তারা একে অন্যকে ভালোবেসেছিল। তারা দুই সাধারণ মানুষ-মানুষী। এক পুজোমণ্ডপের উজ্জ্বল আলোয় মানুষীটি তার উজ্জ্বলতর চোখ তুলে বলেছিল, ‘ভালোবাসি’। তারপর জীবন এসে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের মাঝখানে। গড়ে তুলল দুস্তর দেওয়াল। সে দেওয়াল পেরোতে অনেক উচ্চতায় উঠতে হয়েছিল তাদের। ভালোবাসার অনন্য জাদুডানায় ভর করে দুস্তর বাধা পেরিয়ে অ্যাচিভমেন্টের সুদূর আকাশে তাদের একে অন্যের কাছে ফিরে আসবারই কাহিনি ‘ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা’
বই - ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা লেখক - দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য প্রকাশনা - পত্রভারতী মুদ্রিত মূল্য - ২৯৫/-
কলকাতার বেলগাছিয়া অঞ্চলে বড় হওয়া দেবব্রত বা দেবু অনেক পড়াশোনা করেও নিজের পছন্দের বিষয়ে রিসার্চ করতে না পেরে বেকার, একমাত্র দাদা ও বৌদির উপার্জনেই চলছে তার ও তার একরত্তি বিধবা মায়ের জীবন। এমন সময় হঠাৎ করেই সে পেয়ে যায় স্কুলে পড়ানোর সুযোগ, সেটাও আবার এক গ্রামে যার নাম ঈশ্বরপুর। অনেক কষ্টে পাওয়া চাকরি শুধুমাত্র গ্রামে থাকতে হবে বলে ছেড়ে দিতে চায়নি দেবু। আর তাই ঈশ্বরপুরও সময়ের সাথে সাথে তাকে জড়িয়ে বেঁধেছিল নিজের করে। অন্যদিকে বিবি, যে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসে দেবুকে কিন্তু তার নিজের স্বপ্নকে সে জলাঞ্জলি দিতে চায় না। সে চায় দেবু গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে আসুক। ভালোবাসা, জীবন, স্বপ্ন, লড়াই, পরিবার এই সবকিছুর টানাপোড়েনের সাক্ষী হয়ে থাকে ঈশ্বরপুর।
প্রেমের উপন্যাস থেকে শত হস্ত দূরে থাকা আমি এই বইটা যক্ষের মত আগলে রেখেছি। কারণ এটাকে শুধুই প্রেমের উপন্যাস বললে বলা হয়না অনেক কিছুই। প্রত্যেকটা চরিত্র বড় বেশি জীবন্ত ও বাস্তবিক। প্রকৃতির বর্ণনা বা ঈশ্বরপুরের মায়া যেভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন তাতে বেশ কিছু জায়গায় মনে হয়েছে আমি নিজেই ঈশ্বরপুরে পৌঁছে গিয়েছি। কোনো চরিত্রের উপরে এতটুকুও অভিমান হয় না কারণ তারা প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গায় ঠিক। বাস্তবিক এই যে একটা লড়াই, কারুর স্বপ্নের জন্য, কারুর নিজের বিবেকের জন্য আবার কারুর শুধুমাত্র কিছু নিরীহ মানুষের জন্য এই লড়াইগুলো প্রত্যেকটা ভীষণ চেনা। আমরা আশে পাশেই এমন অনেক লড়াই রোজ দেখি, শুধু শব্দ দিয়ে প্রকাশ হয়তো সবাই করে উঠতে পারিনা। আরো একটা জিনিস যেটা এই বইকে ভীষণ কাছের করে তোলে তা হল, এর সরলতা। সরলতা জিনিসটা এতটাই হারিয়ে গেছে জটিল জট বাঁধানো প্লটের ভেতরে যে এখন সেই সরল বাস্তব প্রকৃতিঘেরা লেখা দেখলে মনটা ভালো হয়ে যায়। ওই অনেকটা প্রচুর হাই রাইজ বিল্ডিংয়ের মাঝে একটুকরো কুঁড়েঘর দেখবার মতো।
একটা চরিত্রের কথা আলাদা করে না বললেই নয়। দেবুর বৌদি, যে বৌদি একসময় বেকার হওয়ার কারণে দেওরকে যা নয় তাই বলেছে। সেই বৌদিই যখন দেখল তার দেওর চিরদিনের জন্য গ্রামের পথে পা বাড়ালো তখন তার নিজের বিবেক কিভাবে তাকে কুড়ে কুড়ে খেলো এটা লেখক যেভাবে ব্যক্ত করেছেন, তা বেশ কিছুক্ষণ ভাবিয়েছে আমায়। আদতেই মানুষ কিন্তু এরকমই। আমরা অজস্র জিনিস করি, এবং পরমুহূর্তেই সেটা নিয়ে রিগ্রেট করি, কিন্তু করার সময় অতকিছু ভাবিনা। আমার মাও এরকম বলতেন, যে তিনি যখন রেগেমেগে কিছু বলছেন সেটা কিন্তু অত ভেবে বলছেন না, অথচ কথাটা হয়তো কাউকে সারাজীবনের জন্য দুঃখ দিয়ে যাচ্ছে এবং পরে সেটা নিয়ে মাও অপরাধবোধে ভুগছেন। এই যে ঘরের ভেতরের মানুষগুলোকে চরিত্র হিসেবে এত সহজ সরল ভাবে লিখে দিয়েছেন লেখক দুই মলাটের ভিতরে এখানেই তিনি এক অসাধ্য সাধন করে ফেলেছেন। লেখকের লেখনী নিয়ে বলবার সাহস আমি তাই আর দেখাবো না। প্রচ্ছদ বেশ ভালো লেগেছে। কিছু কিছু বানানের ত্রুটি পেয়েছি যদিও সেটা নিশ্চয়ই পরের সংস্করণে ঠিক করে নেওয়া হবে।
একটা সুন্দর, মিষ্টি, সরল, প্রেমের বই পড়তে চাইলে অন্যদিকে না তাকিয়ে অবশ্যই এই বইটা পড়ে ফেলুন। (এখানে বলে রাখি, কিছুটা হলেও এই উপন্যাস লেখকের আত্মকথনও বটে)।
চোখ বুঁজে কল্পনা করুন: দুর্গাপুজোর এক মেঘলা বিকেল। আকাশে মেঘের শরীর, নিচে ধুনোর ধোঁয়া। দশমীর বিষণ্নতা গায়ে মেখে হেঁটে যাচ্ছে পাড়ার শেষ কিশোরী দল।
পায়ের নিচে নিঃশব্দে ভেঙে পড়ছে শিউলি ফুল, যেমন কিছু কথাহীন অনুভব ভেঙে পড়ে আমাদের ভিতরে—অব্যক্ত, অথচ প্রবলভাবে উপস্থিত। এই দৃশ্যপটেই শুরু হয় ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা।
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য যেন কলম নয়, হৃদয়ের রক্তাক্ত স্পন্দনে এঁকেছেন একটা গ্রাম, একটা প্রেম, একটা অসীম টানাপোড়েন।
এই সূচনা যেন মনে করিয়ে দেয় সেই বিখ্যাত লাইনটি— “Last night I dreamt I went to Manderley again…”—ডাফনে ডু মরিয়েরের Rebecca-র শুরু যেমন এক হ্রাসপ্রাপ্ত, অথচ বিষাদময় নস্টালজিয়ায় জারিত স্বপ্ন নিয়ে, ঠিক তেমনই ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা শুরু হয় এক ধোঁয়াশার আবহে।
আবার, গার্সিয়া মার্কেজের Love in the Time of Cholera-র সূচনায় যেমন পুরনো প্রেমের গন্ধ মিশে থাকে মৃতদেহের পাশে বসে থাকা এক বৃদ্ধের চোখে, তেমনই এখানেও পুরনো প্রেমের গন্ধ পাওয়া যায় ধুনোর ভাঁজে ভাঁজে।
যেমন ভার্জিনিয়া উলফের To the Lighthouse শুরু হয় এক দৃষ্টিহীন অপেক্ষায়—“Yes, of course, if it's fine tomorrow…”—ঠিক তেমনই এখানে পুজোর আবহ এক প্রতিশ্রুত অথচ অনিশ্চিত ভালোবাসার পূর্বভাষ।
আমার লতার একটি মুকুল ভুলিয়া তুলিয়া রেখো-- তোমার অলকবন্ধনে। আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে একটি বিন্দু এঁকো-- তোমার ললাটচন্দনে।
এই কবিতা যেন শুধু ভূমিকা নয়, এক মায়াবী বাঁশির ডাক—যা পাঠককে নিয়ে যায় ঈশ্বরপুর নামের এক অলীক জনপদে, যেখানে প্রেমের রঙটা গাঢ় অথচ অস্পষ্ট, ছুঁয়ে-ছুঁয়ে পাশ কাটিয়ে যায়।
জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন—
“তবু তোমাকে ভালোবেসে মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে বুঝেছি অকূলে জেগে রয় ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ হৃদয় ।”
তেমনই এই গল্পগুলোর চরিত্রেরা যেন প্রেমেরই প্রতিনিধি, কিন্তু তারা কেউই জানে না প্রেমের পূর্ণ ব্যাকরণ। তারা অপেক্ষা করে, তারা চলে যায়, তারা ফিরে আসে—তবু প্রতিবারেই কিছু একটা অপূর্ন রয়ে যায়।
শক্তির পঙ্ক্তি মনে পড়ে:
“মনে মনে বহুদূর চলে গেছি – যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয় জন্মেই হাঁটতে হয় হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি পথ তো একটা নয় – তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা নদীর দু – প্রান্তের মূল একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোড়েন – দুটো জন্মই লাগে মনে মনে দুটো জন্মই লাগে”
এই একাকিত্ব, এই আকুলতাই ঈশ্বরপুরের প্রেমের আসল চরিত্র। কেউ কারো হয় না, কেউ কারো পাশে থাকে না—তবু এক অদ্ভুত আকর্ষণে আটকে থাকে সম্পর্কগুলোর ছায়া।
শার্ল বোদলেয়র মনে পড়ে, বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে:
বলো আমাকে রহস্যময় মানুষ, কাকে তুমি সবচেয়ে ভালবাসো? তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নীকে? পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নী- কিছুই নেই আমার। তোমার বন্ধুরা? ঐ শব্দের অর্থ আমি কখনোই জানি নি। তোমার দেশ? জানি না কোন্ দ্রাঘিমায় তার অবস্থান। সৌন্দর্য? পারতাম বটে তাকে ভালবাসতে- দেবী তিনি অমরা। কাঞ্চন? ঘৃণা করি কাঞ্চন, যেমন তোমরা ঘৃণা করো ঈশ্বরকে। বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালবাসো তুমি? আমি ভালবাসি মেঘ,…..চলিষ্ণু মেঘ……. উঁচুতে……..ঐ উঁচুতে…….. আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল।
ঠিক এই কবিতাটিই যেন উপন্যাসের বহু সম্পর্কের সারাংশ হয়ে দাঁড়ায়। প্রেম এখানে কখনোই অন্তিম ঠিকানা নয়— তা শুধু ঘুরপাক খাওয়া, এক perpetual desire, যা পূরণ হলেই প্রেম আর প্রেম থাকে না।
বরং অপূর্ণতাতেই তার সৌন্দর্য।
মনে পড়ে যায়, The Book of Unholy Mischief-এ, লেখিকা Elle Newmark-এর সেই উক্তি, “...unrequited love does not die; it's only beaten down to a secret place where it hides, curled and wounded. For some unfortunates, it turns bitter and mean, and those who come after pay the price for the hurt done by the one who came before.”
আর ঠিক এইখানেই দেবজ্যোতির লেখনী ঢুকে পড়ে Gabriel García Márquez-এর ছায়ায়—ফ্লোরেন্তিনো আর ফিরমিনার সে��� প্রেমে, যা বার্ধক্যের ডুবন্ত দুপুরে আচমকা জেগে ওঠে, যেন পুরোনো ট্রাঙ্ক খুলে পাওয়া একটা হলুদচিঠি। Kawabata-র Snow Country-র মতো, যেখানে প্রেম ধ্বনিমাত্র, বরফ গলার মতোই নিঃশব্দ আর ক্ষণিক। ঈশ্বরপুরেও প্রেম কোনও তীব্র চিৎকার নয়, বরং জলপাই রঙের আলোয় ডোবা একটা দীর্ঘশ্বাস।
এই প্রেমে জীবনের প্রতিধ্বনি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে কবিতার দীর্ঘ নিঃশ্বাস—“মরুতে আজ একা আমি, শূন্য পদ্মে হেথা ছায়া।” জীবনানন্দ যেন বাঁশির সুরে এই সম্পর্কের অনুপস্থিতি গুনগুন করেন। শক্তি হয়তো বলতেন, “ভুল করেছিলে কিন্তু ভালোবেসে”। আর বুদ্ধদেব বসুর নিঃসঙ্গ কবি হয়তো বলতেন, “আমরা কেউ কাউকে ছুঁতে পারি না, অথচ ভালোবেসে ফেলি।”
দেবজ্যোতির ঈশ্বরপুরের প্রেম ঠিক এইরকম—সময়ে গেঁথে থাকা এক মিথ্যা-বললেও-ভুল-হয়-না আবেশ, যা দূর থেকে দেখা যায়, স্পর্শ করতে গেলেই গলে যায়।
এই বইয়ের প্রেম এতটা esoteric বলেই “স্মৃতির শৈবাল” এত অসামান্য ভাবে ঘন। গল্পের চরিত্ররা যেন আজকের মানুষ নয়—তারা কোনো ম্লান রূপকথা থেকে উঠে আসা মুখ, যাদের ভালোবাসা আছে, কিন্তু সেই ভালোবাসার অবয়ব নেই। এক মুখহীন আকুতি, এক শব্দহীন সুর, যা শুনে মনে হয় নদীর নীচে নিরন্তর বেজে চলেছে মোজার্টের সিম্ফোনি —তুলোর মতো নরম, অথচ পাথরের মতো ভারী।
Kawabata বলেছিলেন— "His heart was like a delicate earthenware bowl that had been dropped and shattered, the cracks glued together again so perfectly it might have been whole." এই বইয়ের প্রতিটি প্রেম যেন তেমনই — মেরামতি করা, জোড়াতাপ্পি লাগানো হৃদয়ের মতো, যা একবার গুঁড়ো হয়েছিল, তবুও টিকে আছে, কাঁচের দাগের ভেতর দিয়ে সেখানে এখনো আলো ঢোকে।
মনে পড়ে শক্তির বিষণ্ণতা:
চিরটাকাল সঙ্গে আছে—জড়িয়ে লতা শাখার, বাহুর নিমন্ত্রণকে ব্যাপকতা বলার সময় হয় নি আজো ক্ষেমংকরে তার পরিচয় ? মনে পড়ে মনেই পড়ে | গোপন রাখলে থাকবে না আর – বাইরে যাবে পারলে হৃদয় দুর্বলতা দেশ জ্বালাবে মিছেই আমায় জব্দ করে তার পরিচয় ? মনে পড়ে মনেই পড়ে। ........
এর মতোই এই প্রেমও অনির্বচনীয়। হয়তো এই কারণেই, ঈশ্বরপুরের প্রেম ঘটমান। তার নিঃশেষ নেই —সে শুধু এক দীর্ঘ, নিরব আলোয় ভেজা প্রতিমূর্তি । ঈশ্বরপুরের প্রেম — ভাঙা, আবার জোড়াও। এর ভেতরে ভেতরে অসংখ্য সূক্ষ্ম ফাটল। সেই ফাটল দিয়েই আলো ঢোকে, আর সেই আলোর রেখাতেই দেবজ্যোতির ভাষা ঝিকমিক করে।
দেবু—বেলগাছিয়ার ছেলে। বড় হয়েছে চুনোপুঁটির মতোই—নিজস্বতা নেই তার। তার জীবন যেন ঘোলাজলে ভেসে থাকা এক স্বচ্ছ মানিক—আলো পায় না ঠিকমতো, তবু সে নিজের মতো করে দীপ্ত। অঙ্ক ভালোবাসে, গবেষণায় ডুবে থাকে। এবং তার জীবনের সবচেয়ে বড় গুণ—একটা নিরীহ আত্মত্যাগ। সে নিজের স্বপ্নকে ধুলো খাওয়াতে রাজি, যদি তার প্রয়োজনে কারও স্বপ্ন মুক্ত আকাশে উড়তে পারে। এমন নিরব ভালোবাসা, এমন নিঃশব্দ সহানুভূতি, কেবল জাপানি নভেলেই যেন দেখা যায়—Kawabata-র Snow Country-তে যেমন Komako আর Shimamura একে অপরের জীবনে আসে, ন্যূনতম কোনো প্রতিশ্রুতি ছাড়া।
আর বিবি? সে যেন আধুনিক কালের Anna Karenina—তবে টলস্টয়ের সেই ট্র্যাজিক নাটকীয়তা এখানে নেই, আছে এক চুপচাপ মুক্তির অনুসন্ধান। বিবির মধ্যে বুদ্ধদেব বসুর গদ্যপ্রেমের সেই বিশুদ্ধ সৎ প্রশ্ন আছে—"আমি কি ভালবাসি, না শুধু মুক্তি চাই?" সে কারও ঘরে ফেরে না; সে যেন নিজেই এক বাড়ি, যে নিজের ভিতরে খুঁজে চলেছে নিজের ঠিকানা।
তাদের এই প্রেমের রসায়ন এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা তৈরি করে—যেখানে কেউ কাউকে আঁকড়ে ধরে না, কিন্তু ছেড়েও দেয় না। এই অনির্ধারিত বাঁধনটুকুই “ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা”-কে একেবারে স্মৃতির শৈবালে ভেজা কুয়াশার ভেতর নিয়ে যায়—যেখানে প্রতিটি সম্পর্ক মানে "উপস্থিতির মধ্যে অনুপস্থিতি", এবং ভালোবাসা মানে "ফিরে তাকানো ছাড়া দেখা"।
তাদের প্রথম দেখা এক পুজোমণ্ডপে—যেন Before Sunrise-এর সেই জার্মান ট্রেন, যেখানে একজন বলেছিল, “If there's any kind of magic in this world, it must be in the attempt of understanding someone, sharing something.” দেবু আর বিবি সেই শেয়ার করার প্রচেষ্টাতেই বাঁধা পড়ল, কিন্তু ভাগ্য? ভাগ্য, হেমিংওয়ের ভাষায় বললে, always breaks the things we love the most.
ঈশ্বরপুর এই উপন্যাসে শুধুই স্থান নয়, যেন Marquez-এর Macondo বা Narayan-এর Malgudi। প্রতিটি কাঁচা রাস্তা, পুকুরঘাট, পাতা ঝরা ছায়া—সব যেন চরিত্র হয়ে উঠে দাঁড়ায়। আপনি একবার ঢুকলেই বুঝবেন, এই গ্রামে সময় থেমে আছে, এবং আপনি নিজেই একটু একটু করে বদলে যাচ্ছেন। ঈশ্বরপুরে প্রবেশ মানে নিজের মধ্যে ঢুকে পড়া, নিজের ফেলে আসা শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়া।
বিবি হয়তো ইউরোপের সেমিনারে নিজের পেপার পড়ে হাততালি পাচ্ছে, দেবু হয়তো শালপাতার পাতা চাপিয়ে বাচ্চাদের অঙ্ক শেখাচ্ছে—কিন্তু তাদের প্রেম? সেটাকে সংজ্ঞায়িত করলে ভুল হবে। এটা Remains of the Day-এর Stevens-এর মতোই—শুধু এক চুপচাপ বোঝাপড়া, “I gave my best days to a house, not to a person. But that too was love, wasn’t it?”
আর এই প্রেমের পিছনে বেজে চলে শিউলি ফুলের মতন নিঃশব্দ আবেগ। দশমীর বিকেলে দেবুর কপালে বিবির আবির, আর একটিমাত্র অনুরোধ—“চেষ্টা করে দেখ শুধু একবার!”—এটি কোনও আহ্বান নয়, এটি যেন এক test of the soul। যেন Atonement-এর শেষ দৃশ্য, যেখানে সবই ঠিক, শুধু সময়টাই ঠিক নয়।
এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র যেন নিজস্ব ছায়ায় তৈরি। দেবুর মা—যে মুখে কিছু বলে না, অথচ একবার চুপচাপ জামার পকেটে লজেন্স গুঁজে দেয়। বৌদি—যে প্রথমে খোঁটা দেয়, পরে চুপচাপ ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে। এমনকি মেহের দি, সাধু দা—তাঁরা যেন কেবল ‘আলাদা আলাদা মানুষ’ নন, বরং ঈশ্বরপুরের তন্তু, যার সঙ্গে গাঁথা দেবুদের মতো হাজারো ঘরহারা মানুষ।
এদের কেউই নিখুঁত নয়। কেউই “উপন্যাসিক” সৌন্দর্যের প্রতিমা নয়। কিন্তু তারা বাস্তব। Flesh and bone. Mistake and mercy. ঠিক যেমন আমরা।
বইটির প্রচ্ছদ দেখে প্রথমেই মনে পড়ে যায় টমাস হার্ডির উপন্যাসগুলোর অনুচ্চ কভার, যেখানেও চুপচাপ এক গ্রাম থাকে, এক পুরুষ থাকে, এক নারী থাকে—আর মাঝখানে থাকে এক নিঃশব্দ লড়াই, নিজেদের মধ্যে, নিজেদের সঙ্গে। সুবিনয় দাসের আঁকা চিত্র যেন নিজের মতো করে পাঠককে বলছে, “তোমার নিজের ঈশ্বরপুর খুঁজে নাও।”
এটি কেবল প্রেমের উপন্যাস নয়। এটি সেইসব নীরব চিঠির গল্প, যেগুলো কেউ পাঠায় না, তবুও লেখা হয়। এটি সেইসব পথের গল্প, যেগুলো মানুষ নেয় না, কিন্তু আজীবন ভাবে—"নিলে কী হতো?" এটি সেই গান, যার উত্তর আশা না করেও গাওয়া হয়—“আমার এ গান তোমায় লাগি…”
যদি আপনি The Namesake পড়েন, আর ভেতরে কোথাও একটু নস্টালজিয়া জমে—তবে ঈশ্বরপুর আপনার জন্য। যদি আপনি Jane Eyre পড়ে ভাবেন, "তবুও, আমি নিজে নিজে দাঁড়াবো!"—তবে বিবি আপনার পরিচিত। আর যদি কখনও কোনো ট্রেনের জানালার ধারে বসে ভাবেন, “আমার পথটা আলাদা হতে পারতো”—তবে দেবু আপনার ভেতরেই বাস করে।
এ উপন্যাস পড়া মানে নিজেকে একটু ভালোবেসে দেখা। নিজেকে জিজ্ঞেস করা, “আমার ঈশ্বরপুর কোথায়?” আর একবার উত্তর পেয়ে গেলে... আপনি জানবেন, ফেরার আর রাস্তা নেই।
দেবু বলেছিল না? “বিবি, তুই থাকিস। আমি দেখবো, পারি কিনা।” আমরাও একটু একটু করে হয়তো সেই চেষ্টা শুরু করি।
আর আপনি? আপনার বিবি কোথায়? হয়তো সে এখনই কোনও সেমিনারে কথা বলছে, আর আপনি ঈশ্বরপুরে বসে এই লাইনটা পড়ছেন।
তাতে কী? ভালোবাসা তো চিরকালই একটু অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তবেই না সে থেকে যায় চিরন্তন।.
Sarah Dessen, মনে পড়ে যায়। The Truth About Forever!!
Sarah লিখছেন: “I have to admit, an unrequited love is so much better than a real one. I mean, it's perfect... As long as something is never even started, you never have to worry about it ending. It has endless potential.”
অসামান্য বই। পড়ে দেখুন।
পুনশ্চ: দেবু দা'কে বহুদিন চিনি। বিষবৈদ্য সিরিজের স্রষ্টা যে এতটা প্রগাঢ় রসিক, এই বই না পড়লে বুঝতাম না।
◻️তারা একে অন্যকে ভালোবেসেছিল। তারা দুই সাধারণ মানুষ-মানুষী। এক পুজোমণ্ডপের উজ্জ্বল আলোয় মানুষীটি তার উজ্জ্বলতর চোখ তুলে বলেছিল, ‘ভালোবাসি’। তারপর জীবন এসে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের মাঝখানে। গড়ে তুলল দুস্ত��� দেওয়াল। সে দেওয়াল পেরোতে অনেক উচ্চতায় উঠতে হয়েছিল তাদের। ভালোবাসার অনন্য জাদুডানায় ভর করে দুস্তর বাধা পেরিয়ে অ্যাচিভমেন্টের সুদূর আকাশে তাদের একে অন্যের কাছে ফিরে আসবারই কাহিনি ‘ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা’।
◻️ পুজোর ঠিক আগেটায় লেখকের হাত ধরে ঘুরে এলাম ঈশ্বরপুর থেকে। গোটা গল্পটা জুড়ে পুজোয় কখনো সূচনা রয়েছে, কখনো বিচ্ছেদ রয়েছে, কখনো পুনর্মিলন রয়েছে, আবার কখনো এক কঠিন আত্মোপলব্ধি রয়েছে। আছে ঈশ্বরপুরের মানুষদের সরলতার কথা,আছে প্রকৃতির সুন্দর সব দৃশ্যের বর্ণনা, আছে প্রেমকথা,আর আছে অভিনব এক রিসার্চের বিষয়।
◻️প্রেম কি? তা কি শুধু মানুষ মানুষীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ? হয় তো নয়। যা নির্বাক, যা বিমূর্ত তাদের প্রেমেই হয়তো সবচেয়ে গভীরভাবে পড়া যায়। কারণ তা অনুভবে আঘাত করে সবচেয়ে বেশি। তাই গল্পটা শুধু তথাকথিত মানব-মানবীর ভালোবাসার নয়, বরং নিজের আদর্শের প্রতি ভালোবাসা, নিজের আপনজনদের প্রতি ভালোবাসা, তাকে আপন করে নেওয়া পরিবেশ ও স্থানের প্রতি ভালোবাসা, নিজের স্বপ্ন- উদ্দেশ্যর প্রতি ভালোবাসা নিয়ে লেখক এই গল্পটি বুনেছেন। সাধারণত প্রেমের গল্প আমার পছন্দে কমই থাকে, সে জায়গায় এই বইটা শুধু পছন্দই হয়নি, ভাবতেও শিখিয়েছে অনেক বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে।আমরা তো সবাই শুধুই খুঁজছি শান্তি, সুখ - তা কি কেবল বাইরের জগতেই আছে নাকি মনের অনাবিল আনন্দেই তার হদিশ?
◻️একটা বিষয় বিশেষ করে অবশ্যই বলতে হয়, তা হল রিসার্চের বিষয়টি। শিক্ষা, সোশিওলজি ও অঙ্কের মিশ্রণে যে অভিনব বিষয়টা লেখক উত্থাপন করেছেন, তা অবশ্যই প্রশংসনীয় । এছাড়াও দেবু এবং বিবি ছাড়াও এই উপন্যাসের পার্শ্ব চরিত্রেরা এই উপন্যাসের শক্ত খুঁটি বলতেই হবে। সাধু দা, তার স্ত্রী সীতাদেবী, দেবুর বৌদি রমা কিংবা মেহেরদি। এরা না থাকলে হয়তো ঈশ্বরপুরের এই প্রাকৃতিক তথা মানবমানবীর প্রেমকথা সম্পূর্ণ হতোনা। তাই এই গল্প যতটা দেবু এবং বিবির ততটাই এদের সকলের।
◻️ সবশেষে যেটা না বললে বইটা সম্পূর্ণই হবেনা, তা হলো বইয়ের প্রচ্ছদ ও পত্রভারতীর বাঁধাই ।প্রচ্ছদ শিল্পী সুবিনয় দাস কে কুর্নিশ। প্রথম দর্শনেই প্রচ্ছদের সাথে ভেসে যাওয়া যায় ।লেখকের অনেক বই পড়ে থাকলেও এই ধরনের লেখা আমার প্রথম পড়া।ভালো থাকবেন লেখক, আপনার কলম থেকে আরও অনেক প্রেমকথা পাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
এই উপন্যাস পড়তে পড়তে খালি মনে হয়েছে আমার চারপাশের অনেক কাছের মানুষকে ধরে বেঁধে এই গল্প শোনাই। এ যে তাদেরই গল্প.. যারা একদিন কিস্সু হবেনা এইদেশে পড়ে থেকে বলে অনেক দূর দেশে চলে গেছে অনেককাল আগে... নিজের শিকড় উপড়ে যারা অন্য কোথাও অনেক দূরে আবার সেই শিকড় পুঁতে গাছ বানানোর চেষ্টা করে চলেছে ক্রমাগত, এই গল্প তাদের জন্য। ঘর থেকে দুদিন দূরে থাকলে যেমন মনে হতে থাকে কবে বাড়ি ফিরবো, যারা দেশের বাইরে বসতি স্থাপন করেছে তারাই বোঝে জন্মভিটের টান কি জিনিস, বাড়ির টান, বাড়ির মানুষের টান কি জিনিস তা হয়তো তাদের চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। এই গল্প দেশ ছেড়ে যাওয়া আর দেশে পড়ে থেকে স্বপ্নপূরণ করে যাওয়ার মধ্যে তৈরি হওয়া এক বিষূবরেখার সেতু নির্মাণের কথা বলে। 🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂 আপনজন পড়ে শেষ করার পর বহুদিন কিছু পড়তে পারিনি। একটা চাপা কষ্ট, অনেক আকাশপাতাল ভাবনার কালো মেঘে যেন এলোপাতাড়ি ভেসে বেড়াতাম মনে হতো। এরপর বইমেলাতে লেখকের বেশকিছু বই সংগ্রহ করি। তারপর মার্চ মাসে প্রকাশিত হলো ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা। দুবার ভাবিনি কেনার আগে, কারণ লেখকের নামটাই যথেষ্ট ছিল আমার কাছে। আর তিনি নিজের লেখার গুণেই আবারও প্রমাণ করলেন যে আমি ভুল করিনি। গভীর রাতে হাল ছেড়ে দেওয়ার পর নৌকা যেমন হাওয়ার দিকে হালকা চালে ভেসে চলে, যেন কোনো তাড়া নেই, কোথাও পৌঁছানোর তাগিদ নেই, শুধু ভেসে চলে নিজের লক্ষ্যে। এই গল্পও তেমনই। সারাদিনের খাটুনির পর এই গল্প আপনাকে আরাম দেবে, চো জুড়িয়ে দেবে। 🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂
গল্পের নায়ক দেবু ওরফে দেবব্রত বহুবছর বেকার থাকার পর অবশেষে স্কুল মাষ্টারের চাকরি পেয়ে মাকে নিয়ে ঈশ্বরপুরে পাড়ি দেয়। ধীরে ধীরে ঈশ্বরপুরের মানুষের সরলতার জন্যই হোক কিংবা নিজের শিকড়ের কাছাকাছি পৌঁছোনোর কারণেই হোক দেবু ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেললো সেই গ্রাম, গ্রামের প্রতিটা মানুষকে... কিন্তু বিবি?? সে তো শহরের শিক্ষিতা আধুনিক একটি মেয়ে... দুচোখ জুড়ে তার স্বপ্ন বিদেশের মাটিতে গবেষণার কাজ নিয়ে এগিয়ে যাবে আরও উন্নতির পথে... আর পাশে থাকবে তার ছোটবেলার ভালোবাসা দেবু... কিন্তু দেবুর এই দেশ ছেড়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত ক্রমে পাঁচিল তুলে দেয় তাদের এই সাদাসিধে সম্পর্কে। সম্পর্কের টান এড়ানো গেলেও মাটির টান এড়ানো কি এতই সহজ??? দুদেশে বসে তাই দুজনের গবেষণা হয়তো মিলে যায় তাদের মনেরই মতো। কিন্তু তারা কি মিলবে আবার পরস্পর?? ঈশ্বরপুর সেই গল্পই বলে। 🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂
দেবু এবং বিবি ছাড়াও এই উপন্যাসের পার্শ্ব চরিত্রেরা এই উপন্যাসের শক্ত খুঁটি বলতেই হবে। সাধু দা, তার স্ত্রী সীতাদেবী, দেবুর বৌদি রমা কিংবা মেহেরদি। এরা না থাকলে হয়তো ঈশ্বরপুরের এই প্রাকৃতিক তথা মানবমানবীর প্রেমকথা সম্পূর্ণ হতোনা। তাই এই গল্প যতটা দেবু এবং বিবির ততটাই এদের সকলের।
⛳ কি ভাবছেন বইটা কেমন হবে? বইটা কি কেনা যাবে? কী আছে এই বইতে? আসুন দেখে নিই.......
🌿🪷সদ্য পড়ে শেষ করলাম সাহিত্যিক দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য মহাশয়ের লেখা ‘ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা’ উপন্যাসটি। লেখকের লেখা আগে কখনো পড়া হয়নি। ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা-এর মাধ্যমে লেখকের লেখার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হলো। অভিজ্ঞতা বেশ ভালো আর এটা বলতেই হয় লেখকের লেখনীশৈলী ভীষণ ভালো। আসুন দেখে নি কি আছে এই উপন্যাসের মধ্যে........
🌿🪷এটা একটা প্রেমের উপন্যাস। এই উপন্যাসের নায়ক ‘দেবব্রত চৌধুরী’ ওরফে দেবু। নায়কের বড়ো হওয়া কলকাতায়, বিস্তার পড়াশোনা পরেও নায়কের বেকার জীবন কেটছে। দাদার উপার্জনে দিনযাপন করছে..... হঠাৎ করেই নায়ক একদিন মাস্টারের চাকরি পায়। এবং সেই চাকরি সূত্রে অজানা এক গ্ৰামের উদ্দেশ্য পারি দেয় নায়ক। গ্ৰামের নাম ঈশ্বরপুর...... সেই ঈশ্বরপুরের বর্ণনা কি অসাধারণ..... না পড়লে তা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
🌿🪷এদিকে আবার ‘বিবি’ গল্পের নায়ককে বলে দাদা, ব্যাপারটা একটু হাস্যকর হলেও বিবি কিন্তু ভীষণ ভালোবাসে নায়ককে। কিন্তু হ্যাঁ এই যে নায়ক গ্ৰামে জীবনযাপন করছে সেটা ঠিক মানতে পারছে না। তবুও তাকে ওই গ্ৰাম থেকে বের করতেও চাইছেনা। ভালোবাসা যেমন আছে তেমনই আছে নিজের কেরিয়ার, পরিবার এই সবকিছু নিয়ে একটা টানাপোড়েন এর মধ্যে আছে গল্পের নায়িকা.......... ১৯২ পেজের উপন্যাস এর থেকে বেশী কিছু বলতে গেলে পুরোটাই স্পয়েল হয়ে যাবে। এতোটুকুই থাক....
🌿🪷এই যে দুটো মানুষ দুই প��রান্তে আছে তাদের ভালোবাসা কেমন করে আছে? ভীষণ সহজ সরল একটা উপন্যাস। গল্পের মধ্যে বাস্তবতাও ফুঁটে উঠেছে। এই যে গল্পের নায়ক দেবু আর বিবি এরা কি এক হতে পারবে শেষপর্যন্ত? জানতে হলে অবশ্যই উপন্যাসটি পড়তে হবে। ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা তাই নিছক এক সফল ভালোবাসার কাহিনিই নয়, ভালোবাসার দুর্মর শক্তিতে জীবনকে সফল করে তোলবার কাহিনিও বটে.......বইটি হার্ড কভার, ভালো কাগজ, ঝকঝকে ছাপা ও আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ সমৃদ্ধ। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার লেখার দীর্ঘায়ু কামনা করি, ভালো থাকবেন।
📥🗒️2024 Book Review ~ 54 যদি এই বইটি পূর্বেই কেউ পড়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই আপনাদের ব্যক্তিগত মতামত জানাবেন। এছাড়াও আমার রিভিউ কেমন লাগছে সেটাও জানাবেন নিচের কমেন্ট বক্সে। যদি কিছু ভুল ত্রুটি হয় সেটাও জানতে ভুলবেননা। 🍀 আবারো দেখা হবে পরের রিভিউতে। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন আর অনেক অনেক বই পড়ুন। 🙂 🙏🏻 !! ধন্যবাদ !! 🙏🏻
আমাদের জনজীবনে আজকাল একটা কথা খুবই প্রচলিত। এই পোড়া দেশে আর কিচ্ছু নেই। স্টেটসে নিদেনপক্ষে বিদেশ তো যেতে হবেই। তবেই নিজের কর্মজগতে সফলতা ধরা দেবে। কিন্তু যাদের নিজেদের প্রতি এত আত্মবিশ্বাস যে বিদেশে গেলেই তারা উন্নতি করে ফেলবে, তাদের নিজেদের "পোড়া দেশ" কে "সোনার দেশ" বানানোর ক্ষমতা নেই কেন? অন্তত ইচ্ছেটুকু নেই কেন? আসলে এরা পলাতক। কেবলই সমস্যা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। সোনা ফলানোর দক্ষতা টুকু এদের নেই। এরা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানোতেই খুশি। আর নিজেদের এই না পারা গুলোকে, ব্যর্থতাকে ঢাকবার জন্যই ওরা উপহাস করে চলে এই দেশ আর যারা এই দেশের উন্নতির চেষ্টা টুকু করে চলেছে তাদের। এ এক নিরন্তর প্রক্রিয়া।
উপন্যাসের অন্যতম মুখ্য চরিত্র দেবু বেশ কিছু বছর কলকাতায় বেকার কাটানোর পর অঙ্কের মাস্টারের চাকরি নিয়ে চলে আসে ঈশ্বরপুরে। আধুনিকতার ছোঁয়া এখনও লাগেনি এই গ্রামে। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই বিবি কে। বিবি স্বপ্ন দেখে বিদেশের এক সুন্দর শহরে রিসার্চ করে আর ছুটির দিনে দেবুর হাত ধরে পরিস্কার সমুদ্রতটে বসে, অবসরে দেবুর কাঁধে মাথা রেখে সে কাটিয়ে দেবে গোটা একটা জীবন। সে এটা জানবার প্রয়োজন বোধ করে না দেবুর এই জীবনযাত্রায় সম্মতি আছে কিনা। দেবুও বিবিকে ভালোবেসে প্রাথমিক ভাবে রাজি হয় তার প্রস্তাবে। কিন্তু অপর দিকে বেড়ে উঠতে থাকে ঈশ্বরপুরের প্রতি দেবুর আবেগ, ভালোবাসা, এখানকার মানুষগুলোর প্রতি দেবুর আত্মিক টান। এবার কোনদিকে মোড় নেবে এই দুই মানব মানবীর জীবন? ঈশ্বরপুর না বিবি - দেবুর মনকে শেষ পর্যন্ত জিতে নেবে কে? তাদের সম্পর্কের পরিণতি ই বা কি?
প্রেমের উপন্যাসের মোড়কে আধুনিক সমাজের এক আশ্চর্য অসুখের কথা লেখক তুলে ধরেছেন অসাধারণ মুন্সিয়ানায়। মানুষের জীবন, মনের জটিলতা, সাফল্য, সুখ আর শেষমেষ বাঙালির সেরা উৎসব দুর্গাপূজা এই উপন্যাসে যোগ করেছে এক অন্য মাত্রা। সবশেষে এটুকুই বলতে চাই, দেবুর মত চরিত্রদের বড় শ্রদ্ধা করি আমি। এই "পোড়া" দেশে অসংখ্য দেবুর জন্ম হোক, এই আমার প্রার্থনা।
লেখকের লেখা এই প্রথম পড়লাম। পড়ে খুবই ভালো লাগলো। ভবিষ্যতে ওনার আরও লেখা পড়তে চাই। সবশেষে যার কথা না বললেই নয়, তা হলো এই বইয়ের প্রচ্ছদ। অনবদ্য এই প্রচ্ছদ টি অঙ্কন করেছেন শিল্পী সুবিনয় দাস। বলাই বাহুল্য, এই বইয়ের প্রচ্ছদ দেখেই বইটা পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। পত্রভারতীর বই বাঁধাই আর বড় বড় হরফ ও পড়ার আগ্রহ যুগিয়েছে বারবার। পাতার মান ও ভালো। পরিশেষে বলতে চাই এই বই আমায় সার্বিক ভাবে মুগ্ধ করেছে।
🪻 আচ্ছা প্রথমেই আমি আপনাদের কাছে একটা প্রশ্ন করতে চাই। আপনার সামনে যদি কখনো ভালোবাসা এবং কেরিয়ার এই দুইয়ের মধ্যে একটা বেছে নিতে বলা হয়, আপনি কোনটা বাছবেন ??
🪻 তারা একে অন্যকে ভালোবেসেছিল। তারা দুই সাধারণ মানুষ- মানুষী। এক পুজোমণ্ডপের উজ্জ্বল আলোয় মানুষটি তার উজ্জ্বলতর চোখ তুলে বলেছিল ' ভালোবাসি '। তারপর জীবন এসে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের মাঝখানে। গড়ে তুলল দুস্তর দেওয়াল। সে দেওয়াল পেরোতে অনেক উচ্চতায় উঠতে হয়েছিলো তাদের। ভালোবাসার অনন্য জাদুডানায় ভর করে দুস্তর বাধা পেরিয়ে অ্যাচিভমেন্টের সুদূর আকাশে তাদের একে অন্যের কাছে ফিরে আসবারই কাহিনী ' ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা '।
🪻 শহরের ছেলে দেবু ওরফে দেবব্রত। বিধবা মা, দাদা বৌদি এবং ছোট্ট ভাইপোকে নিয়ে দেবুর পরিবার। অঙ্কে মাস্টার্স করা দেবুর ইচ্ছে ছিল তার প্রিয় বিষয় নিয়ে গবেষণা করার, কিন্তু এদেশে সেই বিষয়ের ওপর গবেষণা করার সুযোগ কম থাকায় সে ঈশ্বরপুরে অঙ্কের শিক্ষককের চাকরিটা লুফে নেয়। কারণ সে তার দাদা বৌদির সংসারে আর বোঝা হয়ে থাকতে চায়নি। এই ইট পাথরের নগরী ছেড়ে সে পাড়ি দেয় ঈশ্বরপুরের উদ্দেশ্যে।
🪻 অন্যদিকে আছে বিবি,সমাজবিদ্যার ছাত্রী। তার চোখে জুড়ে অনেক স্বপ্ন। বিবি চায় সে সমাজবিদ্যা নিয়ে বিদেশে গবেষণা করবে এবং দেবুর সাথে সেখানে নিজের একটা ছোট্ট সংসার গড়ে তুলবে। কিন্তু নিজের স্বপ্নের সাগরে ভেসে গিয়ে সে একবারও এটা জানার চেষ্টা করে না যে তার এই ভাবনায় দেবুর সম্মতি কতটা আছে। দেবু বিবিকে ভালোবাসে তাই প্রাথমিকভাবে তার এই প্রস্তাবে রাজি হয়। কিন্তু অপর দিকে দেবুর মনে গড়ে ওঠে ঈশ্বরপুর এবং তাতে বসবাসকারী সরল গ্রামবাসীদের প্রতি আত্মিক টান। ঈশ্বরপুর তাকে দুহাতে জড়িয়ে ফেলে মায়ার বাঁধনে। দেবু কী পারবে এই ঈশ্বরপুরের মায়া কাটিয়ে উঠতে? নাকি ভালোবাসার কারণে বিবি নিজের স্বার্থত্যাগ করবে? কোনদিকে মোড় নেবে দেবু এবং বিবির জীবন? তাদের এই সম্পর্কের পরিণতি কী?
🪻 লেখক এমন সুন্দরভাবে সমস্ত ঘটনা এবং ঈশ্বরপুর গ্রামের বর্ননা করেছেন যে এই কাহিনী পড়তে পড়তে আমি নিজেই কখন ওই গ্রামের একজন হয়ে গেছি বুঝতে পারিনি।
🪻' ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা ' নিছক এক সফল ভালোবাসার কাহিনীই নয়, ভালোবাসার দুর্মর শক্তিতে জীবনকে সফল করে তোলবার কাহিনীও বটে। '
প্রেম কখন জন্মায়—দুটি চোখের মিলনে, নাকি মাটির নীরব নাড়ির টানে? ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা পড়তে পড়তে মনে হয়, প্রেম আসলে কোনো সংজ্ঞার অনুগত নয়; সে যেমন মেঘের, তেমনি নদীর, তেমনি মানুষেরও। সে কখনো ধরা পড়ে না; কেবল ছুঁয়ে যায়।
দেবু যেন সেই ছোঁয়া-প্রাপ্ত মানুষ। শহরের ধোঁয়া, মানুষের কথার অস্পষ্ট কোলাহল—সবকিছু তাকে বাঁচায় না, বরং প্রতিদিন একটু করে ক্লান্ত করে। ঠিক তখনই ঈশ্বরপুর তাকে ডাকে—একটি চিঠির মাধ্যমে, যা আসলে ছিল এক নরম আলোর হাতছানি। সেই আলো তাকে টেনে নিয়ে যায় এমন এক গ্রামে, যেখানে বাতাসে উঠে আসে অচিনফুলের ঘ্রাণ আর বিকেলে�� রোদে নেমে আসে নিঃসঙ্গ শান্তি।
প্রথম পরিচয়ে গ্রামটি তার কাছে যতটা অনভ্যস্ত, ততটাই অগোছালো; কিন্তু সময় ধীরে ধীরে তাকে শিখিয়ে দেয়—সরলতাও কখনো কখনো মানুষের শ্বাসের মতো জরুরি হয়ে ওঠে। ঈশ্বরপুর দেবুকে শুধু আশ্রয় দেয় না, তাকে এক নতুন পরিচয় দেয়। গ্রামের মানুষের হাসি, তাদের অতি সাধারণ অথচ অকৃত্রিম জীবন, আর আকাশের নীলচে দোলায় ভেসে থাকা অজানা ফুলের সুগন্ধ দেবুর ভিতরে অচেনা এক শান্তির বীজ বুনে দেয়। সে নিজের মাকেও এই শান্তির ঘরে নিয়ে আসে। গ্রামটি যেন ধীরে ধীরে তাকে নিজের ভেতর ভাঁজ করে রাখে—যেন এ জায়গাটিই তার অন্তঃস্থল।
এরই মধ্যে বিবি—দেবুর প্রেমিকা—তার ভবিষ্যৎকে আরও দূরের আলোয় দেখতে চায়। সে চায় দেবু যেন শহর ছাড়িয়ে দেশের বাইরে গিয়ে নিজের জীবনকে বড় করে গড়ে তোলে। তার হাত ধরে আসে লোভনীয় এক সুযোগ। কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়ায়—একজন মানুষ কি সত্যিই নিজের শিকড় ছিঁড়ে ফেলতে পারে? দেবুর পায়ের নীচে যে মাটি এখন ঈশ্বরপুরের, সে কি সেই মাটিকে অস্বীকার করতে পারবে?
লেখক দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের ভাষা অনবদ্য—সরল অথচ সুরেলা, কোমল অথচ গভীর। গল্পের প্রতিটি বাক্য যেন ধীর নদীর জলের মতো, কোথাও তাড়াহুড়ো নেই, কোথাও কোলাহল নেই—তবুও গভীরে টেনে নেওয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে।
আর প্রচ্ছদ—অলক্ষ্যে বলেই ফেলে গল্পের আত্মকথা। এমন শান্ত, এমন নিটোল, যেন বইটি খোলার আগেই আপনি ঈশ্বরপুরে পৌঁছে যাচ্ছেন।
এই উপন্যাসটি পড়তে পড়তে বোঝা যায়—এটি শুধু সাহিত্য নয়; এটি এমন এক অভ্যন্তরীণ স্পন্দন, যা অজান্তেই হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। সম্ভব হলে অবশ্যই পড়ুন। নমস্কার!
🍀 বিষয়বস্তু :- "ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা, তার ক্যানভাসের বিরাট বিস্তার ও কাহিনীর বহুমুখীনতা সত্ত্বেও মূলত একটি প্রেমেরই গল্প।" খোদ কলকাতা শহরের বাসিন্দা দেবব্রত ওরফে দেবু প্রত্যন্ত গ্রাম ঈশ্বরপুরের একটি স্কুলে চাকরি পায়। ক্রমশ সে সেখানকার জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে যায়, ভালোবেসে ফেলে ঈশ্বরপুরকে। আর সেই ভালোবাসা এতটাই তীব্র যার জন্য নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানিকে উপেক্ষা করে সে থেকে যায় এই গ্রামেই, হয়ে ওঠে সেখানকার মানুষদেরই একজন । কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষ বিবি? নিজের কেরিয়ার, নিজের গবেষণার জন্য তাকে পাড়ি দিতে হবে বিদেশে। সে কি পারবে দেবুর জীবনের এই আমূল পরিবর্তনকে মেনে নিতে ? ভালোবাসার জাদুডানায় ভর করে দুস্তর বাধা পেরিয়ে অ্যাচিভমেন্টের সুদূর আকাশে তাদের একে অন্যের কাছে ফিরে আসবারই কাহিনী "ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা"।
🍀 পাঠপ্রতিক্রিয়া :- উপন্যাসটিতে প্রেম আছে, কিন্তু তা বাস্তবের রূঢ় মাটিতে প্রতিষ্ঠিত পরিণত বয়সের প্রেম। প্রেমের চেয়েও বেশী যা আছে তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়া, মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা, গবেষণা, কেরিয়ার এবং নিজের জীবনের লক্ষ্যকে খুঁজে পাওয়া ইত্যাদি প্রভৃতি। সত্যি বলতে কি উপন্যাসের প্রথমদিকে একজায়গায় এসে আমার মনে হয়েছিল, এ আবার কীধরনের প্রেম যেখানে শহরের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানিকে উপেক্ষা করায় প্রেমিকা ছেড়ে চলে যায়! কেরিয়ার তৈরির আসল ধাপেই পাশে থাকে না! এটা কি আদৌ প্রেম! কিন্তু যত উপন্যাস এগিয়েছে তত বোঝা গিয়েছে যে এটা একরকমের প্রেমই, বাস্তবের অভিঘাতে চাপা পড়ে যাওয়া প্রেম। কারণ যতই ফ্যান্টাসিতে বিশ্বাস করি না কেন, বাস্তবে শুধু ভালোবাসলেই দুটো মানুষের একসঙ্গে থাকা সম্ভব হয় না, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, কেরিয়ারের সাফল্য, অ্যাডজাস্টমেন্টের ক্ষমতা, সমাজ— আরও অনেককিছুর ওপরেই তা নির্ভর করে। তবে আমার হতাশ হওয়ার মূল কারন হলো আমি বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম অন্যরকম এক্সপেকটেশন নিয়ে। এর জন্য দায়ী বইয়ের প্রচ্ছদ এবং ব্লার্ব , যা দেখে খুব সহজেই একে স্মরণজিৎ- ঘরানার প্রেমের গল্প মনে হবে। কিন্তু আসলে তা একদমই নয়। প্রেমের কথা মাথায় না রেখে পড়লে আমার মনে হয় বেশি ভালো লাগবে বইটি।
ঈশ্বরপুরের প্রেমকথা আমাদের প্রেমের গল্প বলে, শুধু এক জোড়া মানুষ মানুষী এর প্রেম নয়, বলে ঈশ্বরপুর নামক একটি গ্রামের প্রেমের কথাও । এই বইটি আপনাকে থামাবে, আপনাকে ভাবাবে । মানুষ কী জীবনের চাহিদা মেটানোর জন্য ছুটবে বাইরের জগতে? যেখানে আছে টাকা পয়সা, সাফল্য, বিলাসিতা , না শিকড়ের টানে থেকে যাবে মাটির কাছে ? যেখানে খুঁজে পাবে লাল টালির ঘর, হলদে দেওয়াল, সবুজ রঙের দরজা ও জানলা ।
শহুরে দেবু চাকরি পায় মালদার এক গ্রাম ঈশ্বরপুর এ । স্কুল মাস্টার এর চাকরি । অঙ্ক নিয়ে পড়াশুনা করে দেবু রিসার্চ করতে চেয়েছিল, কিন্তু এদেশে সেই রিসার্চ এর স্কোপ কম, তাই চাকরি পেয়ে যেতে সে আর দ্বিধা বোধ করেনি । দাদা বৌদির সংসারে সে আসলে আর বাড়তি বোঝা হয়ে থাকতে চায়নি । তাই তো ঈশ্বরপুরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই সে তার মা কে নিজের কাছে ডেকে নেয় । ঈশ্বরপুরে এসে সে এখানকার লোকজন, প্রকৃতির ভালোবাসায় জড়িয়ে পরে ক্রমাগত । লেখক তার কলমের জাদুতে এক অদ্ভুত মায়াজাল বুনেছেন এই ঈশ্বরপুর নিয়ে যা পাঠকদের ভাবাবে, ভালোবাসাবে ঈশ্বরপুর কে ও এখানকার লোকজন কে ।
শহুরে দেবু নিজেকে জড়িয়ে ফেলে এই ঈশ্বরপুরের ভালোবাসায় । ওদিকে দেবু এর প্রেমিকা বিবি চেষ্টা করে বিদেশে ওদের একটা ভালো ফিউচার এর জন্য । সে নিজের ও দেবুর জন্য এক স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন ও কাজের প্রস্তাব আনে । দেবু কি এই ঈশ্বরপুরের বাঁধন থেকে বেরিয়ে আসবে? না এখানে বিবি স্বার্থত্যাগ করবে? না তাদের মধ্যেকার সংঘাত এক উঁচু প্রাচীর গড়ে তুলবে । জীবনের স্রোতে চলতে চলতে তারা কী পারবে এই পাঁচিল টপকাতে? লেখক এমন ভাবে সব বর্ণনা করেছেন বইটি পড়তে গিয়ে আপনার মনে হবে যে আপনি ওই জগতে বাস করছেন । আমি এই বইটি একটু হাতে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে পড়ছিলাম, যাতে ঈশ্বরপুরে বেশিদিন কাটাতে পারি । কিছু দৃশ্য এর বর্ণনা এতটাই সুন্দর যে পাঠক নিজেই ওই দৃশ্যে পৌঁছে যাবে । এই বই এ আমার একটা প্রিয় দৃশ্য হল - যখন দেবু বৃষ্টিতে ভিজছিলো নীল ফুলের চাদরে । অসাধারণ লেখনী, আমি ওই জায়গাটা বারংবার পড়েছি ।
আর একটা কোথা না বললেই নয় এই বইটি পড়লে আপনি ভাষা সমৃদ্ধ হবেন । এই বিষয়ে বলার ধৃষ্টতা আমার নেই, তবে লেখকের বাংলা ভাষার ব্যবহার আমার বাংলা ভাষাবোধ কে সমৃদ্ধ করেছে । আধুনিক বাংলা উপন্যাসে এইধরনের ভাষার ব্যবহার আজকাল বিরল ।
দেবু ও বিবির রিসার্চ এর বিষয় ও টাও লেখক খুব বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেছেন, বিষয় জ্ঞান না থাকলে এইভাবে বর্ণনা করা যায় না । এই গভীর বর্ণনা ও খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ লেখাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে ।
শেষে বলছি কিন্তু সর্বপ্রথম এই বিষয়টি আমাকে বইটি কিনতে আকৃষ্ট করেছে , তা হলো বইটির প্রচ্ছদ । প্রচ্ছদ শিল্পী সুবিনয় দাস আপনাকে কুর্নিশ ।
বহুদিন যাবৎ আমি ঠিক এইরকমই একটা বইয়ের অপেক্ষায় যেন বসে ছিলাম। কি একটা আদর আদর বই , মন প্রাণ জুড়িয়ে গেছে আমার । গল্প শুরু হয় কলকাতাতে বেড়ে ওঠা দেবব্রত ( দেবুর) ঈশ্বরপুর নামে একটি গ্রামের স্কুল ম��স্টারের চাকরি পাওয়ার মধ্যে দিয়ে । দেবু অত্যন্ত মেধাবী একটি ছাত্র ,গণিতে তার বিশেষ দখল , তা সত্ত্বেও চাকরির আকালের স্বীকার সে,বেকার হওয়ায় বৌদির খোঁটা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে আর বিধবা মা এর মুখের দিকে চেয়ে অগত্যা গবেষণার স্বপ্ন ছেড়ে তাকে ছুটতে হয় সেই গ্রামে । অন্যদিকে সমাজবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করা বিবি , পাগল দেবুর প্রেমে , তার দুচোখে হাজার হাজার স্বপ্ন ভাসছে তখন । বিবি গবেষণা করতে চাই সমাজবিদ্যায় সঙ্গে সে চাই এই শহর থেকে দূরে বিদেশে গিয়ে দেবুর সাথে ঘর পাততে । দুজনের স্বপ্ন গুলো একই সুতোয় বাঁধা ছিল ততদিন যতদিন না দেবু আকৃষ্ট হয়ে পড়লো ঈশ্বরপুরের মায়ায়, ঈশ্বরপুরের মানুষের স্নেহময় হাতছানি , ঈশ্বরপুরের মাটির গন্ধ , পুকুরের টলটলে জলের শব্দ, এসবে বাঁধা পরে গেল দেবু। দুটো বিপরীতধর্মী স্বপ্ন বার বার থাবা মারতে লাগলো তাদের একসাথে বানানো স্বপ্নের তাসের ঘরে । আত্মসম্মান , স্বপ্ন , পিছুটান , এই সব কিছুর বাধা পেরিয়ে কি কাছাকাছি আসতে পারবে বিবি আর দেবু ? ভালোবাসার অপেক্ষায় কি পলি পড়বে শেষে নাকি আকাশের মন ভার করা মেঘ কাটিয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে ভালোবাসা,আকাশ ছোঁবে সাফল্য? জানতে হলে পড়তে হবে বই। শব্দচয়ন ,গল্পের বর্ণনা , প্রকৃতির রূপ , সেই একটা মন কেমন করা সেকেলে প্রেমের স্বাদ আধুনিকতার মোড়কে পুরে লেখক তুলে ধরেছেন এই বইতে, এই বই সারাজীবনের জন্যে আমার মনে একটা জায়গা করে নিয়েছে । যারা খুব করে আমাকে suggestion চাইছিলে ,তাদের জন্য এই বইটা আমিও খুব করে suggest করলাম।
2024 এর শেষে শুরু করা আর ২০২৫ এর শুরুতে শেষ করা বই। প্রচ্ছদ দেখেই আগ্রহ জাগে পড়ার তারপর বেশ কয়েকজনের রিভিউ পরেছিলাম আর আজ বইটা শেষ করলাম। খুব সুন্দর গল্প।
দেবজ্যোতি স্যারের লেখা প্রথমবার পড়লাম।ভালো থাকবেন স্যার। আপনার লেখা আরও পড়তে চাই।
কি মিষ্টি প্রেমের গল্প, যাকে বলে নিখাদ। সেই পুরোনো দিনের মতো। চেনা প্লট, তবুও পড়তে ভালো লাগে। মন চায় ছুটে যাই ঈশ্বরপুর। ঘুরে বেড়াই সেই গ্রাম বাংলায়। হয়তো সেখানেই পেয়ে যাবো আমার দেবুকে।