বিভিন্ন কারবার করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে নদীর ধারে বসে আফসোস করছিলো শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জন। হঠাৎ তারা নদীতে একটা ছুরিবেঁধা দেহ ভেসে যেতে দেখে। উদ্ধার করে দেখা গেল, দেহে এখনো প্রাণ আছে। লোকটার কাছে টাকাপয়সাও অনেক। কিন্তু লোকটাকে কে মারলো, আর কেনইবা মারলো?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একজন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক।
তিনি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত ময়মনসিংহে (বর্তমানে বাংলাদেশের অংশ) জন্মগ্রহণ করেন—যেখানে তাঁর জীবনের প্রথম এগারো বছর কাটে। ভারত বিভাজনের সময় তাঁর পরিবার কলকাতা চলে আসে। এই সময় রেলওয়েতে চাকুরিরত পিতার সঙ্গে তিনি অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে তাঁর জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। শীর্ষেন্দু একজন বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত।
তাঁর প্রথম গল্প জলতরঙ্গ শিরোনামে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাত বছর পরে সেই একই পত্রিকার পূজাবার্ষিকীতে তাঁর প্রথম উপন্যাস ঘুণ পোকা প্রকাশিত হয়। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি।
আগের বইগুলোর মতো এতো বেশি ভালো লাগেনি। কিছুটা রহস্য ও সাইন্স ফিকশন মিক্সড টাইপের। এখানে, শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জন দুই বন্ধু মিলে নদী থেকে একটা লাশ তুলল। পরে দেখা গেল লোকটা মরেনি। তারাতারি করে লোকটাকে নিয়ে তারা করালী ডাক্টারের বাড়ি গেল।
করালীডাক্টার অদ্ভুত মানুষ। রোগীদের জোড় করে পথ্য গেলায়। না খেলে রোগীর গলাটিপে ধরে। লাঠি নিয়ে দৌড়ায়। জটেশ্বর অঘোরগঞ্জের নামকরা জ্যোতিষ। কিন্তু তার সব ভবিষৎবাণী উলটা হয়। কেউ যদি এসে বলে, পরীক্ষায় ফেল করব না পাশ করব? সে উত্তর দিল, না রে এবার তোর হবে না রে। একথা শুনে সে লাফাতে থাকে। এবং রেজাল্ট বেরুলে দেখা যায় সে লেটার নিয়ে পাশ করেছে। করালীডাক্টার এর সাথে জটেশ্বরের বিশ বছরের ঝগড়া। কিন্তু তাও জটেশ্বর প্রতিদিন করালীডাক্টারের বাড়ি এসে বসে থাকে।
মৃগাঙ্ক ঘড়িয়ালের একটা নেশা হচ্ছে ঘড়ি কালেক্ট করা। তার কালেকশনে নানারকম ঘড়ি আছে। কোনও ঘড়ি তার পছন্দ হলে সেটার জন্য লাখ লাখ টাকাও খরচ করতে পারে সে। সেদিন তার বাড়ির বাগানে একটা ছেলেকে দেখলেন তিনি। ছেলেটা কথা বলতে পারে না। তার হাতে ছিল সুন্দর একটা ঘড়ি। মৃগাঙ্ক বাবুর পছন্দ হয়ে গেল ঘড়িটা। জোড় করে ঘড়ি নিতে গিয়ে বাধল বিপত্তি। ছেলেটা তিনতলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নদিতে পড়ে গেল। পড়ার আগে একটা গুলি খেয়েছিল। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে ছেলেটা নাকি করালীডাক্টারের বাড়িতে আছে। দুজন ষন্ডামার্কা লোক পাঠিয়ে দিলেন মৃগাঙ্ক ঘড়িয়াল। ছেলেটাকে খুন করে হাতের ঘড়িটা ছিনিয়ে আনতে বলে দিলেন।
ছেলেটা কে, কোত্থেকে আসল তা কেউ জানেনা। কিন্তু করালীডাক্টারের বউ আর করালীডাক্টার জানতে পারল সেটা। ছেলেটা কথা বলল তাদের সাথে। কিন্তু অন্য উপায়ে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়-এর অনেক বিখ্যাত কালজয়ী বই আছে। যা সব ধরনের রুচির পাঠকের ভালো লাগতে বাধ্য। আমার ক্ষেত্রে উনার লেখার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় হলো "অদ্ভুতুড়ে সিরিজ"। সিরিজের বইগুলো নামে যেমন অদ্ভুত গল্পেও তেমন অদ্ভুতুড়ে। আর তা ছোট-বড় সব বয়সী পাঠককে মনোরঞ্জন করতে একদম যথাযথ।
ভূত হয়ে ভূতের অস্তিত্ব বিশ্বাস করেনা! অবিশ্বাস্য না ব্যাপারটা? এমন অবিশ্বাস্য ব্যাপারটাই ঘটছে অঘোরগঞ্জে। শুধু এই ভূতের ভূত অবিশ্বাস করাটা কেন। আরো ঘোরতর ব্যাপার ঘটতে চলছে অঘোরগঞ্জে।
ছোট্ট গ্রাম অঘোরগঞ্জ। গ্রামের মধ্যে কিছু ডাকাত আছে, আছে ডাক্তার, গণক, আর আছে স্থানীয় কিছু ভূত। এর মধ্যেই গ্রামের নদী দিয়ে ভেসে যাওয়া এক লাশকে কেন্দ্রকরে গল্পের শুরু। আদতে নদীতে ভেসে যাইয়া মানুষটিকে মৃত মনে হলেও। অঘোরগঞ্জের দুই বাসিন্দা যখন লাশটা উঠিয়ে আনে। তখন থেকে শান্তশিষ্ট অঘোরগঞ্জের মধ্যে দেখা দেয় চাঞ্চল্যের। ঘটতে থাকে অদ্ভুত সব ঘটনা। যা এই ছোট্ট গ্রামের প্রতিটা মানুষের মাঝে নিয়ে আসে এক অন্য জীবনের স্বাদ। গ্রামের মানুষের পাশাপাশি গ্রামে পাকাপাকি বসবাসকারী ভূতেরাও জড়িয়ে পরে এই নদীতে ভেসে আসা লাশকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত সব ঘটনার সাথে। যার সমাপ্তিটা সত্যিই বেশ চমকপ্রদ।
অদ্ভুতুড়ে সিরিজের অন্যান্য বইয়ের সাথে তুলনা করতে গেলে এই বইটাকে কিছুটা দুর্বল মনে হতেই পারে। গল্পের দিক থেকে বা অন্যান্য সবকিছু দিয়ে আগের গুলোর সাথে তুলনা করলে এইটা বইটা পিছিয়ে থাকবে। তবে এককভাবে দেখতে গেলে সিরিজের প্রতিটা বই'ই সুন্দর। এটাও তার ব্যতিক্রম নয়।
অদ্ভুতুড়ে সিরিজের যেকোন বইয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য সম্ভবত 'ইনোসেন্স'। যেকোন মুহুর্তে এর একটা বই নিয়ে পড়ে ফেলা যায়, মন ভাল হয়ে যাবে একরকম নিশ্চিত!
এই গল্পে যেমন শুরুতেই বিপদভঞ্জন আর শংকাহরণ দুই হতভাগা দু'দিন ধরে না খেয়ে পথে পথে ঘুরছে। এক লোককে নদীতে ভেসে যেতে দেখে তাকে পানি থেকে টেনে তুলে করালী ডাক্টারের বাড়ি নিয়ে তুললো। তারপর তার পকেট থেকে পাওয়া টাকার নোটগুলো ভিজে গিয়েছিল বলে তা ছাদে নিয়ে রোদে শুকিয়ে আনলো। অথচ এই অভুক্ত মানুষ দু'টার কেও তার কোন টাকা ছুঁয়ে দেখলো না, তার হীরার আংটি দেখে তাদের লোভ হল না! এটাই অদ্ভুতুড়ে সিরিজ!
আরো আছে। মুকুন্দ রায় মরে গিয়ে ভুত হলেন। ভদ্রলোক বেঁচে থাকতে কোনদিন ভুতে বিশ্বাস করেন নি সেটা ঠিক ছিল। ঝামেলা হল, মরে গিয়ে ভুত হয়েও তিনি ভুতে বিশ্বাস করছেন না। ভুত সোসাইটি তে গিয়ে তিনি ভুতে বিশ্বাস একটি কু-সংস্কার' মূলক বক্তৃতা ও দিয়ে ফেললেন! তারপর রাস্তায় কেও তাকে ভয় পেলে নিজে গিয়ে তাদের আশ্বাস দিয়ে আসেন, ভুত বলে কিছু নেই বাছা। মানে, একটা ভুত এসে আপনাকে বোঝাচ্ছে দুনিয়াতে ভুত বলে কিছু নাই!
গল্পের শেষটা এক ভিনগ্রহবাসী কে দিয়ে। সে যে কে বলে দিলে গল্পের টুইস্ট নাই হয়ে যাবে। অদ্ভুতুড়ে সিরিজের অন্যান্য বইয়ের তুলনায় এই গল্প জমেছে কম। কিন্তু বিংশ শতাব্দী'র আশ্চর্য সব দিনের সাক্ষী হবার ফাঁক-ফোকরে এই যে একদল নিষ্পাপ শিশুর মত কোমল মানুষদের দেখা মেলে- তাদের কাগজে বন্দী করে রাখার জন্য আমি শীর্ষেন্দুর কাছে কৃতজ্ঞ!
বহুদিন পরে অদ্ভুতুড়ে সিরিজের আগে না-পড়া কিছু পড়লাম। অদ্ভুতুড়ে সিরিজ এর তুলনামূলকভাবে কম আকর্ষণীয় বই। গল্পের মাঝে সায়েন্স ফিকশন ভূত গ্রামের রঙিন সব চরিত্র সবই আছে, তবে মূল গল্পটা একটু জোলো, অত ঘন রসালো নয় ঠিক।
ব্যপারটা আসলেই বেশ ঘোরালো। শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জন নদীতে অর্ধমৃত এক ব্যক্তিতে খুঁজে পেয়ে করালী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। এরপরই অঘোরগঞ্জে শুরু হয় যত ঘোরালো ব্যপার। ডাক্তার, কবিরাজ, জ্যোতিষী, চোর, পুলিশ, কুসংস্করাচ্ছন্ন ভুত, বিজ্ঞানমনষ্কভুত সব মিলিয়ে আসলেই চমৎকার এক কাহিনী। একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করে থামতে মন চায় না। সবচেয়ে অসাধারণ লাগে গল্প বলার ভঙ্গী। কেমন যেন একটা ভারিক্কি চালে কথাগুলো বলে যান। হাসিও লাগে আবার শঙ্কাও জাগে।
অসাধারণ একটি গল্প। প্রথমদিকে একটু খাপছাড়া লাগছিল। অদ্ভুতুড়ে সিরিজের অন্য গল্প গুলোর মত শুরুতেই ভালো লাগাটা না এলেও একটু পরেই সেই break টা শীর্ষেন্দু ঠিক তৈরী করে দিয়েছেন।
কোথাও যেন স্পেস সায়েন্সের সাথে ক্লপ বিজ্ঞান মিশে একাকার। জীবনের চলার পথে বন্ধুর পথচলাতেই যে আসল আনন্দ সেটা বারবার বুঝিয়েছেন গল্পকার। Nonlinearity যে আমাদের জীবনের একটি অবচ্ছেদ্য অংশ সেটা গল্পকার খুব সাবলীলভাবে গল্পের গাঁথুনিতে বেঁধেছেন।
অদ্ভুতভাবে একজন অশরীরি চরিত্র (মুকুন্দ রায়) যাকে আমরা সচরাচর ভুত বলে আখ্যা দিয়ে থাকি - তার মুখ দিয়ে গল্পকার বলছেন, "আমি এসব ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানায় বিশ্বাসী নই। আমি সায়েন্সে বিশ্বাসী। বিজ্ঞান আর যুক্তি ছাড়া বিশ্বে আর কিছু নেই"।
সেহরির পর বইটা খুলে বসলাম। পড়তে পড়তে কখন যে সময় কেটে গেলো, বুঝতেই পারলাম না। খুবই মজার একটা বই। হাস্যরস, ভুতুড়ে ব্যাপারস্যাপার আর বিজ্ঞানের টুকরো মিশেলে একটা বইকে কেমন দারুণভাবে উপভোগ্য করা যায়, তা শীর্ষেন্দু বাবুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজটা না পড়লে কেউ বুঝবে না।
নির্মল আনন্দ পেতে চাইলে অদ্ভুতুড়ে সিরিজের কোন বিকল্প নাই। নদীতে একটা ছুরিবেঁধা দেহ ভেসে যেতে দেখে তাকে নদী থেকে উঠিয়ে অঘোরগঞ্জের ডাক্তার করালির কাছে নিয়ে শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জন। তারপর সেই অজ্ঞাত পরিচেয়ের যুবককে ঘিরে অঘোরগঞ্জে ঘটতে থাকে নানানসব ঘটনা।
3.5/5 Beautiful! Some cliched facts about society have been put forward to slap on hardly! Funny, Witty, Sarcastic. A touch of science fiction put the whole thing into a different level.
মুকুন্দবাবু মরে ভূত হয়েও নিজে ভূত ব্যাপারটা অবিশ্বাস করেন, বিজ্ঞান ছাড়া কিছু মানেন না। ব্যাপারটা আমার বেশ মজার লেগেছে। অদ্ভুতুড়ে সিরিজটা পড়লেই মন ফুরফুরে হয়ে যায়।
76% "রা" মানে কি পাঠকের জানা দরকার। এটি একটি বীজনামের সংক্ষিপ্ত রূপ। শতম গ্রহ মানে হয়তো সহস্রার চক্র। অর্থাৎ উপন্যাসে অন্তঃস্থ আত্মাকেই কেন্দ্রীয় চরিত্র করা হয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এতে আধ্যাত্মিকতা কিনবা নৈতিকতার বালাই নেই, বরং আছে "সাতে-পাঁচে বেশ থাকা"। সংসারের ভূমি থেকে বিবেচনা করলে আধ্যাত্মিকতা পানসে লাগে। মার-দাঙ্গা নেই, কেনাবেচা নেই, হিংসে মারামারি নেই - এ আবার কেমন জীবন। আমার এক বোন শ্বশুরবাড়িতে একটানা বেশিদিন তিষ্ঠতে পারে না। কেননা সেখানটা তুলনামূলকভাবে শান্তির জায়গা, বরং বাপের বাড়িটা অশান্তিতে গমগম করছে, সেটাই বেশ লাগে। দুঃখের ব্যাপার হল বাপের বাড়ির কিন্তু এমন ভাগ্য কি কর্ম নেই যেখানে আকাশ থেকে "রা" জাতীয় কেউ কোনদিন খসে পড়বে। আর যদি বা কোনওদিন খসেও পড়ে, তাহলেও প্রথম অবকাশেই চম্পট দেবে আর ফিরে আসবার নামটি করবে না। করালী ডাক্তারের চরিত্রটি অনবদ্য, বাস্তবে কতকটা সেইরকম মানুষ দেখেওছি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কল্পিত গাঁ এমনই - ভ্রষ্ট, রুষ্ট, পুষ্ট, শিষ্ঠ যেমন আছে, কেষ্ট আর ইষ্টও আছে তেমনই। প্রকৃতির বিবৃতি দেদার, আবার বিকৃত কিম্ভুতেরও অভাব নেই। বড়োই মজাদার উপন্যাস। এখন কি পড়বো? অদ্ভুতুড়ে সিরিজের সবে মোটে চারটে বই পড়ে শেষ করলাম , এখন সামনে কোনটা পড়বো ভাবছি। গজাননের কৌটো কেমন হয়!