পদ্মা নদীর মাঝিদের নিয়ে একবার বাংলা ভাষায় একটি উপন্যাস লেখা হয়েছিল। সেসব মাঝিদের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু তাদের বংশধরেরা বেঁচে আছে । সারা বাংলাদেশেই, কেউ কেউ দক্ষিণাঞ্চলে । দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের নিয়েই লেখা এই উপন্যাস । নাফ নদীর তীরে ছোট্ট এক দ্বীপের বুকে এইসব মানুষের বসতি । মানুষের, না পোকামাকড়ের? দৃশ্যমান বাস্তবতা তো পোকামাকড়ের কথাই বলে। কিন্তু সেই ঘরবসতিতে আমরা তো মানুষকেই দেখতে চাই । সাহসী, লড়াকু, সপ্নতাড়িত, প্রেমময় মানুষ । পিষ্ট হতে হতে শেষে মাথা তুলে দাঁড়াবে, এমন মানুষ । জলদাস নয়, জলের অধিপতি হিসেবেই বেঁচে থাকবে মানুষ । তাদের কুশলী শ্রমে রুপোলী মাছ আটকে যাবে জালের সুতোয়, স্বপ্নের মধ্যে জালের গুটি টুং টাং বেজে উঠবে যেন অলৌকিক সঙ্গীত । সব জলদাস দাঁড়াবে এসে এক আলোকিত মিছিলে- পুরোভাগের সাহসী মানুষটির চোখে ভিড় করবে স্বপ্নঘেরা এক ভূখণ্ডের মানচিত্র । হাঙরদের পরাভূত করে উঠে আসবে জলমগ্ন মানুষের দল । না, এ উপন্যাস "পদ্মা নদীর মাঝি" নয় । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেলিনা হোসেনের যোগসূত্রের সন্ধানে বেরোলে সামনে থাকবে দীর্ঘ পথ । তবু উভয়ের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম সাদৃশ্য যেন আছে । সেই সাদৃশ্যটি জীবনের প্রতি অঙ্গীকারের বিশ্বস্ততায় । যে মানুষ আমরা সবাই, শহরের, মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত , তার বাইরের মানুষের জন্য লেখকের ভালবাসা । ভালবেসে সে মানুষকে বোঝার চেষ্টা, তার ঘরবসতিকে অন্যরকম করে সাজিয়ে দেওয়ার সাহস ।
Selina Hossain (Bangla: সেলিনা হোসেন) is a famous novelist in Bangladesh. She was honored with Bangla Academy Award in 1980. she was the director of Bangla Academy from 1997 to 2004.
সেলিনা হোসেন (জন্ম: ১৯৪৭) বাংলাদেশের অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিকদের অন্যতম। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি এ অনার্স পাশ করলেন ১৯৬৭ সালে। এম এ পাশ করেন ১৯৬৮ সালে। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমীর গবেষণা সহকারী হিসেবে। তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমীর প্রথম মহিলা পরিচালক হন। ২০০৪ সালের ১৪ জুন চাকুরি থেকে অবসর নেন।
গল্প ও উপন্যাসে সিদ্ধহস্ত। এ পর্যন্ত ৭টি গল্প সংকলন, ২০টি উপন্যাস, ৫টি শিশুতোষ গল্প, ৫টি প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু বই। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক (১৯৬৯); বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮০); আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১); কমর মুশতরী স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৭); ফিলিপস্ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮); অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪)। তাঁর গল্প উপন্যাস ইংরেজি, রুশ, মেলে এবং কানাড়ী ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
সমুদ্র আর দারিদ্র এ দুয়ের সাথে চিরসংগ্রামে লিপ্ত শাহপরি দ্বীপের জেলেরা। তারা নিজেরা দৈনিক লাখ টাকার মাছ ধরে দেয় তোরাব আলী কে। অথচ নিজেদের ঘরে নুন আনতে নিত্য পান্তা সংকট।
এইসব শোষিত জেলেদের মধ্যেও সদা সহজ-সরল মানুষ বিদ্যামান।এ সহজ মানুষটি সালেক। সালেক হাঙর ধরায় পটু। সালেকের মনে সদা সমুদ্রের প্রতি এক অবিচ্ছ্যেদ্য টান বিরাজমান। যখন সমুদ্রে তার কাজ না থাকে,তখন সে তালাকপ্রাপ্ত সাফিয়ার সাথে ঝিনুক সংগ্রহের কাজ করে। সাফিয়ার জন্য মালেক অনুভব করে অন্যরকম এক মুগ্ধতা। কিন্তু বৈশয়িক আর জীবন সংগ্রামে ঘাঁ খাওয়া সাফিয়া মোটেও পছন্দ করেনা আত্মভোলা সালেক কে। সাফিয়ার যতো টান এলাকার গুন্ডা শুক্কুরের প্রতি। তোরাব আলীর গাড়িচালক সালেকের মূল লক্ষ্য ধনী হওয়া যা তার হতেই হবে।সালেক ভালোবাসার নামে প্রতারণা করে জোলেখা কে। জোলেখা বেছে নেয় আত্মহননের পথ। তাতে কী সালেকের বোধদয় ঘটে?
সুজা তার বিশাল পরিবার নিয়ে দারিদ্রপীড়িত।একটু অসৎ হলেই দুপয়সা বেশি কামাই হবে। কিন্তু মনের কোথায় যেনো একটা অস্বস্তি কাজ করে তার। সে কী অসৎ পথে পা বাড়াবে? মালেকের অন্ধ মায়ের প্রতি তার চমৎকার দায়িত্ববোধ।
এদিকে,মালেকের স্বপ্নকন্যা সাফিয়া বিয়ে করে বসে শুক্কুর কে।পারবে কী সাফিয়া সুখী হতে? মালেক স্বপ্নচারী হয়ে স্বপ্ন দেখে।তার স্বপ্ন জেলেদের সবার নিজস্ব নৌকা, জাল থাকবে। কোনো জেলে পরিবার অনাহারে থাকবে না,কোনো জেলে হবে না তোরাব আলীদের মতো শোষকদের শিকার। কিন্তু স্বাপ্নিক মালেকের স্বপ্ন কী পূরণ হবে? নাকী দারিদ্রক্লীষ্ট মানুষদের স্বপ্নের ন্যায় তার পরিকল্পনাও পরিণত হবে দিবাস্বপ্নে?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর ই যেনো এ উপন্যাস।গভীর জীবনবোধের বহিঃপ্রকাশ আর সেই সাথে রূঢ় বাস্তবের সংমিশ্রণ ছিলো চোখে পড়ার মতো।
আঞ্চলিক উপন্যাস এটি। পুরোপুরি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে একপূর্ণতা এনে দিয়েছেন সেলিনা হোসেন।আঞ্চলিক উপন্যাস যে অঞ্চল কে নিয়ে লেখা হয়, সে অঞ্চল কে উপস্থাপনের ওপর উপন্যাসের সাফল্য নির্ভর করে। এদিক বিবেচনা করলে এ উপন্যাস নিঃসন্দেহে "তিতাস একটি নদী নাম", "হাঁসুলি বাঁকের উপকথা", "ইছামতি" কিংবা "পদ্মা নদীর মাঝি"-র মতো লিজেন্ডারি আঞ্চলিক উপন্যাসের উত্তরসূরী।
আমার পড়া সেলিনা হোসেনের প্রথম বই । পড়ে মনে হয়েছে কেন এতদিন ওনার কোনো লেখা পড়লাম না । যখন পড়তে শুরু করি, তখন বারবার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "পদ্মা নদীর মাঝি"-র সাথে তুলনা করেছি, অবচেতন মনেই । কিন্তু এই উপন্যাসের সাথে "পদ্মা নদীর মাঝি"-র তুলনা করলে, উপন্যাসটির প্রতি অবিচার করা হয় । মাঝিদের নিয়ে লেখা গল্প হলেও উপন্যাসটির একটা নিজস্বতা আছে । বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মাঝিদের জীবন, ভালবাসা, সংসার আর সংগ্রামের গল্পকে ঘিরে বিস্তার পায় "পোকামাকড়ের ঘরবসতি" । সেখানে শোষণ আছে, স্বার্থপরতা আছে, হিংসা আছে, হিংস্রতা আছে - কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও মানবতা পুরোপুরি বিরাজিত । "পোকামাকড়ের ঘরবসতি" এই মানবতাকে পুঁজি করে কিছু নিপীড়িত মাঝির একত্রিত হওয়ার গল্প, শোষণের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার গল্প, মাথা তুলে দাঁড়ানোর গল্প ।
তারাশঙ্করের "কবি" উপন্যাসের "নিতাই" চরিত্রটির পরে সেলিনা হোসেনের "পোকামাকড়ের ঘরবসতি" উপন্যাসের "মালেক" চরিত্রটি অতি ভাল লাগল। মালেক এক স্বপ্নালু মানুষ যে জেলে পাড়ার পোকামাকড়ের ঘরগুলো, তাদের জীবনকে দিতে চেয়েছিল জোনাকির আলো। কিন্তু সাফিয়া, সুজা, জুলেখার মত সেও কি ব্যর্থ হবে??? নাকি পোকামাকড়ের ঘরবসতিতে জোনাকির আলো জ্বালাবে তা বুঝা যায় না, ব্যাপারটি অস্পষ্ট রয়ে যায় সমুদ্রের বুকের হাজারো বুদবুদের মত....
দেশের উপকূলবর্তী জেলা কক্সবাজার। এখানকার একটা বড় অংশের জীবিকার প্রধান অবলম্বন সমুদ্র। সমুদ্রে মাছ ধরা, শুটকি করা, লবণ তৈরি করা – এসবের মাধ্যমেই জীবিকার সংস্থান হয় তাদের। বদরমোকাম, টেকনাফ থেকে সর্বোচ্চ সেইন্ট মার্টিন – এটুকুর মধ্যেই তাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, প্রেম, সংসার, জীবিকা ও মৃত্যু। মালেকদের পরিবার এমন অসংখ্য পরিবারের মধ্যেই একটা। মালেক, বড় ভাই সুজা, ছোট ভাই সালেক প্রত্যেকের জীবনই সমুদ্রের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
সমুদ্রে মাছের বা লবণের কোনো অভাব নেই। তাইতো সমুদ্র ওদের দুহাত ভরে মাছ বা লবণ দেয়। কিন্তু সমুদ্র দিলেও তোরাব আলী বা গণি মিয়ারা দেয় না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ওরা যা সংগ্রহ করে তার সিংহভাগ চলে যায় এসব আড়তদার আর মহাজনদের হাতে। ফলে দিনশেষে অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাতে হয় ওদের। সততার কোনো দাম নেই এই এলাকায়, যে যত অসৎ হতে পারবে সেই সবচেয়ে ভালোভাবে চলতে পারবে এখানে। এখানে মহাজানরা বৈধ-অবৈধ ব্যবসা করে উপার্জন করে, জেলে-চাষীরা মহাজনদের ফাঁকি দিয়ে বাড়তি উপার্জন করতে চায়, মহিলারা চায় প্রতাপশালী ( হোক না অসৎ) স্বামী।
এই ব্যবস্থায় এলাকার সবাই এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে সে কেউ ভিন্ন কিছু চিন্তা করে না, ভিন্ন কাজ করে না। শত লাথি-ঘুষি খেয়েও মহাজনদের মন জুগিয়ে চলে তারা। কিন্তু মালেক ব্যতিক্রম। সে প্রশ্ন করতে চায়, এলাকাবাসীকে একত্রিত করতে চায়, এই আবদ্ধ ব্যবস্থা ভাঙ্গতে চায়। কিন্তু সে চাইলেই তো তোরাব আলীরা তা হতে দিতে পারে না কেননা তাতে যে গদি হাতছাড়া হয় তাদের। তাইতো শুরু হয় দ্বন্দ্ব।
সহজ কথায় বললে বইটা পড়ে বেশ মুগ্ধ হয়েছি। একটা অঞ্চলকে, একটা শ্রেণির মানুষকে, তাদের জীবনসংগ্রামকে এত দারুণভাবে প্রকাশ করতে খুব কম লেখকই পারেন। সেলিনা হোসেন সেটা পেরেছেন, বেশ ভালোভাবেই পেরেছেন।
তো কি ভালো লেগেছে বইটার? বইটার নাম থেকেই শুরু করি। বইটার নাম শুনেই প্রশ্ন জাগে এই পোকামাকড় কারা? তাদের ঘর-সংসার নিয়ে লেখিকা এত উদ্বিগ্ন কেন? উপন্যাসের প্রতিটা পৃষ্ঠায় আছে এর উত্তর। পোকামাকড়কে যেমনভাবে আমরা তুচ্ছ করি, ইচ্ছে হলেই তাদের নিয়ে মজা করি বা বিরক্ত হলে পা দিয়ে পিষে ফেলি উপন্যাসটিতে লেখিকা তেমন একটা সম্প্রদায়ের কথা বলেছেন যারা প্রতিনিয়ত এমন পোকার জীবন কাটায়। তাদের নিয়ে কেউ চিন্তা করে না কিন্তু সামান্য হেরফের হলেই যাদের গুড়িয়ে দেওয়া যায়। মৌমাছিদের যেমন বিনা-বাধায় বংশবিস্তার করতে দিয়ে সময় হলে আমরা আগুন দিয়ে তাদের তাড়িয়ে তাদেরই সঞ্চিত মধু আহরণ করি তেমনি এদেরও নৌকা, জাল, খাবার দিয়ে ভয়াল সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে তাদের ধরা মাছ মহাজনরা ভক্ষণ করে নিজেরাই। ফলে দিনশেষে এই মানুষরা পোকামাকড়ের চেয়ে বেশি কিছু না। তবু লেখিকা এদের নিয়ে লিখেছেন কেননা তিনি শ্রেণি নির্বিশেষে সবাইকে ভালোবাসেন। তিনি এই ‘ পোকামাকড়দের’ মানুষ হিসেবে দেখেছেন, তারাও যে ‘মানুষের’ ন্যায় সুস্থ জীবনযাপন করতে চায় সেটা দেখাতে চেয়েছেন তাদের ঘরের মধ্যে গিয়ে।
আঞ্চলিক ���পন্যাস যেমন হওয়ার কথা তেমনটাই হয়েছে উপন্যাসটি। অঞ্চলটির খুটিনাটি বর্ণনা, আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার, জেলেদের জীবন উপস্থাপন – প্রতিটা দিকে লেখিকা চমৎকার করেছেন। চৌধুরী সাহেব নামক একটা চরিত্র এনে তিনি সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ দূষণের দিকেও দৃষ্টি দিয়েছেন। অতিথি পাখি বা মাছ কমে যাওয়া, প্রবালের ক্ষয়ক্ষতি, সমুদ্র দূষণ ইত্যাদি নিয়ে তিনি বেশ জোরালো কন্ঠে বলেছেন।
বইটার সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে দিক সেটা হলো চরিত্রগুলোর মাধ্যমে সমাজের শ্রেণিবৈষম্যকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখিকা। তোরাব আর গণি মিয়াদের মাধ্যমে উপরতলার মানুষদের শোষণ-নিপীড়ন আর মালেক-সুজা-বাদলদের মাধ্যমে নিচুতলার মানুষদের সংগ্রামকে তুলে ধরেছেন তিনি। আর এখানেই এসেছে লেখিকার সাম্যবাদী চিন্তাধারা। তিনি দেখিয়েছেন উচুতলার মানুষরা যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন যখন নিচুতলার মানুষরা নিজেদের সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে একতাবদ্ধ হতে পারবে তখন উপরতলার মানুষদের পতন অনিবার্য। এভাবেই উপন্যাসটিতে মালেকের নেতৃত্বে লেখিকা প্রলেতারিয়েত বিপ্লব উপস্থাপন করেছেন।
এছাড়াও মালেক-সাফিয়ার ভিন্নমাত্রার সম্পর্ক, সুজার বদলে যাওয়া, বাদলের ভয়, মালেক ও সাফিয়ার মায়ের মালেকের প্রতি ভালোবাসা, সালেকের পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়গুলো ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে বইটাতে।
এতসব ভালো লাগার পরও কিছু নেগেটিভ দিকও আছে বইটার। সবচেয়ে বেশি চোখে যা লেগেছে তা হলো মালেকের বিপ্লবী হয়ে ওঠা। মাঝে মাঝে চাপিয়ে দেওয়া মনে হয়েছে তার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড ,স্বতঃস্ফূর্ত না আর কি! লেখিকা যেন আগে থেকেই মালেককে ‘নায়ক’ বানাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন, ফলে তার কর্মকাণ্ড ঘটনার পরম্পরায় ঘটে যাওয়া বলে মনে হয় নি অনেক জায়গায়। তাছাড়া তার চিন্তাধারার গুরু হিসেবে লেখিকা যাকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন সেই চৌধুরী সাহেব চরিত্রটাও কেমন যেন অসম্পূর্ণ, ভাসা-ভাসা। অর্থাৎ মালেকের বিপ্লবী হয়ে ওঠার কোনো ‘ব্যাক-স্টোরি’ নেই বইটাতে।
সবাই সুখে শান্তিতে বাস করছে – এমন পরিণতি দেখতে সবারই ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবতা কখনোই এমন হয় না। বিষয়টা জানেন লেখিকাও। তাইতো একদিকে যখন তিনি মালেকের জয় দেখিয়েছেন সাথে সাথে দেখিয়েছেন সালেকেরও উত্থান। অর্থাৎ বিপ্লব কখনও শেষ হয় না, বিপ্লব জারি রাখতে হয়।
সার্বিকভাবে বলতে গেলে, বইটা একটা দারুণ আঞ্চলিক উপন্যাস। ততটা আলোচনা শোনা যায় না বইটা নিয়ে, আরও বেশি আলোচনার যোগ্য বইটা।
এটা আমার পড়া সেলিনা হোসেনের দ্বিতীয় বই, প্রথমটা হলো হাঙর-নদী-গ্রেনেড। এই লেখাদুটো পড়ে মনে হয়েছে গত কয়েক দশকের বাংলাদেশের শক্তিমান লেখকদের একটা তালিকা করলে সেলিনা হোসেন খুব উপর দিকে থাকবেন। অসাধারণ লেখিকার ভাষার ব্যবহার, পোকামাকড়ের ঘরবসতি পড়তে পড়তে দক্ষিণাঞ্চলের জেলেদের জীবন চোখের সামনে ভেসে উঠবে। বইটার সমাপ্তিও হৃদয়ছোয়া, উৎসাহব্যাঞ্জক। আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের জন্য বইটার কথোপকথনগুলো বুঝতে একটু কষ্ট হয়েছে, তবে এটা না করলে বাস্তব চিত্র আঁকা সম্ভব হতো না।
নাফ নদীর তীরের জেলেপাড়ার উত্থানের গল্প। কিভাবে নিজের সাথে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে মানুষ জেগে উঠে। জীবনবোধ থেকে জীবনমুখী হয়। গল্পটা মালেকের, যেখানে তার সঙ্গী অথবা প্রতিপক্ষ হয় সুজা, সাফিয়া, জুলেখা, জয়গুন, শুকুর, বাদল, মহাজন তোরাব আলী। মালেক জিঞ্জিরা দ্বীপকে ভালোবাসে, পাথরের ফুলকে রক্ষা করতে চায়, করকরি ডাক পাখির দেখা পেতে চায়। সে সাগর ভালোবাসে, চারপাশের মানুষের দৈন্যদশায় তার মন পোড়ে। তারপর একদিন সে একদিন সাগরপাড়ের ঝিমিয়ে থাকা মানুষগুলোকে স্বপ্ন দেখায়।
ছোটবেলায় জানতাম "পোকামাকড়ের ঘরবসতি" একটি জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলা সিনেমা। বেশি ছোট থাকায় কখনো আসলে "পোকামাকড়"-এর অর্থ বোঝা হয়নি। এখন দেখবো তখন দেখবো করে এখনও দেখা হয়নি। এর মাঝে আবার নতুন করে জানলাম এটি আসলে কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস যার সাথে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "পদ্মা নদীর মাঝি"-এর অহরহ তুলনা চলে। আসলে দুটো প্লটের শুধুমাত্র জীবনসংগ্রামের ধরণ আর জেলেপাড়ার ভিটে ছাড়া কোনো মিল পাইনি আমি। দুই উপন্যাসের অনুভব দুই রকমের। কয়েকটা লাইন এতটাই বেশি বুকে বাজে যে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম। উল্লেখ করে দিই -
"একজনের বিশ্বাস অপরজনকে আহত করলে জীবনযাপন উলটে যায়, কিন্তু সেটাই তো শেষবিন্দু নয়। বরং রক্তে ক্রোধের জন্ম হয়, ক্রোধ থেকে শক্তি বাড়ে, শক্তি বেঁচে থাকার পারাপারে ভিন্ন সেতু গড়ে।"
নাফ নদী, শাহপরীর দ্বীপের মানুষের গল্প। জীবন যুদ্ধে যারা বারবার শোষিতই হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কাছে হয়ত সেসব খবর পোঁছে না। পাতে দামী মাছ, মন জুড়িয়ে দেয়া স্বাদ। কিন্তু এর পেছনের মালেক, সুজাদের মত গল্প গুলো আধারেই থেকে যায়, শ্রমের প্রকৃত ভাগীদার রয়ে যায় বঞ্চিত।
নাফ নদীর তীরে ছোট্ট শাহপরি দ্বীপের বুকে কিছুঘর মানুষের বসতি। মানুষের, না পোকামাকড়ের? দৃশ্যমান বাস্তবতা তো পোকামাকড়ের কথাই বলে। এই মানুষরূপী পোকামাকডরাই তার ঘরবসতির সংগ্রামে হাঙর রূপী শাষক গোষ্ঠির পরাজয়ের স্বপ্ন দেখে। গড়ে তুলতে চায় মানুষের বসতি। সমাজে দুই শ্রেণীর মানুষের বসবাস। এক শোষিত আরেক শাষিত। পোকামাকড়ের ঘরবসতি এই দুই শ্রেণীর মানুষের কথন। শুধু স্থান, কাল ভিন্ন। পাত্র পাত্রী ওই দুই শ্রেণীর মানুষ। দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলের মানুষের জীবনের খুবই বাস্তব এবং জটিল একটি অধ্যায় তুলে ধরেছেন সেলিনা হোসেন। শোষিত শ্রেণির উত্থানের সময় শাসক শ্রেণির মধ্যে যে হিংসা, আতঙ্ক দেখা দেয় এবং এ থেকে উদ্ভুত ক্রোধ তাদেরকে নিকৃষ্ট কাজ করতেও বাধা দেয় না এই ব্যাপারটি তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। এছাড়াও বইতে প্রকাশ পেয়েছে অব্যক্ত ভালোবাসার এক নিবিড় আকুতি যা প্রতি পদে লাঞ্চিত হবার পর একটি সময় কেবল বিরক্তির উদ্রেক করে। ঘটনাবহুল এ উপন্যাসটি শোষন-পীড়ন, প্রেম-ঘৃনা, দুঃখ-কষ্ট, ষড়যন্ত্র, প্রবঞ্চনার এক সুষম সংমিশ্রণ। আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার বইটিকে করে তুলেছে আরো আকর্ষণীয়। শেষাংশের প্রত্যেকটি অংশ রুদ্ধশ্বাসে পড়ে শেষ করার মতো। এ যেন বিজয়, সংগ্রামী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একজন পরাজিত মানুষের বিজয়।
সমূদ্র উপকূলবর্তী ছেলেদের নিয়ে লেখা চমৎকার উপন্যাস । বিয়োগান্তক না হয়ে অনেকটা উৎসাহ যোগানো সমাপ্তি । চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষার ব্যবহার অনেক থাকলেও বুঝতে তেমন অ��সবিধা হয় না ।
আমার পড়া সেলিনা হোসেনের লেখা তৃতীয় বই এটি। ১২৫ পৃষ্টার এই বইয়ে এত কাহিনি থাকবে কে জানতো! বইটি পড়ার প্রায় পুরোটা সময় আমি উপভোগ করেছি, এবং ক্ষণে ক্ষণে রোমাঞ্চ বোধ করেছি।