মাহমুদুল হক নিবিড়ভাবে মিশে যেতে পারেন সাধারণ মানুষের জীবনধারার সঙ্গে, অনুভব করতে পারেন নিষ্ঠুর বাস্তবতার পীড়নে দীর্ণ আত্মার হাহাকার; আর জীবনের হর্ষ-বিষাদ কান্না-হাসি সবকিছু মূর্ত করে তুলতে পারেন এক আশ্চর্য ভাষায়, সহজ ছন্দে যা বলে যায় গভীরতর জীবনের কথা। মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের অগণিত গৃহীজনদের প্রাত্যহিক জীবনধারা টলে উঠেছিল আকস্মিক আঘাতে, পাকবাহিনীর নৃশংস হামলায় তচনচ হয়ে গিয়েছিল ছােট ছাোট স্বপ্ন ও স্মৃতি বুকে পুষে রাখা অসংখ্য মানুষের জীবন। পীড়নের অতলে তলিয়ে যেতে যেতেও মানুষ বুঝি এক সময় ঘুরে দাঁড়ায়, কোনাে মহত্তর একজন হিসেবে নয়, পরাক্রমী বীর হয়েও নয়, নিত্যকার জীবনে সকল তুচ্ছতার মধ্যে মিশে থাকা মানুষ হিসেবেই যেন এই জাগরণ। প্রবল শক্তিধরের সীমাহীন বর্বরতায় পিষ্ট অসহায় মানুষের আর্তি উপন্যাসের কাঠামােয় ফুটিয়ে তুলতে বরাবর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন মাহমুদুল হক। আর তাই মুক্তিযুদ্ধের কথা ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর লেখায়। ‘অশরীরী’ সেই ধারার এক স্মরণীয় সংযােজন, পাকবাহিনীর ক্যাম্পে আটক আম্বিয়ার দেহ দলিত-মথিত হয়ে যায় নির্মম অত্যাচারে, পীড়নের সেই অন্ধকারের মধ্যে তাকে গ্রাস করে স্মৃতি, বােধগুলাে হারাতে হারাতে একসময় আম্বিয়া যেন হারাতে বসে তার সত্তা, তার শরীর, আর সেই অন্ধকারে সমস্ত কিছু ছাপিয়ে জেগে ওঠে ভিন্নতর এক উপলব্ধি, এক আচ্ছন্নতা, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মানুষের ভেতরের মানুষটিকে, আত্মার ভেতরের আত্মা, সত্তার ভেতরের সত্তাকে। ‘অশরীরী’ তাই উপরকার কাহিনী কাঠামাের গভীরে ভিন্নতর মানবসত্যের প্রতি ইশারা করে এবং সেখানেই এর অনন্যতা।
Mahmudul Haque (Bangla: মাহমুদুল হক) was a contemporary novelist in Bangla literature. He was born in Barasat in West Bengal. His family moved to Dhaka after the partition in 1947. His novels deal with this pain of leaving one's home.
Mahmud gave up writing in 1982 after a number of acclaimed novels. Affectionately known as Botu Bhai and always seen as a lively figure in social gatherings, the rest of the time he was said to lead a solitary life.
“You Either Die A Hero, Or You Live Long Enough To See Yourself Become The Villain”
মাহমুদুল হকের লেখালেখি প্রসঙ্গে প্রায় সকলের আলোচনায় যে আক্ষেপ বা মুগ্ধতা উঠে আসতে দেখি, হার্ভে ডেন্টের ওই সংলাপটিই মনে পড়ে যায় আমার। থামতে হবে কখন, জানাটা জরুরী সব সময়েই। গল্পের চরিত্রের মতোই, লেখালেখির এক ধরনের চূড়োয় উঠে মাহমুদুল হক নিজেকে বিচ্ছিন্ন করলেন কলম থেকে। কারণ কী? না, তিনি নাকি ঠিক মতো কমিউনিকেট করতে পারছেন না পাঠকের সঙ্গে। যা বলতে চাইছেন, গুছিয়ে ঠিক বলাটা হয়ে উঠছে না। আহমাদ মোস্তফা কামালের ‘তাঁহাদের সঙ্গে কথোপকথন’ নামের সাক্ষাৎকার সংকলনে বিস্তৃত এক আলাপে মাহমুদুল হক আরো জানিয়েছিলেন, লেখা দাবি করে একান্ত মনোযোগ, অথচ ক্লেদজ পরিবেশ আর গুচ্ছের নিচুমনা কবি-সাহিত্যিক-লেখক দিয়ে পরিবেষ্টিত হয়ে থেকে সেই মনসংযোগ তার আর অকাট্য নেই। মাহমুদুল হক, প্রশ্ন করেছিলেন সেই সাক্ষাৎকারে, সংবেনশীলতা হারালে লেখকের আর থাকেটা কী?
কে জানে কী থাকে! আপাতত লোকটার ছোট্ট কলেবরের 'অশরীরী' উপন্যাসটি বেশ নাড়া দিয়ে গেলো বলে কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনা জানাতে লিখতে না বসে পারি না।
উপন্যাসের ঘটনা-পরিক্রমা নিয়ে বলার তেমন কিছু নেই, লেখকের গদ্য নিয়েও। ট্রানজিস্টরকে যে লোক বনবিড়াল বানাতে পারে, দেশকে বানায় পুকুর আর জীবনকেও এক লহমায় বোন করে তোলে- অমন কাউকে নিয়ে বলাটা কঠিন। আর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের পটে 'অশরীরী’ তো আসলে একেবারে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে থাকা আম্বিয়া, শরীরে আর মিলিটারির মার রাখার জায়গা নাই বলে যে আচ্ছন্নের মতো স্মরণ পায় তার ভেঙে যাওয়া সংসারের স্ত্রীর কথা। মেরুদণ্ডের অভাবে সব কিছু সয়ে গেছে বলে বোনের দুঃসহ পরিণতির জন্য আম্বিয়া নিজের অকর্মণ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে, আবার ছেলের কথা ভেবে মন খারাপ করাও তার শোভা পায়। ( হঠাৎ মনে পড়লো, ভঙ্গি এবং স্বকীয়তার জামা সম্পূর্ণ আলাদা হলেও, পরিণতিতে এই উপন্যাসের একটা বনসাই সংস্করণ হতে পারে কি ইলিয়াসের রেইনকোট গল্পটি?)
কিন্তু ঘটনা তো নয়, ভাবনা লিখতে বসেছি।
'অশরীরী’র মাঝে চরিত্র হিসেবে শহীদ সাবেরের উপস্থিতিই বলতে গেলে এই চিন্তা উস্কে দিয়েছে। শহীদ সাবের যথেষ্ট প্রভাবিত করেছেন মাহমুদুল হককে, পূর্বোল্লেখিত সংকলনটির আলাপেও সেটি বর্ণিত। এটিও শুনেছিলাম, উনিশশো একাত্তরের সেই গ্রীষ্মে শহীদ সাবের দগ্ধ হয়ে যখন প্রাণ হারান পত্রিকার অফিসে-তার আগে কারফিউর মাঝে তার দেখা মাহমুদুল হক পেয়েছিলেন। সংবেদনশীলতা, কারো কারো কাছে গালভারি শব্দ নয় শুধু। সে কারণেই, শহীদ সাবেরের দহন একই সাথে পুড়িয়েছিলো মাহমুদুল হককেও। যে মানুষ চুলের গন্ধ দিয়ে কালো রঙের বরফ বানায়, শহীদ সাবেরের পরিণতিতে তাকে রুঢ়তম উপায়ে আঘাত করবে-একে বোধহয় স্বাভাবিকই বলা চলে। লেখকের হাতে যন্ত্র যেহেতু একটিই, একারণেই কি শহীদ সাবেরকে উপন্যাসে স্থাপন করে দিলেন মাহমুদুল হক? হয়তো।
এমন সংবেদনশীল লোকের না লেখাই ভালো। পাণ্ডুলিপির লিপিকার পুড়ে যাবার এই পৃথিবীতে, টিকে গেলে শেষ পর্যন্ত ভিলেনই হয়তো হয়ে পড়তো মানুষটা। প্রস্থানটা নায়কোচিতই থাকুক।
মুক্তিযুদ্ধে কি সবাই সাহসী ছিল? ভীরু বাঙালির সংখ্যা কি একেবারেই নগন্য ছিল? হয়তো না। ভীরুতা কিংবা নিস্পৃহতা, যাই বলি না কেন, এমন এক বাঙালির গল্প গেঁথেছেন মাহমুদুল হক। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস হিসেবে সেসময়ের কথা বেশ অল্পই এসেছে৷ বলতে গেলে হয়তো প্রতীপাদ্য এখানে মুক্তিযুদ্ধ ছিলও না, ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজের মতো ছিল কিছুটা। খুব ভালো লেগেছে এমন না, খুব খারাপও লাগেনি। তবে সাহসী বাঙালির যুদ্ধাভিজ্ঞতার গল্প ছাপিয়ে মুদ্রার উল্টোপিঠের গল্প হিসেবে বেশ অন্যরকম ছিল।
কিছু কিছু বই আছে যেগুলো শেষ করার পর মাথা ঝিমঝিম করে, অনুভূতি গুলো আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ভেতর থেকে মনে হয় কি যেন নেই, কি যেন হারিয়ে গেছে মনের অজানাতেই। অজানা কিছু হারিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সবকিছু কেমন খালি খালি মনে হয়। মনে হয় এই বই আর এই বইয়ের লিখা নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে। আর আমি বই পড়া শেষে দাঁড়িয়ে আছি শূন্য হাতে, একা। এই বইটা ঠিক তেমন একটা বই।
..I had to read between the lines to understand what this story was all about, what I particularly liked was the layers in which human emotions are dissected. Although the story seems short, well paced and can be finished in an hour, there is more to it. The message is only for those who are looking for it. Some lines are haunting and the illustrations very unconventional. I think I will have to re-read this one to understand it better!
মার্কেসের সাক্ষাৎকারে জেনেছি তিনি বছরের পর বছর একটা বই লিখতে কাটিয়েছেন এমনকি ১৭ বছর। সেখানে মাহমুদুল হক ৮ দিনে উপন্যাস লেখা শেষ করেছেন। সেকারণেই কী তার লেখা উপন্যাসগুলো ছোট আকারের? মাত্র ৭৯ পৃষ্ঠার বইটিতে কী দারুন যত্নে গেঁথেছেন গল্পের অনবদ্য কথামালা!
এর আগে কেবল একটি বইই পড়েছিলাম। একই ধারাবাহিকতায় ভীষণ মন খারাপ আর বিষন্নতা ছুঁয়ে গেল। লেখক জানতেন গল্পের ঠিক কোথায় থামতে হয়। কোথায় চমক দেখাতে হয়। গভীর অমনিবাসের গল্প।
সময়টা বড়োই এলোমেলো, চারিদিকে অস্থিরতা। নিজেদের এলাকা অনিরাপদ মনে করে দলে দলে মানুষ যে দিকে ছুটে চলেছে সেখানে গিয়ে আরও বড় বিপদের মধ্যে গিয়ে পড়েছে। ঘর ছেড়ে গাছের তলায়, প্রিয়জন হারিয়ে নিজের জীবনটা হাতের মুঠোতে করে কোন এক নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে চলেছে সবাই। পাক বাহিনীর লোকেরা তছনছ করে দিয়েছে ঢাকা শহর। অফিস আদালত সব বন্ধ।
এই সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কোন এক টরচার সেলে নির্মমভাবে অত্যাচারীত হয়ে বন্দী অবস্থায় আছে আম্বিয়া। ভীতু, সমস্যা এড়িয়ে বাঁচা আম্বিয়া সেই সময়ের অখ্যাত কোন পত্রিকার সাংবাদিক। পত্রিকা অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে পালিয়ে বাচঁবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু রক্ষা শেষ পায় নি, পাকিস্তানি হানাদার'রা তার এমন অবস্থা করেছে যে তার বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করার সুযোগ নেই। শরীর পুরোপুরি অসার। তবে তার মস্তিষ্ক সজাগ, মাথার ভেতর চলতে স্মৃতিহাতড়ে বেড়ানো। তার মেস জীবন, ঘটনার আকস্মিকতায় বিয়ে করা, বিবাহ পরবর্তী জীবন, ছোট্ট ছেলে পুটুর কথা,অফিস এর কথা, বিক্ষিপ্ত আরও অনেক ঘটনা মাথায় ঘুরতে থাকে।
"অশরীরী" লেখক মাহমুদুল হক এর মুক্তিযুদ্ধেরর প্রেক্ষাপটে রচিত একটি উপন্যাস, তবে একই ভাবে সমাজিক ও পারিবারিক খুটিনাটি নিখুঁত ভাবে উঠে এসেছে। ১৯৭১ সালের আবহে একটি প্রধান চরিত্রকে কেন্দ্র করে রচিত এ উপন্যাসে হঠাৎ করে কিছু চরিত্র আসলেও এই একটি মাত্র চরিত্র দিয়েই লেখক বলিষ্ঠ একটা উপন্যাস তৈরি করেছেন যা কাহিনীকে শেষ এক অভাবনীয় পরিনতির দিকে নিয়ে গেছে।
কিছু বই পড়ার পর বেশ কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে থাকতে হয়। মাথায় কেন কাজ করে, তেমনই একটা বই। একটা সময়, একটা ভীতু মানুষ কে কতোটা সাহসী করে তুলতে পারে! পরিবর্তন জোর করে না, ভিতর থেকে আসে। লেখকের বলিষ্ঠ লেখার পরিচয় তার প্রতিটি লেখাতেই পাওয়া যায়।
মাহমুদুল হকের যেকোনো লেখা পড়ার পরে আমাকে ধন্দে থাকতে হয়, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলার মতো কিছু পাই না। কেবল চুপ করে যা পড়লাম তা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করে।
যা পড়লাম, যা অনুভব করলাম তাকে প্রকাশের ভাষা পাই নি এখনও
ভালো লেগেছে। অসাধারণ লিখনশৈলী। একাত্তরের যুদ্ধকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে একজন ভীত, অতি সাধারণ মানুষের গল্প বলেছেন লেখক। সবসময় সাহসী, অসাধারণ মানুষের গল্প পড়ি আমরা, এবার নাহয় বিপরীতটাই পড়লাম।
আম্বিয়া বিশ্বাস করে তার মতো নিরীহগোছের সাধাসিধা একটা মানুষের জীবন থেকে খুব বেশি কিছু চাওয়ার থাকতে পারে না। থাকার দরকার ও নেই। একটা সাজানো গুছানো ছোট সংসার, মমতাময়ী স্ত্রী, দুই একটা ব্যাঙের ছাও.... এইতো। কিন্তু তার কন্যা রাশি তার সাথে প্রতারণা করে। যেই আলাভোলা সহজ সরল মেয়েটারে বাসায় গিয়ে টিউশনি করাইতো সেই মেয়েটাই একদিন তার মেসে এসে তাকে আকার ইঙ্গিতে জানায় " পাপ কে ঘৃণা করো পাপী কে নয়" আম্বিয়া তখন কি মনে করেছিলো তা কেউ জানে না। হয়তো ভেবেছিলো পাপের কথা বলে বলে আজীবন একটা মেন্টাল টর্চার করে স্ত্রী জাতির গর্ব খর্ব করার এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না কিংবা ভেবেছিলো ছন্নছাড়া জীবনে ভাঙা কুলো যে জুটতেছে এই বেশি। শেষতক আম্বিয়া পাপী কে ঘৃণা না করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বিয়ে কইরা জীবনটা পারমাণবিক চুল্লি তে রূপান্তর করে। আম্বিয়ার স্ত্রী উঠতে বসতে আম্বিয়াকে সন্দেহ করে। দেখলে মনে হয় সংসারে অশান্তি করার ব্যাপারে যেন তাহেরা মায়ের পেটে থাকতেই তার পি এইচ ডি সম্পন্ন করে আসছে। তুচ্ছ, সাধারণ, অ গুরত্বপূর্ণ, অসম্ভব ব্যাপার গুলা তাহেরা এমন বিশ্রি ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে সন্দেহের পাত্রে আম্বিয়ার সামনে পরিবেশন করে যে আম্বিয়া অভিভূত হয়ে যায়। চিবিয়ে খাবে না গিলে খাবে বুঝতে পারে না। একটা সময় দেখা যায় বিয়ের পরে যা হবে ভাবা গেছিলো, হচ্ছে ঠিক উলটো টা। আম্বিয়া যে ধুয়া তুলসি পাতা তা না কিন্তু সংসার নিয়ন্ত্রণ করার মতো কঠিন এবং কর্তৃত্বপরায়ণ মন মানসিকতা না থাকাটা যে কত বড় ক্রাইম সেইটা সে হারে হারে বুঝতে শুরু করে। দেশের টালমাটাল রাজনীতি আর সন্দেহবাতিকগ্রস্থা স্ত্রী এই দুইটা জিনিস তার নিরীহগোছের সাধাসিধা চাহিদা টারে কদু ভাজি কইরা দেওয়ার পরেও আম্বিয়া একটা জম্বির মতো ক্ষীণ আশা নিয়ে ঘুইরা বেড়ায় দেশ আর স্ত্রীর পিছে পিছে। হাজার ঘুরার পর বউ তাকে না ধরলেও একদিন পাকিস্তানের সামরিক শালারা তাকে ধরে নিয়ে যায়। শুরু হয় মানসিক ও শারীরিক টর্চার। যখন বই বের হয় তখন তাহেরা সাহিত্য সমাজের সর্পিণী স্ত্রী ক্যারেক্টারদের মধ্যে একটা হৈচৈ ফেলায় দিছিলো সেটা নিশ্চিত। হাজার বছর ধরের "আম্বিয়া" কে যে এইভাবে এইরূপে আবার ফিরে পাবো কোনদিন ভাবতেও পারি নি। অশরীরী পড়ার পর থেকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছি। একটা সময় আম্বিয়ার কথা মনে পড়লে মনটা একদম ফুড়ফুড়ে আর উদাস হয়ে যাইতো আর এখন আতঙ্ক লাগে। Thank you Mahmudul Haque...you spoiled the fun. Thank you very very much..
'অশরীরি' দিয়েই শক্তিমান লেখক মাহমুদুল হকের সাথে মন্ত্রমুগ্ধকর একটা যাত্রা শেষ হলো আমার। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে বারবার আমার মনে পড়েছে তার আরেকটি উপন্যাস 'জীবন আমার বোনের কথা।'
গল্পের নায়ক আম্বিয়া বারবার আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে মানুষের মাঝে লুকিয়ে থাকা আরেকজন মানুষকে, আত্নার ভেতরে থাকা আত্নাকে, সত্তার ভেতরের সত্তাকে।
আম্বিয়ার জীবন আচমকাই এলোমেলো হতে শুরু করে। একদিকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ , অন্যদিকে তার মধ্যে শুরু হওয়া আরেকটি যুদ্ধে সে জড়িয়ে থাকে অনেকদিন ধরে। এরপর দুটি যুদ্ধ ক্রমশই বিষিয়ে তোলে তার জীবনকে।
অথচ একসময় আম্বিয়া ভেবেছিল সে দেশের একজন আধমরা নাগরিক। দেশের যাবতীয় বিষয় থেকে তারমত দুএকজন বিচ্ছিন থাকলে কার কি আসে যায়। কিন্তু না দিনশেষে কেউই রক্ষা পায় না।
তার স্ত্রীর ভাষায়, "অবশ্য আপনাকে দেখেও তাই মনে হয়, আপনি একজন নির্ভেজাল প্রভুভক্ত নাগরিক। তা কি ফায়দাটা পেয়েছেন আপনি তাতে? কই রেহাই তো পেলেন না। ভেবেছিলেন গায়ের গন্ধ শুঁকে শুঁকে মানুষ বুঝে তারপর মারবে ব্যাটারা, ভপ! শালারা ময়দানে নেমেছে হোলসেল স্লাটার করার জন্য, বোঝেন না কেন।"
পুরো উপন্যাস বেশ ভালো হলেও, নায়কের নাম 'আম্বিয়া' হওয়ার কারণে প্রায় দ্বিধায় পড়তে হয়েছে। আর আম্বিয়া স্ত্রী আমার 'নারী ভীতি' রীতিমত দ্বিগুণ করে তুলেছে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মাহমুদুল হকের আরেকটি অনন্যসাধরণ রচণা। অত্যন্ত প্রতিভাবান এই লেখক এই অশরীরী উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর অমানুষিক নির্যাতন আর গণহত্যার ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। নির্যাতন কেন্দ্রগুলোতে বন্দিদের সাথে হানাদার বাহিনীর অমানবিক আচরণ, ২৫শে মার্চের কালো রাত্রি এবং তার পরবর্তী সময়গুলোতে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ, ধর-পাকড় ও অমানুষিক নির্যাতনের একেবারে বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন তার অসাধরণ লেখনীর মাধ্যমে।
অশরীরী' পড়তে পড়তে বার বার 'জীবন আমার বোন' উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। যদিও নায়ক আম্বিয়া অতটা নিরাসক্ত না। নিরাসক্ততা মেরুদন্ডহীনতা- এ কথাটা দাগ কেটেছে। মাহমুদুল হকের স্বভাবত বৈশিষ্ট অনুযায়ী লেখায় সস্তা সেন্টিমেন্টালিটি নেই।
"চোখের পলকে মেয়েটিকে মেঝের ওপর শুইয়ে ফেলে জলিলি। বুট দিয়ে একটা পা মেঝের সঙ্গে চেপে রেখে অপর পা-টি ধরে টান মারে; চড়চড় করে একটা শব্দ হয়, সেই সঙ্গে মর্মান্তিক চিৎকার। খুব সহজে, একটা নরম ঘৃতকুমারির পাতার মতো গলা পর্যন্ত দু'ফালি করে ফেলে।"