পৃথু ঘোষ চেয়েছিল, বড় বাঘের মতো বাঁচবে। বড় বাঘের যেমন হতে হয় না কারও উপর নির্ভরশীল—না নারী, না সংসার, না গৃহ, না সমাজ—সেভাবেই বাঁচবে সে, স্বরাট, স্বয়ম্ভর হয়ে। তার বন্ধু ছিল তথাকথিত সভ্য সমাজের অপাঙক্তেয়রা। পৃথু ঘোষ বিশ্বাস করত, এই পৃথিবীতে এক নতুন ধর্মের দিন সমাসন্ন। সে-ধর্মে সমান মান-মৰ্য্যদা এবং সুখ-স্বাধীনতা পাবে প্রতিটি নারী-পুরুষ। বিশ্বাস করত, এই ছোট্ট জীবনে বাঁচার মতো বাঁচতে হবে প্রতিটি মানুষকে। শুধু প্রশ্বাস নেওয়া আর নিশ্বাস ফেলা বাঁচার সমার্থক নয়। কিন্তু সত্যিই কি এভাবে বাঁচতে পারবে পৃথু ঘোষ? সে কি জানবে না, বড় বাঘের মতো বাঁচতে পারে না কোনও নরম মানুষ? জন্ম থেকে আমৃত্যুকাল অগণিত নারী-পুরুষ-শিশুর হৃদয়ের, শরীরের দোরে-দোরে হাত পেতে ঘুরে-ঘুরে বেঁচে থাকাই মানুষের নিয়তি? এই পরিক্রমারই অন্য নাম মাধুকরী?
এক আলোড়ন-তোলা কাহিনীর মধ্য দিয়ে জীবনের নতুন ভাষ্যেরই এক অসাধারণ ভাষারূপ এ-যুগের অন্যতম জনপ্রিয় কথাকার বুদ্ধদেব গুহর এই বিশাল, বৰ্ণময়, বেগবান উপন্যাস। এ শুধু ইঞ্জিনিয়ার পৃথু ঘোষের বিচিত্র জীবনকাহিনী নয়, নয় “উওম্যানস লিব’-এর মূর্ত প্রতীক তার স্ত্রী রুষার দ্বন্দ্বময় জীবনের গল্প, এমনকি, জঙ্গলমহলের অকৃত্রিম কিছু শিকড় খুঁজেফেরা মানুষের অজানা উপাখ্যানও নয়। এ-সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে তবু এ-সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে 'মাধুকরী' এই শতকের মানুষের জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আগামী প্রজন্মের মানুষের সার্থকভাবে বেঁচে থাকার ঠিকানা । এই কারণেই বুঝি এ-উপন্যাস উৎসর্গ করা হয়েছে 'একবিংশ শতাব্দীর নারী ও পুরুষদের' হাতে। সাধারণ পাঠকের মন ও বুদ্ধিজীবী পাঠকের মনন—দু-তন্ত্রীতেই একসঙ্গে ঝঙ্কার তোলার উপন্যাস 'মাধুকরী'। এর কাহিনী, ভাষা, স্টাইল, জীবনদর্শন, শ্লীলতা-অশ্লীলতার সীমারেখা—সবই নতুন। জীবনের প্রতি আসক্তি ও আসক্তির মধ্যে লুকিয়ে-থাকা বিতৃষ্ণাকে যে-চমকপ্ৰদ ভঙ্গিতে ছড়িয়ে দিয়েছেন বুদ্ধদেব গুহ, যে-নৈপুণ্যে বর্ণনায় এনেছেন সূক্ষ্মতা, যে-কুশলতায় ছোট-বড় প্রতিটি চরিত্রকে দেখিয়েছেন চিরে-চিরে, যে-দক্ষতায় দেশি-বিদেশি অজস্ৰ কবিতার ব্যবহার—সে-সবই এক ভিন্নতর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় পাঠককে । বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী সংযোজন ‘মাধুকরী'।
Buddhadeb Guha (Bengali: বুদ্ধদেব গুহ) is a popular Bengali fiction writer. He studied at the well-known St Xavier's College of the University of Calcutta.
His novels and short stories are characterized by their dreamy abstractness and romantic appeal. His essays reveal the soul of a true wanderer providing some of the most beautiful renditions of travel in Bengal. His love for forests and nature provide the background for many of his novels.
A highly successful chartered accountant by profession, and an accomplished musician, Guha is very urbane in his lifestyle. He was one of the first to create characters representing easy-going, upper middle-class modern Bengali families, whom readers could identify with, and that gave him instant popularity.
He is the recipient of many awards including Ananda Puraskar, 1976; Shiromani Puraskar; and Sharat Puraskar.
The Library of Congress has over fifty titles by him. His most famous novel, according to many, is Madhukori. It is considered a milestone in Bengali literature. He is also the creator of Rijuda, an imaginary character who moves about in jungles with his sidekick Rudra. The jungles that he wrote about were mainly in Eastern India.
শুধু যদি জঙ্গলের গল্প হতো, তবে একশোতে একশো দিতে পারা যেতো। কিন্তু গল্পটা যেহেতু শুধু জঙ্গলের নয়, বরং জঙ্গলের চেয়েও বেশি মানুষের আর মানুষের সম্পর্কের, তাই স্যাটিসফায়েড হওয়াটা কঠিন।
মূলতঃ, বাংলা সাহিত্যে বেশিরভাগ লেখাতেই আমি যেই জিনিসটির অভাববোধ করি সেটি হল দ্বন্দ্বের অভাব। একজনকে একতরফাভাবে ভালোত্বে পরিপূর্ণ করে এবং আরেকজনকে একতরফাভাবে ভিলেন সাজিয়ে লেখা গল্পগুলো কীভাবেই বা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, তা বুঝতে পারি না।
পৃথু আর রুষার সম্পর্কটার যে টানাপোড়েন, সেখানে সব দোষ শুধু রুষারই, পৃথুর যদি দোষ থাকেও সেটাকে মিনমিন করে না বলার মতই বলা- আমি বলব এ লেখকের পক্ষপাতদুষ্টতা না হলেও নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো দেখতে পারার অক্ষমতা। আর, পৃথুর মত মানুষ, সবসময় "আমি আর দশজনের মত নই" ভাবতে থাকা মানুষদেরকে দূর থেকে দেখতে হয়ত সুন্দর, পড়তে ভাল, পরকীয়ায়ও হয়ত ভালই হবে। কিন্তু সাংসারিক মানুষ হিসেবে এরা অচল যে হয়, তার দোষ তার স্ত্রীকেই পৌণপুনিকভাবে দিয়ে যাওয়া হবে- এমনটা আমি আশা করিনি।
মানুষ জাতিগতভাবে পলিগ্যামাস, তবু কাঠামোর খাতিরে নিজেকে সে মনোগ্যামিতে বাঁধতে পারে বলেই সে মানুষ। লেখা পড়ে পড়ে সীওনী, মুক্কি, কানহার জঙ্গল বা বানজার, হাঁলো নদী দেখার যে শখ জাগলো সেই শখের জন্যই তিন তারা, বাকি দু'তারা কেটে রাখলাম গল্প মনপসন্দ হয়নি বলেই।
বইটা একটা সময়ে গিয়ে খুব অর্থহীন হয়ে পড়ে। আর এটা বেশ দুঃখ জাগায়। মারদাঙ্গা এক অংশের পর কই জানি তলিয়ে যায় প্রায় পুরো কাহিনীটাই।
বুদ্ধদেব গুহ নিঃসন্দেহে খুব শক্তিশালী একজন লেখক। কারন, একমাত্র তাঁর লেখার গুনেই প্রচন্ড এনটাইটেল্ড দুই প্রধান চরিত্রের প্রতি একেক সময়ে তীব্র সমবেদনা জন্মায়। চরিত্রগুলোর বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর, কারন, তারা সত্যিই মনে হচ্ছিল আশেপাশের চেনা অচেনা মানুষদেরই প্রতিনিধিত্ব করে। খুবই ক্ষতিকর সব কাজ করে দুইজনই বেশ উচ্চ পর্যায়ের চিন্তা করে নিজে যার ক্ষতি করছে এবং যার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সবাইকে বেশ মেনে নিয়ে বড় সাজবার এক ভানসর্বস্ব প্রচেষ্টায় পুরো বই জুড়েই লিপ্ত থেকেছে। বিরাট কলেবরের বইটি পড়া যায় মূলত লেখনী ও হাটচান্দ্রা নামক মধ্যপ্রদেশের এক কাল্পনিক এলাকার মায়াময় বর্ণনার কল্যানে।
কিন্তু, শেষে এসে শারিরীক সম্পর্ক নিয়ে পৃথুর ভীষন বিরক্তিকর মনোলগ মাথা ধরিয়ে দেয়। মনে হয়, বাংলা সাহিত্যে নায়করা সব শেষমেশ এরকম হয়েই কেন মহান সাজার চেষ্টা করে! নারীটিকে ছোট না করা পর্যন্ত মনে হয় জমি দখলের সত্যিকারের আনন্দ পাওয়া যায় না! পৃথুর শুরুর দিকের উদাসীন ইমেজটা যতো মুগ্ধ করে, শেষে সেই একই উদাসীনতা এক ধরনের অভিনয় বাদে কিছুই মনে হয় না।
তাও, বিশাল এই বই পড়ে সময় নষ্ট করেছি মনে হয় না। কি জানি চুম্বকের মতো টেনে রাখে বইটার প্রতি। শেষ হলে হল দেখে খারাপও লাগায়। কিন্তু, কেন এরকম পাঠাভিজ্ঞতা পেতে হবে কোন বই থেকে? মিশ্র এই অনুভূতির জন্যই মনে হচ্ছে হয়তো শেষমেশ এই বই টিকবে না। ইতিমধ্যেই এই বইয়ের বেশিরভাগ ধ্যানধারনা খুবই হাস্যকর ঠেকে। মনে হয়, খুব সুক্ষভাবে লেখক চাইছেন মানুষ তার তুচ্ছতম ও ঘৃন্য কাজের জন্যও যেন খুব দারুন একটা দর্শনমেশানো অজুহাত খুঁজে পাক। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মনে হয়েছে লেখার এই অতুলনীয় দক্ষতা কতোভাবে মানুষ নষ্ট করে!
শেষে এটাই বলতে চাই যে, শুধুমাত্র অসাধারণ লেখনী যথেষ্ট না পাঠকের মন পুরোপুরি বশ করার জন্য। চাই সত্যিকারের গভীর এক চিন্তার জগৎও, যা মাঝে মাঝে এই বইয়ে উঁকি দিয়ে মিলিয়ে গেছে। লেখক বড় বেশি অকাজের ভ্যালিডেশন খুঁজতে গিয়ে দারুন এক জায়গায় কাহিনীকে নিতে অস্বীকার করেছেন। আর সু্ন্দর করে লিখলেই অর্থহীন ও সস্তা সব ধারণা গভীর হয়ে যায় না। অন্তত এখন শারিরীক সম্পর্ক নিয়ে এসব ‘বন্দি হয়ে গেলাম’ মার্কা ন্যারেটিভ পড়ে কোন গভীর ভাবনায় ডুবে যাবার অবকাশ নেই কারোর।
আবার পড়তে ইচ্ছা করে। কিন্তু সাহস পাই না আবারও এলোমেলো হয়ে যাব—এই ভয়ে। তা ছাড়া এর পাঠ অনুভূতি আজও টাটকা।
প্রচণ্ড খারাপ সময় পার করছিলাম দুই বছর আগে যখন বইটি হাতে নিই। এটি ছিল আমার জন্য জখমে লাগানো জ্বালাধরানো কিন্তু চমৎকার কার্যকরী দাওয়াই। আর তাই 'মাধুকরী' এবং এর স্রষ্টার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। 'মাধুকরী' পড়ার আগে ও পরে পড়া বুদ্ধদেব গুহর কোনো বই-ই তেমন একটা তৃপ্তিকর ছিল না। তা সত্ত্বেও এই এক 'মাধুকরী'র কারণেই তিনি আমার পছন্দের লেখকের তালিকায় থেকে যাবেন জীবনভর।
(চার তারা দেওয়া ছিল। তা বদলে এখন পাঁচ দিলাম। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও যে বইয়ের নেশা কাটেনি, প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে আজ অবধি, সে বইকে পাঁচে পাঁচ না দিলে অন্যায় হবে ভেবে এই সংশোধন!)
একজন পাঠক হিসেবে কিছুটা প্রাপ্তমনস্কতা এসে গেলে এই ধরনের দর্শনে আর মজে যাওয়া যায় না আসলে। কৈশোরে পড়লে হয়তো অবাক হতাম, নতুন লাগত ভাবনাগুলো। কিন্তু এখন প্রেম, ভালোবাসা, নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক নিয়ে নিজের একটা স্বচ্ছ দর্শন থাকায় বইটি এলেবেলেই লাগল। আরো একটা বার খুব জনপ্রিয় কোন বই পড়তে গিয়ে ধোঁকা খেলাম৷ এই শেষ! আর না। নিজের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কেবল অনেক বেশি ভালো রেটিং বা ক্লাসিকের তকমা পেয়ে যাওয়া কোন বই আর পড়া যাবে না। শীর্ষেন্দু-সমরেশের কিছু বই বা এটা অনেকবারই হতাশ করল।
বুদ্ধদেব গুহর একমাত্র বই যাকে ৩ তারা দেয়া গেল। অন্য সময় এর থেকেও কম দিয়েছি বোধয়।
প্রথমে ভাল দিকগুলো বলি। তার লেখা অন্য অনেক উপন্যাসের মতোই এতেও আছে বন, জঙ্গল, পাহাড়ের নান্দনিক মুগ্ধকর বর্ণনা। সে বর্ণনা এই বিশাল কলেবরের বইটিকে উপন্যাসের বদলে কাব্যগ্রন্থ বলে ভ্রম ধরাতে পারে। যেন পাহাড়ী বনভূমিতে চাঁদের আলোর মত চুয়ে পড়ছিল শব্দগুলো। মানুষের হৃদয়ের মাঝে ঘটতে থাকা টানাপোড়েনগুলো নিজেরা নিজেরা যুদ্ধ করে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটাবে নাকি তলিয়ে যাবে সেটা ঠাহর করতে করতে শেষ হয়ে যাবে বই। বিভূতিভূষণের লেখনীই ক্ষনে ক্ষনে মনে পড়ে যাবে। সেই সাথে বাড়তি ভালোলাগা এই যে নানান কবি আর লেখকের নানারকম কবিতা আর বইয়ের উদ্ধৃতি রয়েছে।
এবারে আসি মন্দ দিকে। পুরো উপন্যাস ৬৩২ পৃষ্ঠার। তাতে গল্প কতখানি আর অযাচিত প্যানপ্যানানি কতোখানি সে নিয়ে তর্ক করা যাবে। প্রথম অর্ধেক না পড়ে মাঝ থেকে শুরু করলেও গল্পের শুরু বা শেষে তার কোনো প্রভাব পড়তো বলে মনে হয়না। গল্প এমন আহামরি কিছু নয় তবুও সেটাকে এমন টেনেটুনে লম্বা করায় মনে হচ্ছিল হিন্দি সিরিয়ালের সহস্র পর্বে যাবার মত ঘটনা। তার মাঝে শেষের দিকে গিয়ে খেই হারিয়ে গিয়েছিল কেমন। অযাচিত আর আরোপিত লেগেছে অনেকখানি। যে চরিত্রকে যেভাবে আঁকতে চেয়েছেন তার উল্টোটাই মনে হয়েছে বেশি। আর কোন সময়কে ধরে যে লেখা হয়েছে তা আল্লাহ মালুম। এত বড় কলেবরের উপন্যাস হওয়া সত্ত্বেও মূল চরিত্রগুলোর শেষে কী হল তা জানা যাবেনা। সেটা উৎসাহ তৈরি না করে বিরক্তির উদ্রেক করেছে বেশি।
"মাধুকরী" প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। সেই সময়ে বসেই লেখক লিখেছেন একবিংশ শতাব্দীর জীবনচিত্র ও মানুষের মানোভাব। ফুটিয়ে তুলেছেন একবিংশ শতাব্দীর সামাজিক প্রেক্ষায়পট" মাধুকরী" তে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে এসে মানুষ আজ পেয়েছে অতি আধুনিক সভ্যতা, সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার অদম্য সাহস, বুদ্ধি ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সমাজে। লাজ -লজ্জা ও সমাজের বাঁকা দৃষ্টি তুচ্ছ এই প্রতিষ্ঠার কাছে। ফলে ছিড়েছে অনেক বন্ধন, হারিয়ে গেছে অনেক মধুর কিছু সম্পর্ক। তবু এই প্রজন্মের মানুষের কাছে সম্পর্কের বন্ধন তুচ্ছ আত্মতৃপ্তি ও একান্ত নিজের সুখের কাছে।
পৃথু ঘোষ বিদেশ থেকে বড় ডিগ্রী নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে দেশে ফিরে বড় একটা চাকরি করেন। ছোট বেলার পছন্দ করা কুর্চি কে রেখে পরিবারের মতামতেই বিয়ে করেন অসম্ভব সুন্দরী ও শিক্ষিত রুষাকে।
রুষা নিজেও চাকরি করেন তাই সে কোন ভাবেই পৃথুর উপর নির্ভরশীল নয়। তবে দুই ছেলেমেয়ে ও পরিবারের সব খরচ পৃথুর, যদিও সে টাকাই দেয়। সংসারের কোথায় কি ব্যায় তা পৃথুর দৃষ্টির আড়ালেই থাকে। এ উদাসিনতা চির দিনেরই। ভালো বাসলেও তার প্রকাশের উপায় জানা নাই পৃথুর।
বাবার সাথে জঙ্গলে গিয়ে বাঘ মারার নেশা ছিলো পৃথুর। এখন সে নেশাটা নাই। আইনেও আর নাই বাঘ মারার অধিকার। তবে এখনও জঙ্গলে ঘুরতে পৃথু বেশী পছন্দ করে। মেলামেশা করে সমাজের কিছু নিম্নবৃত্ত লোকের সাথে, যা রুষার কোন দিনও পছন্দ নয়। তাই পৃথু নিজের বাড়ীতেই একা। কোন মতামতা বা জোর এ বাড়ীতে পৃথুর নাই।
এইভাবে হয়তে সময়টা গড়িয়ে যেতে পারতো। তবে পৃথুর না প্রকাশ করা ভালোবাসাটা না খুজে রুষা ভিনোদের ভালোবাসায় হারিয়ে যায়। সমাজ কেন, পৃথুর নিজের দিকেও না তাকিয়ে রুষা ক্রমাগত ঝুকতে থাকে ভিনোদের দিকে। কিন্তু....
বইটাতে পৃথুর বিচিত্র জীবন কাহিনী নয়, রুষার দ্বন্দ্ব ময় জীবনের গল্প ফুটে তুলেছেন লেখক। এছাড়াও সব কিছুকে ছাপিয়ে লেখক নতুন প্রজন্মের মানুষের জীবনের নানা সমস্যা, সীমাবদ্ধতা ও জীবন চিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন। লেখকেরর সেই সময়ের জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি আগামীর জীবনকে উপলব্ধি করে সৃষ্টি করেছেন " মাধুকরী"। তাই হয়তো উৎসর্গ করেছেন "একবিংশ শতাব্দীর সকল নারী ও পুরুষদের জন্য"।
৬৩২ পৃষ্ঠার এই বইটা পড়ে মনে হচ্ছে লেখদের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক এমনটাই। সেই সময়ে না গিয়েও তিনি বইয়ের পাতায় আগে থেকেই বন্দী করেছেন গোটা একটা শতাব্দী কে। হারিয়ে যাওয়া কোন স্থান বা কাল নয়, সামনের সময়কে তিনি আগেই দেখিয়ে দিয়েছেন।
কিছু বই থাকে, যার প্রতিটা লাইন লিখে রাখতে মন চায়, এই বইটাও তেমনই। তাছাড়া লেখক কিছু প্রিয় কবি মুখ, ও তাঁদের কবিতা অংশ তুলে দিয়েছেন যা হয়তো এই লেখকের সাথে সেই সব লেখদেরও পাওয়া। বিখ্যাত কিছু স্থান ও জঙ্গলের বর্ননা টা এমন ভাবে দেওয়া যে, এই বই হাতে করে বেরিয়ে পড়লে সেখানে হয়তো পৌঁছে যাওয়া যাবে।
বাংলা সাহিত্যের অন্য কোন নারী চরিত্রকে কখনো এতো ঘৃণা করেছি বলে মনে হয়না যতটা 'রুষা' চরিত্রটিকে করেছি বইটি পড়ার সময়। এখন অনেকের মনে হতে পারে মূল চরিত্র হিসেবে 'পৃথু ঘোষ' অতিরিক্ত সহনাভূতি পেয়েছে লেখকের কাছ থেকে, 'রুষা' যে দোষে দোষী 'পৃথু ঘোষ' ও একই দোষে দোষী হওয়া স্বত্তেও উপন্যাসে তার দোষত্রুটি গুলো খাটো করে দেখানো হয়েছে। আমার মনে হয় ব্যাপারটি পুরো উলটো। রুষার চরিত্র পুরো উপন্যাসের ১০০ ভাগের শেষ ১০ ভাগেই পুরোপুরি চিত্রিত করেছেন লেখক। এর আগের বাকি ৯০ ভাগ পড়লে মনে হয় রুষায় ভিক্টিম। পৃথুকে দেওয়া রুষার চিঠিতে অনেকবারই রুষা ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চেয়েছে সংসার ও রুষার প্রতি নির্মম উদাসীনতা-ই রুষাকে ঠেলে দিয়েছে বিনোদের দিকে। সত্যি কথা বলতে রুষাকে প্রথম থেকেই ঘৃণা করলেও, রুষার পতন দেখার জন্য মধ্যরাত থেকে প্রায় ভোর অব্দি বই নিয়ে বসে থাকার পরেও মাঝে মধ্যেই মনে হতো রুষার দোষ আসলে কি? সংসার তো মোটেও এক চাকার গাড়ি না। স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই সমান অবদান, দ্বায়িত্ব সংসারে। পৃথুর সংসার-সমাজের প্রতি এই উদাসীনতা, দ্বায়িত্বহীনতা আসলেই তার উচ্চশিক্ষিতা, সুন্দরী স্ত্রীর পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর। এরকম মানুষের প্রথমত বিয়েই করা উচিত না।
কিন্তু রুষার পৃথুকে ছেড়ে বিনোদের কাছে যাওয়ার পেছনে কি শুধুই পৃথুর সংসারের প্রতি অবহেলা, বা পৃথুর মনে কুর্চির জন্য প্রেম দায়ী?তাহলে রুষার, ❝নারী মাত্রই সিকিওরিটি, অর্থ, আরাম, বিলাস চায়। চিরন্তন নারী তাইই চেয়ে এসেছে। আগেকার দিনে তাই রাজা মহারাজাকে বিয়ে করেছে তারা, এখন ভিনোদের মতো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টকে করে। মহাকবি কালিদাস বা মিঞা তানসেন, বা বীটোভেন বা মোৎজার্টকে রাজদরবারে বা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের ড্রইংরুমে নেমন্তন্ন করে পঞ্চাশ হাজার টাকা দামের শাল উপহার দিয়ে শিরোপা দেওয়া যায়, তাদের সবাইকেই বেডরুমে আনা যায় না। ঘর তো করাই যায় না ওইসব মুডি সেন্টিমেন্টাল, স্ট্রেঞ্জ লোকদের সঙ্গে। পৃথু, এই সরল সত্যটা কোনওদিনও বুঝল না। বুঝল না বলেই, তাকে আঘাত পেতে হবে। সুন্দরী নারী, এই সুন্দর পৃথিবীরই মতো বীরভোগ্যা। বাঘ-মারার বীরত্বটা কোনও বীরত্ব নয় এই যুগে, মহাকবি হওয়াও আজকাল মুর্খদেরই সাজে। জীবনে যারা নায়ক-নায়িকা তাদের নিয়ে পৃথুরা লিখবে, চিরদিন লিখে এসেছে। নিজেরা কোনওদিনও নিজেদের জীবনে নায়ক অথবা নায়িকা হতে পারবে না ওরা। দিস ইজ রিয়্যালিটি! ইয়া। দিস ইজ। পৃথু হ্যাজ টু ফেস ইট। রুষা কান্ট হেল্প ইট। নট এনী মোর!❞ এই স্বগোতক্তির কি মানে দাঁড়ায়? দ্যা ফ্যাক্ট ইজ, স্বামীর স্ত্রী-সংসারের প্রতি উদাসীনতা বা পরস্ত্রীর প্রতি প্রেমই রুষাকে তার স্বামী ছেড়ে বিনোদ ইদুঁরকারের দিকে ঠেলে দেয়নি। রুষার নিজের অর্থ, বিলাসী জীবন, সোশ্যাল স্ট্যাটাসের লোভও অনেকাংশেই দায়ী।
পৃথুকে দেওয়া এক চিঠিতে রুষা বলে, ❝তুমি আমাকে আর যাইই মনে করো, করতে পার, আমি কুর্চি নই, বিজ্লীও নই। আমি সৎ। ছিলাম অন্তত দীর্ঘদিন। এবং যখন অসৎ হলাম, তখনই বাঁধন ছিঁড়লাম। ঘোমটার তলায় খেমটা নাচের ট্রাডিশান আমার নয়।❞ কি স্ট্রেইট ফড়োয়ার্ড কথাবার্তা তাইনা? কিন্তু রুষার আসল চরিত্র তো তার এই স্বগোতক্তিতেই প্রকাশ পায়, ❝ভিনোদের সঙ্গে কী করে যে ব্যাপারটা ঘটে গেছিল। সিলী! খুবই ভাল অভিনেতা ছিল ভিনোদটা! নইলে, পুরুষের আবার মন! শরীর ছাড়া কি কিছু আছে ওদের? তাই-ই, শেল্যাক কোম্পানীর নন-রেসিডেন্ট ডিরেকটর, হ্যান্ডসাম, পাইপ-স্মোকিং—ইংলিশম্যান, মাইকেল হাও ক্লাবের টেম্পোরারী মেম্বার, নাগপুর থেকে আসা মিঃ ঘোড়পাড়ে, বিষেণ নারাং অথবা মিঃ এম চ্যাটার্জী এই সব মানুষের সঙ্গে রুষার ফীজিক্যাল অ্যাফেয়ারের মধ্যে আর ভিনোদের সঙ্গে সম্পর্কর মধ্যে একটু তফাৎ ছিল। ওগুলো শুধুমাত্র একইবারের সম্পর্ক। এবং পিওরলি ফীজিক্যাল ছিল। আর ভিনোদেরটা পৌনঃপুনিক। একটু একটু মন মিশোনো। ভিনোদের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা সকলেই জেনে গেছিল। কিন্তু অন্য সম্পর্���গুলো সম্বন্ধে সেই সব দূরে-যাওয়া পুরুষরা আর রুষা নিজে ছাড়া একজনও ঘুণাক্ষুরেও কিছু জানে না আজ অবধি। বুদ্ধিমতী নারীমাত্রই যাযাবরের সঙ্গেই শারীরিক সম্পর্ক করতে ভালবাসে। শিকড়, স্থায়ী ঠিকানা মানেই বিপদ।❞ প্রথমে বললাম না, উপন্যাস পড়তে পড়তে অনেক সময়ই রাগে, ঘৃণায় শরীর রিঃ রিঃ করে উঠছিলো। রাগের জায়গা গুলো, ঘৃণার জায়গাগুলো হাইলাইট করা ছিলো। পতনের পর জায়গাগুলো রিপিট করার যে স্যাটিস্ফিকশন তা অতুলনীয়।
উপন্যাসের মুল উপজীব্য আসলে পৃথু ঘোষ ও তার জীবন। উপন্যাসের প্রায় পুরোটা জুড়েই থাকার কারনে এক ধরনের মায়া অনুভব করছি এই আত্মভোলা, প্রকৃতিপ্রেমী মানুষটির জন্য। প্রথম জীবনে বাঘ শিকার করা সাহসী এই মানুষটি যদি আরেকটু সাহস সঞ্চয় করে কুর্চীকে বিয়ে করতে পারতো তাহলে তার জীবন হয়তো অন্যরকম হতো। কিংবা কে জানে, হয়তো তাহলে কুর্চিও আরেক 'রুষা' তেই পরিণত হতো। ঠুঠা বাইগা-র কথায় মনে হয় ঠিক, ❝ভাল বউ পেতে হলে বিয়ে করতে হয় একেবারে সাদামাটা মেয়ে। মোটামুটি সুন্দরী ; মোটামুটি বিদ্যে-বুদ্ধি। সুন্দরী বউ হবে অন্যের। এমনকি শত্রুরও হতে পারে। যাতে দেখে সুখ হয়, শুয়ে সুখ হয়। অতি সুন্দরী, অতি গুনবতী কখনও ভাল বউ হয় না❞
টানা ৭ ঘন্টা পড়ার পর ক্লান্তির বদলে মন আরো বেশি ফুরফুরা লাগছে। তবে এই ভাল লাগার পেছনে কি পুরোটায় উপন্যাসের সমাপ্তি নাকি ফ্র্যাজাইল মেইল ইগোর স্যাটিস্ফিকশন ও তার একটি কারন সেইটা নিভৃতে চিন্তা করার বিষয়। তবে যাইহোক, অনেকদিন পর কোন উপন্যাস পড়লাম যার এরকম মনের মতো সমাপ্তি।
মাধুকরী- আমার পড়া অন্যতম সেরা বাংলা উপন্যাস। পৃথু ও রুষার জীবনের কাহিনী নিয়েই এ উপন্যাস। কিন্তু এ শুধু এক নিছক কাহিনী নয়,এ এক জীবনবোধ, এ এক অন্যরকম দর্শন, নতুন আঙ্গিকে জীবনকে দেখা।
গল্পের নায়ক পৃথু ঘোষ নামক এক মধ্যবয়সী পুরুষ, এই সভ্য পৃথিবীর আধুনিকতা যাকে কখনই ছুতে পারে নি। আধুনিকতা,বিলাসী জীবন- এ সব কিছুর থেকেও জঙ্গল তাকে বেশি টানে। শুরুর দিকে তাকে আর দশটা দুঃখবিলাসী ছন্নছাড়া নায়ক মনে হতে পারে। প্রথম দিকে মনে করেছিলাম, সে হয়ত এক অলস ধরণের সাধারণ মানুষ,যার বেশিরভাগ সময়ই কেটে যায় স্বপ্নের জগতে, কবিতার জগতে। কিন্তু যতই উপন্যাসের কাহিনী এগোতে থাকে,এই ভুল ভাঙতে থাকে। না,পৃথু ঘোষ কোনো অসাধারণ মানুষ নয়,বরং এই উপন্যাসে সেই একমাত্র সাধারণ মানুষ। অন্যদের মত সভ্যতার মুখোশ পরে জীবনটা কাটিয়ে দেয় নি সে,বরং মানুষের মতই বেচেছে।
উপন্যাসটি অনেক বাস্তবধর্মী। চরিত্রগুলোর চিন্তা ভাবনা,অত্যন্ত সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। তবে অন্যদের তুলনায় পৃথুর কাহিনীই বেশি এতে,তাই পড়তে পড়তে কখন যে পৃথুর সাথে মিশে গেছি,নিজেও জানি না। তার প্রতিটা চিন্তা,প্রতিটা জীবনদর্শনকে নিজের বলে মনে হচ্ছিল। এমনকি তার সুখ-দুঃখগুলোও। এক পর্যায়ে গিয়ে কান্নাও এসেছিল,কিন্তু খুব আশ্চর্য হলাম, কিছুদূর যাবার পরই পৃথুর মত আমার কান্নাটাও হারিয়ে গেল। পৃথুর মত আমিও ভাবছিলাম, দুঃখের তো কিছু হয় নি এখানে, আর সেই দুঃখের কথা মনে করে পরে নিজেরই হাসি পেয়েছে।
এ উপন্যাসটি সব পাঠকের জন্য নয়। কারণ লেখকের অনেক জীবনদর্শনই অনেকের কাছে ভাল লাগবে না। জীবন অনেক কঠিন,সত্যগুলো বড়ই নির্মম। তাই এই সত্য কথাগুলো হজম করতে অনেক কষ্ট হয়েছে।
পৃথুর মতে,একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে পারিবারিক সম্পর্কগুলোতে এক নতুন বিপ্লব ঘটবে। বদলে যাবে সম্পর্কগুলোর সংজ্ঞা,মানুষ হয়ে উঠবে আত্মসচেতন। তবে সব বিপ্লবেই কিছু মূল্য দিতে হয়। তেমনিই, এই বিপ্লবের মূল্য হবে প্রকৃতি, আর মানুষকে তার অনেক মানবীয় গুণাবলি বিকিয়ে এই নতুন পৃথিবী অর্জন করতে হবে হয়ত। আধুনিকতা নাকি প্রাচীনত্ব, কোনটা সঠিক? এই প্রশ্নের জবাবই খোজা হয়েছে গল্পে। পৃথু প্রাচীনপন্থি সমাজের প্রতিনিধি,আর রুষা আধুনিকতার। এক পর্যায়ে পৃথু বলেছে- রুষা আর কুর্চিই হল ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষ। আর সে নিজে প্রাচীনপন্থী।কিন্তু পুরো উপন্যাস পড়ে এটাই বুঝেছি যে, কুর্চি বা রুষা,দুজনের থেকেই অনেক বেশি আধুনিকমনষ্ক হচ্ছে পৃথু নিজে। প্রকৃতপক্ষে,তার চিন্তাভাবনাই ভবিষ্যৎ পৃথিবীর পরিণতি নির্দেশ করে। পৃথু ও রুষা দুজনই আসলে ভবিষ্যতের মানুষ, তবে দুজন দুই ধারার।
রুষা চরিত্রটিকে ভাল লাগে নি,বরং করুণা হয়েছে। নারীবাদিতাকে ভাল কাজে লাগালে সেটা মঙ্গল বয়ে আনবে, কিন্তু রুষার মত শুধু ব্যক্তিস্বার্থে নারীবাদকে ব্যবহারের পরিণতি খুবই খারাপ হবে। পৃথু আর রুষা দুজনেই হয়ত একই দোষে দোষী, কিন্তু তারপরেও বলব,পৃথু যাদের ভালবেসেছে ,সত্যি সত্যিই ভালবেসেছে। আর রুষা শুধু নিজের স্বার্থই মিটিয়েছে, তার মধ্যে কখনই ভালবাসা ছিল না। তবে নির্মম সত্যটা হচ্ছে, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষেরা হয়ত রুষাদের মতই বস্তুবাদী স্বার্থপর হবে, ইতিমধ্যেই তার পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে।
উপন্যাসের বর্ণনা,বাচনভঙ্গী খুবই সুন্দর ছিল। অনেকগুলো সুন্দর কবিতা আর গান আছে, এছাড়াও অসংখ্য বিখ্যাত সাহিত্যিক আর দার্শনিকদের সুন্দর সুন্দর উক্তি আছে। একটা জিনিসই খারাপ লেগেছে, অনেক জায়গাতেই বাংলা হরফে ইংরেজি বাক্য লেখা হয়েছে , এগুলো পড়তে খুবই সমস্যা হয়েছে। আরেকটা সমস্যা হল,প্রচুর পরিমাণে হিন্দী সংলাপ। হিন্দী জানা না থাকায় সেগুলোর বেশিরভাগই বুঝি নি,এতে অনেক ঘটনাই বুঝতে কষ্ট হয়েছে। হয়ত মধ্যপ্রদেশে এই উপন্যাসের পটভূমি বলেই লেখক বাংলা ব্যবহার করেন নি।
মাধুকরী অর্থ ভিক্ষাবৃত্তি। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে,বিভিন্ন মানুষের সঙ্গেই দেখা হয় আমাদের। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকেই কিছু শিখি আমরা, আর এই ভিক্ষা করে পাওয়া শিক্ষা নিয়েই গড়ে উঠে আমাদের মননশীলতা,আমাদের জ্ঞান। পৃথু এই পরম সত্যকে উপলব্ধি করেই, সব রকমের মানুষের কাছ থেকে কিছু শেখার চেষ্টা করেছে। আর এজন্যই উপন্যাসের নাম মাধুকরী- জীবনের পদে পদে পৃথুর মাধুকরী।
পড়া শেষ করে মনে হচ্ছে যেন একটা জার্নি শেষ হল। আমার দৃষ্টিতে অসাধারণ একটা বই। "আরণ্যক" এর পর আরেকটা বই পড়লাম যেখানে অত সুন্দর করে প্রকৃতির বর্ণনা ছিল। মধ্যপ্রদেশের পাহাড় বন-জঙ্গল যেন চোখের সামনে ছিল আর আমি সীওনী অথবা মুক্কির কোন লজ থেকে দেখছিলাম। বইয়ের আসল বিষয় যদিও প্রকৃতি না, কয়েকটা মানুষের (পৃথু, রুষা আর কুর্চি) দৃষ্টিতে জীবন অথবা সম্পর্ক! এই শতাব্দীর মানুষ সম্ভবত ওভাবেই চিন্তা করে, রুষা বা কুর্চির মত। অনেকেই বোধয় পৃথুর মতই নিজের জীবনেই বেঁচে থাকতে চায়। তবে সমস্যা হচ্ছে অধিকাংশ মানুষই বোধয় অপরের বেলায় ব্যাপারগুলো মেনে নিতে পারে না। তবুও লেখকের কথাই সত্য, বইটা এই শতাব্দীর নর-নারীর জন্যেই। কখনো কখনো মনে হয়েছে যে, নারীদের খুব বাজেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। অবশ্য সেইসব সম্ভবত কোন কোন চরিত্রের চিন্তাভাবনা। তাতে আমাদের সমাজের বাস্তবতাই প্রকাশ পেয়েছে। একটা বিরক্তিকর দিক অবশ্য ছিলই। লেখক বড্ড বেশি "সেক্স" ব্যাপারটা নিয়ে এসেছেন। যেকেউই বিরক্ত হতে পারে।
জানি আমি একদিন বুড়ো হব। চশমার ফাঁকে। উলের কাঁটার ঘর গুণে গুণে কাটবে সময়। যদিও অনেক লোক আসে, যায়-- দুটো কথা কয়-- মনে মনে জানা রবে, কেউ তারা খোঁজে না আমাকে। এমনি মেহগ্নি আলো বিকেলের জানালাকে ছোঁবে! নরম চাঁদের বল ফের উঠে আসবে আকাশে। বাতাস সাঁতার দেবে সবুজ ঢেউয়েরই মত ঘাসে। আকাশের বুক ভরে তারারা বিছানা পেতে শোবে। সাদা চুল নেড়া দাঁত, আয়নায় ভ্যাংচানো ছায়াকে তখনো বলবো আমি রাজ্যচুত রাজ্ঞীদের ভাষা। 'জানিস, আমার ছিলো সে এক আশ্চর্য ভালবাসা। তোর কি ক্ষমতা আছে মিথ্যে করে দিবে সে পাওয়াকে?
"মাধুকরী" অর্থাৎ মধুকরের ন্যায় বৃত্তি বা সহজ ভাবে বললে বহু স্থান হতে অল্প অল্প করে সংগ্ৰহ। ঠিক একই ভাবে দেখা যায় উপন্যাসের নায়ক বা নায়িকাও একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত না থেকে নানা স্থান হতে অল্প অল্প করে ভালোবাসা সংগ্ৰহের চেষ্টা করে। নায়ক পৃথু একাডেমিক পড়াশোনা জানা এক নির্বোধ যার সাংসারিক কোনো জ্ঞান নেই। স্ত্রী অন্য পুরুষের সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত ; ফলস্বরূপ অবসাদ ও একাকীত্বের শিকার পৃথু শান্তির সন্ধানে কখনো প্রাক্তন প্রেমিকার কাছে আবার কখনো বাঈজীর কাছে উপস্থিত হয়েছে। উপন্যাস জুড়ে শুধুই পরকীয়া ও বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক। ৬৩২ পৃষ্ঠার উপন্যাস তাতে গল্প কতখানি ও কতখানি অযাচিত বর্ণনা সেই নিয়ে তর্ক করা যায়।
প্রত্যেক সাধারণ পুরুষ ও নারীকে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি অগণিত নারী,পুরুষ ও শিশুর হৃদয়ের এবং শরীরেরও দোরে দোরে হাত পেতে, ঘুরে ঘুরেই বেঁচে থাকতে হয়। প্রীতি,প্রেম,কাম,অপত্য,ভক্তি,শ্রদ্ধা,ঘৃণা,বৈরিতা,ক্রোধ,সমবেদনা এবং এমনকি ঔদাসীন্যরও বোধগুলিকে দেওয়ালির রাতের অসংখ্য প্রদীপের কাম্পমান শিখারই মতো অনুভূতির দ্বিধাগ্রস্ত আঙুলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে জীবনকে পরিক্রম করে যেতে হয়। এই পরিক্রমারই আরেক নামই কি মাধুকরী?
There is a line quoted by Ernest Hemingway's character in Woody Allen's movie 'midnight in Paris' which goes like this: "It was a good book, because it was an honest book". The quote firmly applies to "Madhukari" :)
মাধুকরী এত সুন্দর একটা বই, এত এত সুন্দর একটা বই, এই বই নিয়ে রিভিউ লেখার দুঃসাহস আমি করিনা। তবুও মনে হয় গত বারো দিনের এত সুন্দর অভিজ্ঞতা কোথাও লিখে না রাখলে হারিয়ে যাবে। তাই যা যা মাথায় আসে তা লেখা।
মাধুকরী কোন জীবনমুখী উপন্যাস নয়। মাঝে মাঝেই একে আমার নিখাদ প্রেমের উপন্যাস মনে হয়েছে, মাঝে মাঝেই মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস বলে মনে হয়েছে। জীবনে চলার পথে একজন মানুষের অসংখ্য নারী, পুরুষ, শিশুর মনের ও শরীরের দোরে দোরে ঘুরে ভালবাসা, বন্ধুত্ব, প্রেম, শ্রদ্ধা, ভক্তি, ঘৃণা নিয়ে নিয়ে বেচে থাকার গল্পই মাধুকরী।
উপন্যাসের মূল চরিত্র পৃথু ঘোষ। তার আশেপাশের মানুষ ও তার জীবনকে ঘিরেই এ উপন্যাস। সে একজন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও ভিতরে ভিতরে সে একজন কবি। তাই অন্য দশজন স্বাভাবিক মানুষ যা সহজেই করতে পারে, সে তা করতে পারেনা। নিজের সংসার, স্ত্রী, ছেলেমেয়ের প্রতি তার ঔদাসীন্য মাঝে মাঝে বড্ড বেশিই মনে হয়েছে। তার স্বার্থপরতাও পাঠকের চোখ এড়াবে না। পৃথুর মত কোন দায়িত্ব পালন না করে ভালোবাসার আশা করা অমূলক, এতে যে পাশাপাশি থেকেও দু'জন মানুষ কখন বহুদূর চলে যায় তা যে বুঝা মুশকিল।
আমাদের সকলের মাঝেই পৃথু ঘোষ আছে। আমরা অনেকেই তা লুকিয়ে রেখে অন্য দশজন স্বাভাবিক মানুষের মত ক্যারিয়ার, সংসার এসবে মন বসানোর চেষ্টা করি। আমরা কেউই একজন মানুষ নই। বরং যেন অনেকগুলো মানুষ। হয়ত আমরা সাপেরই মত, একেক জায়গায় একেক মানুষের কাছে একেকরকম খোলস পরে নিজেদের উপস্থাপন করি। আমরা সকলেই মাল্টি ডাইমেনশনাল। নিজের মধ্যে অনেকগুলো আমিকে ধারণ করতে পারি। তারপর যেখানে যেয়ে কারও ওয়েভলেন্থের সাথে আমাদের ওয়েভলেন্থ মিলে যায় সেখানেই আমরা স্থিতু হই।
উপন্যাসে প্রকৃতির বর্ণনা উল্লেখ করার মত। খুব সুন্দর করে মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল, নদী, পাখি, গাছ, দিন-রাতের বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষ যে প্রকৃতিরই সৃষ্টি, প্রকৃতিতেই মানুষের মূল, যা আমরা শহরের মানুষ কবেই ভুলে বসেছি। হয়ত শহরে থেকেও অনেকে পৃথুর মতই প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরে বেচে থাকে। তাই তো অন্য দশজন মানুষের মত তথাকথিত সুন্দর জীবন তাদের পাওয়া হয়ে ওঠেনা।
উপন্যাসে নারী স্বাধীনতার দিকটি উল্লেখ করার মত। পৃথুর স্ত্রী রুষা, প্রেমিকা কুর্চি আর বাইজি বিজলী, প্রতিটিই মেয়েই দিন শেষে একদম স্বাধীন মানুষ। ভালবাসার জন্য কেউই জীবনে আটকে থাকেনা। শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, নিজের জীবনটাকে, নিজের স্বাধীনতাটাকে যেকোন পরিস্থিতিতে শক্ত হাতে ধরে রাখে এরা। যদিও তিনটি একদমই ভিন্নরকম, সমাজের ভিন্ন স্তরের চরিত্র তবুও সমাজের মানুষের কথা কানে না নিয়ে নিজের মত করে বাচার সাধ পূরণ করার সাহস এদের আছে বলেই এদেরকে আমার একই সুতোয় গাঁথা মনে হয়েছে।
ভালবাসার পাশাপাশি অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বন্ধুত্ব। সমাজের উচ্চ পর্যায়ের মানুষের তথাকথিত লোক দেখানো বন্ধুত্ব নয়, মনের সাথে মনের মিল আছে এমন বন্ধুত্ব, যেখানে সামাজিক স্তর বা শিক্ষা কোন ভূমিকাই পালন করেনা। যে বন্ধু তার বন্ধুর জন্য জীবন দিতে পারবে, কিংবা কে জানে হয়ত দিয়ে দিবে তার একটি পা কিংবা তার প্রিয় ভালবাসার রমণীকে। তবুও স্বার্থ আর প্রেম এসে এই বন্ধুত্বতেও ফাটল ধরায়। তখনই মনে হয় জীবনে কোনকিছুই ফর গ্র্যান্টেড নয়, নেভার এভার৷
আমি একদমই কবিতা পড়া মেয়ে না, তবুও নানা পরিস্থিতিতে কবিতা ব্যবহার করে চিন্তাকে ফুটিয়ে তোলাটা আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে। এখন আমার প্রায়ই মনে হয় কবিতার দু'টি লাইন অনেক কিছুই করতে পারে যা হয়ত সারাজীবন হাজার হাজার লাইন লিখে মানুষ করতে পারেনা। কবিতা বড়ই শক্তিশালী। সেজন্যই হয়ত আমি কখনো নিজের মাঝে কবিতাকে ধারণ করতে পারিনি, পারবোনা৷
পুরো উপন্যাসে নানাদিকের, নানারঙের চরিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আবার একজন মানুষের চরিত্রের অনেকগুলো দিকও তুলে ধরতে ভুল করেননি লেখক। তবে এরচেয়ে সুন্দর চরিত্র বিশ্লেষণ বোধহয় সম্ভব ছিল না৷ দিনশেষে আমরা নিজেরাই বা কতটুকু চিনি নিজেদের। মাঝে মাঝে নিজেকেই বড্ড পর মনে হয়।
এ উপন্যাস জীবনে একবার পড়ার উপন্যাস নয়। হয়ত আমি বছর পাচেক পর আবার এই উপন্যাস পড়ব। হয়ত এর মধ্য দিয়ে নতুন করে আবার নিজের জীবনকে খুঁজে বেড়াব। কারণ জীবনের আরেক নামই তো মাধুকরী।
একা হলেই নিজের কাছে নতজানু মানুষ বরফের মতো , ঘাসের মতো মোমের মতো গলতে গলতে বলে -ক্ষমা করো । আমি পারিনি খুচরো পয়সার মতো এলোমেলো হয়ে গেছি গাছ থেকে ঝরে পড়েছি খাদে , ফাঁদে , জঙ্গলে । দরজা খুঁজে পাইনি রাজবাড়ির সিঁড়ি খুঁজে পাইনি মন্দিরের ক্ষমা করো । আমি পারিনি ।
In **"মাধুকরী,"** Buddhadeb Guha explores existentialism through the protagonist Prithu's journey of self-discovery. Disillusioned with the superficiality of urban life, Prithu retreats to the forest, seeking deeper meaning and authenticity. His isolation reflects the existential themes of alienation and the search for identity. The novel delves into the absurdity of societal norms, the burden of individual freedom, and the confrontation with mortality. Prithu's quest embodies the struggle to find purpose and live authentically in a world that often seems indifferent to human existence.
১) গল্পের চরিত্রগুলো এমন হতে হবে যে আমি তাদের বুঝতে পারছি। ২) বর্ণনা এমন হতে হবে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। ৩) গল্প এমন জমাট হতে হবে যে বই ছেড়ে উঠতে পারব না।
মাধুকরীতে তেমন কিছু ছিল না। কোজাগর বইটা বরং এর চাইতে অনেক সুখপাঠ্য। পৃথুর চরিত্র ঠিক বোঝা গেল না। আমার ধারণা লেখক নিজেও স্পষ্ট না। নিজেকে বারবার ব্যর্থ, আবাল, হতাশ বলে বলে বইটার চামড়া মোটা করা হয়েছে মাগার কাজের কাজ হয় নাই। রুষার প্রতি মনে হয় এক ধরনের অবিচারই করেছেন লেখক। এটা ঠিক পছন্দ হয় নাই। কুর্চির কথা বলার মানে হয় না। জোর করে যে লেখা হয় না, কুর্চি এটার প্রমাণ। পৃথুকে মদন প্রমাণ করতে হবে - সেজন্য আরেকজন মহিলা মদন দরকার। এই নাও - কুর্চি। কুর্চির জামাইটা তো আরেক মাল। পৃথুর উপর রাগ করে উনি গাঞ্জার ব্যাবসা ধরেছেন। হা হা হা। শালার নামটাও মনে করতে পারছি না। এসব থেকে ওই বাইজীর চরিত্র স্পষ্ট ছিল। ওরে নিয়ে একটা বই লেখা উচিৎ ছিল বুদ্ধদেব সাহেবের।
বিশাল পাঁচশ সাড়ে পাঁচশ পৃষ্ঠার বই - ভিতরে কিচ্ছু নাই।
দেখেন ভাই, আমি সুনীলের "সেই সময়" "প্রথম আলো", "পূর্ব-পশ্চিম" পড়েছি। এসব বইগুলো আমাকে গল্পের মধ্যে টেনে রাখতে পেরেছিল৷ আমি মনে করি কোনো সাহিত্য কর্ম বা সিনেমা যদি আমাকে তার গল্প দিয়ে আমাকে ধরে রাখতে না পারে তাহলে তা worthless. ঠিক যেমন এই "মাধুকরী"। প্রচুর জনপ্রিয় বই দেখে পড়া শুরু করেছিলাম। কিন্ত লেখনিতে কোনো আকর্ষণ পাই নি। নায়ক পৃথু এক একাডেমিক পড়াশোনা জানা নির্বোধ, সাংসারিক জ্ঞান নেই আর তার বউ পরকীয়া করে। কিছু মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার, দার্শনিক কথা বার্তা আছে তা এত গুরুত্বপূর্ণ না। এই প্লটে এতবড় উপন্যাস লেখার কোনো দরকার ছিল না। বাহুল্য বর্ণনা ভর্তি - অনেকটা বাংলা সিরিয়ালের মত,শুধু টেনে টেনে লম্বা করা হয়েছে। শেষে আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছি৷ বুদ্ধদেব গুহর এটা আমার পড়া প্রথম উপন্যাস ছিল, ভাবলাম অন্য লেখাগুলোও পড়ব কিন্ত এখন আর আগ্রহ পাচ্ছি না।
An amazing fictional narrative that dexterously weaves in the terrains of the human mind while the novel's main characters explore life's journey through ups and downs, jungles, mountains, and plateaux. Beneath it all, a pervading sense of 'not knowing' what life's various turns will bring, the self, and other human beings allows the reader a choice in making sense of it as she would, or not attempting to make sense of it and just accepting the fact that one will never know anything for sure. We reconcile ourselves as being forever incomplete, forever work-in-progress. Overall, a beautiful read.
জোর করে নিজের opinion কে justify করা মনে হলো, তাই একটি তারা কম পড়লো। আর দ্বিতীয় তারা টি খসে পড়লো কারণ শেষ পাতায় হঠাৎ গল্পো শেষ হলো এমন ভাবে যেনো মনে হলো লেখকের নিজের ইচ্ছেটাই ফুরিয়ে গিয়েছে। কিছু গল্পো ধোঁয়াশা রেখে শেষ হয় যাতে পাঠকের মনেই তার পরের পর্ব রচনা হয়। কিন্তু এই বই হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেলে ভাবে কোথায় যেন যাবো বলে বের হয়েছিলাম! সত্যি বলতে লেখক উৎসর্গ আমাদের generation কে করেছেন ঠিকই এটা ভেবে যে একবিংশ শতাব্দী তে এরকম কিছু একটা ঘটবেই, কিন্তু পরে মনে হলো লেখক আসলে চেয়েছেন একবিংশ শতাব্দীর নর নারী এরকম হোক, যেমন অনেক বাবা মা নিজের সন্তানের মধ্যে নিজের অপূর্ণতা, ব্যার্থতা খুঁজে নিতে চেষ্টা করেন। শুধু জঙ্গলের বর্ণনা অসাধারণ, যেতে মন চায় ভীষণ। লেখকের ঋজুদা সমগ্র এর কথা মনে করায়, যা আমার খুব প্রিয়।
"দুঃখী মানুষের চোখের চেহারাটা আমি চিনি। তাদের দুঃখটা চোখের তলায় থাকে না। চোখের এক্কেবারে মণির মধ্যেই বাসা বেঁধে থাকে, ঝিনুকের মধ্যের মুক্তোর মতো।...দুঃখ নিয়ে দুঃখ করে তো একমাত্র বোকারাই।"
"যাওয়া মানেই তো আসা, আর আসা মানেই যাওয়া। যেমন ভাবে যে দেখে।"
"সব আরম্ভই বোধহয় শেষে পৌঁছে আবার আরম্ভেই ফিরে যায়। এবং আরম্ভে পৌঁছে আবারও শেষে।"
"কাউকে সম্পূর্ণতায় পেতে চাওয়ার ভাবনাটাই হয়তো ভূল। একান্ত করে আজকার মানুষ কেউই কাউকে নিতে বা দিতে পারে না, নিজেদের টুকরো করে টুকরো টাকরাই ভেঙ্গে ভেঙ্গে বার-চকলেটের মতো তুলে দেয় বোধহয়, একে অপরের হাতে।"
"ভুলে যাওয়াই ভালো। ভুলে না যেতে পারলে কি মানুষ বাঁচে? এই অকৃতজ্ঞতার, কৃতঘ্নতার পৃথিবীতে সব কিছুই মনে রাখতে গেলে মনের মধ্যে এক বিরাট ক্যানসারাস গ্ৰোথ হয়ে উঠবে যে কুৎসিত, তারপর সেই দলা পাকানো ভীতিজনক স্মৃতি নিঃশব্দে ফেটে যাবে একসময় মস্তিষ্ক খান খান করে দিয়ে।"
"যা হারিয়ে যাবার, তাকে আগলে বসে থাকা সম্ভবও নয় বেশিদিন।"
"বেশিরভাগ স্বামী স্ত্রীর ভালবাসাটা এমনই। একটা অভ্যেস। ছেলেমেয়েরা এসে যাবার পর স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক টা একটা অন্য ডাইমেনশান পায়। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, আলগা হয়ে যায় হয়তো। আবার গভীরও হয়, ছেলে মেয়েদের জন্যই। মনে করো, কী বলব, ধরো ছিঁড়ে যাওয়া বাথরুম স্লিপারের মতো। ছিঁড়ে গেলেও ছেড়ে যাওয়া, ফেলে দেওয়া বড়ই কঠিন।"
"তুমি খুশি থাকলেই আমি খুশি। কীভাবে এবং কোন পথে তুমি খুশি হচ্ছো, তো আমার জানার দরকার পর্যন্ত নেই। খুশি থাকো গো। সবাই খুশি থাকুক। খুশিতে ভরে উঠুক এই খুশিহীন পৃথিবী। আনন্দম। আনন্দম। আনন্দম। দুদিনের এই জীবন। এসেই তো চলে যাওয়া। নিয়ে দিয়ে, দিয়ে নিয়ে ভরপুর করে রেখে সুধন্য করো সকলে, একে অন্যকে।"
"একটাই জীবন। শুধুমাত্র একটা। অথচ এই আমাদের নিয়তি। এই কালে, এ সমাজে আমরা কেউ বেঁচে থাকি না, আমরা বাঁচতে জানি না। সংস্কার, লোকভয় আর অভ্যাসের দাসত্বই করি শুধু আমরা। প্রেমকে খুন করে তার রক্ত ছেনে অপত্যস্নেহের পুতুলদের নিয়ে পুতুলের ঘর করি। শুধুই প্রশ্বাস নিই আর নিঃশ্বাস ফেলি।"
"মানুষ হয়ে যখন জন্ম নিয়েছে এ সংসারে, তখন সারা জীবন কতো অসংখ্য ঘুড়িই যে কেটে যাবে ওর চোখের সামনে। কত সুন্দর স্বপ্নের সব ঘুড়ি, সাধের ঘুড়ি, প্রেমের ঘুড়ি, হয়তো সততা এবং বিশ্বস্ততার ঘুড়িও। কোনো ঘুড়ির সুতো থাকবে তার নিজের হাতে, কোনটায় নিজে মাঞ্জা দেবে কিন্তু প্রায়ই সবসময় অপরপক্ষের ক্ষূরধার মাঞ্জার ভার এ���ং ধারে কচ্ করে কেটে যাবে তার সব ঘুড়ি।"
"একা একা যেকোনও দৌড়েই যে প্রথম হয়, সে একাই আগে থাকে। তার সামনে বা পাশে কেউই নয়।"
"জোরে ছুটে গেলেও অনেক সময় একপাও এগোনো যায় না। আবার এক জায়গায় অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেও ইচ্ছে করলে অনেক দূরে চলে যাওয়া যায় হয়তো।"
"যে ভালবাসা ফ্রিজে ঢুকে যায়, তা আর গরম হয় না কখনও।"
"যে মরতে চায়, মৃত্যু তাকে ছোঁয় না। যে বাঁচতে চায়, মৃত্যু বাঘের মতো তারই ঘাড়ে এসে পড়ে।"
"ভালোবাসা তো ব্যবসা নয়। দেনা-পাওনার ব্যাপার নয়। একজনের সঙ্গে অন্যজনের হঠাৎই হয়ে যায়।"
"শরীরের ভালোবাসার ভয় নেই, ভয় মনের ভালোবাসায়।"
"কেউই যেন কাউকে ভালো না বাসে। জীবনের সব প্রাপ্তিকে এ যে অপ্রাপ্তিতেই গড়িয়ে দেয়। যাকিছুই সে মানুষটি দীর্ঘদিনের চেষ্টা, পরিশ্রম, মননশীলতা দিয়ে গড়ে তুলেছিল, যাকিছু ছিল তার গর্বর, পরিচয়ের, শ্লাঘার, তার সবকিছুই হঠাৎ মূল্যহীন হয়ে পড়ে। যাকে ভালোবাসে তাকে নইলে তার আমিত্বই অনস্তিত্বে পৌঁছোয়।"
"যার বিবেক বেঁচে থাকে, তার সুখ মরে যায়। সুখী হবার সহজ উপায় বিবেকহীন হওয়া। বিবেক, বিবশ হলেই বাঁচি।"
"ভালোবাসা বড়ই অপরাধের। যে বেসেছে, সেই জানে।... ভালোবাসার মতো অসুখ কি আর আছে?"
"পুরুষ ও নারী যখন নীরবে থাকে তখনই তাদের সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। মনের গন্ধ, ম্যাগনোলিয়া গ্ৰান্ডিফ্লোরা ফুলের গন্ধের মতো ওড়ে শুধু তখনই।"
"জীবনটা বাঁচবার জন্য, প্রতি মুহূর্ত পস্তাবার জন্য নয়।"
"কেই-ই বা কাকে চেনে বলো? এই ছোট্ট জীবনে! চিনি চিনি বলে মনে হয়, সত্যিই কি চেনা যায়? আমরা নিজেরাই কি চিনি নিজেদের?"
"আমি ওকে ভালোবাসতাম কিনা কখনও তো যাচাই করে দেখার অবকাশও হয়নি। মানে, আমার দিক থেকে। যখন হলো, এই দুঃসময়ে তখন মহা দুশ্চিন্তাতেই পড়লাম। এখনও বুঝে উঠতে পারছিনা অভ্যেসটাকেই ভালোবাসা বলে ভুল করেছি কি এতোদিন?"
"যাকে মানুষ ভালোবাসে, তার কাছ থেকে কোনও সাহায্য নিলে সে ভালোবাসা নোংরা হয়ে যায়। বিচ্ছিরি দেনা পাওনার বিষয় হয়, সুন্দর আর থাকে না।"
"কেই বা কাকে বোঝে বলো? বোঝা কি অতো সোজা?... বোঝাটা হয়তো বড়ো কথা নয়, বোঝবার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি। বুঝতে চাইলে একদিন নিশ্চয়ই বুঝবে।"
"সব অভাব কেউই পূরণ করতে পারে না কারও। কিছু হয়তো পারে, যেখানে ঘাটতি থাকে।"
"বাবা, মা, বংশ পরিচয় এসব কিছুই নয়। প্রত্যেক মানুষকে, মানুষ হয়ে উঠতে হলে, তার পরিচয় তৈরি করে নিতে হয়। তার জন্য দাম যা লাগে লাগুক, বিনামূল্যে এ জীবনে কি আর মেলে বল?"
"কার ভালোবাসার প্রকাশ যে কেমন, তা ভালোবাসার প্রকাশের সময় না এলে বোঝা যায় না বোধহয়।"
"জীবনে, কটা কথাই বা রাখা যায়? মিথ্যার বেসাতির আর এক নামই তো জীবন। তবু আশ্চর্য। কথা দিতে হয় কতজনকেই কতবার। আর কথা দিলেই যদি কেউ খুশী হয়, তাহলে না দিয়েই বা কি করা যায়? ভবিষ্যতের দুঃখের কথা ভেবে আজকের খুশী নষ্ট করার তো মানে নেই কোনও।"
"দেখাশোনা তো দিনভরই চলে, জীবনভর, জন্ম থেকে মৃত্যু, কিন্তু সেই ভীড়ের মধ্যে মনের মানুষ থাকে কজন? চোখ তো কতই দেখে। সকলকেই কি মনে ধরে? সারাজীবনে হয়তো একজন কি দুজনকেই তেমন করে চায় মানুষ। আর যাকে বা যাদের সে চোখে চাওয়া হয়, মনের চাওয়া চায়, তারাই তো হচ্ছে মনের মানুষ।"
"এই পৃথিবীতে বড় বেশি অপ্রয়োজনীয় কথা হয়। চিরদিনই হয়ে এসেছে। যে যতক্ষণ পারে চুপ করে থাকাই তো ভালো। মুখ চুপ করলে তো আর মস্তিষ্ক চুপ করে থাকে না। আগুন জ্বালায় শরীরকে, আর চিন্তা মনকে।"
"একজন স্বামীর, একজন বাবার, তার স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে ছাড়া কোনও অস্তিত্ব নেই।সে যত তালেবর পুরুষই হোক না কেন?... ছেড়ে যাওয়া যায়, যে কোনো সময়ই, দম্ভ ভরে, কিন্তু সময়ের মধ্যে না ফিরলে ঘর আর ঘর থাকে না। সব পাওয়াই তখন মিথ্যে হয়ে যায়।"
"সময় বড় সাংঘাতিক। সময়ে সময় না রাখলে, সময় পায়ে দলে চলে যায়।"
"এই ছোট্ট জীবনে যদি সুখী হতে চাও নিজের চেনা জানা বন্ধুত্বের জগতেও ছোট করে রেখো। যারা তোমার কাছের মানুষ হবে, তাদের সাথে সম্পর্ক গভীর করো। পাঁচশো জন পরিচিত মানুষের চেয়ে পাঁচ জন কাছের মানুষ অনেকই বেশী দামী।...একসটেনসিভ রিলেশানশিপের চেয়ে ইনটেনসিভ রিলেশানশিপ অনেক জরুরী।"
"মন যখন মন থেকে সরে যায় তখন আদালতে গিয়ে সরে যাওয়া মনকে ফিরিয়ে আনার দরবার করা, কি আইনের চোখে অন্যকে শিক্ষা দেওয়াতে আমি বিশ্বাস করি না।"
"যারা কাউকেই ঠকায় না কখনও, তারাই সবচেয়ে বেশি ঠকে যায় এখানে। আশ্চর্য নিয়ম, তাই না?"
"ফুলের গন্ধর মতোই ভালো মানুষের মনের গন্ধও আপনিই ছড়িয়ে যায় অন্য মানুষের মনে।"
"যে কোন মানুষেরই বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন, তা তার নিজেকে। নিজেকে নিজে একটু সময় না দিলে, ভালো না বাসলে, দিনান্তে আয়নার সামনে একবারও না দাঁড়িয়ে ভালোবেসে নিজের মুখের দিকে না চাইলে তার অন্যর বা অন্যদের জন্যে প্রাণাতিপাত পরিশ্রম করার মানে হয়না কোনও। আসলে, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই বোধহয় সে নিজেই কেন্দ্রবিন্দু। সে আছে, তাইই তার চারধার ঘিরে অন্যান্য সব সম্পর্ক আছে।"
"সুখ মনে করলেই সুখ। সুখকে তো আর হাত দিয়ে ছোঁওয়া যায় না। মনেরই একটা অবস্থামাত্র তা। মনকে সুখী সুখী ভাব করতে বললেই মন সুখী হয়।"
"সব হওয়ারই সময় থাকে, সময় পেরিয়ে গেলে, হয় না আর কিছুই।"
"জীবনে যা কিছুই ঘটে, সব কিছুর পেছনেই মানে থাকে, তাৎপর্য থাকে। আমরা অন্ধ, তাই দেখতে পাই না।"
"পরিবর্তন, সবসময়েই যে বেশি সুখের তা নয়। কিন্তু পরিবর্তনের একটি নিজস্ব মূল্য আছে। পুরনোকে সে নতুন করে তোলে।"
"দুঃখ যা পাবার তা আমরা নিজেরাই নিজেদের দিই, অন্যকে দায়ী করি মিছিমিছি, নিজেরা ভীরু ও অসৎ বলে। ভণ্ড বলে।"
"চুরি করে ভালো না বাসলে বোধহয় ভালোবাসাটা আর ভালোবাসা থাকে না। পরকীয়া প্রেম বা অনাঘ্রাত প্রেম হচ্ছে চাঁদের আলো, আর বিবাহিত প্রেম বা খোলামেলা বাধাহীন শরীরী সম্পর্ক বোধহয় সূর্যালোক। প্রখর সূর্যতাপে, ধূলোয়, আওয়াজে ভালোবাসার ফুল বোধহয় শুকিয়েই যায়।"
"যে ধরে রাখতে না জানে, তার কিছুমাত্রই পাওয়ার অধিকার নেই এ সংসারে।"
"মানুষের জীবনের প্রকৃতিও হয়তো হাওয়ারই মতো, জলেরই মতো সীমানা মধ্যবর্তী কোনও এলাকায় শূণ্যতার সৃষ্টি হলে স্বাভাবিক নিয়মে পারিপার্শ্ব থেকে সেই শূণ্যতা পূরণ করতে ছুটে আসে। আশেপাশের চেনাজানা মানুষও তেমনই আসে ছুটে।"
"একটাই জীবন। সকলেরই নিজের নিজের মতো করে সুখী হবার অধিকার আছে। যে না হতে পারল, সে অভাগা।"
"সাংঘাতিক রাস্তা দিয়ে একদম একা একাই যেতে হয় সকলকে।...পথ না পেরোলে তো গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না। জীবনের কোনো গন্তব্যেই।"
"মানুষের পয়সা যে অনুপাতে বাড়তে থাকে ঠিক সেই অনুপাতেই তার জীবনের মায়াও বাড়তে থাকে। যাদের পয়সা কম তাদের জীবনের মায়াও কম।"
"মানুষ যারা ভাল, সৎ, তারা আন্যের চোখে চোখ রেখে মিথ্যা বলতে পারে না।... ভালোমানুষদের বড়ই কষ্ট, এই খারাপ মানুষে ভরা পৃথিবীতে।"
"ইচ্ছা পূরণের আনন্দের তীব্রতার চেয়েও অনেক সময় অপূর্ণ ইচ্ছার নিবিড় আনন্দ তীব্রতর হয়।"
"নিজের সন্তানের গায়ের গন্ধর মতো মিষ্টি গন্ধ পৃথিবীর কোনও মহার্ঘতম পারফ্যুমেও নেই। শুধুমাত্র বাবা মায়েরাই সে গন্ধর কথা জানেন।"
"প্রত্যেক সাধারণ পুরুষ ও নারীকে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি অগণিত নারী, পুরুষ ও শিশুর হৃদয়ের এবং শরীরের দোরে দোরে হাত পেতে, ঘুরে ঘুরেই বেঁচে থাকতে হয়। প্রীতি, প্রেম, কাম, অপত্য, ভক্তি, শ্রদ্ধা, ঘৃণা, বৈরিতা, ক্রোধ, সমবেদনা এবং এমনকি ঔদাসীন্যরও বোধগুলিকে দেওয়ালির রাতের অসংখ্য প্রদীপের কম্পমান শিখারই মতো অনুভূতির দ্বিধাগ্ৰস্ত আঙুলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে জীবনকে পরিক্রম করে যেতে হয়। এই পরিক্রমারই আরেক নামই কি মাধুকরী?"
"বুদ্ধদেব গুহ"-একজন ভারতীয় বাঙালী লেখক। তিনি মূলত বন, অরণ্য এবং প্রকৃতি বিষয়ক লেখার জন্য পরিচিত। বহু বিচিত্রতায় ভরপুর এবং অভিজ্ঞতাময় তার জীবন। ইংল্যান্ড, ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশ, কানাডা, আমেরিকা, হাওয়াই, জাপান, থাইল্যান্ড ও পূর্বআফ্রিকা তার দেখা। পূর্বভারতের বন-জঙ্গল, পশুপাখি ও বনের মানুষের সঙ্গেও তার সুদীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরংগ পরিচয়। সাহিত্য-রচনায় মস্তিষ্কের তুলনায় হৃদয়ের ভূমিকা বড়- এই মতে তিনি বিশ্বাসী। মাধুকরী উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র পৃথু ঘোষকে সবাই আড়ালে 'পাগলা ঘোষসা' বলে কারণ তিনি কি করেন কি করেন না কার সাথে চলেন কার সাথে চলেন না এসব কিছুই তার ঠিক ছিল না , বিলেত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার ভালোবাসতো কবিতা লিখতে আর জঙ্গলে ঘুরতে, পরিপূর্ণ পরিবার থাকা সত্ত্বেও তিনি ছুটতেন প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে একটু ভালবাসা পাওয়ার আশায় এবং বাঁচতে চেয়েছিল বড় বাঘের মতো। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে অঙ্গ হারানোর পর তিনি বুঝতে পারলেন ভালবাসা এবং নিজের সুখের পিছনে ছুটতে ছুটতে তিনি কতো দূর চলে গেছেন যেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব না এবং তার স্ত্রীও একই ভুল করে তার থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। সুখের পিছে ছুটে ঘরের সুখকে পা দিয়ে পিষে ফেলেছে। এছারাও অন্যান চরিত্র কুর্চি, বিজলী, ভুচু, শামীম, সাবির, দিগা পাড়ে, ঠুঠা বাইগা, গিরিসদা তাদের নিয়েও অনেক ছোট-বড় ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে উপন্যাসে। উপন্যাসটি পড়ার শুরু করার পর থেকেই ভাল লাগছিল কারণ প্রত্যেকটা চরিত্র খুব আকর্ষণীয়, তার সাথে জঙ্গলের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বর্ণনা, নানান রকম পাখি - গাছ - পশুর বর্ণনা, দল নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে শিকার করা, ডাকাত দলের সাথে লড়াই সব কিছুই যেনো চোখের সামনে ভাসছিল। চরিত্র গুলো যেনো আমার চোখের সামনেই কথা বলছে, খাচ্ছে ,হাঁটছে, হাসছে , অভিমান করছে এমন অনুভব হচ্ছিল কারণ লেখক ততটুকু পরিশ্রম করেই লিখেছেন তা আপনারা বইটি পড়ার সময় বুঝবেন। আর একটা বিষয় হচ্ছে এই উপন্যাসে অনেক লেখক-কবিদের নিয়ে এবং বাংলা সাহিত্য নিয়ে 'বুদ্ধদেব গুহ' অনেক আলোচনা করেছেন। বইটি পড়ে প্রায় মাঝামাঝি আসার পর থেকে খারাপ লাগছিল কারণ উত্থানের পর এমন নির্মম পতন মেনে নেয়া যায় না। পড়তে পড়তে চরিত্রের অনুভূতি গুলো অনুভব করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম বুঝতে পারছিলাম কেনো অনেকে বলেছিল- তারা মাধুকরী পড়া শুরু করেছে কিন্তু শেষ করতে পারেনি। লেখক এই উপন্যাসে বোঝাতে চেয়েছেন- মানুষ মাত্রই প্রকৃতির অংশ, মানুষ সামাজিক জীব তাই একা বেঁচে থাকা কখনোই সম্ভব না, জীব জন্তু পাখি তাদেরও অনুভূতি আছে, মানুষ হয়ে আমরা শুধু প্রকৃতির ক্ষতিই করছি, নিজের সুখকে বড় করে দেখলে বা নিজের সুখ খোঁজার জন্য দ্রুত বেগে ছুটে চললে জীবনে সব কিছু হারাতে হয়, পরিবার- সংসারের-সন্তানের মধ্যেই আসল সুখ লুকানো থাকে শুধু একটু সময় দিয়ে খুঁজে নিতে হয়, যাই হোক না কেন! স্বামী স্ত্রীর মাঝে সুন্দর সম্পর্ক ধরে রাখা উচিৎ। এক কথায় বলতে গেলে - মাধুকরী হচ্ছে সামাজিক মানুষের জীবনধারার অভিধান সরূপ। বইটা পড়া শুরু করার পর মনে হচ্ছিল খুব জমপেশ একটা পর্যালোচনা লিখতে পারবো কিন্তু পড়া শেষ অরতে করতে উপন্যাসের অনুভূতি গুলো এমন ভাবে মনে দাগ কেটেছে যে এখন এতো গুলো ঘটনা মিলিয়ে গুছিয়ে পর্যালোচনা লিখতে পারছি না, ভাষা পাচ্ছি না, তল পাচ্ছি না। আমার কথা শুনে আপনাদের মনে হতে পারে একটা বই সম্পর্কে বেশি বেশি বলছি তাই আবারও বলছি আপনারা একটু কষ্ট করে 'বুদ্ধদেব গুহ' এর লিখা "মাধুকরী" উপন্যাসের বই সংগ্রহ করুণ এবং দ্রুত পড়ে ফেলুন। শুভ হোক আপনার পাঠ্য কার্যক্রম
পৃথু ঘোষ চেয়েছিল, বড় বাঘের মতে বাঁচবে। বড় বাঘের যেমন হতে হয় না কারো উপর নির্ভরশীল—না নারী, না সংসার, না গৃহ, না সমাজ—সেভাবেই বাঁচবে সে,স্বরাট,স্বয়ম্ভর হয়ে। তার বন্ধু ছিল তথাকথিত সভ্য সমাজের অপাংক্তেয়রা। পৃথু ঘোষ বিশ্বাস করত, এই পৃথিবীতে এক নতুন ধর্মের দিন সমাসন্ন। সে-ধর্মে সমান মান-মর্যাদা এবং সুখ স্বাধীনতা পাবে পাবে প্রতিটি নারী-পুরুষ। বিশ্বাস করত, এই ছোট জীবনে বাঁচার মতো বাঁচতে হবে প্রতিটি মানুষকে। শুধু প্রশ্বাস নেওয়া এবং নিশ্বাস ফেলা বাঁচার সমর্থক নয়। কিন্তু সত্যিই কি এভাবে বাঁচতে পারবে পৃথু ঘোষ? সে কি জানবে না, বড় বাঘের মতো বাঁচতে পারে না কোনও নরম মানুষ? জন্ম থেকে আমৃত্যুকাল অগণিত নারী-পুরুষ-শিশুর হৃদয়ের, শরীরের দোরে-দোরে হাত পেতে ঘুরে-ঘুরে বেঁচে থাকাই মানুষের নিয়তি? এই পরিক্রমারই অন্য নাম মাধুকরী? এ শুধু ইন্জিনিয়ার পৃথু ঘোষের জীবন কাহিনী হয়, নয় 'উওম্যানস লিব'-এর মূর্ত এক প্রতীক তার স্ত্রী রুষার দ্বন্দ্বময় জীবনের গল্প, এমনকি, জঙ্গলমহলের অকৃত্রিম কিছু শিকড় খুঁজেফেরা অজানা মানুষের অজানা উপাখ্যানও নয়। এ-সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে তবু এ-সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে 'মাধুকরী' এই শতকের মানুষের জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আগামী প্রজন্মের মানুষের সার্থকভাবে বেঁচে থাকার ঠিকানা।
লেখকের অতুলনীয় বিস্তারিত মুগ্ধ করবে সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। লেখক এই বইটি উৎসর্গ করেছেন "একবিংশ শতাব্দীর নারী ও পুরুষদের"। যেখানে লেখক মূলত নারীদের স্বাধীনতা দেখাতে চেয়েছে। পাশাপাশি পাশ্চাত্যে সংস্কৃতির যে প্রভাব তারও। যেমন মানুষ রুষা পাশ্চাত্য সঙ্গীত শুনে, রবীন্দ্রনাথের নামও শুনতে পারেন না। তার পাঠ করা বইগুলোও ইংরেজি। অপদিকে পৃথু ঘোষ বাংলা সাহিত্যের পোকা রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীত নিধুবাবুর টপ্পা গানেই তার মুগ্ধতা। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে, সে দেশের সাথে সাথে বিদেশি সাহিত্যও চর্চা করেন। কাহিনী গড়ে তুলেছেন লেখক মধ্যে প্রদেশের হাটাচন্দ্রা নামক স্থানকে ঘিরে। যেখানে স্বল্পসংখ্যক বাঙালি মানুষসহ গ্রাম ছাড়া আদিবাসী টুঠা বাইগা, শামীম , সাবীর মিঞ, ভুচু, ইদুর ভিনোদকার এবং কুর্চিসহ আরো কিছু চরিত্রের দেখা পাই। লেখাটা অনেকটা ধীর গতির কিন্তু পুরোপুরি শেষ করার পর একটা প্রশান্তি এসে ভর করে। যার জন্য মাধুকরী হয়েছে অনন্য।
"মাধুকরী" শব্দের আভিধানিক অর্থ- মধুকর বা মৌমাছি যেমন ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহ করে তেমনি দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা।
এটা কি কোনো উপন্যাস নাকি মানুষে মানুষে সম্পর্কের উপর লেখা থিসিস?
আগে গল্পে আসি, বুদ্ধদেব গুহ মানেই জঙ্গল, প্রকৃতির নৈকট্য। আর এই বই তাঁর ম্যাগনাম ওপাস। সুতরাং, এটিও জঙ্গলের প্রেক্ষাপটেই লেখা। মধ্যপ্রদেশের কাল্পনিক এক জায়গা, নাম হাটচান্দ্রা। সেখানে শেলাক কোম্পানির উর্দ্ধতন কর্মচারী পৃথু ঘোষ। বাড়িতে সুন্দরী বউ রুষা। মানে একটু বেশিই সুন্দরী আরকি, দেখলে চোখ ঝলসে যায়। সাথে মনও, যাই হোক! এছাড়া আছে ছেলে - মেয়ে টুসু আর মিলি।
পৃথু সংসারের প্রতি উদাসীন কারণ তার কোনো গুরুত্বই নেই তার বাড়িতে। সকালে ��্রেকফাস্টে কী হবে সেটা থেকে শুরু করে, বাড়ির সদস্যদের দিন কিভাবে কাটবে তা সবকিছুই রুষার অঙ্গুলি লেহনে চলে। এদিকে পৃথুর ইচ্ছা কবি হওয়ার, কিন্তু লেখা সেভাবে তার হয়ে ওঠে না। বাড়িতে যখনই থাকে, নিজের স্ত্রীর থেকে অতীব রূঢ় ব্যবহার ছাড়া সেভাবে তার কপালে কিছু জোটে না।
তাই তার সময় কাটে বন্ধু দিগা পাড়ে, ঠুঠা বাইগা, ভুচু, শামীম, সাবির মিয়া এদের সাথে। কখনো বা থাকে গিরিশ বাবু ও মণি চাকলাদার । শেষ দুজন ছাড়া, বাকি কেউই সমাজের উঁচু স্তরের ( আর্থিকভাবে) মানুষ নয়। কিন্তু এদের সাথে পৃথুর আন্তরিক সম্পর্ক। এই ব্যাপারটা তাই স্বভাবতই রুষার অপছন্দের। সকালে ব্রিটিশ ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে sophisticated আর পাওয়ারফুল পরিবারের সাথে পার্টি করা - সবকিছুতেই তার একটা ওয়েস্টার্ন প্রেম। প্রবাসী বাঙালি বলে কথা। তার বাংলাটা ঠিক আসেনা ! পৃথু ঠিক উল্টো! জীবনের নানা মুহূর্তে তার মাথায় ঘোরাফেরা করতে থাকে বিভিন্ন বাঙালি কবির অনন্য সৃষ্টি। সাথে কবিগুরু তো আছেনই। উপন্যাসের শেষে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাসের চরিত্র ও দর্শন সম্বন্ধে গভীর আলোচনাও আছে। এখানে গুহ বাবু বিশ্বকবির প্রতি এক রকম ট্রিবিউট দিয়েছেন।
এরই মধ্যে রুষার সম্পর্ক তৈরি হয় হাটচান্দ্রার এক ধনী ব্যক্তির সাথে। চরিত্রটা আমার এতটাই অপছন্দের, তার নামটাও লিখলাম না। আর পৃথুর দুর্বলতা তার ছোটবেলার প্রেম কুর্চির প্রতি। ব্যস পরকীয়া চলে এল। প্রেমের উপন্যাসের এক অনবদ্য উপাদান যা লেখকেরা অনেক পূর্ব হইতেই ব্যবহার করিয়া আসিতেছেন। কিন্তু এখানে এই পরকীয়া না থাকলে, লেখক যা বোঝাতে চাইছিলেন সেটা হতনা, তাই এটা একটা সলিড প্লট পয়েন্ট।
উপন্যাসটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। অথচ পড়লে মনে হয় এখনকার যুগের প্রেমের উপন্যাস পড়ছি। অর্থাৎ, আহেড অফ ইটস টাইম। বইটা উৎসর্গ করা হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর পুরুষ ও নারীদের, এর থেকেই বোঝা যায় লেখক কত দূরদর্শী ছিলেন।
প্রেম কী? প্রেমে মন বড় নাকি শরীর? নাকি দুটোরই সমান ভূমিকা? আধুনিকতা মানে কি ব্যভিচারের লাইসেন্স? বিয়ে কী? আজকের দিনে, তার রেলিভেন্স কতটা ? বিয়ের হানিমুন ফেসে যেরকম প্রেম থাকে, আস্তে আস্তে সেটা কি শেষ হয়ে যায়? তারপর স্বামীর স্ত্রীর জীবন কি খুব মান্ডেন হয়ে যায়? আর তাই জন্য কি সম্পর্কটাকে 'স্পাইস আপ' করতে হয়? শ্লীলতা কী, অশ্লীলতাই বা কী? মানুষের চরিত্রের পরিবর্তন ঠিক কখন, কবে, কিভাবে হয়? এরকম আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর লেখক দিয়েছেন তার এই বইয়ে।
গুহবাবুর মত এত মারাত্মক সুন্দর লিরিক্যাল প্রোস আমি বাংলা সাহিত্যে খুব একটা দেখিনা। সে সিমিলি হোক বা মেটাফোর, সবেরই দারুণ ব্যবহার। প্রকৃতির এত সুন্দর বর্ণনা, সাথে শিকারের নৃশংসতা। উপন্যাসে একটা খুব সাধারণ দৃশ্য বারবার সামনে আসে। পৃথুর পাশের বাড়ির কালো আয়া তার সাদা আলসেশিয়ান কুকুরটাকে নিয়ে প্রতিদিন বাইরে বেরোয়। এখানে আয়া ও কুকুরের গায়ের রঙের তফাৎ লেখক দেখিয়েছেন। এটা রূপক। কীসের রূপক সেটা বলা আমার অন্যায় হবে। কিছুটা পাঠকের উপরেও ছেড়ে দেই, যারা এখনো পড়েনি। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় মানুষের চরিত্র আর অবস্থা বোঝাতে পশুকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
বুদ্ধদেব গুহ তাঁর ছোটগল্পতেও বাঙালিয়ানার সাথে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুগামিতার সংঘাত দেখিয়েছেন। এখানেও সেটা স্পষ্ট। এছাড়া উপন্যাসের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ধর্ম, রিলিজিয়ান, মাযহাব। হিন্দু, মুসলিম, ক্রিস্টিয়ান বিভিন্ন বিশ্বাসের চরিত্রই উপন্যাস রয়েছে আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেখক তাদের মতবাদের দর্শন আমাদের সামনে আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমে পারদর্শিতার সাথে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
উপন্যাসটি ৬৩২ পৃষ্ঠার। অর্থাৎ বেশ বড় কলেবরের কাহিনী। প্রথম ৩০০ পৃষ্ঠায় আমার উৎসাহের গ্রাফ ছিল হাফ ডুপ্লেক্স এর মত। কিন্তু পৃথুর হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকে উৎসাহটা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে। অর্থাৎ লেখা অনেক বেশি গ্রিপিং হয়ে যায়। অলস ওয়েল দ্যাট এন্ডস ওয়েল !
এইবার এই স্টার দেওয়া অংশটায় চরিত্রগুলো নিয়ে detailed কথা আছে যা স্পয়লার হতে পারে, যারা বইটা এখনো পড়েননি, তারা স্কিপ করে গিয়ে আবার স্টার এর পর থেকে পড়তে পারেন, যদিও বিশেষ স্পয়লার না:
********************************"**********" আপাতদৃষ্টিতে উপন্যাসের অনেকগুলো চরিত্রকেই সিধাসাধা দোষমুক্ত মনে হলেও, ভুলটা ভাঙে গল্পের শেষে গিয়ে। তখন আমরা দেখতে পাই যে, কাহিনীর প্রথম থেকে আমরা যাদের ভালো মানুষ বলে ভেবে আসছি, তাদের কেউই সেরকম ভালো নয়। অর্থাৎ উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই গ্রে শেডের। কেবল একটি মাত্র শুদ্ধ চরিত্র যদি কেউ থেকে থাকে, তবে সে হল শ্রীরামভক্ত দিগা পাড়ে, যে ক্ষণে ক্ষণে তুলসীদাস আওড়ায়। বাকি সবারই পা পিছলায় কোনো না কোনো সময়।
বুদ্ধদেব বসুর রাতভর বৃষ্টি পড়ার সময় যে দ্বন্দ্বে পড়তে হয়, এই উপন্যাসেও সেই একই জিনিস ঘটে। অর্থাৎ দোষটা আসলে কার? পৃথুর নাকি রুষার? রুষার দোষ থাকলেও পৃথুও তো ধোয়া তুলসী পাতা নয়। পৃথুর বিবাহিত জীবন ধ্বংস হওয়ার পিছনে আসল হাত কার? তার নিজের উদাসীনতা আর কিছুটা আলসেমি নয় কি? রুষা কি তার ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতেই চলে যায় অন্য কারো কাছে? এসব মনে হতে থাকে পুরো উপন্যাস জুড়ে।
দোষটা আসলে কার সেটার উত্তর মেলে একদম শেষে গিয়ে, যখন জানতে পারি, রুষা বিভিন্ন সময় সমাজের একাধিক উচ্চস্তরের মানুষের সাথে শারীরিক মিলন করেছে শুধুমাত্র তার ইগো বুস্ট আর এনজয়মেন্টের জন্য। সে নাকি জীবনে চেয়েছে কিছু স্পাইস যেটা বিবাহিত জীবনে পাওয়া যায়না। আর এসবের জন্য তার বিন্দুমাত্র কোন অনুশোচনা হয় না। সে জানে সে ভুল করেছে কিন্তু সেই ভুলটাকে আবার স্বীকারও করতে চায় না। জ্ঞানপাপী। রুষার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অহংকার। নারসিসিস্মের পিকে বসে রয়েছে সে। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম নারী চরিত্রের মধ্যে একটি। এই চরিত্রের প্রতি একরাশ ঘৃণা ছাড়া শেষমেষ আর কিছুই বেঁচে থাকেনা। *******************************************
পৃথুর মনে তার ছোটবেলার প্রেম কুর্চির প্রতি টান থাকলেও মোরালিটি দিয়ে সে তাকে আটকে রাখে। কিন্তু একদিন রুষার অভাবনীয় বাজে আচরণে মন ভেঙে যায় তার, আর তখনই সে যায় বিজলির কাছে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে কুর্চির প্রতি ভালোবাসা। বিতর্কিত মন্তব্য লাগলেও, ভালোবাসায় রুষাকে হারিয়ে দেয় বিজলি। সে সৎ, সে জানে তার পক্ষে কখনও পৃথুকে পাওয়া সম্ভব নয়, তবুও সে ভালোবেসে যায়। পৃথুর সবচেয়ে বড় দোষ তার প্রথম জীবনের কাপুরুষতা। সে যদি নিজের বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ভালবাসার মানুষকে বিয়ে করত, তবে তার জীবন অন্য রকম হতে পারত। এতগুলো জীবন নষ্ট হতো না ।
কুর্চির চরিত্রও বেশ ভালো, কিন্তু তার স্বামীর এই কুপরিণতির জন্য সেও কি দায়ী নয়? হয়ত, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দায়ী পৃথু, যেটা আগের প্যারায় ব্যক্ত করলাম।
উপন্যাসে এত এত সুন্দর ও গভীর লাইন রয়েছে, যা সত্যি মনকে ছুঁয়ে যায় কিন্তু সেসব লিখতে বসলে রিভিউ আরো বড় হয়ে যাবে। তাই এটুকুই থাক।
সবশেষে যেই চরিত্রগুলো আমার ভালো লেগেছে - পৃথু, বিজলি, কুর্চি, দিগা পাড়ে, টুসু আর পৃথুর বস।
উপন্যাসের নাম "মাধুকরী" কেন সেটা লেখক নিজেই একদম শেষে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন।
প্রেম ও হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে শরৎ পরবর্তী যুগে, বাংলা সাহিত্যে এ এক সেরা কাজ - মাধুকরী সত্যি অসাধারণ।
বুদ্ধদেব গুহর সুদীর্ঘ এবং বিতর্কিত উপন্যাস। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন একবিংশ শতাব্দীর নারী ও পুরুষের জন্য। বইটিতে দুইটি ভিন্ন মননের মধ্যকার দ্বন্দ্ব দেখানো হয়েছে। এক শ্রেণী প্রতিনিধিত্ব করছে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক,বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় শিক্ষিত, আত্মনির্ভরশীল ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন শ্রেণী অপরদিকে রয়েছে পুরনো মন মানসিকতায় রয়ে যাওয়া প্রকৃতীপ্রেমী সহজ সরল মনের শ্রেণী। একবিংশ শতাব্দীর এই যুগে এই দুয়ের মধ্যকার পারস্পরিক সংঘর্ষ যে অনিবার্য এবং তার ফলশ্রুতিতে সামাজিক জীবনে কিরূপ প্রভাব পড়ে তা ফুটে উঠেছে রুষা-পৃথুর জীবনে। লেখক শিকারী হবার কারনে বইটিতে প্রায়সময়ই মধ্যপ্রদেশের অরণ্য, পশুপাখির সুন্দর বর্ণনা প্রায় সময়ই সুবিস্তারে প্রকাশ পেয়েছে।
বইটিতে খুব সুন্দর সুন্দর উপমার ব্যবহার করা হয়েছে যা আমাকে যথেষ্টই আনন্দ দিয়েছে। বইটির লেখনীতে এবং কাহিনীর বর্ণনার প্রায়সে লেখক প্রায় প্রাপ্তবয়স্ক সম্পর্কিত ভাষার ব্যবহার করেছেন যা কিনা অনেক পাঠকের রুচিতে আঘাত হানতে বাধ্য। তাই বলা যেতে পারে বইটি আসলে সবার জন্য নয়।
বইটিকে আমি 3 star দিচ্ছি বইটিতে উল্লেখিত কিছু অসাধারণ উপমা এবং মাঝে মধ্যে হাজির হওয়া কিছু Twist এর কারণে। এছাড়া বইটিতে আকর্ষণের মত কিছুই অন্তত আমার চোখে পড়েনি।