বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস রচনায় এই গ্রন্থ নিঃসন্দেহে মূল্যবান সংযোজন। লেখক মঈদুল হাসান একাত্তর সালের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পটভূমিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সকল মূল উপাদানকেই একত্রে তুলে ধরেছেন। এই সব উপাদানের সংঘাত ও সংমিশ্রণে কিভাবে সফল রণনীতির উদ্ভব ঘটেছিল সেই ইতিবৃত্ত এই বিবরণে রয়েছে। এগুলিকে তিনি হাজির করেছেন ঘটনাবিকাশের নিজস্ব ধারাবাহিকতায়, যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণসহ। এ ছাড়া অনেক ঘটনা ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের কথা তিনি প্রকাশ করেছেন, যেগুলির অনেককিছুই আজও অপ্রকাশিত, অথচ যেগুলি ছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির কোন সঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। এ জাতীয় বিবরণ সম্ভবত কেবল এই লেখকের পক্ষেই সম্ভব ছিল। কারণ প্রবাসে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এবং তাঁর পক্ষ থেকে ভারত সরকারের উচ্চতর নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ব্যাপারে লেখক ছিলেন বিশেষ আস্থাভাজন ব্যক্তি। তাঁদের দু’জনার মাঝে যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ ও নিয়মিত। মুক্তিযুদ্ধকালের অনেক ঘটনার জন্যই লেখক এক নির্ভরযোগ্য সূত্র।
একাত্তর সালে পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যা, বর্বরতা ও সন্ত্রাসের ফলে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী মানুষের সংখ্যা অকল্পনীয়ভাবে বেড়ে চলে। প্রথমদিকে প্রবাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে পরিস্থিতি ছিল বহুলাংশেই অসংগঠিত ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে কর্মরত থাকাকালে আমি এই বিশৃঙ্খল ও অনিশ্চিত অবস্থা থেকে এই জাতির স্বাধীনতায় উত্তরণের জটিল প্রক্রিয়ার কোন কোন দিক লক্ষ্য করার সুযোগ পেয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন সমস্ত ঘটনার কেন্দ্রে এবং অপরিসীম নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কিন্তু তাঁর নিজের ভূমিকা সম্পর্কে এই মিতভাষী মানুষটি প্রায় কিছুই বলে জাননি। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের অনেকখানিই আজও অনালোকিত। তার কোন কোন অংশে আলোকপাত করতে মূলধারাঃ ’৭১ সমর্থ হয়েছে বলে আমার ধারণা।
তবে মঈদুল হাসান, সঙ্গত কারণেই সমগ্র বিষয়কে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে উপস্থিত করেছেন পর্যাপ্ত গবেষণা ও অপ্রকাশিত নানা দলিলপত্রের ভিত্তিতে ঘটনার নিরপেক্ষ উপস্থাপনের উদ্দেশ্যেই।
মঈদুল হাসান একজন লেখক এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জুলাই, বাংলা ১৪ শ্রাবণ, ১৩৪৩ সালে বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন; সেখানেই শৈশব কাটে তার।
পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৫৬-৬০)। শেষ বর্ষের ছাত্র অবস্থায় তিনি সেই সময়ের বহু প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাক-এ সম্পাদকীয় লেখা শুরু করেন। এতে করে তিনি পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গতিধারা পর্যবেক্ষণ করেন গভীরভাবে।
একসময়ে তিনি সাংবাদিকতা ছেড়ে দেন। ১৯৭১ সালে তিনি প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পালন করেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে ভারতের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারক সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছিল তাঁর অন্যতম দায়িত্ব।
মুক্তিযুদ্ধ, বাংলা সাহিত্য জগতের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। এই বিষয়েই সবচেয়ে বেশি লেখালেখি হয়। তো পাঠকদের স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘরানার বই পড়ার অভিজ্ঞতা মোটামুটি আছে। বাংলাদেশীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে গর্বের ব্যপার। অনেক বেশি আবেগের স্থান। তো উপন্যাস গুলোতে স্বাভাবিক ভাবেই একটু নাটকীয়তা চলে আসে। আসাটাই স্বাভাবিক।
মঈদুল হাসান এর মূলধারা:'৭১ আমার এ পর্যন্ত পড়া মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা সবচেয়ে প্রিয় বই। মুক্তিযুদ্ধের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো অনেক সুন্দর লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন লেখক। সম্পূর্ণ নির্মোহ ভাবে ইতিহাস লিখেছেন। বইটি পড়ে এক মুহূর্তের জন্যেও নাটকীয় মনে হয় নি তবু এতো থ্রিলিং বই যে এই বই থেকে মারভেল সিরিজ এর মুভি বের করা সম্ভব।
এই বই পড়ে একজন ব্যাক্তির প্রতি সম্মান অনেক বেড়ে গেল। মুজিবনগর সরকার এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। এর আগে সুহান রিজওান এর লেখা সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ পড়েছি। কিন্তু এই বই পড়ে তাজউদ্দীন আহমেদ এর প্রতি মুগ্ধতা বেড়ে গেল। একটি বিষয় না বললেই নয়। ২৫ শে মার্চের কালো রাত্রির পর আওয়ামী লীগ এর সকল বড় বড় নেতা পলায়ন করেন একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাদে। এর আগেই ভারত সরকার এর সঙ্গে আওয়ামী লীগ এর নেতাদের আলোচনা চলছিল। জরুরি অবস্থা যদি সৃষ্টি হয় তাহলে ভারতের সাহায্য পাওয়ার জন্য। কিন্তু এই আলোচনা থেকে কোন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয় নি। ২৫ শে মার্চের পর তাজউদ্দীন আহমেদ যখন প্রথম ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তখন সে জানতেন না কে জীবিত আছে কে মারা গেছে। এই সময় নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভারত সরকার এর সাহায্য আদায় করেছেন তাজউদ্দীন আহমেদ।
বাংলাদেশের জন্ম কিভাবে হল তা জানার জন্য এই বই পড়া সকল বাঙালির অবশ্য কর্তব্য।
১৯৭১ সাল। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজিত হয় বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে কি এমন প্রশিক্ষিত বাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব? তাও আবার এত কম সময়ে? ইতিহাস বলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আর কোনো দেশের মুক্তির লড়াই এত কম সময়ে শেষ হয়নি। এই অসাধ্য সাধন তবে হল কী করে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে পড়তে হবে এই বই।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফলভাবে এতটা দ্রুততায় শেষ হওয়ার পিছনে রয়েছে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতি-কূটনীতি, রয়েছে শরণার্থী সমস্যা আর এমনি আরো অসংখ্য জিনিসের অবদান। রণাঙ্গনের বাইরের এই রণে বাংলাদেশের হয়ে লড়েছে মুজিবনগর সরকার। আর একাই মুজিবনগর সরকারের কাণ্ডারি হয়ে এই লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। যুদ্ধ শুরুর পর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও সমর্থন অর্জন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর গণচীনের সব চোখ রাঙানি আর হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে জয় নিশ্চিত করা, শরণার্থীদের বাঁচানো আর যুদ্ধপরবর্তী দেশ গঠনের কাজ শুরু করা- সবকিছুর পেছনের নায়ক এই তাজউদ্দীনই।
লেখক মঈদুল হাসান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কাজ করেছেন তাজউদ্দীন এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে। বিশেষ বাংলাদেশ সরকারের হয়ে ভারত-রাশিয়ার সাথে যোগাযোগ এবং যুদ্ধ পরিকল্পনায় কাজ করেছেন তিনি। তাজউদ্দীন এর সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি মুজিবনগর সরকারকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। দলাদলি, ষড়যন্ত্র আর নানা প্রতিকূলতা জয় করে পাওয়া কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের সাক্ষী তিনি। তাঁর তথ্যবহুল সুলিখিত স্মৃতিচারণ এই বই।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের টেবিলের পেছনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বই বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। প্রত্যেক বাংলাদেশির জন্য অবশ্যপাঠ্য।
৪.৫/৫ পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে খুব সুন্দর হাতে তুলে ধরেছেন লেখক। একাত্তরের সামগ্রিক ইতিহাস নিয়ে যেসব কাজের সাথে পরিচয় ঘটেছে, একে সেই তালিকার একেবারে উপরের দিকে রাখতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের এক অসামান্য দলিল। মনে করি সব বাংলাদেশিদের জন্য অবশ্য পাঠ্য। মুক্তিযুদ্ধের নায়ক, তাজউদ্দিন আহমেদের লড়াই এর বিস্তারিত উপাখ্যান। মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরের বাইরে বহির্বিশ্বের রাজনীতি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা, একই সাথে দলীয় কোন্দল প্রতিরোধ সব কিছুর বিপরীতে অটল থেকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া এক নিঃসঙ্গ নায়ক, তাজউদ্দিন আহমেদ। এমনকী মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, বঙ্গ্বন্ধুর অনুপস্থিতে মাত্র কয়েক সপ্তাহে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সরকার যন্ত্র, সড়ক/রেল যোগাযোগ, ডাক ব্যাবস্থা চালু করে যেই অসামান্য প্রশাসক হিসেবে নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক তার প্রকৃত মূল্যায়ন হলে হয়ত আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ইতিহাস ভিন্নভাবে রচিত হতো।
মুক্তিযুদ্ধের জানা অধ্যায়ের মধ্যে সাদা সাপ আর কালো সাপেরা কিভাবে বিচরণ করেছে তার নির্মোহ বিবরণ এই বইতে পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা নির্ভরযোগ্য বইয়ের মধ্যে এটি অন্যতম। যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মীমাংসিত বিষয়ে অযথা তর্ক করেন এই বই তাদেরকে তর্কের পরিশ্রম অনেকটা কমিয়ে দেবে বলে আমার বিশ্বাস।
এই বইটার কথা জানতে পারি Bangladesh Studies কোর্সটা করার সময়। ম্যামকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত সবচেয়ে নন-বায়াসড বই কোনটি, তখন উনি এই বইটাই সাজেস্ট করেন। . . বইয়ের কাহিনি শুরু হয় ২৫শে মার্চের প্রাক্কাল থেকে। এরপর ধাপে ধাপে চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গের রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক ভূমিকা। আমরা আগে থেকেই ভাসা ভাসা কিংবা বায়াসড বইপত্র যেসব তথ্য জেনে এসেছি, সেগুলোর তথ্যও এখানে দেওয়া আছে। এই যেমন ঠিক কী কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি গড়ে ওঠে, মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা, নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান দাবি করা, নিজ সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন, মুক্তিযুদ্ধের পরিচালনা পদ্ধতি বিষয়ে মতভেদ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ইত্যাদি।
বইয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল ভারত সরকারের ভূমিকা। প্রথমত তারা মুজিব বাহিনীকে আলাদা করে ট্রেনিং ও অস্ত্র দেওয়া শুরু করে। দ্বিতীয়ত ভৌগোলিকভাবে তারা আমাদের পাশে অবস্থান করায় শরণার্থীরা সেখানেই আশ্রয় নেওয়া শুরু করে। আমরা জানি ভারত আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সমরাস্ত্র ���্রশিক্ষণ দেয়। কিন্তু আসলেই কি ভারতীয় প্রশাসন তা চেয়েছিল? একদম প্রথম থেকে কিন্তু ভারত আমাদের প্রতি সাহায্যের মনোভাব আনেনি। এখানে নেতা হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের চমৎকার কিছু সিদ্ধান্ত ও ভূমিকা দেখা যায়। বইয়ে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। ভারতের সাথে তাজউদ্দীন আহমদের গোপন সাক্ষাৎ, ঠিক কী কারণে ইন্দিরা গান্ধী আমাদের অনুকূলে আসেন এসবও আছে।
আরো আছে মুজিবনগর সরকার গঠন ও এর ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সবাই এক হয়ে যুদ্ধ করেছেন, তা কিন্তু না। অনেকেই আছেন যারা ব্যক্তিস্বার্থটাকেই সবার উপরে রেখেছিলেন ক্ষমতা পাওয়ার লোভে। মুক্তিবাহিনীর নাম করে লুটতরাজেও অনেককে অংশ নিতে দেখা যায়৷
বইটার সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং পার্টগুলোর একটা ছিল মুজিব বাহিনী। এইটা নিয়ে আগে খুব একটা জানতাম না। মূলত এপ্রিলের ১ম সপ্তাহে আওয়ামী যুব সংগঠনের চার নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমদ ও আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে এবং RAW এর পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁরা এই বাহিনী গড়ে তোলেন৷ পরবর্তীতে এটাই মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্ক্রিয়াকলাপকে বাধাগ্রস্ত করে। কারণ তাঁদের মতে শেখ মুজিব যুদ্ধ পরিচালনার কাজ উনাদের উপরেই দিয়ে গেছেন, অন্য কারো উপর নয়৷ এছাড়া অন্যান্য বাহিনীর ভূমিকা তো ছিলই। . . মঈদুল হাসান যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ থেকে ধারাবাহিকভাবে ইতিহাসটাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কথা বলেছেন এমন সব বিষয় নিয়ে, যা নিয়ে খুব কম জায়গায়ই আলোচনা করা হয়। তবে একটা বিষয় ছোট করে বলে রাখছি, এই বইয়ের বিপক্ষে একটা লেখা পড়েছিলাম (কমেন্টে আছে)। সেখানে বলা হয়েছে মঈদুল হাসান বেশ তাজউদ্দীনঘেঁষা যা বই পড়লেই বোঝা যাচ্ছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক উনি তাজউদ্দীনের ভূমিকা নিয়ে এখানে অনেক কথা বলেছেন৷ কারণ প্রবাসে তাজউদ্দিন আহমদের মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এবং তাঁর পক্ষ থেকে ভারত সরকারের উচ্চতর নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ব্যাপারে লেখক ছিলেন বিশেষ আস্থাভাজন ব্যক্তি। তাঁরা দুজনে বেশ ঘনিষ্ঠও ছিলেন। তাই বইয়ে তাজউদ্দীনের ভূমিকা থাকাটা একটু স্বাভাবিক।
বইটি থেকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস অনেকটাই অনুধাবন করা যায়। তবে এইটা এক বসায় শেষ করার মতো বই না৷ একটু ভেবেচিন্তে পড়ার মতো বই। এখানে সবচেয়ে মনখারাপ করা বিষয়টা হচ্ছে যেই দেশের জন্য তাজউদ্দীন আহমদ এত কষ্ট করে গেলেন, সেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৩ বছরও তিনি টিকতে পারেননি।
বইটার পিডিএফ ভার্সন ইউপিএল এর ওয়েবসাইটে বিনামূল্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া আছে। পড়তে চাইলে নামিয়ে নিতে পারেন।
A must read for all the Bangladeshis. The book summarizes and analyzes the diplomatic steps taken by the government of Bangladesh during the liberation war. It portrays the nature and conjuring of the relationship with India and India's role in the war. The readers will get a clear picture of what the government did and why they did so. Despite the combined efforts of US and China on Pakistan's side, the way Tajuddin Ahmed led the war stricken country to independence - is something to be proud of. The book isn't an easy read. But every minute spent reading the book is very much worth it.
আহারে তাজউদ্দীন! এত শ্রম, এত নিষ্ঠা, এত প্রচেষ্টা। বলতে গেলে শেষমেশ বেহাত বিপ্লব। আর আওয়ামী লীগ, এই আওয়ামী লীগ-ই যে মুজিব-কে খুন করবে তাতে আর আশ্চর্য কী!
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর হতে চললেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখনও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। নানা দল, আদর্শ আর মতের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করে। কিন্তু এর থেকে উত্তরণ দরকার আর এজন্য সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি ( আমার মতে) হলো যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন তাঁদের কথা শোনা। সেই উদ্দেশ্যেই বইটা হাতে নেওয়া। ও হ্যাঁ, লেখকের পরিচয়টা বলে নেওয়া ভালো। লেখক যুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহকারী ছিলেন এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, নেতাকর্মী এবং বিভিন্ন বিদেশি কর্মকর্তাদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন।
সহজভাবে বইটা মুক্তিযুদ্ধের একটা অংশের ইতিহাস। আর সেটা হলো মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা। মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে যুদ্ধ করেছেন বা দেশের মানুষ কতটা নির্যাতিত হয়েছেন বা পাক বাহিনী কতটা নিষ্ঠৃর ছিল সেসব ইতিহাসের কথা বইটা বলে নি। বইটা শুধুমাত্র ফোকাসড ছিল মুজিবনগর সরকার যুদ্ধকালে কিরূপ ভূমিকা রেখেছিল সেদিকটায়। ফলে স্বভাবতই উঠে এসেছে সাধারণ জনগণ ও নেতাকর্মীদের ভারতে আশ্রয় নেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও অস্ত্রের ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ( ভারত, রাশিয়া, চীন ও আমেরিকা) ভূমিকার কথা। বইটা দেখিয়েছে কেন ভারত মুক্তিযুদ্ধকে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ হলো, আমেরিকা কেন পাকিস্তানের পিছু ছাড়তে পারে নি, রাশিয়া কিভাবে যুদ্ধের অংশীদার হয়ে গেল মূলত ভারতের কারণে। আর সাথে মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন অন্তর্দ্বন্দ্ব, মুজিব বাহিনী ও আর কিছু গ্রুপের সাথে দ্বন্দ্ব এসবও উঠে এসেছে বইটাতে।
বইটা যেভাবে অসংখ্য রেফারেন্সসহ ধাপে ধাপে ( মাস ভিত্তিক, মার্চ থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত) ইতিহাস বর্ণনা করেছে তা অসাধারণ ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে অল্প সংখ্যক বই পড়েছি তাদের মধ্যে এটাই সেরা সে কথা বলতেও বাধ্য হচ্ছি। প্রবাসী সরকার ভারতে পালিয়ে গিয়ে নয় মাস আরাম-আয়েশ করেছে এ রকম একটা ধারণা যে বিভিন্ন কারণে আমার মধ্যে গড়ে উঠেছিল তা সমূলে ধ্বংস করেছে বইটা। মুজিবনগর সরকারকে বিশেষত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে যেভাবে মন্ত্রীসভার অন্তর্দ্বন্দ্ব, নিজের প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে ঝামেলা, বিভিন্ন গ্রুপের সাথে দ্বন্দ্ব, ভারতকে বিভিন্নভাবে রাজি করানো, মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা, অস্ত্র সংগ্রহ, স্বীকৃতি আদায়, প্রচার মাধ্যম পরিচালনা, মনোবল ধরে রাখা বা স্বাধীনতার মাস খানেকের ভেতর দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে কাজ করতে হয়েছে তা চেখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে বইটা। এছাড়া ‘র’ ও সিআইএ এর ভূমিকা, শরণার্থীদের চাপ, ভারতের উচ্চ পর্যায়ে বামপন্থী ও ডানপন্থীদের সংঘাত এসবও অসাধারণভাবে তুলে ধরেছে বইটা। ‘সিক্সটিনথ ডিভিশন', ফোর্স গঠনে হঠকারিতা ও ব্যক্তিগত ঈর্ষা, সেনাপ্রধানের অভিমান ও একগুয়েমি, বিপুল সংখ্যক ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার নিষ্ক্রিয়তা ইত্যাদি নতুনভাবে জানতে পেরেছি বইটা থেকে।
বিপরীতক্রমে যে একটা কথা বলতেই হয় সেটা হলো বইটাকে কেন যেন ‘ তাজউদ্দীন আহমদের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা’ মনে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা তো অস্বীকার করার প্রশ্নই উঠে না কিন্তু যেভাবে তাঁকে এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে দেখানো হয়েছে তাতে মনে একটা খচখচানির সৃষ্টি হয়েছে তা বলতেই হচ্ছে। তিনি সবকিছু একা হাতে সামলিয়েছেন, অন্যরা কিছু তো করেই নি উল্টো তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন এমন একটা ধারণা হয়েছে বইটা থেকে। তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় এবং লেখক নিজে তাঁর অধঃস্থ কর্মকর্তা হওয়ায় তাজউদ্দীনের ভূমিকার কথা বেশি আশা অস্বাভাবিক না কিন্তু পুরো বইয়ে কামারুজ্জামান খুঁজেই পাই নি বা নজরুল হাতে গোণা কয়েকবার।
যাহোক, বইটা যে আমাকে মুগ্ধ করেছে সেটা বলতেই হচ্ছে। মুক্তিযুদ���ধের ইতিহাসের একটা অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক আমার সামনে উন্মোচন করেছে বইটা। বইটা সকলের পড়া উচিত বলে আমি মনে করছি।
'বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের দূরবর্তী অনেক কারণ ছিল। এর মাঝে সর্ববৃহৎ কারণ ছিল ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থানের সকল বিরুদ্ধতাকে উপেক্ষা করে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠন পরিকল্পনার অভিনবত্বে। দ্বিতীয় বৃহৎ কারণ ছিল ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন নানা ভাষাভাষীদের নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের উপযোগী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো অন্বেষণে পাকিস্তানী নেতৃবর্গের সম্যক ব্যর্থতা। ফলে পাকিস্তানের কাঠামোগত স্ববিরোধিতার সমাধান না ঘটে বরং এক সংঘাতের স্রোত উত্তরোত্তর প্রবল হয়ে উঠে। পাকিস্তান গঠনের পর থেকেই বাঙালীরা রাষ্ট্র জীবনের সর্বক্ষেত্রে উপেক্ষিত, বঞ্চিত ও শোষিত হতে শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে তারা কখনো রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন, কখনো স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, কখনো জনসংখ্যাভিত্তিক আইন পরিষদ গঠনের দাবী এবং কখনো অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের দাবী করে এসেছে।'
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সামরিক ইতিহাসের পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। মুক্তিযুদ্ধ প্রাক্কালে সমস্যাটা রাজনৈতিক থাকলেও পরবর্তীতে সেটি সামরিক সমস্যায় রূপ নেয়। এই সামরিক সমস্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির সমান্তরালে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশ সরকার ও বহির্বিশ্বের সাথে রাজনৈতিক আলোচনা চলতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং ন্যাপের একনিষ্ঠ সমর্থক হওয়ার সুবাদে মুক্তিযুদ্ধকে তিনি দেখেছেন অনেক কাছে থেকে, যারই বর্ননা দিয়েছেন বইটিতে। বইটি একইসাথে নন্দিত এবং নিন্দিত। তবুও এমন কিছু বিষয় বইটিতে উঠে এসেছে যা অনেকটা চাপা পড়ে গেছে। হ্যাপি রিডিং।
First thing first, this book is easily one of the most enjoyable and enlightening books I've read on the 1971's Bangaldesh. The writer Moydul Hasan was one of the close associates of Tajuddin Ahmed during his struggle to keep afloat this tiny nation during the war. From his position he was able to explain various kinds of interaction about both the international factions and internal parties. And if anything else during the last 3 months of the war, the level of geo-politics involved in this small country's war would surely put you at the edge of the seat.
The writer covers incidents he was personally involved in from 25th March, 1971 to 10th January, 1972. The level of reference(not just links but actual documents) provided at the end of book helps to establish the credibility. Due to his approach of narrating only the incidents he was personally involved, the pacing was smooth, but two aspects of the war left pretty much unattended: the struggle of civilians during the war, the oppression of Pakistani army on them and the tale of freedom fighters across the country. But there are other book for them. This one feels like the best book one can pick up to read about the fight Bangladesh had to do in the hostile political and diplomatic landscape during 1971.
যুদ্ধের নয়মাস লড়াইটা যেমন চলেছিল মাঠে, তেমনি লড়াইটা চলেছিল কাগজে কলমে। মূলত মাঠের লড়াইটার গতিপথ ঠিক করে দিত ঠান্ডা ঐ কূটনৈতিক লড়াই। একটা জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন রূপ নিতে যাচ্ছিল পরাশক্তিদের লড়াইতে। সপ্তম নৌবহর যখন চলে এসেছিল আমাদের উপকূলে, অন্যদিকে রাশিয়া যখন প্রস্তুত হয়েছিল তার সামরিক শক্তি নিয়ে। কিন্তু তারপরেও সংঘর্ষ হয়নি? কেনই বা ভারত এত দেরি করেছিল বাংলাদেশের যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে? বিশাল সংখ্যক বাহিনী নিয়ে পাকিস্তান কেন এত তাড়াতাড়ি হার মেনে যায়? চীনের কেন ছিল এক রহস্যময়ী ভূমিকা? মোশতাক-শেখ মনিরা কেন সাপ হয়ে গর্ত খুঁড়তে গিয়েছিল তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে? দালিলিক প্রমান সহ মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক লড়াই নিয়ে অসাধারণ একটা বই। উঠে এসেছে নানা 'কঠিন প্রশ্নের' সহজ উত্তর। অন্যদিকে তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর অসাধারণ রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রজ্ঞার কারণে নানা জটিল বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারলেও আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাই সেটি পারেননি। ফলে সরকার গঠনের পর থেকেই তাজউদ্দীন আহমদকে নানা রকম উপদলীয় ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়। সেসবের বিস্তারিত বিবরণও আছে এই গ্রন্থে। তাজউদ্দিন আহমেদের ঘনিষ্ট সহযোগী মঈদুল হাসান খুব কাছ থেকেই দেখেছেন সবকিছু। তিনি ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ হতে ১৯৭২ এর জানুয়ারি পর্যন্ত ঘটনাবলীর বিবরণ তুলে ধরেছেন ২২টি অধ্যায়ে। ৯০ পৃষ্ঠার পরিশিষ্ট অংশে তুলে ধরেছের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নথিপত্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে জানতে এটি একটি অবশ্য পাঠ্য বই।
তাছাড়া যারা মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে সারাদিন তর্ক করে মজা পান, শ্রম দেন। তাদের কষ্ট অনেকটা লাঘব করে দিবে বইটি।
সমকালীন ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে বর্ণনাকারীর রাজনৈতিক ভাবাবেগ ও পক্ষপাতিত্ব প্রায়শ এক সাধারণ সমস্যা। যদি কোন কারণেই সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে বর্ণনাকারীর কিছু সংস্রব ঘটে, তবে আত্মপ্রকাশের প্রবণতাও একটি অতিরিক্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বিবরণ হারায় ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠা। এই দ্বিবিধ বাধা অতিক্রমের জন্য যে নিরাসক্ত নিষ্ঠা ও সততা প্রয়োজন, তা সম্যক আয়ত্ত করার দাবী আমার নেই। তবে এই প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন ও যত্নবান থেকেছি বিনীতভাবে তার উল্লেখ রাখতে চাই।
লেখক এই কথাটা রাখার শতভাগ চেষ্টা করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
তবে বইয়ের কয়েকটি বিষয় আলোচনা না করলেই নয়।
১. ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পিছনের রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক দিকটি বইটির মূল আলোচ্য বিষয় হলেও যথোপযোগী কারণেই মাঠ পর্যায়ে চলমান যুদ্ধের চিত্রও উঠে এসেছে যা থেকে একটা কথাই মাথায় আসেঃ
সোনার মোড়কে একটা লাশকে মোড়া হলেও লাশটাকে ব্যাকটেরিয়া ভিতর থেকে নিঃশেষ করেই দেয়। আর এ তো একটা সংগ্রামের ইতিহাস।
২. ১৯৭২-১৯৭৫ এবং ’৭৫ পরবর্তী অনেক ঘটনারই সূত্রপাত যে এই সময়েই শুরু হয়েছিল তার একটি প্রচ্ছন্ন আভাস পাওয়া যায় এই বই থেকে।
৩. লেখক যুদ্ধচলাকালীন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী তুলে ধরার পাশাপাশি, সে ঘটনাগুলোর পর্যালোচনাও করেছেন যার সাথে ক্ষেত্রবিশেষে একমত হলেও, ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিমতও পোষণ করেছি।
৪. এই বইয়ের পরিশিষ্ট এই বইয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ যার পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে আমাকে নাকানিচুবানি খেতে হয়েছে। তবু এই পরিশিষ্টগুলো থেকেও এমন অনেক তথ্য পেয়েছি যা মূল বইয়ে নেই।
৫. রাজনৈতিক আর কূটনৈতিক দিকে ফোকাস করলেও এই বইয়ে কিছু ঘটনা অনুল্লিখিত থেকে গেছে। লেখকের একটা ইন্টারভিউয়ে লেখক ভুট্টো আর ইয়াহিয়া খানের লারকানায় মোলাকাতের কথা উল্লেখ করলেও মূল বইয়ে তা উল্লেখ করেন নি। এটা অবশ্যই আলোচনার বিষয়ের মধ্যে থাকার কথা।
তাছাড়া বইটির সমাপ্তি পাঠকদের একটু হলেও এক প্রকার হতাশার আমেজে বিদায় জানাবে। শেষে এ���টা হাইনোটে শেষ হতে গিয়েও বইটি শেষে এমন এক নোটে সমাপ্তি টানবে যাতে লেখকের নিজের মধ্যাকার হতাশাই প্রকট হয়ে প্রকাশিত হয়। এই হতাশা ছোঁয়াছে রোগের মত পাঠকদেরও ঘিরে ধরবে।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের আকর গ্রন্থ হিসেবে "মূলধারা ৭১"-কে দাবী করলে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। কারণ মূলধারা ৭১ মুক্তিযুদ্ধের নির্মোহ ইতিহাস তুলে ধরে বলে আমার ধারণা।লেখক মঈদুল হাসান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন, ফলে কাছ থেকে দেখতে পেরেছেন কিভাবে মুজিবনগর সরকার কূটনৈতিক সমস্যা বা চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলা করেছে। কিংবা কিভাবে বৈদেশিক সমর্থনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করা হয়েছে, সেই সমর্থন আদায়ে কি কি পদক্ষেপ নিতে হয়েছে এসকল কূটনৈতিক আলোচনা তুলে ধরা হয়েছে এই বইয়ে।তাছাড়াও মুক্তিযুদ্ধকে বারবার পিছন টেনে ধরতে চাওয়া হয়েছে, দলের মধ্যে উপদল সৃষ্টি হয়েছে, সে সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে বারবার বানচাল করার চেষ্টা করা হয়েছে।এসব কিছুর নির্মোহ ও আপাত সত্য ইতিহাস তুলে ধরেছেন এই বইয়ে।যেহেতু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে যুদ্ধকালীন সময়ে লেখক ছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী তাই তাজউদ্দীন আহমেদের অনেক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেছেন যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে।বর্তমানে এই তথ্যগুলো সাধারণ মানুষদের জানা নেই বললেই চলে যে তাজউদ্দীন আহমেদ কিভাবে এমন বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। এই বইটা হতে পারে সেই "নটোরিয়াস ম্যান"-কে জানার অনুপ্রেরণামূলক গ্রন্থ। হ্যাপি রিডিং 💙
বিশেষ করে তাজউদ্দীন আহমেদ, প্রবাসী সরকার, ভারত, আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মুক্তিযুদ্ধে কি ভূমিকা ছিল আর সামরিক বেসামরিক মুক্তি বাহিনীর যুদ্ধকৌশল কেমন ছিল তা বিস্তারিত আলোচনা আছে বইটিতে। কেন এবং কিভাবে ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিলো? এ প্রশ্নের উত্তর পরিপূর্ণভাবে দেয়া আছে। এছাড়া বইয়ের বর্ণনা অনেক স্মুথ, পড়তে একফোঁটা বেগ পেতে হয়না।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে জানতে এটি একটি অবশ্য পাঠ্য বই। এর আলোচিত সময় ১৯৭১-এর মার্চ তেকে ১৯৭২-এর ১০ই জানুয়ারীতে শেখ মুজিবরের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকাল পর্যন্ত। বিষয়বস্তু হলো মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও মূল ঘটনাধারা। লেখক এ সময়টায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের যে সব নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন এবং সংগ্রামের সাংগঠনিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার যে দিকগুলো সম্পর্কে অবহতি ছিলেন, তাই বর্ণনা করেছেন।
সচরাচর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা যেসব বই পড়ি তার বেশিরভাগই রণাঙ্গনভিত্তিক। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, জনগণের কষ্ট নিয়ে জানা হলেও যুদ্ধের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে খুব একটা আলোচনা হয়না। অথচ জনতার সংগ্রামকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যেতে রাজনীতির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের সুবাদে প্রবাসী সরকার গঠন, ভারত-সোভিয়েত মিত্রদেশ, আমেরিকা - চীন শত্রুদেশ এটুকু আমাদের জানা থাকলেও ঠিক কিভাবে প্রবাসী সরকার গঠন হয়েছিল, ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এই স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্পর্কে কি মতামত ছিল, সোভিয়েতের স্বার্থ, চীনের স্বার্থ কি ছিল এই বিষয়গুলো সম্পর্কে যথেষ্ট অজ্ঞতা আছে। এই বইয়ের লেখক তাজউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন যার ফলে অনেক অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মিটিং ও কর্মধারা সম্পর্কে সরাসরি অবগত ছিলেন। নয় মাসকে অধ্যায়ে ভাগ করে প্রতিমাসের রাজনৈতিক অবস্থা, সিদ্ধান্তের পরিবর্তন লেখক লিপিবদ্ধ করেছেন। যদিও ঐতিহাসিক বিষয়গুলো ইউটিউবেই অনেকটা জানা যায় বাট এই বইয়ে সরকারপক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা একটা ন্যারেটিভ পাই যে তারা রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি কিভাবে সামলাতেন। আওয়ামীলীগের উপদলীয় কোন্দল, তাজউদ্দিনের দলের মধ্যে অগ্রহণযোগ্যতা, খন্দকার মোশতাক, কর্ণেল ওসমানী এদের নিজ নিজ নীতি, বিভিন্ন পররাষ্ট্রীয় চুক্তির যেমন চীনের স্বার্থ , ভারত-সোভিয়েত, সোভিয়েত-মার্কিন, মার্কিন-চীন, চীন-পাকিস্তান সম্পর্কগুলোর ধারাবাহিকতাটা এবং এই সম্পর্কগুলো কিভাবে মুক্তিযুদ্ধকে প্রভাবিত করেছিল তা বোঝা যায়। তবে এই বইয়ের একটা সীমাবদ্ধতা হলো এখানে ভারত সরকারের ব্যাপারটুকুই এসেছে বেশি, অন্য সংগঠনগুলোর ভূমিকা কম। প্রবাসী সরকারের কার্যকলাপ ও যুদ্ধকালীন পররাষ্ট্রীয় ব্যাপারে বস্তুনিষ্ঠ একটা ধারণা পাওয়ার জন্য ভালো বই। রেটিং:৪/৫
মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য বইয়ের তুলনায় এই বইটি কিছুটা ভিন্ন বলা যায়৷ আক্রমণ, অত্যাচারের ঘটনার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনীতিই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনি যতই পড়বেন ততই কনফিউজড হতে হবে৷ একই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রয়েছে ভিন্নমত৷ তাছাড়া যুদ্ধপরবর্তী বিভিন্ন সময়ে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টাও কম হয়নি। তাই নিরপেক্ষ ইতিহাস পেতে বেগ পেতে হয়৷ তাছাড়া একই ঘটনার একাধিক দিক থাকে যা সব পক্ষের মতকেই সত্য বলে মনে হয়ে থাকে৷
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তাজউদ্দিন আহমেদের সরকার গঠন, ভারত সরকারের নানান প্রতিক্রিয়া, সাহায্য, বৃহৎ শক্তি আমেরিকা, চীন, রাশিয়ার পদক্ষেপ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেমন ছিলো তা বইটিতে খুব সুন্দর করে তুলে ধরা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ মানে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে যুদ্ধের ভয়াবহ আবহ। মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই, এর আশেপাশে থাকে মুক্তিকামী জনগণের প্রচেষ্টা, ইত্যাদি। কিন্তু এর পেছনেও অনেক গল্প থাকে। এই যে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের গল্প বয়ান করা হয়, সাধারণ মানুষেরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে, কিংবা লাখ লাখ মানুষের শাহাদাত বরণ বা মা-বোনদের সম্ভ্রমহানির এত সব গা শিউরে ওঠা ঘটনা ঠিক সহ্য করা যায় না।
প্রকাশ্যে বা সম্মুখ যুদ্ধের অনেক ঘটনাই আমরা জানি। সে সব পড়তে পড়তে শিহরিত হই। মনে হয়, ইশ! যদি সে সময়ে আমিও থাকতাম। কিন্তু পঞ্চাশের অধিক আগের সময়ের সেই গল্পে আমার জায়গা হয়নি। সময়ের বিবর্তনে অনেক গল্পই হারিয়ে যায়। ভিন্ন ধারার পরিচালিত করা হয় সত্যকে। কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে উপরে দেখানোর চেষ্টাতে আড়ালে রাখা হয় মূল কুশীলবকে। অথচ তিনি না থাকলে হয়তো নতুনের ভোর দেখা হতো না। সবুজের বুকে লাল সূর্যের উদয় সময়ক্ষেপণ হতো, কিংবা কখনোই উঠত না।
“মূলধারা ৭১” তেমনই এক বাস্তবসম্মত উপাখ্যান। যা বের করে আনে ভেতরের গল্পকে। যা হয়তো আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। আমরা যুদ্ধের ঘটনা জানি, কিন্তু যুদ্ধের যে এক বিশাল প্রক্রিয়া ছিল তার কতটা জানি? কিছুটা হয়তো জানি, কিন্তু লোকমুখে শোনা অনেক কিছুই সময়ে অসময়ে পরিবর্তিত হয়। সত্যের সাথে মিথ্যের মিশেল সঠিকটা জানতে দেয় না। এই যেমন, তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের ��ুক্তি সংগ্রামের সবচেয়ে বড় নেতা। তিনি না থাকলে হয়তো এই স্বাধীনতার যুদ্ধ বেগবান হতো কি না সন্দেহ। অথচ তিনিই হারিয়ে যান বারবার। কোনো আলোচনাতেই তাকে সেই মর্যাদাটুকু দেওয়া হয় না।
একাত্তর সালের ২৫শে মার্চ যে ভয়াবহ কালো ছায়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর পড়েছিল, তার প্রভাব ছিল পরবর্তী নয়টা মাস। মানুষ জানের ভয়ে পালিয়েছে, ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে অন্য ভূখণ্ডে। পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী নামক সন্ত্রাসদের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম মনে ভীতি সঞ্চার করে। মানুষের তখন একটাই চাওয়া, এই প্রাণটা অন্তত বেঁচে থাক। তাই পাশের দেশ ভারতের উদ্দেশ্যে ছুটতে শুরু করে মানুষ। একটু আশ্রয়ের নেশায়, ভালো থাকার চেষ্টায়। কিন্তু যেখানে এত মানুষের ঢল নামে সেখানে টিকে থাকার লড়াইও করতে হয়।
এত মানুষের ঢল বিচলিত করে ভারতকেও। সবাইকে আশ্রয় দিতে হিমশিম খেতে হয় প্রতিবেশী দেশটিকে। সেই সাথে রাজনৈতিক নেতাদেরও আশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা করতে হয়। বাংলাদেশের সরকার গঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী হন তাজউদ্দীন আহমদ। কিন্তু এই বিষয়টা অনেকেই ভালোভাবে নেননি। তাজউদ্দীনের বিরোধিতা অনেকেই করেন। একটি দেশ তাদেরই সামরিক শক্তি দ্বারা আক্রান্ত, মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য এদিক ওদিক ছুটছে; সেখানেও কিছু অসৎ ক্ষমতালোভী ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যা ইচ্ছে করতে শুরু করেছে। তাজউদ্দীন আহমদ না থাকলে হয়তো এই স্বাধীনতাটাই হতো না।
“মূলধারা ’৭১” মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে রচিত নন-ফিকশন জাতীয় একটি বই। বহু ফিকশনের ভিড়ে, মুক্তিযুদ্ধের গল্পের আড়ালে এসব সত্য ঘটনা চাপা পড়ে যায়। আমরা জানতেও পারি না, ঠিক কীভাবে আমাদের যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। বাইরের পরাশক্তিদের কে আমাদের সাহায্য করেছিল, কেন করছিল! কোনো স্বার্থ ছিল কি তাদের? আবার কারা আমাদের বিরোধিতা করেছিল। অখন্ড পাকিস্তানের যে রূপরেখা ছিল, তার বিভক্তি অনেকেই চায়নি। বিশ্বের বড় বড় পরাশক্তিদের চাওয়া ছিল অখন্ড পাকিস্তান যেন বজায় থাকে। এতে দমন, পীড়ন চললে চলুক!
যে সময় থেকে ভারতের অভিমুখে বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের যাত্রা শুরু হয়, তখন থেকেই চাপে পড়ে ভারত। পঙ্গপালের মতো মানুষ জীবন বাঁচাতে ছুটছে। তাদের আশ্রয় দিতে যেমন জায়গায় প্রয়োজন, তেমনই তাদের জীবনধারণের জন্য যে ত্রাণ বা অর্থ দরকার; সব যোগান দিতে হয়েছে ভারত সরকারকে। কিন্তু বাইরের একটি দেশের মানুষের জন্য কেন কেউ করবে। ভারতের রাজনীতিতে বড় একটা অংশ তখন বিরোধিতা করে বসে। বিশেষ করে বিরোধীপক্ষ। কারণ এই মানুষের চাপে যখন জায়গার সংকুলান হচ্ছে না, তখন দেশীয় অর্থনীতিও নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ছে। যত দ্রুত সম্ভব এসব উদ্বাস্তুদের তাই নিজ দেশে পাঠাতেই হতো।
শুরু থেকেই ভারত বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি উদার মানসিকতা দেখালেও, সাহায্যের হাত বাড়াতে বিশেষ কালক্ষেপণ করেছে। হয়তো তারা ভেবেছে খুব দ্রুত বাংলাদেশের পক্ষে সাহায্য করলে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ আসবে। এতে বিপদে পড়বে খোদ ভারত। তাই সময়ক্ষেপন করে বাংলাদেশের সাহায্যের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু এত মানুষের মৃত্যু, এত মানুষ তখন বাস্তহারা, যুদ্ধের জন্য পরিবার-পরিজন ছেড়ে সীমান্তে ছুটে আসা— সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অপেক্ষা করার ধৈর্য ছিল না। তাই বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও ভারতকে চাপে রাখার চেষ্টা চলেছে। কিন্তু ভারতের অভিমত তখনও বোঝা সম্ভব হয়নি।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সরকার গঠিত হয়েছে। যুদ্ধের মতো বিশাল এক কর্মযজ্ঞ যেখানে আসন্ন, সেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারের অবশ্যই প্রয়োজন। তাজউদ্দীন আহমদ সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। যিনি একা হাতে এই মুক্তিযুদ্ধের রাশ টেনে ধরেছেন। যদিও তাজউদ্দীন আহমদকে সেই সময়ে আওয়ামীলীগের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। হয়তো তাজউদ্দীনের মতো সৎ মানুষের নিঃস্বার্থ কাজ অনেকের স্বার্থেই আঘাত হেনেছিল। তাই বিরোধিতা করার মানুষের অভাব ছিল না। কেউ ক্ষমতালোভে কেউবা ঈর্ষায়। ওদিকে ভারতের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার গড়িমসি ভাব কিংবা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আসা তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ধীরগতির কারণে অনেকেই তাজউদ্দীনের নেতৃত্বের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে। কিন্তু সময়টা তখন এতটাই সঙ্গীন যে, শত চেষ্টাতেও নিজের কাজ গুছিয়ে নিতে পারছিলেন না বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক ঘটনাই সংগঠিত হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাজনৈতিক বিষয় আশয়। সদ্য এক দেশ অত্যাচারের শিকার হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। নিজদের সরকার গঠন করেছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক স্বীকৃতি অনেক গুরুত্ব বহন করে। ভারত আশ্রয় দিলেও সেই স্বীকৃতি দিতে যেন অনিহা। সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়ার পরও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে ধীর গতি। এদিকে সময় এগিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান সন্ত্রাস সেনাবাহিনীর হাতে মারা পড়ছে মানুষ। জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বসতভিটা। তাই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ধৈর্য ধারণ সম্ভব হচ্ছিল না। তাজউদ্দীন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এই স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগতিতে যেন ভারত কিছুটা এগিয়ে আসে।
কিন্তু ভারতের দিকটাও ভেবে দেখা প্রয়োজন। একাত্তরের কিছু বছর আগে চীনাদের সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত এক সীমান্ত যুদ্ধ সংগঠিত হয়ে গিয়েছে। তারপরই ভারত সামরিক শক্তি বাড়াতে সচেষ্ট হয়। এমন অবস্থায় যদি পাকিস্তানের উপর আক্রমণ করে, তাহলে চীনারাও ছেড়ে কথা বলব না। কেননা পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সমর্থক তারাই। অন্যদিকে মার্কিনদের মতো পরাশক্তিও পাকিস্তানের পক্ষে। ফলে ভারত যে চাপে ছিল, তা অনুমেয়। অন্যদিকে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নকে পক্ষে নিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে।
যদি শুরুতেই ভারত পাকিস্তানের পক্ষে আক্রমণ চালাত তাহলে আন্তর্জাতিক মিডিয়া এক পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃতি দিত। ফলে বাঙালিদের যে ত্যাগ, নিজেদের জীবন হারানো; সেই দিক দিয়ে অবিচার হতো। তাই ভারতও অপেক্ষা করেছে। নিজ দেশের যুদ্ধে নিজেরা সর্বাত্মক এগিয়ে যাওয়ার পর ভারত এগিয়ে আসব। আর এই কাজ ত্বরান্বিত করেছে খোদ পাকিস্তান নিজে। নিজ ভূখণ্ড ছেড়ে আসা পকিস্তান হানাদার বাহিনী একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতের আক্রমণ রুখতে তারা সীমান্তে নিজেদের শক্তপোক্ত অবস্থান গড়ে তোলে। এতে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ তাদের শক্তি কিছুটা ক্ষয় হয়। শেষদিকে মার্কিনদের প্ররোচনায় হুট করে ভারতীয় সীমান্তে আক্রমণে ভারত সুযোগ পেয়েও গেল এগিয়ে আসার। আর এতেই যুদ্ধ যথেষ্ট বেগবান হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বাচন করার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই এক ধরনের বৈষম্য দেখা দেয়। বেছে বেছে আওয়ামীপন্থীদের সুযোগ দেওয়ার কারণে এক ধরনের মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। সবাই তো দেশকে ভালোবাসে। দেশের টানে সবাই ছুটে আসছে। তাহলে কেন নির্দিষ্ট এক দলের লোকজনই কে সর্বোচ্চ সুযোগ পাবে? তবে এইদিকে তাজউদ্দীন আহমদ খুব সাহসী একটা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সব ধরনের জনসাধারণ, ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত করার নির্দেশ বা প্রয়াস তারই ছিল। এতে অনেকেই মনক্ষুন্ন হয়েছিলেন।
সেই কারণেই কি না কে জানে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর বিশেষ প্রশিক্ষণে গঠিত হয় মুজিব বাহিনী। এই বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে সহজ করার চেয়ে বেশিরভাগ বাঁধাসৃষ্টি করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নিজ দলের ভেড়ানোর চেষ্টা বা অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টার পাশাপাশি যুদ্ধকে মন্থর করে দেওয়ার চেষ্টা ছিল তাদের। হয়তো তাজউদ্দীনের নেতৃত্ব পছন্দ ছিল না বলেই এই বিপরীতমুখী কর্মকাণ্ডে তারা নিজেদের নাম লিখিয়েছিল।
যেহেতু মার্কিনরা এই যুদ্ধে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিল, তাদের চাওয়া ছিল অখন্ড পাকিস্তান। কোনভাবেই পাকিস্তানের এই বিচ্ছেদ তারা মেনে নিতে পারেনি। তাই বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। জাতিসংঘ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল মার্কিনীদের কূটচাল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতকে হুমকি ধামকি দেওয়ারও চেষ্টা করেছে তারা। মূলত আমার মনে হয়েছে মার্কিনীদের এই ঔদ্ধত্যের কারণে পাকিস্তান অনেক বেশি ফল ভোগ করেছে। হয়তো পঁচিশে মার্চ কিংবা ১৪ই ডিসেম্বরের ভয়াবহতা আগে থেকেই তারা জানত। কে জানে, তাদের বুদ্ধিতেই পাকিস্তানের এই বর্বরতার সূচনা। যদিও মার্কিন জনগণ পুরোটা সময় পূর্ব পাকিস্তানের সাথে ছিল। নিজ সরকারের এমন আচরণ তারা মেনে নেয়নি। যদিও এই দেশেরই কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ মার্কিনীদের সাথে হাত মেলানোর চেষ্টা করেছে দেশেকে আরো অস্থিতিশীল করার চেষ্টায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন কিছু মানুষকে প্রশিক্ষন দেওয়া হয়েছিল, যারা প্রশিক্ষণ নিলেও যুদ্ধ করেনি। তাদের হাতের অস্ত্র তাই অনেক ভীতির কারণ। কেউ কর্মে না থাকলেও কর্মের সুফল নিতে সবাই ছুটে আসে। তাই যুদ্ধ শেষে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাইরে অনেকেই অস্ত্র হাতে উৎসব, উল্লাস করেছে যারা আসল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা না। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো তারা কোথা থেকে অস্ত্র পেল?
“মূলধারা ’৭১” বইটির লেখক মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দীনের সহযোগী ছিলেন। ভারতের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক আলোচনায় তার স্বরূপ উপস্থিতি ছিল। তাজউদ্দীনের কথায় ছুটোছুটি করেছেন। কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। এর অভ্যন্তরীণ ঘটনাগুলো জেনেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ক্ষেত্রে যদি সবচেয়ে নিরপেক্ষ বই ধরা হয়, এই বইটি সর উপরেই থাকবে। কোনো তৈলমর্দন নেই, অতিরঞ্জিত বিষয় নেই। তবুও কিছু কথা থাকে। যেহেতু একজন ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে বইটি রচিত, তাই সবকিছুই যে নিরপেক্ষ এমন নাও হতে পারে। তবে সর্বাধিক নিরপেক্ষ হিসেবে “মূলধারা ’৭১” অবশ্যই সবার শীর্ষে। আমার অন্তত এমনটি মনে হয়েছে।
বইটিতে তাজউদ্দীন আহমদকে অনেক বড় হিসেবে দেখানো হয়েছে। আমাদের এই মুক্তির সংগ্রামের অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। ভারতের সাথে দেন-দরবার, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ সবকিছুতেই তাজউদ্দীন আহমেদ ছিলেন অটল ও অবিচল। তিনি শক্ত হাতে শত্রুপক্ষকে দমন করার চেষ্টা করেছেন। এতকিছু বইটিতে উঠে এসেছে যেখানে মনে হবে, তাজউদ্দিন আহমদই ছিলেন সেই সময়ের সর্বেসর্বা। অবশ্যই এটাই আমাদের মেনে নিতে হবে। যেভাবে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র চলছিল, তাজউদ্দীন আহমদ না থাকলে হয়তো লাল-সবুজের বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে দাঁড়াতে পারত না।
বইটিতে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। কে শত্রু আর কে মিত্র এখানেই জানা যায়। ঘরের শত্রু বিভীষণ তার রূপ দেখিয়েছে বারবার। তাদের কাছে দেশের চেয়ে শেখ মুজিব বড় ছিল। তাই মুজিবকে মুক্ত করাই মূল লক্ষ্য ছিল। কিন্তু তাজউদ্দীন মুজিবের পাশাপাশি দেশকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলেই হয়তো অনেকে চক্ষুশূল হয়েছেন। যারা প্রতিনিয়ত তার বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
বইটি লেখক সময়ের হিসেবে বিভক্ত করেছেন। প্রথম অধ্যায় যেমন বর্ণনা করে একাত্তর সালের ২৫ মার্চের আগের ঘটনাক্রম। কেন এই ২৫শে মার্চ? তা জানতে অতীতে যেতে হয়। সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় লেখক শেষ ফ্ল্যাশব্যাক উল্লেখ করেছেন। যা পরবর্তী অধ্যায়গুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করতে সহজ করবে। এভাবেই মাস ও সময়ের ভিত্তিতে লেখক অধ্যায়গুলোকে আলাদা করেছেন এবং প্রতিটি মাসের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। তবে আমার কাছে যে বিষয়টি দুর্বল লেগেছে, লেখকের লেখায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অধ্যায়ভিত্তিক রচনায় বিভিন্ন অধ্যায়ে একই ঘটনা একাধিকবার ভিন্ন ভিন্ন সময়ের আলোচনায় লেখক বলার চেষ্টা করেছে। হয়তো পারপার্শ্বিক বিচারে এভাবে আলোচনা করার গুরুত্ব ছিল। কিন্তু বারবার একই ঘটনা পড়তে গিয়ে কিছুটা ধৈর্যচ্যুত ঘটে। তাছাড়া এমন বই টানা পড়াটাও একটু কঠিন। সময় নিয়ে পড়তে হয়। না হলে এত তথ্যের ভার মস্তিষ্ক নিতে পারে না।
লেখকের রচনা সাবলীল। পড়তে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। কিন্তু লেখকের কঠিন শব্দের প্রয়োগ একটু বেশি মাত্রাতিরিক্ত ছিল। বাংলায় দখল না থাকলে অনেকের বুঝতে হয়তো অসুবিধা হবে। আমার ভালো লেগেছে তিনি বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে বইটি রচনা করেছেন। যদিও ব্যাকরণগত কিছু ভুল চোখে লেগেছে। অনেক বাক্য লেখক সমাপ্তিতে না টেনে পরের বাক্যে চলে গিয়েছেন। কোথাও ক্রিয়াপদ পরিপূর্ণ হয়নি। অবশ্য গুরুত্বের বিচারে বইটি যে পরিমাণ মূল্যবান, সে হিসেবে ব্যাকরণগত এরূপ সামান্য ভুল মার্জনা করাই যায়।
পরিশেষে, মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে শেখ মুজিব কোথাও ছিলেন না। তিনি তখন পাক বাহিনীর হাতে বন্দি। ফলে যুদ্ধের আগে যে নেতৃত্ব, যুদ্ধের সময়কালে সে নেতৃত্বের বিস্তর ফারাক। এই সময়কালে একমাত্র নেতা তাজউদ্দীন আহমদ। কত ষড়যন্ত্র আন্তর্জাতিক কুচক্রী মহল তাদের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে তারপরও যখন উপরের সৃষ্টিকর্তা আশীর্বাদ ছড়িয়ে দেন, তখন কেউ বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না।
❛একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার।❜
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবথেকে ঘটনাবহুল সময় ছিল একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম। এই সংগ্রাম দিয়েই বিশ্বের মানচিত্রে নিজেদের স্থান করে নিয়েছিলাম আমরা। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আর স্বার্থহীন দেশপ্রেমিকের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল আকাঙ্ক্ষিত বিজয়। কিন্তু বিজয় তো এমনিতেই আসেনি, এর পিছনে যে রাজনীতি, কূটনীতি ছিল তার কতটা আমরা জানি বা জানানো হয়েছে?
একাত্তরের যু দ্ধ নিয়ে ইতিহাস বলতে বেশিরভাগ হয়তো এটাই জানি ৭০'এর নির্বাচন জয়ের পর পাক সামরিক জান্তার ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, গড়িমসি করা, ৭ই মার্চের ভাষণ, ২৫শে মার্চের কালো রাত তথা ❛অপারেশন সার্চলাইট❜, ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা, মুজিবের বন্দী, এপ্রিলের মুজিবনগর সরকার গঠন, সাত বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্বগাঁথা, ৩ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর ভারত বিমানঘাঁটি আক্রমণ, ১৪ই ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হনন এবং অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়, মুজিবের স্বদেশ ফেরত আসা। এর বেশি হয়তো পাঠ্যপুস্তকে নেই, আমরা পড়িনি। কিন্তু দীর্ঘ এই নয় মাসে এসব ঘটনা ছাড়াও প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্ত যু দ্ধ করে যেতে হয়েছে। রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং বৈশ্বিক সবদিকে ছিল বাঁধা আর নানা বিপদ। সব পেরিয়ে এই যে অর্জন তার অনেক কিছুই আমাদের অজানা।
একাত্তরে পরিবেশ পরিস্থিতি যখন আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছিল তখন থেকেই পাক জান্তা ভেতরে ভেতরে কঠিনতম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল। তারই ফলস্বরূপ ২৫ শে মার্চের রাত্রে টিক্কা খানের নেতৃত্বে তারা পরিচালনা করে জঘন্যতম এক মিশন। ঐদিন রাতেই মুজিব তার দলীয় নেতাদের অন্যত্র সরে যেতে বলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে নিজে কোথাও সরে না গিয়ে নিজ বাড়িতেই অবস্থান করেন। বন্দী হন পাক মিলিটারির কাছে। তবে দেশের মানুষ তখন পাক বাহিনীর এ���েন বর্বরোচিত হামলার কারণে অসহায় কিন্তু রাগে ফুঁসছে। এই ঘটনার পর নেতা মুজিবের পক্ষ থেকে এম এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং এরপরেই মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ২৭শে মার্চ বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এবং পরবর্তীতে সেটা মুজিবের পক্ষ থেকে বলেন।
আওয়ামী নেতারা তখন অন্যত্র সরে গেছে। অনেকেই কলকাতা অবস্থান করছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতে তারা আশ্রয় নেন এবং পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে তখন তাজউদ্দিন আহমেদ ভারত সরকারের কাছে সহযোগিতা চাইলে আগে তাকে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে আসতে হতো বিধায় তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন। এরপর গঠন করা হয় অস্থায়ী সরকার। যদিও দলের অন্যদের মধ্যে তাজউদ্দিনের নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করায় অসন্তোষ এবং মনোমালিন্য দেখা যায়। তবুও তাজউদ্দিন তার নিষ্ঠা এবং কর্মপন্থা দিয়ে সব বিপদ মোকাবিলা করেন। বাংলাদেশের তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বিশ্ব তখনো সেটা ভাল করে জানতো না। নব এই বাংলাদেশের পক্ষে তাই আন্তর্জাতিক সাহায্য লাভ ছিল অসম্ভব ব্যাপার। যেখানে বিশ্বের দুই পরাশক্তি আমেরিকা এবং চীন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে এবং তারা অখন্ড পাকিস্তান রক্ষায় ছিল বদ্ধ পরিকর।
এদিকে ভারতের পক্ষে সাথে সাথেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান সম্ভব ছিল না। সরাসরি যু দ্ধে অবতীর্ণ হওয়াও ছিল হুমকির। নিকট অতীতেই পাক বাহিনীর সাথে যু দ্ধ এবং চীনের সাথে ল ড়াই হয়েছিল। বিধায় আরেকটি ল ড়াইয়ে একত্রে তাদের মোকাবিলা করা নিজ দেশের সার্বভৌমত্বের জন্যেও ছিল ঝুঁকির। সাথে বিরোধী দলের অসম্মতি তো ছিলই। কিন্তু বাংলাদেশে থেকে আসা বিপুল স্মরণার্থী, তাদের স্থান দেয়া, খাদ্যের জোগান দেয়া সবকিছুই এক বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল। নিজের দেশের চলতি ঝামেলা তথা নক শাল, মা ওয়াবাদী মুভমেন্ট আর বাংলাদেশ থেকে আগত ইচ্ছুক যো দ্ধাদের ট্রেনিং দেয়া সহ নানা সমস্যার উদ্ভব হয়েছিল।
বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার এপ্রিলে শপথ গ্রহণ করলেও তাদের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। দলের অন্যান্য সদস্যের মাঝে ক্ষোভ, বিশেষ করে শেখ মণি, খন্দকার মোশতাক আহমদের একচেটিয়া বিরোধিতা, নিজেদের স্বার্থ আর ক্ষমতার লোভ সব মিলিয়ে নতুন গঠিত সরকার সুবিধা করতে পারছিল না। R A W এর মাধ্যমে তৈরি ❛মুজিব বাহিনী❜ এর আত্মপ্রকাশ, তাদেরকে সরকারের অধীনে আনার চেষ্টা এবং তাদের অবাধ নীতি ছিল তখনকার চিন্তার বিষয়। তারপরেও তাজউদ্দিনের দক্ষ নেতৃত্ব এবং অটল মনোভাবের কারণে ভারতের সাথে দেন-দরবার করে দেশের স্বার্থ সবার আগে দেখার যে অবিচল নীতি ছিল বলা যায় উত্তাল একাত্তরের সময় এটিই ছিল সবথেকে শক্তিশালী দিক। যো দ্ধাদের ট্রেনিং, যু দ্ধ পরিচালনার জন্য গোটা দেশকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ, সেখানে ফোর্স তৈরি, নেতৃত্ব দেয়ার জন্য লোক নিয়োগ সবকিছু তিনি তার দলের লোক এবং ওসমানীর সাথে আলাপ করে করতে থাকেন। কলকাতা, দিল্লি ভ্রমণ করে আগত লোকদের নিরাপত্তা, যু দ্ধের সরঞ্জাম বিতরণ এবং বাইরের বিশ্বে তাদের অবস্থা তুলে ধরার জন্য নিয়মিত কাজ চলতে থাকে। এত কিছুর মাঝেও কাঙ্ক্ষিত সফলতা তখনো বহুদূরে ছিল। সেজন্য দেশীয় বিশ্বাসঘাতক তথা রাজা কার বাহিনী, দলের ভেতরের কিছু কাপুরুষের অবদান তো ছিলই।
ভারত নিজেদের স্বার্থ রক্ষা এবং বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানকল্পে কাজ করতে থাকলেও দুই পরাশক্তির কাছে ছিল অসহায়। এজন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তি এবং তাদের ভেটো প্রয়োগের পর যে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি হয় তারপরেও দেশের মুক্তি ছিল তখনো অধরা। জাতিসংঘ এবং তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ এবং বিভিন্ন দেশের নিশ্চুপ অবস্থা সবমিলিয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ছিল এক ইস্যু। একদল চাইছিল না পাকিস্তান ভাগ হোক, কিন্তু শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক। তবে তথাকথিত শান্তি পশ্চিম পাক জান্তার উপস্থিতি এবং তাদের সাথে চুক্তি দিয়ে কখনোই আসতো না। ইয়াহিয়া, নিয়াজী, ভুট্টো এদের অদ্ভুত নীতি, একরোখা ভাব এবং এরমধ্যে নিক্সন সরকারের সমর্থন বাংলাদেশের জন্য ছিল উদ্বেগের। শান্তিচুক্তি এবং নেতৃত্বের কোন্দলে পাক বাহিনী একসময় পর্যুদস্ত হলেও দেখা গেছে মার্কিন চাপ এবং তাদের দেয়া আশার ভিত্তিতে আবার তারা বেঁকে বসে। এভাবেই সময় পেরিয়ে যায় এবং আসে নভেম্বর।
তাজউদ্দিন বাংলাদেশের মুক্তি এবং একইসাথে মুজিবের নিঃশর্ত মুক্তির প্রসঙ্গে অনড় থাকেন। দলীয় অনেকেই হয় মুজিব নয় স্বাধীনতা জাতীয় রোল তুললেও দেশের স্বার্থে অবিচল লোকেদের কারণেই হয়তো আমরা আজ স্বাধীন।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। ইয়াহিয়া দশদিনের মাঝে যু দ্ধ ঘোষণা করেন। এদিকে যদি পাকিস্তানের সাথে ভারত সরাসরি সমরে লিপ্ত হয় তবে বিশ্ববাসীর কাছে সেটা আরেকটি পাক-ভারত যু দ্ধ হিসেবেই আখ্যা পাবে। পুবের লোকেদের ত্যাগ, নিঃস্বার্থ অংশগ্রহণ এবং যাবতীয় দুর্দশা আসলে গোচর আসবেই না। এজন্য অস্থায়ী সরকার তাদের নানা মিটিং এবং সিদ্ধান্তে দেশকে শত্রুমুক্ত এবং বহিঃবিশ্বের কাছে নতুন একটি দেশরূপে স্বীকৃতির জন্য কাজ করে যান। পাক বাহিনী যখন দেখে তাদের পরাজয় হতে পারে এমনকি সপ্তম নৌবহরও তাদের রক্ষা করতে পারবে না। তখন তারা শুরু করে এক ঘৃণ্য পরিকল্পনা। এর আগে ভারত বিমানঘাঁটি হা মলা করার ফলে ভারতের বাহিনী এবং বাংলাদেশের সম্মিলিত মিলিশিয়া বাহিনী একত্রে তিন দিক থেকেই শুরু করে যু দ্ধ। রোধ করে পাক বাহিনীর পালনোর পথ। সাথে ছিল রাশিয়ার নৌবহর এবং বাহিনীর হাতছানি। সব মিলে যখন পরাজয় বিনা পথ নাহি তখনই তারা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার এক চক্রান্ত করে। কে বলতে পারে এই বুদ্ধি আসলে কার দেয়া ছিল?
যখন আত্মসমর্পণ প্রায় নিশ্চিত, ঢাকাকে মুক্ত করতে বাহিনী এসে গেছে সেই বার্তা কেন মার্কিন সরকার একুশ ঘন্টা পরে জানালো? এইটুকু সময়ক্ষেপণ না হলে অনেকগুলো প্রাণ যেমন বাঁচত, বাঁচত আমাদের দেশের মেধাগুলো। চক্রান্ত আসলে যতটা পাক বাহিনীর ছিল ততটাই সমর্থন তথা ইন্ধন ছিল মার্কিন সরকারের। নিজ দেশের নাগরিকদের তীব্র নিন্দা সত্ত্বেও সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের অস্ত্র চালান দিয়েছিল।
সব চেষ্টাই যখন ব্যস্ত হলো অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত বিজয় ধরা দিল। রেসকোর্স ময়দানে সেই ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ হলো। কিন্তু বিজয় মানেই তখন মুক্তি ছিল কি? মুজিব তখনো পাকিস্তানে বন্দী, একদল তরুণ যারা নয় মাস বর্বর এক বাহিনীর বিরুদ্ধে ল ড়েছে, তাদের মন মানসিকতা বদলে গেছে। হয়ে গেছে নির্মম।
রা জাকার চিহ্নিত করা, গজিয়ে ওঠা নতুন মুক্তিযোদ্ধা, দল পরিবর্তন করা দেশপ্রেমিক সব মিলিয়ে ১৬ই ডিসেম্বরের পর যেন আরো এক কঠিন যু দ্ধে লিপ্ত হয় নতুন বাংলাদেশ। তবে এই সমস্যাও দক্ষ হাতেই প্রবাসী সরকার তথা অস্থায়ী সরকার সমাধান করেন তাদের দেশের ফেরত আসার অব্যবহিত পরেই। তবুও সম্পূর্ণ অর্থনীতি মুষড়ে পড়া একটি দেশ যেখানে রাস্তাঘাট, কালভার্ট, ব্রিজ সব যু দ্ধের ফলে ধ্বংস হয়ে গেছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন এমন একটা সময় সুযোগ্য নেতৃত্ব এবং হাল ধরার দক্ষতা দিয়েই প্রধানমন্ত্রী দলের অন্যদের নিয়ে কাজ করেছেন। কী করে তিনি এই নয়মাসের অবিশ্বাস্য সময় পার করলেন, কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলেন কিংবা প্রায় আরেকটি বিশ্বযু দ্ধ লেগে যাচ্ছিল তার পুরো ঘটনা অব্যক্তই রয়ে গেল। নতুন দেশ, নতুন সরকার এবং অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে মুজিবের দেশে ফেরা নিয়ে জনতা তখন হুল্লোড় করছে। তবে সামনে ছিল অনেক চ্যালেঞ্জ। অনেক অজানা কথা, অনেক ষ ড়যন্ত্র। চূড়ান্ত বিজয়ের ���রের অবস্থা কতটা সঙ্গীন ছিল?
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
❝মূলধারা, ৭১❞ মঈদুল হাসানের লেখা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের এক দলিল। বইটিকে ❛রোড টু বাংলাদেশ❜ গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযু দ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা। একেক সরকার আসে আর নিজেদের কীর্তন করতে করতে মুক্তিযু দ্ধকে যেমন খুশি তেমন সাজো ইতিহাস হিসেবে সাজায়। এতে চাপা পড়ে যায় আসল ঘটনা। যাদের আত্মত্যাগে অর্জন হয়েছে এই বিজয় তারা অগোচরে রয়ে যায়। সঠিক ইতিহাস জানার একটি প্রয়াস হিসেবে এই বইটা সুখপাঠ্য। উত্তাল সেই সময়ের কথা আমরা যখন শুনি, পড়ি মনে কেমন একটা শিহরণ লাগে। ঐ সময় আমরা থাকলে কী করতাম? উত্তাল সেই সময়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটা মুহূর্ত ছিল দেশের বিজয় অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বইটির লেখক উক্ত সময়ে সরকারের কাছাকাছি ছিলেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা, মতামত এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেক বিষয় তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, নোট রেখেছেন আর তারই সমন্বয়ে বইটি লিখেছেন। বিধায় বইটি অনেকাংশেই নির্ভুল তথ্য প্রদান করে।
প্রয়োজনীয় রেফারেন্স, ফুটনোট ছিল এবং তৎকালীন সময়ের অনেক নথি, দলিল, গোপনীয় অনেক তথ্য (উক্ত সময়ের হিসেবে যেসব গোপন ছিল), প্রধানমন্ত্রীর স্বহস্তে লিখিত অনেক লেখা পরিশিষ্ট হিসেবে দিয়েছেন। যেগুলো বইটা পড়তে গিয়ে উদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। যেসব বিষয় বুঝতে কঠিন লাগছিল কিংবা সংক্ষেপ ছিল সেগুলোর বিস্তারিত সেই রেফারেন্স, নোট আর পরিশিষ্টে পাওয়া গেছে।
বইটা আমি বেশ সময় নিয়েই পড়েছি। যেন বুঝতে পারি। স্লো পড়ার অন্যতম কারণ ছিল লেখকের লেখার ধরন। আমার কাছে লেখার ধরন, শব্দ, বাক্যের প্রয়োগ একটু কঠিন লেগেছে। টানা পড়তে গেলে দেখা গেছে মাথা ভার অনুভূত হচ্ছিলো। এসব লেখায় সাধারণত মান বিচারের থেকে তথ্যের সমাগম, সত্যতা এবং ইতিহাসের কতটুক কভার করেছে এটাই মূল। তবে লেখা সহজবোধ্য হলে পড়তে আরেকটু সুবিধা হতো।
মুক্তিযু দ্ধের এই যাত্রায় লেখক স্বয়ং সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ছিলেন, তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আলোকপাত হয়েছে। পড়ার সময় বারবার এটাই ভাবছিলাম ঐ সময়টায় কেউ কল্পনাও করতে পারেনি নয় মাসেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জন হবে। যেখানে ভারত সরকার থেকে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার সকলের মধ্যে একটা চিন্তা ছিল। হয়তো সামনে ❛আরো অন্ধকার দিন❜ কিংবা ❛দীর্ঘ সময়ের যু দ্ধ❜ হতে পারে এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। বছর পেরিয়ে আরো সামনের চিন্তাও করা হয়েছিল, সেখানে বছর ঘুরার আগেই একটি দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে নিজেদের দাঁড় করানোর যাত্রাটা মোটেও মসৃণ ছিল না। এখন আমরা ঠিক যত সহজে বলে ফেলি, সেটা অর্জন ছিল দীর্ঘ এক অপেক্ষার ফসল।
লেখক বইতে তাজউদ্দিন আহমেদকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো ঘটনা সাজিয়েছেন। প্রচারবিমুখ এই নেতার কথা পড়লে আমি সবসময়ই খুব অবাক হই, দুঃখ লাগে। যু দ্ধ বিষয়ক লেখা পড়তে গেলেই এই অনুভূতিটা আমার হয়। হয়তো একজন তাজউদ্দিন একাত্তরে নিরলস না থাকলে, দেশের স্বার্থে অবিচল, অটল না থাকলে এই বাংলাদেশ উদ্ধার হয়তো সম্ভব ছিলনা কিংবা অনেক দেরি হতো। সে হিসেবে উনাকে নিয়ে আলোচনা খুবই কম। যু দ্ধের পরেও তিনি সেই মূল্যায়ন পাননি যেটুক প্রাপ্য ছিল।
ঘটনাপ্রবাহ গুলো লেখক অধ্যায়ভিত্তিক করে লিখেছেন। তবে বাক্যের কাঠিন্যের কারণে পড়তে একটু বেগ পেতে হয়েছে। তবে শেষের দিকে লেখার গতি কিংবা শেষের দিকের ঘটনাপ্রবাহই ছিল চাঞ্চল্যকর বিধায় খুব দ্রুত পড়েছি। মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং এর কিছু পরের নীতি, দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ, মুজিব বাহিনী, রক্ষীবাহিনী এবং ক্ষমতার ল ড়াইয়ের কিছু বিষয় তুলে ধরে বইটির সমাপ্তি টেনেছেন।
কথায় বলে, ❛স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন❜। বিজয়ের অব্যবহিত পরে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, যে অস্থিরতা বিরাজ করেছিল তা ছিল আরো কঠিন। তখন ঘটনা পড়ে ঐ প্রবাদের গুরুত্ব আরো উপলব্ধি করা গেছে। পরিশিষ্ট অংশে নথিগুলো মূল থেকে কপি করার জন্যে লেখাগুলো বুঝতে একটু কষ্ট হচ্ছিলো। এতে পড়ার গতিও মন্থর হয়েছে।
বাংলাদেশের মু ক্তিসংগ্রাম এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই ইতিহাস, সে সময়ের মিলিত শক্তি আমাদের প্রেরণা দেয়। এই ইতিহাসের আদ্যোপান্ত যেমন আমাদের জানা উচিত তেমনি জানা উচিত এর ভেতরের কঠিন সময়ে কারা হাল ধরেছিলেন। নিরপেক্ষ এবং সত্য ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে প্রকাশের জন্য এ ধরনের বই পড়া উচিত।
❛বাংলাদেশ নামের সাথে মিশে আছে অনেক ত্যাগ, র ক্ত। লাল সবুজের এই পতাকা আমাদের অস্তিত্ব। এই ইতিহাস আমাদের অহংকার।❜
One of the best books I have read on Liberation War of Bangladesh. মুক্তিযুদ্ধকে ড্রামাটাইজ করার কোন দরকারই নেই আসলে। এই বইয়ে রাজনৈতিক ঘটনাবলীর যে বর্ণনা আছে, তা নিয়েই দুই তিনটা আলাদা মুভি বানানো যাবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সময় ১৯৭১ সাল। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে আমাদের যে বৈষম্যের বিরোধ ৪৭ এর পর থেকেই ছিলো তার নিষ্পত্তি ভয়াল রূপ ধারণ করে এই সময়ে।
যুদ্ধের ময়দানে না যতটুকু লড়াই হয় তার চেয়ে বেশী লড়াই হয় যুদ্ধ-মঞ্চের পিছনে। কাগজে কলমে। মঈদুল হাসানের এই বইটির প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার এবং এর ভারতীয় সরকারের সাথে কূটনীতি, তৎকালীন সময়ের বিশ্ব রাজনীতি দর্পনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।
বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কাছে গ্রেফতার, আওয়ামী লীগের কমান্ডের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ যখন বিচ্ছিন্নভাবে সীমানা পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তখন সমগ্র বাংলাদেশে বিশৃংখলা। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের শুরু হলো পাকিস্তানী হিংস্রতায়। যুদ্ধের প্রতিঘাতের কোন রকম প্রস্তুতি, মনোবল, পরিকল্পনা তখন নেই। আর বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতির প্রেক্ষাপটে তাজউদ্দিন এর আবির্ভাব। একটি যুদ্ধে জয় পেতে যতটুকু না সাহস ও সংগ্রামী মনোবল লাগে, তার চেয়েই বেশী লাগে ধৈর্য্য, প্রজ্ঞা, প্রত্যুৎপন্নমতি সিদ্ধান্ত নেয়ার উপযুক্তা এবং সর্বোপরি কূটনৈতিক দক্ষতা। তাজউদ্দিন আহমেদ মুজিবনগর সরকার গঠনের মাধ্যমে তাই করে দেখিয়েছেন।
মুজিবনগর সরকার গঠনের মাধ্যমে বিশৃংখলা ধীরে ধীরে একটি স্বাধীনতার অবয়বে রূপান্তরিত হওয়ার পথে তাজউদ্দিন আহমেদ কে মোকাবিলা করতে হয় আওয়ামীলীগের দলের মধ্যের দ্বিমত বা অনেক ক্ষেত্রেই কোন্দল। একই সাথে ভারত সরকারকে বিশ্বস্ত মিত্রের ভূমিকায় পাওয়ার তাকে কাজ করে যেতে হয়েছে। যুদ্ধের শেষ অংশে সম্মুখ যুদ্ধে যখন মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা সামনা সামনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ, ঠিক তখন সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত একটি দেশকে কিভাবে সিভিল প্রশাসনের অধীন আনা যায় সেসব খুটিনাটি নিয়েও কাজ করে যেতে হয়েছে নিরলস। এইসব ক্ষেত্রে তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুজিব সরকারের নীতি এবং তৎকালীন পরিস্থিতির প্রামাণিক বর্ননা পাওয়া যাবে এই বইয়ে।
বাংলাদেশের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারত, রাশিয়া, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব এবং প্রত্যেকের গৃহী�� নীতি এবং পদক্ষেপের বিশ্লেষনী বর্ণনাও মঈদুল হাসান করেছেন।
বাংলাদেশের যুদ্ধের কূটনীতিক যুদ্ধের অসামান্য দলিল হচ্ছে মূল্ধারা ৭১। বাংলাদেশের মুক্তির ইতিহাস, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, দক্ষিন এশিয়ার রাজনীতির ইতিহাসের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল বইটি। যেকোন বাঙ্গালী পাঠকের বইটি পড়ার অনুরোধ থাকলো।
আমাদের জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধ একটি ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে সকল তথ্য-উপাত্ত বিদ্যমান তা আমরা বিভিন্ন প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি ডকুমেন্ট, রাজনৈতিক ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন গ্রন্থের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি। আবার কিছু ঘটনার বিবরণ আমরা প্রত্যক্ষসাক্ষীর বর্ণনায়ও বিভিন্ন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে যা ওই ব্যক্তির সরাসরি পর্যবেক্ষণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল ইতিহাস জানার একটি সবচেয়ে ভালো রাস্তা।
মইদুল হাসান তেমনি একজন। তিনি মুজিবনগর সরকারের একজন কর্মকর্তা এবং তাজউদ্দিন আহমেদের সহকারী ছিলেন যিনি পুরো মুক্তিযুদ্ধকে নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।তার প্রত্যক্ষ বয়ান এবং স্মৃতি থেকে উদ্ধার করা মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্র বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সমাবেশ 'মূলধারা ৭১ 'যা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দলিল হিসেবে একাডেমিক এবং নন অ্যাকাডেমিক বিষয়ে আলোচিত এবং একই সাথে সমালোচিত হয়েছে।
বইটি ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ মধ্যবর্তী সময়ের বিভিন্ন ঘটনার চুম্বক অংশ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। ৭ই মার্চের ভাষণের পরবর্তী সময়ে তাজউদ্দিন আহমেদের ভারত গমন, মুজিবনগর সরকার গঠন, ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন, ইন্দিরা গান্ধী ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং সাহায্য কামনা, একই সাথে তৎকালীন আওয়ামী লীগের অন্তর দ্বন্দ্ব, ভারতের সহায়তায় মুজিব বাহিনী গঠন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, মিত্র বাহিনী গঠন, পরিশেষে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের আবির্ভাবের ঘটনার পরম্পরা বর্ণনা করেছেন।
তাজউদ্দিন আহমেদের দূরদর্শী নেতৃত্ব, সাংগঠনিক সক্ষমতা এবং তীক্ষ্ণ কূটনৈতিক বৈশিষ্ট্য যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন ঘটনা এবং অঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে নিজেকে বারবার তিনি নিজেকে হাজির করেছেন এবং তাজউদ্দিন আহমেদের সফল নেতৃত্বকে খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য :বইয়ের লেখক যেহেতু নিজেকে তাজউদ্দিন আহমেদের বিশ্বস্ত, মুজিবনগর সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং একই সাথে ন্যাপ দলের সদস্য ছিলেন তাই সম্ভবত এক ধরনের পক্ষপাতদুষ্টতা বিদ্যমান থাকবে। এবং লেখক নিজেও প্রথম দিকে এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রের বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে নিঃসন্দেহে বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
আমাকে যদি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন করা হয় আমি কেবল মোটা দাগে কয়েকটা ঘটনা ছাড়া কিছুই বলতে পারবো না, আমার মনে হয় অনেকেই পারবে না। এই যেমন ৭ই মার্চ, ২৫-২৬শে মার্চ, ১৪ ও ১৬ই ডিসেম্বর এই দিনগুলোর ঘটনাই মানুষের মনে মোটা দাগে জানা থাকবে। এক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালো রাত থেকে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি পর্যন্ত আসলে দেশের প্রেক্ষাপট কেমন ছিলো! এই সময়ে শেখ মুজিবের গ্রেফতারের পর দেশের রাজনৈতিক নেতারা কী করেছেন! তাদের কাজগুলো কতটা ভূমিকা রেখেছে দেশ স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে, কীভাবে সারা দেশকে ১১টা সেক্টরে ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা হয়েছিলো, এই দেশের যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ব মোড়ালদেরই বা কী চিন্তাধারা ছিলো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে জানার জন্য অতি চমৎকার নিরপেক্ষ বই বলা যায় এই 'মূলধারা ৭১'।
২৫-২৬শে মার্চ যখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার টিক্কা ঢাকায় গণহত্যার সমর অভিযান শুরু করেন, তখন শেখ মুজিব সকল নেতাকর্মীকে সরে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েও নিজে রয়ে যান নিজের বাসভবনে, ফলে সেই রাতেই সেখান থেকে গ্রেফতার হোন তিনি, এদিকে সারা বাংলা যেভাবেই হোক ছড়িয়ে পড়ে তিনি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। আর তাতেই পাকিস্তানীর এই গণহত্যা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই বাঙালির একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠে বাংলার স্বাধীনতা, বিদ্রোহ করে বসে বাংলার সশস্ত্রবাহিনী।
আর তাই পরদিন ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় ৮ইবির বিদ্রোহী নেতা মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া তাঁর প্রথম বেতার বক্তৃতায় নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করলেও, পরদিন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন।
অন্যদিকে পাকিস্তানী বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, বেপরোয়া গোলাগুলি ও অগ্নি- সংযোগের মুখে রাজনৈতিক নেতা, কর্মী এবং সশস্ত্রবাহিনীর বিদ্রোহী বাঙালীরা তো বটেই, বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষও নিরাপত্তার সন্ধানে শহর থেকে গ্রামে এবং গ্রাম থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে শুরু করে, প্রথমে হাজারের অঙ্কে, পরে লক্ষের-বিরামহীন, বিরতিহীন। এমনিভাবে পাকিস্তানের আঞ্চলিক বিরোধ ও গৃহযুদ্ধের সাথে ভারত ক্রমশ জড়িত হয়ে পড়ে এই ভীত সন্ত্রস্ত শরণার্থীদের জোয়ারে। আর তাতে ভারতের বাংলাদেশের যুদ্ধে জড়িয়ে না পরে আর কোনো উপায় ছিলো না।
এদিকে শেখ মুজিবের অনুপস্থিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কে বা কারা দিবে এ নিয়ে যখন দলীয় কলহ, বিশৃঙ্খলা শুরু হয় তখনই দলের হাল ধরেন তাজউদ্দীন আহমদ, তিনি প্রথমেই দেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করেন এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী হোন। অবশ্য তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রীত্বকে তখন অনেক আওয়ামিলীগ নেতা মেনে নিতে পারেননি, বারবার চেষ্টা করে গেছে তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য। তারপরও তিনি ভারতের সাথে নানান আলোচনার মাধ্যমে শরণার্থী সমস্যা, মুক্তিযুদ্ধাদের ট্রেনিং, অস্ত্র সরবরাহ, দেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য পরিকল্পনা, দেশকে ১১ ভাগে ভাগ করে রণাঙ্গনের নানান সেক্টরে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে সচেষ্ট হোন মন্ত্রীপরিষদকে সাথে নিয়ে। সেই সাথে কর্ণেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন।এদিকে RAW এর পৃষ্ঠপোষকতায় মুজিববাহিনী নামে আওয়ামীলীগের যুবনেতা শেখ মণি, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল রাজ্জাকদের নেতৃত্বে যে বাহিনী গঠিত হয় যার নিয়ন্ত্রণ ছিলো না প্রবাসী সরকারের যার ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেকখানি বিভক্তির সম্মুখিন হয়। সেই সাথে যুক্ত হয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বিশাল অংশ ট্রেনিং নেওয়ার পরও যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা। এবং কী আওয়ামিলীগের একটা অংশের রহস্যময় আচরণ, মার্কিনীদের সাথে সম্পর্ক পরিবেশ আরো জটিল করে তুলে।
আবার বিশ্ব রাজনীতিতে অখন্ড পাকিস্তান আর ভারতের সংঘাত এক অস্তিরতা সৃষ্টি করেছিলো, চলে গিয়েছিলো আরো একটি বিশ্বযুদ্ধের ধারপ্রান্তে। যেখানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংঘাতে মার্কিনীরা সবসময়ই সমর্থন দিয়ে গিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকারকে, সরবরাহ করে���ে অস্ত্র। শুধু তাই নয় ভারতকে বাংলাদেশের যুদ্ধে সহযোগিতা যাতে করতে না পারে তার জন্য চীনকে দিয়ে চেষ্টা করেছে ভারত আক্রমণের, এদিকে কাশ্মীরেও আক্রমণ চালিয়ে বিভক্তির চেষ্টা করা হয়, আর তাতে মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এবং কী জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতির আয়োজনেও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো দেওয়া আর চীনের নীরবতা মার্কিনীদের খুঁটিকে শক্ত হতে দেয়নি। শেষতক মার্কিনীরা বঙ্গোপসাগরে নৌবহর পাঠিয়ে বাংলাদেশের যুদ্ধে পাকিস্তানকে সহযোগিতার চেষ্টা করলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক টহল আর ভারতের সেনা আর বিমানবাহিনীর সহায়তায় দেশের মুক্তিযুদ্ধারাসহ সম্মিলিত আক্রমণের কারণে নৌবহর পৌঁছানোর আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হওয়ায় তা আর সফল হয়নি।
এদিকে স্বাধীনতা অর্জন এবং পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের পরবর্তী সময়টা ছিলো আরো কঠিন, এই সময়ে এসে অনেকের হাতেই অস্ত্র ছিলো যার ফলে সংঘাত বন্ধ করা, অস্ত্রগ্রহণ, এবং বিজয়ের সুযোগ নিয়ে স্বঘোষিত মুক্তিযুদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ ছিলো অপরিহার্য। আর তা করতে তাজউদ্দীন আহমদ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কাজে নেমে পড়েন। গণবাহিনী, মুজিব বাহিনিসহ ছোটো উপদলকে নিয়ন্ত্রণ, দেশের কাঠামো অবকাঠামোগত দ্রুত পরিবর্তন ও সংস্কার, সরকারগঠন, শেখ মুজিবকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা ইত্যাদিতে মনোযোগ দেন। এক্ষেত্রে তিনি ১৯৭০এর নির্বাচনী ইস্তেহারকে সামনে রেখে কাজ শুরু করেন। এর জন্য তাকে প্রতিনিয়ত দেশের সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের রোষানলে পড়তে হয়। এদিকে ৮ই জানুয়ারি পাকিস্তান শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিন, তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করলে তাজউদ্দীন আহমদ তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন, সেই সাথে ১৯৭১ সালের পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যত কর্মপন্থা নিয়ে শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা করতে চাইলে সেই আলোচনা আর কখনোই হয়ে উঠেনি।আর তারপর থেকেই এই মুক্তিযোদ্ধের সময়ে রাজনীতিতে সবার সামনে থেকে নেতৃত্ব নেওয়া তাজউদ্দীন আহমদ নামক নেতার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আস্তে আস্তে অস্ত যেতে শুরু করে।
বইটি শেষ করতে আমি অনেকদিন সময় নিয়েছি, আর শেষতক যাইহোক শেষ করতে সফল হয়েছি। লেখক মঈদুল হাসানের ভাষাজ্ঞান খুবই খুবই কঠিন, এতোই কঠিন যে আমার বেশ কিছুক্ষণ পড়লেই মাথা ভারী হয়ে আসে, সেই সাথে মাঝে মাঝে লেখক এমন অনেক লাইন লিখতেন যে আমাকে দ্বিতীয়বার পড়তে হয়েছে বুঝতে। সম্ভবত পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের ভাষাজ্ঞান আসলেই কঠিন। যাইহোক তারপরও মুক্তিযুদ্ধো নিয়ে আমার আগ্রহ বইটি শেষ করতে প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিয়েছে।
লেখক মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের হয়ে ভারতের সাথে নানান নীতি নির্ধারণ এবং প্রস্তাব উপস্থাপনে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন তাজউদ্দীন আহমদের খুব কাছে থেকেই যার ফলে তার বর্ণনাতে এই সময়ের বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে ৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি পর্যন্ত এই সময়ের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশের জন্মের ইতিহাসের এক রূপরেখা ও বাস্তবায়নের বর্ণনা বইটিতে স্থান পেয়েছে। যা আপনাকে এই সময়ের বাংলাদেশকে ঘিরে অভ্যন্তরীণ এবং বিশ্বরাজনীতির প্রভাব সেই সাথে বিশ্ব মোড়ালদের রূপের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে। আপনাকে এমন অনেক ঘটনা, মানুষ, রাজনৈতিক পরিবেশের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দিবে যা আগে জানতেন না।
সবমিলিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে ৭২ এর ১০ই জানুয়ারি শেখ মুজিবের ক্ষমতা গ্রহন পর্যন্ত বিস্তারিত জানার জন্য এই বইটি অবশ্যই পাঠ্য হিসেবে থাকবে। আর বইটিতে যেসকল বিষয় স্থান পেয়েছে তার কিছু অংশ এই লেখাতে তুলে আনার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এতো অল্প কথাতে পুরো বিষয়টা তুলে এনে কাউকে ধারণা দেওয়াটা সত্যিই কঠিন।
বইটির প্রোডাকশন খুবই চমৎকার, অভিযোগ করার মতো যদি কিছু থেকে থাকে তা হলো লেখকের বর্ণনা আর ভাষাজ্ঞান যা খুবই কঠিন। বইটির শেষে লেখক বাংলাদেশকে ঘিরে হওয়া নানান সিদ্ধান্তের প্রামাণ্যদলিলও সংযোজন করে দিয়েছেন, দিয়েছেন প্রতিটি ঘটনার রেফারেন্স। তাই কেউ যদি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধের সময়কার ঘটনা বিস্তারিত জানতে চান তাদের জন্য বইটি অবশ্যই রেকমেন্ড করবো।
এই বইয়ের সবচেয়ে ভালো দিক হল এতে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক দিক উঠে এসেছে। লেখক মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হওয়ায় এই বইয়ে মূলত মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দিনের ভূমিকা তুলে ধরেছেন। লেখক দেখিয়েছেন কেন তাজউদ্দিনের সকল সিদ্ধান্ত 'সঠিক' ছিল।
এই বই থেকে বেশ কিছু তথ্য জানতে পেরেছি যা আমাকে খুবই অবাক করেছে। যেমন এপ্রিলের ৩ তারিখে তাজউদ্দীনের ভারতে যেয়ে ইন্দিরা গান্ধীর নিকট নিজেকে প্রধানমন্ত্রী দাবি করা, বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি বেশিদিনের না হওয়া, দেশপ্রেমের পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে অনেকের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া, মুজিব বাহিনী নিয়ে সৃষ্ট সমস্যাসহ আওয়ামীলীগের অন্তর্কলহ, তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ইত্যাদি।
মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন দুই পরাশক্তির ভূমিকা নিয়েও লেখক অনেকটা বিস্তারিত লিখেছেন। ভারত সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের পিছনে যেসকল রাজনৈতিক কারণ ছিল তাও তুলে ধরেছেন। পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে খন্দকার মোশতাককে ব্যবহার করে সরকারকে বিভক্ত করতে চেয়েছে তাও লিখেছেন।
বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার শেখ মুজিবকে দেবতাতুল্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছে, তবে এই বই পড়ে শেখ মুজিবের সম্পর্কে তেমন ভালো ধারণা তৈরি হওয়ার কথা না।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যতটুকু জানাশোনা ছিল তাতে মনে হয়েছিল 'শুধু' ভারতীয় বাহিনীর শক্তি ও পরিকল্পনা পাকিস্তানি বাহিনীর তুলনায় অনেক বেশি ও ভালো হওয়াতেই এত অল্প সময়ে পাকিস্তানীদের হারানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এই বই পড়ার পরে মনে হচ্ছে ওগুলোর পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশের সাধারণ মানুষদেরও এর পিছনে বিশাল ভূমিকা ছিল।
এই বইয়ের সবচেয়ে বড় যে সমস্যা সেটা হল এতে তাজউদ্দিনকে অনেকটা ফেরেশতাতুল্য করে ফেলা হয়েছে, যে তার কোনো সিদ্ধান্তই ভুল ছিল না। অপরদিকে অন্যান্য রাজনীতিবিদদের অনেকটাই বাজেভাবে তুলে ধরা হয়েছে। লেখক তাজউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাজউদ্দীনের প্রতি তার সফট কর্নার থাকবে সেটা স্বাভাবিক কিন্তু লেখক যেভাবে তাজউদ্দীনের মাহাত্ম্য ও অন্যান্যদের দোষ বর্ণনা করে গিয়েছেন সেটা দৃষ্টিকটু ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অনেকের কাছে শুধুই আবেগের জায়গা। কিন্তু এই ধরণের একটা জাতিগত যুদ্ধে শুধু আবেগ দিয়ে জয়ী হওয়া যায় না; বরং ধীশক্তি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, কূটনীতি- সবকিছুরই দরকার হয়। যুদ্ধের নয় মাসে প্রায় ভুলতে বসা এক নাম তাজউদ্দিন যেমনিভাবে ভেতরের ও বাইরের সব প্রতিকূলতা সামলিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকে বুঝতে হলে ঠিক তেমনিভাবেই আমাদেরকেও আবেগের জায়গা ছাড়িয়ে বাস্তববুদ্ধির ��রিধিতে চিন্তা করতে হবে। তাহলেই হয়তো মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর, ঘটনাপ্রবাহ, কুশীলব, এবং এর অন্তর্নিহিত আদর্শের স্বরুপ আমরা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারব।
তাজউদ্দিনের মত আর কেউ আসেনি এই দেশে আর, এই আফসোস যাবার নয়।
Its one of the brilliantly written books, which describes the internal stories of Mujibnogor Government (the sovereign government administration during liberation war of Bangladesh) since inception. Respect to Tajiuddin Ahamed and other mastermind who contributes a lot and tackle against various diplomatic propaganda of US and China also internal conflict among various parties. The writer Moidul hasan narrate everything without emotional judgement. A must read for knowing our glorious history of 1971.