What do you think?
Rate this book


350 pages, Hardcover
First published February 1, 2009
ভিয়েতনাম যুদ্ধের নানা ডকুমেন্টারি তখন দেখানো হয় পাকিস্তান আর্মিদের। আমেরিকান সেনাদের ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রস্তুতি সেসব ডকুমেন্টারির বিষয়। একদিন তাহের আর আনোয়ার ওরকম একটা ডকুমেন্টারি দেখছেন। ছবিতে দেখানো হচ্ছে আমেরিকান সৈন্যরা বাঁশের সাহায্য নিয়ে বিশেষ কায়দায় একটা খুব উঁচু দেয়াল পার হচ্ছে। তাহের হঠাৎ বেশ উত্তেজিত হয়ে পাশে বসা আনোয়ারকে বলেন : দারুণ, আমরাও তো ট্রাই করে দেখতে পারি।
আনোয়ার বলেন : কিন্তু খুব রিস্কি হবে স্যার। ক্ষেপে যান তাহের : মাই ব্লাডি ফুট। রিস্কি শব্দটা কমান্ডোদের অভিধানে আছে নাকি? এই রোববারই আমি আটক ফোর্টের দেয়াল ওভাবে পার হবো। রেপেলিং করার জায়গায় ওটা করব আমি।
আনোয়ার চমকে ওঠেন : কিন্তু আমেরিকানরা যে দেয়ালটা পার হচ্ছে ওটা স্যার ম্যাক্সিমাম বিশ/ত্রিশ ফুট উঁচু হবে। আর আটক ফোর্টের ওয়াল তো এক শ বিশ ফুট। আপনি কি ঠাট্টা করছেন স্যার?
তাহের : শাট আপ। এটা কোনো ঠাট্টার ব্যাপার না। আই এম গোয়িং টু ডু ইট। এ বেটাদের দেখিয়ে দেব বাঙালি অফিসাররা কি করতে পারে।
পরদিন ইউনিটে টি ব্রেকের সময় তাহের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান সবাইকে। ইউনিটের চিফ কমান্ডিং অফিসার কর্নেল সোলেমান আপত্তি করেন ব্যাপারটায়। অন্য অফিসাররাও ব্যাপারটাকে একটা পাগলামি মনে করেন। কিন্তু তাহের তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। কর্নেল সোলেমান তাহেরকে স্নেহ করেন। শেষে কর্নেল সোলেমান রাজি হন এবং সবাইকে পরের রোববার রেপেলিং এরিয়ার আসতে অর্ডার দেন। সব অফিসার বলাবলি করতে থাকে, ছুটির দিনটাই মাটি।
অফিসে ফিরে আনোয়ার তাহেরকে জিজ্ঞাসা করে : কিন্তু স্যার অত উঁচু বাঁশ পাবেন কোথায়?
তাহের : কেন ছোট ছোট বাঁশের টুকরা জোড়া দিয়ে।
আনোয়ার : কিন্তু স্যার জোড়া দেওয়া জিনিস কি আর আস্ত বাঁশের মতো
শক্ত হবে?
তাহের : সেটা আমি ম্যানেজ করব।
রোববার সকাল। সব অফিসার আটক ফোর্টের রেপেলিং করার জায়গায়। হাজির। দুর্গের দেয়ালের একটা জায়গা একটু বাঁক খেয়ে খাড়া কোনাকুনি গোল হয়ে উপরে উঠে গেছে। একটার সঙ্গে আরেকটা জোড়া দিয়ে একশ বিশ ফুট উঁচু একটা বাঁশ তৈরি করেছেন তাহের। তাহের দুই হাতে বাঁশের উপরের কোণাটি ধরেন এবং দশ জন বেশ ভাগরা সিপাই বাঁশটাকে খাড়া দেয়ালের কোনাকুনি বরাবর ঠেলে একটু একটু করে উপরে উঠাতে থাকেন। তাহের দুই পা দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে অনেকটা হাঁটার ভঙ্গিতে দেয়াল বেয়ে উঠছেন। পঞ্চাশ ষাট ফুটের মতো উঠে গেছেন তাহের। নিচে রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে আছেন সব অফিসার। বুক ধড়ফড় করছে আনোয়ারের। বাঁশটা বেশ দুলছে, যে কোনো মুহূর্তে একটা মারাত্মক বিপদ ঘটতে পারে। নিচে দাঁড়ানো অফিসারদের মধ্যে আতঙ্ক। কিন্তু তাহের দেয়াল বেয়ে উঠতে উঠতে যে সিপাইরা বাঁশটা ঠেলছে তাদের বলছেন, দ্যাটস রাইট, ক্যারি অন হ্যাঁ এভাবেই বাঁশটাকে একটু একটু করে ঠেলতে থাকো।
সবাই নিরব। একসময় সবার বিস্মিত চোখের সামনে তাহের আটক ফোর্টের এক শ বিশ ফুট দেয়ালের উপর গিয়ে দাঁড়ান। উপরে দাড়িয়ে চিৎকার করে নিচে কর্নেল সোলেমানকে বলেন, স্যার এটা কোনো ব্যাপারই না। আপনি আরেকজনকে পাঠান 1
কর্নেল সোলেমান চারদিকে তাকান কিন্তু না কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। কর্নেল সোলেমান অন্যদের বলেন, তাহের যদি এটা পারে তোমাদেরও পারা উচিত। কিন্তু সবাই নিরুত্তর।
তাহের এবার পাকিস্তানি অফিসারদের হেয় করার মোক্ষম সুযোগটা নেন। তিনি বলেন: অল রাইট। একজন বাঙালি অফিসার যখন এটা পেরেছে আমার ধারণা আরেকজন বাঙালি অফিসার তা পারবে। আনোয়ার এবার তুমি চলে আস। ক্যাপ্টেন আনোয়ার একটু দ্বিধান্বিত থাকলেও তাহেরের ডাকের পর তার আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয় না। তিনি সোজা গিয়ে ঐ বাঁশটাকে ধরেন। মনের সব সাহস সঞ্চয় করে শুরু করেন উপরে উঠা। উপর থেকে তাহের চিৎকার করে আনোয়ারকে উৎসাহ দিতে থাকেন : ব্রাভো, এই তো আর একটু, কুইক।
আনোয়ার প্রায় আশি ফুটের মতো উঠেও যান। কিন্তু তখন হঠাৎ বাঁশটা দুলতে শুরু করে এবং ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করতে থাকে। বাঁশটা প্রায় ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হলে তাহের তাড়াতাড়ি আনোয়ারকে নেমে আসতে বলেন। নেমে যান আনোয়ার।
নিচে নামলে তাহের আনোয়ারকে বলেন : ব্লাডি হেল কমান্ডো, তোমার মতো একটা ভীতু অপদার্থের কমান্ডোতে যোগ দেয়াই উচিত হয়নি। নাউ পুশ অফ।
আনোয়ার মাথা নিচু করে চলে যেতে নিলে, পেছন থেকে ডাক দেন তাহের : কাম অন, ইটস অল রাইট। আমি তোমার বিপদটা টের পাচ্ছিলাম। একবার ইউজের কারণে বাঁশটা তো উইক হয়ে গিয়েছে, তাছাড়া তোমার ওয়েটও তো আমার চেয়ে বেশি। বাদ দাও চলো এবার বারে গিয়ে গলাটা একটু ভিজিয়ে আসি।**
[১১ নং সেক্টর কামালপুর পাকিস্তান ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাচ্ছে। কর্তা হলো সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের।]
যুদ্ধে, যুদ্ধে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে আসে।
সেকেন্ড লে. মিজান ওয়াকিটকিতে বলেনকর্তা, আমরা পাক বাঙ্কারের একেবারে কাছে চলে এসেছি। একটু পরেই এখন আমরা বাঙ্কারে সরাসরি চার্জ করতে যাচ্ছি।
এইটুকু বলার পর অনেকক্ষণ মিজানের আর কোনো কথা শোনা যায় না। উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন তাহের। ওয়াকিটকিতে বারবার চিৎকার করে : মিজান তুমি কোথায় কোথায় তুমি?
কিন্তু মিজানের কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। তাহের খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করে মিজানের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে তাহের বলেন : লেটস্ মুভ। আই মাস্ট গো ক্লোজার।
পেছনের কমান্ডিং বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন তাহের। ভারী মর্টার আর শেল চারদিকে। ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার [ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার] ওয়াকিটকিতে চেঁচিয়ে বলেন : হোয়াট আর ইউ ডুয়িং কর্তা? ইউ ক্যান্ট মুভ ফ্রম ইয়োর প্লেস। তাহের বলেন : আই মাস্ট ফাইন্ড লে. মিজান, ফ্রন্ট লাইন ফাইটার।
তাহের কমান্ড পোস্ট ছেড়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন। তার পারসোনাল সিকিউরিটিতে থাকা দুই ভাই বেলাল আর বাহারের স্কাউট টিমটিও এগিয়ে চলে সামনে। মিড রেঞ্জ বরাবর আসেন তাহের। সেখানে ভাই সাঈদ অবস্থান করছেন তার কোম্পানি নিয়ে। সাঈদ বলেন: আপনি আর সামনে যাইয়েন না। মিজান আগেও এরকম কয়েকবার কমিউনিকেশন মিস করছে। সুতরাং ভয়ের কিছু নেই।
কিন্তু তাহের কথা শোনেন না, এগিয়ে যেতে থাকেন ফ্রন্ট লাইনের দিকে। তিনি প্রথম সারির বাঙ্কারগুলো অতিক্রম করে যান, অতিক্রম করেন বানরোড। একটু এগিয়েই পেয়ে যান মিজানকে। তাহের বলেন: তুমি তো চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে।
ওয়াকিটকির যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছিলেন মিজান। তাহের বেলাল বাহারকে বলেন তাদের কোম্পানি নিয়ে সতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যেতে। দিগন্তে ভোরের আলো ফুটছে। তাহেরের হাতে কোনো আর্মস নেই। তার হাতে সর্বক্ষণিক সঙ্গী সেই গলফ স্টিক। তার আশে পাশে তার পারসোনাল সিকিউরিটির যোদ্ধাদের কারো কাছ থেকে প্রয়োজনে অস্ত্র নেবেন তাহের ব্যবস্থা তেমনই।
তাহের যখন এগোচ্ছেন পাশের আখক্ষেত থেকে এবং পেছনের বাঙ্কারগুলো থেকে তুমুল গুলিবর্ষণ হচ্ছে তখন। শত্রু সীমানার ভেতর ঢুকে গেছেন তাহের। একটা প্রবল উত্তেজনা তাকে ভর করে। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে তাহের হঠাৎ তার হাতের গল্ফ স্টিকটি ফেলে দিয়ে পাশে অবস্থান নেওয়া বেলালের কোম্পনির একজন যোদ্ধার কাছ থেকে চাইনিজ এসএমজিটি হাতে তুলে নিয়ে ফায়ার করতে শুরু করেন। বেলাল, বাহারকেও বলেন, তিনি যে রেঞ্জে ফায়ার করছেন ঠিক সে একই রেঞ্জে তারাও যেন ফায়ার করতে থাকে। বেড়ে যায় গোলাগুলির তীব্রতা। তাহেরকে এগিয়ে আসতে দেখে পেছন পেছন ভারতের মেজর এস আর সিংও একটা জীপে রিকুয়ারলেস রাইফেল নিয়ে এগিয়ে এসে খানিকটা দূরে অপেক্ষা করতে থাকেন। তাহের ইশারায় বেলালকে বলেন: এস আর সিংকে গিয়ে বলো আরও একটু সামনে এগিয়ে আসতে একটু পরেই আমি পাকিস্তানি বাঙ্কারে হিট করব আর এজন্য আমার রিকুয়ারলেস রাইফেল দরকার।
তাহের জানেন পাকিস্তানি বাঙ্কারের যে কংক্রিট সেগুলো শুধু রিকুয়ারলেস রাইফেল দিয়ে আঘাত করলেই ভেদ করা এগিয়ে আসেন মেজর সিং। তাহের তার কাছে থেকে রিকুয়ারলেস রাইফেল হাতে নিয়ে এগিয়ে যান এবং সরাসরি বাঙ্কারে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। পেছনের কমান্ডিং পজিশন ছেড়ে সেক্টর কমান্ডার তখন যুদ্ধের মধ্যবিন্দুতে। বেলাল, বাহার খানিকটা পেছনে একটা আম গাছের আড়ালে। তারা দেখতে পান পাকিস্তানিরা সামনের বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে পেছনের বাঙ্কারে। অনেকে ঢুকে যাচ্ছে পাশের আখক্ষেতে। বোঝা যাচ্ছে নিশ্চিতভাবে পিছু হটছে তারা। বেলাল, বাহার এবং তাহের এগোতে এগোতে পাকিস্তানি বাহিনীদের প্রথম বাঙ্কারটি দখল করে ফেলেন। উত্তেজিত বাহার ওয়াকিটকিতে সবাইকে জানিয়ে দেন তাদের প্রথম বাঙ্কার দখলের খবর। পাকিস্তান বাহিনীরা রিইনফোর্সমেন্টের জন্য ওদিকে বক্সিগঞ্জ থেকে সৈন্য পাঠায়। কিন্তু তাদের ঠেকিয়ে দেয় বক্সিবাজার সড়কে পজিশান নিয়ে থাকা মারাঠা রেজিমেন্টের অ্যামবুশ। যোগাযোগের পথ ধ্বংস হয়ে যাওয়াতে কামালপুর বক্সিবাজার থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে সেখান থেকে সাহায্য পাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায় পাকিস্তানিদের।
সকাল প্রায় সাতটা তখন। কামালপুরের অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেছে মুক্তিবাহিনী। তারা এগোচ্ছেন প্রচুর পাকবাহিনী এমনকি মুক্তিযোদ্ধার মৃতদেহ ডিঙিয়ে। ভয়াবহ গোলাগুলির মধ্যে পড়ে একই সাথে পাকবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধা উভয়ই নিহত হচ্ছে একের পর এক। দখল করে নেওয়া বাঙ্কারের সামনে উঁচু একটা ঢিবির মতো জায়গা দেখা যায়। ঢিপিটা বানানো হয়েছে বাঙ্কারের প্রতিরক্ষার জন্য। সেই উঁচু জায়গায় গিয়ে বসেন তাহের। উত্তেজনা, আত্মবিশ্বাস তার মধ্যে। আবার তিনি হাতে তুলে নিয়েছেন তার সেই গলাফ স্টিক। এক মুক্তিযোদ্ধা হঠাৎ দৌড়ে এসে পাকিস্তানিদের বাঙ্কার থেকে দখল করা একটি মেশিনগানের গুলির চেইন মালার মতো করে পরিয়ে দেয় তাহেরকে, বলে-শুভ জন্মদিন কর্তা।
সেদিন ১৪ই নভেম্বরের ভোর। তাহের মুচকি হেসে বলেন : জলদি পজিশনে ফিরে যাও।
পাকিস্তানিরা পাশের আখ ক্ষেতে লুকিয়ে অবিরাম ফায়ার করছে। তাহের উঁচু ঢিবিতে বসে তার গলফ স্টিক দিয়ে মিজান, বেলাল, বাহারের কোম্পানিকে নির্দেশনা দেন কোনো কোনো দিকে ফায়ার করতে হবে। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি জায়গায় তখন বসে আছেন তাহের। সামনে আরও ৭/৮ টি বাঙ্কার। সে বাঙ্কার গুলোও অচিরেই দখল করার পরিকল্পনায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে থাকেন তাহের।...
...উঁচু ঢিপিতে বসে থাকা তাহের নামতে উদ্যত হবার মুহূর্তেই সেখানে বস্তুত একটি শেল ড্রপ হয়। তাহেরের সবচেয়ে কাছে ছিলেন বেলাল আর বাহার। তারা তখন তার পারসোনাল সিকিউরিটির দায়িত্বে। তারা হঠাৎ দেখেন উঁচু ঢিপি থেকে ঢলে পড়ছেন তাহের।**
[কর্নেল তাহের তাঁর পা হারায়। মিসকমিউনিকেশনের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা মন�� করে সেক্টর কমান্ডার মারা গেছে। মনোবল হারায় সবাই। নিশ্চিত জিতে যাওয়া যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ হারায় যৌথবাহিনী। পিছু হটতে বাধ্য হয়।]