২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বান্দরবান থেকে দক্ষিণ রাঙামাটিতে রাইনক্ষ্যং নদীর উৎসমুখে ট্রেকিঙে গিয়েছিলেন কয়েকজন অভিযাত্রী। সে যাত্রার বিবরণের সঙ্গে বাগাড়ম্বরের যোগফল এই গ্রন্থটি।
নিচে Download eBook সূত্র থেকে বইটি মোবি ও ইপাব কাঠামোয় সংগ্রহ করা যাবে।
হিমালয় কিংবা আন্দিজ নয়, ঘর থেকে দু'পা ফেলে, বান্দরবানের রুমা থেকে রাঙামাটির পুকুরপাড়া পর্যন্ত বিস্তৃত এই অভিযান। ভ্রমণকাহিনী আমার বরাবরই ভালো লাগে। মাহবুব আজাদের চমৎকার লেখনীর জন্য তা আরো সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে।
লেখক মাহবুব আজাদের ভক্ত হয়ে আমি ওনার সচলায়তন ব্লগ পড়ার সময় থেকেই (২০১২-১৩); কিন্তু তখন জানতাম না তার আসল নাম মাহবুব আজাদ। যাকগে, হিল্লি-দিল্লীর-আন্দেজ-আম্রিকা-আফ্রিকা-আরবের ভ্রমণকাহিনি পড়তে অভ্যস্ত আমরা, লেখকরাও বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে লিখেই অভ্যস্ত। দেশ-ভ্রমণ নেই লেখা-টেখা বোধহয় তেমন একটা নেই; অন্তত আমার চোখে পড়েনি (অবশ্য আমার পড়াশোনার যে বহর, তাতে না পড়ার সম্ভাবনাই বেশি)। তাই কিঞ্চিৎ যে অল্প ক'টা ভ্রমণকাহিনি পড়েছি, সেগুলো পড়তে পড়তে আফসোস করেছি, কেউ কেন বাংলাদেশ নিয়ে অমন সুন্দর কোন ভ্রমণকাহিনি লিখেন না। মাহবুব আজাদ আমার সেই তৃষ্ণা অনেকাংশেই মিটিয়েছেন আপাতত। :P
ভূমিকায়ই লেখক বলেছেন-- শিরোনাম দেখে পাঠকসমাজের (পাঠিকারাও আছেন এই দলে) মনে হতে পারে, হিমালয় বা আনদেজ চষে বেড়িয়ে এসে কলম হাতে নিয়েছি। আদপে ব্যাপারটা সেরকম নয়, ঘর থেকে শুধু দুই পা ফেলে, বান্দরবানের রুমা থেকে রাঙামাটির পুকুরপাড়া পর্যন্ত বিসতৃত গরীবের এই অভিযান।
তো, মাহবুব আজাদের ভীষণ উইটি, সরস, প্রাণবন্ত লেখায় বান্দরবান থেকে দক্ষিণ রাঙামাটিতে রাইনক্ষ্যং নদীর উৎসমুখে ট্রেকিঙ যাত্রার বিবরণের এবং বাগাড়ম্বর উপভোগ করেছি পুরোমাত্রায়। এক মুহূর্ত একঘেয়ে লাগার সুযোগ দেননি।
ইপাব ফাইলটার ডেসক্রিপশনে লেখা "২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বান্দরবান থেকে দক্ষিণ রাঙামাটিতে রাইনক্ষ্যং নদীর উৎসমুখে ট্রেকিঙে গিয়েছিলেন কয়েকজন অভিযাত্রী। সে যাত্রার বিবরণের সঙ্গে বাগাড়ম্বরের যোগফল এই গ্রন্থটি।"
লেখকের বাগাড়াম্বরের আমি ভক্ত হয়ে গেছি (যদিও শুধু এটা আর আশাকর্পূরই পড়েছি)। আর যাত্রাটা যেহেতু মারাত্মক ছিল, তাই পরিমিত রোসবোধের সাথে দেয়া বর্ণনাটাও দারুন লেগেছে।
লেখাটার মধ্যে, গদ্যের সামগ্রিক গড়নে আর কৌতুকবোধেও – একটা নারায়ণ সান্যালোচিত রাবীন্দ্রিক রুচির ছাপ আছে। সেটা খারাপ নয়। তবে কমবেশি মধ্যবিশের এক তরুণের বয়ানে শোনানো, একদশকও পার না করা গল্পের রসবোধ পূর্বসূরির চার দশক আগের রসবোধের মতো স্লাইট বয়স্ক শোনাবে কেন – এই বিষয়টা একটু প্যারাদায়ক ঠেকেছে।
আলাদা করে তারিফ করতে হয় যেটার সেটা লেখকের শব্দপ্রাচুর্য। আবার বলি। প্রাচুর্য। বাহুল্য নয়। এদিক-ওদিক সত্তর পাতার একটা সফরনামাতে বাক্যমাফিক শব্দ ব্যবহারের যেসব জমাটি প্রয়োগ শেখা যেতে পারে, গোটাকয়েক প্রমান মাপের বাংলা উপন্যাস পড়েও ততখানি আয়ত্ত হবার নয়।
অন্যপ্রসঙ্গঃ লেখক একজন জনপ্রিয় ব্লগারও। তাঁর লেখার অনেকগুলো গুনের মধ্যে দুটো আমার বিশেষ পছন্দের। এক, বাংলা লেখাপত্রে বিদেশি শব্দ – সরাসরিই বলা যাক – ইংরেজি শব্দের ব্যবহার এড়িয়ে চলার ব্যাপারে নির্লজ্জ সচেতনতা। আর অন্যটা, একজাতের স্বকীয় শব্দসৃজনী ব্র্যান্ড অব হিউমর পত্তন। তাঁর সাম্প্রতিক লেখাগুলো যেমন ‘কটিবন্ধু’ ইত্যাদিতে দ্বিতীয়টার ব্যবহারে যে ধী-শক্তি টের পাওয়া যায় সেটা অসামান্য! ‘দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা’ যে সামান্য ওল্ড স্কুল শোনাচ্ছে বলেছি সেটা আসলে এই লেখাগুলোর পাশে বসিয়ে বিচার করলেই।
"দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা" পড়তে গিয়ে বহুদিন পর মনে হলো, একটি নিখাদ-নির্মেদ ভ্রমণকাহিনী পড়ছি। এ যেন ভ্রমণসাহিত্যের মূলে ফিরে যাওয়া। লেখক তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করবেন, কিন্তু পাঠকের সাথে লেখকের যোগাযোগের একটাই উপায়- তাঁর কলম ও শব্দাবলী; আর কিচ্ছু না। আজকালকার ভ্রমণোকাহিনীগুলো পড়ে শেষ করাটাও যেন একেকটি এডভেঞ্চার; পাঠককে ক্ষণে ক্ষণে লেখকের দাঁতাল আলোকচিত্রের উপদ্রপ ডিঙিয়ে যেতে হয়। মাহবুব আজাদের এই বইটিতে সেই উপদ্রপ নেই। বরং পড়ার সময় ফটোগ্রাফের অভাব একেবারেই অনুভূত হয়নি; পুরো এডভেঞ্চারই মনের চোখে দেখে নিয়েছি।
লেখকের গদ্য নিয়ে দু'একটা মন্তব্য না ছুঁড়লে অন্যায় হবে। তাঁর স্বভাবসুলভ রসময় ভাষার গতিতে তরতর করে পড়া এগিয়ে গেছে। শব্দ নিয়ে খেলা করার যে প্রবণতা আমি লক্ষ্য করেছি তা যেকোনো মনযোগী পাঠককে অভিভূত করবে। মাঝেমধ্যেই বাক্যে কিছু কিছু শব্দের বিন্যাস ঘটিয়ে এমনসব দ্যোতনা সৃষ্টি করেছেন যে, পড়তে পড়তেই ফিক করে হেসে ফেলেছি! কেবলমাত্র লেখকের গদ্যের সাথে পরিচিত হবার জন্যও এই বইটা পাঠ করা যায়।
খুব খুব ভালো লেগেছে। আমার ট্র্যাকিং এর স্বপ্ন হয়তো আজীবন স্বপ্নই থেকে যাবে। :( মাঝে মধ্যে মনে হয় জীবনে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই হবে না আমাকে দিয়ে।
ভ্রমণ কাহিনীর সার্থকতা হলো পাঠককে ভ্রমণে উৎসাহিত করা। লেখক এই দিক দিয়ে সম্পূর্ণ সার্থক। কারণ বইখানা পড়তে যেয়ে প্রতি মুহুর্তেই মনে হচ্ছিল, ব্যাকপ্যাকখানা (আমার ন্যাপস্যাক নাই) কাঁধে চেপে ল-জাইগা বলে রওনা দেই। সেই সাথে ঘটনার বর্ণনার মজলিশি আমেজ মিলে বইটা পড়া খুবই আনন্দদায়ক এক অভিজ্ঞতা। তবে লেখক যে রকম সময়ে অসময়ে ছবি তোলার বর্ণনা করেছেন, সেই কয়েকটা ছবি বইয়ে সংযুক্ত করতে পারলে বইটা পরিপূর্ণ হতো।
ভ্রমন বা অভিযান কাহিনী পড়তে আমার সবসময়ই খুব ভালো লাগে। সেই সাথে ঘুরে বেরানোটা অনেকটা নেশার মতো। গত নভেম্বর মাসেই গিয়েছিলাম বান্দরবন অভিযানে। তাই মাহবুব আজাদের দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা বইটা পড়তে পড়তে বারবার আমাদের সেই অভিযানের স্মৃতি টুকরো টুকরো ছবি চোখের সামনে ঘুরে ফিরে আসছিল�� যদি ও আমাদের রুট এক ছিল না, লেখকরা গিয়েছিলেন রুমা হয়ে পুকুরপাড়া, আর আমরা গিয়েছিলাম রুমা হয়ে বগা লেক হয়ে কেওকেরাডং।
লেখকের বর্ণনাশৈলী দারুণ। বেশ রসাত্মক ভাবে তিনি তাদের অভিযানের সাবলীল বর্ণনা করেছেন। যে কখনো পাহাড়ে যায়নি তার একটু সমস্যা হলেও যে অন্তত একবার পাহাড়ে গিয়েছে সে এই বইটা পড়তে পড়তে একটা অসাধারন ট্যুর দিয়ে আসতে পারবেন বান্দরবনে, আপনার মনের জানালা লেখক খুলে দেবে। আমি যখন বইটা পড়ছিলাম মনে হচ্ছিল আমি ও ছিলাম ওই দলে। এটাই লেখকের সার্থকতা।
বাংলায় ভ্রমণকাহিনী আছে বিস্তর। কিন্তু লেখায় মুন্সিয়ানা আর রসবোধ, এই দুইয়ের উপস্থিতি বাংলা ভ্রমণকাহিনীতে সচরাচর পাওয়া যায়না। এই বইয়ের লেখক সেদিক থেকে সফল। ভ্রমণকাহিনীসমূহে কোন এক অদ্ভুত কারণে ঘটনাপ্রবাহ কবে সংঘটিত হয়েছে তা উহ্য থাকে। এই বইয়েও তাই। যদিও এই বইয়ে দেওয়া পারিপার্শ্বিক তথ্যসমূহ বিচার করে ঘটনাপ্রবাহ কবে সংঘটিত হয়েছে তা অনুমান করা যায়। লেখকের আরো ভ্রমণকাহিনী (যদি থাকে) পড়ার ইচ্ছা রাখি।
বিশাল এই ভ্রমণ কাহিনীর সবথেকে চমৎকার ব্যাপার হচ্ছে পড়তে যেয়ে কোথাও ক্লান্তি আসে না। আড়ম্বরপূর্ণ বর্ণনা শৈলী নিতান্ত ঘরকুনো পাঠককের সুপ্ত ভ্রমণ ইচ্ছাকেও কিছুটা উসকে দিতে বাধ্য। লেখক থেকে থেকেই আয়োজন করে ছবি তোলার বর্ণনা দিয়েছেন। অক্ষরের জালে সেই ছবি বেশ ভালই ফুটে ওঠে। কিন্তু এরপরেই কল্পনার সাথে বাস্তব ছবিটা মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। সেই আকাঙ্খাকে লেখক ভবিষ্যতে গুরুত্ব দেবেন এই দাবী জানাই।
বহুদ্দিনবাদে একখান জমজমাট ভ্রমণ কাহিনি পড়লাম। লেখকের বর্ণনাগুণে পুরো ট্রেকিংটুকু চোখের সামনে ঘটলো বলে মনে হলো। সাথে কিছু ছবি দেখার সুযোগ হলে একদম ষোলআনা আশ মিটে যেত।
আমি আগে ভ্রমণকাহিনী পড়তাম না। মনে হত, আমি নিজে ঘুরব, মানুষ গিয়ে কী করল না করল সেইটা জেনে আমার কী। পরে এই পার্সেপশান পরিবর্তন হয়েছে। এখন ভ্রমণকাহিনী আর আত্মজীবনী পড়ে যত মজা পাই, উপন্যাস আর তত টানে না। এই মুক্তাখচিত বইটির সন্ধান পেয়েছি যথারীতি গুডরিডস ঘেঁটে। আমার বহুদিনের দুঃখ ছিল এই নিয়ে যে, বাংলাদেশের মানুষ বহু জায়গা ঘোরে কিন্তু লেখে না। এক দুই শব্দের ক্যাপশন দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষের দেখার ভঙ্গি আলাদা। সেম ঘটনা পাঁচজন লিখলে পাঁচরকম দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যাবে। এই বইটা আমার বহুদিনের তৃষ্ণা মিটালো এবং আরো অনেকখানি বুভুক্ষু করে রেখে গেল।
লেখক এবং তাঁর দল রাঙ্গামাটির রাইনক্ষ্যং জলপ্রপাত দর্শনের নিমিত্তে বান্দরবানের রুমা থেকে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং যে বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে এসেছিলেন, এ তারই কাহিনী। মানুষ বান্দরবান যাবে কিন্তু 'ঘটনা' ঘটবে না, এ সম্ভব না। আমি বাচ্চা মানুষ অন্তত যে দুইবার গিয়েছি, দুইটা নিয়েই আলাদা বই লেখা সম্ভব। আর এই ভদ্রলোকের লেখা পড়ে মনে হলো ইনারা প্রফেশনাল ট্রেকার। এমন জোস মানুষজনের অভিজ্ঞতা পড়তেও আনন্দ। আমার দুঃখও লাগলো একটু, এই মানুষগুলো কোথায় হারায় যান? এখনকার সময়ের এইরকম মানুষগুলো ঠিক কোথায়? তারা কি ভ্লগ বানায়? তারা কি লেখেনা? কেন লেখেনা?
লেখক প্রচণ্ড রসবোধসম্পন্ন। আমি উনার লেখার ফ্যান হয়ে গেছি। জায়গায় জায়গায় এত রকম উপমার প্রয়োগ, কখনো সাহিত্য, কখনো সংগীত, কখনো বিশ্বরাজনীতি থেকে, আমার খুবই ভালো লাগছে খুঁজে খুঁজে উপমার মাহাত্ম্য বের করতে। কখনো সুকুমার রায় রিভিশন হলো, কখনো নতুন ছোটগল্প পড়ে বিস্মিত হলাম। সাথে বান্দরবানের পাহাড়ি পথে এডভেঞ্চার তো আছেই। লিখনশৈলীর গুণেই কি না মনে হলো আমিও ওঁদের দলের একজন। গরুমরা পাহাড় পার হতে গিয়ে প্যানিক এটাক খাচ্ছি, অথবা পথ ভুলে মাঝরাতে ঝিরির পাশে ক্রমাগত ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছি। হিংস্র গয়ালকে টর্চ মেরে ধমকে থামিয়ে দিচ্ছি অথবা ত্রিপুরা পাড়ায় অচেনা বাড়িতে রাত কাটাচ্ছি।
আপনারা যারা ভাবেন, বিদ্যাশ না গেলে ঘোরা হয় না; আপনারা প্লিজ এই বইটা পড়েন৷ 'দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা' নাম দেখে মনেহয় না জানি কি পর্বত দেখতে গেছেন। কিন্তু দেশি মরিচের মত দেশি এইসব ছোটখাট পাহাড়ের যে ঝাঁজ, একদম কাঁদিয়ে ছেড়ে দিতে যথেষ্ট। ইদানীং রিল্যাক্স ট্যুর দেখলে গা জ্বলে (হ্যাঁ, হ্যাঁ, এর পজেটিভ সমস্ত যুক্তি আমার জানা, আমি আপনার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। কিছুদিন পর পার্সেপশান চেন্জ হইলে হয়ত অন্যকথা বলব, শুধু ইদানীং গা জ্বলে, হাহা!) মনেহয়, what a waste of money! Raw জিনিসপাতি ভাল্লাগে। আরো ভালো লাগে কেউ যদি সেই জিনিস এমন যত্নে লিখে ফ্রি বই আকারে ইন্টারনেটে রেখে দেন।
এইরকম বইয়ের সন্ধান, স্পেশালি দেশি পাহাড় জঙ্গলে অভিযান নিয়ে লেখা বই/আর্টিকেল যদি নজরে থাকে, এই দরিদ্র পাঠক বরাবর একটু জানান দেবেন।
ভ্রমণকাহিনী পড়ায় খুব বেশি আগ্রহ নেই তারপরেও এই বইটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক নিশ্বাসে পড়ার মতো। বইটা পড়ার পর মনে হয়েছে আরও লম্বা সময়ের জন্য ঘুরতে গেলে আরও বেশি লিখতে পারেতেন। এক কথায় অসাধারণ