Jump to ratings and reviews
Rate this book

দেশভাগ ##১

নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে

Rate this book
দেশভাগ নিয়ে ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে' সিরিজের চারটি পর্ব। প্রথম পর্ব ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে', দ্বিতীয় পর্ব ‘মানুষের ঘরবাড়ি’, তৃতীয় পর্ব ‘অলৌকিক জলযান’, চতুর্থ পর্ব ‘ঈশ্বরের বাগান'। কিংবদন্তী তুল্য উপন্যাস ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ সম্পর্কে অগ্রজ সাহিত্যিক বিমল কর লিখেছেন, ‘অতীনের সেরা লেখা, এর মধ্যে অতীনের সত্তা ডুবে আছে, আমরা যাকে বলি ভর পাওয়া লেখা । ‘পুতুলনাচের ইতিকথার পর এতটা আর অভিভূত হইনি'—অশোক মিত্র। ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে এই সময়ের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস'—শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে এই সময়ের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস’–সমরেশ মজুমদার। সমকালের আর এক বিশিষ্ট সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ লিখেছিলেন—দুই বাংলার সাহিত্যিক ঐতিহ্যের ঐক্যে বিশ্বাসী বলে আমার জানাতে দ্বিধা নেই যে, অতীনের এই রচনা এযাবৎকালের নজিরের বাইরে। ভাবতে গর্ব অনুভব করছি যে, আমার সমকালে এই তাজা তেজস্বী খাঁটি লেখকের আবির্ভাব ঘটেছে। আজ হয়ত তিনি নিঃসঙ্গ যাত্রী। কিন্তু বিশ্বাস করি, একদা আমাদের বংশধরগণ তাঁর নিঃসঙ্গ যন্ত্ৰণা অনুভব করে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে তিরস্কার বর্ষণ করবে। ‘পথের পাঁচালীর' পর এই হচ্ছে দ্বিতীয় উপন্যাস যা বাংলা সাহিত্যের মূল সুরকে অনুসরণ করেছে।' পাঠিকা ঝর্ণা নাগ শিবপুর থেকে লিখেছিলেন—‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে' পড়ে আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। ঈশ্বরের সৃষ্ট সুন্দর পৃথিবী দেখে মুগ্ধ হয়ে যেমন তার সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে কৌতুক বিস্ময় জাগে এও তেমনি।' এমন অজস্র চিঠি এবং সাহিত্যঋণের কথা স্বীকার করা হয়েছে অন্য তিনটি পর্ব ‘মানুষের ঘরবাড়ি’, ‘অলৌকিক জলযান’ এবং ‘ঈশ্বরের বাগান' সম্পর্কেও। বিদগ্ধ এবং গুণী ব্যক্তিরা লিখেছেন, ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে' যদি মহৎ উপন্যাস, ‘অলৌকিক জলযান' তবে মহাকাব্য বিশেষ—আর ‘মানুষের ঘরবাড়ি সোনার কিশোর জীবনের অবিনাশী আখ্যান। শেষ পর্ব ‘ঈশ্বরের বাগান’–এতে আছে দেশভাগ জনিত উদ্বাস্তু পরিবারটির সংগ্রামী বিষয়, অভিনব চরিতমালা এবং পটভূমি সহ জীবনের রোমাঞ্চকর অভিযানের লৌকিক-অলৌকিক উপলব্ধি পুষ্টি খণ্ডিত বঙ্গের অখণ্ড বর্ণমালা।

412 pages, Hardcover

First published April 1, 1971

61 people are currently reading
725 people want to read

About the author

Atin Bandyopadhyay

80 books27 followers
Atin Bandyopadhyay (Bangla: অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়; anglicised spelling of surname: Banerjee) is a noted writer of Bengali literature. He was born in 1934 in Rainadi, Dhaka.

He spent his childhood in a joint family set-up in the then East Bengal of undivided India and studied in Sonar Gaon Panam School. After the Partition, migrated to India. He earned his undergraduate degree in commerce in 1956 and subsequently earned a teacher's training degree, all from the University of Calcutta. He took various jobs as a sailor, truck-cleaner, primary school teacher. Also became headmaster of a senior basic school. Settled permanently in Kolkata in 1963. Here also he took on various jobs like factory manager, publication advisor and lastly journalist.

The first story of the author was published in the magazine Abasar of Berhampore. He has penned many works since then, but his masterpiece is a three-part trilogy on the Partition: Nilkantha Pakhir Khonje (নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে), Aloukik Jalajan (অলৌকিক জলযান) and Ishwarer Bagan (ঈশ্বরের বাগান). Another famous writer of Bengal, Syed Mustafa Siraj has compared Nilkantha Pakhir Khonje (নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে) with Greek tragedies and also found it tuned with the core spirit with the Bangla literature like Bibhutibhushan Bandyopadhyay's Pather Panchali.

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
159 (60%)
4 stars
62 (23%)
3 stars
28 (10%)
2 stars
12 (4%)
1 star
4 (1%)
Displaying 1 - 30 of 56 reviews
Profile Image for Daina Chakma.
440 reviews772 followers
January 15, 2019
“জ্যাঠামশাই, আমরা হিন্দুস্থানে চলিয়া গিয়াছি, ইতি সোনা।"
দেশ ছাড়ার আগে নিরুদ্দিষ্ট জ্যাঠামশাইয়ের জন্য অর্জুন গাছের কান্ডে ধারালো ছুরির খোঁচায় সোনা তাদের ঠিকানা লিখে গিয়েছে।

পাগল জ্যাঠামশাইয়ের জন্য সোনার ভালোবাসা প্রকাশের মধ্যে ফুটে উঠেছে দেশ ছাড়ার তীব্র যাতনা। অথচ সোনার শিশুমন কেবল রক্তের সম্পর্কের জ্যাঠামশাইকে ছেড়ে যাবার কষ্টে বিদির্ণ হয়নি। অনাত্মীয় মুসলিম মেয়ে ফতিমার জন্য তার মন কেমন করেছিল। ইশম শেখকে ছেড়ে যাবার বোবা শোক সোনাকে খুবলে খেয়েছিল!

এই গোটা ভারতবর্ষটা নাকি আমাদের দেশ হবার কথা ছিল। রবিবাবুর উপর আমাদের একচ্ছত্র অধিকার থাকার কথা ছিল। অথচ আত্মার খুব কাছের সত্যজিৎ কে আমরা চিনি পশ্চিমবঙ্গের একজন হিসেবে। কলেজ স্ট্রীট ধরে হেঁটে বেড়ানো তারাশঙ্কর, মানিক একান্ত আমাদের হতে গিয়েও হলোনা। চন্দ্রবিন্দু কিংবা মহীনের ঘোড়াগুলির গান শুনতে ভাষার কোনো ব্যবধান নেই। তবু ওরা ওপার বাংলার। শিল্প-সাহিত্যের কোনো সীমারেখা নেই জানি। তবে চিনচিনে একটা বোধ খোঁচা দিয়ে যায় কেন?!

নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে বইয়ের মূল উপজীব্য দেশভাগ। সম্ভ্রান্ত এক ব্রাহ্মন ঠাকুর পরিবারের দৈনন্দিন জীবনকে ঘিরে উপন্যাসের কাহিনী সাজানো। "সোনার দ্যাশে" প্রবল দাপটের সাথে তারা জীবন কাটিয়ে গেছে। অভাব ছিলনা কোনো কিছুরই। অথচ দেশভাগের পর বাংলাদেশ ছেড়ে হিন্দুস্তান চলে গেলে তারাই হয়ে উঠে পরজীবি। আমাকে দেশ ছাড়তে হয়নি। তবু সোনার কষ্টের মধ্য দিয়ে দেশ ছাড়ার যন্ত্রণা মর্মে মর্মে টের পাই!

‘ …এতগুলো শতাব্দী গড়িয়ে গেল, মানুষ তবু ছেলেমানুষ রয়ে গেল
কিছুতেই বড় হতে চায় না
এখনো বুঝলো না ‘আকাশ’ শব্দটার মানে
চট্টগ্রাম বা বাঁকুড়া জেলার আকাশ নয়
মানুষ শব্দটাতে কোন কাঁটাতারের বেড়া নেই।'


যে সামু মুসলিমদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন করেছে সে সামুই আবার হিন্দু মেয়ে মালতীকে স্মরণ করে শোকে কাতর হয়। গ্রামের মেলায় হিন্দু এক মেয়েকে অসম্মান করতে গিয়ে ধরা পড়ে একজন মুসলমান যুবক। আর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রীতিমতো দাঙ্গা বেঁধে যায়। এখানে সবকিছুকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠে ঠাকুরবাড়ির প্রতি ঈশম শেখের আনুগত্য। সোনাকে মেলায় হারিয়ে ফেলে পাগলপ্রায় হয়ে যায় ঈশম। শিশুকাল ফেলে এসে বড় হয়েও ফতিমা ভুলতে পারেনা সোনাবাবুকে। অথচ এতকিছুর পরেও মানু্ষের মাঝে ধর্ম বিশাল এক দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে!

এবার বরং উপন্যাসের খারাপ লাগা দিকগুলো তুলে ধরি।

সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের মতে- " পথের পাঁচালীর পর এই হচ্ছে দ্বিতীয় উপন্যাস যা বাঙলা সাহিত্যের মূল সুরকে অনুসরণ করেছে।" তুলনা করার জন্য যখন পথের পাঁচালীকে টেনে আনা হয় তখন প্রত্যাশাটা গিয়ে দাঁড়ায় আকাশের কাছাকাছি। অথচ নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে সেই প্রত্যাশা মেটায় না। বরং অপ্রয়োজনীয় বর্ণনার আধিক্য বারংবার বিরক্তির উদ্রেক ঘটায়। আমি খুবই দ্রুতগতির পাঠক। বিরক্তির ঠ্যালায় এই বই পড়তে সময় লাগিয়েছি প্রায় দুই মাস! আর বিভূতিবাবুর বর্ণনা পড়তে গেলে বই ফেলে উঠতে ইচ্ছে করেনা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো গিলতে ইচ্ছে করে শুধু! আরেকটা ব্যাপার হলো এই উপন্যাসে কোনো শক্তিশালী চরিত্র নেই। কোনো প্রধান চরিত্র নেই। সবাই ছোটখাটো চরিত্র। গল্পের প্রয়োজনে এসেছে। না এলেও খুব একটা ক্ষতি ছিলনা। ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করে ঘটনা আগালেও কোনো চরিত্র মনে দাগ কাটেনি৷ ঘুরেফিরে সোনার কথা উঠে এলেও মনে হয়নি সোনা এই উপন্যাসের মূল চরিত্র। সবচেয়ে হতাশার ব্যাপার হলো মূল উপজীব্য দেশভাগ হলেও একদম শেষের কয়েক পাতা ছাড়া লেখক এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কিছু লিখেননি।

কিঞ্চিত হতাশা নিয়েই জানতে চাই, এতো দুর্বলতা নিয়ে এই উপন্যাস সাহিত্যজগৎ তোলপাড় করলো কিভাবে??
Profile Image for Shotabdi.
818 reviews193 followers
March 31, 2023
দেশভাগ নিয়ে রচিত এই বিখ্যাত সিরিজটি যে আমার এতদিন ধরে পড়া হচ্ছিল না সেই অপরাধবোধ থেকেই নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে শুরু করেছিলাম। অন্তত প্রথম উপন্যাসটি তো পড়া হল এই মাসে৷ এটা একটা অর্জন নি:সন্দেহে৷
আসলে ভেবেছিলাম কিনে পড়ব৷ অরিজিনাল ৪টি বইয়ের এখন যে দাম দাঁড়িয়েছে তাতে কবে কিনে উঠতে পারব সে নিয়ে সংশয়, তাই পিডিএফই পড়লাম আপাতত। যদি কখনো কোন চিন্তা ছাড়া যেমন ইচ্ছে বই কেনার সামর্থ্য উপরওয়ালা আমাকে দান করেন, তখন কালেকশনে তুলব, এই ইচ্ছা।
এই বইটি বিখ্যাত খুব, কারো কারো মতে দেশভাগের উপর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এই বইটি লিখে আর কোন কিছু না লিখলেও চিরস্মরণীয় হয়ে রইতেন৷
একটা সার্থক উপন্যাস আসলে একটা সময়ের আয়না। লেখক যখন সম্পূর্ণ নিস্পৃহ হয়ে কোন হৃদয়বিদারক ঘটনা নিয়ে উপন্যাস লিখতে বসেন, তখনই এমন একমেবাদ্বিতীয়ম সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয়৷
দেশভাগের মতো একটা ঘটনার চেয়ে আরো বেশি দু:খজনক কোন কিছু কি হতে পারে? মানুষ তার মাটিকে ভালোবাসে, মায়ের পরেই স্থান দেয় ভিটেকে, তার ফসলের জমিকে। কারণ মায়ের মতোই স্নেহচ্ছায়া আর খাদ্য যোগায় সেই পবিত্র ভূমি। ছোটবেলা থেকে সমস্ত স্মৃতি আর সংস্কৃতি নিয়ে বড় হওয়া কতগুলো মানুষকে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে বলা হল তুমি চলে যাও এই জায়গা ছেড়ে, এই দেশ তোমার না। কতটা মর্মান্তিক ছিল বিষয়টা তা আমরা অনুধাবনও বোধহয় করতে পারি না ঠিকমতো।
লেখকের আশ্চর্য মুন্সিয়ানা হিন্দু-মুসলিম দুই তরফেরই মনের ভাব সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলায়। মায়া আর নিষ্ঠুরতার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ তিনি ঘটিয়েছেন। কল্পনার কোন সাগরে পাঠকদের ভাসিয়ে দেননি৷ অনুভব করতে দিয়েছেন বাস্তবতাটা। তাই ফেলু শেখ আর পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথ দুজনের দু:খেই, দুজনের পরিণতিতেই পাঠক বিচলিত হয়।
বিচলিত হয় হিন্দু বিধবা মালতীর জীবনের করুণ সব মোড়ে, বিচলিত হয় নির্বিবাদী, তরমুজ ক্ষেতে পড়ে থাকা, ঠাকুর বাড়ির মুনিষ ঈশম শেখের পরিণতিতে।
দেশভাগ-ভাষা আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার পাশাপাশি লেখক ছুঁয়ে গেছেন ব্যক্তিগত জীবনের চাওয়াপাওয়াগুলোকেও। যৌনতা, ঈর্ষা, দৈনন্দিন জীবন, গাঁয়ের শীত-বর্ষা, প্রেম কোন কিছুই অতিরঞ্জিত নয়। যেন পরিমিত, ঠিকঠাক তার জায়গায় সব।
ক্লাসিক একটি উপন্যাস শেষ করার অনুভূতি সবসময়ই তৃপ্তিদায়ক। আর এমন উপন্যাস একই সাথে বেদনাতুর করে রাখে হৃদয়।
Profile Image for Mahmudur Rahman.
Author 13 books356 followers
June 26, 2019
দুধ-সাদা জোছনায় নদীর তীরে হাঁটার অভিজ্ঞতা কেমন? কিংবা তপ্ত রোদের মাঝে সোনারঙা ফসলের মাঠের দিকে চেয়ে থাকলে কেমন লাগে? চিতার আগুণ কি কখনও জীবিত ব্যক্তিকে পোড়ায়?

কিছু কিছু লেখা থাকে যেগুলো পড়লে মনে হয় তুষার ধবল জোছনায় হাওয়ায় ভেসে চলেছি। পর মুহূর্তেই মনে হয় একটা ধারালো ছুরি দিয়ে হৃৎপিণ্ডটা কেউ ফালা ফালা করে কাটছে। কোথায় যেন তীব্র দহন চলে। আবার মুহূর্তে শীতল করে দেয়। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ তেমনই একটা বই।

সময়টা বহু আগে। প্রা���় শ’ খানেক বছর আগে। আমাদের এই বর্তমান ব্যস্ত রাজধানী থেকে খানিক দূরে কোথাও রাইনাদি গ্রাম। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানায়। সেখানেই বহু বছর আগে কেমন ছিল জীবন। সেখানকার মানুষেরা? তাদের সুখ দুঃখ, বেঁচে থাকা। সে সব কিছুই উঠে এসেছে লেখকের কলমের আঁচড়ে, মায়াবী বর্ণনায়।

ঠাকুরবাড়ির ধনবৌর ছেলে হওয়ার কথা দিয়ে সে আখ্যান শুরু হয়। খবর নিয়ে যায় ঈশম, ধনকর্তার কাছে। নদীর তীরে বালির জমিতে তরমুজ ফলায় ঈশম। ঠাকুরবাড়ির বাঁধা মানুষ। যে বাড়ির বড় ছেলে মনীন্দ্রনাথ এক অদ্ভুত পাগল মানুষ। বিদ্বান, জ্ঞানী, মরমী সে মানুষ ভালবেসেছিলেন এক ইংরেজ মেয়েকে। সাত্ত্বিক পিতা তা মেনে নেননি। মিথ্যা খবর দিয়ে আনিয়ে ছেলেকে বিয়ে দিলে সে এক নির্বিবাদী, নির্বাক মানুষে পরিণত হয়।

সে বাড়ির ছেলে সোনা। ভালো নাম অতীশ দীপঙ্কর। সোনার জন্মের খবর নিয়েই ঈশম ছুটেছিল। মনীন্দ্রনাথের মতো চেহারা সোনার, স্বভাবটাও যেন তার মতো। মাঠে ঘাটে ছুটে বেড়ানো। জ্যাঠার সঙ্গে সেই তার এক কাজ। যেন প্রকৃতির কতো কাছের মানুষ তাঁরা, প্রকৃতির সন্তান। এলাকার মানুষ যেমন পছন্দ করে পাগল মানুষটাকে, তেমনি সোনাকে।

সে গ্রামেই বসবাস জোটনের। তিন তিনবার বিয়ে এবং তালাক পাওয়া জোটন তেরো সন্তানের জননী। তবু তার শরীরের খিদে। সেই সঙ্গে বিশ্বাস, যতদিন শারীরিক সক্ষমতা থাকে, ততদিন সন্তান ধারনই আল্লাহ্‌র ইচ্ছা। তাই এবার তার আশা এক ফকির সাবের সঙ্গে তার নিকা হবে। বয়স হলেও ফকির সাহেব সমর্থ পুরুষ।

জোটন যখন এতোসব ভাবে, তখন নরেন দাসের বোন মালতী এসেছে বিধবা হয়ে। রূপের ডালি সাজানো তার মুখে, শরীরে। কিন্তু হিন্দুর বিধবা, যৌবন পার করতে হবে তার এভাবেই। অথচ এই মালতীর সঙ্গে এক সময় মাঠে মাঠে ছুটে বেরিয়েছে সামু, শামসুদ্দিন। যে কিনা এখন মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ইস্তাহার ঝুলিয়ে বেড়ায়। মালতীকে দেখে সামুর বুকে কষ্ট হয়। আর মালতী মনে মনে রঞ্জিতের কথা ভাবে। ঠাকুরবাড়ির বড় বৌর ভাই রঞ্জিত। দেশের কাজ করে সে।

সময় বদলে যাচ্ছিলো খুব দ্রুত। সেই সঙ্গে বদলে যাচ্ছিলো মানুষেরা। কখনও সে বদল দ্রুত, কখনও ধীর। আর সেই বদল আসার আগ পর্যন্ত গ্রামের জীবন চলে বহু পুরনো নিয়মে। সেখানে লেগে থাকে অভাব, অনাহার। তাই জালালিকে বিলে ডুবে শালুক খুঁজতে হয়। আর সে শালুক খুঁজতে গিয়ে মারা যায় সে জলে ডুবে। বিস্তীর্ণ বিলে ডুবে সে মৃতদেহ উদ্ধার করে মনীন্দ্রনাথ। কাঁধে করে নিয়ে যায় যেন গ্রীক পুরাণের কোন দেবতা। তেমনই তাকে মনে করে সকলে। তিনি কোন পীর, কিংবা মনুষ্যকুলে জন্ম নেওয়া দেবতা।

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এভাবেই সাজিয়েছেন তার ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’-র চরিত্রদের। তাদের ঘিরে চলে নানা ঘটনাপ্রবাহ। একটা সময়ের চিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন এসব চরিত্র এবং তাদের গল্পের মাধ্যমে। কিন্তু সে গল্প পুরোপুরি গল্প নয়। বাস্তব। কিন্তু সে বাস্তবকে বুঝতে হলে আমাদের এখন থেকে সত্তর আশি বছর পূর্বের সময়টাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। পূর্ব ধারণা না থাকলে এ গল্প বুঝতে, প্রবেশ করতে কষ্ট হবে।

‘গুডরিডস’-এ এ বই সম্পর্কে পাঠকের মতামত দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম যে প্রায় অনেকেই বলছেন, ‘বইটা অনেক স্লো’। ‘দেশভাগ নিয়ে বই বলা হলেও শেষদিকে বাদে দেশভাগ নিয়ে কিছু নাই’। ‘লেখক অকারণ প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছেন’ ইত্যাদি।

‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ বইয়ে লেখক কোন চরিত্রকে ‘মূল চরিত্র’ বা নায়ক করে রাখেননি। এ উপন্যাসে সময় আর প্রকৃতিই নায়ক। চরিত্রগুলো কেবল সে সময় আর প্রকৃতিকে তুলে ধরে। এ কারনেই পাগল মানুষ, ঈশম কিংবা সোনা, কাউকেই আমরা একচ্ছত্র নায়ক হিসেবে দেখি না। মূলত অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় সে সময়ের বাংলাদেশ, বাংলার মানুষের গল্প বলেছেন। আর এই দেশের, যে অঞ্চলের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন সেখানকার প্রকৃতির কথাও বলেছেন। কেননা প্রকৃতি ছাড়া দেশ যে অপূর্ণ।

এ বই দেশভাগ নিয়েই রচিত কিন্তু দেশভাগ মানেই যে দাঙ্গা, গান্ধী জিন্না বিতর্ক, আর শরণার্থী নিয়ে জল ঘোলা করতে হবে, তা নয়। দেশভাগ কীভাবে একটা ছোট গ্রামের উপর প্রভাব ফেলেছিল সে কথা পাওয়া যায় এই বই থেকে। এবং তা এসেছিল ধীরে। মন্দিরের পাশে গরু জবাই নিয়ে সংঘর্ষ, মণীন্দ্রনাথের প্রতি ফেলুর আক্রোশ সে সময়ের কথাই আমাদের বলে। যে ভাঙ্গনটা এসেছিল, তা ধীরে ধীরেই এসেছিল। কেমন করে এসেছিল, সে কথা একদম এড়িয়ে যাননি অতীন। এমনকি বিভাগ-পূর্ব সময়ে যে সামাজিক অবক্ষয়ের কথা মিহির সেনগুপ্ত লিখেছেন ‘বিষাদবৃক্ষ’ বইয়ে, সে চিত্রও পাওয়া যায় ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ উপন্যাসে।

উপন্যাসের গতী ধীর। তবে এমন উপন্যাস ধীর হওয়াই স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে উপন্যাসটি যথেষ্ট জটিল। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার ধরন একেকবারেই আলাদা, নিজস্ব। সেক্ষেত্রে বর্ণনার ধরতাইটা সহজ নয়। তা ছাড়া এ গল্প, গল্পের মানুষ, তাদের জীবনাচরণ এখন থেকে বহু আগের। তাই যে সকল পাঠকের ‘ক্লাসিক’ পড়ার অভ্যাস নেই, তাদের জন্য ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ পড়া পীড়ার বিষয় হতেই পারে।

কিন্তু বাংলা সাহিত্যে এ উপন্যাস এক অনন্য সংযোজন। প্রকৃতির বর্ণনা, প্রেম, সময়ের কথা, ধর্মের কথা, রাজনীতির কথা সব মিলে এ আখ্যান এক অনন্য আখ্যান। মানুষের স্বাভাবিক জীবনের কথার সঙ্গে উঠে এসেছে আধ্যাত্মিকতা। কখনও কখনও একটা সাধারণ বর্ণনাকে লেখক নিয়ে গেছেন ম্যাজিক রিয়ালিজমের পর্যায়ে। সব মিলিয়ে এ উপন্যাসের গল্পগুলো এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমরা কখনও মনে মনে হাসি, কখনও গুমরে কাঁদি, কখনও চিৎকার করে উঠতে বাধ্য হই।

মূলত নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজ, আসলে কোন পাখি দেস্খার খোঁজ নয়। ‘পথের পাঁচালী’-র অপু তার বাবার সাথে পাখি দেখতে বেড়িয়েছিল ঠিক, কিন্তু অতীন বাড়ুজ্জের উপন্যাসের মণীন্দ্রনাথ, সোনা যে নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজ করে বেড়ায়, তা আসলে খুঁজে বেড়াই আমরা সবাই। সে পাখি বাস করে আমাদের পরাণের গহীনে। যেখানে আমাদের পরম সুখ। সে পরম সুখের খোঁজ আমরা পাই না, কেবল খুঁজে বেড়াই। খোঁজে জোটন, খোঁজে মালতী, খুঁজে ফেরে লম্পট ফেলুও। ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র পরিবার আর জৈবিক চাহিদা ছাড়িয়ে সে পাখির খোঁজ আমাদের চলতে থাকে জীবনভর।
Profile Image for Emtiaj.
237 reviews86 followers
February 26, 2015
ছোট্টকালে শুনতাম, বাংলাদেশটা অনেক বড় হওয়ার কথা ছিলো। ইংরেজদের কারণে আমরা পিচ্চি একটা দেশ পেয়েছি। বড় কিছুর কত স্বপ্ন আমার। মনে হতো, আমি যদি রাশার নাগরিক হতাম অথবা বাংলাদেশটা যদি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ হতো।

বড় হলাম, বুঝলাম বড় মানেই সব না। মনে হতো, ওখানে সংস্কৃতির কতো কিছু। নিজেরটাকে যেন কিছুই মনে হতো না :( কিন্তু বুঝে গেলাম, আমি বাংলাদেশের মানুষ হয়ে কি পশ্চিমবঙ্গের বই পড়তে পারছিনা? মুভি দেখতে পারছিনা? গান শুনতে পারছিনা? সবই পারছি।

কিন্তু অনেক মানুষের দুঃখ মুছে দিতে পারছিনা। সোনার ঈশম, ফতিমাকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট ভুলিয়ে দিতে পারছিনা, মাথা উঁচু করে বাঁচবে বলে নিজের বাড়ী ছেড়ে চলে যাওয়ার দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারছিনা। এই দেশে থাকলে মুসলমান হয়ে যেতে হবে, ওইখানে গঙ্গার পাড়ে মরেও সুখ, কত দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে এই কথা বলতে পারে একজন?! অথবা সামসুর কথা, যে কিনা পাকিস্তানের পক্ষে আন্দোলন করেছে, আর ’৪৮ এই মোহভঙ্গ হয়ে গেল, ভাষার প্রশ্নে।

উপন্যাসের কিছু কিছু কথা/উক্তি মনে করিয়ে দেয়, কতটা খারাপ ছিলো ওইসময়ের মানুষগুলো।

“হিন্দুরা আমাগো দ্যাখলে ছ্যাপ ফালায়, আমরা-অ ছ্যাপ ফালাম���”

“পরাপরদীর বাজারে সব মুসলমানরা এককাট্টা। অরা ঠিক করছে হিন্দুগ দোকান থাইকা আর কিছু কিনবনা”

"দু’চার বিঘা জমি বাদে, সব জমি কার?
-হিন্দুর।
ভূমিহীন কারা?
-আমরা।
উকিল বলুন, ডাক্তার বলুন কারা?
-হিন্দুরা।
শিক্ষা-দীক্ষা কাদের জন্য?
-হিন্দুর জন্য।
ওদের জমিতে খাটলে আপনি খান, আপনার নাম মুসলমান।"

উপন্যাসের দাঙ্গার ব্যাপারটা চমৎকারভাবে দেখানো হয়েছে। মেলায় একজন মেয়েকে অসম্মান করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার পর তাকে উদ্ধার করতে না পেরে দাঙ্গা বেঁধে গেলো। কেননা সে মুসলমান, আর মেয়েটা হিন্দু। অথবা একটা স্থাপনাকে কেন্��্র করে দাঙ্গা যেটাকে কেউ বলছে মন্দির, কেউ মসজিদ কেউবা বলছে পর্তুগিজ স্থাপনা।

ঈশম চরিত্রটাকে কেন জানি ভালো লেগে গেছে। রঞ্জিত নিয়ে লেখক বেশি আগাননি, হতাশ করেছে এই ব্যাপারে।

“নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে”, যার সম্পর্কে বলা হয়েছে, পথের পাঁচালীর পর এই হচ্ছে দ্বিতীয় উপন্যাস যা বাংলা সাহিত্যের মূল সুরকে অনুসরণ করছে। এক্কেবারে আমার কথা :P মূল ঘটনাকে পাশে রেখে ছোটখাটো ঘটনাগুলোর বিশাল বর্ণনাতো এই দুইটা উপন্যাসেই রয়েছে। এই সব পড়ার সময় আমি নীলকন্ঠ পাখি নামক কিছু একটা খুঁজে বেরিয়েছি, যেই পাখিকে উপন্যাসের অধিকাংশ চরিত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে।

ওয়েল, দেশভাগ নিয়ে লেখা, আমার প্রিয় বিষয়গুলোর একটা। চোখ বন্ধ করে ভালো বলে রায় দেয়ার কথা। কিন্তু পারছিনা। অকারণ বর্ণনা আমাকে হতাশ করেছে। ফ্ল্যাপে বিখ্যাত সব মানুষদের প্রশংসা আছে। কিন্তু আমি যে এর খুব বেশি প্রশংসা করতে পারছিনা! এই সিরিজের বাকী তিনটা পড়ার ইচ্ছেও করছেনা শীঘ্রই :(
Profile Image for প্রিয়াক্ষী ঘোষ.
361 reviews34 followers
September 6, 2021
জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একটি নির্দিষ্ট ভুখন্ডে পাশাপাশি বসবাস করা মানুষগুলো যখন জানতে পারে এটা আর তাদের দেশ নয়, যেখানে জন্ম থেকে দেখে আশা পাশাপাশি ঘর, রাস্তা, জঙ্গল, মাঠ, নদী। পরিচিত চিরচেনা চারপাশ, আপনজনের মত প্রতিবেশী গুলো, যাদেরকে কখনও ধর্মের কারনে আলাদা করা যায় নি, বিপদে আপদে যারা সব সময় পাশে থেকেছে আজ তারা চিরশত্রু। দেশ ভাগের সাথে সাথে মনের দিক থেকেও ভাগ হয়ে গেলো।

শ্রী অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক যার ডাক নাম সোনা। জন্ম থেকে বেড়ে উঠা সেই চিরচেনা নিজের দেশ ছেড়ে পরিবারের সাথে তাকে চলে যেতে হবে হিন্দুস্থানে। দেশ ভাগের ফলে নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষ গুলো সবকিছু ছেড়ে গেলেও খুব প্রিয় কিছু জিনিস সাথে করে নিয়ে যায়। শুধু সোনা তার খুব প্রিয় কিছুই সাথে করে নিয়ে যেতে পারছে না, পাগল জ্যাঠামশাই, ঈশম আর ফাতিমাকে।

বইটা শেষ করার পর থেকে কেমন এক অনুভূতিহীনতায় ভুগতেছি।
বইটা এক লাইনে বোঝানোর জন্য এই একটা লাইনই যথেষ্ট ---
" জ্যাঠামশাই, আমরা হিন্দুস্থানে চলিয়া গিয়াছি, ইতি সোনা।"
Profile Image for DEHAN.
275 reviews86 followers
November 9, 2024
মহেন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান , ঠাকুর বাড়ির বড় ছেলে মনিন্দ্রনাথ। গ্রামের সবচাইতে বিদ্বান ব্যাক্তি ।
ঠাকুর পরিবারের এই গর্ব যখন এক ম্লেচ্ছ কন্যার প্রেমে পতিত হলো তখন মহেন্দ্রনাথ বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন নাকি যখন খবরটি পাওয়ার সাথে সাথে শহর থেকে ছেলেকে ধরে এনে এক প্রকার জোর করে বিবাহ দেওয়ার পর অধিক শোকে ছেলেটি মানসিক ভারসাম্য হারায় তখন বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন তা মহেন্দ্রনাথ মৃত্যুর আগে প্রকাশ করে গেলেন না । শেষের দিকে চোখে তেমন দেখতেন না । শুধু শুনতেন বড় ছেলে মনি নাকি সবার প্রশ্নের জবাবে একটি কথাই বলে- ''গ্যাৎচোরেৎশালা''। এই বিরক্তিমিশ্রিত গালমন্দ কি পরোক্ষভাবে তাকেই দেওয়া ? এই মন্তব্য কি পাগল মানুষটার অভিমান নাকি নিছক তামাশা উনি বুঝতে পারেন না। এমনিতে তার সবই আছে ,জমি আছে , সম্মান আছে,স্ত্রী আছে, ছেলেরা আছে , ছেলেদের বউ , ছেলেদের সন্তান , ঘর-বাড়ি । শুধু নেই ক্ষমা। বড় ছেলে তাকে ক্ষমা করে নি । সারাজীবন যে মানুষটি সৎ থেকেছে, অন্যের উপকার করেছে, কখনো অন্যায় করেন নি , তিনি নিজের সন্তানের কাছে পৃথিবীর সবচাইতে উৎকৃষ্ট অপরাধী...এটা ভাবতেই মহেন্দ্রনাথের চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। মনিকে তিনি হয়তো খুঁজতেন, দেখতে চাইতেন কিন্তু তার অভিমানী ছেলেটি কখনোই বাড়িতে থাকতো না ।এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতো ,দূরে কোথাও চলে যেত । কখনো বাড়িতে ফিরতো আবার কখনো ফিরতো না । মহেন্দ্রনাথের পুত্রবধূদের মধ্যে একমাত্র বড় বউটির কাছেই তার মনের ভাব প্রকাশ করতেন। ক্ষমা চাইতেন । পাগল মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়া না চাওয়া একই কথা তাই হয়তো পাগলের স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাওয়া। বড়বৌ কোন কথা বলে না। চুপ করে কথা শুনে শুধু। পাগল মানুষটার বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করে। সুস্থ স্বামীর চাইতে তার হয়তো উন্মাদ স্বামীর সঙ্গই বেশি পছন্দ । কিন্তু এ কথা আসলেই সত্যি না মহেন্দ্রনাথের একান্তই ব্যক্তিগত সান্ত্বনা সেটা জানার উপায় নেই। জানার উপায় নেই এই বাড়ি কিংবা গ্রামের সবাই আসলেই তাকে দোষী মনে করে কিনা! সম্মানীয় মানুষ কে মনে মনে অসম্মান কিংবা ঘৃণা করলে তা জানার সাধ্যই বা কার থাকে!
তবে হ্যাঁ ঠাকুর বাড়ির সবাইকে এই গ্রামের মানুষরা সমীহ করে চলে এটা সত্য। ভয় না , এ যেন সম্মান আর অন্যরকম একটা ভালোবাসা ওদের জন্য।
মনিন্দ্রনাথ পাগল হওয়ার পর কাউকেই চিনেও না বুঝেও না একমাত্র তার স্ত্রী আর তার ছোট ভাইয়ের ছেলে ''সোনা'' কে ছাড়া । সংসারের সব মায়া যেন তাদের জন্যেই । যখন পাগল জ্যাঠা হারিয়ে যায়, সোনা ঠিক ই তাকে কোথাও থেকে ধরে নিয়ে আসে। বাচ্চাটি এক অদ্ভুত জাদুবলে তার জ্যাঠামশাই এর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। সোনার দৃষ্টিতেও যেন জ্যাঠামশাই এর স্থান অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক জায়গায়। একটু বড় হলে সেও জ্যাঠার সাথে বেড়িয়ে পড়তো । ঘুরে বেড়াত । হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে মনিন্দ্রনাথ তাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে থাকেন।উন্মাদ জ্যাঠামশাইয়ের কাঁধ থেকে বিশাল এই পৃথিবী দেখতে দেখতে সোনা নাওয়া খাওয়া সব যেন ভুলে যায় ।
এর মধ্যে গ্রামে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায় দেশের মালিকানা নিয়ে ।
গ্রামে গোলযোগ তখনো ওভাবে শুরু হয় নি যখন হাডুডু খেলোয়ার ফেলু আরেকজনের গলা নামিয়ে তার সুন্দরী স্ত্রী কে নিজের বাড়িতে উঠিয়ে আনলো;
তখনো নয় যখন লীগের পান্ডা সামসুদ্দীন , নরেন দাসের বাড়ির সামনের গাছ টাতেই হিন্দুদের মুসলমানের উপর অন্যায় অবিচারের বর্ননামূলক ইশতিহার টাঙিয়ে দিলো ;
এমনকি তখনো নয় যখন পাগল মনিন্দ্রনাথ হাতিতে চড়ে উল্টাপাল্টা কমান্ড দিয়ে সামসুদ্দিনের আয়োজন করা কাফের বিদ্বেষী মুসলমানদের সিন্নির ভেতর ঢুকে সব তছনছ করে দিলো ।
আবেদালির স্ত্রী জালালী পানিতে ডুবে মরার পরেই যেন একটা বিশৃংখলা শুরু হয়ে গেলো গল্পে ।
এরপরেই তো মেলার মধ্যে এক মুসলমান ব্যাটা একজন হিন্দু নারীরে মোলেস্ট কইরা দাঙ্গাটার সলতে তে আগুন দিয়ে দিলো ।অনেক গুলো মানুষ মরলো কিন্তু তাতে দাঙ্গার ক্ষুধা মিটলো না।
ফেলুর আউট অব কন্ট্রোল ''স্বামী কোপায়া উঠায় আনা সুন্দরী স্ত্রী'' এই অঞ্চলের বিশিষ্ট ধার্মিক আকালুদ্দিনের সাথে ঝোপে জঙ্গলে শুয়ে পড়তে লাগলো। যে ফেলু জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে কিনা সন্দেহ তার স্ত্রীর গায়ে থেকে আসে আতরের সুবাস! কি লজ্জার কথা!
নরেন দাসের সদ্য বিধবা হওয়া বোন মালতীকে গভীর রাত্রে আবেদালির সহজ সরল ছেলে জব্বর উঠায় নিয়ে বিক্রি করে দিলেও দাঙ্গার ক্ষুধা মিটলো না । বাড়তেই লাগলো , বাড়তেই লাগলো ।
পুরো গল্পে চরিত্র গুলোর সাথে সাথে যেন বিশৃংখলাও এভাবে একটু একটু করে বড় হতে থাকে । একই সাথে হিন্দু মুসলিম প্রীতি এবং অপ্রীতি ''প্রত্যক্ষ করা যায় কিন্তু সেটা অস্পষ্ট'' করে লেখক তুলে ধরেছেন।
বইটিতে এত সুন্দর করে প্রাকৃতিক বর্ণনা দিয়েছেন যেন প্রতিটি লাইন চোখের সামনে দূরদর্শনের মতো ভাসে।
অনেকদিন পর এরকম একটা খাঁটি গ্রামীণ ঊপন্যাস পড়লাম ।
এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড় সার্থকতা হলো লেখকের কোন বিশেষ চরিত্র কে বিশেষায়িত না করে সব চরিত্র কেই প্রাধান্য দেওয়া । একটি উপন্যাসে প্রতিটি চরিত্রকেই এমনকি হাঁস,কুকুর,হাতি,মাছ,ষাঁড়,বাছুরকেও এরকম সহজ ও সাবলীল ভাবে ''অসাধারণ অবদান'' রাখতে আগে দেখেছি কিনা মনে পড়ে না ।
ব্যাপারটা এমন যে খুব তুচ্ছ কিছু যেন চোখের সামনে তার একান্ত নিজস্ব প্রয়োজনে বিরাট কিছু হয়ে যাচ্ছে, যা একদম ই অস্বাভাবিক লাগছে না আবার হজম করতেও কষ্ট হচ্ছে ।
হয়তো সেই কষ্ট থেকেই ,
কিংবা লেখকের কল্পনার ক্ষমতা দেখে ইর্ষান্বিত হয়েই,
ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে রিভিউর শেষে লেখতে ইচ্ছা করছে-
গ্যাৎচোরেৎশালা
Profile Image for Kripasindhu  Joy.
542 reviews
December 2, 2024
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গদ্যের ভাষা সুন্দর, আকর্ষণীয়৷ গল্পে তাড়াহুড়ো না করে ধীরেসুস্থে এগিয়েছেন।
দেশভাগ নিয়ে অনেক লেখা হলেও, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে থাকবে।
Profile Image for Masudur Tipu.
125 reviews2 followers
May 30, 2025
ক্লাসিকের রিভিউ হয় না! এই বই মিস কইরেন না কেউ!
Profile Image for Anjum Haz.
285 reviews69 followers
January 8, 2022
রবি শংকরের একটা প্রভাত-রাগ আমার বড় প্রিয়, বেশ ধীর লয়ে এর শুরু, নিঃশ্বাসের তালটা কেমন কমে আসে সেই রাগ শুনলে। তারপর তরী যেমন মাঝ-নদীতে পৌঁছালে, চারিদিকে উত্তাল, মনে হয় এখানে অস্তিত্ব শুধুই নদীর, তেমনি সেই রাগ বক্ষে আছড়ে পড়ে। 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে' বইয়ের সাথে এই রাগটার তুলনা চলে। শব্দের ঝংকারে প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনা, গ্রাম বাংলার মাটি ও মানুষ, বাঙালি পরিবারের আচার অনুষ্ঠান- এসব সোনা-রোদ-মাখা স্নিগ্ধ বর্ণনা থেকে অতীন বাবু পাঠককে নিয়ে আসেন এক মাঝ-নদীতে— যে নদী উত্তাল স্লোগান আর ইশতেহারে- লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, ভারতমাতা কী জয়, বন্দে মাতরম, নারায়ে তকদির।‌ মনে হয় বেলা পড়ে গিয়ে সোনা-মাখা-রোদ হারিয়ে গেছে, এখন চারিদিকে নেমেছে কুয়াশা। শব্দ দিয়ে যদি উচ্চাঙ্গ সংগীত লেখা হতো বাংলার প্রকৃতি ও ইতিহাস অবলম্বনে, তবে তাই হতো অতীন বাবুর 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে'।

উপন্যাসের পরিধি বিস্তর। সোনালী বালির নদীর চরে উপন্যাসের পটভূমি। নদীর মাঝে মাঝে বসতি কিছু হিন্দু পরিবার ও মুসলিম পরিবারের। তাদের ভাষা এক, ধর্ম ভিন্ন, উৎসব অনেকটা মিলমিশে। তাদের আবহমান নিজস্ব জীবনধারা। বর্ষা এলে গয়না নৌকার মাঝি, শীতে নদীর চরে চাষবাস, দু'মুঠো অন্নের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম, অন্ন না মিললে নদীতে ডুবে ডুবে শালুক তুলে এনে তাই সেদ্ধ করে খাওয়া, তাই যেন অমৃত। অশিক্ষিত মানুষ, পুরুষশাসিত সমাজ।

উপন্যাসের চরিত্রগুলো দাগ কেটে দেয় মনের ভিতরে। এক সোনা, ন'-দশ বছরের বালক। সোনা বাবুর গায়ে চন্দনের সুবাস। তার পিছু মাঠময় ছুটে বেড়ায় ফতিমা। ফতিমার পায়ে মল, নাকে নোলক। এক ঈশম, ঠাকুর পরিবারের জন্য খাটছে সারাদিন। জালালি, জোটন হিসাব করছে অন্নের। মালতি— তরুণী বিধবা, শীতের ভোরে সে ডুব দেয় পুকুরে, শরীরের জ্বালা যেন ফেলে আসতে চায় সেখানে। আর আছেন এক পাগল ঠাকুর, জীবনের ছন্দ যেন তার কবে কেটে গেছে। তবু খুঁজে বেড়াচ্ছেন পুরনো ছন্দ, হাতে তালি দিচ্ছেন, কোথায় তুমি, এসো নীলকন্ঠ পাখি।

ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে দিয়ে উপন্যাসটা গড়িয়ে নিয়েছেন অতীন বাবু। শীতের কালে মুড়াপাড়া থেকে হাতি আসে এই গ্রামে। আসে আরো কত ইস্তাহার-
এই হাতি বাড়ির উঠোনে উঠে এলে জমিতে সোনা ফলবে। ওরা হাতির মাথায় কপালে লেপে দেবার জন্য সিঁদুর গুলতে বসে গেল। হাতিটার কপালে সিঁদুর দিতে হবে, ধান দূর্বা সংগ্রহ করে রাখল সকলে। আর মালতি দেখল, হাতির পিঠে পাগল মানুষ হাততালি দিচ্ছেন। হাতির পিঠে সোনা। ফতিমা সোনাবাবুকে নিচ থেকে বলছে, আমারে পিঠে তুইলা নেন সোনাবাবু। ফতিমা হাতির পিঠে ওঠার জন্য ছুটছিল। আর তখন ফতিমার বা'জী সামসুদ্দিন সামিয়ানার নিচে বড় বড় অক্ষরে ইস্তাহার লিখছিল, ইসলাম বিপন্ন। বড় বড় হরফে লিখছিল—পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

কখনো বর্ণনায় ব্যবহার হয়েছে গ্রামের মানুষের মুখের ভাষা।
হোগলার জঙ্গলে দুটো সাদা পা, কী সুন্দর আর যেন দুর্গাঠাকুরের পা। ওর বুকটা কেঁপে উঠলো। ... তরে নিয়া আইছে কে!

দুগগাঠাকুরের পা দু'খান য্যান ভৎসনা করছে কাকে, কিসের এক বিশ্বাসঘাতকতা।

এমনি সময়ের স্রোতে আমাদের মিলমিশে গ্রামে আসে নতুন ইস্তাহার। দেশ ভাগ হইবো। ভাঙনই তাইলে সই।



দ্বিতীয়বার পড়লাম এই উপন্যাসটি। প্রথমবার যখন পড়ি তখন আমার রিডিং ম্যাচুরিটি তেমন ছিল না। কিন্তু কেমন আকর্ষণ বোধ করছিলাম আর বইটা পড়া শেষ হলে মনে হয়েছিল যে, এরকম কিছু আগে কখনো পড়িনি। দ্যাট ওয়াজ আ টার্ন অফ মাই রিডিং যার্নি। দ্বিতীয়বার পড়লুম মাত্র। আবারো ফিরে আসবো, কোনো সোনা-রোদ-মাখা সকালে উল্টাবো পাতা- নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে
Profile Image for Anirban.
2 reviews
December 4, 2021
এই বইটি ভারতের বাঙালিদের একটা অমূল্য সম্পদ। অতীন বাবু দেশভাগ নিয়ে লিখেছেন এতে রাজনীতি নেই আছে ভালোবাসা, আছে দুঃখ আর আছে হারিয়ে যাবার বেদনা। ভালোবাসা হারিয়ে গেলো, দেশ হারিয়ে গেলো !! পড়তে পড়তে মনে হয়েছে ভালবাসা থেকেই দুখের জন্ম হয়।
দুঃখের বিষয় আতিন বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা যোগ্য মর্যাদা দিতে পারিনি। বাংলাদেশের এত সুন্দর বর্ণনা আর কোথায় !! কিন্তু না উনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছেন না ভারতের পদ্ম পুরস্কার পেয়েছেন। অতীন বাবুর এই লেখাটি নোবেল প্রাইজ পাবার যোগ্য। হয়তো উনি যদি ইহুদি হতেন আর হলোকস্ট নিয়ে লিখতেন তাহলে পেয়েও যেতেন।
Profile Image for হাবিবুর রুহিন.
32 reviews4 followers
July 26, 2022
লেখক সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না আমার। কিন্তু হুট করে বইটার নাম শোনা মাত্র আমার ভিতরে কেমন শূণ্যতার সৃষ্টি হলো৷ পড়ার আগ্রহ তৈরি হলো। নেট ঘেটে জানলাম দেশভাগ নিয়ে খুব বিখ্যাত বই। লেখকের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে এই উপন্যাস৷ যার অনেক চরিত্র কাল্পনিক নয়, বাস্তব।
১৯৪৭ সাল। এক রাক্ষুসে সময়। একটা দেশ ভেঙে দুটুকরো হয়ে যাচ্ছে৷ সেই দেশভাগের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী দশককের বাংলার প্রান্তিক সাধারণ মানুষকে প্রেক্ষাপট করে রচিত এই উপন্যাসটি। একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেশভাগ প্রস্তাবের প্রভাব, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ও দেশভাগের প্রস্তাবের কারণে উদ্ভুত সমস্যায় দুই গোত্রের টানাপোড়েনের কথা উঠে এসেছে এই উপন্যাসে৷ প্লট দেশভাগ হলেও—দেশভাগ নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা খুব কমই স্থান পেয়েছে বইতে৷ বইটিতে স্থান পেয়েছে সেই সময়ের দুই ধর্মের মানুষ, তাদের সৌহার্দ্যের কথা, স্থান পেয়েছে গ্রাম-জীবন, প্রকৃতি আর প্রকৃতির মতোই সরল নয়—কঠিনও নয়, যখন যেখানে যেমন তেমন মানুষেরই কথা।
এক সময় দেশভাগের হুজুগে মানুষগুলো অস্থির হয়ে ওঠে। হিন্দুরা অস্তিত্বের সংকটে ভোগে। জাত, ধর্ম, পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য গেলগেল রব উঠে। ওদিকে নানান বঞ্চনায় মুসলমানদের ভিতরে দেশভাগের আগ্রহ আরও বেশি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে৷ তাদের আগ্রহ কেন এত বেশি ছিল তা বোঝা যায় এই কথোপকথনে-
❝-এডা করলি ক্যান?
-ক্যান করুম না। দেশটা কেবল তর জাতভাইদের?
-ক্যান আমার জাতভাইদের হইব। দেশটা তর আমার সকলের।
-তবে কেবল ইসলাম ইসলাম করস ক্যান ?
-করি আমার জাতভাইরা বড় বেশি গরু- ঘোড়া হইয়া আছে। একবার চোখ তুইল্যা দ্যাখ , চাকরি তগ, জমি তগ , জমিদারি তগ। শিক্ষা দীক্ষা সব হিন্দুদের।❞
এভাবেই সৌহার্দ্য আর দ্বন্দ্বের মিশেলে কাহিনি এগিয়ে যেতে থাকে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সোনাবাবুকে মনে করা হলেও প্রতিটি চরিত্রই এখানে সমানভাবে প্রধান চরিত্রও হবার দাবী রাখে৷ এছাড়াও সোনাবাবুর পাগল জ্যাঠামশাই, যে নীলকন্ঠ নামের অস্তিত্বহীন এক পাখির খোঁজে দিকবিদিক ঘুরে বেড়ায়৷ কিন্তু কখনওই সেই পাখির দেখা পায় না৷ এই পাখি যে রুপক আর পাখির সন্ধান যে সব মানুষই করে তা বুঝতে বাকি রাখে না৷ এই ‘নীলকন্ঠ পাখি’ কারো কছে নারী, কারো কাছে, কারো কাছে লালসা, কারো কাছে বা শুধু পেটভরে আহার আবার কারো কাছে দেশভাগের আকাঙ্ক্ষা যা তাদের সমৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখায়।
একসময় সেই কুখ্যাত চলে আসে। ভিন্ন প্রসঙ্গে চরিত্রের মুখে বহুবার উচ্চারিত সে কথাই বলতে হয় যা দেশভাগের সাথে অতিপ্রাসঙ্গিক ❝এট লাস্ট দা সেলফিস জায়ান্ট কেম❞। সোনা বাবুদের মতো আরও অসখ্য হিন্দু পরিবার দুঃখ-ভয়-শঙ্কা-অনিশ্চয়তাকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে হিন্দুস্থানে পাড়ি জমায়। ছেড়ে যাওয়ার সময় সোনা বাবু বাড়ির উঠনের বড়ো অর্জুন গাছে নিরুদ্দেশে যাওয়া পাগল জ্যাঠামশাই এর জন্য লিখে যায়, ❝জ্যাঠামশাই আমরা হিন্দুস্থান চলিয়া গিয়াছি- ইতি সোনা❞।
উপন্যাসের বর্ণনা ধীরগতির। একই কথার পুনরাবৃত্তি দোষে দুষ্ট। ধীরগতির না হলে উপন্যাসটা হয়তো আরও উপভোগ্য হতো বলে আমি মনেকরি।
Profile Image for Rumana Nasrin.
159 reviews7 followers
October 31, 2015
অনেক বেশী প্রত্যাশা নিয়েই পড়ছিলাম। দেশভাগ নিয়ে এমন বই আর হয়না ধরনের কথা পড়েছি অনেক জায়গায়। প্রতিটা ঘটনার পরে মনে হয়েছে দেশভাগ, তারপর তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যাপারে সমাজের সব ধরনের মানুষের ভাবনার কথা হয়তো আসবে! কিন্তু খুব কম জায়গায়ই অমন কিছু পেয়েছি। বরং প্রায় প্রতিটা চরিত্রের জৈবিক চাওয়া-পাওয়া নিয়ে অনেক বেশী আলোচনা করা হয়েছে! আমি সত্যিই আশাহত!
Profile Image for Koyel Bhattacharyya.
Author 3 books2 followers
December 15, 2020
একটা তরমুজ খেত, একটা ঈশম শেখ, একটা সোনা, একটা ফতিমা, একটা মালতী, একটা সামসুদ্দিন, একটা পলিন, একটা পাগল মানুষ, একটা আশ্বিনের কুকুর, একটা দূর্গাপুজো, একটা অর্জুন গাছ, একটা দেশভাগ, একটা নীলকন্ঠ পাখি, আর মাথার উপর একটা নীল আকাশ যা কখন‌ও শেষ হতে শেখেনি ❤️
Profile Image for Dr. Rubaiyat Rahman.
15 reviews33 followers
September 21, 2013
পারলাম না বইটা শেষ করতে। যদিও বইয়ের প্রথম দুই অধ্যায় পড়ে অসাধারণ লেগেছিলো। লেখকের মাত্রাতিরিক্ত উপমার ব্যবহার আর প্রতি লাইনে প্রকৃতির বর্ণনা এক পর্যায়ে বিরক্তিকর লেগেছে।
Profile Image for Preetam Chatterjee.
6,740 reviews355 followers
July 2, 2025
১. ভূমিকা: দেশভাগের বিভীষিকা ও বাংলা উপন্যাসে নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে-র অবস্থান

“যে জাতি ইতিহাস ভুলে যায়, তারা আবার ইতিহাসেরই খেলনা হয়ে যায়”—এই তীক্ষ্ণ সতর্কবাণীর ভেতরেই যেন অঙ্কুরিত হয়েছে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাসের অন্বয় ও অন্তর্দৃষ্টি। ১৯৪৭-এর দেশভাগ ইতিহাস নয় শুধু, তা এক দীর্ঘ, রক্তস্নাত আর আত্মগত মানসযন্ত্রণার দলিল। এই উপন্যাস সেই দলিল নয়—বরং তার স্বপ্নভঙ্গ। সেই স্বপ্ন, যা রচিত হয়েছিল একসাথে বাসের আশায়, আর ভেঙে পড়ে রক্ত, ধর্ম ও ভাষার বিভাজনে।

দেশভাগ নিয়ে লেখা সাহিত্যে অনেক কথাই বলা হয়েছে, কিন্তু নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে সেই রচনাগুলোর থেকে ভিন্ন—এর বর্ণনা কোনও ধ্বংসস্তূপের সাংবাদিক বিবরণ নয়, বরং এক গভীর আত্মপীড়নের আলেখ্য। বিভাজনের রেখা এখানে কেবল মানচিত্রে নয়, মানুষের অন্দরমহলে। এ উপন্যাসে দেশভাগ মানে শুধু হিন্দু-মুসলমানের আলাদা হয়ে যাওয়া নয়, বরং এক গোটা গোষ্ঠীর স্মৃতি, ভাষা, জীবিকার অবলম্বন, ও আত্মপরিচয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধস নেমে আসা।

বাংলা সাহিত্যে দেশভাগকে কেন্দ্র করে রচিত উপন্যাসগুলির মধ্যে সাহেববাড়ির লোক, তিতাস একটি নদীর নাম, এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, যাত্রা প্রভৃতি গ্রন্থের পাশে নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে যেন এক গূঢ় আত্মার্তনের মত দাঁড়িয়ে থাকে। অন্যরা যেখানে শহুরে বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে গুরুত্ব দিয়েছে, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে আমাদের নিয়ে যান প্রত্যন্ত এক নদীচরের ভিতরে, সেইসব নিঃশব্দ মানুষদের কাছে—যাঁরা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায় না, কিন্তু যাঁদের কান্না মাটি ও বাতাসে মিশে থাকে বহু শতাব্দী ধরে।

এই গ্রন্থে ইতিহাস কোনও ক্যানভাস নয়—ইতিহাস এখানে ঘর্মাক্ত কৃষক, চুপচাপ গৃহবধূ, ঠ্যাঙাড়ে প্রেমিক, উন্মাদ পণ্ডিত আর অনাথ শিশুর চোখে দেখা এক অভিশপ্ত মুহূর্ত। ঠিক যেমন হিন্দু দর্শনে ‘কাল’ কেবল সময় নয়, তা এক ধ্বংসকারী দেবতা—এই উপন্যাসেও কাল যেন শিবের নৃত্যরত রূপে এক ধ্বংসনৃত্য করে যায়।

আর তখনই মনে পড়ে ঋগ্বেদের সেই উচ্চারণ—

"सह नाववतु। सह नौ भुनक्तु। सह वीर्यं करवावहै।" (আমাদের একত্র রক্ষা করো। একত্র ভোজন করাও। একত্র বল অর্জন করতে দাও।)

কিন্তু দেশভাগ সেই সহবৃত্তিকে ছিন্ন করে দেয়, রক্ত আর অগ্নিতে সেই মন্ত্র পুড়ে যায়।

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস এই ছিন্নতার মধ্যেই খোঁজে এক রূপক—এক নীলকণ্ঠ পাখি—যে উড়ে চলে যায় ওপার বাংলার আকাশে। কিন্তু সে কি বাস্তব, না কেবল আমাদের চেতনার এক অন্তর্লীন স্বপ্ন? সেই প্রশ্নেই শুরু হয় উপন্যাসের দীর্ঘ যাত্রা—যেখানে পাঠক নিজেই এক উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে, নিজেই নিজেকে খোঁজে নিজের ভাঙা ইতিহাসের মধ্যে।

এ এক আত্মার দলিল—আর কোনও কিছু নয়।

২) বিন্যাস:

উপন্যাসটি চার খণ্ডে বিভক্ত হলেও, এই প্রথম খণ্ডেই অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় নির্মাণ করেন এক ধরনের ‘স্মারক অভিধান’—একটি জাতির ধ্বংসের নৈঃশব্দ্য সংকলন। যেন প্রতিটি চর, প্রতিটি নদী, প্রতিটি চরিত্র হয়ে ওঠে ইতিহাসের একেকটি পদচিহ্ন। এই প্রথম খণ্ডে রচিত হয় যে মানসিক ভূগোল, তা পরবর্তী তিন খণ্ডের জন্য রেখে যায় এক অফুরন্ত ব্যথার ভিত্তিপট।

স্মরণযোগ্য ভাবে কথাসাহিত্যিক যতীন সরকার বলেছিলেন, “এই উপন্যাস না থাকলে বাংলা সাহিত্যের দেশভাগ-স্মৃতি অসম্পূর্ণ থেকে যেত।” সত্যিই তো—নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে ছাড়া দেশভাগের সাহিত্যিক অভিধান একরকম অর্ধাঙ্গ থাকত; যেন কোনও গোষ্ঠীর আত্মজৈবনিক না-বলা অধ্যায় ঝুলে থাকত বাতাসে।

যাঁরা সাহেববাড়ির লোক, বিষাদবৃক্ষ, বা তিতাস একটি নদীর নাম পড়ে ছিন্নমূলের ক্রন্দন, প্রান্তিক জনজীবনের অভিধান, অথবা অস্থিচর্মসার স্মৃতির আখ্যানের সন্ধানে মগ্ন, তাঁদের কাছে নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে সেই অভিজ্ঞতার পরবর্তী স্তর—এক স্নায়বিক, স্পন্দিত, আধিভৌতিক ও আধ্যাত্মিক পাঠানুভব।

এই উপন্যাস যেন বাস্তব আর অলৌকিকের মধ্যবর্তী কোনও আলো-ছায়ার সীমারেখায় অবস্থান করে—একদিকে ইতিহাসের রক্তমাখা হুকুম, অন্যদিকে ফতিমার মল পরা পায়ে নদীর কাদামাটি, মনীন্দ্রনাথের গালমন্দে মিশে থাকা পরম ক্ষমাহীন অভিমান, কিংবা সোনার চোখে দেখা এক গ্যাসলাইটের মতো ধোঁয়াটে ভবিষ্যৎ।

ঠিক তখনই মনে পড়ে পথের পাঁচালী-র সেই মেলানকোলিয়া—কিন্তু এখানে অপু নেই, এখানে আছে জ্যাঠামশাই মনীন্দ্রনাথ, যার কাঁধে উঠে দুনিয়াকে দেখে ছোট্ট সোনা; যেন নব্য কলিঙ্গ যুদ্ধ-পরবর্তী কোনও অশোক সম্রাট, যার বুকে অহিংসার পাষাণ খোদাই হয়েছে দুঃখের ভাষায়।

উপন্যাসটি পড়তে পড়তে মনে হয়, এটি কেবল দেশভাগ নিয়ে লেখা নয়—এটি মনোভাগ নিয়ে লেখা। ভাষার, বিশ্বাসের, ভূমির, ভোগের ভাগ নিয়ে লেখা। আর সেই বিভাজনপূর্ব মুহূর্তগুলোতেই, লেখক ধরতে পেরেছেন এমন সব আলোড়নের তরঙ্গ, যা পাঠককে টেনে নিয়ে যায় ইতিহাসের ধুলিধুসর অথচ প্রগাঢ় আবেগমথিত তীরে।

এ যেন স্রেফ উপন্যাস নয়—এ এক আত্মিক দেশনামা।

৩. চরিত্রচিত্রণ: ক্ষত ও করুণা—এক অনুপম প্রান্তিকতার প্রতিসরণ:

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে এমন এক উপন্যাস, যেখানে কোনও একক ‘নায়ক’ নেই। বরং প্রতিটি চরিত্র, তার নিঃশব্দে বয়ে আনা ক্ষত, অনুচ্চারিত করুণা এবং নিঃসঙ্গতার দহন—এই আখ্যানের সুরস্রোতে এক একটি গূঢ় নোটের মতো। এরা কেউ রাজনীতির পোস্টারে নেই, ইতিহাসের কেন্দ্রে নেই, কিন্তু এরা ইতিহাসের সবচে��়ে প্রকৃত অভিজ্ঞ মানবচিহ্ন।

ঈশম শেখ—ঠাকুরবাড়ির মুনিষ, মৌন শ্রমিক, মাটির সন্তান। যার জীবন, প্রেম, মৃত্যু—সবই যেন ভূমিসংলগ্ন। সে চাষবাস করে, মনীন্দ্রনাথের মতো পাগলের মুখে জল তুলে দেয়, আবার মেলায় গিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে ধর্মদ্বন্দ্বে। ঈশম আমাদের মনে পড়িয়ে দেয় John Steinbeck-এর The Grapes of Wrath-এর Tom Joad-কে—যে চুপচাপ শ্রম করে, তবু বিদ্রোহ করে না; বরং প্রান্তিকতার মধ্যে মানবিকতা খুঁজে বেড়ায়।

তার নিঃসঙ্গতা আর আকাঙ্ক্ষা যেন গালিবের কণ্ঠে মিশে যায়—

“हज़ारों ख़्वाहिशें ऐसी कि हर ख़्वाहिश पे दम निकले।” (হাজার হাজার আকাঙ্ক্ষা, প্রতিটিতেই যেন প্রাণ বেরিয়ে আসে।)

সোনা (অতীশ দীপঙ্কর)—একটি শিশুচোখের মাধ্যমে দেখা দেশভাগ। তার জ্যাঠামশাইয়ের কাঁধে চড়ে সে দেখে এক গ্রাম, এক সভ্যতা, যা ধীরে ধীরে ফাটছে, ভাঙছে, ছিঁড়ে যাচ্ছে। সোনা যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয় Anne Frank-এর সেই বিখ্যাত The Diary of a Young Girl—যেখানে একটি কিশোর হৃদয় রোজকার নিঃসঙ্গতা আর যুদ্ধের কোলাহলে নিজের আত্মা বাঁচিয়ে রাখে। সোনা সেই স্নিগ্ধতা, যা ধ্বংসের মাঝেও জীবনের দিকে তাকায়।

মণীন্দ্রনাথ—পাগল, অথচ দার্শনিক। প্রেমে পরিত্যক্ত, সমাজে অপাংক্তেয়। তবু তার ভেতরে লুকিয়ে আছে এক আদিগন্ত আত্মজিজ্ঞাসা, যেন সে আমাদের সামনে হাজির হন Dostoyevsky-র Prince Myshkin হয়ে—The Idiot-এর সেই বেদনার রাজপুত্র, যার সহজ মনবিকাশ এবং মানসিক বিপন্নতা তাকে সকলের কাছে এক ‘অন্যরকম’ করে তোলে। তার মুখের “গ্যাৎচোরেৎশালা” উচ্চারণ, শুনতে কদর্য হলেও, এক নিঃশব্দ অভিমানের অনুরণন—এক আদর্শিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

জোটন—বারবার তালাকপ্রাপ্তা, তবু সন্তান ধারণে বিশ্বাসী, শরীরসর্বস্বতায় নিবিষ্ট। সে যেন আমাদের সামনে হাজির হয় Toni Morrison-এর Sula-র সেই নামচরিত্রের মতো—সমাজের নিয়ম ভেঙে বাঁচতে চাওয়া এক নারী, যাকে সমাজ একভাবে চেনে, পাঠক আরেকভাবে উপলব্ধি করে। জোটনের কামনাও পবিত্র, তার মা হওয়ার ইচ্ছাও আধ্যাত্মিক।

সামসুদ্দিন—ধর্মের নাম করে রণহুঙ্কার তোলা মানুষ। অথচ তার চোখে আছে এক পরিত্যক্ত প্রেম, মুখে আছে ভাষার জন্য একসময়কার সংগ্রাম। এই দ্বৈততা পাঠককে মনে করায় Albert Camus-এর The Stranger-এর Mersault-কে—যার ভেতরে আছে অস্পষ্ট আবেগ, অথচ সামাজিক কাঠামো তাকে বিচারে টেনে আনে। সামসুদ্দিনের দোলাচল আমাদের বোঝায়, একেকটি রাজনৈতিক স্লোগানের আড়ালেও লুকিয়ে থাকে বহু পরাজিত প্রেম।

ফতিমা—যে ছুটে বেড়ায় সোনার পাশে, তার পায়ে নোলক, গায়ে মাটি, মুখে আকাশ। তবু ধর্মের নামে বিক্রি হয়ে যায় সে, নিছক এক শরীর হয়ে ওঠে এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে। তার ভঙ্গুরতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় Mahasweta Devi-র Draupadi চরিত্রটিকে—যাকে নগ্ন করে ফেলেও রাষ্ট্র তার আত্মমর্যাদাকে ভাঙতে পারে না। ফতিমা সেই বিক্রিত যোনির ভেতরে থাকা অপার কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন তোলে—"কেন?"

মালতী—যুবতী বিধবা, যার শরীর এখনো ডাকে। সমাজ বলে, সে সংযমে থাকুক; মন বলে, সে ভালোবাসুক। তার জীবন যেন নির্ঝরিণীর মতো—ধারা আছে, শব্দ নেই। সে যেন আমাদের জানায় Virginia Woolf-এর Mrs. Dalloway-র মতো আত্মভেদী নারী চরিত্রের কথা—যে একা হেঁটে যায় স্মৃতির নদীপথে, পরিচ্ছন্নতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে প্রেমের আঁচড়।

ফেলু শেখ—লম্পট, স্বঘোষিত ধার্মিক, আসলে প্রবঞ্চক। তার মধ্যে আছে হিপোক্রিসি আর ভণ্ডামির বিস্ময়কর সমবায়। সে যেন রূপান্তরিত Mephistopheles—Faust-এর সেই প্রলুব্ধকারী—যে ধর্মের মুখোশে ভোগের রাজনীতি করে।

এইসব চরিত্রদের মধ্যে দিয়ে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এঁকেছেন এক পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি—একটি সমাজের, একটি দেশের, একটি সময়ের। যেখানে প্রত্যেকেই আংশিক নায়ক, প্রত্যেকেই পূর্ণ ব্যথিত মানুষ। যেন আমাদের রক্তমাংসের প্রতিবিম্ব।

"अभी मुझ में कहीं बाकी थोड़ी सी ज़िंदगी है..." (আমার ভিতরে কোথাও এখনো একটু বেঁচে থাকা রয়ে গেছে) —Gulzar

এই চরিত্রগুলোর মধ্যে দিয়েই, সেই সামান্য বেঁচে থাকা আমরা দেখি—ভগ্ন হৃদয়ে, ক্লান্ত আশায়, মাটি-গন্ধা রাত্রির নিঃশ্বাসে।

৪. দেশভাগের প্রভাব: ধর্ম, রাজনীতি ও হৃদয়ের ভাঙন

যে গ্রামে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে দূর্গাপুজোয় খিচুড়ি খেত, মহররমে কাঁদত, বৈশাখে নদীতে গিয়ে গা ধুতো, সেখানে হঠাৎ করেই ভাগ হয়ে গেল রাস্তা, বাড়ি, মন, দৃষ্টি।
“এই দেশ তোমার নয়”—এই বাক্যটিই যেন এক অদৃশ্য ছুরি হয়ে হৃদয়ে কেটে বসে। এই একটি বাক্যেই জেগে ওঠে হাজার বছরের সহাবস্থানের ছিন্নবিচ্ছিন্ন চিত্র।

এখানে আর শুধু ভৌগোলিক দেশ ভাগ হয় না, ভাগ হয়ে যায় ভাষা, স্মৃতি, সংস্কৃতি, এমনকি স্বপ্ন। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় যেন ‘দেশ’ শব্দটিকে জাতীয়তাবাদের নয়, এক গভীর আত্মিক অনুভূতির প্রতীকে পরিণত করেন। দেশভাগ এখানে মানচিত্রের কাহিনি নয়, মানসপটের বিপর্যয়।

দাঙ্গার সূত্রপাত হয় এক হিন্দু নারীর সম্ভ্রমহানিকে ঘিরে—একটি ব্যক্তিগত ঘটনার ভিতর দিয়ে জাতীয় উন্মাদনার দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বলে মন্দির, কেউ বলে মসজিদ, কেউ পর্তুগিজ শাসনকালীন স্থাপনা—এক ইমারতের নাম নিয়ে শুরু হয় রক্তপাত, যেমনটা আমরা ইতিহাসে দেখেছি অযোধ্যা কিংবা কাশী-মথুরায়।

“হিন্দুরা আমাগো দ্যাখলে ছ্যাপ ফালায়, আমরা-অ ছ্যাপ ফালামু”—এই সংলাপগুলো পাঠকের গায়ে ছ্যাঁকা দেয়, হাড়ে হাড়ে টের পাই, কারণ এই কথাগুলো আর কল্পনা নয়, এ তো একেবারে পাড়ার মোড়ে, মসজিদের পাশের অলিগলিতে শোনা যায়।

এই দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়ে থাকে সেই মানুষগুলো, যারা কোনও পক্ষেই নয়। তারা শুধু ভালোবাসতে চেয়েছিল, বাঁচতে চেয়েছিল। “Tum zameen ke na the, aasman ke bhi nahi the—tum kahaan ke the?” (তুমি তো না মাটির ছিলে, না আকাশের—তুমি তবে কোন দেশের ছিলে?) —Firaq Gorakhpuri

উপন্যাসে ভাষা আন্দোলনের উল্লেখ এক জরুরি সংযোজন। সামসুদ্দিনের মোহভঙ্গ ঘটে ১৯৪৮ সালে, যখন পূর্ব বাংলার ছাত্ররা “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” বলে রাজপথে নামে। এই মুহূর্তে অতীন যেন ইতিহাসকে সাহিত্যের ভেতরে এক অনুপম শোকগাথা করে তোলেন।

এই ভাষাসংগ্রামের পটভূমিতে প্রতিধ্বনিত হয় তসলিমা নাসরিনের সেই তীব্র উচ্চারণ— “ভাষা যখন স্বপ্ন হয়ে ওঠে, তখন প্রতিবাদের ভাষাও আগুন হয়ে ওঠে।”

এই অংশে উপন্যাসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় বিভূতিভূষণের অপরাজিত, যেখানে পৃথ���বী বদলায়, কিন্তু মানুষ খুঁজে চলে তার শিকড়। আবার মনে পড়ে Sadat Hasan Manto-র Toba Tek Singh—যেখানে পাগলরাই সবচেয়ে বেশি বোঝে, কোন দেশ আসল, আর কোনটা কাঁটাতারের দম্ভ।

সেইসব গ্রাম, যেগুলি আগে ছিল সাঁওতালদের গানের মতো, সেখানে এখন শুধু থাকে—

Partition:

Shut up in a lonely mansion, with police night and day
Patrolling the gardens to keep assassins away,
He got down to work, to the task of settling the fate
Of millions. The maps at his disposal were out of date
And the Census Returns almost certainly incorrect,
But there was no time to check them, no time to inspect
Contested areas. The weather was frightfully hot,
And a bout of dysentery kept him constantly on the trot,
But in seven weeks it was done, the frontiers decided,
A continent for better or worse divided.

— WH Auden

এই উপন্যাসে দেশভাগ মানে শুধু রাজনৈতিক সংকট নয়, এক গভীর মানবিক দুঃস্বপ্ন, যা পাঠকের মনে দীর্ঘশ্বাস হয়ে বাজে, বহুদিন পরেও।

৫. বর্ণনার ধীরতা ও রূপকধর্মিতা: পাঠক-সমালোচকের দ্বৈততা

এই উপন্যাসের সবচেয়ে আলোচিত বৈশিষ্ট্য—এর ধীর গতি। কেউ বলেন, “নড়ে না, এগোয় না, পাতা ঘোরে, কিন্তু গল্পটা যেন দাঁড়িয়ে থাকে একজায়গায়।”

আবার কারও কাছে, এই ধীরতা এক অভ্যন্তরীণ নদীর প্রবাহ—যা বাইরে থেকে স্থির, অথচ ভেতরে গহীন।

প্রকৃতির বর্ণনা এখানে শুধু সৌন্দর্যচর্চা নয়—এ এক “নাটকীয় স্তব্ধতা”, যা মানুষের চেতনার বহিঃপ্রকাশ। রোদ পড়া নদীর ঢেউ, ঘুঘুর ডাক, ধানের ক্ষেতে বাতাস—সব মিলিয়ে এটি এক রূপকধর্মী প্রত্নস্মৃতি, যা সময়কে থামিয়ে দিয়ে বলে, “শোনো, তোমার ভেতরের মানুষটা কেমন করে কাঁদে।”

যাঁরা এই উপন্যাসকে slow-paced বলে ক্ষুণ্ণ হন, তাঁদের জন্যই এই লাইনটি—

“তুই-ই সেই চিরসত্য”—
तत्त्वमसि (তত্ত্বমসি)।

এই উপনিষদীয় ঘোষণা এখানে যেন আত্মজিজ্ঞাসার অনুরণন। উপন্যাসের ধীর বর্ণনা পাঠককে নিজস্ব স্মৃতি ও যন্ত্রণায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়—তাকে সময়ের পাত্রে বন্দি না রেখে এক স্মৃতির জ্যোতিষ্কক্ষেত্রে চলাফেরার অনুমতি দেয়।

এই ধীরতা, আসলে, এক intentional resistance—যাতে পাঠক স্থির হয়ে দেখতে পারেন নিজেকে, দেশকে, এবং অতীতকে।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে মার্কেস-এর One Hundred Years of Solitude, যেখানে মাকোন্ডো নামক গ্রামে সময় এগোয়, অথচ পিছিয়ে যায়; ইতিহাস ঘোরে চক্রাকারে, অথচ মানুষ থাকে একই যন্ত্রণার কেন্দ্রে।

এই উপন্যাসেও চরিত্ররা যেন কোনও রৈখিক সময়ে বাস করে না। অতীত-পথ-ভবিষ্যৎ একসঙ্গে ধরা দেয় নদীর বুকে নৌকা ভাসানোর মতো—চরিত্রগুলো কোথাও যেন time loop-এর বাসিন্দা।

আর এখানেই রূপকধর্মিতা এসে যায়। নদী এখানে শুধু জলধারা নয়, এক প্রস্থানপথ—যেমন জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে ফেরার কোনো নাও থাকে না। চর বললেই মনে পড়ে চর্যাপদের ভাষা—“চরি চরি যাই চরিয়া”—যেখানে জীবন এক অনির্বচনীয় চলাচল।

শরীর ও প্রেমের বর্ণনাও এখানে রূপক। মালতীর নিঃসঙ্গতা, ফতিমার প্রতারিত আকাঙ্ক্ষা, বা ফেলু শেখের আতর-স্নাত ধর্মচর্চা—সবই যেন এক বৃহৎ অর্থব্যঞ্জনার অংশ।

এই উপন্যাস তাই কেবল গল্প বলে না, গল্পের মধ্যে নিজেকেও বলে—এক অলৌকিক সংবেদনায় গাঁথা মাটি, নদী, শরীর, প্রেম। এর ভাষা ধীরে গড়ায়, যেন মনে করিয়ে দেয়:

“Slow is smooth, smooth is fast.” —(পুরনো ন্যাভি সিলদের কথায় যেমন বলা হয়: ধীরে করো, ঠিক করে করো, তাহলেই তা দ্রুত ও নিখুঁত হয়।)

সবশেষে বলাই যায়, “নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে” এমন এক উপন্যাস, যার গতি অনুভব করতে হলে পাঠককেও হতে হয় নদীর মতো—বহমান, কিন্তু ধীর, অথচ গভীর।

৬. “নীলকণ্ঠ পাখি”: এক পরম রূপক

এই উপন্যাসের সবচেয়ে গূঢ়, সবচেয়ে আধ্যাত্মিক স্তরে যদি পৌঁছাতে হয়, তবে পৌঁছাতে হয় সেই পাখির খোঁজে—যার নাম নীলকণ্ঠ। কিন্তু সে কি কোনও পাখি মাত্র? না, সে হল এক প্রতীক—এক আবছা ঈশ্বরচেতনা, এক অন্তঃস্থ শান্তির আভাস—যা নেই, তবুও আছে।

এই পাখিকে আমরা দেখি না, ধরি না—তবুও সে চরিত্রদের সমস্ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্রে।
সে হল ঈশমের নিঃশব্দ কর্তব্য, মালতীর শূন্য দৃষ্টিপাত, মণীন্দ্রনাথের পাগলামির অন্তর্লীন দার্শনিকতা, ফতিমার ভালোবাসা-হারা আকুলতা, এবং সোনার বিস্মিত শৈশবের অন্তর্গত গান।

এটি সেই পাখি—যাকে আমরা কেবল খুঁজি। যেমন জীবনভর খুঁজি অজানা কোনো স্বদেশ, হারিয়ে যাওয়া শিকড়, এক বাউল-সমান্তরাল চেতনাজগৎ।

“चलो कि चल के बताएं तुम्हें कि क्या होता है
ग़म-ए-वतन से बिछड़ना, ग़म-ए-जुदाई क्या” (চলো তোমায় বুঝিয়ে দিই, দেশ হারানোর ব্যথা কাকে বলে।)
— ফয়জ আহমদ ফয়জ

এই নীলকণ্ঠ পাখি হল সেই দেশ—যা শুধু ভূগোল নয়, এক ভবিষ্যতের ব্যর্থ সম্ভাবনা। এটি হল সেই আত্মা, যা মাটি হারিয়েছে, ঘর হারিয়েছে, ভাষা হারিয়েছে—তবুও গান গাইছে, পাখির ডাক শোনার আশায়।

এই রূপকটির মধ্যে আছে উপনিষদীয় পরমাত্মা-র ইঙ্গিত। যেমন মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে:

“দ্বা সুপার্ণা সযুজা সখায়া…
একঃ ভূঞ্জানঃ অন্যঃ তু পশ্যতি” (দুই পাখি—একটি খায়, একটি দেখে; একটি আত্মা ভোগে, অন্যটি চিরন্তন দ্রষ্টা।)

এই নীলকণ্ঠ সেই ‘দেখা’-র পাখি—যা ভেতর থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে আমাদের অস্তিত্বের সীমানায় দাঁড়িয়ে কেবল জিজ্ঞেস করে—"তুই কোথায়?"

উপন্যাসের শেষের দিকে যখন সোনা লেখে,

“জ্যাঠামশাই, আমরা হিন্দুস্থানে চলিয়া গিয়াছি—ইতি সোনা”—
এই একটি লাইনে গোটা উপন্যাসের হৃদয় দুলে ওঠে।
এ যেন কাদম্বিনী না মরে বেঁচে থাকা নয়—বরং বেঁচে থেকেও বারবার মরে যাওয়া।

যেমন সাদত হাসান মণ্টো লিখেছিলেন—
“Partition was not just a division of land. It was the dismemberment of the human soul.”

এখানেও তাই—নীলকণ্ঠ পাখি কেবল চরিত্রগুলোর নয়, পাঠকেরও inner wound হয়ে ওঠে। সে যেন কবি অমৃত প্রীতমের সেই আর্তনাদ:

"अज्ज आखाँ वारिस शाह नूं…"
(আজ আমি ওয়ারিস শাহকে ডাকি—এই পাঞ্জাবের দরদ শোনার জন্য।)

আমরা যখন এই উপন্যাস পড়ে শেষ করি, তখন সেই পাখির ডাক যেন আমাদের বুকের গভীরে কোথাও শোনা যায়। পাখি দেখা যায় না, কিন্তু রয়ে যায় তার ছায়া—নদীর ধারে, কাশফুলের ফাঁকে, স্মৃতির কান্নার নিচে। আর পাঠক বুঝে যায়—এ বই পড়া মানে শুধু কাহিনি পড়া নয়। এ এক আত্মার যাত্রা, এক চির অন্বেষার আখ্যান, এক “নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজ”।

৭) সমাপ্তি: আত্মার খোঁজে, নীল আকাশের দিকে

শেষে বলি—এই উপন্যাস পড়া যায় না, অনুভব করতে হয়।

চোখ বন্ধ করে, বুকের গভীরে, নদীর শব্দে, মাটির গন্ধে, ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় আর এক চিরন্তন প্রশ্নে জেগে ওঠে—
“নীলকণ্ঠ পাখিটা কই?”

যতবারই পড়ি, মনে হয়—দূরে কোথাও, কুয়াশার কিনারে, কেউ যেন ডাকছে… “কে আছো? কে খুঁজে ফিরো নীল আকাশে?”

এই ডাক কোনও এক চরিত্রের নয়—এ সেই ভাষাহীন বেদনা যা ইতিহাসেরও ভাষা নেই, ধর্মেরও নেই, ভূগোলেরও নয়।

এ হল সেই অবিনশ্বর তৃষ্ণা—এক পরম শান্তির খোঁজে আত্মার নিরন্তর অন্বেষণ।

নীলকণ্ঠ পাখিটা ধরা দেয় না, ঠিক যেমন সত্য ধরা দেয় না, ভালোবাসা ধরা দেয় না— তবুও মানুষ খোঁজে, খুঁজতেই থাকে।

উপন্যাসের এই শেষটুকু যেন জীবনানন্দের সেই পঙ্‌ক্তি হয়ে ওঠে—

“পৃথিবীর পরে আর যদি পৃথিবী থাকে—
যদি আকাশ থাকে, যদি পাখি থাকে—
আমি সেখানে যাব।”

আর আমরাও পাঠক হিসেবে এই উপন্যাস রেখে যাই বুকের ভিতর— না বলা কিছু কথার মতো, একটি নীল পাখির অসমাপ্ত ডানার মতো।

অলমতি বিস্তরেণ।
Profile Image for Sadia Sultana.
3 reviews12 followers
November 1, 2018
পাঠ-অনুভূতি
------------------
বই-নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে
লেখক-অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ-পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রকাশনী-করুণা প্রকাশনী
প্রকাশকাল-১৯৭১

নীলকণ্ঠ পাখি সেই পাখি যে পাখি মানুষকে সারাজীবন ঘুরিয়ে মারে। এই পাখি যেন মানুষের 'কামনা-বাসনার ঘর।' সবার মনেই হয়তো স্বপ্ন থাকে, একদি��� সেই পাখি উড়ে আসবে-পাখি আর আসে না। তবু মানুষের স্বপ্নসাধ জিইয়ে থাকে।

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে' উপন্যাসের চরিত্র মণীন্দ্রনাথও প্রতিনিয়ত সেই নীলকণ্ঠ পাখি খুঁজে চলেন। হঠাৎ হঠাৎ তিনি দুহাত ওপরে তুলে তালি বাজাতে থাকেন-যেন আকাশের কোন প্রান্তে তার পোষা হাজার হাজার নীলকণ্ঠ পাখি হারিয়ে গেছে। তাই তিনি হাতের তালি দিয়ে সেই পাখিদের ফেরানোর চেষ্টা করছেন। মণীন্দ্রনাথের বড় ইচ্ছে, 'জীবনের হারানো সব নীলকণ্ঠ পাখিরা ফিরে এসে রাতের নির্জনতায় মিশে থাক' কিন্তু তিনি এই যে এতো তালি বাজিয়ে চলেন-পাখিরা নামে না।

দেশভাগ নিয়ে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মহাকাব্যিক উপন্যাসের চার পর্ব-নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে, মানুষের ঘরবাড়ি, অলৌকিক জলযান আর এবং ঈশ্বরের বাগান। সম্প্রতি পাঠ করেছি প্রথম পর্ব 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে।' কিছু বই আছে যা ‘ইতিহাসের বিকল্পপাঠ’ হয়ে কালে কালে সমাদৃত হবার মতো। তেমনই এক বই 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে।' সময়কে ধরে রাখার এক অনন্য দলিল এই বইটি পড়ার সময় আমি যেমন বিভোর ছিলাম তেমনি পাঠশেষেও সেই ঘোরগ্রস্ততা থেকে মুক্তি পাইনি।

প্রায় চারশ পৃষ্ঠার এই বইয়ের প্রায় পুরোটা জুড়ে দেশ আর মাটির অলৌকিক সুন্দর বর্ণনা আর বন্দনা। মণীন্দ্রনাথ যখন আকাশ আর দরগার ভাঙা কাচের স্বচ্ছভাব মথিত করে হেসে উঠে সোনাকে বলেন, "নক্ষত্র দ্যাখো-ঘাস-ফড়িং-ফুল-পাখি দ্যাখো, জন্মভূমি দ্যাখো" সেই সময়টাতে আকাশজুড়ে থাকা আলোরস্রোতে প্রিয় জন্মভূমিকে আমিও নতুন করে দেখি।

উপন্যাসের আরেকটি অংশ উদ্ধৃত না করলেই না, "এই যখন দৈনন্দিন সংসারের হিসাব, তখন বৃন্দাবনী দুই মেয়েকে বাংলাদেশের মাটির কথা শোনায়। শরৎকালে শেফালি ফুল ফোটে, স্থলপদ্ম গাছ শিশিরে ভিজে যায়, আকাশ নির্মল থাকে, রোদে সোনালী রঙ ধরে-এই এক দেশ, নাম তার বাংলাদেশ, এদেশের মেয়ে তুমি। এমন দেশে যখন সকালে সোনালী রোদ মাঠে, যখন আকাশে গগনভেরি পাখি উড়তে থাকে, মাঠে মাঠে ধান, নদী থেকে জল নেমে যাচ্ছে, দু'পাড়ে চর জেগে উঠেছে, বাবলা অথবা পিটকিলা গাছে ছেঁড়া ঘুড়ি এবং নদীতে নৌকা, তালের অথবা আনারসের, তখনই বুঝবে শরৎকাল এ-দেশে এসে গেল।"

নিজের দেশের মাটির লাবণ্য, গাছের ডালে-ডালে, ছায়ায়-ছায়ায়, পুকুরের পাড়ে-পাড়ে জীবনের যে বন্দনা; সামসুদ্দিনের মায়ের বাতের ব্যথার জন্য শশীবালা 'ঠাইরেনে'র উদ্বেগে তেলের শিশি দেয়ার দৃশ্যে মানুষে মানুষে ধর্মে-বর্ণে যে মিথস্ক্রিয়া; দুদিন ধরে পেটে ভাত না জোটা জোটন বিবির ধান খেতের জলে-আলের নরম মাটির আশ্রয়ে কচ্ছপের ডিম খোঁজা, শালুক তোলা, গাছতলায় সুপারি খোঁজা, আলকুশী লতার কাঁটার ঝোপ পেরিয়ে পানের পাতা ছেঁড়া, ফকির সাবের সামনে সানকির নুন মেশানো ফ্যান গলা ভাত-এসব দৃশ্যপট কি বানিয়ে বানিয়ে লেখা যায়? পাঠককে কি ভাসানো যায় কাল্পনিক বেদনায়? যায় না। 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে' পড়েছি আর বেদনার চোরাস্রোতে ভাসতে ভাসতে বইয়ের এক একটি চরিত্র ঈশম, জোটন, জালালি, মালতী, ফতিমা, ফেলু, সোনা এদের সাথে এদের প্রিয় জন্মভূমিতে বিচরণ করেছি।

উপন্যাসের ভালো লাগার একটি চরিত্র ঈশম। ঠাকুরবাড়ির বান্দা ঈশম শেখ আগে গয়না নৌকার মাঝি ছিল। ভয়ানক শক্ত সমর্থ শরীর তার যদিও বয়স বাড়ায় এখন আর সে নৌকা চালাতে পারে না, নদীর চরে তরমুজের খেত পাহারা দেয়। লন্ঠনের আলোতে বিল ভেঙে, গ্রাম ডিঙিয়ে সে মুড়াপাড়ায় ধনকর্তা ওরফে চন্দ্রনাথের কাছে তার ছেলে হবার খবর নিয়ে যাচ্ছে। পথিমধ্যে বিলের জমি, গাছগাছালির ভয়ে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। তাকে কানাওলায় ধরে, সে অজ্ঞান হয়ে যায়। 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে' উপন্যাসের এই দৃশ্যপটসহ ফাওসার বিল, গজার মাছের আক্রমণ, গর্ভবতী বোয়াল, তরমুজ খেতের সাদা জোৎস্নায় পৃথিবীর আদি মানব-মানবীর মতো দুজন নর-নারীর ভেসে যাওয়া, সূর্যমুখী ঘা সারাবার বাসনায় ফেলুর জোনাকি ধরা এইসব দৃশ্যপট পড়তে পড়তে মনে হয়েছে যে বইয়ের বাক্য নির্মাণে লেখকের কোনো তাড়াহুড়ো নেই, যে কাহিনী রচনায় লেখকের আছে নিবিড় মমতা, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি সেই বইই তো কালজয়ী হবে।

বইপাঠের শুরু থেকেই ক্ষণে ক্ষণে সোনার পাগলা জ্যাঠামশাইয়ের মতো নীলকণ্ঠ পাখি খুঁজেছি। ১৫ নং পৃষ্ঠায় প্রথম পেয়েছি নীলকণ্ঠ পাখির কথা যাকে সোনার পাগলা জ্যাঠামশাই খোঁজেন অবিরত। মাথা ঠিক না থাকা বড়কর্তা ওরফে মণীন্দ্রনাথ উত্তর চল্লিশের মানুষ, ঋজু শরীর তার। এই মেধাবী মানুষটিকে একদিন দরগার হাসান পীর বলেছিলেন, 'পীর-পয়গম্বর হইতে হইলে তর মত চক্ষু লাগে। তর মত চক্ষু না থাকলে পাগল হওন যায় না, পাগল করন যায় না।' সেই মণীন্দ্রনাথ সত্যিই পাগল হয়েছিলেন। মানসিকভাবে অসুস্থ মণীন্দ্রনাথ যখন উচ্চারণ করেন, 'গ্যাৎচোরেৎশালা' তখন চমকে উঠতে হয়। যতটি দৃশ্যপটে মণীন্দ্রনাথ উপস্থিত হন এই একটি শব্দে অবলীলায় তিনি যেন তার মনের ইচ্ছেটা বা মনের না বলা কথাটা বলে ফেলেন।

একদিন মণীন্দ্রনাথকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে চন্দদের বড় নৌকার মাঝি আবেদালি ছেলে জব্বরকে বলে ঠাকুরবাড়িতে বাড়িতে খবর দিয়ে আসতে যেন তাকে নিয়ে যায়। কিন্তু জব্বর তার বাজান আবেদালিকে উপেক্ষা করে জানায় ঐ বাড়িতে সে যেতে পারবে না কারণ সে লীগে নাম লিখিয়েছে। বাবার মুখের ওপর জব্বর বলে, 'হিন্দুরা আমাগ দেখলে ছ্যাপ ফালায়, আমরা অ ছ্যাপ ফ্যালামু।'

কাহিনীর এই পর্যন্ত এসে স্তব্ধ হয়ে থেকেছি। তখন আবেদালি-জব্বর যেই সময়ে দাঁড়িয়ে আছে সে সময়ে ঢাকায় রায়ট লেগেছে-হিন্দু আর মুসলমানরা জবাই হচ্ছে, কচুকাটা হচ্ছে। মুসলমানরা জবাই হচ্ছে জেনে প্রথমে আবেদালি উত্তেজিত হলেও বড়কর্তা, ধনকর্তা, অন্যান্য গ্রামের হিন্দুর উদারতা, পুরুষাণুক্রমে আত্মীয় সম্পর্ক আবেদালির উত্তেজনা মুছে দিয়েছে। বরং ছেলের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা শুনে সে ছেলের ভাত বন্ধ করে দেবার কথা ভাবে।

রাইনাদী, মুড়াপাড়া, টোডারবাগে হিন্দু আর মুসলমান পাড়ায় এভাবে সুখ-দুঃখে মাখামাখি করে থাকা মানুষগুলোর মাঝে সূক্ষ্মভাবে ধর্ম দেয়াল হয়ে থাকে। ছোট ফতিমা আর সোনাও জানে মুসলমানের মেয়ে ফতিমাকে ছুঁতে নেই। ফতিমার আঁচলে প্রজাপতি বেঁধে দিয়েছিল বলে মা সোনাকে খুব মেরেছিল তাই আরেকদিন ফতিমা সোনাকে ছুঁয়ে দিলে সোনা ভয়ে ভয়ে বলে, 'আমি তরে ছুইয়া দিছি মায়েরে কইস না।' আবার ফতিমাকে আদর করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলেও মালতী তা করে না কারণ মুসলমানের মেয়েকে ছুঁয়ে দিলে তার জাত যাবে।

বিপরীতদিকে ইসলামপ্রীতির জন্য সামু ক্রমে ক্রমে এক গভীর অরণ্যের ভেতরে ডুবে যেতে থাকে আর আকালুদ্দিনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, 'কাফের যত বিনষ্ট হয় তত ভাল না?' আবার কোনো বনবাদাড়ে করবী গাছের নিচে কবরের পাশে বসে থাকা জোটন ভুলে যায়-মাটি কার, হিন্দু না মুসলমানের। এই মাটির ভাগ নিয়েই যতো বিভাজন। তবে বস্তুগত বিভাজন হয় বটে, আত্মার বিভাজন হয় না বলেই তো আজ এতকাল পরেও শুকানো ক্ষত লাখো মানুষের মনে তাজা থাকে। বইটি পড়তে পড়তে বার বার বিচ্ছেদের দেয়ালের দুপাশে থাকা অসংখ্য মানুষের স্নেহসিক্ত চোখমুখ ভেসে উঠে এই উপলব্ধিকে আরো সজল করে তোলে।

আবার যখন মুড়াপাড়ার হাতি লক্ষ্মীর পিঠে চড়ে সোনার পাগলা জ্যাঠামশাই নিরুদ্দেশ হতে চান, যেতে চান পলিনের খোঁজে, হেমলক গাছের কাছে তখন ভীষণ কৌতূহলী হয়ে উঠতে হয় পলিন কে কিংবা কী করে জ্যাঠামশাই পাগল হলেন তা জানার আগ্রহে। জানতে ইচ্ছে হয় কেন স্মৃতি জাগ্রত হতে হতে মণীন্দ্রনাথ হঠাৎ পলিনের দেশে যাবার জন্য হাতির পিঠে উঠে হামাগুড়ি দিতে চাইছিলেন? মণীন্দ্রনাথ যখন সবাইকে এমন মানসিক দোলাচলে রাখেন তখন গ্রামের সর্বত্র, গাছে-গাছে, মাঠে মাঠে সামসুদ্দিন পাকিস্তান জিন্দাবাদ, নারা���়ে তকদির ইত্যাদি ইস্তোহার ঝুলাতে থাকে। গাছে ঝুলানো ইস্তেহার আর হাতি ঘিরে থাকা সবার আনন্দ-আগ্রহ এই বিপরীতমুখী দৃশ্য দেখতে দেখতে মালতী কেঁদে বলতে চায়, ‘সামু, তুই দেশটার কপালে দুঃখ ডাইকা আনিস না।’

মালতীর স্বামী রায়টে মারা গেছে। শরীরী হাহাকার আর মনোবেদনায় অকাল বিধবা মালতীর বুকের ভেতরে যখন এক সুখপাখি 'কাইন্দা কাইন্দা মরে', আবেদালি-জালালির ঘরে আগুন লাগে কিংবা ক্ষুধার্ত জালালি যখন মালতীর হাঁসাকে চুরি করে সেদ্ধ পোড়া মাংস নুন লংকাতে ভেজে খেয়ে হাঁসার পালক তুলে অশ্বথের নিচের ঝোপ-জঙ্গলে ছড়িয়ে রেখে আসে তখন বুকের অতলের দুঃখের তোরঙ্গ খুলে যায়।

শুধু সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব নয় এই উপন্যাসে বেশ কয়েকটি চরিত্র ঘিরে নারী-পুরুষের পারস্পরিক জৈবিক আকর্ষণ বা তাড়নার কথা এসেছে। বয়সন্ধিঃকালে নিজের বয়সের সাথে সোনার যুদ্ধ আর সন্ধির কথা এসেছে। জেনেছি গভীর গোপনে বা প্রকাশ্যে মানুষ জৈবিকতাকে কত ভাবেই না লালন করে। মানুষের মনোজগতে বিচরণ করে বিধবা মালতী-রঞ্জিত, জোটন-ফকিরসাব, আবেদালি-জালালি চরিত্রগুলোকে জীবনের বিচিত্র রঙে নির্মাণ করে সেই বৈচিত্র্যই দেখিয়েছেন এই শক্তিশালী লেখক।

এভাবে বিভিন্ন চরিত্রের কলরবে উপন্যাসের কাহিনী যতো এগোয় সারাদেশের মতো গ্রামে-গ্রামে সবার মনে বাড়তে থাকে দ্বিধাদ্বন্দ্বের চারাগাছ। ধর্ম বিপন্ন-সেই ইস্তেহার নিয়ে ধীরে ধীরে গাঁথা হতে থাকে মানুষে মানুষে বিভেদের দেয়াল, বাড়ে সামসুদ্দিনের মতো মানুষের মনে বিদ্বেষ। তারপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চূড়ান্ত পর্যায়ে একদিন এখানেও আসে দেশভাগের খবর। সারাদেশের মানুষের ঘরবাড়ি আর আবেগমথিত মাটির ওপর দিয়ে রাডক্লিফ লাইন বিভাজনের সীমান্তরেখা টেনে দেয়। ধর্মীয় সহিংসতা, সীমান্ত পারাপারে মারা যায় লাখো মানুষ। বাস্তুচ্যুতও হয় অসংখ্য মানুষ।

নিজেদের বাস্তুভিটে ছেড়ে যাবার দিন সোনা যেই ধারালো ছুরির সাহায্যে নিরুদ্দিষ্ট জ্যাঠামশাইয়ের জন্য ঠাকুরবাড়ির অর্জুন গাছের কাণ্ডের ছালবাকল কেটে লিখে রেখে যায়-‘জ্যাঠামশাই আমরা হিন্দুস্তান চলিয়া গিয়াছি, ইতি সোনা’ ঠিক তেমনই এক ছুরি দিয়ে যেন হিন্দু-মুসলমানের এক দেশ দু’টুকরো হয়ে যায়। আর সারাদেশের মতো সোনাদের গ্রামেও ফুটে ওঠে দেশভাগের বুকচেরা ছবি।

দুই খণ্ডে বিভক্ত উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডের এই অংশে আছে শতশত মানুষের ভিটেবাড়ি ছাড়ার করুণ চিত্র। অর্জুন গাছের কাণ্ডে সোনার খোদাই করা এক লাইনের বাক্যটি পড়ে বহুক্ষণ আমার পরবর্তী পাঠ এগোয়নি। সত্যি 'জ্যাঠামশাই, আমরা হিন্দুস্তান চলিয়া গিয়াছি' বাক্যটিকে দেশভাগের সবচেয়ে নির্মম শিলালিপি মনে হয়েছে।

এত বড় মাপের উপন্যাসের কোনো খুঁত ধরার ধৃষ্টতা দেখাতে চাই না। তবে একটা পর্যায়ে উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র মালতী আর পছন্দের চরিত্র জোটনের দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিতিতে বেশ অতৃপ্তি লেগেছে। এদের কথা আরও পড়তে মন চাচ্ছিল। কিন্তু বিপর্যস্ত মালতী আর লক্ষ লক্ষ শয়তানকে কলা দেখিয়ে মালতীর অনাকাঙ্ক্ষিত ভ্রুণ নষ্ট করার পাপের জন্য কাঁদতে থাকা জোটনকে পরে আর সেভাবে খুঁজে পাইনি। যদিও একেবারে শেষের দিকে রিফিউজি মালতীকে পাই নতুন করে যে পুনরায় কদর্য মানুষের লালসার শিকার হতে গিয়ে উল্টো শিকারির রক্তের নোনা স্বাদ নিজের ঠোঁটে মেখে নেয়।

এই উপন্যাসের অন্যতম শক্তিশালী অংশ এর সমাপ্তি। দেশভাগের সাথে সাথে মানুষের বুকে যে অন্তহীন রক্তক্ষরণের উৎসমুখ খুলে গিয়েছিল তার নির্মম ইঙ্গিত দিয়েই যেন শেষ হয়েছে 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে।’

বহু বছর পরে এই একটি বই গভীরভাবে আমাকে আচ্ছন্ন করেছে। আর আমাকে আমার অপরূপ জন্মভূমিকে নতুন করে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, দেখিয়েছে শত শত মানুষের জন্মভিটে হারানোর দগদগে ক্ষত, জানিয়েছে আত্মিক বন্ধনে বাঁধা অজস্র মানুষের অবয়বহীন আর নিবিড় ভালোবাসার কথা।
Profile Image for Pranta Biswas.
122 reviews4 followers
December 9, 2023
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পটভূমিতে রচিত বিখ্যাত উপন্যাস। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারটি উপন্যাস নিয়ে রচিত 'দেশভাগ' সিরিজের প্রথম বই এটি। পুরো বইয়ের শেষের ১৫-২০ শতাংশে মূলত রয়েছে দেশভাগের কাহিনী। আর বাকি অংশ জুড়ে শুধু নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজার থানার রাইনাদি গ্রাম। সেই গ্রামে আছে এক ঠাকুর বাড়ি। সেখানে আছে 'শ্রী অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক' ওরফে 'সোনা বাবু' আর তার পাগল জ্যাঠামশাই। আরো আছে ঠাকুর বাড়ির বাকি সদস্য চন্দ্রনাথ, শচীন্দ্রনাথ, ভূপেন্দ্রনাথ, বড়বৌ, ধনবৌ। ঠাকুর পরিবারের বাইরে উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের মধ্যে মালতী, জালালী, জোটন, ফেলু, সামসুদ্দিন, জব্বর, আন্নু উল্লেখযোগ্য। মোটামুটি রাজনৈতিক উপন্যাস কম, সামাজিক উপন্যাস বেশি মনে হয়েছে।

পাঠক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে দ্রুত গতির কাহিনী সম্বলিত বই বেশি পছন্দ। মূল ঘটনার আশেপাশের বর্ণনা তাই অনেকক্ষেত্রে একঘেয়ে লেগেছে। প্রথমার্ধ পড়তে তাই দুই সপ্তাহের বেশি সময় লেগেছে। সচেতনভাবেই বর্ণনা এড়িয়ে গেছি বইয়ের অর্ধেকের পর থেকে। ব্যতিক্রম যে নেই তা না, এই যেমন কেয়াপাতার নৌকা, অপরাজিত, শ্রীকান্ত এগুলোও প্রচুর বর্ণনাবহুল, কিন্তু সেগুলো অতটা একঘেয়ে মনে হয়নি। বরং বর্ণনাগুলোই যেনো বইগুলোতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলো।

ঐতিহাসিক এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে রচিত উপন্যাসের মধ্যে আমার পড়া তৃতীয় এটি। প্রথম ও দ্বিতীয় যথাক্রমে কেয়াপাতার নৌকা ও শতধারায় বয়ে যায়। তবে প্রফুল্ল রায়-এর 'উত্তাল সময়ের ইতিকথা' সিরিজের প্রথম দুটি উপন্যাসের কাহিনী প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে একটি নির্দিষ্ট পরিবারের চতুর্দিকেই যেভাবে আবর্তিত হয়েছিলো, 'নীলকন্ঠ পাখির খোজে' উপন্যাসে সেরকমটা ছিলো না। তাছাড়া 'শতধারায় বয়ে যায়' এর পুরো কাহিনীজুড়েই ছিলো তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর ভারতে চলে যাওয়ার পরবর্তী চিত্র। কিন্তু অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসে লেখক দেশভাগের পর পুর্ব-পাকিস্তান থেকে হিন্দুস্থানে চলে যাওয়া মানুষের পাশাপাশি পূর্ব-পাকিস্তানে রয়ে যাওয়া মানুষদের অবস্থার চিত্রও তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
Profile Image for Damini.
130 reviews86 followers
July 18, 2020
অনেকটা সময় লাগলো বইখানা শেষ করত। শুরু করেছিলাম অনেক প্রশংসা শুনে এবং অনেকখানি প্রত্যাশা নিয়ে। প্রথমভাগেই হোঁচট। যে বই গোগ্রাসে গেলবার অভিপ্রায় নিয়ে শুরু করেছি তার এক একটা পৃষ্ঠা পড়ে শেষ করতেই এত বেশি সময় লাগছিলো যে ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেছে বারবার। কিন্তু কেন জানিনা পড়া বন্ধও করে দিতে পারিনি। প্রাকৃতিক বর্ণনার আতিশয্য কখন যেন উপন্যাসের চরিত্রগুলির জীবন কাহিনীর পরিপূরক হয়ে উঠেছ। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসের প্রতিটি পর্যায়ে মনকেমন আর ভালোলাগা একইসাথে জড়িয়ে রাখে পাঠককে। কেন এমন হলো আর কি হতে পারতো সে ভাবনা উপন্যাসের চরিত্রদের মতো আকুল করে পাঠক হৃদয়কেও।
Profile Image for Sweta Bose.
84 reviews3 followers
March 11, 2022
কিছু কিছু বইয়ের কোনো পাঠ প্রতিক্রিয়া হয়ে না, যেমন এই বই টি। শুধু পড়ার পর মনে একটি আবেশ ছড়িয়ে থাকে যাকে বর্ণনা করা যায়না।
Profile Image for Shuvescha De.
40 reviews2 followers
June 29, 2021
কোন বই যদি সহজ পাঠ্য হয়, তবে এই বইটি অবশ্যই স্নিগ্ধ পাঠ্য। বই এর পরতে পরতে আছে সোনালী বালির মাঠ, নদীতীর, ফসলের মাঠ আর এমন একটা সময়ের চিত্র যখন সমস্ত গ্রামটা ছিল একটা পরিবারের মত, যেখানে হিন্দু মুসলিম ছিল একই পরিবারের সদস্য। অসম্ভব মেধাবী ঠাকুর পরিবারের বড় ছেলে মনীন্দ্র নাথ যখন পাগল হয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়াত, হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষ সমাদরে তাকে দিত নিজ গাছের ফল বা ফসল। গ্রামের তারকা ফুটবলার ফেলু যখন খেলায় জিতে ফেরত সমস্ত গ্রাম গল্পে মুখর হয়ে উঠত। ঠাকুর পরিবারের বিশ্বস্ত ভৃত্য ঈশম শেখ দশমীর দিন যেভাবে লাঠি খেলা দেখাতো অন্য কোন উৎসবেই সে এমন ত্তৃপ্তি পেতোনা। বিধবা মালতীর জন্য মন কেমন করে উঠতো মুসলিম লীগ করা সামুর। সেই গ্রামেই একদিন লাগলো দাঙ্গার আঁচ, দেশভাগের আগুন। বিধবা মালতি মুসলমান যুবকের অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত হলে তার নিজের ভাই নিরেন দাস যখন তাকে অনাদর করতে থাকলো সে ঠাই পেল অনাত্মীয় মুসলিম জটনের ঘরে! সেই জটন যে কিনা তিনবার বিয়ে করলেও তার যৌবন যায়নি এখনো। পাগল ঠাকুর, সোনার পাগল জেঠামশাই পানিতে ডুবে যাওয়া মুসলিম নারীর শব অবলীলায় উদ্ধার করে নিয়ে চলে এল কিংবা ছোঁয়াছুঁয়ি এর বাছবিচার ভুলে ফতিমার হাতে গপগোপ করে খেয়ে নিলেন এক হারি মিষ্টি। এভাবে দেশভাগ হলো একদিন। সোনা তার হারিয়ে ফেলা পাগল জেঠামশাই কে রেখেই দেশ ছেড়ে চলে গেল। অর্জুন গেছে লিখে রেখে গেল, " জেঠামশাই আমরা হিন্দুস্তান চলিয়া গিয়াছি"। রেখে গেল প্রিয় ঈশম শেখকে, খেলার সাথী ফতিমাকে। আর রেখে গেল নিজের দেশ। ঈশম শেখ যে এতদিন ঠাকুরবাড়ির জমিতে নিশ্চিন্তে ঘর তুলে আর লাল তরমুজের আবাদ করে দিন চালাতো, ঠাকুরবাড়ি জমি বেচে চলে গেলে সে এক লহমায় হয়ে গেল জমিহীন। দেশ না ছেড়েও সে যেন কিভাবে দেশভাগের কবলে পড়ে গেল!

আমি থ্রিলার পড়লেও এই বইটি এক মুহুর্তের জন্যও আমার বিরক্তিকর মনে হয়নি। প্রকৃতির মনোরম বর্ণনা, চরিত্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক আর বন্ধন, সময়ের স্রোতে সেই সম্পর্কের পালাবদল, দেশভাগের বাতাবরণে সমাজের পরিবর্তন লেখক অনবদ্য ভঙ্গিমায় তুলে এনেছেন।

নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ আর ক্লাসিক উপন্যাস নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে। পাগল মানুষ তার হারানো ভালোবাসার মানুষের চোখে খুঁজে বেড়ায় সেই নীলকন্ঠ পাখি, বড়বৌ পাগল মানুষের ভালোবাসার মাঝে খোঁজে সেই একই নীলকন্ঠ পাখি। ছোট্ট সোনা, দেশভাগের সাথে বড় হতে থাকা সোনা আর ফতিমা যাদের একজন নিজ দেশ ছেড়েছে আরেকজন ছাড়েনি দুজনেই যেন সেই দেশের মাঝেই খুঁজে বেড়ায় নীলকন্ঠ পাখি!
Profile Image for Momin আহমেদ .
112 reviews49 followers
March 11, 2020
দ্বিতীয় খণ্ড অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়েছি পুরতা।কোথাও সামান্য বিরক্ত লাগেনি।প্রথম খণ্ড পড়ার পর যে অভিযোগ করেছিলাম দ্বিতীয় খণ্ডে তা একদম উধাও হয়ে গেছে।সমাপ্তি টা অনেক ভালো লেগেছে।একটুও নাটকীও লাগেনি।
6 reviews2 followers
September 11, 2020
অনেকদিন পর একটানা সম্পূর্ণ একটা সিরিজ শেষ করলাম।
Profile Image for Asif Khan Ullash.
143 reviews8 followers
September 2, 2023
নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে- অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ক্ল্যাসিক বাংলা উপন্যাস। উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় দেশভাগ অনেকেই বলে, তবে মূলত উপন্যাসটি দেশভাগের পূর্বের সময়কে ধারণ করেই লেখা। দেশভাগের বিষয়ও এসেছে তবে ধীরে ধীরে এবং সেটাই উপন্যাসটিকে দেশভাগ নিয়ে লেখা অন্যান্য উপন্যাস থেকে অনেক আলাদা করে দিয়েছে। হুট করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা যে শুরু হয়নি, দীর্ঘ একটা কাল যাবৎ বীজ অংকুরিত হয়ে ধীরে ধীরে একসময় মহীরুহতে পরিণত হয়েছে সেটা লেখক সফল এবং খুবই স্মুথলি তুলে আনতে পেরেছেন। এই উপন্যাসে দেশভাগকে হুট করে উড়ে এসে জুড়ে বসা আপদ মনে হয়না, এখানে দেশভাগ, তমরা-আমরা ক্যান্সার সেলের মত নিঃশব্দে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ভারতবর্ষের মাটিতে। উপন্যাসের শুরু অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক তথা সোনার জন্মলগ্ন থেকে আর শেষ ও বলতে গেলে সোনার আরেক জন্মের মাধ্যমেই।

এই বইটি অতীনবাবুর দেশভাগ সিরিজের প্রথম বই। পুরো সিরিজের মূল চরিত্র হয়তো সোনা কিন্তু নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে বইয়ের মূল চরিত্র সে নয়। বস্তুত, কোন ব্যক্তি চরিত্রকে আধার করে লেখক উপন্যাসের বিস্তার ঘটাননি। তিনি চেয়েছেন কিছু চরিত্রকে সম্বল করে পূর্ব বাংলা, বাংলাদেশের মানুষদের তুলে ধরতে। বলাই বাহুল্য লেখক তার অভীষ্টে শতভাগ সফল।

নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাসে অতীন বন্দ্যোপাদ্যায়ের উপমার ব্যবহার, প্রকৃতির বর্ণনা, চরিত্রায়ন সবকিছু ছাপিয়ে আমার সবচেয়ে মনে ধরেছে তার ‘ওয়ার্ল্ড-বিল্ডিং’, অতীনবাবু পূর্ববাংলার গ্রামের চিত্র এঁকেছেন খুবই বাস্তবতার আবরণে কিন্তু জায়গাটাই জাদুবাস্তব কিনা তাই এখানে জালালিরা গজারের গুতো খেয়ে মরে ভেসে থাকে, ফকির সাবেরা রাতারাতি মরে পীর হয়ে যায়, ফেলু শেখ আগুনের গোলা হয়ে ছুটে বেড়ায়, মণীন্দ্রনাথেরা আজীবন নীলকন্ঠ পাখি খুঁজে বেড়ায়।

বইয়ের অন্যান্য পর্বগুলোর রিভিউ সুবিধার না। এই বইতেই কেস ডিসমিস করে দিলে ব্যাপারটা পারফেক্ট হইতো মনে হয়। ইশম শেখ দিয়ে শুরু হয়ে ইশম শেখেই শেষ হইলে বেশ একটা পরিপূর্ণ জীবন চক্রের মত ব্যাপার হইতো। এই সিরিজের বাকি বইগুলো মনে না ধরলে এটাকে স্ট্যান্ড-অ্যালোন হিসেবেই বিবেচনা করবো।

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের এটা আমার পড়া দ্বিতীয় লেখা এর আগে তার একটা ঈষৎ হরর ছোট গল্প পড়ছিলাম ভালো লাগছিল কিন্তু সেই ছোটগল্পে তার ভাষা ব্যবহারের মুন্সিয়ানা বোঝা যায় নাই। এই উপন্যাসে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার রূপ পূর্ণ মহিমায় উপস্থিত। তবে দ্রুতগতির কাহিনী, গল্প, জমজমাট রোমাঞ্চ আশা করলে হতাশ হতে হবে। উপন্যাসটি যথেষ্ট ধীর কিন্তু লেখনীর গুণে এর আকার এবং গতি কোন বাধার সৃষ্টি করতে পারেনা।

গল্পের গাঁথুনি, চরিত্রায়ন, লেখনী, পরিণতি, ভাষার ব্যবহার সবদিক দিয়েই; মাস্টারপিস!
Profile Image for Yeasmin Nargis.
177 reviews1 follower
December 2, 2025
মনটা এক বিষন্নতায় ভরে আছে, পরে কখনও বিস্তারিত রিভিউ লিখবো।
Profile Image for Sanowar Hossain.
281 reviews25 followers
November 7, 2022
'ঈশম বলেছিল, সাদা জ্যোৎস্নায় যখন বালির চরে পাতার ভিতর তরমুজ ভেসে থাকে এবং নদীতে যখন রাতের পাখিরা নাম��ে শুরু করে, দূরের মসজিদে আজান শুনলে তখন তার দু'হাত উপরে তুলে কেবল দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। তার ঘুম আসে না চোখে। সে সেই এক জগতের মায়াতে জড়িয়ে যায়। নির্জন মাঠে তার তখন কেবল মনে হয়, আল্লা এক, তার কোনও শরিক নেই।'

দীর্ঘ দুইশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের পর 'স্বাধীনতা' শব্দটি পাক-ভারত উপমহাদেশের মানুষের কাছে বহু আরাধ্যের বিষয়ে পরিণত হয়। এই স্বাধীনতা প্রাপ্তির পাশাপাশি হারাতে হয়েছে আরো অনেক কিছু। নিজ ভিটা ছেড়ে অন্য ভূমিতে উদ্বাস্তু হিসেবে বসবাস কিংবা দীর্ঘদিনের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার যন্ত্রণা শুধু তারাই বোঝে, যারা এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছে। আশ্চর্য এক পাখি নীলকন্ঠ। উপন্যাসটিতে সেই রূপক নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে অসংখ্য চরিত্রের আনাগোনা দেখা যায়। লেখক নিজেও দেশত্যাগ করেছিলেন; সেই আত্মপরিচয়ের বয়ানই যেন এই উপন্যাস।

পূর্ববঙ্গের শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা গ্রামের অভিজাত ঠাকুর পরিবারকে নিয়ে কাহিনি গড়ে উঠেছে। পুরো এলাকায় ঠাকুর পরিবারের বেজায় প্রভাব। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে তাদের কর্তা জ্ঞান করে। ঠাকুরবাড়ির বড় ছেলে মণীন্দ্রনাথ মানসিকভাবে অসুস্থ। পিতার একটিমাত্র মিথ্যা কথা তার জীবনকেই শেষ করে দিয়েছে। মেজো ছেলে ভূপেন্দ্রনাথ ও সেজো ছেলে চন্দ্রনাথ মুড়াপাড়ার বাবুদের কাছারিতে চাকরি করে। ছোট ছেলে শচীন্দ্রনাথ ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। বড় ও সেজো ছেলের সন্তানও রয়েছে। গ্রাম বাংলার চিরচেনা একান্নবর্তী সাজানো সুখের সংসার। তবে বড় ছেলে মণীন্দ্রনাথ পাগল হওয়াতে সকলেই তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে। কয়েকদিন পরপরই নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, আবার ফেরত আসে। এদিকে পাগল মানুষের আশায় বড় বৌ পথ চেয়ে বসে থাকে। ছাত্রজীবনে পলিন নামের এক ইউরোপীয় মেয়েকে ভালোবেসেছিল মণীন্দ্রনাথ। কিন্তু ধর্মের বাহিরের কোনো মেয়েকে ঘরের বউ মেনে নিতে পারেন নি বুড়ো কর্তা মহেন্দ্রনাথ। মিথ্যা অসুখের দোহাই দিয়ে জরুরিভাবে মণীন্দ্রনাথকে বাড়ি এনে বিয়ে দিয়ে দেন অন্য এক মেয়ের সাথে এবং কিছুদিন পর পাগল হয়ে যায় বড় ছেলে। চারদিকে শুধু যেন পলিনকেই খুঁজে ফেরে পাগল ঠাকুর। আর নিজ বংশের সম্মান বজায় রাখতে গিয়ে ছেলের এমন অবস্থার জন্য প্রতিনিয়ত অপরাধবোধের বিষে জর্জরিত হন বুড়ো কর্তা।

ঠাকুর বাড়ির কাজের লোক ঈশম শেখ। দীর্ঘদিন যাবত ঠাকুর বাড়িতে কাজ করার সুবাদে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও তাদের আত্মীয়তে পরিণত হয়েছে। আগে গয়না নৌকার মাঝি ছিল। এখন বয়স হয়েছে। তাই আর নৌকার কাজ করেনা। বাড়িতেই কাজকর্ম করে এবং রাতে চরের মধ্যে তরমুজ ক্ষেত পাহারা দেয়। উপন্যাসের শুরুতেই ঈশম শেখকে দেখা যায় রাতের বেলা মুড়াপাড়ায় সেজো ঠাকুর চন্দ্রনাথকে তার দ্বিতীয় পুত্র জন্মানোর খবর দিতে যাচ্ছে। পথিমধ্যে কানাওলার কবলে পড়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে ঈশম শেখ এবং উল্টোপথে বাড়ি আসার সময় চন্দ্রনাথ আবিষ্কার করে তাকে। ঈশম শেখের বাড়িতে এক পঙ্গু স্ত্রী ব্যতীত আর কেউ নেই। ঠাকুরবাড়িতেই তার সবকিছু।

চন্দ্রনাথ ও ধনবৌ দম্পতির দ্বিতীয় পুত্রের নাম রাখা হয় অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক। ডাকনাম 'সোনা'। সোনাকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের বেশিরভাগ কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। সোনার বড় ভাই লালটু ও বড় জ্যাঠার ছেলে পলটুর সাথে তার শৈশবের দিনগুলো ভালোই কাটে। সোনার মুখের আদল অনেকটা বড় জ্যাঠামশায়ের মতো এবং তার বেশ ন্যাওটা। সবসময় কাছাকাছি থাকতে চায়। জ্যাঠামশাই হারিয়ে গেলে সেইই যেন সবার আগে খুঁজতে বের হয়ে পড়ে। সোনার ছোটবেলায় আশ্বিন মাসে পাগল ঠাকুর তাকে হাসান পীরের দরগায় রেখে এসেছিল। এদিকে তাকে না পেয়ে বাড়ির সবার পাগল হওয়ার জোগাড়। সেই সোনাকে পাহারা দিয়ে রেখেছিল একটি কুকুর; যাকে আশ্বিনের কুকুর নাম দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর লালটু-পলটুরা পূজা দেখতে মুড়াপাড়ায় বাবুদের বাড়িতে গেলেও সোনা যেতে পারেনা। একটু বড় হওয়ার পর প্রথমবার সোনা মুড়াপাড়া যায় পূজা দেখতে। মায়ের থেকে দূরে যাওয়ার কষ্ট যেন, নতুন পরিবেশ দেখার আনন্দে মিলিয়ে যায়। সোনা, লালটু, পলটু ঈশম শেখ নৌকায় মুড়াপাড়া যায়। কিন্তু পাগল ঠাকুর ও আশ্বিনের কুকুর নদী সাঁতরেই সেখানে পৌঁছে যায়। পূজা উপলক্ষে সোনারা সেখানে কিছুদিন থাকে এবং পরিচয় হয় অমলা-কমল নামের দুই বোনের সাথে। সম্পর্কে ওরা সোনার পিসি। অমলের সাথে সম্পর্কের গভীরতায় এত ছোট বয়সেই এমন এক কাজ করে ফেলে যা সোনাকে সবসময় পাপবোধে বিদ্ধ করে।

ঠাকুরবাড়ির ভেতরের গল্প রেখে এখন বাইরে আসা যাক। হিন্দু-মুসলিম পাশাপাশি দীর্ঘদিন বসবাস করলেও পাকিস্তান আন্দোলনের জোয়ার এখানে এসেও লেগেছে। তারই প্রভাবে মুসলিম লীগে নাম লেখায় সামসুদ্দিন ওরফে সামু। লীগের ইস্তেহার গাছে সাঁটানো নিয়ে বাল্যবন্ধু মালতীর সাথে বচসাও হয়ে যায়। সামু চায় পাকিস্তান হোক; অন্যদিকে মালতীর বক্তব্য দেশটা শুধু সামুদের নয়। সামুর মেয়ে ফতিমা সোনার বয়সী। ফতিমা ও সোনা একইসাথে খেলাধুলা করলেও কেউ কাউকে ছোঁয় না ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে। সোনাকে একবার ফতিমা ছুঁয়ে দিয়েছিল এবং মায়ের কাছে লুকিয়ে মার খেয়েছিল; তাই দূরে থাকাটাই তাদের কাছে নিরাপদের।

নরেন দাসের বিধবা বোন মালতী। ঢাকার দাঙ্গায় তার স্বামী নিহত হওয়ার পর ভাইয়ের বাড়িতেই তার বসবাস। স্বামীর অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে তার দিন কাটে। তবে তারও একসময় ভালোবাসার মানুষ ছিল। পাগল ঠাকুরের শ্যালক রঞ্জিতকে সে পছন্দ করতো। রঞ্জিত স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকায় বেশিদিন একজায়গায় থাকেনা। একদিন হুট করেই নিরুদ্দেশ হয়ে যায় রঞ্জিত। তার কোনো খোঁজ পায় না মালতী। আত্মসম্মানবোধের কারণে কাউকে ভালোমতো জিজ্ঞাসাও করতে পারেনা রঞ্জিতের কথা। রঞ্জিত যেন মালতীর কাছে একটি সেলফিশ জায়ান্ট!

আবেদালি ও জালালির সংসারে পরগাছার মতো পড়ে রয়েছে জোটন। কয়েকবার বিয়ে হলেও বেশিদিন স্বামীর ঘর করতে পারেনা। কাউকে দেখলেই বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতে বলে। এবার এক ফকিরসাবের সাথে তার ভাব হয়েছে। ফকিরসাব বলেছে কোরবান শেখের সিন্নি থেকে আসার পর জোটনকে নিয়ে যাবে। কিন্তু ফকিরসাব আর ফিরে আসেনা। ফকিরের পথ চেয়ে জোটন দিন পার করে অথচ শরীরের চাহিদা মেটায় মনজুরকে দিয়ে।

ফেলু শেখ নামকরা কাবাডি খেলোয়াড় ছিল। ঐ অঞ্চলে এমন কেউ ছিল না যে তাকে আটকে রাখতে পারে! এক ব্যবসায়ীর সুন্দরী স্ত্রীর প্রতি আকর্ষিত হয়ে সেই ব্যক্তিকে কোরবানির চাকু দিয়ে জবাই করে পাটক্ষেতে ফেলে রাখে। কিছুদিন পর ঘরে আসে আন্নু বিবি। কিন্তু এই আন্নু বিবিও হাতছাড়া হওয়ার জোগাড়। পাগল ঠাকুর পাগলা হাতি চালিয়ে ফেলুর হাত ভেঙে দিয়েছে। সেই হাতে আর জোর পায়না। এই সুযোগে আন্নু বিবি ভাব জমায় লীগের পান্ডা আকালুদ্দিনের সাথে। তাই আকালু ও পাগল ঠাকুরের প্রতি ফেলুর অনেক রাগ। সবকিছুই যেন ফেলুর কাছে 'হালার কাউয়া' রূপে দৃষ্টিগোচর হয়।

মেলার মধ্যে এক মুসলিম যুবকের এক হিন্দু মেয়ের শরীরে হাত দেওয়া এবং মন্দিরের পাশে মসজিদে নামাজ পড়া নিয়ে দুইবার দাঙ্গা যেন দেশভাগ পূর্ববর্তী সময়ের চিত্রায়ণ। পান থেকে চুন খসলেই লাঠি-সোঁটা নিয়ে দুইদিকে দাঁড়িয়ে পড়ে সবাই। মুসলিমরা দীর্ঘদিন যাবত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হওয়াতে হিন্দুদের আধিপত্য মেনে নিতে পারছিল না। তাই তারা পাকিস্তান আন্দোলনকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। এদিকে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের অবস্থা খারাপ হচ্ছিল। কারণ পাকিস্তান হয়ে গেলে তাদের প্রভাব নষ্ট হয়ে যাবে। জান-মান নিয়ে বাঁচা কষ্টকর হয়ে যাবে এই ভয়েই দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয় অ���িকাংশ হিন্দুরা।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি যখন অবধারিত হয়ে গেল, তখন পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের মধ্যে দেশত্যাগের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। নিজ ভূমি হওয়া সত্ত্বেও এখানে নিরাপত্তা ছিল না। অস্থির এক সময়ের মধ্যেই পানির দামে ভিটে-মাটি বিক্রি করে চলে যায় ভারতে। দেশভাগের আগে হিন্দুদের যে প্রভাব ছিল, সেটাও খর্ব হয়। যা আমরা দেখতে পাই ঠাকুরবাড়ির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সামসুদ্দিন-আকালুদের উত্থানে। তবুও আভিজাত্যের খাতিরে তারা সামনাসামনি কখনো ঠাকুরবাড়ির মানুষকে অসম্মান করেনি।

ঈশম শেখের মধ্যে প্রভু ভক্তের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা বিরল। মনিব ভিন্নধর্মের হলেও তাদের ধর্ম রক্ষায় সবসময় সচেষ্ট ছিল সে। মেলায় যে দাঙ্গা হয়েছিল, সেই দাঙ্গায় সোনাদের খুঁজে না পেয়ে যেন পাগল হয়ে গিয়েছিল ঈশম। পরে বাড়িতে এসে যখন সোনাদের নিরাপদ পায়, তখন হাপ ছেড়ে বাঁচে।

আশ্চর্য এক চরিত্র মণীন্দ্রনাথ। যার মুখে শুধু একটাই কথা 'গাৎচোরেৎশালা'। পলিনকে না পাওয়ার দুঃখে অপ্রকৃতস্থ হয়ে যাওয়া সকলের কাছে পাগল ঠাকুর হলেও বড় বৌয়ের নিকট দেবতাতুল্য। সারাদিন কাজের ভিড়ে থাকলেও বড় বৌয়ের মন পড়ে থাকে এই পাগল লোকটির কাছে। যখন নিরুদ্দেশ হয়ে যায় তখন আর রাতে ঘুম আসেনা বড় বৌয়ের।

উপন্যাসটিতে ঘুরেফিরে নীলকন্ঠ পাখির কথা উঠে এসেছে। বইটার নামকরণও এই পাখির নামেই করা হয়েছে। তবে এই উপন্যাসে নীলকন্ঠ পাখি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষের না পাওয়া কিংবা আকাঙ্ক্ষার বস্তুগুলোকেই লেখক নীলকন্ঠ পাখি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন; যার পেছনে ফিরে মানুষ তার সারাজীবন কাটিয়ে দেয়।

উপন্যাসটির অনন্য বৈশিষ্ট্য এর অসাধারণ প্রকৃতির বর্ননা। জোনাকি পোকা মানুষের গায়ে সেঁটে দিলে রাতের বেলায় যে ভৌতিক আবহের সৃষ্টি করে তা লেখক দারুণভাবে উপস্থাপন করেছেন। সোনা কিংবা মণীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে প্রকৃতির যে বর্ননা দিয়েছেন লেখক তা গ্রাম বাংলার চিরাচরিত প্রকৃতিকে তুলে ধরে। প্রকৃতির মাঝেই মণীন্দ্রনাথ পলিনকে খুঁজে পায় এবং তার বিশ্বাস পলিন একসময় ফিরে আসবে। জ্যোৎস্নার রাতে তরমুজ ক্ষেতে ঈশম শেখ পাহারা দেওয়ার সময় যে নৈসর্গিক দৃশ্যের অবলোকন করেছে তা পড়ার সময়ই উপলব্ধি করেছি। তরমুজ চাষ শুরুর গল্পটাও বেশ অভিনব ছিল।

পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের লেখার ধাঁচ দেখলেই বলে দেয়া যায় এটা ওপারের লেখা। তবে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখাকে স্বতন্ত্র মনে হয়েছে। এর মূল কারণ লেখক আমাদের এপারেরই লোক। দেশভাগের বেদনা তাঁর মধ্যেও আছে এবং সেই বেদনার সত্ত্বাকে যেন দু'হাতে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন লেখার মধ্যে। হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের প্রশ্ন আসলেই লেখকেরা নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেন না কিংবা কোনো এক পক্ষকে পাশ কাটিয়ে লিখে যান। অথচ বইটিতে কোনো প্রতিহিংসাপরায়ণ বাক্য ব্যবহার করেননি লেখক।

দীর্ঘ কলেবরের উপন্যাস। লেখক চেষ্টা করেছেন বৃহৎ একটা গল্পকে পাঠকের কাছে সহজ ভাষায় উপস্থাপন করতে। তিনি সেদিক দিয়ে সফল হয়েছেন। বইটার গল্প অনেক ধীরগতির এবং পুনরাবৃত্তি আছে। তবে এত ভালো একটা বইয়ের খাতিরে এই দিকটাকে অগ্রাহ্য করা যায়। আমার মতে দেশভাগের প্রেক্ষাপটে যত উপন্যাস লেখা হয়েছে, তার মধ্যে 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে' প্রথম সারিতে থাকবে। হ্যাপি রিডিং।
Profile Image for Anwesha Chakraborty.
49 reviews
February 13, 2016
অসাধারণ... বাংলাদেশের উপর এমন বই বোধ হয় আর নেই।
Profile Image for ANURAG RAKSHIT.
18 reviews2 followers
July 12, 2021
দেশভাগের সেই রকম অভিজ্ঞতা আমাদের প্রজন্মের আর নেই। তবু এই সব বই পড়লে মন টা কেমন ভারী হয়ে যায়।
Displaying 1 - 30 of 56 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.