Syed Mujtaba Ali (Bengali: সৈয়দ মুজতবা আলী) was a Bengali author, academician, scholar and linguist.
Syed Mujtaba Ali was born in Karimganj district (in present-day Assam, India). In 1919, he was inspired by Rabindranath Tagore and started writing to the poet. In 1921, Mujtaba joined the Indian freedom struggle and left his school in Sylhet. He went to Visva-Bharati University in Santiniketan and graduated in 1926. He was among the first graduates of the university. Later, he moved to Kabul to work in the education department (1927–1929). From 1929 to 1932 he studied at the universities in Berlin, London, Paris and Bonn. He earned Ph.D. degree from University of Bonn with a dissertation on comparative religious studies in Khojas in 1932. In 1934-1935 he studied at the Al-Azhar University in Cairo. Subsequently, he taught at colleges in Baroda (1936–1944) and Bogra (1949). After a brief stint at Calcutta University (1950), Mujtaba Ali became Secretary of the Indian Council for Cultural Relations and editor of its Arabic journal Thaqafatul Hind. From 1952 to 1956 he worked for All India Radio at New Delhi, Cuttack and Patna. He then joined the faculty of Visva-Bharati University (1956–1964).
পঞ্চ-তন্ত্রকে কি পাঁচ তারার কম দেয়া যায়? হয়ত সর্বাঙ্গ নিখুঁত নয়, কিন্তু হাতের পাঁচ আঙুলের সব কয়টা সমান হবে কে বললো? এই বইয়ের মধ্যাঙ্গুলি অলক্ষ্যেই খাইবারপাস পাস করে সাইবেরিয়া অব্দি চলে যায়, বুড়া আঙুলের ব্যাপ্তিও কমসেকম করাচী তক।
চমৎকার, দুর্দান্ত, অসাধারণ। এ যেন এক মধুর ভাণ্ডার! একেবারে বুঁদ করে রাখে। আর কী দুর্দান্ত পরিমিতিবোধ আলী সাহেবের! বেশিরভাগ প্রবন্ধই ৮০০-১২০০ শব্দের মধ্যে শেষ, অথচ এই ক্ষীণকায় লেখাগুলোই কী দারুণ রসে টইটম্বুর! আর কী অসাধারণ দেখার চোখ ছিল আলী সাহেবের! এই না হলে মায়েস্ত্রো! বারবার ফিরে আসা যায় এমন সব বইয়ের কাছে।
“বই কিনে কেউ তো কখনো দেউলে হয়নি। বই কেনার বাজেট যদি আপনি তিনগুণ বাড়িয়েও দেন, তবু আপনার দেউলে হবার সম্ভাবনা নেই।“
আসেন একদল গরীব পাঠকের কথা বলি। এদের মাসের ইনকাম ধরুন ৫ টাকা। সমস্ত খরচ শেষ করার পর তার হাতে থাকে ৫ পয়সা। এদিকে একটা শার্ট বা জামা কেনার প্রয়োজনীয়তা কিছুতেই অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। একটা শার্ট বা জামা এবার নিয়েই ফেলব, এমন মনোবাসনা মস্তিষ্কে শক্তপোক্ত আসন গেড়ে বসেছে। কিন্তু না, হঠাৎই তার সামনে চলে আসলো দশ পয়সা দামের বই। এই মাসের ৫ পয়সা, সামনের মাসের থেকে ৫ পয়সা ধার করে বই কিনেও ফেললো। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে বলে চিৎকার দিয়ে উঠতেই মনে হলো, তবে কি আমি দেউলিয়া হয়ে গেলাম?
এই একদল গরীব পাঠকের মধ্যে আমি সহ অনেকেই আছে। সৈয়দ মুজতবা আলী নিজে বই কিনে কখনো দেউলিয়া হয়েছেন কি না জানি না। তবে তার বক্তব্য শুনে আমি এরকম কতবার যে ক্ষণস্থায়ী দেউলিয়া হিসেবে নিজেকে ঘোষিত করেছি তা বোধহয় আঙুলে গুণে শেষ করা যাবে না।
বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় কি না সেই তর্কে জয় পরাজয়ের জন্য আমি শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রেতাত্মা বা ভুতকে ইহজগতে টেনে আনার পক্ষপাতী না। তিনি বুজুর্গ মানুষ, যা বলেছেন তা আমি দেউলিয়া অবস্থাতেও বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছি, এখনো নেই। তাই এসব দিকে মনোযোগ না দিয়ে বইয়ের দিকে মনোযোগ দেয়া যাক।
পঞ্চতন্ত্র, সৈয়দ মুজতবা আলীর অসামান্য সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যে শয়ে শয়ে লেখক এসেছেন, শয়ে শয়ে লেখক আসবেন। কিন্তু রসিকতায় তার ধারে কাছে কেউ পৌঁছাতে পারবেন কি না সেটা নিয়ে জোর সন্দেহ রয়েছে।। তার সাধারণ একটা কথাও আপনাকে পেট চেপে ধরে হাসতে বাধ্য করবে। তার বইয়ের মূল আকর্ষণ থাকে তিনি কি বলছেন সেটা নয়। তিনি কিভাবে বলছেন সেটা। যেমন ধরুন আপনাকে বা আমাকে যদি বলা হয় খাবার দেখে খুব খুশী হয়েছেন এটা সবাইকে হাসানোর মত করে বলুন। খুব ইনোভেটিভ মাইন্ড না হলে যে রসিকতা আমি বা আমরা সৃষ্টি করবো সেটা শুনলে মানুষের ঠোঁট বেঁকে যাবে বটে, তবে সেটা হাসির জন্য নয়, বিরক্তিতে। তিনি কিভাবে বলতেন সেটার উদাহরণ এই বইয়ের “কোন-ভিনারের মা” গল্পের এক অংশ থেকে উল্লেখ করলে বুঝতে সুবিধে হবে। তিনি এসপেরেগাস খেতে খুব পছন্দ করতেন৷ জার্মানীতে ঘুরতে যাওয়ার পর একজনের বাসায় গেলে তাকে অনেক এসপেরেগাস খেতে দেয়া হয়। তার খুশীর বয়ান পড়ুন তার নিজের লেখার মাধ্যমে। “এসপেরেগাসের পরিমাণ দেখে আমার চোখ দুটো পটাং করে সকেট থেকে ছিটকে বেড়িয়ে গেল। মহা মুশকিলে সেগুলো কার্পেট থেকে কুড়িয়ে নিয়ে সকেটে ঢুকিয়ে এসপেরেগাস গ্রাস করতে বসলুম।“ এহেন লোকের বই পড়ে মন ভালো না হয়ে কোন উপায় নেই।
পঞ্চতন্ত্র, একটা গল্প বা ঘটনার সমষ্টি নয়। অনেক গুলো ছোট ছোট ঘটনা বা প্রবন্ধ নিয়ে বই। তিনি কি নিয়ে লিখলেন, এই বইয়ে সেটা মাথব্যথা না। কিভাবে লিখেছেন সেটা বড় পেটব্যথা। তা না হলে একটা স্যুট ট্রায়ালের ঘটনা পড়তে যেয়ে কিভাবে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দেয়ার অবস্থা হয় বলেন? নানা রকম বিষয় নিয়ে আলোচনার আবাসস্থল পঞ্চতন্ত্র, অথচ আলোচনা শুনলেই যে গুরুগম্ভীর একটা ব্যাপার মাথায় বসে যায় সেই জনাব গুরুগম্ভীর চাচা এইখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বইয়ের একেকটা অধ্যায় পড়বেন, কখনো মুচকি হাসবেন, কখনো ঠা ঠা করে হাসবেন, দুয়েক জায়গায় মন খারাপ হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। নানাবিধ সহজ বা কঠিন বিষয়ে তিনি আলোকপাত করেছেন বা কখনো নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন কিন্তু কৌতুককর শব্দের বা প্রকাশভঙ্গী কখনোই বাদ পড়েনি। বই পড়ে একই সঙ্গে বেশ কিছু জ্ঞান অর্জন ও করা হয়ে যাবে বটে। জানতেন ইংরেজরা “চুরুট” শব্দটা নিয়েছে তামিল “শুরুট্টু”থেকে?
আমার ধারণা মানুষকে হাসানো বেশ কঠিন কাজ। নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা বা সাধারণ আলোচনা করে হাসানো তো আরো কঠিন ব্যাপার। দুয়েকটা গল্প, দুই চার দশ বিশ পৃষ্ঠা হয়ত বিভিন্ন টপিকে রস কস ঢেলে টেনে নেয়া যায়, তবে এর বেশী যারা টানতে পারে তাদের উচ্চতা অন্য ধরনের। সৈয়দ মুজতবা আলীর মুন্সিয়ানা এখানেই। তিনি এক হাজার পৃষ্ঠা লিখে যাবেন কিন্তু প্রথম পৃষ্ঠার মত শেষ পৃষ্ঠাতেও হাস্য রসাত্মক বর্ণনার কমতি থাকবে না।
কাইরো থেকে প্যারিস, আজব শহর কলকেতা থেকে বার্লিন, ছাত্র বনাম পুলিশ বা এমেচার ভার্সেস স্পেশালিস্ট, পঞ্চতন্ত্রের প্রত্যেকটা পৃষ্ঠায় সৈয়দ মুজতবা আলী তার প্রতিভার প্রমাণ দিয়ে গিয়েছেন। আমার মত নগন্য মানুষের পক্ষে তার বইয়ের সঠিক রিভিউ দেওয়া অসম্ভব ব্যাপারই বটে। কখনো দেখেছেন গাধাকে দিয়ে হালচাষ করাতে?
‘পড়ার জন্য’ পড়া এ অতিমাত্রায় স্বাভাবিক ব্যাপার পড়ুয়া পাঠকদের জন্য । ভারিক্কি চালের এসব পড়ার মাঝখানে মাঝেমধ্যে কিছু লেখা আমরা পড়ি যেগুলো মনকে বিশ্রাম এনে দেয়; মন খুলে হাসার প্রশান্তি দেয়। শাণিত বুদ্ধির খরদীপ্ততা আর সুতীক্ষ্ণ রসবোধের সংমিশ্রণে লেখা পাঠকমনে এক ধরনের প্রফুল্লতার ছোঁয়া দেয়। তেমন ধারার লেখাই হলো এই আলী সাহেবের লেখা । আর তার এক ঝলকই ' পঞ্চতন্র' ।
গত সপ্তাহে লাইব্রেরিতে আলী সাহেবের সম্পূর্ণ রচনাবলী (বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র হতে প্রকাশিত। প্রচ্ছদ দেখে প্রেমে পড়তে বাধ্য) দেখে জিহ্বে জল চলে এল। ভাবলাম নিজের চিত্তকে আর বঞ্চিত করব না। যেই ভাবা সেই কাজ। সংগ্রহ করে ফেললাম পুরো রচনাবলী। এখন শুধু তারিয়ে তারিয়ে রস গ্রহণ করাই যা বাকী।
অভিযান শুরু প্রথম খন্ড দিয়েই। আর প্রথম খন্ডেই পঞ্চতন্র এর ২টি পর্ব আছে। প্রথম পর্বে প্রবন্ধ আছে ৩৫ টি আর ২য় পর্বে আছে ৩২ টি। যদিও সবগুলো প্রবন্ধ, তবুও প্রত্যেকটি লেখাই তার নিজের জীবনের গল্প আর অভিজ্ঞতা দিয়ে ঠাসা। তার পাণ্ডিত্য আর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা জাস্ট আমাকে অভিভূত করে দিয়েছে। মধ্যাকথা এই বইতে যদি ৫ টা তাঁরা না দিই সেটা নিতান্তই অবিচারের শেষ সীমায় চলে যাবে।
কল্পনায় আপনি আর কি খেলবেন, আপনাকে নিয়ে বহুকাল আগেই খেলে গেছেন আলী সাহেব।
ধরুন, সেই খেলার নাম মেটাফর, শুনলেন তোতা থেকে নিয়ে রবিবাবুর কবিতা কিংবা ফারসি বয়েৎ; অর্থাৎ প্রথমার্ধের দুই মিনিটেই আপনি খেয়ে গেলেন পাঁচ গোল।
কিংবা ধরুন, সেই খেলার নাম 'ভ্রমণ-ভোজন', চোখ মুদলেন আর দেখলেন কাইরো, দিল্লি, জার্মানি কিংবা প্যারিস; না চাইতেই নাকে এলো কাফে'র কফি, জাহাজের ডাইনিং কিংবা পদ্মার ইলিশের ঘ্রাণ; অর্থাৎ বিনা রানে পাঁচ উইকেটের পতন।
অথবা ধরেই নিন সেই খেলার নাম ভাষাতত্ত্ব, যার মানে অনেকটা 'একখানা বড়ে নিয়ে পুরো দাবার সেটের সাথে পাল্লা দেয়ার চেষ্টা করা'।
মোদ্দা কথাটা হলো, এঁনার সাথে খেলতে যাওয়া ভুল, না খেলতে যাওয়া আরও বড় ভুল।
মাত্র পাঁচটি তারা হাতে নিয়ে এই বইয়ের মূল্যমান যাচাই করতে যাওয়া? নারে ভাই, বরং 'জিতসেন ভাই জিতসেন' কথাটা অনেক কিছুতেই বলা যায়, কিন্তু এই বইয়ের ক্ষেত্রে পাঁচটি কেন, দশটি তারাও অনায়াসে দেয়া যায় কোনও চিন্তা না করেই।
বৃহস্পতিবার রাত এলেই ভাবি পরদিন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাব সারাদিন। কিন্তু প্রতি শুক্রবার ঘুম ভাঙে কাক ডাকা ভোরে। আজকের দিনটাও ব্যতিক্রম ছিল না। অনেক চেষ্টার পরেও ঘুমাতে না পেরে আলী সাহেবের শরণাপন্ন হতে হলো। এদিকে আবার চলছে অ্যাশেজ। ক্রিকেটে অ্যাশেজ এবং গদ্যে মুজতবা আলী, দুটাই আমার খুব পছন্দের। গোলাপি রঙের অ্যাশেজের সাথে মুজতবা আলীর হরেক রঙের হিউমার মিশিয়ে প্রায় দিনটা কাটানোর পর শুক্রবার সকালে ঘুমাতে না পারার দুঃখটা কমলো অবশেষে।
আলী সাহেবের সমগ্র কিনে রাখা অনেক আগে, শুরু করবো করবো করেও শুরু করা হচ্ছিল না। পঞ্চতন্ত্র শেষ করে মনে হচ্ছে শুরু না করলেই ভালো করতাম; শুরু করেছি মানেই তো শেষ হয়ে যাবে :( ছয় তারা দেয়া যদি সম্ভব হতো তাহলে তাই দিতাম।
রম্যরচনায় যার মৌলিক অবদান সে সৈয়দ মুজতবা আলী এবং রম্যরচনায় একমাত্র সেরা বই 'পঞ্চতন্ত্র'। কী নেই এই বইতে!! সাহিত্যের প্রতিটি শাখার স্বাদ পাবে পাঠক এই বই পড়ে।
বহুভাষাবিদ, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের গবেষক, কবিগুরুর অনুরাগী, চরম বিনয়ী, যে আমাদের বিশ্বের নাগরিক করে তুলেছে, বহুভাষা শিখতে অনুপ্রাণিত করেছে সে আমার প্রিয় লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী।
আমাকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করেছে তার লেখা, প্রকৃত সুখ কাকে বলে তা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে বহুভাষা শেখার অনুপ্রেরণা একমাত্র তার লেখা থেকে পেয়েছি। এখন আমার জীবনের দ্বিতীয় সেরা শখ ভাষা শেখা। ভাষা শেখার মত দুর্বোধ্য বিষয়কে আমার জন্য সরল করে দিয়েছে সৈয়দ মুজতবা আলী।
আমি আজীবন কৃতজ্ঞ বাংলা সাহিত্যের ৫ জন লেখকঃ সৈয়দ মুজতবা আলী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং হুমায়ুন আজাদ এর প্রতি। উনারা আমাকে চরম অন্ধকার থেকে বের করে আলোকিত, পুলকিত করছে প্রতি প্রাতে সূর্যের মতো।।।
পঞ্চতন্ত্রের এক একটা প্রবন্ধ পড়তে পড়তে বেশিরভাগ সময় মুচকি হাসবেন, কখনো দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠবেন, কখনো করুণ রসে হৃদয় ভরে উঠবে, কখনো-বা মন থমকে উঠবে নতুন কিছু জেনে, ভ্রূ কুঁচকে যাবে- কিংবা অচেনা দেশের অচেনা মানুষের গল্প শুনে হয়তো মনে হবে বুঝি দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছেন। সৈয়দ সাহেবের লেখার ঢঙ তুলনাহীন- প্রতিটি পাতায় পাতায় আছে অসামান্য পাণ্ডিত্য আর রসবোধ, অজস্র না-জানা জিনিস। জ্ঞানে কিঞ্চিৎ খাটো বলেই হয়তো কিছু প্রবন্ধের সবকিছু হৃদয়ঙ্গম করতে পারি নি। তবে এ এমন এক বই যা বারবার পড়া যায়! নামে যদিও প্রবন্ধের বই-রম্যরচনা; তবু গল্প-বই থেকেও এটা কম কিছু নয়। প্রত্যেকটা লেখাই গল্পে গল্পে ঠাসা- এ যেন-তেন গল্প নয়- ভারতবর্ষ, ইউরোপ, আরব চষিয়ে বেড়ানো এক লোকের ঝুলির গল্প, যে লোক শুধু ঘুরেই বেড়াননি, দেখেছেন, শুনেছেন, কথা বলেছেন ভিনদেশীদের সাথে ওদেরই ভাষায়। 'বিদেশে' নামের রচনাটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, আহা, এ লেখা যেন শেষ না হয়ে যায়। 'পঞ্চতন্ত্র' এনেছিলাম আরেকজনের কাছ থেকে ধার করে। এখন ফেরত দিতে মন সায় দিচ্ছে না :p নিজে একটা কপি কিনে তবেই ফেরত দিবো ভাবছি। :3
বইটি খুব সুন্দর। লেখকের রসবোধের তুলনা হয় না! তার লেখার ধারণটাও অন্য রকম। বেশির ভাগ লেখা ৮০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে হবে সর্বোচ্চ। তবুও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। দুইখন্ড পঞ্চতন্ত্রের প্রায় সব লেখাই লেখকের স্মৃতি কথা। এই বই দিয়ে লেখকে চেনার যাত্রা শুরু। সামনে যে কয়েকজন লেখকের সব লেখা পড়ার ইচ্ছে রাখি তার মধ্যে তিনিও একজন।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা প্রাবন্ধিক ও রম্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর দ্বিতীয় সেরা গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয় 'পঞ্চতন্ত্র'। দুই খণ্ডে রচিত এই গ্রন্থে নানাবিধ বিষয় সম্পর্কে প্রবন্ধ এবং নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার অবতারণা করেছেন গ্রন্থটিতে।
'বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়নি।' বহুল জনপ্রিয় এই বাক্যটি পাওয়া যায় বইটিতে। বাঙালি আমুদে এবং ফ্যাশনেবল হওয়ার জন্য টাকা খরচ করলেও বই কেনার পেছনে আলাদা বাজেট থাকেনা। বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে চায় সবাইই। তবে সেই বই নিজের গাটের টাকা খরচ করে কেনার প্রবৃত্তি খুব কম মানুষেরই আছে। তবে অনেকে আবার মার্ক টুয়েনের পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। ধার করে বই ফেরত না দেওয়া। বইয়ের পৃষ্ঠায় বিষ মাখিয়ে রাজাকে হত্যার গল্পটা বাঙালি জানে বলেই কিনা বই কেনায় এত অনাগ্রহ!
বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের তৎকালীন দুর্দশা নিয়ে আলোকপাত করেছেন লেখক। একইসাথে গুণী ব্যক্তিদের অনুবাদে যে বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদগুলোর পরিচয় পেত পাঠকেরা তার গুনগানও করেছেন। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে অনুবাদের জোয়ার থাকলেও তা মূলত নির্দিষ্ট এক জনরা কেন্দ্রিক। সামগ্রিক সাহিত্যের প্রতি প্রকাশক অনুবাদকদের নজর কম। বাংলা ছোটগল্পের প্রবাদপুরুষ রবীন্দ্রনাথের 'শেষ হইয়াও হইলনা শেষ' অনুভূতি পাঠকের মনে রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে। এই রোমাঞ্চ সৃষ্টির প্রক্রিয়া মোঁপাসার নিজস্ব আবিষ্কার। অন্যদিকে চেখফ দেখালেন যে, ক্লাইম্যাক্স না দিয়েও সরস গল্প লেখা যায়।
ভারতের বরোদাতে আলাপ হয়েছিল ডাঃ কোন ভিনারের সাথে। হিটলারের শাসনামলে সস্ত্রীক জার্মানি ছেড়ে ইংল্যান্ড চলে যান এবং সেখান হতে ভারতে চাকরি জুটিয়ে নেন। জার্মানিতে বৃদ্ধা মায়ের খোঁজ নেওয়ার জন্য লেখককে অনুরোধ করেন এবং লেখক জার্মানি গেলেকাজটি সম্পন্ন করেন। এই গ্রন্থটির সবচেয়ে মর্মস্পর্শী লেখা হলো 'কোদণ্ড মুথহানা'। কোদণ্ড মুথহানা মিশরের একজন চা ব্যবসায়ী। ভারতের কান্নাড়া অঞ��চলে জন্মেছিলেন। ভাগ্যান্বেষণে কায়রোতে চা পাতার ব্যবসা শুরু করেন। বিয়ে করেছিলেন সাইপ্রাসের এক মেয়েকে। সংসার সুখেরই ছিল অন্তত লেখকের সাথে পরিচয়ের পূর্বে। ব্যবসার কাজে এসেছিলেন ভারতে। কিন্তু ফিরে গিয়ে দেখতে পান ব্যবসা যার ভরসায় রেখে গিয়েছিলেন, সেইই তাকে পথে বসিয়েছে। পুনরায় ব্যবসা গোছানোর কাজে নেমে পড়েন। তাঁর ইচ্ছাশক্তি ও উদ্যম দেখে অবাক হয়ে যান লেখক।
ঐতিহাসিক উপন্যাস নিয়ে লেখকের ভাবনা ও উপস্থাপিত গল্প পাঠককে আনন্দ দেবে। বইটির অনেকগুলো গল্প আছে কায়রো কেন্দ্রিক। কায়রোর আড্ডা, সংস্কৃতি ইত্যাদি ফুটে এসেছে গল্পগুলোতে। জার্মানিতে ছাত্রাবস্থায় যখন সার্টিফিকেট সাবমিট করতে যান তখন দপ্তরি কৌতুক করে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার সার্টিফিকেট চান। পুলিশের ধাওয়া খেয়েও কীভাবে বেঁচে গিয়েছেন সেই গল্পেরও দেখা পাই আমরা। জাওয়ারব্রাখ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাসপুতিন, নন্দলালসহ আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির উপর লিখিত প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে বইটিতে।
সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা পড়ার সবচেয়ে বড় লাভ হলো বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, ভাষা এবং আমোদপূর্ণ গল্পের সাথে পরিচিত হতে পারা। অবশ্যই এই বিষয়গুলো রসাত্মক বর্ননার সাহায্যে উপস্থাপিত হয়, যা পাঠককে আনন্দিত করে। অনেকেই সৈয়দ সাহেবের লেখাকে জটিল ভেবে পড়তে চান না, তাদের বলবো একটানা এই প্রবন্ধগুলো না পড়ে দুই একটা করে পড়ুন। সহজ লাগবে আবার উপভোগও করতে পারবেন। হ্যাপি রিডিং।
গত জন্মদিনে প্রিয় বন্ধু আচমকাই উপহার হিসেবে গছিয়ে দেয় সৈয়দ মুজতবা আলীর পুরো সমগ্র। ভদ্রতার খাতিরে তখন বলেছিলুম "আহ! কি দরকার এসবের।" কিন্তু আমিই খালি অনুভব করেছিলাম, কতটা ভালো লাগা কাজ করেছিলো আমার মধ্যে। কিন্তু ধরি ধরি আর ধরা হচ্ছিলো না সমগ্রটা।
মাঝখানে টুকটাক আলী সাহেবের লেখা পড়লেও 'পঞ্চতন্ত্র' দিয়া শুরু হলো পুরো অভিযান। বিশাল একটা মন খারাপ আর ঘোরের মধ্য দিয়ে যেন শেষ হয়ে গেল পঞ্চতন্ত্রের দুইটা খন্ড। আহ এত ভাল লাগা! যদিও প্রথম থেকে আলী সাহেবের রচনাশৈলীর সাথে বিবর্তিত হতে একটু বেগ পেতে হয়েছিল।
ডজন খানের প্রবন্ধের এই বই যখন আপনি পড়া শুরু করবেন, তখন অবশ্যই আপনাকে ভরা পেটে তাকা উচিৎ। খিধা নিয়ে এই বই পড়া বিপদজনক। আহ! আলী সাহেব এত সুন্দর করে এত সব বিচিত্র খাওয়ার বর্ণনা করেছেন রোজা রেখে রীতিমত জিভে জল এসে গিয়েছিল।
এরপর বইটা যখন পড়া শুরু করলেন, প্রথমেই পাবেন 'বই কেনা' প্রবন্ধ খানা। হাসতে হাসতে আলী সাহেব আপনাকে "ব্রেন ওয়াশ" করে দিবে। আপনি যদি ট্যাকাওয়ালা পাবলিক হোন, তাহলে তক্ষনি দৌড় দিবেন হয় রকমারিতে না হয় আজিজ কিংবা নীলক্ষেতে। আর আমার মত মরা আদমি হলে, কখন নতুন কিছু বই কিনবেন, এই আশায় বেহুঁশ হবেন বারবার।
বিনা খরচে বিশ্বভ্রমন করতে চাইলে আপনার জন্য এই বই। শুরু করলেন বিলেতগামী কোনো জাহাজে করে,মাঝখানে সুয়েজ বন্দরে নেমে ঘুরে এলেন কায়রো থেকে। এরপর কদিন বাদে ঘুরে আসলেন জর্মন, ফরাসি দেশ থেকে। আবার ভারতে, আবার মন চাইলো চলে গেলে সুইজারল্যান্ড। আহ বিচিত্র সব দেশের বিচত্র সৌন্দর্য এক সাথে এক প্যাকেজে পেতে চাইলে এই বই। আলী সাহেবে ভাষায়, "বিশ্ব-সংসার আমাকে বাঁদর-নাচ না নাচিয়ে ছাড়বে না।"
এত সব তথ্য, এত উঁচুমানের হিউমার দিয়ে সাজানো শিক্ষণীয় বই আমার জানামতে খুব কমই আছে। এই যেমন ভাষাতত্ব আলোচনা করতে গিয়ে মুজতবা আলী বলেন, "ফরাসি ভাষাটা সবসময় ঠিক বুঝতে পারি কি না বলা একটু কঠিন। এই মনে করুন, কোনও সুন্দরী যখন প্রেমের আভাস দিয়ে কিছু বলেন, তখন ঠিক বুঝতে পারি; আবার যখন ল্যান্ডলেডি ভাড়ার জন্যে তাগাদা দেন তখন হটাৎ আমার তাবৎ ফরাসি ভাষাজ্ঞান বিলকুল লোপ পায়।"
লেখকের ভাষায় যদি বলি, "এ রকম আরও বহু মজার মজার কথা আছে এই অসাধারণ পুস্তকে; বস্তুত পুরো বইখানাই হাস্যরসের কুমকুমে কুমকুমে ভর্তি। পাঠকের চটুল হৃদয়ে একটুখানি চাপ পড়লেই আবীরে আবীরে ছয়লাপ। কিন্তু এর ফাঁকে ফাঁকে আবার ট্র্যাজেডির করুণ রসও আসে বলে সে রস যেন জল এনে দেয় চোখের পাতায়, বুক ভরে দেয়, নিবিড়তর ব্যথায়-- আরও বেশি"
পন্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলী নিজ জীবনে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন, অনেক মানুষের সাথে মিশেছেন। জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা দুই দিক থেকেই তিনি অন্য অনেকের থেকেই আলাদা। পঞ্চতন্ত্র বইটি ওনার জনপ্রিয় বইগুলোর মাজে অন্যতম। বইয়ের প্রতিটি প্রবন্ধই অত্যন্ত সরস। যারা মনে করেন প্রবন্ধ পড়াটা খুবই বিরক্তিকর, ধৈর্য ধরে রাখা মুশকিল, তাদের এই বইট পড়ার পরামর্শ দিব।
বইটিতে মুলত লেখক নানা ডংয়ে নিজের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, মতামত ও ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
রম্যগদ্যের জাদুকর সৈয়দ সাহেবের ছোট কলেবরের লেখাগুলোর শ্রেষ্ঠ সংকলন বলা চলে এটিকে। তাঁর স্বভাবসুলভ চটুল গল্প ফাঁদা, বিনয়ের অবতার সেজে হরহামেশা অভিনব তথ্য দিয়ে আমাদের বিমোহিত করা, ইতিহাস, সাহিত্য আর ভাষা নিয়ে তাঁর অগাধ জ্ঞান দিয়ে বারংবার আমাদের তাক লাগিয়ে দেয়া। সাথে বিদেশ যাত্রা ও অবস্থানের মজার ও আবেগী কাহিনীগুলো দিয়ে আমাদের হাসানো, কাঁদানো ও ভাবানো। তিনি খোশমেজাজের আবেগী লেখক। মানুষের কাছে যেয়ে তাকে আপন করে নেয়ার দুর্লভ গুণ ছিল তা তাঁর লেখা থেকে বুঝা যায়। আবার তিনি অসামান্য গুল মারতে পারতেন তা তিনি নিজেই স্বীকার করেন। অতএব চোখের জলের বা অতি নৈকট্যের গল্পগুলো কতখানি সত্য আর কতখানি চাট্টি - সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সবকিছুর পরও মোদ্দা কথা - তাঁর লেখা পড়তে ভাল্লাগে। অসম্ভব ভাল্লাগে। এই বইয়ের প্রথম পর্বে ক্লাসিক রম্যরচনাগুলো অতি চমৎকার। দ্বিতীয় পর্বে আরো পরিশীলিত, কিছু বড় গল্পের সন্নিবেশ হয়েছে। আনন্দ লাভ তাঁর সকল গল্পেই সমান। এতে আছে তাঁর মিশর, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, বরোদা প্রিন্সলি স্টেট আর শান্তিনিকেতনসহ আরো নানা স্থানে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে অসামান্য কিছু গল্প। আছে ভাষা, হতভাগ্য মিজো নৃগোষ্ঠী, হিটলার-য়প্প্এর জার্মানি নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা। আছে ইতিহাসের নন্দিত-নিন্দিত পুরুষের কাহিনী। কখনো হিটলারের উল্লেখ এসেছে, এসেছে হ্যোসের কথা, এসেছে রাসপুতিন, আবার এসেছে রবিঠাকুর (আলী সাহেবের গুরুদেব), বাদশা বাবুর, সুলতান মাহমুদ, সম্রাট মুহম্মদ তুঘলক, গান্ধী, নন্দলাল বসু, ৩য় সায়াজীরাও গায়কোয়াদ, ওস্তাদ ফৈয়াজ খান, হিডজিভাই পি মরিস, জাওারব্রুখ, শ্বোয়াইৎসার, মোপাসাঁ, চেখফ, নেতাজি সুভাষসহ প্রথিতযশা বহু সাহিত্যিক, পণ্ডিত, কবি। তাঁর মননের উচ্চতা, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-লিঙ্গ সবকিছুকে পেছনে ফেলে মানুষকে মানুষ হিসেবে আলিঙ্গন করার ক্ষমতা, শিল্প-কলা আর সাহিত্য নিয়ে সুগভীর চিন্তাভাবনা, ভাষার প্রতি অতল আগ্রহ - এসকল কিছু নিয়ে হযরত মুজতবা সাহেব (পীরের বংশধর) যে পসরা নিয়ে আমাদের সামনে আসেন তা সত্যিই উপভোগ্য। একবার নয় বারবার। তাঁর টোটকাধর্মী গল্পগুলো বা নিখাদ রসিকতার জন্য জমানো লেখাগুলো সবসময় এক অনন্য আবেশ নিয়ে আসে। খাঁটি বাঙালির ভোজনপ্রিয়তা আর ইলিশের প্রতি সীমাহীন দুর্বলতা নিয়ে তিনি যেন আমাদের হৃদয়ের কাছের লেখক। আমাদের অতি আপন। ঘরের সেই মজার মজার গল্পবলা চাচ্চু।
অনেক কিছু লিখব ভেবেছিলাম, কিন্তু মুজতবার সরসতা এতই বিরল এবং চমৎকার যে আমার মত গণ্ডমূর্খের ও আলোচনায় যাবারই দরকার নেই।
সরসতা অতি গভীর জিনিস, নেহাত কাউকে অপদস্ত না করে, সুড়সুড়ি না দিয়ে, শুধুমাত্র প্রাণের মধ্যে খুশির লহর বইয়ে দেওয়া সহজ নয়। বাংলা সাহিত্যে এমন দক্ষতা দেখাতে পেরেছেন মাত্র দুজন, আমার মতে। পরশুরাম(রাজশেখর বসু) আর আমাদের সৈয়দ সাহেব। রাজশেখর এখনো পড়িনি, তবে একথা বলতে পারে, সৈয়দ সাহেবের কোন বই হাতে নিয়ে গোগ্রাসে গিলতে কোন রিভিউ এর প্রয়োজন হয় না।
মুজতবা আলী একজনই, ওয়ান এন্ড অনলি। ছোট ছোট গল্পে যেমন হাস্যরস আর ভাষার কেরদানি আছে, তেমনি অনেক গল্পেই আছে শিক্ষা,প্রেম, সমাজসচেতনতার পাঞ্চ। তাই গল্পগুলিকে নেহাত হাসির গল্প বলে পড়লে আপনি মুজতবাকে পুরো বুঝতেই পারবেন না!
এমন হাস্যরসের মাধ্যমে কোন গভীর জীবনদর্শন তুলে ধরা সহজ কথা নয়। আর যে ইউনিক ভাষা! আমি শিওর, একটা র্যান্ডম লাইন পড়লেই বোঝা যায় ওটা সৈয়দ সাহেবের লেখা কিনা! উপমা, অনুপ্রাস আর ভূয়োদর্শিতায় ভরপুর এমন লেখা তার পর বঙ্গদেশে আর কোন আল্লাহর বান্দা লিখতে পারেননি।
পড়া শেষ করতে অনেক সময় লাগল। লেখক আসলে অনেক বিজ্ঞ হওয়ার হেতু অনেক সমস্যা অথবা বিষয় সাধারণের গ্রাহ্য করাটা একটু কষ্টকর। তথাপি আমার জ্ঞান অনেক কম, আর কিছু জ্ঞানার্জন করতে পারলে হয়ত বুঝতে পারব। সে আশায় থাকলাম।
অনেকগুলো ছোট ছোট স্মৃতি গল্পের আকারে এই বইয়ে লিপিবদ্ধ। কখনো ইচ্ছে হলেই একটা দুইটা গল্প পড়ি, আবেগউদ্বেলিত হই, মুজতবা আলীর আনন্দ বেদনার সামিল হই এভাবেই একটু আধটু করে বারবার পড়ি! চমৎকার বই!
অনেক দেশ ঘুরাঘুরি একই সাথে বিভিন্ন মানুষের কাছাকাছি থেকে তাদের সাথে নিজের ভাবের আদান প্রদান করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তা নিজের কাছে রেখেদেন নাই লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। বিভিন্ন সময়ের ভ্রমণের সেই অভিজ্ঞতা লিখে রেখেছেন একই সাথে ভিন্ন দেশের মানুষের কাছাকাছি গিয়ে তাদের সেই গল্পও তিনি আমাদের শুনিয়েছেন।
"পঞ্চতন্ত্র " লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর দুই খন্ডের এক প্রবন্ধ গ্রন্থ। কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে নয় এই প্রবন্ধ গুলো। এর মধ্যে আছে ছোট ছোট গল্প আকারে লেখা, আছে নিজের অভিজ্ঞতা, অন্যের কাছে শোনা গল্প, স্মৃতিকথা, সমসাময়িক বিষয়, দেশ ভ্রমণের গল্প যাতে আছে নিজের ও অন্যদের গল্প। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়েই এই গ্রন্থ।
বইটার কিছু প্রবন্ধ আগে পড়া ছিলো, এখন আবার সবগুলো পড়লাম। যারা প্রবন্ধ নাম শুনেই ভয়ে পড়ার আগ্রহ হারায় ফেলেন তারা লেখকের প্রবন্ধ অনায়াসেই পড়তে পারবে কারন গল্প দিয়ে দিয়েই যেন সাজানো সব গুলো, সাথে আছে ভ্রমণকাহিনি। কিছু প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে আমি ভুলেই গেছি আসলে ভ্রমণ কাহিনি পড়ছি না প্রবন্ধ। তাছাড়া ছোটবেলায় পড়া "বইপড়া" প্রবন্ধ টা আছে এই বইয়েই। লেখকের লেখা মানেই অন্য কিছু।
শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী লিখেছিলেন, “মুজতবা আলীর ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে বিচিত্র ও মিশ্র উপাদানে”। এই বক্তব্যের সার-সংক্ষেপটুকু আমার মতে ‘পঞ্চতন্ত্র’ বইটিতে ধরা পড়ে সবচেয়ে বেশি করে। মোট ৩৫টি প্রবন্ধের ডালি সাজানো আছে এতে। বিষয়ের বিবেচনায় সেখানে যেমন আছে ভ্রমণ ও দর্শন, ভাষা ও সাহিত্যতত্ত্ব, শিক্ষা ও শাস্ত্রচর্চা, তেমনি আছে আড্ডা। নানা রঙের তুলিতে আঁকা যেনো একটি রঙিন ক্যানভাস। রসের প্রায় সবকটি অঙ্গই এখানে খেলা করে। ‘মার্জারনিধন কাব্য’ বলে একটি লেখা আছে কবিতার ছন্দে লেখা। এটা পড়লে পাঠক হয়তো বুঝে যাবেন, বাঙলায় কেনো ‘বাসর রাতে বিড়াল মারার’ গল্পটি চালু হয়েছে। আর ভাষার তাক লাগানো প্রয়োগ তো আছেই।
আমার মনে হয়, ‘পঞ্চতন্ত্র’ কেবল পড়ে রেখে দেবার বই নয়; বারবার পড়ে মনে রাখার মতো বই। বইটি পড়ে বেশ জোর গলায় নিজেকে বলা চলে- “আমার ভাণ্ডার আছে ভরে...”।
এই বইটা পড়তে গিয়ে খেয়াল করলাম সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা পড়েছি অথচ অসাধারণ লাগে নাই,এরকম কখনো হয় নাই।নি:সন্দেহে প্রিয় লেখকদের একজন তিনি। পঞ্চতন্ত্র তাঁর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে কয়েকটি লেখার সংকলন।
বর্তমান জেনারেশন হুল্লোড়ে আড্ডাবাজ নয়। আমি একজন আড্ডাবাজ লেখকের কথা বলব যাকে সেই শুরু আমার বিষম ভালো লাগে। 'আড্ডাবাজ' বললাম বলে আবার অনেকেই নাক সিটকবে কিন্তু তারমতন রসকষে পরিপূর্ণ স্টোরি টেলার বাংলায় বোধকরি আর দুটি নেই। বাংলায় যে দু একটি কথা সর্বসাধারণ জানে যে 'বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না' সেই কথাটা এই আমুদে ষোলআনা রসকষে পরিপূর্ণ পণ্ডিত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। তার লেখা পড়া আসলে এক বহুজাতিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া। মুখে মুখে বলা গল্প তিনি লেখেন। বিচিত্র তার অভিজ্ঞতা।
গল্প বলতে, শোনাতে তিনি দারুণ পছন্দ করেন। জীবনকে কীভাবে এনজয় করা যায় তার স্পষ্ট প্রকাশ তার লেখায় দেখতে পাওয়া যায়। আড্ডা এ কারণেই মুজতবার প্রধান ফর্ম। এ কারণেই মুজতবাকে দেখি আড্ডায়—কলকাতায়, কাবুলে, প্যারিসে, বার্লিনে আর কায়রোয়। এ কারণেই নিশাচর শহরের প্রতি তাঁর দুর্মর পক্ষপাত। যাকে বলা যায় পাবলিক স্পেইস—জনপরিসর, সে রকম আখড়ায় তাঁর আসর জমে প্রায় রুটিনমাফিক। তাতে নানা সংস���কৃতির বহুবিচিত্র মানুষের সমাগম। আড্ডার শরিকেরা সবাই রসিক। রসের রসিক। উপভোগের রসিক। তথ্য-উপাত্ত আর পাণ্ডিত্যে তারা টইটম্বুর। কিন্তু মুজতবার আড্ডায় তথ্য আর পাণ্ডিত্য ভার হয়ে আসে না। প্রতিহত করে না। কারণ, সেখানে উপভোগের সাদর আমন্ত্রণ আছে। প্রধান শরিকদের পাশে আরও অনেকেই আছে। তারা কথা বলে না। কিন্তু আড্ডার রস উদ্যাপনে কোনো বাধা নেই। এরাই মূলত পাঠক। মুজতবার লেখা পড়া মানে আড্ডার সজীব সপ্রতিভ কথামালার অংশীদার হওয়া। মুজতবা এমন জমানার মানুষ, যখন কলকাতায় ‘সংস্কৃতি’ একটি উচ্চতম বর্গ হিসেবে পরম প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ওই সংস্কৃতি-ধারণায় সংকীর্ণতা ছিল, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছিল। মুজতবা এই সংকীর্ণতা ও বিদ্বেষ ভাব থেকে বেশ অনেক দূর পর্যন্ত মুক্ত ছিলেন। তখন ভারতীয়রা কেবল আর পশ্চিমের কথা শুনছিল না, পশ্চিমকে ভারতের কথাও শোনানো শুরু করেছিল। মুজতবা নিজের আবিষ্কৃত আড্ডার ফর্মে একজন ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিতেন। তাতে হীনম্মন্যতার লেশমাত্রও ছিল না। ছিল বহুজাতিক অভিজ্ঞতার মধ্যে নিজের হিস্যা উপস্থাপনের আর আদায়ের সক্রিয়তা। উদারনৈতিক ভাব-পরিসরে নিজেকে মজলিসি কেতায় উদযাপনের ভঙ্গিতে হাজির করতে পেরেছিলেন বলেই সহস্র ভ্রমণকাহিনি আর রম্য রচনার ভিড়ে মুজতবাকে সহজেই চিনে নেওয়া যায়।
জীবনকে উদযাপনের মতো যাপনের প্রতি সৈয়দ মুজতবা আলীর নিদারুণ আগ্রহ ছিল, কিন্তু হাহাকার ছিল না। হাহাকার না থাকার কারণ, জীবন স্বয়ং উদযাপনের বিচিত্র বর্ণিল সাজে ধরা দিয়েছিল তাঁর জীবনে। তাঁর কলম ছিল সেই জীবনের বিশ্বস্ত আজ্ঞাবাহক।
বইয়ের নামকরণ সার্থক হয়েছে কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। সন্দেহ বিলকুল অমূলক নয় তাও প্রমাণ করতে পারছি নে। প্রায় সব রচনায় অসাধারণ। পড়ি আর ভাবি 'এ জিনিস তো আমার মতো অভাজনের লেখা সম্ভব নয়।' মানে বই পড়ার সময় পাঠক হিসেবে লেখকের লেখনীর এপাশ-ওপাশ করে নিজের মনের মতো গোছানোর কার্যটা সৈয়দ সাহেবের লেখার ক্ষেত্রে করে উঠতে পারিনে। বইয়ের রচনাগুলো ঠিক কোন কিসিমের এও বলা মুশকিল। কোথাও হাস্যমুখে কাজের বাত, আবার কোথাও সিরিয়াস ভাষায় গালগল্প। ' পুলিনবিহারী' পড়ে মনে হয় প্রকৃতি নিজে ওঁর হাতে কলম তুলে দিয়েছে। কথা একেবারে মিথ্যে না। রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবেশ, ধর্ম সবই বইয়ে আছে। দু একখানা পড়ে যে বিরক্ত হইনি বলছিনে। তবে তার কারন যে আমার নিজের অজ্ঞতা তা বলতে মোটেই পিছপা হচ্ছি না।
সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখার জনরা ডিফাইন করা অত্যন্ত কঠিন। অনেকে মোটাদাগে তার বেশিরভাগ লেখাকেই ‘রম্যরচনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন বটে তবে সেটাতে লেখাগুলোর প্রতি সুবিচার একেবারেই হয় না। তবে এই অবিচারটা আরো চরমে পৌছে যখন বিজ্ঞজনেরা মুজতবা সাহেবের নাম নিলে সাথে এটাও জানাতে ভোলেন না ব্যাটা রম্যলেখক। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী প্রাবন্ধিককে শুধুমাত্র ভাঁড় হিসেবে রিডিউস করে রাখার মাজেজা আমার ক্ষুদ্র মাথায় ঢোকে না।
লেখায় স্বভাবজাত উইট থাকলে বা সূক্ষ্ম রস থাকলেই সেগুলো রম্যরচনা হয়ে যায়না। মুজতবা সাহেবের লেখা পড়ে ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে বটে তবে তার চেয়েও লেখকের প্রজ্ঞা, জ্ঞান, প্রত্যুৎপন্নমতিতা এবং লেখনীর উপর শ্রদ্ধা আসে বেশি।
বিষ্ণু শর্মা বিরচিত সংস্কৃত পঞ্চতন্ত্রের একক উদ্দেশ্য জ্ঞান ফলানো হলেও মুজতবা সাহেবের পঞ্চতন্ত্রের সত্তরটি প্রবন্ধে অনেক জ্ঞান-বুদ্ধির ঝনঝনানি আছে ঠিকই কিন্তু তাতে চোখ ঝলসে যায় না বরঞ্চ, শানে মুগ্ধ হতে হয়।
মুজতবা আলীর জ্ঞান অনেক অনেক, একটা মানুষ ভিন্ন ভিন্ন এত বিষয়ে জ্ঞান কিভাবে রাখে? প্রাচীন ভারতের বই থেকে নিয়ে বিবর্তনের মিসিং লিংক সব কিছুরই রেফারেন্স আছে। প্রবন্ধের বই, প্রবন্ধের বিষয় নিজের আগ্রহের ভিতর থাকলে প্রবন্ধটি ভাল লাগবে না থাকলে হয়ত লাগবেনা৷ এত ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ আছে, তবুও শেষ দিকে কেন জানি একটু, অতি একটু একঘেয়ে লেগেছিল।
আমার কাছে ভাষা প্রাঞ্জল মনে হয়নি। লেখার প্রেক্ষাপট আমাদের এখনকার প্রেক্ষাপট থেকে আলাদা৷ সম্ভবত তাই কিছু অনুচ্ছেদ out of context মনে হয়েছে। কিছু ঘটনা সত্যি অসাধারন, বইয়ের একটা বড় অংশ জার্মান ফরাসি সাহিত্য নিয়ে লেখকের ভাবনা, যা আমার মত সাধারণ পাঠকের কাছে কিছুটা অনুধাবন করা শক্ত।
আগে থেকে মুজতবা আলী পড়ে থাকলে। কিছুটা আশাহত হবেন। পান্ডিত্য আছে। রসবোধ আছে। মুজতবার চিরচেনা ঢঙেই লেখা। তবে কিছু একটা যেন নাই। মানে সব শুধু থেমে থেমে। অনেকের ভাল লাগতে পারে। অনেকের নাও লাগতে পারে। আমার অতোটাও ভাল লাগে নাই।