রহস্যময় আলো-আঁধারির ফাঁদে জড়িয়ে থাকা কিশোর পুত্রসহ এক দম্পতি, ভাগ্যাহত ছন্নছাড়া কয়েকজন কিশোর, কানাচে ধ্যানস্থ এক অন্ত্যজ পল্লী থেকে স্বপ্নে কুড়িয়ে পাওয়া মুখরা কিশোরী সরুদাসীসহ প্রধান ও গৌণ গোনাগুনতি ক'টি চরিত্র নিয়ে ঠাসবুনোট এই কাহিনীর বিস্তার। তাদের মনোলক অন্তর্জগৎ নিয়ে যে বিপুল বিশাল নির্মাণ, তাদের ঘিরে যে টালমাটাল ঘূর্ণাবর্ত, তুমুল তোলপাড়, তাদের কবজা করার জন্য দরকার অশেষ ক্ষমতাশালী কলম ও কবজির জোর। যা মাহমুদুল হকের মত পরীক্ষিত এবং কুশলী কারিগরের হাত ছাড়া ভাবা যায় না। পরিবেশ তৈরিতে তার দক্ষতা অবিসংবাদী। প্রতিটি চরিত্রের প্রতি সমান অভিনিবেশ, সযত্ন পরিচর্যা, পাকা জহুরির মতো নিখুঁত নিক্তির ওজনে প্রতিটি শব্দের অনপনেয় ব্যবহার, শৈল্পিক ছেনিতে কেটে কেটে সকলকে ঘূর্ণাবয়বে ফুটিয়ে তোলার কাজ খুব দুরুহ। মানুষের প্রতি, মানবসমাজের প্রতি মমতার নিষ্পলক দৃষ্টি ব্যতিরেকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার গণ্ডিকে এভাবে অতিক্রম করাটা রীতিমত পরাক্রমের ব্যাপার। অনুর চোখ দিয়ে বিশ্বরুপ দর্শনের ফাঁক-ফোকরে প্রকৃতি পাঠেরও এ এক বিরল অভিজ্ঞতা। পাঠক নির্বিশেষকে এমন তাড়া করে ফেরে যে অনুর অসহায়ত্ব, নিরুদ্ধ ক্রোধ, ইচ্ছে-অনিচ্ছে, ভালবাসার জন্য আনচান করা প্রাণের সঙ্গে একাত্ম না হয়ে উপায় থাকে না। সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে বা গুটিয়ে নেয়ার আভাস চকিতে দেখা দিয়ে গোচরীভূত হওয়ার আগেই যেন আবার মিলিয়ে যায়। অনু কি নিজস্ব দর্পণে নিজেরই পরসত্তা নয়?
Mahmudul Haque (Bangla: মাহমুদুল হক) was a contemporary novelist in Bangla literature. He was born in Barasat in West Bengal. His family moved to Dhaka after the partition in 1947. His novels deal with this pain of leaving one's home.
Mahmud gave up writing in 1982 after a number of acclaimed novels. Affectionately known as Botu Bhai and always seen as a lively figure in social gatherings, the rest of the time he was said to lead a solitary life.
...ইচ্ছেরা সব জলেশ্বর মালী.... ইচ্ছেরা সব এক একটা চন্দনের পুরানো কৌটো।
অনুর পাঠশালা বিশেষত নির্জনতার গল্প, অথবা চিবুক ছুঁয়ে থাকা আজীবন নিঃসঙ্গতার। এমন হয়তো মনে হয়েছে একা আমারই। সে মনে হওয়ার নেই সমর্থন পাওয়ার দায়।
বিতিকিচ্ছিরি দুপুরগুলোর কথন আঁকা এ পাঠশালার ধুলোয়। দিকশূন্যপুরের রাস্তার দিকে হেঁটে যাওয়া গন্তব্যহীন নিরুদ্দেশ ভ্রমণের দুপুর। সমস্ত কিছু দিয়ে চাওয়ার পরও কাউকে হারিয়ে ফেলার ভয়ংকর কষ্টের দুপুর। ছুটির দিনে নিরিবিলি, চুপচাপ ছাদের পাঁচিল ঘেঁষে ছেলেমানুষের মতো হাঁটু মুড়ে বসে থাকার সময় মিছিমিছিই কান্না পাওয়া ফিকে রঙের দুপুরগুলো। ফিকে হলুদ। সন্ধ্যার রঙ যেমন গাঢ় বাদামি।
..তখন কি আমি জানতাম দুপুর এমন বাঙ্ময় হতে পারে, হতে পারে কোনো পাখির দীর্ঘ ডাক?
হলুদ মাখা রৌদ্রদিনে উদাম গরম হাওয়ায় উড়ে যাওয়া স্বপ্নকে ঘুমের কাছে সমর্পণ করে দেয় আমার আপন উদাস দুপুরবিলাস। পড়তে পড়তে সন্ধ্যা হয়ে এল, কিন্তু এই বই চৈত-বোশেখের দুপুর ব্যতীত পড়া কঠোরভাবে নিষেধ।
"নিথর দুফুর বেলা, মরা পাখি, রবি কি নিষ্ঠুর!"এই জ্বলন্ত দুপুরে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা অনুর তখন ভারী বিপদ- কালো কোট পরা বাবার সাথে যোজন দূরের সম্পর্ক; একলা ঘরের একমাত্র সঙ্গী মা'ও দুপুরে খুউউব ব্যস্ত, তার যে স্যারের কাছে ইংরেজি শিখবার তাড়া! তা না হলে চাকরি জোগাড় করে এখান থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। তাই জানালার ধার-ই সই। ঐ তো লামাদের বাগানে কারা ব্রিং (মারবেল) খেলে কিন্তু ওখানেও যাওয়া বারণ কিনা! মা বলেছে,"ঐসব হাঘরে ইতরদের সঙ্গে তোর অনেক তফাৎ" কী যে নিঃসঙ্গ লাগে অনুর!
জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা অনুর ঘোর লেগে যায়, একদিন হঠাৎ করেই ওর এই নিথর দুপুরে বাইরে পদার্পণ। টোকানি, গেনদু, মিয়াচাঁন, সরুদের সাথে ব্রিং খেলার শুরু। তবে ওদের সাথে মিশতে গিয়ে সব কিছু এমন আলাদা কেন বুঝতে পারে না অনু। তাই তো অনুকে গেনদু বলে, তুই হালায় অক্করে বোদাই । কিংবা, তুই এলায় অক্করে ম্যানথামারা পোলা, তরে লয়া চলে না । আর এর কারণেই বোধহয় অনুর আমার আমি সরুদাসী'র অবতারণা হয় যে কিনা অনুর সাথে সংসার-সংসার খেলা খেলতে চায় কিংবা বলা যায় নিঃসঙ্গ অনুর জীবনে একটি সঙ্গ হতে চায়। কিন্তু সরুদাসী যেন কাঁচের বক্স থেকে বের হওয়া গোলাপী রঙের হাওয়াই মিঠাই। আফসোস ঐটুকু ছেলে অনু! সে জানে না- "মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!"
দ্বিতীয় মাহমুদুল হক পাঠ; ঘোর লাগানিয়া; গভীর-শীতল নদী কাব্যিক ধারায় বয়ে চলেছে যেন...
"এইভাবে দীর্ঘ অসতর্ক মুহূর্তে নিজের অগোচরে তার ভেতরের যাবতীয় বোবা ইচ্ছেগুলো ধীরে ধীরে ফ্রিজের ঠাণ্ডা বোতলের মতো যখন ঘেমে ওঠে, এবং খাঁখাঁ দুপুরের হাঘরে ছেলেদের মতো ধুলোবালি মাখা হাওয়ার গরগরে শরীর জানালা টপকে এইসব ভিজে ইচ্ছের ওপর নাক ঘষে পরক্ষণেই আবার উধাও হয়ে যায়, তখন অকারণেই সমস্ত আকুলতার ভেতরে মাকে পাবার অদম্য আগ্রহ চিলের আর্তনাদের থরে-বিথরে পালকের মতো ভেসে বেড়ায় গুমরে উঠতে থাকে অনু,--মা কোনো এক মরা নদী৷ ইচ্ছেরা সব জলেশ্বরী মালী৷ ইচ্ছেরা সব এক একটা চন্দনের পুরানো কৌটো৷"
দ্বিতীয়বার পাঠের পর অধিকতর বিস্ময়ে, আনন্দে, আবিষ্কারে সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম। কেবল নিত্যনতুন বইয়ের পেছনে হন্যে হয়ে না ঘুরে প্রিয় বইগুলো ঘুরেফিরে পড়লে আনন্দটা সুনিশ্চিত, যেহেতু আগেও ভাল লেগেছিল ; আর নতুন করে প্রিয় বইটার ভুলে যাওয়া কিংবা চোখ এড়ানো জায়গাগুলোর আবিষ্কার মুগ্ধতাকে বাড়িয়ে দেয় বহুমাত্রায়।
মাহমুদুল হক বরাবরের প্রিয় লেখক আমার৷ বলতে গেলে তার ব্যাপারে অবসেশড আমি। মায়া-মানবিকতার জগতে স্বপ্ন, বাসনার মিশেলে যে জগত লেখায় তিনি তৈরি করেন, তা শরীরে-রক্তে লিটারেলিই, ঝিমঝিম, আচ্ছন্ন এক অনুভূতি এনে দেয়৷
'অনুর পাঠশালা' উপন্যাসে ছোট্ট ছেলে অনুকে এ কোন জগতে পুরে দিয়েছেন মাহমুদুল হক!
কবি ভাস্কর চক্রবর্তী বলেছিলেন, কবিতা হলো একটা শতশত আলোর মশালওয়ালা পাহাড়ের আকাশে উড়ে উড়ে যাওয়া৷ বলা যায়, সেই রকম একটা আলোর পাহাড়ের জগতকেই অনুর সামনে এনে যেন বা হাজির করেছেন মাহমুদুল হক৷ এই কাব্যিকতা উপন্যাসের ভাষার কাব্যিকতা যতোটা, তার চেয়ে ঢের বেশি দৈনন্দিন জীবনের কাব্যিকতা। যাকে টেনে তোলা যায় বিল থেকে আলগোছে শাপলা তোলার মতো করে৷ যেগুলো লুকিয়ে থাকে, অপেক্ষায় থাকে কখন আমরা সেগুলোর মুখোমুখি হবো? আর যখন সেই মুহূর্ত আসে, তখন মনেই হয় না এসব কাব্যিকতায় মোড়ানো কোন পলকা জগত। মনে হয়, ঐ,মুহূর্তটিতে চিরন্তন কোন অনুভব যেন দেখিয়ে দেয় জীবনের মায়াকে, অসীমতাকে। সাথেসাথে বলেও দেয়, এ নতুন কিছু নয়৷ তোমার ভেতরে এসব কনজ্যুম করার জন্য একটা পিপাসার্ত শরীর সব সময়ই হাজির ছিল। এই তো সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত! ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই যতো পারো পান করে নাও৷ পিপাসা পূর্ণ যদি নাই বা হলো, অন্তত ঐ বোধের অগম্য শরীরকে বাঁচিয়ে রাখো, কেননা দৃশ্যেরা কোথাও গিয়ে শেষ হয় না। তারা কেবল ফিরে ফিরে আসে।
অনু তার মরার মাথার মতোন নিস্তব্ধ দুপুরের নাগপাশ ভেঙে বেরিয়ে পড়ে। খুঁজে নেয় খেলার সঙ্গীদের। কিন্তু অনুর ভেতরে যে বিশাল জগত ঘাই মারছে, যে আকাঙ্ক্ষা অনুকে তার দাঁতাল দুপুরের দুঃস্বপ্ন থেকে নিয়ে যেতে চায় বহুদূরে, তার কাছাকাছি অনুকে কেবল বন্ধুদের সঙ্গ, ব্রিং খেলা---এসব নিয়ে যেতে পারে না৷
অনু দেখা পায় ঋষিপাড়ার সরুদাসীর৷ কিন্তু এই সরুদাসী আসলে কে? চপল এক বালিকা যে ঘোর বৃষ্টির মাঝখানে অনুর রাজ্যে এনে দেয় রঙধনু? নাকি নিতান্তই এক বৃদ্ধা যাকে অনু খুঁজে পায় পুনরায় সরুদাসীকে খুঁজতে গিয়ে?
অনুর মতো আমার কাছেও যেন একটা বরফযুগ পার হয়ে গেল উপন্যাসটা পড়ে। চৈতন্যের কী একটা ঘোরে অনু তার এসব আলোছায়া দিয়ে নির্মিত পাঠশালায় ফিরে যায় আর ফিরে আসে৷ ছুটে যায় আবার৷ বুঝতে পারি, এসব অনুর ওপরে চাপিয়ে দেওয়া লেখকের কোন কল্পরাজ্য বা স্বপ্নজগত নয়, বরং অনুর ভেতরের ওয়ান্ডারল্যান্ডকেই দেখতে চাওয়া হয়েছে ভাষার কুশলে।
প্রথমবারের মত মাহমুদুল হকের লেখা পড়লাম। উনার লেখার ধরনটা বিচিত্র। কখনো জটিল, কখনো একেবারে সরল। মাঝেমধ্যে জাদু মাখানো, মাঝেমধ্যে আদুরে আবার কয়েক জায়গায় অদ্ভুত হেঁয়ালির জাদুবাস্তবতা। অনুর পাঠশালা অনু নামক এক ছোট ছেলেকে নিয়ে। ব্যস্ত বাবা ও পরকীয়ায় আসক্ত মায়ের চোখ এড়িয়ে রোজ দুপুরে যে প্রান্তিক শ্রেণীর বাচ্চাদের সাথে বের হয় জীবনের স্বাদ অর্জনে। এরইমধ্যে দেখা হয় সরুদাসী নামের এক মুচি কন্যার সাথে। চলতে থাকে গল্প। শ্রেণীবৈচিত্র্য, স্বামী-স্ত্রীর সাংসারিক দ্বন্দ্ব, শিশুসুলভ কল্পনা সবকিছুই অনুকে ঘিরে পরোক্ষভাবে পোট্রে করেছেন মাহমুদুল হক। চুয়াত্তর সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসিকা সময়ের থেকেও অনেক এগিয়ে ছিল। সবমিলিয়ে অনুর পাঠশালা একটা মনস্তাত্বিক ভ্রমন। এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হল লেখক কার মনস্তত্ব নিয়ে খেললেন? অনুর নাকি পাঠকের?
বোশেখের চলিষ্ণু মেঘ যখন বর্ষার দোরগোড়ায় এসে থেমে থাকে, ঠিক সেই সময়ই কানাচে ধ্যানস্থ এক অন্ধগলি থেকে উঠে আসে সরুদাসী। সরুদাসী কি বিধ্বস্ত কল্পলোকের কোন নেপথ্যছায়া? তার সঙ্গেই তো অদ্ভুত সখ্য গড়ে ওঠে অনুর। যার—নিস্তব্ধ দুপুরে পাখির শিষ ভালো লাগে, লামাদের বাগানে প্রজাপতির উল্লাস ভালো লাগে, ভালো লাগে রৌদ্র পরাক্রান্ত দুপুরে বিধৌত পাখির রাজ্যে ঘুরে বেরাতে।
হাঘরে, ইতর, ছন্নছাড়া কিশোরদের দলের সঙ্গেও খাতির হয় অনুর। দু’টাকা মেরে দেওয়ার মতো সস্তা স্বার্থ বেড়ানোর পেছনে থাকে উদ্রেক জাগানো অভাবগ্রস্থতা। বাবা মায়ের টালমাটাল মনোজগতে প্রবেশ করতেই অনু দেখে—নিস্তরঙ্গ সাদা দেয়ালের বন্দিত্ব তাকে আরও গভীর নির্জনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অনুর সেই ভেতরের জগৎটাকে মাহমুদুল হক অসামান্য কোমলতায় আর দগদগে ক্ষততে তুলে ধরেছেন। তাই তো অনুর মনে হয়—
“…এইসব বিদীর্ণ দুপুরের মাঝখানে, ধু-ধু রৌদ্রের মাঝখানে, গোল চারকোণা বাগানের চেয়ে, গাছের পাতার চেয়ে, সমুদ্রের চেয়ে, পাখির গানের চেয়ে, সুন্দর আর ঠান্ডা একটি মেঝে পরম নিভৃতে কোথাও আরামে চোখ বুজে অচৈতন্যপ্রায় পড়ে আছে জলেশ্বর মালীর মতো। অনুর মনে হলো, জলেশ্বর মালী কতো সুখী!”
শব্দের এমন স্বতঃস্ফূর্ত চলাচল, এমন অন্তর্লোকময় তরঙ্গ, এমন অদ্ভুত কাব্যিক ছন্দ—কলমের জোর না থাকলে কি আর সম্ভব? মাহমুদুল হক বরাবরের মত মুগ্ধ করলেন।
"ফুঁসে উঠছে হাওয়া, কখনো গলায় ঘুঙুর বাঁধা বাছুরের মতো, কখনো কুঁদুলে ষাঁড়ের মতো শিঙ উঁচিয়ে; কখনো রণোন্মত্ত সিংহের মতো, দুর্দান্ত দস্যুর মতো কখনো।"
"কোনো একদিন ঝনঝনে থালার মতো দুপুরে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে একটা পাখি দারুণ চিৎকার করে উঠলো; কানে বাজলো, এসো অনু - এসো!"
"ঊর্দ্ধশ্বাসে ফিরে যাবার পথে বারবার অনুর মনে হলো, জারজ নিনাদে উন্নীত পাখোয়াজের উত্তরোত্তর দ্রুততর উত্তাল ফেনিল তরঙ্গমালা পিছন থেকে পরাক্রান্ত ঘাতকের মতো তেড়ে আসছে তাঁর দিকে।"
একেই মনে হয় বলে fictional art!! এমন অদ্ভুত, সুন্দর, আর্টিস্টিক লেখা আর পড়ব কিনা সন্দেহ আছে! এটা আমার এতো ভাল লাগছে যার কারণে এতদিন সময় নিয়ে শেষ করলাম। ইচ্ছে হচ্ছিল না শেষ করতে ।। । এখন যদি আমাকে একটা বইয়ের নাম বলতে বলেন সেটা হবে "অনুর পাঠশালা".... এটা শুধু পাঠক না, লেখকদেরও পড়ে দেখা উচিত(একদম বাড়িয়ে বলছি মনে হচ্ছে না) উনার লেখা ছাড়াও শব্দের ভান্ডার প্রচুররররর!!
অল্প বয়সী এক বালক অনু। আর দশটা বালকের এই সময়টা যেখানে কাটে হৈ-হুল্লোড় করে সেখানে অনুর জীবনটা কেমন যেন নীরস। ব্যস্ত উকিল বাবা আর সংসার থেকে পালাতে চাওয়া মায়ের মধ্যে একটুও সদ্ভাব নেই, যার আঁচড় পড়ে তার উপরেও। আগে যেখানে মা ওকে নিয়ে নানান খেলা খেলতেন এখন সেখানে তিনি ব্যস্ত গৃহশিক্ষকের কাছে ইংরেজি শিখতে ; ইংরেজি শিখে চাকরি নিয়ে সংসার থেকে পালিয়ে যাওয়াই যে তার উদ্দেশ্য। ফলে অনুর দুপুরগুলো কাটে ভীষণ নিঃসঙ্গভাবে; টিভি আর দেখতে ইচ্ছা করে না, এক গান বারবার শোনার রুচি হয় না, একই বই আবার পড়ার কোনো মানে হয় না।
এমন নিঃসঙ্গ অনু জানালায় দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে পাশের বাড়ির লামাদের বাগানে বস্তির ছেলেদের মার্বেল দিয়ে ব্রিং খেলা দেখত। দেখতে দেখতেই একদিন সে সবার অজান্তেই বাড়ি বেড়িয়ে পড়ে। আর বাড়ির বাইরে পা দিয়ে টোকানি, গেনদুদের সাথে পরিচিত হয়েই সে যেন এক নতুন দুনিয়ায় প্রবেশ করে। যা সে ভাবতেও পারে না তা গেনদুরা প্রকাশ করে অবলীলায়। ওদের সাথে মিশতে গিয়েই সে জীবনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে। এভাবে একদিন তার সাথে পরিচয় হয় সরুদাসীর যে প্রথম দিনের আলাপেই তাকে ‘মনসাপাতা' বন্ধু বানিয়ে ফেলে। অনুর মনে হতে থাকে জীবনের এক নতুন পাঠশালায় প্রবেশ করেছে সে।
একবাক্যে বললে বইটা নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্বের গান। বইটা বিভিন্ন শ্রেণির বালক-বালিকাদের পৃথিবীর পাঠশালায় পাঠ শেখার বয়ান। আর এই বর্ণনা আর বয়ান এত কাব্যিক যে উপন্যাস পড়তে গিয়েও মনে হয় যে কোনো কবিতার বই পড়ছি! খুব অসাধারণভাবে লেখক অনুর নিঃসঙ্গতার কথা তুলে ধরেছেন বইটাতে। নির্জন দুপুরে অনুর ছটফটানি দেখে জীবনের ঐ সময়ে পিছিয়ে যেতে হয় যখন আমিও অনুর মতো বাড়ির চার দেয়াল পেরিয়ে সবসময় বাইরে ছুটতে চাইতাম। অনুর সবসময় নিজেকে অপাংতেয় মনে করার বিষয়টাও কোনো না কোনোভাবে নিজের শৈশবকালের কথা মনে করিয়ে দেয়। বাবা-মায়ের দাম্পত্যকলহটাও তো ভীষণ পরিচিত। ‘শয়তান’ বাবা আর ইংরেজি শিখতে ব্যস্ত মায়ের থেকে পর্যাপ্ত মনোযোগ না পেয়ে একাকী বেড়ে ওঠা অনু যে তার নিঃসঙ্গতা কাটাতে চায় টোকানি আর সরুর মাধ্যমে যাদের সাথে কোনোভাবেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না সেটাও অপরিচিত না আমাদের সমাজে।
এবার আসি নামকরণ নিয়ে। নামটা ভীষণ অর্থবহ। পাঠশালা মানে মানুষ যেখানে জীবনকে বুঝতে শেখে, ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রস্তুত হয়৷ তাহলে অনুর পাঠশালা দ্বারা লেখক কি বোঝালেন? নাহ, এখানে লেখক কোনো পাঠশালা বা স্কুলের কথা বলেননি। বরং এখানে পাঠশালা হলো টোকানি, গেনদু, সরুদাসীর সান্নিধ্য। দালানের খাঁচায় বড় হওয়া অনু প্রথম জীবন সম্পর্কে শিখতে পারে যখন সে বাড়ি থেকে বাইরে বের হয়, টোকানিদের সাথে ব্রিং খেলায় যোগ দেয়, সরুর সাথে দোকানের ঝকপের নিচে দাঁড়ায়। এখানেই যে তার একাকীত্ব দূর করে, জীবনের বিচিত্র রূপটা দেখে, জীবন সম্পর্কে শেখে। লেখক পাঠশালা ব��তে এই পরিবেশকেই বুঝিয়েছেন।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় লেখক দুইটা ভিন্ন জীবনপদ্ধতিকে পাশাপাশি দেখিয়েছেন বইটাতে। একদিকে অনু, মজ্ঞু, গোর্কিদের জীবন আর অন্যদিকে রয়েছে টোকানি, গেনদু, মিয়াচাঁন, সরুদের জীবন। সুযোগ-সুবিধা, ভাষা, পোশাক, চিন্তাধারা ইত্যাদি সবদিক থেকেই জীবন দুইটা যে কত আলাদা সেটা সহজেই বোঝা যায়। একদিকে অনুর খালা যেখানে নকল হিরের গয়না কিনে ঠকার পরও হাসাহাসি করছেন সেখানে অন্যদিকে টোকানির বাবা ওষুধের টাকাটা পর্যন্ত পাচ্ছেন না। সমাজের দুই অংশের এই অসাদৃশ্য আর বৈষম্যও বইটার একটা উল্লেখযোগ্য দিক।
এবার আসি সরুদাসীর প্রসঙ্গে। চরিত্রটা কি বাস্তব নাকি অবাস্তব? শেষের টুইস্ট নিশ্চিতভাবেই বিপদে ফেলে দেয়। আমার মনে হয়েছে সরুদাসী চরিত্রটা ‘ আদর্শ বন্ধু' ধরনের কিছু একটা। সারাজীবন আমরা যেমন বন্ধু চাই, মাঝে মাঝে ভুল করে মনে করি যে পেয়ে গিয়েছি কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে তাকে পাওয়া সম্ভব না – সরুদাসী তেমন একটা চরিত্র। সরুদাসী চরিত্রটা যেমন ঘোলাটে উপন্যাসটাও অনেক জায়গায় তেমনি। বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝখানের সরু সুতার উপরে যেন অনুর পাঠশালাটা অবস্থিত।
বইটার অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হলো লেখকের ভাষা আর বর্ণনাভঙ্গি। কেমন যেন একটা ঘোর লাগা ভাষা ব্যবহার করেছেন লেখক। কোনো চিত্রকর্ম আঁকতে যেমন শিল্পী অনেক ভেবেচিন্তে রঙ ব্যবহার করেন তেমনি লেখক এখানে অনেক ভেবেচিন্তে শব্দ ব্যবহার করেছেন। বাক্যগুলোও এমনভাবে লেখা যে একবার পড়লে ঠিক ধরা যায় না কিন্তু ২-৩ বার পড়ার পর যখন অর্থ পরিষ্কার হয় তখন অবাক হতে হয় লেখকের শব্দের ব্যবহার আর পর্যবেক্ষণ শক্তি দেখে। আরেকটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো লেখকের উপমার প্রয়োগ। মড়ার মাথার সাথে দুপুরের নিস্তব্ধতা, মরা নদীর সাথে মা, পাথরের সাথে ইচ্ছা, আগের ক্লাসের বইযের সাথে অতীত স্মৃতি ইত্যাদি উপমার ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। আর বাক্য বা অনুচ্ছেদ তো প্রচুর রয়েছে যেগুলো অদ্ভুত সুন্দর লেগেছে।
পাত্রপাত্রী কিশোর-কিশোরী হলেই যে উপন্যাসটা কিশোরোপন্যাস হয় না তার একটা উদাহরণ এই বইটা। যে একাকীত্ব আর হতাশা দেখানো হয়েছে বা যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা কিশোর-কিশোরীদের জন্য কঠিন তো বটেই, অনেক প্রাপ্তবয়স্কও হোঁচট খেতে পারেন।
দুপুরের সাথে উপন্যাসটা বেশ জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে, যেমন শুয়ে ছিল লামাদের বাগানের মালি তার মালিনীর ধবধবে সাদা বুকে,শুয়ে ছিল যতোক্ষণ না ঘুম আসে।
দুপুরবেলাটা অনুর আগে বেশ ছিল, কারণ মা তখন ওকে পুরনো সব গল্প-গান শু্নাতো, কিংবা পাশে বসে শেখাতো ছবি আঁকা। অতঃপর এসব ব্যস্ততা কেমন ফিকে হয়ে আসে। কারণ, মায়ের তখন অন্য কাজ বাড়ছে। মা প্রতিদিন দুপুরে ইংরেজি স্যারের কাছে ইংরেজি শিখে বিশাল বাড়ির কোণার এক কামরায়। আর অনুর তখন ওই কামরায় যাওয়া বারণ, কারণ এতে ইংরেজি শিক্ষায় বিড়ম্বনা দেখা দিতে পারে। মায়ের ইংরেজি শিখতে হবে, তাই অনুর দুপুরগুলো নিঃসঙ্গ হতে শুরু করে। তাই সে জানলা থেকে বাচ্চাদের খেলা দেখে, এবং মাঝে মাঝে মালির একচালা ঘরটার দিকে তাকিয়ে দেখে সে তার বউয়ের বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে আছে।
অতঃপর দুপুরবেলা অনু বাইরে বেরোতে শুরু করে। দোতলার জানলা থেকে যেসব 'বজ্জাত' ছেলেদের খেলা দেখতো সে, চিনে ফেলে তাদের সবাইকে। গেনদু, লাটু, মিয়াচান, টোকানি। আর পরিচয় হয় মুচির মেয়ে সরুদাসীর সাথে। সরুদাসী বারংবার অনুকে অভিযুক্ত করা শুরু করে ওর নিতম্ব চোখ দিয়ে গিলে খা্বার অভিযোগে।
মা বিশাল বড় বাড়িটা থেকে পালায় না, বাবা কেমন নিস্পৃহ-নিস্তেজ হয়ে যায়। সরুদাসী হা্রিয়ে যায়। ছোট অনু পালাতে চায়।
"মা কোনো এক মরা নদী। ইচ্ছেরা সব জলেশ্বর মালী। ইচ্ছেরা সব এক একটা চন্দনের পুরোনো কৌটো।"
আলো আঁধারে জড়িয়ে থাকা একটা পরিবার, কিছু কিশোর আর এক অন্ত্যজ পল্লী থেকে স্বপ্নে কুড়িয়ে পাওয়া মুখরা এক কিশোরীর গল্প নিয়ে মাহমুদুল হকের উপন্যাস 'অনুর পাঠশালা।'
মূল চরিত্র অনু সমাজের সামলম্বী এক পরিবার থেকে উঠে আসা। আর সবার মত অনু তার বাবাকে ভালোবাসে না, অনুর মাও তার পিতার পরিবারকে চরমভাবে ঘৃণা করে। লেখকের ভাষায়, "অনু আব্বাকে সহ্য করতে পারে না। শয়তান মনে করে। ঘৃণা করে। যে সময় তিনি ঘরে থাকেন সে ইচ্ছে করা গা বাঁচিয়ে সন্তর্পণে বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে নিজেকে আড়াল করে রাখে।"
অনুর কাছে কাছে তার আব্বা হিমালয়ের মতন অনেক দূরে বাস করে। "মা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। ভাবতে শিখিয়েছে। এখন জানা হয়ে গিয়েছে- ভাবনার ভেতরে কতো রকমেই না মানুষ নিজেকে পায়। ভাবনার ভেতরে নিজেকে সবরকমে যথেচ্ছ পাওয়া যায়। ভয়ংকর যে শত্রু, টলানো যায় তাকেও এবং অতি সহজে। মাকে সবচেয়ে বড় বন্ধু ভেবে তার আনন্দ।"
অনুর কাছে তার ঘর রাগী দুপুরের দংশন যন্ত্রণায় নিষ্পোষিত জঠরের মত মনে হয়। সে পালিয়ে যেতে চায় কিন্তু পারেনা। পালানোর এই যুদ্ধে অনুর একসময় পরিচয় সরুদাসী নামক বালিকার সাথে। কিন্তু সরুদাসীকে সে পেয়েও আবার হারিয়ে ফেলে।
অনুর ভাষায়, "সেরে ওঠার পর প্রথমেই মনে হলো যেমন করেই হোক সরুদাসীকে তাঁর খুঁজে বের করতেই হবে। বুকের ভেতর একটা আধলা ইট আটকে আছে। কতো দিন আমি রুগ্ন নিছানার উপর শুয়ে আছি, অনুর মনে তোলপাড় করতে লাগলো, কতদিন হয়ে গেল আমি রক্তশূন্য শাদা কাফনের উপর পড়ে আছি, কতোদিন হয়ে গেল আমি সরুদাসীকে খুঁজি নি, কতোদিন যে হয়ে গেল আমার কাশ নেই, শুধু গা পোড়া জ্বর।"
আহ! এত্তগুলো চরিত্র লেখক এত যত্ন নিয়ে সাজিয়েছেন রীতিমত অবাক করেছেন। আর প্রতি লাইনে লাইনে ভাষার এমন অলংকারের ব্যবহার রীতিমত ধাক্কা দিয়েছে বারবার। লেখক পুরো চোখের সামনে হাজির করেছেন সবগুলো চরিত্রকে।
লাইব্রেরীর নতুন বইয়ে যখন আমি পাগলের মত লাইনের পর লাইন দাগাচ্ছিলাম, লাইব্রেয়িন স্যার আবার দিকে মুচকি হাসছিল। অনুর জায়গা বারবার নিজেরে কল্পনা করছিলাম। আচ্ছা আমার একাকীত্বে ভরা দুপুরে আমি কেমন থাকি? আমিও কি বলি?, "রক্তমাংসহীন আমি পড়ে আছি, কেউ নিদারুনভাবে গুম করে দিয়েছে আমাকে..."
অনু যখন ভাবে, "মানুষ মরে যায়, কিন্তু মা কি মরে, সে ভাবতে চেষ্টা করে। সম্পূর্ণ লোপ পায় তার বোধশক্তি; ভেতরের যাবতীয় কষ্ট ছুঁই ছুঁই করেও পরক্ষনে আবার পালিয়ে যায়, কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে।"
বুকটা তখন কেঁপে উঠে। আর আমি খুন হতে থাকি অসংখ্যবার।
“এইভাবে দীর্ঘ অসতর্ক মুহূর্তে নিজের অগোচরে তার ভেতরের যাবতীয় বোবা ইচ্ছেগুলো ধীরে ধীরে ফ্রিজের ঠান্ডা বোতলের মত যখন ঘেমে ওঠে, এবং খাঁখাঁ দুপুরের হাঘরে ছেলেদের মতো ধুলোবালি মাখা হাওয়ার গরগরে শরীর জানালা টপকে এইসব ভিজে ইচ্ছের উপর নাক ঘষে পরক্ষণেই আবার উধাও হয়ে যায়, তখন অকারণেই সমস্ত আকুলতার ভেতরে মাকে পাবার অদম্য আগ্রহ চিলের আর্তনাদের থরে-বিথরে পালকের মতো ভেসে বেড়ায়। গুমরে ওঠতে থাকে অনু,__মা কোনো এক মরা নদী। ইচ্ছেরা সব জলেশ্বর মালী। ইচ্ছেরা সব এক একটা চন্দনের পুরানো কৈাটো।”
এই বছর দুয়েক আগেও আমি এই লেখককে চিনতাম না।জানতাম না এমন একজন আছেন যে পরিচিত গন্ডির মাঝেকার রিনিঝিনি সব শব্দের পসরা সাজিয়ে এমন আশ্চর্য সুন্দর ভাবে শৈল্পিক একটা আবহ তৈরি করতে পারেন।কোনো এক বইয়ের গ্রুপে অনেকগুলো বইয়ের নামের মাঝে আমি একটা অদ্ভুত নাম শুনি। কালো বরফ। আরে বইটা তো ছোট। পড়েই দেখি। হয়ত নতুন লেখক।এমনই ছিল আমার ভাবখানা।তখনও জানা ছিলনা,এই লেখকের লেখাই আমার এমন প্রিয় হতে চলেছে।আমার নানা রকম বইয়ের প্রতি আগ্রহের মূল কারণ বইয়ের সুন্দর সব উক্তি। যে বইয়ে যত বেশি লাইনগুলো পছন্দ হয়, বইটা তত প্রিয়। লেখকের অণুর পাঠশালা পড়তে গিয়ে আমি বারবার থেমে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল সুন্দর সব শব্দের সমারোহের আমি যেন আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। নিঃসঙ্গ নিথর দুপুরবেলা, একেও এত সুন্দর করে বর্ণনা করা চলে আমার জানা ছিল না। এই বইয়ে এত এত লাইন পছন্দ হয়েছে লিখে শেষ করতে পারবো না। তবে আমার বিশেষ প্রিয় অণুর ফুরোতে না চাওয়া ত্যক্ত বিষন্ন দুপুরবেলাকার বর্ণনাটুকু।🤍
বললেন, সর্বনাশ, তার গায়ে যে টাটকা রক্ত। ধূর্ত কাকের ঝাঁক মাস্তুলের উপর বসে, মানে মাস্তুলের উপর বসে আহার সন্ধান করছে। তোমার একজোড়া নৌকোয় সূর্যের ডিম দুটি ঠুকরে ঠুকরে খাবে, অন্ধ হয়ো না।
তা খাক। অন্ধ হই সে-ও ভালো, তবু যেতে ভালোবাসি। … …
▪️▪️▪️
ফের কৈশোরের সোনালি-আঁধারি-উদাসী দ্বিপ্রহরের সময়গুলোয় ফিরে গেলাম। বই পড়া, ছবি আঁকা, গান শোনা, কী এক অদম্য আকাঙ্ক্ষায় ঘর ছেড়ে পালাবার ফন্দি আঁটা– নিখুঁত, নিখুঁত কাব্যগল্প।
অনু এক কিশোরের নাম। তের চৌদ্দ বছরের বিষণ্ণ এক কিশোর। প্রাচুর্য ভরা পরিবারে তার বাস। সময়টা গত শতকের ষাটের দশকের, জায়গাটা এই বাংলাদেশেই। পড়ালেখায় দুর্দান্ত অনু ভীষণ নিঃসঙ্গ এক কিশোর। দুপুরবেলায় তার সময় কাটে না। এককালের সবচেয়ে কাছের বন্ধু মা যেন দূরে সরে গেছেন এখন অনেক। বাবা, বাবাকে সে ঘৃণা করে তার মা ঘৃণা করেন বলেই। তাছাড়া বাবা তার অনেক দূরের মানুষ, ব্যস্ত মানুষ, চেনাশোনাই হয় নি কখনো ঠিকমতো।
নিজেদের উঁচু ছাদ আর অনেকগুলো ঘরওয়ালা বাড়ি অনুর অসহ্য লাগে। অনেকদিন নতুন কোন বই, খেলনা কিনে দেয়া হয় না তাকে। পুরোনো বইগুলো বারবার পড়তে পড়তে আর ভালো লাগে না। খাঁচার পাখির মতোই সে মুক্ত হতে চায়, এই স্বপ্ন তাকে দেখিয়েছিল তার মা। কোনদিন এই বাড়ি, সবকিছু ছেড়ে সে আর মা অনেক অনেক দূরে চলে যাবে।
সামনের লামাদের বাড়িতে বখাটে ছেলেরা ব্রিং খেলে, অনুর সেখানে যাবার উপায় নেই। অনুমতি নেই বাইরে যাবার।
কিন্তু মায়ের আর সময় হয় না তাকে সময় দেবার, দুপুরবেলাগুলো এখন মায়ের স্যারের কাছে ইংরেজি শেখার সময়। গ্রীষ্মের দুপুরগুলোতে আর মা শোনান না কবেকার সেই দার্জিলিং এ কাটানো ছোটবেলার গল্প।
সেই অনু চিরকালের ভালো ছেলে অনু তার অসহ্য একলা দুপুরগুলোতে একসময় বেরিয়ে পরে বাইরে। বন্ধুত্ব হয় টোকানি, গেনদু বা মিয়াচাঁনের সাথে। এদের কারো বাবা গাড়োয়ান, কারো বা ছুতোর। এদের কাছে পৃথিবীর পাঠশালায় অনু নতুন করে জীবনের শিক্ষা নেয়। বন্ধুত্ব হয়, মনসাপাতা পাতায় ঋষিপাড়ার সরুদাসীর সাথে। আগ্রহ হারিয়ে ফেলে বড়লোকদের মেকি বন্ধুত্বে, জীবনে। কিন্তু কোনটা অনুর স্বপ্ন কোনটা বাস্তব? বাস্তব অবাস্তবে, সত্যি আর কল্পনায় মেশানো অদ্ভুত এক উপন্যাস অনুর পাঠশালা। বুঝতে গিয়েও মনে হয় ঠিক যেন বুঝতে পারি নি। অদ্ভুত মায়াময় এক লেখা। ভক্ত হয়ে গেলাম মাহমুদুল হকের।
সিন কনারি না, নামটা হবে শন কনারি। ৫৪ বছর বাদেও সম্পাদনায় কেউ নজর দেয় নি। অনুর বড়োলোক বন্ধুরা অনুকে হড়বড় করে প্রশ্ন করছিল, যেটা মনে হয়েছে অনুর দরিদ্র বন্ধুবান্ধবীর সঙ্গে বৈসাদৃশ্য আনতে মাহমুদ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু হড়বড় করাতে সেটা কিছুটা কৃত্রিম বলে মনে হয়েছে। কোথাও পড়েছিলাম বইটা শিশু-কিশোরদের। কিন্তু কলেজ পর্যায়ের আগে পড়লে কিছু বোঝা যাবে না। দ্বীপের মতন নিঃসঙ্গতা, পাহাড়ের ন্যায় চাপ, মা-বাবার কলহ, কিশোরপ্রেম, দারিদ্র্য, শহুরে 'ব্রো'-'সিস'দের আলকাতরা হৃদয়, আলকাতরা বচন। সরুদাসী পশ্চিমবঙ্গের কথ্যভাষায় যে কথা বলে, ওখানকার মানুষজন কি ষাটের দশকে ঢাকায় থাকত?
প্রথম বার যখন আমি "অনুর পাঠশালা " পড়ি, অদ্ভুত এক বিষ্ময়ে অভিভূত হয়েছিলাম। গল্পটা বা উপন্যাস টা যে খুব বুঝেছিলাম, তা নয়। তবে লেখকের লেখনী আমাকে মুগ্ধ করেছিল। খুশিতে গদগদ হয়ে পাঁচ তারা দিয়েছিলাম,বেশ অনেক জনকে-ই বই টা পড়তে উৎসাহ দিয়েছিলাম।
প্রায় বছর দুয়েকের ব্যবধানে আমার তৎকালীন প্রিয় বই,আবার পড়লাম। কিন্তু সেই আগের স্বাদ টা পেলাম না। বরাবরের মত লেখকের মনোহর লেখনীতে মুগ্ধ হলেও,কি যেন নেই মত লাগলো! কিসের একটা অভাব অনুভব করলাম!! গল্পটা ও লেজ- মাথা নেই মনে হলো! হয়ত আমারই বোঝার দোষ! কি জানি!!
মাহমুদুল হকের লেখা পড়া আমার প্রথম বই হলো এই অনুর পাঠশালা। বইয়ের ব্যাপারে না জেনেই হুট করে কিনে ফেলা থেকে পড়ে শেষ করার সময়টা পর্যন্ত যেই এক্সাইটমেন্টে ছিলাম সেটা বলে বুঝানো সম্ভব না। বইয়ের লেখার মধ্য এমন হেঁয়ালি জাদুবাস্তবতা, জাদু মাখানো শব্দ, বাক্য,কাহিনী যে নিজে কি অনুভব করছি সেটা লিখতে গেলেও মনে হচ্ছে আমিও অনুর ওই দুনিয়াটাতেই আছি। তবে অনুর দুনিয়ার মত আমার এখানে এত সুন্দর সুন্দর শব্দরা ঘুরে বেড়াচ্ছে না। আমাদের ছোটবেলার মত হলুদ রঙ্গা একটা দুপুর অনুরও আছে। তবে সেই দুপুর ভীষণ একা এবং বিষণ্ণতায় ঘেরা। মা আগের মত গল্প করে না অনুর সাথে,অনুর গল্পের বইগুলোও পড়া হয়ে গেছে হাজারবার। একই খেলাও আর খেলতে ভালো লাগে না তার। অনু তার দোতালা বাড়ির জানালা থেকে দেখে টোকানি,গেনদু,মিয়াচাঁনদের ব্রিং খেলা। তবে ওই জায়গায় যাওয়া আবার মায়ের বারণ। কিন্তু নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আবার বরাবরেই আগ্রহ বেশি। এরপর আরেকদিন একই হলুদ রঙ্গা দুপুরে অনু টোকানিদের স��থে আবিষ্কার করে নিজেকে। তারপর? তারপর আরকি। শুরু হয় অনুর এডভেঞ্চার। এডভেঞ্চার বললে ভুল হবে। অনুর ধরা-ছোয়ার বাইরের দুনিয়ার পাঠশালায় অনুর যাত্রা শুরু হয়। টোকানি, গেনদু, মিয়াচাঁনদের সাথে যে অনু, মজ্ঞু, গোর্কিদের তফাৎ কোথায় সেই চিন্তার জট খুলতে শুরু করে অনুর মধ্য। কি এক সামাজিক বৈষম্য! ওইদিকে অনুর খালা নকল পার্লের নেকলেস কিনে এনেও হাসে আর এদিকে টোকানিদের খাবার জুটে না।
এমন আরও অনেক কিছু। এতকিছুর মাঝেই আসে সরুদাসী। যে কিনা অনুকে বৃষ্টির মধ্যই রংধনু দেখায় ।
শ্রেণীবৈষম্য, মা-বাবার সাংসারিক দ্বন্দ্ব, একটি ছোট ছেলের একাকিত্ব, সেই একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য একটা সম্পূর্ন বিপরীত পরিবেশে বন্ধু খোঁজা কি নেই এই বইতে। কি দারুণ একটা ইমাজেনেটিভ আর্ট। বিষন্ন সুন্দর তার সাথে হালকা খেয়ালি জাদুবাস্তবতার সাথে সাইকোলকজিক্যাল মিশেলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে তার এই জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ হবে এই বইটি। আর শব্দেরবুনন এর প্রশংসা না করলে আমার পাপ হবে। বইটা পড়ার সময় ছোটবেলার সেই দুপুরগুলোর কথাও মাথায় ঘুরছিল। এসবের পর আবারও মাথায় আসে সরুদাসী আসলেই কে? এই মনস্তাত্তিক যুদ্ধ লেখক কার সাথে করলেন? এত কিছু শুধু অনুর মনের মধ্যই হলো? এতকিছুর উত্তর আসলে আমি খুঁজে পাইনি।এই বইতা নিয়ে কেন যে আলোচনা হয়না জানিনা। কিছু কিছু জিনিস থাকে অসম্ভব ভালো লাগে।কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কেন ভালো লেগেছে তখন তার উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই বইয়ের ক্ষেত্রেও আমার সাথে সেটাই হয়েছে মনে হচ্ছে। শুধু বলতে চাই ভালো লেগেছে। বড় হাতের বাংলা অক্ষর যদি থাকত তাহলে সেটা দিয়ে বুঝাতাম। যেহেতু নেই তাই কষ্ট করে ইমাজিন করে নিন।
"পায়ের সেবা করলেই মাথা পাবি, মাথার মধ্যেই সব, মাথার মধ্যে বিশ্ব।" 📖: অনুর পাঠশালা --- চমৎকার একটা বই, কলেবরে ছোট, এক বসাতেই শেষ করার মতো। ব্যক্তিগতভাবে অনুর চেয়ে সরুদাসী চরিত্রটি ভালো লেগেছে। অনুর ক্যারেক্টার প্রোফাইল করতে লেখক মাহমুদুল হককে যে বেগ পেতে হয়েছে তার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি খাটুনি গেছে সরুদাসীর চরিত্র লিখতে। পড়ার সময় এই সহজ সরল বাচ্চা মেয়েটার কথার প্রেমে পড়তে আপনি বাধ্য। পড়া শেষে অনুধাবন করলাম, I fall in love with "সরুদাসী" 🌻
অ্যাকোরিয়ামের ভেতর আমাকে ঠুকরে ঠুকরে খায় জ্যান্ত মাছেরা। মরুর অন্তহীন বালু স্রোত ফিরে আসে সাদা দেয়ালের নিরেট প্রতিবিম্বে। নিশ্চিহ্ন বিরান ভূমিতে বুড়িয়ে যাওয়া বটের গরম নিঃশ্বাসে যেন পার হয়ে যায় একেকটা বরফযুগ। ভোতা মস্তিষ্কের তেতো কল্পনার মাটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে তলিয়ে যায় ঋষিগ্রামে। রাক্ষুসে জিহ্বার মত বিরাট উঠান গিলে নেয় নিষ্কণ্টক কিছু সময়। গিলে নেয় সমস্ত জড়তা তথা ভ্রম। দাঁড় করিয়ে রাখে অবিশ্বাস্য অমোঘ সত্যের মুখে। ভ্রম থেকে যার সূত্রপাত।
জীবন এমনই। কেউ সব পেয়েও নিঃসঙ্গ থাকে যা তাকে তিলে তিলে মারে। তখন হয়তো লোভ তাঁর সঙ্গী হয় ও সে আরো চায় অথবা সঙ্গ চায়। সে অন্যের দ্বারা এতোকাল প্রভাবিত হলেও আজ সে স্বাধীনতা চায় কিন্তু সেই প্রভাব থেকেই যায়। কেউ বা সঙ্গ পায় কিন্তু সে সঙ্গ সুখকর নাও হতে পারে। পাখি যেমন মাটিতে নামলেও গাছ কে ভালোবাসে তেমনি, গল্পে অনুকে আমার পাখি মনে হয়েছে। সে বস্তি নামক মাটিতে নেমে এসেছে কিন্তু সে মানাতে পারেনি নিজেকে। সে মাটি সম্পর্কে আগ্রহী কিন্তু বেশিদূর হাটতে পারেনি। কারণ যে মাটিতে ফসল ফলে সে মাটিতে মল-মূত্রও ত্যাগ করা হয়। এর মানে এই নয় মাটি খারাপ , এর মানে মানিয়ে না নেয়াটা। তবে যে পাখি মাটিকে ভালোবাসতে চায় সে এক সময় গাছেরও ক্রুটি ধরে। কারণ না গাছ, না আকাশ না মাটি কেউ একা শ্রেষ্ঠ নয়।
যাই হোক। একটা অসাধারণ গল্প ছিল। জীবন কে চেনার একটা উপায়। একজন মানুষ, পরিবার বা সমাজ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। জীবনের সাথে মিল আছে বটে। যদিও ভাষা হালকা কঠিন এবং লেখকের দৃষ্টি যে কতটা প্রসারিত তা প্রকাশ পায় এই বই পড়ে। লেখক অনুর অনুভূতিকে নিজ চোখে দেখে ব্যাখ্যা করেছে।
বইটি আমি ১৬+ বয়সের মানুষকেই পড়তে বললো। এবং অবশ্যই বলব পড়তে।
আপনাদের কোন পছন্দের বই সাজেস্ট করবেন আশা করি। ধন্যবাদ
বছর চারে'ক আগে বইমেলায় স্টল ঘুরে ঘুরে লেখক মাহমুদুল হক'কে চিনলাম এর সাথে চিনলাম সাহিত্য প্রকাশের আরও চমৎকার সব বইয়ের সম্ভারকে। বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর সমগ্র লেখার রচনাবলী সংগ্রহ না করলেও সাহিত্য প্রকাশ থেকে এক নিমিষেই সবগুলো আলাদা আলাদা বই বগলদাবা করলাম।
'সেইসব গোল চারকোনা নরম বাগানে ছোটবড় অনেক গাছ। ফিকে সবুজ, ঘন সবুজ, নীলচে সবুজ, ধূসর সবুজ সেইসব গাছ অসংখ্য হাত বাড়িয়ে ধরে রেখেছে আকাশ সমুদ্র আর সুবিস্তীর্ণ স্তেপস কিংবা কিরঘিজ প্রান্তরের ছবি, সে রোমাঞ্চিত হয়৷ সেইসব গাছের পায়ের কাছে পোষ-মানা আদুরে হাতির মতো কান নাড়ছে অঢেল ছায়া। সবুজ উষ্ণতায় জড়ানো সেইসব সাংকেতিক গাছের অসংখ্য বাহুতে বসে নাম না জানা সুনীল পাখিরা দিনরাত আকুল সুরে গেয়ে চলেছে।
এইসব বিদীর্ণ দুপুরের মাঝখানে, ধু-ধু রৌদ্রের মাঝখানে, গোল চারকোনা বগানের চেয়ে, গাছের পাতার চেয়ে, সমুদ্রের চেয়ে, পাখির গানের চেয়ে, সুন্দর আর ঠান্ডা একটি মেঝে পরম নিভৃতে কোথাও আরামে চোখ বুজে অচৈতন্যপ্রায় পড়ে আছে জলেশ্বর মালীর মতো৷ অনুর মনে হলো, জলেশ্বর মালী কতো সুখী।
শ্রীনাথ জ্যাঠা ঋষিপাড়ার ফাঁকিবাজ ছোড়াগুলোকে তো বলেই, বলে সব কাজই কঠিন, তাকে ভালোবাসতে হয়, নিজের মাগী করতে হয়, মাগী করলি তো ধরা দিলো, তোর যে মাগী সে তোরই জানা। পায়ের জুতো পায়েই থাকবে মাথায় উঠবে না কখনো- স্রেফ গোঁজামিল দিয়ে চলা, এই যদি তোর মনের কথা হয়, তাহলে শিখবিটা কেমনে করে। পায়ের সেবা করলেই মাথা পাবি, মাথার মধ্যেই সব, মাথার মধ্যে বিশ্ব! '
স্বপ্নের আধার, তুমি ভেবে দ্যাখো, অধিকৃত দুজন যমজ যদিও হুবহু এক, তবু বহুকাল ধরে সান্নিধ্যে থাকায় তাদের পৃথকভাবে চেনা যায়, মানুষের চেনায় সক্ষম। এই আবিষ্কারবোধ পৃথিবীতে আছে বলে আজ এ-সময়ে তোমার নিকটে আসি, সমাদর নেই তবু সবিস্ময়ে আসি। -বিনয় মজুমদার
কিশোর বয়সী বড়লোকের সন্তান অনু। বাবা কোর্টের বাগ্মী পটু উকিল। যিনি কিনা বড় বড় আসামিদের সাজা মওকুফ করে দিতে পারেন। আসামিদের পক্ষে ওকালতি করে প্রচুর টাকা উপার্জন অনুর মায়ের অপছন��দ। পুলিশের ভয়ে থাকতে হয় সবসময়। যদি কখনো প্রয়োজন পড়ে তো উড়াল দিবে প্রবাসে। সেজন্য ইংরেজি শেখার জন্য শিক্ষক রাখে বাড়িতে। আগে অবসর সময়ে মা গল্প করতো অনুর সাথে; এখন আর সময় নেই। নির্জন দুপুরে মা যায় ইংরেজি শিখতে। নতুন বই নেই, নেই নতুন রেকর্ড কিংবা খেলনা। তাই অনুর দুপুর কাটে জানালা দিয়ে লামাদের বাগানে ভাসমান কিশোরদের ব্রিং খেলা দেখে। ধনীর অট্টালিকায় সকল কিছু থাকার পরেও যেন অনু একা।
এক নির্জন দুপুরে মায়ের আদেশ অমান্য করে অনু বাইরে খেলতে চলে যায়। সেখানে পরিচয় হয় ফকিরা, টোকানি, গেনদু, লাটু, ফালানি, মিয়াচাঁনদের সাথে। তাদের সাথে মার্বেল কিনে ব্রিং খেলায় মজে যায়; প্রতিবার সে হারতে থাকে। তবুও বদ্ধ পরিবেশের বাইরে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে অনু। নতুন সব অভিজ্ঞতা হয় তার। এভাবেই নতুন কিছু শেখার নেশায় নিয়মিত ওদের সাথে মিশতে থাকে। একদিন রাস্তায় সরুদাসী নামের একটি মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। যে কিনা বাবা-মায়ের সাথে বস্তিতে থাকে। অনুর পোশাক আশাক দেখেই তাকে বড় ঘরের সন্তান বুঝে নেয় সরুদাসী। দুইজন দুই মেরুর মানুষ হলেও অল্প সময়ে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। একে অপরকে তাদের জীবন সম্পর্কে খবরাখবর দেয়। হুট করেই যেমন বন্ধুত্ব গড়ে উঠে আবার তুচ্ছ কারণেই সরুদাসীর সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় এবং তার সাথে আর কখনো দেখা হয় না।
অনুর বাবা অনেক ব্যস্ত একজন মানুষ। তাঁর সময় নেই স্ত্রীকে দেওয়ার। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলেও তিনি নিজ ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেন। অনুর বিধবা ফুফু রানি ভাইয়ের বাসায় থাকার জন্য চিঠি দেয় এবং অনুর বাবা স্ত্রীর মতামতের জন্য আলোচনায় বসে। কিন্তু অনুর মা রাজি হয় না। এই নিয়ে তর্কবিতর্ক চলতে থাকে এবং এক পর্যায়ে চিরাচরিত নিয়মে অনুর মা সংসারের সকল অভিযোগ তুলে ধরে অনুর বাবাকে চরিত্রহীন সাব্যস্ত করে।
বইটির প্রধান চরিত্র কিশোর হলেও, কিশোর উপযোগী বই নয় এটি। 'অনুর পাঠশালা' নাম থেকে বোঝা যায় অনু নামের এক কিশোরের পাঠশালা নিয়ে গল্প। তবে এই পাঠশালা চিরাচরিত বিদ্যালয় নয়; আমাদের পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান থেকেই শিক্ষালাভকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। ধনী পরিবারের বদ্ধ পরিবেশ থেকে ভাসমান কিশোরদের সাথে সহজেই মিলে যাওয়াতে অনু যেন সকল বৈষম্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। সরুদাসীর চরিত্র নিয়ে একটু রহস্য রেখে দিয়েছেন লেখক। পাঠককে চিন্তা করার অবকাশ দিয়েছেন। বইটিতে একাকীত্বকে উপস্থাপন করা হয়েছে সকলের মাঝে অনুকে একা বানিয়ে।
বইটিতে সমাজের দুইটি শ্রেণির মানুষদের জীবনযাত্রার চিত্র ফুটে উঠেছে। একদিকে গোর্কি, মঞ্জুদের প্রাচুর্যময় জীবন এবং অন্যদিকে গেনদু, টোকানিদের কোনোরকম টিকে থাকা ; দুই মেরুর সাঁকো হিসেবে আবিভূত হয় অনু। একা থাকতে থাকতে অনু যখন বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছিল তখনই বস্তির কিশোরদের সঙ্গ তাকে আনন্দ দেয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের সাথে একমত না হলেও মেনে নেয়। একাকীত্ব কাটানোর উপায় হিসেবে তাদের সাহচর্যকে উপভোগ করে অনু।
মাহমুদুল হকের লেখা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কাব্যিক ভাষা ও উপমার যথার্থ প্রয়োগ প্রতিটি লাইনকে জীবন্ত করে উপস্থাপন করেছে। কাহিনির পরিসর খুব অল্প; তবুও বইটি পড়ার পর পাঠককে মুগ্ধ করবে। হ্যাপি রিডিং।
ভাল লাগছিল পড়তে, নিজেকে অনুর জায়গায় বসিয়ে ভাবছিলাম কী করতাম এমন দুপুরে? যখন ছোট ছিলাম? ছুটির দিনগুলো ছাড়া এমন দুপুর পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। তখন কম্পিউটার কেবল হাত দিয়ে শিহরিত হওয়ার বস্তু, বাবার অফিসের টেলেক্সের পরিবর্তে সবেমাত্র জায়গা করতে নিতে শুরু করেছে। মোবাইল ফোন সেতো ঢের দূর ভবিষ্যতের আগন্তুক। মা'র সংসারের কাজ গুছিয়ে ভাতঘুমের প্রস্তুতি, বাবা হয়তো অফিসে কিংবা পত্রিকা পড়তে পড়তে তা হাতে রেখেই ঘুমিয়ে। এমন দুপুরে কী করতাম আমি?
পড়তে পড়তে মনে মনে একটা সস্তা কাহিনীর প্লট ভেবে ফেলেছিলাম। তাই মনে হল হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গিয়েছে। অনুর পাঠশালার অনেক কিছুই মাথায় ধরেনি, এলেমে কুলোয়নি। তবে যতটুকু সংগ্রহ করতে পেরেছি তাই বা কম কীসে?
খাটের পুরু তোশকে তুলোর গরমে যে ছাদের শিকারী রৌদ্র ঘাপটি মেরে থাকে সে কথা মাহমুদুল হক ছাড়া আর কে লিখতে পারতেন?