Jump to ratings and reviews
Rate this book

জীবন আমার বোন

Rate this book
Psychedelic journey of an apathetic youth, his sister and the people around them during the political volatility of 71.

158 pages, Hardcover

First published May 1, 1976

19 people are currently reading
508 people want to read

About the author

Mahmudul Haque

20 books111 followers
Mahmudul Haque (Bangla: মাহমুদুল হক) was a contemporary novelist in Bangla literature. He was born in Barasat in West Bengal. His family moved to Dhaka after the partition in 1947. His novels deal with this pain of leaving one's home.

Mahmud gave up writing in 1982 after a number of acclaimed novels. Affectionately known as Botu Bhai and always seen as a lively figure in social gatherings, the rest of the time he was said to lead a solitary life.

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
171 (40%)
4 stars
181 (43%)
3 stars
52 (12%)
2 stars
13 (3%)
1 star
2 (<1%)
Displaying 1 - 30 of 94 reviews
Profile Image for ORKO.
196 reviews197 followers
June 20, 2023
আমার কাছে মনে হয়, মাহমুদুল হকের 'জীবন আমার বোন' বাংলাদেশের অ্যান্টি-ন্যারেটিভ ঘরানার উপন্যাসের সফলতম উদাহরণ। সচেতনভাবে দৃশ্যনির্মাণের মধ্য দিয়ে একটা সময়কে ধরে রাখা না,বরং নিস্পৃহ দর্শকের মতো দূর থেকে দেখে যাওয়াটাই 'জীবন আমার বোন'-কে করে তুলেছে অ্যান্টি-রিয়ালিস্ট। ধরুন,আপনি কাঁচা বাজার করতে গেছেন। ঝুড়ির মধ্য থেকে দড়ির জাল পেরিয়ে গলা বাড়ানো মুরগি,মাছের আঁশটে গন্ধ, থাবা চাটতে থাকা বিড়াল, একদাম একশো একদাম একশো করে চেঁচাতে থাকা বিক্রেতার আওয়াজি গলা,
নাগমণিরাজ-অশ্বগন্ধা-ভৃঙ্গরাজের সাথে জোঁকের তেলের পসরা সাজিয়ে বসা দোকানি আর তাকে ঘিরে ধরা উৎসুক জনতা,এক কোণায় সাপের খেলা দেখাচ্ছে সাপুড়ে,কালাচ সাপের উদ্যত ফণা উঁকি দিচ্ছে বাক্স থেকে—এরকম অজস্র দৃশ্য মুহূর্তে আপনার মাথায় ভিড় জমায়। এর মাঝেই কোনো এক পকেটমারকে সুযোগ পেয়ে বেদম পিটিয়ে দিচ্ছে পাবলিক।আপনার ঘাম গড়াচ্ছে দরদর করে। অথচ দু'চার ঘা লাগিয়ে দেয়ার জন্য আপনার হাত নিশপিশ করছে না। এই নিদারুণ ক্লস্ট্রোফোবিক অবস্থায় দুম করে বোমা ফাটলো। প্রাণ বাঁচাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌড়াতে থাকলো সবাই। অথচ আপনি নির্বিকার। দাঁড়িয়েই আছেন। কিছুতেই কিছু আসছে বা যাচ্ছে না। 'জীবন আমার বোন' উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র খোকার অবস্থা ঠিক এই রকম।খোকার মুখ দিয়ে প্রবহমান ঘটনার নির্লিপ্ত বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন মাহমুদুল হক।যা কিছু মহৎ-সৎ-বাঞ্ছিত তাকে তুচ্ছ করছেন, তাচ্ছিল্য করছেন,ঠাট্টা-বিদ্রূপে জর্জরিত করছেন। প্রেম,ভাই-বোনের সম্পর্ক,সব রকমের রাজনীতি,দেশপ্রেম, স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন,বন্ধুত্ব সবকিছুই জীবন আমার বোনে হয়ে উঠেছে ঠাঠা হাসির নির্মম মকারি।

❝রাজনীতির ব্যাপারটাই আগাপাশতলা একটা জমকালো ছেনালি; একজন শিক্ষিত নাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে তার পুরোপুরি ধারণা থাকলেও ভোটার লিস্টে সে তার নাম তোলে নি। রাজনীতির ব্যাপারটা তার কাছে শিকার ফসকাতে না দেওয়া হুবুহু সেই মাদামোয়াজেল ব্লাশের মতো......... ট্যানারি শ্রমিকরা রাজনীতির বোঝেটা কি, গিনিপিগ এক একটা। হাতের কবজিতে যারা সর্দি মোছে, এখনো যাদের পা গড়িয়ে পেচ্ছাব পড়ে, সেইসব হাফপ্যান্ট পরা ইস্কুলের গালটেপা ছেলেরাও চৌরাস্তার মোড়ে মোড়ে দীক্ষা দিচ্ছে। কোথায় আমেরিকা কোথায় চীন আর কোথায় ফৈজুদ্দিন ব্যাপারি প্রাইমারি স্কুলের লালট-মার্কা ছেলে; কোন অন্ধকারে বসে কে বিধাতার মতো কলকাঠি নাড়ছে ওরা তার সবকিছু বোঝে। ধর্ম আর রাজনীতি ব্যবসার রাঘব বোয়ালরা ভেজাল ওষুধের কারবারি কিংবা পচা মাছ বিক্রেতার চেয়েও জাতে নিকৃষ্ট –এই জ্ঞান যখন টনটনে হয় ততোদিনে সংগ্রামী ছাত্রজীবনের আয়ুও শেষ, অতএব কোমরে গামছা বেঁধে সি.এস.এস. অথবা ঐ জাতীয় একটা কিছুতে ঝপাং করে লাফ না দিলে পাপস্খলনের সুযোগ তাদের জন্যে বারবার ফিরে আসে না।❞

অ্যান্টি-ন্যারেটিভের ধারায় জীবন আমার বোন 'হ্যাপেনিং' হয়ে উঠেছে। ৭১ এর অগ্নিঝরা মার্চের অস্থির শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি জীবন আমার বোনের কেন্দ্রীয় শিল্প উপাদান। ঘটনার পর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আর মাহমুদুল হক চোখের সামনে ঘটা সেইসব দৃশ্যকে সংরক্ষণ করছেন। চোখ দুটোকে ক্যামেরার মতো ব্যবহার করে সযতনে দূরত্ব বজায় রেখে তিনি খোকার বিযুক্ত জীবনকে পোর্ট্রে করছেন। জীবন আমার বোনের তাই কোনো সুনির্দিষ্ট প্লট নেই,চরিত্রের মুন্সিয়ানা নেই। আর সংলাপ?এই উপন্যাসে সবাই কথা বলে এক কেতাবি ভাষায়। এটাই হলো 'দ্য হ্যাপেনিং' এলিমেন্ট। মাহমুদুল হকের কাব্যিক ভাষা,ঘটনা নিয়ে প্রতিক্রিয়া বিবশ করে দেয়। মনস্তাত্ত্বিক দৃশ্যাবলিও পেয়ে গেছে শরীরীভাষা। ট্রানজিস্টার হয়ে গেছে বনবিড়াল,কালিবাড়ি হয়ে গেছে শিয়ালমুখো আনুবিস। অ্যান্টি-ন্যারেটিভের ফাঁদে পড়ে ভাষা এক পর্যায়ে গিয়ে প্রায় বিপর্যস্ত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার জগতের বিলয় ঘটেছে,আবার কিছু ক্ষেত্রে ভাষা হয়ে উঠেছে অভিজ্ঞতা বর্ণনার শৈল্পিক মাধ্যম।

এই হ্যাপেনিং ধারার পাশাপাশি রেফারেন্সের চোরাগোপ্তা স্রোতও 'জীবন আমার বোন' নদীর একটা অংশ।ইউলিসিসের সমুদ্রগামী জাহাজ,কাফকার গ্রেগর সামসা,বোদলেয়ারের কবিতা থেকে বুলেটবিদ্ধা আনোয়ারা,অর্ধেন্দু দস্তিদার,প্রীতিলতার বিষপান,মতিউর রহমানের প্লেনক্র্যাশকে ধারণ করে সামগ্রিকভাবে মকারিস্বর্বস্ব চিত্র হয়ে উঠেছে জীবন আমার বোনের কোনো কোনো অনুচ্ছেদ।



বাংলাদেশ, তুমি শুয়ে আছো অর্ধেন্দু দস্তিদার হয়ে, থেকে থেকে কাতরাচ্ছো, বোমা বিস্ফোরণে নিদারুণ ক্ষতবিক্ষত তোমার মুখ; তোমার মুখ পুড়ে গেছে। বাংলাদেশ, তুমি মরে গেছ প্রীতিলতার মতো বিষপান করে। বাংলাদেশ, তুমি বুলেটবিদ্ধা আনোয়ারা, কোলের শিশুকে স্তন দিতে চাও? বাংলাদেশ, তুমি রাক্ষুসি, একটা শালিকের মতো শিকার করেছ মতিয়ুরকে। বাংলাদেশ তুমি কারফিউ, গভীর রাতে যার বস্ত্রহরণ করতে গিয়ে মারা পড়েছি আমরা। তুমি টর্নেডো, বাংলাদেশ তুমি সাইক্লোন, বারবার সমুদ্রে ভাসিয়ে দাও তুমি আমাদের, হাঙরের পাকস্থলীতে বসে সুর করে তেলাওয়াত করি আমরা। তুমি গর্ভিণী পুলোমা, বাংলাদেশ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে রাক্ষস কাম, একটু পরেই সে তোমাকে বলাৎকারের চণ্ড লালসায় হাত মুচড়ে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে গভীর নিভৃত অরণ্যে। বাংলাদেশ তুমি কিছুই নও, আবার তুমি সব; তুমি বাংলামদের একটা বোতল, মাতাল হবার তুঙ্গ অভিপ্রায়ে খালি করে গড়িয়ে দিয়েছি তোমাকে, এখন পায়ে পায়ে গড়াবে তুমি। বাংলাদেশ তুমি একটা সস্তা মদের দোকান, কে শুঁড়ি কে বা তার সাক্ষী তার কোনো হিসেব নেই সেখানে। বাংলাদেশ তুমি একটা ছমছমে ঘুটঘুটে বেশ্যালয়, যার সব কুঠরি এক একটি বেলীর বাগান, যেখানে কখনো কাউকে ভূতে পায়, যেখানে জং ধরা কব্জার মতো কর্কশ হিজড়েরা খ্যামটা নাচে, যেখানে ষাট বছরের বেতো মাসি নাঙ ধরে, যেখানে তোবড়ানো বদনায় সাতনরীর হার ঝুমকা অনন্ত কানপাশা, যেখানে তাস পাশা জুয়া কড়িখেলা, যেখানে উপদংশ আর সন্ন্যাস রোগ, যেখানে শিকড় তুকতাক ঝাড়ফুঁক ঢোলের মতো মাদুলি, যেখানে ক্ষুধার্ত কাকের ঠোঁটে গর্ভপাতের লাল নাড়ি, যেখানে ঝুলকালিধরা ঘুলঘুলির টিমটিমে প্রদীপের শিখা বরাবর উদ্বন্ধনে ঝোলা জোড়াপা শূন্যে দোল খায়। লাল পেটিকোটের কষি আলগা করে বজবজে ঠাণ্ডা কুয়োতলায় নীল সবুজ শ্যাওলায় উদোম
বুকে-পিঠে-বগলে ভোসা কিংবা গামছা কিংবা ছোবড়া কিংবা চিবানো শজনে কিংবা দূর্বা কিংবা চড়ুইপাখির বাসা ডলছ তুমি, বাংলাদেশ তুমি একটা লক্ষ বছরের বেতো ডাইনি মাসি, ঘেয়োকুত্তার মতো নাঙ ধরেছ এক হাজার, ঘাটের মড়ার মতো নাঙ ধরেছ এক হাজার, ধোয়াঘাটের মুলোর মতো নাঙ ধরেছ এক হাজার, আর তোমার থলথলে পেটের রবরবা চর্বিতে সুড়সুড়ি না দিয়ে, তোমার সিংহমার্কা তামার পয়সা লালপলা আর কড়িগাঁথা ঘুনসি জড়ানো গরুর গাড়ির চাকার ক্ষতে দুষ্ট কোমরের খরখরে তেঁতুলবিছায় তেল মালিশ না করে, খালপাড়ে যাবার অছিলায় বদনা হাতে সেই সব নাঙ ফতুর করে দিয়েছে তোমাকে তিন হাজারবার!

মাইগ্রেশন টু নো হোয়্যার, তুমি একটা ছবি বাংলাদেশ; কতগুলো খঞ্জ—যাদের দেহ যুদ্ধের একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, ক্রাচে ভর দিয়ে উড়ে চলেছে হাওয়ায়, সম্মুখে দিগন্ত, যা অসম্ভব ধূসর মূক ও বধির, তীব্রভাবে ছুটছে। হাওয়ার উজানে ছিন্নভিন্ন মলিন পোশাকের পাল তুলে দৃপ্ত খেলোয়াড়ের মতো বারবার নেচে রুগ্ন দিগন্তের অন্ধকার পরিব্যপ্ত বিশাল অনিশ্চয়তার কুহকে ছুটে চলেছে। এখন আর তুমি মোদিল্লিয়ানির সেই দীর্ঘায়িত সুঠাম রতিমঞ্জরি নও, আত্মতৃপ্ত নির্ভার নিদ্রার আলস্যে যা মদি��ার কুঞ্জ হয়ে আছে (নিদ্রা তার নগ্নতাকে ঢেকে রেখেছে, ল্যাট্রিনে বসে একদিন মনে হয়েছিল কথাটা) পুরু বিছানায়, যেখানে একটি টিকটিকিও এখন ঠিক ঠি�� ঠিক করে উঠবে না পাছে শিরশিরিয়ে ওঠে আলস্যময় নিদ্রা; এমন কী নির্দয় নিয়তি যে—শুধুমাত্র একটি দোমড়ানো সেপ্টিপিন কুড়িয়ে পরম সার্থকতায় ফিরে যাবে সেও।


এই অ্যান্টি-ন্যারেটিভ উপন্যাসকে মোটাদাগে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস বলতে সমালোচকের সিদ্ধহস্ত। মুক্তিযুদ্ধ এখানে প্রাসঙ্গিক বটে,কিন্তু জীবন আমার বোন টপ টু বটম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আখ্যান নয় মোটেও। বরং জীবন আমার বোন চরম মানসিক বিপর্যয়কর অবস্থার ভেতর নিরুপদ্রব জীবনের জন্য আকাঙ্ক্ষাতাড়িত এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় বেকার যুবক আর তার চারপাশের মানুষের জীবনযাপনের শৈল্পিক ক্যানভাস।
Profile Image for Nusrat Mahmood.
594 reviews737 followers
November 2, 2017
যে বই পড়ে ঘোরে চলে যেতে হয় এবং ঘোর কাটতে দু-তিনদিন চলে যায় সেই বই পড়ার অনুভূতি প্রকাশ করাটা কঠিন, বেশ কঠিন। এর আগে মাহমুদুল হকের ছোট গল্প পড়েছি। সেখানেই বলতে গেলে মোটামোটি বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম। জীবন আমার বোন বইটা সেই অল্প কয়েকটা বইয়ের একটা যার ব্যাপারে প্রশংসা বাদে অন্য কিছু আজ পর্যন্ত কানে আসেনি। বিপরীত প্রতিক্রিয়া পেয়েছি বা যাদের কাছ হতে পেয়েছি তারা কারণগুলো ঠিকমতো ব্যখ্যা করতে পারেননি তাই সেগুলো গোণায় ধরলাম না।

খোকা চরিত্রটা কি যত্ন ও অবহেলা একই সাথে লেখক এমন সুনিপুনভাবে আঁকলেন তা ভেবে আমার আশ্চর্য লাগে। আমি খোকার সাথে নিজের একটা সম্পর্ক খুজে পাই কারণ কোথাও না কোথাও আমি খোকার মতোই। এই যে একটা আসন্ন যুদ্ধ, তারপরও কি নির্লিপ্ততা নিয়ে খোকা ঘুরে বেড়ায় এ আমার রোজকার গল্প। আমার মনে হয় খোকা জানে তাকে কি করতে হবে এবং তা এড়ানো সম্ভব না জেনেই সে বারবার দেশের সংজ্ঞা খুঁজতে বের হয়। তার জীবনে আছে নীলা ভাবীর বেডরুম, লুলু চৌধুরীর খসে পরা আঁচল, বেলীর ব্লাউজের অন্তরালে থাকা রহস্য - এগুলো আশ্রয় করে, প্রত্যাখ্যান করে এক এক সময় এক এক ভাবে খোকা নিজেকে প্রকাশ করে। বন্ধুত্বের বেড়াজালে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে জানে আবার ছেঁড়েছুড়ে চলে আসতেও জানে।

নারী চরিত্রএর ভুমিকা নিয়ে যথেষ্ট খচখচানি থাকলেও কেন জানি প্যাঁচাতে ইচ্ছা করেনা কারণ পড়তে গিয়ে মনে হয় সব গল্পের প্রয়োজনে নিজ নিজ জায়গায় ঠিক সময়ে ঠিকভাবে উপস্থিত ছিল। সেক্সিজম দোষে দুষ্ট তাই মানতে গিয়েও মানিনা।

আফসোস কি জানেন? জীবন আমার বোনের মতো বই থাকা সত্ত্বেও পত্রিকায় আমাদের নায়ক নায়িকাদের এক হুমায়ূন আহমেদের হিমু আর মিসির আলী বাদে কখনো অন্য কোন বইের কথা উল্লেখ করতে দেখলামনা। মাঝে মাঝে জিনিসটা ভাবায়। মাঝে মাঝে মনে হয় সবকিছু সবার জন্য না, সবাই সবকিছু ধারণ করতেও পারেনা।
Profile Image for Shuhan Rizwan.
Author 7 books1,107 followers
May 1, 2016
মাহমুদুল হকের প্রথম পড়া বইটি ছিলো তার অগ্রন্থিত গল্প। লেখার তুঙ্গে থেকেও কলম ত্যাগে যে রোমান্টিক মিথ গড়ে উঠেছে তাকে ঘিরে, অগ্রন্থিত গল্পে তার সত্যতা আমি পাই না। ওভাবেই থেকে যাই বিচ্ছিন্ন আরো কিছু ছোটগল্প পাঠ করে।

তবু তার সমস্ত উপন্যাস, প্রশংসায় যারা বিপুল স্নাত, পড়তে বসে যাই। এশিয়ায় চলমান অদ্ভুত দাবদাহ, ভীতি আর রক্ত সয়ে যাওয়া দেশ, আর নিস্পৃহ জনপদের ছায়া স্ক্রল করে আবিষ্কার করি, জীবন আমার বোন।

ট্রানজিস্টার সেখানে বনবেড়াল, সেখানে দেশ পুড়লেও নীলাভাবীর সমস্ত বয়স এলোমেলো করা যায় দুহাতে। সেখানে প্রতিটি চরিত্র, এতোদিন পরেও ফিরে এসে আমাদের চারপাশের দখল নেয়। যেখানে, যেভাবে গোরভিদাল আর সোফিয়া লরেন জায়গা নেয় রেক্সে, সেখানে-সেভাবেই জাদুকর হয়ে ওঠেন মাহমুদুল হক।

মহৎ সাহিত্যের একটি বৈশিষ্ট্য, মনে হয় যে, তা পড়লে, বলতে ইচ্ছা হয় কিছু। ফোনের স্ক্রিন চেপে ভাব প্রকাশের সেই ক্লান্তিকর অপর্যাপ্ত চেষ্টা আবারো পুনরাবৃত্ত করবার প্রয়াসে মাহমুদুল হক, আপনার কাছে ফিরে আসবো নিশ্চয়ই।
Profile Image for Daina Chakma.
440 reviews772 followers
February 26, 2018
"খোকা শিউরে উঠলো, এতদিন তার কাছে যা ছিল দয়িতা, যামিনী, মদিরার মতো তিন অক্ষরের হালকা পালকে মোড়া পাখির মতো নিছক একটি রোগা শব্দ, এখন তা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়েছে শহরময়, জনতা!"


কি প্রচন্ড শক্তিশালী কথা! কোট করার লোভ সামলানো গেলনা। অবশ্য কোট করতে গেলে পুরো বইয়ের অর্ধেকটাই কোট করতে হয়।

জীবন আমার বোন গল্পটা ঠিক একাত্তরের নয়। বরং বলা চলে একজন নির্লিপ্ত তরুণের সাইকেডেলিক ভাবনা। কিংবা গল্পটা মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সংকটময় সময়ের, যা খোকা নামক একজন উদাসীন যুবকের চিন্তাজগতের ক্যানভাসে প্রকাশ পেয়েছে। খোকা যেন ঠিক তার সময়ের কেউ নয়। খোকা কখনো চায়ের কাপে দেশ উদ্ধার করা উত্তপ্ত যুবক কিংবা রাস্তাপথে নেমে মিটিং মিছিলের স্রোতে ভাসা জনতার দলে ছিল না। খোকা থ্রিজি কিংবা ফোরজি যুগের "I hate politics" থিওরিতে বিশ্বাসী একজন ঘুণেধরা তরুণ।

মাহমুদুল হক প্রচন্ড শক্তিশালী একজন লেখক। সম্মোহিতের মতো পড়ে যেতে হয় তাঁর লেখনী। কখনও কখনও শব্দের তীব্র আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে হয়। আবার কখনও অদ্ভুত ঘোরের ভেতর চলে যেতে হয়। বইটা শেষ করেছি কাল রাতে। অথচ নতুন একটা সকালেও সেই ঘোর থেকে বের হতে পারছিনা।
Profile Image for Nabila Tabassum Chowdhury.
373 reviews274 followers
January 25, 2016
একটি লেখাকে রিভিউ হিসেবে গণ্য হবার জন্য গুডরিডস রিকোয়ারমেন্ট কমপক্ষে ৫০ শব্দ। 'জীবন আমার বোন' অল্প কিছু বাংলা বইয়ের মাঝে একটি যেখানে এই রিকোয়ারমেন্ট ফুলফিল করে এমন সাতটি রিভিউ রয়েছে। যা 'হাজার বছর ধরে'রও নেই, ( বইটি পড়তে আমার প্রজন্মের সবাই মোটামুটি বাধ্য হয়েছিল), পথের পাঁচালীর ও নেই (যে বই ভাল লাগেনি এমন কোনো মানুষ আমি এখনও বাস্তবে দেখিনি)।

ওয়েল-ডিসকাসড এই বইটি নিয়ে প্রায় সবকিছু বলে ফেলা হয়েছে। বলা হয়েছে মাহমুদুল হকের পাঠককে ঘোরগ্রস্ত করে ফেলার মত লেখনীর কথা। বলা হয়ে গেছে কাপুরুষতার প্রকাশে পিছু না হটার কথা। বলা হয়ে গেছে মানুষ হিসাবে মানুষের অক্ষমতা, দুর্বলতা আর অসহায়ত্বের নগ্ন প্রকাশের কথা।

সমালোচনার ক্ষুদ্র জায়গায় কেউ বলেছেন সেক্সিজমের কথা। বইটাতে সেক্সিজম আছে। এক রঞ্জু ছাড়া আর কোনো নারীরই 'চরিত্র' নামক কিছুর কোনো বালাই নেই। সেক্সিজম এমনভাবে আছে যেন দেহ দিয়ে পুরুষকে ভোলানোই নারীর প্রথম এবং প্রধান কাজ। কিন্তু সেই সেক্সিজম লেখকের নয়। সেক্সিজম খোকাবুর। এটা তার সার্থক চরিত্রায়ন। তাই লেখককে রেহাই দিলাম এই অপরাধ থেকে।

তথাপি সেক্সিজমের দোষ থেকে লেখককে রেহাই দিলেও বইয়ের জেন্ডার নির্ধারণের দায়ভার থেকে লেখককে রেহাই দেয়া সম্ভব হলো না। একটি বইয়ের ক্লীবলিঙ্গ হবার কথা থাকলেও মাঝে মাঝে বইয়ের স্রষ্টারা বইকে একখানা বিশেষ লিঙ্গ প্রদান করে থাকেন। সেক্সিজমের সাথে এর ক্ষুদ্র প্রভেদ রয়েছে। সেক্সিজমে একটি বিশেষ সেক্সকে হেয় করা হয়ে থাকে, তুলনামূলকভাবে অন্যটিকে মহত্ত্ব প্রদানের মাধ্যমে। আর জেন্ডার নির্ধারণের ব্যাপারটি একটু ��লাদা। নারী-পুরুষ মনের কিছু অনুভূতি রয়েছে যা একেবারে অনন্য। ভেন ডায়াগ্রাম করলে যা একে অপরকে স্পর্শ করবে না। আবার কিছু অনুভূতি সার্বজনীন। ভেন ডায়াগ্রামে যা একটি আরেকটিকে স্পর্শ করে থাকে। যখন একটি বইয়ের অনুভূতির প্রাধান্য রচিত হয় ভেন ডায়াগ্রামে বিশেষ একটি জেন্ডারের স্পর্শ না করা অনুভূতিটুকু নিয়ে তখন বইটির জেন্ডার নির্ধারিত হয়ে যায়। এই বইটির জেন্ডার দুঃখজনক ভাবে আমার জেন্ডারের বিপরীত। তাই খুব সম্ভবত আমার ঘোরগ্রস্ততা পাঁচতারা স্পর্শ করে না। কাপুরুষতার প্রকাশ আমাকে পাঁচ তারা পরিমাণ কাবু করে না। দুর্বলতা, অক্ষমতা এবং অসহায়ত্বের নগ্ন প্রকাশে আমি পাঁচতারা পরিমাণ বিচলিত হয়ে পড়ি না।

শেষ কিছু পাতা বাদে বইটির সময় কাল মার্চ, ১৯৭১। সারাটা সময় ধরে খোকাবাবু মুক্তির সংগ্রামকে পাশ কাটিয়ে চলার কঠিন প্রচেষ্টার পরও এটি নিজের জায়গা করে নেয় তার ভাগ্য-বিধাতার আসনে। এই ব্যাপারেও খুব বেশি কিছু না লিখেই পারলাম, সাহায্য করলো পেরিক্লিসের পাঠকপ্রিয় উক্তি - “Just because you do not take an interest in politics doesn't mean politics won't take an interest in you. ”। শুধু ছোট্ট একটা ইম্প্রোভাইজেশন হবে, 'পলিটিক্সে'র জায়গায় 'টাইম' বসবে।

এই, এতটুকুই।
Profile Image for Rifat.
501 reviews329 followers
June 7, 2023
Psychedelic journey of an apathetic youth, his sister and the people around them during the political volatility of 71. যিনি বইটিকে গুডরিডসে এড করেছিলেন তিনি ডেস্ক্রিপশন বক্সে এই লাইনটিই লিখেছেন। গত পরশু যখন বইটা পড়া শেষ করে কিছু লিখতে বসলাম তখন বই সম্পর্কে আসলে কী লিখবো তা মাথায় আসছিল না, কেননা আমি দিশেহারা ছিলাম। হুট করে যখন আজকে লাইনটা দেখলাম তখন মনে হলো- তাইতো! এটাই তো। মুক্তিযুদ্ধ আসলে একটা প্রসঙ্গমাত্র, কালরাত্রি উপন্যাসের ইতি টানার একমাত্র উপায়! নইলে মাহমুদুল হক যেভাবে শব্দের পর শব্দ জুড়ে পাঠককে এক মিহি অথচ তীব্র সুরে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন তা থেকে বের হওয়ার উপায় ছিল না। শব্দের ব্যবহারে পারদর্শিতা কী ভীষণ অদ্ভুত! এজন্যেই বুঝি ভাষা সাহিত্যের এত কদর!

মাহমুদুল হকের "জীবন আমার বোন" আমার কাছে সাধারণ সত্ত্বার প্রতিফলন হিসেবে ধরা দিয়েছে। সময়কালটা ৭১ এর শুরুর দিকে হলেও আসলে মুক্তিযুদ্ধ উপন্যাসের মূল অংশ নয়। উপন্যাসের মূল অংশ বছর বাইশের অতি সাধারণ ব্যক্তিত্বের খোকা আর খোকার মাথায় চলতে থাকা শব্দের ঝড় যার কাছে গিয়ে আমরা বুঝতে পারি সত্যিই সে খুব সাধারণ। কেননা এত অস্থির সময়ে হেঁটে চললেও তার মনে হয় এসব রক্তারক্তি কিংবা যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই কাজেই যুদ্ধে যাওয়ার কিংবা ট্রেনিং নেয়ার তাড়না তারমধ্যে মাথাচাড়া দেয় না; ঠিক যেমন এই সাধারণ আমাদের পথ চলতে মনে হয় মৃত্যু আমাদের দ্বারে আসবে না, আমাদের শরীর বহন করা কোনো যান দুমড়েমুচড়ে যাবে না! অতি সাধারণ মানুষের মতোই খোকার মস্তিষ্কে শুধু খোকাই, আর আছে ওর অতি আদরের বোন রঞ্জু, শান্ত তিরতিরে পুকুরের গভীরে জড়াজড়ি করে থাকা অঞ্জু আর মঞ্জু, আর দরজায় খিল দেয়া একটি নির্লজ্জ দুপুর যে দুপুরে উষ্ণতা ছড়িয়ে ছিল নিজের থেকে বছর দশের বড় নীলাভাবী। যেহেতু পুরো বইটি খোকার মাথায় চলতে থাকা গল্প কাজেই খোকার সব নারীকেই বেলী বাগানের সদস্য ভাবাকে তেমন কিছু মনে হয় না।

৩য় মাহমুদুল হক পাঠ। ঘোর লাগানিয়া, খরস্রোতা নদীর মতো অবিরাম বয়ে চলেছে যেন!


৭ জুন, ২০২৩
Profile Image for Nadia Jasmine.
213 reviews18 followers
March 25, 2021
মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ পড়া অজানা এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে। তিনি শব্দের ও সংলাপের সিঁড়ি দিয়ে পাঠককে ক্রমাগত এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যান যে নিজেদের দৈনন্দিন সংলাপ ও অনুভূতিকে খুব যাচ্ছেতাই মনে হয়। মনে হয়, যে আহা, এমন করে কথা বলা বা এমন ভাবে চিন্তারা কেন আমাদের মধ্যে তাঁর মতো সহজাত হয়ে আসে না। অথচ, শব্দের অলি-গলি পেরোতে থাকা আমরা ঠিকই একটা গল্পে ঢুকে যাই, তা হয়তো অতো ঘটনাবহুল নয়, কারন, গল্প চলছে খোকার মাথায়। তাঁর চোখ দিয়ে আমরা এমন এক সময়কে দেখতে থাকি, যা নিয়ে আমাদের চিন্তার মধ্যেও ছিল না যে ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ বাদে ঐ সময়ে খোকার মতো কেউও ছিল। কারন, যুদ্ধের এই সময়ের কথা ভাবলেই আমাদের মনে ভাসতে থাকে আতংকগ্রস্থ মানুষের নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য বর্ডার পার হওয়া এবং যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণে নিজেদের নিবেদিত করা সে সময়ের যুবসমাজ। কিন্তু, খোকা যুদ্ধে যাওয়া নিয়ে বা পাকিস্তানীদের তাড়ানো নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল না। তাঁর জীবনে রঞ্জু, তাঁর বোন সবটা জুড়ে আছে, আর নীলাভাবীর প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে কাটানো একটি দুপুর আছে। এর মধ্যে খোকার নির্লিপ্ততা ও পলায়নপ্রবণতাকে পাত্তা না দিয়েই এক সময়ে যুদ্ধ চলে আসে।

খোকা এমন দেখেই তাঁর সাথে একাত্নবোধ না করা মুশকিল। একাত্তর যে একাত্তর হবে, তা তো সে জানতো না। ঠিক যেমন আমরা জানতাম না, মহামারী কখন অতিমারী হয়ে যাবে বা এরপর কি হবে। সমস্যা হল, পালাতে থাকা এবং না থাকা দুইজনের উপরেই যে ভবিতব্য ভর করে, এটাই লেখকের শব্দজালে যাকে ইন্দ্রজাল বললে অত্যুক্তি হয় না তাতে আমরা দেখতে থাকি। শেষে যখন খোকা নিজের স্খলনের জন্য একচেটিয়াভাবে মেয়েদের ‘চারিত্রিক ত্রুটিকে’ দোষারোপ করতে থাকে, তখন তাঁর অসচেতন চিন্তা অতোটা মেজাজ খারাপ করে না। কারন, খোকাকে সুদূরপ্রসারী চিন্তা করার মতো কেউ মনে হয় না। বরং, এটাই বোঝা যায় যে গভীর ভাবনার চেয়ে অতি আবেগই তাঁর বেঁচে থাকার মূল সম্বল।

লেখক এমন এক চরিত্র তৈরি করেছেন, যাকে সিরিয়াসলি নিলে চরিত্রের চিন্তাভাবনাও ধারণ করতে হয়, যা জরুরী মনে করি নি। খোকার মতো ভাবনায় থাকা মানুষেরা আসলেই ছাপ ফেলে না, তা লেখক নিজেই বলেছেন। নির্ভার খোকার জীবনের পরিক্রমা নিয়ে লেখকও নির্লিপ্ত, কারন, হঠাৎ জেগে উঠে তছনছ করে সব পাল্টে দেওয়া কারোর গল্প তিনি বলতে চান নি। এমন সাধারণ একটা চরিত্র তৈরি করতে হলে ভেতর থেকে উচিৎ-অনুচিতের অনেকটুকু ফেলেই তৈরি করতে হয়। কিছুটা খোকার মতোই সব বিচারের আওতায় না এনে শুধু দেখে যেতে হয়।’জীবন আমার বোন’ একারনেই সবসময়ে প্রাসঙ্গিক থাকবে। যুদ্ধের আগের সময়টা নিয়ে এমন এক কাহিনী মাহমুদুল হক বলেছেন, যা সব কালকে এবং যুদ্ধে আক্রান্ত হতে পারে এমন সব দেশের (সেটা কোন দেশ না?) এক উদাসীন এবং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা কারোর মনে উঁকি দেয়, যার কোন দোষ নেই, কিন্তু, টিকে থাকার রসদও নেই।
Profile Image for SH Sanowar.
118 reviews29 followers
February 12, 2024
জীবনের এতোগুলো শরৎ হেমন্ত পার করে ক'বারই বা জোর দিয়ে বলতে পেরেছি, 'আমি জীবনে সঠিক সময়ে এই ঠিক কাজটাই করেছি!?' মনে নেই। হয়তো একবারও না! কিন্তু "জীবন আমার বোন" পড়ে আমার সেই অনুভূতি হয়েছে। এখন আমি বলতে পারি, এই বইটি শেষ করার মতো মহৎ কার্যটি ঠিকঠিক সময়েই সমাধা করেছি। এই বইটা পড়ার জন্য এরচেয়ে ভালো সময় বোধহয় আর হয়না। মাহমুদুল হকের ঘোরলাগা ভাষায় সময়ের বৈতরণী পার হয়ে আমি যেন অন্য একটা সময়ে ভ্রমণ করে এলাম। মাথাভর্তি রোদ নিয়ে হেঁটে বেড়ালাম খোকার সাথে যুদ্ধপূর্ব টালমাটাল অস্থির সময়টাতে। মাহমুদুল হক এমন ঘোরলাগা ভাষায় গল্পের বয়ান করলেন, মনে হোলো কেউ কানের কাছে মুখ রেখে গড়গড় করে মন্ত্র পড়ে যাচ্ছে আর আমি ঘোরগ্রস্তের মতো মুগ্ধ হয়ে তার মন্ত্র���াঠ শুনছি৷ আর লেখায় উপমার ব্যবহার? 'অন্ধকারে হাত-পা ছুড়ে পিংপং খেলার মতো' যা 'ঘুমের ভেতরে বালকের পেচ্ছাবের' মতো অলক্ষ্যে বয়ে যায় আরোপিত কোনো ভাব ছাড়াই।


"জীবন আমার বোন" পড়তে পড়তে আমার নিজেকে কখনো খোকা কখনো মুরাদ কখনো ইয়াসিন কিংবা রাজীব ভাই মনে হয়েছে। আমি মানেই যেনো সবাই, সবার ভেতরে আমি আছি। আর সবাই মানেই যেনো আমি, আমার ভেতরে সবাই আছে। পড়তে পড়তে রঞ্জু মঞ্জু অঞ্জুকে মনে হয়েছে আমারই বোন। বিবিধ ভাবনা চঞ্চল করেছে চিত্ত। এমন ভাবনাও এসেছে, জীবন আসলে কী? ‘আসলে জীবন মানেই শৈশব। জীবনভর মানুষ ওই একটা ঐশ্বর্যই ভাঙিয়ে খায়, আর কোন পুঁজি পাট্টা নেই তার।’ আর শৈশব কী? শৈশব হলো যা হারিয়ে যায়, যা তলিয়ে যায়; যার বিভ্রম মাথায় নিয়ে মানুষ সারাজীবন পার করে। শৈশব হলো হারানো কয়েন, শ্যাওলায় ঢেকে যাওয়া লাল বল, পুকুরের অতলান্তে তলিয়ে যাওয়া মঞ্জু অঞ্জু রঞ্জু। শৈশবট�� আসলে জীবন যা কেবলই তলিয়ে যেতে থাকে রঞ্জু অঞ্জু মঞ্জুর মতোই। আর জীবন হলো পুকুরের অতলান্তে তলিয়ে যাওয়া আমার শৈশব, আমার বোন। জীবনটা আসলে আমার আপনার সকলের বোন।


~১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
Profile Image for DEHAN.
275 reviews87 followers
February 7, 2020
খোকার জন্য মায়াই লাগে। অঞ্জু গেলো ,মঞ্জু গেলো । এক ছিলো রঞ্জু সেও গেলো...জীবন নামক গভীর পুকুরে সবাই ভেসে থাকতে পারে না।আর যাদের ভাগ্যে আগে থেকেই ডুবে যাওয়া নির্ধারণ করা ছিলো- হাজার চেষ্টা করেও তাদের বাঁচানো যায় না।
Profile Image for Anik Chowdhury.
175 reviews36 followers
June 23, 2023
মুক্তিযুদ্ধ যখন আর পাঁচটা উপন্যাসের বিষয়বস্তু হয় তখন সাধারণত তা উক্ত বইয়ের প্রধান বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। তার সাথে বইয়ের মূল চরিত্র হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করা বিশেষ চরিত্র। এইখানেই 'জীবন আমার বোনের' মূল পার্থক্য। এই বইয়ে মুক্তিযুদ্ধকে দেখা হয়েছে দূর থেকে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে। মূল চরিত্র 'খোকা', সে-ও দেশে এগিয়ে আসা সগ্রামকে দেখছে অনেকটা খোলা চোখে। যুক্তিতর্ক দিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলেও সে সক্রিয় নয়। আমাদের চারপাশে আমরা অনেক মানুষ দেখি, যারা ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করে, আলোচনাও করে থাকে কিন্তু সেই ঘটনার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা তা দেখা যায় না। খোকা তার নিজস্ব চিন্তার জগত তোলপাড় করে ফেলে। সেখানে যুক্ত হয় তার ছোট বোন রঞ্জু, নীলাভাবী, লুলু চৌধুরী, মুরাদ অনেকেই। লেখক সবকিছুকে নিয়ে খোকার চারিদিকে স্থাপন করে দিয়েছেন। খোকার চিন্তার জগৎতে তাই হানা দেয় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জন। নীলভাবীর মতো চরিত্র চরিত্র কত উজ্বল! বিক্ষিপ্ত চিন্তা গুলোকে জোড়া লাগানো, সংসারের যাঁতা কলে পিষ্ট হয়ে যখন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, সংসারে একটা সময় পর যে উচ্ছিষ্টটা থাকে তা আর কিছুই নয়, অপর জনের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানো। এরমাঝে হিজিবিজি চিন্তার শৈলী তৈরি করে গল্পের খোকা তোলপাড় করে দেয় আমাদের। তার চিন্তা, চেতনার ভিতরে প্রবেশের যে স্বাদ তা পাঠককে উপলব্ধি করে নিতে হয় গভীর চেতনার দ্বারা। ভাসা ভাসা সেসব চিন্তার জগতের সুতো ধরে গভীর এক গোলক ধাঁধায় প্রবেশ করিয়ে দেয় লেখক। শব্দ আর বাক্যের অদ্ভুত সুন্দর খেলায় লেখক মেতেছিলেন পুরো বই জুড়ে। এমন ধারার জাল বিছিয়ে লেখক পাঠকদের টেনে নিয়ে যান গল্পের স্রোতের আরো গভীরে। এই কারণে 'জীবন আমার বোন' হয়ে উঠেছে ভিন্নধর্মী।
Profile Image for Karishma Anika.
48 reviews53 followers
May 6, 2021
এখনো ঘোরের অধ্যে আছি। মাহমুদুক হক একজন শব্দের জাদুকর। এত অসাধারণ উপমাশৈলী!
Profile Image for Ummea Salma.
126 reviews121 followers
November 30, 2022
'কালো বরফ' পড়ে যদি কেউ 'জীবন আমার বোন' পড়তে বসে তাহলে মস্ত বিপদ। কারণ 'কালো বরফ' পড়ার পর আপনার expectations এত আকাশচুম্বী হবে যে কোন ভাবেই লেখকের এই ঘরনার লেখায় মন বসবে না। লেখকের লেখনী নিয়ে কথা বলার মত যোগ্যতা আমার নেই। তবে সত্যি কথা বলতে এই বই আমার জন্য না। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে টুকটাক অনেক বই পড়েছি আমি, এজন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যে কোন বই ভীষণ টানে আমাকে। সেই আগ্রহ নিয়েই basically বইটা শুরু করা। কিন্তু কোনভাবেই ভালো লাগে নাই আমার। যদিও বইটা মুক্তিযুদ্ধকালীন বই, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বই ছিলো না। শুধুমাত্র রঞ্জু আর খোকার ভাই বোনের যে একটা মধুর সম্পর্ক সেটা ছাড়া আর সবকিছুই মাথার উপর দিয়ে গেছে। নীলা ভাবির সাথে খোকার সম্পর্ক আমার কাছে স্রেফ সময় নষ্ট লাগছে। মানে এটা এই গল্পের ভিতরে না আনলেই পারতো। যুদ্ধের আগের উত্তাল সময়ের সাথে এরকম একটা জিনিস কিভাবে যায় কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকলো না।
পুরা বইটাই খুব অগোছালো। মাঝে মাঝে পড়তে পড়তে খেই হারিয়ে ফেলেছি যে আসলে ঘটনা কোনদিকে যাচ্ছে। তবে পড়ে যতটুকু বুঝেছি সেটা হচ্ছে বইটা মূলত তরুণ প্রজন্মের যুদ্ধবিষয়ক ভাবনা নিয়ে লেখা। কিন্তু শেষটুকু খুব মন খারাপ আর হৃদয়স্পর্শী।
আরো অনেক বয়স হলে, যখন নিজের চিন্তা ভাবনার আরো অনেকখানি পরিবর্তন হবে তখন আরেকবার পড়ে দেখবো, ভালো লাগাইতে পারি কি না!
Profile Image for Injamamul  Haque  Joy.
100 reviews115 followers
July 8, 2021
মাহমুদুল হক এই বইয়ে যেটা করেছে সেটাকে এক কথায় সংজ্ঞায়িত করলে দাঁড়ায়— শব্দজব্দ খেলা। যে খেলায় কোনো তিক্ততা নেই, অভক্তি নেই, যে খেলায় মাথা ধরে না, মেজাজ খিঁচড়ে যায় না। যে খেলার দরুন মন্ত্রমুগ্ধের মত পাতা উল্টিয়ে যেতে হয় গল্পের শুরু থেকে শেষ এবং ভেতরে জন্ম নেয় কিছু নস্টালজিয়া। কিছু হাহাকার। কিছু পাওয়া না পাওয়ার নেক্সাস। তৈরী হয় স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ঘৃণা। তৈরী হয় মুরাদ, ইয়াসিন, রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা। জন্ম নেয় রঞ্জু, রাজীবদের প্রতি ভালোবাসা আর সমবেদনা। আর খোকা? তার প্রতি একরাশ ধিক্কার।

জয় বাংলা।
Profile Image for Anika.
29 reviews42 followers
August 26, 2017
আমার পড়া মাহমুদুল হকের প্রথম বই। পড়তে গিয়েই মাথায় প্রথমেই আসল ইনি এক অসাধারণ কথাশিল্পী। উপমার যাদুকর বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রত্যেকটি ঘটনা ব্যাখার জন্য তুলনাহীন সব রুপক, উপমার অবতরণ ঘটাতে পারেন এই লেখক। তাঁর এই অনন্যসাধারণ লেখনশৈলীর জন্যই বইটির স্থান এক অন্য উচ্চতায় থাকবে পাঠকদের কাছে।
বইটির ঘটনা ও কিছুটা ইউনিক। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা বই শুনলেই মোটা দাগে যে কাহিনী মাথায় আসে, ঠিক সেরকম কিছু নেই বইটিতে। যুদ্ধ শুরু আগের যে দোদুল্যমান অবস্থা, মানুষের স্বাভাবিক জীবনে যে অস্থিরতা তার ই কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। সেই সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভিতরে ভিতরে কী হচ্ছে, সঠিক খবরের অভাবে মানুষের মনে যে দ্বিধা-দ্বন্দের উপদ্রব তারই প্রতিচ্ছবি মূল চরিত্র খোকা। কারো ধারণা স্বাধিকার আন্দোলন, স্বশত্র সংগ্রামই এক মাত্র উপায়, আবার কারো মনে হচ্ছে এ সব ই কিছু সংখ্যক মানুষের বানোয়াট কথাবার্তা। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম খোকা আর মুরাদের কথোপকথনে। লেখক নিজের মনের দ্বিধাই উপস্থাপন করেছেন যেন তাঁর সৃষ্ট এই দুই চরিত্রের মধ্য দিয়ে। গল্প ইউনিক, নিঃসন্দেহে তা বলা যায়, বইটি পড়ার সময় থেকে শেষ করা পর্যন্ত একটা কিন্তুভাব থেকে যায়, ঠিক বোঝা যায় না আর সে জন্যই সম্পূর্ণ স্যাটিস্ফেকশন টা আসে না।
Profile Image for Titu Acharjee.
258 reviews34 followers
April 30, 2021
এই বইয়ে অন্য এক মাহমুদুল হক'কে দেখতে পেলাম। উনার আগের বইগুলোর তুলনায় 'জীবন আমার বোন' কোথায় জানি একটু অন্যরকম, স্বতন্ত্র।
Profile Image for Shishir.
186 reviews39 followers
March 14, 2025
"খোকার মনে হয় এই তো সেই রঞ্জু, এ আমার কতো চেনা, রুপোর তোড়াপরা ঝুমঝুমি বাজানো ছোট্টবেলার সেই রঞ্জু, মুরাদ একে চেনে না, কাব্যচর্চার ঘোড়ারোগ দিন দিন বানোয়াট করে তুলেছে তাকে।

রঞ্জুর স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে খোকা স্বস্তি পায়, সুস্থ হয়; এমন স্নিগ্ধ এমন নির্মল এমন নিষ্কলঙ্ক হতে পারে কেবল করুণাধারা।"

- কিছু লেখা পড়লে বিস্মিত হতে হয়। আফসোস হয়, আগে পড়িনি বলে। এটা তেমনই লেখা। সার্থক নামকরণ, ব্রিলিয়ান্ট !!
Profile Image for Zunaed.
54 reviews119 followers
October 7, 2020
"দেশ তাহলে একটা পুকুর। অঞ্জু মঞ্জুর মত এর নিস্ততরঙ্গ নিথর তলদেশে চিরকালের মত হারিয়ে গিয়েছে রঞ্জু।"

কাল যখন পড়ছিলাম তখন আমি মেঘনার উপর। ঈদের ছুটিতে ঢাকা ফাঁকা, সেই ফাঁকে আমিও ট্রেনে চেপে বেরিয়ে পড়লাম। ভৈরব ব্রিজের উপর থেকে মেঘনার জলরাশি দেখতে দেখতে মনে হল, দেশ পুকুর না, দেশ হল মেঘনা— দেশ মেঘনার মত উত্তাল, মেঘনার মত সুন্দর, মেঘনার মত শক্তিশালী। দেশ আমার কাছে মেঘনার মত, এক সুখের অনুভূতি, যা চোখের সামনে আসতেই আমার মনে হয়, এই নদী পেরুলেই তো ব্রাহ্মণবাড়িয়া! আমার শৈশবের কৈশোরের শহর!

"জীবন আমার বোন" মাহমুদুল হকের লেখা আর আমার পড়া প্রথম উপন্যাস। প্রথম বইয়েই আমাকে মুগ্ধ করেছেন লেখক। উনার লেখায় মাঝে একবার ঢুকে গেলে আর বেরুনোর উপায় নেই। পড়তে হবে, লোকটার লেখা আরো পড়তে হবে।

উপন্যাসটা একাত্তরের মার্চে ঢাকার পটভূমিতে লেখা, খোকা নামের এক শিক্ষিত বেকারের জবানিতে। খোকার মা মারা গেছেন বছর কয়েক আগে, বাবা কর্মসূত্রে ছিলেন রাওয়ালপিন্ডি। ধানমন্ডির বাড়িতে থাকতো সে আর বোন, রঞ্জু। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় বেকার হওয়া সত্ত্বেও কাজ নিয়ে ভাবতে হয় না খোকার, কাজের মাঝে তার কাজ যখন খুশি ঘুমানো, আর যখন খুশি বেরিয়ে আশা।

রঞ্জু খোকার ছোটো বোন। সময়ে সময়ে অবশ্য বড় বোনের ভূমিকাতেও তাকে দেখা যায়। অতিরিক্ত সিগারেট খেতে থাকা খোকাকে তার শাসন, খোকার মৃত্যু নিয়ে কথায় অমঙ্গলের ভয়ে চোখে পানি চলে আসার ব্যাপারগুলো পড়ার সময় মনে হচ্ছিল, আমারও একটা বোন থাকলে খুনসুটি আর শাসনে খুব একটা মন্দ হত না!

বইটাতে বেশ কয়েকবার কাফকার মেটামরফোসিস বইটার উল্লেখ আছে। মেটামরফোসিসের গল্প গ্রেগর সামসার রূপান্তরের পরের গল্প, আর এই গল্প খোকার পরিণত খোকায় পরিণত হবার। আমি সেসময়ে ছিলাম না, কিন্তু যত শুনেছি আর পড়েছি তাতে মনে হয়েছে, সেই সময়টাতে প্রত্যেকটা বাঙালির মাঝেই মেটামরফোসিস হচ্ছিল, সকলেই যোগ্য হয়ে উঠছিল একটা সংগ্রামের জন্য, যে সংগ্রাম স্বাধীনতা এনে দেবে, মুক্তি এনে দেবে।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কাছ থেকে দাম নিয়েছে অনেক, সেই দামে আমরা কিনেছি স্বাধীনতা। মহাকালের হিসেবে ৪৫ বছর তেমন বড় সময় না। আবার একজন মানুষের জীবনকালের হিসেবে খুব ছোটো সময়ও না। আমাদের পরিবর্তন কিন্তু এখনও থেমে নেই, কিন্তু এই সময়ে আমাদের চিন্তাভাবনায় যে পরিবর্তন হচ্ছে, সেটা খানিকটা ভাবাবার মতই। পরিবর্তনটা সত্যিই ইতিবাচক, নাকি নেতিবাচক? আমরা পিছনে হাঁটছি না তো? দেশের মানুষের একটা বিরাট অংশকে যখন দেখি উগ্রবাদীদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন রাখে, একের পর এক হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে যায় কেবল মাত্র ধর্মের নাম নিয়ে এসব করা হচ্ছে বলে, তখন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় হয়। সামাজিক গণমাধ্যমের প্রসারে কতটুকু লাভ ক্ষতি হয়েছে জানি না, তবে এর কল্যাণে অনেকের মনের কদর্য রূপটা চোখের সামনে ফুটে উঠছে। কাল (২ জুলাই, ২০১৬) গুলশানের জঙ্গি হামলার পর যখন কাউকে ব্যাপারটা নিয়ে মজা করতে, কাউকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিতে, আবার কাউকে এই নিয়ে রাজনীতিতে মাততে দেখি আর যাই হোক, কোনোভাবেই নির্ভয় হতে পারি না। এইসব কথা হয়তো বইয়ের রিভিওয়ে অপ্রাসঙ্গিক। হোক, আমি তো আর রিভিও লিখছি না, সেই যোগ্যতা আমার কই? আমি লিখছি পাঠ-প্রতিক্রিয়া। পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় পাঠের সময়ের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করাই যায়।

সে যাক, শুরুর মত শেষটাও মেঘনাতেই হোক। কারণ এতসব ভয়ের মাঝেও মেঘনা আমায় সাহস দেয়। মেঘনার জলে প্রতিফলিত সূর্যকিরণ বলে, আশা আছে! এই আশা নিয়েই তো বেঁচে আছি। বাংলাদেশ মুক্ত থাকুক সকল অপশক্তির আঘাত থেকে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাক সামনে, অনেক দূরে। এদেশের নরম মাটিতে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকুক ত্রিশ লক্ষ রঞ্জুরা, অশান্ত হয়ে দেশ যেন তাদের ঘুমে কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়।
This entire review has been hidden because of spoilers.
Profile Image for Adham Alif.
334 reviews80 followers
June 27, 2023
শব্দের খেলায় মাহমুদুল হক বাজিমাত করলেন। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে আশেপাশের উত্তাল পরিবেশ। সে সময়কে ছাপিয়ে গল্পের মূল চরিত্র খোকার ভেতরে চলা উথাল-পাথাল অনুভূতির আচ পাই আমরা। নীলাভাবি, রঞ্জু, বেলী, মুরাদ কিংবা রাজীব ভাই একেকটা চরিত্র সেই অনুভূতির উত্তপ্তটা বাড়িয়েই যায় কেবল। আমরা জানতে পারি মানুষের একান্ত ব্যাক্তিগত অনুভূতির নাম "যন্ত্রণা"। যন্ত্রণার চেয়ে নিজস্ব কোনো অনুভূতি নেই।
Profile Image for Syeda Ahad.
Author 1 book131 followers
May 25, 2016
মুক্তিযুদ্ধের সেই বিপর্যস্ত আবার রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া সময়ের উপর এই প্রথম এভাবে লেখা কোনো বই পড়লাম। সারা দেশ যখন কি হয় কি হয় নিয়ে ব্যস্ত, একদিকে দেশের স্বাধিকার রক্ষা নিয়ে মানুষের চেষ্টা-ত্যাগ, অপরদিকে মানুষজনের নিজের জীবন নিয়ে পালাবার পথ খোঁজার হাহাকার - সেই সময়ে সবকিছুকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ভাবনার জ্বাল বুনে যাওয়া এক তরুণের গল্প। সে সবই দেখে, একটু বেশি করে খতিয়েই দেখে বরং অন্য সবার চেয়ে। স্বাধীনতার নামে দিনরাত এদিকে সেদিকে ঘুরে খোঁজখবর নেয়া বন্ধুর এই ছোটার পেছনে সে তার ক্যারিয়ার গড়ে নেবার লুকানো ইচ্ছা বুঝে ফেলে, দিনরাত সভা-মিছিল করে বেড়ানো মানুষের পেছনে সে গড্ডালিকা প্রবাহ দেখে, জাতির ঐক্যবদ্ধ রূপের পেছনে সে দেখে ক্ষমতাসীনদের কলকাঠি নাড়া হাত। আবার এই খোকাই সবাই যখন জীবনেের ভয়ে ঢাকা খালি করে ফেলছে, তখন প্রশ্ন তোলে, সবাই চলে গেলে লড়বে কে?! এই খোকাই আশেপাশের সবকিছুর মধ্যে থেকেও না থেকে বেঁচে থাকলেও নিজের বোনকে আগলে রাখতে চায় পারিপার্শ্বিক সব ধরনের কদর্যতা থেকে। সব কিছুর প্রতিই তার প্রশ্নবিদ্ধ মন কটাক্ষ করে বেড়ায়। তাই, যদিও এখানে বইয়ের বর্ণনায় দেখলাম 'এক উদাসীন তরুণের কাহিনী', আমার তা মনে হয়নি।

যুদ্ধ বড় অদ্ভুত এক সময়, নিজে কখনো সামনে থেকে না দেখলেও দেশি-বিদেশি নানান যুদ্ধের বই পড়ে আর যারা সেই সময়ে বেঁচে ছিলেন তাঁদের মুখে শুনে অন্তত এটুকু বুঝেছি যে, যুদ্ধ একেকজনকে একেকভাবে বদলে দেয়- একেকজনকে একেকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই নিজে যতই ৭১-এর ইতিহাস পড়ে রাগে-দুঃখে-হাহাকারে-অসহায়তায় দুমড়ে যাই, এই খোকাকে ঠিক উদাসীন বলতে পারি না। পেছন ফিরে তাকালে সময়কে যত বিশদভাবে দেখা যায়, সময়ের মধ্যে থেকে তা পারা যায় না; আবার বর্তমানকে যেভাবে যাচাই করার উপায় থাকে, অতীত সেভাবে দেখা যায় না। তাই এই খোকা, মুরাদ, রঞ্জু, লুলু চৌধুরী, রাজীব ভাই বা নীলাভাবি কাউকে দুর্বল-শক্তিশালী-খারাপ-ভালো এসব যাচাই করতে চাইছিনা। তারা এই বইয়ের কল্যাণে রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ- সে সময়ের বা এই বই��়ের ভাষা অনুযায়ী, 'সকল সময়ের' মানুষ।

ব্যক্তিগতভাবে, বইয়ের একটা খুব ছোট একপেশে দিক চোখে পড়েছে, তা হল মেয়েদের প্রতি লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি। নিছক খোকার চরিত্র সাজাতে গিয়েই তিনি এমনটা করেছেন, না তার ব্যক্তিগত হতাশা বা মনোভাবের ছাপ পড়েছে, বুঝতে পারিনি। এছাড়া, বাকি সব কিছুই- বিশেষ করে ভাষা, উপমা, রূপক, আর শব্দের ব্যবহার দেখে আমি এক কথায় মুগ্ধ! অবশ্যই পড়ার মত বই; একটু সময় নিয়ে বুঝেশুনে পড়ার মত বই- নিঃসন্দেহে!
Profile Image for Momin আহমেদ .
112 reviews49 followers
Read
July 10, 2023
বইটা এবার শেষ না করেই রেখে দিচ্ছি এই কারণে যে একবার একটা বই শেষ করে ফেললে সেটা দ্বিতীয় বার পড়া আমার জন্য প্রায় অসম্ভব। আমি এই বইটা আর একবার ট্রাই করবো।
বইটা পড়ার জন্য একটা অখন্ড ���বসর আর মনোযোগ দরকার।
Profile Image for Shanto.
45 reviews15 followers
January 23, 2014
ভেবেছিলাম ঘোর কেটে গেলে লিখব, অথবা সম্ভবত ঘোর কেটে গেলেই লিখব। সেই ভেবেই অপেক্ষা করছিলাম, দু-চার দিন, কিন্তু ঘোর কাটল না, কাটছে না, বরং ঘোরের মধ্যেই পড়ে ফেললাম আরেকটা বই। সে জন্যেই লিখতে বসা। ঘোর কাটার অপেক্ষায় থাকলে হয়ত লেখাই হয়ে উঠবে না। লেখা না হয়ে ওঠা আরও অনেক সম্ভাবনাময় লেখার মত হারিয়ে যাবে, অনেক লেখাই যে রকম ভ্রুণ অবস্থায় হারিয়ে যায়। অবশ্য তাতে বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়নি বা হয়না। আমি এমন কিছু লিখিয়ে নই যে আমি লিখিনি বলে কেউ অপেক্ষায় দাঁতে কামড়ে হাতের নখ ক্ষয় করে ফেলবে অথবা আমি লিখেছি বলেই লেখা পড়ে কেউ দুরন্ত পায়চারীতে অস্থির করে দেবে অন্ধকার ব্যালকনি। তাছাড়া আমি লেখকও নই, না লিখলে আমারও যে বিশেষ কিছু এসে যায় এমন নয়। কিন্তু এই লেখাটা সেরকম কোন উদ্দেশ্যেই লেখা নয়, লেখার উদ্দেশ্য অনেকটাই উগড়ে দেবার মত, এমন উগড়ে দেবার অনুভূতি অনেক দিন কোন বই পড়ে হয় নি।

কথাটা পরিষ্কার করেই বলতে হবে, এটা সম্ভবত কোন বুক রিভিউ নয়, সম্ভবত এটা কিছুই নয়। কিছু হতে হবে তেমন পরিকল্পনা করে লিখছিও না, শুধু যতটুকু উগড়ে দিতে পারলে নিজের আরাম হয়, স্বার্থপরের মত শুধু সেটুকু উগড়ে দেব সম্ভবত। তবে উগড়ে দেবার একটা সমস্যা আছে, সেটা বোধহয় খুব একটা হিসেব করে দেয়া যায় না। বিবমিষার জন্য দোষী সাব্যস্ত পানীয় বা খাবারের সাথে গতকালের খাওয়া নির্দোষ পুষ্টিকর আর অনাকাঙ্খিত খাবারের অংশও বের হয়ে আসে নির্দ্বিধায়, আবার অনেক সময় অধিক পুষ্টিকর খাদ্যের ভার দেহ সহ্য করতে না পেরে উগড়ে দেয় নির্বিচারে, আমার অবস্থা বোধহয় কিছুটা সেরকমই। এখন এই অবস্থায় লিখতে গেলে অপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু যদি লেখা হয়ে যায় অথবা যেটুকু উগড়ে দেব ভেবেছিলাম সেটা যদি না বেরোয়, সে দোষ পাঠক আমাকে দিলেও তার দায় নিতে আমি অপারগ।

শুরুটা সাদামাটা, একটু বেশিই হয়ত, চমক নেই কোন। ভাইবোনের সংসার, খুঁনসুটি, ঝগড়া, হাসাহাসি আর অভিমান। এই নিয়ে শুরু। এর মধ্যে নতুন কিছু নেই যে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে হবে, কিন্তু এই কিছু না থাকার মধ্যেই লেখক আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেন। অদ্ভুত তাঁর উপমার ব্যবহার, একেবারেই অন্যরকম তাঁর ঘটনার বর্ণনা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পড়েছি আগেই, তুলনা করাটা ঠিক হবে না হয়ত, কিন্তু বর্ণনা আর উপমায় মাহমুদুল হক আর ইলিয়াসকে পাশাপাশি না রাখলেও কাছাকাছি রাখা যেতে পারে। কিন্তু ঠিক সেই কারনেও এই লেখার অবতাররণা নয়।

একেবারে আটপৌঢ়ে ঘটনা আর কথোপকথনের পেটে ছুরি চালিয়ে মাহমুদুল হক একেবারে নাড়িভুড়ি পর্যন্ত বের করে আনেন নির্লিপ্তভাবে, অনেকটা ইলিয়াসের মতই। কিন্তু পড়ার সময় আমি লেখককে টের পাই না একেবারেই, গল্পের মধ্যে ততক্ষণে আমি ঢুকে পড়েছি খোকা হয়ে। বুঝতে না বুঝতেই রঞ্জু, মঞ্জু আর অঞ্জু আমার বোন হয়ে যায়। মঞ্জু আর অঞ্জু তলিয়ে যেতে থাকে অতলে, ঠিক জীবনের মত, রঞ্জু বেঁচে থাকে সেও জীবনের মত। জীবন অদ্ভুত! জীবন যেন ঠিক খোকার বোনের মত, জীবন যেন অনেকটা ঠিক আমার বোনের মত।

এই লেখাটা ২০১২ তে পড়তে পারতাম বা ২০১১ বা তারও আগে। মাহমুদুল হক আগে কেন পড়িনি সেজন্যে শুরু করার পর থেকেই একটু মন খারাপ হতে থাকে। এই লেখককে চিনতে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম? সচলের কনফুসিয়াস কোন একটা লেখায় বোধহয় এনাকেই বলেছিলেন সাঁপুড়ে লেখক, অদ্ভুত সম্মোহনে সম্মোহিত করে ফেলেন। কিন্তু বইটি যতই পড়তে থাকি যতই একটা করে পৃষ্ঠা পড়া হয়, ততই মনে হয় এই বই পড়ার জন্য এর চেয়ে ভাল সময় বোধহয় আর হতে পারত না, একটা করে পৃষ্ঠা আগাতে থাকে আর মনে হয় এই বইটা ঠিক এই সময়েই পড়তে হত। আর ঠিক সেইজন্যেই বইটি নিয়ে লিখতে বসা।

বইটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা। পুরোটা ঠিক মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিও নয় বরং আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ব্যক্তিগত জীবনের যে সংকট, যে টানাপোড়েন, যে দ্বন্দ্ব, যে হিসেব-নিকেশ, সেইসব উঠে এসেছে খোকা নামের এক আত্নমগ্ন, আপাতসচেতন, পড়ুয়া অথচ নির্বোধ যুবকের জীবনের মধ্যে দিয়ে। এক হিসেবে গল্পের নায়ক বা মূল চরিত্র তাকে বলা যেতে পারে, কারন তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় সব চরিত্র আর সংলাপ। অথচ একটু খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যায় গল্পের মূল চরিত্র আসলে সেই সময়ের সংকট, সেই সময়ের স্বপ্ন, সেই সময়ের নির্মাণ আর বিনির্মাণ। আর আরেরকটু খেয়াল করলে বুঝতে পারি, সেই সংকট কেবল সেই সময়ের নয়, বরং সেই সংকট সেই সময়কে অতিক্রম করে কখন যেন আজকের নাস্তার টেবিল, রাস্তার পাশে চায়ের দোকান অথবা রাজপথের সংকট হয়ে উঠেছে।

'জীবন আমার বোন'কে আমি দেখলাম দুই হাজার তের এর ভেতর দিয়ে অথবা অন্যভাবেও বলা যায় দুই হাজার তের কে দেখলাম 'জীবন আমার বোন'-এর ভেতর দিয়ে। সম্প্রতি আমি মুক্তিযুদ্ধকে দেখতে চেষ্টা করেছি শাহবাগের সানগ্লাস চোখে লাগিয়ে, তাতে মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করা হয় হয়ত, শাহবাগের সানগ্লাস চোখে লাগিয়ে সত্তর আর একাত্তরের ক্যানভ্যাস দেখতে গেলে পুরো ক্যানভাসের অনেকটাই ঢাকা পড়ে হয়ত। কিন্তু এর চেয়ে ভাল সানগ্লাস আমার হাতে আর কীইবা আছে! আমি বরং দুই হাজার তের বা শাহবাগকে সানগ্লাস হিসেবে না দেখে একটা দূরবীন হিসেবে দেখি। 'জীবন আমার বোন' সেই দূরবীনের লেন্স নয় বরং ফোকাস রিং, তাতে আগের চেয়ে অধিক দূরত্বে যে দৃষ্টিপাত করতে পারি তা নয়, কিন্তু আগের চেয়ে অনেক পরিষ্কার দেখি এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এই জায়গাতেই জীবন আমার বোন শুধু একাত্তরের গল্প নয়, এটা হয়ে ওঠে দুই হাজার তের এরও গল্প। এটা একাত্তরের ঢাকা থেকে আজকের শাহবাগে এসে থমকে দাঁড়ায়, আমি আর আমার বন্ধুদের চ্যাটবক্সে আর ফেসবুক স্ট্যাটাসে। চায়ের কাপে অথবা স্কাইপ ভাইবারে এক একটা 'জীবন আমার বোন' রচিত হতে দেখি। আমার আশেপাশের সবাই, আমি তুমি আর সে সবাই মিলে কেউ হয়ে যাই খোকা, কেউ মুরাদ বা ইয়াসীন, কেউ নীলাভাবী বা লুলু চৌধুরী, কেউ বা বোকার মত রাজীব ভাই হয়ে বসে থাকি। আর কেউ কেউ অঞ্জু মঞ্জু রঞ্জু হয়ে কেবল তলিয়ে যায় জীবনের মত। আর কোন কোন খোকা না বুঝে শুধু সেই রঞ্জু মঞ্জু আঞ্জুকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে জীবনটাকেই কোথায় যেন হারিয়ে ফেলে।

খোকার মধ্যে যখন খুঁজে পাই এই সময়ের ফেসবুকের বামপাশে 'আই হেইট পলিটিক্স' ঝুলিয়ে রেখে চেগেভারার টি-শার্ট পরে ঘুরে বেড়ানো তরুণটিকে, তখন এই লেখাটি না লিখে উপায় থাকে না। অথবা রাজনীতিকে বইয়ের পাতায় আটকে ফেলে রাজনীতিবিদদের গালাগাল দেয়া মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া তরুণীর ফেসবুক স্ট্���াটাসের সাথে খোকার এই উপলব্ধির পার্থক্য কতটুকু? “রাজনীতির ব্যপারটাই আগাপাস্তলা একটা জমকালো ছেনালি; একজন শিক্ষিত নাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে তার পুরোপুরি ধারণা থাকলেও ভোটার লিস্টে সে তার নাম তোলেনি। রাজনীতির ব্যাপারটা তার কাছে শিকার ফসকাতে না দেওয়া হুবহু সেই মাদামোয়াজেল ব্লাশের মত”।

অথচ এই অস্থির সময় কাউকে রেহাই দেয় না। ফেসবুক বা টি-শার্টে 'আই হেইট পলিটিক্স' ঝুলিয়ে রাখা যে তরুণ প্রতিদিন অ্যালিয়ন, প্রেমিও বা সদ্য কেনা বাইকের পিছে প্রেমিকাকে চাপিয়ে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, সাইলেন্সার খুলে রেখে বিশাল শব্দে জানান দিয়ে যে যুবক বসুন্ধরার ফাঁকা রাস্তায় কার রেসিং করে বন্ধুদের সাথে, হরতাল বা অবরোধে তাকেও রিকশা বা হাঁটা পায়ে পৌছাতে হয় গন্তব্যে, কখনও বা পৌছানোই হয়ে ওঠে না। সেই ঘৃণা করা পলিটিক্সের উত্তাপ তার গায়ে এসেও যখন লাগে তখন সেও কি খোকার মত করে ভাবে নি বা ভাবে না? এইসব প্রশ্ন আমাকে পেয়ে বসে, তাই লিখতে বসি।

এইসব ঝামেলা, ফেসবুক আর রাজপথের উত্তাপ থেকে আমি বা আমরাও কি কখনও খোকার মত নীলাভাবীর ড্রইংরুমে আশ্রয় খুঁজিনি? এতসব তর্কবিতর্ক, গালাগালি আর কথার মারপ্যাচে একে অপরকে হেনস্থা করার সময় খোকার মত আমারও কি কখনও অর্থহীন মনে হয়নি সবকিছু? আমিও কি কখনও এসব থেকে মুক্তি চেয়ে খোকার মতই কোন এক সেগুনবাগিচার দিকে অগ্রসর হতে হত��� মনে মনে বলে উঠিনি? নিজেকে বোঝাইনি? “কথার প্যাঁচে ফেলে একে অপরকে অহেতুক হেনস্তা করার অপপ্রয়াসই নেই ওখানে। আড্ডা আর তর্কের মুখোশ এঁটে বন্ধুরা যখন মাঝে মাঝে হীন মনোবৃত্তির আশ্রয় নিয়ে একে অপরের নামে কাদা ছোড়াছুড়ি করে, জারিজুরি ফাঁসের ব্যপারে পরস্পর নোংরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়, তখন তার মন বিশ্রী রকম তেতো হয়ে যায়”।

কিন্তু নীলাভাবীর ড্রয়িংরুমে সেই আগের নেশা কোথায়? সময় বোধহয় সবসময় আর নীলাভাবীদের নিয়ে ভাবার সময় দেয় না, সময়ের প্রয়োজনেই সময়কে চিনতে হয়। এই সময় আর সেই সময়ের মাধ্যে পার্থক্য কতটা? পার্থক্যের মাত্রা হিসেব করতে গেলে হয়ত বিস্তর ফারাক পাওয়া যাবে, কিন্তু প্রকৃতিগত মিল সম্ভবত ব্যপক। খোকার মত তাই এখন আমার বা অনেকেরই অনুভূতি হয়, “কি দ্রুত বদলে যাচ্ছে যাবতীয় দৃশ্যপট, বদলে যাচ্ছে মুখের আদল, দ্রুত দ্রুত, দ্রুত এবং ধাবমান, গ্লেসিয়ারের মত দাবমান; দুর্মদ মৃত্যুর মত দরগলমান গ্লেসিয়ার। এই সময়ে কত বন্ধু হারিয়ে ফেললাম, কত মুখোশ খুলতে দেখলাম, কত মুখই বদলে গেল”, মিছিলে হাজার মানুষে মানুষে হাজার পার্থক্যের ভেতরেও একটা শ্লোগান থাকে, সেই শ্লোগানে সুর না থাকলেও গানের মত মনে হয়। সেই সময়ের শ্লোগান আর এই সময়ের শ্লোগানের মধ্যে ফারাক কতটুকু? এই বদলে যাবার মিছিলে কেউ যোগ দেয় কেউ যোগ দেয় না, কিন্তু সেই মিছিলের উত্তাপ সবার গায়েই লাগে, সেটা কেউ উপলব্দি করতে পারে, কেউ বা খোকার মত পালিয়ে বেড়ায়। এই উত্তাপের মাত্রা একাত্তর আর আজকে এক নয় নিঃসন্দেহে, কিন্তু সেই উত্তাপের প্রকৃতি আর কারন অনেকটাই অভিন্ন।

“সমস্ত ব্যাপারটা খোকার কাছে নিছক খেয়ালখুশি চরিতার্থ করার মত কিছু একটা মনে হয়, মিছিলের মানুষগুলোর মুখে দুরারোগ্য অসুস্থতার অক্ষর পড়তে থাকে সে। কোন স্তরের মানুষের সঙ্গেই আমার কোন সম্পর্ক নেই, কেমন একটু ভিন্নধাতে গড়া আমি- খোকা মনে মনে নিজেকে সামাল দিতে থাকে, কি ঘটছে না ঘটছে আমি তার কোন তোয়াক্কাই করি না, অথচ ফুটপাতের পানওয়ালা থেকে মাটিকাটা কামালারাও কমবেশি কিছু না কিছু বলতে সক্ষম; সময় বদলে দেয় মানুষকে, অথবা মানুষই কান মুচড়ে চাঙ্গা করে তোলে প্রাণশক্তি-বিবর্জিত নির্জীব সময়কে, এবং আমি কোন কিছুর ভিতর নেই। দেশ দেশের কল্যাণ, দেশের ভবিষ্যত, দেশপ্রেম, এসবের কিছুই তার মগজে ঢোকে না। এইসব ভজকট ব্যাপারে নিরর্থক অপচয়িত না হয়ে বরং শিথিল আলসেমির ভিতর ডুবে থাকা ভাল, অন্তত নিরাপদ তো বটেই।” এই গল্প একাত্তরের না গতকালকের এই পার্থক্য কে এঁকে দেবে? সময়কে অস্বীকার করে কূপমন্ডুক হয়ে বেঁচে থাকতে চাওয়া নপুংসক প্রজন্ম শুধু এই সময়ের সন্তান নয়। এরা সবসময়ই ছিল, সময়ের উত্তাপ থেকে বেঁচে থাকতে এরা নীলাভাবীর আঁচলের নীচে আশ্রয় নিতে চায়। কিন্তু নিষ্ঠুর সময় নীলাভাবীকে চিনতে পারে না। নীলাভাবীর আঁচলও একসময় সময়ের উত্তাপে গলে যায়।

জীবন আমার বোন কোন গল্পকে ঘিরে আগায় না, গল্প সেখানে থমকে থাকে বেশিরভাগ সময় নীলাভাবীর বেডরুম অথবা লুলু চৌধুরির খসে পড়া আঁচলে, কখনও রঞ্জুর সাথে খুনসুটিতে, মুরাদ বা ইয়াসীনের সাথে চায়ের কাপে। থমকে থাকা এক একটা মুহুর্ত থেকে মাহমুদুল হক এক একটা রত্ন বের করে নিয়ে আসেন। সেই রত্নের জ্যোতি শুধু সেই সময়ে আটকে থাকে না, সেটা অতীতকে পেছনে ফেলে ঘটমান বর্তমানের অংশ হয়ে ওঠে। মুরাদ যখন সময়কে কাজে লাগিয়ে তার কবিতার একটা বই প্রকাশের কথা ভাবতে থাকে, আমরা তখন মুরাদের মধ্যে আজকের শাহবাগকেও কি কিছুটা খুঁজে পাই না?

অথবা গল্পের সেই আসাদের সাথে আমাদের রাজীবের পার্থক্য কোথায়? খোকা যখন বলে, “আমি ভাবতেই পারি না আসাদ নেই। খুব কষ্ট হয় আমার। এই যে ও নেই, তার জন্য কার কি এমন ক্ষতি হয়েছে, কি এমন যাচ্ছে আসছে?” আমার কিন্তু ঠিক ঠিক রাজীবের কথা মনে হয়। রাজীব ঠিক আমার মতই একজন ছিল হয়ত, কিন্তু আজকে আমার কী এমন আসছে যাচ্ছে? আবার ঠিক তখনই আমার ভেতর থেকেই মুরাদ কি বলে ওঠেনি, “চোখটা নিজের দিক থেকে ফিরিয়ে দেশ ও দশের স্বার্থের মাপকাঠিতে ফেলার চেষ্টা কর, দেখবি আজ আর এটা নিছক একটা নাম নয়, ঝকঝকে সোনার তরোয়ালের একটা প্রতীক, বিশাল দেশের ওপর স্থির বিদ্যুতের মত যা ঝুলে রয়েছে।”? রাজীব কি আমাদের আজকের আসাদ নয় অথবা লেখক কি আসাদের নাম দিয়ে আমাদের রাজীবের কথাই বলেন নি? ঝকঝকে সোনার তরোয়ালের সেই প্রতীক কি আজকের রাজীব নয়?

লাইন ধরে ধরে কোটেশান দেব বলে এই লেখা লিখতে বসিনি। সেটা করতে গেলে পুরো বইটিই এখানে তুলে দিতে হবে। গল্পের ডাইমেনশানও একমাত্রিক বা দ্বিমাত্রিক নয়, কম করে হলেও ত্রিমাত্রিক বা চতুর্মাত্রিক। সেই আলোচনায় যাব বলেও লিখতে বসিনি। সেটা বুক রিভিউ যদি কখনও লিখতে বসি তখন চিন্তা করে দেখব। খোকার চরিত্র বিশ্লেষণ করে খোকার গুষ্টি উদ্ধার করাও আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়। শুধু বইটি পড়তে গিয়ে আমি বারবার যখন নিজের মধ্যে কখনও খোকা, কখনও মুরাদ বা কখনও লুলু চৌধুরীকে খুঁজে পেয়েছি, তখন মনে হয়েছে এই বইটি এখন শুধু আমি একা পড়লে হবে না, 'জীবন আমার বোন' এই সময়ে সবাই মিলে পড়তে হবে। না হলে যখন খোকার মত আমি বা আমরা বুঝতে পারব, তখন দেখব, অর্ধনিমজ্জিত যে বোনকে আমি বা আমরা জীবন মনে করে আঁকড়ে ধরছি, নিজেকে আড়াল করে মিছিলের উত্তাপ থেকে পিঠ বাঁচাতে চাইছি, সেই বোন কখন যেন টুপ করে সময়ের এঁদো পুকুরে ডুবে গেছে।

রিভিউ প্রথম প্রকাশ হয়েছিল সচলায়তনেঃ http://www.sachalayatan.com/shopnobaz...
Profile Image for Shahidul Nahid.
Author 5 books141 followers
Read
November 5, 2016
শুরুর দিকে ভালো লাগছিলো অনেক... মাঝের পর থেকে কেন জানি টানতেছিল না আর। গুবলেট হয়ে যাচ্ছিলো সব ! অনেকেই পাঁচ তারা দিয়েছে এই বইটাকে, হয়তো আমার মাথার উপর গিয়েছে বলে বোধগম্য হয় নাই ... আবার পড়তে হবে, ধৈর্য্য নিয়ে।
110 reviews
March 30, 2021
অন্য সব বই এর মতো গুডরিডস এই বইটার সন্ধান পাই।বই সম্পর্কে দু লাইন পড়তে গিয়ে ছোট্ট করে দু তিনটা Quote চোখে পড়ে এবং সাথে সাথে যেন মনে দাগ কাটে,তো একরকম সেই লোভে পড়েই বইটা নিয়ে বসি।প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর সেই ঘোর কেটে যায়।বইটার Quote তুলে আনতে চাইলে যে অর্ধেক বইটাই তুলে আনতে হচ্ছে মশাই!

'জীবন আমার বোন' উপন্যাসটিতে মার্চ,১৯৭১ এর এক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।'খোকা' নামে গল্পের মূল চরিত্রের চোখে আমরা সেই চিত্র দেখতে পাই।লেখক যেন চরিত্র টাকে কিছুটা স্নেহ আর অনেকটা অবহেলার সমন্বয়ে তৈরি করেছেন।যুদ্ধের সেই চরম অস্থিরতার সময়েও বীরের তালিকায় নিজের নাম লিখানোর বদলে দেশের সংগা খুজতেই বেশি সময় ব্যয় করতে দেখা গেছে খোকাকে।অবশ্য এই নির্লিপ্তিতার জন্য তাকে দোষ ও দেয়া যায় না।তার জগৎ যে নিলাভাবির আঁচলের স্নিগ্ধতা,বেলীর লিখা চিঠিখানা,লুলু চৌধুরীর বদনাম,মুরাদকে বাক্যবাণে হারানো আর অনেক্ষাণি অংশ জুড়ে বোন 'রঞ্জু' কে ঘিরে!

কিছু জায়গায় লিংগবাদ চোখে পড়েছে।ভেবেছিলাম এক তারা কি তবে কাটা যায়?পরক্ষণেই মনে হয়েছে 'খোকা'র করা লিংগবাদের জন্য লেখক কে কেন এক নম্বর কম দেব বলুন তো?

অন্য সব বিষয়ে নির্লিপ্ত ও কতকটা লাম্পট্য চোখে পড়লেও বোন রঞ্জুর সামনে খোকা যেন আদর্শ ভাই!চিরায়ত ভাই বোনের চিত্রই লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন অনেকখানি মায়া দিয়ে।

বইখান পড়ার পর আমার প্রিয় কথাশিল্পীর তালিকাটা হালনাগাদ করতে হবে দেখছি!অনেকদিন পর একজন লেখকের শব্দের ইন্দ্রোজালে এতক্ষণ বন্দী ছিলাম।

বি.দ্র. যারা উপন্যাসে প্রাপ্তবয়স্ক শব্দ নিতে পারেন না,তাদেরকে এটি পড়তে নিরুৎসাহিত করবো।
Profile Image for Saiful Sourav.
103 reviews72 followers
January 22, 2023
জীবন আমার বোন ঠিক যুদ্ধের নয়, যুদ্ধকালিন উপন্যাস । যেখানে একজন ভাই খোকা ও তার বোন রঞ্জু শহরের প্রত্যন্ত জায়গায় থাকে । যুদ্ধের মধ্যেও উদাসিন হেঁটে বেড়ায় খোকা । বোনের সাথে ঝগড়াটে কিন্তু আনন্দম এক সম্পর্ক তার । আজ না, কাল না করেও কোথাও আশ্রয় নিতে যায় না সে বোনকে নিয়ে । যেন এই পরিস্থিতির সাথে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই এবং এসবের কিছুই সে চায়নি । এদিকে যখন শহরে ঢুকে পড়েছে পাকবাহিনী এবং সমস্ত দেশ মুহূর্মুহু আক্রমণে ভঙ্গুর প্রায়, তখন খোকার চোখে ঝরে পড়ছে অন্ধকার । বন্ধুদের আড্ডায় বাকপটু খোকাকে যুদ্ধ পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যতা বিধানে স্বাভাবিক ভাবেই কোনঠাসা হতে দেখা যায় । ক্ষণিকতা, মুড বেইজড কথা-বার্তার প্র্যাকটিস ও অসহিষ্ণু আচরণ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ব্যক্তিকে গ্রাস করে যেন । ভেঙে পড়া ঝুরঝুরা দালানের ধ্বংসাবশেষে ঝুলে থাকে জীবন আমার বোন ।
মাহমুদুল হকের কাব্যভাষায় শব্দের সংস্হানে গল্পের রূপরেখা ছায়ার মতো চলতে থাকে । খোকা কেন যুদ্ধের মধ্যে গ্রেগর সামচা বনে গেল সে সূত্রটা কি পাওয়া যাচ্ছে ৪৭'এর দেশ বিভাগে, যখন লেখকের বয়স আট এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকায় সপরিবারে যাত্রা বা আগমনের দুই যুগের প্রান্তে যুদ্ধ পরিস্হিতি?
Profile Image for নিলয় দেবনাথ .
14 reviews12 followers
June 6, 2025
এই দুদিন আগেও হুমায়ূন আহমেদের একঘেয়ে প্রেম-বিরহের উপন্যাস পড়তে থাকা আমি যখন "জীবন আমার বোন" পড়তে যাই, তখন আমার মনে হতে থাকে মাহমুদুল হক আদতে কোন উপন্যাস লিখতে চাননি, তিঁনি শব্দের পর শব্দ বুনে তৈরি করতে চেয়েছিলেন একটি নকশিকাঁথা, হয়তো তিঁনি শব্দের আঁচড়ে আঁকতে চেয়েছিলেন ভিঞ্চির সেই বিখ্যাত "মোনালিসা" যাঁর প্রতিটি আঁচড়ে লুকিয়ে আছে বিস্তৃত বিশ্লেষণ, হয়তোবা তিঁনি লিখতে চেয়েছিলেন ১৫৭ পৃষ্ঠা দীর্ঘ একটি ছন্দময় কবিতা যা পাঠ শেষে ঘোরগ্রস্থ হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না, বারংবার পাঠ করতে হয় সেই কবিতা। হয়তোবা তিঁনি সফল হয়েছিলেন, হয়তোবা না। কি জানি? আমার মতো পাঠকের কি আর সাধ্য আছে সেই বিচার করার?
Profile Image for Saiqat .
60 reviews1 follower
October 16, 2021
আমরা সবাই স্বপ্ন। স্বপ্নের ভিতরেও আরেক স্বপ্ন সে স্বপ্নটাই আমরা। আর আমরা আমাদের স্বপ্নের মতোই শূন্য!
Profile Image for সারস্বত .
237 reviews136 followers
June 17, 2022
এবারের ৪৪তম বিসিএসের একটি প্রশ্ন এসেছিল 'খোকা' ও 'রঞ্জু' মাহমুদুল হক-এর কোন উপন্যাসের চরিত্র। কাকতালীয়ভাবে ঠিকই তখন আমি এই উপন্যাসটি পড়ছিলাম। উপন্যাসটির নাম 'জীবন আমার বোন'।

উপন্যাসে ঘটনা প্রবাহ কাল ১ মার্চ থেকে ২৭শে মার্চ ১৯৭১ সাল; যে সময়কালে শোষণের ও প্রতিবাদের পারস্পরিক বারুদের যোগান, ইন্ধন আর বিষ্ফোরণে একসাথে সংঘটিত হয়েছিল। ২৫শে ,মার্চের আগে প্রায় শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ঢাকা শহরের মানুষ শহর ছেড়ে প্রাণের দায়ে পালিয়েছে, ঘুরতে গেছে, আড্ডা জমিয়ে দিয়েছে কোন রেস্টুরেন্ট কিংবা লেকের কাছে, পরকীয়া করতে গেছে কোন নিস্তব্ধ দুপুরে, অন্যের পরিবারের দুর্বল স্থান লক্ষ্য করে বন্ধুকে খোঁচা মেরেছে নিষ্ঠুরভাবে, অবশেষে দেশের পরিস্থিতি বাড়াবাড়ি আর কিছু হবে না নিজেকে বলে ঘুমাতে গেছে মাঝরাতে। শেষ অবধি পুরোদমে বেঁচে থেকেছে।

কিন্তু সময় মুহুর্তে বদলে গেছে। ২৫ শে মার্চ। এলোপাথাড়ি ফায়ারিং। বিকট শব্দে মর্টার সেল বিষ্ফোরণ। ঘরের লাশ তখন রুমমেট, রিক্সার উপর লাশ, নীচে লাশ, বস্তির ঘরে ঘরে লাশ, কলেজের ক্যান্টিনে লাশ, নদীর কূলে জমা লাশ, পুকুরের জলে লাশ। শহরের চারিদিকে মৃতদেহ প্রদর্শনী। অদ্ভুত তার বৈচিত্রতা। সৃষ্টিতে কোথাও কোন কার্পণ্য নেই। সেই লাশ ঠেলে কেউ পুরোদমে মরে বেঁচেছে আর কেউ বেঁচে থেকে ধুকে ধুকে মরেছে। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জাহেদুল কবির খোকা। পূর্বোক্ত দুই শ্রেণীর মাঝে দ্বিতীয়।

খোকা, যাকে বাঁচাতে গিয়ে অঞ্জু আর মঞ্জু যমজ বোন ডুবে মরেছে। সময়ের ব্যবধানে অনেক দূরের সময়কে মনে হয় এই তো সেদিন আর আবার সেই একই সময়ের ভিন্ন ঘটনাকে মনে হয় সেই অন্য কোন জন্মে হয়েছিল এসব।

সেই খোকা রেক্সের আড্ডা পরিত্যাগ করে এগিয়ে যায় নীলাভাবীর দিকে। নীলাভাবী যে কিনা খোকাকে প্রথম দিয়েছে দুর্লভ কিংবা অনিবার্য পৌরুষত্বের স্বাদ। নীলাভাবীর বাসার পথের মাঝে প্রতিবাদ পরিবেশ, মিটিং মিছিল খোকাকে প্ররোচিত করতে গেলে তার মাঝে জেগে ওঠে 'লোলচর্ম নীতিবাগীশদের চিড়-খাওয়া করব'। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, গণতন্ত্র, পুজিবাদ, শ্রেণীসংগ্রাম সব আস্তাকুড় থেকে তুলে এনে আরেকবার আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে দেয় খোকা। শ্রমিকের আন্দোলন আইজেন-স্টাইনের চলচ্চিত্র, পাবলো নেরুদার কবিতা, গেরিভিদালের বই, পিকাসোর দেয়ালচিত্র শোষিত আর শাসিতদের মাঝে শান্তির উদ্দীপনা যোগাতে ব্যর্থ হয়। সেই ব্যর্থদের দলে খোকাও একজন। অথচ খোকাই অভিযোগকারী।

খোকার একমাত্র জীবিত ছোট বোন রঞ্জু। যাকে কল্পনায় গড়তে গিয়ে মনে হয়েছে '৭১ এর কোন নারীচরিত্র নয়। এই চরিত্র ২০২২ সালেরও হয়তো ২০৪৫ এরও, হয়তো আরও সময় পেরিয়েও সে একইরকম। চুপচাপ থাকা, হুট করে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, চুপিসারের গড়ে তোলা নিজের চারপাশে এক অভেদ্য দেয়াল, কত সরল অথচ কত ধাঁধা, কত কোমল অথচ কত সুক্ষ্ম। খোকার খালাত বোন বেলীর মত চরিত্রকে বরং বেশি আধুনিক আর টেকসই মনে হবার কথা ছিল। অ���চ রঞ্জু যেন কোন শব্দ আর রহস্য বলে আধুনিক থেকেও বেশি স্পষ্ট, চিরন্তন।

উপন্যাসে এক একটা দিন গড়ায় আর কোথায় যেন মনের ভেতর চুপিসারে রঞ্জুর জন্য দুঃচিন্তা বাড়তে থাকে আর খোকার প্রতি আসে বিরক্তি। সরীসৃপের মত বুকের ভর দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে আসে ২৫ শে মার্চ। খোকা তবুও থাকে নিরুদ্বেগ। দুঃচিন্তা আর উদাসীনতার লড়াইতে উদাসীনতার বার বার দুঃচিন্তার ছকের মন্ত্রীর খেয়ে দেয়।

অবশেষে আসে সেই দিন, সেই রাত। তারপর গল্পটা ভীষণ আলাদা। অথচ আলাদা কিছু নয়। গল্পটা '৭১ এর ৯০ ভাগ যুবকের জন্য একই। শুধু কিছু যুবক বাদে যারা মুরাদ, ইয়াসিন, রহমান হতে পেরেছিল। জাহেদুল কবির খোকারা তীক্ষ্ম মেধা আর তীব্র প্রতিভা নিয়েও পরিবর্তি ৯ মাস পালিয়ে বেড়িয়েছি কিংবা বিলাপ করেছে প্রিয়জনের লাশের উপর। অন্যদিকে মুরাদরা বাংলায় স্নাতকের ছাত্র হয়ে, কারখানার শ্রমিক হয়ে, কৃষক হয়ে, পাড়ার মাস্তান হয়ে, অজ্ঞ হয়ে, সরল হয়ে, সাহসী হয়ে স্বাধীন দেশ নামক এক তীব্র ঝোঁক নিয়ে লাশ হয়েছে কিংবা হয়নি কিন্তু কোনদিন আফসোস করেনি।
Profile Image for Tahsina Syeda.
207 reviews63 followers
December 19, 2016
মাহমুদুল হক-এর জাদুকরী লেখনী এখানে উপস্থিত, কিন্তু বইটা পড়ার সাথেসাথে ৪ তারা রেটিং দিলেও পরে কমিয়ে ৩-এ আনতে হলো। সম্ভবত এটা এমন বই যে ভাষার জাদুর ঘোরটা কেটে যাওয়ার পর দুর্বলতাগুলো বেশি করে মনে পড়ে। কালো বরফ বা অনুর পাঠশালার সমপর্যায়ের নয় এই বই। তবু পড়ার মত তো নিশ্চয়ই।
Profile Image for Shojib Saha.
18 reviews5 followers
August 27, 2023
বাংলা সাহিত্যে মাহমুদুল হকের লেখায় শব্দচয়ন, রচনাশৈলীর স্বাতন্ত্র্যতা অসাধারণত্ব বোঝার জন্য খুব বড় মাপের সাহিত্যবোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন নেই। জীবন আমার বোন বইতে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন অস্থিতিশীল সময়ের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট, সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া। তখনকার সময়ের যুবকদের চিন্তা-চেতনা, বিদ্রোহের চিত্র, দৃষ্টিভঙ্গী সকলকিছুই সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন হক সাহেব। খোকার বন্ধুদের মধ্যে দেশপ্রেম ও তাদের দেশকে নিয়ে ভিন্নধর্মী মতাদর্শের ভিন্ন ভিন্ন দিক। সেসব নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে তর্ক, অর্ন্তদ্বন্দের দিকটি মাহমুদুল সাহেব যেভাবে চিত্রায়িত করেছেন সেটা আমার অসাধারণ লেগেছে।

উপন্যাসের মুলচরিত্র খোকা বাইশ বছরের টগবগে যুবক। তার দৃষ্টিতে তখনকার তোলপাড় সময়ের ব্যাতিক্রমী চিন্তাভাবনা ও প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই যা আমার কাছে অভিনব মনে হয়েছে। যেখানে সবাই সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ, দেশপ্রেমের আবেগে নিমগ্ন সেই সময়ে খোকার চিন্তাভাবনা বইতে থাকে বিপরীত ধারায় সাথে চলতে থাকে দ্বিধা, সংশয়। সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া, প্রতিবাদ নিরর্থক মনে হয় তার কাছে।

এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে হক সাহেবের সরস বর্ণনায় স্বতন্ত্রভাবে মনে দাগ কাটে। আর অনবদ্য রুপকের ব্যবহার সেটা পরিবেশগত বর্ণনাই হোক। কোনো এক চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার বর্ণনাই হোক বা জীবনের কোনো গভীর উপলব্ধির রুপক বর্ণনাই হোক। রুপক বর্ণনাকে আমি খুব গুরুত্বের সাথে দেখি। এক্ষেত্রে মাহমুদুল হক সাহেবের রুপকবর্ণনা মন ছুঁয়ে যায়, বিস্ময় জাগায়, মনে দাগ কাঁটে।

নীলাভাবী চরিত্রটি নজর কেড়েছিলো শুরুতেই। এই চরিত্রটির কিছু দিক আমার কাছে পরিষ্কার হলেও বেশিরভাগই অধরা রয়ে গেছে। নারী চরিত্রের এই রহস্যমন্ডিত দিকটি অধরাই আর রহস্য হয়েই থাক আমার কাছে। যে রুপে এই চরিত্রটি চিত্রায়িত হয়েছে তাকে কয়েকটি সীমাবদ্ধ শব্দে আর নাই বা বাঁধি আর সেই যোগ্যতাও আমার নেই।
Profile Image for musarboijatra  .
283 reviews351 followers
August 13, 2018
মাহমুদুল হক বাংলাদেশের রত্নসম একজন সাহিত্যিক। সাহিত্যের ময়দানে তিনি নেই এখন অবশ্য। বেশ লম্বা সময় ধরে, হয়তো এক দশকেরও বেশি, তিনি সাহিত্য রচনায় অব্যাহতি নিয়েছেন অনেকটা আত্নগোপনের মতোই। কিসের অভিমানে জানা নেই। কয়েকজন বাঙ্গালী লেখক ভাষার জাদুতে পাঠককে অন্য দুনিয়ায় নিয়ে যান। সুবোধ ঘোষ। মুজতবা আলী। আজ মাহমুদুল হকের প্রথম বইটা পড়ে তাঁকেও ভাষার জাদুকরদের মাঝেই রাখতে হচ্ছে।

সবে 'জীবন আমার বোন' শেষ করলাম। বইয়ের পেছন থেকেই তুলে দিচ্ছি:
"খুব বেশি নয় তাঁর রচনার পরিমাণ, কিন্তু মাহমুদুল হক যখনই লেখেন, লেখেন স্মরণীয়ভাবে, বারবার পড়তে হয় তাঁর প্রতিটি বই, অসামান্য ভাষাশিল্পী তিনি। কখনো রাজহাঁসের গতির সুষমা ছড়ানো তাঁর বাক্যবিন্যাসে, আবার কখনো কথ্য বুলিতে বেজে ওঠে চিলের তীক্ষ্ণ চিৎকার। জীবনের চোখে তিনি তাকান প্রেমিকের মতো, কিন্তু সেই দৃষ্টি মামুলি আবেগে বিহ্বল নয়; বুদ্ধিতে দীপ্র, গভীরতায় অতল। জীবনের উপরিস্তরেই তাঁর দৃষ্টি সীমাবদ্ধ নয়, তাঁর দৃষ্টি যায় আরো অনেক গভীরে- যেখানে আদিম লতাগুল্মে আচ্ছাদিত এক জটিল জগৎ, যা মানুষের অস্তিত্বকে নাড়া দেয় আমূল, আলো-অন্ধকারে সম্পূর্ণ নগ্ন করে দেয়।"

কাহিনীর পটভূমি মার্চ মাস, ১৯৭১। প্রচন্ডভাবে রাজনীতি আর সময়বিমুখ যুবক 'খোকা' মূল চরিত্র, একমাত্র ছোটবোন রঞ্জুকে নিয়ে ঢাকায় নিজস্ব বাড়িতে থাকে আর সারাদিন রাজাগজা মেরে বেড়ায় যে। নানান নামের বন্ধু, সেগুনবাগিচার রাজীব ভাই নীলাভাবি, খালার বাসায় মাথা-খাওয়া বেয়াড়া বোন বেলী, এই সব চরিত্রদের সাথে মিথষ্ক্রিয়ায় খোকা বয়ে চলতে থাকে। পরিস্থিতি উঠে আসে আলোচনায়, উপেক্ষা আসে, কাপুরুষত্ব আসে, অতীতের স্মৃতির পীড়ন আসে, সর্বোপরি মাহমুদুল হকের ইন্দ্রজালে একটা প্রাপ্তবয়স্ক যুবকের হালচালে খুব করে জড়িয়ে পড়তে হবে বইটার সাথে। কাহিনীর চেয়ে সাইকোলজি এই বইয়ের অন্যতম বাহন, তবু সর্বস্বে তা-ই ভাবলেও ভুল হবে।

গুডরীডসে একজন নাবিলা'র রিভিউ পড়ে মনে হয়েছে এই চিন্তাগুলো আমার কাছে বড় হয়ে প্রতীয়মান হওয়া উচিৎ ছিল। প্রথমত, সেক্সিজম।

নিজ বোন রঞ্জু ছাড়া সব নারী চরিত্রই চরিত্র বিকিয়ে দিতে আর পুরুষকে প্রলুব্ধ করতে উন্মুখ। নীলাভাবি, বেলী, লুলু চৌধুরী প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে বাঁকা চোখে দেখানোর প্রবণতা 'খোকা' চরিত্রের মাঝে আছে। আমার কাছে সেটা বড় হয়ে দেখা দেয়নি, চরিত্র চিত্রণে সার্থকতার জন্য দরকারি ছিল সেটা।

তবে, দ্বিতীয়ত, বই বা কাহিনীর লিঙ্গ হয় না, তা কমন বা ক্লীব হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। সেক্ষেত্রে বলতে হয় লেখক বইকে একলিঙ্গিক করেছেন। ভালো উদাহরণ হতে পারে, ধরুণ, লাস্ট স্টোরিজ। হিন্দি সিনেমাটা দেখেছি, দেখে বুঝেছি সিনেমাটা কখনো আমার জন্য না। পুরুষ আর নারীর ঠিক নিজস্ব কিছু চিন্তা থাকে, দুটো সেট ধরে ভ্যান ডায়াগ্রাম আঁকলে ওই 'পুরুষের একান্ত চিন্তা' আর 'নারীর একান্ত চিন্তা' কখনো অন্তর্চ্ছেদ করবে না। পরস্পরের এই খানিকটা এলাকায় পদার্পণের দায়ও অন্যজনের নেই। যখন কোন একটা সাহিত্যের বা সৃষ্টির বিচরণক্ষেত্র ওই একান্ত জায়গাগুলোর একটা হয়ে যায়, তখনই সাহিত্য হয়ে পড়ে একলিঙ্গিক। সেখানে 'জীবন আমার বোন' অনেকটাই, পুরুষের।

তৃতীয়ত। এখানে নাবিলা উপসংহার টেনেছেন পেরিক্লিসের একটি উক্তি দিয়ে। "Just because you do not take an interest in politics doesn't mean politics won't take an interest in you." যে রাজনীতি বা পরিস্থিতি, তথা সময়কে পাশ কাটিয়ে বেড়িয়েছে খোকা, সেই 'সময��'ই নিমেষে উল্টেপাল্টে দিয়ে তার কাপুরুষত্ব বলুন আর নির্বিকার ভাব বলুন, সব কিছুকে আবার উন্মুক্ত করে দিয়ে যায়।

অতদূর ডুব দিতে না চাইলে লেখকের ঘোর জাগানো ভাষাই পাঠককে অভিভূত করে দিবে, একেবারে পাঁচতারা পর্যন্ত। আর ভাই বা বোন থেকে থাকলে তাকে মনে করিয়ে দিতে পারে ভীষণ ভীষণভাবে, যেমন আমি মিস করছিলাম আমাত মেজো বোনকে কালেভদ্রে আমি যার বড়ভাই বনে যাই।
Displaying 1 - 30 of 94 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.