Shahaduz Zaman (Bangla: শাহাদুজ্জামান) is a Medical Anthropologist, currently working with Newcastle University, UK. He writes short stories, novels, and non-fiction. He has published 25 books, and his debut collection ‘Koyekti Bihbol Galpa’ won the Mowla Brothers Literary Award in 1996. He also won Bangla Academy Literary Award in 2016.
শাহাদুজ্জামান যেটাই লিখুন না কেন, সেটা বাজারের তালিকা হলেও, পড়তে ভালো লাগে। পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ ছোটগল্পের সংকলন। লেখালেখি জীবনের শুরুর দিককার গল্পই বেশিরভাগ। ভালো-মন্দ আছে অবশ্যই, তবে লেখনশৈলী যে একটা শিল্প সেটা এখান থেকে বোঝা যায়। ভালো লেগেছে আন্না কারেনিনার জনৈক পাঠিকা, শিং মাছ লাল জেল এইসব, চিনা অক্ষর অথবা লংমার্চের গল্প। তবে সবথেকে সুন্দর গল্পটি হল ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস। ধীরগতিতে শুরু হয়ে পাঠককে এমনভাবে ভ্রমে ফেলবে সেটা বোঝাই যায় না। কিছুটা জাদুবাস্তবতার ছোয়া আছে এই গল্পতে, যা শেষপর্যন্ত বয়ে আনে একরাশ মুগ্ধতা।
গল্পের আড়ালে গল্প বলার ক্ষমতায় শাহাদুজ্জামান অনন্য। এই বইয়ের "ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস" গল্পটা রীতিমতো ক্লাসিক হবার যোগ্যতা রাখে। "নিজকলামোহনায় ক্লারা লিন্ডেন" গল্পটাও চমৎকার। এই দুটো গল্পই উনার চাকুরী জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখা। আমার কেন যেন উনার নিজের জীবনের আলোকে লিখা গল্পগুলো বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়।
"শিংমাছ, লাল জেল এইসব" গল্পটা কমিউনিজমে বুদ হয়ে থাকা একজনকে নিয়ে। সময়ের সাথে সাথে যার শোষণহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন ফিকে হয়ে এসেছে৷ পড়তে গিয়ে মনে হলো নিজের জীবনের কথাটাই যেন একটু ভিন্ন আঙিকে পাড়লেন লেখক। বইয়ের শেষদিকে "চীনা অক্ষর অথবা লংমার্চের গল্প" তে মাও সে তুং ফিরে আসে অন্য আঙিকে। কমিউনিস্ট সমাজ গড়ার স্বপ্নভাঙনে হতাশ হলেও সে স্বপ্নগুলো যে একবারে ছেড়ে যায়নি তার প্রমাণ মেলে গল্পগুলোতে।
"পন্ডিত" ও "উড্ডীন" গল্প দুটি সমাজের নগ্ন বাস্তবতার ভিন্নধর্মী প্রকাশ। এগুলোকে হয়তো ঈষৎ স্যাটায়ারধর্মী বলা যায়। ওদিকে "আন্না কারেনিনার জনৈক পাঠিকা" আবার অসম্পূর্ণ প্রণয়ের গল্প। এখানেও শাহাদুজ্জামানের গল্পের আড়ালে গল্প বলার চমৎকার ক্ষমতায় বিমোহিত হতে হয়।
শাহাদুজ্জামানের উপর জীবনানন্দের প্রভাব যে তীব্র তা এই বইয়ের নামকরণ দেখলেই বুঝা যায়। এমনকি বইয়ের প্রথম লিখাটাও ধুসর কবিকে নিয়েই৷ (উনার চতুর্থ গল্পগ্রন্থের নামও জীবনবাবুকে উৎসর্গ করেই দেয়া। এই তীব্রতাতে কাবু হয়েই হয়তো শেষমেশ "একজন কমলালেবু" লিখে ফেলেছেন।)
ভালো লেগেছে বেশিরভাগ গল্পই। শাহাদুজ্জামান যখন প্রথম দিকে এই ঢঙে গল্প বলা শুরু করলেন তখন সাহিত্যাঙ্গনে রেসপন্স কিরকম ছিল, জানতে ইচ্ছে করছে। তার গল্পের নামগুলো খুবই আকর্ষণীয় লাগে আমার কাছে, সেই ধারা অব্যাহত ছিল এই বইয়েও। উড্ডীন গল্পটা কয়েকবার পড়েছি, প্রতিবারে ভেতরে নাড়া দিয়েছে।
মুমূর্ষু বাংলা ছোটগল্পকে উদ্ধার করবার কাজে নিয়োজিত শ্রান্তিহীন শ্রম এবং সচেতন দৃষ্টি কল্পনা নিয়ে অতি সামান্য যে দু’-তিনজন, তাদের সহযাত্রী শাহাদুজ্জামান। - সৈয়দ শামসুল হক
সত্যিই শাহাদুজ্জামানের গল্প বলার ধরন অদ্ভূত সুন্দর। ১৮৯৯ থেকে শুরু করে ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস পর্যন্ত সবগুলো গল্পই সুন্দর। তবে কাগজের এরোপ্লেন, আন্না কারেনিনার জনৈকা পাঠিকা, নিজকলমোহনায় ক্লারা লিন্ডেন, ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস পড়ে আমি সত্যিই মুগধ!
'কয়েকটি বিহব্বল গল্প' বইয়ের গল্পগুলো ভালো লাগলে, পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ গল্পগ্রন্থের গল্পগুলোই শাহাদুজ্জামানের সেরা ছোটগল্প মনে হয়।
ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস গল্পই যথেষ্ট এই বইকে ৫ স্টার দেয়ার। শাহাদুজ্জামানের গল্প পড়ার সময় অদ্ভূত একটা ঘোর লাগা কাজ করে৷ গল্প বলার ভঙ্গি এতই আকর্ষণীয়, রহস্যময় ও বিষাদমাখা যে গল্পের মধ্যে জলমগ্ন মাছের মত ডুবে যেতে হয়। শেষ করার পরেও পানির উপর ভেসে থাকা মহিষের মুখের মত চোখের উপর ভাসতে থাকে।
"পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ " এটা কী টাইপ গ্রন্থ? একটু নাড়া-চাড়ার পরে টের পেলাম এটা গল্পগ্রন্থ।
মোট এগারোটা আজিব ও গারিব ধরনের নাম সম্বলিত গ্রন্থ। প্রথম গল্প ১৮৯৯ (কী এমন হইসে ঐ সালে), মূলত জীবনানন্দের জন্মসাল এটি।আর জীবনানন্দ কে ট্রিবিউট জানাতে লেখাটির অবতারণা। দ্বিতীয়গল্পে সাহিত্যিক ঢঙে একজন মানুষের জীবনবোধ আর পাওয়া, না-পাওয়ার কথা মেলে। তৃতীয় গপ্পো এক বামকর্মীর বিপ্লব নিয়ে হতাশা আর "সোভিয়েতোস্কি কৌতুকভ" থেকে নেয়া কিছু জোকসের মেলবন্ধন যা গল্পের প্লটের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। চতুর্থ কাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিত শিক্ষকদের কে নিয়ে সারকাজম (প্রেক্ষাপট জোশ লাগসে)। পঞ্চমকথন বাসস্ট্যান্ড আর সেখানকার জনগণের মনের বিশ্লেষণ (ছোট্ট তবে ভাবায়)। ষষ্ঠ গল্পটা কে মনে হয়েছে "আন্না কারেনিনা"র বুক রিভিউ তবে গল্পে গল্পে। সপ্তম গল্প উড্ডীন একেবারে কলিজায় খোঁচা দিয়েছে। মনে আছে?কোনো এক যুবক বিদেশে যাবার জন্যে উড়োজাহাজের পাখায় আশ্রয় নিয়েছিলো? ঠিক সেই ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা অতিবাস্তব এক গল্প। পরের কাহিনী, আমার দেশের গ্রামে প্রসূতি নারীদের যে কী দুর্গতি তা ঘিরে জৈনক বিদেশিনীর রিসার্চ ও বাস্তবতা। পরের দুইটা গল্প এভারেজ। এবার আসি,সেরা গল্পটার কথা। "ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস " গল্পে গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকে যুবা ডাক্তারের আগমন, চিরায়ত গ্রামের চিকিৎসাব্যবস্থা সেই সাথে গল্পের নাম চরিত্র মধু ব্যবসায়ী আর সার্কাস ক্লাউন ইব্রাহিমের সাধারণ হলেও অসাধারণ চিন্তা-ভাবনা আর ক্রিয়াকলাপ এই গল্পকে নিয়ে গিয়েছে অন্যমাত্রায় আর করেছে এ সংকলনসহ শাহাদুজ্জামানের অন্যতম সেরা গল্পে।
আসেন,কিছু নেগেটিভ কথা শোনাই। "কয়েকটি বিহ্বল গল্প"(ক্রাচের কর্ণেলের কথা বললাম না কারণ ঐটা উপন্যাস)তে প্রিয় শাহাদুজ্জামান কে যেমন গভীর ভাবনা নিয়ে লিখতে দেখেছিলাম, এবার তিনি ছিলেন কিছুটা অনুপস্থিত,লেখায় ছিলোনা আগের তেজ তাই পড়তে গিয়ে একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছি। তবে সার্বিক বিবেচনায় শাহাদুজ্জামান বাংলা গল্প আর উপন্যাস লিখিয়েদের মাঝে নতুনত্বের ছোঁয়া দিয়েছেন যা পাঠককে খুব টানে।
বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্��� শাহাদুজ্জামান। মননশীল কথাসাহিত্য রচনায় তাঁর কলমের ধার; সমসাময়িক সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা রাখা সকলেই কমবেশি জানেন। 'পশ্চিমের মেঘে সোনা�� সিংহ' একটি গল্পগ্রন্থ। বইটিতে মোট ১১ টি ছোটগল্প সংকলিত হয়েছে। ছোট অথচ প্রতীকী কিংবা বড় গল্পের কাছাকাছি রচনার মধ্য দিয়ে দারুণ কিছু উপহার দিয়েছেন লেখক।
সাধারণত গল্পগ্রন্থে নাম ভূমিকায় গল্প থাকলেও এই বইটিতে তা অনুপস্থিত। তবে সেই গল্পটি পাওয়া যায় '১৮৯৯'-তে। ১৮৯৯ সালে জন্ম নেওয়া বিষন্ন কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লেখা প্রথম গল্পটি। অন্তর্মুখী কবিকে নিয়ে লেখকের ভাবনাকে মাত্র দুই পৃষ্ঠায় অসাধারণ বর্ননার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন লেখক।
'কাগজের অ্যারোপ্লেন' গল্পটা বেশ ভালো লেগেছে। গল্পকথকের ব্রিজের রেলিং-এ বসে থাকতে ভালো লাগে। সেখানে বসেই নানামুখী ভাবনায় বিভোর হয়ে যায় সে। একসময় অদ্ভুত এক লোক আসে আর জিজ্ঞাসা করে বসে 'আই ফল আপওন দি থর্ন অব লাইফ, আই ব্লিড' বইটি কার লেখা? কথক উত্তর দিতে পারেনা। আবার লোকটা ফেরত আসে এবং সাহিত্যের সৃষ্টি কীভাবে হয়েছিল তার গল্প বলে চলে যায়। এখানে বসেই আরো সব ভাবনা কথকের মস্তিষ্ককে জর্জরিত করে তখনই ব্রিজ পেরিয়ে যাওয়া নাইটকোচ থেকে উড়ে আসে একটি কাগজের অ্যারোপ্লেন।
'শিং মাছ, লাল জেল এইসব' গল্পটায় আমরা দেখতে পাই সমাজতন্ত্রের উত্থান-পতনের প্রভাব। হামিদ হোসেন বাজার থেকে শিং মাছ কিনে বাড়ি ফিরছিলেন। তখনই ব্যাগ ছিঁড়ে একটি শিং মাছ ধুলোতে পড়ে যাওয়ায় তিনি সেই মাছ আবার ধরতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পারছেন না। এই মাছ ধরতে না পারার মাঝেই তাঁর মনে পড়ে মাও সেতুং এর পৌত্রের বিলাসী জীবনের খবরের কথা। অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে থাকেন তাঁর অতীত জীবনের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ও বিপ্লবী ধারার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ।
'পন্ডিত' গল্পটা একটি প্রতীকী গল্প। আমাদের দেশের এনজিওগুলোর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের টাকার ঝনঝনানিকে গ্রামের ছোট বাচ্চাদের অদ্ভুত এক ছড়ার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন লেখক।
'আন্না কারেনিনার জনৈকা পাঠিকা' গল্পটা আমার মতে সকল পাঠকের পড়া উচিত। গল্পকথক পুরনো বইয়ের দোকান হতে দুই খন্ড আন্না কারেনিনা কিনেছিলেন। সেই বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় হাসান ও মমতা নামক দুইজন মানুষের একটি কথোপকথন ছিল। সেই কথোপকথনকে গল্পকথক নিজের কল্পনাকে কাজে লাগিয়ে আরো সামনে এগিয়ে নিয়েছেন। তবে গল্পের মূল আকর্ষণ এক নাবিকের সাথে এক পাঠিকার রোমান্টিসিজমের ঘটনাটুকু। তবে সেই ঘটনার সমাপ্তি টানেননি লেখক। পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন।
বইটির সর্বশেষ এবং সবচেয়ে বড় গল্প 'ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস'। একজন চিকিৎসক গ্রামে চাকরি করে। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় মধুচাষী ও সার্কাসে খেলা দেখানো ইব্রাহিম বক্সের সাথে। ইব্রাহিম বক্সের সাথে পরিচয়ের পর যুবক চিকিৎসক অনেককিছু জানতে পারে জীবন সম্পর্কে। অথচ গ্রামের জীবন তার কাছে রোমাঞ্চহীন মনে হয়েছিল। ইব্রাহিম বক্সের অদ্ভুত কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে যুবক চিকিৎসক। এই গল্পের বেলাতেও লেখক সমাপ্তি টেনেছেন পাঠকের উপর ভার ছেড়ে দিয়ে। বেশ ভালো একটা গল্প।
শাহাদুজ্জামানের অনেকগুলো বই পড়া হয়েছে। তার মধ্যে এই বইটা ভালো লাগার সারিতে উপরের দিকে থাকবে। পাঠকমাত্রই নিজেকে অন্যরকম আঙ্গিকে আবিষ্কার করবেন। হ্যাপি রিডিং।
শাহাদুজ্জামানের সাথে পয়লা মোলাকাত হয়েছিল কয়েকটি বিহবল গল্প বইটিতে। আক্ষরিক অর্থেই গল্পগুলো পড়ে বিহবল হয়েছিলাম, বাঁধাগতের বাইরে একেবারেই আলাদা ঢঙ্গে লেখা, তারিয়ে তারিয়েই পড়েছিলাম। এরপর প্রথম মওকাতেই পড়ে ফেললাম তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ। এই বইটিতেও নিরীক্ষা নিয়ে লেখকের প্রয়াস লক্ষণীয়, প্রথাগত ধারার বাইরে গিয়ে এই বইতে আমি আবিষ্কার করি নতুন একজন শাহাদুজ্জামানকে।
১৮৯৯ সংখ্যাটা শুনলে কবিতাপ্রেমীদের মাথায় ঝট করে একটা নামই আসার কথা। কাব্যপ্রিয় আমাকে বলা যাবেনা কোন অর্থেই, তাই শিরোনামের মাহাত্ম্য টের পেতে আমাকে কিছুদূর অবধি পড়ে যেতেই হল। ছোটগল্পের মানদন্ডেও গল্পের কলেবর একেবারেই পৃথুল নয়, শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এর মাঝেই জীবনানন্দের প্রতি উৎসারিত প্রগাঢ় অনুরাগ ঠাহর করতে বেগ পেতে হয়না বৈকি।
শুরুর গল্পটা পড়ে বইটা ছেড়ে ওঠা মুশকিল হয়ে পড়ে, এরপর তরতর করে বাকিগুলো পড়ে ফেলতে কসুর করিনা। তবে এর মাঝে একটি গল্পের কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়, আন্না কারেনিনার জনৈক পাঠিকা। এই গল্পের শুরু পুরনো বইয়ের দোকানে লেখকের আন্না কারেনিনা বইটি কেনার পরের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। গল্পটাকে বলা যায় গল্পের মধ্যেই যেন আরেকটা গল্প, অনেকটা আমার দারুণ পছন্দের একটা ছবি দ্য ফল এর মত। আন্না কারেনিনা বইয়ের মার্জিনে একজন পাঠিকার কিছু মতামত, মতামত না বলে অবশ্য দর্শন বলাটাই যুৎসই। হাসান ভাই নামের একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে মমতার ছুঁড়ে দেওয়া কিছু আপাতসরল জিজ্ঞাসা লেখককে তাড়িত করে, বইটা পড়ার সময় লেখকের সামনে উন্মোচিত হয় একজন আনকোরা কিন্তু মনোযোগী পাঠিকার নতুন অলিন্দ। এইসব প্রশ্ন থেকে উপজাত হিসেবে বেরিয়ে আসে কিছু অমোঘ প্রশ্ন, মমতা-হাসানের সম্পর্কের একটা হালকা আঁচও পাওয়া যায় এতে। তাই গল্পে লেখকের পাঠক সত্ত্বার চেয়ে অনুসন্ধিৎসু সত্ত্বা প্রবল হয়ে ওঠে অনেকটা এভাবে-
এ ছাড়াও আরও কয়েকটি টুকরো মন্তব্যে লক্ষ করি নানা সামাজিক প্রসঙ্গে আমাদের এই পাঠিকার মনোযোগী পর্যবেক্ষণ।আন্না কারেনিনায় দেখা যাচ্ছে, সে সময় ধনাঢ্য রুশদের মধ্যে নিজের ভাষা ছেড়ে মাঝে মধ্যে ফরাসী বলার একটা ফ্যাশন ছিল। লেভিনের বন্ধুর স্ত্রী ডল্লি যখন তেমনি তার মেয়ের সঙ্গে ফাঁকে ফাঁকে ফরাসী বলছিল লেভিন তখন ভাবছিলেন- ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ফরাসী ভাষায় কেন কথা বলছেন উনি? কি অস্বাভাবিক আর কৃত্রিম। ছেলেমেয়েরাও টের পায় সেটা, এই ফরাসী শেখা আর স্বাভাবিকতা ভোলা। মমতা পাশে লিখেছেন- ঠিক যেমন আজকাল এদেশের বড়লোক পরিবারগুলোতে ইংরেজি বলা। ওদেরগুলোও মনে হয় কি অস্বাভাবিক আর কৃত্রিম।
এইভাবে একটি বইয়ের "মার্জিনে মন্তব্যে"র সূত্র ধরে লেখকের সামনে এক অনালোকিত জগতের দুয়ার খুলে যায়। এই ঠাস বুনোটের শহরে একজন অচিন পাঠিকার হারানো ঠিকুজির তিনি সন্ধান করে চলেন, আমরাও পড়ে ফেলি গল্পের মধ্যে আরেকটি গল্প।
তবে বইটির যে গল্পটা আমার চোখে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আদল নিয়েছে সেটা হল, ইব্রাহীম বক্সের সার্কাস। অন্যান্য গল্পের মত এটি স্বল্পবপু নয়, তবে গল্পের কিছুদূর এগিয়ে এটাও লেখকের ভুয়োদর্শনমূলক বলে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। গল্পের কাহিনি এক প্রত্যন্ত গ্রামে একজন তরুণ চিকিৎসকের কিছু অভিনব অভিজ্ঞতা নিয়ে। সদ্যপাশকৃত এই ডাক্তার বদলি হয়ে চলে আসেন এই দুর্গম জনপদে। এই পরিস্থিতিতে যেটা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক; গ্রামের কুসংস্কারপীড়িত মানুষের ভ্রান্ত ধারণা, রোগ বালাই নিয়ে তাদের উদ্ভট খেয়াল, আধুনিক চিকিৎসা সম্পর্কে অজ্ঞানতা এসবই ডাক্তারকে মোকাবেলা করতে হয়। এই পর্যন্ত গল্পটিকে আটপৌরে মনে করলে আসলে খুব বেশি দোষ ধরাও যায়না। কিন্তু এরপর প্রাত্যহিকতার আবডালে আরেকটি অতীন্দ্রিয় জগতের হদিস পান ডাক্তার, যেখানে বাস করে ইব্রাহিম বক্সের মত খামখেয়ালি, রহস্যময় একজন লোক, বকরি বুড়ির মত একজন আপাতপমূর্খ কিন্তু দুর্বোধ্য গ্রাম্য প্রবীণার। গ্রাম্য সংস্কারের আড়ালে ইব্রাহিম বক্সের কৌতূহলী মন আর বৈজ্ঞানিক সত্ত্বার ঠিকুজি ডাক্তারকে দ্বিধায় ফেলে দেয়, এতদিনের আধুনিক কলাকৌশলের সাথে এসব উন্মার্গিক অথচ সৃষ্টিশীল প্রজ্ঞার সন্ধান তাকে ফেলে দেয় ভয়ানক টানাপোড়েনে। এক লহমায় ইব্রাহিম বক্সের চিকিৎসা বিষয়ক মতবাদকে উড়িয়ে দিতে যেমন পারেননা, ঠিক তেমনি পারেননা নিজের যুক্তিবাদী সত্ত্বার সাথে টক্কর দিয়ে সবকিছু মেনে নিতে। অবশ্য নিয়তি অচিরেই তাকে এই সংকট থেকে মুক্তি দেয়, সেই গণ্ডগ্রামে ডাক্তারগিরির পাট চুকিয়ে অচিরেই তিনি ফিরে যান নিজের শেকড়ে। গল্পটা একদিক দিয়ে খানিকটা প্রথাগতই বটে, এখানেই তিনি নিরীক্ষার আশ্রয় নিয়েছেন সবচেয়ে কম। চরিত্রগুলোকে স্বাভাবিক বিকাশের পথ দেখিয়েছেন, ঘটনাগুলোকে একসূত্রে গেঁথেছেন দক্ষ হাতে।
তবে অন্যগল্পগুলো নিয়ে কিছু না বললে অন্যায়ই হবে। শিং মাছ, লাল জেল এইসব গল্পে লেখক আসলে একটি থিমের ওপর কিছু ছোট ছোট চুটকি ফেঁদেছেন। গল্পটা ভীষণ রকম সুখপাঠ্য, এ ধরনের গল্প পড়ার আনন্দ অসামান্য, তবে এসব গল্প ভুলে যাওয়াটাও অনেকটা সহজ। অন্যদিকে পন্ডিত গল্পে লেখকের বিদ্রুপের তীর্যক সুর অনেকটাই স্পষ্ট, সখেদে তিনি অর্থগৃধু বুদ্ধিব্যবসায়ীদের অন্তসারশূন্যতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, বাস্তবের কর্কশ জমিনের সাথে সংশ্রবহীন তত্ত্বকথার ঝান্ডাধারীদের একহাত দেখে নেন। এসব গল্পে লেখক অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত, পাঠক হিসেবে এ ধরনের গল্পের প্রতিও আমার একটা বাড়তি পক্ষপাত আছে অবশ্য।
খুব স্থির একটি স্থির চিত্র গল্পটি আদপে স্রেফ একটা স্ন্যাপশট, যেখানে একটা খুব সংক্ষিপ্ত ঘটনার মাধ্যমে লেখক অনেকগুলো উপসংহার টেনেছেন। এখানে কাহিনি খোঁজাটা হবে অরণ্যে রোদন, তবে নিরীক্ষার ছাপ এই গল্পেও সুস্পষ্ট। উড্ডীন গল্পের ক্ষেত্রেও এই কথা অনেকটা খাটে, এই গল্পটা আমি ঠিক ধরতে পারিনি, মাঝেমাঝেই রাশটা ছুটে গিয়েছে বলে মনে হয়েছে। আয়নার ওপিঠ লাল একজন পঙ্গু মানুষের গল্প, অনেকটা ডাইভিং বেল অ্যান্ড দা বাটারফ্লাই ছবিটার কথা মনে করিয়ে দেয়। এই ঘরানার গল্পের একটা বিষাদমাখা সুর থাকে, সেটা আমাকে ছুঁয়ে যায় বৈকি। কিন্তু কতটা দাগ কেটেছে এ সওয়াল পুঁছলে সেটার উত্তর দিতে আমি খানিকটা ভাববই। চীনা অক্ষর অথবা লংমার্চের গল্পটিকে আমার কিছুটা কমজোরি মনে হয়েছে, ঠিক দানা বেঁধে উঠতে পারেনি ,কেন জানি মনে হয়েছে এটা হয়েছে "একটি হতে গিয়েও না হতে পারা " গল্প।
আরেকটি গল্পের কথা আলাদাভাবে বলব, নিজকলমোহনায় ক্লারা লিন্ডেন। একজন ভিনদেশী রমণী দোভাষীর সাহায্য নিয়ে গন্ডগ্রামে সন্তান প্রসবের ওপর গবেষণা করতে আসেন। অনেক চটকদার পিলে চমকানো তথ্যই তিনি জানতে পারেন, নিজের গবেষণার সাফল্যের কথা ভেবে তিনি উচ্ছ্বসিতও হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে এদেশীয় দোভাষীর কাছেও ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় দুর্বোধ্য এক প্রহেলিকার নাম, গ্রাম্য মিথের অভিনবত্ব তাকে চমকিত করে। প্রবীণ ধাত্রীর কাছে এর আবেদন আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন। গল্পের শেষলাইনটি আসলে অনেক কথাই বলে দেয়-
নিজকলমোহনায় তখন দুপুর। ঢেঁকিঘরে হাওয়া, সেখানে শ্বেতাঙ্গ, বাদামি, শ্যামবর্ণ তিনজন নারীর মিথস্ক্রিয়া।
বইটিতে আমরা একজন শক্তিমান লেখকের দেখা পাই, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যার নিবিড় পর্যবেক্ষণ রয়েছে, সমাজ- সংস্কার নিয়ে যার অভ্রভেদী দৃষ্টিভঙ্গি আছে। লেখক নিরীক্ষার প্রশ্নে কোন আপস করেননি, হয়ত গল্প হিসেবে সবগুলো ঠিক উতরে যেতে পারেনি, কিন্তু প্রত্যেকটি গল্প আলাদাভাবে ভাবতে বাধ্য করবে, চিন্তার খোরাক জোগাবে এটুকু হলফ করে বলা যায়। তাই, একজন পাঠক হিসেবে পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ পড়ে লেখকের কাছ থেকে প্রত্যাশার পারদও অনেকখানি চড়ে যায়।
ব্যক্তিগতভাবে শাহাদুজ্জামানের যেকোনো লেখাই আমার ভীষণ ভালো লাগে। তার কোনো লেখা হঠাৎ সামনে চলে আসলে বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়তে থাকি। অতিসরল বর্ণনার মাঝে চমৎকার জীবনানন্দীয় ভাবাবেগ, অতি সরল প্রকৃতিকে রহস্যময়ভাবে উপস্থাপন ইত্যাদি কাজে বেশ ওস্তাদ উনি। সাধারণ জীবনকে একটু অন্যচোখে দেখার প্রবণতা ওনার মধ্যে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান, আর ঠিক এই কারণেই ওনার লেখা আমার বেশি পছন্দের।
এই বইয়ের গল্পগুলোর মধ্যে 'আন্না কারেনিনার জনৈক পাঠিকা' গল্পটা আবির ভাই আগেই পড়িয়ে নিয়েছিলেন, তারপর থেকেই অন্যতম প্রিয় হয়ে গেছে। এ ছাড়াও 'কাগজের এয়ারপ্ল্যান', 'শিং মাছ,লাল জেল এইসব', 'নিজকলমোহনায় ক্লারা লিন্ডেন ' , 'ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস ' বেশ ভালো লেগেছে। 'ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস' বোধহয় আলাদা করে মেনশন করাই ভালো। অনেকদিন বাদে এতো চমৎকারভাবে হুকড হয়ে একটা গল্প পড়া হলো। 'উড্ডীন' পড়তে গিয়ে থমকে গেছি বারবার। তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে 'কাগজের এরোপ্লেন'।
"নিরানন্দ জপ করি প্রতিদিন। যখন শুনি, 'এমন মানব জনম আর কী হবে', তখন আঁতকে উঠি। ভাবি, তা হলে? 'মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।' কিন্তু যদি জানতাম কী করব। কী করতে হয়?"
"একটিই জীবন আমাদের। তুলনা করবার মতো পূর্ববর্তী কোনো জীবন আমাদের হাতে নেই, হাতে নেই শুধরে নেবার মতো পরবর্তী কোনো জীবন। তা হলে কী করে বোঝা যাবে জীবনের কোন সিদ্ধান্তটি সঠিক, কোনটি ভুল?"
....
শেষ করার পরে ভাবছিলাম, অক্ষরদেরকে ঠিক কতটা যত্নে লালন করলে শাহাদুজ্জামানের মতো চমৎকারভাবে লেখা যায়? কতটা স্নেহ করলে মনের ভাব এতো সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়?
গরু যেমন খাদ্যবস্তুকে পাকস্থালীতে গিলে ফেলার পর পুনরায় সেখান থেকে মুখগহ্বরে ফিরিয়ে এনে দাঁত দিয়ে চর্বন করে আমিও গতকাল থেকে এই বইয়ের গল্পগুলোকে মস্তিষ্ক থেকে তুলে এনে বারবার রিওয়াচ দিচ্ছি। ঘোরলাগা সব গল্প। কিছু গল্প খুব বাজে রকমের সুন্দর।
“একটিই জীবন আমাদের। তুলনা করবার মতো পূর্ববর্তী কোনো জীবন আমাদের হাতে নেই, হাতে নেই শুধরে নেবার মতো পরবর্তী কোনো জীবন। তা হলে কী করে বোঝা যাবে জীবনের কোন সিদ্ধান্তটি সঠিক, কোনটি ভুল?”
এ বইটিতে মোট ১১টি ছোট গল্প আছে। আমার কাছে গল্প সংকলন পড়ার সবচেয়ে প্রিয় দিক হচ্ছে গল্পের নামগুলো। যেমন, 'খুব স্থির একটা স্থির চিত্র', 'চীনা অক্ষর অথবা লংমার্চের গল্পগুলো', 'কাগজের এরোপ্লেন'। এক দুই পাতার গল্পগুলো পড়ে কখনো বারোটা চড়ুউ পাখির তেরোটা ডিমের একটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরাবাস্তব বেদনা আমাকে ঘিরে ধরে, কখনো কোন এক ব্যস্ত রাস্তায় দেখা সাধারণ একটা দৃশ্য স্থির চিত্র হয়ে চোখের সামনে ভেসে এসে অস্থির করে তোলে আবার ভাবতে থাকি হঠাৎ নীলির মরে যেতে ইচ্ছে হলো কেন! মাথায় ঘুরতে থাকে আন্না কারেনিনার জনৈক পাঠিকা ও তার হাসান ভাইয়ের সাথে বই অদলবদলের সুন্দর সম্পর্ক। পড়তে পড়তে ঢাকা থেকে বদলি হওয়া এক যুবক চিকিৎসকের সাথে চলে আসি কোনো এক অচেনা গ্রামে। যেখানে রাতের আকাশে অবিন্যস্ত তারার দল দেখে যুবক চিকিৎসক ভাবতে থাকে বিন্যাসই সৌন্দর্য কথাটা কি তাহলে মিথ্যে? আর আমি জানালা দিয়ে আকাশে তাকাই, পশ্চিমের মেঘে কোন সোনার সিংহ দেখা যাচ্ছে কি?
তখন লংমার্চের সময় মাও সে তুং তার বিপ্লবী সঙ্গীদের নিয়ে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিচ্ছেন দীর্ঘপথ। মাও সে তুং আর তার সঙ্গীরা দূরপাল্লার পথে হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় থামলেন, বিশ্রাম নেবেন বলে। দেখলেন, একটু দূরে একটা নদীর তীরে, এক যুবক আর যুবতী আলিঙ্গনে বিভোর হয়��� বসে আছে গাছের নিচে। মাও সে তুং-এর বিপ্লবী সঙ্গীরা তাঁকে ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, দেশের জন্য আমরা প্রাণপণ করে সংগ্রাম করছি আর কিনা গাছের নিচে বসে নদীর হাওয়া খেয়ে প্রেমে মশগুল হয়ে মজা করছে? এ কিছুতেই হতে পারেনা। ওদেরও আমাদের সাথে লংমার্চে যেতে হবে।
মাও সে তুং বললেন না, এই প্রেমিক যুগল ওখানেই থাক আমাদের যা কিছু সংগ্রাম, সে তো ওদের জন্যই।
"কয়েকটি বিহ্বল গল্প " পড়ে যতটা মুগ্ধ হয়েছি এই বইটা পড়ে ততটা হতাশ হয়েছি আমি। অনেক চেষ্টা করেছি ভালো লাগাইতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিনাই।
শুধু ওই যে নাবিক, পুরাতন বই, চিঠি আদান প্রদান অতঃপর তাদের নাটকীয় দেখা... ছোট্ট এই গল্পটা খুব খুব ভালো লেগেছে। এটা অনেক দিন মনে দাগ কেটে থাকবে। এভাবে কারো সাথে পরিচয় হলে কি দারুণ হতো বিষয়টা!!!
বইটাতে সব মিলিয়ে ১১ খানা গল্প আছে। সবগুলোই দারুন তবে কিছু গল্প ভীষণ রকম আমার মনে দাগ কেটে গিয়েছে
কাগজের এরোপ্লেন, উড্ডীন, নিজকলমোহনায় ক্লারা লিন্ডেন, এবং বিশেষ করে আয়নার ওপিঠ লাল গল্পটা আমার কাছে দারুন লেগেছে। আমি মনে করি এই গল্পটা পড়ার জন্যে হলেও সকলের বইটা নেয়া দরকার। গল্পটা বেশ অনেকক্ষণ আমায় ভাবিয়েছে। একজন অঙ্গহারা মানুষকে আমরা কিভাবে দেখি, কেমন করে মূল্যায়ণ করি কতটা অবহেলা করি এই গল্পটা না পড়লে আমার পূর্ণ ধারণা হত না। এখন কেন জানি নিজেকে বড় হীন মনে হচ্ছে। সচরাচর আমরা অঙ্গ হারা মানুষকে করুনার চোখে দেখি কিন্তু আমরা একবার ও কি ভেবেছি আমাদের আচরনে তাদের কেমন অনুভূতি হয়??
এর বেশি এই বই সম্পর্কে আমার বলার ভাষা অবশিষ্ট নেই। শব্দ যেন ফুরিয়ে গেছে।
বইটা থেকে কিছু কথা উঠিয়ে দেয়া হলো-
> "একটিই জীবন আমাদের। তুলনা করার মতো পূর্ববর্তী কোনো জীবন হাতে নেই,হাতে নেই শুধরে নেবার মতো পরবর্তী কোনো জীবন। তা হলে কী করে বোঝা যাবে জীবনের কোন সিদ্ধান্তটি সঠিক, কোনটি ভুল?” >
গল্প - কাগজের এরোপ্লেন
> “আয়না এবং যৌনসঙ্গম পরিত্যাজ্য কারণ দুটোই মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে”।
> “একমাত্র মানুষই তো গভীর বেদনায় হেঁসে থাকে।” >> “যার পা নেই তার সঙ্গে যার পা আছে তার দীর্ঘক্ষণ স্বচ্ছন্দ আড্ডা চলা দুরুহ।যা চলে তা একটি উপভোগ্য দক্ষ অভিনয়।”
গল্প — আয়নার ওপিঠ লাল।
This entire review has been hidden because of spoilers.
শাহাদুজ্জামানের গল্প মানেই ভিন্ন এক ধরণের মুগ্ধতা। পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ পড়ার উদ্দ্যেশ্য জাগে "আন্না কারেনিনার জনৈকা পাঠিকা" গল্পটি আমার এক বন্ধুর ফেসবুক ডে তে খন্ডাংশ পড়ে। সবগুলোই গল্প ভিন্ন ধারার, ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের গল্পে ভরপুর বইখানা। একেবারে ফুল কম্বো। ভাল লেগেছে "খুব স্থির একটা চিত্র", "আয়নার ও পিঠ লাল", "চীনা অক্ষর অথবা লংমার্চের গল্প"। তবে সবচেয়ে ভাল লেগেছে শেষ গল্পখানা অর্থাৎ "ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস"। শাহাদুজ্জামানের লেখনীর মুগ্ধতা সকলের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক।
'পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ' হলো একটা গল্পগ্রন্থ। কিন্তু আমার কাছে মনে হলো গল্পের ছদ্মবেশে যেন কবিতা পড়লাম। আশ্চর্য সুন্দর শাহাদুজ্জামানের লেখার ধরন। এর আগেও আমি তাঁর কিছু গল্পগ্রন্থ পড়েছিলাম। কিন্তু এটি যেন তাঁর অন্য গল্পগ্রন্থগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।
চমৎকার সব গল্প আর বাহারী শিরোনাম দিয়ে সাজানো বইটি একবার পড়ে আমার মন ভরলো না।
"একটিই জীবন আমাদের। তুলনা করাবার মতো পূর্ববর্তী কোনো জীবন আমাদের হাতে নেই, হাতে নেই শুধরে নেবার মতো পরবর্তী কোনো জীবন। তা হলে কী করে বোঝা যাবে জীবনের কোন সিদ্ধান্তটি সঠিক, কোনটি ভুল?"--
" পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ" বইটা একটা ছোট গল্প সংকলন, এতে মোট ১১ টি গল্প স্থান পেয়েছে। গল্প গুলোতে এক টার সাথে অন্য টার কোন ধারাবাহিকতা নাই বিষয়বস্তু বা ভাবগত। ছোট, খুব ছোট গল্প দিয়ে সাজানো এই বইটা। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবনের ছায়াতে, বিপ্লবীদের জীবন ভাবনা- আদর্শ, রুপক চিন্তা, বিশেষ কোন বই বা বইয়ের অংশ, গ্রাম্য জীবনের আলোকে ক্ষুদ্র কোন ভাবদর্শন এই ছোট গল্পের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।
সামজিক ও ব্যক্তিগত সমস্যা, জীবনের গভীর বোধ, জাতিগত হিংসা, দেশের প্রতি হারিয়ে ফেলা সব মমতা, আমাদের দৈনন্দিন সমস্যা যা লেখক ভিন্ন চোখে দেখেছেন, উপস্থাপন করেছে এবং আমাদের ভাবনাতে নাড়া দিয়েছেন।
ছোট গল্প আমার কখনই পছন্দের বিষয় নয়। বড়ই অনীহা নিয়ে পড়ি, খারাপ লাগে না তবে ছোট গল্প পড়ার আগ্রহ পাই না, এটা আমার দোষ। এই অনীহা নিয়ে বেশ কিছু ছোট গল্প পড়েছি তবে এমন করে ভাবায় নি, যেমনটা লেখক শাহাদুজ্জামান এর গল্প গুলো ভাবায়। গল্পের একটা পটভূমি থাকে বরাবরই যা দেখে থাকি ছোট গল্পের বেলায় কিন্তু লেখক শাহাদুজ্জামান এর গল্প শুধু যেন গল্প নয়, গল্প শেষ হবার পরও যেন আরও একটা গল্প থেকে যায়। লেখক একটা ভাবনা ঢুকিয়ে দেন পাঠকদের মনে, যে ভাবনাটার জন্ম হয় গল্প পড়ার পর।
আমি খুবই ধীরে পড়ি। এটার জন্য মাঝে মাঝে খারাপ লাগে না। ধীরে পড়ার কারনে ছোট একটা বইয়ের সাথে একটু বেশী সময় কাটানো যায়। চমৎকার একটা বই, ভাবনাতে থেকে যাবার মতই।
এই বইয়ে একটা ‘গল্প’ আছে। ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস। অর্থাৎ ভদ্রলোক চাইলে হাতটা ওদিকেও নাচাতে পারেন।
আমরা খুশি যে, বেশি নাচান না। তার এগারো লেখার বইয়ে দশটাই হয় অগল্প। পৃথিবীর এই কিনারায় যার বড় অভাব।
তবে কিনা, দশটা অগল্পের মধ্যে কয়টা ���সলে না-গল্প, এবং হ্যারিসনের গিটার যেমন মৃদুভাবে ক্রন্দন করে অমন যেকোনো কিছুকেই নিংড়ে যেকোনো রস বের করার সার্থকতা কতটুকু—সেটা তর্কসাপেক্ষ।
বছরের শেষ মাসে এসে ভালোই শাহাদুজ্জামান পড়া হলো। (এটা সহ ৬ টা) মনে হচ্ছে লেখকের অন্ধভক্ত হয়ে যাচ্ছি দিনদিন। এই বইয়ের সবগুলো গল্পই ভালো ।১৮৯৯ গল্পটা জীবনানন্দের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে লেখা ।বইয়ের নামও এসেছে জীবনান্দের লেখা থেকেই।'কাগজের এরোপ্লেন', 'ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস' এদু'টি গল্প বিশেষ ভালো লেগেছে।
শাহাদুজ্জামান বেশি পরিচিত তার অসাধারণ গল্প বলার ধরণের জন্য হলেও, আমার কাছে দিন দিন যে বিষয়টা সবথেকে আশ্চর্য লাগছে, তা হলো-লেখক ভাবতে শেখাচ্ছেন, লেখক ভাবাতে পারছেন!
গল্পের আঙ্গিক-ফর্ম ভেঙ্গে ফেলার প্রবণতা তো আছেই, পাশাপাশি গল্প গুলো তার সময়-বাস্তবতা-রাজনীতি-মানুষসহ অপরাপর আরও অসংখ্য বিষয় নিয়ে ডালপালা মেলে ধরে । তাছাড়া কোথাও যেন কবিতার চোরাগোপ্তা সুর । শাহাদুজ্জামান সম্পর্কে কিছু কিছু জানার সুবাদে বুঝতে পারছি লেখকের জীবন-যাপন-সম্পর্ক-বোঝাপড়া কী নিবিড় অথচ বিচিত্র সব উপায়ে সাহিত্য সৃষ্টিতে এসে উপস্থিত হতে পারে । কখনও দেখেছি ক্যান্সারের দুষ্ট দোষে পা হারানো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে আবার সোভিয়েত রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া এবং ক্রমে বিশ্ব জুড়ে জাঁকিয়ে বসা এ দগদগে অর্থনীতিক ব্যবস্থার চাপে ভারাক্রান্ত কোন বিপ্লবীর স্বপ্নের ঠাণ্ডা মৃত্যু । এভাবে প্রতিটা গল্প ধরে ধরে বলা যায় । উড্ডীন গল্পটার কথা এখন বলতে ইচ্ছা করছে । আমি তখন বেশ ছোট । হঠাৎ দেশে একটি খবর বেশ চাউর হয় । খবরটি একি সঙ্গে নির্মম এবং অপমানকর । অভিনব এক উপায়ে বিমানের চাকার খুপরিতে লুকিয়ে থাকা বাংলাদেশি এক যুবকের শেষ মেষ তীব্র শীতে মৃত্যুর ঘটনাকেই বিভিন্ন দিক থেকে আলো ফেলে দেখেছেন শাদুজ্জামান । বিদেশের প্রকৌশলী যখন প্রথম সে যুবকের লাশটা আবিষ্কার করেন তখন তার পায়ে মাটি লেগে ছিল । গল্পের শুরু থেকে শেষ আছে এমন উপায়ের কোন গল্প না । তারপরও যা করেছেন, তার মানে এই না যে শুধু কাব্য করেছেন । একটা দেশে-সমাজে কী এমন ঘটে গেলে একজন যুবক এমন এক পথ বেছে নিতে পারেন? এই গুলো অবশ্যই ভাববার মতো বিষয় । আর বইয়ের শেষ গল্প ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস যেন একটা ঝলমলে জ্বলজ্বলে হীরে । গল্পটি পড়তে পড়তে বিভূতির আরণ্যকের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল । না কোন মিল-টিলের জন্য না । আরণ্যক পড়বার সময় যে অনুভূতি তৈরি হয়েছিল ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস পড়ে একি সুরের এক অনুভূতি কাজ করছিল । আকারে আর বিস্তৃতিতে আরও বড় হলে কেমন হতো তাই ভাবছিলাম । সম্প্রতি এক লেখায় জেনেছি শাহাদুজ্জামান এই গল্প নিয়ে চিত্রনাট্য লিখছেন । সিনেমার পর্দায় ইব্রাহিম বক্স-ঠাকুরের বিল-যুবক চিকিৎসকের ঘোর লাগা বিস্ময় দেখার অপেক্ষায় থাকলাম ।