সংশপ্তক বিগত যুগের কাহিনী। সংশপ্তক এ যুগের দর্পণ। সংশপ্তক ভাবীযুগের কল্লোল। সংঘাতে, বেদনায় ক্ষুব্ধ যে কাল—সে কালের মানুষ দরবেশ, ফেলু মিয়া, জাহেদ, সেকান্দার মাস্টার, রামদয়াল, অশোক, রমজান আর মোজাদ্দেদী সাহেব। জীবনসংগ্রামে যারা আজও হাল ছাড়েনি তাদেরই প্রতিভূ লেকু-কসির-হুরমতি। আর যারা ধরা পড়েছে যুগের দর্পণে, হার মেনেছে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, সেই রাবু, আরিফা, রানু, রিহানা কিংবা মালু—এরা সবাই মুখর ক্রান্তিলগ্নের উত্থান-পতনে। যুগধারার ত্রিবেণী সঙ্গমে এই নায়ক-নায়িকারা কেউ অসাধারণতার দাবিদার নয়। কিন্তু এরা সবাই অনন্যসাধারণ। এরা ইতিহাস।
Shahidullah Kaiser (Bengali: শহীদুল্লাহ কায়সার) was born Abu Nayeem Mohammad Shahidullah. He is the brother of another famous Bengali author Zahir Raihan. Kaiser studied at Presidency College, Kolkata and obtained a Bachelors degree in economics with honours. Later, he enrolled in Masters of Arts at Calcutta University but did not finish getting the degree.
Kaiser was active in politics and cultural movements from his student days. Following the formation of Pakistan in 1947, he became a member of the provincial Communist Party of East Pakistan. He started working as a journalist in 1949 with the Ittefaq in Dhaka. In 1952, he participated actively in the Language Movement. For his political role in the movement for protection of Bengali language, Kaiser was arrested on 3 June 1952. He was later jailed for three and a half years. Right after his release in 1955, he was again arrested and jailed on a political crackdown on activists. A few years later he was released. In 1958, Kaiser joined as an associate editor of the Daily Sangbad - a Bengali language daily - where he worked for the rest of his life. When the Military coup of 1958 put Ayub Khan in power, and martial law was proclaimed, Kaiser was arrested again on 14 October 1958 and remained in jail for four years till his release in September 1962.
At the end the Bangladesh Liberation War of 1971, the Pakistan Army and its local collaborators initiated a plan for killing the leading Bengali intellectuals. As a part of it, Kaiser was rounded up on 14 December 1971. He never returned, nor was his body found. It is assumed that he was executed along with other intellectuals. His brother Zahir Raihan also disappeared while searching for Kaiser.
"তুমি যাও পরিচিত কোন ডাকে বাড়ি ফিরে এসো সন্ধ্যে নামার আগে.."
বইয়ের শেষ দুটো লাইন কেন যেন এ গানটার কথা মনে করিয়ে দিল। রাত ২টা ৬ কি ৭ এর দিকে বইটা শেষ হল। এরপর অনেকক্ষণ বইটা কোলে নিয়ে বসে থাকলাম। তারপর মাঝরাতে এঘর সেঘর অনেকক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম। পরে খেয়াল হল সকালে পোলাপানের ক্লাস নিতে হবে - এবেলা ঘুমোনো দরকার!
আচ্ছা আমাদের এত চমৎকার বইগুলোর কেন অজস্র অনুবাদ হয় না? এ বইয়ের সবথেকে সুন্দর দিক হল কনটেক্সটঃ changing contexts. কিভাবে ঘরের-বাহিরের কনটেক্সট পরিবর্তনের সাথে সাথে কতকিছু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে, হারিয়ে যায়, নতুন কিছু স্থান পায়, আবার কিছু হারায়, কিছু থেকে যায়, থিতু হয়, সত্য-মিথ্যায় মেশানো এক সাম্যাবস্থায় পৌঁছায় --- বিশাল এক ইকোসিস্টেম!
ডেনিসের ভাষায়, "Change is the only constant, hanging on is the only sin." আমি বলব, "To sin is human." নাহলে তো আমরা সব ফেরেশতাই বনে যেতাম।। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশে যে বিবর্তন, পরিবর্তন, কিংবা নিজের ভেতরের একান্ত সুরকে বদলাতে না দিয়ে বেঁচে থাকার গল্প সংশপ্তক।
শহীদুল্লা কায়সার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ধর্ম, রাষ্ট্র, শিক্ষা, শ্রেণিভেদ কে হাতিয়ার করে মানুষের উপর যে শোষণ চলে তার চমৎকার এক ছবি এঁকেছেন সংশপ্তকে। এ বইয়ের আরেকটা শক্তিশালী দিক হল জেন্ডার ডাইনামিকস। হুরমতী আর রাবু ধর্মীয় আচারের বলি হয়েও যেরকম হার মেনে নেয় নি - they defied and evolved - that adds lots of plus points in favor of this book.
বইটা পড়েছিলাম প্রায় একবছর আগে। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে। কোনরকমে শেষ হলেই যেন বাঁচি। এই কোয়ারিন্টিনে স্টক প্রায় খালি হয়ে যাওয়ায় আবার হাতে নিলাম। এবার আর বিরক্তি নয় প্রচন্ড ভালো লাগা নিয়ে পড়লাম। বাসায় আটকে থাকা বের হই বের হই মনটাকে ঘুরিয়ে আনলাম বাকুলিয়া থেকে।
আর ভাবলাম সেই ১৯৩৪-১৯৪৭ আর এই যে ২০২০। তখনের সময় আর এখনের সময়। তখন ছিল অশিক্ষা, ধর্মান্ধতা, জবরদখল আর মহামারির সাথে লড়াই। এই ৫০ বছরে অবস্থার খুব পরিবর্তন দেখলাম না। তখন ছিল অশিক্ষা আর এখন হচ্ছে কুশিক্ষা। ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার কাটলো কই? এখনো কত রমজান আছে যারা করোনা আক্রান্ত পরিবারকে ফেলে পালিয়ে আসে। এই দুর্দিনে চালটা, ডালটা চুরি করে নিয়ে, ত্রানের তেলের বোতল খাটের নীচে রেখে এখনো অবস্থা উন্নতির স্বপ্ন দেখে। চোখ খুলতে কত দেরি, পাঞ্জেরি?
" এক ধারায় নয়, বহু ধারায় প্রবাহিত জীবন। যদি শুকিয়ে যায়, যদি রুদ্ধ হয় একটি ধারা আর এক ধারায় জীবন বয়ে চলে সার্থকতার পানে। এটাই জীবনের ধর্ম। সহস্র ধারায় জীবনের বিকাশ, অজস্র পথে তার পূর্ণতা। "
বুদ্ধিজীবী। শব্দটার মধ্যে কেমন যেন একটা ভারী ভারী ভাব আছে।ছোটবেলায় যখন বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়তাম তখন এই 'বুদ্ধিজীবী' টার্মটা প্রায়ই উঠে আসত।সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠত কয়েকটা নাম, যেমন - মুনির চৌধুরী,জি.সি. দেব,মুফাজ্জাল হায়দার চৌধুরী,আনোয়ার পাশা,জোতীর্ময় গুহ ঠাকুর,আব্দুল মুক্তাদির,ফজলুর রহমান খান, মনিরুজ্জামান,ফজলে রাব্বী,ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত আরো অনেক নাম।তখন বুঝতে পারতাম না, এনাদের কেন বুদ্ধিজীবী বলে।ভাবতাম হয় তো অনেক বুদ্ধি আছে তাই বুদ্ধিজীবী বলে। থাক সে সব কথা,পড়ালেখার খাতিরে এই নামগুলো মুখস্ত করতে হত আমাকে।কিন্তু কোনো সময়ই সব নাম মনে থাকত না।কয়েকটা নামই মনে থাকত, তার মধ্যে একটা হল শহীদুল্লা কায়সার।জানি না কেন কিন্তু নামটা আমার অনেক ভাল লাগত। তারপর বড় হলাম, ব্যাপারগুলো বুঝতে শিখলাম,বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠল।আব্বুর চাকরির কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাযাবরের মত ঘোরা লাগত।যেখানেই যেতাম,খোঁজ করতাম লাইব্রেরী আছে কি না।কারণ স্টুডেন্টদের জন্য লাইব্রেরীই সাশ্রয়ী,বেশির ভাগ বই লাইব্রেরীতে পড়তাম। তবে লাইব্রেরীতে পড়ার অনেক ডিসএডভান্টেজও আছে।কোনো বড় বই পড়া কষ্টসাধ্য। যখন শরীয়তপুর ছিলাম,সেখানকার কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে প্রায়ই যাতায়াত করতাম।যেহেতু বই বাসায় নিয়ে আসার পারমিশন ছিল না,তাই ছোট ছোট বই পড়ে লাইব্রেরীতেই শেষ করতাম। একদিন বুকশেলফে বই খুঁজতে খুঁজতে একটা নাম দেখে আমার চোখ আটকে গেল, ' শহিদুল্লা কায়সার '।নামটা দেখে পড়ার জন্য চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল।কিন্তু ঠিক পরের মুহূর্তেই দমে গেলাম।বইটার নাম ছিল সংশপ্তক।ঢাউস সাইজের ৪০০ পৃষ্ঠার বই। এতবড় বই লাইব্রেরীতে পড়ে শেষ করার ধৈর্য এবং অভিজ্ঞতা কোনোটাই ছিল না।তাই মুখ বেজার করে অন্য বই খুঁজতে লাগলাম।
তারপর থেকে ৩ বছর কেটে গেল।বইটার কথা আমার মাথায় ছিল।অনলাইন থেকে কিনে নিলাম এবং বইটায় ডুবে গেলাম পুরো।
বইটা শেষ করে মুখ দিয়ে একটা শব্দই বের হল,মাস্টারপিস ! বাংলা সাহিত্যের সেরা উপন্যাসগুলোর একটা।শহীদুল্লা কায়সার একটা যুগের কাহিনী চোখের সামনে তুলে ধরেছেন।উপন্যাসটিতে ব্রিটিশ ভারত এবং তৎকালীন সামাজিক অবস্থা সুন্দর করে বর্ণনা করা হয়েছে।উপন্যাসটিতে কিছুই বাদ যায় নি।তৎকালীন জমিদার তালুকদারদের বর্বরতা,ইংরেজদের শোষণ,সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মত কঠিন প্রসঙ্গগুলো লেখক অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় ব্যক্ত করেছেন।উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলোর শৈশবের সুখস্মৃতি থেকে শুরু করে যৌবনের দাম্পত্য কলহ কোনো কিছুই বাদ যায় নি। প্রথমে বুঝতে পারি নি বইটির মূল চরিত্র আসলে কে।তবে প্রতিটি চরিত্রই মনে দাগ কেটে দিয়েছে। সংশপ্তক অর্থ হল "যুদ্ধে জয়লাভ কিংবা মৃত্যু এমন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সৈনিক"।প্রতিটি চরিত্রই যেন ছিল তাই,নিজের নিজের জীবনের হার না মানা সৈনিক।মালু,রাবু,জাহেদ,সেকান্দার মাস্টার,লেকু, হুরমতি,ফেলু মিঞা,রমজান সবাই সৈনিক।নিজের জীবনে তারা সকলেই নায়ক।তবে গল্পের বিস্তারটা হয়েছে মালুর জীবনকে নিয়েই।বাকুলিয়া গ্রামের দূরন্ত কিশোরের গ্রামের জীবন উপভো, গ্রাম ছেড়ে কলকাতা শহরে যাত্রা,হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ,৪৭এর দেশভাগ,গায়ক হিসেবে শিল্পী সমাজে টিকে থাকে,প্রেমে পড়া,দাম্পত্য কলহ সব কিছুর পর জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার গল্পই সংশপ্তক।
এক সময় বইটার আকার দেখে ভয় পেয়েছিলাম,এখন মনে হচ্ছে বইটা খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল। বুদ্ধিজীবী!আসলেই বুদ্ধিজীবী।শহীদুল্লা কায়সার ওয়াজ এ জিনিয়াস।খারাপ লাগে।আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি।আসলেই অনেক কিছু হারিয়েছি।
[কিছু কথা বলে রাখি,আমার সংগ্রহের বইটা জোনাকি প্রকাশনীর।জায়গায় জায়গায় অজস্র বানান ভুল এবং একই লাইন দুইবার করে লেখা।প্রকাশনী সম্পর্কে তেমন আইডিয়া ছিল না বলে কোনো রকম বাছ-বিচার না করেই কিনে ফেলেছিলাম।এমন একটা বিখ্যাত বইয়ে এত এত ভুল থাকা সত্যিই লজ্জার বিষয়। আপনারা যারা বইটি সংগ্রহে রাখতে চান অবশ্যই চারুলিপি প্রকাশনীরটাই কিনবেন।]
"সংশপ্তক" বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের একটি। উপন্যাসটির কাহিনী তৎকালীন ইংরেজ শাসন এর অন্তিম লগ্ন থেকে শুরু করে পাকিস্তানের সূচনালগ্ন পর্যন্ত। পটভূমি হিসেবে দেখতে পাই পূর্ববঙ্গের এক নদী পাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে, কলকাতা, তারপর ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
নদী পাড়ের দুই গ্রাম বাকুলিয়া আর তালতলিকে কেন্দ্র করে গল্পের মূল প্রেক্ষাপট হলেও। গল্পের স্বাভাবিক ধারাবাহিকতায় তা ছড়িয়ে গেছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, সেখান থেকে আবার শহরের এক অন্য জীবনে। যা গ্রামের জীবনের সম্পূর্ণ বিপরীত। মালু, দরবেশ চাচা, জাহেদ, লেকু, সেকান্দার মাস্টার, হুরমতি, রাবু, রমজান। নাম গুলো বলে হয়তো শেষ করা যাবেনা। যাদের প্রতিটা চরিত্র আলাদা আলাদা একটা গল্পের অথবা বলা যা সমাজের এক একটা স্থরের প্রতিনিধিত্ব করে। এর বৃহত্তর পটভূমিতে যেমন উঠে এসেছে মহাযুদ্ধ ,মন্বন্তর ,পাকিস্তান আন্দোলন , সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনের ঘটন। আর এসব লেখকের লেখনীর নৈপুণ্যে হৃদয়গ্রাহী হয়ে ফুটে উঠেছে গল্পে।
নাটকটা দেখে মনে রাখার মতন বয়সও তখন হয়নি যখন এইটা টেলিভাইজড হয়, শুধু একটা সিন মনে ছিলো একটা লোহার গরম বস্তু কাউকে ছ্যাঁকা দেয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে (এই টাইপ)। সেই আগ্রহ থেকেই পড়া। অসাধারণ! অসাধারণ! অসাধারণ! 👌
এককথায় এর জন্যে কোনো বিশেষণ মাথায় আসছে না। তবে শহীদুল্লা কায়সারকে বলতে পারি, আপনি বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র! অসাধারণ আপনার সৃষ্টি। গ্রহণ করুন গুণমুগ্ধ এই ক্ষুদ্রের শতকোটি প্রণাম..
একটি কথা বলতেই হয় এই উপন্যাস টি হচ্ছে খাটি বাংলাদেশের উপন্যাস ! আছে বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের কথা , আছে ভন্ড পীর দের কথা , গুণী লোকদের সম্মান না করার কথা আর আছে পচে যাওয়া একটি বিশেষ শ্রেনীর লোকদের কথা।
সুতরাং বাংলাদেশ কে পিছিয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশের খাটি একজন বুদ্ধিজীবী কে হত্যা করে আসলেই বাংলাদেশ কে অনেকাংশে পিছিয়ে দিয়েছে ।
পর পর তিনটা গ্রামীণ জীবনের উপন্যাস পড়লাম। প্রথম দুটি ছিল "গণদেবতা","পঞ্চগ্রাম" , শেষের টি সংশপ্তক। প্রথম দুটি উপন্যাসের একটি ছায়া যেনো ছিল সংশপ্তকে ,তবুও সংশপ্তক নিজেই স্বতন্ত্র। গ্রাম্য রাজনীতি,জীবনের গতি ,জন্ম, মৃত্যু, দুঃখ,কষ্ট সব যেন সময়ের সাথে পুষিয়ে যায়। মৃত্যু যেখানে ,সেখানে আবার প্রাণ জেগে ওঠে ,সময় যেখানে থেমেছিল ,আবার সেখানে ঘটে নতুন সময় উত্থান। কিন্তু তবুও খারাপ শক্তি গুলো যেনো পরাভূত হয়না কোনো অভিশাপ দ্বারা,কোনো অলৌকিক কাণ্ড দ্বারা। ওরা যেনো ফুলে ফেঁপে ওঠে। অদ্ভূত ভগবানের বিচার , অদ্ভূত এই দুনিয়ার আন্দাজ।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক গ্রাম বাকুলিয়া। সেই বাকুলিয়ার বালক আবদুল মালেক ওরফে মালুর চোখ দিয়ে বৃহত্তর জীবনকে দেখার উপন্যাসই সংশপ্তক। তবে এ কাহিনী শুধু মালুর নয়, এই কাহিনী রাবুর, জাহেদের, হুরমতীর, সেকান্দার মাস্টার, রমজান কিংবা লেকু মিয়ারও।
সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে। তখন বাংলায় মিলেমিশে থাকতো হিন্দু মুসলমান। বর্গা চাষীরা জমিতে হাল চাষ করতো, বাকি সময় চলে যেতো বার্মা মুল্লুকে কিংবা আসামের পাহাড়ে। সেই সময়ের একটি সবুজ শ্যামল গ্রাম বাকুলিয়া, তার পাশেই সারা বছর ফসল দেয়া উর্বর দক্ষিণের ক্ষেত। বাকুলিয়ার বহুদিনের আত্মীয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দুই বাড়ি, মিয়া বাড়ি আর সৈয়দ বাড়ি। মিয়া বাড়ির ফেলু মিয়া পূর্বপুরুষের হারানো জমি ফিরিয়ে এনে মিয়াদের হৃত গৌরব ফেরাতে বদ্ধপরিকর। এ কাজে তার দোসর রমজান। এ গ্রামেই বাস করে লেকু মিয়া, কাসির, ফজর আলী, ট্যান্ডল, রহমত, সেকান্দার মাস্টার, হুরমতী। তারা পেশায় ও সম্পদে প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষ। অপরদিকে সৈয়দ বাড়ির মুনশীর ছেলে মালু শুধু এ বাড়ির মেয়ে আরিফা আর রাবুর অনুগত শীষ্যই নয়, মেজো ভাই জাহেদের একান্ত প্রিয়।
হঠাৎ করেই সব যেন এলোমেলো হয়ে যায়। মালুর জীবন বয়ে চলে এখান থেকে সেখানে। এর মধ্যেই চলে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সেখান থেকে কলকাতার হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা অতঃপর দেশভাগ। মালু তার যাযাবর জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রত্যক্ষ করে এক বিরাট পৃথিবীকে। আর এই সব কিছুর মাঝ দিয়ে বিরান হয়ে যায় এককালের সুজলাসুফলা বাকুলিয়া। তবুও আশা কখনো মরে না, নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে মালু, রাবেয়া, জাহেদ, সেকান্দার মাস্টারেরা।
মোটামুটি বিরাট কলেবরের উপন্যাসে লেখক সেই সুপ্রাচীন বাংলার জীবন যাপন, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সময়ের পরিবর্তনে সেই সংস্কৃতি সেই জীবনধারার বিলুপ্তিটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। মালুর চোখ দিয়ে ভূবন ঘুরে তাই সত্যিই মন বিচলিত হয়, মনে হয় সময়কে এক জায়গায় স্থির রাখা গেল কত ভালোই না হতো!
সব মিলিয়ে সংশপ্তক যেন বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধ মাখা এক উপন্যাস। এ যেন মালুর সাথে আমাদের সকলকে যার যার শেকড়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। যে বাংলা আমরা দেখিনি সেই বাংলাকে চোখের সামনে তুলে ধরার এক অসামান্য প্রয়াস। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, সংশপ্তক উপন্যাসও থাকবে তার আপন মহিমায়।
ঠিক কোন ভাষায় বইটাকে মূল্যায়ন করবো সেটা আমার জানা নেই। বাংলা সাহিত্যের এক উত্তর তারকা শহীদুল্লা কায়সার। বইটা শেষ করার পরে যে অনুভুতি সেটা প্রকাশ করার সাধ্য কার আছে!
বই : সংশপ্তক লেখক : শহীদুল্লা কায়সার প্রকাশক : চারুলিপি ধরণ : কালজয়ী উপন্যাস পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৪০০ প্রচ্ছদ : হাশেম খান প্রথম সংস্করণ : সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ ( আশ্বিন ১৩৭২ ) সংস্করণ : এপ্রিল ২০১৭ ( চতুর্থ মুদ্রণ ) মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা ISBN : 978-984-598-012-8
লেখক পরিচিতি :
শহীদুল্লা কায়সার ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২৭ সালে ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে ৷ ১৯৪৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ অর্থনীতিতে স্নাতক এবং পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হলেও রাজনীতির কারণে তা অসমাপ্ত ৷ সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি সক্রিয়ে ছিলেন বামপন্থি রাজনীতিতে ৷ কারাবরণ করেছেন অগণিতবার ৷
'সংশপ্তক', 'সারেং বৌ', 'রাজবন্দীর রোজনামচা', 'দিগন্তে ফুলের আগুন' প্রভৃতি তার সৃষ্টি ৷ তিনি আদমজী সাহিত্য পুরষ্কার (১৯৬৩) , বাংলা একাডেমী পুরষ্কার (১৯৬৯) , একুশে পদক (১৯৮৩) , স্বাধীনতা পদক (১৯৯৮) পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন ৷
শহীদুল্লা কায়সার ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর দ্বারা ধৃত হন এবং আজও তাঁর খোঁজ পাওয়া যায় নি ৷
ফ্ল্যাপের কথা :
'সংশপ্তক' উপন্যাসের কাহিনির শুরু ইংরেজ আমলের অন্তিমকালে, শেষ পাকিস্তান আমলের সূচনাপর্বে ৷ কাহিনির অনেকখানি স্থাপিত পূর্ববঙ্গের গ্রামাঞ্চলে, খানিকটা কলকাতা ও ঢাকায় ৷ এর বৃহত্তর পটভূমিতে আছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, মন্বন্তর, পাকিস্তান-আন্দোলন,সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠার ঘটনা ৷ এতে প্রাধান্য লাভ করেছে শাখা-প্রশাখাসমেত এক সৈয়দ পরিবারের কথা ৷ তাঁর এক সৈয়দ প্রাচীনপন্থী নানা সংস্কারের সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষা ও ইংরেজের চাকরি সমন্বিত করেছেন ৷ আরেক সৈয়দ স্ত্রী-কন্যা ফেলে নিরুদ্দেশযাত্রা করে দরবেশ হয়েছেন ৷ প্রথমোক্তজনের পুত্র জাহেদ আধুনিক শিক্ষা ও জীবনবোধ আয়ত্ব করে প্রথমে পাকিস্তান-আন্দোলন এবং পরে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৷ প্রাচীনতার সঙ্গে তার ভয়াবহ দ্বন্দ ৷ তাই পিতৃব্য যখন তাঁর একবয়স্ক শিষ্যের সঙ্গে কন্যা রাবুর বিয়ে দিয়ে ফেলেন, তখন সে তার সমর্থকদের নিয়ে নতুন বরের উপর এমন হামলা করে যে শুধু জামাতা নন, সদলবলে শ্বশুরকেও পলায়ন করতে হয় ৷ রাবুও এ-ঘটনাকে বাড়াবাড়ি মনে করে, কিন্তু পরে — জাহেদের শিক্ষার প্রভাবে— ওই স্বামীকে স্বামিত্বের অধিকার দিতে অস্বীকার করে ৷ কাহিনি শেষ হয় বাম রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতার কারণে জাহেদের গ্রেপ্তারে এবং তার প্রতি রাবুর দেহাতীত প্রেমের স্থিতিতে ৷
– আনিসুজ্জামান
ব্যক্তিগত মন্তব্য :
২০০৪ কিংবা ২০০৫ এর দিকে যতদূর মনে পরে বিটিভিতে রাত দশটার সংবাদের পর নাটকটা প্রচারিত হতো ৷ যতোই হরর মুভির ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর শুনি নাহ্ কেন, নাটকটির শুরুতে যে সাউন্ডটা দিতো সেটার ভয়ে আজো গা কাঁটা দিয়ে উঠে ৷ রমজানের চোখ রাঙানো আর হুরমতির চাহনি কিংবা ছোট্ট মালুর কৌতুহল সবকিছুই শিহরণ জাগাতো মনে ৷
প্রথমে বলি, 'সংশপ্তক' কালজয়ী কেন ! কারণ, বইটির যে প্রেক্ষাপট সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, ইংরেজ দমন , '৪৭ এর দেশভাগ সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পটভূমির এক সংমিশ্রণ ৷ আর বইয়ের বিস্তৃতি যা শাশ্বত ৷ নিত্য বহমান জীবনের পরও বইটি বাঙলা সাহিত্যে চিরতরুণ ৷
প্রধান চরিত্র যদিও জাহেদ আর রাবু কিন্ত আমার ভোটটা এ হিসেবে পাবে মালু ৷ কারণ, উপন্যাস যেভাবে এগিয়েছে মালুও সেভাবেই বেড়ে উঠেছে ৷ বাকুলিয়ার ছোট্ট মালু সমাজের টানাপোড়ন, শখ, ইচ্ছা, অভিলাষ, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা সবই পরখ করেছে ৷ ঢাকা বেতারের গায়ক মালেক একসময় ভাবে যদি সে আবার সেই বাকুলিয়ার ছোট্ট মালু হতে পারতো ৷
এরপরই আসে জাহেদ আর রাবু ৷ জাহেদ সৈয়দ বাড়ির মেজো ছেলে আর তার চাচাতো বোন রাবু ৷ যদিও রাবুর মা নেই, বাবা দরবেশ হয়ে ঘুরে বেড়ায় ৷ হঠাৎ এসে সৈয়দ দরবেশ যখন রাবুকে এক বয়স্ক পীরের সাথে বিবাহ দিয়ে দেয় , তখন জাহেদ তাদের লাঠি পেটা করে বাড়ি থেকে বের করে ৷ ঐদিকে যখন দেশভাগ নিয়ে মুসলিম-হিন্দু দাঙ্গা তখন জাহিদ মুসলিমলীগ পন্থী যদিও নিজের দেশটাকে ভালোবেসে সে সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে বামপন্থী হয়ে যায় ৷ অন্যদিকে রাবু কলেজ পাশ করে নিজে আত্মনির্ভরতার স্বাদ পায় ৷ যদিও রাবু ভালোবাসে জাহেদকে ৷ জাহেদ যে মুক্ত ৷ সে কি পাবে জাহেদকে নিজের করে ৷
উপন্যাসে একটা ব্যাপক স্থান পেয়েছে রমজান ৷ রমজান সর্দার - কানকাটা রমজান - রমজান আলি - কাজী মোহাম্মদ রমজান, সবগুলো নাম কিন্ত একজনেরই ৷ রেঙ্গুনের কুলি সর্দার বাকুলিয়ায় ফিরে হয়ে যায় মিঞার ডানহাত, এরপর হুরমতি কেটে দেয় কান , হয়ে যায় কানকাটা রমজান ৷ হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় সে রমজান আলি আর দেশভাগের সময়ই লুটতরাজ করে হয়ে যায় কাজী মোহাম্মদ রমজান ৷
শিক্ষিত যুবক আর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোক সেকান্দর মাস্টার ৷ যাকে ধনী-গরীবের মেলবন্ধ বলা চলে ৷ পিছুটান যাকে আটকে রাখতো দ্বায়বদ্ধতায় হঠাৎই সে বদলে যায় ৷ বিভিন্ন আন্দোলনে যোগদান, মিছিল-মিটিং করছে ৷ সকলকে একত্র করবার ছোট্ট ছোট্ট প্রয়াসগুলোই বাঁচিয়ে তোলে মৃতপ্রায় বাকুলিয়াকে ৷
আমার মতে, যারা বাঙালি তাদের সবার জন্যই অবশ্য পাঠ্য এই উপন্যাসটি ৷ এমন সৃষ্টি শতাব্দীতে দৈবাৎ ৷
“এক ধারায় নয়,বহু ধারায় প্রবাহিত মানুষের জীবন। যদি শুকিয়ে যায়, যদি রুদ্ধ হয় একটি ধারা আর এক ধারায় জ়ীবন বয়ে চলে সার্থকতার পানে।এটাই জীবনের ধর্ম। সহস্র ধারায় জীবনের বিকাশ,অজস্র পথে তার পূর্ণতা।“
আব্বা-আম্মার কাছে শুনেছিলাম, সেই কবে বিটিভিতে নাকি “সংশপ্তক” নাটক হতো। একদিন বড় হয়ে জানতে পারলাম নাটকটা শহীদুল্লাহ কায়সারের লেখা একটা উপন্যাস থেকে নেয়া। ততদিনে আমি শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসের কথা জানি, জানি ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনীর তুলে নিয়ে যাওয়ার পর নিখোঁজ হওয়া শহীদুল্লাহ কায়সারের কথা।
“সংশপ্তক” – যার অর্থ নির্ভীক, যে পরাজয় মেনে নেয় না। দুটি গ্রাম – বাকুলিয়া আর তালতলি কে কেন্দ্র করে মূলত এই উপন্যাস। পুর্ববঙ্গের এই গ্রাম দুটিতে হাজারো মানুষের বসবাস। সে সময়ের কথা বলা হচ্ছে উপন্যাসটায় সেটা ১৯৩৫-৪৭ এর দিকের কথা। ব্রিটিশ শাসনকাল প্রায় শেষ হয়ে আসছে, অবশ্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তখনও বহাল। গ্রামে যেমন আছে জমিদার-তালুকদার শ্রেণীর মানুষ যেমন মিয়া-সৈয়দ, রামদয়ালদের পরিবার তেমনি আছে সাধারণ প্রজা যেমন লেকু, ফরজ আলী, সেকান্দার মাস্টার। আছে ফেলু মিয়ার মত জমিদার যিনি হৃত সম্পদ আবার উদ্ধার করতে দ্বিধা করেন না প্রজাদের উপর অমানবিক হতে, আবার জাহেদ-সেকান্দারদের মত চরিত্র যারা সবার জন্য আনতে চায় একটি সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে শোষিত হবে না লেকু বা কসিরের মানুষেরা। কুসংষ্কার আর ধর্মীয় গোঁড়ামির বলি হয়ে রাবুর বিয়ে হয় এক বয়ষ্ক পীরের সাথে। আবার “ছেনালিপনার” জন্য হুরমতিকে পেতে হয় বর্বরোচিত শাস্তি। যুদ্ধের বাজারে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হতে দেখা যায় রমজানের মতো লোকদের। এভাবে একে একে উপন্যাসটিতে উঠে আসবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতন ইতিহাসের নানান গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
উপন্যাসটার যে ব্যাপারটা আমার ভালো লেগেছে তা হলে এর পটভূমি শুধু যে গ্রাম তা নয়, মোটামুটি দ্বিতীয় অর্ধেকে আমরা মূল চরিত্রদের বেশির ভাগকেই পাব কলকাতা শহরে। এই শহর-গ্রামের Juxtaposition টা বেশ উপভোগ করার মত। তবে প্রথম দিকের যেমন বেশ সামাজিক-রাজনৈতিক উপন্যাস মনে হচ্ছিল পরের অর্ধেকে দেখা গেল আবদুল মালেক উরফে মালুই যেন উপন্যাসের নায়ক চরিত্র। এই অংশের গল্প মালুর কলকাতা আসা-গায়ক হওয়া-রিহানার সাথে বিয়ে ও বিচ্ছেদ পর্যন্ত। যদিও এটাতেও বেশ একটা coming of age taste ছিলো আর এটাও যে উপভোগ করিনি তা না, তবে এতে করে বইটার কলেবরে বেশ একটা অগোছালো ভাব চলে আসছে। শেষে গিয়ে আবার গ্রামের কাহিনিতে ফিরে আসে। কিন্তু প্রথম অর্ধেকে যাদের কথা এতো করে পড়লাম মাঝের অংশে এসে ওদের পরিণতি বা বিবর্তন কিভাবে হল কিছুই বোঝা গেল না। এটা এই উপন্যাসের একটা বড় ত্রুটি আমার কাছে।
আমি “জোনাকী প্রকাশনী”র বইটা পড়েছি। এতো বড় বইয়ের দাম মাত্র ২৫০ টাকা। আর তাতেই সস্তার বার অবস্থা করে রেখেছে। পাতায় পাতায় ৮-১০টা করে বানান ভুল। মালু কে “মাল”, কদাচিৎ কে “বদাচিত”, কৃপাবোধ কে “কৃপাবেধ”, খুঁটিনাটি কে “কুঁটিনাটি” এরকম শ’য়ে শ’য়ে বানান ভুল। পড়ে একদমই আরাম পাইনি। তবে এর সাথে রেটিংয়ের কোন সম্পর্ক নেই।
"বাকুলিয়া আর তালতলি গ্রাম। দুই গ্রামের মাঝে ফারাক করে রেখেছে বিস্তর এক শস্যক্ষেত। বাকুলিয়ার দক্ষিনের ক্ষেত দখিন খেত আর তালতলির মানুষেরা বলে উত্তুরের খেত। বাকুলিয়া গ্রামের প্রবেশ পথেই সৈয়দ বাড়ির সদর ফটক আর বেরুবার পথেই মিঞা বাড়ির মসজিদ। দুটো খানদানি বাড়ি দুই প্রহরীর মতো গেইট, গ্রামকে যেন দু হাতে বেষ্টন করে রেখেছে।"
উপরের গ্রামের বর্ননাটি শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক উপন্যাস থেকে নেয়া। সংশপ্তক কথাটির অর্থ যুদ্ধে জয় লাভ অথবা মৃত্যু এমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সৈনিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর কাল থেকে আরম্ভ হয়ে দেশ বিভাগ পর্যন্ত প্রায় এক যুগের (১৯৩৮-৫১) বিস্তৃত ঘটনা নিয়ে রচিত। উপন্যাসের মুল পটভূমিতে মুসলিম প্রধান বাকুলিয়া গ্রাম ও হিন্দু প্রধান তালতলি গ্রামকে কেন্দ্র করে কাহিনী ঢাকা কলকাতা শহরে গিয়ে গড়ায়। গল্পের শুরুতেই আমরা লক্ষ্য করি মিঞা বাড়ির আঙ্গিনায় হুরমতি নামক এক যুবতী পোয়াতি হওয়ায় সালিশি বিচার। বিচার কার্যের মুলে ছিল ফেলু মিঞা, মিঞা বংশের সন্তান মিঞা বাড়ির প্রধান। মাথায় টুপি বুক পকেটে আতর মাখা রুমাল।ফেলু মিয়া বাকুলিয়ার সবচে গণ্যমাণ্য লোক তথা জমিদার। তার দক্ষিন হস্তে রমজান আর বাম হস্তে কালু। বিচার কার্জের এখান থেকে শুরু হয়ে একেক চরিত্র আসতে থাকে এবং কাহিনীর গতিশীলতা আসে।এই উপন্যাসে লেখক একাধারে তুলে ধরেছোন গ্রামীন জীবন গ্রামীন পরিবেশ সেই সাথে ৪৩এর মনান্তর, হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা, হিন্দু মুসলিম সংঘাত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা আর বাম ধারার রাজনীতি।
উপন্যাসে কাহিনীর চে আমার কাছে চরিত্র গুলো বেশি শক্তিশালী মনে হয়েছে। চরিত্র গুলোই কাহিনী তৈরি এবং কাহিনীর গতিশীলতা এনেছে। লেখক বাস্তবতাকে অস্বীকার করেননি। ফলে লেখক প্রতিটা চরিত্রে বাস্তবতা তুলে এনেছেন। যেমন ফেলু মিঞা চরিত্রের মাঝে লেখক প্রভু-সামন্তবাদিদের ফুটিয়ে তুলেছেন,লেকু ও তার স্ত্রী আম্বিয়ার চরিত্রে লেখক গ্রামীন সংসার তুলে এনেছেন। সেকেন্দার মাস্টার চরিত্রের মাঝে লেখক আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী তুলে এনেছেন।মালু উপন্যাসটির অন্যতম একটি সৃষ্টিশীল চরিত্র, ১৩ বছরের মালএ তার গায়েন প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে পরিশ্রমো এক পর্যায় বর শিল্পী হতে সক্ষম হয়। রাবু উপন্যাসের একটি প্রতিবাদী নারী চরিত্র। সৈয়দবাড়ির মেয়ে রাবু একপর্যায় পিতার আদেশ এ এক দরবেশকে বিয়ে করলেও কলকাতায় গিয়ে সে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করে এবং নিজের মনমানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। জায়েদ চরিত্রটি উপলব্ধি করে ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব। ইংরেজি শিক্ষার অভাবে মুসলমানরা কিভাবে পিছিয়ে পরছে, তা জায়েদ চরিত্রটির মাঝে উপন্যাসের শেষ দিকে আমরা লক্ষ্য করি। রমজান উপন্যাসের অন্যতম এবং সবচে গুরুত্বপূর্ন চরিত্র। এই চরিত্রটির মাধ্যমে লেখক ঐ সময়ের জোচ্চোর সুবিধা পার্টি এবং চোরাকারবারি সহ বিভিন্ন অপকর্মে জরিত ব্যাক্তিকে তুলে এনেছেন, উপন্যাস থেকে বাস্তবজীবনে রমজান হয়েছে কানকাটা রমজান।
সর্বাপরি বলা যায় প্রতিটা চরিত্র লেখক সতন্ত্ব ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
আগেই বলছি শহীদুল্লা কায়সার বাম ধারার রাজনীতির সাথে জরিত ছিল। ফলে উপন্যাসে লেখক এর বামধারা রাজনীতির ব্যাপক প্রভাব লক্ষনীয়। হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা কিংবা বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ সবকিছু ছাড়িয়েই সংশপ্তক।
সংশপ্তক উপন্যাসটি থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন তথা বিটিভি তে ধারাবাহিক নাটক তৈরি করা হয়। কিন্তু ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের কারনে নাটকটি নির্মান ও সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯৮৮ সালের দিকে নাটকটি আবার প্রচারণ শুরু হয়। এবং এই ক্ষেত্রেও বলতে অনীস্বীকার্য যে উপন্যাসের চরিত্রগুলো নাটকে যারা প্লে করছে, তাদের আসল নাম থেকে উপন্যাসের নামেই তারা জনসাধারণ এর কাছে বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ চরিত্রগুলো এতোটাই শক্তিশালী এবং বাস্তবিক ছিলে যে তা তখনকার ব্যাক্তিমানসের সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায়।
সর্বাপরি কথা বলা যায় যে বাকুলিয়া তালতলি গ্রামের এক ঝাক চরিত্রের মাধ্যমে সেই সময়ের সামান্ত সমাজব্যবস্থা রাজনীতি ইত্যাদি উপস্থাপনে লেখক সার্থক।
আর পাঠক হিসাবে আপনাকে খুঁজতে হবে সংশপ্তক আসলে কে বা কোন চরিত্রটি।
বিঃদ্রঃ আমার পারসোনাল কালেকশনের বইটি অনেক পুরাতন, তাই এই ইডিট করা পিক আপলোড দিতে হলো।
ফিরে দেখা,
বইয়ের নাম : সংশপ্তক লেখক : শহীদুল্লাহ কায়সার জনরা : চিরায়ত বাংলা সামাজিক উপন্যাস। প্রকাশনী : জোনাকী প্রকাশন প্রথম প্রকাশ কাল : ১৯৬৫ পৃষ্টা সংখ্যা : ৪৩৬ পেজ। মুদ্রিত মূল্য :২৫০ টাকা।
ধন্যবাদ এবং বিজয়ের শুভেচ্ছা। মিদুল চকবাজার, ঢাকা। বেলা ১:৩০ মিনিট, ১৬ই ডিসেম্বর ২০১৯।
"এক ধারায় নয়, বহু ধারায় প্রবাহিত জীবন। যদি শুকিয়ে যায়, যদি রুদ্ধ হয় একটি ধারা আর এক ধারায় জীবন বয়ে চলে স্বার্থকতার পানে। এটাই জীবনের ধর্ম। সহস্র ধারায় জীবনের বিকাশ, অজস্র পথে তার পূর্ণতা। "
বইটাকে ঠিক কিভাবে মূল্যায়ন করব তা আমার জানা নেই৷ শুধু এতটুকু বলতে পারি এটি খাঁটি বাংলাদেশের উপন্যাস।
হাতে তেমন বই না থাকার কারনে বইটি ধরেছিলাম। একরকম বিরক্তিকর মনোভাব নিয়েই বইটি পড়তে শুরু করি৷ তবে যতো এগুতে থাকে গল্প ততো আগ্রহ ও ভালোলাগা কাজ করে নিজের ভিতরে।
সংশপ্তক শব্দের অর্থ পরাজয় জেনেও যে হাল ছাড়ে না। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উৎকৃষ্ট মানের উপন্যাস শহীদুল্লা কায়সার'র 'সংশপ্তক'। তবে যুদ্ধ নামক এক কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে ফেলি আমরা শহীদুল্লা নামক এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে।
Shahidullah Kaiser's "Sangshaptak" stands as one of the most significant literary works to emerge from East Bengal (now Bangladesh) in the 1960s. The novel's title, "সংশপ্তক" (Sangshaptak) doesn't have a direct English translation. However, it can be roughly translated as "determined soldier" or "sworn warriors who took an oath to fight until death" - a metaphor that encapsulates the book's revolutionary spirit.
📖 𝐁𝐨𝐨𝐤: সংশপ্তক/ Sangshaptak ✍️ 𝐀𝐮𝐭𝐡𝐨𝐫: শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সার/ 𝐌𝐚𝐫𝐭𝐲𝐫 𝐈𝐧𝐭𝐞𝐥𝐥𝐞𝐜𝐭𝐮𝐚𝐥 Shahidullah Kaiser 📚 𝐆𝐞𝐧𝐫𝐞: Historical Fiction, Political Drama 📅 𝐏𝐮𝐛𝐥𝐢𝐬𝐡𝐞𝐝: 1965 by চারুলিপি প্রকাশন/ Charulipi Prokashan
The novel portrays class struggles, resilience, and the indomitable human spirit amid socio-political upheaval. It delves into the lives of hardworking Bangladeshis, exposing hypocritical elders, societal disregard for virtuous individuals, and a corrupt elite. Through its vivid depiction of exploitation across economic, religious, political, educational, and class systems, it becomes a mirror of the real Bangladesh. Kaiser's background as a leftist activist and journalist imbues the narrative with authenticity and depth
Ω 𝐏𝐥𝐨𝐭 𝐎𝐯𝐞𝐫𝐯𝐢𝐞𝐰: Set against the turbulent backdrop of pre-Independence Bengal, 𝑆𝑎𝑛𝑔𝑠ℎ𝑎𝑝𝑡𝑎𝑘 captures the socio-political upheaval of the time through the eyes of rural villagers. The story unfolds in two villages—Bakulia (Muslim-majority) and Talatali (Hindu-majority)—amid the final years of British rule, the Partition, and subsequent political shifts. Kaiser's masterful narrative portrays the enduring struggle of the villagers against entrenched systems of exploitation—be it through economic, religious, political, or class-based oppression.
Ω 𝐌𝐲 𝐓𝐚𝐤𝐞 𝐨𝐧 𝐭𝐡𝐞 𝐁𝐨𝐨𝐤: At its core, 𝑆𝑎𝑛𝑔𝑠ℎ𝑎𝑝𝑡𝑎𝑘 is about resistance—not just against oppressive forces but also against the inner contradictions of human nature. Kaiser explores how personal convictions evolve into collective action, driven by the promise of justice. As mentioned earlier, the title, 𝑆𝑎𝑛𝑔𝑠ℎ𝑎𝑝𝑡𝑎𝑘, refers to those who swear an oath to fight until death—a fitting metaphor for the characters who refuse to yield to a corrupt world.
Kaiser delves into the complexities of Bengali society, with characters like Zaheed/Mejho Bhai and Sekander Master who represent contrasting yet interconnected aspects of the human mind—asceticism and struggle. Rabu, though soft and gentle, faces adversities with resilience, while Hurmati and Leku adapt to life's challenges, embodying human persistence. Even Ramzan, the novel's antagonist, is portrayed as a survivor—cunning and relentless, yet trapped within his own struggle for survival. While Zaheed and Rabu take center stage, Malu’s journey is the heart of the narrative. Malu’s life—shaped by communal riots, the traumatic partition, love, and personal struggles—captures the timeless human quest for identity and belonging. As Malu strives to rebuild his life amidst these challenges, his resilience becomes emblematic of the eternal human spirit. So, it can be said that the novel's characters—Malu, Rabu, Zaheed, Sekander Master, Leku, Hurmati, Phelu Mia, and Ramzan—are all soldiers in their own battles, embodying heroism in their lives. Uniquely for its time, 𝑆𝑎𝑛𝑔𝑠ℎ𝑎𝑝𝑡𝑎𝑘 portrays women as active participants, challenging societal norms and shaping their community's struggles. Each and every character’s journey deepens the narrative's emotional resonance, driving the novel's broader themes of resilience and transformation.
So, we see that, 𝑆𝑎𝑛𝑔𝑠ℎ𝑎𝑝𝑡𝑎𝑘 transcends its historical setting with themes of political resistance, justice, and collective defiance against oppression that remain profoundly relevant. The struggles of the past—illiteracy, bigotry, coercion, and epidemics—mirror many of today’s challenges, with education still inadequate, prejudice persisting, and figures like Ramzan continuing their exploitation. Kaiser’s exploration of personal loyalty versus political ideology offers timeless insight into the human condition. The novel’s depiction of social upheaval echoes contemporary global fights for justice, equality, and freedom. By the end, 𝑆𝑎𝑛𝑔𝑠ℎ𝑎𝑝𝑡𝑎𝑘 doesn’t just look back at the past—it foreshadows the tumultuous political changes that would lead to the liberation of Bangladesh, offering crucial insights into the nation’s formative years.
Despite its political intensity, 𝑆𝑎𝑛𝑔𝑠ℎ𝑎𝑝𝑡𝑎𝑘 does face some challenges in terms of pacing and narrative structure. The novel’s ideological discussions may feel dense, especially for those unfamiliar with the political history of Bengal. Some readers may find the portrayal of rural life to be somewhat disconnected from authentic experiences, while others may struggle with the fragmented character arcs. The slow pacing and non-linear sequence of events could detract from the flow, making it a bit harder to fully engage with the story at times. Nevertheless, these elements are integral to the novel’s larger purpose—contextualizing the personal within the political and highlighting the collective struggle for justice. 𝑆𝑎𝑛𝑔𝑠ℎ𝑎𝑝𝑡𝑎𝑘 isn’t just a story about individuals; it’s a commentary on the societal structures that shape their lives and actions.
At the end, we can say that, 𝑆𝑎𝑛𝑔𝑠ℎ𝑎𝑝𝑡𝑎𝑘 is more than just a historical novel; it is a powerful reflection on the resilience of the human spirit amidst adversity. Shahidullah Kaiser’s storytelling, paired with his deep understanding of political and social dynamics, makes this work a cornerstone of Bengali literature. For readers interested in exploring the intersection of history, politics, and human emotion, Sangshaptak is an essential read.
𝐓𝐡𝐞 𝐮𝐧𝐟𝐨𝐫𝐭𝐮𝐧𝐚𝐭𝐞 𝐫𝐞𝐚𝐥𝐢𝐭𝐲 𝐢𝐬 𝐭𝐡𝐚𝐭 masterpieces like this remain largely inaccessible to global readers due to the lack of English translations. It is imperative that such works are shared with the world to inspire future generations of leaders and thinkers.
যখন বইটা প্রথম পড়তে শুরু করি খুবি বিরক্ত লেগেছিল।প্রথম ৩০-৪০ পেজ।এরপর থেকে একরকম আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু।জীবন কেথায় শুরু কেথায় শেষ, কোন দিকে মোড় নেয় কেউই বলতে পারেনা। আর শেষে ওই যেমন হয়ে থাক সব ওরমই।
বইটা পড়ার পর একটা কথা বারবার মনে হচ্ছিল আমরা বেশ ভাল সময়ে জন্ম নিয়েছি...আছি...। না পড়তে হয়েছে মহামারী কলেরা,বসন্তের কবলে না যুদ্ধের মধ্যে ,না দান্ঙা ,না একাত্তর,না ভয়ংকর রোগ শোক...... ।জীবনে কত ধরনের উথ্থান পতন,নিষ্ঠুরতা,সংগ্রাম আছে অনেকাংশই দেখানো হয়েছে এখানে ।পুর্বপুরুশেরা সব করে দিযে গেছে আমরা শুধু ভোগ করছি ।দেশভাগ,দাঙ্গা,রোগশোকে কত্ত কষ্ট করতে হয়েছে।মাঝে মাঝে ভাবি তখন জন্মালে কি হত!!!
...আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে ওগুলোর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি ।
" সংশপ্তক " শব্দটার অর্থ জানা ছিলো না । অন্তর্জালে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো। নির্ভীক।
আজ শেষ পাতাটুকু উল্টিয়ে রেখে মনে হলো বইটার নাম এছাড়া বুঝি ভিন্ন কিছু হওয়ার ছিলো না।
সেই সাথে একই সাথে মনে প্রশ্ন জাগে নির্ভীক আসলে কে?
মালু? কথায় কথায় ছোট বয়সে সবার জন্যে চোখের পানি ফেলা মালু, যে জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতের মুখোমুখি হয়ে দাড়ায় এক ফিনিক্স পাখির প্রতিরুপ হয়ে, যে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে থাকা নিজের ভগ্নাবশেষ থেকে আবারও মহাশূণ্যে ডানা মেলে। একবার, দুইবার... বারবার! মালুর জীবনের এই বিনির্মাণ, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, সকল বাধাবিঘ্ন, প্রতিকূলতার উজানে দাড়িয়ে সংগ্রাম করে এগিয়ে চলার এই গল্প কি শাশ্বত মানবজীবনেরই আখ্যান নয়?
মেঝো ভাই আর সেকান্দর মাস্টার? অকারণে সর্বস্ব ত্যাগ করে কী এক ঘোর লাগা চোখে যারা ছুটে বেড়ায় সর্বত্র? তারা রুখে দাড়াতে জানে অন্যায়ের, আবার আপ্রাণে এগিয়ে আসতে জানে আর্তের। চরিত্রে, প্রেক্ষাপটে, জীবনের গন্ডি আর বাস্তবতায় দুজনের মাঝে অমিল অনেক, কিন্তু কোথায় যেন তারা আসলে একই মানুষ। সংশপ্তক মানুষের একই মনেরই দুই পৃথক অংশের প্রতিরূপ। সন্ন্যাস আর সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
কিংবা রাবু? একটু একটু করে ক্ষয়ে যেতে যেতেও যে কখনো জ্বলতে জানে এক মুঠো জোনাকের পেলব আভার মতো, কিংবা কখনো মশালের আগুন হয়ে; যখন যেমন দরকার ... রাবু যেন ম্রীয়মান হয়েও সরব, ক্ষুরধার হয়েও কোমল। প্রতিকূলতার মাঝে সে কখনো কখনো নতজানু হলেও এগিয়ে গেছে আপন মনে, মুখ থুবড়ে পড়ে নি।
বলা উচিত হুরমতী বুয়া, লেকুর কথাও.. জীবন এদের কাছে কখনও পুষ্পিত সৌরভে ধরা দেয় নি, বরং এগিয়ে এসেছে বিকট ক্লেদ, ক্ষুধা আর অত্যাচারিতের রূপে। এরাও অবলীলায় জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে জীবনের মতো করেই। লেকু তাই নির্মম ভাবে বউকে পেটায় জান্তব বোবা রাগে, আবার তাকে জড়িয়ে ধরে অনুতপ্ত হয়, পরমুহূর্তে তা ভুলেও যায়। হুরমতী ভরা মজলিশে ব্যভিচারের একপেষে শাস্তি নেয় পরম অবহেলায়, কিন্তু দ্বিচারিণী সমাজের চোখ কলুষ যে জীবন, তা থেকে সে বেরিয়ে আসে না। ভেসে বেড়ায় শিকড়বিহীন জলজের মতো।
এরা সবাই মচকেছে, কিন্তু কখনো ভাঙ্গে নি। মানবজনমের কাঙ্খিত প্রতিরূপ এমনই।
খলনায়ক রমজানও তো আক্ষরিক অর্থ বিবেচনায় সংশপ্তক । ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ শক্তি হয়ে ওঠা রমজানের অপ্রতিরোধ্যতার কাছে অনেক শুভশক্তিই তো পরাজিত হয়।
অনুভব করি সংশপ্তক একক কোন চরিত্র নয়, সবাই। সামষ্টিক এবং একক, দুইভাবেই।
...... তবুও কিছু কথা বলতেই হয়। শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক যেন কিছুটা শহুরে মানুষের চোখে দেখা গ্রাম। ঔপন্যাসিক চরিত্রগুলোর সাথেও সুবিচার করেন নি অনেকাংশেই। তাদের জীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তিনি আমাদের দেন নি, দিয়েছেন বিক্ষিপ্ত ছাড়া ছাড়া ছবি। তাই হুট করে বইয়ের পাতা থেকে সুপরিচিত কোন চরিত্রকে সরিয়ে দিয়েছেন এক লাইনেই, ধীর মন্থর গতিতে এগোনো কাহিনী পরম্পরাকে কয়েক পাতার ব্যবধানে বেখাপ্পা ভাবে টেনে নিয়ে গেছেন দীর্ঘপথ। অস্পষ্ট সে পথে হেঁটে পাঠক কিছুটা খেই হারাবেন। বোধকরি কিছুটা বিরক্তও হবেন। পাঠককে দোষ দেয় যায় না, কারণ এতো বৃহৎ প্রেক্ষাপটের উপন্যাসে এমন সুর কেটে দেওয়া সংক্ষিপ্ততা বিরক্তির উদ্রেক করারই কথা। তবে এমনটা ঘটার দায় যতোটা লেখকের, তারচেয়ে বেশি সম্ভবত প্রকাশকের। এর আঁচ পাওয়া যায় শুরুতে লেখকের সংক্ষিপ্ত ভুমিকাতে। তিনি সেখানে পরোক্ষভাবে অনুযোগ করেছেন বড় উপন্যাস ছাপাতে প্রকাশকদের অনীহার কথা। সেজন্যেই হয়তো মাঝেমাঝেই ছন্দপতনের সুর।
তাই কিছুটা অতৃপ্তি নিয়েই আমার কাছে শেষ হলো বাংলা সাহিত্যে ধ্রুপদী সৃষ্টির মর্যাদা পাওয়া এ উপন্যাস ।
পুরো উপন্যাস জুড়ে আমি কী যেন একটা খুজছিলাম। শেষ বাক্যের শেষ শব্দ অব্দিও উন্মুখ হয়ে ছিলাম কিসের যেন আশায়। সেটা পাইনি কোথাও এই বইতে। বই শেষ করার অনেক ঘন্টা পরে আমি বুঝতে পেরেছি, যা খুজছিলাম সেটার নাম "স্বাধীনতা"। এই বইতে কোথাও নেই সেটা। না মানুষের ব্যক্তিগত মনে, না মানচিত্রে। কারন, এটা স্বাধীনতার গল্প নয়। এটা মানুষের লড়ে যাবার গল্প। মহাযুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা যখন ভারতজুড়ে লেলিহান শিখার মত জ্বলে উঠছিল এবং তার হলকা এসে লেগেছিল অবিভক্ত বাংলায়, সেই সময়ের মানুষগ��লো কীভাবে গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছিল স্বাধীনতার দিকে তার গল্প এটি।
রাজনৈতিক যুদ্ধের কথা অত সরাসরি না বলেও যে তার উপস্থিতি, ভয়াবহতা, হাহাকারের কথা অল্প কিছু শব্দ দিয়ে সাবলীল ভাবে বুঝিয়ে দেয়া যায়, তা এই উপন্যাসটি পড়ে আবারও বুঝেছি!
এই বইটা মন ভালো করার কোনো বই নয়। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ফলাফল ও গতিহীনতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিস্তার এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সূত্রপাত - এইরকম একটা সময়কালকে ধরেছেন শহীদুল্লাহ কায়সার। উপন্যাস নামক দর্পণে সেই সময়কালের লড়াইতে নামা মানব যোদ্ধাদের প্রতিচ্ছবি দেখাতে চেয়েছেন।
উপন্যাসের শুরুতে অবিভক্ত বাংলার গ্রামীণ বর্ণনা আর ঘটনাপ্রবাহ আমাকে খুব বেশি টেনেছে। পরাধীন বাংলাদেশের একেবারে আসল চিত্রটি এত অকপটে রচনা করেছেন শহীদুল্লাহ কায়সার, যে তা প্রশংসার দাবী রাখে বললে কম বলা হবে। এরপর যখন সব বদলে গেছে পরাধীন অসহায় মানুষগুলোর জীবনে, তখন আর পড়তে ভালো লাগছিল না। কিন্তু মানব জীবন তো আসলে এমনই। হেরে যাব জেনেও লড়ে যাওয়া! আশার ভেলায় ভেসে ভেসে একটা স্বপ্নকে বাচিয়ে রাখা! আমি তো এখনও দেখি সেই অনর্থক, অপ্রয়োজনীয়, প্রাচীন বিশ্বাস ও মানসিকতা আকড়ে ধরে থাকা একটা আধা শিক্ষিত সমাজকে, যারা কেন যেন পারছেই না তাদের মনের সবগুলো দ্বার উন্মুক্ত করে তাদের ছাতা পড়া মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে। পারছে না নিজেরাও সংস্কার মুক্ত হতে আবার যারা মুক্তি নিয়ে আসার কথা বলে, তাদেরকেও সমর্থন দিতে! সংশপ্তক উপন্যাসের পট ছেড়ে তারা যেন বাস্তবে উঠে এসেছে এই একবিংশ শতাব্দিতেও।
পচন ধরা কতকগুলো মানুষের তুচ্ছ ব্যক্তিগত, জাতিগত বিশ্বাস ও লোভ লালসার বলি হয়ে গেছে শুধু একটু নিরিবিলিতে নিজের চরকায় তেল দিয়ে চলতে চাওয়া কত মানুষ। এতগুলো দশক চলে গেল, একটা শতক ও পার হয়ে গেল, শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সার; আপনার লেকু, হুরমতি, রাশুরা আজও আছে বাংলার পথে প্রান্তরে, ঘরে-বাইরে। তারা আজও অসহায়, উপেক্ষিত। সততার কোনো মূল্য নেই। রমজানদের দাপট চলছে সমাজ ও দেশজুড়ে। সেকান্দর মাস্টাররা মাঝেমধ্যে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে ওঠে, এটা কী মগের মুল্লুক নাকি? জাহেদদের রক্ত মাঝে মাঝে টগবগ করে ফুটে ওঠে, বক্তৃতায় ঝাঁঝরা হয় বাতাসের গতিবেগ। এর বেশি আর কিছু করার ক্ষমতা নেই কারও!
‘অভাগা দেশের অভাগা জনগণের জন্য কিছু করার চেষ্টা অন্তত করিয়াছি—এটাই সান্ত্বনা।’ শহীদুল্লা কায়সার অভাগা দেশ বলেছিলেন পরাধীন ভারতকে। আজও টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া সমগ্র মানচিত্রটা তেমনই অভাগা। স্বাধীনতার এত বছর পরেও অন্য রূপে মানুষেরা পরাধীন। কোথায় সেই স্বাধীনতা? একদল সংশপ্তক আবারও কী জন্ম নেবে এই বাংলায়?
সংশপ্তক উপন্যাসের কাহিনির শুরু ইংরেজ আমলের অন্তিমকালে, শেষ পাকিস্তান আমলের সূচনাপর্বে ।কাহিনির অনেকখানি স্থাপিত পূর্ববঙ্গের গ্রামাঞ্চলে,খানিকটা কলকাতা ও ঢাকায়। এর বৃহত্তর পটভূমিতে আছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ,মন্বন্তর ,পাকিস্তান আন্দোলন , সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঘটনা। এতে প্রধান্য ভাল করেছে শাখা প্রশাখাসমেত এক সৈয়দ পরিবারের কথা। তার এক সৈয়দ প্রাচীন পন্থী নান সংস্কারের সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষা ও ইংরেজের চাকরি সমন্বিত করেছেন। আরেক সৈয়দ স্ত্রী-কন্যা ফেলে নিরুদ্দেশযাত্রা করে দরবেশ হয়েছেন।
প্রথমোক্তজনের পুত্র জাহেদ আধুনিক শিক্ষা জীবন বোধ আয়ত্ত করে প্রথমে পাকিস্তান-আন্দোলন এবং বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। প্রাচীনতার সঙ্গে তার ভয়াবহ দ্বন্দ্ব। তাই পিতৃব্য যখন তাঁর এক বয়স্ক শিষ্যের সঙ্গে কন্যা রাবুর বিয়ে দিয়ে ফেলেন, তখন সে তার সমর্থদের নিয়ে নতুন বরের ওপর এমন হামলা করে যে শুধু জামাতা নন, সদলবলে শ্বশুরকেও পলায়ন করতে হয়। রাবুও এ ঘটনাকে বাড়াবাড়ি মনে করে, কিন্তু পরে-জাহেদের শিক্ষার প্রভাবে-ওই স্বামীকে স্বামিত্বের অধিকার দিতে অস্বীকার করে। কাহিনির শেষ হয় বাম রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতার কারণে জাহেদের গ্রেফতারে এবং তার প্রতি রাবুর দেহাতীত প্রেমের স্থিতিতে। সংশপ্তক শব্দের অর্থ জয় নাহয় মৃত্যু।
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!
This entire review has been hidden because of spoilers.
শহীদুল্লা কায়সার একজন বুদ্ধিজীবী এটা আমরা কমবেশি সবাই স্কুলে থাকতে সমাজ বইয়ে মুখস্থ করে আসছি। আমার মনে আছে ক্লাস সেভেন কি এইটে থাকতে কোনো এক ইংলিশ প্যাসেজে পড়েছিলাম যে শহীদুল্লা কায়সার এর সবচেয়ে জনপ্রিয় বই হলো "সারেং বৌ" আর "সংশপ্তক"। সংশপ্তক নামটা তখনই মনে দাগ কেটেছিল অথচ তখন এর অর্থই জানতাম না।
“মন যখন কচি, বুদ্ধিটা যখন স্বার্থবোধে অপরিণত, হাত জোড়া নরম–বিপন্নের সাহায্য তো দূরের কথা, নিজের জন্যও বুঝি বিশেষ কাজে আসে না সে হাত; অথচ বুকে আকুলতা জাগে অন্যের দুঃখে, ঠিক সেই বয়স ওদের।” I love novels with poetic narratives and this beautiful, almost poetic line was used to explain Malu and Rashu's age. There are many other phrases I love from the book, but I adore this particular one a lot because the author has put so much thought into this single line, only to explain someone's age! And it truly impressed me.
A very thought-provoking novel that explores many themes through a lot of characters but doesn't get too overwhelming. Very easy to follow and keeps you engaged. The story is about the struggle and determination to continue to live in a world that seems unbearable to live in with all the injustice and obstacles faced every day. The characters persevere even when life seems to close all the doors for them. They try to bring positive change in society but the world always seems to favor the wicked ones. It shows the sacrifices of people who are like you and me, simple yet full of complications, fighting just to survive, one day at a time.
বইয়ের নামটা কেনো সংশপ্তক সেটা বইটা পড়তে পড়তেই বুঝা যায়। আমার কাছে সংশপ্তক শব্দটা শুরু থেকেই ভালো লাগতো, এখন গল্পটা শেষ করার পর, গল্পের মর্ম বুঝার পর নামটা আরো বেশি ভালো লাগে। বইটা পড়তেই পড়তেই খেয়াল হয়, আসলে আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জীবনে একেকজন "সংশপ্তক"...
"আমাদের সুখ-দুঃখের গণ্ডীটাও বড় ক্ষুদ্র। সেই ক্ষুদ্র জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা দিয়েই বিচার করতে চাই এতবড় দুনিয়াটাকে। তাই এত বিড়ম্বনা পায়ে পায়ে। না পারি নিজেকে যাচাই করতেম না পারি অপরকে বুঝতে।"
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে চক্রব্যূহে অভিমন্যু যখন কৌরবপক্ষীয় সপ্তরথী দ্বারা আক্রান্ত হোন, তখন অর্জুনকে আটকে রাখার দায়িত্ব ছিল সংশপ্তক বাহিনীর। সংশপ্তক, যে যোদ্ধা শপথ নেয় যুদ্ধে বিজয়ী না হলে মৃত্যু বরণ করবে। এই যে আমরা 'মানুষেরা' প্রত্যেকেই প্রতিমুহূর্তে জীবন আর মৃত্যুর এক চিলতে ছোট্ট করিডরে দাঁড়িয়ে নিয়ত সংগ্রাম করে যাই, আমরা ও কি সংশপ্তক নই?? সংশপ্তক বিগত যুগের কাহিনী। সংশপ্তক এ যুগের দর্পন৷ সংশপ্তক ভাবী যুগের কল্লোল।
দেশভাগের পর স্বাধীনতাত্তোর যুগে স্বাধিকার চেতনা ও জাতীয়াবাদ প্রবলভাবে নাড়া দেয় দেশের জনমানসে। তার ঢেউ আছড়ে পড়ে সাহিত্যাঙ্গণেও। সেইসময়ের সাড়াজাগানো একটি ধ্রুপদ সৃষ্টি "সংশপ্তক"। এর সুবিশাল ক্যানভাসে ধ্বনিত হয়েছে বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, ভারত ভাগের জটিল সময়ে বেড়ে ওঠা মানবচরিত্রের চাওয়া- না পাওয়া আর অনবরত জীবন সংগ্রামের গাঁথা।
বাকুলিয়া আর তালতলি মেঘনা নদীর তীরবর্তী দুটো গ্রাম, প্রথমোক্তটি মুসলিম অধ্যুষিত, শেষটি হিন্দু। এই দুটো গ্রামের নিখাঁদ গ্রামীণ জীবন নিয়ে সংশপ্তকের সূচনা। অবশ্য এ জীবন নিস্তরঙ্গ না। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের অশান্ত সময়ের ঝড়ো হাওয়া একটু একটু করে জোড়ালো হচ্ছিল এই অজপাঁড়া গাঁয়ে। উপন্যাসের শুরুতেই এক গ্রাম্য সালিসের মাধ্যমে যুক্তি আর রক্ষণশীলতাকে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে পাঠককে এই লেখার সুরের সাথে পরিচিত করিয়েছেন লেখক।
বৃহৎ কলেবরের উপন্যাসটিতে চরিত্রের সংখ্যা অনেক। একদম শুরুতেই উপন্যাসের প্রতিনায়ক রমজানকে দেখা যায়। যার আত্মপ্রতিষ্ঠাতার লোভের আগুনে পুড়েছে উপন্যাসের প্রায় প্রতিটি চরিত্রই৷ সে বাকুলিয়া গ্রামের মোড়ল ফেলু মিঞার সাগরেদ। ফেলু মিঞা মোহান্ধ, মিঞা বাড়ি অতীত সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে মশগুল। সেকান্দার মাস্টার, লেকু, হুরমতি এরা সবাই প্রচলিত রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে রুখে দিতে চাই৷ বাকুলিয়ার দুই সম্ভ্রান্ত ঘরের একটি মিঞা বাড়ি আরেকটি সৈয়দ বাড়ি। এই সৈয়দ বাড়ির বড়জন ধর্ম ও অধর্ম ছলে বলে কৌশলে দুই নৌকাতেই একসাথে পা দিয়ে চলে৷ তার ছেলে জাহেদ শুরুতে পাকিস্তানপন্থী আন্দোলন করলেও পরে কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। তাই পিতার চোখে অপাংক্তেয়। ছোটজন আবার পীরের মুরিদ ও বদরাগী। নিজের মেয়েকে ৮০ বছর বয়সী পীরের সাথে বিয়ে দিতে তার দ্বিমত নেই। এই বাড়িতে আশ্রিত থেকেই উপন্যাসের নায়ক আবদুল মালেকের (মালু) বেড়ে ওঠা। উপন্যাসের শুরুর অবশ্য ছোট মালুর ভূমিকা ছিল সীমিত। তার চোখে তখন অনাবিল কৌতুহল। হুট করে সৈয়দ কন্যা আরিফা আপা, রাবু আপার হুট বড় হয়ে যাওয়ার কৌতুহল, রাশুর হঠাৎ পরিবর্তনের কৌতুহল, তালতলির স্কুলের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ আর রাণুদির গানে, কথায়, আদরে। মূলত গ্রামীণ রাজনীতিই ছিল সেসময় উপন্যাসের ইঞ্জিনের জ্বালানি। কিন্তু যুদ্ধ ও আর দুর্ভিক্ষ দ্রুতই পাল্টে দেয় গ্রামের চেহারা। সৈয়দরা কলকাতা শহরে পালায়, যুদ্ধের জমি অধিগ্রহনের সেনাবাহিনী দখল করে নেয় ফেলু মিঞার সাধের জমিদারী, রমজানের মতো ধূর্তরা হয়ে ধনী। শিকড়চ্যুত মালু প্রথমে ভিড়ে গানের দলে পরে সেও পাড়ি জমায় আনন্দনগর কলকাতায়।
"মৃত্যুর শেষ মৃত্যুই। মৃত্যুর শেষ জীবন, সে কদাচিৎ। কেননা জীবনের জন্য মৃত্যুটা দুলর্ভ।" সময়টা ১৯৪৬ এর আগস্ট। আনন্দনগরীর রাজপথ দখল করে নিয়েছে মৃত্যুর বিভীষিকা। প্রাণ দেখলেই তাকে তাড়া করে সেই মৃত্যু। কোথাও হিন্দু মরে, কোথাও মুসলিম, দিনশেষে অবশ্য মানুষই মরে। মালুকেও তাড়া করেছিল। তবে শচীন বাবু আর তালতলির অশোকদা ছিল তার ছায়া হয়ে। অল্প ক'দিনের মধ্যেই কলকাতা আর বাকুলিয়া হয়ে পড়ে দুটো আলাদা দেশের অংশ। মালু ঠিকানা খুঁজে নেয় নতুন এক শহর ঢাকায়। শুধু মালু নয় সৈয়দরা ঠিকানা নেয় নতুন শহরে। অবশ্য ঢাকা নাগরিক বাস্তবতা ছিঁড়েখুঁড়ে খায় মালুর শৈল্পিক সত্ত্বাকে। মালু ফিরে আসে বাকুলিয়ায়। ততদিনে তালতলির হিন্দুরা দেশ ছেড়েছে। হারিয়ে গিয়েছে বাকুলিয়ার অনেকেই কিন্তু যারা টিকে আছে তাঁরা লড়ে যায় সংশপ্তকের মতোই। হয় মৃত্যু বা জয়! তাই তো শেষ দৃশ্যে জাহেদ দৃপ্তকন্ঠে বলে, 'আমি ফিরে আসবো'।
"এক ধারায় নয়, বহু ধারায় প্রবাহিত মানুষের জীবন। যদি শুকিয়ে যায়, যদি রুদ্ধ হয় একটি ধারা, আরেক ধারায় জীবন বয়ে চলে সার্থকতার পানে। এটাই জীবনের ধর্ম" "মৃত্যুর জন্য জীবন কখনো অপেক্ষা করে না, মৃত্যুর পাশাপাশিই জীবনের অস্তিত্ব"
আজগুবি এক উপন্যাস। পড়তে পড়তে কখন কখন বিরক্তি চলে এসেছিল। প্রথমে ভাবলাম আবাহমান বাংলার চিত্র, তারপর দেখলাম মুসলাম সমাজের কুসংস্কার, মাইজভান্ডারির বর্বতা আর মূর্খতা, আবার মুসলমানদের সংস্কৃতির তথা গানের সাথে নব পরিচয়, পরক্ষনেই আবার হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা, দেশভাগ, বিপ্লবী, আবার প্রেম ভালবাসা, ভালাবাসার তিক্ততা, শেষে ভিটেমাটির স্মৃতি। শেষের দিকে পড়তে ভাল লেগেছিল। লেখক এক বিশাল তাবত জীবনের কাহিনী চিত্রিত করেছেন, আলোকপাত করেছেন জীবনের হাসি কান্না নিয়ে সব দিক নিয়ে কিন্তু কোন জিনিস বা কাহিনী পট গুছিয়ে আনতে পারেনি। তারপর ও বলব সুন্দর উপন্যাস৷