা বুঝানো হয়ে থাকে, সেরকম বলতে বাঙলা চিরায়ত সাহিত্যে 'পৌষ-ফাগুনের পালা'-র কথাই সবার প্রথমে মনে আসে। 'কলকাতার কাছেই', 'উপকণ্ঠে' এবং সবশেষে 'পৌষ-ফাগুনের পালা' দিয়ে ঔপন্যাসিক গজেন্দ্রকুমার মিত্রের এই তিন উপন্যাসের সার্থক যবনিকা।
মনুষ্য চরিত্র ভয়াবহ আশ্চর্য, তার থেকেও আরও আশ্চর্য মনুষ্য জীবনের বৈচিত্র্যময় পরিক্রমন। আদি-অন্ত এই দুইয়ের মাঝেই থাকে জীবনের সকল আদ্যোপান্ত। সেই আদ্যোপান্তের অনন্ত বিচিত্রতার এক দুর্লভ সাক্ষর 'পৌষ-ফাগুনের পালা'।
এ এক এমন বই যেই বইয়ের পাতায় পাতায় রাক্ষস-খোক্কস নাই, কোনো খুনের রহস্য উদঘাটনের কাহিনি নাই, নাই কোনো প্রেমের উপাখ্যান। কিন্তু পাতার পর পাতা পড়ে গেছি এক অদ্ভূত মুগ্ধতায়।
রাসমণির আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব আর কমলা,শ্যামা আর উমা দের জীবনের দুর্ভাগ্যের আঘাত সব মনে হলো আমি চোখে দেখেছি। তাদের বাড়ির ছাদের কোণ থেকে দেখা যাওয়া বড় রাস্তাটা, ভাঁড়ার ঘর, দরজা-জানালা, সিঁড়ি সব কিছু এতো জীবন্ত লেগেছে যে আমার মায়া পরে গেছে।
পৌষ-ফাগুনের পালা উপন্যাসত্রয়ীর প্রথম পর্ব কলকাতার কাছেই। রাসমণি, তাঁর তিন মেয়ে ও তাদের ছেলে-মেয়ের জীবনের উপাখ্যান এই বই। তাদের মন্দভাগ্য, দুর্দশার কথা পড়ে কখনো প্রচন্ড মন খারাপ হয়েছে, আবার রাগও লেগেছে। মেয়েদের সবরকম অপমান, অত্যাচার সহ্য করেও একই জায়গায় পড়ে থাকার রীতি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি। আজ এই একশো বছর পরেও এই মানুষগুলোকে ভীষণ পরিচিত লাগছিল কারণ প্রতিটা চরিত্রকে খুব নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন লেখক। মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ে গেলাম।
কলকাতার খুব কাছেই কাহিনীর এমন ঘনঘটা ঘটে চলেছে কে জানত? রাসমণির তিন মেয়ের জীবনই যে আলাদা করে একেকটা আখ্যান হয়ে উঠবে তাই বা কে ভেবেছিল? অমন ট্র্যাজিক আখ্যান না হলেই তো ভালো ছিল! রাসমণি শান্তি পেতেন, শান্তি পেতো শ্যামা, উমা, কমলা আর বোধহয় পড়তে পড়তে কখনো দুঃখের ভাগীদার হওয়া, কখনো রাগে জ্বলে উঠা এই আমরা পাঠকেরাও! তবে বাংলা সাহিত্য কিন্তু বঞ্চিত হত চমৎকার এক সৃষ্টি থেকে। লেখক গজেন্দ্রকুমার মিত্রের সেরা কাজ এই ট্রিলজিটা। শুরু করলে এক অমোঘ আকর্ষণ টেনে নিয়ে যায় শেষ অবধি। রাসমণির ব্যক্তিত্বে শ্রদ্ধা জাগে ঠিকই, পরক্ষণেই মনে হয় কেন তবে অমন বিয়ে দিলেন মেয়েদের? শ্যামা কেন নরেনের মতো পশু স্বামীকে মেনে নেয়? রাগে জ্বলতে থাকে গা। কেন মেয়েরা ভাবতে থাকে স্বামীই সব? সংসারই সব? আসলে যুগটাই ছিল অমন। রাগ লাগলেও মেনে নিতে হয় তাই। তন্মধ্যে উমাই একটু অন্যরকম, একটু বিদ্রোহী, একটু আত্মসম্মানজ্ঞানের অধিকারী। অভাবের তাড়নায় অনেক আগেই যা খুইয়ে বসেছে শ্যামা। বৈচিত্র্য ও বড় বেশিই তার জীবনে। আর তাই বোধহয় সেই এই পর্বটির মূল নায়িকা। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময় শুরু হয়েছে কাহিনীর শেষ দিকে স্বদেশী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এক ঝলক রাখী আর রবিঠাকুরের উপস্থিতি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল উৎকর্ষ। লেখনশৈলী দারুণ, শুরুতেই বলেছি। পরবর্তী দুই পর্ব যত দ্রুত সম্ভব পড়ে নিতে হবে।
বিস্তর খোটা দেয়া সম্ভব লেখকেরে, কিন্তু অনেকদিন পরে দুইটানে একটা বই শেষ করলাম। তাও দুইটান বলতে রাতে আর সকালে, কার্যত দেড়। বলে গেছে কাহিনী, সেই বলায় কোনো পা পেছল যায়নি, বা গলা আটকে যায়নি। আঠারোশ সত্তুর আশির দিক থেকে ঊনিশশো ছয়, সময়কাল বোঝা যায় না, আমি বুঝবার পারি নাই, কারণ সাধারণ মানুষের জীবন, এত দূর থেকে তার আবার সময়কাল! এত সাবলীল লেখার জন্য গজেন্দ্রকুমারকে ধন্যবাদ। বাকী দুটো পড়ে ফেলতে হবে। উপকণ্ঠে নাকী অপুর কাছে আছে এটা জানতে জানতে ফোনের টাকা ফুরায় গেছে, ধার চাইতে পারি নাই। কপাল! টিউশানির বাসাকেও ধন্যবাদ, এটা ধারে দেবার জন্য।
এক পরিবারের বিভিন্ন নারী চরিত্রের জীবনের প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাস নিয়ে গজেন্দ্রকুমার মিত্রের তিন খন্ডে রচিত উপন্যাসের প্রথম খন্ড 'কলকাতার কাছেই'
'শ্যামা ঠাকুরুন' এর অভাব জর্জরিত সংসারে টিকে থাকার আপ্রাণ লড়াই, 'রাসমনি' ও তার দুই কন্যার দুর্ভাগ্য, বিংশ শতকের শুরুর দিকে হিন্দু সমাজে নারীদের অবস্থা ও তাদের ঘিরে রাখা সংস্কার কিংবা কুসংস্কারকে উপজীব্য করে মোটামুটি বড় কলেবরে লেখা এই উপন্যাস পড়ার সময় মাঝে মাঝেই অভিভূত হয়ে গিয়েছি। 'নরেন' ও 'শরৎ' এর নির্লজ্জতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠেছে, একইসাথে তৎকালীন সময়ের পুরুষ(!) সমাজের চিত্র দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছি। বিভিন্ন নারী চরিত্রের মধ্য দিয়ে সেই সময়ের নারী জীবনের যে চ���ত্র লেখক তুলে ধরেছেন তা কল্পনা করাও কষ্টকর। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিলো 'শ্যামা'র রুপান্তর! অভাবকষ্ট যে কিভাবে মানুষের সুকুমার বৃত্তি ও মানবিক দিকগুলোকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয় তার জলজ্যান্ত প্রমাণ এই শ্যামা ঠাকরুন।
গজেন্দ্রকুমার মিত্রের লেখার প্রশংসা না করলে অন্যায় হবে। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র ও চিত্র এত প্রাঞ্জল ও বাস্তব ছিলো যে পড়ার সময় সবকিছু যেনো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। আর ঘটনা প্রবাহের গতিও ছিলো আমার মতো অস্থিরমতি পাঠকের উপযোগী।
ট্রিলজির প্রথম বই এটা। যদিও আমি দ্বিতীয়টি পড়েছি প্রথমে। তাতে অবশ্য কাহিনী বুঝতে সমস্যা হয় নি। বরং এই বইয়ের চরিত্রগুলোর ভবিষ্যত আগেই জানা ছিল। সেজন্য হয়তো কাহিনীর চমক আমাকে তেমন স্পর্শ করে নি। অবশ্য কাহিনীতে খুব বেশি চমকও নেই। একই গতিতে উপন্যাসের কাহিনী বয়ে চলেছে অল্প কয়েকটি চরিত্র নিয়ে। বরং উপকন্ঠে চরিত্রের বৈচিত্র্য আরও বেশি। তবে গজেন্দ্র কুমার মিত্রের প্রতি একটা অনুযোগ থেকেই যায়। মানলাম, বেশিরভাগ মানুষের জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখের ভাগটাই বেশি। তবু তো কিছু সুখ থাকে জীবনে। কিন্তু লেখক যেন স্রষ্টার চেয়েও নির্মম হয়ে উঠেছেন রাসমণি আর তার মেয়েদের প্রতি, বিশেষত শ্যামা আর উমার প্রতি। আরেকটি কৌতুহল লেখক নিবৃত্ত করেন নি। শ্যামার অপদার্থ স্বামী নরেন কোথায় কোথায় পালিয়ে বেড়াতো, কি ই বা করতো সে বিষয়ে পাঠকের কৌতুহল হবেই, কিন্তু এ বিষয়ে লেখক পাঠক কে প্রায় অন্ধকারেই রেখেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার উপকন্ঠে বইটিই বেশি ভালো লেগেছে যদিও কলকাতার কাছেই বোধহয় অধিক আলোচিত এবং পাঠকপ্রিয়। এই ট্রিলজির তৃতীয় বই “ পৌষ ফাগুনের পালা” পড়া হবে কি না জানিনা, বলতে পারছি না চরিত্রগুলোর জীবনে আরও কতো দুর্দশা সেখানে অপেক্ষা করছে। তবে স্বীকার তো করতেই হবে সেই আমলের বেশিরভাগ বাঙালি নারীর জীবন এমন দুঃখে ভরা ছিল। বিশেষত হিন্দু বিধবাদের জীবন যে কতোটা অসহায়তার মধ্যে যেত তা তো বোঝাই যাচ্ছে। শুধু বিধবা কেন, সধবা নারীর জীবনও মোটেও সুখের ছিল না। বালিকা অবস্থায় বিয়ে কেড়ে নিতো তাদের শৈশব, পতি কে পরম দেবতা ভাবতেই শেখানো হয়েছিলো তাদের যদিও তাদের অনেকেই হয়ে যেতেন এক একজন অপদেবতা। সারা জীবনে একটু আনন্দের, ভালো খাওয়া দাওয়া, বেড়ানো, সামান্য সুখের, অবসরের সুযোগ তারা পেতেন না। অক্ষর পরিচয়ও বেশিরভাগেরই হতো না, হলেও তা জীবনে কাজে লাগতো কেবল চিঠি লেখা আর পড়ায় আর সামান্য হিসেব রাখায়। সেই আমলের এইসব দুঃখী মেয়েদের কথাই লিখেছেন গজেন্দ্র কুমার মিত্র।কাহিনীর সময়কাল বোধ হয় উনিশ শতকের শেষ আর বিশ শতকের প্রথম দিক। স্থান কলকাতার কাছেই এবং শহর কলকাতা। স্বাদু গদ্যে এই বই পড়তে ক্লান্ত লাগে না, কেবল একটাই সমস্যা চরিত্রগুলোর জীবনের এতো দুঃখ নিজের মনটাকেও বিষাদে ভরিয়ে দেয়।
গজেন্দ্রকুমার মিত্রকে আমার আবিষ্কার করা হলো অনেক দেরীতে। আগে কেনো পড়িনি আফসোস হয়েছিল উনার লেখা পড়ে। কলকাতার কাছেই গল্পটা আমরা যারা ক্লাসিক বংলা উপন্যাস পড়ি তাদের কাছে পরিচিত গল্প, পরিচিত চরিত্রেরা। প্রায় এক শতাব্দী আগের হিন্দু সামাজিক ব্যবস্থার গল্প তুলে ধরেছেন লেখক। বৃদ্ধা শ্যামার গল্প দিয়ে শুরু হয় গল্পটা। কিন্তু লেখক নিয়ে যান আরো পেছনের গল্পে শ্যামার ব্যাল্যবিয়ে, বৈবাহিক অস্থিতিশীল জীবন, স্বামীর দায়িত্বহীনতা। লেখকের গল্পের গাঁথুনি এতো চমৎকার যে এক সময় সেই একা আশিতিপর বৃদ্ধা শ্যামার কথা পাঠক ভুলেই যায়। লেখকও গল্পটা এখানে শেষ করেন না। এটা রচনা করেছেন লেখক ট্রিলজির প্রথম অংশ হিসেবে।
🪴বইয়ের নাম - কলকাতার কাছেই🪴 ✒️লেখক - গজেন্দ্রকুমার মিত্র 🖨️প্রকাশক - মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স 📔প্রচ্ছদ - অজিত গুপ্ত 📑পৃষ্ঠা সংখ্যা - 240 💰মূল্য - 200₹
🏆সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কার প্রাপ্ত-১৩৬৫🏆 📌🎋ক্লাসিক্স উপন্যাস
🪴এই বিখ্যাত উপন্যাসের রিভিউ লাগে না। এই বই আমিই বোধহয় অনেক পরে পড়লাম। এই উপন্যাস আমি গতবছর পড়েছি, রিভিউ আর লেখা হয়ে ওঠেনি। আজ এই বই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা~
🪴এটি একটি ট্রিলজি। এই উপন্যাস-এর আরো দুটি পার্ট রয়েছে। প্রথম কলকাতার কাছেই, দ্বিতীয় উপকণ্ঠে, তৃতীয় পৌষ ফাগুনের পালা।
🪴একেই হয়তো বলে ক্লাসিক্স উপন্যাস। উপন্যাস পড়ে কি অসাধারণ অনুভূতি তা হয়তো বলে বোঝানো যাবে না। অত বছর আগের লেখা। কিন্তু এখনও ভাষার মাধুর্যে, গল্পের প্লটে আর লেখার টানে পাঠককে বই নামিয়ে রাখতে দেয় না। এই উপন্যাসের সময়কাল পরাধীন ভারতবর্ষ।
🪴এই উপন্যাস কোনো একটি বা দুটি চরিত্রকে নিয়ে সৃষ্টি হয়নি, হয়েছে একাধিক চরিত্রকে নিয়ে। রাসমণির ও তার তিন মেয়ে - কমলা, শ্যামা, ও উমা। রাসমণির নীজে ছিলেন শিক্ষিতা। তিন তার মেয়েদের ও যথাসাধ্য লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেন।
🪴একটা সময় জমিদার বাড়ির বউ ছিলেন রাসমণির। বর্তমানে তিনি থাকেন ভাড়াবাড়িতে, অবস্থা মোটামুটি ভালোই। সেই সময় মেয়েদের শিক্ষা সেই ভাবে দেওয়া হতো না। বালিকা বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। রাসমণির তিন মেয়ের ও বিয়ে হয়ে যায় অল্প বয়সেই।
🪴বিশেষ করে এই উপন্যাসে শ্যামা ও উমার বিবাহিত জীবনের ঘটনা বিস্তারিত ফুঁটিয়ে তুলেছেন। এই দুই মেয়ে জীবনে সুখ কি তা কোনো দিনই বোঝেনি। বিয়ের পর থেকেই কষ্টই পেয়ে এসেছে। তাদের জীবনে গল্প অতি দুঃখের। এখানে আমি বিস্তারিত আলোচনা করে স্পয়েল করবোনা। তাহলে তো এই বই পড়ার মজাই থাকবে না, তাই এতোটুকুই।
🪴চরম দারিদ্রতা এই বইয়ের প্রতিটি পাতায় পাতায় ফুঁটে উঠেছে। যা চোখে জল এনে দেয়। পুরো উপন্যাস জুড়ে লেখক প্রত্যেকটি চরিত্রকে সুনিপুণ হাতে বিশ্লেষণ করেছেন। এক কথায় বলতে গেলে অসাধারণ। 🪴আপনি কি একজন প্রকৃত বইপ্রেমী? আর কলকাতার কাছেই এই ট্রিলজি পড়েননি? তাহলে কিন্তু অনেক কিছু মিস করে যাচ্ছেন।
Reading this book made me feel like I am listening to our own family history, which is being narrated by one of my elderly aunts. There is neither suspense nor high-volume drama, that is to say, there is no embellishment in the plot in order to make it more likeable. Rather, the author has weaved the most simple and clean plot that I had come across in a long long time. But, the simplicity of the story rather than making it dull and drab, had in fact rendered a freshness to it. There is such a subtle power embedded within the narrative that the reader is compelled to be deeply invested in the destiny of each and every character. I am in awe of the author for writing such a mundane story about ordinary lives in a strikingly extraordinary manner. I am glad that this book is the first installment in the trilogy series because as soon as I finished reading this book my heart was seized by an unknown melancholia and I wanted to keep on reading about the characters, who by that point of time had become my own relatives. I have been meaning to read this book for a long time, and I am glad that I did pick it up before the end of this year. As today is the last day of 2022, I can assert that 'Kolkatar Kacchei' by Gajendrakumar Mitra has been my best read of this year. I am eagerly looking forward to reading the next two installments of this trilogy in the coming year. My rating: 5 Shimmering Stars
কিছু লেখার মধ্যে আমরা এমনভাবে হারিয়ে যায় যে চোখের জল বাধ মানে না। গজেন্দ্রকুমার মিত্রের মতন কালজয়ী সাহিত্যিকই পেরেছেন সহজ সাবলীল ভাষার ব্যবহারে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কগত চিত্রে পরিপুষ্ট সমাজদর্পণ তুলে ধরতে। প্রাচীন কলকাতার সমাজব্যবস্থার এক সুনির্দিষ্ট জীবনদর্শন ধরা পড়ে লেখকের কলমে। মা ও তিন মেয়ের যন্ত্রণাময় জীবনের প্রতিচ্ছবি পরিলক্ষিত হয় প্রতিটি পাতায়। এই উপন্যাসে যথোচিত আবেগের পাশাপাশি পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী যুক্তির উপস্থাপন অবাক করে। উপন্যাস যত এগোয় ততই প্রতিটি চরিত্র যেন আমাদের এক একজনের 'পরিচিতি' রূপে প্রকাশ পেতে থাকে। এইভাবেই পুরোনো লেখার গতিবিধিকে স্মরণে রেখে একবিংশ শতকে এসে বোঝা যায়, 'সীমাবদ্ধতা' কোনো মানুষের অগ্রগতির অন্তরায় হয় না, বরং আরও নতুনভাবে ফুটিয়ে তোলে ও রাঙান্বিত করে এই জীবনের সিদ্ধান্তগুলো। আমাদের পূর্বসূরীদের মধ্যে যেন জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জেদ বিশেষভাবে চোখে পড়ে। এই উপন্যাস তেমনি এক পরিপাটি অথচ অগোছালো জীবনের বেদনার সুনিপুণ বর্ণন যা আমাদের শেখায় 'শেষটুকু দেখার আগে থামতে নেই'।
আজ “কলকাতার কাছেই” বইটা শেষ করলাম । আমি কিছুটা স্তম্ভিত - কিছুটা বিহ্বল হয়ে বসে আছি । কদিন মনটা অস্থিরতার মাঝে কাটছিলো । আজ বইটার শেষ পাতায় এসে জীবনভার কেমন হালকা হয়ে গেলো । নিঃসন্দেহে আমার এ যাবৎকালে পড়া সেরা বইয়ের মাঝে এর নামটা শুরুতে থাকবে । এ গল্পটা আমার জীবনে বড়সড় একটা শিক্ষা দিয়ে গেলো। একই সাথে “যে বই না পড়লে আপনার জীবন বৃথা” - এমন কোনো লিস্ট করলে এ গল্প শুরুতে থাকবে । মনে হলো জীবনটা বরবাদ হয়ে গেলো এমন অদ্ভুত সুন্দর বই পড়ে । বইটা আসলে এত ভালো আমি আগে বুঝিনি । নাহলে বহু আগেই পড়তাম । তিন বোনের জীবন কেমন করে নিজের মনে গেঁথে গেলো, উমার কষ্টে মন আঁধার হলো । আবার শ্যামার দারিদ্রতে হীনতা কেমন নির্লজ্জ ভাবে বেরিয়ে এলো তা দেখে লজ্জাও পেলাম । বড় বোন কমলার সোনার সংসার কেমন ফিকে হয়ে গেলো আর রাসমণির জীবনে এত আফসোস। সব মিলে বইটা পড়ে খুব কষ্ট পেয়েছি রে
বইটির প্রথম পরিচ্ছেদে ঊনআশি বছরের অশীতিপর এক বৃদ্ধা - শ্যামাঠাকরুণকে নিয়ে শুরু হয়ে উপন্যাস। প্রথম পরিচ্ছেদের প্রথম অঙ্ক পেরুতেই ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যাই সেই শ্যামার ছোটবেলায়। দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় রাসমণি নামক মধ্যবয়স্কার মেজ মেয়ে শ্যামার। সেই থেকে শুরু হয় মূল গল্প।
গল্পটা টানাপোড়নের; নারীর প্রতি বিরূপ, জাতিভেদে দুষ্ট অখণ্ড ভারতের সামাজিক পটভূমিতে শ্যামা, তার দুই বোন কমলা ও উমা, তার ছেলেমেয়ে - সকলের দারিদ্রের শেকলে বাঁধা জর্জর জীবনের গল্প।
গজেন্দ্রকুমার মিত্রের 'পৌষ ফাগুনের পালা' ত্রিত্বের প্রথম বই এটি। সামাজিক উপাখ্যান হিসেবে কোনভাবেই ফেলে দেবার মত নয় - অবিভক্ত ভারতবর্ষের জাতিকোন্দলে জীর্ণ ও দরিদ্র্য হিন্দুসমাজের বেশ সাবলীল চিত্রায়ণ করেছেন লেখক।
এ এক অন্য গল্প। যা আগে পড়ি নাই। অন্য সমাজ, অন্য সময়। গজেন্দ্রকুমার মিত্রে'র উপন্যাস "কলকাতার কাছেই"। মূলত এইটি একটি ত্রিলজী। "কলকাতার কাছেই" প্রথম পর্ব। কুলীন ব্রাহ্মণের বিধবা পত্নী রাসমণি ও তার তিন কন্যার জীবন নিয়ে এই উপন্যাস-ত্রয়ীর কাহিনী শুরু। অন্য দুইটি পর্ব - “উপকণ্ঠে” এবং "পৌষ-ফাগুনের পালা"। সংস্কারে সংস্কৃতিতে উন্নত অথবা নিদারুণ দারিদ্রক্লিষ্ট মধ্যবিত্ত সমাজের এই সব মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থ-সংকীর্ণতা, আশা-নিরাশা, ছোট বড়, সুখ দুঃখ. বিপদ আপদ সবকিছুর মধ্যদিয়েও তাদের অপরাজেয় জীবনাকাঙ্ক্ষার এবং জীবনযুদ্ধের এক নিটোল অনবদ্য কাহিনী শুনিয়েছেন লেখক যা আমরা আগে শুনিনি। পড়ে দেখতে পারেন পড়ার অভ্যাস থাকলে।