Sharadindu Bandyopadhyay (Bengali: শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়; 30 March 1899 – 22 September 1970) was a well-known literary figure of Bengal. He was also actively involved with Bengali cinema as well as Bollywood. His most famous creation is the fictional detective Byomkesh Bakshi. He wrote different forms of prose: novels, short stories, plays and screenplays. However, his forte was short stories and novels. He wrote historical fiction like Kaler Mandira, GourMollar (initially named as Mouri Nodir Teere), Tumi Sandhyar Megh, Tungabhadrar Teere (all novels), Chuya-Chandan, Maru O Sangha (later made into a Hindi film named Trishangni) and stories of the unnatural with the recurring character Baroda. Besides, he wrote many songs and poems.
Awards: 'Rabindra Puraskar' in 1967 for the novel 'Tungabhadrar Tirey'. 'Sarat Smriti Purashkar' in 1967 by Calcutta University.
ঐতিহাসিক উপন্যাস হলেও ইতিহাসের কচকচানি কম। বরংচ গল্পটাই বেশী। আর সেই গল্পে রাজা দেবরায় একজন বিচক্ষণ রাজা যে কিনা ক্ষয়িঞ্চু হিন্দু সমাজকে টিকিয়ে রেখেছেন মুসলমানদের আধিপত্যের ফলেও। অর্জুনবর্মার মত ভৃত্যকে কিভাবে কাজে লাগাতে হয় আর রাজত্ব কিভাবে শত্রুর কাছ থেকে নিরাপদ রাখতে হয় তাহা বিচক্ষণতার মাধ্যমে রাজা প্রমাণ করেছে। মণিকঙ্কণা চরিত্রটি শান্ত ও সুশ্রী লেগেছে। এ উপন্যাসে সব ধরনের রসদ পেয়েছি আমি। ঐতিহাসিক, রোমান্টিক, রহস্য, হরর এবং সামাজিক আবহ। মোট কথা অনন্য এক সাহিত্য।
শুরু ১৩৫২ বঙ্গাব্দের প্রারম্ভকালেই। কলিঙ্গ দেশের রাজকন্যা বিদ্যুন্মালা তিন তিনটি নৌকার নৌবিহার নিয়ে চলছে বিজয়নগর রাজ্যের দিকে। বিজয়নগরে কলিঙ্গ রাজ্যের রাজকুমারি বিদ্যুন্মালার বিবাহ হবে রাজা দেবরায়ের সহিত। তৎকালীন সময়ে রাজাধিরাজ দেবরায় খুব প্রতাপশালী ছিলো যাহার ধরুণ তাহার শত্রুও কম ছিলো না। এজন্যই বিবাহ করিবার উদ্দেশ্যে সুদুর কলিঙ্গে যেতে শত্রু কর্তক প্রাণনাশের হুমকির আশঙ্কার ধরুণ কন্যাপক্ষই আসতেছে সদলবলে। কলিঙ্গ রাজ্য থেকে বিজয়নগর রাজ্য মাস তিনেকের পথ। প্রতিপত্তি বাড়ানোর তাগিদে রাজা দেবরায় কলিঙ্গ রাজকুমারি বিদ্যুন্মালা কে চতুর্থতম রাণী করতে যাচ্ছেন।
তিন মাসের সুদীর্ঘ যাত্রাপথের প্রায় শেষ পক্ষে হঠাৎ দুপুরবেলা বিদ্যুন্মালা দেখলো নৌকার অদূরে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছেন একজন। প্রহরীকে ডেকে লোকটিকে উদ্ধার করতে পাঠালো রাজকুমারি। বেঁচে গেলো সে লোকটি। যার নাম অর্জুনবর্মা। বিজয়নগর পৌছে যাবে এমন সময় ঘটে যায় আকস্মিক ঝড়ের ধরুন সিটকে পড়ে যায় নৌকাগুলোর আরোহী একেকদিকে। বিদ্যুন্মালাকে অর্জুনবর্মা অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে একটি ভাসমান দ্বীপে তুলে আনে। অন্ধকার রাত দ্বীপে তারা দুজন, বিদ্যুন্মালা জ্ঞান ফিরে এলে নিজেকে এভাবেই আবিষ্কার করে। অর্জুনবর্মার প্রতি একটা আকর্ষণ কাজ করে এ ঘটনায়। বিদ্যুন্মালা আগে থেকেই রাজা দেবরায়ের চতুর্থ রাণী হতে অসম্মত ছিলো। পরদিন প্রভাতে রাজার দেবরায়ের লোকজন তাদের কে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। পরপুরুষ ছুয়ে দেওয়াতে বিয়ে তিন মাস পিছিয়ে যায় বিদ্যুন্মালার। এ তিন মাসের মাঝেই বিদ্যুন্মালা আপন করে নেয় অর্জুনবর্মা কে। দুইজনই মারাত্নক ভাবে জড়িয়ে পড়ে এ ভয়াবহ প্রেম জালে।
কি হবে এর শেষটা? বিদ্যুন্মালা এবং অর্জুনবর্মার প্রেম রাজার কান পর্যন্ত পৌছালে কি ঘটবে? রাজাধিরাজ দেবরায় কি ভয়ংকর হবে না তাদের প্রেমকে মেনে নিবেন !!! এরকম উপন্যাস ফেলে রাখার কোন মানে নেই। পড়ে ফেলুন অতিসত্বর।
তুঙ্গভদ্রায় অবগাহন করার ইচ্ছা আপাতত ছিল না। কিন্তু বিজয়ের ৫০তম বছর পূর্তির আগের রাতে ট্রাফিক জ্যামের জমাজমিতে আর চারপেয়ে যন্ত্রের প্যাঁ পুঁ বাজনা শুনে এই শীতেও যখন ঘামছিলাম তখন ভাবলাম ঠান্ডা হওয়া দরকার। রাতের অন্ধকারে তখন মির্চিই ভরসা :)
তুঙ্গভদ্রার তীরে ভীড়েছে তিনটি বিশাল নৌকা। যার একটিতে আছেন দুই রাজকুমারী বিদ্যুন্মালা এবং মনিকঙ্কনা। বিদ্যুন্মালা এসেছেন এ রাজ্যের রাজাকে বিয়ে করতে ( ওয়েল! একটু উইয়ার্ড। তবে সঙ্গত কারণেই রাজামশাই বিয়ে করতে যেতে পারেননি। ) এরপরে দেখা যায় অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেম আর কাঙ্ক্ষিত বিশ্বাসঘাতকতা।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা শিউলির সাদার মতো নরম আর কমলার মতো পোক্ত। কাজেই উপভোগ না করে নিস্তার নেই। মির্চির পরিবেশনা অনবদ্য।
রাজকুমারী কি কখনও প্রেম নিবেদন করে? দেখেছেন থুক্কু দেখার তো কথা না, শুনেছেন কখনও?
আসলে নারীদের এমনভাবে সৃষ্টিকর্তা তৈরি করেছেন যে তাদের বুক ফাটে তো মুখ ফাটে না। আর তাই প্রেম নিবেদন ব্যাপারটা যুগে যুগে এমন একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন ওটা পুরুষের এক চেটিয়া সম্পত্তি। কলিকাল বলে কিছু কিছু দুঃসাহসীনীরা মাঝেমধ্যে সেই অকাজটি করে ফেলে বটে! যাকগে! যা বলছিলাম... রাজকন্যা মানে হলো গিয়ে রাজার কন্যা। আর সেই কন্যাদের পাণিপ্রার্থী হবার জন্য যুগে যুগে কতো রাজা, রাজকুমার কতো কি-ই না করেছেন। যুদ্ধ, সন্ধি কিংবা কূটকৌশল ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে ব্যাপারটা আসলে কী! রাজকন্যা হবার বেশ কিছু বিপদও আছে। এই রাজার সাথে অই রাজার দ্বন্দ্ব, যুদ্ধে সমাধান হবার নয়.. তবে লাগাও বিয়ে। যুদ্ধে হেরে গেছো? সন্ধি প্রয়োজন? তবে দুই দেশের রাজায়-রাজকন্যায় লাগাও বিয়ে। কোন রাজা নিজ দেশের নিরাপত্তা দিতে পারছে না? তবে বড় কোন রাষ্ট্রের সাথে সম্বন্ধ পাতিয়ে নিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এসবের বলি হতেন রাজকন্যারা। তারা যেন সন্ধির হাতিয়ার, রাজনীতির বলি আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র।
কিছুটা ঐ রীতি মেনেই কলিঙ্গ দেশের রাজকন্যা বিদ্যুন্মালার সাথে বিয়ে ঠিক হয় বিজয় নগরের রাজা দেবরায়ের সাথে। সাধারণত রাজারা বাদ্য বাজনা বাজিয়ে বিয়ে করতে গেলেও ওদের বিয়েতে ঠিক সেটা ঘটল না। বিজয় নগরে শত্রুর হামলার আশংকা আছে। সেই সাথে আছে আরও নানাবিধ কিছু যন্ত্রণা। আর তাই রাজা বিয়ের জন্য কলিঙ্গে যেতে পারবেন না। অগত্যা রাজকন্যা ছোটবোন মণিকঙ্কণা, মাতুল, রাজবৈদ্য ও একজন পরিচারিকাকে সাথে নিয়ে সৈন্য পরিবেষ্টিত হয়ে রওনা হলেন বিজয় নগরের উদ্দেশ্যে৷ উপরে উপরে আসন্ন বিয়ের জন্য প্রস্তুত হলেও মনে শান্তি নেই তার। তার যে রামচন্দ্রের মতো রাজা পছন্দ। মানে এক রাজার এক রানী হতে চান তিনি অর্থাৎ স্বামীর ভাগ কাওকে দিতে আগ্রহী নন। অথচ রাজা দেবরায়ের তিন পত্নী বর্তমান। কি আর করা.. ভগ্ন হৃদয়ে জলপথে রওনা হয়ে যান মালা।
পথে ঠিক বিপত্তি না একটা ছোট্ট ঘটনা। মাঝপথে তুঙ্গভদ্রা নদীতে ভেসে যাওয়া এক তরুণকে উদ্ধার করে রাজকন্যার সেনারা। আবার সেই ক্লান্তিকর যাত্রা। বিজয়গড়ে পৌঁছবার আর মাত্র কিছুকাল বাকি.. হবু রাণীর আগমন উদ্দেশ্যে রাজ্যের আনন্দ উৎসবের শব্দ শোনা যাচ্ছিল-এতোটাই কাছে পৌঁছে গিয়েছিল অভিযাত্রীরা। তখনই ঈশাণ কোণে অল্প অল্প করে জমতে থাকা মেঘ হুট করে জমাট হয়ে হয়ে শুরু হলো দমকা বাতাসের সাথে ঝড়ো বৃষ্টির। রাজকন্যা বিদ্যুন্মালা সামলাতে পারলেন না নিজেকে, নৌকা থেকে ছিটকে পড়ে গেলেন পানিতে। ডুবে যাবার সময় অচেতন হতে হতে অনুভব করলেন কেউ একজন টেনে তুলছে তাকে।
রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহর, ঝড় থেমে গেছে। জ্ঞান ফিরে বুঝতে পারলেন একটা দ্বীপে আটকা পড়ে গেছেন। তিনি আর তার উদ্ধারকর্তা, অর্জুনবর্মা। ভাগ্যের কী পরিহাস.. কিছু কাল আগে রাজকন্যা জীবন বাঁচিয়েছিলেন অর্জুনবর্মার প্রাণ আর সেই ঋণ শোধ করতেই বুঝি বা সে আজ তার উদ্ধারকর্তা। সে রাতটুকু কথা বলে কাটিয়ে দিলেন দু'জনে। ভোরে রাজার ছোটভাই এসে এই নির্জন দ্বীপ থেকে উদ্ধার করে তাদের৷ তারপর?
তারপর আর কি.. যে যার পথে।
অর্জুন রাজার সৈন্যদলে কাজ জুটিয়ে নিলো আর রাজকন্যা তিন মাস সময় পেলেন বিবাহের জন্য প্রস্তুত হতে। এতো সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য আর অবাধ স্বাধীনতা পেয়েও বিদ্যুন্মালার মনে শান্তি নেই। তার শান্তি যে হরণ হয়েছে তার উদ্ধারের দিন রাত্তিরেই... হরণ হয়েছে তার মন। রাজাকে নয় বা রাজার শাণ-শওকত, মর্যাদা কিছুই চাই না তার। তার চাই কেবল একজনকে। ভাগ্যবিড়ম্বিত সেই ক্ষত্রিয় যুবক অর্জুনবর্মাকে। আর তাই বাগে পেয়ে নিজের গলার মালাটি তার গলে পড়িয়ে দিতে দিতে অস্ফুটে মনের কথাটি বলে দিতে বিন্দুমাত্র সংকোচ বোধ করলেন না।
কী করবে অর্জুনবর্মা? যে রাজার অনুগ্রহে একটু সুখের মুখ দেখেছে, সেই রাজার হবুবধূর প্রেম নিবেদন গ্রহণ করে বিশ্বাসঘাতক হবে? নাকি ফিরিয়ে দিবে রাজকন্যাকে! ঐ যে আছে না একটা গান-'এক পা দু পা করে তোমার দিকে, যাচ্ছি চলে কেমন করে, কোন সে টানে টানছো আমায়, পারি না রাখতে নিজেকে ধরে'৷ 🐸 বেচারা অর্জুনবর্মার শুরু হলো সে দশা। হতচ্ছাড়া মন আর বাস্তববাদী মস্তিষ্কের টানাপোড়েন।
এদিকে প্রাণে সুখ নেই রাজা দেবরায়ের ছোট ভাই দেবকম্পনের মনেও। সে চায় পিতৃতুল্য বড় ভাইকে হটিয়ে নিজে রাজা হতে। সুযোগের সন্ধানে রয়েছে সে। ওদিকে রাজ্যে দেখা দিয়েছে হুক্কো-বুক্কার প্রেতাত্মার। কথিত আছে, রাজ্যে বিপদ আসলে ইনারা দেখা দেন। তার মানে কঠিন সময় সমাগত। দূরে.. সীমান্তের ওপারে পশ্চিম আর পূর্ব থেকে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে দুর্ধর্ষ মুসলিম সৈন্যরা। বিজয়নগর দখল করতে হবে যে! চারপাশের গ্যাঁড়াকলে আঁটকে গেছে রাজা। কী হবে এখন?
প্রেমের উপন্যাসের মোড়কে কিছুটা ইতিহাসের মিশেলে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিখিত ঐতিহাসিক উপন্যাস 'তুঙ্গভদ্রার তীরে'। ঐতিহাসিক উপন্যাস মানেই ইতিহাস আশ্রয় করে লেখা। ভয় নেই, বইয়ে নেই কোন ইতিহাসের কচকচানি। কাহিনির প্রয়োজনে ঠিক যতটুকুর প্রয়োজন, ঠিক সেই পরিমাণে ঐতিহাসিক ফ্যাক্টস আর বাকিটুকু ফিকশন। আহা! সাধু! সাধু! ❤
বি.দ্র. রাজা দেবরায়কে বেশ লেগেছে। না শুধু তার শারীরিক সৌন্দর্যের বর্ণনা পড়েই না, তার ধীর-স্থিরভাবে চিন্তা করার মানসিকতাটাকে, প্রজা বা তার অধীনস্থদের প্রতি তার বাৎসল্য ইত্যাদি ইত্যাদি। সব কিছু মিলিয়ে ভাল্লাগসে। মনে হয়েছে, এইতো! রাজার মতো রাজা। বিদ্যুন্মালাকে ভালো লেগেছে তার স্পষ্টবাদী স্বভাবটার জন্য। যদিও তার মাঝে ডেসপারেট একটা ভাব দিতে চেয়েছিলেন লেখক, কিন্তু চরিত্র ফুটিয়ে তোলার সময় অতোটা প্রকাশ করেননি। তারপরেও ভালো লেগেছে। ইয়ে! আরেকটা ব্যাপার। সেটা অবশ্য ফ্যাক্টস দায়ী নাকি দৃষ্টিভঙ্গি দায়ী আমি জানি না। যে সময়টা পটভূমি গল্পের, সে সময় মুসলমান বা যবনেরা রাজ্য বিস্তার করছিল। স্বাভাবিকভাবে রাজ্যবিস্তারে নৃশংসতা হয়-ই। জয়ী রাষ্ট্র সদ্য পরাজিতদের শারীরিক-মানসিক নানান উপায়ে নির্যাতন করে থাকে। মুসলিমরা রাজ্য বিস্তারে সাধুর মতো পথ ধরেছিল সে কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। প্রাচীন সাহিত্যগুলোই তার সাক্ষী। তারপরেও ক্যান জানি একটু মনে হয়েছে খুব হালকা করে হলেও যবনবিদ্বেষী একটা ভাব শরদিন্দু বাবুর লেখায় আছে 🐸 অতি কল্পনাও হয়ে যেতে পারে। সেটা অবশ্য কাহিনির প্রয়োজনেও হতে পারে। যাকগে! বইটা এনজয় করার কথা ছিলো, পুরোমাত্রায় করেছি। আমি তাতেই খুশি৷
‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ (রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত) ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রচিত একটি ❛সাম্প্রদায়িক❜ উপন্যাস। লেখক নিজেই যে একজন মুসলিম বিদ্বেষী সেটা তার লেখায় অনেক ভালো ভাবেই প্রকাশ পেয়েছে।
ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিদ্বেষ থাকা লোকেদের আমি কি মনে করি সেটা না হয় নাই বললাম!
এইসব বইয়ের রিভিউ... মানে কেন? হোয়াই? যাউক গিয়া। গুডরিডস অ্যাডা স্লট দিসে। হেইডারে ভরন জাউক। ষোড়শ শতকের ভারতবর্ষ। দক্ষিণের বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গে কূটনৈতিক বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে নদীপথে এগিয়ে চলেছন কয়েকজন মানুষ। পথে একটি তরুণকে অবশ্যম্ভাবী সলিলসমাধি থেকে উদ্ধার করলেন তাঁরা। কিন্তু তারপর দেখা দিল সংশয়। এমনিতেই সমকালীন রাজনৈতিক আকাশ নানা আশঙ্কার মেঘে আচ্ছন্ন। এই অজ্ঞাতকুলশীল মানুষটিকে নিয়ে কী করা উচিত? রীতিমতো দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থাতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল সেই তরুণকে সঙ্গে নিয়ে বাকি পথটুকু চলার। পৌঁছোনো গেল গন্তব্যে। কিন্তু তারপর? প্রেম, ঈর্ষা, ক্রোধ, ষড়যন্ত্র, রাজনীতি, রোমাঞ্চ, ইতিহাস, আর কৌতুক— এরা সবাই মিলে গড়ে তুলল এমন এক আখ্যান, যেমনটি বাংলায় আর লেখা হয়নি। হবেও না। এই "মা কসম" লেভেলের লেখাটি যদি এখনও পড়ে না থাকেন, তাহলে আপনার জীবন ষোলো আনাই বৃথা।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে 'বিজয়নগর সাম্রাজ্য' বেশ পরিচিত বলেই মনে হল। দক্ষিন ভারতের এই রাজ্য সময়ের তুলনায় বেশ এগিয়ে ছিল বলে জানতে পারি। উইকিতে দেখি "ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে দক্ষিণ ভারতে ‘ইসলামি আক্রমণ’ প্রতিহত করে এই সাম্রাজ্য নিজস্ব প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়।" আরও দেখতে পাচ্ছি,"দক্ষ প্রশাসন ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কল্যাণে এই সাম্রাজ্যে জলসেচের নতুন প্রযুক্তি আমদানি করা সম্ভব হয়। বিজয়নগর সাম্রাজ্য শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিল। কন্নড়, তেলুগু, তামিল ও সংস্কৃত সাহিত্যে এই সাম্রাজ্যের পৃষ্টপোষকতায় এক নতুন যুগের সূচনা হয়। কর্ণাটকী সংগীত এই সাম্রাজ্যের রাজত্বকালেই তার বর্তমান রূপটি লাভ করে। দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে হিন্দুধর্মকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় সংহতি সাধনের মাধ্যমে বিজয়নগর সাম্রাজ্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।"
"তুঙ্গভদ্রার তীরে" উপন্যাসটি পড়বার সময় এই ইতিহাসটি জেনে নেয়ার দরকার ছিল বলে মনে হল। এটি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস। উপন্যাসটি প্রকাশের পর এটি রবীন্দ্র পুরষ্কার এ ভূষিত হয়েছিল। পুরো উপন্যাসটি এই রাজ্যকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খেয়েছে। এই রাজ্যের রাজা দেবরায় উপন্যাসের একটি মুখ্য চরিত্র হলেও কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়। বরং উপন্যাসটি দুই নারী বিদ্যুন্মালা এবং মনিকঙ্কনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এই দুই নারীর আনন্দ, বেদনা, নিবেদন, প্রীতি, প্রেম, বিরহ, মিলন বেশ ভালভাবেই কাহিনী আকারে উপস্থাপন করেছেন শরদিন্দু। কাহিনীর আখ্যান শুরু হয় ঢিমেতালে, কলিঙ্গ রাজ্যের দুই রাজকন্যা বিদ্যুন্মালা ও মনিকঙ্কনা নৌকাযোগে বিজয়নগর রাজ্যের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা করছেন কেননা ওই রাজ্যের রাজা দেবরায়ের সাথে বিদ্যুন্মালার বিয়ে হবে বলে কথা রয়েছে। কাহিনী জমে উঠতে শুরু করে মুলত তুঙ্গভদ্রা নদীতে ভেসে ওঠা অর্জুনবর্মা নামক এক পুরুষের শরীর এবং বিজয়নগর রাজ্যে এই দুই নারীর আবির্ভাবের সাথে সাথে একটি দুর্বিপাক-কে কেন্দ্র করে। তখন থেকেই এই কাহিনীতে এক অসাধারণ বৈচিত্র্য আর গতি আসে যেটি প্রায় শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছেন লেখক। পাঠকের এদিক ওদিক হবার আর কোন সুযোগ দেননি।
কাহিনীর আখ্যান বর্ণনা আকর্ষণীয়। মুখ্য চরিত্রগুলিকে নিপুণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কাহিনীতে অনেক রহস্য আছে তবে সেটি জমাট বাঁধতে খানিক দেরী হয়েছে বলে মনে হল। রাজা দেবরায়ের কুচক্রী ভাই দৃশ্যে উপস্থিত হবার পর হত্যা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এগুলি স্পষ্ট হতে থাকল। আর এর বাইরে ‘যবন’ কর্তৃক বিজয়নগর রাজ্য আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা এবং তার এক যুদ্ধাংদেহী এক���া রূপ আমরা দেখলাম একদম শেষে এসে।কাহিনীর মূল চরিত্রগুলি যতটা শক্তিশালী পার্শ্বচরিত্রগুলি ততটাই দুর্বল। তাঁদের পরিচিতি কিংবা তাঁদের কর্ম কাহিনীর গতিকে শ্লথ করে শুধু রাজার ভাই এর অংশটুকু ছাড়া। একটি বিষয় আরও খেয়াল করলাম। কাহিনীতে প্রেম-ভালোবাসা আছে পর্যাপ্ত, সেই তুলনায় হত্যা-ষড়যন্ত্র-আক্রমন-যুদ্ধ কম। তবে ষড়যন্ত্র কিংবা আক্রমণের অংশগুলিতেই লেখককে বেশী সিদ্ধহস্ত বলে মনে হল��� শরদিন্দু ব্যোমকেশে কেন এত সফল সেটা কি এই উপন্যাস পড়েও কিছুটা বোঝা গেল না?
উপন্যাসটি শেষ হয়েছে ইচ্ছেপুরনের মধ্যে দিয়ে। দুষ্টের দমন হয়েছে, শিষ্টের পালন হয়েছে, নায়ক নায়িকাদের যার যা পাবার কথা ছিল তারা তা পেলেন, কারোর কোন ক্ষতি হলনা। হয়ত একটি ইচ্ছেপুরনের গল্পই আগাগোড়া বলতে চেয়েছিলেন লেখক।চরিত্রগুলি বড় বেশী সাদা কালো। মানুষের চরিত্রের ধুসর অংশ হিসেবে আনা হয়নি। তাই উপন্যাসটি হয়ে রইল এক ফ্যান্টাসি এবং মনোরঞ্জনকারী। এখানে রাজ্য আক্রমণকারীর একমাত্র পরিচয় তারা মুসলমান। যে সময়কাল নিয়ে এই উপন্যাস রচিত হয়েছিল তাতে করে শুধু বিজয়নগরই কেন পুরো ভারতবর্ষ তো পার্শ্ববর্তী দেশের ওয়ারলর্ডরা করায়ত্ত করবার চেষ্টা করেছে। এইসব ওয়ারলর্ডদের পরিচয় কি শুধুই ‘যবন’ রূপে প্রতিভাত হবে? শুধু মুসলমানরাই আক্রমণকারী, নিষ্ঠুর, পাষাণ? তুঙ্গভদ্রার তীরে উপন্যাসটি পড়লে এরকম সিদ্ধান্তে আসা অবান্তর নয়। আবার বিজয়গর রাজ্যের যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, শুদ্ধ সঙ্গীতের প্রসার সেগুলির ছিটেফোঁটাও তো পেলাম না এই গল্পে!কোথায় সেই বিজয়নগর রাজ্যের শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা?
১৩৪ পৃষ্ঠার উপন্যাসটির প্রচ্ছদ অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং বিচিত্র। দাম মাত্র ১০০ রুপি বা ১৮০ টাকা। প্রকাশনায় সবখানে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। সবশেষে এককথায় বলা যায় তুঙ্গভদ্রার তীরে একটি উপভোগ্য উপন্যাস কিন্তু স্মরণীয় নয়। আর এই বইকে রবীন্দ্র পুরষ্কার দেয়া হল কেন সেটি মাথায় ঢুকছেনা। ১৯৬৭ সালে কি আর কোন ভালো বই পুরষ্কারযোগ্য ছিলনা?
ইতিহাসকে নিয়ে এই ফিকশন , কিন্তু আগেই জানিয়ে রাখি, ছোটবেলায় ইতিহাস বললে যে ভয়টা আমরা সকলে কম বেশি পেতাম তা কিন্তু এখানে এই।
১৪৩০ এর আসে পাশে সময়ে চারিদিকে যবনরা একে একে বিভিন্ন রাজ্য দখল করে নিচ্ছিল। কিন্তু তুঙ্গভদ্রার তীরে বিজয়নগর রাজ্যটি তখন সগর্বে স্বাধীন একটি হিন্দুরাজ্য হিসেবে টিকেছিল।
আর এই সময় বিবাহ শুধু একটি সামাজিক বন্ধন ছিল না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাই সুদূর কলিঙ্গ থেকে রাজকন্যাকে বিবাহের জন্য তিনমাস জলপথে যাত্রা করতে হয়। সেই সাথে তার একাধারে সখী ও ভগিনী মণিকর্নিকাও।
কিন্তু বিজয়নগর পৌঁছনোর আগে,নতুন একজনের প্রবেশ ঘটে তাদের নৌকায়। তার নাম অর্জুনবর্মা ।
গল্প বেশি দীর্ঘ নয়। কিন্তু রকবার শুরু করলে শেষ করা যায় না। অনেকগুলি ছোট বড় চরিত্র আছে কিন্তু তাদের প্রত্যেককে যত্ন সহকারে সৃষ্টি হয়েছে।
চিরকাল প্রেম নিবেদনটা যেন একান্ত ভাবে পুরুষের অধিকার ভেবে নেওয়া হয়েছে। এই stigma ভেঙেছেন লেখক। এই ব্যাপারটা ভীষণভাবে ভালো লেগেছে আমার। পাঁচটি তারার বেশি দেওয়া গেল না !
কাজিনের জন্মদিন ছিলো। তার এক আত্মীয়া (ঢাবির পিস এন্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের বিখ্যাত (অনলাইনে কুখ্যাত) তরুণী শিক্ষিকা দিয়েছিলেন বইটা, ঈদী উপহার। ক্লাস সেভেনের মেয়েকে এই পুস্তক প্রদানের মরতবা ধরতে হলে ইনটেলেকচুয়াল হতে হয় বোধকরি, তা আমি বেকার মুখ্য মানুষ। বাবা-বাছা বলে মাথায় হাত বুলিয়ে ধার নিয়ে এসেছিলাম পড়বো বলে। আনন্দের প্রচ্ছদটা 'জুশ', শক্ত মলাটের মাঝখানে একটুকরো চটের ওপর বোধহয় ব্লকে লেটারিং করা। বইটা মেরে দিতে পারলে হতো, ছিলো গোড়ার দিকের 'গুপন' দুষ্টু ভাবনা।
পাঠশেষে মত বদলেছে। লাল গানে নীল সুর, বঙ্কিম বঙ্কিম গন্ধ...মানে চরিত্রগুলো নয়, লেখক-ই আদতে মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন, বারবার এমত দুষ্ট ভাবনা 'গুপনে' মাথায় এলো। ২/৫।
বইটা শুরু করলে শেষ করতে হয়, পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখে। কিন্তু পড়তে গিয়ে মনে হয়, কেবল উপন্যাসের চরিত্রগুলোই নয়, লেখক নিজেও মুসলমানের প্রতি বিদ্বিষ্ট। এটা অস্বস্তির উদ্রেক করে।
কলিঙ্গ রাজ্যের রাজকুমারী বিদ্যুন্নালা, মণিকঙ্কনা আর বিজয়নগরের বিচক্ষন রাজা দেবরায় ; সাথে অর্জুনবার্মার মতো ভৃত্য এবং বলরামের মতো বন্ধু নিয়ে অসাধারন ঐতিহাসিক,রহস্য,প্রনয় কাহিনী নিয়ে নির্মিত উপন্যাস 💗
তুঙ্গভদ্রার তীরে এক প্রেম ও রাজনীতির নদীগাথা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ কোনো খাঁটি ইতিহাসের খোলস নয় এটি ইতিহাসের ছায়ায় গড়ে ওঠা এক মানবিক উপাখ্যান, যেখানে প্রেম, রাজনীতি ও নিয়তির সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।
কলিঙ্গ রাজ্যের রাজকুমারী বিদ্যুন্মালা যখন রাজনীতি ও প্রতিপত্তির চাপে রাজা দেবরায়ের চতুর্থ রানি হয়ে উঠতে যাত্রা শুরু করে, তখন তুঙ্গভদ্রার উত্তাল স্রোত বয়ে আনে অর্জুনবর্মা নামের এক নিঃশব্দ বিপ্লব। ঝড়ে ভেসে গিয়ে এক দ্বীপে একসাথে রাত কাটানো এই ঘটনাই বাঁধিয়ে তোলে এমন এক সম্পর্ক, যা সমাজের শাসিত পথকে অস্বীকার করে।
এ উপন্যাসে রাজা দেবরায় কেবল এক শাসক নন, বরং এক সময়-সচেতন কৌশলী, যিনি জানেন প্রেমের বিরুদ্ধে তরবারি তোলা দুর্বলতার প্রকাশ। বিদ্যুন্মালা ও অর্জুনবর্মার প্রেম যেন ইতিহাসের কাঠামোর ফাঁকে জন্ম নেওয়া এক দ্রোহ যেখানে মানবিকতা রাজনীতিকে ছাপিয়ে যায়।
এই উপন্যাস ইতিহাসের ছায়ায় এক দুর্লভ প্রেমগাঁথা, যেখানে নদী শুধু প্রাকৃতিক উপাদান নয়, বরং চরিত্রগুলোর আবেগ, উত্থান-পতন ও মোচড়ের প্রতীক।
কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে যখন হিন্দু রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, ঠিক সেইসময় কৃষ্ণার উত্তর তীরে একজন শক্তিশালী মুসলমান দিল্লির নাগপাশ ছিন্নকরে স্বাধীন মুসলমান রাজ্যের প্রবর্তন করেন। এই রাজ্যের নাম বহমনী রাজ্য। তখনকার সময়ে বিজয়নগর ও বহমনী রাজ্যের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ যুদ্ধ বিগ্রহ প্রায় লেগেই থাকতো। বহমনী রাজ্যের চেষ্টা কৃষ্ণার দক্ষিণে মুসলমান অধিকার বিস্তার করবে আর বিজয়নগরের প্রতিজ্ঞা কৃষ্ণার দক্ষিণে মুসলমানদের ঢুকতে দিবে না।
রাজ্য প্রতিষ্ঠার আনুমানিক শতবর্ষ পরে বিজয়নগরের যিনি রাজা হলেন তাঁর নাম দেবরায়। ইতিহাসে উনি প্রথম দেবরায় নামে পরিচিত। দেবরায় অসাধারণ রাজ্যশাসক ও রণপণ্ডিত ছিলেন।
দেবরায়ের পৌত্র দ্বিতীয় দেবরায় অল্প বয়সে সিংহাসনে বসেন এবং রাজ্যবিস্তার করতে থাকেন। যুদ্ধ করে রাজ্য দখল করে অথবা কুটুম্বিতা করে। একটি একটি করে রাজ্যকন্যা বিয়ে করে তিনি সুসম্পর্ক স্থাপন করতে থাকেন।
দাক্ষিণাত্যের কলিঙ্গ দেশ, বিজয়নগর হতে অনেক দূর। কলিঙ্গের রাজা ভানুদেবের কাছে দেবরায় দূত পাঠান তার কন্যাকে বিয়ে করার জন্য কিন্তু তিনি রাজি না যুদ্ধ করতে গিয়ে পরাজিত হয়ে শাস্তি ভিক্ষা করেন। শাস্তির শর্তস্বরূপ দেবরায়ের হাতে কন্যাকে সমর্পন করার প্রস্তাবে রাজি হন।
ভানুদেব কন্যাকে বিজয়নগরে পাঠানোর জন্য তিনটি বহিত্র সজ্জিত করলেন। রাজকীয় আড়ম্বরে রাজকুমারী বিদ্যুন্মালা বিয়ে করতে যাচ্ছেন, সাথে সঙ্গী হয়ে যাচ্ছেন বৈমাত্রেয়ী বোন মণিকঙ্কণা।
এ এক রাজনৈতিক দাবাখেলার চাল। যেখানে বর নিজে বিয়ে করতে যায় আর এখানে কন্যা নিজেই বিয়ের করতে যাচ্ছে, হোক দাবা খেলার চাল, বর বিয়ে করতে আসবে না কেন?
"তুঙ্গভদ্রার তীরে" উপন্যাস টি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস। এর পটভূমি ইতিহাসাশ্রিত সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। বিজয়নগরের রাজাদের বিবরণ ও ভৌগোলিক অবস্থানের স্থাপত্য-ভাস্কর্যের বিশদ বর্ণনার জন্য বইটি বিখ্যাত। লেখক বিজয়গর রাজবংশের দ্বিতীয় দেবরায় কে উপন্যাসের নায়ক হিসেবে বেছে নিয়েছেন এবং কাহিনি উপস্থাপন ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক বর্ণনায় তিনি সত্যতা বজায় রেখেছেন। লেখকের বর্ণনার কারনে মন্দির -প্রাসাদ- সরোবর-রাজপথ-গুহা সব চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ইতিহাস আশ্রিত রোমাঞ্চ সৃষ্টির দিকে লেখক দৃষ্টি দিয়েছে বেশী করে, তিনি তা পেরেছেন সফল ভাবেই। সাধুভাষার ব্যবহার করেছেন উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই কারন ঘটনা কাল ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দের। তবে পড়ার সময় সাধুভাষাটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বিজয়গড়ের তরুণ রাজা দ্বিতীয় দেবরায় ইতিহাস প্রসিদ্ধ চরিত্র। লেখকের লেখনিতে সে চরিত্র উপন্যাসের মধ্যেও প্রসিদ্ধ হয়ে ফুটে উঠেছে।
লেখকের লেখা নিয়ে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। অসাধারণ একটা উপন্যাস পড়লাম যার রেশটা অনেকদিন থাকবে।
কলিঙ্গ থেকে কলিঙ্গের রাজকুমারী বিদ্যুন্মালা বিজয়নগরে যাচ্ছেন দেবরায়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে। তবে সেটা বিবাহ না বলে রাজনৈতিক কূটনীতি বলাই ভালো। সলিলপথে তারা উদ্ধার করে অর্জুন বর্মাকে। তারপর সেও যায় বিজয়নগরে। তারপর সেখানে গিয়ে আস্তে আস্তে চরিত্রের রূপময়তা পরিবর্তন, প্রেম, ঈর্ষা, কূটনীতি, রোমাঞ্চ সব মিলিয়ে জমজমাট একখানা আখ্যান। আর সারাদিন তো বাবুর বর্ণনার প্রসঙ্গে তো কিছু বলাই নেই। মনে হচ্ছিল যেন আমি নিজেই বিজয়নগরে বিচরণ করছি।
তুঙ্গভদ্রা আর কৃষ্ণা নদী, বিজয়নগর, বাহমনী রাজ্য ইত্যাদি কথা প্রথম পড়েছিলাম সুনীলের কাকাবাবু সিরিজের 'বিজয়নগরের হীরে' গল্পে। পরিচিত এলাকায় এবার এই ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়তে পেরে ভালো লাগলেও ইতিহাস বেশি পেলাম না। বরং কয়েকটি যুগল কাহিনীই যেন হয়ে উঠল গল্পের মূল। খারাপ লাগেনি অবশ্য, তবে ইতিহাস আরেকটু বেশি পেলে আরো বেশি ভালো লাগতো।
উপন্যাসের শুরু চলনসই এবং মধ্যভাগ ভালো হলেও সমাপ্তি একেবারেই বাজে। জোর করে "অতপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল" এই পরিনতি দেওয়ার জন্য অবাস্তব ভাবে কাহিনীর মোড় ঘুরানো হয়েছে।
"গঙ্গার জলে স্নান, তুঙ্গর জল পান। অর্থাৎ গঙ্গার জলে স্নান করিলে যে পুণ্য হয়, তুঙ্গর জল পান করিলেও সেই পুণ্য।" তুঙ্গ ও ভদ্রা দক্ষিণ ভারতের দুটো ছোট্ট উপনদী। যাদের মিলিত স্রোত তুঙ্গভদ্রা নামে আরো পূর্বে কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা আর অন্ধ্রপ্রদেশের সীমান্ত মিলেছে কৃষ্ণা নদীর সাথে। তুঙ্গভদ্রার পিঠে গড়ে ওঠা বিজয়পুর সম্রাজ্য কৃষ্ণার পাড়ে মুসলিম সম্রাজ্যের বিস্তারকে আটকে দিয়েছিল প্রায় তিনশ বছরের জন্য। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বিজয়নগরের হেমকূট পর্বতের চূড়ায় সারারাত ধরে জ্বলতে থাকা ধূনীর সূত্র ধরে বর্ণনা করেছেন এইভাবে, "রক্ষী অপসৃত হইলো। দুইজনে দূরাগত আলোকরশ্মির পানে চাহিয়া রহিলেন। উত্তর ভারতের দীপগুলি একে একে নিভিয়া গিয়াছে। নীরন্ধ্র অঅন্ধকারে অবসন্ন ভারতবাসী ঘুমাইতেছে; কেবল দাক্ষিণাত্যের একটি হিন্দু রাজা ললাটে আগুন জ্বালিয়া জাগিয়া আছে।"
বিজয়নগর ১৩৩৬-১৬৪৬ পর্যন্ত মোট ৪ টি হিন্দু রাজবংশের অধীনে শাসিত হয়েছে। এর প্রবল প্রতিপক্ষ ছিল দিল্লি সালতানাতের নাগপাশ ছিন্ন করে বেড়ে ওঠা স্বাধীন মুসলিম সম্রাজ্য, বহমনী। আর দুই রাজ্যের বিরোধের কাঁটাতার কৃষ্ণা নদী। শরদিন্দুর তুঙ্গভদ্রার তীরের গল্পের যে সময় সেই সময় বিজয়নগরের সিংহাসনে ছিলেন দ্বিতীয় দেবরায় আর বহমনী সম্রাজ্যের তখ্তে আহমেদ শাহ।
মধ্যযুগে বিয়ে রাজনৈতিক মৈত্রীর এক হাতিয়ার। দ্বিতীয় দেবরায়ও সিংহাসনে বসার পর এই হাতিয়ারের ব্যবহারে পিছপা হন নি। তেমনিই পাণিগ্রহণের উদ্দেশ্যে কলিঙ্গদেশের চতুর্থ ভানুদেবের দুই কন্যা রাজকুমারী বিদ্যুন্মালা ও মণিকঙ্কণার নৌযাত্রার মধ্য দিয়ে তুঙ্গভদ্রার স্রোতে পাঠকের যাত্রার সূত্রপাত। রাজকুমারীদের বহর বিজয়নগরের ঘাটে ওঠার আগেই বিপত্তি। ঝড়ের ঝাপটায় বিক্ষুব্ধতা জাগে তুঙ্গভদ্রার স্রোতে আর দেবরায়ের ছোট ভাই কম্পনদেবের হৃদয়ে। নদীর স্রোতে ডুবতে বসা বিদ্যুন্মালা প্রাণে বাঁচে বহমনী সম্রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা হতভাগ্য অর্জুনবর্মার হাতে। তা কলিযুগের অর্��ুনের হাতযশ বা মদনদেবের বানের গুণেই হোক বিদ্যন্মালা তার প্রাণরক্ষককে মন দিয়ে ফেলে। অসম এক প্রেম, হিংসা, যুদ্ধ, বিগ্রহের যুগপৎ স্রোত ঠেলে এগিয়ে চলে উপন্যাসের গল্প।
"আমি কি পিতার তৈজস? আমার কি স্বতন্ত্র সত্ত্বা নেই?" বিদ্যুন্মালার এই উক্তির যেন কাল নেই, জাতি নেই। এতো বছর পরেও কতটাই না প্রাসঙ্গিক!! "তুঙ্গভদ্রার তীরে" যদিও ইতিহাস ঠাঁই নিয়েছে তবে উপন্যাসটিতে লেখকের কল্পনাবিলাসী মনকে ইতিহাস গিলে খায় নি। এর বেশিরভাগ প্রধান চরিত্রগুলো অনৈতিহাসিক। অনৈতিহাসিক চরিত্রগুলোর হাতেই ছিল উপন্যাসের চাবিকাঠি। এই উপন্যাস নায়িকাপ্রধান। নায়িকা বিদ্যুন্মালা উপন্যাসের প্রাণ। গল্পজুড়ে সবচাইতে সুগঠিত চরিত্রও এটিই। বিদ্যুন্মালার হৃদয়াবেগ এর পাঠকদের ছুঁয়ে যাবে। এই গল্পে জিংঘাসা তাই রক্তপাত ছিল, হৃদয় ছিল ফলতঃ হৃদয়াবেগ ছিল। চরিত্রগুলোতে চরম ভাগ্যবিপর্যয় ছিল এর থেকে মুক্তিও ছিল। ভাষার সাবলীলতা, লেখনীর ঋজু ভঙ্গি পুরো উপন্যাসকে এতোবছর পরেও অনিন্দ্য সুন্দর করে রেখেছে।
বিদ্যুন্মালা এতোটাই শক্তিশালী রুপে উপন্যাসে ছিল তার আলোর দমকে উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রগুলো সেভাবে মানবিক হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। বিশেষত ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর ডেভেলপমেন্ট একদমই ফ্ল্যাট। নায়ক অর্জুন যেমন জড়, পার্শ্বনায়ক বা কখনো খলনায়ক হয়ে থাকা দেবরায় ততটাই একঘেঁয়ে। মুসলিম সম্রাজ্যের বিস্তারের সময় খু*ন, মন্দির ধ্ব*স, অত্যা*চার হয়েছে তা সত্য। বস্তুত সব সম্রাজ্য বিস্তারেই এই হয়। পালদের হটিয়ে সেনরা একই কায়দাতে বাংলা দখল করেছিল, বাবরও কম নৃশংস ছিলেন মধ্যভারতের দেশগুলোতে ভাগ্য পরীক্ষার সময়। কিন্তু কথা হলো এ নিয়ে ঢালাও অভিযোগ চলে না। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও চরিত্রের ব্যাকস্টোরি নির্মাণের জন্য উপন্যাসে যা লিখেছেন তাকে লঘু অভিযোগ ছাড়া আর কিছু বলা মুশকিল। এই কর্ম না করলে উপন্যাসটা দ্যুতি বাড়তো বই কমতো না।
শরবিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের তার লেখাকে বলতেন আমার কাহিনী ফিকশনালাইজড হিস্ট্রি নয়, হিস্ট্রিক্যাল ফিকশন।
১৯৬৭ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিল শরবিন্দু বন্দ্যেপাধ্যায়ের লেখা তুঙ্গভদ্রার তীরে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বেশ সমৃদ্ধশালী রাজ্য ছিল বিজয়নগর। বিজয় নগরের রাজা দেবরায় সন্ধি স্থাপনের জন্য আশে-পাশের রাজ্যের রাজ কন্যাদের বিয়ে করার ব্রত করেন। কলঙ্গীর রাজা ভানুদেব নেয়াৎ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বেপৈত্নীক বিজয় নগরের রাজার দেবরায়ের কাছে সপে দিতে হয়েছে নিজের কন্যা বিদ্যুন্মালাকে।
তুঙ্গভদ্রা দক্ষিণ ভারতের বিজয় নগর রাজ্যে প্রবাহিত জলধারা। তৎকালিন সময়ে বঙ্গ দেশের সাথে যোগাযেগের উৎকৃষ্ট মাধ্যম ছিল এই জলপথ। রাজকন্যা বিদ্যুন্মালা ও রাজকন্যা কঙ্কাবতী ময়ূরপঙ্খি করে বিয়ে করতে যাচ্ছিল দক্ষিণ ভারতের বিজয়নগর রাজ্যের রাজধানীতে। পথে মধ্যে হঠাৎ একজন অচেনা বিদেশীকে নদীর মাঝ স্রোতে ভাসতে দেখা যায়। হাতে বাঁশের লাঠি, লাঠির জেড়েই ভেসে ছিল অনেকক্ষণ। রাজকন্যা বিদ্যুন্মলা যুবকটিকে দেখে উদ্ধারের তৎপর চালায়। বলরাম কর্মকার নামের এক দাস উদ্ধার করে যুবকটিকে। যুবকটির নাম ছিল অর্জুন বর্মা। অর্জুন বর্মা আর বলরাম ক্রমেই দুজনের ভালো বন্ধুতে পরিনত হয়।
একসময়, জলযানগুলো বিজয়নগর রাজ্যে প্রবেশ করে। কিন্তু, বিপত্তি এখানেই ঘটে, জলযানগুলো ডুবে যেতে থাকে একে একে যার ফলশ্রুতিতে নদী থেকে রাজমকুমারী বিদ্যুন্মালাকে উদ্ধার করে অর্জুন। এখান থেকেই যেন তাদের মধ্যে ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করে। উদ্ধারকার্য সমাধা হওয়ার পর প্রাসাদে ফিরে যায় রাজকুমারীরা। রাজ অতিথি হিসেবে থাকতে শুরু করে দুই বন্ধু বলরাম ও অর্জুন। ক্রমেই যেন বিদ্যুন্মালা অর্জুন বর্মাকে পছন্দ করে ফেলে। ঘনিষ্ঠ হতে থাকে দুজনে। এসময়ের মধ্যে দুই বন্ধু তাদের নিজ গুনে রাজার গুরুত্বপূর্ণ কার্যে পদাসন হয়। অর্জুন রাজার দূত হিসেবে কাজ করতে শুরু করে আর বলরাম কর্মকার। হঠাৎ একদিন রাজার চোখে পরে যায় এ ঘটনা। রাজা অর্জুন বর্মাকে হত্যা করল না, তাকে ছেড়ে দিয়েছিল বোধহয় রাজার জীবন বাঁচানোর দরুন। রাজা তাকে দেশ ত্যাগের আদেশ দেন। দুই বন্ধু এক সাথে দেশ ত্যাগের জন্য সীমান্তে পৌছালে দেখতে পায় শত্রুরা বিজয়নগর আক্রমনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রানের মায়া ত্যাগ করে অর্জুন বর্মা চলে যায় রাজাকে খবরটা জানাতে। এক সময় সফলও হয় অর্জুন। রাজা তার যথার্থ ব্যাবস্থা নেয়। এদিকে রাজা দেবরায় বিচক্ষণ। সে দেখেছে রাজকন্যা বিদ্যুন্মালার ছোটবোন কঙ্কাবতী তার প্রতি দুর্বল। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্জুনের সাথে বিদ্যুন্মালার বিয়ে দেবার। অবশ্য রাজা একই দিনে বিদ্যুন্মালার ছোটবোনকে বিয়ে করবেন।
উপন্যাসটির প্রতিটি পৃষ্ঠায় লেখা আছে আকাঙ্খা, প্রেম যেন তারা বলছে জগৎতের তুচ্ছাতীত জিনিসকেও ভালোবাসা যায় । যদিও শরবিন্দু বন্দ্যোপধ্যায়ের অধিকাংশ হিস্ট্রিক্যাল ফিকশনের মূল উপজীব্য ছিল মানুষের মধ্যকার প্রেমের সম্পর্ক। আমার মনে হয়, তুঙ্গভদ্রার তীরে পড়ার জন্য বেশ ভালো বই হতে পারে। . . .
This entire review has been hidden because of spoilers.
সদ্য পড়ে শেষ করলাম তুঙ্গভদ্রার তীরে। অনেক বছর আগে ব্যোমকেশের কিছু উপন্যাস পড়েছিলাম। দীর্ঘ সময় পর এইবার শরদিন্দুবাবুর ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়লাম এবং খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে, মুগ্ধ হলাম। তাই এই সংক্ষিপ্ত পাঠ প্রতিক্রিয়া।
বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে অকপট ও সাহসী সাহিত্যিক আমার মতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ওনার পরে শরদিন্দুবাবুকেই কিছু অপ্রিয় সত্যি কথা অকপটে লিখতে দেখলাম। এছাড়া, ওনার ভাষাও কিছু অংশে বঙ্কিমের লেখনীর কথা মনে করিয়ে দেয়, যদিও সন্ধিবদ্ধ শব্দের কোনো প্রাচুর্য নেই।
গল্পের কথা বলতে গেলে কলিঙ্গের দুই রাজকুমারী বিজয়নগর সাম্রাজ্যের উদ্দেশ্যে নৌবাহিনী নিয়ে চলেছে কারণ তাদের পিতা বিজয়নগরের সম্রাট দেবরায়ের কাছে কন্যাদানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বঙ্গদেশের কর্মকার বলরামও একটি নৌকোতে রয়েছে। যাত্রাপথে নদীর স্রোতে ভাসমান অর্জুনবর্মাকে উদ্ধার করে বলরাম। দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে সখ্যতা। বিজয়নগর পৌঁছানোর ঠিক পূর্বে ভয়ংকর ঝড়ের কবলে পড়ে কলিঙ্গের তিনটি নৌকাই। রাজকুমারী বিদ্যুন্মালাকে সমুদ্রের প্রকোপ থেকে উদ্ধার করে অর্জুনবর্মা । আর সেই মুহূর্ত থেকেই দেবরায়ের হবু সম্রাজ্ঞী বিদ্যুন্মালার মনে অর্জুনবর্মার প্রতি প্রণয়ের সূত্রপাত ঘটে। এরপর বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় কাহিনী। আসে বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য অর্জুনবর্মা ও বলরামের সংগ্রাম এবং আরো অনেক কিছু।
উপন্যাসটি পড়ার সময় মনে হচ্ছিল চোখের সামনে কোনো চলচ্চিত্র চলছে, এতটাই প্রাঞ্জল বর্ণনা সবকিছুর। বিজয়নগর সাম্রাজ্যে যেন আমি নিজেই পৌঁছে গেছি। এছাড়াও আছে যথেষ্ট হাস্যরস, অনেক উত্তেজনায় পরিপূর্ণ মুহূর্ত। আছে বন্ধুত্ব, প্রেম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অগাধ দেশপ্রেম। প্রকৃতির সুন্দর বর্ণনা, রামায়ণের প্রসঙ্গ উত্থাপন - এসবের সার্থক ব্যবহারও আছে। পান সুপারি পথের কথা পড়লে মনে হয় সেটি লেখকের কল্পনা কিন্তু আমার এক দিদি, যিনি কর্ণাটক ভ্রমণে গেছিলেন, তার থেকে জানলাম ওখানে এখনো পান সুপারি পথ রয়েছে। তো এর থেকেই বোঝা যায় কত তথ্যনির্ভর কাহিনীটি !
উনি নিজেই বলে গেছেন ওনার কাহিনী fictionalised history নয়, historical fiction. আরও একটি বিষয় আমার বেশ ভালো লেগেছে এবং সেটি হল বিভিন্ন খাবার পদের পুরোনো নাম যেমন শূল্য মাংস, উক্ষ্য মাংস, পর্পট, তক্র ইত্যাদির ব্যবহার। বাংলা ভাষার উপন্যাসটির উৎকর্ষ প্রতিটা লাইনে ধরা পড়ছিল ।
সবশেষে, এটাই বলা যায়, তুঙ্গভদ্রার তীরে একটি সার্থক ১০/১০ উপন্যাস।
বিষয়সংক্ষেপ: তুঙ্গভদ্রা নদীর উপর দিয়ে পাল তুলে তিনটি নৌকো চলেছে, তাতে করে কলিঙ্গ দেশের রাজকন্যা বিদ্যুন্মালা চলেছেন, বিজয়নগরের তরুণ রাজা দ্বিতীয় দেবরায়ের সাথে তাঁর বিবাহ ঠিক হয়েছে। তাঁর বোন মণিকঙ্কণা সাথে আছেন। বিদ্যুন্মালার এই বিয়েতে সেভাবে মত নেই কারণ রাজার একের বেশি রাণী আছে। বিদ্যুন্মালা নিজের জন্য যেমন স্বামী চান তাঁর কেবল একটিই স্ত্রী থাকবে। হঠাৎ নদীর জলে এক অজ্ঞাত পরিচয়���র ব্যক্তিকে ভেসে থাকতে দেখে তাঁর নৌকার একজন তাকে বাঁচিয়ে নৌকায় নিয়ে আসে। তাকে সুস্থ করে তার পরিচয় জানা যায়। তার নাম অর্জুনবর্মা, যদুবংশীয়, গুলবর্গার অধিবাসী। যবনদের অত্যাচারের ভয় নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল। এরপর কাহিনী নদীবাঁক পরিবর্তন করে জলের সাথেই বয়ে বিজয়নগরে ঢুকে পরে। এর মাঝে বিদ্যুন্মালার ভাবনা চিন্তাও পরিবর্তিত হয়েছে। অর্জুনবর্মা ও তার রক্ষাকারী বলরাম দুজনেই নিজ নিজ কৌশলের দ্বারা রাজার বিশ্বাসের পাত্র হয়েছে। বিজয়নগরেকেই নিজের মাতৃভূমি মনে করে তারা। রাজা ও বিদ্যুন্মালার বিবাহে বাঁধা আসার ফলে তা তিন মাস পিছিয়ে গেছে , আর এরই কাহিনীর রং পরিবর্তন ঘটেছে। অবশেষে কি রাজার সাথে বিদ্যুন্মালার বিবাহ হবে? মণিকঙ্কণার মনে কে আছে এই কাহিনীতে তার চরিত্র কি রকম? অর্জুনবর্মারই বা ভূমিকা কি এই গল্পে?
আমার কেমন লেগেছে: ক্লাসিক উপন্যাস আমার তেমন পড়া হয় না, ক্রাইম থ্রিলার ডিটেকটিভ এসবের ভক্ত আমি। অনেকদিন পর সাধু ভাষায় বর্ণিত একটি ঐতিহাসিক অথচ কাল্পনিক উপন্যাস পড়লাম। অনেক ভাষার মানে বুঝতে একটু কষ্ট হয়েছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিধান দেখতে হয়েছে। প্রথমদিকে ওই কারণে পড়ার গতিও অনেক কম ছিল তারপর আস্তে আস্তে পুরো ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেছে। ইতিহাস, রাজা রানী, যুদ্ধ, প্রেম, ষড়যন্ত্র সমস্ত মিলিয়ে মিশিয়ে বেশ ভালো একটি উপন্যাস। আমার পড়ে ভাল লেগেছে এবং আমি বলব যারা ক্লাসিক পড়তে ভালোবাসেন বা যারা পড়তে ভালোবাসেন তাদের প্রত্যেকের জন্য এই বইটি একটি must read 🙌🏻
কৃষ্ণার দক্ষিণে যখন হিন্দু রাজ্য বিজয়নগর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, কৃষ্ণার উত্তরে তখন বহমনী নামে এক মুসলমান রাজ্যও প্রতিষ্ঠা হলো। পরস্পরবৈরী এই দুই রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকতো। আর এই যুদ্ধের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বিজয়নগরের রাজা দ্বিতীয় দেবরায়কেও বিভিন্ন সময়ে নিতে হয়েছে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। এমনই এক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে কলিঙ্গের রাজকন্যা বিদ্যুন্মালার সাথে বিয়ে স্থির হয়ে রাজা দেবরায়ের।
চিরকালই বর বিয়ে করতে কনের বাড়ি যায়। কিন্তু রাজনৈতিক দাবাখেলার এই বিয়েতে ঘটলো ব্যতিক্রম। দেবরায় বিয়ে করতে শ্বশুরবাড়ি যাবেন না। কন্যাকেই আসতে হবে বিজয়নগর, সেখানেই বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে তাদের। সেজন্যই তিনটি নৌকা নিয়ে বিজয়নগরে যাত্রা করে কনেযাত্রীরা, সাথে দুই রাজকন্যা বিদ্যুন্মালা আর মণিকঙ্কনা। যাত্রাপথে ঘটে যায় চমৎকার এক ঘটনা। যে ঘটনা বদলে দিতে পারে ভবিষ্যত।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'তুঙ্গভদ্রার তীরে' চমৎকার এক ইতিহাসাশ্রিত উপন্যাস। রাজা দ্বিতীয় দেবরায় ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য এক চরিত্র। লেখক এই উপন্যাসে দ্বিতীয় দেবরায়কে নায়ক করেই কাহিনী এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সেইসাথে ঐতিহাসিক বর্ণনার যথাসম্ভব বিশুদ্ধতা রক্ষারও চেষ্টা করেছেন তিনি।
মধ্যযুগের ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বর্ণনার দারুণ এক উদাহরণ এই উপন্যাস। উপন্যাসের বর্ণনায় উঠে এসেছে নদী-সরোবর, বন-পাহাড়, নগর-প্রাসাদের মনোমুগ্ধকর চিত্র। এসেছে রাজা-রাজরাদের বিচিত্র জীবনযাপনের বর্ণনাও।
অনেকদিন পর সাধুভাষার কোনো বই পড়াতে শুরুর দিকে পড়তে একটু বেগ পেতে হচ্ছিলো, তবে খুব দ্রুতই সে অস্বস্তি কেটে গেছে। শেষদিকে এসে দারুণ উপভোগ করেছি। সবমিলিয়ে দারুণ উপভোগ্য এক উপন্যাস 'তুঙ্গভদ্রার তীরে'।
Princesses Bidyunmala and Manikankana of Kalinga EMBARK on a journey to Bijaynagar. Bidyunmala is BETROTHED to Prince Debroy II, soon to ASCEND the throne. Though she is not happy about marrying a stranger, she YIELDS to the royal decree. Manikankana, less opinionated, consoles her sister, saying she would have accepted the marriage herself had the order been hers to follow. While crossing the Krishna River, they RESCUE a drowning man. Upon regaining consciousness, he identifies himself as Arjun Verma. Arriving in Bijaynagar, the sisters introduce Arjun to Debroy. Impressed by Arjun’s extraordinary agility—he outruns horses using only sticks—and his skill in warfare, the prince appoints him royal messenger. Arjun quickly earns ADMIRATION throughout the court. One night, Arjun FOILS an assassination attempt planned by Debroy’s brother Kampandev who seek the throne. Arjun’s bravery earns the king’s trust and friendship. Meanwhile, Bidyunmala begins to fall in love with Arjun, and the feeling is mutual. Despite Arjun’s initial RESTRAINT, their bond DEEPENS, and one day Debroy CATCHES them together. As punishment for DISHONORING the crown, Arjun is EXILED from the kingdom. Exhausted after hours of wandering, Arjun SEEKS REFUGE in a cave. But the movement of air HINTS it's not just a cave—it’s a hidden tunnel. At the end of it, he discovers Bahmani troops preparing to attack Bijaynagar. He races back and warns Debroy, helping to secure a dramatic victory over the enemy. GRATEFUL and HUMBLED, King Debroy BLESSES the union of Arjun and Bidyunmala. In a joyous twist, Manikankana marries King Debroy himself. #Goodreads
This entire review has been hidden because of spoilers.
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ঐতিহাসিক উপন্যাসের নামে রীতিমতো থ্রিলার লিখে গেছেন একেকটা!
রাজনীতির প্যাঁচে পড়ে কন্যার বাবা কন্যাদান করেন রাজা দেবরায়কে। কিন্তু স্বাধীনচেতা রাজকুমারী বিদ্যুন্মালা একাধিক পত্নী থাকা রাজাকে বিয়ে করতে নারাজ। যে শাস্ত্র বলে নারীর আলাদা কোনো সত্তা নেই সে শাস্ত্র সে মানে না। কিন্তু বিধি বাম! রাজাকে বিয়ে করতে তাকে যেতেই হলো। পথে এক আগন্তুকের সাথে দেখা। এই আগন্তুকই গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
ইতিহাস, রাজনীতি, বন্ধুত্ব, নিষ্ঠা, হিংসা, বিশ্বাসঘাতকতা, ক্ষমতার লোভ, যুদ্ধ আর প্রেম নিয়ে লেখা আখ্যান "তুঙ্গভদ্রার তীরে"। একে নিছক ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে রসকষহীন কাঠখোট্টা মনে করলে সে নিছক ভ্রম বই কিছু নয়!
তুঙ্গভদ্রার স্রোতের কলকল ধ্বনিতে আজও মিশে আছে দেবরায়, অর্জুন, বিদ্যুন্মালা, মণিকঙ্কনা দের গল্প, সেই গল্প তুঙ্গভদ্রা আজও ফিসফিস করে বলে যায়।
ইয়ে মানে, সবই ঠিক আছে, কিন্তু এই মুসলিম বিদ্বেষটা না ঢোকালেই কি চলত না? এই ভিলেনদের একমাত্র পরিচয় তারা মুসলম��ন, এবং মুসলমান মাত্রই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিন্দু ক/ত/ল। সিরিয়াসলি? যেখানে পুরো ভারতবর্ষ মোগলরা কয়েকশ বছর শাসন করছে সেখানে এই ধরনের কথাবার্তা কি বালখিল্য নয়? বইয়ের চরিত্র নয় লেখক সাহেবকেই মুসলিম বিদ্বেষী মনেহল বইটা পড়ে।