আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন একজন বাংলাদেশি ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্পকার। তিনি মাত্র দুটি উপন্যাস রচনা করলেও সমালোচকরা তাঁকে একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি ঔপন্যাসিক হিসেবেই বিবেচনা করেন। এই দুটি উপন্যাসের বাইরে ইলিয়াস মাত্র তেইশটি ছোটগল্প এবং বাইশটি প্রবন্ধ লিখেছেন। ইলিয়াস সমাজ, রাষ্ট্র এবং জনগণের একজন একাগ্র পর্যবেক্ষক ছিলেন। তিনি তাঁর লেখার চরিত্রগুলোকে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি এবং অবস্থানের প্রতীক হিসেবে সুদক্ষভাবে রূপায়ন করতেন। লেখার সময় তিনি চেষ্টা করতেন ঐতিহাসিকভাবে নির্ভুল থাকতে, ফলে তিনি পাঠকের স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে লেখার অন্তর্নিহিত গুরুত্বকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন সবসময়। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অকালমৃত্যুর ফলে তাঁর সৃজনশীল জীবন খুব দীর্ঘায়িত হতে পারেনি, কিন্তু তাঁর লেখাগুলো বাংলা সাহিত্যে ধ্রুপদী সৃষ্টি হিসেবে স্থান পেয়েছে।
Akhteruzzaman Elias was a Bangladeshi novelist and short story writer. Despite the fact that he only wrote two novels, critics consider him to be one of the finest Bengali novelists. Besides these two books, Elias wrote only 23 short stories and 22 essays. Elias was a good observer of society, state, and people as he created his characters symbolising social classes and positions. He always strived to be historically accurate when writing, even if it meant pushing readers out of their comfort zones. His creative life was cut short by a premature death from cancer, but his writings are regarded as Bangla literature classics.
আমার ম্যারমেরে ঘুমকাতুরে কলেজ জীবনের প্রথম মরম ছিল ইলিয়াস। বাংলা বইয়ে সর্বপ্রথম “রেইনকোট" পড়ে ব্যাকবেঞ্চে লেগে থাকা ঝিমুনি রোগের ব্যাকডোর দিয়ে পলায়ন। তারপর একরাশ রুদ্ধশ্বাস চেপে রেখে টিফিন পিরিয়ডের অবসরে কলেজ লাইব্রেরির দিকে ছুট। এক উদভ্রান্ত উটপাখির মতো আমাকে ছুটে আসতে দেখে সুশীল পাঠাগার পাঠকেরা বেআক্কেল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। আমার সেদিকে খেয়াল নেই। ইলিয়াস আমাকে পাগল বানিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। তৎক্ষণাৎ “চিলেকোঠার সেপাই” বগলদাবা করে আমি ফের ক্লাসে ফেরা। তারপর এক সপ্তাহের ঘোর! ক্লাসে, বাসে, ঘরে, খাটে, মাঠে কোথায় পড়ি নি এই বই? পুরান ঢাকা, গণঅভ্যুত্থান, ওসমান, হাড্ডি খিজির, আনোয়ার সবকিছু আমার ভেতরে সেঁদিয়ে গেছে বলতে গেলে, আমি পুরো বেদখল হয়ে গিয়েছি। আমিও ঠিক করে ফেলেছি এই বই আমি আর বেদখল হতে দেব না, কলেজের সম্পত্তি হোক, যাই হোক, আমার জিম্মায় থাকবে চিলেকোঠার সেপাই। এরপর মন আনচান, ইলিয়াস সাহেবের বাকি বইগুলোও পড়ে ফেলতে হবে। অথচ পকেটে ফুটো কড়ি নেই। তার উপর ক্লাস, কোচিং, পরীক্ষা এটা সেটা কত কী! নেই সময়ও। তবুও রোজ টিফিনে সময় করে কলেজ লাইব্রেরিতে উঁকিঝুকি মারি। ইলিয়াসের গল্পসমগ্র থেকে বেঁছে বেঁছে ছোট ছোট গল্পগুলো পড়ি। ইলিয়াসের ছোটগল্প নামে ছোটগল্প হলেই কী আর ছোট? সেসব ব্যপ্তিতে যেমন বড়, ঠিক তেমনই গাম্ভীর্যে। টিফিনের স্বল্প বিরতিতে গল্পগুলো পড়ে ফেলতে সময়ের সাথে রেস লাগাতে হয়। আর কী চমৎকার চমৎকার সব গল্প! নিরুদ্দেশ যাত্রা, উৎসব, পিতৃবিয়োগ, দুধে-ভাতে উৎপাত। আমি পড়ি আর রোমাঞ্চিত হই, বাকরুদ্ধ হই, শ্বাসরুদ্ধ হই, পড়ি আর ভাবি ফকিন্নি কলেজটা এসি লাগায় না কেন? ওদিকে লাইব্রেরিয়ান বেটা ততদিনে আমাকে চিনে ফেলেছে। নাকের ডগায় রাখা চশমার উপর দিয়ে আমার নিঃশব্দ আসা-যাওয়াতে সে তীব্র শঙ্কাজনক দৃষ্টি হানছে। অবশ্যম্ভাবী সম্ভাবনা একদিন সঠিক হল, একদিন বেটা আমার পথ আটকালো, জানতে চাইলো আমার ধার করা “চিলেকোঠার সেপাই” এর বিষয় আশয়। সেটা কী সহীহ সালামতে আছে? ভালো আছে? সুস্থ আছে? এবং সেটা কী আমি এই জন্মে ফিরিয়ে দেওয়ার আগ্রহ পোষণ করছি? অবশ্যই! হে হে! এই সপ্তাহেই দেব। পরের সপ্তাহেই দিচ্ছি। তারপরের সপ্তাহের পরের সপ্তাহেও দেওয়া হয় না আমার। তারও কতিপয় সপ্তাহ পর লক্ষ করি লাইব্রেরিতে ফিরে যাওয়ার সাহসটাই দেখি আমার মারা গেছে। আমার খাবলা খাবলা ইলিয়াসের গল্পপাঠ এক খাবলা মাংস উপড়ে নেওয়া বেদনার মতো অস্ফুট ও অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। আমি শালা এত ভীতু কেন? ভাবি আমি। আবার আমিই উত্তর করি, ভীতু তো ইলিয়াসের গল্পের চরিত্ররাও। কোথায় ভীতু? ঐ যে “রেইনকোট” এর নুরুল হুদা! আস্ত ভীতু এক কেমিস্ট্রির প্রফেসর, থুক্কু লেকচারার। তারপর ধর গিয়ে “প্রেমের গপ্পো” গল্পের জাহাঙ্গীর। এই লোককে চাপাবাজ বলা যায়, আবার ভীতুও বলা যায়, কারণ চাপাবাজরা ভীতু হয়। তারপর “জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল” গল্পের লালমিয়া তো বিশুদ্ধ ভীতুর তালিকায় পড়ে। এই তিন গল্পে দেখা যায় তিন রকমের ভীতুকে। একজন কপটচারী, একজন হঠকারী, আরেকজন স্রেফ ভীতির চক্রবুহ্যে আটকে পড়া মানুষ। তাই বোঝা যায়, ভীতু মানুষ বিভিন্ন রূপে ধরা দেয় ইলিয়াসের গল্পে। তারা বার বার খাবি খায় বর্তমান আর অতীতে। “প্রেমের গপ্পো” আর “জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল” গল্প দুটির বর্ণনায় অতীত ও বর্তমান মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। অতীত বর্তমানকে ছাপিয়ে যায় কখনও কখনও। অতীতের স্মৃতিসমূহকে ইলিয়াস ব্যবহার করেন বর্তমানের অন্দরে ঢোকার চাবির মতো। প্রতিটা চরিত্রের আদ্যপান্ত আমরা তাই কীভাবে যেন জেনে যাই অতটা না জেনেও। ভীতু চরিত্র ছাড়াও আছে ধর্মের বর্মধারী লোকজন। এদের মধ্যে পড়ে “জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল” গল্পের লালমিয়া, নাজির আলী, “কান্না” গল্পের আফাজ আলী, “রেইনকোট” গল্পের প্রিন্সিপাল। “কান্না” গল্পটার প্রতিক্রিয়া আসলে ব্যক্ত করার ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন। ইলিয়াসের ট্রেডমার্ক হল মিলমিশ। আগে দেখেছি অতীত বর্তমানের মিলমিশ। “কান্না” গল্পের পরিসমাপ্তিতে আমরা দেখি সমান্তরাল ভাবে চলা দুটো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার মিলমিশ। এই গল্পটা আমার অসম্ভব প্রিয়। তবে তার চেয়ে বেশি প্রিয় “ফোড়া”। এই গল্পটা কেন আমার সবচেয়ে প্রিয় তার সঠিক কারণ আমি ঠিক খুঁজে পাই না। কারণ কী এই গল্পে একটা মার্কামারা ভীতুর অভাব? নাকি ইলিয়াসের ট্রেডমার্ক মিলমিশ টেকনিকের লাগামটা খানিক আটকে রাখা? নাকি এর আন্ডাররেটেড তকমা? আসলে একজন পাঠকের ভেতর পর্যন্ত ছুঁয়ে যাওয়ার পাথওয়ে কিছু কিছু গল্প শুধুমাত্র এর গল্পের জোরেই খুঁজে পায়। “ফোড়া” গল্পটা আমার পড়া ইলিয়াসের সবচেয়ে ইন্টারেক্টিং গল্পের একটা। হয়তো এই ইন্টারেকশনটাই ভালো লাগার কারণ। প্রথমে ভেবেছিলাম, ইলিয়াসের সাথে আমার পরিচয়ের গল্পটা সংক্ষেপে খানিক বলব, তারপর কিছু বলব এই বইটা নিয়ে। এত দীর্ঘ হয়ে যাবে ভাবি নি। কেউ সম্পূর্ণটা পড়ে থাকলে ধন্যবাদ।
পুনশ্চঃ সেই চিলেকোঠার সেপাই আজও আমার দখলে আছে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে গেলে এবার আমি সেটা ফিরিয়ে দিয়ে আসব। কসম!
ইন্টারনেটের এই যুগে কোনো জিনিস জানা একদম সহজ হয়ে গেছে। যদি জানার আগ্রহ নাও থাকে তারপরও আপনি জেনে যাবেন। শেষবেলায় একটু ফেবুতে ঢুঁ দিতে গিয়ে দেখি পাঠকদের গ্রুপে খালি ইলিয়াস সাহেবের নাম। পরে আসল তথ্য জানার পর মনে হল, তাহলে আজই "জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল" দিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পাঠ শুরু হোক!
প্রেমের গপ্পো: আমাদের এলাকার দিকে কেউ বেহুদা/বানানো গল্প করলে মানুষ লম্বা সুরে বলে ওঠে," উঁ.......হ! হায়রে গপ্পো............!" তো 'প্রেমের গপ্পো' নামক গল্পটা আসলেই প্রেমের গপ্পো। নব বিবাহিত দম্পতির একে অপরের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠার গল্প।
ফোঁড়া: এ গল্পে এক রিকশাচালক চরিত্রের মাধ্যমে সমাজে প্রচলিত শ্রেণি বৈষম্য ফুটে উঠেছে। অনাহারে থাকা মানুষের থেকে সমাজের নিজস্ব ইজ্জত রক্ষার প্রতিচ্ছবি এই ফোঁড়া গল্প।
জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল: মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও এ গল্পে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ এর ব্যাপারও প্রাধান্য পেয়েছে। একদিকে যেমন সমাপ্ত যুদ্ধ নিয়ে ব্যবসায় নেমেছে কিছু মানুষ আরেকদিকে মূলধন হিসেবে পুঁজি করেছে ধর্মকে।
কান্না: প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। আর মুসলিম হলে শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে কবর। শহরের দিকে নামকরা সব গোরস্থানে ছোট্ট জায়গা-জমি ঠিক করে নিতে হয়। এমনই এক গোরস্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে 'কান্না' গল্পটি। নতুন আসা মুর্দার পার্টিকে ঘিরে গোরস্থানে কাজ করা মানুষদের আয়ের জন্য জন্ম নেয়া স্বার্থপরতা, কপটতাকে ছাপিয়ে ফুটে উঠেছে আপনজনের মৃত্যুর বেদনা আর মায়া-মমতা।
বাকি রইলো রেইনকোট, এটা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প। এর জন্য একতারা বেশি দিলাম। আমার খুব প্রিয় গল্প। পাঠ্য বইতে থাকার কারণে এই একটি লেখাই আগে পড়া ছিল। এমনি ইলিয়াস সাহিত্যে আমার আজই পদার্পণ।
রেইনকোট গল্পের সাথে আমার বেশ কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সায়েন্স ল্যাবের কথা আছে গল্পে। তো ঢাকাবাসী না হওয়ার কারণে বস্তুতই সায়েন্স ল্যাবের রাস্তা দিয়ে আমার যাতায়াত কোনোদিনও ছিল না। প্রথমবার নীলক্ষেত যাচ্ছিলাম; গরমে আনমনা হয়ে বসে ছিলাম বাসে, হঠাৎ কানে আসলো-এই সায়েন্স ল্যাব, নাইম্মা যান। সচকিত হয়ে, আমি অজান্তেই আস্তে করে বলে ফেললাম "রেইনকোট" (গট আ গুজবাম্প! হ��য়রে মানব মন!!) আরও একটা স্মৃতি আছে! কলেজের ২য় বর্ষের ক্লাস চলে, ম্যালা দিন পার হয়ে গেছে। বাংলা ম্যাম প্রথমবারের মতো পড়া ধরলেন, 'আখতারুজ্জান ইলিয়াসের পুরো নাম কি?' একটু দেরি হয়ে গেছিল উত্তর দিতে; ভুলে গেছিলাম, পরে মনে পড়লো একটু অন্যরকম। উত্তর দেয়ার পরে ম্যামের ফেইস রিয়াকশন ছিল- কি? কে বলে দিল? আহা! খুবই কষ্টিত হয়ে গেছিলাম। আজ আবার এইসব মনে পড়তেছে.......
শুভ জন্মদিন আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস ❣ (১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)
নতুন এক ইলিয়াসকে খুঁজে পাইলাম গল্পগুলোর মাঝে, উপন্যাসের ইলিয়াস সাহেব এখানে অনুপস্থিত। পাঁচটি গল্পের মিশেলে "জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল"। ইলিয়াস সাহেব চিরাচরিত মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলা অতি সুক্ষ্মরূপে ফুটায়ে তুলছেন গল্পে। আত্মস্তুতি, ইনসিকুরিটি, ভীরুতা কিংবা দোটানা ভিন্ন ভিন্ন গল্পে ভিন্ন ভাবে উঠে আসছে।
প্রথম গল্প "প্রেমের গপ্পো" তে গল্পের নায়ক নিজের নামে মিথ্যে বড়াই সদ্য বিয়ে করা বউকে শুনায়। যখনই নিজের বউয়ের ছোটবেলার গান শেখা ও গান শেখার বন্ধুর সাথে পরিচয় হয় ইনসিকুরিটি যেন জেঁকে বসে তাকে। অ্যানি আর্নো এর দ্য পজেসন বইয়ে একটা লাইন ছিল," ঈর্ষার সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে ঈর্ষা সমগ্র পৃথিবী ছেঁয়ে ফেলতে পারে এমন এক মানুষকে ঘিরে যাকে হয়ত কখনো তুমি দেখোই নাই!" এখানে তো জাহাঙ্গীরের মুশতাকের সাথে দেখাই হয়। সুতরাং, ঈর্ষান্বিত জাহাঙ্গীর হিপ হিপ হুররররে দেখতে ট্রাফিক পুলিশ বক্সের কাছে ভেসপা চালায়ে দেখতে যায়। ইলিয়াস সাহেব এ গল্পে যে ধরণের রসিকতা কিংবা সরস বাক্যের ব্যবহার করেছেন তা দুর্দান্ত।
ফোঁড়া গল্পটি রিকশাওয়ালার ফোঁড়া উঠা এবং ফোঁড়া কে কেন্দ্র করে তার ঈদের দিনের সওদাপাতি কেনার অপরাগতার কাহিনী। যদিও সে ধার করে বাজার করেছে কিন্তু ঈদের আগের দিনই লোভের দরুন তা শেষ হয়ে যায়। ধারের মধ্য থেকে ১ টাকা আবার দান করার জন্য রাখা হয়েছে৷ ভিক্ষা করা টাকার থেকে ভিক্ষা দেয়ার ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। রিকশাওয়ালা শ্রেণীর চিরাচরিত রুপকে টেনে তুলতে তিনি শুরু করেছেন হাসপাতালে ভর্তি আহত কারখানা শ্রমিককে ঈদের দিন দেখতে যাওয়ার প্রেক্ষাপট থেকে। হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় নঈমুদ্দিন চিকিৎসার জন্য পার্টি থেকে পাওয়া ১০০ টাকা নিয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে ঈদ ঘরে করবে বলে। আবার সেই ১০০ টাকার খবর বাতাসে হয়ে গেল ৫০০ টাকা। ঈদকে ঘিরে শ্রমিক মানুষের একটা সেন্টিমেন্ট এই গল্পে দুর্দান্তরূপে পোট্রে হইছে।
নাম গল্প "জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল" মুক্তিযুদ্ধের গল্প। মুক্তিযুদ্ধের গল্প সচরাচর এক পাক্ষিক ন্যারেটিভ থেকে লেখা হয়, হয় সাদা বা কালো। কিন্তু ইলিয়াস সাহেব লালমিয়া কে এখানে পুরোপুরি ভিলেইন দেখানোর চিরাচরিত ধারাটুকু ভেঙ্গেছেন। লালমিয়ার নিষ্ক্রিয় দর্শক হিসাবে গ্রে এরিয়াটুকু গল্পে একটা ভিন্নতা এনেছে। খুব সম্ভবত এই বইয়ের শ্রেষ্ঠতম গল্প এইটি।
কান্না গল্পটা আজিমপুর গোরস্তান কে ঘিরে। ইলিয়াস সাহেব আমার এলাকাতেই থাকতেন জিনিসটা বেশ গর্বের। আজিমপুর গোরস্থানের মাঝে দিয়ে নতুন রাস্তা হয়েছে নিউ মার্কেট পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। মাঝে মাঝে সেই রাস্তা দিয়ে চলাচলের সময় দু'পাশের কবরগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা জিয়ারত করার দৃশ্য দেখা হইছে বহুবার। এই গল্পটা পুরাপুরি ভিজ্যুয়ালাইজ করেছি। আফাজ আলীর ভুল করে মৃতের জিয়ারতের দোয়ার সময় নিজের জীবিত পুত্র হাবিবুল্লার নাম উচ্চারণ করে ফেলা কাকতালীয় ছিল নাকি আল্লাহর নিদর্শন ছিল সেটা আমরা জানি না, তবে গল্পের শেষাংশে আফাজ আলীর ট্রাঞ্জিশন টা ছিল অদ্ভুত রকমের সুন্দর।
রেইনকোট আমাদের এইচএসসি তে পাঠ্য ছিল। সুতরাং, এই গল্প কাঁটাছেড়া-দাগাদাগি করে পড়তে হয়েছে অনেকবার। আলমারি কয়টা এসেছিল সেই তথ্যটুকুও যেভাবে পরীক্ষার জন্য মুখস্থ করা লাগছিল ইলিয়াস সাহেব তা জানলে এই গল্প লিখতেন কিনা সন্দেহ। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গল্প হিসাবে রেইনকোট বরাবরই আমার প্রিয় ছিল। আবার পড়ে নস্টালজিয়ায় ভুগেছি কিছুটা।
ইলিয়াস সাহেবের শব্দ যেন ঝংকার সুরে বাজে। সুন্দের প্লটের চেয়েও সুন্দর লেখনীর আকর্ষণে প্রতিটা গল্প পড়ে গেছি।
গল্পগুলো অচেনা নয়, হয়তো আমাদের মাঝেই এরা বাস করে। কিন্তু, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের হাতে গল্পগুলো পড়লে কেমন যেন হয়ে যায়... মনের এমন কিছু অনুভূতিকে ছুঁয়ে ফেলে তারা, যাদের সহসাই চিনতে পারিনা।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সারির লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। সাহিত্যের বিস্তৃতি বিচারে ক্ষণজন্মা। মাত্র দুইটি উপন্যাস, পাঁচটি গল্পগ্রন্থ এবং একটি প্রবন্ধসংকলন রচনা করেছেন। তবে এই গুটিকয়েক সাহিত্য নিয়েই বাংলা সাহিত্যে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। 'জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল' গ্রন্থটিতে মোট পাঁচটি ছোটগল্প স্থান পেয়েছে।
প্রেমের গপ্পো
স্ত্রী বুলার নিকট নিজের প্রেমের গল্পগুলো বলে আনন্দ পায় জাহাঙ্গীর। কবে কোন মেয়ের সাথে তার মন দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক হতে গিয়েও হয়নি কিংবা মেয়েরা তার জন্য পাগল ছিল, এসব বলেই স্ত্রীকে নিজের পৌরুষের জানান দেয়। বুলাও যেন আগ্রহভরে গল্পগুলো শুনে। সেই গল্পগুলো বলতে বলতে জাহাঙ্গীর তার অতীত জীবনে চলে যায়। যাপিত জীবনের হিসাব চলে আসে নিজের কাছেই। গল্পের শেষটা পাঠককে অভিভূত করবে।
ফোঁড়া
কারখানার শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সংঘর্ষে আহত নইমুদ্দিনকে হাসপাতালে দেখতে যায় মামুন। কিন্তু গিয়ে দেখতে পায়, অসুস্থ শরীর নিয়েই সকলের কথা অমান্য করে ঈদ করতে বাড়ি চলে গেছে সে। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে ফিরে আসার সময় মামুন একটি রিকশায় উঠে। সেই রিকশাওয়ালার কাছেই নইমুদ্দিনের বিস্তারিত জানতে পারে মামুন। আহত হওয়ার পর হাসপাতালে এসে পার্টির পক্ষ থেকে একশো টাকা দিয়েছিল নইমুদ্দিনকে। সেই টাকার লোভেই কিনা ঈদের দিন ভালোমন্দ খেতে বাড়ি চলে গিয়েছে সে। এদিকে রিকশাওয়ালার উরুর নিচের দিকে একটি ফোঁড়া হয়েছে। সেই ফোঁড়াটি মামুনকে দেখাতে উদ্গ্রীব রিকশাওয়ালা। কিন্তু রিকশার সিটে বসে তা দেখা সম্ভব না। তাই মামুন রিকশা থেকে নামার পর ফোঁড়াটি দেখতে রাজি । মূলত গল্পটি শোষিত ও শাসকের দূরত্ববাচক সম্পর্কের ইঙ্গিত করে।
জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের গল্প। লন্ড্রি দোকানে কাজ করা লালম��য়া ও ইমামুদ্দিন দুই বন্ধু। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ইমামুদ্দিন দেশকে বাঁচাতে যুদ্ধে চলে যায়। তখন তার সন্তান ছয় মাসেরও হয়নি। একদিন যুদ্ধের অপারেশনের পর ধরা পড়ে যায় ইমামুদ্দিন এবং তাকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। যুদ্ধের সময় হিন্দু বা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর লুট করেছে নাজির আলি। সেই নাজির আলির লন্ড্রিতেই কাজ করে লাল মিয়া। যুদ্ধের পর ইমামুদ্দিনের ছেলে বুলেটের সাথে তাঁর বাবার গল্প করে লাল মিয়া। স্বপ্নে দেখতে পায় এক বয়স্ক লোককে। একদিন হঠাৎ দেখতে পায় নাজির আলি পুনরায় এলাকায় ফিরে এসেছে। তারপর?
কান্না
আফাজ আলি মৌলবি ঢাকার একটি কবরস্থানে মৃত মানুষের কবর জিয়ারত ও পরিচর্যার কাজ করেন। কবে কোন ব্যক্তির মৃত্যু তারিখ এবং তার আত্মীয়রা কবর দেখতে এসে যেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পায় এই ব্যাপারে সজাগ থাকেন। কোনো ধনী ব্যক্তি মারা গেলে নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আবেগঘন দোয়া পরিচালনা করেন এবং মোটা টাকা পারিশ্রমিক নেন। কবরস্থানে অন্যান্য গোরখোদক কিংবা মালিদের মধ্যে কবরের দায়িত্ব নিয়ে ঝগড়া বাঁধে তখন তারই দ্বারস্থ হয় সবাই। শবে বরাতের পূর্বে সকল মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনরাই কবরস্থানে আসে এবং এই সময়ে অনেক টাকা উপার্জন করে সবাই। অথচ এরই মাঝে খবর আসে তাঁর ছেলে হাবিবুল্লাহর অবস্থা ভালো না। এখনই তাকে দেখতে গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। বাড়ি গেলে এই উপার্জনের মৌসুমটা হাতছাড়া হবে তাঁর। তাহলে কি যে ব্যক্তি সকলের কবরে দোয়া দরুদ পড়েন, তাঁর নিজের অসুস্থ ছেলেকে দেখতে যাওয়ার ফুরসত হবে না?
রেইনকোট
উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা শিক্ষার্থী মাত্রই এই গল্পের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। গল্পটা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা। বৃষ্টির দিনে কলেজের প্রভাষক নুরুল হুদার বাড়িতে কলেজের পিওন এসে জানায়, তাঁকে কলেজের অধ্যক্ষ ডেকে পাঠিয়েছে। কোন উদ্দেশ্যে তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়েছে তা জানানো না হলেও, পিওনের মুখ থেকে জানতে পারেন; কারা যেন কলেজে বোমা ফাটিয়ে গিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদেরই কাজ হবে। নুরুল হুদার শ্যালক মিন্টু মুক্তিযোদ্ধা। তারই কারণে কয়েকবার বাসা পাল্টাতে হয়েছে। বৃষ্টির দিনে বাইরে যাওয়ার জন্য মিন্টুর ফেলে যাওয়া রেইনকোট পরেই বের হন নুরুল হুদা। পথ চলতে গিয়ে রেইনকোটের মাহাত্ম্য যেন বুঝতে পারেন তিনি।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখাগুলো গম্ভীর ধরনের এবং বাক্যগুলো পড়তে গেলে অনেকটা কঠিন মনে হয়। আমিও যখন প্রথমবার এই লেখকের বই পড়েছিলাম, এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি। এখন আর সমস্যা হয়না। তাই যারা নতুন পাঠক, তারা বইগুলো পড়ার সময় একটু বেশিই ধৈর্য নিয়ে বসবেন। হ্যাপি রিডিং।
ইলিয়াস শুধু চোখের সামনে ছবি আঁকেন না, একে একে সব কয়টি ইন্দ্রিয়কে আচ্ছন্ন-আক্রান্ত করে এক জান্তব অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করেন । গল্প বলার ঘোর থেকে বেড়িয়ে ইলিয়াস বরং বিশ্লেষণ করার সুযোগ কখনোই ছাড়েননি, আর নিপুণ ডিটেইল নিয়ে কাজ করার ক্ষমতায় তিনি এখনো দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশে অতুলনীয় বলে মনে হয় । বিছানায় ঘুমাবার আগে স্ত্রী যখন স্বামীর মুখ চেপে ধরে, তখন রাতের খাওয়া পাঙ্গাশ মাছের ঝোলের গন্ধ ঠিকই স্বামীর নাকে ধাক্কা দেয় । এমন আরও, ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বহু মাত্রায় বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সামনে পাঠককে দাড় করাতে পারেন ইলিয়াস । আপাদমস্তক সমাজ-শ্রেণি সচেতন থেকে শ্রেণি দ্বন্দ্বই মুখ্য থাকে তাঁর গল্পে । গল্পের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিকে আবিষ্কার করতে হয় সমষ্টির মাঝে, মধ্যবিত্ত প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অন্তঃসারশূন্য, পুরুষ চরিত্রগুলো আপাদমস্তক "ডেল্টা মেল" ।
ইলিয়াসকে কখনোই সোজা-সাপটা লেখক বলে মনে হয় নি । তারপরও একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে এখনো মানুষ তাঁর লেখা পড়ছে । দেদারছে না হলেও ইলিয়াসের বই নিয়মিত বিক্রি হয়, ঢিমে তালে হলেও তাঁর বইয়ের নতুন মুদ্রণ বাজার আসছে । শিল্পসৌন্দর্যের হিসেব-নিকেশের সুরাহা না করে, বরং ইলিয়াসের বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি আর তার উপর ভিত্তি করে আপামর জনগণের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে আবিষ্কার করার বহু-বিচিত্র উপায়ের দিকে নজর দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায় । ইলিয়াস সমাজ বা মানুষকে অগ্রাহ্য করেননি কখনোই । গরিব বাংলাদেশের আরও গরিব সাহিত্য অঞ্চলে বার বার ফিরে যাওয়ার মত লেখক তো খুব বেশি নেই । তার উপর ফিরে গেলে লাভ হয় এমন কাউকে আজকাল খুঁজে পাওয়াই মুশকিল । এমন পরিস্থিতে ইলিয়াসের কাছে কেউ যদি উপস্থিত হন এবং সফর শুরু করেন তবে লাভ বৈ ক্ষতি হবে না ।
কুল্লে মাত্র পাঁচটি গল্প। সবগুলোর সুতা এক বাঁধনে বাঁধা। মানবিকতা।
প্রেমের গপ্পো নিছক প্রেমেরই গপ্পো। নবদম্পতির প্রথম প্রথম নিজেদেরকে আবিষ্কারের গল্প। একজনের বুদ্ধিহীনতাকে আরেকজনের তীক্ষ্ণ মানবিকতা দিয়ে পুষিয়ে দেয়ার কাহিনী।
ফোঁড়া গল্পটা মনে হলো, ঠিক যেন ইলিয়াস সাহেবের গল্পগুলোর এক প্রতীকী উপস্থাপনা। শ্রেণীবৈষম্য ত আছেই। সাথে আছে আমাদের সমাজের কিছু দগদগে ঘা, কিছু মুখছাড়া ফোঁড়া - যেটাকে দেখাতে গেলে লজ্জাঙ্গ অনাবৃত হয়ে যায়, কিন্তু তারপরও লেখক তা দেখিয়েই ছেড়েছেন!
জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল ও রেইনকোট মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ঢাকা শহরের অবস্থা নিয়ে লেখা। দুটোতেই গেরিলা - মিলিটারি দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে এক দোকানদার ও শিক্ষকের অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প ফাঁদা হয়েছে। আশেপাশে মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি কীভাবে মনে ভয়-আশা-সাহস-উদ্যম-প্রেরণা-মনোবল জোগাতে পারে তার আয়োজন এই দুই গল্প। স্বাধীনতার বিশ-বাইশ বছর পরেও সে সময়কার এতো আন্তরিক বর্ণনা তাঁর কলমে দারুন মানিয়েছে। আন্তরিক বলেই ঘৃণ্য কাজকারবারকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের মানবিকতা।
আর সবচেয়ে হৃদয়বিদারক মনে হলো কান্না গল্পটিকে। এতটা সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ইলিয়াস সাহেব গোরস্থানের ছবি এঁকেছেন যে অবাক হতে হয়। কপটতা, স্বার্থপরতা - এসব থাকলেও সবকিছু ছাড়িয়ে দেখা মেলে মায়া-মহব্বতের। মানুষের সাথে মানুষকে বাঁধার কিছু অতি সাধারণ সুতা।
ছোটকালে ভালোলাগার একটা গল্প ছিল " রেইনকোট" । সেখানে লেখক পরিচিতি বা ব্যাখ্যায় পড়তাম যে এটি "জাল স্বপ্ন , স্বপ্নের জাল" গ্রন্থ থেকে নেওয়া। ছোটকালের আগ্রহ থেকেই বইটি পড়া শুরু করি। গল্প গুলো প্রতিটি ই সুন্দর আর মানুষের মনের নির্দিষ্ট অনুভূতি কেই ভিত্তি করে তৈরি। নামে ছোট গল্প তবে আকারে একেবারেই যে ছোট এমনটি ও নয়। সেই সাথে ব্যপ্তী ও যেন বিশাল। ছোট গল্পর মতো ছোট একটা ঘটনা বা মুহুর্ত কেন্দ্র করে নয়, বরং অল্প কথায় বোধহয় পুরো মানুষটিকে জানা হয়ে। তবে, রেইনকোট বা জাল স্বপ্ন নয়, সবচেয়ে ভালো লাগার গল্পটি ছিল "কান্না" । বইটি ভালো লাগবে নি:সন্দেহে।
এই বইয়ের রেইনকোট গল্পটি উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্য হওয়ায় লিজেন্ডারি গল্পে পরিণত হয়েছে। অনেকবার পড়তে হয়েছে একাডেমিকের জন্য। তারপরেও আমার পছন্দের এটা। বাকি গল্পগুলোও বেশ ভাল