What do you think?
Rate this book


80 pages, Hardcover
First published January 1, 1960
এই বইয়ের কাহিনী নির্যাস বেশ সংক্ষিপ্তই। শিল্পী জাহেদ করাচীর এক আর্ট এক্সজিবিশানে অংশগ্রহন করেছিল যেখানে তারই আঁকা তৈলচিত্র ‘মাদার আর্থ’ বা ‘বসুন্ধরা’ প্রথম পুরষ্কারটি অর্জন করে। কিন্তু এই ছবি, শিশু কোলে এক বিভোর মাতৃমূর্তির এই ছবির অনুপ্রেরনা যে আরেক ‘ছবি’! সে ‘ছবি’ এক রক্ত মাংসের মানুষী, জাহেদের সহধর্মিনী। শিল্পী জাহেদের জীবনে ছবির প্রবেশ ও তার অনুষঙ্গ ধরে অন্যান্য কাহিনী নিয়েই এই উপন্যাস।
উপন্যাসে লেখকের ভাষার ব্যাবহার ভাল, প্রকৃতি বর্ননায় তিনি বিশেষ পারঙ্গম কিন্তু দুঃখের কথা কোন বর্ননাই কোন আশ্চর্য হয়ে ধরা দেয় না, কোন কথোপকথন চাবুকের মত আছড়ে পড়ে না পাঠকের মনে। উপন্যাসের এই নির্লিপ্ততার কারন লেখকের কোন প্রকার ছক ভাঙতে চাওয়ার অনীহায়; লেখকের তথা জাহেদের সর্বদা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অনুশাসনের গন্ডির মধ্যে থাকতে চাওয়ার প্রবল আপ্রান প্রয়াসে! এই রচনায় সচেতন ভাবেই হোক বা অবচেতন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েই হোক, পুরুষ-তান্ত্রিকতার ছায়া পড়েছে সর্বত্র।
যে সব দন্দ্ব-মূলক ভাবনা এই পাঠ থেকে মনে উঠে এল, তাদের মধ্যে প্রথমটি হল শিল্পীর আত্মপ্রকৃতি সম্বন্ধীয়। শিল্পীরা কেমন হন? শিল্পী মানেই কি উদ্দাম, বেপরোয়া জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হতে হবে; মুজতবা, মুজিব, আমেদ ও রায়হানের মত? না কি শিল্পী মানেই ছেড়া শার্টে, অ-ছাটা চুলে, নোংরা জামা-কাপড়ে আবৃত কেউ হবেন, ছবির দাদা জামিলের মত? প্রকৃত শিল্পী কি আদপেই ধোপদুরস্ত, ভদ্র আময়িক হতে পারেন না! প্রথমটি নিশ্চিত ভাবে শিল্পীদের চারিত্রিক ও দ্বিতীয়টি শিল্পীদের আর্থিক ভাবে ‘ক্লাসিফায়েড’ করার আমাদের চিরকালীন পদ্ধতি। বিশেষত দ্বিতীয়টি, সফল এবং বিফল শিল্পীদের এই যে চিত্রায়ন পদ্ধতি, এটা আমরা বারংবার দেখে আসছি, প্রায় সকল ভাষার সাহিত্যেই! এখন তো মনেই হয় যে প্রকৃত শিল্পী কমার্শিয়াল শিল্প করেন না; অপরপক্ষে একজন ধোপদুরস্ত সফল শিল্পী নিশ্চই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা প্রতিক্রিয়াশীল, বুর্জোয়া, কমার্শিয়াল শিল্পী! এই মনে হওয়ার মানে, কিছু জীবিকার সাথে অবচেতনেই আমরা কিছু কিছু ছবি জড়িয়ে নিয়েছি এবং আমরা সেই ক্লিশে থেকে বেরতে পারছি না।
দ্বিতীয় ভাবনাটি লেখক তথা শিল্পী জাহেদের চেতনে-অবচেতনে পুরুষ-তান্ত্রিক সমাজের প্রভাব সম্মন্ধীয় যেটি বারবার তার ছাপ রেখেছে এই উপন্যাসে। জাহিদের সাথে প্রথম পরিচয়ে ছবি ধরা দেয় এক লাজুক, নতমুখী ও মিতভাষী মেয়ের রূপে। ছবির এই সমস্ত গুণ এবং অবশ্যই ছবির নিটোল শরীর, নিশ্চিতভাবে একজন পুরুষের কাছে লোভনীয় এবং স্বাভাবিক ভাবেই জাহেদ ছবির প্রেমে পড়তে দেরী করে না! সত্যি কথা বলতে, পুরুষ এমন নম্র মেয়েকেই কিন্তু পচ্ছন্দ করে; আমরা খুব কম পুরুষই আছি যারা কোন তেজী, স্পষ্টভাষী মেয়েকে পচ্ছন্দ করি! কিন্তু কেন? কারন কি এই যে আমরা, পুরুষেরা, নারীকে চেয়েছি আমাদের পাশে নয়, চেয়েছি আমাদের ঘরের কোনে, চেয়েছি আমাদের শুভ্র বিছানায়, নারীকে চেয়েছি আমাদের খাচায় আটকা পোষা ময়না পাখির রূপে! হাজার হোক সহিংস বাঘিনীর চেয়ে নম্র বিড়ালিনী পুষতেই তো বেশী আনন্দ! আমার মতে, মেয়েদের উপর সার্বিক ভাবে এই অতীব কোমল হওয়ার দায় সেই দিন থেকে বর্তায় যেদিন গোষ্ঠীযুদ্ধের ফল স্বরূপ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ কে পরাজিত করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বর্তমান এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। শিল্পী জাহেদ তো এই পিতৃতন্ত্রেরই উৎপন্ন ফসল, তাই স্বাভাবিক ভাবেই তার চরিত্র কোন অংশেই ব্যাতক্রমী নয়।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ-শিক্ষার এক নিষ্করুন উদাহরন প্রকাশিত হয় জাহেদের একপেশে ইচ্ছের মধ্যে দিয়ে যখন জাহেদ বিনা অনুমতিতে ছবি কে জড়িয়ে ধরে! এমন কি জাহেদ ছবির নিটোল শরীর দেখে, তার উন্নত স্তন যুগল দেখে মনে করে যে নারী শরীরকে “নিপীড়িত লুন্ঠন করাই প্রত্যেক পুরুষের ধর্ম!” এমন কি বাসর রাতেও জাহেদ মনে করে যে স্ত্রীর সম্মতি নয়, তার দৈহিক ‘বাধা’ কে জয় করাই পুরুষের কাজ! তাই যদি হয় তবে তাহলে জাহেদের ধর্ম ওই পুরুষ, যে অতীতে ছবিকে ধর্ষন করেছিল তার চেয়ে আলাদা কিসে? এমন কি মুজতবা যে প্রেমের আশ্বাস দিয়ে তিনা নামক মেয়েটিকে ভোগ করেছল তারই বা ধর্ম কিসে আলাদা? এরা সকলেই তো মনে করেছে যে নারীকে লুন্ঠন করাই পুরুষের চরম পালনীয় ধর্ম!
আর, ঠিক এই প্রশ্নেই লেখক এক দারুন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন, তিনি জাহেদ কে আলাদা করার চেষ্টা করেছেন অন্যদিক দিয়ে। হ্যা, বিয়ে নামক একটি সামাজিক প্রাতষ্ঠানিক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে! স্যুট-টাই পরিহিত জনৈক ধর্ষক মার্চেন্ট, মুজতবা এবং জাহেদ, এরা সকলেই নারীকে ভোগ করতে চেয়েছে কিন্তু শুধু শেষোক্ত জনই তার নারীকে বিবাহ করেছে। যেন বিয়ে করলেই একজন পুরুষ তার নারী-ভোগের ইচ্ছেটাকে একটি সম্মান জনক রূপ দিয়ে ফেলতে পারবে! যেন বিবাহিতা হওয়াটাই একজন নারীর পক্ষে হাসিল করা সর্বোচ্চ সামাজিক সম্মান! আদতে এই ভাবনার ফলশ্রুতি হিসেবেই নারীর বেচে থাকার উপায় হয়ে দাঁড়ায় মাত্র দুটি; হয়, নারী তুমি আমার বিবাহিতা হও, না হলে তুমি রাধারানির মত বেশ্যা হও! এখন নিঃসন্দেহে, যেহেতু নারীর কাছে বিবাহিতা হওয়ার মধ্যে সম্মান অনেক বেশী, এই সুযোগে বিবাহ নামক রীতির মধ্যে দিয়ে নারীর সম্মান, তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের প্রসঙ্গটিকে বিলকুল ধামাচাপা দেওয়ার সুযোগও পুরুষের বেশী। আমাদের সমাজে বিবাহ যে নারী-সম্মানের পরাকাষ্ঠা, তার বাস্তবিক উদাহরন দেখা যায় হামেশাই, যখন আদালতে বিচারক ধর্ষকদের প্রস্তাব দেন ধর্ষিতাকে বিয়ে করার। তবে হ্যা, এই বইতে পুরুষ কে নারী লুন্ঠনের অনুমতি দিয়েও লেখক শেষ পর্যন্ত তাকে হুশিয়ারিও দিয়েছেন। শেষে দেখিয়েছেন যে নম্র কোমল নারীকে দলিত করলে মুজতবার মত পরিনতিও হতে পারে! অতএব সাধু সাবধান!
যাই হোক, জাহেদের এই অসাধারণ পুরুষালি মানসিকতার উদাহরন ছড়িয়ে আছে সমস্ত বই জুড়ে। ছবি কে বিয়ে করে তাকে নারীত্বের সর্বোচ্চ শিখরে উন্নিত করা, অভিজ্ঞ ডাক্তারের মত ছবির শরীর দেখেই তার অতীত বুঝে ফেলা, সেই অতীত কে আবার ‘ক্ষমা-ঘেন্না’ করে দেওয়া, শেষে ছবিকে মাতৃত্ব দিয়ে নারীত্বের একমাত্র অভিষ্ঠা পূরনে ব্রতী হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন কি এই উপন্যাসের নাম-স্বরূপ ‘তেইশ নম্বরের তৈলচিত্র’ও কিন্তু আসলে আখেরে উদযাপন করছে এই মাতৃত্বের ছবিই, অন্য ভাষায় যা আসলে পুরুষের বংশ-বিস্তারের ছবি। জাহেদের পাশাপাশি, ছবিও কিন্তু অপরপক্ষে লেখকের হাত ধরে এই আদর্শ নারীর নাম-ভূমিকায় দারুন অভিনয় করেছে। স্বামীকে ভালবাসাই যে নারীর সবচেয়ে বড় কাজ, সন্তান ধারনেই যে নারীর জীবনের সকল মোক্ষ হাসিল, এসব উদাহরন ছবি ভয়ঙ্কর সুপষ্ট ভাবে পাঠক-পাঠিকাদের সামনে তুলে ধরেছে! স্বাভাবিক ভাবেই, নারীর এমন নিটোল, কোমল, শান্ত অবয়ব (যা পুরুষ কে হয়ত তার অবচেতনে মায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়) আর কেউ না হোক, একজন পুরুষ পাঠককে খুশী করবেই করবে।
আমি, তাই, একজন পুরুষ হিসেবে এই উপন্যাস পড়ে বেশ আনন্দই পেয়েছি কিন্তু আমি, মানুষ হিসেবে, এই বই পড়ে শুধু যে ভীষণ হতাশ তাইই নয়, আমি বেশ দুর্ভাবনায়ও পড়েছি। নারীকে আমি কি চোখে দেখি? আমি কি মানুষ, না কি নিছকই পুরুষ?
শেষ কথাঃ বর্তমান এই উপন্যাস দেখা যাচ্ছে মাঘ, ১৪০০ বঙ্গাব্দে দশম বার মুদ্রায়িত হচ্ছে! খুব কাটতি এই বইয়ের নিশ্চই। এই বইয়ের সুত্রে আমার আরেকটি দারুন (!!) বইয়ের কথা মনে পড়ছে, সেটিও বহুবার মুদ্রিত হয়েছে! সেটি হল কাসেম বিন আবু বকরের বিখ্যাত ‘ফুটন্ত গোলাপ’, আমি যার ১০ পৃষ্ঠা পড়েই ক্ষান্ত দিয়েছিলাম! পিতৃতন্ত্রের মন্ত্র আওড়ানো এই বই গুলি যখন এই শতাব্দিতেও রমরমিয়ে চলছে, তখন বুঝতে হবে নারীর প্রতি আমাদের, পুরুষের এই ক্ষমা-মিশ্রিত, উচ্চাসীন, ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আসলে কিছুই পরিবর্তন হয় নি। মানুষ, আদতে যে গুহাবাসী জানোয়ার ছিল, এখনও তাই আছে, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে।