সব বাজিকর জানে ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ কথাটাই ঐন্দ্রজালিক,বু জরুকি। তবুও সব বাজিকরই এখনো রহু চণ্ডালের হাড়ের স্বপ্ন দেখে মনে মনে ও বিশ্বাস করে তার সার্থক অস্তিত্ব সম্ভব। রহুর হাড় লুকিয়ে আছে কোনো এক ভূখন্ডের ফলপ্রসূ মৃত্তিকার গভীরে, যে স্থানটি বাজিকরকে খুঁজে বের করতে হবে। সেই স্থানটি খুজে বের করবার জন্যই বাজিকরের এই ভূ-পরিক্রমণ। যাযাবর বাজিকররা আজো খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের বীজপুরুষ রহু চণ্ডালের হাড়।
... সে এক অপরিচিত দেশ। যেখানে ঘর্ঘরা নামে এক পবিত্র নদী বয়ে যায়। সেখানে নাকি কবে এক শনিবারের ভূমিকম্পে সব ধূলিসাৎ হয়েছিল । ঘর্ঘরার বিশাল এক তীরভূমি ভূ-ত্বকে বসে গিয়ে নদীগর্ভের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আর তাতে মিশে গিয়েছিল গোরখপুরের বাজিকরদের জীর্ণ বাড়িঘর। ধ্বংস হয়েছিল বাজিরদের প্রধান অবলম্বন অসংখ্য জানোয়ার।
লুবিনি সেই পুবের দেশের কথা শারিবাকে বলে, যে পুবের দেশের কথা দনু পীতেমকে বলেছে, পীতেম বলেছে পরতাপ, জমির আর লুবিনিকেম জামির বলেছে রূপাকে। কিন্তু কোথায় যে সেই স্থির দেশটি ,যেখানে আছে বাজিকরের স্থিতিস্থায়িত্ব, সেকথা কেউই জানে না। প্রতিবারই মনে হয়েছে এই বুঝি সেই দেশ। প্রতিবারই কোনো না কোনো আঘাত, সে আঘাত মানুষের সৃষ্ট হোক কিংবা প্রকৃতির সৃষ্ট হোক, বাজিকরকে দিশাহারা করেছে।
এই যাযাবর বাজিকরদের স্থায়ী কোনো নিবাস নেই। কেবলই জায়গা বদলায়। তাদের বিশ্বাস তাদেরও একসময় এক দেশ ছিল।
অভিজিৎ সেন মহাকাব্যিক আবহে অত্যন্ত নিপুণতায় লিখেছেন ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাস। এই উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে যাযাবর বাজিকর সম্প্রদায়ের জীবন-আখ্যান।
Abhijit Sen was born on January 28, 1945 in a village named Keora in the Barishal district of what is now Bangladesh. He moved to Kolkata in the beginning of the 1950s. He finished his high school and some parts of college-level education from multiple institutions while moving from Kolkata to Jhargram, then Purulia, and then back again to Kolkata. Finally while working in an Insurance company in Kolkata, he earned both Bachelor's and Master's degrees in History. In 1969, he sacrificed his job, family-life and domicile in Kolkata to join the revolutionary Naxal movement. After living in Malda, in the northern part of West Bengal for some years, he has recently moved to Calcutta. Most of the characters of his stories are drawn from his direct and varied experiences of life.
His first novel, Rohu-Chandaler HaaR has been published in 1985. This has been translated into English as Magic Bones in 1992 (published jointly by Abhinav Publications, Delhi, and Facet Books International, New York). He received the Bankimchandra Memorial Award for this novel in 1992. He also received the Saratchandra Memorial Award from the Calcutta University in 2005.
এই জীবনপুরে পরিব্রাজকের কোনো সাকিন থাকে না। মায়াময় কোনো স্মৃতির উপলক্ষ্য থাকে না। এই তীব্র অভাববোধের কারণেই গন্তব্যের বদলে পথটা,সফরটা তার কাছে পরম আরাধ্য হয়ে ওঠে। চলতি পথে সে মানুষকে যত জানে,তত কম প্রত্যাশা করতে শেখে। এই পথমুখী উজাড় জীবনে ছুটতে ছুটতে অপসৃয়মান দৃশ্যের মতো মানুষের ব্যাপারে তার ধারণা পরিবর্তিত হয়। তবু অভ্যাশবসে সে মানুষকে বিশ্বাস করতে চায়, বিশ্বাস করে ঠকেও। তাতেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, আফসোস নেই। বারবার থিতু হতে চাওয়া,ঘর বসানোর ঝোঁক যখনই পাল্লায় ভারী হয়, তার অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করে রহুর উদাত্ত আহ্বান। পথের ডাকে সাড়া না দিলেও আদিপুরুষের পাপের ভারে কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়-দাঙ্গার মতো ক্রমশ বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়ে অগ্নিমোহাবিষ্ট পতঙ্গের মতো সে নেমে পড়ে পথে।
কে এই রহু? অথচ বাজিকরদের কাছে এই রহুই সব। আল্লাহ, ভগবান বা যীশুর সাথে মিল নেই তার। নেই কোন অলৌকিক গুণাবলি। মরুর বুকে পানির নহর বইয়ে দিতে পারে না। মৃতকে হাতের ছোঁয়ায় জীবিত করতে পারে না। শক্ত হাতে বিনাশ করতে পারে না দুষ্কৃতিকারীদের। অভাবও দূর করতে পারে না। তারপরও বাজিকরদের কাছে এই রহুই সব। রহুর ডাক এড়াতে পারে না সে। না আছে জাতপাত, না আছে ধর্ম। না তারা হিন্দু, না মুসলমান, না খ্রিষ্টান। তারা গরুও খায়,শুয়োরও খায়। তাদের ভাষা-সংস্কৃতি এমনকি ধর্মীয় আচার সে সংগ্রহ করেছে পথে পথেই। যে অঞ্চলে যায়, খুব দ্রুত রপ্ত করে সেখানকার ভাষা,সংস্কৃতি। পরিচয়ের প্রশ্নে তাই তারা কেবল বাজিকর। হাটেগঞ্জে ঘুরে নানাবিধ খেলা দেখানো, দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, শারীরিক কসরৎ, ভেলকি লাগিয়ে টাকা দ্বিগুন করে দেওয়া, ভানুমতির খেলার নানান ভোজবাজি দেখিয়ে,বানরের নাচ দেখিয়ে, জড়িবুটি বেচে জীবন কাটিয়ে গেছে তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। জীবিকার মূল নির্ভরতার কৃষিকাজ নয়, পশুপালন। মেলা, উৎসব কিংবা সমৃদ্ধ লোকালয়ের খোঁজে তার যাত্রা ছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে এই বাজিকর চায় স্থায়ী হতে, এক টুকরো ঠাঁইয়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় দিগ্বিদিক । তার যেহেতু কোনো ধর্ম নেই সে আশ্রয় নিতে পারে না সেখানে, তার মাঝে কোনো জাত নেই, পথে পথে সে সংগ্রহ করেছে নানা দেবতা, তার গায়ে সবচেয়ে শক্তভাবে লেগে আছে তার পূর্বপুরুষের স্মৃতি। সমাজে অন্তর্ভুক্ত হতে চেষ্টা করে ক্লান্ত বাজিকরের স্থায়ী হওয়ার এক তীব্র বাসনার উপাখ্যান ‘রহু চণ্ডালের হাড়’। থিতু হয়ে সমাজের মূলস্রোতের সাথে মিশে যাওয়ার এই তীব্র আকাঙ্খার জন্য তাদের দিতে হয়েছে চড়া মূল্য।
ফরাসিদের ভেতর একটা চল আছে চল্লিশের নিচের কোনো ছোকরা লেখককে তারা তোয়াক্কা করতে চায় না। অভিজিৎ সেন যখন আশির দশকে তার এই প্রথম উপন্যাস পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছেন, তার বয়সও তখন চল্লিশ ছুঁইছুঁই। তার রহু চণ্ডালের হাড় একেবারেই আলাদা গতের লেখা। ব্রিটিশ-রুশ-মার্কিন উপন্যাসের যেসব ছাঁদ আমাদের নাগালে আছে, রহু চণ্ডালের হাড়-কে তাদের সঙ্গে মেলানো দায়। ম্যাজিক রিয়েলিজমের চেনা লবজেও একে আঁটানো যায় না। বাংলার সংস্কৃতি ও ইতিহাসের যেসব গলিঘুঁজিতে নগরকেন্দ্রিক সাহিত্যের ব্যাপারীরা বড়ো একটা যাতায়াত করেন না, সেসব দিকেই অভিজিৎ সেনের বরাবরের মনোযোগ। বাজিকরদের এই যাযাবর জীবনের ঔপনিবেশিক ভারতের চড়াই-উতরাই কীভাবে তাদের প্রভাবিত করেছে তার রংবেরঙের বুনোটে এই ভাঙা হাড়ের পদাবলীর বিস্তার। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীর চোখ দিয়ে, সাম্যবাদী সমাজচিন্তকের মরমি মন নিয়ে এই আখ্যানকে কলমে ধরেছিলেন লেখক। যে-আখ্যানে কোনো নায়ক নেই, যেখানে কিংবদন্তি আর অতিকথা পাশাপাশি পথ চলে, তাকে ‘মহাকাব্যিক’ বললে কিঞ্চিৎ বেখাপ্পা শোনায়। তবে আজকালকার পরিভাষায় যাকে নিম্নবর্গীয় ও প্রান্তিক মানুষের আখ্যান বলা হচ্ছে,সাব-অল্টার্ন বলে দেগে দেয়া হচ্ছে, তার দাঁড়িপাল্লায় উপন্যাসের মাপজোখ করলে ওজনে বেশ ভারী দেখায় রহু চণ্ডালের হাড়কে। কারণ অভিজিৎ খাপছাড়া এক যাযাবর জাতের কয়েক পুরুষের আনাগোনার বৃত্তান্ত শোনাতে বসে লাগাতার সুইফোঁড়ে বুনে দিয়েছেন সমাজ বিবর্তনের মার্কসবাদী পাঠের এক চোরা বয়ান। পুঁজির সর্বগ্রাসী ক্ষুধার মাঝে ডুবে কাতর ফাঁকা ও ফাঁপা ব্যক্তির গল্প অভিজিৎ সেন বলেন নি। তিনি যে শক্তির ইঙ্গিত দেন,তা কোনো ব্যক্তির নয়,কেবল একটি গোষ্ঠীর নয়, বরং মানুষের শক্তি।
‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাসের কথক লুবিনি নামের এক বৃদ্ধার নাতি শারিবাকে গল্প শোনানোর মধ্য দিয়ে উঠে আসে যাযাবর বাজিকরের দেড়শো বছরের দীর্ঘ পরিক্রমা। আত্মমগ্ন হয়ে সে বাজিকরের দিনযাপনের মৌখিক ইতিহাস বলে যায়, কীভাবে তারা গোরখপুর, রাজমহল, মালদা, নমনকুড়ি, রাজশাহী, আমনুরা, পাঁচবিবিসহ উত্তরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। এর কিছু লুবিনির চোখে দেখা, কিছু শুধুই মুখে মুখে বেঁচে থাকা ইতিহাস। বাজিকরের নতুন প্রজন্ম যখন জানতে চায় কেন তাদের এই ঘুরে বেড়ানো তাদেরকে কেন দুর্ভাগ্য তাড়া করে বেড়ায়? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সে নিয়ে আসে আদিপাপের ধারণাও। এই আদিপাপের কল্পিত বোঝা তার মাথায় বদ্ধমূল, এবং প্রতিটি জায়গায় তার সাথে হয়ে যাওয়া অন্যায়কে সে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই মোকাবেলা করে, তার পশু কেড়ে নিলে কিংবা তার দলের নারীকে ছিনিয়ে নিলে তার আপোষ করে লোকালয় ছাড়তে হয়, আদিপাপের দায় নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায়। ইহুদিরা হাজার বছর ঘুরে বেড়িয়েছে তাদের প্রমিজড ল্যান্ডের খোঁজে। ঈশ্বর তাদের পছন্দ করেন, তাই পছন্দের বান্দাদের জন্য তিনি খাস তালুক দেখে রেখেছেন। কিন্তু বাজিকরদের কোনো দেশ তাদের জন্য অপেক্ষা করে না,নিজের দেশ গড়ে নিতে হবে নিজ হাতে। ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাসে সাধারণ মানুষের অলিখিত ইতিহাসের সন্ধান যেমন মেলে, তেমনি ভৌগোলিক সম্প্রসারণও নজরে আসে। বাজিকরদের কোনো স্থিতি নেই বলেই একটা বড় অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই আখ্যান। এসব অঞ্চলের সাথে বাজিকরদের ভাষা-সংস্কৃতির পাল্টে পাল্টে যাওয়া,ভৌগোলিক পরিবেশ,মানসিকতা,প্রকৃতি ও কৃষি সবই অভিজিৎ তুলে এনেছেন খুব যত্ন নিয়ে। এমন মূলোৎপাটিত জনগোষ্ঠীকে সুনির্দিষ্ট কোনো ভাষায় কথা বলানো সহজ নয়। গোরখপুর থেকে আরও পুবে রাজমহল-মালদা-নমনকুড়ি, রাজশাহী-আমনুরা ঘুরে পাঁচবিবি পর্যন্ত তাদের কেবল স্থানবদল হয়। প্রতিবারই তাদের মনে হয়, এটা তাদের দেশ, এই তো তাদের স্বপ্নের নিকানো উঠান। কিন্তু হায়! সেই স্বপ্ন প্রতিবারই অধরা থেকে যায় দনু পীতেম কিংবা লুবিনিদের কাছে। লুবিনি তার নাতি শারিবাকে বলে ‘কুথায় হারাই গেল গোরখপুর?’ গোরখপুর বাজিকরদের আদি নিবাস, সেখানে ঘর্ঘরা নামে এক পবিত্র নদী বয়ে যায়। কিন্তু সেই নদীর সন্ধান আর মেলে না। বদলে বাজিকর পাটখেত নিড়াতে জানে না,মার খায়। হালে মই দিতে জানে না,মার খায়। আচানক চুরির দায়ে ধরা পড়ে,মার খায়,জেল হয়। গ্রামে মড়ক লাগে,দোষ হয় বাজিকরের। বাচ্চাকাচ্চা চুরি গেল,হারিয়ে গেল,মারো শালা বাজিকরকে,দাও ঘর জ্বালিয়ে। যখনই কৃষিকাজ করে একটু আলোর মুখ দেখে বাজিকর,ফসলের ভাগ নিংড়ে নেয় জোতদার। হাজার তরমুজে ভরা নৌকায় খুনোখুনি হয়ে নৌকা ডুবে,বাজিকর জেলে যায়। প্রতিহিংসাবশত হাতি দিয়ে ঘরদোর ভেঙে দিয়ে যায় প্রভুরা।
অভিজিৎ সেনের 'রহু চণ্ডালের হাড়' উপন্যাসের পুরো কাহিনিটিই এমনভাবে বর্ণিত হয়, যেন কোনো রূপকথা বা লোককথার গল্প। কাহিনিটি যখন শুরু হয় ল��বিনির জবানিতে, তখন শ্রোতা ছিল তার নাতি শারিবা। লুবিনির কাহিনিতে ক্রমে কিংবদন্তি ও ইতিহাস মিশে যেতে থাকে। রহু আর দনুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় পীতেম ও জামিরের। কিংবদন্তি চরিত্রের সঙ্গে ইতিহাসের চরিত্রদের। নবজাত শিশুকে দেখে পীতেম যখন বলে ওঠে 'রহু রহু', তখন ইতিহাস কিংবদন্তি হয়ে উঠতে থাকে। এক্ষেত্রে বাখতিনের 'পলিফোনি' র রূপ লক্ষ্য করা যায়। 'পলি' অর্থাৎ 'বহু', 'ফোনি' র উৎসে আছে 'ফোন' অর্থাৎ 'ধ্বনি' বা 'স্বর'। রুশ সাহিত্য সমালোচক বাখতিনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কোনো একটি সাহিত্যকর্মে অনেক চরিত্র এবং তাদের অনেক স্বর থাকাই সাহিত্যকর্মটিকে পলিফোনিক করে তোলে না। চরিত্র অনেক থাকলেও এবং তাদের অনেক রকম স্বর থাকলেও তা কোনো না কোনো ভাবে লেখকের একক স্বরের ও একক চেতনার বিভিন্ন মাউথপিসরূপ অর্থাৎ মুখপাত্ররূপ প্রকাশ হতে পারে। সেরকম ক্ষেত্রে বহু চরিত্র ও বহুস্বরের মধ্যেও যার প্রকাশ ঘটবে তা মূলত একক স্বর ও একক চেতনা। বহুর মধ্য দিয়ে লেখকের একক স্বর ও একক চেতনার এমন প্রকাশকে বাখতিন বলেছেন মনোলজিজম (monologism)। সত্যিকারের পলিফোনি অর্জিত হলে সাহিত্যকর্মটিতে মনোলজিজমের স্থান থাকবে না।এই উপন্যাসে খেয়াল করে দেখলে,লুবিনিকে বাজিকরদের গল্বের মাউথপিস মনে হয়। তবে লুবিনির বলা গল্পের মধ্য দিয়ে বর্ণিত হলেও দনু-পীতেম-ধন্ধু-বালি-পরতাপ-জামির-ইয়াসিনের মতো বাজিকর তো বটেই, সাথে সাথে তাদের চারপাশের মূলস্রোতের চরিত্রগুলোর দুনিয়া সম্পর্কে স্বাধীন বোধ ও ব্যাখ্যা আছে এবং দুনিয়ার সাথে তাদের স্বাধীন সম্পর্ক আছে। লুবিনির মৃত্যুর পরও চলতে থাকে উপন্যাসের আখ্যান। এই অজস্র চরিত্রের নিজস্ব স্বরের সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে অভিজিৎ সেনের রুহু চণ্ডালের হাড় পেয়েছে পলিফোনিক রূপ।
কখনো আলতামিরা গুহায় আদিম মানুষের আঁকা ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে যে আমি আমূল শিহরণে কেঁপে উঠবো,সেই শিহরণই জেগে উঠেছে ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ পড়তে গিয়ে। আমি এমন একজন লেখকের রচনার সমালোচনার কথা ভাবতে পারি না। শুধু পাতায় পাতায় ছড়ানো মণি-মুক্তোগুলোর দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হতে পারি,সম্মোহিতের মতো বসে থাকতে পারি।
ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে (রংপুর অঞ্চলে) প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দেখতাম বাদিয়া সম্প্রদায়ের একদল নারী আসতো, এই বইয়ের ভাষায় যাকে বলে ভিখ মাঙ্গা করতে। যাদেরকে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দেয়া হত না নীচু জাত বলে। গেটের বাইরে থেকে চাল দিয়ে বিদায় করা হত। এই বইটা পড়ার সময় বারবার তাদের কথাই মনে পড়েছে। সেই কালো কালো নারী-শিশুদের কথা। তারা এখন কেমন আছে, কোথায় আছে?
তারাই কি এই বাজিকরের বংশধর ! যে বাজিকর এসেছিল এক অপরিচিত দেশ থেকে। শত শত বছর আগের এক রহু চণ্ডালের হাড় নিয়ে যারা ঘুরতো দেশ দেশান্তর। নানা ভেলকিবাজি দেখিয়ে, জানোয়ার, মোষ বিক্রি করে যারা চালাতো সংসার। পশ্চিমের কোন এক মরুভূমির দেশ থেকে জীবনের তাগিদে রহুর নির্দেশে যাদের ছুটে চলা পূবের কোন এক দেশের পানে।
কিন্তু প্রকৃতি তাদের সহায় থাকে না কখনো। নির্যাতন, নিপীড়ন, অপমান সব সহ্য করে রহু চণ্ডালের নির্দেশে জীবনে স্থিরতা আনতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছুটে চলে কোন এক পূবের দেশের পানে।
নানা জনপদ আর জীবিকা দেখে বাজিকরদের মনে একসময় সাধ জেগেছিল স্থায়ী ঠিকানা গড়ার। কিন্তু বেজাত বলে, ধর্ম নেই বলে স্থায়ী ঠিকানা হয় না কোথাও। ছুটেই চলে পূবের দেশের সন্ধানে। কোন সেই অজানা দেশ থেকে মালদহ। মালদহ থেকে নমনকুড়ি, রাজশাহী, পাঁচবিবিসহ নানান দেশে ছুটে চলে। দেশ ভাগ হয়, নতুন দেশ হয় কিন্তু বাজিকররা পায় না স্থায়ী কোন ঠিকানা।
নতুন নতুন ঠিকানায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় বাজিকরদের চিরাচরিত ভাষা। হারিয়ে যায় পোশাক। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মানুষগুলো। মুখ্য হয়ে ওঠে বাজিকরের জাত। তারা না হিন্দু, না মুসলমান, না খ্রিস্টান । সহস্র বছর ধরে ছুটে চলা ক্লান্ত বাজিকরদের বেঁচে থাকার জন্য বেছে নিতে হয় ধর্মীয় জাত। কেউ হয় মুসলমান, কেউ হিন্দু। সহস্র বছরের বাজিকরের সেই ভেল্কিভাজি পিষ্ট হয় যান্ত্রিক মোটরের চাকায়। লুবিনির ভাষায়,
" হায়, সারা দুনিয়া হামার আছিল। হামার আছিল লদী, পাহাড়, বালি আর মাঠ, আর এখুন দেখ হামরা বন্দী হই গেলাম। বাজিকর যদি ঘাটা ছাড়ি ঘর ধরে, তবিই সে আহাম্মক, লচেৎ লয়"।
শুধুমাত্র ধর্মের কাঠামোয় ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় বাজিকর নামের একটি সম্প্রদায়। হারিয়ে যায় তাদের স্বপ্ন। ভাষা। হারিয়ে যায় সেই রহু চণ্ডালের হাড়।
আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে অভিজিৎ সেনের লেখা উপন্যাসটি কাল্পনিক হলেও বাংলার জনপদের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এক দলিল হয়ে থাকবে।
বহুগামী আমি, বহুকামীও। উপভোগ করতে ভালোবাসি রূপ, রঙ, গন্ধ, স্পর্শ, সব-সবগুলো ইন্দ্রিয় দিয়েই। ভাসতে চাই, হারিয়ে যেতে চাই আবেগ, শিহরণ, উত্তেজনা, নেশাতুরতা, অনুরাগের ময়ূরপঙ্খী নৌকায়। একে আমার তৃপ্তি হয় না, চাই অনেক, অনেককে। যেমনটা বলেছিলেন প্রাক্তন লুল কবি নজরুল: "প্রেম সত্য, পাত্র সত্য নয়/ যে-পাত্রে ঢালিয়া খাও, সেই নেশা হয়।" মৌতাত জমাতে একেও চলে, আবার বহুতেও অরুচি নেই। সব ঋতু, সব সময়, সব জায়গাতেই আমি আমার প্রেম প্রদর্শন করতে ভালোবাসি, প্রকাশ্যে অনুরাগ প্রদর্শনে আমি অশ্লীলভাবে অক্লান্ত ও নিরতিশয় নির্লজ্জ।
ওহো, বলছিলাম বইয়ের কথা! যাদের হতাশ করলাম, তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা চেয়ে বলছি, আমি বড় হতভাগ্য। এতেই ক্ষমা পাবো আশা করি।
কাজেই, স্বভাবতই, আমি কখনোই বলতে পারি না আমার প্রিয় বই কোনটা। কে-ই বা আমার প্রিয় লেখক। যখন যেটা পড়ে ভালো লাগে, সেটারই প্রেমে পড়ে যাই। সেই লেখার ভাষার মতোই আমার ভাবনা সেদিক পানে ধায়। নিজেকেই ভর্ৎসনায় বলি সেই ইংরেজি শব্দটা, "তুমি বড় impressionable। এখনো বয়ঃসন্ধি ঘুচলো না তোমার।"
আমাদের বিষাদগীতিগুলোই যদি আমাদের মধুরতম সঙ্গীত হয়, তবে বইয়ের তাক খুঁজে ধুলো ঝেড়ে তুলে নেই সেই বইটা। যে আমায় দিয়েছিলো বইটা, সে আমার তীব্র দুঃখের অপ্রাপ্তির সাধন। নাম বা কোন অভিজ্ঞানই রাখে নি সে বইটায়, হয়তো নারীদের অতীন্দ্রিয় অনুভূতিতে বুঝেছিলো আগেই, বাড়াতে চায় নি কষ্টের বা বুক-চলকানোর কোয়ান্টা। তবে, লেখক আর বইটা দুটোই আমার পূর্বপরিচিত, সমালোচনার মাধ্যমে। আর সমালোচনাও করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের আরেক দিঙ্নাগ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তাঁর 'অভিজিৎ সেনের হাড়তরঙ্গ' পড়েই লেখকের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। আজ দু'চার কথকতা হবে সেই বইটা নিয়েই।
অভিজিৎ সেন প্রায় পঁচিশ বছর আগে লেখেন এই বই। আজও সেই বই এতো আধুনিক, আমি নিশ্চিত আগামী পঞ্চাশ বছর পরেও এই বইয়ের আবেদন থাকবে অনন্য। এককথায় সাহিত্যিক নৃতত্ত্বের শ্রমসাধ্য শিল্পিত সংকলন 'রহু চণ্ডালের হাড়'।
প্রথমত, বইটার বিষয়েই চমক। বলি নি বুঝি, এটা উপন্যাস একটা! বাজিকর নামের ক্ষুদ্র এক যাযাবরি গোত্রের মানুষ-মানুষীর জীবন ঘষে আগুন জ্বালানোর ক্লান্তিকর কিন্তু অনিবার্য অলাতচক্রে ঘোরার, প্রাণ টিকিয়ে রাখার অনন্ত অধ্যবসায়ের শিল্পময় বিবরণে গতিশীল এই উপন্যাস। আমার কথাটা যতোটাই নীরস আর অনির্দেশ্য হলো, ততটাই শিল্পরসঋদ্ধ এই লেখা।
তিনি ইতিহাস টানেন এতে, তাদের কল্পপৌরাণিক কাহিনি, তাদের ভাষা, তাদের সংস্কৃতি বিশদ করেন অন্য আরো ভূমিপুত্র আর অন্ত্যজদের টুকিটাকি জীবনযাত্রার সুপাঠ্য মিশেলে। কিন্তু ভোলেন না তিনি গল্পই শোনাতে এসেছেন শেষমেষ, নৃতত্ত্বের তত্ত্বগত পাঠ দিতে নয়।
বাজিকর চুরি করে গেরস্থের ঘরে, হাতসাফাই দেখায়, ডুগডুগ করে বেজে-ওঠা ঢোলের ভোঁতা আওয়াজ তাদের বিজ্ঞাপন, দলের অর্ধবন্য নারীদের লাস্য তাদের আকর্ষণ, প্রতারণা আর লোভ তাদের অলঙ্কার। কী করে আসলে তারা?
মানিকের মতো লেখকেরও পা আর মাথা থাকে মাটিতে, মাটির দিকে নিবদ্ধ। তাই 'পান্না কোথায়' নামের ত্যাঁত্যাঁর চাররঙা কমিকসের মতো নিঝুম চাঁদনি রাতে জিপসিদের গিটারিত গান শুনে উদাস হয়ে কেউ বলে না, "মনকে কেমন আচ্ছন্ন করে দেয় এই সুর"। স্তেপে ঘোড়া-ছোটানোর বন্য উদ্দামতা বা প্রেইরিতে কিংবা রুক্ষ গেরুয়াধুলো পশ্চিমা খামারে ক্যারাভান জীবনের চলমানতা কি মাথায় রংবেরঙের স্কার্ফপরা জিপসি মেয়ের ছুরির মতো চকিত চাহনিময় রোম্যান্টিকতা তাই কারোর চোখে উঠে আসে না। অচিন্ত্যকুমারের 'বেদে' বা প্রেমেনের 'যাযাবর', নিদেনপক্ষে জসীমউদ্দীনের 'বেদের মেয়ে'-র "বাবু সেলাম বারে বারে"-এর কিছুটা নিরাপদ উপভোগের ভাতঘুমের সম্ভাবনাও এর মাধ্যমে আহরিত হয় না। বরং, গ্রামে বা গঞ্জে তারা এলে কাজের চাপে যৌবন হারানো পেটমোটা ব্যবসাদার বাজিকরের হাত-দেখা রমণীর কাছে নিদান খোঁজে বাজীকরণের, সুলুকসন্ধান চায় ইন্দ্রিয়তৃপ্তির। ক্ষমতার তাগড়াই হাত কখনো দারোগা, কখনো তার ছেলে, কখনো পত্তনিদার, কখনো জমিদার, কখনো ভিনজাতের মাথা সেজে তাদের কাছ থেকে টাকা চায়, পশু চায়, নারী চায়। সে শুধু পালায়, শুধু সূর্য-ওঠার দিকে পালাতে থাকে সদলে, পুবের দেশে যেতে থাকে সে অনবরত। তাদের পূর্বপুরুষেরাই এই পূর্বগমনের পূর্ববাণী করেছিলো: "হাঁ শারিবা, তোর নানার নানা পীতেম, তার বাপ দনু, তো সি কহিল, পীতেম, তুমু পচ্ছিমেৎ নয়, পুবেৎ যাবা। কেন কি, পুবেৎ তর্ক উঠে আর পচ্ছিমেৎ ডুবে যায়।" এতো অরুণোদয়ের সাক্ষী হয়েও তাদের ঘরে আলো আসে না, শত শত বছরের আঁধার ঘিরে থাকে তার পরিপার্শ্ব।
কেন এই নিয়ত সদলবল চংক্রমণ তাদের?
কিংবদন্তী বলে, তাদের এক পূর্বপুরুষ পুরা বিয়ে করে তারই বোন পালিকে। দেবতার অভিশাপে তারা হয় উন্মূল। "তারা কোথাও আশ্রয় পায় না এবং দেবতা তাদের অভিশাপ দিয়ে সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় করে দেয়। তোমরা এক বৃক্ষের ফল দু-বার খেতে পারবে না, এক জলাশয়ের জল দু-বার পান করতে পারবে না, এক আচ্ছাদনের নিচে একাধিক রাত্রি বাস করতে পারবে না এবং সব থেকে ভয়ানক-এক মৃত্তিকায় দু-বার নৃত্য করা দূরে থাকুক, দু-বার পদপাত পর্যন্ত করতে পারবে না। এই ছিল দেবতার অভিশাপ। সেই থেকে বাজিকর পথেপ্রান্তরে ঘুরছে। সেই থেকে সে দেবতা থেকে বঞ্চিত। গৃহস্থের গৃহের নিকট পর্যন্ত সে যায়, কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। সুতরাং বাজিকর এক ভিন্ন জীবন, এক অস্থির চলমান জীবনকে আশ্রয় করে আছে।"
তিনি জাদুকরি ভাষায় ব্যবচ্ছেদ করতে থাকেন তাদের সদাচর জঙ্গমতা এবং তাদের পথিক জীবনচর্যা, বইয়ের এবং লেখকের আরেকটা অনন্য সদগুণ। "সে নিজেকে ভুলিয়েছে নাচ গান এবং চিন্তাহীন সরল জীবনযাত্রায়। সে শিখেছে মানুষকে ঠকাতে এবং তা নিয়েই তার অহংকার। সে গ্রহণ করেছে বিচিত্র ভিক্ষাবৃত্তি, যার জন্য কোন সংকোচ তার নেই। তবুও প্রাচীন কিছু স্মৃতি বা পাপবোধ কিংবা নিতান্তই বিশ্বাস তাকে এখনো চালিত করে, এখনো নিযুক্ত রাখে কিছু আস্তিক চিন্তায়। কিছু ভীতি অথবা দারুণ দুর্দিনের আশংকা তাদের সমস্ত বিধিহীন জীবনযাত্রাকেও বেঁধে রাখে নিয়মের নিগড়ে।"
আমি সৌম্যেন পালের মধুবনী শিল্পকলা প্রভাবিত দুরঙের প্রচ্ছদ উল্টে দেখি আবারো। বইটা বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছিলো ১৯৯২-তে, বালখিল্য প্রচেষ্টা একটা বটবৃক্ষকে বনসাই করার।
ফিরে যাই বর্ণনাত্মক ঘটনাপ্রবাহে।
মানুষের মতো কৌতূহলপ্রবণ হয়ে তাদের কেউ বেরিয়ে পড়ে দলের বাইরে, সাঁওতালদের সাথে ভিড়ে পড়ে কেউ। ফিরে আসে আবার। সাঁওতালদের প্রাণোচ্ছল যূথবদ্ধতার এবং অকৃত্রিম বন্ধুত্বের কিছু কিছু নিয়ে আসে তারা, আবারো তাদের কেউ কেউ যায় কালো মানুষগুলোর ভালোবাসার টানে। এমনকি, সাঁওতালদের মারণ 'হুল'-এ অস্ত্রও হাতে তুলে নেয় কেউ কেউ তাদের কাপুরুষসুলভ মিমের উল্টোরথে গিয়ে। দামিন-ই-কো, ভাগলপুর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম এলাকায় জ্বলে ওঠে কালো মাটির মানুষগুলো। সাঁওতাল যুবকেরা পায়ে ঘুঙুর বেঁধে টামাং নিয়ে গ্রামে গ্রামে গেয়ে আগুন ছড়িয়ে দেয়। মহাজন, ব্যবসায়ীদের লোভের নির্বিচার নিঃসীম শিকার সরল গেঁয়ো শক্তিধরগুলো ক্ষোভের আগুন তীক্ষ্ণধার করে তির আর বল্লমের ফলায়, ঘৃণায় গেঁথে দেয় শোষকদের শরীরে। হুল মাহা হয় এটা, হুল মাহা হয় এটা।
কিন্তু, সাম্রাজ্যবাদের সাথে পারবে কেন ভূমিপুত্রেরা, যেখানে হেরে গেছে হিন্দু রাজা আর মুসলিম সালতানাত? কানু মুর্মু, সিদু মুর্মু, চাঁদরাই যতোই অদম্য আত্মার অধিকারী হোক, বুলেট তো আর ঠেকানো যায় না শুধু সংকল্প দিয়ে! সূর্য সেন আর সুভাষ বোসই পারেন নি!
ব্রিটিশ বাহিনীর নির্মম সংঘবদ্ধতায় আর সামরিক শক্তিতে পরাজিত সাঁওতালদের ফেলে পালাতেও তারা কসুর করে না বাজিকরদের চিরাচরিত পলাতকপ্রাণের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে।
এদিকে তাদের দল বসত গাড়তে চায় বাজিকরের চিরকেলে চলনের সমাপ্তি টানবে বলে। থানাদারের কাছ থেকে জায়গা পাট্টা নেয় তারা, বন কেটে, জল সরিয়ে জমি বানায়। বীজ ছেটায় ফসল ফলাবে বলে। ফসল ফলে, কিন্তু শেষমেষ নানা প্রতিকূলতায় সে-বসতিও হারায় তারা।
ক্রমে মৃত্যু আর দুর্যোগ আর সরকারি সিদ্ধান্ত তাদের আবারো মাটিছাড়া করে।
তাদের ভরসা কোথায়?
কোথায় বাজিকরের একটু ঠাঁই হয়?
কাকেই বা ডাকবে সে?
হিন্দুর ভগবান, কৃষ্ণ, কালী, কি মুসলিমের আল্লা, কি খ্রিস্টানের গড তাকে অচ্ছুৎ করেছে। নীরবে, সরবে প্রশ্ন করে সে নিজেকে বা দলের অন্যকে, কে হবে তার শরণ? "তো হামরার বাজিকরের রহুই সি ভগবান, কি আল্লা, কি যেশু। লয়?" কিন্তু কে দেবে উত্তর? যার কাছে প্রশ্ন, তার তো নিজেরই সংশয়। "প্রশ্নটা তার নিজের কাছেই। চতুষ্পার্শ্বের সমাজবদ্ধ মানুষের কাছে এটা কোন সমস্যাই নয়। সর্বশক্তিমান এক বা একাধিক অস্তিত্বের উপস্থিতি যেখানে জন্মের পরেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো সাধারণ বিষয়, সেখানে বাজিকর নামক সম্প্রদায়ের এ ধরনের কোন আশ্রয় নেই-একথা অন্য কারো বোধগম্য নয়। অন্য কারো সমস্যাও নয়।"
শেষাবধি কঠোর জীবনচলার পথে-থাকা পথের মানুষগুলোর হয়তো অনুভব হয়, "যে আছে তার নাম রহু। কিন্তু সে কি এমন অমোঘ? পীতেমের মতো জামিরেরও মনে হয়, না, তা কখনোই নয়। আসলে রহু, দনু, পীতেম কিংবা জামির মূলত প্রায় একই। আর বিগামাই, কালীমাই, কি ওলামাই? সেও তো শুধু পথের সংগ্রহ, তার বেশি কিছু নয়।"
গল্প চলে চার পুরুষ ধরে। কিন্তু, স্থিতি কোথাও তো মেলে না। শত পুরুষ ধরেই মেলে নি।
তারপরও মানুষের অনমনীয় জেদ! হোক সে বাদিয়া, বানজারা কি বাজিকর। হোক সে শতাব্দী যাবৎ অস্পৃশ্য বা নিপীড়িত। মাটিতে খুঁটিগাড়ার দাঁতে দাঁত চাপা লড়াইটা সে আবারো লড়তে চায়। আবারো গেরস্থালির নিরুপদ্রব, যাযাবরের কাছে আগে উপহাস্য ও তুচ্ছ, জীবনই এখন বুঝি তার কাম্য হয়ে ওঠে।
শুধু বিলাপে ব্যর্থতা মূর্ত করা ছাড়া তার অসহায়ত্বের প্রতিকার কী? "বাজিকর পাটখেত নিড়াতে জানে না, মার খায়। বাজিকর হাল মই দিতে জানে না, মার খায়। আচানক চুরির দায়ে ধরা পড়ে, মার খায়, জেল হয়। গ্রামে মড়ক লাগে, দোষ হয় বাজিকরের। বাচ্চাকাচ্চা চুরি গেল, হারিয়ে গেল, মারো শালা বাজিকরকে, দেও তার ঘর জ্বালিয়ে।"
তাহলে অন্তত প্রেম? ওই অমৃতের মাধ্যমে এই অন্ত্যজদের মূলধারায় প্রবেশের ছাড়পত্র জোটে?
পেমা প্রেমে পড়ে দারোগার ছেলের। স���জন ভালোবাসে ঝালোদের মেয়ে পাখিকে, যার হয়তো দুটো খাটো শাড়ি কেনার ক্ষমতাও নেই। ওমর লুকিয়ে ঘর বাঁধে নমশূদ্রের মেয়ে মালতীর সাথে। প্রতিটারই পরিণতি কষ্টে, বিচ্ছেদে...এবং কখনো মৃত্যুতে। আর নিচুত্বের আরো একধাপ নিচে যেন বাজিকর যাযাবরী। "বাজিকরের বিটিক পাট খ্যাতে চিৎ করা চলে, বাজিকরের বিটিক লুঠ করা চলে, ঢেমনি বানাবার চলে, আর বাজিকরের ব্যাটাক্ জামাই করা চলে না।"
প্রশ্ন ওঠে, কারণ ওটা সেই সময়েরই অনিবার্য মানসিক ঘেরাটোপ। "...তখন চৌধুরী সাহেব ঐ কথাটি তুলেছে, তুরা হিঁদু না মোছলমান, অ্যাঁ? মহিমবাবু প্রশ্ন তুলেছে, হাঁই বাপু, তোরা গরুও খাস, শুয়ারও খাস, ই কেম্কা জাত রে বাবা?"
তাই এবার তাদের গোত্রের বেশিরভাগ জুম্মাবারে কলমা পড়ে মুসলিম বনে যায়, কারণ এমনকি হিন্দুদের অন্তেবাসী নমঃশূদ্রদের ভেতরও তাদের ঠাঁই মেলে না। পথের দেবতা পথেই ফিরে যায়, রহুর হাড় তোলা থাকে তাকে, লাগ ভেল্কি লাগ মন্তরগুলো ফুসমন্তর হয়ে যায়।
কিন্তু হায়, প্রতারণা যার রক্তে ছিলো, সে যে বরাবরের মতো এবারও প্রতারিত সমাজের হাতে। যে-সমাজের বঞ্চনার, অবমানননার মুখে পদাঘাত করে নিজের সমাজ গড়ে তুলেছিলো তারা, বাজিকরের ওপর সেই বকেয়া প্রতিশোধ সমাজ বুঝি নিয়েই ছাড়ে এবার। সমাজের র্যাংক এন্ড ফাইলে তাদের নামই থাকে না এরপরও। "সেই একই নিরন্ন হাঘরে সমাজ বহির্ভূত অসহায় বাজিকর।"
ছিটকে যায় শুধু শারিবা। প্রশ্নকর্তা যে-শাকিবার সাথে চিনপরিচয় হতে হতে খোলে উপন্যাসের সদরদরজা, সেই শাকিবা হিন্দুও হয় না, মুসলিমও বনে না। সে বাজিকরই থাকে, কিন্তু স্রেফ ধর্মত। তার ভেতরেই বসত করে বুঝি রহু-দনু-পীতম-জামিরেরা। কিন্তু, বাস্তববাদী সে। পথে পথে বোহেমীয় ধূলিধূসরতা তার মধ্যে রোমান্টিকতার জন্ম দেয় না। কাজ জোটায় সে গ্যারেজে। দেখে ঘর-বাঁধার আর সন্তানের চিরাচরিত স্বার্থপর জিনাবলম্বী স্বপ্ন। কিন্তু, পাশাপাশি তার ভেতরমনে উঁকি দিয়ে যায় অপরাধক্ষালনের মানবীয় খোঁচা। যে-বন্ধুকে সে বাঁচাতে পারে নি, তারই বিধবাকে ও অসহায় সন্তানকে বুকে তুলে নিতে চায় আত্মশরণ হয়ে।
লেখক বাজিকরদের নিঃশেষ করে দেন বাস্তবতার ট্রাক্টরের তলায়। জাতহীনেরা জাত পায়, কিন্তু তাদের আদি পরিচয় মুছে যায় আস্তে আস্তে নতুন দিনের সূর্যের তলায়। কী হবে শেষাবধি তাদের? প্রশ্নের উত্তর অনুচ্চারিত কিন্তু বোধগম্য রেখে লেখক বোধহয় পরের বইয়ের জন্যে কলম ধরেন তাঁর বিপুল শ্রমসাধ্য সৃষ্টিটি নীরবে সফল করে।
অক্ষম এক বিষাদে লীন হয়ে আমিও মুড়ে দেই বইয়ের মেলা ডানাদুটো। সবার ভেতরেই উদাসী এক ঘরছাড়া যাযাবর ডাকে, কেউ শোনে, কেউ শোনে না। আমি হাজারবারের মতো আরো একবার বইয়ে খুঁজি আমার ফেলে-আসা পুনর্জন্মের চিহ্ন, ঘ্রাণ নেই মন-কেমন-করার আশায়। আবারো না-পাওয়ার স্মৃতিটা মিলে যায়, ইকথিয়ান্ডারের খ্যাপা বুড়ো বাপ বালথাজারের মতো পরশপাথর হারানোর দুঃখে আকুল বিষাদসিন্ধুর পাড়ে আমার অসহায় মনটা আছড়ে পড়ে, কিন্তু সমুদ্র কোন রহস্য উন্মোচন করে না।
গলাবন্ধ আবেগ নিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছি, এ কী পড়লাম। না পড়া ছিলাম ভালো ছিল। আবার ভাবছি, রহু চণ্ডালের হাড় না পড়ে পড়ার পাট সাঙ্গ করি নাই, প্রকৃতিকে ধন্যবাদ।
কোনো লেখকের ম্যাগনাম ওপাস না, মনে হয় বাংলা সাহিত্যের দুটো ম্যাগনাম ওপাস; এক, ঢোঁড়াই চরিত মানস, আর এক, রহু চণ্ডালের হাড়।
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক, চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর, মানুষ বেকুব চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷ - সৈয়দ শামসুল হক
যাযাবর জনগোষ্ঠীকে নিয়ে লেখাজোখা তেমন একটা নেই। এই জনগোষ্ঠী সামাজিকভাবে যেমন অবহেলিত, তেমনি সাহিত্যাঙ্গনেও উপস্থিতি কম। অভিজিৎ সেনের 'রহু চণ্ডালের হাড়' উপন্যাসটি যাযাবর জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে রচিত। তাদের জীবনযাপন, সামাজিক বিধিব্যবস্থা, প্রেম ইত্যাদি বিষয়গুলো উঠে এসেছে উপন্যাসটিতে।
আমাদের দেশে যাযাবর জনগোষ্ঠী হিসেবে যাদের দেখি সেই 'বেদে'র থেকে আলাদা একটা জাতি বাজিকর। তারা ভিক্ষাবৃত্তি করে, ভানুমতির খেলা দেখায়, বনের পশুকে পোষ মানায় আবার কখনো পুতুলনাচের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায় তারা। তাদের সম্প্রদায়ের অমোঘ নিয়মে কখনো স্থায়ী আবাস গড়ে তুলে না তারা। দনুর ছেলে পীতেম চেয়েছিল স্থায়ী হতে। ভূমিকম্পের পর ঘর্ঘরার উত্তর তীরে সরে গিয়ে বাসস্থান নির্বাচন করেছিল। কিন্তু স্থানীয় গোয়ালারা থাকতে দিল না তাদের। স্বপ্নে বাপ দনুকে দেখতে পায় পীতেম। দনুই পথ দেখায় তাদের। পুবের দেশে যাওয়ার নির্দেশ দেয় দনু। তারই নির্দেশ মোতাবেক পূর্ব দিকে যাত্রা শুরু করে তারা। রাজমহলে ছাউনি পড়ে বাজিকরদের। সেখানের দারোগার ছেলে পছন্দ করে বসে পীতেমের ছেলে ধন্দুর ঘোড়াকে। ধন্দু রাজি না হলেও দারোগার ছেলে বলে কথা! ঐ এলাকায় ব্যবসা পরিচালনা করতে হলে দারোগার সুনজরে থাকতে হবে বৈকি।
পরতাপ আর জিল্লু মুর্শিদাবাদের পথে তাদের মালামাল আনতে গেলে পথে সাঁওতাল যুবক ডুমকা সোরেনের সাথে পরিচয় হয়। ডুমকা সোরেন আহত অবস্থায় বাজিকরদের ছাউনিতে আসে এবং তাকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলে। যাওয়ার সময় বাজিকরদের নিমন্ত্রণের কথা বলে যায় এবং উৎসবের সময় পীতেম তার দলের কিছু বাজিকরদের নিয়ে সাঁওতাল এলাকায় বেড়াতে যায়। সেখানেই মহাজনদের সাথে ধান মাপামাপি নিয়ে ঝামেলা বাঁধায় বাজিকরেরা। বালি, পিয়ারবক্স, ধন্দু, পরতাপ ও জিল্লু এই পাঁচ বাজিকর সাঁওতালদের পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশ নেয় এবং বাজিকরদের সঙ্গ ছেড়ে গা ঢাকা দিতে বাধ্য হয়। বাজিকরদের সাথে সাঁওতালদের যোগসাজশ থাকায় ছাউনিতে এসে চোটপাট চালায় পুলিশ।
রাজমহল থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর আবার মালদা শহরের মহানন্দা নদীর তীরে বাজিকরেরা তাদের গৃহস্থালি শুরু করে। গা ঢাকা দেওয়া বাজিকরেরা ফেরত আসে। সেখান থেকেও সরে নিয়ে নতুন ভূমি জামিলাবাদে আবাস গড়তে হয়। পেছনে রেখে আসে অনেককে। জামিলাবাদেই ধন্দুর ছেলে জামিরের প্রেম হয় রাধার সাথে। অথচ ঐ এলাকার গুণ্ডা বলে খ্যাত দেদোন ঘোষ রাধাকে পছন্দ করতো। একদিন জামির ও রাধাকে একসাথে দেখতে পেয়ে জামিরের সাথে মারামারি শুরু করে দেয়। যুদ্ধে হেরে গিয়ে দেদোন পালিয়ে যায় এবং কিছুদিন পর দলবল নিয়ে বাজিকর বসতিতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং নির্যাতন করে নারীদের। কিন্তু বাজিকরেরা পুলিশের কাছে যেতে ভয় পায়। তাই ঘরগুলো আবার নতুন করে গড়ে উঠে। জামিরের ছেলে রূপা ও নাতি শারিবার প্রজন্মে এসে বাজিকরদের গল্পের সমাপ্তি টেনেছেন লেখক।
'রহু' আসলে কী? কোনো মানুষ নাকি দেবতা? যে কিনা বাজিকরদের পথ দেখায়। 'রহু' একটি বিশ্বাস। যে বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে বাজিকরদের জীবন চালিত হয়। তাদের মধ্যে কোনো ধর্ম বিশ্বাস নেই, নেই চিরাচরিত সামাজিক প্রথা। বহু বছর পূর্বে এক জোড়া যুবক যুবতী পালিয়ে বিয়ে করেছিল, দেবতার অভিশাপে তাদেরই বংশধরেরা যাযাবরের জীবনযাপন করতে বা��্য হয়। তারা হিন্দু নাকি মুসলমান এই প্রশ্ন উঠলেও সঠিক উত্তর তাদের জানা নেই। তারা রহুকে ভক্তি করে আসছে এবং বাজিকর গোত্র প্রধানের স্বপ্নাদেশের উপরই পরবর্তী পন্থা ঠিক করে নিয়েছে। স্থায়ী বসতির চিন্তা কখনো তাদের ছিল না। কিন্তু পীতেম যখন দলের সর্দারি পায় তখন সে বুঝতে পারে এই বিশ্বাসে বেশিদিন টিকে থাকা যাবেনা; যুগ পালটে যাচ্ছে। তাই সে বাপ দনুর স্বপ্নাদেশ মেনেই পথের দিশা ঠিক করে।
বাজিকরদের নিজস্ব কিছু রীতিনীতি রয়েছে। তারা নিজেদের গোত্রের মধ্যে বিয়ে করে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তাদের গোত্রের মেয়েরা পালিয়ে যায় অন্যদের সাথে কিংবা গোত্রেরা ছেলেরা বিয়ে করে আনে ভিন্ন জাতির মেয়েকে। এই ব্যাপারে খুব একটা উচ্চবাচ্য তারা করে না। স্বামী মারা গেলে খুব সহজেই নারীরা নতুন স্বামী বা উপপতি রাখে। সারাজীবন ধর্মের বাইরে থাকলেও একসময় তাদের টিকে থাকার জন্য ধর্মের ভেতরে আসতে হয়। তারা জমি পায়, ধর্ম পায় কিন্তু পুরনো বাজিকর পরিচয় থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। বাজিকরেরা নতুন পেশার মধ্যে মানিয়ে নিতে গিয়ে নানান ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যে পড়ে। রক্ত ঝড়াতে হয় তাদের। তবুও জীবনের একটাই আশা স্থায়ী আবাস গড়ে সকলের মধ্যে মিশে যাওয়া।
কয়েকটি প্রজন্মের গল্প বলা হয়েছে। প্রায় দেড়শো বছরের; ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে দেশভাগের পরবর্তী সময় পর্যন্ত। তবে গল্পগুলো আরো দীর্ঘায়িত হতে পারতো। এত এত চরিত্রের জন্য যথেষ্ট স্থান না পেলে চরিত্রগুলো ঠিকঠাক উঠে আসতে পারে না। একইসাথে ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটেছে যে একটি ঘটনার সাথে আরেকটা ঘটনার সামঞ্জস্য রেখে পাঠ করা কিছুটা জটিলতার সৃষ্টি করেছে। লেখকের বর্ননাভঙ্গি ও ভাষাশৈলিতে কিছু কিছু জায়গায় ঘাটতি থাকলেও তা ধর্তব্যের বাইরে রাখা যায়। যাযাবর জাতি কেন্দ্রিক উপন্যাস ও তাদের জীবনের উত্থান-পতনের সাক্ষী হতে চাইলে বইটি পড়তে পারেন। হ্যাপি রিডিং।
কে এই রহু? বাজিকরদের কাছে এই রহু'ই সব। না, গতানুগতিক আল্লাহ্, ভগবান বা যিশুর সাথে মিল নেই এই রহু'র। নেই কোন অলৌকিক গুণাবলি। তবুও, বাজিকরদের কাছে রহু'ই সব। বাজিকরদের না আছে জাতপাত, না আছে ধর্ম। না তারা হিন্দু, না মোসলমান, না খ্রিষ্টান। তারা কেবল বাজিকর। তারা শুয়োরও খায়, গরুও খায়।
রহু, মূলত একজন দলনেতা, বাজিকরদের পথপ্রদর্শক।
রহু'র ছিল নিজস্ব ভূমি। রহু তার মানুষ নিয়ে সেখানেই থাকতো। যেখানে জীবন ছিল নদীর মতো, নদীতে ছিল অফুরন্ত স্রোত, বনে অসংখ্য শিকার আর মাঠে অজস্র শস্য। মানুষ ছিল স্বাধীন, সুখী।
তারপর একদিন বহিরাগতরা প্রবেশ করতে শুরু করলো। কোণঠাঁসা হয়ে পড়লো রহু আর তার লোকজন। তারপর, বহিরাগতের আক্রমণে রহু আহত হয়ে সেই পবিত্র নদীর জলে ভেসে গেলে। রহুর সাথে গেল তার দলের এক অংশ, অপর অংশ রয়ে গেল সেই স্থানেই। কারণ, ইতোমধ্যে বহিরাগতদের ভ্রষ্ট্রাচার প্রবেশ করেছে তাদের ভেতর।
তখন রহু'র রক্তে রঞ্জিত সেই পবিত্র নদী প্রবল বন্যায় ফেঁপে উঠল। রক্তের নদী ধ্বংস করল বহিরাগতদের নগরী, দলত্যাগীদের ভূখণ্ড। কেবল, রহু'র অনুগামীরা তার দেহকে আশ্রয় করে ভেসে গেল।
অবশেষে বন্যার বেগ মন্দীভূত হল। তারা তীর খুঁজে পেল। আর পেল রহু'র দেহের কয়েকটা অস্থি।
রহু চণ্ডালের সেই হাড় কে অবলম্বল করে বাজিকরদের যাত্রা শুরু। এটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের দিকে অনন্ত যাত্রা। যেখানে বাজিকরের দল পাবে তাদের সেই হারানো জৌলুস। যেটা হবে তাদের নিজস্ব ভূমি।
তাদের এই হাজার বছরের যাত্রাপথের বিবরণই মূলত 'রহু চণ্ডালের হাড়' উপন্যাসের বিষয়বস্তু। সমাজের সাথে মিশতে চাওয়া, সমাজের অংশ হতে চাওয়া, প্রতিবন্ধকতা আর শোষণ, নিপীড়ন, দুর্দশা আর প্রায়শ্চিত্তের বিস্তারিত বিবরণ এই আখ্যান। সাথে আছে ভালবাসার গল্প, আছে প্রতিশোধের গল্প। একটুকরো স্থায়ী আবাস ভূমি প্রাপ্তির গল্প। আর, বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্প।
গল্পটা একদল বাজিকরের। যারা বানজারা নয়, নয় হিন্দু, মুসলিম বা খ্রিষ্টারন। তারা বাজিকর। এটাই তাদের পরিচয়।
নানা প্রতিবন্ধকতা আর অস্তিত্বের লড়াইয়েও রহু'কে বিস্মৃত না হওয়া প্রজন্মের পর প্রজন্মের গল্প। যে রহু'র গল্প দনু বলেছে পীতেমকে, পীতেম বলেছে পরতাপ জামির আর লুবিনিকে, জামির বলেছে রূপাকে, তারপর শারিবাকে। এভাবেই কয়েক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে আছে রহু চণ্ডাল। টিকে আছে বাজিকর।
'রহু চণ্ডালের হাড়' অভিজিৎ সেন এর প্রথম উপন্যাস। প্রথম উপন্যাসেই তিনি বাজিমাত করেন। বইটির ভাষা, বিষয়বস্তু, বিষয়বস্তুুর বিস্তৃতি সহ সার্বিক দিক বিবেচনা করলে সমগ্র বাংলাসাহিত্যে এই বইয়ের পাশে দাঁড়াতে পারে এমন দ্বিতীয় কোন বই নেই।
কিছু বইয়ের রেশ আজীবন থেকে যায়। এই বইটিও তেমন। এর রেশও আজীবন রয়ে যাবে। যখনি কোন বাজিকর, সাপুড়ে বা বেদে দেখবো, মনে পরবে অভিজিৎ সেনের 'রহু চণ্ডালের হাড়'। তাদের ভেতর খুঁজতে থাকবো পীতেম, সালমা, লুবিনি, পরতাপ, জামির, রূপা, ওমর, ইয়াসিন বা পলবি কে।
এই বইটি নিয়ে মন খুলে একটা প্রতিক্রিয়া লেখা সত্যিই কঠিন, অন্তত আজকের দিনে। তবুও কখনো অসম্ভব ভালো লাগার বইটার একটা পূর্ণাঙ্গ প্রতিক্রিয়া লেখার ইচ্ছে মনের কোণে লুকিয়ে রাখলাম। এই প্রথম কোন বই পড়ে সাথে সাথেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার ভাষা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।
একজনের প্রায় সমস্ত লেখা না পড়ে সামগ্রিকভাবে কিছু লিখতে ইচ্ছা করে না। তবে এটাও সত্যি যে সেটা করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাই তাৎক্ষনিক পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখে রাখাই ভালো। কালে কালে সেই অনুভূতির বিবর্তন দেখাটাও বেশ আকর্ষণীয়। তাই পাঠক বই পড়বে আর পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখবে; লেখকের লেখনীর বিশ্লেষণ করবে, যখন যেটা মনে হচ্ছে।
অভিজিত সেনের লেখা রহু চণ্ডালের হাড় শেষ করলাম আজকে। এক বাজিকর গোষ্ঠীর দেড়শ বছরব্যাপী ছয় পুরুষের জীবনের ধারাবাহিক নিপীড়নের অজানা কাহিনী। বোদল্যেয়র বলেছিলেন - কুৎসিতেরও সৌন্দর্য আছে। তাই বিশিষ্ঠ জনজাতির জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস হয়েও আসলে এটি এক সার্বজনীন উপন্যাস। এক চিরায়ত জীবনের উপলদ্ধি।
প্রচলিত দেশীয় সাহিত্যের একমুখী ঘটনা ও একক কেন্দ্রীয় চরিত্রের ধারণাকে ভেঙে এই উপন্যাসে লেখক তৈরি করেন বহু চরিত্রের একমুখী ডাইমেনশন। দনু, পীতেম, পরতাপ, জিল্লু, ইয়াছিন, জামির, শারিবারা যেন একটি পুরুষ চরিত্রে রূপ নেয়। সালমা, পেমা, ধার্য, পাখি, রাধা, লুবিনিরাও একটি নারী চরিত্রকে ইঙ্গিত করে। সমান্তরালে বদিউল শেখ, দয়ারাম ভকত, দেদন ঘোষ, আজুরা মণ্ডল, হানিফ চরিত্রগুলোও একক কোন চরিত্র না হয়ে বরং ধর্ম কিংবা গোষ্ঠীগত চারিত্রগুণ লাভ করেছে। যেটা কিনা এই বইয়ের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক!
শিল্পসফল উপন্যাস বিষয়ে রুশ দার্শনিক Mikhail Mikhailovich Bakhtin বলেন, '… in the novelist’s world generally nothing merely thing-like no mean matter, no object – there are only subjects. Therefore, there is no word-judgment, no word about an object, no second hand referential word – there is only the word as address, the word dialogica – my contacting another word, a word about a word address to a word.' Bakhtin’র এই শব্দগ��� উচ্চারণ ও এর মর্মার্থ আমার কাছে অনেকটা মন্তাজের মতো মনে হয়। সিনেমায় মন্তাজ বলতে যেমন একটি দৃশ্যের সাথে আরেকটি দৃশ্যের জোড়া লাগিয়ে তৃতীয় অর্থ নির্দেশ করা। তেমনি ভাবে শব্দের সঙ্গে শব্দ যুক্ত হয়ে উপন্যাসের গন্তব্যকে আবিষ্কার করা হয়েছে। রহু চণ্ডালের হাড় এ এর উদাহরণ ব্যাপক।
অবশেষে এক কথায় শেষ করতে গেলে বলা যায়, যে জীবন দেখিনি, তেমনই আরেকটা বই পড়া হয়ে গেল।
এত অনাসক্ত আর প্লেইন ভাষায় একদল মানুষের চরিত্র নির্মাণ কঠিন ব্যাপার। অভিজিৎ সেন জাদু দেখালেন। আর গল্পের কী টান। রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলা গেল। এরপরে আসা যাক বইটির নৃতাত্ত্বিক গুরত্বের ব্যাপারে। এ বই তুলে এনেছে প্রায় লুপ্ত বাজিকর নামের এক যাযাবর সম্প্রদ্বায়ের ভাসমান জীবনের গল্প, পৃথিবীর বুকে একদল হতভাগ্য মানুষের জায়গা করে নেবার সংগ্রাম।
সামনে কখনও বিস্তারিত লিখব এ বই নিয়ে।
ঔপন্যাসিকের যে আড়াল পাঠকের থেকে, তা হয়ত লেখক রাখতে পেরেছেন। বইটা এক কিংবদন্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে, লেখকের জীবদ্দশাতেই। এমন জটিল বিষয় নিয়ে লেখা সুখপাঠ্য উপন্যাস বাংলাসাহিত্যে বিরল।
[রহু চন্ডালের হাড়, অভিজিৎ সেন, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৫, বর্তমান প্রকাশক যে এন চক্রবর্তী এন্ড কোং, ২৫০/-, ২৭২ পাতা, বঙ্কিম পুরষ্কার ১৯৯২] -****★*******★*********★****-
বাউদিয়া-বাজিকরদের আসল দেশ কোথায় ছিল, তা আর কেউ সঠিক ভাবে জানে না, এমনকি স্মরণে নেই আর প্রবীন দলপতি পীতেমেরও। তার বাপ দনু স্বপ্নের ঘোরে এসে বলে যায় সে অজানা দেশের কথা, দলপতি রহু চন্ডালের কথা। “রহু তার মানুষ নিয়ে সেই ভূখন্ডে থাকত, যেখানে জীবন ছিল নদীর মতো, নদীতে ছিল অফুরন্ত স্রোত, বনে অসংখ্য শিকারের পশু এবং মাঠে অজস্র শস্য। মানুষ ছিল স্বাধীন, সুখী।“ কিন্তু সে সুখ স্থায়ী হল না। দখলদার এল একদিন, প্রথমে নদীর ভাগ চাইল, তারপর জমি আর পশুর দখল চাইল, আরও পরে চাইল নারীর বশ্যতা। রহু আর তার মানুষেরা এমন নিষ্ঠুর মানুষ আগে দেখেনি। অচিরেই রহু আর তার মানুষেরা সেই স্বেচ্ছাচারী মদমত্ত দখলদার আর তার সেনাদের দাসে পরিনত হল। আপন ভূমিতেই বাজিকরেরা পরিনত হল অচ্ছুৎ চন্ডালে! ক্রমে ক্রমে বহিরাগতদের ভ্রষ্টাচার প্রবেশ করল সেই প্রাচীন বাজিকরদের মধ্যেও । কিছু পরে রহু যখন নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হল, তখন স্বাভাবিক ভাবেই তার পথ আটকালো সেনারা। রহুকে আঘাত করে সেনারা ছুড়ে দিল পবিত্র নদীর জলে; রহুর অনুগামীরা রহুর দেহ ছুঁয়ে ভাসতে ভাসতে উঠে এল অন্য ভূখণ্ডে। রহু চন্ডালের অস্থি ক'খানি আশ্রয় করে বাজিকরেরা এরপর নামল পথে। তবে, রহু কোনো ঈশ্বর নয়, রহু কেবল বাজিকরদের এক ভরসা।
বাজিকরদের সে পথ চলা শেষ হয় না যেন! বৃদ্ধা লুবিনি তার নাতি শারিবাকে গল্প শোনায় তাদের চলমান বাজিকর জীবনের। লুবিনির নানাশ্বশুর পীতেম যখন বাজিকরদের দলপতি, তখন থেকে সে স্থিতি চেয়েছে বাজিকরদের জন্যে। এই পথে পথে সারা বছর ঘুরে বেড়ানো, জন্তু জানোয়ার নিয়ে বাজিকরের খেল দেখানো, এই 'ভিখ মাঙ্গা' এর থেকে মুক্তি চেয়েছিল পীতেম। আফিমের ঘোরে, পীতেম স্বপ্ন দেখত, তার বাপ দনু তাকে নির্দেশ দিচ্ছে যে, পূবদেশে যেতে, থিতু হতে। বলে, রহু তোমাদের সহায়, তোমরা যাও। গোরখপুর থেকে ডেহরিঘাট, সেখান থেকে সিওয়ান, ফের দানাপুর, পাটনা, মুঙ্গের। সেখান থেকে আরও পূবে আসে তারা। রাজমহল, মালদা, নমনকুড়ি, রাজশাহী, কত পথ হাটল বাজিকরেরা। গ্রামের বাইরে, নদীর ধারে, শহরের কিনারায় তাদের তাবু পড়ে। ডিগডিগ করে ঢোল বেজে ওঠে; বান্দর-ভালু নিয়ে খেল দেখায় বাজিকরেরা; অবসরে গাই-ঘোড়া-শুওর পালে, মেয়েরা মাদুলি-জড়ি-বুটি বেচে, তুকতাক করে, কিন্তু কিছুদিন বাদেই নানা ঝামেলায় জড়িয়ে আবার আবাস ওঠাতে হয় তাদের, আবার নামতে হয় পথে। স্থিতি আর জোটে না।
আসলে, থিতু হতে চাইলেই তো থিতু হওয়া যায় না। বাজিকরেরা খেল দেখানো আর জন্তু জানোয়ার পোষা ছাড়া আর কাজই বা কি জানে! চাষের কাজ, খেত-খামারির কাজ, কুলি কামিনের কাজ কিছুই তো তারা শেখেনি। তার উপরে বাজিকরদের কেউ বিশ্বাস করে না, বাজিকরদের নামে সদাই চুরি-চামারির অভিযোগ ওঠে। যেখানেই ডেরা পাতো, দারোগা আসবে, জমিদারের লোক আসে, তাদের উঠিয়ে দিতে চায়। পয়সা দিয়ে, কাকুতি মিনতি করে বাস রাখতে হয় বাজিকরদের। ভানুমতীর খেল দেখিয়ে, পুতুল নাচ দেখিয়ে, জানোয়ার পেলে পুষে, রসিক নাগরের কামনা তুষ্ট করে বাজিকরদের কুড়িয়ে বাড়িয়ে যা কিছু জোটে, তাই তাদের জীবনধারণের জন্যে সম্বল।
তবু থিতু হওয়ার চেষ্টা কি পীতেমরা করেনি? করেছে। রাজমহলে, নমনকুড়িতে, রাজশাহিতে পীতেম, পরতাপ, জামিররা থিতু হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। জমিদারের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে, পাথর খালাস করে, বন কেটে, আধা আধি চুক্তিতে চাষে নেমেছে তারা। সাঁওতাল হড় ওরাও দের সাথে মিলে নমনকুড়ির বাদা জমিকে আবাদ করেছে পরতাপ, ধান ফলিয়েছে প্রবল পরিশ্রম করে, কিন্তু ঘটনাচক্রে সেও থিতু হতে পারে না। জামির রাজশাহির পদ্মার চরে রামজান চাচার সাথে মিলে সোনালী তরমুজ ফলিয়েছিল পরিশ্রমে, বাবুদের দল এসে ডুবিয়ে দিল তরমুজের নৌকা। ফলে, দেখা গেলো থিতু হওয়া বড় সহজ নয়। তার উপরে বাজিকরের জাত নেই, ধর্ম নেই, এমনকি ঈশ্বর ও নেই। তাকে হিন্দু মুসলমান কেউই নিজের বলে মানে না। অচ্ছুৎ চাড়াল বাজিকরদের তাই অনবরত ধাক্কা খেয়ে, মার খেয়ে, অপমান সয়ে, প্রাণ হারিয়ে সেই পথেই ফিরতে হয় বারেবার। বাজিকরেরা কি সত্যিই পারবে একদিন থিতু হতে? পীতেমের স্বপ্ন কি সার্থক হবে কোনোদিন?
বাজিকরেরা থিতু হতে পারুক, বা না পারুক, তবু এই পথ চলার মাঝেই তাদের জীবনে জন্ম আসে, ভালবাসা আসে, বিচ্ছেদ হয়। লাঠালাঠি খুনোখুনিতে মৃত্যু হয় অনেকের; সাপকাটি হয়, ভূখমারি হয়; বন্যায় ভেসে যায় জীবন। প্রায় নিয়ম করেই মহাজন জমিদার জোতদার দারোগার লুব্ধ নজর এসে পড়ে তাদের মেয়েদের উপরে; বাজিকর মেয়ে যেতে রাজি হলে ভালো, নয় তুলে নিয়ে যেতে কতক্ষণ! বাজিকরের মেয়ে পেমা ভেবেছিল বাবুর রাখেল হয়ে সারাজীবন সুখে কাটবে, কিন্তু বাবুর নেশা কাটতেই পেমার সুখ অস্ত গেল; সালমা ভাবে মুসলমান জমিদারের কাছে থেকে, টুকটাক সুদের ব্যবসা করে বুঝি সে বাজিকরদের থেকে আলাদা হতে পেরেছে, কিন্তু সময় এলে সেও দেখে তার বাজিকর পরিচয় কিছুতেই মোছার নয়। বাজিকর এর মেয়ের সাথে আশনাই করা যায়, কিন্তু তাকে ঘরে তোলা যায় না। তেমনি, বাজিকরের ছেলের সাথে কোনো মেয়ের পীরিত হলেও উচু জাতের সম্পন্ন সমাজ তা মেনে নেবে কেন? তাই সোজন কে ভালবেসেও পাখিকে ফিরে আসতে হয়, জামিরের সাথে রাধার প্রণয় দেখে ঘোষেরা দাঙ্গা লাগিয়ে পোড়ায় বাজিকরদের ঘরদোর। মালতীকে বিয়ে করে ওমরকে প্রান দিতে হয় সমাজের মাতব্বরদের হাতে। বাজিকরেরাও শোধ নিতে চায়, মারপিট হয়, কাটাকাটি হয়, প্রাণ যায়, নিয়ম করে ধর্ষিতা হয় মেয়েরা। কিন্তু বাজিকরেরা কি জিততে পারে? কে হবে তাদের সহায়? হিন্দু, না মুসলমান, কোনো সমাজেই কি বাজিকরের জন্যে জায়গা নেই?
রহু চন্ডালের হাড়, এই উপন্যাসের সময়কাল যদিও দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু আগে থেকে স্বাধীনতার কিছু পরের সময় পর্যন্ত, কিন্তু আসলে তা প্রান্তিক মানুষের চিরকালের কাহিনী। প্রবাদ পুরুষ রহু থেকে শুরু করে পীতেম, বালি, পরতাপ, জামির, শারিবা, কয়েক পুরুষের পথ চলার কাহিনী ধরা পড়েছে এই আখ্যানসম উপন্যাসে। বাজকরদের নিজেস্ব জীবন কাহিনীর সাথে জড়িয়ে গেছে সাধাসিধা সাঁওতালদের কাহিনি। একদিকে ব্রিটিশরাজ, আর অন্যদিকে পতাকী সাউ এর মতো সুদখোর দুর্নীতি প্রবণ মহাজনদের অত্যাচারে সাঁওতালদের জমিজিরাত চাষবাস ছেড়ে কুলির কাজে নাম লেখাতে হয়েছে। প্রাণ গেছে অজস্র, রক্ত বয়েছে অঝোর ধারায়। বাজিকরদের পাশাপাশি এমনি করেই ধরা পড়েছে গরীব চাষি, কুলি, শ্রমিকের জীবনের অংশবিশেষ। অভিজিৎ সেনের এই উপন্যাস যথাযথ ইতিহাস মেনে লেখা কিনা জানা নেই, কিন্তু উপন্যাসের ধারা নিশ্চিত ভাবে প্রান্তিক মানুষের জীবনের ইতিহাসের একটা দিকদিশা তুলে ধরেছে। বাজিকর সহ অন্যান্য যত নিম্নবর্গের মানুষ আছে, দরিদ্র, নিরক্ষর দলিত আদিবাসী সংখ্যালঘু মানুষের সাথে এদেশের ক্ষমতাশীল শাসক, দারোগা, ঘুষখোর মহাজন, জমিদার, তাদের নায়েবরা, সমাজের বিভিন্ন স্তরের ক্ষমতাশালীরা যে ভাবে প্রতিনিয়ত অবিচার করে এসেছে, যে ভাবে তুমুল শোষণ আর অত্যাচার করে এসেছে, এই উপন্যাসে তার কিছু রূপরেখা পাওয়া যাবে। তারাশঙ্করের 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা'র করালীর মতো, এই উপন্যাসের শেষেও বাজিকরের ছেলে শারিবা স্বাধীন কিন্তু দারিদ্র্য এবং অত্যাচারিত বাজিকরের জীবন ছেড়ে, পেটের দায়ে, জীবনে স্থিতি পেতে শ্রমিক হওয়ার পথে এগোয়। দুই চরিত্রের এই মিলটুকু নেহাত কাকতালীয় নয়, এ ইতিহাসের এক সুনির্দিষ্ট ধারার নির্দেশক ।
অভিজিৎ সেনের 'রহু চন্ডালের হাড় ' উপন্যাসটি সার্থক ভাবেই প্রান্তিক মানুষের উপাখ্যান। বাঙালির ইতিহাস যে কেবল টোলে বিদ্যাচর্চার মতো বৌদ্ধিক পরিসরে আবদ্ধ ছিল না, বরং উচ্চ বর্গের ক্ষমতাশালী বাঙালি যে জাত বর্ণ ছুৎ-অচ্ছুৎ মেনে ধারাবাহিক ভাবে নিম্নবর্গের মানুষের উপর অত্যাচার চালিয়ে এসেছে, তার বিবিধ উদাহরণের মধ্যে এই উপন্যাসও একটি। 'অরণ্যের অধিকার', 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা', 'গঙ্গা', 'পদ্মা নদীর মাঝি', 'ধনপতির চর', 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'তিস্তা পারের বৃত্তান্ত', এমনতর যেসব উপন্যাস আছে, যা প্রান্তিক মানুষের, নিম্নবর্গের জীবনকাহিনী তুলে ধরে, সেই তালিকায় রহু চন্ডালের হা্ড় একটি উজ্জ্বল সংযোজন হওয়ার দাবী রাখে।
পাঁচ তারা না, যদি এক লক্ষ সহস্র কোটি তারা দেওয়া যেত তাহলে একটু শান্তি পাইতাম।
প্রতিটা উপন্যাসের স্বতন্ত্রতা থাকে তার ভাষায়, গল্পে না। কত সুন্দর ভাবে বাক্য গঠন করছেন, কত সুন্দর শব্দ চয়ন করছেন, কত সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন এই সবগুলোর গুনে একটি সাধারণ গল্পের রচনা ও অসাধারণ হয়ে ওঠে। অন্তত আমি সেটা মনে করি। এবং উপরের জিনিসগুলোর সাথে যদি গল্পটাও স্বতন্ত্র হয় তাহলে তো পুরো মাখন। এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে লেখক এসবগুলো জিনিসের সাথে যে সুবিচার করেছেন তা বলাই বাহুল্য। প্রথমে আসি ভাষা বর্ণনা ভঙ্গিতে। পুরো উপন্যাসটা যে ধরনের ভাষা প্রয়োগ করে লিখা হয়েছে বা যে ধরনের বর্ণনা ভঙ্গি দেয়া হয়েছে সেটা আর দশটা উপন্যাস থেকে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। সে ভিন্নতাটা আমি বোঝাতে পারবো না। পড়তে পড়তে ঠিকই বুঝতে পারবেন। এবং এই ভিন্নতার কারণে শুরুতে পড়তে একটু অসুবিধা হচ্ছিল কিন্তু লেখকের লেখনীর মোহ চুম্বকের মতো। তারপর সে কাহিনী এবং চরিত্র বিন্যাস। এক কথায় দুর্দান্ত। প্রতিটা চরিত্র যেন চোখের সামনে দুলছে কথা বলছে। পীতেম, সালমা, পেমা, পরতাপ, জামির, লুবিনি, শারিবা, পলবি আরও কত চরিত্র। যেন কতটা আপন। তাদের দুঃখ কষ্ট হতাশা সব আপনি ফিল করতে পারবেন। এতটাই ক্ষুরধার লেখনি। কষ্ট একটাই কেন উপন্যাসটি ২৭২ পৃষ্ঠার। কেন ৫০০ পৃষ্ঠার নয়।
বিগামাই, কালীমাই, ওলামাই। পথে কুড়িয়ে পাওয়া দেব-দেবতারদের নাম। সেই যে বাজিকরেরা গুজরাটের কোন এক অচিহ্নিত স্থান থেকে গোরখপুর, মুঙ্গের, রাজমহল, মালদা, নমনকুঁড়ি, পাঁচবিবি পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে যাযাবর জীবন কাটিয়েছে এই দীর্ঘ পথেই কুড়িয়ে নিয়েছে আরাধ্যদের।
শ্রুতি আছে তাদের যাত্রার প্রথম পথ দেখিয়েছিল রহু। না সে ঈশ্বর, না সে দেবতা, না সে গুরু। সে হয়তো কোন পূর্বপুরুষ কিংবা কিংবদন্তি। টোটেম থেকে দেবতার বিবর্তনের পথটুকুর মাঝে অক্লান্ত হেঁটে চলা রহু যেন একজন উপলৌকিক সত্ত্বা।
গোরখপুরের ভূমিকম্পের পরে রাজমহলে পীতেম বাজিকর থিতু হবার স্বপ্ন দেখলো। হ'লো না। সেই স্বপ্ন রক্তে বয়ে নিয়ে গেল বালি, জামির, ইয়াসিন, শারিবা। কিন্তু একটু ভূমির প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে বাজিকররা প্রতিবার পেলো প্রতারণা, হত্যা, আগুনে ভস্মীভূত ঘর, ধর্ষণ, গণধর্ষণ। অত:পর যাযাবরের দীর্ঘপথ।
বাজিকর না হিন্দু না মুসলমান। ওরা গরুও খায়, শূকরও খায়। ওরা ভানুমতীর খেল দেখিয়ে, মিথ্যে যৌনবর্ধকের শেকড় বেঁচে, শূণ্যে সরু দঁড়িতে হেঁটে পয়সা লোটে। এই ওদের নিয়তি। এসবের বাইরে ওরা চাষী হ'লে ওদের ফসল মহাজন আত্মসাৎ করে। ওরা হিন্দু হ'তে চাইলে সমাজ বলে ওদের জাত নেই। ওরা মুসলিম হ'লেও সমাজ ওদের সীমা রাখে মসজিদ অবধি। আচার অবধি। সমাজের জাতের মেয়ে আনতে গেলে ওদের অপমানিত হ'তে হয়। খুন হয়ে বেওয়ারিশ লাশ হ'তে হয়।
শারিবা জানে, সমাজ ওদের কখনো জাতে নেবে না৷ ওরা বিষহরির মন্ত্র পড়ে কখনো হিন্দু হ'তে পারবে না, না পারবে হ'তে কালেমা পড়ে সামাজিক মুসলমান। তাই যখন সরকারি বাসের ক্লিনারের চাকুরীর দরখাস্তে ধর্মের নাম লিখতে হয়, শারিবা লেখে বাজিকর।
অভিজিৎ লিখেছেন, রহু চণ্ডালের হাড়। প্রচলিত সংজ্ঞায়িত সমাজের বাইরে যে মানুষেরা বেঁচে থাকে, পথে রাস্তায় যারা বাক্সে সাপ এনে ভয় দেখিয়ে টাকা চায় তাদের ব্যাপারে কখনো আগ্রহী হয়ে থাকেন পড়তে পারেন। অদ্ভুত এই জগতে নিয়ে যাবে লেখক আপনাকে। ছোটবেলায় বিটিভির চলচ্চিত্রে রূপসী বেদেকন্যার প্রেমে পড়া জমিদার তনয়ের ফ্যান্টাসির বাস্তব রূপ হ'লো এই রহু চণ্ডালের হাড়। সমষ্টিগত নির্মিমতার এক প্রাচীন সত্য।
একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী তবে তাদের নাই নির্দিষ্ট কোন ধর্ম ও ভাষা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। এরা বাজিকর সম্প্রদায়ের। মূলত এরা যাযাবর জাতি। নিজেদের কিছু রীতিনীতি আছে যা পালনে তারা যথেষ্ট কঠোর। তবে যে এলাকাতে তারা যায় সেখানের ভাষা ও রীতিনীতি অনেকটা নিজের করে নেয়।
তাদের নির্দিষ্ট কোন পেশা নাই তবে ভিক্ষাবৃত্তি, পশুপালন, পুতুল নাচ, ভানমতির খেলা দেখিয়ে তারা জীবিকার্জন করে। তবে তারা কি চিরকাল এমনই যাযাবর ছিল? নিজস্ব ভূখণ্ড বলে তাদের কি কোন দেশ ছিল না?
পৌরাণিক উপাখ্যান অনুযায়ী-- হাজার বছর আগে, পুরা নামে এক যুবক একজন নর্তকী পালিকে (মতান্তরে বোন) ভালবেসে বিয়ে করায় দেবতার অভিশাপে তারা নিজের বসতি খুইয়ে দেশান্তরী হয় আর সেই অভিশাপ থেকেই বর্তমান বাজিকর সম্প্রদায়ের যাযাবর জীবন ।
চার প্রজন্মের বাজিকর সম্প্রদায়ের কাহিনি নিয়েই এই "রহু চণ্ডালের হাড়"। প্রথম প্রজন্মের দনু বাজিকর। দ্বিতীয় প্রজন্মে আছে তাঁর ছেলে পীতেম বাজিকর ও স্ত্রী ধুন্দুর মা। তৃতীয় প্রজন্মে আছে তাঁদের তিন ছেলে ধুন্দু ও তার স্ত্রী রোহীন, জামির ও তার স্ত্রী লুবিনি আর পরতাপ এবং শেষ প্রজন্মে আছে জামিরের ছেলে শারিবা।
বইটাতে আছে বাজিকর সম্প্রদায়ের জীবনচিত্র, নগরায়নেও সাথে তাল মিলিয়ে উন্নত না হওয়া যাযাবর বাজিকরদের দরিদ্র জীবনযাত্রা সাথে সাঁওতাল বিদ্রোহ, , এরই মাঝে আবার উঠে এসেছে দৈনন্দিন জীবনের প্রেম, ভালবাসা, প্রতিশোধ বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কও। যাবাবরদের জীবনে সভ্যতার শিখরে থাকা উচ্চসমাজের অবহেলা ও নিপীড়ন ও দারুণ এক বহিঃপ্রকাশ।
বহু বছর আগে রহু ও বাজিকররা পশ্চিমের এক ভূখন্ডে বাস করতো। তাদের জীবন ছিল সহজ সরল। তাদের বসতির কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে ছিল অফুরন্ত স্রোত, বনে অসংখ্য শিকারের পশু এবং মাঠে অজস্র শস্য। তারপর একদিন বহিরাগতরা এসে প্রথমে রহুর সেরা ঘোড়াটি নিয়ে গেল। কিছুদিন পর বহিরাগতরা আবার সদলবলে ফেরত আসে। নদীর তীরে তাদের দেবতার মন্দির নির্মাণ করে তারা দেশে ফেরত চলে যায়। ফেরার পথে তারা রহুর জনপদের উপর ইচ্ছেমতো অত্যাচার করে। তৃতীয়বার তারা আরো শক্তিশালী হয়ে আসে, তখন তাদের সাথে ছিল পুরোহিতরা। তারা সেই মন্দিরে তাদের দেবতার পূজা করা শুরু করলো। তারা রহুর জাতিকে নদীর পবিত্র জল ব্যবহারে বাঁধা দিল। অবশেষে রহু এক সময় বুঝতে পারলো বহিরাগতদের অপসংস্কৃতি তার নিজ গোষ্ঠীতে অনুপ্রবেশ করেছে। রহু তার লোকজনকে ডেকে বলে, তার জাতিকে সে আর রক্ষা করতে পারবে না। তাদের অধঃপতন ঠেকাতে এই এলাকা থেকে সরে যেতে হবে। রহু বলেছিল, যারা তাকে অনুসরণ করবে তারা একদিন আবার পূর্ণ সমৃদ্ধি খুঁজে পাবে। রহুর অনুসারীরা তার পথ ধরে দেশান্তরী হয়। রহু তার হাড় দিয়েছিল বাজিকরদের। কালের বিবর্তনে তারা সেই হাড় হারিয়ে ফেলে। সেই হাড়ের খোঁজেই বংশ পরম্পরায় বাজিকর দনু, পিতেম, লুবিনি এবং সর্বশেষ শারিবার অভিযাত্রা চলতে থাকে। এই মহাযাত্রার শেষ কোথায়?
‘রহু চণ্ডালের হাড়’ সমাজের নিম্নবর্গের(সাব-অলটার্ন) মানুষের জীবন সংগ্রামের কাহিনি। লেখক অভিজিৎ সেন যাযাবর গোষ্ঠীর জীবনযাত্রার এক অদ্ভুত চিত্র-চরিত্র একেঁছেন এই উপন্যাসে। উপন্যাসের এই কাহিনি শুধু রাঢ়-বরেন্দ্র অঞ্চলের বাজিকরদের কাহিনি নয়, এই কাহিনি প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাসও বটে। পুরুষানুক্রমে এই উপন্যাসের চরিত্র দনু-পীতেম-ধন্দু-জামির-রূপা-শারিবার মধ্য দিয়ে যাযাবর গোষ্ঠীর অতীত-বর্তমানের কাহিনি বার বার ভিন্ন ভিন্ন চোখে ফিরে আসে আমাদের সামনে। আলোচনার জন্য উপন্যাসটিকে মোটাদাগে তিনটি অংশে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমে পৌরাণিক অংশ: রহুর কিংবদন্তি, ঐতিহাসিক অংশ: পুবের দেশের সন্ধান এবং তৃতীয়াংশ: বর্তমান।
★ ‘রহু চণ্ডালের হাড়ের’ পৌরাণিক অংশে আমরা দেখতে পাই, রহুর পৌরাণিক গল্পগাঁথা। বহিরাগত অপশক্তি রহুর জনগোষ্ঠীকে অত্যাচার করে,নিজেদের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে অপসংস্কৃতি ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু এখানে রহুর প্রতিবাদ কোনো কাজে আসে না। শক্তিধর বহিরাগতদের কাছে রহুর অসহায়ত্বের সূচনার সাথে সাথে বাজিকররা তাদের নিজ ভূমিতেই নিম্নবর্গের মানুষে পরিণত হয়। বহিরাগত শক্তির এই উপনিবেশায়নের(colonization) স্বীকার হয়ে বাজিকররা হয় ভূমিহীন, দেশছাড়া। বাজিকররা বাপদাদাদের মুখে শোনা কিংবদন্তি রহুর হাড় খুঁজতে শুরু করে। খুঁজতে থাকে নিজেদের জন্য নতুন বাসস্থান, নতুন দেশ। বাজিকররা জানে রহুর হাড় ঐন্দ্রজালিক, বুজরুকি। তবুও রহু নামের পৌরাণিক চরিত্রের দেখানো স্বপ্ন নিয়ে বাজিকররা বেঁচে থাকার প্রেরণা পায়। রহুর হাড়ের সন্ধানে তারা কোনো দেশ-কালে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। পীতেম তার বাপ দনুর নির্দেশে এই অভিযাত্রা শুরু করে, শেষ হয় প্রায় একশ বছরের পরিক্রমায় শারিবার মধ্য দিয়ে। সব বাজিকর নিজের বুদ্ধিবিবেচনা মতো রহুর হাড় খোঁজে। রহুর হাড় খুঁজতে গিয়ে পীতেম উপলব্ধি করে বাজিকরদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হতে পারে তাদের হারানো রহু চণ্ডালের হাড়। অন্যদিকে সর্বশেষ প্রজন্ম শারিবা বর্তমান সমাজে মিশে যেতে চায়। তার ধারনা হয় সমাজে তাদের গ্রহনযোগ্যতাই হয়তো রহুচণ্ডালের হাড়। এখান থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, বিচ্ছিন্ন বাজিকর গোষ্ঠী কেনো এত বছর পার হয়ে গেলেও রহুর হাড়ের সন্ধান পায়নি। তারা কখনো সমাজে থিতু হতে পারেনি বা চেষ্টা করেও বিফলে গেছে। তাদের সর্বশেষ প্রজন্ম শারিবার মধ্য দিয়ে তারা সেই স্থিতিশীলতা পায়, রূপক অর্থে যার নাম রহু চণ্ডালের হাড়। লেখক তার উপন্যাসে অত্যন্ত সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন বাজিকর গোষ্ঠীর লোকজ মিথ ও তাদের রীতিনীতিকে। বইটা পড়ার সময় আপনার মনে হবে এতো সেই অতিপরিচিত বেদে যাযাবরদের মতো মানুষজন, যারা সাপের খেলা দেখায় আমাদের দেশের পথেপ্রান্তরে।
উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায়, নানি লুবিনি কথক হয়ে উপন্যাসের সব গল্প বলতে থাকে বালক শারিবাকে। লুবিনির বয়ানে আমরাও শুনতে থাকি রহুর কিংবদন্তি। কাহিনি বলতে বলতে একসময় কিংবদন্তি ও বাজিকরদের অতীত ইতিহাস একসাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে। লুবিনি পুবের দেশের কথা শারিবাকে বলে। এক সময় এই পুবের দেশের কথা দনু বলেছিল তার ছেলে পীতেমকে। পীতেম বলেছিল পরতাপ, জামির ও লুবিনিকে। এভাবেই রহুর মিথ চক্রাকারে একই পরিবার, যাযাবর সমাজের মাঝে শতবর্ষব্যাপী ঘুরতে থাকে। এক সময় দেখা যায়, কালের বিবর্তনে রহুর মিথের সমান্তরালে আরেকটি নতুন মিথ ‘পুবের দেশ’ সৃষ্টি হয়েছে। এই দুটো মিথের সংযোগ করতে গিয়ে অভিজিৎ সেন জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ ঘটান__”এক চাঁদনী রাতে পীতেম তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এসে একেবারে হতবাক হয়ে যায়। এত কাল যে গাছটার নীচে বসে সে একান্তে কাটালো, সে গাছটা কই? গাছটা সেখানে নেই….সেখানে দাঁড়িয়ে আছে পীতেমের বাপ দনু। দনু বলে, ‘পীতেম হে, পীতেম, পুবের দেশে যাও,বাপ’।“
★ পুবের দেশের সন্ধানে অংশে, আমরা দেখতে পাই এক অপরিচিত দেশে বাজিকররা বসতি গড়েছে। ঘর্ঘরা নামের এক পবিত্র নদীর পাশে থাকতো বাজিগররা। প্রবল এক ভূমিকম্পে তাদের বসতি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। আর তার সাথে হারিয়ে যায় গোরখপুর বাজিগরদের সব বাড়িঘর। এই অবস্থায় পীতেম বাজিকর ঘুমের মধ্যে তার মরা বাপের নির্দেশ পেয়ে পুবের দেশের দিকে যাত্রা করে। গঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে রাজমহলে তাদের নতুন বসতি গড়ে উঠে। তারা রাজমহলে পাঁচ বিঘা জমির পত্তনি নেয়। কিন্তু পরে জানতে পারে এসবই ভুয়া। বাজিকরদের এখানে আরো সমস্যায় পড়তে হয়,যখন পীতেমের ছেলে ধন্দুর ঘোড়াটা নিতে চায় দারোগা। পাঠক খেয়াল করবেন, রহুর ঘোড়া ছিনিয়ে নেয়ার মতই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে এখানে (জাদুবাস্তবতায় একই ঘটনার বার বার পুনরাবৃত্তি ঘটার মতো)। একই সময়ে সাঁওতালদের সাথে বাজিকরদের ঘনিষ্ঠতার সূচনা হয়। বাজিকর যুবকদের একাংশ সাঁওতাল বিদ্রোহে যোগ দেয়। বিনিময়ে সাঁওতালরা বাজিকরদের স্থায়ী বসতির সন্ধান দিতে চায়। অন্যদিকে দেখা যায়, পীতেমের নাতি জামিরের সাথে লুবিনির বিয়ে হয়। জামির তরমুজের চাষ করে স্থায়ী আয়-ইনকামের চেষ্টা করে। তরমুজের বাম্পার ফলন ঘটার পর প্রতিপক্ষ সেই তরমুজ নষ্ট করে দেয়। জামির রক্তক্ষয়ী প্রত��শোধ নিলে যাযাবররা আবারো বিতাড়িত হয়। আবার তারা রহুর নির্দেশিত পথে চলতে শুরু করে। এই অংশের কাহিনি লক্ষ্য করলে খেয়াল করবেন, বাজিকররা এখানে বুঝতে পারে তারা আদতে দেশহীন, ধর্মহীন এক যাযাবরের জাত যাদের কোনো পরিচয় আমাদের আধুনিক সমাজে নাই। তাদের স্বপ্ন ঘুরতে থাকে রহুর মিথকে ঘিরে কারন রহুর কথা মতে পুরা দুনিয়াই তো বাজিকরদের। অথচ সেই দুনিয়ায় এক টুকরো জমিন পায় না বাজিকররা। তারা রহুর হাড়ের সন্ধানে তামাম দুনিয়া চষে বেড়ায়। তারা মুসলমানদের মতো নামাজ পড়ে না, হিন্দুদের মতো পূজা-আর্চনা করে না। অথচ তারা গরুও খায়, শূকরও খায়। দীর্ঘ একশো বছরে কেউ এসব নিয়ে অভিযোগ তোলেনি। যখন দেশভাগের সময় এলো তখনি ধর্ম, জাত-পাতের হিসাব এসে গেলো। দেশভাগের পর বাজিকরদের সামনে একটাই পথ খোলা থাকে, নতুন ধর্মীয় পরিচয় গ্রহণ করা। উপন্যাসের শেষে পাঠক বুঝতে পারবেন, রহুর দেখানো সেই ‘পুবের দেশ’ আদতে একফালি উর্বরা জমি ছাড়া আর কিছু নয়।
★ বর্তমান অংশে, দেখা যায় যাযাবররা বরেন্দ্র অঞ্চলে নতুন বসতি গড়েছে। এখানে দেখা যায়, জামির ও লুবিনির ছেলে রূপাকে দিনমজুরের কাজ করতে। জামিরের জেলহাজত ও রূপার অন্তর্ধানে যাযাবরদের অস্তিত্ব সংকট প্রকট হয়ে উঠে। এলাকার তসশিলদার হাজী সাহেব তাদের মুসলিম হবার প্রলোভনে স্থায়ী বাসস্থানের লোভ দেখায়। হাজী সাহেব তাদের পতিত জমি দেবে, বিনিময়ে মুসলমান হতে হবে বাজিকরদের। এই পরিচয়ে তারা নতুন জাত পাবে, নিজস্ব ধর্মীয় পরিচয়ে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এর মধ্য দিয়ে বাজিকরদের একশ বছরের পরিভ্রমণের সমাপ্তি ঘটবে। এক পর্যায়ে রূপা যখন ফেরত আসে, তার ছেলে শারিবা ততদিনে বড় হয়ে গেছে। শারিবা শহরে যায় গ্যারেজের কাজ করতে। শহরে পরিবেশে শারিবার মধ্যে আমূল পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বাজিকরদের নিজস্ব কিছু রীতিনীতি রয়েছে। তারা সাধারণত নিজেদের গোত্রের মধ্যে বিয়ে করে। এখানে দেখা যায়, শারিবা নমশূদ্র মেয়ে মালতীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। অন্যদিকে ড্রাইভার হানিফ বাজিকর মেয়ে পলবিকে বিয়ে করতে চায়। এই দুই ঘটনাই মূলত একই সূত্রে গাঁধা। এই বৈবাহিক বন্ধনের মাধ্যমেই বাজিকররা একই সাথে হিন্দু মালতী ও মুসলিম হানিফের সমাজে প্রবেশ করে। এই ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে বাজিকরদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটা বিষয় পাঠকের নজরে আসবে। তারা অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল, অন্যের দুঃখে সহমর্মিতা তাদের মজ্জাগত। আধুনিক সমাজে থিতু হবার সাথে সাথে তাদের পরিচয় তৈরি হয়, জাত-পাতহীনের সমস্যা মিটে গিয়ে বাজিকররা হিন্দু-মুসলিম দুইভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। তাদের নতুন ধর্মীয় পরিচয় সামাজিক স্বীকৃতি দিলে তাদের রহু চণ্ডালের হাড় অনুসন্ধানের সমাপ্তি ঘটে। বাজিকররা দেশ ও সমাজের স্থায়ী বাসিন্দা হবার স্বীকৃতি পায় কিন্তু হারিয়ে ফেলে তাদের শতশত বছরের লালন করা নিজস্ব পরিচয়। নিচু জাত হিসেবে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও আগের মতই থেকে যায়। রহুর বাজিকররা যেমন উপনিবেশায়নের স্বীকার হয়ে নিজস্ব ভূমি হারিয়েছিল, বর্তমানের বাজিকররা সেই একইভাবে বিউপনিবেশায়নের (Decolonization) এর ভিতর দিয়ে গিয়ে এক খন্ড ভূমি পাবার বিনিময়ে নিজেদের বাজিকর পরিচয় হারায়। এই উপন্যাস বাজিকর গোষ্ঠীর আত্ম-অনুসন্ধানের, নিজেদের সুলুক-সন্ধানের গল্প বলে। অভিজিৎ সেন দেখিয়েছেন কীভাবে আমাদের সমাজে নিম্নবর্গের মানুষেরা সব সময় অবহেলিত, বাস্তুভিটাহীন হয়ে জীবনের শেষ পর্যন্ত থিতু হবার চেষ্টায় থাকে। লেখক শুধু গল্প বলেননি, তার উপন্যাসের ভিতর দিয়ে আবহমান কালের সব প্রান্তিক মানুষের বিশাল এক ইতিহাস উপন্যাসের রূপ পেয়েছে।
এই উপন্যাসের চরিত্র তৈরি করতে গিয়ে অভিজিৎ সেন যেনো নতুন দেশ, নতুন এক বাস্তবতার সৃষ্টি করেছেন। এখানে বাস্তবতা যেনো জাদুর মতো অলৌকিক নয়, লৌকিক হয়ে সমাজের সাথে মিশে যায়। এই বাস্তবতায় কোনো প্রধান চরিত্র নেই, নারীপুরুষের ভেদাভেদ নেই। সব চরিত্রের পরিচয় একই, তারা বাজিকর। যখন দনু তার ছেলে পীতেমকে স্বপ্নে এসে রহুর পথে চলার নির্দেশ দেয়, তখন পীতেম তার বাপের আদেশ মেনে নিজেকে পরিণত করে শ্রেষ্ঠ বাজিকর নেতা হিসেবে। পীতেমের ভিতর প্রথমবারের মতো দেখা যায় আধুনিক চিন্তার একজন যাযাবর মানুষের পরিচয়। পুবের দেশের সন্ধানে এসে সাঁওতালদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি তার দুরদর্শিতার অপূর্ব নির্দশন। পীতেমের এই সফলতার পিছে সালমা নামের একজন নারীর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল। বাজিকর সালমা পীতেমের সৎবোন কিনা সেটা নিয়ে দুজনেরই মনে সন্দেহ থাকায় তারা বিয়ে করে না। কিন্তু দুজনের বোঝাপড়া, অবৈধ ভালবাসা তাদের সম্প্রদায়কে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বহুলাংশে সাহায্য করে। ধন্দুর ছেলে জামির হবার পর পীতেম বলে উঠেছিল,’রহু রহু’। পীতেমের এই পৌরাণিক বিশ্বাস বাস্তবের জামির ভিতর দিয়ে চিত্রায়িত করেন অভিজিৎ সেন। পীতেমের পর বাজিকর সমাজের সবচেয়ে যোগ্য নেতৃত্ব দেয় জামির। জামির পীতেমের অর্থনৈতিক মুক্তির চিন্তা বাস্তবে রূপ দেয়; ফসলি কাজ করে বাজিকরদের পুর্নবাসন প্রক্রিয়ার দিকে নিয়ে যেতে। লুবিনি চরিত্রটি মূলত এই উপন্যাসের কথক, লেখক অভিজিৎ সেনের কণ্ঠস্বর। শক্তিশালী কোনো চরিত্র নাহলেও লুবিনির জবানিতেই বাজিকরদের অতীত এবং বর্তমানের কাহিনি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। লুবিনির গল্পগুলো শারিবার জন্য নতুন দিগন্ত তৈরি করে দেয়। বাজিকরদের অতীত কাহিনি শুনতে শুনতে ঋদ্ধ শ্রোতা শারিবাই ছিল বাজিকর সম্প্রদায়ের সবচেয়ে উদার ও আধুনিক চিন্তার মানুষ। হিন্দু বা মুসলিম কোনো পরিচয়ে না গিয়ে সে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় ‘শারিবা বাজিকর’ নামে; কাগজে-কলমে, সমাজের প্রতিটা জায়গায়। এই উপন্যাসের চরিত্রগুলা এতটাই বাস্তব যে উপন্যাস পড়তে গিয়ে পাঠক নিজেই চরিত্রগুলোর ভিতর ঢুকে যাবেন।
উপন্যাসের শেষ পর্যায়, শারিবা বাজিকর সমাজ ছেড়ে নাগরিক জীবনে প্রবেশ করে রহুর দেখানো স্বপ্নের কাছাকাছি চলে আসে। শারিবার আমাদের সমাজে মিশে যাবার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে যাযাবরদের শতবর্ষব্যাপি অভিযাত্রা। অনিশ্চিত জীবন জেনেও রহুর দেখানো পথেই শারিবা আধুনিকতাকে মেনে নেয়, বাজিকর আত্মপরিচয়কে নিজের ভিতর সুপ্ত রেখে নাগরিক জীবনে নিজের অবস্থান তৈরি করে। এই সময় শারিবার কাছে শেষবারের মতো আসে রহু। রহু শারিবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কে?’ ‘আমি শারিবা।’ ‘শারিবা কে?’ ‘শারিবা বাজিকর।’ ‘তবে তো তোমার খুব দুঃখ।’ ‘হ্যাঁ, আমার বড় দুঃখ। আমার দুঃখের আসান নেই।’
'জামশেদ মুস্তফির হাড়' নামে সেবার একটা বই নাকি খুব বিখ্যাত। মাসুদ রানার কি? আমি ঠিক জানি না। পড়া হয় নাই। কিন্তু সে বইয়ের যেমন অনেক সুনাম শুনেছি, তেমন এই বইটারও অনেক শুনাম শুনলাম।
এভাবে কোন বই সম্পর্কে বলা উচিত না। শুরুতেই একটা নেগেটিভ ধারনা চলে আসে।
প্রচ্ছদে প্রাগৈতিহাসিক শিকার-শিকারির ছবি থাকলেও, গল্পের সময়কাল তত পুরাতন নয়। হবে হয়ত সতেরশ' আঠারো শ'। গল্পের মূল চরিত্র মূলত কিছু মানুষ। তারা বাজিকর। অর্থাৎ, আজকে আমরা সার্কাস বলে যাকে বুঝি। কিন্তু এরা শুধু সার্কাস পার্টি নয়। তার বেশি কিছু। একটা সঙ্ঘবদ্ধ দল যাদের কিছু বিশ্বাস আছে, কিছু নিয়ম আছে।
কিন্তু এই যাযাবর জাতির তেমন কোন বিধিবদ্ধ নিয়ম দেখা যায় না। তাদের নারীরা কখনও দল ছেড়ে চলে যায়। কখনও পুরুষেরা একাধিক নারীতে আসক্ত হয়। ধর্মবিশ্বাস তাদের ���েই, না তারা হিন্দু, না মুসলমান। গরুও খায়, শুয়োরও।
কিন্তু তারা হিন্দু, না মুসলিম, সে প্রশ্ন বহুদিন আসেনি। এসেছিল অনেক পরে। তখন ব্রিটিশেরা ভারত ছেড়ে যাবে যাবে সময়। একেক দিকে একেক রব উঠছে তখন। কিন্তু তাতে বাজিকরের কিছু আসা যাওয়ার কথা না। বাজিকরের জাত নিয়েও প্রশ্ন উঠত না। 'রহু চন্ডালের হাড়' তাদের রক্ষা করবে, এ বিশ্বাস নিয়েই কেটে যেতো কাল। কিন্তু তা হয়নি, কেননা বাজিকর পিতেমের বংশের কোন এক অধস্তন পুরুষ, জামির, থিতু হতে চেয়েছিল।
মাটির সাথে শেকড় গাড়া সহজ নয়। যাযাবরের জন্য তা আরও কঠিন। তাই হঠাৎ করে বসত জমানো যায় না। কেটে যায় বহুকাল। পাল্টে যায় বিশ্বাস, পাল্টে যায় মানুষ, পাল্টে যায় সময়।
কাল পরিক্রমা এবং মানুষের পরিবর্তনের গল্প হিসেবে ভালো। উপভোগ্য। মানুষের মুখে প্রাকৃত ভাষার ব্যবহার সার্থক। কিন্তু কেন যেন যাত্রা বেশ খাপছাড়া। মুখে কাঁকড় পড়ার মতো অনুভূতি হয়েছে বারবার। গল্পের বয়ান মোটেও মসৃণ লাগেনি। কোন চরিত্র বলিষ্ঠ হয়ে ফুটে ওঠে না। কোন সময়ই পুরোপুরি ধরা দেয় না এ উপন্যাসে। জানি না, এসব লেখকের ইচ্ছাকৃত কিনা। কিন্তু, আমার মনে হলো উপন্যাসের মাঝে মাঝে প্রচুর ফাকা জায়গা, যা ভরাট করলে আরও ভালো হওয়া সম্ভব ছিল।
রহু চন্ডালের হাড় লেখক - অভিজিৎ সেন প্রকাশক - জে এন চক্রবর্তী অ্যান্ড কোং মুদ্রিত মূল্য - ২৫০.০০ টাকা
এই বছরের ২২ নম্বর উপন্যাস অভিজিৎ সেন এর লেখা বঙ্কিম পুরস্কার প্রাপ্ত " রহু চন্ডালের হাড় " বইটির নুতুন সংস্করণ সুপ্রকাশ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হলেও আমার কাছের বইটি জে এন চক্রবর্তী থেকে প্রকাশিত ১৯৯২ সালের দ্বিতীয় সংস্করণ। বইটি পুরোনো হিসেবে আমি সংগ্রহ করেছিলাম। বইটি অনেকদিন ধরেই বইয়ের তাকে পড়েছিল, গুডরিডস এ দারুন রিভিউ আর বইয়ের গ্রুপে দারুন সব রিভিউ দেখে বইটি তুলে নিয়েছিলাম পড়ার জন্য। আসলে এই বছর ঠিক করেছি বাংলা ক্লাসিক উপন্যাসগুলো পড়ে ফেলবো সেই অনুযায়ী একটি বইয়ের লিস্ট তৈরি করে সেই অনুযায়ী বই সংগ্রহ করে পড়া শুরু করেছি। এই বইটিও সেই লিস্ট এর অন্তর্গত। বইটির নাম শুনে অনেক পাঠক ঘাবড়ে যেতে পারেন যে চন্ডাল হাড় আসল বইটি কি নিয়ে কোন তন্ত্র মন্ত্র সম্মন্ধে এই বই না, বইটি পুরাতন ভারতবর্ষের এক যাযাবর জাতি "বাজিকর" দের গল্প, তাদের জীবনচর্চার গল্প।
⭐ পটভূমি -
সব বাজিকর জানে ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ কথাটাই ঐন্দ্রজালিক ,বুজরুকি। তবুও সব বাজিকরই এখনো রহু চণ্ডালের হাড়ের স্বপ্ন দেখে মনে মনে ও বিশ্বাস করে তার সার্থক অস্তিত্ব সম্ভব। রহুর হাড় লুকিয়ে আছে কোনো এক ভূখন্ডের ফলপ্রসূ মৃত্তিকার গভীরে, যে স্থানটি বাজিকরকে খুঁজে বের করতে হবে। সেই স্থানটি খুজে বের করবার জন্যই বাজিকরের এই ভূ-পরিক্রমণ।... যাযাবর বাজিকররা আজো খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের বীজপুরুষ রহু চণ্ডালের হাড়। সে এক অপরিচিত দেশ। যেখানে ঘর্ঘরা নামে এক পবিত্র নদী বয়ে যায়। সেখানে নাকি কবে এক শনিবারের ভূমিকম্পে সব ধূলিসাৎ হয়েছিল । ঘর্ঘরার বিশাল এক তীরভূমি ভূ-ত্বকে বসে গিয়ে নদীগর্ভের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আর তাতে মিশে গিয়েছিল গোরখপুরের বাজিকরদের জীর্ণ বাড়িঘর। ধ্বংস হয়েছিল বাজিরদের প্রধান অবলম্বন অসংখ্য জানোয়ার। লুবিনি সেই পুবের দেশের কথা শারিবাকে বলে, যে পুবের দেশের কথা দনু পীতেমকে বলেছে, পীতেম বলেছে পরতাপ, জমির আর লুবিনিকে জামির বলেছে রূপাকে।... কিন্তু কোথায় যে সেই স্থির দেশটি ,যেখানে আছে বাজিকরের স্থিতিস্থায়িত্ব, সেকথা কেউই জানে না। প্রতিবারই মনে হয়েছে এই বুঝি সেই দেশ। প্রতিবারই কোনো না কোনো আঘাত, সে আঘাত মানুষের সৃষ্ট হোক কিংবা প্রকৃতির সৃষ্ট হোক, বাজিকরকে দিশাহারা করেছে ।.. এই যাযাবর বাজিকরদের স্থায়ী কোনো নিবাস নেই। কেবলই জায়গা বদলায়। তাদের বিশ্বাস তাদেরও একসময় এক দেশ ছিল। এ কাহিনী শুরু হয় লুবিনি নামের এক বাজিকর বৃদ্ধার কথার মধ্য দিয়ে। বারো বছরের নাতি শারিবাকে সে শোনায় এক অজ্ঞাত দেশের কথা, যা পূব দিকে অবস্থিত যদিও সে নিজেও দেখেনি। কিন্তু শুনেছে, নিজের নানাশ্বশুরের কাছে। একটা যাযাবর জাতি, তাদের না আছে কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম না আছে কোনো জাত অথবা সমাজ। তারা হাটে- বাজারে ভেলকি দেখিয়ে বেড়ায়, আর শহরের এক প্রান্তে অস্থায়ী তাবুতে দল বেঁধে থাকে। বাজিকর কী থিতু হতে চায়নি কখনও? চেয়েছিল। প্রায় দেড়শো বছর আগে পীতেম নামের মানুষটি স্থায়ী বসতি বসাতে চায়। কিন্তু, পারেনা। এরপর পাঁচ প্রজন্ম ধরে চলতে থাকে লড়াই।
⭐ পাঠ প্রতিক্রিয়া -
এ এক জীবনসংগ্রামের গল্প। পাঁচ প্রজন্ম এবং ১৫০ বছরের পথ চলার কাহিনীটি পড়তে গিয়ে পরিচয় হয় অনেক চরিত্রর সাথে। পীতেম-সালমা-পেমা-ধন্দু- পরতাপ-বালি-জামির-সোজন-ইয়াসিন-পলবি-রূপা। আরোও অনেকে ছড়িয়ে আছে এই কাহিনীর ছত্রে ছত্রে। আছে প্রেম, আছে অত্যাচার, আছে প্রতিশোধ। রাস্তার অনিশ্চিত জীবন ছেড়ে তারা চেয়েছিল গৃহস্থের জীবন। সাঁওতালদের কাছ থেকে চাষাবাদ শিখেও ভাগ্য তাদের জমিতে থিতু হতে দেয়না। ভাগ্যের খোঁজে রাজমহল থেকে মালদা, মালদা থেকে রাজসাহীতে এসেও তাদের আকাঙ্খা পূর্ণ হয় না। নানা প্রতিবন্ধকতার আর অস্তিত্বের লড়াইয়েও রহু কে বিস্মৃত না হওয়া প্রজন্মের পর প্রজন্মের গল্প। যে রহু র গল্প দনু বলেছে পীতেমকে, পীতেম বলেছে পরতাপ, জামির আর লুবিনীকে। জামির বলেছে রূপা কে, তারপর শারিবাকে। এইভাবেই কয়েক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে আছে রহু চন্ডাল। রহু!! আসলে কে তিনি? বাজিকর জাতির ঈশ্বর? না, তিনি ঈশ্বর নন। কিন্তু তিনিই সব। তিনি বাজিকরদের আদিপুরুষ। বিশ্বাস আর ভরসার আধার। রহু বলেছিল, " এ পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার সবই বাজিকরের। কিন্তু আসলে, বাজিকরের কিছুই নেই, রহু ছাড়া। " রহু চন্ডালের হাড় অভিজিৎ সেন এর প্রথম উপন্যাস, প্রথম উপন্যাসই তিনি বাজিমাত করেছেন। বইটির ভাষা, বিষয়বস্তু ও বিস্তৃতি এর দিক থেকে যেকোনো বাংলা অপরাজেয় সেরা সৃষ্টির থেকে কোনো অংশে কম যায়না। কিছু বইয়ের রেশ সারা জীবন থেকে যায়। এই বইয়ের রেশ সারা জীবন রিয়ে যাবে। যখনই কোন বেদে, বাজিকর বা সাপুড়ে দেখব মনে পরে যাবে পিতেম, সালমা, জামির, লুবিনি, পরতাপ, রূপা এদের কথা।
উপন্যাসটি একটি গভীর নৃতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক এবং সাহিত্যিক দলিল, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাজিকরদের বিস্মৃত ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক স্মৃতিকে পুনরুদ্ধারের প্রয়াস। লেখক এখানে ফোক-ইতিহাস (folk history) ও মৌখিক ঐতিহ্য’কে পাঠ্য ইতিহাসের বাইরে এক বিকল্প আখ্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা ইতিহাসের কেন্দ্রে নয়, প্রান্তে থাকা মানুষের আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন তোলে। ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ কেবল একটি প্রতীক নয়, এটি অপহৃত গৌরব, দমনকৃত সংস্কৃতি ও অস্বীকৃত অস্তিত্বের প্রতিধ্বনি, যার খোঁজ এক চিরন্তন অন্বেষণ।
শারিবা ও লুবিনির মতো চরিত্রগুলো উপন্যাসে যেন স্মৃতি ও ইতিহাসের মধ্যবর্তী সেতু, যাদের কণ্ঠস্বর ইতিহাসের অনুপস্থিত অধ্যায়ে আলো ফেলতে চায়। উপন্যাসটি ভাষার দিক থেকেও ব্যতিক্রম—লৌকিক, গ্রামীণ ও অনারম্ভর বর্ণনার মধ্য দিয়েও তাতে রয়েছে এক গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্য। এখানে জাতিসত্তা, সামাজিক ���্থানচ্যুতি ও সাংস্কৃতিক নির্মূলের ইঙ্গিত রয়েছে যা পোস্ট-কলোনিয়াল ও সাবঅল্টার্ন তত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণযোগ্য। লেখক যখন হারিয়ে যাওয়া "হাড়" খোঁজেন, তখন আসলে তিনি খুঁজছেন সেই পরিচয়, যেটি জাতি-রাষ্ট্রের সীমানায় স্থান পায় না, কিন্তু ইতিহাসের গহ্বরে একদিন বেঁচে ছিল। এইভাবে ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ বাংলা সাহিত্যে প্রতিরোধ ও পুনর্দখলের এক অনন্য ভাষ্য, যা আমাদের সমাজবোধ, স্মৃতিবোধ ও ইতিহাসবোধকে গভীরভাবে চ্যালেঞ্জ করে।
বইটা পড়ার পর কেমন ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। চেক করে দেখলাম বইটার সফটকপি ডাউনলোড করে রেখেছিলাম প্রায় দুই বছর আগে। তখন মনে হলো কেন এই অসাধারণ বইটি আমি পড়ি নি। কেন ফেলে রেখেছিলাম? কি এমন আহামরি বই আমি গিলেছি এই দুই বছরে। উত্তর নেই, কারণ বই জোগাড় যত আগ্রহ নিয়ে করা হয়, পড়ার সময় বের করাটা ততোটাই কঠিন। অভিজিৎ সেনের 'রহু চণ্ডালের হাড় ' উপন্যাসের মানুষগুলোর কথা ভাবা যাক। একটা কবিতার কথা মনে পড়লো। কবি এবং কবিতার নাম ভুলে গিয়েছি। দৃশ্যটা এরকম, একজন মানুষ জ্যোৎস্না রাতের নিস্তব্ধতার ভেতরে অরণ্যের গভীরে ঘুরতে নেমে তাজ্জব বনে যায়। আর ভেতরে জেগে ওঠে আদিম মানুষের স্মৃতি। যেন সে শিকারে বেরিয়েছে। যেন শিকারের খোঁজে এই মুহূর্তে সে হয়ে উঠেছে এক আদিম মানুষ। যে কোন সময়ে শিকার তার বাগে আসতে পারে, আবার উল্টোভাবে সে নিজেও হয়ে যেতে পারে কারও শিকার।
রহু। রহুর পরিচয় কি? যে বাজিকরদের নিয়ে এই উপন্যাস, সেই বাজিকরদের দেবতার নাম রহু? না, ঠিক তাও নয়।
" রহু ঈশ্বরের মতো সর্বশক্তিমান নয়। সে এক প্রাচীন দলপতি। সে এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নীতি নির্ধারণ করত তার জীবদ্দশায়। কিন্তু লুবিনি কিংবা কোনো বাজিকর তাকে ভগবান, আল্লা ইত্যাদির সমগোত্রীয় ভাবতে পারে না। এই অমোঘ শক্তিধরদের যে পরিচয় বৃহত্তর সমাজের কাছ থেকে সে পায়, রহুকে তার সমগোত্রীয় ভাবতে তার শুধু ভয় নয়, অনিচ্ছাও বটে। কাজেই তার বোধের মধ্যেও রহু বেঁচে থাকে এক মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী দলপতির মতো। তার উপরে সে দেবত্ব আরোপ করতে পারে না, কারণ দেবত্ব আরোপ করতে পারার সামাজিক স্থিতি তার নেই। সে সমাজচ্যুত। সে ভ্রাম্যমাণও। পথই তার যাবতীয় নীতিনির্ধারক। "
বৃদ্ধা লুবিনি তার নাতি শারিবার কাছে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে আগত রহুকে বর্ণনা করে এভাবে, "না শারিবা, রহু রহুই। সি হামারার মঙ্গল চায়। সি চায় বাজিকর সুখে থাকুক ;থিতু হোক সে। " সদা চলমান, জাত ধর্মহীন, পতিত বাজিকরদের মাঝে থিতু হওয়ার বাসনাকে একরকম স্থায়ী করে দিয়ে যায় জামির। এই বাসনা সে পেয়েছিল তার দাদা পীতেম বাজিকরের কাছ থেকে। কিন্তু সময় যেন এই সম্প্রদায়কে কোথাও থিতু হতে দেয় না। তারা সাঁওতালদের সাথে কখনো ভূমি দখলের লড়াইয়ে একাট্টা হয়ে লড়াই করে, কখনো চাষবাসের কাজে মন দেয়, বিল অঞ্চলের জল জমা ভূমিতে চাষের পদ্ধতিও শিখে আসে, কিন্তু ক্ষমতার লড়াইয়ে তাদের পূর্বের কোন সামাজিক বিবর্তন নেই বলে বারবার তারা ছিটিকে পড়ে মানুষের সমাজ থেকে। হারাতে থাকে কাছের মানুষদের। কেউ হারিয়ে যায়, কেউ মরে দাঙ্গায়, পালাতে গিয়ে কেউ মরে অপঘাতে। তবে সময়ের পরিক্রমায় তাদের এই লড়াইটাই যেন বাজিকরদের ভবিষ্যতের একটা ভিত তৈরি করে দেয়। মার তারা খায়, আবার কখনো কখনো সেই মারের শোধ নিতেও ভোলে না। তৈরি হয় অধিকতর শক্তিশালী এক বংশপরম্পরা, যা কিনা মাটিতে স্থায়ী আবাস স্থাপনের পূর্বসূত্র।
" যে রাত শেষ হয়ে কখনো সূর্যোদয় হয় না, যে রাতের অন্ধকার শুধু লবণাক্ত জলে ভাসিয়ে দিতে হয়, সেইরকম রাত পার করে দেয় এইসব মানুষ। "
একসময় আভাস আসে নতুন স্বপ্নের। আসে কিছু সফলতাও। কিন্তু রাজনীতিতে আসে পরিবর্তন। যে প্রশ্নকে বাজিকররা সিঁদূরে মেঘের মতো ভয় পায়, সে প্রশ্নই বিভিন্ন বিরূপ পরিস্থিতিতে ফিরে ফিরে আসে তাদের কাছে। তোমরা হিঁদু, না মুছলমান?
কিছুটা মাথা গোঁজার ঠাই, কিছু ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার পরেও বাজিকররা যেন তাদের রহুর মতোই নিঃসঙ্গ, জাতহীন। রহুর হাড় যেখানে পুঁতে রাখা হয়েছে, সেই জায়গাটা আজীবন খুঁজে বেড়ানোই যেন তাদের নিয়তি। সেখানেই যেন তাদের আদিম ভরসা, একমাত্র স্বস্তিদায়ক স্থান। তারা এবং তাদের দেবতা একই, চণ্ডাল।
এক অন্য রকম বই। বাজিকর নামক এক যাযাবর গোষ্ঠীর কয়েক প্রজন্মের এই গল্পে তারা বারবার প্রশ্নের সম্মুখীন হয় তারা কোন জাত? হিন্দু? মুসলমান? খ্রিষ্টান? বাজিকরদের কাছে এর কোনো উত্তর নেই। তারা শুধু জানে তারা বাজিকর। তারা গরু খায়, শুকর খায়। তাদের কিছু দেবীর নাম তারা জানে, সেগুলো কেমন বা কোন ধর্মের তা তারা জানে না। আর জানে তাদের আছে রহু চণ্ডাল অথবা তার গল্প।
তারা হিন্দু নয়, তাই হিন্দুদের সর্বনিম্ন জাতিগোষ্ঠীও তাদেরকে এড়িয়ে চলে। তারা মুসলমান নয়, তাই মিশতে পারে না মুসলমানদের সাথে। তারা বারবার পথ ছেড়ে থিতু হতে চায়, কিন্তু তাদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় ধর্ম। তাদের সবাই তাড়ায়, সবাই মারে। তাদের নারীদের ধর্ষণ করে, সাময়িক ভোগ করে। তারা এক জনপদে তাড়া খেয়ে আরেক জনপদে ছোটে, একটু স্থিতির আশায়। তাদেরকে খাটিয়ে নেয়ার জন্য কেউ সাময়িক আশ্রয় দেয় বটে, তবে তা স্থায়ী হয় না।
বাজিকরদের কাছে সবাই তাদের ধর্ম জানতে চায়, জানতে চায় তারা হিন্দু কি মুসলিম। মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয়টাই যেন ধর্ম। মানুষ যে মানুষ সেটাই আজ ভুলে গিয়েছে মানুষ। লেখক যেন আমাদেরকে এটাই বলতে চান।
বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটা ইউনিক বেশ। ভালো মুন্সিয়ানা দেখাইছে। বেশ ভালো রিয়ালিস্টিক। যেমন উপন্যাসে যে খুনগুলা হইতেছিল, লেখক এতো নর্মালভাবে ন্যারেট করে, প্রচন্ড রিয়ালিস্ট ছিল ব্যাপারগুলা।
এই উপন্যাস নিয়ে সবসময় যে বলে হয়, সে সমষ্টিকেই গুরত্ব দিছে খালি৷ আমার কাছে মনে হয় এখানে সমষ্টি-ব্যক্তির যৌথ সম্পর্ক আসছে বেশ ভালোভাবে৷ পীতেমেত ক্যারেক্টারের কথা বলা যায় এইক্ষেত্রে। সে একটা ওয়েল ডেভেলপড ক্যারেক্টার ছিল৷ কিন্তু পীতেমের মৃত্যুর পর উপন্যাসে ক্যারেক্টারগুলা আর সেভাবে দাড়ায় মাঝখানে। জামিরকে একটা পাপেটের মতো লাগে। মাঝ বরাবর গিয়ে উপন্যাসে রিপিটিশন বাড়ে, ক্লিশে বর্ণনা হইতে থাকে। যেমন ২-৪ পেইজের ব্যবধানে দুইটা খুন হয়। কিন্তু লেখক এই খুনগুলারে আলাদাভাবে কিছু দেখাইতে পারে না৷ একইরকম লাগে, রিপিটেশন। মাঝখান দিয়ে লেখক দ্বন্দের দিকে বেশি গুরত্ব দিতে গিয়ে ক্যারেক্টারগুলার ভয়েস, গতিবিধি,একশন একরৈখিক করে ফেলছে।
তবে শেষের দিকে আবার ভালো লাগতে থাকে। যাযাবরদের ধর্মীয় পরিবর্তন, আর আত্মপরিচয়ের অংশগুলা দারুন।
উপন্যাসটা শেষ হয় শারিবা আর মালতীর (বিয়া করবে ওরা) মিলের মধ্য দিয়ে৷ একটা স���ষ্টির কাহিনী দুইজন ব্যক্তির বিয়েজনিত ব্যাপার স্যাপারে শেষ করাটা কেন জানি কাজ করে নাই ভালোমতো মনে হইছে৷
তবে এই উপন্যাসের ভালো দিক হইলো, লেখক রিয়ালিস্ট হিসেবে ঘটনার চেয়ে, ঘটনার পরম্পরার গুরত্বটা বুঝছে।হয়তো সে সবখানে কাজে লাগাইতে পারে নাই এই বুঝটা। কিন্তু বোঝাপড়ার জায়গাটা টের পাওয়া যায়।
সে এক অপরিচিত দেশ। যেখানে ঘর্ঘরা নামে এক পবিত্র নদী বয়ে যায়। সেখানে নাকি কবে এক শনিবারের ভূমিকম্পে সব ধূলিসাৎ হয়েছিল। ঘর্ঘরার বিশাল এক তীরভূমি ভূ-ত্বকে বসে গিয়ে নদীগর্ভের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আর তাতে মিশে গিয়েছিল গোরখপুরের বাজিকরদের জীর্ণ বাড়ি-ঘর। ধ্বংস হয়েছিল বাজিকরদের প্রধান অবলম্বন অসংখ্য জানোয়ার।
সে এক কালো অন্ধকারের শনিবার, তারপর যাযাবর বাজিকরের দল ঘর্ঘরার উত্তর তীরে আরো উত্তরে সরে গিয়ে নতুন বসতি তৈরি করে। সে গ্রামটা ছিল গোয়ালাদের। নতুন করে ভাল্লুক বাঁদর সংগ্রহ করে, দূরবর্তী গ্রাম-শহরে গিয়ে গেরস্থ বাড়ি থেকে 'ভইস' চুরি করে আনে। আবার বছরের আট মাস দশ মাস দুনিয়া ঘুরে বেড়াবার নেশায় বেরিয়ে পড়ে তারা। কিন্তু সেখানাকার লোকরা এসে বলে, বাজিকর, হেথায় থাকা চলবে না। তাদের হাতে মোটাসোটা বাঁশের লাঠি। সেই লাঠি দিয়ে তারা খেপা ষাঁড় ঠাণ্ডা করে, জঙ্গলের জানোয়ার তাড়ায়। পীতেম বলে, বাজিকর তো স্থায়ী বসবাস করে না। দু-চার মাস থাকব, ফের উঠে যাব। তোমাদের জমি তো দখল হয়ে যাচ্ছে না। সে কথা কেউ শুনল না। তারা বাজিকরদের তিনদিনের মধ্যে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিল। পীতেম বলল, ঠিক আছে, যাব। সারা দুনিয়া বাজিকরের। জায়গার অভাব?
পীতেমকে স্বপনে তার বাপ দানু নির্দেশ দেয়, পীতেম হে, পীতেম, পুবের দেশে যাও, বাপ। সিথায় তুমার নসিব। লুবিনি সেই পুবের দেশের কথা শারিবাকে বলে, যে পুবের দেশের কথা দনু পীতেমকে বলেছে, পীতেম বলেছে পরতাপ, জামির আর লুবিনিকে, জামির বলেছে রূপাকে, আর এখন এই সমুদয় পুবের দেশের বৃত্তান্ত লুবিনি শোনায় শারিবাকে। কিন্তু কোথায় যে সেই স্থির দেশটি, যেখানে আছে বাজিকরের স্থিতিস্থায়িত্ব, সেকথা কেউই জানে না। প্রতিবারই মনে হয়েছে এই বুঝি সেই দেশ। প্রতিবারই কোনো না কোনো আঘাত, সে আঘাত মানুষের সৃষ্ট হোক কিংবা প্রকৃতির সৃষ্ট হোক; বাজিকরকে দিশাহারা করেছে।
প্রতিবারই তাদের একটা প্রশ্নে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তুরা হিঁদু না মোছলমান, অ্যাঁ? তোরা গরুও খাস, শুয়ারও খাস, ই কেম্কা জাত রে বাবা। বাজিকরের আপন কুনো ধর্ম নাই। কর্ম এ্যাকটা আছে বটে, তো সেটা হলো ভিখ-মাঙ্গার কাম। মুলুক মুলুক ঘুরে বান্দর নাচানো, ভাল্লুক নাচানো, পিঙ্গু-বুঢ়া পিলু-বুঢ়ির কাঠের পুতলা নাচানো, ভানুমতির খেলা, বাঁশবাজি, দড়িবাজি, নররাক্ষস হয়ে কাঁচা হাঁস, কাঁচা মুরগা কড়মড় করে খাওয়া, নাচনা গানা- এলা সব বাজিকরের কাম। এলা সব ভিখ-মাঙ্গার কাম।
ক্রমশ অভিজ্ঞতা এবং বহিঃসমাজ তাদের শেখাবে আরো অনেক কিছু। তারা জানবে বাজিকরের নিজস্ব সমাজ বলতে বিশেষ কিছু নেই, বিশ্বাস নেই, ধর্ম নেই, সাইতারণ, স্থান-কাল-পাত্র কাণ্ডজ্ঞান খুব কম। বাজিকর জানে হামবড়াই, কিন্তু মানুষের সমাজের প্রয়োজনীয় মৌলিক কাজ সে জানে না। সে আসলে ভীরু ও লোভী। তার নিয়তি দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও ক্ষয়রোগ। এই সমস্ত পৃথিবী তার, কিন্তু এমন কোনো জায়গা তার নেই যেখানে সে পা রেখে দু'দণ্ড দাঁড়াতে পারে।
একটা উপন্যাস পড়তে গেলেই আপনার কল্পনাটা কেমন হয়? নিশ্চয়ই সেখানে কারো না কারো জায়গাতে মনের অজান্তে নিজেকে ভাবতে শুরু করেন! কিন্তু পুরে উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই যদি প্রধান চরিত্রের ভূমিকায় চলে আসে তবে ব্যাপারটা কেমন হবে বলুন তো! কিংবা যে গল্পটা গড়ে উঠেছে অনেকগুলো প্রজন্মের বিবর্তন দিয়ে যেখানে প্রতিটা প্রজন্মের মানুষগুলোই এক একটা আস্ত জীবন উপন্যাস হয়ে উঠে তখন!!
রহু চণ্ডালের হাড় উপন্যাসটা ঠিক তেমনই বাজিকর, যাযাবর কিংবা বাদিয়া গোষ্ঠী যে নামেই তারা আপনার কাছে পরিচয় হোক না কেন এই গোষ্ঠীর কয়েকপ্রজন্মের জীবন নিয়েই এই উপন্যাস। যেখানে প্রতিটা প্রজন্মেই তারা রহু নামক তাদের এক আদিপুরুষের অমুক বাণীকে সঙ্গী করে ছুটে চলেছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, এক প্রান্তর থেকে অন্য প্রান্তে। আর স্বপ্ন দেখে একদিন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে, এই পৃথিবীর বুকের কোনো এক জায়গায় থিতু হবে তারা। সমাজ সাদরে গ্রহণ করবে, তোরা হিঁদু না মোসলমান? জাত কিইবা তোদের? বলে প্রশ্ন করে বসবে না।
এই গল্পের দনু যে স্বপ্ন দেখেছিলো সেই স্বপ্ন দেখেছে পীতম, দেখেছে জামির, ইয়াসির, শারিবা। কখনো কখনো সেই স্বপ্ন নদীর চলায় ভেসে উঠা চড়ে নমনকুড়ির মতো ফুটে উঠেছিলো, হয়েছিলো বাজিকররা কিছুদিনের জন্য সংসারী, গৃহস্তি। কিন্তু যাদের নসিবে রহু পথের ধূলো লিখে দিয়েছে তাদের কপালে কী সেই সুখ সয়!! কখনো প্রকৃতি কখনো বা সমাজের হিংসায় ভরপুর মানুষগুলোর করালগ্রাসে অচিরেই ভেঙে পড়েছে তাদের স্বপ্নের নমনকুড়ির গৃহস্থ বাড়ী। কখনো বা পাখিদের মতো জীবন নিয়েই শোধ করতে হয়েছে সমাজে স্থান করার প্রচেষ্টার ফল। তবুও প্রজন্ম ধরে তারা যুদ্ধ করে গেছে, হতাশ হওয়ার পরও আবারও নেমেছে নতুন উদ্যোমে। এ যেন কেউ একজন এক জীবন চক্রের মধ্যে ফাঁসিয়ে দিয়েছে তাদের। যেখানে কখনও সুখ নেমে আসে তো কখনও হঠাৎ ঝড় উঠে ধ্বংস করে দেয় সব।
এই গল্পের গল্পটা যেমন হৃদয়ছোয়া, হৃদয়বিদারক ঠিক তেমনই লেখকের এই গল্পের শব্দের জাল বুননের জাদুও বিস্ময়কর। বাদিয়া গোষ্ঠীকে যেন তাদের ভাষায় তাদের সংস্কৃতিকে তাদেরই নিয়মে শব্দবন্দি করা হয়েছে। প্রতিটি শব্দের ব্যবহারে লেখকের ক্ষুরধার মস্তিষ্কের পরিশ্রমের ফল ফুটে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেমন ছোটোগল্প গুলো 'শেষ হইয়েও হইলো না শেষ' অনূভুতি দিয়ে যেত, এই উপন্যাসটা শেষ করেও ঠিক তেমনই এক অনূভুতি দিয়ে যাবে। তবুও এই গল্পের পরিণতির জায়গা পড়ার পর মনে হবে, না কিছু গল্পের শেষ থাকতে নেই। কিছু গল্পের শেষটা না জানাটাই বরং ভালো। জীবনের উপন্যাসের কী আর শেষ জানা যায়!
একদিকে পুরো একটা যাযাবর কিংবা বাজিকর সম্প্রদায়ের এই দিনদিন সীমান্তের কাঁটাতারে ছোটো হয়ে আসা পৃথিবীতে বেজাত হয়ে জাতের ভীড়ে ঠিক থাকার লড়াইয়ের গল্পের চক্র আর আরেকদিকে শব্দের জাদু এই দুইয়ে মিলে আমার এই বছরের পড়া দারুণ একটা মাস্টারপিস বই হয়েই রবে অভিজিৎ সেন-এর লেখা এই রহু চণ্ডালের হাড় বইটি।
এই বইয়ের অনেকগুলো ভার্ষণ দেখেছি। আমি যেটা পড়েছি তা কবি প্রকাশনীর, প্রচ্ছদ করেছেন সব্যসাচী হাজরা। এই দুইয়ের কম্বিনেশনে বইয়ের সবকিছু কেমন হয়ে উঠে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা ভালো বই পড়তে চান, ভালো গল্পের সন্ধান করেন যেখানে জীবনের উত্থান পতন আর ঠিকে থাকার লড়াই করে চলেছে এমন কিছু মানুষকে জানতে চান তাদের এই বইটা মুগ্ধ করবে, বিষন্ন করবে আর শেষ করার পর অনেকক্ষণ ভাবাবে এই গল্পের শেষ সীমানার চিত্রটা কেমন হবে সেই কল্পনার জগতে।
অভিজিৎ সেনের লেখা রহু চণ্ডালের হাড় শেষ করলাম আজকে। এক বাজিকর গোষ্ঠীর দেড়শ বছরব্যাপী ছয় পুরুষের জীবনের ধারাবাহিক নিপীড়নের অজানা কাহিনী। বোদল্যেয়র বলেছিলেন - কুৎসিতেরও সৌন্দর্য আছে। তাই বিশিষ্ঠ জনজাতির জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস হয়েও আসলে এটি এক সার্বজনীন উপন্যাস। এক চিরায়ত জীবনের উপলদ্ধি। এত অনাসক্ত আর প্লেইন ভাষায় একদল মানুষের চরিত্র নির্মাণ কঠিন ব্যাপার। অভিজিৎ সেন জাদু দেখালেন। আর গল্পের কী টান। রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলা গেল। এরপরে আসা যাক বইটির নৃতাত্ত্বিক গুরত্বের ব্যাপারে। এ বই তুলে এনেছে প্রায় লুপ্ত বাজিকর নামের এক যাযাবর সম্প্রদ্বায়ের ভাসমান জীবনের গল্প, পৃথিবীর বুকে একদল হতভাগ্য মানুষের যায়গা করে নেবার সংগ্রাম। রহু। রহুর পরিচয় কি? যে বাজিকরদের নিয়ে এই উপন্যাস, সেই বাজিকরদের দেবতার নাম রহু? না, ঠিক তাও নয়।
" রহু ঈশ্বরের মতো সর্বশক্তিমান নয়। সে এক প্রাচীন দলপতি। সে এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নীতি নির্ধারণ করত তার জীবদ্দশায়। কিন্তু লুবিনি কিংবা কোনো বাজিকর তাকে ভগবান, আল্লা ইত্যাদির সমগোত্রীয় ভাবতে পারে না। এই অমোঘ শক্তিধরদের যে পরিচয় বৃহত্তর সমাজের কাছ থেকে সে পায়, রহুকে তার সমগোত্রীয় ভাবতে তার শুধু ভয় নয়, অনিচ্ছাও বটে। কাজেই তার বোধের মধ্যেও রহু বেঁচে থাকে এক মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী দলপতির মতো। তার উপরে সে দেবত্ব আরোপ করতে পারে না, কারণ দেবত্ব আরোপ করতে পারার সামাজিক স্থিতি তার নেই। সে সমাজচ্যুত। সে ভ্রাম্যমাণও। পথই তার যাবতীয় নীতিনির্ধারক। " রহু চন্ডালের হাড়, এই উপন্যাসের সময়কাল যদিও দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু আগে থেকে স্বাধীনতার কিছু পরের সময় পর্যন্ত, কিন্তু আসলে তা প্রান্তিক মানুষের চিরকালের কাহিনী। প্রবাদ পুরুষ রহু থেকে শুরু করে পীতেম, বালি, পরতাপ, জামির, শারিবা, কয়েক পুরুষের পথ চলার কাহিনী ধরা পড়েছে এই আখ্যানসম উপন্যাসে। বাজকরদের নিজেস্ব জীবন কাহিনীর সাথে জড়িয়ে গেছে সাধাসিধা সাঁওতালদের কাহিনি। একদিকে ব্রিটিশরাজ, আর অন্যদিকে পতাকী সাউ এর মতো সুদখোর দুর্নীতি প্রবণ মহাজনদের অত্যাচারে সাঁওতালদের জমিজিরাত চাষবাস ছেড়ে কুলির কাজে নাম লেখাতে হয়েছে। প্রাণ গেছে অজস্র, রক্ত বয়েছে অঝোর ধারায়। বাজিকরদের পাশাপাশি এমনি করেই ধরা পড়েছে গরীব চাষি, কুলি, শ্রমিকের জীবনের অংশবিশেষ। অভিজিৎ সেনের এই উপন্যাস যথাযথ ইতিহাস মেনে লেখা কিনা জানা নেই, কিন্তু উপন্যাসের ধারা নিশ্চিত ভাবে প্রান্তিক মানুষের জীবনের ইতিহাসের একটা দিকদিশা তুলে ধরেছে। বাজিকর সহ অন্যান্য যত নিম্নবর্গের মানুষ আছে, দরিদ্র, নিরক্ষর দলিত আদিবাসী সংখ্যালঘু মানুষের সাথে এদেশের ক্ষমতাশীল শাসক, দারোগা, ঘুষখোর মহাজন, জমিদার, তাদের নায়েবরা, সমাজের বিভিন্ন স্তরের ক্ষমতাশালীরা যে ভাবে প্রতিনিয়ত অবিচার করে এসেছে, যে ভাবে তুমুল শোষণ আর অত্যাচার করে এসেছে, এই উপন্যাসে তার কিছু রূপরেখা পাওয়া যাবে।
অভিজিৎ সেনের 'রহু চন্ডালের হাড় ' উপন্যাসটি সার্থক ভাবেই প্রান্তিক মানুষের উপাখ্যান। বাঙালির ইতিহাস যে কেবল টোলে বিদ্যাচর্চার মতো বৌদ্ধিক পরিসরে আবদ্ধ ছিল না, বরং উচ্চ বর্গের ক্ষমতাশালী বাঙালি যে জাত বর্ণ ছুৎ-অচ্ছুৎ মেনে ধারাবাহিক ভাবে নিম্নবর্গের মানুষের উপর অত্যাচার চালিয়ে এসেছে, তার বিবিধ উদাহরণের মধ্যে এই উপন্যাসও একটি।
বইতে কিছু বানান ভুল আছে, প্রুফ রিডিং ঠিক মত হয়নি। অনেক সাধারণ বানান মিসটেক হয়েছে।
বাজিকর নামে একটি একটি জনজাতি আছে, তাই জানতাম না, এই প্রান্তিক শ্রেনীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় অভিজিৎ সেনের বিখ্যাত উপন্যাস " রহু চণ্ডালের হাড়" এর মাধ্যমে। 1992 সালে বঙ্কিম পুরস্কার পাওয়া বইটি প্রকৃত অর্থেই প্রান্তিম মানবজীবনের আখ্যান। যায়াবর মানুষ্যগোষ্ঠী বাউদিয়া বাজিকরদের পূর্বের আবাস কোথায় ছিল তা জানা নেই দলের কারওই, এমন কি প্রবীণ দলপতি পীতমেও। আফিমের নেশার ঘোরে সে নির্দেশ পায় তার পিতা দনুর থেকে পুবের দিকে যাওয়ার , পুবেই তারা সুস্থির হবে, অভিশপ্ত যাযাবর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। তাদেও বাসস্থান ছিল, নদী ছিল, নদীর আশীর্বাদে শস্য শ্যামলা ভূমি ছিল, জীবনে স্থিতি ছিল। দখলদারদের লোভে তাদের সব গেছে, তাদের পূর্বপুরুষ রহু সেই দখলদারদের সঙ্গে লড়াইতে হয়েছিল নিহত। তার নিহত শরীর আশ্রয় করে নদীতে ভেসেছিল জীবিত কয়েকজন স্বজাতি, দেহ পচে যায়, শক্ত হাড়টুকু রয়ে যায়, আর রয়ে যা স্বপ্ন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাহিত স্বপ্ন, -- রহু তাদের বাসভূমিতে সুস্থির করবেই। সময় এগোয়, এগোয় যাযাবর বাজিকররা, হিন্দুরা তাদের স্থান দেয় না, মুসলমানেরাও না। আসলে যাদের ভূমি নেই, সেই শিকড় ছাড়া লোকজনদের কেথাও স্থান নেই, দুর্বল অসহায়দের কবে কেই বা আপন করেছে? আসলেই তো, " জমিন হল্যে থিতু হবে, থিতু হল্যে সব হবে।" এ বড় সত্য প্রলাপ, নিজের জমি না পেলে কোন জাতি কবে কথায় সব কিছু পেয়েছে? আপন ভূমির সন্ধানে বাজিকরদের সে পথ চলা শেষ হয় না যেন! পথে পথে সারা বছর ঘুরে বেড়ানো, জন্তু জানোয়ার নিয়ে বাজিকরের খেল দেখানো, আর 'ভিখ মাঙ্গা'। পুবের পথে গোরখপুর থেকে ডেহরিঘাট, সেখান থেকে সিওয়ান, ফের দানাপুর, পাটনা, মুঙ্গের। সেখান থেকে আরও পুবে। রাজমহল, মালদা, নমনকুড়ি, রাজশাহী, কত পথ হাঁটল বাজিকরেরা। গ্রামের বাইরে, নদীর ধারে, শহরের কিনারায় তাদের তাবু পড়ে। ডিগডিগ করে ঢোল বেজে ওঠে, বান্দর-ভালু নিয়ে খেল দেখায় বাজিকরেরা, অবসরে গাই-ঘোড়া-শুওর পালে, মেয়েরা মাদুলি-জড়ি-বুটি বেচে, তুকতাক করে, কিন্তু কিছুদিন বাদেই নানা ঝামেলায় জড়িয়ে চুরির অপবাদ নিয়ে আবার আবাস ওঠাতে হয় তাদের, আবার নামতে হয় পথে। স্থিতি আর জোটে না। প্রবল পরিশ্রমে তরমুজ ফলায়, ফলায় শস্য, তাদের হটিয়ে জমিদারেরা ক্ষমতাশালীরা কেড়ে নেশ তাদের ফসলে অধিকার। দারোগার ছেলের কামের শিকার হয় দলপতি কন্যা পেমা, রসিক নাগরদের সন্তুষ্ট করতে হয় বাজিকর কন্যাদের, এগিয়ে যায় সময়, ক্রমশ দল ছোট হতে থাকে, কমতে থাকে, নিভু নিভু হতে থাকে বাজিকরদের বংশ। তারা কি হেরে যাবে? প্রজন্মের পর প্রজন্মের এই এক টুকরো ভূমির জন্য লড়াই কি তাদের বৃথা যাবে? নাহ্ কোন লড়াই-ই বৃথা যায় না, সব হিসাব তুলে রাখে সময়। রহুর হাজার বছর পরে বাজিকারেরা পাবে একটুকরো ভূমি, শ্রমজীবী মানুষের স্বীকৃতি। এই বই কেবলমাত্র কালো অক্ষরে ছাপা কয়েকটি কাগজের সমষ্টি নয়, এই বই আমাদের তথাকথিত সমাজ জীবনের বাইরে নিরন্তর বয়ে চলা প্রান্তিক জনজীবনের নিত্য যাপনের উপাখ্যান। অবশ্য পাঠ্য এই বই, বাংলা সাহিত্যের এই ধারাকে চিনতে জানতে হলে পড়তেই হবে 'রহু চণ্ডালের হাড়।'
বুক রিভিউ : ০২ বই : রহু চণ্ডালের হাড় লেখক : অভিজিৎ সেন প্রকাশনী : কবি জনরা : জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক উপন্যাস
রহু চণ্ডালের হাড় : বাজিকর জনগোষ্ঠীর যাযাবর জীবনের মহাকাব্যিক আখ্যান
বাজিকর ও বাউদিয়া সম্প্রদায় ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজ ঐতিহ্যের এক অনন্য অংশ। নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও যাযাবর জীবনের বৈচিত্র্যময়তায় তারা স্বতন্ত্র। ধরণীর পথে পথে তাদের ভ্রমণ, আবার সেই পথই তাদের গন্তব্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাটে-গঞ্জে, মেলায় বা উৎসবে খেলা দেখানো, ভেলকিবাজি, ভোজবাজি, দড়ির উপর দিয়ে কিশোরীর হাঁটা, শারীরিক কসরৎ, বানর ও ঘোড়ার খেলা দেখানো—এসবই তাদের জীবিকার মাধ্যম। তাদের জীবনধারায় পরিব্রাজকের স্বাধীনতা ও বৈচিত্র্য স্পষ্ট হলেও তা আসলে শতশত বছরের গভীর জীবনসংগ্রামের ইতিহাস, বেঁচে থাকার লড়াই।
তাদের ইতিহাস জনমানসের অবহেলা ও সমাজের প্রান্তে টিকে থাকার সংগ্রামের। পূর্বপুরুষের স্মৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে তারা যেমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তেমনই তারা স্বপ্ন দেখে স্থায়ী বসতির—নিজের জমিতে চাষাবাদ, নতুন ফসলের মৌ-মৌ গন্ধে মাতোয়ারা গ্রামীণ জীবনের। তারা চায় পরবর্তী প্রজন্মকে ভূমিপুত্র হিসেবে গড়ে তুলতে। এই আকাঙ্ক্ষায় তারা বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করতে চায়, কিন্তু প্রতিবারই মানবসৃষ্ট কিংবা প্রকৃতি সৃষ্ট বিপর্যয়ের মুখে দিশেহারা হয়ে পথে ফিরতে বাধ্য হয়েছে।
ভারত ভাগের পর তাদের পরিচয় সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করে। 'তারা হিন্দু না মুসলমান?'—এই প্রশ্ন তাদের অস্তিত্বকে নতুন করে সংকটে ফেলে। ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত ভূ-ভারতে মানুষ হিসেবে তাদের ঠাঁই হয়নি কোথাও। ইসলাম, সনাতন কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠিত ধর্মের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় সমাজের মূলস্রোতে প্রবেশাধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। আধুনিকতা, নগরায়ণ এবং সমাজের প্রান্তিককরণ তাদের অস্তিত্বকে আরও সংকটে ফেলেছে।
অভিজিৎ সেন তার উপন্যাস 'রহু চন্ডালের হাড়'-এ এই সম্প্রদায়ের জীবন সংগ্রাম, আনন্দ-বেদনা, সামাজিক শোষণ এবং আধুনিকতার অভিঘাতে তাদের সংকটময় অবস্থাকে সংবেদনশীলভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে আধুনিকায়ন, সমাজপতিদের ভূমিদস্যুতা, শ্রেণীবৈষম্য এবং বর্ণবিদ্বেষের কারণে এই সম্প্রদায় তাদের ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে। সভ্যতার আধুনিকায়ন ও প্রাচীন প্রান্তিক সংস্কৃতির সংঘাত এবং এর ফলে সৃষ্ট টানাপোড়েন—সবকিছুই এখানে অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে চিত্রিত হয়েছে।
'রহু চণ্ডালের হাড়' আমাদের সমাজের এমন এক অংশকে তুলে ধরে, যাদেরকে আমরা প্রায়শই অবহেলা করি। এটি শুধু একটি সাহিত্যকর্ম নয়; এটি সমাজের প্রান্তিক জীবনের এক জীবন্ত দলিল, যাযাবর জীবনের প্রতিচ্ছবি। এই উপন্যাস তাদের না বলা কথা, তাদের স্বপ্ন, সংগ্রাম এবং বঞ্চনার এক অনবদ্য চিত্রায়ন।
এই উপন্যাস পড়ার পর যে কেউ নদীর তীরে দুর্বিষহ জীবনযাপন করা যাযাবর জনগোষ্ঠীর কাউকে দেখলে তার সাথে কথা বলতে চাইবে, মনে গভীর সহানুভূতি জাগবে তার জন্য ৷ এটাই সাহিত্যের শক্তি। এখানেই সাহিত্যিকের সাফল্য৷
সব বাজিকর জানে ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ কথাটাই ঐন্দ্রজালিক ,বুজরুকি। তবুও সব বাজিকরই এখনো রহু চণ্ডালের হাড়ের স্বপ্ন দেখে মনে মনে ও বিশ্বাস করে তার সার্থক অস্তিত্ব সম্ভব।
রহুর হাড় লুকিয়ে আছে কোনো এক ভূখন্ডের ফলপ্রসূ মৃত্তিকার গভীরে, যে স্থানটি বাজিকরকে খুঁজে বের করতে হবে। সেই স্থানটি খুজে বের করবার জন্যই বাজিকরের এই ভূ-পরিক্রমণ।... যাযাবর বাজিকররা আজো খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের বীজপুরুষ রহু চণ্ডালের হাড়।
... সে এক অপরিচিত দেশ। যেখানে ঘর্ঘরা নামে এক পবিত্র নদী বয়ে যায়। সেখানে নাকি কবে এক শনিবারের ভূমিকম্পে সব ধূলিসাৎ হয়েছিল । ঘর্ঘরার বিশাল এক তীরভূমি ভূ-ত্বকে বসে গিয়ে নদীগর্ভের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আর তাতে মিশে গিয়েছিল গোরখপুরের বাজিকরদের জীর্ণ বাড়িঘর। ধ্বংস হয়েছিল বাজিরদের প্রধান অবলম্বন অসংখ্য জানোয়ার।
লুবিনি সেই পুবের দেশের কথা শারিবাকে বলে, যে পুবের দেশের কথা দনু পীতেমকে বলেছে, পীতেম বলেছে পরতাপ, জমির আর লুবিনিকেম জামির বলেছে রূপাকে।... কিন্তু কোথায় যে সেই স্থির দেশটি ,যেখানে আছে বাজিকরের স্থিতিস্থায়িত্ব, সেকথা কেউই জানে না। প্রতিবারই মনে হয়েছে এই বুঝি সেই দেশ। প্রতিবারই কোনো না কোনো আঘাত, সে আঘাত মানুষের সৃষ্ট হোক কিংবা প্রকৃতির সৃষ্ট হোক, বাজিকরকে দিশাহারা করেছে ।..
এই যাযাবর বাজিকরদের স্থায়ী কোনো নিবাস নেই। ধর্ম নেই। কেবল প্রশ্ন আছে, হিঁদু না মোছলমান। আর কেবলই জায়গা বদলায়। তাদের বিশ্বাস তাদেরও একসময় এক দেশ ছিল।
অভিজিৎ সেন মহাকাব্যিক আবহে অত্যন্ত নিপুণতায় লিখেছেন ‘ রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাস। এই উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে যাযাবর বাজিকর সম্প্রদায়ের জীবন-আখ্যান।
শুনলাম বইটি নাকি বঙ্কিম পুরস্কার প্রাপ্ত। এর প্রশংসাও প্রচুর তাও দেখলাম। সবার নিজ নিজ পাঠ্যানুভূতি আছে, আমি আমার টা বলি।পুরস্কারপ্রাপ্ত বই হলেই যে পড়তে ভালো হবে তার কোনো মানে নাই। যাযাবর সম্প্রদায়কে ঘিরে মানবিকতায় পূর্ণ কাহিনী হলেও আমার কাছে সুখপাঠ্য মনে হয়নি তাই এত কম রেটিং। বই পড়ার শেষে সুখানুভূতির রেস না থাকলে বেশি রেটিং দিতে ইচ্ছা করে না।বড্ড ধীরগতির বই, পড়তে টাইম লেগেছে, এগোতেই পারছিলাম না,ফালতু টাইম ওয়েস্ট হলো।
এ কাহিনী বাজিকর যাযাবর সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত।"বাজিকর কখনও জাত যাযাবর নয়।জাত যাযাবর হল বানজারা।" এক বাজিকরদের দল, যাদের সর্দার পীতেম বাজিকর। এদের দলের কিছু পুরুষ ও কিছু মহিলা এবং বাচ্চা আছে। বাঁদর, ভাল্লুক নাচানো, দড়ির খেলা, ভানুমতির খেল এসব দেখিয়ে ভিখ নিয়েই এদের বেঁচে থাকা। এদের কোনো জাত নাই, না হিন্দু না মুসলমান। তবে হিন্দু বা মুসলমান এদের সবার কাছেই বাজিকররা বজ্জাত। এদের বিয়া শাদি মানেই একই রক্তের মিলন। এরা স্থায়ী হতে চাইলেও হতে পারে না। পূর্বে কোনো দেবতার অভিশাপেই তাদের এখনও দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে হয়।আর সব বাজিকরদের একটাই স্বপ্ন রহু চন্ডালের হাড় খুঁজে বের করা। এই দুই মলাটের মাঝে আছে এই বাজিকরদের অবহেলিত জীবন, চরিত্র,ভাষা, ক্রিয়াকর্ম,দুর্দশা ও সুখ দুঃখের বিবরণ।
বাজিকর জাত, পৃথিবীর মঞ্চে বাজি দেখিয়ে দুই পয়সা তার আয়। পূর্বপুরুষের এক আদিম পাপে সে ঘরছাড়া। পথে পথে ঘুরে বেড়াতে থাকে এই যাযাবর মানুষেরা, এরমাঝে সমাজ সভ্যতায় বদল আসতে শুরু হয়েছে। কানের পাশ ঘেঁষে চলে যায় রেল। বাজিকরের সামান্য আয়ে ভাগ বসে পুলিশ, স্থানীয় মহাজনের। এরমাঝে বাজিকরের পূর্বপুরুষ ডেকে বলে, থিতু হওয়ার কথা। থিতু হওয��ার স্ব��্নে উদ্বেল হয়ে যায় বাজিকর, সে দড়ির উপরে খেলা দেখায়, সে ভেলকি লাগায়, কিন্তু পাটের ক্ষেতে নিড়ানি দিতে পারেনা। সে নতুন ধানের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে সন্তানের মুখ দেখার সুখ পায়না। তাও চেষ্টা চলে, এই চেষ্টায় তাকে না মুসলমান কাছে টানে না টানে হিন্দু। ভারত ভাগের অস্থির সময়ে সে এক টুকরো জায়গা পায়না। বিশাল ভারতে একটু জায়গা নেই এই যাযাবরের। কাম, ক্রোধ আর ভালোবাসা আর দারিদ্র্য নিয়ে এগিয়ে যায় থিতু হওয়ার জন্য, অভিশাপ কাটিয়ে উঠবে বলে। তাকে সমাজ মেনে নিবে বলে! এই যাত্রা অনন্তকালের।