Jump to ratings and reviews
Rate this book

প্রদোষে প্রাকৃতজন

Rate this book
সেনরাজার শাসন থেকে স্খলিত হয়ে যাচ্ছে দেশ, তুর্কী আক্রমণ অত্যাসন্ন। তবু সামন্ত-মহাসামন্তদের অত্যাচারের শেষ নেই। সেই অত্যাচার রুখে দাঁড়ায় কখনো অন্ত্যজেরা, কখনো বৌদ্ধেরা। শাসকদের বিশেষ রোষ তাই তাদের উপরেই। তাদেরই একজন প্রশ্ন করে: “দেখো, এই কি মানুষের জীবন? সুখ নেই, স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবলই প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছে - এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা যায়? বলো, কতদিন এভাবে চলবে?” ইতিহাসের সেই প্রদোষকালের জটিল আবর্তে ঘূর্ণ্যমান কয়েকজন প্রাকৃত নরনারীর কাহিনী বিবৃত হয়েছে এই উপন্যাসে।

197 pages, Hardcover

First published January 1, 1984

69 people are currently reading
940 people want to read

About the author

Shawkat Ali

44 books65 followers
Shawkat Ali (Bangla: শওকত আলী) is a major contemporary writer of Bangladesh, and has been contributing to Bangla fiction for the last four decades. Both in novels and short stories he has established his place with much glory. His fiction touches every sphere of life of mass people of Bangladesh. He prefers to deal with history, specially the liberation war in 1971. He was honored with Bangla Academy Award in 1968 and Ekushey Padak in 1990.

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
387 (56%)
4 stars
234 (33%)
3 stars
52 (7%)
2 stars
10 (1%)
1 star
6 (<1%)
Displaying 1 - 30 of 123 reviews
Profile Image for Arupratan.
235 reviews385 followers
September 14, 2024
সঙ্গত কারণেই এই উপন্যাসটি নিয়ে এপার বাংলায় কোনো আলোচনা নেই। বর্তমান জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক পরিবেশে তো আলোচনার পরিসর আরো সীমিত। বাঙালি এমনিতেই ইতিহাস লিখতে পারেনা, লিখলেও লেখে রাজারাজড়ার প্রশস্তি। সত্যি কথা বলতে, ১৯৪৯ সালে নীহাররঞ্জন রায় "বাঙ্গালীর ইতিহাস" বইটি লেখার আগে পর্যন্ত সাধারণ বাঙালি গণমানুষের ব্যাপারে কেউ কিছু লেখার চেষ্টা করেনি। সেই কবেকার চর্যাপদ কিংবা বৈষ্ণব সাহিত্য কিংবা মহাকাব্যের অনুবাদ কিংবা মঙ্গলকাব্যগুলোতে বাঙালি মানুষ এবং সমাজের ছবি ফুটে ওঠে বটে, কিন্তু এগুলোকে তো আর "ইতিহাস" বলা যায় না। বাঙালির ইতিহাস নেই।

তাই আজকের হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের মূল কারণ (এবং সমাধান) খোঁজার বদলে কেবল পারস্পরিক খিস্তি খেউড় চলে। এপার বাংলার হিন্দুয়ানি মস্তানরা "ঘর ওয়াপসি" নামক সামাজিক প্রকল্প চালু করে। ভারতে বসবাসকারী বাঙালি মুসলিমদের বাংলাদেশে চলে যাওয়ার পরামর্শ দ্যায়। বাংলাদেশকে লুঙ্গিদেশ নামে ডেকে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে (অথচ নিজের পাছাতেও কাপড় নেই)। আর ওপার বাংলার মুসলমানি মস্তানরা ফেসবুকে রবীন্দ্রনাথের সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার বৃত্তান্ত বিষয়ে গবেষণাধর্মী থিসিস পাবলিশ করে (পিয়ার রিভিউড)। কিংবা সেভেন সিস্টার্সকে "জয় বাংলা" করার জন্য "লুকিং ফর শত্রুজ" স্লোগানকে তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে নামিয়ে আনে। এবং আগামী দুর্গাপূজায় কী হবে সেটা এখনও বলতে পারছি না। এইসব ফুটোমস্তানি করেই দিন কাটে বাঙালি জাতির। ছোটবেলায় ইশকুলে পড়ার সময় বন্ধুরা একে অপরের প্যান্ট আচমকা পিছন থেকে টেনে নামিয়ে দিয়ে মস্করা করতাম, সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।

বাংলার শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজা লক্ষ্মণ সেনের শাসনকালের একদম অন্তিম পর্যায়ের একটি কালখণ্ড চিত্রিত হয়েছে উপন্যাসে। একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের বৃত্তান্ত। বুড়ো রাজা লক্ষ্মণ সেন রাজ্যশাসনের প্র্যাকটিকাল দায়দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন সামন্ত আর উচ্চবর্ণের গুন্ডাদের হাতে। শাসনের দায়ভার থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে শেষ জীবনটা অতিবাহিত করছেন তীর্থস্থান নবদ্বীপ শহরে। যোগ্য শাসকের অনুপস্থিতির সুযোগে ওই "তত্ত্বাবধায়ক" শাসকরা আক্ষরিক অর্থে যথেচ্ছ ধর্ষণ করছে গৌড়বঙ্গের আমজনতাকে। ঐতিহাসিক উপন্যাসে কল্পনার বিস্তার থাকে, তবু কল্পনার জন্যেও তো তথ্যের দরকার হয়। যৎসামান্য তথ্যকে আশ্রয় করে একটা বাস্তবসম্মত পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন শওকত আলী। তৎকালীন গৌড়বঙ্গের নিম্নবিত্ত জনসাধারণের যে অসহায় রূপটি দেখিয়েছেন, পড়তে পড়তে দমবন্ধ হয়ে আসে। চৈতন্য মহাপ্রভুর নেতৃত্বে সামাজিক গণজাগরণের প্রায় তিনশো বছর আগে, বঙ্গদেশের এত বিপুল সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল ক্যানো— এই কূটপ্রশ্নটির একটা লজিক্যাল উত্তরের আভাস আছে এই উপন্যাসে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে উপন্যাসটি অবশ্যই সার্থকতা অর্জন করেছে। কিন্তু আমার দুটো প্রশ্ন আছে।

প্রথম প্রশ্নটি উপন্যাসের নামকরণ নিয়ে। প্রদোষ মানে তো সন্ধ্যাবেলা। সন্ধ্যার পরে রাত্রি আসে। কিন্তু বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের পরে রাত্রি কি এসেছিল? লেখক কি পরবর্তী সাড়ে-পাঁচশো বছরব্যাপী ইসলামি শাসনকালকে রাত্রি হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন? দ্বিতীয় প্রশ্নটি উপন্যাসের তৎসমবহুল ভাষা নিয়ে। কয়েকটা উদাহরণ দিই। "তোমাদের খুরে দণ্ডবৎ একশতবার", "শূকরপুত্র" (শুয়োরের বাচ্চা গালি বোঝাতে), "চুপ কর দগ্ধমুখী" (চুপ কর পোড়ামুখী বোঝাতে), "ললাটে সম্মার্জনী" (কপালে ঝাঁটা), "চক্ষুর মস্তকটি কি ভক্ষণ করে বসে আছিস?" (চোখের মাথাটা কি খেয়ে বসে আছিস?)— এরকম আরো অনেক। প্রশ্ন হলো, আটশো বছর আগেকার প্রাত্যহিক বাংলাভাষায় কি এইসব আপাত-আধুনিক বাগধারা ব্যবহার করা হতো?

এই দুটো খটকা বাদ দিলে উপন্যাসটিকে অবশ্যপাঠ্য বলে মনে হয়েছে আমার। বাংলা ঐতিহাসিক কথাসাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ধর্মীয় রাজনীতির অচলায়তনে আটকে না-থেকে, বাঙালি এবার সত্যিকারের প্রশ্ন করতে শিখুক, তবেই তো সত্যিকারের উত্তর খুঁজে পাবে। উপন্যাসের "প্রদোষ" শব্দটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি, কিন্তু ফুটোমস্তান বাঙালিজাতির সত্যিকারের প্রদোষকাল কি সমাসন্ন?
Profile Image for Zunaed.
54 reviews119 followers
June 27, 2017
'প্রদোষে প্রাকৃতজন'— নামটাই কেমন সুন্দর না? ছন্দময়, নামটা শুনলেই ভেতরটা খুলে পড়ে দেখতে ইচ্ছে হয়। অবশ্য বইটা যখন পড়েছিলাম, বছর দুয়েক আগে হবে বোধহয়, তখনও আমি প্রদোষ শব্দের অর্থ জানতাম না। প্রদোষ শব্দটার মত জানতাম না বইয়ে ব্যবহৃত আরো অনেক শব্দের অর্থ। কিন্তু কঠিন সাধুভাষারও যে এক অসাধারণ সৌন্দর্য আছে, সেটা জানতে পেরেছিলাম বইটা পড়তে পড়তে। পুরো বইটাই কেমন যেন কাব্যিক, পুরো বইটাই যেন একটা কবিতা, যে কবিতায় বলা হয়েছে প্রাকৃতজনদের কথা।

রাজারাজরারা যুগে যুগে এসেছে গেছে, তাদের ('তাদের' শব্দে চন্দ্রবিন্দু ইচ্ছাকৃতভাবেই বাদ দিয়েছি) কথা তো কতই পড়েছি। ওসব গল্পে কেন যেন খুব আগ্রহ পাই না। সেই গল্পও নেই এতে। এতে আছে রাজপ্রাসাদ থেকে বহুদূরে মাটির ঘরে থাকা লোকেদের কথা। আজ থেকে কয়েক শতাব্দ বা সহস্রাব্দের আগের ভারতবর্ষের, বিশেষ করে এই বাংলা-আসাম অঞ্চলের প্রাকৃতজনদের কথা পড়তে, শুনতে বসলে কেন যেন আমি মোহাবিষ্ট হয়ে যাই। হয়ত ডিএনএতে বহন করা কোনো পূর্বপুরুষের স্মৃতি মনের অজান্তেই দোলা দিয়ে ওঠে, হয়ত সেই সময়ের প্রাকৃতজনের সুখ-দুঃখ এই অধম উত্তরপুরুষের অনুভূতিতেও চলে আসে, তাই। সে যাই হোক, উপন্যাসটা তার বিষয়বস্তুতেই আমাকে মুগ্ধ করে ফেলেছিল। এ কারণে পড়ার শুরুতে এমনিতেই বোনাস প্রশংসা রেডি করেছিলাম লেখকের জন্য, প্রিয়জন/প্রিয়বইকে একটু বেশি কিছু দিতে ক্ষতি কী?

প্রদোষ শব্দের অর্থ তখন জানতাম না। এখনও নিশ্চিত নই পুরোপুরি, তবে যদ্দূর জানি এখানে প্রদোষ মানে সন্ধ্যা। তো নামের অর্থ করলে দাঁড়ায় সন্ধ্যাবেলায় প্রাকৃতজন। সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মম সেনের রাজত্বে সেই ইতিহাসের সাঁঝবেলা ঘনিয়ে এসেছিল প্রাকৃতজনদের জীবনে। তুর্কি আলাউদ্দিন খিলজির আক্রমণ দেখা যায় উপন্যাসের শেষে। কিন্তু এগুলো কোনোটাই উপন্যাসের মূখ্য কিছু নয়, শুধু প্রাকৃতজনদের জীবনে এদের প্রভাবই এখানে মূখ্য হয়েছে।

যদ্দূর মনে পড়ে, শ্যামাঙ্গের কথায় শুরু হয়েছিল গল্প। শ্যামাঙ্গ শিল্পী, আমাদের দেশের সেই সময়ের একান্তই নিজস্ব শিল্প, মাটি দিয়ে মূর্তি তৈরির কাজ করত সে। এক মন্দিরের জন্য কাজ করার সময় সে দেবদেবীর সাথে সাথে তৈরি করে কিছু মানবমূর্তি। কিন্তু মন্দির যার টাকায় হচ্ছিল, সে এসব মেনে নেয়নি, মেনে নেননি শ্যামাঙ্গের গুরুও। একটা সময় শুধু আমাদের উপমহাদেশে না, সারা পৃথিবীতেই শিল্প ছিল আরাধনার মাধ্যম। দেবদেবীর আরাধনা নিয়ে শিল্প হয়েছে বহুদিন। আমার কাছে এখনও শিল্প আরাধনার মাধ্যম। কিন্তু আরাধ্য হিসেবে দেবদেবী থাকলে কেমন যেন প্রাণ পাই না তাতে। মানুষ, প্রকৃতির বন্দনা কেমন করে যেন অনুভব করতে পারি খানিকটা। তাই শুরুতেই শ্যামাঙ্গকে ভাল লেগেছিল। কিছুদিন পর জাতীয় জাদুঘরে গিয়ে অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তির সাথে কিছু মানবমূর্তিও দেখেছিলাম। তখন মনে পড়েছিল শ্যামাঙ্গের কথা।

আছে কিছু বৌদ্ধ ভিক্ষুর কথাও, যারা সেনরাজা আর তার সামন্তদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য এক সশস্ত্র বিপ্লবের চিন্তা করছিল। বেশি কিছু তো ���ানি না, মোটের উপর বৌদ্ধদের জীবনদর্শনও আমাকে মুগ্ধ করে। "সশস্ত্র" বিপ্লবের ব্যাপারটা কেমন যেন যাচ্ছিল না তার সাথে। অবশ্য সময়ই সবকিছুর উপরে, সে চলার পথে দরকারমত বদলে দেয় সবকিছুকেই।

সেই সময়ের প্রাকৃত নারীদের তো দেখিনি, কিন্তু তাদের কথা পড়তে গেলে কেন যেন চোখের সামনে ভেসে উঠে আমার মায়ের কথা, বোনের কথা, অথবা কল্পনার প্রেমিকার কথা। তাদের কি ভালো না বেসে পারা যায়?

বইটার শেষদিকে এসে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর আছে ঘোলাটেভাবে। এদেশের হিন্দু-বৌদ্ধরা এত সংখ্যায় মুসলমান হয়েছিল কেন? প্রশ্নটা কাকতালীয়ভাবে আমার মাথাতেও ঘুরছিল তখন। সত্যি বলতে, এখনও বিষয়টা নিয়ে পড়াশুনা করার ইচ্ছে আছে। সে যাক, কারণটা কী? ঐশ্বরিক কোনো অনুভব? ধর্মীয় ব্যাখ্যা হয়ত তেমনই কিছু, অল্প লোকের জন্য হয়ত তা সত্যিও, কিছু কিন্তু ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞান একটু বেয়াদব কিনা, সে অন্য ব্যাখ্যা খুঁজে। দলিতদের একটু ভাল থাকার ইচ্ছা, কঠিন বর্ণপ্রথা থেকে মুক্তি, আর খানিকটা রাজানুগ্রহ— এসবই ছিল এই বিশাল দলের ধর্মান্তরের কারণ।

এক কথায় আমার খুব ভালো লাগার একটা বই প্রদোষে প্রাকৃতজন। গুডরিডসে মনে হয় বাজে বইয়ের জন্য নেগেটিভ রেটিং আর খুব ভালোলাগা বইয়ের জন্য পাঁচতারার সাথে বোনাস দুয়েকটা তারা দেয়ার সুযোগ দেয়া উচিৎ।
Profile Image for Sumaîya Afrôze Puspîta.
220 reviews288 followers
April 22, 2025
“আমি কি চিন্তা করি শুনবে? শোনো তাহলে, আমি তোমার আমার মতো মানুষের কথা ভাবি। দেখো, এই কি মানুষের জীবন? সুখ নেই, স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবলি প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছে—এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা যায়? বলো, কতদিন এভাবে চলবে?”

▪️▪️▪️

অবিস্মরণীয় এক উপন্যাস। ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি সেন রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বাংলা জয় করেন–লাইনটা ঝাড়া মুখস্থ আজ কত বছর! অথচ তারপর আর কিছু জানি না। কিংবা এই বিজয়ের আগেই বা কেমন ছিল, তাও জানা ছিল না। পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই অজানা এসব অন্ত্যজদের কথা জানতে পেরেছি ব‌ইটা পড়ে।
Profile Image for পীয়্যান নবী.
52 reviews87 followers
March 8, 2017
এমন একটা সঙ্কটকাল, যার কথা আমরা খুব একটা জানি না। ১৭ জনের অশ্বারোহী বাহিনীর হঠাৎ আক্রমণে লক্ষণ সেনের পলায়ন, আর তুর্কিদের হাতে বাংলার পতন। এর বেশি আমরা খুব একটা ছোটবেলায় পড়ি নাই। তবে সময়টা এতো সহজে বর্ণনা করবার মতন ছিল না।
একদিকে বরেন্দ্র, সমতট, রাঢ়, পুন্ড্র এইসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের অর্থাৎ প্রাকৃতজনদের জীবন, আরেকদিকে এইসব অঞ্চলের সামন্ত মহাসামন্তদের শাসন এবং শোষণ। অন্যদিকে উত্তর আর পশ্চিম থেকে ক্রমে ক্রমে মুসলমানদের আগমন... এর মাঝে একদল ভিক্ষু, যারা কি না আর দুই শতাব্দী আগেও বাংলার শাসক ছিল, তারা প্রতিনিয়ত শাসকদের দ্বারা বিতাড়িত হচ্ছে।

সাধারণ মানুষের যে একটা অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট কাজ করছিল সেই সময়টায়, সেটা বেশ অবাক করে দেবার মতন। তাদের একটা বিরাট অংশ ভাবছিল যবনদের (মুসলমান) আগমনে সামন্তদের অত্যাচারের সমাপ্তি ঘটবে। অনেকেই ধর্ম কিংবা দীর্ঘদিনের বিশ্বাসের বাইরে চিন্তা করতে পারছিল না, তারা অত্যাচারিত হলেও ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় দ্বারা শাসিত হতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল। আর খুব সামান্য কিছু মানুষ ছিল, যারা কি না জানত যে, শাসক বদলালেও চরিত্র বদলাবে না।

এমনই একজন মানুষ ছিলেন বসন্তদাস। ছিলেন শ্যামাঙ্গ যে কি না সঙ্কট উপলব্ধি করতে পারলেও অতীতকে মুছে ফেলতে পারছিল না কোনভাবেই। আমরা পরিচয় পাই অনিন্দ্যসুন্দর লীলাবতীর, যে কি না নিজের ভালোবাসাকে প্রতিষ্ঠিত করতে নতুনকে স্বাগতম জানাতে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করে না। আরেক অনিন্দ্যসুন্দরী মায়াবতী... যে কি না সেই সময়ের সাধারণ একজন নারীর ভুমিকাতেই ছিল। তবে আমরা কৃষ্ণা আর তার দুই মন্দিরদাসী সখীকে পাই, পাই ছায়াবতীকে... যারা নারী হয়েও সেই সময়টাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

এটা ইতিহাসের বই না, ঐতিহাসিক উপন্যাস বলতেও আমার আপত্তি আছে। তবে নিশ্চয়ই বইয়ের উপজীব্য ইতিহাস। এমন একটা সময়ের ইতিহাস যা নিয়ে আমাদের খুব ঘোলাটে একটা ধারণা। তবে বাংলা মুসলমানদের আগমন কিংবা আগমনের ফলে এই যে এতো সংখ্যক মানুষ ক্রমাগত মুসলমান হয়ে গিয়েছিল, সেসব নিয়ে বেশ ভালো একটা ধারণা পাওয়া যায়।

বইয়ের ভাষা শুরুতে প্রচন্ড খটমটে ঠেকছিল। মনে হচ্ছিল বাংলা অভিধান নিয়ে না আবার বসতে হয়। তবে কিছুদূর যেতেই মনে হচ্ছিল একটা তালের ভেতর চলে আসছি, খুব সাবলীল মনে হচ্ছিল বর্ণনা। নারীরূপের বর্ণনার জন্য হলেও বোধয় আবার পড়তে হতে পারে বইটা! এত অসাধারণ!

এতকিছুর পর যে একটা সিদ্ধান্তে চলে আসবে বইটা শাসকের ধর্ম কিংবা ভাষা বদল হলেও, অভিমন্যু দাসের মতন মানুষজনই শাসনে অগ্রগামী থাকে। ফলে সবকিছুর পরেও প্রাকৃতজনদের জীবনের দুর্দশার খুব একটা হেরফের হয় না... তাদের প্রদোষকাল বোধয় কখনোই শেষ হয় না।
Profile Image for Rohun.
120 reviews58 followers
January 26, 2022
"তুমি অন্তরে সৎ থাকবে, মহান থাকবে, কিন্তু বাইরে কিছু বলবেনা, এভাবে কি শিল্পী জীবনযাপন করতে পারে?"

উপন্যাসটিকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। লেখক মাত্রই স্রষ্টা। গল্প, উপন্যাস, কাব্য এসব তার সৃষ্টি। কখনো কখনো সৃষ্টির মহিমা ছাড়িয়ে যায় স্রষ্টাকে। এই উপন্যাস টি স্থান,কাল,পাত্র সমেত ছাড়িয়ে গেছে স্বয়ং স্রষ্টাকালকে। যে সময়ের ইতিহাস এই গ্রন্থ বর্ণনা করে তা দ্বাদশ শতাব্দীর বাংলা সমাজ৷ যখন বাংলার শেষ রাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বকাল প্রায় ক্ষীয়মাণ। তুর্কী মুসলমানরা বখতিয়ার খলজীর নেতৃত্বে একের পর এক নগর জয় করে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে তৎকালীন রাজধানী নদীয়ার দিকে। উপন্যাসটি হিস্ট্রিকাল ফিকশান হলেও, ইতিহাস বর্ণনা এর মূল উদ্দেশ্য ছিল না। কোথাও ইতিহাসের লম্বাচূড়া, ধারাবাহিক ক্রম বর্ণনা নাই! তৎকালীন সাধারণ নিচু শ্রেণির মানুষ তথা প্রাকৃতজনদের জীবনযাত্রা, জীবনদর্শন এবং তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া শত বছরের শোষণ ফুটিয়ে তোলাই ছিল এর অন্যতম উপজীব্য।


উপন্যাসের মূল চরিত্র কে তা সঠিক বলা যাবে না। কখনো মনে হবে মৃৎশিল্পী প্রাকৃতজন শ্যামাঙ্গ, আবার কখনো মনে হবে ক্ষেত্রকর বণিক বসন্তদাস। তার স্ত্রী মায়াবতী। স্বামী বাণিজ্য করতে গেছে বলে যার অবস্থান পিত্রালয়েই। এই মায়াবতীরই বাল্যবন্ধু লীলাবতী। এই লীলাবতী-ই যে প্রধান নারী চরিত্র তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তবুও অন্যান্য নারী চরিত্র, যেমন- মন্দিরদাসী ছায়াবতী কিংবা বিদ্রোহী কৃষ্ণাও মনে রাখার মতো।

ছোটবেলার ইতিহাস কিংবা সামাজিক বিজ্ঞান বই পড়ে আমাদের জানা এতটুকুই যে মাত্র আঠারো জন সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার খলজী বিনা যুদ্ধে লক্ষণ সেনের রাজ প্রাসাদে ঢুকে বাংলা জয় করেন। কিন্তু বাংলা জয়েরগল্পটাকি এদ্দুর ই? আমার বরাবর জানতে ইচ্ছা হতো, তখন সেখানকার মানুষের জীবনযাপন কেমন ছিলো? লক্ষণ সেনের আমলে মানুষ কেমন ছিলো? তুর্কিরা আসার পর কি পরিবর্তন হয়ে কেমন হলো? কেমন ছিল আটশো বছর পূর্বের বাংলা? কেমন ছিল তখনকার সমাজ? গ্রামগুলোই বা কেমন ছিল? আটশো বছর আগে এদেশের মানুষ কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করত? কী ছিল তাদের পেশা? কীরূপ ছিল তাদের ধর্মা��রণ? সম্পর্কের স্বরূপগুলো কেমন ছিল? কেমন ছিল এদেশের নদ-নদী, প্রকৃতি? উত্তরসূরী হিসেবে আমার মধ্যে পূর্বপুরুষদের, তথা এদেশের আদিজনদের সমাজ, রাষ্ট্র, গ্রাম বা জীবনাচরণ সম্পর্কে জানার কৌতূহল বা এদেশের প্রাচীন প্রকৃতি, নদ-নদী, হাট-বাজার, গ্রাম-গঞ্জ বা রাস্তাঘাট কেমন ছিল- তা দেখার ইচ্ছা, এই সমস্ত কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে এই উপন্যাসের মাধ্যমে। কারন তৎকালীন সময় নিয়ে কথা বললেই সর্বদা রাজা, মহারাজা, সেনাপতি বা সমাজের উচ্চপদ বা শ্রেণীর কথাই আসে, বলা হয়। কিন্তু এই উপন্যাসে এদের সবাইকে উপেক্ষা করে ঐ সময়ের সমাজের আমজনতা বা সাধারণ মানুষের কথা বলা হয়েছে। এতো মায়াবী, অদ্ভুত সুন্দর ভাষাশৈলী,বর্ণনা যে আমি অভিভূত। লেখনশৈলী গভীরভাবে স্পর্শ করেছে আমাকে। পিপ্পলীহাট, উজবুট গ্রামের পথে-প্রান্তরে, ঘরে ঘরে, নদ-নদী, বন-জঙ্গলে, ফসলের মাঠে ঘুরে বেড়িয়েছি- তখনকার সাধারণ মানুষের একজন হয়ে। তাদের অনিশ্চিত জীবনের প্রতিটি দুর্ভোগ-দুর্দশাকে নিজের করে ভেবেছি। সেই সময়ের সামাজিক নিপীড়নে পীড়িত হয়েছি, আসন্ন বিপ্লব কিংবা বিপর্যয়ে উত্তেজিত, ভীত হয়েছি।

প্রদোষে প্রাকৃতজন' নামটি একটু দুর্জ্ঞেয়। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, দিনের একটি বিশেষ তিথি হলো 'প্রদোষ'। যার দ্বারা মোটামুটি সূর্যাস্তের আগে-পরে দেড় ঘণ্টা সময়কে বোঝানো হয়। অর্থাৎ 'প্রদোষ' অর্থ শেষ বিকেল বা সন্ধ্যা। আর, 'প্রাকৃতজন' শব্দের অর্থ নিতান্ত সাধারণ মানুষ। তবে রূপক অর্থে অন্ধকার বা বিপজ্জনক সময়, বিপদ-অনিশ্চয়তা ঘনিয়ে আসা সময়কে বুঝানো হয়েছে। উপন্যাসটির প্রথম পাতার উৎসর্গপত্রটি পড়লেই সেটি বুঝা যায়,"রাঢ় বরেন্দ্র বঙ্গ সমতট বাসী প্রাকৃতজনের সংগ্রামী পূর্বপুরুষদের স্মরণে"। রাঢ়-বরেন্দ্র-সমতট নিয়ে বর্তমান যে বাংলা, তার নিতান্ত সাধারণ মানুষ, যারা আমাদের পূর্বপুরুষও বটে, তাদেরকেই লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের বাংলা আক্রমণের সময়টি এ অঞ্চলের মানুষের জন্য কি প্রদোষ ছিল? সেটি অবশ্য বিতর্কের বিষয়। 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' নামেই সমগ্র উপন্যাসের সারমর্ম জ্বলজ্বল করছে। প্রাকৃতজনের প্রতিনিধি হয়ে যারা বিচরণ করেছেন পুরো উপন্যাস জুড়ে, তুর্কিদের বাংলা বিজয়ের পূর্বে বর্ণপ্রথা আর সামন্তবাদের কষাঘাতে জর্জরিত সমাজের দ্বারে দ্বারে তারা ঘুরেছেন। সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম, নতুন জাতি, নতুন একটি জীবনধারার আগমন ঘটতে যাচ্ছে এ অঞ্চলে। প্রাকৃতজন, তথা সাধারণের মাঝে কেমন হয় এর প্রতিক্রিয়া? আসন্ন একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিপ্লবকে কীভাবে গ্রহণ করবে এ অঞ্চলের মানুষ? সেনদের দ্বারা বিতাড়িত বৌদ্ধদের সামাজিক অবস্থানই বা কেমন হবে? লেখক সেরকম কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছেন উপন্যাসটিতে। উপন্যাসের কাহিনীধারায় সোমজিতের মতো কিছু চরিত্র ছিল, যারা তৎকালীন সমাজিক সংহতি রক্ষায় তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। সামন্তদের অত্যাচারের পীড়ন থেকে মুক্তির পথনির্দেশনা নিয়ে যারা ছুটে যেতেন লক্ষণ সেনদের দরবারে। কিন্তু সামন্তবেষ্টিত রাজদরবারে রাজার কাছে ঘেঁষার সুযোগ সোমজিতদের হয়ে উঠত না। লেখক সোমজিতকে নিয়ে যান হলায়ুধ মিশ্রের মতো ঐতিহাসিক চরিত্রের কাছেও। উপন্যাসটির চরিত্রগুলোর চিত্রায়ন আর গল্পের প্রবহমানতায় লেখক অনন্য মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। ভাষা, উপমা আর কাহিনী বিন্যাসে সুদূর অতীতের সমাজকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়। বিংশ শতাব্দীতে বেড়ে উঠে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মানুষের সমাজালেখ্য রচনা তার জন্য খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। কেননা, সে সময়ের সমাজ ব্যাবস্থার পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়ার মতো ঐতিহাসিক সূত্র খুবই অপ্রতুল।

উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা নিয়ে সরল পাঠকের মনে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হতে পারে। মুসলমানদের আগমনের পূর্বে বাংলার সমাজ ছিল বর্ণপ্রথা, জাত-পাত ও মানবিক অসাম্যে জর্জরিত। সাম্যের পতাকাবাহী ধর্ম হিসেবে ইসলামের আগমন এ অঞ্চলে একটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। বিধিবদ্ধ 'সামাজিক-সাম্য' ধারণার সাথে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ প্রথম পরিচিত হয় ইসলাম ও মুসলমানদের সংস্পর্শে আসার কারণেই। আবার এটাও ঠিক, একটি বহিঃশক্তি হিসেবেই মুসলমানদের এ অঞ্চলে আগমন ঘটেছিল। তবুও মুসলমানদের আগমনে এ অঞ্চলে যে সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, তা নিছক বিজয়ী শক্তির চিরাচরিত প্রভাবে হয়নি। এর পেছনে ছিল ইসলামের সাম্যের বাণীর প্রত্যক্ষ প্রভাব। কিন্তু লেখক এ পরিবর্তনকে বিজয়ী বহিঃশক্তির চিরাচরিত প্রভাব হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। ইসলামের সাম্য-বাণীর প্রভাবের বিষয়টি সেখানে গৌণ হয়ে থেকেছে। আর সে কারণেই সম্ভবত উপন্যাসের নাম 'প্রত্যুষে প্রাকৃতজন' না হয়ে, 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' হয়েছে। ধোঁয়াশাটাও এখানেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে, আমার মনে হয়, সেই মুসলময়ান দের মধ্যে দুটো শ্রেণী ছিলো। একদল দরবেশ আর বণিক, যারা প্রকৃতই ইসলামের সাম্যের অনুসারী। আরেক শ্রেণী তুর্কি যবনসেনা- যুদ্ধ,লড়াই, খুন, অত্যাচার, ধর্ষণ, জ্বালাওপোড়ায়, দখল,ভোগ ছিলো যাদের কাজ। এরা সামন্তপতিদের সাথে তাই হাত মেলাতে দুই মিনিট সময় নেয়নি! তাই সাধারন মানুষের অবস্থাদৃষ্টে একই হাল- আগের মতোই অত্যাচারিত! তবে এর জন্য একমতে পৌছুতে না পারাও দায়ী।

আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে। আটশো বছর পূর্বে যদি সামন্তপতি সহ সকলে বিশ্বাস ঘাতকতা না করতো, যদি বৌদ্ধ সদ্ধর্মিরা সেন শাসন বা মুসলমানদের সাথে শান্তি চুক্তির ঐক্যমতে পৌছুতে পারতো, বখতিয়ার খিলজির সেইসব জ্বালাওপোড়াও অভিযান সফল না হতো- তবে কেমন হতো আমাদের বর্তমান বাংলা? আসাম, বিহার, উড়িষ্যা, কোলকাতা সহ পুরো বাংলা এক জাতিয়তাতে থাকতো? নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই হাজার হাজার পুথির অগ্নিসংযোগ, সোমনাথ মন্দির লুটপাট অগ্নিযংযোগ- এসব কি হতো? এসব বিষয়ে কারো চিন্তাভাবনা থাকলে শেয়ার করতে পারেন!
Profile Image for Shadin Pranto.
1,469 reviews560 followers
January 2, 2019
পুনঃপাঠ এবং চরম মুগ্ধতায় পাঠের সমাপ্তি।

"প্রদোষে প্রাকৃতজন "অবশ্যপাঠ্য ইতিহাসভিত্তিক ফিকশন। তবে ফিকশন থেকে ইতিহাস শেখায় চেষ্টা না করাই উত্তম। কেননা ফিকশনে বোঝা বড় দায় কোনটি ইতিহাস আর কোনটি ঔপন্যাসিকের কথন।
Profile Image for Adwitiya (অদ্বিতীয়া).
297 reviews42 followers
April 29, 2020
আমার মতে বাংলাদেশের সাহিত্যজগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি কীর্তি এই ঐতিহাসিক উপন্যাস। পড়া শেষে যখন উঠলাম, রাগ হচ্ছিলো এক প্রকার - কেন এই বই আরো বিখ্যাত নয়? যাকগে নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতি বাদ দিয়ে বইয়ের কথায় আসি।

মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী না হলে, আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় প্রাচীন বাংলা সম্বন্ধে জানার সুযোগ খুব কম। প্রাকৃত যুগের সেই পূর্ব পুরুষদের এভাবে রক্ত-মাংসে এই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখে অব্যক্ত কিছু অনুভূতি কাজ করবেই যেকোন বাঙালির মনে। খুব যত্নে লেখা একটি উপন্যাস এটি - সেটি শওকত আলীর সমৃদ্ধ গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতেই বলি আর তার ভাষার ব্যবহারের জন্যই। তৎসম শব্দের প্রচুর ব্যবহার, তবুও পড়তে গিয়ে থমকে যেতে হয়নি একবারও - কী অপূর্ব চমৎকার ছন্দময় ভাষা! মনে হচ্ছিলো যেন উপন্যাস নয় আস্ত এক কবিতা।

নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের জগতে একেবারেই ভিন্নধর্মী খুব চমৎকার একটি কাজ এটি।
Profile Image for Syeda Ahad.
Author 1 book131 followers
February 23, 2016
সাধু রীতিতে লেখা বই আমার তেমন পড়া হয়না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পড়ার কষ্ট পড়া শেষে পাওয়া তৃপ্তির চেয়ে বেশি হয়েছে বলেই হয়তো এ অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সেদিক থেকে এই বই পড়ে শুধু ভালো লেগেছে বলা ভুল হবে, বরং বলা যায়, এরকম একটা বই পড়া গেলে এর আগে পরে এমন কঠিন ভাষায় লেখা গোটা কয়েক বই পড়ে ফেলা কোনো ব্যাপার না। বইয়ের নামকরণ খুবই যথার্থ। ছোটবেলায় যখন সমাজবিজ্ঞান বইতে পড়েছি যে এই উপমহাদেশে মুসলমান শাসনের শুরুটা হয় মাত্র ১৯জন সৈন্য নিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিনের একটা অতর্কিত হামলায়, তাতেই তখনকার রাজা লক্ষণ সেন মহলের পেছন দিয়ে পালিয়ে যায়, খুবই অবাক হয়েছিলাম। আসলে কি হয়েছিলো জানার ইচ্ছে হয়েছে কিন্তু সেই উদ্দেশ্যে ইতিহাস পড়ার সাহস হয়নি! এই বইটায় সেসময়কার সাধারণ 'প্রাকৃত'জনের জীবনযাপনের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এত সুন্দরভাবে সেই 'প্রদোষ'কালকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে ইতিহাস পড়ছি বলার উপায় নেই। যদিও বইটায় ইতিহাসের আর রাজনীতির বেশি গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর কথা না বলে সাধারণ মানুষের কথাই বলা হয়েছে, এখানেই বইটার বিশেষত্ব। কাহিনিবিন্যাস বা ভাষাশৈলী - সবই মুগ্ধ করে রেখেছে। একটু সময় নিয়েই পড়েছি- তবে পুরো সময়টা সার্থক ব্যয় হয়েছে বলতে পারি :)
Profile Image for Zuberino.
429 reviews81 followers
April 13, 2022
এই বইয়ের সাথে প্রেম আমার পনেরো বছর পুরনো। প্রথম সাক্ষাতেই যে বিহ্বলতা আর অপার বিস্ময় আর বিপন্নতা বোধ করেছিলাম, তা লিখে রেখেছিলাম অন্যত্র। সেই বিস্ময় আজো অটুট, প্রতি মোলাকাতেই আমাদের প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হয়। আমার মানসে এই উপন্যাসের প্রভাব আদৌ বলে বোঝানো সম্ভব না। এতটুকুই বলবো - যে আরেক জনমে আমি শ্যামাঙ্গ হয়েই প্রাচীন বাংলার বুকে আবার ফিরে আসার স্বপ্ন দেখি।

প্রদোষে প্রাকৃতজন - বাংলা ভাষায় আমার সবচেয়ে প্রিয় বই, বাংলা উপন্যাসের পথপরিক্রমায় জ্বলজ্বলে মাইলফলক, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম অবিনশ্বর কীর্তি।

http://www.sachalayatan.com/shubinoym...
Profile Image for Salman Sakib Jishan.
272 reviews158 followers
February 4, 2022
আটশো বছর পূর্বের বাংলা!
কতটুকু জানি সেসময়ের কথা? সমাজ বইতে তুর্কি শাসক ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি (এখনও নাম মুখস্থ, কি আজব ব্যাপার!) মাত্র ১৭জন সেনা নিয়ে লক্ষণসেন কে বিতারিত করে এই ভূখণ্ডের শাসনভার তুলে নেয়। কি সম্মোহিত হয়ে মুখস্থ করে গিয়েছি এই গল্প।

'প্রদোষ' অর্থাৎ সন্ধ্যালগ্ন, 'প্রাকৃতজন' অর্থ সাধারণ মানুষ, শোষিত শ্রেণী। এই বইতে শওকত আলী এক অসাধারণ, বর্ণণাতিত রূপকল্প তৈরি করেছেন সেই আটশ বছর আগের সময়কালকে কেন্দ্র করে। যেখানে তিনি বলেছেন সাধারণ মানুষের সময়টা কেমন ছিলো। কে জিতলো, কে বিতারিত হলো সে গল্প নয়। ইতিহাসের সেই প্রদোষকালের জটিল আবর্তে ঘূর্ণায়মান কয়েকজন প্রাকৃত নরনারীর কাহিনী বিবৃত হয়েছে এই উপন্যাসে। এই গল্পে একজন মৃৎশিল্পী, একজন স্বামী পরিত্যাক্তা নারী, একজন মায়াময় স্ত্রী, একজন জেগে ওঠা বণিককে কেন্দ্র করে ঘটনা চিত্রিত হয়েছে।

সেই সময় একদিকে সেনরাজের শাসন চলে যাচ্ছে, তুর্কি আক্রমণ চলছে। গ্রামের পর গ্রাম উভয় পক্ষই জ্বালিয়ে পুরিয়ে, মানুষ মেরে, অত্যাচার করে, বণিকদের স্বর্বস্ব লুট করে যাচ্ছে। কে শত্রু, কে মিত্র বোঝার উপায় নেই। সেসময়ের মানুষের শত বছরের সনাতন চিন্তাধারায় যেখানে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র ইত্যাদি জাত পাত্র ভেদ করে দিয়ে ভাগ্য, জীবিকা নির্ধারণের রাস্তা তৈরি করে দেয়া হতো, সেখানে শাসন করতে আসছে কোনো জাত পাত বর্ণপ্রথাহীন এক বিচিত্র ধর্মের যবন সেনারা। ওদিকে সেন সমান্তরা চালিয়ে যাচ্ছে লুটতরাজ, বৌদ্ধ বিতারিতকরণ। সাধারণ মানুষ জাতের বাইরে চিন্তাও করতে পারছিলোনা অত্যাচারিত হয়েও।

'কতোকাল মানুষ কেবলি দাসত্ব করে যাবে? মনুষ্যজন্মের অর্থই কি দাসত্ব? ভয় আর সন্ত্রাস কি চিরকাল মানুষকে দাস করে রাখবে? এরা কি বারেকের জন্যও সংঘবদ্ধ হতে পারেনা? বোঝে না কি যে সংঘবদ্ধ বাহুবল কি বিপুল ও প্রচন্ড শক্তি ধারণ করতে পারে?'

রাজার পাপে রাজ্য নাশ!
একটা প্রবাদ আছে এরকম। যে রাজা বা, শাসকের ভুলের মাশুল তার একার না, তার প্রজাদেরও। সেরকমই একটা অবস্থা চলছিলো সর্বত্র। এরকম অদ্ভুত এক মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কটের সময় চিন্তা করলেই অবাক লাগে।

বইটা পড়ে আমি যারপরনাই মুগ্ধ। এতো সুন্দর বর্ণণামধুর বই, এত অসাধারণ লেখনি, মুগ্ধ না হয়ে উপায় কই? তবে সত্য করে যদি না একটা কথা বলি, তাহলে ঠিক হবেনা। বইয়ের শুরুতে আমি ভাষা পড়ে পাগলপ্রায় ছিলাম। এতো কঠিন, শুদ্ধ চলিত বাংলা আমি জীবনেও বোধহয় পড়িনি। ঘাম ছুটে যাচ্ছিলো মনোযোগ ধরে রাখতে গিয়ে। কিছুদূর পড়বার পর অবশ্য তাল চলে আসছিল। পুরো ২সপ্তাহ ধরে একটু একটু করে পড়ে আজকেই শেষ করেছি।
এবং আমার শ্রম সার্থক। বাংলা এই ক্লাসিক বইটি নিতান্তই কল্পিত উপন্যাস হলেও আমার মনেহয় সবারই পড়া উচিত চিন্তার পরিবর্তন আনবার জন্য। ইউপিএল এর প্রকাশিত বইটির প্রডাকশনও অত্যন্ত চমৎকার।
অনেকদিন মনে থাকবে বইটির কথা।
Profile Image for Farzana Raisa.
530 reviews237 followers
August 23, 2020
ছোটবেলায় সমাজ বইয়ে পড়েছিলাম, ১৭ জন সঙ্গী নিয়ে বখতিয়ার খলজি দেশে আসেন, অত:পর বাংলা জয় করেন লক্ষ্মণ সেনের কাছ থেকে। বলতে লজ্জা নেই, বখতিয়ার খলজিকে মনে মনে হিরো ভাবতাম। কম কথা? এভাবে ঝড়ের মতন এসে বাংলা বিজয় এরপর আবার এভাবে দাপটের সাথে শাসন করা? দিনে দিনে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। একটাই খারাপ লাগা.. রাজা আসে, রাজা যায়.. প্রজাদের ভাগ্যটা ঠিক বদলায় না।
Profile Image for Ashkin Ayub.
464 reviews228 followers
Read
July 8, 2021
বইটা আসলেই ভাল কিন্তু আমার হয়ত এখনো বয়স হয় নাই। পড়লাম কিন্তু স্বাদ পেলাম না। কয়েক বছর পরে আবার পড়ে দেখবো...
Profile Image for Dev D..
171 reviews26 followers
March 27, 2019
ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে কম নয়, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে প্রমথনাথ বিশী, শরদিন্দু হয়ে সুনীল, হুমায়ুন পর্যন্ত অনেক লেখকই ঐতিহাসিক ঘটনাকে ভিত্তি করে উপন্যাস লিখেছেন, তার অনেকগুলোই পড়া হয় নি কিছু কিছু পড়েছি। বিশেষ করে শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলো আমাকে মুগ্ধ করেছে। শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন পড়ে একই রকম তৃপ্তি পেলাম। সেনদের আমলের শেষে তুর্কী বাহিনী বঙ্গ জয় করেছিলো এই ইতিহাস আমাদের সবারই জানা, তবে তার বিশদ বিবরণ নির্মোহভাবে পাওয়া হয়তো এখন অসম্ভব। এই বইকেও ইতিহাসের বই হিসেবে না পড়ে উপন্যাস হিসেবে পড়লেই মনের মধ্যে এসব যুক্তি তর্ক উঁকি দেবার সুযোগ পাবে না। বাংলায় একসময় বৌদ্ধ ধর্ম ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিলো, কিন্তু পাল আমলের পরে সেনরা এসে আবার বৈদিক হিন্দু ধর্মকে শাসনযন্ত্রের সাথে যুক্ত করায় হিন্দু ধর্মের পুর্নউথ্থান ঘটে। জাতপাত আর ধর্মীয় কুসংস্কারের বলি হয়েছিলো এদেশের আদিম অধিবাসীরা, যারা হয়তো সেভাবে আর্য মিশ্রিত হয় নি। শঙ্করাচার্যের হিন্দুধর্মের পুর্নজাগরণের ফলে বৌদ্ধধর্ম তখন ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিতে চলেছে। কেমন ছিলো সেসময়ের প্রাকৃতজন, বাঙালিরা? তাদেরই কথা লিখেছেন শওকত আলী।অস্বীকার করার উপায় নেই হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে আমাদের বেশিরভাগ বাঙালির পূর্বপুরুষ এই প্রাকৃতজনরাই। সাথে সামান্য আর্য,মোঙল, তুর্কী, পাঠান বা আরব রক্ত নিশ্চয়ই ম��শেছে কিন্তু এই উপন্যাসের শ্যামাঙ্গ, বসন্তদাস, লীলাবতী, মায়াবতীর মতো মানুষরাই তো আমাদের আদিপুরুষ বা নারী। এই উপন্যাসে তো তাদের কথাই বলা হয়েছে। সময়ের প্রেক্ষিতে এসেছে হরিসেন, উগ্রসেনের মতো সামন্ত প্রভুর কথা, তুর্কী আক্রমণকারীদের কথা, ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কথা, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কথা, যোগীদের কথাও। সেসময়ে হিন্দুধর্মের রূপও যে ঠিক এখনের মতো ছিলো না তাও বোঝা যায় এ উপন্যাস পড়লে। সূর্য দেবতার মন্দির মনে করিয়ে দিলো বরেন্দ্র যাদুঘরে দেখা সূর্য মূর্তির কথা। মন্দিরে সেবাদাসী বা দেবদাসীর প্রচলনও হয়তো তখন ছিলো। সেসময়ের সাধারণ মানুষ সত্যিই এমন রাজনীতি সচেতন ছিলো কিনা জানিনা তবে শ্যামাঙ্গদের মতো মানুষ যেমন সব সমাজে থাকে অভিমন্যুদাস, হরিসেন এর মতো মানুষও থাকে। প্রাকৃতজনদের জীবনে এরপর হয়তো অনেক পরিবর্তন এসেছে, ধর্ম পরিবর্তন হয়েছে, রাষ্ট্র পরিবর্তন হয়েছে, প্রায় হাজার বছর কেটে গেছে, নদীর গতিপথ বদলে গেছে, বদলে গেছে ভূপ্রকৃতি, সেসময়কে আর সঠিকভাবে জানার কোন সুযোগ নেই, তবু শওকত আলী যে সে সময়টাকে কল্পনা করার ভাববার সুযোগ করে দিলেন সেটাই একটা বিশাল ব্যাপার। লেখক তার লেখায় তখনকার প্রচলিত অনেক শব্দ ব্যবহার করেছেন, তাতে সেই সময়টি আরও সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। উপন্যাসটি কখনো বিরক্তি উৎপাদন করে নি, বরং মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেছে সবসময়।
Profile Image for Shanto.
45 reviews15 followers
April 20, 2015
"আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম, গেরামের নওজোয়ান, হিন্দু-মুসলমান"। এই গানটা আমরা অনেক সময় আক্ষেপ করে গেয়ে থাকি, উল্লেখ করে থাকি বিভিন্ন সময়। কিন্তু আমরা জানি এই গান অতীত নিয়ে স্বভাবসুলভ রোমান্টিসিজম ছাড়া বাস্তবকে খুব কমই পরিচয় করায়। এই অঞ্চলে আসলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কখনোই ছিল না সেইভাবে। বিশেষ করে সমাজপতি, রাজ-রাজরা আর সামন্তপতিদের ধর্ম, সংস্কৃতি আর ক্ষমতার খেলায় ব্রাত্যজনেরা ইতিহাসের ঠিক কোন সময়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করেছে সেটা বলা আসলেই খুব কঠিন ব্যাপার। তারপরেও সেই অনালোকিত ইতিহাসের মধ্যেও কখনও কখনও নেমে আসে আরও গভীর অন্ধকার। এই আখ্যান ইতিহাসের এমনই এক প্রদোষকালের আখ্যান।

সমাজের পতিত, ব্রাত্য আর নীচতলার মানুষের জীবনের প্রভাতকাল দৃশ্যমান হয় কদাচিৎ। তথাপি ইতিহাসের কোনো প্রদোষকালে এই সব প্রাকৃতজনেরা দাঁড়িয়ে যান এমন এক সময়ের মুখোমুখি যখন শুধু চুপ করে মৃত্যুর অপেক্ষা করা ছাড়া, ধ্বংসের অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। সমাজপতি আর উঁচুপর্যায়ের মানুষ সুযোগ পেয়ে সটকে পড়েন, কেউ আপোষ করেন নতুন সমাজপতির সাথে। কারণ নতুন সামন্তপ্রভু আর সমাজপতিদের শোষণের কায়দা কানুন শিখতে পুরোনোদের নিজেদের সাথে নিয়েই চলতে হয়। কিন্তু এইসব সময়ে নতুন সমাজপতিদের লোভ আর প্রয়োজনের শিকার হয় সমাজের ব্রাত্যজনেরা। এই আখ্যান ইতিহাসের এমনই এক প্রদোষকালের। এই আখ্যান ইতিহাসের এমনই এক প্রদোষকালে প্রাকৃতজনদের আখ্যান।
Profile Image for Titu Acharjee.
258 reviews34 followers
November 30, 2021
অতুলনীয়। অভূতপূর্ব। অবশ্যপাঠ্য।
Profile Image for সারস্বত .
237 reviews136 followers
August 15, 2020
আনুমানিক ১২০৫-০৬ সালে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৭ জন ( ঐতিহাসিক মিনহাজের মতে ১৮ জন ) সৈন্য নিয়ে নদীয়া আক্রমণ করেন এবং রাজা লক্ষণ সেন পরাজিত হয়ে তার অন্য রাজধানী বিক্রমপুরে পলায়ন করেন, এই ইতিহাস সবর্জনবিদিত।

কিন্তু তৎকালীন বৌদ্ধ ভিক্ষু আর যোগী সম্প্রদায়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় যে বাংলায় মুসলিম আগমণ ত্বরান্বিত হয়েছিলো সেই ইতিহাস আজও অনেকের অজানা।
কিন্তু কেন তাঁদের এই বিশ্বাসঘাতকতা শাসক শক্তির সাথে?
স্বদেশে বিদেশী শক্তি ডেকে আনার পিছনে কি উদ্দেশ্য ছিল এইসব সংস্যারত্যাগী ভিক্ষু আর যোগীদের?
সামন্তবাদী বাংলার পতন ঘটলে কি লাভ হতো তাঁদের?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছেন বাংলাদেশের বরেণ্য লেখক শওকত আলী তার অনবদ্য সৃষ্টি প্রদোষে প্রাকৃতজন বইটিতে।

বইয়ের নামঃ প্রদোষে প্রাকৃতজন
লেখকঃ শওকত আলী
প্রকাশনীঃ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১৯৬
জনরাঃ ঐতিহাসিক
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৪

নামকরণের সার্থকতাঃ

প্রদোষকালের অর্থ হলো সায়াহ্ন কিংবা সন্ধ্যাকাল। ঠিক আঁধার নামার পূর্বকাল হলো প্রদোষকাল। আর প্রাকৃতজনের বলতে লেখক বিশেষ করে তৎকালীন ( কিছু কিছু আজও বিদ্যমান ) হিন্দুদের দাসশ্রেণীকে অভিহিত করেছেন যেমনঃ ডোম, হডডি, ক্ষেত্রকর, কুম্ভকার প্রভৃতি।

বাংলায় মুসলিম আক্রমণের মধ্য দিয়ে নেমে আসে এক গাঢ় আঁধার কাল। কারণ অন্য মুসলিমদের থেকে তুর্কিরা ছিল দুর্বিনীত। তারা কোণ কিছুর তোয়াক্কা করতো না। অবাধে লুন্ঠন, নারী ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ইত্যাদী বাংলার ঐ অঞ্চলে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। আর সেই সাথে এই মহানিধনে যোগ দেয় সামন্তরা আর সেই উদ্বেগজনক সময়ে প্রাকৃতজনের বেঁচে থাকার লড়াই নিয়ে রচিত হয়েছে প্রদোষে প্রাকৃতজন বইটি।

আর বইটির দ্বিতীয়ভাগের নাম দুষ্কালের দিবানিশি। মুসলিম আক্রমণ শুরু হবার পর বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষেরা যে দুষ্কালের অন্ধকার রূপ প্রত্যক্ষ করেছিল সেটা নিয়ে রচিত এই পরবর্তী অংশ।

ভৌগলিক প্রেক্ষাপটঃ

বাংলার প্রাচীন জনপদ গুলো মূলত বঙ্গ, গৌড়, বরেন্দ্র, পুন্ড্রু, রাঢ়, সমতট , হরিকেল, এই সাতটি ভাগে ভাগ ছিল। আর প্রদোষে প্রাকৃতজনের ঘটনা প্রবাদ আমরা মূলত দেখতে পাই বরেন্দ্র অঞ্চলে (বর্তমানে উত্তরাঞ্চল যেমন রাজশাহী, দিনাজপুর )

মূল প্রেক্ষাপট সংক্ষেপেঃ

বাংলায় মুসলিম আক্রমণের ঠিক কয়েক দিবস পূর্বে এই গল্পের প্রারম্ভিকা। গল্পের শুরুতে আমরা দেখতে পাই, শ্যামাঙ্গ নামের এক কুম্ভকার (মৃৎশিল্পী) যুবক তার গুরুর সাথে কলহ করে আত্রেয়ী নদীর তীরে নিজ গ্রামে প্রত্যাবর্তন করতে চায়। কিন্তু পথ ভুল করে সে উজুবট নামক এক ক্ষেত্রকরের গ্রামে উপস্থিত হয়। আর এখানেই তার পরচিয় ঘটে দুই নারীর সাথে, মায়াবতী আর লীলাবতী। দুজনেই স্বামী থাকা সত্ত্বেও স্বামীহীনা। মায়াবতীর স্বামী বসন্তদাস বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে নিরুদ্দেশ আর লীলাবতীর স্বামী অভিম্যনুদাস উন্মাদ এবং বর্বর।

মায়াবতীদের গৃহে আতিথিয়তায় শ্যামাঙ্গ একটি রাত্রি যাপন করে পরের দিবসে নিজ গ্রামে যাত্রা শুরু করে । কিন্তু তার উদ্দেশ্য সফল হয়না। নবগ্রাম হাটের নিকট পিপ্পলীহাটের একটি ঘটনায় সৈন্য সমাবেশ দেখা যায়। এমন কি তারা শ্যামাঙ্গকেও বিপদগ্রস্ত করে তোলার চেষ্টা করে । অবশেষে কিছু উৎকোচ দিয়ে শ্যামাঙ্গ মুক্তিলাভ করে। তারপর সে নানা স্থান ভ্রমণ করে পুনরায় ফিরে আসে উজুবট গ্রামে আর এই প্রত্যাবর্তন তার জীবনে লীলাবতীকে এনে দেয়। ঠিক তখন সামন্ত অনুচর আর যবনদের (মুসলিম সৈনিকদের) আক্রমণে উজবুট গ্রামটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। গ্রামদের বাসিন্দারা প্রতিবেশী অঞ্চলে পয়ালন করে আর শ্যামাঙ্গ আর লীলাবতীর শুরু হয় গন্তব্যহীন এক যাত্রা। যেখানে প্রতিমুহুর্তে মৃত্যু নিঃশ্বাস ফেলে।

পিপ্পলীহাটের একটি ঘটনা তৎকালীন শাসন ব্যবস্থা বুঝে নেবার জন্য পর্যাপ্ত। রাজার মন্ত্রী, সামন্ত, মহাসামন্তদের বিশাল প���াতিকবাহিনী, অশ্ববাহিনী, হস্তীবাহিনী সবই ছিল। কিন্তু সেগুলোর ব্যবহার ছিল শুধুমাত্র প্রজাপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কোন বহিঃশক্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নয়। দস্যুরা ইচ্ছামত যাত্রীদের লুন্ঠন করতো, হত্যা করতো, বাঁধা দেবার কেউ ছিলনা। স্বয়ং রাজপুরুষেরাও বণিকদের বিপণী লুঠ করতো। আইন শৃঙ্গলা ছিল প্রহসন মাত্র। নিম্নশ্রেণীর মানুষদের পীড়ন করা ছিল যেন উচ্চবর্ণে মানুষের জন্মগত অধিকার। এই সময়কালে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উপর হিন্দু সামন্তেরা অত্যাচারের সব সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিলো।

চারিত্রিক বিশ্লেষণঃ

শ্যামাঙ্গ চরিত্রটি স্বাতন্ত্র্য। শাসন ব্যবস্থার পালাবদল কিংবা রাজনীতির সাথে শ্যামাঙ্গের সম্পর্ক সবসময় ছিল শীতল। লীলাবতী তার জীবনে এলে নারীত্বের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে ক্লান্ত জীবনে শ্রান্তি অনুসন্ধানে তাকে অধিক আগ্রহী মনে হয়। তবে সে দক্ষ শিল্পী। মাটির কাঠামোয় নিজ প্রিয়তমা লীলাবতীকে জীবন্ত করে তুলেছে বার বার। আবার সে ধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। যবনকেন্দ্রে তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে লীলাবতী অনুরোধ করলে সে প্রত্যাখান করে চলে আসে আর তার জন্য তাকে চরম মূল্য দিতে হয়।

মায়াবতীর স্বামী বসন্তদাস এবং লীলাবতীর স্বামী অভিমন্যু দাস দুজনেই আমরা পরবর্তীতে দেখতে পাই। কিন্তু দুই রূপে। প্রথমজন লেবারেল চিন্তাধারা অধিকারী যে মানুষে মুক্��ি চায় আরেকজন অসুস্থ মানসিকতা পোষণ করে যে মানুষের রক্ত চায়।

লেখক বসন্তদাসকে অনেকটাই লেবারেল চিন্তাধারার ব্যক্তিত্ব হিসাবে উপস্থাপন করলেও স্বল্পশিক্ষিত একজন ক্ষেত্রকরেরে খোলসটা একেবারে খুলে দেননি। কখনো কখনো সে বলেছে নিম্নশ্রেনীতে জন্ম মানুষে ভবিতব্য, এটা মেনে নিয়ে নিজ নিজ কাজ করাই একমাত্র শান্তির পথ। আবার বসন্তদাস তার বন্ধু বৌদ্ধ ভিক্ষু মিত্রানন্দের সাথে সাধারণ মানুষের মুক্তির সুরে সুর মিলিয়েছে। উপন্যাসটতে বসন্তদাসের ব্যাপ্তি অনেক বেশী। মূল চরিত্র হিসাবে শুরুতে শ্যামাঙ্গকে মনে হলেও ধীরে ধীরে কখনো বসন্তদাস যে পাঠক হৃদয়ের দখল নেবে এরা উদ্ধার করা কঠিন।

ব্যক্তিগত মতামতঃ

একজন মানুষের সবথেকে বড় ধর্ম কি?
যদি বস্তুনিষ্ঠতায় উত্তর হয় বলতে হবে পরিবার একজন মানুষেত সবথেকে বড় ধর্ম। পরিবারের সুখ, সন্তানের লালিত্য এইসবের জন্যই বেঁচে থাকা। কিন্তু তৎকালীন সামন্তবাদী সমাজে নিম্নশ্রেনীভুক্ত মানুষের সেই পরিবার ব্যবস্থা উচ্চবর্ণে হাতে বার বার লাঞ্ছিত হচ্ছিলো। উচ্চবর্ণের ছেলেরা পুত্রকে হত্যা করলে বিচার নেই, স্ত্রীকে অসম্মান করলে প্রতিবাদ করার অধিকার নেই। এমতাবস্থায় এই ভূমির প্রাকৃতজনের জন্য যবন আগমণ ছিল আশীর্বাদ। শত শত সমাজ পরিত্যাক্ত মানুষ দলে দলে শুধু নিজের পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে।

কিন্তু শুরুতে পথ মসৃণ হয়নি। বর্ণ এবং জাত নির্বিশেষে হত্যা আর নারী ধর্ষণের, জোর করে ধর্মানন্তরে তৃপ্তি হয়ে তুর্কিরা শাসন ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে কয়েক যুগ সময় ব্যয় করে। আর বৌদ্ধরা সে প্রত্যাশা নিয়ে যবনের এই দেশে আমন্ত্রন জানায় তাঁদের সেই প্রত্যাশা মুখ থুবড়ে পরে থাকে। গল্পের শেষে আমরা সেটি দেখতে পাই যখন যবনদের সঙ্গে মিশে অভিমন্যুদাস দুজন্য বৌদ্ধ ভিক্ষুকে তরবারি দিয়ে কবন্ধ করে দেয়।

ইতিহাস কখনো নিরপেক্ষ নয়। তবে শওকত আলী নাকি লেখাটি এক যুগেরও অধিক সময় ধরে সম্পন্ন করেছেন। বইটি পড়ার পর আমার মনে হয়েছে সাধারণ ঐতিহাসিক উপন্যাস থেকে এর স্থান অনেক উপরে আর নিঃসন্দেহে বইটি ইতিহাসের দলিল স্বরূপ।
Profile Image for Saiful Sourav.
103 reviews72 followers
October 31, 2022
সেন রাজত্বকালে সাধারণ প্রজারা সামন্ত জমিদারদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ । আর তখনই ঘোড়ায় চড়ে বখতিয়ার খলজি ও তার সৈন্য-সামন্তদের আগমন । যবনদের (মুসলিম) আগমন ও তান্ডব, সেন রাজার সামন্তদের অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের ও ক্ষমতা চর্চার অত্যাচারে জনকূল ছত্রছিন্ন । বহুমুখী অত্যাচারের প্রতিবাদ করে হিন্দু, বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সাধারণ ভুক্তভোগিরা । সে সময়কালে কয়েকজনের জীবন-সংগ্রাম ও প্রকৃত জনগোষ্ঠির ছুটে বেড়ানো পরিবার, আপন ও প্রিয়জনদের অসহায়বস্হার গল্প ।
চরিত্রগুলো তৈরি করতে ইতিহাসের শেকড় খুঁড়ে নৃতাত্বিক পর্যালোচনায় এই ভূখন্ডের অতীতকে তুলে আনতে হয়েছে । গদ্য ভাষণেও সে মত শব্দ ও শব্দের আদি অবস্হা কিছুটা লক্ষ্য করা যায় । একবার ডুবে গেলে মজে যাওয়া যায় । এ উপন্যাস পড়ে এক ঢিলে ইতিহাস ও গল্পের দুই পাখি মারা গেল ।
Profile Image for Momin আহমেদ .
112 reviews49 followers
December 13, 2022
শুধুমাত্র প্রচ্ছদ এর জন্যেই এই বইটি সংগ্রহে রাখা যায়...
Profile Image for Samsudduha Rifath.
425 reviews22 followers
August 30, 2025
এতো কঠিন চলিত ভাষা পড়তে গিয়ে অনেকে বার বার হোচট খেতে পারেন। কিন্তু যদি দৃঢ়ভাবে পড়ে যেতে পারেন বইটা আস্তে আস্তে সময় নিয়ে তাহলে এক অসাধারণ যাত্রায় অগ্রসর হবেন। শ্যামাঙ্গ, তোমার তো কোনো কূলেই জায়গা হলো না। আঠশো বছর আগের বাংলা কেমন ছিল তা শওকত আলী অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। দেরীতে পড়ায় ভালোই হয়েছে। কঠিন কঠিন শব্দগুলোর অর্থ ধরতে পেরেছি যার জন্য উপভোগ্য হয়েছে বইটা।
Profile Image for পটের দুধের কমরেড.
209 reviews25 followers
December 18, 2020
মহারাজা লক্ষ্মণ সেনের শাসন সন্ধ্যার অন্তিমকালে এবং তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৮ জন অশ্বরোহী নিয়ে বাংলা দখল ও মুসলমান শাসন কায়েমের উদয়কালের প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত শওকত আলীর 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' নামের নিপুণ শিল্পকর্ম সাহিত্য মন্দিরের দেয়ালে শ্যামাঙ্গের মৃত্তিকাপটের ন্যায় সৌন্দর্যতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত শিল্পদর্শন হয়ে শতাব্দীকাল অক্ষুণ্ণ থাকবে৷ সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেনের শাসনের ইতিহাস বিবৃতিকে প্রধান্য দেওয়া হয় নি, বরং সেই দুঃসময়কালে বাংলার জনপদে নিম্নবর্গের মানুষদের জীবনযাত্রায় সংকটকালীন অস্থির প্রতিকৃতিতে আলোকপাত করাই ছিল মুখ্য৷



প্রদোষ শব্দের অর্থ সন্ধ্যাবেলা আর প্রাকৃতজন বলতে বোঝায় অত্যন্ত সাধারণ/প্রান্তিক/নিরীহ মানুষজন৷ তবে শব্দ দুইটোর মিলিত অর্থ ভিন্ন৷ 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' অর্থ দাঁড়ায় বিপর্যস্ত অবস্থায় সাধারণ জনগন৷ এই শব্দজোড়াতেই বইয়ের মূলভাবের সম্প্রসারণ এবং নামকরণের সার্থকতা নিহিত আছে৷ রাজকার্য পরিচালনায় লক্ষ্মণ সেনের অদক্ষতার সুযোগ নিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী সামন্ত—মহাসামন্তপতিরা তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপে নিচুজাতের মানুষদের উপর অন্যায়, অত্যাচার, হত্যা, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে জনজীবন শোষিত নিপিড়ীত ও বিপর্যস্ত করে তুলে৷ সৈন্যদের প্রতি বিদ্রুপের কারণে দুই ডোম নারীর যোনিদেশে উত্তপ্ত লোহার রড প্রবেশ করানো এবং এক ভিক্ষুকে শূলে ছড়িয়ে হত্যা করার মাধ্যমে সেই কালের নির্মমতা সহজেই অনুধাবন করা যায়৷

গল্পের শুরু হয় মন্দিরের চিত্রকপটে দেবদেবীর মূর্তি বাদে অন্য নরনারী মূর্তি তৈরির অস্প��্ধায় গুরু বাসুদেব কর্তৃক লাঞ্চিত হয়ে মৃৎশিল্পী শ্যাঙ্গামের নিজ গ্রামে যাত্রাপথের মাধ্যমে৷ পথিমধ্যে পরিচিত হয় মায়াবতী ও লীলাবতীর সাথে এবং তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন গ্রামে সৈন্যদের অযাচিত বর্বরতার কথা শুনে শ্যাঙ্গাম মায়াবতীর মাতুলালয়ে আশ্র‍য় নেয়৷ মায়াবতীর স্বামী বসন্তদাস বাণিজ্যর কারণে বাইরে ঘুরে বেড়ায়৷ সংসারের প্রতি তার উদাসীনতাও স্পষ্টই পরিলক্ষিত৷ লীলাবতীর স্বামী অভিমন্যু বিকারগস্ত মানুষ৷ তাই স্বামীর সংসার ত্যাগ করে সে নিজ বাড়িতেই থাকে৷ সময়ের আবর্তনে শ্যাঙ্গাম ও লীলাবতী একে অপরের মায়ায় জড়িয়ে যায়৷ কিন্তু সমাজ, ধর্ম ও জীবনবাস্তবতার নানা ঘাত সংঘাতে জর্জরিত তাদের সম্পর্ক অনিবার্য নিয়তির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে৷ অন্যদিকে, বসন্তদাস গ্রামঞ্চলে ঘুরে সামন্তপতিদের এইসব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠে৷ ক্ষমতাচ্যুত বৌদ্ধধর্মানুসারী ভিক্ষুদলও এইসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমাবেত হয়ে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করে৷ কিন্তু সবকিছুর পরেও কি আদৌ পরিবর্তন আসবে? সেই উওরের জন্য শুধুই অপেক্ষা করে যেতে হয়৷ অন্যদিকে, বাঙলার দোরগোঁড়ায় যবন জাতির (তুর্কি মুসলমান) আক্রমণের পদধ্বনি শোনা যায়৷ তাদের নিয়ম আচরণ ব্যতিক্রম এবং ঠিক বোধগম্য নয়৷ তবে কি যবনদের ঢালের আড়ালে প্রাকৃতজনের মুক্তির সীমানা নাকি তরবারিতে রঞ্জিত হবে সংশয়কুল জীবনের আখ্যান? শ্যাঙ্গামের নিয়তি জানা যায়, কিন্তু বসন্তদাস, মায়াবতী, লীলাবতী, মিত্রানন্দ, নিরঞ্জন প্রমুখের ভাগ্য কি হলো?

প্রদোষে প্রাকৃতজন বইয়ের অন্যতম অলঙ্কার হলো ভাষার ব্যবহার৷ সাধুভাষার সাথে চলিতরূপের অভূতপূর্ব মিশ্রণে গদ্যগুলো চমকপ্রদ লেগেছে৷ ভাষাগত তাৎপর্য বইয়ের শিল্প বৈশিষ্ট্য বাড়িয়েছে বহুগুণে৷ তবে সত্যি বলতে সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার কিছু জায়াগায় অতিরঞ্জিত ও বেমানান ঠেকেছে৷ বিশেষ করে গালির দেওয়ার ক্ষেত্রেশালার ছেলের যখন শ্যালক পুত্র, শূয়োর যখন শূকর পুত্র হয়ে যায়, সেই গালি বুঝা গেলেও পড়ে ঠিক আরাম পাওয়া যায় না!

প্রদোষ প্রাকৃতজন থেকে উদ্ধৃত —

" যদি কোনো পল্লী বালিকার হাতে কখনও মৃৎপুত্তলি দেখতে পান, লক্ষ্য করে দেখবেন, ঐ পুত্তলিতে লীলাবতীকে পাওয়া যায় কি না- আর যদি যায়, তাহলে বুঝবেন, ওই শুধু মৃৎপুত্তলিই নয়, বহু শতাব্দী পূর্বের শ্যামাঙ্গ নামক এক হতভাগ্য মৃৎশিল্পীর মূর্ত ভালোবাসাও৷ "

Profile Image for Shuvongkar Shitu.
44 reviews17 followers
April 17, 2021
প্রদোষে প্রাকৃতজন নামের বাংলা অর্থের থেকে ইংলিশ নামটা সহজে বোঝা যায়। Sons of the Soil in Twilight. সুন্দর নাম।
বাংলায় বৌদ্ধ্ব সাম্রাজ্যের পতন এবং যবন তথা মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা নিয়ে গল্প। গল্প বলাটা আসলে ঠিক হবে না ইতিহাস বলা যেতে পারে।

সামন্তবাদী বৌদ্ধ সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হবার পিছনে কারণ কী? কী করে বাংলায় ভিনদেশী যবন সাম্রাজ্যের উত্থান। যবন হোক বা হিন্দু, বাংলার চরিত্র আজও একই রয়ে গেছে।

রক্তপাত, লাঞ্চনা, অপমান ইত্যাদি আমরা পূর্বেও দেখেছি, এখনও দেখছি। অন্ধের কি বা রাত্রি, কি বা দিন। তখন ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়রা নির্যাতন করতো, এখন যবনেরা করবে-একই ব্যাপার।
Profile Image for Nazrul Islam.
Author 8 books228 followers
April 3, 2018
অফিসে বসিয়া শেষ করিয়াছি। ইহার রিভিউ লেখার পূর্ণ ইচ্ছাই বিদ্যমান রইলো। হয়তো কোন একদিন হবে।
Profile Image for শৌণক.
112 reviews17 followers
June 20, 2021
সময়টা সম্ভবত এখনের থেকে প্রায় বারোশ' বছর আগে। লেখকের ভাষায়ই বলি, উত্তম রাজ চক্রবর্তী পরম ভট্টারক ব্রহ্মক্ষত্রিয়কুলতিলক মহারাজ শ্রীমৎ লক্ষ্মণ সেন দেব এর সময়কাল। সেন বংশের শাসনামল শেষ হয়ে আসছে প্রায়। পুণ্ড্র, রাঢ়, বঙ্গ জুড়ে সামন্ত, মহাসামন্তদের প্রতিপত্তি। শাসন আর অপশাসনে অস্থির জনপদ। অত্যাচার, বিশৃঙ্খলা আর শিথিল শাসনে নদীয়ার সিংহাসন টলে উঠে। আমরা বসন্তদাস, শ্যামাঙ্গ আর মিত্রানন্দের চোখে দেখি কৃষক, বণিক যারা  প্রকৃত অর্থেই প্রাকৃতজন বা সাধারণ মানুষ, তাদের নিত্য দুর্দশার চিত্র।


পাল রাজাদের শাসনামলে বৌদ্ধ ধর্ম তখন এ উপমহাদেশে বিস্তার লাভ করেছিল। সেন বংশ ক্ষমতা দখলের পর আর্যরা পুনরায় ফিরতে আরম্ভ করে দৃশ্যপটে। বৌদ্ধ বা সদ্ধর্মীদের দেখা হয় রাষ্ট্রোদ্রোহী হিসেবে। একইসাথে উপমহাদেশে ইসলাম প্রভাব বিস্তার শুরু করে। ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় দ্বারা নিত্য অত্যাচারিত ডোম, চন্ডালরা দলে দলে আশ্রয় নেয় যবনকেন্দ্রে। সদ্ধর্মীদের অবস্থাও যে ভিন্ন কিছু ছি ল, ব্যপারটা অমন না।


কি অসাধারণ লেখনী। আমার ভকাবুলারি খুবই সীমিত হওয়ায় মাঝেমাঝে বাংলা ডিকশনারী খুলতে হয়েছে যদিও, মুগ্ধতা কমেনি একটুও। গল্পের শুরুটা হয় শ্যামাঙ্গের হাত ধরে। উজুবট গ্রামে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সে শ্রান্ত হয়ে পড়ে। যে সময়টার কথা বলছি, গো শকট বা গরুর গাড়ি একমাত্র বাহন। হাটবারে ফিরে দেখে সমস্তই ফাঁকা। সে গ্রামেরই দীনদাসের কাছে তার আশ্রয় হয়। পরিচয় হয় লীলাবতী, মায়াবতীর সাথে। গল্পের এগিয়ে চলা এরপরে। দেখতে পাই সাধারণ মানুষের উপকথা, তাদের ভালোবাসা, কামনা, হিংসা, ক্রোধ, লোভ, আক্ষেপ, হতাশার খন্ডচিত্র। শুনতে পাই শস্ত্রধারী সেনাদের নৈরাজ্য আর হুঙ্কার। তুর্কি বা যবনদের আগমন  তখন সন্নিকটে। সামন্ত আর মহাসামন্তদের রোষানলে ভষ্ম হয়ে যায় লোকালয়। এরপরও সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকে। নতুন আশা নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে, নতুন প্রাণ বুকে নিয়ে।

দিন বদলের আশায়...
Profile Image for তানজুম ফেরদৌস.
56 reviews5 followers
February 19, 2022
আটশো বছর আগের কাহিনী! ভাবা যায়!

'যদি কোনোপল্লী বালিকার হাতে কখনও মৃৎপুত্তলি দেখতে পান, তাহলে লক্ষ্য ক'রে দেখবেন, ঐ পুত্তলিতে লীলাবতীকে পাওয়া যায় কি না - আর যদি যায়, তাহলে বুঝবেন, ওটি শুধু মৃৎপুত্তলিই নয়, বহু শতাব্দী পূর্বের লীলাবতীর জন্য শ্যামাঙ্গ নামক এক হতভাগ্য মৃৎশিল্পীর মূর্ত ভালবাসাও.....’
Profile Image for Ahmed Aziz.
381 reviews69 followers
April 10, 2019
সেন রাজত্বের শেষদিকে সামন্তরাজদের অত্যাচার, সাধারণ মানুষদের রুখে দাঁড়ানো, সাথে থাকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা, বাংলায় আগমন ঘটে বখতিয়ার খিলজির। সেইসময়ের সাধারণ মানুষের জীবনের অসাধারণ গল্প।
Profile Image for Rehnuma.
444 reviews21 followers
Read
January 10, 2025
❛প্রদোষের পথে হাঁটে প্রাকৃতজন,
আলোর সন্ধানে খুঁজে আপন স্বপন।❜

❛প্রদোষে❜ শব্দটি সংস্কৃত থেকে এসেছে। যার অর্থ ❛সন্ধ্যার সূচনা বা সন্ধ্যা নামার সময়❜। একে ভাবগতভাবে ❛কোনো কিছুর শেষে নতুন শুরু❜ কেও বোঝায়। আবার খারাপ কিছুর অবসান হিসেবেও বলা যায়।
❛প্রাকৃতজন❜ বলতে সাধারণ স্বাভাবিক মানুষকে বোঝায়। যারা অতি সাধারণ জীবনযাপন করে থাকে।

তখন চলছে সেন শাসন। রাজা লক্ষণ সেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। রাজ্য তিনি অন্যের কথায় চালাচ্ছেন। তবে তিনি আড়ালেই আছেন। রাজার দেশে প্রজার সুখ নাই। সামন্ত-মহাসামন্তদের যথেচ্ছ ব্যবহার আর প্রজাদের পীড়ন নীতিতে তারা বেশ চলছে। জীবনকে লেলিয়ে দিয়েছে ভোগ আর ব্যসনে। প্রজার দুঃখে উপরমহলের কোনো গা নেই। বিচার দিলে উপরন্তু নিজেকেই অপমান হতে হয়।
কেউ রুখে দাঁড়াতে চাইলেও জনতা কম। সেই কম জনতার মাঝেই আছে নিচু বর্ণের অন্তজ্যেরা কিংবা বৌদ্ধরা। বর্ণ প্রথা, উঁচু-নিচু ভেদাভেদ এই নিয়েই চলছে তাদের জীবন। সামন্তপতিদের নিকট ক্রমাগত লুণ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে প্রজারা।
এর উপর আবার নতুন করে ভয় দেখা দিয়েছে। দূরদেশ থেকে নাকি যবন সেনারা আসছে এই মুলুকে। তারা অন্য ধর্মের। কেউ বলছে তারা খুবই নিষ্ঠুর প্রকৃতির। ঘোড়ায় চড়ে তারা একের পর এক গ্রাম করায়ত্ত করে ফেলছে। অনেকেই ধর্মান্তরিত হচ্ছে। সামন্তরা আসলে কার পক্ষে বোঝা যাচ্ছে না।
নিজ ভূমিতে অন্যের এমন পদচারণা প্রাকৃতজনেরা চায় না। তারা স্বদেশীদের সাথেই চুক্তি করতে চায়। কিন্তু এতেও অনেক বাঁধা।

মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ কোন কারণে আপন গাঁও ছেড়ে অজানার পথে ছুটলো। বসুদেবের থেকে হওয়া অপমান নাকি তার শিল্পের কদর না পেয়ে সে ছুটলো অজানা পথে? এই অজানার মাঝেই তার জীবনে আসে লীলাবতী। আহা লীলা! কী মোহোমায়ায় তাকে টানে এই ললনাটি।
লীলাবতী, এক রহস্যের আঁধার। সামন্তদের আ ক্রমণে ঘরহারা, পিতৃহারা হয়ে অবশেষে যোগীরূপে ছুটেছে সে শ্যামাঙ্গের সাথে। জগতের এই কঠিন পরীক্ষায় সে ক্লান্ত। কী সম্পর্ক ঐ যুবকটির সাথে তার? তার ধর্ম তাকে হেলা করেছে। প্রিয় মানুষটিকে আপন করে পাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সে চায় ধর্ম ত্যাগ করতে। যবনদের দীক্ষা তাকে টানছে। বিগ্রহ ছাড়াই যে ঈশ্বরের পূজা করা যায় সেটা সে যবনদের দেখেই জেনেছে। মহাকাল তাকে কোথায় নিবে শেষ পর্যন্ত?
ক্ষেত্রকরের ঘরে জন্ম নিয়েও বেনে হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বসন্তদাস ঘর ছাড়ে। মায়াবতী নাম্নী স্ত্রীর মায়াও তাকে ঐ বণিকের টান থেকে সরাতে পারে না। কিন্তু বেনে হতে গিয়ে পথের অভিজ্ঞতায় সে পরিবর্তন হয়ে গেলো। আজন্ম চলে আসা এই অ ত্যাচারের বিরুদ্ধে সে রুখে দাঁড়াতে চায়। তাইতো ঘরে মায়াবতীর কাছে ফিরেও আবার প্রাকৃতজনের টানে সে বন্ধু মিত্রানন্দের পথসঙ্গী হয়। বসন্ত বলে,
❛দেখো, এই কি মানুষের জীবন? সুখ নেই, স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবলই প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছে- এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা যায়? বলো, কতদিন এভাবে চলবে?❜

সামন্তের আক্রমণে গৃহহারা কতক মানুষের ভবিষ্যৎ শঙ্কায়। একে তো রাজার শাসন, তায় আবার আসছে বাইরের তাতারি। কার পক্ষে গেলে শান্তি মিলবে সদুত্তর নেই।
মন্দিরদাসী ছায়াবতী, তার ভাই নিরঞ্জন এরা একেক পথে আছে। নিরঞ্জন চায় হিংসাকে প্রতিহিংসা দিয়ে দংশন করতে। সন্ন্যাসী মিত্রানন্দ এমন চায় না। বাইরের শত্রুর সাথে হাত মেলানোর চেয়ে ঘরের লোককে আপন করে নেয়া কি বুদ্ধিমানের? কেউ একমত হতে পারে না।
ওদিকে যবন নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। কেউ বলে তারা হিং স্র জাতি, কেউ বলে তারা নাকি রাজা প্রজা একত্রে এক পাত্রে খায়। এও হয়? তাদের বাকি উঁচুনিচু ভেদাভেদ নেই। বর্ণ ছাড়া মানুষ হয়!
দেখা গেল নির্দিষ্ট সময়ে যবনেরা তাদের হানা দিলো কিন্তু প্রতিপক্ষ নেই। তারা বিনা বাঁধায় রাজ্য জয় করে ফেললো। পালিয়ে গেলো সেন রাজা। প্রাকৃতজনেরা কেউ তীর্থে গেল, কেউ ভবিতব্য মেনে নিলো। আদতে কষ্ট পোহাতে হলো ওই প্রজাকেই। রাজার কোনো ক্ষতি নাই।
শ্যামাঙ্গ কি তার লীলাবতীর সাথে মিলতে পেরেছিল? মৃৎপাত্রে সে লীলার অবয়ব কল্পনা করেছিল ওরকম কল্পনা আরো কেউ করেছিল কি?
বঙ্গে নতুন করে যবনদের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হলো। প্রদোষকালে প্রাকৃতজনেরা তবে শুধু লুণ্ঠিত আর নির্যাতিতই হলো।


পাঠ প্রতিক্রিয়া:


❝প্রদোষে প্রাকৃতজন❞ শওকত আলীর অসাধারণ ভাষাশৈলীর এক উপন্যাস।
ইতিহাসের সেই সময়কে নিয়ে লেখক উপন্যাস লিখেছেন যে সময়ে রাঢ়, বরেন্দ্র, সমতট অদ্ভুত এক সময় পার করেছে। বিদেশীদের আগমন আর ভূপতিদের পলায়ন হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে প্রজারা।
উপন্যাসটা শুরু করে আমি একটু দমে গিয়েছিলাম। সবসময় যেমন ভাষারীতি পড়া হয় তার থেকে একটু ভিন্ন ভাবে লেখা বইটি পড়তে পারবো নাকি দ্বিধায় ছিলাম। তবে গল্প যত এগিয়ে গিয়েছে ভাষার মাধুর্যতায় আমিও যেন সিক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সেকালের জনপদের সাথে মিলিয়ে এমন ভাষার ব্যবহারই মনে হয়েছে যথোপযুক্ত। কিছু শব্দের অর্থ আলাদা করে খুঁজে বুঝে নিতে হয়েছে তবুও দারুণ সময় কেটেছে বইটির সাথে।

১২০৪ সালের কথা। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলা হানা দেন এবং প্রায় কোনো বাঁধা ছাড়াই জয় করেন। লক্ষণ সেন পলায়ন করেন। ইতিহাস থেকে আমরা এই জানি। কিন্তু কেন এই বিনা বাঁধায় জয়? কেউ কি ছিল না প্রতিহত করার মতো? যেখানে নেতা আর তার চরেরা ভোগে ব্যস্ত সেখানে বাঁধা দেয়ার দল ভারী কী করে হয়?

উপন্যাসটা সেই ইতিহাসের দিকে আলোকপাত না করে কিছু সাধারণ মানুষের সে সময়ের অবস্থার দিকে আলোকপাত করে। উপন্যাসে তাদের নাম মায়াবতী, ছায়াবতী, লীলাবতী, বসন্তদাস, শ্যামাঙ্গ কিংবা মিত্রানন্দ হতে পারে। বাস্তবে হয়তো তারা অন্য নামে পরিচিত ছিল। কিংবা তাদের নামই নেই।
বাংলার সে সময় ধর্ম অর তাদের ভেদাভেদ, উঁচুদের স্বেচ্ছাচারিতা, নিচুদের শুধু দাসত্ববরণ করে নিগ্রহে বেঁচে থাকার পরিস্থিতি লেখক তার সুনিপুণ লেখায় বর্ণনা করেছেন। বাংলা ছিল বিপুলা সম্পদের আঁধার। কিন্তু যুগে যুগে কালে কালে লুণ্ঠিত আর নির্যাতিত হতে হতে এই ভূমির লোকেদের মধ্যে এক অজানা দাসত্ব বাসা বেঁধেছে। সেই দাসত্ব থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বসন্ত কিংবা মিত্রার মতো লোকেরা চেষ্টা করেছিল। চেষ্টার ফল আসার আগেই ইতিহাসের ঝঞ্ঝা এসে তাদের আঘাত করে।

আমার কাছে ভালো লেগেছে পুরো উপন্যাস। এক ধর্মের কাছে আরেক অজানা ধর্মের লোকের ব্যাখ্যা গুলো আমার দারুণ লেগেছে। হিন্দু কিংবা বৌদ্ধরা যখন তাদের ভূমিতে নতুন আগত যবনদের বর্ণনা দিচ্ছিলো সেই ব্যাখ্যাগুলো খুবই অভূতপূর্ব ছিল। কিছু আবার বেশ হাস্যকর লেগেছে। যদিও সেটা অন্য ধর্মের ব্যক্তির উক্ত ধর্ম সম্পর্কে না জানার হেতুই এমন বর্ণনা এসেছিল। তবে ব্যাপারটা বেশ লেগেছে।

সব গোষ্ঠীতেই ভালো মন্দ আছে। সেটা যবন হোক কিংবা হিন্দু, স্লেচ্ছ, কিংবা স্বদ্ধর্মী। তাইতো আহমদ সাধু পুরুষের সান্নিধ্যে লোকে নতুন করে ভাবে। আবার একই জাতের অন্য ব্যক্তি হতে পারে অত্যা চারী। বসন্তের মতো উদার মানুষের বিপরীতে তেমনি থাকে অভিমন্যুর মতো কিট।

দারুণ এই উপন্যাসের শেষটা আশাব্যাঞ্জক নাকি আশার পাতে পানি দেয়ার মতো এটা পাঠক মাত্রেই ভিন্ন। উপন্যাসে আমার কাছে নির্দিষ্ট কাউকে মূল হিসেবে মনে হয়নি। যাদের কথা এসেছে কমবেশি সবাই তাদের নিজ জীবনে মূল। লেখক শ্যামাঙ্গ ছাড়া কারোই শেষ পরিণতি দেখান নি। তার শেষ পরিণতিটাও আশানুরূপ ছিল না। এদিকে বরং কিছুটা হতাশই হতে হয়েছে। তবে সব মিলিয়ে লেখকের মনোমুগ্ধকর একটা উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা হলো।

প্রায় ৮০০ বছর আগের ইতিহাস উপজীব্য করে লেখা উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে ধ্রুপদী এবং কালজয়ী একটি উপন্যাস হিসেবে থাকবে।

❛যদি কোনো পল্লী বালিকার হাতে কখনও মৃৎপুত্তলি দেখতে পান, তাহলে লক্ষ্য করে দেখবেন, ঐ পুত্তলিতে লীলাবতীকে পাওয়া যায় কি না- আর যদি যায়, তাহলে বুঝবেন, ওটি শুধু মৃৎপুত্তলিই নয়, বহু শতাব্দী পূর্বের শ্যামাঙ্গ নামক এক হতভাগ্য মৃৎশিল্পীর মূর্ত ভালোবাসাও।❜
Profile Image for Ranendu  Das.
156 reviews63 followers
August 5, 2016
শওকত আলীর এই ঐতিহাসিক উপন্যাস পাঠ এক অসামান্য অভিজ্ঞতার সামিল। শওকত আলী নিশ্চিত ভাবে সেই বিরল লেখনী ক্ষমতার অধিকারী যার একমাত্র তুলনা বোধহয় আমাদের প্রিয় শ্রী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।

গৌড়ের ইতিহাস, গৌড়ের ইতিবৃত্ত, ওপর ওপর অতিক্রম করেছিলাম ছোটোবেলায়, ইতিহাস বইয়ের পাতার দ্রুত সঞ্চারণে। সেই থেকে মনের ধুসর প্রকোষ্ঠে কেবল থেকে গেছে কিছু শব্দ- সেন বংশ, বল্লাল সেন, লক্ষন সেন, মাৎস্যানায়, আর কোথাও পড়া এই তথ্য যে ষোলোজন যবন ঘোড়সাওয়ারীকে দেখে, খাওয়া ফেলে খিড়কী পথে লক্ষণ সেনের পালিয়ে বাচা!


ছোটোবেলার ইতিহাস বইতে ঐতিহাসিকরা আসলে যে কথাটা মুখ ফুটে বলেন নি, সেটি হল লক্ষন সেন আদতে ছিলেন অপদার্থ। আর দুনিয়ার ইতিহাসে শুধু বাংলার শেষ রাজা লক্ষন সেনই নন, তার মত আরও ভুরি ভুরি অপদার্থ রাজা-বাদশাহ আছেন, যেমন, ভারতের শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ্‌ যারা একধারে পিতৃপুরুষের অর্জিত সম্পত্তি পেয়ে, বিলাস-ব্যাসনে, রমণী আর রমনীয় সকল নেশায় ডুবে থেকেছেন, আর অন্যধারে সাধারন প্রজারা জীবন দিয়ে দাম চুকিয়েছে সেই রাজকীয় অপদার্থতার! এই উপন্যাসে লক্ষণ সেনের আরেকটু বর্ননা থাকলে ভাল হত কিন্তু লেখক আবার নামকরনেই বলে রেখেছেন যে এ কাহিনী রাজা-রাজড়ার নয়, এ কাহিনী আম-জনতার, প্রাকৃতজনের। ফলে লেখক কে কিছু মাত্র অনুযোগ করা চলে না।


আসলে প্রদোষে প্রাকৃতজন নিয়ে কোন দ্বিরুক্তি বা পুনরক্তির অবকাশ নেই, কারন গৌড়ের নারীরা আমায় এমনিই বাক্‌রুদ্ধ করে রেখেছে তাদের মায়াজাল দিয়ে! ওহো হো, মায়াবতী, লীলাবতী, ছায়াবতী, বিভাবতীরা কালের স্রোতে তোমরা কোথায় হারিয়ে গেলে? আমার যে রাজ-ঐশ্বর্য্য চাই না, শুধু তোমাদের মত একটি ভালবাসার নারী চাই। হায়, ঈশ্বর, এক লীলাবতীর অপেক্ষায় অপেক্ষায় যে জীবনটা আমার বৃথা চলে যায়!


যাই হোক, জীবনে লীলাবতীদের নিদারুন অনুপস্থিতি ছাড়া, পাঠ-শেষে নির্বাক মনে ক্ষোভ আর একটি ছিল যে লেখক কি শ্যামাঙ্গ কে কি বাচাতে পারতেন না? কিন্তু শেষে দেখি লেখক স্বয়ংই স্বীকার করেছেন যে শ্যামাঙ্গ বা বসন্তদাসের বেচে থাকা আর না থাকায় ইতিহাসের গতি বিশেষ পালটায় না। আর সত্যিই তো আর পাঁচজন প্রজার থেকে শ্যামাঙ্গ বা বসন্তদাস এর ভাগ্য খুব একটা আলাদা হওয়ার কথাও তো না! ফলে শ্যামাঙ্গ বা বসন্তদাস যে শেষ পর্যন্ত কোন যুগ-নায়কের আসনে বসেন নি, তাতে আসলে লেখকের পরিমিতি বোধই প্রকাশ পেয়েছে।


এই অসামান্য উপন্যাসটি সার্থক অর্থেই বাংলা ভাষার এক অবিস্মরনীয় সৃষ্টি। লেখক ও তার লেখনীকে এই পাঠকের আভূমি-নত কুর্নিস। আর সেই সাথে দুষ্ট-লোকের নজর এড়িয়ে লেখকের পায়ে আমার পাঁচটি স্বর্ন-মুদ্রার উপঢৌকন।

Profile Image for প্রিয়াক্ষী ঘোষ.
361 reviews34 followers
April 3, 2023
সুদূর প্রাচীন কাল থেকেই প্রতিটা সমাজ ব্যবস্থায় বা রাষ্ট্রে একজন রাজা থাকেন, যিনি দেশ ও দেশের জনগনের নিরাপত্তা ও সুখ-শান্তি নিশ্চিত করে থাকেন। অন্য রাষ্ট্রের প্রভাব থেকে নিজ দেশকে রক্ষা করে থাকেন কিন্তু তার পরও অন্য দেশের শক্তিশালী জনগোষ্ঠী বা রাজাদের দ্বারা হয়তো দূর্বল রাজার পরাজয় ঘটেছে আর এ পরাজয় শুধু যে দেশের রাজারই হয় তা নয়। একই সাথে সে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে নতুন রাজার কাছে মাথা নত করতে হয় অথবা জীবনও দিতে হয়।

ইতিহাসের সেই কালের ঘটনা যখন রাঢ়- বরেন্দ্র- বঙ্গ -সমতটে ছিলো সামন্ত- মহাসামন্তদের শাসন। নিজেদের তৈরি আইনের মাধ্যমে এই সকল শাসকরা জনগনদের শাসন করতে থাকে।

সেন রাজার শাসন আমল প্রায় শেষের দিকে।তুর্কীদের দ্বারা বাংলা আক্রমন তখন সন্নিকটে। তবুও সেই সময়ে সামন্ত-মহাসামন্তদের সাধারন জনগনের উপর অত্যাচারের শেষ নেই। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায় মুষ্টিমেয় কিছু লোক। কিছু অন্ত্যজ শ্রেনী আর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। আর তারাই শাসকদের রোষের শিকার হয়।

"প্রদোষে প্রাকৃতজন " উপন্যাসটিতে ইতিহাসের এই প্রদোষ কালের কয়েকজন প্রাকৃত নর-নারীর কাহিনী বর্ননা করা হয়েছে। হয়তো তাদের নাম ইতিহাসের কোন খানেই নাই। হয়তো তারা অন্য নামে বাস করছে ইতিহাসের সেই কালে বা অন্য কালেও।

সেই প্রদোষ কালে কিছু মানুষ চেয়েছে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা বিধ্বস্ত করতে, দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে, নিজেদের পরিচয়ে উঠে দাঁড়াতে।

শ্যামাঙ্গ একজন মৃতশিল্পী। সমাজ ব্যবস্থার কারনে তার শিল্প রচনায় ছেদ পড়ে। তাকে যাত্রা করতে হয় নিরুদ্দেশে। আর কখনই ঘরে ফেরাই হয় না। স্বামী পরিত্যক্তা লীলাবতী । যার কিছু স্বপ্ন থাকলেও সে স্বপ্নগুলোকে কখনই ছুয়ে দেখতে পারে না। মায়বতীর কোমল বাহুবন্ধন ছিন্ন করে তার স্বামী বসন্তদাস চলে যায় মিত্রানন্দের সাথে। এরকম হাজারো সমস্যা ও বিপুল প্রশ্ন থেকে যায় সেই সময়ের মানুষের মনে।

এসব মীমাংসা হবার আগেই শুরু হয় ইতিহাসের ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময়, যা তাদের সমূলে উৎপাটিত করে। তবুও কিছু মানুষের জিজ্ঞাসা আর ভালোবাসা , স্বপ্ন আর প্রায়শ সঁপে দিয়ে যায় উত্তরসূরিদের হাতে।

"প্রদোষে প্রাকৃত জন" উপন্যাসের লেখক শওকত আলী ১৯৩৬ সালে পশ্চিম বাংলার পশ্চিম দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পঁচিশ বছর অধ্যাপনা করেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। বইটি প্রথম প্রকাশ ১৯৮৪ সালে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে একজন লেখক কতটা নিবিড় ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ইতিহাসের বিছিন্ন কিছু ঘটনা ও চরিত্র,যা বহন করে চলেছে সেই সময়কে। কিছু বই আছে যা নিয়ে কিছু বলার থাকে না শুধু অনুভবই করতে হয়, এই বইটাও তেমনই একটা বই।
Profile Image for Swakkhar.
98 reviews25 followers
February 22, 2018
একটু ওভার রেটেড, তবু ভালোই।
Profile Image for শুভঙ্কর শুভ.
Author 11 books51 followers
October 8, 2018
কিচ্ছু বলব না। শুধু নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, পড়েছি অবশেষে।
Displaying 1 - 30 of 123 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.