আজিজ মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ, যিনি সদ্য বিয়ে করেছেন। আর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছেন, তাঁর স্ত্রী ঘুমায় না। দিন- রাত চব্বিশ ঘণ্টার একটা মুহূর্তও চোখের পাতা এক করা হয় না তার। আজিজ আরও লক্ষ করেছেন, ওই না ঘুমানোর দরুন খুব একটা শারীরিক-মানসিক অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে না স্ত্রীকে একদম । বরং তিনি বেশ সুস্থ, প্রাণচঞ্চল আর চমৎকার। প্রথম প্রথম অতটা মনোযোগ না দিলেও খুব শীঘ্রই আজিজ তাঁর বউকে নিয়ে চিন্তিত হবেন। কারণ, তাঁর জানা হবে কোথাও গুঁজে থাকা একখানা টলটলে নীলচে জগৎ আর কিছু সুতোয় বাঁধা পুতুল। তাঁর জানা হবে প্রতিটা ভালোবাসার গল্পের কোনো এক কোণায় খুব গোপনে একটা বিসর্জনের গল্প রচনা হয় কেন; জানা হবে একটা আমোল্ড ফুলের গল্প, যে গল্পে প্রচণ্ড ভালোবাসার মানুষটির নিকট কারোর ফেরত আসতে দেরি হয়ে গিয়েছিল খুব।
সবার আগে আমার যা প্রয়োজন ছিলো তা হলো কাহিনিতে বর্ণিত বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও তাদের বৈশিষ্ট্যসম্বলিত একটি টীকা আর ঘটনাস্থলের মানচিত্র। প্রাণীদের প্রজাতি ও ব্যক্তিনামগুলো অদ্ভুত (পৃয়ুশ, পৃ, মায়াল, বিউমেরাস, নৃধিয়া, কালখাটুস, মৃয়ঙ্ক ইত্যাদি ইত্যাদি)। কে কোন পক্ষের, কে কী করছে তা বুঝতে আমাকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।
লেখকের কল্পনাশক্তি ও দূরদর্শিতা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু গদ্যশৈলী ভালো লাগলো না খুব একটা। মনসুরের অংশ ব্যতীত পুরো কাহিনিতে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা নেই। একটার পর একটা ঘটনা ঘটেই চলেছে। ঘটেই চলেছে। এপিক হওয়ার উপাদান ছিলো গল্পে। কিন্তু সব মিলিয়ে, সমস্ত সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, "মৃগয়া" অসাধারণ কিছু হয়ে উঠতে পারেনি।
"𝙼𝚊𝚢𝚋𝚎 𝚝𝚑𝚒𝚜 𝚠𝚘𝚛𝚕𝚍 𝚒𝚜 𝚊𝚗𝚘𝚝𝚑𝚎𝚛 𝚙𝚕𝚊𝚗𝚎𝚝'𝚜 𝚑𝚎𝚕𝚕." ~ 𝙰𝚕𝚍𝚘𝚞𝚜 𝙷𝚞𝚡𝚕𝚎𝚢 মায়াং। চারপাশে রাইবন দিয়ে ঘেরা অনিন্দ্য সুন্দর এক জায়গা। অসীম এক বিস্তৃত অবনি জুড়ে জায়গাটা ঠিক কোথায় স্বয়ং মায়াংবাসীরাও জানে না। পুরোটাই জল, অদৃশ্য জলে টইটুম্বুর নীলচে এক জগৎ। পায়ের তলায় কোমল ঘাসের ডগা, বৃক্ষের সবুজ নরম পাতা, মাথার উপরে ঈষৎ নীলচে টলটলে জলময় আসমান। সবকিছু ভীষণ মায়ামাখা। . নদীশ্বরী এই জগতের স্রষ্টা। অনেক যত্ন করে তিনি তৈরী করেছেন এই জগত ও জগতের প্রত্যেক প্রাণীকে। প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে ছিল নদীশ্বরীর নিখুঁত পরিকল্পনা। সবশেষে নদীশ্বরী সৃষ্টি করেছিলেন ভীষণ সংবেদনশীল এক কোমল প্রাণী, মৃগ। মায়াং এর শুদ্ধতম প্রাণী এই মৃগ। যে প্রাণীকে নদীশ্বরী দিয়েছিলেন সর্বাধিক স্বাধীনতা। আর নদীশ্বরীর অনেক আদুরে এই সৃষ্টিকে হত্যা করেই অভিশপ্ত হয় এক কিশোরী। শাস্তিস্বরূপ করতে হয় নরক যাত্রা। প্রাণ নেওয়া এবং দেওয়ার মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে পারার পরেই খণ্ডন হবে যে শাপ। প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ। . জলবিহঙ্গম বিউসেরাসের পিঠে চড়ে পরিবার, প্রিয় ডোডো পাখি, পরিচিত জগত, নিজের শৈশবকে পেছনে ফেলে পারি জমাতে হয় নরকে। যেখানের রৌদ্রতেজে শরীর গলে যায়। প্রকৃতপক্ষেই নরক। এতোকিছুর পরেও নরকের গিয়ে কিশোরী জড়িয়ে পরে সৃষ্টিজগতের সবথেকে শুদ্ধতম বন্ধনে। আচ্ছা এইসব কিছুই কী পূর্ব নির্ধারিত ছিল? . গল্পটা এই শুদ্ধতম অনুভূতির, মিলনের, যা পাওয়ার জন্য আলো অন্ধকার দু'দিকের পথই মাড়িয়ে আসতে হয়। যে মিলনের প্রতিটা গল্পের কোণায় রচনা হয় একটি করে বিসর্জনের গল্প। গল্পটা একজন মৃগয়ার, স্রষ্টাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলে যাকে গ্রহণ করতে হয় নির্বাসিত জীবন। এবং সবশেষে গল্পটা সৃষ্টি ও স্রষ্টার। . মৃগয়া তে দুইটা ওয়ার্ল্ড রয়েছে। একটা হচ্ছে প্রাইমারি ওয়ার্ল্ড আরেকটা সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড। সংক্ষেপে প্রাইমারি ওয়ার্ল্ড হলো আমাদের পরিচিত এই চেনাজানা জগত আর সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড হলো লেখক যে জগতটা নিজস্ব কল্পনাশক্তির মাধ্যমে ভিন্নভাবে তৈরী করেছেন। মায়াং হলো এই বইয়ের সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড। . মায়াং এর একটি মানচিত্র মৃগয়ার সতীর্থ সংস্করণের সাথে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মানচিত্র যদি নাও দেওয়া হতো তবুও লেখক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়গুলো এতো বিস্তারিতভাবে লিখেছেন যে খুব সহজেই মায়াং এর ভৌগলিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। মায়াং এর সবথেকে ক্ষমতাধর স্থান ইথেমপেলি; যেখানে প্রকট হন নদীশ্বরী। এছাড়াও পুরো মায়াং এ জল সরবরাহ ব্যবস্থারও রয়েছে নিজস্ব ভিন্ন এক পদ্ধতি। মায়াং এ সময় খুবই ধীরে প্রবাহিত হয় কালডোরার প্রভাবে; বৃক্ষরা ঘুমালেই অতিক্রান্ত হয় দিন, যার কারণে মায়াং এর প্রকৃত সময় কারো জানা নেই। মায়াং এর প্রধান ফটক নিরোদ্বার, যা দেখাশোনার দায়িত্বে আছে মায়ালদের ‘থোমন’ গোষ্ঠী। পুরো বই জুড়েই ছিল এসব ডিটেইলিং। মিথলজি নিয়ে টুকটাক জানাশোনা থাকলে উপলব্ধি করবেন মায়াং জগৎ তৈরীতে অনেকক্ষেত্রেই গ্রীক ও নর্স মিথলজি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছে লেখক। . ভিন্ন জগত হওয়ার পাশাপাশি এই জগতের রয়েছে ভিন্ন ধরনের বাসিন্দা। মায়াল, থোমন, কালখাটুস, ঔশ্যাল, খৌম, রেভান যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এরকম খুঁটিনাটি বর্ণনা দিয়ে লেখক চমৎকার ভাবে ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং করেছেন এবং এই ভিন্ন ওয়ার্ল্ডের সম্পূর্ণ ম্যাকানিজমটা পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। ফলে ভিজুয়ালাইজ করতে বেগ পেতে হয়নি। . অন্যদিকে প্রাইমারি ওয়ার্ল্ডে নতুন বিবাহিত দম্পতি আজিজ ও সায়রা৷ এই ওয়ার্ল্ডের কাহিনিও মায়াং এর কাহিনির পাশাপাশি সমান্তরালভাবে এগিয়েছে। এই ওয়ার্ল্ডের বেশ কিছু বিষয় শুরুদিকে বেশ ঘোলাটে ও অতিপ্রাকৃত লাগলেও সময়ের সাথে সাথে তা খোলাসা হয়েছে। আজিজ ও সায়রার পাশাপাশি আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো মনসুর। এই চরিত্রের কর্মকাণ্ড, সেক্সুয়াল ডিজায়ার অনেকের কাছে সস্তা, থার্ড ক্লাস লাগতে পারে তবে এখানে বুঝতে হবে মনসুরের মাইন্ডসেট। তার মাইন্ডসেট অনুযায়ী, তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসবই ঠিক আছে। এছাড়া বইয়ে একটা বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুবই স্বল্প পরিসরে পুলিশ ইনভেস্টিগেশনের বর্ণনা দেওয়া আছে, এই অংশটা অনেকের কাছে অপ্রয়োজনীয় লাগতে পারে কিন্তু এই অংশেরও প্রয়োজন ছিল, তা পাঠক একটু সচেতনভাবে পড়লেই ধরতে পারবে বলে আশা করা যায়। . পুরো বইয়েই এতো সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম ডিটেইলিং রয়েছে যে তাড়াহুড়ো করে পড়লে অনেক কিছুই মিস হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকবে। শেষে গিয়ে অনেকে কিছু জিনিস রিলেট নাও করতে পারেন। কেননা ধড়মড়িয়ে পড়ে যাওয়ার মতো বই এটা না। এই বইটা পড়ার সময় একটু মনোযোগী হতেই হবে। বইয়ে কিছু জিনিস লেখক সরাসরি বলে দেননি; বলে না দিলেও সচেতন পাঠক মাত্রই সেই বিষয়গুলো বুঝতে পারবেন। . ফ্যান্টাসি বই হলেও গতানুগতিক ধাঁচের থেকে ভিন্ন এর প্লট। সবমিলিয়ে উপভোগ্য একটা সময় কেটেছে মৃগয়ার সাথে। ফ্যান্টসির ভক্ত না হলেও সকল ধরনের পাঠকদেরই হয়তো ভালো লাগবে এই সৃষ্টি ও স্রষ্টার গল্প। লেখক সাখাওয়াত হোসেন দীর্ঘদিন যাবত অনলাইনে লেখালেখি করলেও তার কোনো লেখাই আমার আগে পড়া হয়নি। ফলে লেখকের লেখা সম্পর্কে কোনোরকম ধারণা ছিল না। কিন্তু বইটা পড়তে গিয়ে মুগ্ধ হলাম লেখকের মনোমুগ্ধকর গদ্যশৈলীতে। বাংলা শব্দের খেলার ছড়াছড়ি ছিল বইয়ে। যথাযথ শব্দচয়ন, বাক্যগঠনের মাধ্যমে সাখাওয়াত হোসেন পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন নীলচে আলোময় মায়াবী এক জগতকে। . মৌলিক ফ্যান্টাসি নিয়ে আমাদের দেশে আগে খুব বেশি কাজ না হলেও বিগত বছরগুলো থেকেই মোটামুটি ফ্যান্টাসির পালে হাওয়া লেগেছে। আর এই মৌলিক ফ্যান্টাসিতে আরেকটা দারুণ সংযোজন হলো “মৃগয়া”। এই বইটা আসলে আরো পাঠক, আরো আলোচনার দাবিদার। . ◑ বই পরিচিতি: ▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬ ➠ বইয়ের নাম: মৃগয়া ➠ লেখক: সাখাওয়াত হোসেন ➠ জনরা: ফ্যান্টাসি ➠ প্রকাশনী: সতীর্থ প্রকাশনা সংস্থা ➠ প্রচ্ছদশিল্পী: জুলিয়ান ➠ মুদ্রিত মূল্য: ৫২০ টাকা
এই বইটার খুব ই ভাল রিভিউ পেয়েছিলাম আমার পরিমন্ডলে।
তাই দেরিতে হলেও পড়া শুরু করে, একদম প্রথমে বেশ চড়ায় উতরায় পার হতে হচ্ছিলো মায়াং এর ঘটনা পড়তে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। কঠিন ভাষা মনে হচ্ছিলো। তবে কিছুদূর এগেনোর পরেই ডুবে যাওয়া সহজ।
যাইহোক, বইটা অসম্ভব ভাল বই। লেখনশৈলী,প্লট,এক্সিকিউশন সব ই বেশ দূর্দান্ত।
টপ নচ একদম।
৯.৫/১০ (নাম গুলো সহ একটা ছোট পরিচয় পর্ব দিয়ে রাখলে সুবিধা হত যেহেতু নাম গুলো সহজ সাবলীল না)
পৃথিবীর সবচেয়ে শুদ্ধতম অনুভূতি বোধ করি ভালোবাসা। যেখানে নিখাদ প্রেম থাকে, বিশ্বাসের খনি থাকে, অজানা কিছু জড়ো করা গ্লানি আর পার করা সীমাহীন কষ্ট মাখা স্নিগ্ধতা থাকে। ভালোবাসা নামক বিষয়টা ব্যক্তি ভেদে বেশ ভিন্ন। কারও নিকট কুরুচিপূর্ণ অথবা কেবলই বৃথা সময় নষ্ট বলে মনে হয়। তবে যে একবার এ-ই অনুভূতির আলকাতরা গায়ে মেখে নেয়, তাকে ও-ই অবস্থা থেকে আলাদা কিংবা মুক্ত করা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। নিজের চারপাশ অধঃপত করে দেওয়া থেকে হেন কোনো কাজ নেই যা ও-ই মানুষটা পারে না করতে। এক অদ্ভুত অদেখা ক্ষমতা তখন বেড়ে উঠে তার মাঝে। বৃহৎ হয় ধীরে ধীরে। একদিন কিংবা একটা সময় আসে যেটা ফেটে পড়ে প্রবল উচ্ছ্বাসে অথবা ক্ষোভের প্রচণ্ড তাণ্ডব রূপ নিয়ে।
‘মৃগয়া’ উপন্যাস শেষ করার পর আমার অনুভূতি ছিল নিস্পন্দ। ঠিক ঝড়ের আগ মুহূর্তের মতো। অথচ বিশাল এক ঝড় তখন বয়ে গিয়েছে আমার মস্তিষ্কের কোষ শহরের গলিঘুপচি দিয়ে। এক অন্যরকম তাণ্ডবের স্বাক্ষী হয়েছি আমি। তবুও খুব বেশি শূন্যতা কেন যেন ঘিরে ধরেনি আমাকে। যেটা ধরেছে, ওটা কিছুটা সম্পূর্ণ ও অসম্পূর্ণের মাঝামাঝি। ভালো ও মন্দের এক মিশ্র অনুভূতি। এ অনুভূতিটা ঠিক তখন হয়, যখন একজন মানুষের রুচি, ইচ্ছা বা চাহিদার বিপরীতে কিছু ঘটে। পছন্দের কিছু হলে সেটা ভালো, আর অপছন্দ হলে মন্দ। উক্ত উপন্যাস আমাকে দুটোরই স্বাদ দিয়েছে। প্রথমত, মৃগয়াকে আমি পুরোপুরি ‘ফ্যান্টাসি’ ট্যাগ দিতে কিছুটা গাঁইগুঁই করব। তবে একেবারে যে দিব না, তা কিন্তু না। কারণ যে গল্প লেখক সাজিয়েছেন পুরো বই জুড়ে, ওটাতে যদি ‘সেকেন্ডারি’ কোনো সেটিংস না থাকত─খুব একটা ঝামেলা হতো বলে মনে করি না। কিন্তু, ও-ই সেটিংস ব্যতীতই পুরো উপন্যাসটা থেকে যেত অসম্পূর্ণ। কেন─তা না-হয় ব্যক্ত করার চেষ্টা করি।
‘মৃগয়া’ উপন্যাসের স্ট্রং ফিলোসফিটা হলো ‘সৃষ্টি ও স্রষ্টা’ তত্ত্ব। স্রষ্টার জায়গায় সৃষ্টি না সৃষ্টিই একমাত্র স্রষ্টা? এখানে দুটো জগৎ দেখানো হয়েছে। একটা আমাদের পৃথিবী অন্যটা মায়াং। মায়াং হলো উক্ত উপন্যাসের দ্বিতীয় বাসযোগ্য স্থান অথবা পৃথিবীর কোনো এক কোনায় লুকিয়ে থাকা উপগ্রহ। যা বাস্তবিকভাবে অনাবিষ্কৃত। আগামীতে যার সন্ধান কেবল মৃগয়া নামক উপন্যাসে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। সেই মায়াংয়ে কিছু জীব ও জাতির বসবাস। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ হলো—মায়াল। তাদের সাথে সাথে ও-ই জগতে আরও বেশকিছু জীবের দেখা পাওয়া যায়; যাদের একে একে আমরা থোমন, কালখাটুস, হোমি, বিউসেরাস, প্রাইফেড, ঔশ্যাল, খৌম, রেভান, টৌশান, সিয়াস, কায়াস বলতে পারি। ওহ হ্যাঁ, ডোডো নামক এক পাখিও রয়েছে সেখানে, যারা এক সময়ে পৃথিবীকে বসবাস করত। মানুষ নামক প্রাণীকে অন্ধ বিশ্বাস করে বিলুপ্ত করেছে নিজেদের। তাদের দেখা পাওয়া যায় মায়াংয়ে। এছাড়া ওখানকার বৃক্ষরা থাকে সদা জাগ্রত। তাদেরই কেবল ঘুমানোর ক্ষমতা আছে সেই জগতে। বাকিদের নেই। এ-ই না থাকার পিছনে কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। ওগুলোর কথা বলছি না, ওসব স্ব উদ্যোগে জেনে নেওয়ার বিষয়। যাহোক,
এক অদ্ভুত মায়াময় জগৎ মায়াং। পুরোটা ঢাকা নীল চাদরে। যেখানে কখনও রাত নামে না আবার পুরোপুরি আলোকিত থাকে না। এক বাক্যে বললে─বিষণ্নতার প্রলেপ মাখানো। লেখক এ জগৎ যে খুব যত্নে তৈরি করেছেন, তা বার কয়েক ফুঠে উঠেছে কোমল বর্ণনার বদৌলতে। এবং এ সৃষ্টিতত্ত্ব যে ‘নর্স মিথলজি’ কেন্দ্রিক তার আভাস মিথলজি জানাশোনা পাঠকরা খুব করে ধরে নিতে পারবে। কিছু জিনিসের ব্যাখ্যা বা সামঞ্জস্যতা আমাকে আনন্দিত করেছে। এ-ই যেমন মায়াং প্রবেশের স্থান─নিরোদ্বার। সত্য যে, আপনি চাইলে মায়াং বেড়িয়ে (বেড়ানো) আসতে পারবেন। তবে এর কিছু জটিল প্রসেস রয়েছে। ওটা বর্ণিত আছে বইয়ে। আপাতত আমি এ নিরোদ্বারের সাথে মিথলজির একটা সামঞ্জস্য নিয়ে বলি।
‘Bifrost’ নামক রংধনুর ব্রিজের ব্যাপারে যদি জেনে না থাকেন, তবে জানাই। ওটা সেই ব্রিজ, যেটা দিয়ে অ্যাসগার্ডিয়ানরা পৃথিবীতে (মার্ভেল কমিক অনুযায়ী মিডগার্ড) যাওয়া-আসা করে। মৃগয়ার নিরোদ্বার অনেকটা তেমনই। যেটা দেখাশোনা করার দায়িত্বে থাকে মায়ালদের একটা জাত বা ‘থোমন’ নামক গোষ্ঠী। তবে সেই কার্যক্রম বেশ স্বকীয়। এমন অনেক টুকরো টুকরো মিথলজি ছোঁয়া পুরো বই জুড়ে ছড়ানো ছিটানো রয়েছে। বাদ যায়নি গ্রিক মিথের ঘনঘটাও। কেবল খুঁজে বের করতে হবে পাজলের ন্যায়। এসব এ মুহূর্তে স্পুন ফিডিং করিয়ে পড়ার মজা নষ্ট করতে চাই নে।
মায়াল জাতদের দায়-দায়িত্ব ব্যাপক। মায়াং জগৎটা বন বা জঙ্গলের কয়েকটা লেয়ার দ্বারা সাজানো। বিষয়টা স্বচক্ষে দেখতে একটা মানচিত্রের অনুভব বেশ ভুগিয়েছে বটে। তবে একটানা পড়ে গেলে এ ভুক্তভোগী দায় থেকে কিছুটা মুক্ত থাকা যায়। মায়াং জগতের সবচেয়ে শুদ্ধতম প্রাণী হলো ‘মৃগ’। যার সাথে কোনোভাবে মৃগয়া জড়িত। মৃগয়া কী বা কে সেই আলাপ এখানে স্থগিত করা উচিত। তার চেয়ে একবার ঘুরে আসি আমাদের চেনা জগৎ, পৃথিবী থেকে। ওখানে দু’জন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
আজিজ ও সায়রা। পুরো উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ দুটো চরিত্র। যাদের খুব ভালোভাবে অতীত থেকে বর্তমান অবধি সম্মানের সহিত পরিচিত করিয়েছেন লেখক। ওদের পর্বগুলো বেশ আকর্ষণীয় এবং কিছুটা উত্তেজনায় পূর্ণ ভিন্ন এক কিসিমের চরিত্রের আগমনের জন্য। তবে দৃশ্যপট সাজাতে লেখক এখানে পুরোপুরি জোর দিয়েছেন মনস্তত্ত্বের ওপর। বাস্তবতা ওখানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঠাসা। গল্প বর্তমান থেকে ধীরে ধীরে প্রভাহিত হয়েছে অতীত আলোচনা, পুনরায় ওটা ফিরে এসেছে বর্তমানে। চলমান এই যাওয়া-আসা চলেছে বেশ ক’বার। ব্যাকস্টোরি, ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাক এসেছে মুহুমুর্হু। দম নেওয়ার জন্য সময়টুকু এখানে নেই। খুব ফাস্ট-পেসড অথবা বলা যায় পেজ টার্নার। এর মূল কারণ ছোটো ছোটো শব্দ দিয়ে সাজানো বাক্য। ফ্যান্টাসিতে সাধারণত এ দিকটা মিসিং থাকে। অনেক রাইটার গল্প বিল্ড নিজস্ব ঢঙে করলেও সেখানে একটা শ্বাস নেওয়ার জায়গা থেকে। এ উপন্যাসে সেটা নেই। তবে থামতে তো হয়। ব্যাকফায়ার অনেকটা। অর্থাৎ যে লেখনশৈলীটা টেনে নিয়ে যায় আপন গতিতে নদীর বহমান স্রোতের মতো, ওটাই আবার কিছুটা ভ্রুকুঞ্চনের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তখন অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, ওটা না রাখা যায় আর না গেলা। বিষয়টা অনেকটা পছন্দের কোনো গান হঠাৎ শুনতে বিরক্ত লাগার মতোই।
‘মৃগয়া’ উপন্যাস কাহিনির আবহ, মায়াং নামক সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড সেটিংস─সবই ভালো। তবে ওই লেখনশৈলীটা ভালো হওয়া সত্ত্বে কিছু সময় একঘেয়ে অনুভূতি দেয়। তার ওপর লেখকের বারবার ‘ডোডো’ পাখির কর্মকাণ্ড বর্ণনা করার সময় যে ধরনের ‘আদুরে’, ‘মায়াময়’ বাক্য ব্যবহার করেছে, ওটা যখন ভিন্ন কোনো চরিত্র কিংবা ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে ব্যবহৃত হয়েছে, তখন খুব একটা আমোদ লাগেনি।
সাহিত্য সমালোচনা কঠিন এক জিনিস, হুট করে কিছু বলে নেতিবাচক ট্যাগ দিলে কেবলই হয় না। নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন পড়ে। ওটা ব্যতীত বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো কোনো উপন্যাস খুব ‘ভালো’ অথবা ’খারাপ’ বাক্য সমেত উতরাতে পারে না। পারা সম্ভবও নয়। ‘মৃগয়া’ মৌলিক ফ্যান্টাসিতে খুব ভালো সংযোজন, এমনকি অনেক লেখকের প্রথম কোনো লেখা ফ্যান্টাসি উপন্যাস থেকেও। তবে জগৎ সৃষ্টি, সেখানকার জীব ও জগৎ তৈরি এবং ভেতরগত রাজনীতিই মূল অবলম্বন না অম্বুজমূলের মতো। এর বাইরে পরিপ���র্ণ আবেগ যুক্ত করতে অনেক কাঠখড় আর শক্তপোক্ত কারণ দেখানোর প্রয়োজন পড়ে। এ-ই উপন্যাসে সেটার দেখা পাওয়া গেলেও ওটা খুব একপেশে মনে হলো। চরিত্রের আবেগ আর অনুভূতি থেকে লেখকের নিজস্ব ভাবনাটা এখানে সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে। এমন কোনো স্থান নেই যেখানে বুকে কাঁপুনি ধরে কিংবা সংশয়রা খৌম থেকে প্রাইফেড বনে অজানা কিছু ভয়ের সৃষ্টি করে। কিন্তু ও-ই মৃগয়া বনে যাওয়া, তাকে এক দুর্দান্ত শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়া করিয়ে দেওয়ার পরও জানা থাকে শেষটা কী হতে চলেছে। উপভোগের বিষয়টা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে এতে। একপাক্ষিক ক্ষমতা বিরাজমান থাকে পুরো বই জুড়ে। অবশ্যই সেটা ইতিবাচক কেন্দ্রিক। কিন্তু পাঠক হিসেবে মায়াং কেন্দ্রিক রাজনীতিটা আরেকটু জগৎ সৃষ্টির বর্ণনার মতো বৃহৎ আর শক্তিশালী হওয়া দরকার ছিল।
ভিলবনের ভিলের ব্যবহারটা চমৎকার। কিন্তু ওটা কেবলই সৌন্দর্য পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এমনকি কয়েকটা জীবের বর্ণনা মিসিং, ওদের কেবল নামেরই অস্তিত্ব রয়েছে। তবে স্রষ্টা ও সৃষ্টির দর্শনটা পোক্ত। অস্তিত্ব রক্ষা ও সংকল্পের বিষয়টাও। মৃগয়ার সবকিছুর সাথে একাত্মতা থাকার পরও খুব বেশি অনুভব করার মতো বিষয় পড়া শেষে ছিল না। মনে রাখার মতো কেবল মাত্র থেকে যায় মায়াং সৃষ্টির অতিব সুন্দর বুননটি। আর ওটাই উপন্যাসের প্রাণ, মৃগয়ার ভাষায় যাকে বলে ইথেমপিল। এছাড়া লেখকের বুদ্ধিমত্তা ও কাহিনি সাজানোর ধারাটা প্রশংসনীয়। তাড়াহুড়োময় লেখনশৈলীটা না থাকলে ব্যাপারটা আরও জমত বলে মনে করি। যদিও বিষয়টা সম্পূর্ণ নিজস্ব পার্সপেক্টিভ। ফ্যান্টাসিতে এমন তাড়াহুড়ো সচারাচর দেখা যায় না, লেখক দেখিয়েছেন এবং ওটাই তাঁকে আলাদা করেছে।
উপন্যাসের সৃষ্টিতত্ত্ব ও স্রষ্টার কারুকার্যের পাশাপাশি ‘ভালোবাসা’ নামক অনুভূতির বন্ধনটা বেশ শক্ত। ওটা শেষ অবধি টিকে থাকে। কিছুটা সময় ব্যয় করে মাথা থেকে যাবতীয় যত ভাবনা ত্যাগ করে যদি আমরা ভাবতে বসি, স্রষ্টা কেন এ জগৎ সংসার সৃষ্টি করেছেন, তবে সর্বপ্রথম কোন উত্তরটা আপনার মাথায় আসবে জানি না, তবে আমার আসবে ভালোবাসা নামক শুদ্ধ অনুভূতির কথা। ওটা ছাড়া কোনো কিছু সৃষ্টি সম্ভব না। অর্থহীন থাকে সেটা। আর অর্থহীন বলে কিছুই থাকে না। অনর্থক কাজটারও একটা অর্থ থাকে। লেখকের মৃগয়া লেখার পিছনে সেইরকম এক অর্থ আছে। ওই অর্থ কেবল পাঠক হিসেবে খুঁজে বের করতে হবে। সম্ভবত আমি সেটা পেরেছি। অপ্রাপ্তির ভিড়ে এ প্রাপ্তিটা আমাকে আনন্দ দেয়। এখনও। এবং সেটা অনুভব করেছি মৃগয়া শেষে।
লেখক দক্ষ গল্প বুনক, চিন্তা ভাবনার ডালপালা বেশ বিস্তৃত তাঁর। ইগড্রাসিলের শেকড়ের মতো। আগামীতে তিনি আরও দুর্দান্ত কিছু দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন তার আভাস মৃগয়ায় স্পষ্ট। পুরোনো কমতিটা আগামীতে পুষিয়ে দিবেন নতুনতার পূর্ণতা দিয়ে এ-ই বিশ্বাস।
নিতান্তই সাদামাটা এবং মধ্যবয়সী আজিজ অত্যন্ত চমৎকার সুন্দরী এক মেয়েকে বিয়ে করে সবার চোখে তাক লাগিয়ে দিল। তবে শিগগিরই সে আবিষ্কার করলো তার নতুন বউ ঘুমায় না। ঘুমায় না মানে ঘুমায় না, দিন রাত ২৪ ঘন্টায় সে কখনো ঘুমায় না। এমনকি নির্ঘুম থাকার কোনো ক্লান্তিও তার হয় না। আবার মাঝেমাঝে তার বলা কিছু কথাও ভবিষ্যৎবানীর মতো ফলে যায়! আজিজ তার বউয়ের রহস্য বের করতে গিয়ে আবিষ্কার করলো অন্য এক নীলচে মায়াময় জগতের অস্তিত্ব। যেখানে রয়েছে অসংখ্য প্রাণ। আর সে সব প্রানীর যুদ্ধ, ত্যাগ আর ভালোবাসার গল্পের সাথে জুড়ে গিয়েছে আজিজের নিজের ভাগ্যও। এসব রহস্যের সুতোটা কার হাতে?
সাখাওয়াত হোসেন সাম্প্রতিক সময়ের ফেসবুক লেখকদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং প্রতিভাবান একজন লেখক। লেখকের ব্লক লিস্টে যাওয়ার আগে আমি নিজেই উনার বেশ ভক্ত ছিলাম। আর সে কারনেই মৃগয়া বের হবার পর থেকেই বইটা পড়ার আগ্রহ ছিল আমার প্রবল। আর পড়া শেষে বলতেই হয় আমি আশাহত হইনি।
মায়াং এবং তার নরক
ফ্যান্টাসি জনরার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ এর সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং। এই বইতে সেখানটায় বেশ চমৎকার কাজ করেছেন লেখক। একদমই ভিন্ন ধরণের একটা দুনিয়া দেখিয়েছেন পাঠককে। যে দুনিয়ার প্রানীরা সর্বদা নিয়ম মেনে চলে আর তাদের নদীশ্বরীর অনুগ্রহ কামনা করে। এই দুনিয়ায় হরেক রকমের প্রানের সৃষ্টি করেছে নদীশ্বরী। মায়াল, কালখাটুস, ঔশ্যাল, থোমন, হোমি, প্রাইফেড, বিউসেরাস এমন আরো অনেক। এরা নিজেদের মাঝে লড়াই করে আবার সন্ধিচুক্তি করে একে অপরকে রক্ষাও করে। লেখকের তৈরী করা এই দুনিয়ার নাম মায়াং। বইয়ের মূল গল্প মূলত এই মায়াং কে কেন্দ্র করেই। শুরুটা অবশ্য আমাদের চেনা পৃথিবী দিয়েই। আর সে শুরুটা এতোটাই চমকপ্রদ যে বইটা একদম ইনস্ট্যান্ট পাঠককে হুকড করে ফেলবে। তবে অমন দূর্দান্ত শুরুর পর বইটা কিছু সময়ের জন্য খানিকটা এলোমেলো হয়ে যায়। এরপর আবার যখন গতি পায়, তখন তা একদম শেষ পর্যন্ত পাঠককে আকড়ে রাখে। মায়াংবাসীরা নরক হিসাবে যাকে চেনে, তা আমাদের এই পৃথিবী। কিভাবে পৃথিবী এবং মায়াং একে অপরের সাথে জড়িয়ে পড়ে সেটা নিয়েই বইয়ের গল্প।
কাহিনীর গতিপ্রকৃতি
শুরুর দিকে প্রতিটা চ্যাপ্টার পৃথিবী এবং মায়াং এর ঘটনা অলটারনেট করে সাজিয়েছেন লেখক। একের পর এক রহস্যময় ঘটনাবলী দিয়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন তৈরী করে গিয়েছেন। পৃথিবীতে ঘটছিল এক রকম ঘটনা, ওইদিকে মায়াং এও শুরু হয়েছে ঘটনার ঘনঘটা। দুইদিকেই একসাথে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাবলী টানা পড়তে গিয়ে পাঠক হিমশিম খেয়ে যেতে পারে। এরই মাঝে ধীরে ধীরে কাহিনীর লেয়ার ছড়িয়ে গিয়েছেন। পাঠককে অজস্র প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েই গল্প এগিয়ে নিয়েছেন। আর শেষে এসে সবগুলো সুতোকে জুড়ে দিয়েছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। শুরুর দিকে অমন প্রশ্নের পর প্রশ্ন সাজানোর কারনেই কি না, শেষের দিকে বইটায় ছোট ছোট টুইস্ট বা ধাক্কার পরিমাণ ছিল বেশ অনেক। বইয়ের অর্ধেকের পর থেকে নতুন নতুন আরো চরিত্রের আগমন, ব্যাকস্টোরি আর অপ্রত্যাশিত সব মৃত্যুর কারনে বইটা হাত থেকে রাখা দায় হয়ে পড়ে। বইয়ের এন্ডিংটা এক দৃষ্টিতে দেখলে ভালো। তবে আমার কাছে খুব একটা ভালো লাগেনি। নৃপিয়াস নামের চরিত্রের অমন সিদ্ধান্ত নেয়ার কারন কি সেটাই ধরতে পারিনি। তবুও সব মিলিয়ে বলা যায় বেশ সুন্দর একটা গল্পকে অদ্ভুত দক্ষতার সাথে ভালোভাবেই টেনে নিতে পেরেছেন লেখক। বইয়ে বিভিন্ন সময়ে উঠে আসা প্রতিটা ছোট্র ছোট্র এলিমেন্টকে যেভাবে শেষে এসে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তার জন্য লেখক সাধুবাদ প্রাপ্য। একজন নতুন লেখকের কাছ থেকে মৌলিক ফ্যান্টাসিতে এরচেয়ে বেশী কিছু আশা করা যায় না।
তবুও থেকে যায় কিছু কথা,
এবার আসি বইয়ের যেসব ব্যাপার ব্যক্তিগতভাবে আমার ভালো লাগেনি সেই আলোচনায়। প্রথমেই বলতে হয় লিখনশৈলীর কথা। এটা অনস্বীকার্য যে এই বইয়ের লিখনশৈলী অদ্ভুত রকমের সুন্দর। ছোট্র ছোট্র বাক্যে চমৎকার শব্দচয়ন, উপমার ব্যবহার, অল্টারনেট শব্দ দিয়ে বাক্য সাজানো; সব মিলিয়ে একেবারেই ভিন্ন একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে বইটা পড়ার সময়। সমস্যা আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে তা হলো, ধীরে ধীরে বইয়ের কাহিনী যত কমপ্লেক্স হয়েছে এই লিখনশৈলী তত প্রেশার ফেলেছে। বই পড়ার গতি স্লো করে দিয়েছে। লেখক আমাদের পরিচিত বাক্যগুলোকে কিছু শব্দ এদিক সেদিক করে সাজিয়েছেন। যেটা শুরুর দিকে আকর��ষণীয় মনে হলেও, কিছু সময় পর আর ভালো লাগেনি। পুরো বইটার ভাষা একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। শেষে এসে এমনও দেখেছি যে এক শব্দেই উনি বাক্য সম্পন্ন করেছেন। আমি নিজে যতিচিহ্নের ব্যাপারে খুব একটা ধারণা না রাখলেও, পড়ার সময়ে দাঁড়ি এবং কমা এই দুটো জায়গা মেনে চলি। ১/২/৩ শব্দের বাক্যগুলো তাই পড়ার সময় কিছু জায়গায় বিরক্তির জন্ম দিয়েছে। তবে এতে করে লেখকের নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় থেকেছে। আর ফ্যান্টাসি হিসাবে এমন ভাষাশৈলীর হয়তো বা দরকারও ছিল।
২য় যে সমস্যা তা কিছুটা প্রোডাকশন জনিত সমস্যা বলা যায়। নৃধিয়া, নৃপতি, নৃপিয়াস, পৃয়ুস, পৃথি, পৃ এমন অদ্ভুত সব নামের সমাহার, এর সাথে একেক রকম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন অনেক রকমের প্রানী উঠে এসেছে গল্পে। মায়াং এর এসব প্রানীদের নামধামের ব্যাপারে বইয়ের শুরুতে একটা নির্ঘন্ট থাকা জরুরী ছিল। যেহেতু দুইটা টাইমলাইন, বিভিন্ন চরিত্রের কাছাকাছি নাম, তার উপর কিছুটা কঠিন গদ্যের বই তাই প্রায়ই এমন হয়েছে যে পিছনে গিয়ে গিয়ে আবার মনে করতে হয়েছিল যে কোন চরিত্রটা আসলে কী ছিল, কেমন ছিল!
৩য় সমস্যা, যৌনতা। সাহিত্যে যৌনতা থাকাকে আমি খারাপ মনে করি না। তবে তার জন্য প্রপার কাঠামো থাকা উচিত গল্পে। এই বইতে যৌনতার পরিমাণটা অল্পই, লেখক শুধুমাত্র দুইটা চ্যাপ্টারে যৌনতা দেখিয়েছেন। কিন্তু সেই দুই চ্যাপ্টারকে অনায়াসেই লাইট পর্ন হিসাবে চালিয়ে দেয়া যায়। অতো ডিটেইলসের আদৌ কোনো দরকার ছিল বলে আমি মনে করি না। এমনকি মনসুরকে যতোটা সময় দেয়া হলো গল্পে, ততটা সময়ও তার প্রাপ্য ছিল না। তার তো মেজর কোনো ভূমিকা আর থাকলোই না গল্পে। তেমনি পৃথিবীর টাইমলাইনে দুই পুলিশের তদন্ত আর তদন্তের কারন খাপছাড়া অবস্থায় শেষ হওয়ায় অযাচিত মনে হয়েছে।
এছাড়াও মায়াং এর বেশকিছু অংশে রিপিটেটেড বর্ণনা ছিল। আর অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতেও লেখকের অপরিপক্কতা লক্ষ্যনীয়। বইয়ে অনেকগুলো অ্যাকশন সিকুয়েন্স থাকলেও সবগুলোই প্রায় একইরকম ভাবে লিখে ফেলেছেন লেখক। এছাড়া কারেক্টার ডেভেলপমেন্টে উন্নতির জায়গা ছিল অনেক।
তবুও সব মিলিয়ে বলবো বাংলা মৌলিক ফ্যান্টাসিতে চমৎকার সংযোজন মৃগয়া।
ব্যক্তিগত রেটিং: ৭.৫/১০ ( চমৎকার সেটিংস, গতিশীল গল্প, প্রয়োজনীয় চমক আর সকল প্রশ্নের মোটামুটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা সব মিলিয়ে বইটা ভালো। তবে ব্যতিক্রম সাজতে গিয়ে লেখকের ছোট বাক্য সাজানোর অতিরিক্ত প্রচেষ্টা পড়ার অভিজ্ঞতা কিছু জায়গায় নষ্ট করেছে। লেখকের নিজস্ব কিছু ফিলোসফির ইমপ্লিমেন্টেশনও কারো কারো ক্ষেত্রে আপত্তি তৈরী করতে পারে)
প্রোডাকশন: ক্রাউন সাইজের বইটার প্রোডাকশন বেশ ভালো। বিশেষ করে প্রচ্ছদটা নজরকাড়া। অবাক লেগেছে যে বইটার ডাস্ট কাভারের তুলনায় জেল কাভারের ছাপা বেশী ভালো হয়েছে তা দেখে। তবে বইটায় বেশকিছু বানান ভুল ছিল। অমন দামের একটা বইয়ের ক্ষেত্রে এটা বেমানান লেগেছে। দামটা একটু বেশীই বইটার।
"স্রষ্টাও ন্যায় অন্যায়ের ফাঁদে পড়ে নিষ্ঠুর। স্বজনপ্রীতি দোষে দুষ্ট।"
🔸চমৎকার একটা ফ্যান্টাসী বই পড়লাম। এটাকে সেক্লুডেড ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসী জনরায় ফেলা যায়। কারণ এখানে পৃথিবীকে দেখানো হয়েছে নরকবাস। আর নদীশ্বরীর অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টি এক জগৎ মায়াং। আর মায়াং এবং পৃথিবীতে যাতায়াত করা যায় বিউসেরাস প্রজাতির এক বিহঙ্গমের পিঠে চড়ে।
🔸নদীশ্বরীর সৃষ্ট জগৎ মায়াং রয়েছে অনেক প্রাণী। মায়াল, থোমন, ঔশ্যাল, কালখাটুস, হোমি,খৌম, প্রাইফেড। আর রয়েছে কিংবদন্তি কায়াস। এছাড়াও রয়েছে নদীশ্বরীর সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি তিন পা ওয়ালা মৃগ। আর এই মৃগ যে হত্যা করে তাকে বলা হয় মৃগয়া।
🔸পৃ ছোট্ট এক মায়াল। নদীশ্বরীর সৃষ্ট প্রিয় মৃগ হত্যা করে পাপমুক্ত হতে নরকবাসে যায়। সেখানে ভালোবাসার শুদ্ধ বন্ধনে আবদ্ধ হয় আজিজ এর সাথে। পুরো গল্প জুড়ে প্রতিটা চরিত্র খুব সযত্নে তৈরি করা হয়েছে। পৃয়ুস, পৃথা, নৃপিয়াস, ডোডো পাখি, বিউ, মৃয়ঙ্ক, প্রধান, অস্টিন সহ আরো কিছু চরিত্র। পৃ কী পারবে নরকবাস থেকে ফিরে আসতে?
🔸পুরো গল্পটা সাজানো মায়াং এর মৃগয়াকে কেন্দ্র করে হলেও এখানে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় স্রষ্টা এবং সৃষ্টি। স্রষ্টাকে প্রশ্ন করায় স্রষ্টা অসন্তুষ্ট। বুনলেন নিখুঁত এক জাল। কী ছিলো সেই প্রশ্ন আর কে করেছিলো? কিংবদন্তী কায়াস কী আসলেই সত্য? তাহলে কি বা কে এই কায়াস? স্রষ্টার কোনো সৃষ্টি নাকি ভুল? এসবের সব উত্তর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো গল্প জুড়ে। কিন্তু এসবের মাঝে খুব সন্তর্পণে লুকানো আছে এক গভীর ভালোবাসা আর ত্যাগ এর গল্প। ভালোবাসার বিশুদ্ধ বিসর্জন।
🔸 শাখাওয়াত হোসেনের পড়া এটা আমার প্রথম বই । লেখার মাধুর্য মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতো। প্রতিটা পৃষ্ঠায় মনে হচ্ছে শব্দগুলো ঝংকার দিয়ে উঠছে। কী সুন্দর শব্দচয়ন । গল্পটা একটু ধীরে ধীরে পড়ার মতো। তবে কোথাও কোনো কিছু অপ্রয়োজনীয় মনে হয়নি। একদম মেদহীন, সাবলীল লেখা।
🔸 তবে একটা বিষয় আলোচনার মতো তা হলো ১৮+ কন্টেন্ট। যদিও কন্টেন্ট গুলো খাপে খাপ বসানো তবুও কিছু যায়গায় ডিপলী আলোচনা না করে হালকার উপর স্কিপ করাই যেতো। তবে পাঠক চাইলেই তা স্কিপ করে পড়তে পারে।
🔸 কিছু উক্তি: -সব জগতেই ঈশ্বরের আলোকজ্জ্বল গল্প প্রচলিত খুব। অন্ধকারের অস্তিত্ব আছে বলেই আলো ফুটে ওঠে। তবে ঈশ্বরকেও ফুটে উঠার জন্য পাড়ি দিতে হয়েছে অন্ধকার একটা গল্প। -এক হস্তে পাথর না নিলে অন্য হস্ত কামড়ে খাবে মায়া। - স্রষ্টাও ন্যায় অন্যায়ের ফাঁদে পড়ে নিষ্ঠুর। স্বজনপ্রীতি দোষে দুষ্ট। - কালখাটুস সর্বোচ্চ কামড়ে শরীর খাবে, নদীশ্বরী আমার আস্ত জগত খেয়ে ফেলেছেন!
🔸বইয়ের প্রোডাকশন সুন্দর। ছোট্ট একটা বই। দামটা একটু বেশি মনে হয়েছে। দুই একটা বানান ভুল চোখে পড়েছে। প্রচ্ছদটা সুন্দর অনেক 🥰 সব মিলিয়ে চমৎকার একটা বই।
গল্পটা পড়তে শুরু করার সময় খুবই সমস্যা হচ্ছিল, একে তো কঠিন নামকর, তার মধ্যে বোঝা যাচ্ছিল না কোথায় হচ্ছে ঘটনা গুলো। অবশ্যই পৃথিবীতে না। তবে অন্য কোন গ্রহে? তাই শেষে reveal করা plot টা আমার খুবই পছন্দ হয়েছে।
সত্যি কথা বলতে আমার পড়া অন্য রকম একটা গল্প ছিল এটা। Plot খুবই promising ছিল কিন্তু execution টা আরেকটু ভালো হলেই এটা একটা অসাধারণ গল্প হত। ৩ তারকা দেয়ার reason গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে শেষটা। কেন যেন প্রধান চরিত্রকে আমি ঠিক পছন্দ করতে পারছিলাম না। আবার রোমান্সটাও আমার অতটা পছন্দ হয় নি। আজিজ এর মনে অনেক ঘাপলা আছে। সহ্য করতে না পারা সায়রা বানু দুই মিনিটে তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় ব্যাক্তিত্বে পরিণত হওয়াটা একটু বেশিই বাস্তবতা সাংঘর্ষিক। মাঝে cottage এর ঘটে যাওয়া topic গুলোর প্রয়োজন আমি একদমই দেখছি না।
গল্পটা এতোটা confusing হওয়ায় আমি খুব সময় নিয়ে পড়েছি। কিন্তু একটু হতাশ করল শুধু একটা বিষয়ই। অসম্ভব সুন্দর একটা গল্প - ইশ্বর ও তার সৃষ্টিদের নিয়ে কিন্তু তাও গল্প সাজানোর ভঙ্গিটার গল্পটাকে পিছিয়ে দিয়েছে। এর চেয়েও সাধারণ গল্পকে আমি ৫ তারকা দিয়ে থাকি। কিন্তু আমি একটা বইকে judge করি আমার ভালো লাগার মাপকাঠি দিয়ে। অন্য বইয়ের সাথে তুলনা করে rating দিলে এটা ৫ তারকাই পেত।
মৃগয়া- যে মৃগ শিকার করে। অদ্ভুত ভালো লেগেছে, তবে চরিত্রের নাম গুলো কোরিয়ান ভাষার যেকোনো বইয়ের চরিত্রগুলো মনে রাখার থেকেও কষ্টকর। যদি ফ্রন্ট পেইজে একটু ডিটেইলস দিয়ে দিত, ভালো হতো। ওভারঅল কনসেপ্ট ভালো। স্রষ্টা ও তার সৃষ্টি নিয়ে মৃগয়ার জগৎ-এ স্বাগতম।
নদীশ্বরীর অতি যত্নে সৃষ্ট মৃগের মতোই লেখক অনেক যত্ন ও মায়া নিয়ে রচেছেন এই গল্প। কী সুন্দর, কী অদ্ভুত অথচ একই সাথে কী সাধারণ। ছোটবেলায় গল্পের বই পড়ে এই রকম অনুভূতি হতো। ভালো লাগলো।
❛জগত বিপুল রহস্যের আঁধার। সেই রহস্যের কুল কিনার নেই কোনো। সৃষ্টির আদিতত্ব জানতে পেরিয়ে গেছে যুগের পর যুগ। এখনো সেই রহস্যের সীমানায় আসা যায় নি। স্রষ্টা আর সৃষ্টির এই রহস্যের মাঝে লুকিয়ে আছে কত অজানা কথা।❜
সবুজ বৃক্ষে ঘেরা পৃথিবীর এক মধ্যবয়স্ক থলথলে মানুষ আজিজ। সদ্য বিয়ে করেছেন। স্ত্রীকে খুব ভালোবাসেন। না বেসে উপায় কী? অমন রূপবতী, গুণী স্ত্রী কয়জনের ভাগ্যে জুটে? তাও হীনমন্যতায় ভোগা আজিজের। সে নিজেকে অসুসন্দর ভাবে। ভাবে আশপাশের মানুষও। আজিজের বয়স চল্লিশ এর কাছাকাছি বা বেশি হলেও স্ত্রী সায়রা বানু ২৩-২৪ এর যুবতী। অনেকেই এই জুটিকে একেবারে মিসম্যাচ হিসেবে ধরেন। বলা যায়, ❛গোবরে পদ্মফুল কিংবা বাঁদরের গলায় মুক্তোর হার!❜
বিয়ের পর তারা এসেছে তিনমাসের হানিমুনে। সমুদ্র দেখার ইচ্ছা সায়রার। বেশ আনন্দেই কাটছে তাদের সময়। সায়রার সব ভালো কিন্তু অদ্ভুত কিছু ব্যাপার আছে। আজিজ লক্ষ্য করছে সায়রা নিদ্রা যায় না। মানে একেবারেই না। তাও কেমন প্রাণোচ্ছল, তরতাজা সে। এটা কী করে সম্ভব? আবার এক দুইবার কাকতাল হলেও মানা যায়, কিন্তু বেশ কয়েকবারই সে আসু ঘটনা আঁচ করতে পেরে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে আজিজের অফিস কলিগকে। কীভাবে সম্ভব?
মায়াং - অনাবিষ্কৃত কোনো গ্রহ হয়তো। আমাদের দুনিয়ার মতো নয়। সে জগত ভিন্ন। মায়াময় নীলাভ এক পরিবেশ। রাইবনে ঘেরা অনিন্দ্য সুন্দর জায়গা। যেখানে জল থৈথৈ করছে। অদৃশ্য সে জল। কিন্তু ভিজে ছলছলে একটা অনুভূতি বিরাজ করছে সেখানে। মায়ংয়ের সবথেকে ক্ষমতাসম্পন্ন স্থানের নাম ইথেমপেলি। সেখানেই কখনো কখনো জলের ঘূর্ণনের মতো দেখা দেন নদীশ্বরী। মায়াং স্রষ্টা তিনি। এখানে প্রতিটি প্রাণীকে তিনি তৈরি করেছেন নিজের মমতায়। মায়াল, কালখাটুস, ঔশ্যাল, সিয়াস, টৌশান, খৌম, প্রাইফেড, রাভেন সহ অন্যান্য অনেক প্রাণী। যাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মায়াল। যাদের ক্ষমতা সবার উপরে। তবুও স্রষ্টা রাখলেন নিজের প্রিয় একজন সৃষ্টি। তারও বুঝি স্বজনপ্রীতি আছে! সেই প্রীতি থেকেই তিনি তৈরি করলেন তিন পেয়ে অদ্ভুত মায়াময় ❛মৃগ❜। প্রায় অদৃশ্য হয়ে চলার ক্ষমতা। তাকে বেশি ভালোবাসেন বলেই তাকে দিলেন যন্ত্রণাহীন প্রয়াণ। নাইকুন্ডলে হাত রাখলেই সে ব্যথাহীন প্রয়াণ পাবে। কিন্তু নিষিদ্ধ করে রাখলেন মৃগ হ ত্যা। যে এই কাজ করবে নদীশ্বরীর অসন্তুষ্টি অর্জন করবে সে।
মানুষ কিংবা সৃষ্টি জগতের যেকোনো প্রাণী তাদের স্বভাবই হয়তো নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ। স্রষ্টা এই জগৎ সৃষ্টির আগে যেমন স্বর্গে আদম (আ) ও হাওয়া (আ) কে গন্ধম ফল খেতে মানা করেছিলেন। তবুও প্ররোচনা আর কৌশলে পড়ে সেই নিষিদ্ধ কাজ করে তাঁরা বিতাড়িত হয়েছিলেন স্বর্গ থেকে। যার শাস্তিস্বরূপ পাঠানো হলো দুনিয়ায়। মায়াং এর মায়াল নৃপতিও দূর অতীতে করেছিল সেই একই কাজ। ঘটিয়েছিল মৃগ হ ত্যা। নাম হয়েছিল তার ❛মৃগয়া❜। শাস্তিস্বরূপ পিতার হাতেই নিজ প্রাণ দিতে হয়েছিল তাকে। এরপর বহু দিবস কেটেছে। সবাই নদীশ্বরীর অনুগ্রহে থেকেছে। অমান্য করেনি তার কোনো আদেশ। মায়ালরা আধিপত্য বিস্তার করেছে। ওই নীল আবছা জগতে কেউ ঘুমায় না। ওখানে হয়না বৃষ্টি। ঘুমায় শুধু বৃক্ষরা, রাইবৃক্ষ। তারা চলাচলও করতে পারে। এভাবেই কেটে যায় বহু দিবস।
আজিজের সন্দেহ দানা বাঁধে। তবুও এই একলা জীবনে এমন ভালোবাসা সে পায়নি। সায়রা তাকে নিখুঁত ভালোবাসে। পরম যত্নে, মমতায় তার সংসার করে। কিন্তু একদিন সেই বিশ্বাস ভেঙে গেল। পরিণত হলো ভয়ে। আপেল কাটতে গিয়ে ভালোবাসার দুষ্টুমিতে কেটে গেল সায়রার আঙুল। পট্টি দিতে গিয়ে আজিজ খেয়াল করলো, এ কী! হাত কেটেছে সেখানে লাল র ক্তের বদলে স্বচ্ছ জল! এও হয় নাকি! একটা মানুষের শরীরে জল কোত্থেকে আছে কাটলে? প্রাণপ্রিয় স্ত্রী তবে নয় মানুষ? সুখের দিনগুলো এক মুহূর্তে শেষ হয়ে গেল। সায়রা নির্বাক। কিছু বলে না। স্বামীর সাথে তবুও জুড়ে থাকে। যদিও দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে আজিজ। সে ভয় পায়। ভালোবাসার কাছে ভয় জিতে যায়। কে সায়রা? বড়ো কথা কী সায়রা? পৃ উচ্ছল এক বাচ্চা। মায়াং জুড়ে দৌঁড়ে বেড়ায়। দ্রুত সব শিখে যায়। পিতা পৃয়ুশ আর মাতা পৃথী এই নিয়ে তাদের তিনজনের সুখের সংসার। পরিবার সমেত একদিন বেরিয়েছিল শিকারে। আর উদ্দেশ্য ছিল যদি দেখা পায় মৃগের। কন্যাকে দেখানোর ইচ্ছা। ইচ্ছা পূরণও হলো। পৃ একমনে মনোযোগ দিয়ে দেখা পেলো মৃগের। পৃ ঘটালো আরেক বিপর্যয়। যন্ত্রণাদায়ক এক হ ত্যা উপহার দিলো মৃগকে। পিতামাতা হতবাক। এর পরিণতি হবে মা রাত্মক। তবে দ্বিতীয় ❛মৃগয়া❜ হিসেবে অধিষ্ঠিত করে নিলো নিজের নাম সে। স্বাভাবিক নদীশ্বরী রুষ্ট হলেন। তবে এবার আর দিলেন না মৃ ত্যু। নরকবাস দিলেন। সেখানে মৃ তপ্রায় একটা প্রাণ বাঁচালেই হবে সাপ খন্ডন। ফিরে আসবে আবার নিজের দুনিয়ায়। কিন্তু নরক সে কোথায়? 𝗔𝗹𝗱𝗼𝘂𝘀 𝗛𝘂𝘅𝗹𝗲𝘆 বলেছিলেন,
❛𝕸𝖆𝖞𝖇𝖊 𝖙𝖍𝖎𝖘 𝖜𝖔𝖗𝖑𝖉 𝖎𝖘 𝖆𝖓𝖔𝖙𝖍𝖊𝖗 𝖕𝖑𝖆𝖓𝖊𝖙'𝖘 𝖍𝖊𝖑𝖑.❜
আর মায়াংবাসীর নিকটে সেই নরক হলো আমাদের এই বিপুলা পৃথিবী। নিরোদ্বার খুললে বিউসেরাস নামক পাখির পিঠে করেই নরকযাত্রা করবে পৃ। শুরু হলো যাত্রা। আজিজ টের পেলো শরীরের নানা জায়গায় সূক্ষ্ম ছিদ্র। শরীর ভেঙে গেছে। একদিন আবিষ্কার করলো রাতের বেলা তার আঙুল চুষে খাচ্ছে সায়রা। ঠোঁটে লেগে আছে লাল আঠালো তরল। বউ আসলেই তবে ডাইনি? ভয় পেয়ে গেল সে। সায়রাও ভয় পেলো। কিন্তু আকুতি করলো জলের কাছে নিয়ে যাওয়ার। তাদের একটা সমুদ্রস্নান বাকি। ভয়ের সময় এসব কথা কে পাত্তা দেয়। দুর্বল শরীরে পড়ে গেল আজিজ। সায়রা এগিয়ে আসছে।
মায়াংবাসী ওদিকে অল্প কয়েক দিবস পার করছে সংঘর্ষের মাঝে। পিতা মাতা অপেক্ষায় আছে কন্যার। তারা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এইদিকে দুনিয়ায় ঘটছে করুণ অথচ মায়াময় এক দৃশ্য।
একটা বিজাতীয় ভাষার লতাপাতা আঁকা পুরোনো বই, কিছু রহস্য, স্রষ্টা আর সৃষ্টির মধ্যে অস্তিত্বের প্রশ্ন সব মিলে একাকার হচ্ছে। খুলে গেছে মায়াংয়ের নিরোদ্বার। উড়ে আসছে একটা বিউসেরাস পাখি। প্রায় অন্তিম সময় আগত। এখনো অনেক বন্ধ দুয়ার খোলা বাকি। ঐযে দৃশ্যমান হলো এক যুবতী, তার পিছে এক লোক। কারা?
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
ফ্যান্টাসি উপন্যাস পড়ার সময় আলাদা একটা আগ্রহ কাজ করে। লেখকের কল্পনার বিস্তার কেমন আর সেটা লেখায় কেমন ফুটে ওঠে আর পাঠকের মাঝে তার সঞ্চার কতদূর হলো এই ব্যাপারটা ফ্যান্টাসি উপন্যাসে বেশ গুরুত্ব রাখে।
❝মৃগয়া❞ সাখাওয়াত হোসেনের লেখা ফ্যান্টাসি জনরার উপন্যাস। এমনকি লেখকের বইয়ের মলাটে আবদ্ধ প্রথম লেখা। প্রথম লেখাতেই তিনি বলা যায় পাঠকের কাছে ফ্যান্টাসি ধারার মৌলিকে নিজের লেখার পটুটা জাহির করতে পেরেছেন। বইটা নিয়ে আর ছিল অনেক। পড়বো পড়বো করেও পড়া হয়ে ওঠেনি। অনেক কিছুর পর অবশেষে ৩০২ পৃষ্ঠার উপন্যাস পড়তে পারলাম। ফ্যান্টাসি নিয়ে আগেও বেশ কয়েকটা বই পড়া আছে। এই ধরনের বই পড়তে বেশ ভালো লাগে।
এই উপন্যাসের শুরুটা আমাদের পরিচিত দুনিয়ায়। বেশ সাধারণ ঘটনা দিয়েই শুরু। শুরুতেই লেখকের লেখার গতিতে নিজেকে আবদ্ধ করে নিয়েছিলাম। ফলে আগ্রহ হচ্ছিলো অনেক। সামনে কী হয়, কী হয় জানতে। এরপরই লেখক প্রবেশ করালেন সেকেন্ডারি দুনিয়ায়। আশ্চর্য সুন্দর সে দুনিয়া। নীল ঘেরা, অদৃশ্য জলের ছপছপে অনুভূতি ওয়ালা জগৎ। যে জগতের সবাই সমান। সবার প্রাণ আছে, হাঁটাচলার ক্ষমতা আছে, এমনকি গাছেদেরও আছে হাঁটাচলার অধিকার। তারাই সে আজব জগতের একমাত্র সৃষ্টি যারা ঘুমায়। লেখক সেকেন্ডারি দুনিয়ার বিল্ডআপ এত দারুণভাবে করেছেন যে কখনোই মায়াংয়ের পরিবেশের বর্ণনা এসেছে, প্রাণীর কথা, পশু, বিহঙ্গমের কথা এসেছে মুগ্ধ হয়েছি। লেখকের লেখার গুনেই সেই নীলচে মায়ার দুনিয়াকে কল্পনাও করতে পেরেছি। আজব সেই জগতের ঘটনার সাথে আগে আগেই এসেছে আমাদের ধরণীর বর্ণনা। শুরুতে আজিজ ও সায়রা নামক যুগলের ঘটনার সাথে এগিয়েছে এক দম্পতির নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা, এসেছে মনসুর নামক এক পার ভা র্টের কথা। যে ঘটনার খুব ছোট একটা সূত্র অথবা গল্পের খাতিরে আসা কেউ। লেখক এই দুনিয়ায় বেশ কিছু ঘটনা এনেছেন। সাথে রেখেছেন বই পড়ুয়া এক পুলিশ অফিসারকে। যে কাজের ফাঁকে বই পড়ে, প্রচুর জ্ঞান সাথে তদন্তে পটু। এই ঘটনা গুলো শুরুতে আগ্রহের পরিমাণ যারপরনাই বাড়িয়ে তুলেছিল। এরপর তারা একে একে সাইড হয়ে গেল। লেখক প্রাইমারি আর সেকেন্ডারি দুনিয়ার মূল ঘটনায় সমান্তরালে নিয়ে গেলেন। উপভোগ করছিলাম। তবে শুরুর গতি কমে গেছিল। যেহেতু ফ্যান্টাসি, এখানে দুনিয়া তৈরি, চরিত্র বর্ণনা, ধাঁচ বর্ণনায় সময় লাগবে সে হিসেবে এই ধীরতা সহনীয় ছিল। সবথেকে আশ্চর্য সুন্দর ছিল বর্ণনার ভাষা। ফ্যান্টাসি উপন্যাসে এই ভাষা হয়তো উপন্যাস পাঠকে কখনো ধীর করেছে আবার দ্রুত পড়তে বাধ্য করলেও সূক্ষ্ম কিছু তথ্য যেন ছেড়ে না যেতে হয় সেজন্য মনোযোগ দিয়ে পড়তে বাধ্য করেছে। এই ভাষাকে কাব্যিক বলা যায় কী? শব্দ এদিক ওদিক করে লেখায় বাসায় একটা গাম্ভীর্যতা এসেছিল। পড়তে ভালো লাগছিল। আবার কোথাও গিয়ে একটু অসহনীয় লাগছিল। প্রচলিত শব্দের প্রতিশব্দ ব্যবহার করায় লেখা কিছুটা ধীর লেগেছে। এটা একান্তই আমার মনে হয়েছে। হতে পারে লেখার এই ধরনের জন্য কারো কাছে উপন্যাসটা অনেক উপভোগ্য লাগবে, আবার কারো কাছে খারাপ লাগাটা অস্বাভাবিক না। দুই জগতের মধ্যকার সমান্তরাল অবস্থানে চলতে থাকা ঘটনা ধীরে ধীরে এগিয়ে শেষে এসে মিলেছিল এক সুতায়। সেখানেই খন্ডন হয়েছে অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর। রহস্য প্রকাশ হয়েছে। পরপর অনেকগুলো টুইস্ট ছিল। নিঃসন্দেহে অবাক করেছে সেসব। শেষের দিকে এসে পড়ছি আর মনে হচ্ছে আরো কিছু তো বাকি তবে পৃষ্ঠা শেষ হয়ে যাচ্ছে কেন? তারমানে অনেক কিছু আমাকে বুঝে নিতে হবে, অথবা অব্যাখ্যেয় রয়ে যাবে? ধারনা ভুল নয়। আমার মনে হয়েছে লেখক শেষ দিকে বেশ তাড়াহুড়ো করেছেন। নৃপিয়াসের বিষয়টা খোলাসা হলেও অনেকটা ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। শেষটা আরো গোছালো হতে পারতো। এতে বিস্তারিত বর্ণনা আসলেও মনে হয় না পৃষ্ঠা বাড়ার কোনো অভিযোগ থাকতো। বরং তৃপ্তি থাকতো। শেষে লেখক নিজের লেখাতেই চাইলে মায়াং ঘেরা যে কালডোরা সময়কে ধীর করে রেখেছে সেই কালডোরাকে নিজের লেখায় এনে আরেকটু আস্তে শেষ করতে পারতেন। এটা পড়ার পর আমার আক্ষেপ ছিল। তবে পুরো উপন্যাসটা উপভোগ্য ছিল। কিছু এলাচি সবসময়ই থাকে। সেটা হোক বিরিয়ানিতে কিংবা উপন্যাসে।
এই বইটা পড়ার সময়েও আমার কাধে কিছু বিষয় অসহ্য ঠেকেছে। একান্তভাবেই আমার ভালো লাগেনি। কারো উপর সে অনুভূতি চাপিয়ে দিচ্ছিনা।
* উপন্যাসে ১৮+ বর্ণনা থাকবেই। যে জিনিস বাস্তবে আছে সে জিনিস উপন্যাসে থাকতে দোষ নেই। সমস্যা হলো সেটার মাত্রা। বাস্তবে সে মাত্রা কয়েকগুণ বেশি হতেই পারে। কিন্তু উপন্যাসে আমি ব্যক্তিগতভাবে রগরগে বর্ণনা পছন্দ করিনা। গল্পের খাতিরে আসতেই পারে। তবে সেটা বিকৃত মানসিকতার হলে বিরক্তির মাত্রা বাড়ে। মনসুর এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিল না। তার বিকৃত যৌ নতার যে বর্ণনা দুইটা অধ্যায় জুড়ে দিয়েছেন সেটায় আমি বেশ বিরক্ত দিয়েছি। খুবই বিচ্ছিরি লেগেছে। আমার কপাল মনে হয় এমনেই বেশি খারাপ। খেতে খেতে বই পড়তে গেছিলাম। স্যুপ খাইতে খাইতে একটা বিশেষ দৃশ্যের বর্ণনায় আমি রীতিমত খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আর মুখে রুচে নি। বলতেই পারেন এই ঘটনার সাথে শেষের আগের কিছু অধ্যায়ের ঘটনা যোগ ছিল। সেই যোগ অনেকভাবেই করা যেত। দুইয়ে দুইয়ে চার না মিলায় একের সাথে তিন যোগ করলেও চার হয়। পাঁচ থেকে এক বিয়োগ করলেও হয় (অংক শেখাচ্ছি না)। এটা দুইটা অধ্যায় ছাড়া আর কোথাও ছিল না বলে লেখককে ধন্যবাদ। বাকি উপন্যাসে কোথাও এরকম বিরক্তির উদ্রেক হয়নি। তবে এটা ভালো লেগেছে আমাদের দেশের হোটেল গুলোর নিরাপত্তা নিয়ে আর তাদের গোপন কর্ম নিয়ে একটা অ্যালার্ট দিয়েছেন লেখক। এই ঘটনাগুলো হরহামেশাই ঘটতে দেখি।
* যে তদন্তের উল্লেখ ছিল সেটা এরপর কোনো প্রভাবই মূল গল্পে ফেলেনি। সময় পেরিয়ে গেছে। চাইলে এখানে কিছু ঘটনা আনা যেত।
* মনসুর কেন একটা বইয়ের খোঁজে ওই নিখোঁজ ব্যক্তির বাড়ি গেল আমার বুঝে আসেনি। এটাও ঘটনার সাথে সামঞ্জস্য ছিল না।
* এক জায়গায় লেখা ছিল মায়ালরা চললে ❛থপ থপ❜ শব্দ হয় না। শেষের দিকের কোনো এক লাইনেই লেখা ছিল থপ থপ শব্দের কথা। আমার ভুলও হতে পারে। আসলে বিভিন্ন নাম (মায়াল, থোমন জাতীয়), নতুন পরিচয় এগুলোতে কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।
* লেখক তার বর্ণনাতেই যেভাবে ওয়ার্ল্ড বিল্ড করেছেন সেটাই আমার যথেষ্ঠ লেগেছে। তবে নাম পরিচয় নিয়ে শুরুতে একটা পরিচিতি দেয়া যেত (জাপানিজ উপন্যাসে বোঝার সুবিধার্থে যেমন নাম, পরিচয় ইত্যাদি দেয়া থাকে তেমন)।
* রিয়া কটেজের নিজের মন্দ কাজ ঢাকতে যেমন বর্ণনা দিয়েছিল মনসুর মানে ভেবে নিয়েছিল সেগুলো খোঁড়া যুক্তি লেগেছে। এটা ফ্যান্টাসি না হয়ে থ্রিলার গোয়েন্দা জাতীয় হলে তুখোড় গোয়েন্দা কপ করে ধরে ফেলত।
বইটার সাথে ভালো আর কিছুটা মন্দ মিলে সময়টা আদতে ভালো কেটেছে। টুকরো কিছু আক্ষেপ বাদ দিলে এই উপন্যাসটি বাংলা মৌলিক ফ্যান্টাসি ঘরনায় বেশ উপভোগ্য।
❛এমন জগতে কি আপনি যেতে চাইবেন যেখানে ঘুম নেই, নেই টিনের চালে বৃষ্টির সেতার? অথবা যেখানে গাছ হেঁটে বেড়ায়। শব্দ করলে ঘুমে ব্যাঘাত হয় বলে আক্রমণ চালিয়ে দেয়। যে মায়াময় গাছের ছায়ায় আমরা অন্তর জুড়াই মহাবিশ্বের কোনো এক গ্রহে সে প্রাণী খেদিয়ে বেড়ায়! আচ্ছা কে প্রকৃত ঈশ্বর? ভাবতে ভাবতে কাল পেরিয়ে যাবে।❜
যেসব বই আমি সচরাচর পড়ি তা খুব বেশি একটা সময় নিয়ে পড়ি না। একবার মজা পেয়ে ফ্লো তে ঢুকে গেলে আমি খুব বেশি একটা সময় নেইনা। যাইহোক বইটা যখন আমি শুরু করেছিলাম তখন আমি হসপিটালাইজড ছিলাম তখন এমন কিছু চাচ্ছিলাম যেইটা একটু ইউনিক হবে নতুনত্ব থাকবে। রোজার শেষদিকে একটা ফেসবুক পেজে অর্ডার করেছিলাম প্রচ্ছদটা দেখে বেশ আকর্ষণীয় লাগায়। পরে যখন পড়া শুরু করি তখন প্রথম প্রথম একটা কেমন অদ্ভুত একঘেয়েমি লাগছিল। অনেক কিছু ঠিক মতো ধরতে পারছিলাম না। মায়াল-থোমন, এইবন-সেইবন বুঝেছিলাম তবে কারেক্টারদের নাম গুলো কাছাকাছি হওয়ায় একটা কনফিউশন লাগছিল। বই প্রকাশনী পারতো কয়েকটা ক্রিয়েচার আর ক্যারেক্টারের ছবি দিতে। যাইহোক প্রথমে আমার একটু বোরিং টাইপ লাগছিলো কয়েক অধ্যায় পড়ার পর মনে হয়েছে রেখে দেই আর পড়বো না। কারণ ভীষণ গোজামিল আর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিলো সব। গুলিয়ে যাচ্ছিলো কিছু বুঝছিলাম না। কিন্তু আমার একটা নীতি আছে যেইটা সবসময় ফলো করি তা হলো একবার যা শুরু করি যত অখাদ্যই হোক শেষ করেই উঠতে হবে। আর সত্যি বলতে অর্ধেক পড়ার পর ডট কানেক্ট করে সব প্রপারলি বুঝে যখন পড়া শুরু করি তখন আর থামিনাই যখনই সময় পেয়েছি তখনই বই নিয়ে বসেছি। বাংলা লিটারেচারে ফ্যান্টাসি নিতান্তই কম আর মৃগয়া এর মধ্যে অনন্য সংযোজন। লিখার মান যথেষ্ট ভালো যা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এই সময়ের থেকে একটু আগানো, আমার এইটা অনেক ভালো লেগেছে আর মনে দাগ কেটেছে। কোয়ালিটি অনেক অ্যাডভান্সড তবে একটা কিন্তু যে রয়েই যাচ্ছে। সেই কিন্তু টা হলো কিছু কিছু চ্যাপ্টার এ কিছু অযাচিত সেক্সচুয়ালিটির অনুপ্রবেশ। আমার মতে রিয়া কটেজের মনসুর আর রাফায়েত এর কর্মকাণ্ড গুলো ওরকম ভাবে না তুললেও পারতেন। যেই সেক্সচুয়ালিটি গুলোকে প্রসঙ্গের ভিতর টেনে আনা হয়েছে সেইগুলা না আনলে বইটা পেত সর্বজনীনতা। এইসবের কারণে একটা ট্যাবু ক্রিয়েট হয়েছে যা একটা সার্টেন এইজের পরে পড়া উচিত। না হলে বাচ্চা বুড়া সবার জন্য উপযোগী ছিলো। পরিশেষে তাও লেখক ধন্যবাদ প্রাপ্য কারণ তার লেখনী ছিলো স্বতন্ত্র আর মৌলিক। কারো অনুকরণ বা কারো ছায়ায় থেকে লিখা হয়নি। ধন্যবাদ সুন্দর একটা বই পাঠক সমাজকে উপহার দেয়ায়। ভালো বাসা রইল সায়রা আর আজিজের জন্য আর স্যালুট ছোট্ট পৃর জন্য। আমার এখন দরকার একটা সমুদ্রস্নান।
সৃষ্টির শুরুতে স্রষ্টা তৈয়ার করলেন এক জোড়া মানব-মানবী। স্বর্গের সবকিছুর উপরে তাদের অবাধ অধিকার দেয়া হলেও একটা বিষয়ে তাদের উপর ছিল নিষেধাজ্ঞা । কখনোই তারা গন্ধম বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করতে পারবেন না । কিন্তু মানবী ঠিকই স্রষ্টার এই আদেশ অমান্য করে গন্ধম বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করলেন। স্রষ্টার অবাধ্য হওয়ায় শাস্তি হিসেবে স্বর্গ থেকে তাদের বিতারিত করে পাঠানো হলো অবনীতে।
মায়াং। চারপাশে রাইবন দিয়ে ঘেরা অনিন্দ্য সুন্দর যে জায়গা। অসীম এক বিস্তৃত অবনী জুড়ে জায়গাটা ঠিক কোথায় স্বয়ং মায়াংবাসীরও জানা নেই কারোর। পুরোটাই জল। জলে টইটম্বুর। এবং তা অদৃশ্য। ছোঁয়া যায়, ভেতর গলে হাঁটা যায় ছপছপ শব্দ তুলে দারুণ । পায়ের তলায় মাড়ানো কোমল ঘাসের ডগা, বৃক্ষের সবুজ নরম পাতা, মাথার উপর ঈষৎ নীলচে টলটলে জলময় আসমান। এত রঙিন সব। এত মায়ামাখা।
মায়াং এর সর্বময় কর্তৃত্ব যার হাতে তিনি হলেন নদীশ্বরী। মায়াং এর প্রতিটি বৃক্ষ তার হাতের তৈয়ার। তিনি জল মা। তিনিই নির্ঝরিণী। শুধু বৃক্ষ নয়, মায়াং এর প্রতিটি প্রাণ- মায়াল, কালখাটুস, ঔশ্যাল,সিয়াস,টৌশান,খৌম,প্রাইফেডসহ সকল সৃষ্টি তার হাতে তৈয়ার। একের অধিক সন্তান থাকলে মা যেমন সকল সন্তানকে সমানভাবে ভালোবাসতে পারেন না , কোনো সন্তানের প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়। তেমনি নদীশ্বরীও এই পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। নিজের সর্বশেষ সৃষ্টি মৃগ এর প্রতি তার মনে রয়েছে এক কোমল স্থান।
মায়াং এর সবচেয়ে শুদ্ধতম প্রানী তিন পা বিশিষ্ট মৃগ। নদীশ্বরীর বড়ই আদরের। নরম,লাজুক,সংবেদনশীল খুব। মায়াং এর অন্যান্য প্রাণীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য নদীশ্বরী মৃগকে দিয়েছেন প্রায় অদৃশ্য থাকার ক্ষমতা। পেটের মাঝখানে দিয়েছেন নাইকুন্ডল। যা ছুলে যন্ত্রনাহীন ইচ্ছামৃত্যু। মায়াং এর অন্যান্যদের উপর আরোপ করেছেন মৃগ হত্যার নিষেধাজ্ঞা।
মায়াং এর সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গা হলো ইথেমপেলি। সমগ্র মায়াং এ বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ জল সরবরাহ যে এখান থেকেই সরবরাহ হয়। তবে এর থেকেও শক্তিশালী জায়গা মায়াং এ আছে বোধহয়। তা হলো ভিলবন। মায়াং এর সবারই আছে একটা করে ভিল। কড়া নীল রঙা ভীষণ হালকা কোমল একখানা তন্তু। ভিল বৃক্ষের শিকড় ছিড়ে তন্তুখানা ছুলেই সম্ভাব্য মৃত্যু ভেসে উঠে চোখের সামনে। তখন একটি বৃক্ষের প্রাণের বিনিময়ে নিজের প্রাণ বাঁচানো যায়।
তবুও মায়াং এর কেউই চায়নি ভিল বৃক্ষের প্রাণের বিনিময়ে নিজের প্রাণ বাচাতে। মায়ালরা বাদে। ভিলবনের পাশাপাশি ইথেমপেলিও তাদের দখলে। মায়াং এ তাই সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রাণী তারাই।এই মায়াং দের মধ্যেই একজন একদিন করে ফেললেন গর্হিত এক কাজ। নদীশ্বরীর আদরের তৈয়ার মৃগ হত্যা করে। মায়াং রা তার নাম দিলেন মৃগয়া।
সমাজে একজন পুরুষের অনাকর্ষণীয় হিসেবে বিবেচনা করার যেসকল বৈশিষ্ট্য রয়েছে তার সবই আজিজ সাহেবের মধ্যে বিদ্যমান। কালো, পেটমোটা, মধ্যবয়সী এবং নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা এই ব্যক্তি কীভাবে যেন বাগিয়ে ফেলেছেন সুন্দরী এক বউ। বাইরে বেরোলে দুজনকে দেখে মানুষ আড়চোখে তাকিয়ে ফিসফাস করলেও আজিজ সাহেবের স্ত্রী সায়রা বানুর তা নিয়ে মাথা ঘামাতে বয়েই গিয়েছে। সায়রাকে ভীষন ভালোবাসেন আজিজ সাহেব। নামের পিছনে আদর করে বানু ডাকেন তিনি নিজেই। রাতে আরশি ব্রীজের নীচের জলে দাওদাও করে জ্বলা আগুন দেখতে সায়রার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবার সময়ে আজিজ সাহেবের নিজেকে এই দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়।
তবে পাষাণ এই দুনিয়াতে সুখ কোনোদিনই চিরস্থায়ী হয় না। আজিজ সাহেব বিয়ের কিছুদুন পরে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন সায়রা কখনোই ঘুমায় না । বিয়ের পর তাকে দু চোখের পাতা এক করতে দেখেননি তিনি। এতে অবশ্য সায়রার প্রতি আজিজ সাহেবের ভালোবাসার টান পড়েনি। নব দম্পতির বিয়ের পর কিছুদিন না ঘুমানোই তো স্বাভাবিক। তবে আজিজ সাহেব আর সায়রার ভালোবাসার নদীর স্রোতে একদিন ভাটা আসলো। যেদিন আপেল কাটতে গিয়ে সায়রা হাতের আংগুল কেটে ফেললো। আর আজিজ সাহেব অবাক বিষ্ময়ে দেখলেন সায়রার হাতের কাটা অংশ দিয়ে লাল রঙা রক্ত নয়, বরং বের হচ্ছে স্বচ্ছ জল।
তখন ২০২৩ সাল। এক রাতে ফেসবুকে অযথা স্ক্রল করতে করতে সাখাওয়াত হোসেন এর একটা ছোট গল্প সামনে আসে। গল্পের নাম ছিল অবনীল। পড়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে ঐ রাতে উনার প্রোফাইলে গিয়ে একটানা একের পর এক গল্প পড়ে যাচ্ছিলাম। সকালে জানালা দিয়ে সুয্যি মামার উঁকি দেয়া দেখে পরে গল্প পড়া ক্ষান্ত দিই। এত প্রতিভাবান লেখকের প্রকাশিত কোনো বই নেই দেখে সেদিন যারপরনাই আশ্চর্য হয়েছিলাম ৷ অবশ্য কিছুদিন পরেই ঘোষণা দেন ২০২৩ বইমেলায় তার বই প্রকাশিত হচ্ছে ,বইয়ের নাম মৃগয়া। এরপর থেকেই বইটি কিনব কিনব করছিলাম। কিনতে সাহস পাচ্ছিলাম না কারণ বইয়ের দাম। গত মাসে মনে হলো ধুর, বাঁচবই বা কয়দিন। শখ আহ্লাদ পূরণ করে নিই। তাই পকেট ফাঁকা করে নিয়েই নিলাম শখের মৃগয়া।
সাখাওয়াত হোসেনের লিখনীর সাথে আগে থেকেই পরিচিতি ছিল। ছোট ছোট বাক্যে লেখা উনার লিখনীর ধরণ আমার বেশ পছন্দে্র। আমার মত যাদের একপাতা বই পড়তে নিলেই মোবাইল হাতে নেবার জন্য মন আকুলি বিকুলি করে তাদের জন্য বইটি পারফেক্ট। একপাতা দুপাতা করে পড়তে পড়তে কখন যে লেখকের লিখনীর জালে ফেসে যাবেন টেরও পাবেন না ।
আজিজ আর সায়রার গল্পের পাশাপাশি সমান্তরালে এগিয়ে যাওয়া মায়াং এর গল্প ছিল বেশ আকর্ষনীয়। মায়াং এর বর্ণনায় লেখকের কল্পনাশক্তি এবং সৃজনশীলতার প্রশংসা করতেই হ���়। সমান্তরালে এগিয়ে যাওয়া দুটো গল্প যেভাবে লেখক শেষে একসাথে মিলিয়েছেন তা ছিল একেবারে পারফেক্ট। গল্পের এন্ডিং নিয়েও কোনো অভিযোগ নেই।
যা নিয়ে অভিযোগ আছে তা হলো গল্পের গতি। সচরাচর থ্রিলার বই বেশি পড়া হয় বলেই গতিশীল গল্প আমার বেশ পছন্দ। ফ্যান্টাসির ক্ষেত্রে আবার তা উল্টো। রয়েসয়ে ধীরে ধীরে ফ্যান্টাসি চিবুতেই পছন্দ আমার। মৃগয়ার শুরুরটা দারুণ গতিশীল। পুরো গল্পেই লেখক সেই গতির ধারা বজায় রেখেছেন। কেন রে ভাই? আরেকটু সময় নিয়ে আরো ধীরে সুস্থে বিশাল কলবরে লিখলে কী হত? ৩০০ পৃষ্ঠার ক্রাউন সাইজের এই বইয়ের বদলে তখন এক এপিক ফ্যান্টাসি উপহার পেতাম। এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল দেখ আফসোস রয়েছে তাই বৈকি ।
আরেকটা আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে বইটার দাম। আমরা প্রায় সবাই হয়তো বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যার সাথে মুদ্রিত মূল্যের তুলনা করি। ক্রাউন সাইজের ৩০০ পৃষ্ঠার এই বইটি তাই ৫০০ টাকা দিয়ে কিনতে অনেকেরই বাঁধবে । আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে বইয়ের দাম আরেকটু কম রাখলে ভালো হত। তাহলে আরো বেশি মানুষ বইটি পড়তে আগ্রহ বোধ করতেন। এত চমৎকার একটি বই পড়তে তাই দামের জন্য অনেকেই কিনতে পিছিয়ে যাবেন।
বইয়ের আরেকটি সমালোচনার বিষয়বস্তু হলো স্ন্যক্স এর বর্ণনা ( এই স্ন্যাক্স মানে খাবার না! ) । গল্পের বর্ণনায় আমি মনে করি তার দরকার ছিল। লেখকের সেই স্বাধীনতা রয়েছে। তবে সর্বস্তরের পাঠকের কথা চিন্তা করে হালকার উপর ঝাপসা বর্ণনা মেরে দিলেই এত কথা উঠত না।
আপনি যদি তাই রাজার সন্তান হোন এবং খোলামেলা স্ন্যাক্স এর বর্ণনায় আপনার আপত্তি না থাকে তাহলে শীগ্রই চমৎকার এই বইটি পড়ে ফেলতে পারেন। লেখকের পরবর্তী বই সূবর্ণ-রাধিকা পড়বার অপেক্ষায় রইলাম।
[ কি-বোর্ডে ঝামেলার কারনে কিছু বানান ভুুল চোখে পড়লেও ঠিক করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ]
অন্তর্জালে পোষ্ট করা সাখাওয়াত হোসেনের ছোটগল্প এবং তার প্রথম ছোটগল্প-গ্রন্থ "সুবর্ণ রাধিকা" পড়ার সুবাদে তার লেখার স্ট্যাইল সম্পর্কে বেশ ভালো ধারনাই আছে। আড়ষ্ঠতা নেই; ফলতঃ লেখা যেমন মেইড-আপ না, স্বতঃস্ফূর্ত - তেমনি পড়তে গেলেও যে প্রাসাদগুণে ভূষিত করা যায় সেটাকে এক শব্দে ধরতে গেলে বলা লাগে - প্রাঞ্জল।
"মৃগয়া” তার লেখা প্রথম বই। যে কোন লেখকেরই প্রথম বইয়ের ক্ষেত্রে একটা বাঁধা হয়তো পাঠকের ফেস করতে হতে পারে - যেটা হচ্ছে ভাষা। দেখা যায় শুরুর দিকে একধরনের আড়ষ্টতা বা কৃত্রিমতা থাকে। "মৃগয়া"র বেলা সেটা হয়েছে কি? এর উত্তর অনেকটা হ্যাঁ এবং একি সাথে না। মায়াং অংশের প্রারম্ভে সেই আড়ষ্টতার শুরু। তবে বেশ অনেকটা যাবার পরে সেটা মাটির সাথে মিশে গল্পের মতোই দ্রুত ঘাস গজানোর মতো করে সেই সাখাওয়াত হোসেনের লেখার সাবলীলতায় সবুজ হয় উঠেছে। এটা মূলত লেখার ভিন্নতা নয়, বরং মায়াং এর চরিত্রগুলোর অদভুত নামগুলোর এবং সম্পর্কগুলোর সাথে খাপ খাওয়াতে যেয়েই একধরনের স্লো-ভাব চলে এসেছে পাঠকালে।
"মৃগয়া" নিয়ে বহু আলোচনাই আছে গুডরিডস এবং অন্তর্জালে। তাই সেই সব পুরানো কথার রিপিটেশনে যাবো না। কোন মিথলজির হালকা নড, বা সৃষ্টি ও স্রষ্ঠার সম্পর্কিত আলোচনাগুলোও সাইড কাটিয়ে গেলাম। কিছু নির্দিষ্ট কথায় আমার আলাপটুকু সীমিত রাখি।
ভালোলাগা খুব আপেক্ষিক একটা বিষয়। কেউ চাইলে যে কোন জনরাতে বুঁদ থাকতে পারেন। চাইলে বাতিলের খাতায়ও ফেলতে পারেন। উপভোগ্য যে কেনা কিছুই আমার কাছে সমাদৃত। হোক সেই জনরা আমার অপছন্দের। ফ্যান্টাসি ঘরনার লেখা আমার প্রিয় না অবশ্যই। তথাপি "মৃগয়া" আমার কাছে দারুন লেগেছে। পুরো গল্পের প্লট, তার সমাপ্তি সব কিছু মিলিয়েই দুর্দান্ত একটা সময় পার করলাম বলাই যায়।
মৃগয়ার কাহিনিতে যেটুকু নির্মমতা বা সহিংসতা দেখানো হয়েছে, তার মধ্যে শুকনো নির্দয়তা নেই। সেটা নিশ্চই লেখকের কারনে। শুকনো নির্দয়তা বা গা-গুলানো সহিংসতা নেই বলেই নতুন নির্ভিক রোমাঞ্চে নিজস্ব কৌতুহুলটুকু গনগন করতে থাকে। লেখকের বা মৃগয়াতে সবচেয়ে দারুন কাজটকু হচ্ছে "পৃথিবী" নামক জায়গাটা বা বইয়ের কাহিনিতে নরক যেটা - সেই নরকের স্বরূপ প্রকাশের জন্যে লেখক আলাদা কোন বর্ণনার প্রয়োজন বোধ করেননি। "পৃ" এর প্রথম পদার্পাণ নরকে এবং "গাছ কর্তনের" যে দৃশ্যকল্প - সেটুকুই যথেষ্ঠ ছিল নরকের বা নরকে থাকা এনটিটিগুলোর স্বরুপ খুব সহজেই উন্মোচনের বা প্রকাশের। আদতে, নরকের স্বরূপ প্রকাশের জন্যে বাড়তি কোন শব্দের দরকার নেই এবং লেখক অযথা শব্দের রং বেয়ে সেই চিত্রের শরীর স্পর্শ করারও চেষ্টা করেননি।
তবে এখানে এটা বলে রাখি (একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত) লেখক দুটো জায়গায় কিছু বাড়তি কথা বলেছেন। বলাটায় সমস্যা নেই, তবে না বললে পাঠক অন্ধকারে আরও বেশিক্ষন থাকতো। অন্ধকার না হোক নীলাভ আলোর রহস্যে থাকতো। নদীশ্বরী যখন শাপ দিলো "পৃ" কে - ঠিক তখনই চলে এলো Aldous huxley. ঠিক এখানে এসেই কাহিনির অধিকাংশ পরিষ্কার হয়ে যায়। উক্তিটা বইয়ের শেষেই অর্ন্তভূক্ত করলে দারুন হতো। যাই হোক- তবে সেই কাহিনির ফ্লোতেই তার এক্সিকিউশন এবং ডিসইল্যুশনমেন্ট-টা লেখকের কৃতিত্ব বা তার কলমের। কথা একই।
Aldous huxley এর পরে আমি ভেবছিলাম, "ফিলিস" আর "ডেমফন" বা "আমোল্ড ফুল" এর গল্পটাও লেখক ভুল যায়গায় বলেছেন। ভেবেছিলাম বলেছি। ভেবেছিলাম, এই "ফিলিস" এবং "ডেমফন" বোধহয় শেষে এসে আজিজ ও সায়ারা হয়ে উঠবে। ভাবার কারনও আছে। লেখকের বিবিধ গল্প পড়ে মনে হয়েছে লেখক এই ধরনের একটা বিষন্ন সমাপ্তিতে পাঠককে সিক্ত করবেন। যদিও সেটা না। তবে শেষ করে মনে হয়েছে সেটা হলেও পাঠক সাদরেই গ্রহন করত। তবে "আমোল্ড ফুল" না ঝরুক - লেখক ঠিকই জায়গামত এসে "পৃথি" ফুল ঝরিয়ে পাঠকের সামনে রেখেছেন। আজিজ এবং সায়রা বাণুকে আমাদের জন্যে "এন্টিডোট" করেই রেখে দিয়েছেন সমাপ্তিতে।
মায়াং এবং নরক (পৃথিবী) দুই জায়গায় গল্প সমান্তরালে এগিয়েছে। প্রথমেই নরককে লেখকে নিজের শব্দের বাড়তি খরচে চিত্রিত না করে মানুষের (পাঠকের) চিন্তা ও যাপন থেকে অপসৃত না করে তাদের চেনা-জানা অনুভূতির উপরই ছেড়ে দিয়েছেন। একথা শুরুতেই বলেছি। তবে মায়াংকে আলাদা একটা জগৎ হিসাবে তুলে ধরলেও মূলত সেটা আমাদের চিন্তা ও যাপন থেকে অপসৃত হয়নি। অথবা লেখক সেই চেষ্টাই করেননি, বরং "পৃথিবীর" একটা অল্টার-ইমেজ তৈরী করে জলছাপে খুব স্পষ্টভাবেই আমরা আমাদের এই চেনা-জানা পৃথিবীর আদল দিতে পারি। সেটা সামাজিকভাবে হোক, ধর্মীয় এঙ্গেল বা রাজনৈতিকভাবে - টোনটা চাইলে পাঠক ঠিকঠাক বসিয়ে নিতে পারেন। যেমন "মৃগয়া" বা "ভ্রম"-টাকে চাইলেই আপনি ধর্ম-ব্যবসা বা অন্য-অর্থে নিতে পারেন। ঠিক এখানে এসে aldous huxley এর উক্তিটা বরং নরকের থেকে মায়াং-এর আবহে এসে খাপ খায় বেশি। সেই মূল কথা যেটা এক্সিসটেনশিয়াল ক্রাইসিস এন্ড কোর্শেনিং এবং সেন্স অফ ডিসইল্যুশনমেন্ট।
বৈচিত্রহীনতা বা একমাত্রিকতা সাখাওয়াত হোসেনের "মৃগয়া" না, বরং কাহিনির বৈচিত্রর সাথে সাথে গল্পের গরুর আকাশে উড্ডয়ন করলেও বেশ কিছু বিষয়ে সচেতনার কথা তো আছেই। বৃক্ষ তার মধ্যে অন্যতম। এই ধরনের গল্পে উত্তম আর অধমের ক্রাইসিস এবং এই দুয়ের "পরিপ্রেক্ষিত" তো চিরায়ত; একটা ভ্রম - যার সৃষ্টি অন্তর্গত চেতনার ভগ্ন-দশা থেকে। সেই ভ্রমও মায়াং-এ আমরা দেখি কাহিনি জুড়ে। পরিপ্রেক্ষিত শব্দটা কোটেশন-মার্কের মধ্যে বন্দি করে দিলাম; প্রেক্ষিত বললাম না। দুয়ের মধ্যে হালকা একটা পার্থক্য তা আছেই। যেমন থাকে পাঠ ও ভাবনার মাঝে।
তবে শেষটায় প্রবীণ বা নৃপিয়াসের হাসি কিছুটা ভাবনায় ফেলে বৈকি। অনেক কিছই collateral damage হিসাবে ভাবনার অবকাশ থাকে। নিজের সন্তানকে বাঁচাতে যেমন পৃথি এবং পৃয়ুশর কমতি নেই, ঠিক তেমনি প্রবীণও তার সন্তানকে রক্ষায় যেকোন সীমানা পার করে যায়। তাই পাঠকের জন্যে বা যে কারও জন্যেই "ভালো" এবং "মন্দ" অথবা "ঠিক" বা "বেঠিক" নির্ধারণ করা নিজস্ব চেতনা ও নীতিবোধের অতি সূক্ষ্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। নিক্তির পরিমাপে কোন পক্ষ নেবার কুইক প্রবণতা একমাত্রিকতা হয়ে ওঠে - যদিও খুব সহজ নয়। শুধু গল্প বলেই হয়তো আমাদের পক্ষপাতিত্ব পৃয়ুশ, পৃথি, পৃ এর দিকে থাকে।
এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। আমি বরাবরই বলেছি, যেকানে সবার বাসায়ই হুমায়ূন আহমেদের বই কম বা বেশি আছে, তাই পড়ার ইচ্ছে হলে আমি সেটাই পড়তে পারি। একটুকরো হুমায়ূন পড়তে চাই না। আজিজ এবং সায়রার বেশ কিছু কথোপকথনে হুমায়ূনের ভূত এসে ভর করেছে। আবার পুলিশি তদন্তে অফিসারের আচরনও সেই ভূত জেঁকে বসেছে। বানান ভুল সেভাবে নেই। যতটুকু আছে তা পড়ার আনন্দ মাটি করবে না। যেমন একই প্যারায় "মায়াতির" এবং "মায়াতীর" এবং আবার "মায়াতির" অ/স্ত্র - আলাদা আলাদা শক্তি বহন করেনা নিশ্চিত; বরং হালকা দুর্বল হয়ে পড়ে। হালকা কিছু "প্রশ্নবোধক" ভাবনা ছিল, বা খুব হালকা ভুল। যদিও সেটাও কোনভাবেই গল্পে ইফেক্ট ফেলবে না।
যেমন একদম শুরুতেই মুনাতাসির সাহেব এবং তার স্ত্রী বাসায় যাবার পথে এক্সিডেন্টে একজন পা ও অন্যজন কোমর ভাঙে। পরবর্তী সপ্তাহেই সায়রার দাওয়াত দেয়া এবং স্বপরিবারে দাওয়াত খেয়ে যাওয়া - লেখকের অন্যমনস্কতা নাকি - পাঠক হিসাবে আমার প্রশ্ন থাকছে। আবার পৃয়ুশের মতো গুরুত্বপূর্ন চরিত্রর খুব ভালা করেই জানা যে মায়াং এ কেউ মা/রা গেলেই তাদের শরীর সাথে সাথেই ভূমি গিলে খায় বা ঘাস দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে যায়। তাই একটা র/ক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে পৃয়ুশ যখন কৃতিন ও কৃপিয়ানের মৃ/ত্যুর সংবাদে পৃয়ুশ প্রশ্ন করে "ওদের দেহ?" - এই দুটো শব্দও কিছুটা প্রশ্নের জন্ম দেয়। যদিও উপরেই বলেছি খুব গুরুত্বপূর্ন কিছু না।
"ফ্যান্টাসি" বলেই কি বা শুধু বইয়ের পাতার নিছক গল্প বলেই কি একটা কাহিনি অনেকটা রঙিন হয়ে ওঠে? প্র্রানবন্ত হয়ে ওঠে? চেনা-জানা ছকের আদলে অদেখা ভূবন, আধো-চেনা অচেনা মুখ বা চরিত্র, চিরচেনা মৃ/ত্যুও যেন হয়ে ওঠে রঙিন। উপভোগ্য। কার বাইরেও কিছু হিসেব থাকে। ভাবনার ডায়নামোতে বিন্দু বিন্দু প্রশ্ন জমতে থাকে। তাই -
"মৃগয়া" ফ্যান্টাসি ঘরনার লেখা। পাঠক কিভাবে পড়বেন, ভাববেন তার নিজের ব্যাপার। মূল কথা, লেখক যে কাহিনি উপহার দিয়েছেন পাঠকের নির্মল আনন্দের জন্য - তা পাঠক ষোল আনাই পাবে আশা করা যায়। তবে গল্প থেকে ভাবনার উপাদানগুলোকে আলাদা করে নিলে হয়তো পাঠকের এবং লেখকের মাঝের স্পেসটুকু জুড়ে থাকবে নিছক বিনোদন। সেটাও নিতে পারেন। তাতে হয়ত ক্ষতি নেই, তবে ভিন্ন-ভিন্ন ভাবনায় সেটাকে অন্য-স্তরে নিয়ে যাবার লক্ষ্যটুকু বিফলে যাবে। রূপকথাটুকু তার বিনোদরে রূপ নিয়েই থাকবে - অন্তর্গত চুপকথাটুকু মায়ালদের মৃ/ত্যুর মতোন ঘাসের নিচে চাপা পড়ে থাকবে।
"মৃগয়া" দারুন উপভোগ্য সন্দেহ নেই। সাখাওয়াত হোসেনের গল্পবলার ভঙ্গি এবং পাঠককে পাতায় ধরে রাখার সক্ষমতাও প্রশ্নবিদ্ধ না, বরং প্রমানিত। তবে শেষটায় "পৃ" ওরফে সায়রা বানু যখন মায়াং এ ফেরৎ আসে এবং পা রাখে মায়াং এর মাটিতে - ঠিক সেখান থেকে "পৃ" কি অনেকটা ওয়ান্ডার ওম্যান বা সুপার-ওম্যান এর ছায়ার মধ্যে রয়ে গেল কিনা বাকিটা সময়জুড়ে সেটা একটা জিজ্ঞাসা হয়ে থাকল। লেখক এখান থেকে আরও ভিন্ন কিছু ভাবার এবং উপস্থাপণের প্রচেষ্টা "মৃগয়া"কে অন্য মাত্রা দিত বৈকি।
প্রেজেন্টেড মাত্রায়ও বইটা সব বয়সী পাঠকের (বাচ্চারা বাদে) সময়-্উপভোগের সহায়ক হয়ে উঠবে।
৩.৫ তারা আমি লেখকের ফেসবুকে প্রকাশিত সব ছোট গল্প মোটামোটি পড়েছি।ওই গল্পগুলো যেমন শেষ হলে একটা ইমপ্রেশন রেখে যেতো সেভাবে মৃগয়া পারে নাই।একটু হতাস হলাম।হয়তো আশা বেশি ছিলো দেখে। সুবর্ণ রাধিকা পড়বো এবার ।ওটা তো আবার গল্প গ্রন্থ হয়তো ওটা ভালো লাগবে অনেক
প্রথমত, লেখককে ধন্যবাদ এমন করে একটা দুনিয়া ভাবার জন্য। এটা বেশ কঠিন, একটা সম্পূর্ণ জগত কে এভাবে ভাবা, এতে বসবাসকারী বাসিন্দাদের অবয়ব থেকে শুরু করে এতে যে সকল প্রানী আছে এবং তার সাথে তাদের জগত পরিচালনাকারী কে নিয়ে ভাবা। তার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
দ্বিতীয়ত যেটা বলার বিষয় তা হলো, গল্পের পটেনশিয়াল। এভাবে স্রষ্টা আর সৃষ্টি নিয়ে একটা গল্প ফাঁদা নেহাতই সহজ নয়। সুতরাং এইটাও বইয়ের একটা স্ট্রং সাইড।
এবার আসি খারাপ বিষয় গুলো নিয়ে।
প্রথম এবং সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা আমার কাছে মনে হয়েছে তা হলো ভাষা। ভাষা মোটেও সাবলীল নয়। শুধু মাত্র গল্পের ভাষাটা সাবলীল হলেই আরও চমৎকার হতো। এতেই গল্পের আকর্ষনীয়তা হারিয়েছে।
আর আরেকটা সাইড প্রবলেম যে টা আমার কাছে মনে হয়েছে তা হলো, যেহেতু নতুন জগত নিয়ে কথা হচ্ছে আর যেহেতু অনেক প্রানী, ক্যারেক্টার, সাথে তাদের অনেক অস্ত্র এবং তাদের নামগুলোও বেশ কাছাকাছি, তাই বইয়ের শেষে একটা টীকা রাখা খুবই জরুরী বলে মনে করি।