যখন হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হয়, তখন আমি দৈনিক বাংলার একজন সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। বইটি পড়ে আমার এত ভালো লেগেছিল যে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমি আমার কলামে সেই বইয়ের একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা করি। সেদিনই আমার মনে হয়েছিল, আমাদের কথাসাহিত্যে একজন নতুন কথাশিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছে। এরপর সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ অনেকগুলো উপন্যাস রচনা করেছেন এবং ইতোমধ্যে তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। জনপ্রিয়তা সম্পর্কে কারো কারো মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় এবং কেউ কেউ বাঁকা উক্তিও করে ফেলেন। কিন্তু দেখা গেছে, অনেক উৎকৃষ্ট রচনাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সস্তা চতুর্থশ্রেণীর লেখকদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তিনি, সন্দেহ নেই, বিশাল পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করেছেন, যা সাহিত্যের পক্ষে উপকারী। এ কথা বলতে আমার বিন্দু মাত্র দ্বিধা নেই যে, তিনি ভবিষ্যতে আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে কিংবদন্তির মর্যাদা পাবেন।
শামসুর রহমান দৈনিক জনকণ্ঠ ১৩ নভেম্বর ১৯৯৮
ভূমিকাঃ
মাসিক ‘মুখপত্রে’র প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় গল্পের নাম ‘নন্দিত নরকে’ দেখেই আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কেননা ঐ নামের মধ্যেই যেন একটি নতুন জীবনদৃষ্টি, একটি অভিনব রুচি, চেনতার একটি নতুন আকাশ উঁকি দিচ্ছিল। লেখক তো বটেই, তাঁর নামটিও ছিল আমার সম্পূর্ণ অপরিচিতি। তবু পড়তে শুরু করলাম ঐ নামের মোহেই। পড়ে আমি অভিভূত হলাম। গল্পে সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি একজন সূক্ষ্মদর্শী শিল্পীর; একজন কুশলী স্রষ্টার পাকা হাত। বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক সুনিপুণ শিল্পীর, এক দক্ষ রূপকারের এক প্রজ্ঞাবান দ্রষ্টার জন্মলগ্ন যেন অনুভব করলাম। জীবনের প্রাত্যহিকতার ও তুচ্ছতার মধ্যেই যে ভিন্নমুখী প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির জটাজটিল জীবনকাব্য তার মাধুর্য, তার ঐশ্বর্য, তার গ্লানি, তার দুর্বলতা, তার বঞ্চনা ও বিড়ম্বনা, তার শূন্যতার যন্ত্রণা ও আনন্দিত স্বপ্ন নিয়ে কলেবরে ও বৈচিত্র্যে স্ফীত হতে থাকে, এত অল্প বয়সেও লেখক তাঁর চিন্তা-চেতনায় তা ধারণ করতে পেরেছেন দেখে মুগ্ধ ও বিস্মিত। বিচিত্র বৈষয়িক ও বহুমুখী মানবিক সম্পর্কের মধ্যেই যে জীবনের সামগ্রিক স্বরূপ নিহিত, সে উপলব্ধিও লেখকের রয়েছে। তাই এ গল্পের ক্ষুদ্র পরিসরে অনেক মানুষের ভিড়, বহুজনের বিদ্যুৎ-দীপ্তি এবং খন্ড খন্ড চিত্রের সমাবেশ ঘটেছে। আপাতনিস্তরঙ্গ ঘরোয়া জীবনের বহুমুখী সম্পর্কের বর্ণালি কিন্তু অসংলগ্ন ও বিচিত্র আলেখ্যর মাধ্যমে লেখক বহুতে ঐক্যের সুষমা দান করেছেন। তাঁর দক্ষতা ঐ নৈপুণ্যেই নিহিত। বিড়ম্বিত জীবনে প্রীতি ও করুণার আশ্বাসই সম্বল। হুমায়ূন আহমেদ বয়সে তরুণ, মনে প্রাচীন দ্রষ্টা, মেজাজে জীবন-রসিক, স্বভাবে রূপদর্শী, যোগ্যতায় দক্ষ রূপকার। ভবিষ্যতে তিনি বিশিষ্ট জীবনশিল্পী হবেন-এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করব।
Humayun Ahmed (Bengali: হুমায়ূন আহমেদ; 13 November 1948 – 19 July 2012) was a Bangladeshi author, dramatist, screenwriter, playwright and filmmaker. He was the most famous and popular author, dramatist and filmmaker ever to grace the cultural world of Bangladesh since its independence in 1971. Dawn referred to him as the cultural legend of Bangladesh. Humayun started his journey to reach fame with the publication of his novel Nondito Noroke (In Blissful Hell) in 1972, which remains one of his most famous works. He wrote over 250 fiction and non-fiction books, all of which were bestsellers in Bangladesh, most of them were number one bestsellers of their respective years by a wide margin. In recognition to the works of Humayun, Times of India wrote, "Humayun was a custodian of the Bangladeshi literary culture whose contribution single-handedly shifted the capital of Bengali literature from Kolkata to Dhaka without any war or revolution." Ahmed's writing style was characterized as "Magic Realism." Sunil Gangopadhyay described him as the most popular writer in the Bengali language for a century and according to him, Ahmed was even more popular than Sarat Chandra Chattopadhyay. Ahmed's books have been the top sellers at the Ekushey Book Fair during every years of the 1990s and 2000s.
Early life: Humayun Ahmed was born in Mohongonj, Netrokona, but his village home is Kutubpur, Mymensingh, Bangladesh (then East Pakistan). His father, Faizur Rahman Ahmed, a police officer and writer, was killed by Pakistani military during the liberation war of Bangladesh in 1971, and his mother is Ayesha Foyez. Humayun's younger brother, Muhammed Zafar Iqbal, a university professor, is also a very popular author of mostly science fiction genre and Children's Literature. Another brother, Ahsan Habib, the editor of Unmad, a cartoon magazine, and one of the most famous Cartoonist in the country.
Education and Early Career: Ahmed went to schools in Sylhet, Comilla, Chittagong, Dinajpur and Bogra as his father lived in different places upon official assignment. Ahmed passed SSC exam from Bogra Zilla School in 1965. He stood second in the merit list in Rajshahi Education Board. He passed HSC exam from Dhaka College in 1967. He studied Chemistry in Dhaka University and earned BSc (Honors) and MSc with First Class distinction.
Upon graduation Ahmed joined Bangladesh Agricultural University as a lecturer. After six months he joined Dhaka University as a faculty of the Department of Chemistry. Later he attended North Dakota State University for his PhD studies. He grew his interest in Polymer Chemistry and earned his PhD in that subject. He returned to Bangladesh and resumed his teaching career in Dhaka University. In mid 1990s he left the faculty job to devote all his time to writing, playwright and film production.
Marriages and Personal Life: In 1973, Humayun Ahmed married Gultekin. They had three daughters — Nova, Sheela, Bipasha and one son — Nuhash. In 2003 Humayun divorced Gultekin and married Meher Afroj Shaon in 2005. From the second marriage he had two sons — Nishad and Ninit.
Death: In 2011 Ahmed had been diagnosed with colorectal cancer. He died on 19 July 2012 at 11.20 PM BST at Bellevue Hospital in New York City. He was buried in Nuhash Palli, his farm house.
কলেজ জীবনের পর প্রথমবারের মতো এই বইয়ের কাছে ফিরে এলাম। বেলজিয়ামের এক অজপাড়ায় যে দূরসম্পর্কের আপা থাকেন, তার বইয়ের তাকে গাদা গাদা হুমায়ুন দেখে ভেবেছিলাম এটাই চেয়ে পড়ি আবার - পরে হয়তো ডাকে ফেরত পাঠিয়ে দেবো। কুড়ি বছরের বেশি সময়কালে পড়া (বা পুনরায় পড়া) এটাই তাই প্রথম হুমায়ুন। পরিণত পাঠক হিসেবেও আবার আমার প্রথম হুমায়ুন।
পড়ে যা কিছু মনে হলো...
তার গদ্যে একরকম স্বপ্নময় শক্তি ছিল সন্দেহ নেই, আর অদ্ভুত এক টেকনিক.. কিভাবে যে এটা রপ্ত করেছিলেন, প্রথম বইয়েই কি করে এই কৌশলের এমন মোক্ষম প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন, সে এক রহস্য বটে। হয়তো কোথাও বলে গেছেন সে কথা, জানা নেই। কি ছিল এর মালমশলা? খোকার মুখে ছোট ছোট এপিসোডে কাহিনী এগোয়, অনেকটাই সিনেম্যাটিক গল্প বলার ধরণ.. তবে এপিসোডিক হলেও অনাবশ্যক ডিটেইল থাকবে না, গদ্যে কোন মেদ বা বাহুল্য নেই। অল্প কিছু মিনিমালিস্ট আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতে জানতেন নিম্নমধ্যবিত্তের একদা-জীবন। যে জীবনে হারিকেন আলোয় পড়াশোনা করতে হতো, টিভি ছিল না কারো ঘরে, মাত্র কয়েকশো টাকার বেতনে চলতো ৬-৭ জনের গোটা পরিবার। সেই পরিবার, সেই সমাজ, সেই শ্রেণী, তাদের মানস-মূল্যবোধ-লজ্জা-ভীতি-আনন্দ-গর্বের জগৎটা ছোট ছিল হয়তো, তবুও স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই বইয়ের কোথাও যেমন বহির্জগতের প্রতি বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই - কোন সাল বা কার আমল বোঝা যায় না, দেশে কোন রাজনীতির বিতর্ক চলছে, বিদেশে কোন যুদ্ধ বা বিপ্লব কাঁপিয়ে দিচ্ছে কিচ্ছু জানা যায় না, কিচ্ছু না.. যেন সমসাময়িক সময়ের থেকেও বেশ তফাতে, আপন কোন স্বপ্নসময়ে বিচরণ এই মানুষগুলোর।
কালকে উপেক্ষা করাও কি কালজয় করা নয়?
*
হুমায়ুন-খোকার গল্প-বলার কায়দা আগাগোড়া ইম্প্রেশনিস্টিক, কিন্তু প্রচন্ড কার্যকর। যেহেতু জর্জ সিমনোন পড়ে আসছি ছোটবেলা থেকেই, এই মিনিমালিস্ট, ইম্প্রেশনিস্ট কারিগরিটুকু ধরতে বেশি কষ্ট হয় না। তবে খুব ঝুঁকিও আছে এতে, সেটা সিমনোন বা হুমায়ুনের মতো জন্মগত ওস্তাদ না হলে যে কোন লেখক উষ্টা খেয়ে উল্টে পড়ে যেতে বাধ্য। কি লাগে এভাবে লিখতে? লেখার শক্তি, অসীম মমত্ববোধ আর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি তো নিশ্চয়ই - কিন্তু সর্বোপরি যা প্রয়োজন, তা হলো প্রচন্ড শৃঙ্খলা, পরিমিতি বোধ। সেটা না থাকলে এমন লিখে পার পাওয়া যায় না.. প্রতিটি অতিরিক্ত বাক্য বা দৃশ্য বা চরিত্র গল্পের আবেদনকে হালকা করে দিতে পারে, আপন গতিপথ থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারে। হুমায়ূনের বয়স তখন ২২-২৩ হলেও তিনি অবলীলায় এসব ফাঁদ এড়াতে জানতেন। প্রতিটি পাতায় সংযম, যেন এই অন্তর্গত গুণ নিয়েই ছাত্র হুমায়ুন মহসিন হলের রুমে লিখতে বসেছিলেন। যে সরীসৃপ-নির্লিপ্ততায় খোকা তার পরিবারের ধ্বংস হবার বর্ণনা করে যায় শেষ কয় পৃষ্ঠায়, নিরাবেগ জানায় রাবেয়ার চুপচাপ মৃত্যু, আর মাস্টার কাকার দিনেদুপুরে ফালাফালা খুন - এরপর তার তরুণ স্রষ্টার ইনস্টিংক্ট আর আত্মবিশ্বাসকে তারিফ না করে পারা যায়?
লেস ইজ মোর - বলে সবাই, করতে পারে খুব কম।
*
তার "সহজ সরল" স্টাইল সম্পর্কে ম্যালা বলা হয়ে গেছে, তাই সেই নিয়ে আরো বলার দরকার নেই... সাবলীল-স্বচ্ছন্দ-সম্মোহনী এমন নানা শব্দ ডেইলি এখনো হুমায়ুন-গদ্যকে বর্ণিত করে। তবে এই প্রথম উপন্যাস পড়ে আবার যেটা মনে হলো - এই স্টাইলকে একটা নীলু-বিলু ক্লিশে বানিয়ে ফেলার আগে, চার দশকের চর্বিত চর্বণ আবারো একই বোতলে পরিবেশন করার আগপর্যন্ত এখানে আসলেই কিছু একটা ছিল। নতুন একটা কিছু, মূল্যবান কিছু। ইংরেজিতে সারল্যকে "আর্টলেস" বলা চলে - হুমায়ূন তার গদ্যকে সযত্নে আর্টলেস রেখেই নিয়ে গেছিলেন হাই আর্টের পর্যায়ে, অন্তত এই মধ্যবিত্ত কাহিনীগুলোতে। এই লেখা পড়ে মনে হয় হিমশৈলের উপর দাঁড়িয়ে আছি - পানির উপরে ১০% দেখে-চেখে সন্তুষ্ট থাকা যায়, কিন্তু পৃষ্ঠের নীচে যে ৯০% লুকিয়ে আছে, সেখানেই নিম্নমধ্যবিত্তের নিরন্তর সংগ্রাম, করুণ কমেডি, অজেয় ট্র্যাজেডি।
সেখানেই সমস্ত মায়া... মানবজীবনের অকথ্য রহস্য। দৃশ্যমান পৃথিবী আর পঞ্চইন্দ্রিয়ের ধরাছোঁয়ার বাইরেও সেই জীবনানন্দময় প্রহেলিকা, বেঁচে থাকার অব্যক্ত অবর্ণনীয় হাহাকার। আজ অব্দি হুমায়ুন আহমেদের চেয়ে এই হাহাকার আর কে ভাল অনুভব করেছেন, খাতা কলমে বেঁধে ফেলতে পেরেছেন? প্রকাশের ঠিক ৫০ বছর পরেও যে কারণে নন্দিত নরকের রাবেয়া আর রুনু, খোকা আর মন্টু আর শীলু আর ইয়াসমিন আর পলার জীবনযন্ত্রণা আজও পাঠককে এমন অনায়াসে ধরাশায়ী করে দিতে পারে।
*
পুনশ্চ - পাঠককে (প্রায়-নগ্ন) ম্যানিপুলেশনের চর্চা হুমায়ুন সেই প্রথম উপন্যাস থেকেই করে আসছিলেন বোঝা যায়! যেমন মন্টুর পরিণতি ফিরে আসবে ২০ বছর পরে বাকের ভাইয়ের চরিত্রে, এমনকি ৭৮ সালে নির্মিত টেলিনাটকের জেলের দৃশ্যটিও "কোথাও কেউ নেই"-এর সাথে কত মিল? জেনে বুঝে নাকি অবচেতনে?
পুনশ্চ (২) - ইন্টারনেট, মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়া আর নিওলিবারেল বিশ্বায়নের আগে আমাদের জীবনযাত্রা আসলেই কেমন ছিল, সেটা জানতেও হুমায়ুন অপরিহার্য। মোক্ষম বলেছেন এই রিভিউয়ার।
আমার হুমায়ূন পড়া শুরু হয়েছিল সম্ভবত মিসির আলী আর হিমু দিয়ে, নব্বই দশকের শেষ দিকে। সে সময় তিনি ছাঁচে ফেলা রোমান্টিক উপন্যাস লেখেন, মাঝে মাঝে ২-১টা অন্যরকম ভাল বই-ও চলে আসে। কাজেই তখন পর্যন্ত আমার কাছে হুমায়ূন মানে একজন বিনোদনদায়ী লেখক, যিনি ভাল লেখেন কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থায়ী অবদান রাখার মত কিছু চোখে পড়ছে না। এরপর নন্দিত নরকে আর শঙ্খনীল কারাগার বই দু'টো মনে হয় কোন আত্মীয়ের বাসায় পেয়ে পড়ি। এই বই দু'টোর আগে আর পরে হুমায়ূনের যত বই পড়েছি, তার কোনটার সাথেই এই দু'টোর হুমায়ূনকে আমি আর কখনো মেলাতে পারিনি। এখনো আমি বিশ্বাস করি, হুমায়ূন যদি আর কোন বই না লিখে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মত মাত্র এই দু'টো উপন্যাসই লিখে যেতেন (ইলিয়াস ভক্তরা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন, কোথায় ইলিয়াসের মহাকাব্যিক চিলকোঠার সেপাই ও খোয়াবনামা, আর কোথায় প্রায় চটি বই সাইজের, নভেলা বলাই ভাল, হুমায়ূনের এই ২টা বই!), তাহলেও বাংলাদেশি সাহিত্যে (বাংলা আর বললাম না, দাদারা আমাদের লেখালেখিকে ঠিক জাতের মনে করেন না) হুমায়ূনের নাম স্থায়ীভাবে থেকে যেত, এবং বেশ উঁচু আসনেই থাকতো। নন্দিত নরকে, আমার মতে, যাকে বলে ট্রেন্ডসেটার। হমায়ূন এর পরেও নিম্ন মধ্যবিত্তদের নিয়ে অনেক উপন্যাস লিখেছেন, কিন্তু প্রথম পুরষের কথনে খুব সাধারণ বাক্যে নিম্নমধ্যবিত্তের বিষণ্নতা আর কষ্টের মহাসাগরকে কিভাবে আঁটানো যায়, নন্দিত নরকে আর শঙ্খনীল কারাগারের চেয়ে উত্তম কোন উদাহরণ আমি অন্তত দেখি না। নন্দিত নরকে এত ভয়াবহ বিষাদময় যে, অনুভূতির গভীরতা বেশি হলে, বা বিষণ্নতার রোগী হলে আমি এটা না পড়ারই পরামর্শ দেব। সত্যি বলতে কি, প্রথমবার পড়ার অনেক বছর পর আমি আরো একবার পড়েছি, এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ বস্তু আর ধরা যাবে না। পৃথিবীটা কষ্টের জায়গা, কিন্তু এত নির্মমভাবে সেটা মনের মাঝে না ঢোকালেও আমার চলবে। যারা পড়েননি, তাদের জন্য সতর্কতা, হাতের কাছে একদম হালকা কিছু রাখুন, নয়তো এই বিষাদের অতল সাগর থেকে উঠে আসা কঠিন। এরকম কিছুকে রেটিং করা কঠিন; যেহেতু পাঁচতারা সর্বোচ্চ, সেটাই দ��লাম।
নন্দিত নরকে- বইটি কী আগে পড়েছিলাম?? বোধহয় হ্যাঁ। একটা বয়সে হুমায়ূনের একগাদা বই পড়েছিলাম। বয়সটা হুমায়ূন বয়স ছিলো,ওনার বই পড়লাম-জানতাম কষ্ট পাবোই-তবুও নিয়ে পড়তাম। গল্পের ষোড়শীদের মতো আনমনে হতাম। "জীবনে একটা সময় আসে যখন তীব্র অনুভূতিতে সমস্ত আচ্ছন্ন হয়ে থাকে।"-আমার দেখি এখনো এই সময় চলে। নয়তো বই পড়ে প্রতিদিন পানি ফেলা নর্মাল কাজ নয়। আচ্ছা,হুমায়ূন স্যার স্কুলের ছেলেমেয়েগুলোকে ধুম করে বড় করে ফেলতেন কেনো? এইটুকুন বয়স,অথচ রাজ্যচালনার চিন্তার মতো একরাশ চিন্তা।
"তাঁর বুক পকেটে জেলারের চিঠি রয়েছে।সেটি দেখালেই তারা মন্টুকে আমাদের হাতে তুলে দেবেন।মন্টুকে আমরা ঘরে ফিরিয়ে নেব।ঘরে, যেখানে মা আজ সারারাত ধরে কোরান শরীফ পড়ছেন।"
খোকার পরিবারে আছে মা, বাবা, ছোট বোন রুনু, ভাই মন্টু আর বড় সমবয়সী বোন রাবেয়া! তবে রাবেয়া একটু আলাদা, মানসিক সমস্যা রয়েছে তার। তাদের বাড়িতেই থাকে তাদের বাবার ছোট বেলার বন্ধু শরীফ আকন্দ। রাবেয়ার এই অসুস্থতার সুযোগ নেয় কেউ। জঘন্য লালসা চরিতার্থ করে কেউ! কিছুদিন পরেই রাবেয়ার পরিবার জানতে পারে তা।ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় রাবেয়াকে, ডাক্তার বলেন রাবেয়া সন্তান সম্ভবা! খোকা আর তার মা রাবেয়ার থেকে জানতে চেষ্টা করেন এই সর্বনাশ কে করেছে।কিন্তু দুর্ভাগা রাবেয়া বুঝতেই পারে নি হয়তো। একদিন রাতে এবোরশান হয়ে যায় রাবেয়ার, আর সকালে চুপচাপ রাবেয়া এই নরকের দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। তখন মন্টু বাড়ি ছিল না। মন্টু বাড়িতে এসেই মাছ কাটার বটি দিয়ে বাড়ির সামনে হত্যা করে শরীফ আকন্দকে। পরে ওরা বুঝতে পারে রাবেয়ার সাথে এই পাপাচার কে করেছে! ফাঁসি হয়ে যায় মন্টুর। পিছে রয়ে যায় পরিবার আর প্রতিবেশীরা!!
নন্দিত নরক এ পৃথিবী! নন্দিত নরক!
This entire review has been hidden because of spoilers.
কিছু কিছু বই আছে যেগুলো এত আবেগময় যে,পড়ার পর বুকের মধ্য চিনচিন করে উঠে। নন্দিত নরকে,পড়ে কখন যে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেছে লক্ষ্য করে নি। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম বই এটি। এত সুন্দর আর আবেগময় এক উপন্যাস, না ভালোলেগে উপায় নাই। আমাদের সবার আবেগ-ভালোবাসা প্রকাশের ধরণ আলাদা। কেউ মুখে বলে প্রকাশ করে,কেউ গোপন রাখে।যারা গোপন রাখে তাদের ভালোবাসা অনেক সময় আমরা বুজতে পারি না। মন্টু, সারা উপন্যাসে তার উপস্থিতি কম কিন্তু তার চরিত্রটি অসাধারণ আর বলিষ্ঠ। কত রাবেয়া আমাদের সমাজে ঘুরে বেরাচ্ছে,তাদের জীবন টা হয়তো রাবেয়ার মত অকালে শেষ হয়ে যায় বা বেঁচে থাকে সমাজের লাথি ঘুসা খেয়ে।
"স্মৃতি সে সুখেরই হোক আর বেদনারই হোক - সবসময় করুণ।" হূমায়ুন আহমেদের প্রথম উপন্যাস। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী, স্বল্প দৈর্ঘ্যের উপন্যাস। এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে নেমে আসে হঠাৎ বিপর্যয় আর তাকে কেন্দ্র করেই পাল্টে যায় মানুষগুলোর জীবন। তারই হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। পড়তে পড়তেই বাকরুদ্ধ হয়ে আসে। সাধারণ উপন্যাসটি লেখকের গল্প বুননের গুণে অনায়াসেই অসাধারণ হয়ে ওঠে।
চলচ্চিত্র অনেক আগে দেখা ছিল। চলচ্চিত্র দেখার সময় যা কষ্ট পাওয়ার পাইছিলাম। গল্পটা যেহেতু জানতাম তাই এখন পড়ার সময় বেশি কষ্ট হয়নি।
হুমায়ূন আহমেদ যদি সময় নিয়ে তার অন্য বইগুলো লিখতেন তাহলে আজ তার এতো সমালোচনা হতো না। বড্ড তাড়াহুড়ো করে বেশিরভাগ উপন্যাস লিখেছিলেন বলেই আজ তার বেশিরভাগ উপন্যাস অখাদ্য।
ভাল আছো? বোকার মত প্রশ্ন, কিন্তু সব চিঠিতেই দেখি লেখা হয়, "আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় ভাল আছেন।" তাই মনে হল, তুমি বোধ হয় ভাল আছো।
কাল রাতে তোমাদের গল্পটা পড়ার পর অনেকক্ষণ জেগে ছিলাম, আমাদের গ্রামের কথা ভাবছিলাম। সেখানে তো এইরকম ঘটনা হামেশাই হত, এখনও হয়। শুধু গ্রাম কেন, শহরেও হয়; গলিখুঁচির ঘিঞ্জিতে সেইসব ভিক্টিমরা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
আমাদের গ্রামে নিম্নবিত্ত পরিবারদের অত পয়সা নেই যে তোমার মত লোকেদের কলকাতা এনে চিকিৎসা করাবে। যাদের রয়েছে, তারা আবার যেতে চায় না, বলে, "লোকে তো পাগল বলবে রে। আমাদের সবাইকে একঘরে করে দেবে।" তাই সেইসব লোকেদের এরা লুকিয়ে রাখে, ভেতরঘরে বা চিলেকোঠার টঙে, যাতে পরিবারের বাকিরা সদর্পে ঘুরে বেড়াতে পারে। তোমার মত লোকেরা রাস্তায় বেরুলে হয় করুণার পাত্র হয়, নয় টিটকিরির। তোমাদের মানুষ হিসাবে দেখতে যেন কষ্ট হয় আমাদের।
তোমার দাদা বলেছে, "মেয়েদের মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয় ছেলেদেরও আগে। তারা তাদের কচি চোখেও পৃথিবীর নোংরামি দেখতে পায়। সে নোংরামির বড় শিকার তারাই। তাই প্রকৃতি তাদের কাছে অন্ধকারের খবর পাঠায় অনেক আগেই।" এই কথাটা এত সত্যি কেন, রাবেয়া? সেই নোংরামির শিকার যে কেউ হতে পারে, যে কোন সময়, যে কারুর কাছ থেকে৷ ঘরে বাইরে সব জায়গায়, তোমরা নিরাপত্তা কাকে বলে, সেটা ভুলে গেছ।
আর কিছু বলার নেই, রাবেয়া। তোমার বুকটা আশা করি আর খালি খালি লাগছে না।
ইতি, নিমো
পুনশ্চঃ পলা আর মন্টু কেমন আছে, জানিও। কেন জানি মনে হল, তোমরা একসাথে রয়েছ।
হুমায়ূন আহমেদের লেখার সবচেয়ে বড় গুণ কী জানেন? তার লেখা কোনো বই শেষ করার পর অদ্ভুত বিষন্নতা ভর করে। আর কোনো কিছু পড়তে ইচ্ছা করে। এক মায়ার আবেশে জড়িয়ে তিনি গল্প লিখেন, আবেগের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আর এই মায়া আর আবেগে জড়িয়ে এক বিষন্ন সময়ের সাথে কথপোকথন হয়। তার থেকে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে হয় না।
“নন্দিত নরকে” হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিত প্রথম বই। আর প্রথম বইয়ে এমন ঘোরলাগা, মায়াময় লেখনশৈলী যে কাউকে অবাক করবে। হয়তো তখনই তিনি জানান দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যে রাজ করতে আসছেন একজন ‘বাদশাহ হুমায়ূন’।
গল্পটা একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের। হুমায়ূন আহমেদ তখন থেকেই পাঠকের মনস্তত্ত্ব নিয়ে ���েলা শুরু করেছেন। আমাদের সমাজের পাঠকশ্রেণীর মধ্যে অধিকাংশই মধ্যবিত্ত। তাই তিনি তার লেখায় এই মধ্যবিত্ত জীবনকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাতে পাঠক নিজেকে অনুভব করেছে। গল্পের সাথে জুড়ে গিয়েছে। মনে করেছে এই গল্পটা তার নিজের।
এই যেমন এই গল্পের মূল কুশীলব খোকা ও তার পরিবার। আমাদের গল্পের গল্পকথক খোকার আসল নাম লেখকের নামের সাথে মিল হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। খোকার দুই বোন — রুনু ও রাবেয়া। রাবেয়া খোকার এক বছরের বড়। আর রুনু সবে তেরো। রাবেয়ার মাথার ব্যামো আছে। সুস্থ নয় মেয়েটা। তাই তাকে নিয়ে বাসার সবার চিন্তার অন্ত নেই। একে তো পাগল, তার উপর টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। কখন যে কী হয়ে যায়!
খোকার আরেক বোন রুনুকে খোকা প্রচণ্ড ভালোবাসে। ছোটো বোনের জন্য তার ভীষণ মমতা। বয়ঃসন্ধিকালে পদার্পণ একজন মেয়েকে রুনুর মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছে তার মতো অগণিত মেয়ের মনোভাব। যে গোপনে কবিতা লেখে। একটা কবিতা লেখার খাতা পেলে খুশি হয়ে যায়। খুশি হতে বেশি কিছু লাগে না তারপর লেখা কবিতা লুকিয়ে রাখে ট্রাংকের গোপনে। কোনো নিষিদ্ধ কথপোকথনে লজ্জায় রাঙা হয়ে। মনের মধ্যে গোপনে লালন করে ভিন্ন অনুভূতি।
আর থাকে বাবা-মা। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের তিন ছেলেমেয়েকে সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া যায় না। তাদের আবদার মেটানো যায় না। আর্থিক অবস্থান বাঁধা প্রদান করে। তবুও মায়ের মন, ছেলেমেয়ের কিছু আবদার পূরণ করতে না পারলে চোখেমুখে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে, লেখক এমন এক অভিব্যক্তি যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন; নিজের লেখা প্রথম বইতে এমন চিত্র ফুটিয়ে তোলা সহজ কিছু নয়। এক কথায় দুর্দান্ত লেগেছে আমার কাছে।
তাছাড়া বাড়ির বড়ো ছেলে, যে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে চাকরির বাজারে নামবেন; তার প্রতি মধ্যবিত্ত পরিবারের গুরুত্ব অনেক বেশি। খোকা চাকরি করবে। স্বপ্ন দেখে বাবা-মায়ের কষ্ট এতে কমবে। রুনুর জন্য শাড়ি কিন দিবে। রাবেয়াকে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করবে, এরপর ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিবে। মধ্যবিত্ত স্বপ্নে সুখের দিনের দেখা পাওয়া যাবে। দুচোখে অপার স্বপ্ন নিয়ে জীবনের লড়াই চালিয়ে যাওয়া-ই মধ্যবিত্ত জীবনের রূপরেখা।
নন্দিত এ পৃথিবীতে অনেকেই নরক যন্ত্রণা ভোগ করে। কেউ শারীরিক অসুস্থতার কারণে, কেউ মানসিক সমস্যা জন্য, কেউ আবার নীরবে ভালোবেসে। ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবন্ধকতা হলেও, পরিণতি একই।
এই গল্পে থাকা দুইজন চরিত্রের কথা বলা হয়নি। একজন মাস্টার কাকা, আরেকজন মন্টু। মন্টু খোকাদের কাজিন। গল্পের শেষভাগে এসেছিল। তীব্র রাগী এই ছেলেটা যে অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছিল, তার ফল তাকে ভোগ করতে হয়েছে। আর মাস্টার কাকা ছিলেন খোকাদের শ্রদ্ধাভাজন। কিন্তু সেই শ্রদ্ধা শেষে ছিল কি না, সে প্রশ্ন থেকে যায়। হুমায়ূন আহমেদের এই দিকটা আরও বেশি তারিফের যোগ্য। তিনি পুরো ব্যাখ্যা দেননি, কী ঘটেছে বর্ণনার আশ্রয় নেননি; গল্পের গতিপ্রকৃতি বুঝিয়ে দিয়েছে আসলে কী ঘটেছে। এর পরিণতি কী হয়েছে। মানুষের অবস্থান বর্ণনার মধ্য দিয়ে চরিত্রের অনুভূতি, গল্পের ধারা ফুটিয়ে তোলার গুণ সবার থাকে না।
সমাজের অনেকগুলো দিক লেখক বইতে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক কেমন হতে পারে, মায়া মমতার এক অদ্ভুত বাঁধনে সবাই বাঁধা পড়ে। নীরব ভালোবাসার গল্প হয়, যা হয়তো প্রকাশ করা যায় না। এই সমাজ অনেকের জন্য নরক। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য। আর যদি মানসিক অসুস্থতা থাকে, স্বাভাবিক বিষয় বুঝতে না পারে! তার জন্য আরও বেশি হয়ে উঠতে পারে। রাবেয়া যে এর শিকার। পরিণতিটা মেনে নেওয়ার মতো না। ভীষণ কষ্ট দিয়ে যায় এই গল্পের গতিপথ।
হুমায়ূন আহমেদ নিজের প্রকাশিত প্রথম বই থেকেই পাঠকের অনুভূতি নিয়ে খেলার চেষ্টা করেছেন। ভীষণ মন খারাপের গল্প লিখেছেন, দুঃখের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। যেন তিনি বলতে চেয়েছেন, খেলা তো সবে শুরু। আরও কত দুঃখ দেওয়া বাকি! বিষন্ন এই গল্পের মধ্যে পাঠক খুঁজে নিতে পারে পারিবারিক বা সামাজিক বন্ধন। যে বন্ধনে একবার বাঁধা পড়লে, আর ছুটে যেতে পারে না। তখন অন্যের দুঃখ নিজের বলে মনে হয়। মমতার অদ্ভুত সুন্দর দিক এটাকেই বলা যায়। মানুষ রাগের মাথায় কিছু করে ফেললে এর পরিণতি কখনও ভালো হয় না। তবুও বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
খেয়াল করলে দেখা যায় হুমায়ূন আহমেদের পরবর্তী লেখনশৈলীর সাথে তুলনা করলে “নন্দিত নরকে” বইটির ভাষাশৈলীতে পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য তার লেখাকে ভিন্ন রূপ দিয়েছে। এক ঘোরলাগা ভাষাশৈলী। ছোট্ট বই। এক বসায় পড়ে ফেলা যায়। মেদহীন লেখা অনেক কিছু না বলেই বুঝিয়ে দেয়। এই জাতীয় লেখা আমার ভীষণ পছন্দ। সবকিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয় না। লেখকের গল্প ও শব্দের এ খেলায় পাঠককেও শামিল হতে হয়। বুঝে নিতে হবে লেখক কী বলতে চান। তাছাড়া লেখকের নিজের মনস্তত্ত্ব, চরিত্রের গভীরে প্রবেশ করে তাদের মনস্তত্ত্ব প্রকাশের যে সক্ষমতা; তাকে ছোটো করে দেখার উপায় নেই। এ অনেক বড় গুণ। আমরা হুমায়ূন আহমেদের ভিন্ন ভিন্ন বইয়েও এই গুণের সাথে পরিচিত হবো। কখনও কখনও মুগ্ধও হবো। তিনি নিজের মতো করে চরিত্রগুলো অনুভব করতেন বলেই হয়তো যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন।
হুমায়ূন আহমেদের গল্পের শেষে কখনও সমাপ্তি ঘটে না। যেন আরও কিছু বলতে চেয়েও হুট করে থেমে যাওয়া! পাঠক তখন আফসোস করে, আরও লিখলে ক্ষতি কী হতো? জীবনের গল্পের পরিসমাপ্তি থাকে না। এক গল্পের শেষে নতুন এক গল্পের শুরু। কখনও কখনও বদলে যায় দৃশ্যপট। পরিবর্তন হয় জীবনের গতিপথের। তাই হয়তো লেখক তার অধিকাংশ গল্পের সমাপ্তিতে বিশ্বাস করেন না। হয়তোবা এমনও হতে পারে, আমরা যেভাবে জীবনের পরবর্তী সময়ের প্রতীক্ষা করি, লেখকও সেই অপেক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে চান। তাই শেষ হয়েও গল্পের শেষ হয় না। কেননা এই প্রতীক্ষা চলমান। খোকা ও তার বাবার জেলখানার বাইরে এই অপেক্ষা বাস্তব কিংবা অবাস্তবের মধ্যবর্তী কোনো নন্দিত সমাজে নরকের সমতুল্য।
পরিশেষে, “নন্দিত নরকে” এমন এক গল্প যা মধ্যবিত্ত সমাজের অনুপ্রবেশের দুয়ার খুলে দিয়েছে। সমাজকে ভিন্নভাবে দেখার উপায় এনে দিয়েছে। আর যিনি এ কাজটি করেছেন, তিনি জানান দিয়েছেন — এ তো সবে ট্রেলার। আরও কত উপায়ে পাঠকের সাথে গল্প হবে! এখান থেকেই শুরু।
এই সেই বই যে বই দিয়ে হুমায়ূন আহেমদ বাংলা কথাসাহিত্যের “বাদশাহ” হুমায়ূন হওয়ার বাণী শুনিয়েছিলেন। আঠারো বছর আগে তার লেখার সাথে পরিচয় হলেও ইচ্ছা করেই বইটা পড়িনি। পড়লেই যদি ম্যাজিক শেষ হয়ে যায়! এই ভেবে। আজকে দুপুরে কি মনে করে যেন শেষ করে দিতে ইচ্ছা করল ম্যাজিকটা। শেষ করলাম, বুক ভরা হাহাকার আর দীর্ঘনিঃশ্বাস নিয়ে। একটা ভাঙাচোরা সংসার যেই না একটু উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে তখনই আরও বড় ঝড় এসে একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে দিলো পরিবারটাকে। এটাই মূলত গল্প, কিন্তু কি যে মায়া মিশিয়ে বলেছিলেন হুমায়ূন। চোখে জল না এসে পারে না।
লেখনীজুড়ে এক পরিণত দীপ্তিময়তা,যেন কোন মায়াবী রজনীর নরম জ��ছনায় ভরে গেছে বইখানা...... পাতার পর পাতাজুড়ে কত শব্দ মুদ্রিত হয়ে আছে,অথচ কী অন্তহীন শূন্যতা বিরাজমান!
"হৃদয় আমার আকুল হল, নয়ন আমার মুদে এলো রে- কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে৷৷ আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে বসন্তের বাতাসটুকুর মতো৷"
উপন্যাসটা ছোট হলেও এখানে সব কিছুই প্রাধাণ্য পেয়েছে। যাকে 'একের ভেতর সব' বলা চলে। পরিবার,প্রতিবেশি,সামাজিক ব্যবস্থা,মনে মনে ভালোবাসা সকল কিছুই ছিল অনবদ্য।
রাবেয়ার অকাল মৃত্যু, মন্টুর ফাঁসি পীড়াদায়ক লেগেছে। মাস্টার মশায়ের মতো কালপ্রিট চরিত্র আমাদের সমাজে অহরহ রয়েছে।
মাত্র ৫০ পাতার মধ্যে একটি পরিবারের সুখ, দুঃখের কথা, দরিদ্রের সপ্ন ও সপ্নভঙ্গের কথা এত সুন্দর করে কে কবে লিখতে পেরেছে আমার জানা নেই। হুমায়ুন আহমেদের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস পড়ে আমি মুগ্ধ।
হয়তো আরো বড় করে লিখতে পারতো, এমন লাফালাফি টাইপ না লিখলেও চলত। হয়তো লেখক নিজের ইচ্ছাতেই কাজ টা করেছে, যেন খুব বেশি মিল না যায়। হয়তো ভালোই হয়েছে, আরো বড় লিখা থাকলে আরো বেশি কষ্ট পেতাম। শুরু থেকে শেষ আসলেই ভালো ছিল।
এত হুমায়ূন আহমেদ পড়েছি, সামহাউ এই ক্লাসিকটাই বাদ রয়ে গেছিলো। পড়েই ফেললাম, প্রতিটা চরিত্রায়ণ বরাবরের মত ভালো হয়েছে। ঘরোয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের চিত্রায়ণে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মুন্সীয়ানা আবারও দেখিয়েছেন। যাই হোক, এটা পড়তে যেয়ে বারবার জহির রায়হানের "বরফ গলা জল" মনে পড়ছিলো। ঐটাও শহরের মধ্যবিত্ত জীবনের একটা দারুণ আখ্যান। রাবেয়ার জন্য একবুক ভালোবাসা।
ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি কেমন তা নিয়ে যাবতীয় বিতর্কগুলো এই একটি জায়গায় এসে খেই হারিয়ে ফেলে। তাঁর সবচেয়ে বড় সার্থকতা হল তিনি এমন এক শ্রেণীকে নিয়ে লিখে গেছেন, যাদের কথা আর কেউ ভাবেনি। যৌথ পরিবারগুলো ভাঙতে ভাঙতে যাদের যাত্রা শুরু। দরিদ্রের কষাঘাতের মাঝে যাদের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল শিক্ষা। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরাতো, কিন্তু সম্মান এবং ইগোর সাথে আপোষ নেই। এই ধরণের পরিবারে বেড়ে ওঠাটা ম্যাজিকাল ছিল। হুমায়ুন না লিখলে হয়তো তাঁরা কালের আবর্তে হারিয়েই যেতেন। একাবিংশ শতাব্দীতে জন্ম নেওয়া হাইটেক "শিক্ষিত" জেনারেশন কোনোদিন জানতেও পারতো না তাদের জীবনটা কেমন ছিল। বইটি পড়তে গিয়ে বারবার চোখের কোণে জল জমে উঠে। ঠিক যেমন হয় শঙ্খনীল কারাগার পড়ার সময়। তবে শেষটা এমন না হলেও পারতো! কী দরকার ছিল দুঃখ বাড়ানোর?
হুমায়ূন আহমেদের অথর প্রোফাইল চেক করছিলাম, কোনো বই আর বাদ আছে কি না, দেখি নন্দিত নরকেকেই শেলফে তোলা হয়নি!
নন্দিত নরকে দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যে প্রথম প্রকাশ। বিস্ময়করভাবে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম যে কয়টা বই পড়েছি, তার মধ্যে নন্দিত নরকে একটা। সিক্স বা সেভেনে পড়েছিলাম প্রথম, বলাবাহুল্য বুঝিনি অনেকটাই। হুমায়ূন এর ব্যবহার করা এডাল্ট জোক্স কিংবা পুরো ব্যাপারটাই হয়তো তখন বুঝিনি। কিন্তু না বুঝেও কি সাবলীলভাবে পড়ে গিয়েছিলাম- ভাবলে এখন অবাক লাগে।
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে যে জনপ্রিয় কিন্তু শক্তিশালী না ক্লিশে আছে, যারা এটা বলে, তারাও অন্তত চাপা সুরে, আস্তে আস্তে যেন কেউ শুনে না ফেলে ভাবে যে বইটার প্রশংসা করে- নন্দিত নরকে তার একটা। (হয়তো প্রথমবই করেই করেছিল, ভেবেছিল বেশি বিক্রি হবে না!)
বইটা নিয়ে কিছু বলছি না কেন? ছোট বই, পড়েই ফেলুন। আশাহত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম বলেই মনে করি। পড়ে ফেলুন, হয়তো আমার অবস্থাটা বুঝবেন, এই বইয়ের ‘রিভিউ’ লেখা আমার জন্য বড্ড কষ্ট। হুমায়ূন আহমেদ ওই অল্প বিস্তৃতিতে যে একটা পরিবারের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন, ক্রাইসিস কমিক রিলিফ সব রাখেন- সেটা আসলে বইটা পড়লেই বেশি ভালো বোঝা যায়।
যখন পড়া শুরু করি তখন একটা অন্যরকম ম্যাজিক অনুভব করেছিলাম। এ বইয়ে একটা জাদু ছিলো। খুব ছোট বই অল্প সময়ে পড়ে ফেলা যায় তাও আস্তেধীরে পড়ছিলাম জাদু শেষ হয়ে যাবে বলে। তাও তো শেষ হতে হলো!
আর শেষ হয়ে কি পেলাম? খুব অল্প কথায়, অল্প সময়ে কি করে মায়া তৈরি করতে হয় তা হুমায়ুন সাহেব বোধহয় খুব ভালো করেই জানতেন। জানতেন বলেই তো মায়া তৈরি করতেন। এমন চরিত্রের প্রতি মায়া তৈরি করবে যা হয়তো শেষ মুহূর্তে গল্পে আসলো তাও তার প্রতি কি অগাধ মায়া। এই গল্পে সেইরকম মায়া জন্মেছিলো মন্টুর প্রতি। মন্টুর কথা শুরু থেকে খুব অল্প অল্প ছিলো কিন্তু হুট করে ঝড়ের মতো এসে এক মায়া তৈরি করলো। আর অল্প সময় পরেই সেই মায়া চূর্ণবিচূর্ণ করে দিলো হুমায়ুন আহমেদ। কিন্তু শুধু এই একটা ধাক্কা? না, আরো একটা ধাক্কা দিয়েছে গল্পে। এক ধাক্কা/কষ্ট সেরে না উঠতেই আরো একটা দিয়ে গল্পই শেষ করে দিলো। যেমনটা তিনি সব গল্পে করে আসছেন। তাও তো গল্পের মায়ায় পড়ে যাই, চরিত্রের মায়ায় পড়ে যাই। নিজেকে নিয়ে যাই গল্পের মধ্যে, আবদ্ধ করে ফেলি কাহিনীর মধ্যে।
नंदित नरक में हुमायूँ अहमद जी का पहला उपन्यास था। यह पहली बार 1972 में प्रकाशित हुआ था। हुमायूँ अहमद बांग्लादेशी उपन्यासकार, फ़िल्मकार हैं जो कि जितना अपनी फिल्मों के लिए जाने जाते हैं उतना ही अपने उपन्यासों के लिए भी मशहूर हैं।
उपन्यास मूलतः बांग्ला भाषा में लिखा गया था। हिन्दी में इसका अनुवाद रामलोचन ठाकुर जी ने किया है।
निम्न वर्ग के संघर्ष को दर्शाते इस उपन्यास ने मुझको अंत तक बाँधे रखा। कहानी के किरदारों से मैंने जुड़ाव महसूस किया। मैंने उनके दुःख में दुःख का अनुभव किया, उनकी सुख की चाह को मैंने अपनी सुख की चाह बना ली। उपन्यास की अंतिम पंक्तियाँ निम्न हैं:
सुबह होती जा रही है। चाँद डूब चुका है। विस्तृत मैदान के ऊपर चादर-सी फैली उदास चाँदनी अब नहीं है।
और इन पंक्तियों को पढ़ते हुए मैं केवल यही आशा कर रहा था कि यह सुबह इस परिवार के लिए भी एक नई सुबह लेकर आये और यह अपने दुखो से उभर कर एक सुखमय जीवन बिताये।
उपन्यास के प्रति मेरे विस्तृत विचार आप निम्न लिंक पर जाकर पढ़ सकते हैं: नंदित नरक में
বুকশেলফের এক কোনায় পড়ে ছিল। এই সাইটেও দেখি আনরেড। ভাবলাম, এটা তো মিস হয়ে যাওয়ার কথা না। পড়তে গিয়ে খেয়াল হলো, মিস হয় নি। এটা আগেও পড়েছি। এবং মনে রাখতে চাইনি। অপ্রস্তুত করে দেয়ার মতো বিষয়। জীবনশিল্পী হয়ে উঠার যাবতীয় লক্ষণ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ পেশ করেছিলেন এক অস্বস্তিকর গল্প। কিন্তু জীবনের গল্প। মধ্যবিত্ততার প্রশংসিত জাহান্নামের গল্প। মানবিকতার অনুভূতির আগে এখানে সম্মান-অর্থ-মর্যাদার দাম বেশি। তাই অস্বস্তিকর। তাই বোধদৃষ্টি এড়িয়ে ভুলে যাওয়াই হয়তো ভাল মনে করেছে অবচেতন। আহমদ শরিফ সেই ১৯৭২ সালে এর প্রকাশকালে ভালমতই টের পেয়েছিলেন এই কথাশিল্পীর শক্তিমত্তা। তাঁর ভাষার জোর আর প্রথম পুরুষে নিজ নামে লিখা এক অনন্য, অনবদ্য, কালিময় কাহিনীকে স্বীকৃতি দিয়েছিল গুনীসমাজ। প্রাপ্য ছিল তাঁর।
বই পড়ার পরের এই সময়টুকুন আমার অনেক বিষন্নের, এমন বইটি শেষ হয়ে যাবার দুঃখে। বইয়ের কাহিনির আঙ্গিকে গেইস করা যায়, দুঃখ আপাতত প্রশমনের সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ। ব্রেইনে এতো ওয়ার্ডসও আসতেসে না যে কিছু লিখা যাবে (রিভিউ বলবার মতোন), পুরো বইটিতেই একটু স্যাডনেস ছাড়ানো, আর মায়াময়টাইপ আবহ ক্যামন যেন; হয়তো সংলাপগুলোর কল্যাণে, কিংবা স্টোরির টেলিংয়ে। এটা অবশ্যি কিছুক্ষেত্রে সমস্যাজনক, কজ আপনাকে উপন্যাস পড়াকালীন পুরোটা সময়ই দুঃখসমেত মুড নিয়ে থাকতে হয়, সমস্যাটা আরো প্রকট হয়, তখন;— যখন আপনি উপলব্ধি করেন, বইটি আপনার সম্পূর্ণ পড়া শেষ, এবং এই কাহিনি আপনার কাছে পুনরায় আর অপরিচিত ঠেকবে না।
সুন্দর একটা স্টোরির সংখ্যা কমে যাওয়াটা নিশ্চয়ই দুঃখজনক, নাহ?
. পুনশ্চঃ নন্দিত নরকের নাম আর প্রচ্ছদ, দুটোই গল্পের মতোনই অসাধারণ।