সঞ্চিতা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য-সংকলন। এই গ্রন্থে ঊনআশিটি কবিতা ও সতেরোটি গান আছে। এর মধ্যে - ‘বিদ্রোহী’, ‘সর্বহারা’, ‘সাম্যবাদী’, ‘মানুষ’, ‘জীবন বন্দনা’, ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’, ‘চল্ চল্ চল্’ প্রভৃতি প্রধান।
গ্রন্থটির উৎসর্গ পত্রে লেখা আছে: “বিশ্বকবিসম্রাট শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু”।
Kazi Nazrul Islam (Bengali: কাজী নজরুল ইসলাম) was a Bengali poet, musician and revolutionary who pioneered poetic works espousing intense spiritual rebellion against fascism and oppression. His poetry and nationalist activism earned him the popular title of Bidrohi Kobi (Rebel Poet). Accomplishing a large body of acclaimed works through his life, Nazrul is officially recognised as the national poet of Bangladesh and commemorated in India.
আমি যখন ক্লাস টু তে পড়ি তখন বাবা জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল বইটা। ওইটুকু বয়সে নজরুলের কবিতা আর কিইবা বুঝবো? চেষ্টাও করিনি খুব একটা। অবশ্য এখনো যে খুব বুঝি তা একেবারেই না। সেসময় ২/৩ টা কবিতা হয়ত মুখস্ত করেছিলাম আবৃত্তির জন্যে। কিন্তু তারপর থেকে বুকশেলফ এর এক কোনায় পড়েই ছিল। এত বছর পর মনে হল একবার চেষ্টা করেই দেখি কতটুকু ছুঁতে পারি। কতটা সফল তা বলতে পারব না, তবে কবিতাগুলো পড়ার সময় ভেতরে একটা শিহরণ কাজ করে। এটুকু বুঝেছি যে এটা একবার পড়ে রেখে দেওয়ার বই না। বারবার পড়তে হবে। মুখস্ত না, অন্তস্থ করতে হবে প্রতিটি শব্দ।
হয়ত কেবলি গাহিয়াছি গান,হয়ত কহিনি কথা, গানের বাণী সে শুধু কি বিলাস, মিছে তার আকুলতা?
আমি যখন কাজী নজরুল ইসলামের “সঞ্চিতা” পড়তে বসি, তখন মনে হয়েছিল—আমি যেন হঠাৎ এক ঝঞ্ঝার মুখোমুখি হয়েছি। আবার কিছু দূর এগোতেই বুঝলাম, শুধু ঝড় নয়, এখানে আছে ফুলের সুগন্ধও, প্রেমিক হৃদয়ের অশ্রুও, মানবতার মহান আহ্বানও। এ বইটি নিছক কবিতার সংকলন নয়, বরং কবির আত্মার বহুস্তরীয় প্রকাশ।
“বিদ্রোহী” কবিতা পড়তে গিয়ে যেন বুকের ভেতর কাঁপন জেগে উঠেছিল— “আমি ঝঞ্ঝার মতন তাণ্ডব-নৃত্য করি বিশ্বজগৎ মহাশূন্যে।” এই ঘোষণার মধ্যে আমি বুঝলাম, নজরুল কেবল এক কবি নন, তিনি যুগের বজ্রকণ্ঠ। তাঁর বিদ্রোহ কেবল রাজনীতির বা শাসকবিরোধী নয়, বরং মানুষের আত্মমুক্তির আকাঙ্ক্ষারও প্রতিধ্বনি।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, সেই একই নজরুল আবার একেবারেই ভিন্ন রূপে আমার কাছে ধরা দিলেন। যখন পড়লাম “দোলনচাঁপা দোলে রাতে, দোলে তার সোনালি বাতাসে”—মনে হলো এই তো অন্য এক নজরুল, যার হৃদয় প্রেমে, প্রকৃতিতে আর স্নিগ্ধতাতে ভিজে গেছে। বিদ্রোহের ঝড় আর প্রেমের মাধুর্য—দুটো বিপরীত স্রোতকে একসাথে ধারণ করতে পেরেছেন তিনি। আমি পড়তে পড়তে উপলব্ধি করেছি, এটাই নজরুলের মহিমা।
“সঞ্চিতা”-য় আরেকটি যে দিক আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে, তা হলো তাঁর মানবতাবাদ। যখন তিনি বলেন— “হিন্দু না ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারি, বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।” তখন মনে হয়েছে, এ কণ্ঠ শুধু বাংলার নয়, সমগ্র মানবতার। ধর্ম-বর্ণের বিভেদ অতিক্রম করে নজরুল মানুষের জয়গান গেয়েছেন। আমি পড়তে পড়তে অনুভব করেছি, কবি যেন আমাকেই প্রশ্ন করছেন—আমি কি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিখেছি?
আরেকটা দিক আমাকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছে—তাঁর কবিতার সুরেলা ছন্দ। পড়তে পড়তেই মনে হয়েছে যেন কোনো গান শুনছি। তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ধ্বনি সংগীতের মতোই বয়ে চলে। এ কারণেই হয়তো নজরুলের কবিতা গেয়ে ওঠে, বাজে বাঁশির মতো, কখনো শোনায় ঝড়ের মতো। আমি বুঝেছি, কবি আসলে সংগীতেরই সন্তান।
__ফোকলোর চর্চায় নজরুল__
নজরুলকে আমি যতই পড়েছি, ততই মনে হয়েছে তিনি কেবল আধুনিক কবি নন, ফোকলোরেরও এক প্রাণবান ধারক। শৈশবের গ্রামীণ জীবনে বাউল, মরমি গান, যাত্রা আর লোককাহিনী তাঁর শিরায়-শিরায় প্রবাহিত হয়েছিল। “সঞ্চিতা”-য় সেই লোকজ উপাদান আমি স্পষ্টভাবে খুঁজে পেয়েছি।
আমি লক্ষ্য করেছি, তাঁর উপমা-চিত্রকল্প অনেকটাই লোকপ্রাণের সঙ্গে যুক্ত। বজ্র, অগ্নি, ঝড়, নদী—এসব চিরচেনা গ্রামীণ প্রতীক। তাঁর ছন্দে ভাটিয়ালির ঢেউ, তাঁর ভাষায় মরমি সাধকের সুর। কখনো মনে হয়েছে, তিনি যেন লোককবিতাকে আধুনিক রূপে ঢেলে দিয়েছেন।
বিশেষ করে তাঁর সংগীতে যে ফোকলোরের প্রভাব, তা অনস্বীকার্য। কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালি, মারফতি সুর তিনি ব্যবহার করেছেন এমনভাবে, যাতে লোকসংস্কৃতি আধুনিক সাহিত্যের সাথে যুক্ত হয়েছে। আমি মনে করি, নজরুল ফোকলোরকে কেবল ব্যবহার করেননি, বরং একে নতুন রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
“সঞ্চিতা” পড়ে আমার মনে হয়েছে—এ শুধু কবিতার বই নয়, এটি যেন এক আলো-ঝড়। এখানে বিদ্রোহ আছে, প্রেম আছে, মানবতা আছে, আবার লোকজ সুরও আছে। আমার কাছে এটি এক অমূল্য সম্পদ, যা একইসাথে উদ্দীপ্ত করে, আবেগে ভরায়, আবার গভীরভাবে ভাবায়।
আমার উপলব্ধি—“সঞ্চিতা” হলো সেই কাব্যগ্রন্থ, যেখানে নজরুল নিজেকে চিরকালের জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিদ্রোহী কবি, প্রেমিক কবি, মানবতার কবি এবং ফোকলোরের আধুনিক রূপকার হিসেবে।
ছোটবেলায় নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করতাম - তখন অবশ্য অর্থগুলো এখনকার মতো বুঝতাম না। তীক্ষ্ণ ভাষা আর ভাবের মিলন নজরুলের কবিতাগুলোতে। বিদ্রোহী, মানুষ - এই কবিতাগুলোর আবেদন কখনোই মলিন হয় না।
নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—বাংলা কবিতার দুই বিস্ময়, দুই দিগন্ত। আর ‘সঞ্চিতা’ ও ‘সঞ্চয়িতা’—তাঁদের জীবনের দুই গুরুত্বপূর্ণ সংকলনগ্রন্থ—সেই দিগন্তে সূর্য ও চন্দ্রের আলোকবর্তিকা। অনেক পাঠকই এই দুই গ্রন্থকে কেবল কবিতার সঙ্কলন ভেবে পড়েন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এগুলি দুই কবিজীবনের আত্মপ্রতিকৃতি।
সঞ্চিতা: আগুন, প্রেম ও প্রতিবাদের সম্মিলন:
নজরুল ইসলাম তাঁর সঞ্চিতা প্রকাশ করেন ১৯২৮ সালে। গ্রন্থটি তাঁর পূর্বে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর কবিতা থেকে সংকলিত—বিশেষত অগ্নিবীণা, ঝিঙে ফুল, দোলনচাঁপা, ফণি-মনসা প্রভৃতি। এই গ্রন্থে রয়েছে ৭৮টি কবিতা ও ১৭টি গান। নিজেই বলেছেন—“আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া রচিত পুষ্পাঞ্জলি”।
এই পুষ্পাঞ্জলি কিন্তু একমুখী নয়। একদিকে প্রেম, মমতা, বিষাদ আর ধর্মীয় সহনশীলতার গান, অন্যদিকে আছে ঝড়ো বিদ্রোহ, সাম্যবাদ, নারীর মুক্তি ও ব্রিটিশ বিরোধী ভাষ্য। কবির ভাষা কখনও সং���ত, কখনও আগ্নেয়গিরির মতো উদগীরিত। সে যেন শুধু কাব্য নয়, এক রাজনৈতিক ও মানবিক ম্যানিফেস্টো।
সঞ্চয়িতা: সৌন্দর্য, সাধনা ও আত্মজিজ্ঞাসার সমাবেশ:
রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে—অর্থাৎ নজরুলের সঞ্চিতা-র তিন বছর পরে। প্রথমে ‘চয়নিকা’ নাম দেওয়া হলেও পরে কবিগুরু নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘সঞ্চয়িতা’। সাহিত্যঐতিহাসিকদের অনেকেই বলেন, নজরুলের গ্রন্থের নামই তাঁকে এই পথে অনুপ্রাণিত করেছিল।
সঞ্চয়িতা কেবল কবিতার নির্বাচনী সংকলন নয়; এটি এক জীবনদর্শনের প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ এখানে তাঁর পরিণত চিন্তার, পরিপক্ব সৌন্দর্যবোধের ও আত্মমগ্ন আধ্যাত্মিকতার কবিতাগুলিকে স্থান দেন। “আমার অল্প বয়সের যেসব রচনা স্খলিত পদে চলতে আরম্ভ করেছে মাত্র...তাদের স্থান দেওয়া আমার প্রতি অবিচার”—এই বাক্যেই স্পষ্ট হয় তাঁর অভিপ্রায়।
এই গ্রন্থে ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতিমাল্য’, ‘গীতালী’, ‘স্মরণ’, ‘নৈবেদ্য’, ‘শেষলেখা’ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে বাছাই করা কবিতাগুলি স্থান পেয়েছে। প্রতিটি কবিতা যেন এক ধ্যান, এক তপস্যা, এক আত্মসন্ধান।
তুলনামূলক সাহিত্য-আলোচনা: দুই সঞ্চয়ের দুই সুর:
নামদুটি—সঞ্চিতা ও সঞ্চয়িতা—দেখলে মনে হয়, যেন দুই সহোদর, যারা দুই ভিন্ন দিগন্তে হেঁটে গিয়ে আবার পাঠকের হৃদয়ে এসে মিলিত হয়েছে। নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক ভাষা, অভিব্যক্তি ও অভিমুখ আলাদা, কিন্তু তাঁদের সংকলনগ্রন্থ দুইটিই হয়ে উঠেছে দুই আত্মার সংরাগ।
নাম ও প্রেরণার পার্থক্য:
নজরুলের সঞ্চিতা উৎসর্গিত হয় রবীন্দ্রনাথকে—এ যেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক চূড়ান্ত প্রকাশ। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা-য় উৎসর্গ নেই, কিন্তু তার ভূমিকাতেই তিনি নিজেকে একজন সম্পাদক-চিন্তক হিসাবে তুলে ধরেন—যে কবি নিজের সৃষ্টিকে ছাঁকেন, সাজান এবং আত্মসমালোচনায় উন্মুক্ত থাকেন।
শৈলী ও কাব্যভাষা:
নজরুলের ভাষা ঝড়ের মতন, রক্তমাখা শব্দ, বুলেটের ছন্দ। তাঁর কবিতা পাঠ করতে করতে পাঠক যেন মাঝে মাঝে গর্জনের শব্দে চমকে ওঠে, আবার কখনও মুগ্ধ হয় প্রেমিক নজরুলের কোমল উচ্চারণে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা হল নিরব ছন্দের রঙতুলি, যেখানে শব্দগুলো জলরঙের মতো ক্যানভাসে মিশে যায়। সে এক গীতিকবির গোপন দিনলিপি, যেখানে প্রতিটি ছন্দে জেগে থাকে আকাশ, বৃক্ষ, নদী, মৃত্যু ও প্রার্থনার ধ্বনি।
দর্শন ও উদ্দেশ্য:
নজরুলের কবিতা সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার, তাঁর সংকলন যেন এক অস্ত্রভাণ্ডার। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা পাঠকের অন্তরলোকে প্রবেশ করে; তাঁর কবিতা সময়কে ছাপিয়ে, নীরবতায় গান গায়।
উপসংহার: দুই কবিতার সেতুবন্ধন:
‘সঞ্চিতা’ ও ‘সঞ্চয়িতা’—দুটি কাব্যসংকলন নয়, দুটি দৃষ্টিভঙ্গি। একদিকে দ্রোহ, অন্যদিকে ধ্যান; একদিকে আগুন, অন্যদিকে দীপশিখা। কিন্তু দুইয়ের সুরই বাংলা সাহিত্যের গর্ব, জাতির মননে চিরকালীন সমৃদ্ধি।
কাজী নজরুল ইসলাম কবিগুরুকে উৎসর্গ করেছিলেন নিজের শ্রেষ্ঠ পুষ্পাঞ্জলি—সঞ্চিতা, আর রবীন্দ্রনাথ নিজে নিজের জীবনদর্শনকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন সঞ্চয়িতা-য়। দুই কবির সংকলন যেন দুই চিত্রপট, যার একটিতে রঙ চড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিদ্রোহে, অন্যটিতে ছায়া ফেলা হয়েছে শান্তির প্রজ্ঞায়।
শেষ কথা এই যে, বাংলা কবিতা যদি হয় এক মহাসাগর, তবে সঞ্চিতা তার তরঙ্গ, আর সঞ্চয়িতা তার গভীরতা। আর আমরা, পাঠকেরা, ভাগ্যবান যে এই দুই স্রষ্টার ধ্যান ও দহন—দুটিকেই পাঠ করে নিজের হৃদয়কে একটু বেশি মানুষ করে তুলতে পারি।
"সঞ্চিতা" হলো কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার এক সমগ্র বা সংকলন, যেখানে তার সব ধরনের কবিতা একত্রিত রয়েছে। এখানে প্রেম, বিদ্রোহ, সমাজবিরোধিতা, মানুষের স্বাধীনতা, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং মানবতার নানা দিকের কথা উঠে এসেছে।