নিজের প্রয়ােজনের কথা ভেবে, নিজের সুখ-সমৃদ্ধি-চাহিদার কথা মাথায় রেখে দলবদ্ধ হয়েছে মানুষ। গড়েছে সমাজ, নির্মাণ করেছে পরিবার, অসংখ্য ধরা-অধরা সম্পর্কের সুতােয় জড়িয়ে নিয়েছে নিজেকে। চিরকাল মানুষ বিশ্বাস করতে চেয়েছে সে পরিবারের মধ্যে, দলের মধ্যে, সমাজের মধ্যে বেঁচে থাকতে চায়, সঙ্গীহীন জীবন যেন বৃথা। অথচ কী আশ্চর্য, প্রতিটি মানুষই কিন্তু মূলত একা। একাই আজীবন। জীবনের প্রতিটি স্তরে তার ভিন্ন ভিন্ন নামের সহযাত্রী জোটে বটে, কিন্তু তাতে হৃদয়ের নির্জনতা ঘােচে না। এই উপন্যাস সেই নির্জনতারই অনুসন্ধান।
এই বৃহৎ উপন্যাসের চালচিত্র সমসময়, পটভুমি সমসাময়িক সমাজ। এর আখ্যানভাগের একদিকে রয়েছে এ-যুগের মা-মেয়ের গল্প, সফল মানুষের গোপন ব্যর্থতার কাহিনী, বিফল মানুশের সফল না হতে পারার আকুতি, নতুন প্রজন্মের আশা আকাঙ্খার গল্প, বর্তমান সমাজের অসহায়তা আর পাপবোধের কথা, ব্যর্থ বিপ্লবের যন্ত্রণা, দুই প্রজন্মের দ্বন্দ্ব। সঙ্গে প্রতীকের মতো সমান্তরাল ভাবে চলেছে একটা পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি গরে ওঠার উপাখ্যান। এই বাড়ি যেন সময়ের বিবেক, সময়ের মূল্যবোধ, সময়ের অনুশাসন। এর মধ্যে দিয়েই লেখক খুঁজতে চেয়েছেন মানুষের নিঃসঙ্গতার উৎস। আজকের আত্মকেন্দ্রিক আধুনিক সমাজই কি মানুষকে লক্ষ্যহীন উচ্চাশার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে? নাকি সেই চিরন্তন ষড়রিপু আবহমান কাল ধরে মানুষের মনে বুনে চলেছে একাকিত্বের বীজ?
এই উপন্যাস জুড়ে অজস্র চরিত্রের মিছিল। কেউ বা বৃদ্ধ, কেউ বা মধ্যবয়স্ক, কেউ কিশোর কিশোরী, তরুণ তরুণী, কেউ বা নেহাতই শিশু। ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের মানুশ হওয়া সত্ত্বেও কোথায় যেন এরা অভিন্ন, এদের সকলের মধ্যেই চারিয়ে যাচ্ছে এক দুঃখী বিষন্নতা। কেন?
উপন্যাসের নামটিও ভারী ব্যঞ্জনাময়। গল্পের পাত্রপাত্রী সবই যেন আমাদে রতি পরিচিত, নিকটজন। অর্থাৎ কাছের মানুশ। আবার এই নিকটজনরা পরস্পরের খুব আপন হওয়া সত্ত্বেও সত্যিই কি কেউ কারও প্রকৃত কাছের মানুশ? এইসব জীবন্মুখী প্রশ্নের উত্তর প্রকীর্ণ আছে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের এই উপন্যাসের পাতায় পাতায়।
Her writing focuses on contemporary social issues. She is a perceptive observer of the changing urban milieu and her writing closely examines the contemporary Bengali middle class. Crisis in human relationships and the changing values of the present era along with degeneration of the moral fibre of the society in the backdrop of globalisation and consumerism are depicted in her prose. Exploitations and sufferings of women regardless of their social or economic identities find a distinct voice in her writing. While she is famous for her writing on women's issues, she does not consider herself as a feminist. She took up many odd jobs in her early youth and finally joined the public service which she left in 2004 to become a fulltime writer. Her long career is reflected in many of her stories and novels.
Over the past two decades, Suchitra has written about 24 novels and a large number of short stories in different leading Bangla literary magazines. Some of her acclaimed novels are Kachher Manush (Close to Me), Dahan (The Burning), Kacher Dewal(The Wall Of Glass), Hemonter Pakhi(Bird of Autumn), Neel Ghurni, Aleek Shukh(Heavenly happiness), Gabhir Ashukh (A Grave Illness), Uro Megh(Flying Cloud), Chhera Taar, Alochhaya(Shadows Of Light), Anyo Basanto(Another Spring), Parabas, Palabar Path Nei, Aami Raikishori, Rangin Pritibi and Jalchhobi among others. Her novels and short stories have been translated into many Indian languages such as Hindi, Tamil, Telugu, Malayalam, Oriya, Marathi, Gujarati, Punjabi and English. She also writes novels and short stories for children. Her novel Dahan was made into a movie by famous Bengali director, Rituparno Ghosh.
তা বেশ অনেক বছর আগের ব্যাপার. Early-mid nineties. আমি তখন ছোট-ই। সবে দেশ পড়া শুরু করেছি। মা রেগুলার পড়তেন-টড়তেন, পড়ার অভ্যেসটাও তিনি-ই তৈরী করেছিলেন, কিন্তু একটুখানি পিউরিটানও ছিলেন। তোমার এখনো এইটা পড়ার বয়েস হয়নি - টাইপের কথা অনেক-ই শুনেছি। যাকগে , net-net তখন আমার দেশ পড়ার বয়েস সবে হয়েছে , আর দেশে তখন ধারাবাহিক ভাবে বেরোচ্ছে এক সাথে সুনীল গঙ্গেপাধ্যায়ের “প্রথম আলো” , আর সুচিত্রা ভট্টাচার্যের “কাছের মানুষ”। আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "সেই সময়" টিভি সিরিয়াল দেখেছি, তার হিন্দি রূপান্তর যুগান্তরও টিভিতে দেখেছি - কী সুন্দর সুন্দর সব সিরিয়াল তৈরী হতো তখন ! তারপর মায়ের অফিসের লাইব্রেরি থেকে এনে বইটাও পড়ে শেষ করে ফেলেছি তদ্দিনে । যখন বুঝতে পারলাম "প্রথম আলো" literally "সেই সময় " এর পরবর্তী ভাগ, তো খুব আগ্রহের সঙ্গে দেশের আগের সংখ্যাগুলো নামিয়ে এনে প্রথম থেকে শুরু করে দিলাম পড়তে। দারুন, দারুন - কিন্তু হয়ে গেলো শেষ পুরোনো পর্বগুলো , এখন বসে থাকো পরের কিস্তির জন্যে। কিন্তু সে কি আর হয়? আমি পড়ুয়া ছেলে , পুরোনো দেশ গুলো তো হাতের কাছেই ছিল, শুরু হয়ে গেলো অন্য উপন্যাসটি পড়া। বাঁচোয়া এই, যে প্রথম আলো তখন গল্পের একেবারে মাঝপথে, কাছের মানুষ সবেই শুরু হয়েছে। কিন্তু মজে গেলাম গল্পে - especially কারণ গল্পের পাত্র-পাত্রীরা আমাদের মতনই মিডল-ক্লাস শহুরে সাধারণ লোকজন। "প্রথম আলো" তো আর ঠিক "সেই সময়" নয়, মাঝখানে খানিকটা ঝুলে যায়, যদিও সব মিলিয়ে খুবই উঁচু লেভেলের লেখা - যারা পড়েছেন তারা বুঝবেন কি বলছি। চার পাঁচটা কিস্তির মধ্যে-ই হয় কি, আমি প্রথমে "কাছের মানুষ" দিয়েই নতুন দেশ পড়তে শুরু করি. কী সুন্দর, free-flowing লেখা ! বিপুলকায় উপন্যাস, কত ক্যারেক্টার এর আনাগোনা, তাদের নিজেদের গল্প, একটা কাঠামোয় বেঁধে রাখা খুব একটা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু সুচিত্রা ভট্টাচার্য্য খুবই দক্ষতার সঙ্গে সেটা করেছেন - narrative flow is super smooth, character arcs are very well-defined. আর ভদ্রমহিলা এতো সুন্দর ডায়ালগ আর সিন লিখতেন ! খুবই visual লেখার style । পড়লে যেন মনে হয় ঠিক চোখের সামনেই সব ঘটনাগুলো হচ্ছে। ইন্দ্রানীকে আপনি নিশ্চয়ই একজন স্ট্রং ক্যারেক্টার বলবেন - স্পষ্টবক্তা , দৃঢ়চেতা , বুদ্ধিমতী, সাহসী। একান্নবর্তী পরিবারের তিনি-ই মাথা - স্কুলে পড়ান, আবার সংসারের যে বংশানুক্রমিক ছোট ছাপাখানার ব্যবসাটি আছেই, তারও কর্মভার সামলান। একটা কিছু অসম্পূর্ণতা যেন তাকে ঘিরে আছে। তাঁর স্বামী আদিত্য বিভিন্ন ব্যবসায় অসফল , মদ্যপ, কুঁকড়ে থাকা এক ব্যর্থ মানুষ ( বলা যায় বেশ শীর্ষেন্দু-উপযোগী এক হেরো লোক). তাদের ছেলে বাপ্পা, মেয়ে তিতির। বাপ্পা কলেজ স্টুডেণ্ট, উদ্যোগী , উচ্চাকাঙ্খী, কিছুটা হয়তো স্বার্থপর। তিতির স্কুলে - শান্ত, বাবা-অন্ত-প্রাণ , নরম-হৃদয়। ঢাকুরিয়া-র কাছে তাদের বাড়ি - তাদের সঙ্গে থাকে আদিত্য-র অশীতিপর বাবা জয়মোহন, তার দুই ভাই, সুদীপ তার স্ত্রী রুনা আর ছেলে এটম-এর সাথে, আর ছোট ভাই কন্দর্প, struggling film actor। আর আছে স্বনামধন্য ডাক্তার শুভাশিস, ইন্দ্রানী-র পুরোনো বন্ধু, আর তার সংসার, স্ত্রী ছন্দা আর ছেলে টোটো। আর আছে কলকাতা, এতো লোক, এতো কথা, এতো বন্ধন, তবুও একাকিত্ব। একদিকে যেমন এই নিস্তরঙ্গ জীবন, তেমনি হঠাৎ কখনো কোনো বিশেষ ঘটনা যেন এই ভিত-টাকে নাড়া দিয়ে যায়। কত চাপান উতর, শ্লেষ, গ্লানি, হতাশা, আবার হঠাৎই মন ভরা আনন্দ । এই নিয়েই তো মানুষ। কেউ বা কিছু দূরের, কেউ বা কাছের। আমি একটু আধটু লিখি , যদিও বাংলায় লেখার ঠিক সাহস হয় না। যে ভাষায় আপনি প্রতিদিন কথা বলেন না, যে ভাষা আপনাকে প্রত্যহ ঘিরে নেই, সে ভাষায় লেখা তো দুঃসাহস, তাই না? যাই হোক, যখন কেউ জিজ্ঞেস করে আমার প্রিয় লেখকদের কথা, আমি সাধারণতঃ বলি যে যারই লেখায় পড়তে ভালো লাগুক না কেন, আমি যখন লিখি, তখন খুব চেষ্টা করি আমার লেখাটা যেন Raymond Chandler বা Nick Hornby-র মতো হয়, সহজপাঠ্য কিন্তু কিছুমাত্রায় গভীরতাপূর্ণ (পারি না বেশিরভাগ সময়, বলাই বাহুল্য ) - আর একটা নামকে অনেক সময় বলি না, সেটা কিন্তু এই জন্য-ই যে আমার ভিন্নভাষী বন্ধুবান্ধব এবং সহলেখকরা সবাই তো আর সুচিত্রা ভট্টাচার্য কে চিনবেন না। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মতন-ই লিখতে চাই। কিছুদিন আগেই আবার পড়লাম, একইরকম ভালো লাগলো।
মানুষ তো চিরকালই নিঃসঙ্গ। কি ভিড়ে,কি নির্জনে। নিজের চারদিকে প্রিয়জনের বলয় সৃষ্টি করে বৃথাই সেই নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে চায় মানুষ।
খুচরো পয়সা যেমন একটু একটু করে জমে ভারী করে মাটি ব্যাংক। তেমনি একটু একটু করে পড়তে পড়তে কখন যে "কাছের মানুষ " শেষ হয়ে গেল,বুঝতেও পারিনি। প্রায় ১৫ দিন ধরে পড়েছি বইটা। প্রতিদিন রাতে আমার অভ্যাস হয়ে উঠেছিল,খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাতের একটা অব্দি বই পড়া। আজকে যখন হুট করে দেখলাম শেষ পাতায়,অদ্ভুত একটা অনুভূতি ঘিরে ধরল, বিশাল এই উপন্যাস শেষ করার আনন্দ আর বই শেষ হয়ে যাওয়ার দুঃখের আশ্চর্য এক মিশেল। কেউ একটা এত দিন সঙ্গে ছিল,হুট করে যেন ছেড়ে গেল আমায়।
"কাছে যারা থাকে,তারা কী আসলে কাছের মানুষ হয়? "
মাঝে মাঝে মনের মধ্যে কিছু যেন চলে,কারো কাছেই শান্তি পাই না,not even to my parents. অদ্ভুত এক বৈরাগ্য ভর করে। দ্বীপান্তরে যেন আমি একা। নীল বেদনা শকুন হয়ে চেপে বসে বুকে। বলতে পারি না,শুনাতে পারি না কাউকে। শোনার বলার মানুষ নেই,এমন নয়; ইচ্ছে টা আসে না। নিকোটিন সঙ্গ দেয়। ভান করি,স্রেফ ভান করি,সিগারেট যেভাবে পুড়ে,সেভাবে যেন পুড়ে যাচ্ছে বুকে চিরে দেয়া দুঃখের শকুন। আসলে সে পুড়ে না,সে থাকে। তাকে থেকে যেতে হয়। সব ই থেকে যায়,শুধু সময় টা চলে যায় তার গতিতে।
সময় এক উদাসীন স্রোত। মানুষের সুখ-দুঃখ আনন্দ বিষাদ উল্লাস-অবসাদ কোন কিছুতেই তার কৌতুহল নেই। সে চলে আপন খেয়ালে। জীবন কখনও কখনও থমকে যায়,সময় দাঁড়ায় না।
কাছের মানুষ মানুষের গল্পই বলে। সেখানে আমরা দেখি শিবসুন্দর,আদিত্য, ইন্দ্রাণী, শুভাশিস, তিতির নামের কিছু মানুষের জীবনের গোপন কুঠুরির হালচাল,যা আসলে সমগ্র মানুষের ভেতরের চিত্র।
জটিল এই মানব জীবন। এখানে মানুষ নিজেই নিজেকে ঠিক মত চিনতে পারে না,ইন্দ্রাণী আর শুভাশিস মত দোলাচলে রেখে পাড় করে দেয় সময়। যেখানে মানুষ নিজেকে চিনতে পারে না,সেখানে আবার গড়ে সংসার!! গড়ে? নাকি গড়তে হয়?
সব সম্পর্ক তৈরি হয় প্রয়োজনে।
আমরা কেউ কারো সুলুকসন্ধান জানি না,শুধু প্রয়োজনের গরজে একসাথে পাড় করে দিই জীবন। মানুষ আসলে মরুর বুকে গজিয়ে ক্যাকটাস। তার কোন সঙ্গী হয় না,সাথী হয়। সবাই আসে,আবার চলে যায়।
"কাছের মানুষ" আমাকে খুব প্রিয় একজন দিয়েছিল। সেখানে সে লিখেছে, "" কাছের মানুষ " to my "কাছের মানুষ"। From your." কাছের মানুষ "। কি অদ্ভুত বই টা আছে,মানুষ টা নেই। মানুষেরা আসলে থাকে না। সময় তাদের অন্য কূলে ভিড়িয়ে দেয়। মানুষের " কাছের মানুষ " বলতে আদো কিছু হয়??
প্রতিটি মানুষই নিজের জন্য বাঁচে। কেউ অন্যের জন্য বেঁচে আছে,এ ভাবা ভীষণ মূর্খামি।
সূচিত্রা ভট্টাচার্য আমাকে হাজারটা চিন্তা ভর্তি একটা তরী দিয়ে গেলেন,সে তরী নিয়ে ভাসতে ভাসতে আমি ভাবছি, " ঈশ্বর, এ কেমন নিষ্ঠুরতম খেলা খেলেন মানুষের সাথে? সব দিয়েও যে, তিনি গোপন মারণাস্ত্র টি নিজের হাতেই রেখে দিলেন! "
সুচিত্রা ভট্টাচার্য 'কাছের মানুষ'দের উপাখ্যান লিখতে লিখতে কী লিখেছেন তা হয়তো নিজেও জানেন না। পুরোটা তো নয়ই! হৃদয়ের কাছাকাছি না হোক, রক্তের বাঁধনের অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ যারা, তারাও কি সবাই ঠিক কাছটায় থাকে? রাখা যায় সবসময়?বলা যায় কে আমার কতটা আপনার? মনে হয় না। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কাছের মানুষরাই আদপে দূরের বহু দূরের জন। পরও। আপনও। এও এক অদ্ভুত সম্পর্কের খেলা। যে খেলা খেলছে তিতির, ইন্দ্রাণী, শুভাশিস, আদিত্যরা আর টোটো, বাপ্পারা। যিনি রেফারি, তিনি সবার অলক্ষে মনুষ্যসন্তানদের নিয়ে মেতেছেন খেলায়। সম্পর্কের নামে নানা বিচিত্র সব ঘটনা নিরন্তর ঘটছে সে খেলায়।
দুইটি পরিবারের হাতগোণা কয়েকজন মানুষের জীবন নিয়েই এই ঢাউস উপন্যাস। মানবজীবনের সকল উপাদানের উপস্থিত হয়তো সবার জীবনেই থাকে। কিছু হাসি, কতক কান্না, পাওয়ার সুখ, হারাবার বেদনা - এ সবই আছে 'কাছের মানুষ'এ। আর আছে উপন্যাস শেষ করে উঠবার পর এক অনির্বচনীয় শূন্যতা। কয়েকটি দীর্ঘশ্বাস। আর হৃদয় আর্দ্র হয়ে যাওয়ার গরল অনুভূতি ।
কি অদ্ভুত! এই সংসারের প্রতিটা মানুষ কি গভীর দুঃখ নিয়ে বাঁচে! কেউই সুখী নয়। কেউই না! সব চেনা মানুষের গল্প নিয়ে নির্মম সত্য একটা উপন্যাস "কাছের মানুষ"। অথচ কাছের মানুষের সাথেই আমাদের যোজন যোজন আত্মার দূরত্ব! ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করতে না পারার জন্য দুটো পরিবারের কেউই সুখী হতে পারেনি। শুভময় আর ইন্দ্রাণীর উপর আমার একেক সময় এমন রাগ হচ্ছিল! সাথে করুণাও।
জয়মোহনের মৃত্যুতে হঠাৎ চোখে পানি চলে এসেছিল। আহারে.. মানুষ কত একা! কে কার বেদনা বোঝে!
শিবসুন্দর লোকটাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। জীবনের কাছে তার কোনো উচ্চাশা নেই, দাবী নেই। নিজের আদর্শ নিয়ে সাদাসিধে ভাবে জীবনটা পার করে দিল!
এই গল্পের মাইনর চরিত্র সুকান্তকে আমার সবচাইতে ভাল লেগেছে। ঠিক যেন সঞ্জীবদার "এই নষ্ট শহরের নাম না জানা যে কোনো মাস্তান" যে সত্যি সত্যি তিতিরকে ভালোবেসেছিলো! শেষবেলায় তিতিরকে সে যেভাবে সম্মান দেখিয়েছে সেটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।
গল্পের মাঝখানে কিছুটা বোরিং লেগেছে। মনে হচ্ছিল সেইম দুঃখের কাহিনী টেনে টেনে লম্বা করা হয়েছে। ঠিক একটু পরেই আবার তিতির, টোটো, হিয়া, হিয়ার দাদীমার কষ্ট গভীরভাবে আচ্ছন্ন করেছে।
ইগো আর অভিমানকে ঝেড়ে ফেলতে না পারা মানুষগুলো অসম্ভব দুঃখী হয়। কি গভীর দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে আছে একেকজনের ভেতর কেউ জানেনা। কেউ জানেনা!
"শোকের সঙ্গে সময়ের এক সুক্ষ্ম রেষারেষি আছে। তাদের মধ্যে এক চাপা লড়াই চলছে অবিরাম। এই দ্বৈরথের প্রথম দফায় শোকই জেতে, চকিত আঘাত হেনে সময়কে নিশ্চল করে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে সময় বলবান হয়ে ওঠে, তার অদৃশ্য শরজালে হঠে যেতে থাকে শোক। ক্রমশ নির্জীব হয়ে পরে সে। তবে তাকে নিশ্চিহ্ন করার শক্তি বুঝি সময়েরও নেই। এক শীতল বিষণ্ণতা হয়ে সে টিকে থাকে বহুকাল। অনেকটা যেন মেরুপ্রভার মতো। ক্ষীণ দীপ্তি, অথচ কি তার অপার বিস্তার।"
বইটি শেষ করে শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর একটি কবিতা খুব মনে পড়ছে...
মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও। তোমাকে সেই সকাল থেকে তোমার মতো মনে পড়ছে সন্ধে হলে মনে পড়ছে, রাতের বেলা মনে পড়ছে মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।
এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালবেসে দাঁড়াও মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও
স্কুলে থাকতে দেখতাম এনটিভি তে হত সিরিয়ালটি। সেই ২০০৭/২০০৮ এর ঘটনা। তখন তো আর এতকিছু জানতাম না এটা একটা উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে বানানো। আর তাছাড়া তখন মেগা সিরিয়াল দেখার অভ্যাসও ছিল না। টেলিফিল্ম আর না হয় বড় জোর ধারাবাহিক নাটক যা একটু দেখা হত। তবে সামিনা চৌধুরীর এই গানটার সুবাদে অল্প কিছু পর্ব দেখা হয়েছিল। গানটা বেশ ভালো লাগতো। এর প্রায় চার/পাঁচ বছর পর ইন্টারনেটের কল্যাণে জানতে পেরেছিলাম এটা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস নিয়ে বানানো। এই ভদ্রমহিলার কোন বই তখনও পড়া হয়ে উঠে নি। একদিন লাইব্রেরিতে বই নিতে গিয়ে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের একটি বই চোখে পড়লো। বইটির নাম ছিল ‘অন্য বসন্ত’। কাছের মানুষের লেখিকার বই দেখে নিয়ে এলাম বাসায় পড়ার জন্য। কাহিনী খুব সাদামাটা কিন্তু কী চমৎকার লেখার গাঁথুনি। পড়ে শেষ করলাম। কয়েকদিন আগে দেখলাম এটার কাহিনী নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে একটি সিনেমা নির্মাণ করেছে। শুরু করছিলাম দেখা। কিন্তু তেমন টানলো না। তাই দেখা শেষ করিনি। সে যাই হোক, এরপর আরও একদিন লেখিকার আর একটা বই পেয়ে গেলাম লাইব্রেরি তে। এটার নাম ‘ছেঁড়া তার’। নিয়ে এলাম কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আর পড়া হয়ে উঠছিল না। পড়ে ছিল পড়ার টেবিলে। একদিন হঠাৎ করে নিউজে দেখি সুচিত্রা ভট্টাচার্য আর নেই। চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। লেখিকার একটা বই ছাড়া আর কোন বই পড়া হয়ে উঠেনি তখন কিন্তু তাও বেশ খারাপ লেগেছিল। একটা বই পড়েই তাঁর লেখার কিছুটা ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম কিনা। তারপরের দিনই পড়া শুরু করলাম ছেঁড়া তার। এটার গল্পও আহামরি কিছু ছিল না। কিন্তু কী সুন্দর লেখনী! এরপর একে একে পড়লাম কাচের দেওয়াল, পরবাস, গভীর অসুখ, ভাল মেয়ে খারাপ মেয়ে, হলুদ গাঁদার বনে, তিন কন্যা ইত্যাদি। বলাই বাহুল্য তাঁর লেখার ভক্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু এত বই পড়ার পরও তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সেই কাছের মানুষ আর পড়া উঠছিল না। গত বছর এক সকালে একটা ক্লাস ছিল আর দুপুরে ছিল একটা পরীক্ষা। পরিচিত সবাই ক্লাস করে বাসায় চলে গেল। কী আর করি একা একা বসে। তাই হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম নীলক্ষেতে। উদ্দ্যেশ্য ছিল অন্য কিছু বই কেনার। সেগুলো কেনার পর ভাবলাম এটাকেও বাসায় নিয়ে আসি। রেখে দিয়েছিলাম কিছু দিন এটাকে। এত মোটা উপন্যাস পড়ার সময় ছিল না তখন। ভেবেছিলাম ধীরে সুস্থে একটু ফ্রি হলে এটাকে পড়া শুরু করবো। তাই অন্য বই পড়ে কিছুদিন সময় পার করলাম। কিন্তু খুব টানছিল এটা। এক্সামের পড়া আর টার্মপেপারের কাজ সব শিকেয় উঠলো। বসে পড়লাম এই ঢাউস বই নিয়ে। আর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে ফেললাম।
উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে দুই নারী। ইন্দ্রাণী আর তিতির, যারা সম্পর্কে মা এবং মেয়ে। তাদেরকে ঘিরে আছে আরও একদল মানুষ। আপাতদৃষ্টিতে সবাই খুব কাছের মানুষ। তাদেরকে নিয়েই এই কাহিনী। ইন্দ্রানীর স্বামী আদিত্য বাড়ির বড় ছেলে। কিন্তু হাবভাব বা কাজকর্মে বাড়ির বড় ছেলে হওয়ার কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। মদের বোতল নিয়ে পড়ে থাকতে থাকতে অসুখ বাধিয়ে বসে আছে। এর আগে কয়েকটি ব্যবসা শুরু করে সফলতার মুখ দেখতে পারে নি। সেই কয়েকটি ব্যবসার মধ্যে একটি ছিল ছাপাখানা। ইন্দ্রানী পরে সেটাকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। খুব সফল না হলেও মোটামুটি চলার মত একটি পজিশনে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। আর সাথে আছে তার স্কুলের চাকুরী। আদিত্যর বাবা জয়মোহন যথেষ্ট স্নেহ করেন ইন্দ্রানীকে। একটি অপরাধবোধও তার কাজ করে অপদার্থ ছেলের সাথে ইন্দ্রানীর বিয়ে দিয়ে। ইন্দ্রানীর ছেলে বাপ্পা কলেজে পড়ে। আর মেয়ে তিতির এবার মাধ্যমিক দিয়েছে। আদিত্যর মেজ ভাই সুদীপের অবস্থা আদিত্যর মত নয়। সে বেশ কর্তব্যপরায়ণ এবং তার আর্থিক অবস্থাও বেশ ভালো। তার স্ত্রী রুনার বেশিরভাগ সময় কাটে তাদের ছেলে অ্যাটমকে কড়া শাসনে বড় করে তোলার পিছনে। আদিত্যর ছোট ভাইও আছে এই সংসারে যে একজন স্ট্রাগলিং ফিল্ম অ্যাক্টর। সব মিলিয়ে আপাতদৃষ্টিতে হয়তো মোটামুটি একটি সুখী পরিবার। আদিত্যর একটি বোন আছে, জয়শ্রী। স্বামী শংকর আর ছেলে ঝান্টুকে নিয়ে তার ছোট সংসার। ইন্দ্রানীর বাড়ির কাহিনীও আছে তার অসুস্থ বাবা ধীরাজ আর মা উমাকে ঘিরে। তার ভাই তনুময় অনেক বছর ধরেই নিখোঁজ।
ইন্দ্রাণীর কলেজ জীবনের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু শুভাশিস আছে উপন্যাসের প্রায় অনেকাংশ জুড়ে। আদিত্যর ফ্যামিলি ফ্রেন্ড এবং ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান সে। তার স্ত্রী ছন্দা আর ছেলে টোটোকে নিয়ে ছোট কিন্তু অসুখী পরিবার তার। টোটো আর তিতির একই ক্লাসে পড়ে। ছোটবেলায় খুব ভালো বন্ধু ছিল তারা। কিন্তু কালক্রমে সে সম্পর্কটা বিলীন হয়ে গিয়েছে। টোটোই মায়ের কথা চিন্তা করে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। শুভাশিস আর ইন্দ্রানীর সম্পর্ক নিয়ে অনেকের অনেক রকম কটুক্তি চোখে পরে উপন্যাসটিতে। ইন্দ্রাণীর পরিবারের রুনা আর শুভাশিসের স্ত্রী ছন্দা এর ভিতর অন্যতম। এর কতটুকু সত্যি আর কতটুকু মিথ্যা সেটা বইটা পড়লেই বোঝা যাবে। শুভাশিসের গ্রামের বাড়ির কাহিনীও উঠে এসেছে কিছুটা। সেখানে শুভাশিসের অসুস্থ মাকে নিয়ে থাকেন শুভাশিসের বাবা শিবসুন্দর। তিনিও চিকিৎসক। আরও আছে শুভাশিসের ভাই তুফান, তার স্ত্রী অলকা আর তাদের মেয়ে টুকি।
হ্যাঁ, অনেক অনেক চরিত্র। বড় উপন্যাসগুলোতে সাধারণত যেমনটি থাকে। এরা সবাই একে অপরের খুব কাছের মানুষ। কিন্তু এই চেনাজানা মানুষের ভীড়ে অনেকেই আবার খুব একলা, খুব নিঃসঙ্গ। উপন্যাসের প্রতিটি পাতায় পাতায় যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তার বেশিরভাগই খুব সাধারণ। একটি যৌথ পরিবারে যা যা ঘটে থাকে। সেই চিরন্তন ভাঙ্গাগড়ার খেলা। আমাদের চারপাশে যেমনটি হচ্ছে। বড় পরিবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হওয়ার গল্প। বড় বাড়ি ভেঙ্গে অ্যাপার্টমেন্ট উঠে যাচ্ছে তার গল্প। চির পরিচিত মানুষের মৃত্যুর পর বদলে যাওয়া বাড়ির পরিবেশের গল্প। এই সবকিছু তো আমাদের জীবন থেকে নেওয়া। আর এই সব ঘটনা উপন্যাসে আবর্তিত হয়েছে ইন্দ্রানী আর তিতিরকে কেন্দ্র করে। সিরিয়ালটিতে এই দুটো চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা এবং সানজীদা প্রীতি। দুটি চরিত্রেই তাদেরকে সুন্দরভাবে মানিয়ে গিয়েছিল। সাথে অন্যান্য যারা ছিলেন প্রায় সবাইকেই ভালো মানিয়েছিল। বিশেষ করে আদিত্য চরিত্রে হুমায়ুন ফরিদীর অভিনয় অনবদ্য ছিল। যদিও সিরিয়ালে ইরানী আর আদনান নামে পরিচিত ইন্দ্রাণী ও আদিত্য চরিত্র দুটির। অন্যান্য চরিত্র গুলোর নামেরও কিছু পরিবর্তন আছে কিন্তু গল্প একই। যারা সিরিয়ালটি আগে দেখেন নি কিন্তু দেখতে চান তারা আগে বইটি পড়ার চেষ্টা করবেন। সিরিয়ালটি বেশ ভালো ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু এমন বইয়ের তুলনা আসলে কোন কিছুর সাথে হয় না। আমার খুব প্রিয় বই পথের পাঁচালী ছোটবেলায় যে কতবার পড়েছি তার কোন হিসাব নেই। কিন্তু সেটার মুভি হাতে গোনা কয়েক বার দেখেছি। আমার অসম্ভব প্রিয় একজন পরিচালক সত্যজিৎ রায় ডিরেকশান দেওয়ার পরও। এটার কারণ বইয়ের তুলনা আসলে শুধু বই-ই হতে পারে। খুব কম চলচ্চিত্র দেখেছি যেটা তার বইকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।
অনেকে আবার সিরিয়ালটি দেখে ফেলায় বইটি আর পড়তে চায় না। আমি খুব বেশি পর্ব দেখে না থাকলেও ঘটনার আদ্যোপান্ত সবই জানতাম। তখন তো ছিল সেই ল্যান্ডফোনের যুগ। ফ্রেন্ডদের সাথে স্কুল আর কোচিং ক্লাস করে আসার পরও রাজ্যের কথা জমে থাকতো। সন্ধ্যার পর শুরু হত পড়ার ফাঁকে ফাঁকে পালা করে সবাইকে ফোন দেওয়া। এক ফ্রেন্ড খুব সিরিয়াল দেখতো। তবে আমি সিরিয়ালে তেমন ইন্টারেস্টেড না থাকায় সেগুলোর কাহিনী আর শুনাতে পারতো না। তবে এটা যেহেতু মাঝে মাঝে কিছু পর্ব দেখতাম তাই এটার গল্প শুনতে কোন বাধা ছিল না। কাহিনী জানার পরও পড়তে খুব ভালো লেগেছে। যাদের দেখা আছে তারা পড়ে দেখতে পারেন। আশা করছি নিরাশ হবেন না।
কিছু বই হয় নদীর মত। সাঁতার কেটে একের পর এক টুকরো গল্প পেরিয়ে ওপারের কিনারে পৌছাতে হয়। আর কিছু বই হয় সমুদ্রের মত। সেই সমুদ্রের ঘটনা গুলোর সাথে, চরিত্র গুলোর সাথে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে হয়। ভাসতে ভাসতে কখন যে পাড়ে আছড়ে পড়া যেন টের পাওয়া যায় না। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কাছের মানুষ ঠিক যেন তেমন এক সমুদ্র।
বাবা-মা, আত্নীয়, বন্ধু, পড়শি সবার সাথে মিলেমিশে থেকেও যে আমরা প্রত্যেকে কতটা গভীরভাবে একা, কতশত সম্পর্কের ভিড়ে আমরা যে কতটা গভীরভাবে সম্পর্কহীন সেটার একটা স্বচ্ছ চিত্র এই বইটি।
ইন্দ্রাণী ভালোবেসে ছিল শুভাশিসকে। কিন্তু বুকে কমিউনিজমের মশাল জ্বালিয়ে শুভাশিস একদিন কোথায় হারিয়ে গেল। ওদিকে ইন্দ্রাণীকে মেনে নিতে সময়ের নিয়ম। ইন্দ্রাণীর সাথে বিয়ে হয়ে গেল আদিত্যর। অনিচ্ছুক, অসাড় মৃতপ্রায় শরীর আদিত্যকে দিয়ে ইন্দ্রাণীর সংসার চলছিল একরকম। একটা সন্তানও এলো। বাপ্পা। কিন্তু সব হিসেব উলোটপালট করে একদিন শুভাশিস ফিরে এলো। শুভাশিসও ততদিনে সংসারী। ছন্দা নামের সুন্দরী স্ত্রী ঘরে।
কিন্তু সংস্কার আর সংসারের কেটে দেয়া গন্ডি কেউ মেনে নিলো না। শুভাশিস আর ইন্দ্রাণী আবার দুর্বল হয়ে পড়লো। শরীরের সাথে শরীরের কর্ষণে মেতে উঠলো অতৃপ্তি আর না পাওয়াকে মুছে দিতে। ইন্দ্রাণীর গর্ভে আবার সন্তান এলে। মেয়ে সন্তান। তিতির। তবে এইবার পিতৃত্বের অহংকারের ভাগি হতে পারলো না আদিত্য। জানলোও না।
তারপর সময় গড়াল। শুভাশিসের বৈধ সন্তান টোটো বড় হল, অজ্ঞাত কন্যা তিতির আদিত্যর পরিচয়ে কৈশোরে উঠলো। ইন্দ্রাণীদের ঢাকুরিয়ার প্রাচীন বাড়িটা আদিত্যর ছোট ভাই কন্দর্পকে ব্যবহার করে নিয়ে নিলো ধুরন্ধর প্রমোটার অশোক মোস্তাফি। অবশ্য বিনিময়ে কন্দর্প ফিল্মে সুযোগ পেল। সেই আক্ষেপ বুকে নিয়ে প্রথমে চলে গেলেন আদিত্যর পিতা জয়মোহন।
তার বেশ কিছু পরে শুভাশিসের পিতা মাধবপুরের ডাক্তার শিবসুন্দরও চলে গেলেন। সম্ভবত এই উপন্যাসের সবথেকে লিবারেল আর ম্যাচিউরড চরিত্র ছিলেন শিবসুন্দর। মাধবপুরের মানুষের সেবার নিজেকে করেছিলেন নিয়োজিত কিন্তু নিজেকে উজাড় করেছিলেন স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখার নিরলস সংগ্রামে। যে স্ত্রী একটা জড় বস্তু অধিক কিছু নয় সেই স্ত্রীর জন্য এই মানুষটার লড়াই দেখে মনে হয়েছে হোক উপন্যাসে তবুও ভালোবাসা আজও বেঁচে আছে। ভালোবাসায় বিশ্বাস হারাতে নেই।
গল্পটা মূলত মা ইন্দ্রাণী আর মেয়ে তিতিরকে নিয়ে। নিজের পেটের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ইন্দ্রাণী জানত তাদের সম্পর্কের মাঝে পুরোটাই যেন ফাঁকি। আচ্ছা তিতির যদি কোনদিন জানতে পারে তারা প্রকৃত পিতার পরিচয় ও কি মেনে নিতে পারবে? ওর পুরোটা জুড়েই তো বাবা আদিত্য। মাতাল, অপদার্থ, বাস্তববুদ্ধিহীন কিন্তু বাবা আদিত্যকে ছাড়া যে তিতির আর কাউকে ততটা আপন করতে পারে না। কি করে মেনে নিবে তিতির? আর সেদিন কি ইন্দ্রাণী তিতিরের চোখে চোখ রাখতে পারবে? নাকি পালিয়ে যাবে?
"কাছের মানুষ" পড়ার পর একটা জিনিস মনে হল-- যে কেউই এই বইখানা পড়বে,এই উপন্যাসের কোন না কোন চরিত্রের সাথে নিজের মিল খুঁজে পাবে। হোক সে মেইন ক্যারেক্টার,হোক সাইড ক্যারেক্টার। এ জিনিস টা সত্য কিনা যাচাই করার জন্য আমার ছোটবোন কেও পড়তে দিলাম। সে ও একটা চরিত্রের সাথে নিজের মিল খুঁজে পেল। হতে পারে উপাখ্যান টা যেহেতু পারিবারিক পরিপ্রেক্ষিতে লেখা তাই মিলটা খুঁজে পাওয়া যায়। তবে আমার মতে সব চরিত্র কে গুরুত্বদানের কাজ টা সুচিত্রা ভট্টাচার্য খুব সুন্দরভাবেই করেছেন। আমার ব্যক্তিগতভাবে শিবসুন্দর চরিত্র কে বেশি ভাল লেগেছে।পারিবারিক কলহের অংশ গুলো পড়ে হাসি ই পাচ্ছিল। মানুষ বড়ই অদ্ভুত,সময়ের সাথে কত কি ই না করে।এক কথায় বেশ ভাল লাগার মতন উপন্যাস।
উহ্! এভাবেও সম্ভব? শুধু শব্দ দিয়ে এভাবে বেঁধে ফেলা যায়? বিহ্বল করে ফেলা যায়? পড়ার সময় সারাক্ষণ মিশে ছিলাম চরিত্রগুলোর সঙ্গে। শেষ করার পর স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম কিছুক্ষণ। এখনো সেই ঘোর কাটছে না।
Lately I'm watching Goodreads is improving and updating lots of Bengali books ! Which s totally great ! কাছের মানুষ আমার অন্যতম প্রিয় বই । কারণ এই বউড়ির মধ্যে মানুষের অন্তরের অনেক প্রতিচ্ছবি আছে। বই পড়ে কান্না পাবে ইন্দ্রানীর জন্য । মন খারাপ হবে তিতির ও ওর বাবার জন্য । শুভর জন্য ও কষ্ট হবে। অবশ্যই পড়ুন বইটা।
এ বছরে এখন পর্যন্ত পড়া সেরা বই, পুরোটা সময় জুড়েই ইন্দ্রাণী আদিত্য আর শুভাসিষের সম্পর্কের টানাপোড়েন, তিতির টোটোর দ্বন্দ্ব ,আর বাকি চরিত্রগুলোকে মনে হয়েছে পাশের বাড়ির আত্মীয় যাদের কে রোজ দেখি,অনুভব করি, বইটা আসলেই খুবববববববই ভালো ছিল
কাফকা বলেছেন, যে বই পড়ে তোমার হৃদয় জখম হবে, যে বই তোমার বুকে আঁচড় কাটবে, দুঃখ দিবে প্রিয়জনের মৃত্যুর মতো আর হৃদয় সমুদ্রে হানবে জলোচ্ছ্বাস- প্রকৃত সুখ তো সে বই পড়েই। কাফকার কথা জানিনা। কিন্তু আমি নিজে দীর্ঘদিন বই পড়ার এই সুখ থেকে বঞ্চিত ছিলাম। এই যে এতদিন ঘরে বন্দি! এই কদিনে বই পড়া হয়েছে গুটিকতক। কিন্তু তা শুধু পড়ার জন্য পড়া। তারপর একদিন হঠাৎ আমার ছোট বুকশেলফটা ঘাটতে ঘাটতে খেয়াল হলো একটা বই অনেকদিন ধরে শেলফে তুলে রাখা আছে কিন্তু পড়া হয়নি।
সূচিত্রা ভট্টাচার্যের 'কাছের মানুষ'। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই বইটা আমার অতি কাছের একজন মানুষের থেকেই পাওয়া! বই খুলতেই প্রথম পাতায় চোখে পড়ে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা জলের গানের 'ফুলচাষী'র চারটে লাইন। বই খুলে যতবারই এই চার লাইন চোখে পড়ে মন স্নিগ্ধ ভালোলাগায় ভরে যায়। সূচিত্রা ভট্টাচার্যের বই আমি আগে কখনো পড়িনি। তার নামও শুনেছি কদাচিৎ। তাই কোনোরকম এক্সপেকটেশন ছাড়া শুরু করেছিলাম বইটা। বইয়ের নাম কাছের মানুষ হলেও পুরো বই জুড়ে শুধু মানুষের দূরে যাওয়ার কাহিনী।
এই বইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইন্দ্রাণী। তাকে ঘিরে তার কাছের মানুষেরা যেই বৃত্ত রচনা করেছে তাই নিয়েই এই উপন্যাস। এই বৃত্তের একজন কিশোরী থেকে যুবতি হওয়ার মাঝপথে দাড়িয়ে থাকা ইন্দ্রাণীর মেয়ে তিতির, যে কিনা সম্পর্কের পেঁচানো সুতো একটু একটু করে ছাড়াতে গিয়ে নিজেই তার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে। বৃত্ত রচনায় তিতিরের সঙ্গি হয়েছে তার ভাই বাপ্পা- নিজের মানুষ, নিজের শহর ছেড়ে সমুদ্রের বুকে আশ্রয় খুঁজতে থাকা এক যুবক। ইন্দ্রাণীর স্বামী আদিত্য, পরিবারের বড় ছেলে হয়েও বড় না হতে পারা, সহজে মানুষকে বিশ্বাস করে নিজের কাছে নিজে ঠকে যেতে থাকা এক ব্যর্থ মানুষ। আর আছে শুভাশিস, ইন্দ্রাণীর অপরিণত প্রেম, ইন্দ্রাণীর মেঘে ঢাকা আকাশের এক কোণে উকি দেওয়া সূর্যের মতো। এদের ঘিরে ডালপালা ছড়িয়েছে আরো ছোটবড় অনেক চরিত্র। আদিত্যর বাবা জয়মোহন, দুইভাই-সুদীপ, কন্দর্প। শুভাশিসের স্ত্রী ছন্দা, ছেলে রাজর্ষি, বাবা শিবসুন্দর। এই চরিত্রগুলো নিজেদের ঘিরে তৈরি করেছে অসংখ্য ছোট ছোট বৃত্ত। যেই বৃত্তের ভেতর তাদের প্রত্যেকের আলাদা একটা জীবন আছে। প্রত্যেকের আছে আলাদা গল্প। এই গল্পের মাঝে ডুবে গিয়ে কখনো ইন্দ্রাণীর জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি, কখনো তিতির মেয়েটার জন্য বড্ড মায়া লাগতো, কখনো বাপ্পার স্বার্থপরতায় ক্ষোভও হয়েছে, কখনো আদিত্যর জন্য এসেছে সহানুভূতি।
সূচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখনি এত দারুণ! আমি সব দৃশ্যগুলো যেন চোখের সামনে দেখতে পেতাম! ঢাকুরিয়ায় ইন্দ্রাণীদের সেই দোতলা বাড়িটা যেন আমার কত পরিচিত! নিচতলায় জয়মোহন ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে আছেন, দুপুরবেলায় শুনশুান বাড়ির গায়ে আঁচড় কাটা গ্যারেজ ঘরে প্রেসের শব্দ, বিকালে বারান্দায় বেণী বেঁধে দাড়িয়ে থাকা তিতিরকে যেন স্পষ্ট দেখতে পেতাম। ইন্দ্রাণী বসে আছে ভেতরের ঘরে, ঝুকে একমনে পরীক্ষার খাতা দেখছে। সব ছবি হয়ে ভেসে উঠতো!
এই বই আমাকে জীবন নিয়ে অনেক ভাবিয়েছে। সম্পর্ক জিনিসটা বাইরে থেকে যতটা মজবুত দেখায় ভেতরে কি ততোটাই ফাঁপা! আমাদের কাছের মানুষেরা আসলে আমাদের কতোখানি কাছের! নাকি সবই স্বার্থের খেলা, স্বার্থে টান পড়লে কাছের মানুষেরা কত অনায়াসেই না দূরত্ব জমিয়ে ফেলে! তবে পুরো বই জুড়ে যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি সে হচ্ছে ইন্দ্রাণী। বই পড়ে আমার বারবার মনে হয়েছে আমি যেভাবে ইন্দ্রাণীকে দেখছি সেভাবে যদি সবাই দেখতে পেতো! এই পৃথিবীতে ইন্দ্রাণীরা যে বড় দুঃখী হয়। তারা নিজেদের চারপাশে যে অদৃশ্য দেয়াল তুলে রাখে তা ডিঙিয়ে কেউ আসতে পারেনা, তাদের কাছের মানুষেরাও নয়। ইন্দ্রাণীর জন্য আমার কষ্ট হতো। মনে হতো ক্যানো এই পৃথিবীতে এত মানুষের মাঝে একজন মানুষকে কেউই বুঝতে পারলোনা, কেউ না! ক্যানো ইন্দ্রাণীরা এত একা হয়। আহা, প্রবল আত্মসম্মানবোধ আর অভিমানের অনলে পুড়তে থাকা ইন্দ্রা���ী! ইন্দ্রাণীর পরেই আমার প্রিয় চরিত্রের জায়গা দখল করে নিয়েছেন শুভাশিসের বাবা শিবসুন্দর। নিজের আদর্শের উপর ভর করে চলা এই মানুষটার সাথে ইন্দ্রাণীর কোথায় যেন একটা মিল- প্রবল আত্মসম্মানবোধে নাকি অভিমানে কে জানে! তা সে যাই হোক, চিন্তা চেতনায় নিজের সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন এই মানুষটি। তবে সে ইন্দ্রাণী হোক, বা শিবসুন্দর, বা আদিত্য, বা শুভাশিস, সংসারের করুণ খেলায় তারা সবাই বিপর্যস্ত। সংসারে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চাওয়া। আর সেই মেটাতে না পারা চাওয়া দিনশেষে তাদের বিবেক হয়ে দংশন করে। সংসারের এই ভাঙা-গড়ার খেলা সূচিত্রা ভট্টাচার্য নিপুণ হাতে এঁকেছেন।
এই বইয়ের শেষপাতা যখন পড়ছিলাম কাফকার কথামতো তখন আমার হৃদয় সমুদ্রে প্রবল জলোচ্ছ্বাস আর চোখে জমেছে বাষ্প। চশমায় জমতে থাকা সেই বাষ্প মেঘ নিয়ে বইটা যখন আমি শেষ করলাম তখন আমার বুকের ��েতরে দুমড়ে-মুচড়ে এক কষ্টের সুর বেজে যাচ্ছে। সেই কষ্টের উৎস কি ইন্দ্রাণী, শুভাশিস নাকি তিতির জানিনা। জানতেও চাইনা। কিছু কিছু কষ্ট বড় ভালোলাগে।
মেয়ের প্রতি যুগপৎ ঘৃণা আর ভালোবাসা বহন করা ইন্দ্রাণীর প্রতি মায়া জাগে না এমন পাঠক বোধহয় নেই। আবার তিতিরের দুঃখ কস্ট ও ছুয়ে যায় আমাদের। এক মুহূর্তের সিদ্ধান্ত বা দোলাচলের ফল কিভাবে ভুগতে হয় সারা জীবন তাই প্রমাণ করে এই বই। নাম টাও অদ্ভুত!কাছের মানুষ! মানুষ কাছে আসে কিসে? রক্তে আত্মায় নাকি ভালোবাসায়?
উপন্যাসটা প্রথম পড়েছিলাম তখন আমি ক্লাস সেভেন কি এইট। বিশেষ কিছু অনুধাবন করতে পারিনি। তারপর আবার পড়া বছর পেরিয়ে। তারপর যতবারই পড়েছি একটু একটু করে নতুন ভাবে চিনতে শিখেছি আশপাশের জগৎ টাকে। এ যেন সাহিত্যের এক অন্য পাওনা।
অসাধারণ ফ্রি ফ্লোয়িং লেখনী সুচিত্রা ভট্টাচার্যের। আমাদের colloquial ভাষায় এরকম বিশাল এক উপন্যাস লেখাটা একপ্রকার দুঃসাহসিক নয় কি? বিপুলকায় উপন্যাসে কত শত চরিত্রের আনাগোনা, তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব এক একটা গল্প আছে, সূক্ষ্ম সুতোয় প্রতিটা গল্প বাঁধা আছে একটা আরেকটার সাথে; একটু টান পড়লেই সে সুতো ছিঁড়ে কাঠামো ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। অথচ লেখিকা দক্ষতার সঙ্গে ধরে রেখেছেন পুরোটা — narrative flow is super smooth, character arcs are very well-defined. চরিত্র সংখ্যার ব্যাপ্তিতে কিন্তু খেই হারাতে হয় না কখনোই কারণ এইসব চরিত্ররা সম্পর্কে আমাদের কাছের মানুষ, অথচ প্রত্যেকে একাকী, নিঃসঙ্গ— আজীবন! জীবনের প্রতিটি স্তরে ভিন্ন ভিন্ন নামের সহযাত্রী জোটে বটে, কিন্তু তাতে হৃদয়ের নির্জনতা ঘোচে না। এই উপন্যাস সেই নির্জনতারই অনুসন্ধান।
এই বৃহৎ উপন্যাসের চালচিত্র সমসময়, পটভুমি সমসাময়িক সমাজ। লেট 80s এর গল্প হলেও কিন্তু সময়ের স্রোতে গল্পের সমসমায়িকতা এখনো ক্ষয়ে যায়নি। আধুনিক যুগে আত্মকেন্দ্রিক সমাজই কি মানুষকে লক্ষ্যহীন উচ্চাশার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে? নাকি সেই চিরন্তন ষড়রিপু আবহমান কাল ধরে মানুষের মনে বুনে চলেছে একাকিত্বের বীজ? এত স্বার্থপর ভাবে কিভাবে বাঁচতে পারে মানুষ? "কোনোভাবে একটা তো বাঁচতেই হয়! আসলে বেঁচে থাকাটাই সুখ। বেঁচে থাকাটাই আনন্দ।" কিন্তু মানুষ কি একাকী দ্বীপ, যে সে কারোর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রেখে বেঁচে থাকবে আদি অন্তকাল? দ্বীপও যে গভীর জলের তলে একে অপরের সাথে সংশ্লিষ্ট, তাহলে মানুষ কি করে নিজেকে সম্পর্কের জাল থেকে ছাড়ায়? "অনেককেই তো ছেড়ে থাকা যায় না রানি! তবু ছেড়ে থাকতে হয় একসময় বিচ্ছেদটাই অভ্যাস হয়ে যায়।" সম্পর্কের সংজ্ঞাটা ঠিক কি? সম্পর্কের ভিত্তি কি শুধুই বিনিময়? নাকি অন্য কোনো গভীর রহস্য নিহিত রয়েছে এই ছোট শব্দটিতে? এরকম টুকরো টুকরো নানান জটিল অথচ মনস্তাত্বিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন লেখিকা এই বিরাট উপন্যাসের পাতায় পাতায়।
উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে দুই নারী চরিত্র। ইন্দ্রাণী আর তিতির— সম্পর্কে মা এবং মেয়ে। তাদেরকে ঘিরে আছে আরও একদল মানুষ, আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কে তারা কাছের মানুষ। একান্নবর্তী রায় পরিবারের বড়ো বউ ইন্দ্রাণী— স্পষ্টবক্তা, দৃঢ়চেতা, বুদ্ধিমতী, সাহসী, দায়িত্ব পরায়না এক নারী। স্কুল শিক্ষিকা এবং সংসারের বংশানুক্রমিক ছোট ছাপাখানার ব্যবসার কর্মভারও সামলায়। কিন্তু মধ্যে মধ্যে সে এক মুখোশ আঁটা অভিমানী মানুষ। কেন?
তাঁর স্বামী আদিত্য— বিভিন্ন ব্যবসায় অসফল , মদ্যপ, কুঁকড়ে থাকা ব্যর্থ এক মানুষ। ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো রাস্তাই কি নেই তার?
আদিত্য ইন্দ্রাণীর বড়ো ছেলে বাপ্পাদিত্য— কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রেখেছে কলেজের গণ্ডিতে এসে। সে উদ্যোগী, উচ্চাকাঙ্খী, কিছুটা হয়তো স্বার্থপর। জাহাজের চাকরিটা পেয়ে গিয়ে পূরণ হয় তার পালিয়ে বাঁচার স্বপ্ন গুলো। জাল বোনে এক নতুন অভিজ্ঞতার। কিন্তু খরচ যোগাবে কে?
ছোটো মেয়ে মঞ্জিমা ওরফে তিতির— মাধ্যমিক দিয়ে নতুন ইস্কুল, নতুন করে বড়ো হওয়া তার। শান্ত, বাবা-অন্ত-প্রাণ , নরম-হৃদয় তিতিরের স্বপ্নটা ভারী অদ্ভুত— সে চ্যাপেলের নান হতে চায়। পাড়ার তথাকথিত মস্তান সুকান্তর সাথে সময় কাটানোর সময় সে যেমন আড়ষ্ট, তেমনই প্রিয় বান্ধবী হিয়ার সাথে ভুল বোঝা বুঝিতে আহত। কৈশোরের নানান চড়াই উতরাই এর গল্প পড়তে পড়তে কখন যেন মিশে যাই তার সাথে আমিও।
পরিবারের বটবৃক্ষ অশীতিপর জয়মোহন— স্ত্রী র মৃত্যুর পর একাকী নিস্তরঙ্গ ক্ষয়িষ্ণু জীবন কাটান চার দেয়ালে বন্দি মেজো ছেলের সংসারে। তিনি কি পারবেন চিরন্তন ভাঙ্গাগড়ার খেলা এড়িয়ে বাড়িটা বাঁচাতে? নাকি সময়ের বিবেক, মূল্যবোধ, অনুশাসনে গড়ে ওঠা বাড়ির মত ভেঙে পড়বেন তিনিও?
মেজো সুদীপের অবস্থা আদিত্যর মত নয়। সে কর্তব্যপরায়ণ এবং আর্থিক ভাবে সচ্ছল। তার স্ত্রী রুনার বেশিরভাগ সময় কাটে তাদের ছেলে অ্যাটমকে কড়া শাসনে বড় করে তোলার পিছনে। তবু কিসের না পাওয়া তাদের সংসারে?
আদিত্যর ছোট ভাই কন্দর্প ও আছে দাদার সংসারে। সে একজন স্ট্রাগলিং ফিল্ম অ্যাক্টর। প্রেমে পড়ে তারই বন্ধুর বিধবা স্ত্রীর। সমাজ কি মেনে নেবে সেসব? ঘুষ খোর মানুষদের সাথে ওঠা বসায় কি তার চরিত্র বদলে যাবে, পারবে সে গ্ল্যামার জগতে ঠাঁই করে নিতে?
আছে তাদের ছোটো বোন জয়ী। বাড়ির অমতে পালিয়ে বিয়ে করে শংকর কে। স্বামী পুত্র নিয়ে সুখের সংসার তার। আদেও কি সুখী তারা?
আছে ইন্দ্রাণীর অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা মা আর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ভাই তনুময়। কিভাবে নিখোঁজ হল সে? বেঁচে আছে কি কোথাও কোনো এক প্রান্তে? নাকি সে মরে গিয়েছে গভীর জটিল এক গোপন ঘটনার সাক্ষী হয়েই?
উপন্যাসের প্রায় অনেকাংশ জুড়ে আছে ইন্দ্রাণীর কলেজ জীবনের ঘনিষ্ট বন্ধু শুভাশিস— ইন্দ্রাণী দের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড এবং ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান সে। তার স্ত্রী ছন্দা আর ছেলে টোটোকে নিয়ে ছোট কিন্তু অসুখী পরিবার। কেন বিলীন হয়ে গেলো টোটো আর তিতিরের সম্পর্কটা। হিয়া কি পারবে সেই সম্পর্ককে ফিরিয়ে দিতে? ছন্দার পসেসিভনেস কি নিতান্তই অমূলক নয়? নাকি সূক্ষ্ম সুতোয় বাঁধা আছে অন্য কোনো নৌকো?
গ্রামের বাড়ি মাধবপুরে রয়েছে শুভাশিস এর ভাই তুফান, তার স্ত্রী অলকা আর তাদের মেয়ে টুকি। সহজ সরল গ্রাম্য সংসার তাদের।
এই উপন্যাসের সবথেকে লিবারেল আর ম্যাচিউরড চরিত্র সম্ভবত শিবসুন্দর— শুভ আর তুফানের বাবা। মাধবপুরের মানুষের সেবায় নিজেকে করেছিলেন নিয়োজিত কিন্তু নিজেকে উজাড় করেছিলেন স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখার নিরলস সংগ্রামে। যে প্যারালাইজড স্ত্রী বহু বছর ধরে একটা জড় বস্তু অধিক কিছু নয় সেই স্ত্রীর জন্য এই মানুষটার লড়াই দেখে মনে হয়েছে ভালোবাসায় বিশ্বাস হারাতে নেই। পারবেন কি তিনি বিশ্বাসে ভর করে টিকে থাকতে?
উপন্যাসের প্রতিটি পাতায় পাতায় যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তার বেশিরভাগই খুব সাধারণ। অথচ তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে কত অজানা প্রশ্নের উত্তর। বদলে যাওয়া এই সমাজ ও পরিবারের অংশ আমরা সবাই। বইটা পড়লেই এক জীবন্ত চলচ্চিত্র চোখের সামনে ভেসে চলে। নানা রকমের আবেগ মন ছুঁয়ে কোথাও বিলীন হয়ে যায়। আমি মনে করি এইটাই হল একটা ভালো উপন্যাসের কষ্টি, যেইটা পড়ে পাঠকের মনে নানা রকমের আবেগের সৃষ্টি হবে।
শুধু চরিত্রের ���মাহার নয়। একান্নবর্তী সংসারের ভাঙ্গন, চাকরিসূত্রে বাইরে চলে যাওয়ার ফলে মা-ছেলের মধ্যে বেড়ে চলা দূরত্ব, গ্রাম জীবনের সরলতা ও রাজনীতি, তারই মধ্যে এক উন্নতশীর বৃদ্ধ ডাক্তারের জীবনযাপন, কিশোর বয়েসের মান অভিমান ভালোবাসার লুকোচুরি, সফল মানুষের গোপন ব্যর্থতার কাহিনী, বিফল মানুষের সফল না হতে পারার আকুতি, নতুন প্রজন্মের আশা-আকাঙ্খার গল্প, বর্তমান সমাজের অসহায়তা আর পাপবোধের কথা, ব্যর্থ বিপ্লবের যন্ত্রণা, দুই প্রজন্মের দ্বন্দ্ব বর্তমান জীবনের অনেক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গল্প এগিয়েছে , যার সম্মুখীন আমাকে আপনাকেও জীবনের কোনো না কোনো সময়ে হতে হয়েছে বা হবে। এইজন্যেই এই উপন্যাস হয়ে উঠেছে আত্মবিশ্লেষণের উপাদান।
3 star দিচ্ছি কারণ পুরোটা না পড়ে রেটিং দেওয়া উচিত না, নইলে 2star দিতাম। আমি পড়লাম শুরুর কিছুটা। আমার ঠিক পোষায়নি। কেমন যেন অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা, ঠিক জমছিলনা, ইচ্ছে করছিলনা যে পড়তে থাকি, শেষ করি। তাই করলামনা। আপনাদের মতামত জানাবেন।
একবারও মনে হলনা গল্পঃ পড়ছি। বাস্তবের ছায়া, নিত্যদিনের চিন্তা - ভাবনা দিয়ে ছেয়ে যাওয়া খুব কাছের কিছু মানুষের পরিবর্তনের সাক্ষী রেখে যাওয়া প্রত্যেক পাতায়। কি স্বচ্ছ বাস্তব! কি জটিল সব সম্পর্ক,মানুষের মন। - মানুষ এর মন এবং মানুষের সম্পর্কে আগ্রহী হলে পরে ফেলুন নির্দ্বিধায়।
আমাদের যারা কাছের মানু্ষ, তারা কি সত্যিই কাছের? কিংবা, আমরাই কি তাদের কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পারি? নাকি সবটাই কাছের মানুষের মুখোশ পরে থাকা হেঁয়ালিময় উপাখ্যান! . . . জুন ১৯, ২০২৫ | ঢাকা, বাংলাদেশ
ঠিক কাদের বা কাকে কাছের মানুষ বলি আমরা? রক্তের সম্পর্ক নাকি , যারা মনের কোণে জায়গা দখল করে বসে আছে? মানব সম্পর্কগুলো কেমন অদ্ভুত তাই না? যুগ যুগ ধরে একসাথে থেকেও আমরা বলতে পারি না মানুষগুলো ঠিক কতটা আমাদের আপন আবার অপরপক্ষে অল্প দিনের পরিচয়ে আমরা ঠাহর করে ফেলতে দ্বিধা করিনা অপর মানুষটি নিশ্চয়ই আমাদের কাছের কেউ। বছরকে বছর একই ছাদের নিচে থেকেও অনেক সময় মানুষগুলো আমাদের প্রভাবিত করতে অক্ষম হয় , কোথায় যেন সুতো ছিঁড়ে যায় যা বুনতে তো সময় লাগে কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সময়ের ব্যবধানে, কাছের মানুষ হয়ে যায় দূরের মানুষ। আবার দীর্ঘ দিন একসাথে বাস করা মানুষগুলো ক্রমশ নিজেদের আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চায়, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াতেই তাদের ভয়। এসবটাই বোধ হয় মানব সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য।
একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে ওঠা তিতিরের কিছু দিন হলো মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। মা ইন্দ্রানী ও বাবা আদিত্যর যে শুধু স্বভাবে অমিল তা না, তাদের নিজেদের মধ্যেও এখন পাহাড় সমান দূরত্ব। মা যেমন দায়িত্ববান, বাবা ঠিক তার উল্টো, নেশায় বুঁদ হয়ে এখন হাসপাতালে দিন গড়াচ্ছে তার। তিতিরের পরিবারটিকে কেবল নামেই যৌথ পরিবার বলা চলে , কেননা এক সাথে থেকেও সবাই বিচ্ছিন্ন। তিতিরের মেঝ কাকা সুদীপ তার পরিবার নিয়ে ঘরের এক কোণে আলাদা সংসার জীবন শুরু করেছে বহুদিন হলো, তিতিরের ছোট কাকা কন্দর্পের ফিল্মের নেশা, বাড়ির মানুষদের নিয়ে তার খুব একটা মাথা ব্যথা নেই। এদের সবাইকে না চাইতেও যুক্ত করে রেখেছেন তিতিরের দাদা জয়মোহন। তবুও কালে ভাদ্রে এই বাড়ির সদস্যদের একত্রে দেখতে পাওয়া যায়, দূর থেকে দেখলে মনে হয় কাছেই তো এরা ভালো ছিল কিন্তু যা পুরোদমে ফাটল ধরতে শুরু করে তা জোড়া লাগার বৃথা শ্রম না করাই শ্রেয়, এতে অন্তত সম্পর্কে তিক্ততা জন্মে না তবে দূরত্ব অটল থাকে। এক পক্ষ যেখানে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারলে বাঁচে ঠিক তার বিপরীতে ইন্দ্রানীর মা-বাবা আজও অপেক্ষায় আছে তাদের ছেলের, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সে নিরুদ্দেশ তবুও তারা আশায় আছে ছেলে হয়তো ঘরে ফিরবে।
অপরদিকে শুভাশিস, ছন্দা ও তাদের ছেলে টোটোর জীবনে অর্থের প্রাচুর্যের অভাব না হলেও সম্পর্কে ভালোবাসার ঘাটতি বিদ্যমান। পেশায় ডাক্তার শুভাশিসের যান্ত্রিক জীবনে পরিবারের প্রতি তার একমাত্র দায়িত্ব অঢেল সম্পদ দিয়ে তাদের তুষ্ট করার ব্যর্থ চেষ্টা করা। তার পরিবার এবং তার মাঝে দেয়াল সৃষ্টিকারী সে মানবী আজও যেন তাকে আটকে রেখেছে নিজের কাছে। এই পরিবার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখতে পাওয়া যায় শুভাশিসের বাবা শিবসুন্দরের জীবনে। বিশ বছর যাবত শুভাশিসের মা মানসিক ভারসাম্যহীন তবুও শিবসুন্দর স্ত্রীকে আঁকড়ে ধরে আছে, এক অদৃশ্য টান আটকে রেখেছে দু'জনকে।
লেখিকার লেখনশৈলী এতোটাই চমৎকার যে বইয়ের প্রত্যেকটা চরিত্রকে জীবন্ত মনে হচ্ছিলো। ছয়শো পেইজেরও বেশি এই বিশাল বইটি পড়ে শেষ করার পর মনে হচ্ছিল আরেকটু বড় হলে খুব ক্ষতি হতো না। চরিত্রগুলোর গাঁথন এমন করে তৈরি করা যে ঠিক কার জন্য করুণা করবো সে নিয়ে দোটানায় পড়তে হয়েছে। শুধু এই বছরের পছন্দের বইগুলোর মধ্যে না , সাথে আমার পড়া সেরা বইগুলোর মধ্যে এই বইটিকে নিঃসন্দেহে যুক্ত করা যায়।
‘কাচের দেয়াল’ শেষ করেই সুচিত্রা ভট্টাচার্যের প্রতি অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করছিল। তাই দেরি না করে ‘কাছের মানুষ’ শুরু করলাম। এর আগে অনেকের মুখেই ‘কাছের মানুষ’ এর প্রতি ভালোলাগার কথা শুনেছি কিন্তু আজ কাল করে করে আর পড়া হয়ে ওঠেনি। তবে মিতিনমাসী সিরিজের বেশ কিছু গল্প অনেক আগেই পড়া ছিল। শুরু থেকেই চুম্বকের মত ধরে রেখেছিল কাছের মানুষ। যেন একটা থ্রিলার উপন্যাস পড়ছি, প্রতি মুহূর্তে উত্তেজনা। ৬৩৯ পৃষ্ঠার যথেষ্ঠ বড় এই উপন্যাসটি পড়তে গিয়েও আমার মত অধৈর্য্যশীল মানুষেরও খুব একটা বিরক্তি আসেনি। প্রতিটি চরিত্র এবং পারিপার্শ্বিক বর্ণনা এমন অসাধারণ দক্ষতার সাথে ফুটে উঠেছে যে পড়তে গিয়ে কখন যে সেই সময়ে চরিত্রগুলোর মাঝে ডুবে গেছি নিজেও জানি না। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ইন্দ্রানী। গভীর ব্যক্তিত্বসম্পন্না সুন্দরী স্কুল শিক্ষিকা পুত্র বাপ্পা, মেয়ে তিরির আর স্বামী আদিত্যকে ঘীরে সংসারের সেই কর্ত্রী। প্রথম থেকেই চরিত্রগুলোর মধ্যে সম্পর্কের জটিল আবর্ত তৈরি শুরু। ক্রমেই তা জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। কলেজ জীবনে সহপাঠী শুভাশীষকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলে ইন্দ্রানী কিন্তু ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে শুভাশীষ দেশোদ্ধারের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যায় ইন্দ্রানীর আড়ালে। বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলে আদিত্যর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে ইন্দ্রানী। আদিত্য-ইন্দ্রানীর প্রথম সন্তান জন্মের কিছুদিন পর দৈবক্রমে আবার পরিচয় হয় শুভাশিষের সাথে। ইন্দ্রানীর পুরোনো প্রেম জেগে ওঠে। নতুন করে কাছে পেয়ে শুভাশিষের ডাকে সাড়া দেয় ইন্দ্রানী। জন্ম হয় তিতিরের। পড়ার সময়ে বার বার মনে হয়েছে আমি যেন পুরোনো সংস্কার ছেড়ে এখনও পুরোপুরি বের হতে পারিনি। ইন্দ্রানী আদিত্য’র স্ত্রী হয়েও পুরোনো বন্ধু শুভাশিষের সাথে কিভাবে এক বিছানায় গেল- এই চিন্তা যেন মনের মধ্যে খচখচ করেই চলেছিল অবিরত। ইন্দ্রানীর প্রতি প্রথম থেকে যে শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছিল তা যেন এই সংবাদে কাঁচের দেয়ালে ফাটল তৈরি করে। অবশ্য আমার ধারণা লেখক নিজেই পাঠকের মনে এই ফাঁটল ইচ্ছে করেই তৈরি করেছেন, তা না হলে ইন্দ্রানী নিজেই কেন নিজেকে অপরাধী ভেবে অসহায়ত্ব অনুভব করবে? তবে একটা ব্যপারে খুব মজা পেয়েছি, আগের উপন্যাস পড়ে এবং এই উপন্যাসে প্রথম থেকে কাহিনী বিন্যাস বিশ্লেষণ করে এর পরের ঘটান কোন দিকে যেতে পারে সেটা আগে থেকে কল্পনা করে দেখছি অনেক কিছুই পরের ঘটনার সাথে মিলে গেছে। যেমন মুস্তাফির সাথে কন্দর্পের পরিচয়ের সাথে সাথেই মনে হয়েছিল সে তাদের বাড়ির দিকে নজর দিচ্ছে। মধুমিতার প্রসঙ্গ যখনি এসেছিল তখনই মনে হয়েছিল কন্দর্পের সাথে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। তবে অমিলও ঘটেছে, আমার ধারণা ছিল বাপ্পা কখনও জাহাজে যেতে পারবে না। পড়তে পড়তে বার বার মনটা ভারি হয়ে যাচ্ছিল, ঘটনার এত উত্থান-পতন। বিষ্ণুপ্রিয়া আর এনাক্ষী দুজনের সাথে বাপ্পার সম্পর্কের টানাপড়েন। বিষ্ণুপ্রিয়াকেই বেশি আবেগী মনে হয়েছে। একেবারে শেষ দিকে কিছুটা একঘেয়েমি লেগেছে। বিশেষ করে আদিত্যকে নিয়ে লেখিকা যা করছেন। শুধু মনে হচ্ছে এত নিষ্ঠুর কেন লেখিকা? আর পারছি না! ধৈর্য্যের বাধ যেন ভেঙ্গে যাচ্ছে। রাগ হচ্ছে রঘুবীরের প্রতি। মনে হচ্ছে আদিত্যদের ১লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে রঘু। এক একবার মনে হয়েছে আমি একটা দুখের ট্রেনে উঠে পড়েছি যার প্রতিটি কামরায় শত শত দুঃখী মানুষ গিজগিজ করছে এবং ট্রেনটা অনন্তকাল ধরে চলছে তো চলছেই, কখনই থামবে না। পাঠকের হৃদয় নিঙড়ে সবটুকু সুখ যেন বের করে নিচ্ছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। মনে হচ্ছে এটাই উনার লেখার স্টাইল, ‘কাচের দেয়াল’ পড়তে পড়তেও এক একবার এমন অনুভূতি হয়েছিল। বৃষ্টি, জয়া, সুবির প্রত্যেকে প্রত্যেকের কত আপন অথচ কত পর। তবে কাচের দেয়াল শেষ হয়েছিল ভুলের সমাপ্তি দিয়ে, আশার আলো জ্বালিয়ে। ‘কাছের মানুষ’ কিন্তু তেমনভাবে শেষ হয়নি। কেননা এখানে একটার সাথে আরেকটা চরিত্র এমনভাবে যুক্ত একটাকে টানলে সবগুলোই যে ছিড়ে যাবে। উপন্যাসটা শেষ করে মনে হল যেন একটা যুদ্ধ শেষ হল, চারিদিকে শুধু ধ্বংসস্তুপ, মৃত্যুর হাহাকার কোথাও শান্তি নেই। বুকের উপরে কে যেন একটা পাথর চেপে ধরেছে। তিতির যখন জানতে পারল তার প্রকৃত পিতা কে, বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। ইন্দ্রানী করল আত্মহত্যা। যে সুকান্তকে প্রথম থেকে প্রচন্ড অপছন্দ ছিল আমার মত পাঠকের সে-ই শেষ মুহূর্তে রক্ষা করল তিতিরকে। ঘুরেফিরে শুধু একটা কথাই মনে ভাসছে, সুচিত্রা ভট্টাচার্য কি বার্তা দিতে চেয়েছেন সমগ্র উপন্যাস জুড়ে ? ছোট একটা ভুল, সামান্য অসংযমের পরিনাম কি ভয়ংকর হতে পারে সেটাই কি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন তিনি? কিন্তু ভুলটা আসলে কি? শুভাষীসের সাথে পুনরায় দেখা হওয়ার পর ইন্দ্রানী সব ছেড়ে তার সাথে পালিয়ে গেলনা কেন? এটা তার ভুল না কি গোপন অভিসারের ফলে তিরিরের জন্ম নেওয়াটাই ভুল? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই উপন্যাসের নামকরণে সুচিত্রা চরম দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে বার বার মনে হয়েছে, কে কার ‘কাছের মানুষ’? এ যেন অদৃশ্য মুখোশ পরে একে অন্যকে কেবলি ফাঁকি দেওয়ার আদিম প্রচেষ্টা।
This book had moved me in an unique way. It's one of the best books I had read in a while.
I would give this book 4 stars out of 5.
⭐- The characters are so relatable. Every other person is someone whom we already know, meet in day to day life.
⭐- The rule: Show Don't Tell. Is portrayed amazingly by the author. None of the feelings were given a name yet they hit hard.
⭐- Character Development! Nothing was hurried, the story churned out smoothly.
⭐- The ending deserves a whole star. With a painful end comes a mesmerizing start. A part of me wants to read about them more, especially Titir and Toto. But, another part knows it's the perfect place to leave them.
⭐🚫- The pace is slow, pretty slow. 645 pages! But don't let that deter you, it's worth it.
🐱- I loved the theme of the book. How we expect the people we love to be the closest person in our lives. When at last, the person we can completely rely on is ourselves only.
🐱- How we imagine others are drowning in a sea of happiness. How we think their lives are easier than is. When in truth, everyone has a set of problems, aches within their soul.
🐱- I had read numerous books about romantic love but it is the first which have platonic bonds importance. They both are equally important.🐱- My most favorite couple in the book is Aditya and Titir. A father-daughter duo.
🐱- I loved the unsaid feelings bustling between Titir and Toto.
🐱- A little fanfiction here. I can almost predict Titir and Toto's future. If they meet again, Titir would be competitive. Trying to be more successful than him. Toto, has something for her, which was unsaid throughout the novel. But, he would be jealous if someone else is in her life. He got all red in the face when Titir just talked with another guy. 😂.
🐱- It's a pity that this gem is not translated in English.
🐱- This was my first from Suchitra Bhattacharya and definitely not my last.
It’s not everyday that I sit down to write about a Bangla book. There are a few that not only tug a few strings at the heart, but pull them hard enough to inflict pain. Kachher Manush (The Close One) by Suchitra Bhattacharya is an epic work in contemporary Bangla Literature.
Suchitra Bhattacharya has kept it simple with this book. She flourishes with the story rather than fancy words and articulation. It’s the story that holds you together till the last page, perhaps yearning for more at the end. My favourite character is Indrani and it’s a revelation that such people exist, at least within book covers.
Highly recommended for anyone who can read Bangla. For others, you have to wait till some kind soul decides to translate the book to near perfection.
One of the most realistic novel from my recent read. Each and every character is unique yet very practical. We all have bumped into them at least once in our life. They are more like our 'next-door-neighbor' than a fiction character. The entire story is a collage of middle-class lives in Kolkata which is hardcore reality, there is hardly any frame for fantasy or melodrama. Even the ending seemed very practical to me which we can see in our surroundings.
This entire review has been hidden because of spoilers.
*প্রথম রিভিউ * আমার কাছের মানুষটি তার সংগ্রহে থাকা সবচেয়ে দামি এই বইটি আমাকে উপহার দিয়েছিলো।রিভিউ লেখা উচিত এই সংক্রান্ত মোটিভেশন সে গত এক বছর ধরে আমাকে দিয়ে আসছে। অবশেষে বইটি পড়া শেষ করে মনে হল নিজের কিছু অনুভূতি লিখি। প্রথম দিকে খুব সাধারণই লেগেছিল এখন সাধারণের মাঝে অসাধারণ কিছু ফিল হচ্ছে। রিভিউএ কি লিখতে হয় আমি জানি না,আমি শুধু আমার পছন্দ-অপছন্দের কিছু চরিত্র সম্পর্কে লিখব। প্রথমে, পৌঢ় কিছু চরিত্র যেমন - জয়মোহন, শিবসুন্দর, ধীরাজ এদের শেষ বয়সের অসহায়ত্ব, একাকীত্ব গুলো আমাকে সূক্ষ্ম এক যন্ত্রণায় দিয়েছে । আরো দুটি চরিত্র ইন্দ্রাণী ও শুভাশীষ এদের জন্য পুরো বই জুড়ে আমার শুধু ঘৃণা বোধ ছাড়া আর কোনো অনুভূতিই তৈরি হয় নি।শুধু এই দুইজনের ভালোবাসা, ইচ্ছা, মান অভিমান, রাগ এর জন্য পরিবারের সবাই অব্যক্ত কষ্ট, যন্ত্রণাই পেয়েছে বিশেষ করে আদিত্য।শেষে অবশ্য ইন্দ্রাণীর শেষ পরিণতি টায় একটু মায়াও পড়েছিলো । আর তিতির,টোটো এই দুটোকে কোন পর্যায়ে ফেলবো বুঝতে পারছি না। তবুও বলতে চাই সব মিলিয়ে বইটা আমাকে অনেক রকম অনুভূতি উপহার দিয়েছে।
উপন্যাস টি পড়ে মুগ্ধ। এত সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে পড়ার পরও একটা রেশ থেকে যাচ্ছে। আমাদেরকে জীবন র বিভিন্ন স্রোত সম্পর্কে অবগত করেছে, সাথে ভাবতে শেখাবে ।