কদম সারেং ভালবাসার নবিতনকে বিয়ে করে জাহাজের কাজে চলে যায়। অপেক্ষায় দিন কাটে নবিতনের। গ্রামের মোড়লের ষড়যন্ত্রে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়, দূরত্ব স্থান করে নেয় ভালোবাসার জায়গায়। তবে ফিরে আসে কদম, আবার ভালবাসে নবিতন, ভালবাসে কদম। কিন্তু সাগর পাড়ের জীবনে ছন্দপতন ঘটায় জলোচ্ছ্বাস, ছন্দ ফেরাতে চায় নবিতন। স্বামীকে বাঁচাতে নবিতনের নতুন স্নেহময়ী রূপ কি কদমকে বাঁচিয়ে তোলে নাকি দূরে ঠেলে দেয় নবিতনকে?
Shahidullah Kaiser (Bengali: শহীদুল্লাহ কায়সার) was born Abu Nayeem Mohammad Shahidullah. He is the brother of another famous Bengali author Zahir Raihan. Kaiser studied at Presidency College, Kolkata and obtained a Bachelors degree in economics with honours. Later, he enrolled in Masters of Arts at Calcutta University but did not finish getting the degree.
Kaiser was active in politics and cultural movements from his student days. Following the formation of Pakistan in 1947, he became a member of the provincial Communist Party of East Pakistan. He started working as a journalist in 1949 with the Ittefaq in Dhaka. In 1952, he participated actively in the Language Movement. For his political role in the movement for protection of Bengali language, Kaiser was arrested on 3 June 1952. He was later jailed for three and a half years. Right after his release in 1955, he was again arrested and jailed on a political crackdown on activists. A few years later he was released. In 1958, Kaiser joined as an associate editor of the Daily Sangbad - a Bengali language daily - where he worked for the rest of his life. When the Military coup of 1958 put Ayub Khan in power, and martial law was proclaimed, Kaiser was arrested again on 14 October 1958 and remained in jail for four years till his release in September 1962.
At the end the Bangladesh Liberation War of 1971, the Pakistan Army and its local collaborators initiated a plan for killing the leading Bengali intellectuals. As a part of it, Kaiser was rounded up on 14 December 1971. He never returned, nor was his body found. It is assumed that he was executed along with other intellectuals. His brother Zahir Raihan also disappeared while searching for Kaiser.
বানের জলে ভেসে গেল গ্রামের সবাই, শুধু মাত্র কদম সারেং আর নবিতুনই বেচে রইল!! আমার দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়টা একটু নাটকীয় হয়ে গেল। এমনটা হতেই পারতো ওরা দুজন ছাড়াও আরো কিছু মানুষ বেঁচে গেল।যাইহোক কোনভাবেই বইটিকে নূন্যতম পছন্দের তালিকায় ফেলতে পারছিনা না। খুব কষ্টে শিষ্টে শেষ করেছি। আসলে সব ভালো বই যে আমারও ভালো লাগবে এমনটা আশা করিও না। এর আগে লেখকের আরো দুটো বই পড়েছি। দুটোর অবস্থাই সেইম।
শহীদুল্লা কায়সার তখন রাজবন্দী। আছেন ঢাকা জেলে। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ এই চার বছর একটানা বন্দিশিবিরে ছিলেন। তখনই লিখেছেন এক মহাকাব্যিক উপন্যাস "সারেং বৌ"। মহাকাব্যিকতা আয়তন অর্থে নয়, বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং বাংলা উপন্যাসের বিচারে অভূতপূর্ব সমাপ্তি টানার জন্য। বলে রাখছি, "সারেং বৌ" চলচ্চিত্রের তুলনা বইটির সাথে দিয়েন না। ঔপন্যাসিকের চিন্তার ব্যাপ্তি সেলুলারে নিয়ে আসার মতো সংস্কৃতি সচেতন জাত এখনও হইনি। তখনও ছিলাম না।
নবিতুন সারেং কদমের বউ। সমুদ্র উপকূলের বামনছড়ি গ্রামের দরিদ্র সারেং কদম।আজ তিন বছর সে স্ত্রী - সন্তানের খোঁজ নেয় না। এই খোঁজ না নেয়ার যে চিত্র শহীদুল্লা কায়সার তুলে ধরে তাতে অনেকগুলো সামাজিক নির্ধারক আলোচনায় চলে আসে। বাংলার নারীর প্রতিভূ নবিতুন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে টিকে থাকতে সদাসংগ্রাম করতে হয়েছে।
নবিতুন এক দরিদ্র সারেংয়ের স্ত্রী নয়। সে প্রতিনিয়ত চৌধুরীদের, পালদের বাড়িতে কাজ করে। এভাবেই সে নিজে বেঁচে আছে। সে টিকিয়ে রেখেছে তার দশ বছর বয়সী মেয়ে আককি কে। ধনী প্রতিবেশী শেখের কুনজর এড়াতে কিনা করেছে নবিতুন। অথচ বহুদিন পর সারেং এসে তাকেই ভুল বুঝলো? সারেংয়ের মুখ দিয়ে একপর্যায়ে শহীদুল্লা কায়সার বলালেন,
" যেমন খানকি মা, তেমনি মেয়ে"
যেন মায়ের সব দোষ মেয়েতে বর্তালো। এ আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিরায়ত নিয়ম। অথচ সারেংয়ের কাছে নবিতুনের টিকে থাকার মূল্য কানা কড়িও নেই।কথার মূল্য নেই। অপরে নিজের বউ সম্পর্কে যা বললো তাতেই শতভাগ ভরসা সারেংয়ের। গর্ভের সন্তান নষ্ট হল। তবুও স্বামীর প্রতি অবিচল আস্থা নবিতুনের। এ কোন নারীর প্রতিকৃতি এঁকেছেন শহীদুল্লা কায়সার?
উপন্যাসের শেষপর্যায়ে যেভাবে নবিতুন বাঁচিয়ে তোলে কদমকে তা অভূতপূর্ব, অকল্পনীয়। তাতেও শহীদুল্লা কায়সার প্রমাণ করতে চেয়েছেন নারীজাতির জাগরণ নয়, তার মমতাময়ী রূপ। যে রূপ সাত চড়ে রা করে না, পতিকে পরমেশ্বর জ্ঞান করে। অথচ নিজে হয় নিপীড়িত। সে নিপীড়ক সমাজ, সে নিপীড়নকারী স্বামী উপাধিধারী পুরুষতন্ত্র।
সারেংয়ের জাহাজে চাকরির স্মৃতি আছে। সুপুরুষ সারেংও আছেন। তবুও সারেং বউ নবিতুনের উপন্যাসে ব্যাপ্তির কথা ভাবলে সারেং আক্ষরিক অর্থেই গৌণদের দলে চলে যান। পাঠক হিসেবে আমি বিস্মৃত হই তার সমুদ্রভ্রমণে সারেং জীবনের উজ্জ্বল - অনুজ্জ্বল কথকথা।
শহীদুল্লা কায়সার পুরো সমাজের চিত্র আনেন নি। তাঁর কিছু ব্যর্থতা চোখে পড়েছে। তিনি ষাটের দশককে ধরতে অসফল হয়েছেন। পাঠকের বোঝার সাধ্যি নেই কোন সময়ে ঘটছে ঘটনা। তিনি এড়িয়ে গেছেন সেই সময়ের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে। উপন্যাসে অনুপস্থিত ষাটের দশকের সেনাকবলিত রাষ্ট্র। ধর্মের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদনের পরোক্ষ নিদর্শনের হদিসও নেই উপন্যাসে। শুধু গ্রামীণ দারিদ্র্যতা, পুরুষতান্ত্রিকতার বিষে ভরা এক সমাজ আর এক নারীর সবকিছুকে ছাপিয়ে মহত্তম বোধ নারীত্ব যে নারীত্বের মূল অনুষঙ্গ পুরুষ - এই হল বামপন্থী চেতনায় বিশ্বাসী শহীদুল্লা কায়সারের বহুলপঠিত উপন্যাস "সারেং বৌ"। নিজে যে সমাজবিপ্লবে বিশ্বাস করতেন, সেই বিপ্লবী চিন্তাকেই বাদ দিয়ে দিয়েছেন শহীদুল্লা কায়সার তাঁর কালজয়ী এই উপন্যাস থেকে। উল্লেখ্য, ১৯৬২ তেই তিনি আদমজী পুরস্কার পেয়েছিলেন।
উপন্যাসের ভাষার দিকটির প্রশংসা না করে পারছি না। 'ভদ্রলোকের' ভাষায় আমার গ্রামের মানুষ কথা কয় না, মুখের ভাব মনে পুষে রাখে না। তারা যেমনটি করে কথা বলে লিখলে পাঠক বিশ্বাস করবে, ঠিক সেই ভাষাতেই লিখেছেন শহীদুল্লা কায়সার। গ্রামীণ মানুষদের মুখেও যেসব অতিকায়, মহাকায় কথাসাহিত্যিক বাবুবুলি তুলে দেয়, দিয়েছে তাদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারেন একাত্তরে হারিয়ে যাওয়া শহীদুল্লা কায়সার।
একটি জাতি, একটি দেশ তার সুযোগ্য মেধাবী সন্তানদের হাত ধরে অনেক দূর এগোতে পারে। ফেলতে পারে পৃথিবীর বুকে স্পর্ধিত পদভার। এই চরম সত্যিটা খুব জানা ছিল একাত্তরের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর। বাংলাদেশ নামের দেশটা, পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবার লড়াইয়ে যখন যুজছিল, ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে ১৪ ডিসেম্বর পাকিদের সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের তালিকায় ওঠে আসে জাতির মেধাবী সন্তানদের থোকা থোকা নাম। একাজে তাদের সাহায্য করে এদেশীয় কিন্তু পাকমন পিয়ারু রাজাকার আলবদর বাহিনীর কুলাঙ্গারেরা। কতো তীব্র ছিল সে জাতি বিদ্বেষ, ভাষা বিদ্বেষ, সেটা তাদের পাশবিক হত্যাযজ্ঞই বলে দেয়। এ বিষয়ে দ্বিমত নেই বাংলাদেশ তাঁর যে সুযোগ্য সন্তানদের হারিয়েছে তাঁদের মেধায়, প্রজ্ঞায় সে কতো বেশি ঋদ্ধ হতে পারতো। এ ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ হবার নয়।
বুদ্ধিজীবি হত্যার এ সারিতে বেশ ক'জন সুসাহিত্যিকও ছিলেন। শহীদুল্লাহ কায়সার তাঁদেরই একজন। যাঁকে আমরা বড্ড অবেলায় হারিয়ে ফেলেছি। খুব অল্প সংখ্যক সৃষ্টিকর্ম তিনি আমাদের দিয়ে যেতে পেরেছেন। যার মধ্যে "সংশপ্তক", "সারেং বৌ" উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তাঁর এসব সাহিত্যের প্রতি এখন পর্যন্ত আমরা ঠিক কতোটা সুবিচার করেছি? উত্তরটা চট করে মুখে ঠিক আসে না। অস্বস্তিতে পড়তে হয় খানিক। বলতে বিব্রতবোধ করছি, লজ্জিতও হচ্ছি। উল্লেখিত নাম দুটি যতোটা না একজন শহীদ বুদ্ধিজীবির সাহিত্যকর্ম হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত, তারচে' বেশি পরিচিত এগুলো স্যেলুলডের ফিতায় বন্দী হবার কারণে। আমাদের(অনেকের) ভাবখানা এমন যে চলচ্চিত্র এবং নাট্য মাধ্যমে এই দুই সাহিত্যকর্ম না আসলে তা বিস্মৃতির অতলেই থেকে যেতো। চলচ্চিত্র বা নাটকের বিষয়টা খাটো করতে একথা বলছি না মোটেও। কিন্তু সেকারণে যখন "সংশপ্তক" কিংবা "সারেং বউ" আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে স্হান পায় তখন কষ্ট লাগে। যেন ঠিক এ কারণেই ওঁর "রাজবন্দীর রোজনামচা" আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসতে পারেনি। আমাদের অনেকেরই জানা নেই(হয়ত) এর স্রষ্টাও শহীদুল্লাহ কায়সার! শহীদ বুদ্ধিজীবিদের সাহিত্য কর্মগুলোর যতোটা মনোযোগ, সযত্ন পাঠের প্রয়োজন ছিল আমরা সেখানটাতে অনেক পিছিয়ে। যদিও আমার মূল আলোচনা শহীদুল্লাহ কায়সারের পঠিত "সারেং বৌ" কে ঘিরে, এ কথাগুলো বলা এ কারণে ওঁর লেখালেখি বিষয়ে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে এই সত্যিটা পীড়াদায়ক ভাবে চোখে লেগেছে। সেটা এখানে বলে নেয়া খুব অবান্তর হলো না আশা করি। এ কথা মাথায় গেঁথে রাখা দরকার, আমাদের ভবিষ্যতের জন্য যাঁরা তাঁদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছেন, তাঁরা আমাদের সবোর্চ্চ মনোযোগ আর ভালোবাসার দাবীদার। লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে তাঁদের বেশি করে জানা এবং পাঠ করাটা খুব জরুরী।
"সারেং বৌ": শহীদুল্লাহ কায়সা�� -------------------------------------------- 'আইয়ূব খান জেলে পাঠিয়েছিলেন, তাই আমি সাহিত্যিক হতে পেরেছি।' এমন কথা যিনি বলেন, তাঁর সূক্ষ্ণ রসবোধ সম্পর্কে পাঠকের কোনো দ্বিধা থাকে না। যদিও উল্লেখিত উপন্যাসটি রসঘন কোনো বিষয় নিয়ে লিখা নয়। এটি দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের নাবিক এবং তাদের জীবনের সাথে জড়িত জনগোষ্ঠীর উণ্থান পতনের কাহিনি সমৃদ্ধ উপন্যাস। উৎসর্গে সে কথা লেখক চমৎকার ভাবে ব্যক্ত করেছেন।
বলাই বাহুল্য শহীদুল্লাহ কায়সার একটা দীর্ঘ সময় কারাগারে কাটান। বামরাজনীতিতে জড়িত থাকবার কারণে 'জন নিরাপত্তা আইন' এর ধুয়ো তুলে আইয়ূব সরকার তাঁকে নানান মেয়াদে কারাগারে আটকে রাখে। আট বছর কারাগারে অবস্হানকালে তিনি তাঁর সাহিত্য কর্মগুলোর বেশির ভাগই রচনা করেন সেখানে। উল্লেখিত উপন্যাস ''সারেং বউ'' ১৯৬১ সালে কারাগারে বসে রচনা করেন।
কাহিনির শুরুতে করাল নদী তীরবর্তী বামনছাড়ি গ্রামের সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটে। জানা হয় তার আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা কদুরখাল, মাদারটেক, পিয়ালগাছা ইত্যাদি আরো কিছু গ্রামের নাম। বামনছাড়ি গ্রামের সারেং বাড়ি নামে পরিচিত উত্তর হিস্যার 'একট্টু খানি বৃষ্টি হলে ঘর নড়বড় করে' এমন তরো এক ঘরের বাসিন্দা নবিতুন। নবিতুন এবং কদম সারেং এ উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্র। এদের ঘিরেই উপন্যাস এগিয়েছি নানান ঘটনার কথা বলতে বলতে। না , না, যা ভাবছেন তা মোটেও নয়। আমি মোটেও পুরো কাহিনি ফেঁদে আগ্রহী পাঠকের বিরক্তির কারণ হবো না। খুব সংক্ষেপে গপটা বলে দায়িত্ব সারবো।
পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, উত্তর হিস্যার কান টানলেই সুড়সুড় করে পূর্ব পশ্চিম ইত্যাদি হিস্যাও এসে যাবে! ঠিক ধরেছেন। সারেং বাড়ির মোট তিন হিস্যা। উত্তরের কথা তো বলেইছি। বাকি দুটি হলো পুব আর বড় হিস্যা(পশ্চিম হিস্যা না বলে একে বড় হিস্যা বলবার কারণ হলো এই ভাগে বড় দুটি ঘর, গোয়াল ঘর, ঢেকিঘর আছে)। যেখানে কদম সারেঙের আত্মীয় পরিজনেরা বসবাস করেন।
তো এই উত্তর হিস্যায় মেয়ে আককি কে নিয়ে কদম সারেঙের বউ নবিতুন থাকে। কদম আগে নিয়ম করে চিঠি টাকা পাঠালেও বেশ কিছু বছর তার কাছ থেকে নবিতুন না পাচ্ছে কোনো চিঠি, না টাকা। 'বারা বান্দনী'র কাজ করে মা মেয়ের কোনোভাবে দিন চলে যাচ্ছিল। কিন্তু ভূঁইয়ার হাটে ধান এবং গম ভাঙার কল বসায় সে পড়ে যায় বিপাকে। গ্রামের মানুষ জন কদমের দীর্ঘ অনুপস্হিতির কারণে আড়েঠাড়ে তাকে বোঝায় কদম মাঝি হয় মরে ভূতটি হয়েছে কিংবা কোনো বারাঙ্গনায় মজে গেছে। তুমি বাপু আবার বিবাহ করো! যেন বিবাহ ছাড়া নারীর একলা জীবন কাটানো পাপ! ইহা কিছু মানুষ, আর তার বানানো রীতিনীতি, এবং তা গ্রাম্য নীতি। হাজারো হুড়ো! তো এ হেন পরিস্হিতিতেও 'আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেলো'র হাহাকারে না গিয়ে বামনছাড়ি গ্রামের জনমত "যে দেয় কড়াল পাড়ি, বৌ তার দুপুরের রাঁড়ি"র মুখে ঝামাটি ঘষে 'সে তো আসবে, জানি আসবে' বিশ্বাস নিয়ে নবিতুন দিন পার করে। তার দুঃসময়ের সুযোগ নিয়ে গুজা বুড়ি লুন্দর শেখের খায়েশ মেটাতে এগিয়ে আসে তাকে বিবাহের কুপ্রস্তাব নিয়ে। নবিতুন, মেয়ে তো নয় যেন আগুনেরই গোলা। তাকে বশ করা এত্তো সোজা? সোজা কী বাঁকা জান্তে পাঠককে বইটি পড়বার অনুরোধ করে নবিতুনকে আপাততঃ এখানে ওর মতো ছেড়ে দিয়ে কদম মাঝির ঘটনায় এট্টু চোখ রাখি বরং.....
জাহাজে কাজ জোটানো সেসময়ে বেশ ঝক্কির ব্যাপার হলেও(কোলকাতায় গিয়ে নানান হ্যাপা সয়ে কাজের খোঁজ খবর নিতে হতো) কদম সারেঙের রক্তে সমুদ্রের প্রতি ছিল তীব্র টান। মজল সারেঙের ছেলে কদম সারেং তাই গ্রামের আর দশজন মানুষের মতো ক্ষেতি গেরস্তালির কাজ বা অন্যের জমিতে ভাগের চাষ করে জীবন কাটানোর পথে পা বাড়ায় না। এ জাহাজে, সে জাহাজে কাজ জুটিয়ে সে সমুদ্রে সমুদ্রে ভেসে বেড়ায়। আর সুদূর গ্রামে ফেলে আসা বউ নবিতুনের জন্য মন খারাপের প্রহর গিলে। এরই মধ্যে র্যাভেনপোর্ট বা রাবনপোতের জব্বর সারেঙের অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে কদম বিপদে পড়ে যায়। যার মাশুল হিসেবে তাকে প্রায় তিনবছর জেলের ভাত পর্যন্ত খেতে হয়। এতো সব হাঙ্গামাতেও কদম একমুহূর্তেও জন্যেও নবিতুনকে মনছাড়া করেনা। বন্দরের রঙ্গিলা নারীও তার সে ধ্যান ভাঙাতে ব্যর্থ হয়। দীর্ঘ একটা সময় বউ আর মেয়েকে না দেখতে পাওয়ার অনুশোচনা তাকে দগ্ধ করে। জেল থেকে বেরিয়ে কদম রুতুন্দা জাহাজের ছোট সারেং হিসেবে কাজ জোটায় এবং হাতে কিছু টাকা পয়সা জমলে গ্রামে বউ মেয়ের কাছে আসে।
ততোদিনে নবিতুনের অবস্হা অতি শোচনীয়। অন্যের বাড়িতে কাজ জুটিয়ে অন্ন সংস্হানের অর্থাৎ নবিতুনের সাবলম্বী থাকার নিরন্তর লড়াইটা মোটেও ভালো চোখে দেখে না প্রত্যাখিত লুন্দর শেখ। কদমের আত্মীয় (বুড়া কাজিম) কাজিমদ্দির মাধ্যমে বিষয়টাকে আরেট্টু জটিল করার কূটচাল চালে। এ রকম একটা সময়ে কদম শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে গ্রামে ফিরে আসে। বউ আর মেয়ের শতছিন্ন অবস্হা দেখে হতবাক হয়। যাইহোক, বেশ কয়েক মাস তারা সুখে শান্তিতে থাকে। নবিতুনের সুখ দেখে গ্রামের কারো চোখ টাটায়, কারো জুড়ায়। এখানে একটা বিষয় একটু (হয়ত)গড়বড় লাগবে পাঠকের। কারণ কদম বা নবিতুন(বিশেষত নবিতুন) ..কেউ ঝেড়ে কাশে না। বলে না টাকা চিঠি পাঠাও নাই কেন? কিংবা টাকা পাঠাইছি পাও নাই! যে কারণে নবিতুনের দুর্দশার জন্য দায়ী কালপ্রিটটি আসলে কে সেটি জানতে পাঠকের সময় লাগে। লেখক ঘটনায় মোচড় দেবার জন্যই এমন ধন্দের আশ্রয় নিয়েছেন সেটা বোঝা যায় কাহিনির শেষ পর্যায়ে এসে। যখন একই সাথে বাইরের প্রকৃতি আর ঘরের ভেতরের মানুষ নবিতুন-কদম ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ পরিস্হিতিতে বেসামাল। ততোদিনে নবিতুন আরো একবার সন্তান সম্ভবা হয় এবং দাম্পত্যের ভুল বোঝাবুঝির জের হিসেবে সে সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য হারায়। কাহিনির পরিসমাপ্তিতে দেখি জলচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে গ্রাম, মানুষ পরিজনেরা। বিস্তৃর্ণ জলোরাশি আর কাদায় মাখামাখি অবস্হায় নবিতুন খুঁজে পায় তার চিরসখা কদম সারেং কে। কিন্তু সে কী পিপাসার্ত কদমকে বাঁচাতে পারে? সেটা জানতে পাঠককে অবশ্যই "সারেং বৌ" পড়তে হবে। এইখানে এসে নবিতুনকে একবারের জন্যেও তার মেয়ে আককির খোঁজে কাতর হতে দেখি না। যা বেশ অবাক করে। মাতৃত্ব হেরে যায় চিরন্তন প্রেমের কাছে। লেখক এখানে অতি সাহসী একটি ঘটনার অবতারনা করেছেন। যা তৎকালীন মুসলিম সমাজের জন্যেই শুধু না; এখনকার অতি আধুনিক মানসিকতার মানুষও বিষয়টা অবতারনা নিয়ে বেশ করে ভাবতে বসবেন। ঘটনা কয়ে দিলে মজা নষ্ট হবে বলে তোলা থাক বরং সে রহস্যটুকু। শুধু বলি, যারা জন স্টেইনবেকের(John Steinbeck) বিখ্যাত উপন্যাস "The Grapes of Wrath" পড়েছেন তারা "সারেং বৌ" এর সে ঘটনার সাথে স্টেইনবেকের উপন্যাসের প্রধান চরিত্র টম জোডের বোন রোজ অফ শ্যারণের বন্যা পীড়িত একজন মুমূর্ষু মানুষকে বাঁচানোর তাগিদে কৃত কাজটির সাথে বেশ একটা মিল খুঁজে পাবেন হয়ত। পাপী মনে প্রশ্ন জাগে ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত স্টেইনবেকের এই উপন্যাস কোনো ভাবে কী শহীদুল্লাহ কায়সারের মনে প্রভাব ফেলেছিল? শহীদুল্লাহ কায়সারের "সংশপ্তক" উপন্যাসের জাহিদের মধ্যেও কোথাও যেন "The Grapes of Wrath" টম জোডের গোঁর্য়াতুমি ছোঁয়া পাই। হতে পারে লেখক স্টেইনবাকের ভক্ত ছিলেন, তাঁর প্রভাব বলয়ে ছিলেন হয়ত। কিন্তু সে উত্তর এখন আর পাওয়া সম্ভব না।
"সারেং বৌ" শুধু গ্রামীন জীবনের টানাপোড়েন বা সুখ দুঃখের উপন্যাস নয়। এতে লেখক বেশ কিছু সমুদ্র পথের মনোজ্ঞ বর্ণনা দিয়েছেন। জাহাজের বিভিন্ন কাজ এবং তার পদবী সংক্রান্ত কিছু বর্ণনা আছে। সমুদ্র বা জাহাজী জীবনের প্রতি যাদের আগ্রহ আছে তারা নিঃসন্দেহে তা উপভোগ করবেন। আছে জাহাজে কর্মরত বিদেশি সাহেবদের বর্ণিল জীবনের গল্প। আছে ভাস্কোদাগামা, ম্যাপ বা নেভিগেশন সংক্রান্ত উপভোগ্য বর্ণনা। তাছাড়া গ্রামীন জীবনের কিছু অপ্রচলিত শব্দ তার অর্থ যেমন ঢেকির নানান অংশের নাম এবং তার ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে পাঠক জানতে পারবেন। সাদামাটা ভাষায় লিখিত "সারেং বৌ" জীবনকে জয় করে সামনে এগিয়ে যাবার গল্প বলে আমাদের; যা পাঠকের জন্য আনন্দ পাঠ হবে বলেই বিশ্বাস। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন পটুয়া কামরুল হাসান,এটি পাঠকের জন্য একটি বাড়তি পাওনা।
এই গান শুনেনি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। সারেং বৌ সিনেমার এই গান বাংলার সব ঘরে ঘরে পৌছালেও সারেং বৌ বইটি যেতে পারে নাই। আফসোস।
এতো ছোট একটা বই কিন্তু উঠে এসেছে কতো কিছু! গরীবের প্রতি ধনীর শোষন, নিপীড়ন, অত্যাচার, অবিচার, গ্রাম্য কুটিলতা, অমল প্রেম, অপেক্ষা কত কিছুকে নিয়ে এসেছেন লেখক ছোট একটি বইয়ে। গল্পের মূল দুই চরিত্র নবিতুন আর কদম। কদম সারেং বিনা দোষে জেলে গেলে একাকী নবিতুন গ্রামের ক্ষমতাধরদের অত্যাচার আর কুদৃষ্টিকে প্রতিরোধ করে টিকে থাকে। বেচে থাকার একাকী সংগ্রামে সে স্বপ্ন দেখে তার কদম একদিন ফিরে আসবে, তার গায়ের সাথে সে লতার মতো নিজেকে পেচিয়ে রাখবে, ভুলে যাবে জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট। অন্যদিকে কদম সারেংও সমুদ্রের বুকে তার নবিতুনের তৃষ্ণা বুকে নিয়ে ছুটে চলে, পুরো পৃথিবীর যাবতীয় আকর্ষন তাকে টানে না, টানে শুধু নবিতুনের ভালোবাসা, নবিতুনের স্পর্ষ, সে ফিরে যেতে চায় নবিতুনের কোলে, মেয়ে আককির বাহুবন্ধনে।
অবশেষে সারেং ফিরে আসে, নবিতুনকে ফিরে পায়, আবার একইসাথে সমাজের কুটিলতার স্বীকার হয়ে অবিশ্বাস করে নবিতুনকে এবং এর পরই আসে প্রলয়ঙ্কারী জলোচ্ছ্বাস। মৃত্যু এবং জীবন। কদমের নতুন জীবন, কদম নবিতুনের নতুন সংসার। জলোচ্ছ্বাসের কারণে সকল মানব সম্প্রদায়ের মৃত্যু এবং শুধু গল্পের নায়ক নায়িকার বেচে থাকাটা খুব বেশি নাটকীয় লেগেছে। এই নাটকীয়তা আনার পেছনে লেখকের অন্য কোন ভাবের প্রকাশ হয়তো আছে, আমি বুঝতে পারিনি। লেখক সমাজতান্ত্রিক আন্দলনের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। কদমকে নবিতুনের বাচিয়ে তোলার মাঝে হয়তো লেখক দেখিয়েছেন বিশ্বসংসারে নারীর মহত্বের কথা এবং সকল মানব সম্প্রদায়ের নিশ্চিহ্ন করার মধ্যে দিয়ে হয়তো নতুন সমাজ গড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন, যেখানে সামাজিক বৈষম্য থাকবে না, কদম আর নবিতুনের থেকে জন্ম নিবে নতুন মানব সভ্যতা। (লেখক গল্পে কদম আর নবিতুনকে বিশুদ্ধ মানব মানবী রূপে দেখিয়েছেন, শারীরিক এবং চারিত্রিক গুণাবলির দিক থেকে দুজনই উৎকৃষ্ট)। যাদের পরবর্তী প্রজন্ম হবে কদম আর নবিতুনের মতই শারীরিক এবং চারিত্রিক গুণাবলিতে উৎকৃষ্ট।
পুরো গল্পে একটা রোমান্টিক আবহ থাকলেও শেষটা কেমন যেন হয়ে গেলো। বইটাকে এখন আর রোমান্টিক মনে হচ্ছে না। ছোট একটা পরিসরে লেখক অনেক বড় কিছু দিয়েছেন বা দিতে চেষ্টা করেছেন।
"পূর্ব বাংলার লেখকের বই কেউ পড়ে না, সবাই চায় কলকাতার বই।"
ভূমিকায় লেখা লেখকের প্রথম লাইন এটি। আজ থেকে ৪৯ বছর আগে লেখা বইটির এই বক্তব্য আজ কতখানি বদলে গেছে?
হুমায়ূন আহমেদের উপস্থিতি বাদ দিলে সম্ভবত খুব বেশি বদলায়নি। আজও আমাদের দেশের ষাট সত্তরের কিংবা তারও পরের অধিকাংশ লেখকের বই যথেষ্ট মান সম্মত হওয়া সত্ত্বেও একরকম অনাদরেই পড়ে আছে। তাদের সৃষ্টি সম্পর্কে আমাদের জানার তাগিদ কিংবা ইচ্ছা দুটোই অনেক কম।
তাই ১৯৪৭-৭০ এ বাংলাদেশী লেখকদের সেরা বইগুলো পড়ার পরিকল্পনা করেছি। তার বাস্তবায়নের অংশ স্বরূপ লেখক শহীদুল্লা কায়সারের সারেং বৌ বইটি পড়লাম।
সারেং বৌ বইটিতে এদেশের শেকড়ের কথা বলা হয়েছে। সেই আদি ও অকৃত্রিম লড়াই করে বেঁচে থাকার দীপ্ত চেহারা।
সারেং বাড়ির উত্তরের হিস্যার সারেং কদম স্ত্রী নবিতুনকে রেখে চলে যায় সেই সাগরের বুকে। তারপর দিন যায়, বছর যায়, কদম ফেরে না। আসে না কোন অর্থ কড়ির সাহায্য। একমাত্র মেয়ে আককিকে নিয়ে জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
বাড়িতে কোন পুরুষ নেই কিন্তু নবিতুনের দেহে এখনো যৌবনের ছোঁয়া। তাই আসে প্রলোভন। শেখ বাড়ির লুন্দর শেখ নানা রকম অপকৌশল প্রয়োগ করতে থাকে নবিতুনকে হস্তগত করতে। কিন্তু কোন ফাঁদে, কোন প্রলোভনে পা দেয় না নবিতুন।
অগত্যা না পেরে লুন্দর শেখ জোর করে নবিতুনকে পেতে চায়। কিন্তু নবিতুন যেন আগুনের ফুলকি। নিজেকে ঠিকই রক্ষা করতে জানে সে। পরাজিত লুন্দর শেখ পালিয়ে যায়।
অপেক্ষা চলতে থাকে। সারেং আসবে। শেষ হবে কষ্টের দিন। একটা সময় সারেং বৌ নবিতুনের কদমের জন্য অপেক্ষা যেন পাঠকের অপেক্ষায় পরিণত হয়। নবিতুনের সাথে পাঠকও অপেক্ষা করে সারেং ফিরবে নবিতুনের কাছে। সারেং কি ফিরে আসে? নাকি সে ভুলে গেছে নবিতুনকে?
ভাঁটি অঞ্চলের অদ্ভুত সুন্দর চিত্রায়ণ করেছেন লেখক। কয়াল নদীর মাঝে না দ্বীপ না গ্রাম বামনগাছি যেন চোখের সামনে এনে দেন আত্র ১২৮ পৃষ্ঠার বইটিতে। আছে নাবিক জীবনের অজানা অনেক আবেগের কথা। দীর্ঘশ্বাসের কথা। সমুদ্রের মান অভিমানের কথা।
সবমিলিয়ে বইটি বাংলা সাহিত্যের অসামান্য অবদানগুলোর একটি।
বাংলা সাহিত্যের জন্য এক অতুলনীয় সম্পদ।কি অদ্ভুত সুন্দর!কি নির্মম বাস্তবতা!কি নিপুণ লেখনী!বিশেষ করে উপন্যাসের শেষটা আমাকে ভাবাবে আরও কয়েক দিন কারণ তা গেঁথে গেছে মনের একদম গভীরে। এই উপন্যাস নিয়ে ডিটেলড রিভিউ লেখার ক্ষমতা আমার আছে বলে মনে হয়না।পড়ুন,সত্যিকারের সাহিত্যকে ভালোবাসুন!
বিদ্রঃ উপন্যাসের মাঝখানে নবিতুনের প্রতি কদমের আচরণ নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ, তবে সময়কাল ভুললে চলবেনা।সেই সময়ের সামাজিক বাস্তবতা, গ্রাম্য মানুষের মানসিকতার সাথে আজকের প্রেক্ষাপট মেলানো মূর্খতা। সেই টক্সিক পুরুষতান্ত্রিকতার কিছুটা কাটিয়ে উঠেছি আমরা, দিনে দিনে এ পরিবর্তন আরও অগ্রসর হোক সেই আশাই রাখি!!
বাংলাদেশের নারীর কষ্ট, ত্যাগ, দৈনন্দিন যুদ্ধ নিয়ে তো অনেক লেখা আছে, কিন্তু কই নবিতুনের মতো সাহসী নারীর কথা লিখেছেন কয়জন? ঝড়-ঝঞ্ঝার দেশের মানুষের লড়াইয়ের কথা তো আছে, কিন্তু সেই লড়াই শেষে আবারও মাথা তুলে উঠে দাঁড়াবার গল্প কয়জন বলেছেন?
বাংলাদেশের সাহসী নারী-পুরুষদের বারবার জেগে ওঠার গল্প লিখতে যেন শত বছর বিলম্ব হয়, যেন সে সাহস সঞ্চারিত হতে না পারে জনপদে, যেন শুধু ঋণাত্মক আর সাহস ভেঙে দেওয়ার গল্পই বলা হয়, সেই মাস্টারপ্ল্যানেই তো শহীদুল্লাহ কায়সারদের-কে হত্যা করা হয়েছিলো।
সফল সেই দুরভিসন্ধি। এরকম গল্প আর কেউ যে লিখতে সাহস পায়নি, তা তো পরিষ্কার!
বাংলাদেশের শক্তিশালী নারী চরিত্রের মধ্যে নবিতুন অন্যতম।গ্রামের কামুক লালসাযুক্ত মানুষগুলোকে ঠেকিয়ে রাখা ও নিজে খেয়ে পড়ে বেচে থাকা, যুদ্ধ বই কম কিছু না। কিন্তু কদমের নৃশ্নংসতা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি।লোকের কাছে বউ এর নিন্দে শুনে গর্ভবতী স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া আমার কাছে মানুষ হত্যার থেকেও বড় পাপ।
আমার ছোট বেলাটা কেটেছে গ্রামে। নানান কারণে আমাদের শহরে আসতে হতো। শহরে আসতে ডিঙিয়োতে হতো কর্ণফুলী। তখন দেখতাম কর্ণফুলীর বুকে ভেসে আছে অনেক জাহাজ। ভাবতাম এত বড় বস্তু কিভাবে ভেসে থাকে! এর ভেতরেই বা থাকে কারা! বড় হয়ে জানতে পারলাম জাহাজের ইতিহাস। আর জানলাম এর ভেতরে কারা থাকে,কারাই বা এটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
সারেং,যারা জাহাজ চালায়।
তেমনি একজন সারেং কদম আর তার বউ নবিতুন। গল্পটা নবিতুনের। একজন বাঙালি নারী একাকী জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার গল্প। সাথে সমুদ্র প্রেমী কদমের গল্প। অদ্ভুত একটা গল্প। এই গল্পের রিভিউ করার মত যোগ্যতা আমার হয়নি,আমি শুধু নিজের অনুভূতিটুকু বলব।
কোন লেখা পড়ার সময় যে বিষয়গুলো প্রথমেই আমার নজর কাড়ে সেটা হচ্ছে শব্দ আর বাক্য। এত চমৎকার ভাবে শব্দ বসিয়েছেন লেখক,মনে হয় যেন সমুদ্র সেঁচে মুক্তো এনে বসানো হয়েছে। এতই চমৎকার ছিল। কি চমৎকার সমুদ্রের বর্ণনা,গ্রামীণ জীবনের বর্ণনা। এত নিখুঁত লেগেছে আমার। দূর্দান্ত। এই বইয়ের রেশ কাটবে না। এসব বই বার বার পড়তে হয়।
বামনছড়ি, সমুদ্রে তীরবর্তী একটি গ্রাম। এখানে জীবিকার একমাত্র উৎস হলো হালচাষ অথবা সমুদ্রের নাবিকের। নবিতুন, সেই গ্রামেরই এক সারেং এর বউ।তাঁর স্বামী কদম সারেং। কদম দের বাড়ী টাকে গ্রামের মধ্যে সারেং বাড়ী বলা হতো। মূলত সেই সময়ে নাবিকদের বা সমুদ্রে যাঁরা জাহাজের কাজ করতেন তাঁদের সারেং বলা হতো।
পেশা যেহেতু সারেং তাই কদমকে বছরের পর বছর জাহাজে করে বন্দরে বন্দরে ঘুরতে হতো। বাড়ীতে চিঠি এবং খরচের টাকা ঠিকই পাঠিয়ে দিত। তবে সারেং বাড়িতে বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনতো সারেং বৌ নবিতুন। বছর শেষে বাড়ীতে না ফিরলেও টাকা এবং চিঠি ঠিকই পাঠিয়ে দেয় কদম। কিন্তু হঠাৎ করে ৩ বছর চলে গেলো কদম না ফেরে বাড়ীতে না আসে চিঠি ও টাকা।
শহীদুল্লা কায়সারের বিখ্যাত উপন্যাস "সারেং বৌ"। দেশের নিদিষ্ট এক এলাকার নিদিষ্ট এক পেশার লোকদের নিয়ে লেখা হলেও সেই সময়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা স্পষ্ট। মানুষের জীবনযাপন ও সামাজ ব্যবস্থা সুন্দর ভাবে উঠে এসেছে।
কিছু বইকে রিভিউ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না, কোন বিশেষণ পারে না বিশেষায়িত করতে। যা স্তব্ধ হয়ে বসে ভাবতে বাধ্য করে, আনমনা হয়ে হরিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় দূর কোনো অজানায়।
সারেং বৌ নবিতুন। যার স্বামী জাহজের কাজে বেড়িয়ে যেয়ে অনেক বছরে পিরে আসে না। গ্রামের মানুষের নারী লোলুপতা, ষড়যন্ত্রকে জয় করে নবিতুনের সংগ্রাম, টিকে থাকা। সারেং-এর আশায় মাঠের ওপারে পথটায় চেয়ে থাকা। সব যেন নিজের অস্তিত্বকে জাগিয়ে তোলার আহবান।
দূর অজানায়, সারেং তার প্রিয়তমার মুখ কল্পনা করে। কিন্তু পরিষ্কার হয়ে উঠে না। প্রিয়তমার দুমড়ে মুচড়ে পরা চিঠি সযত্নে নিজের কাছে তুলে রাখে। আর ভেতরে এক বুক আশা জমিয়ে রাখে ফিরে যাবার।
'ডাঙার মাটি যে ওদের কেমন করে টানে সেটা হয়তে বোঝে না ঢাকার মানুষ। ডাঙার মানুষ বোঝে না জলের মানুষগুলোর বুকে কত দীর্ঘশ্বাস। বোঝে না নীড় বাঁধা ডাঙার মানুষ, ডাঙার মানুষের একটুখানি হৃদ্যতা, একটুখানি মমতার জন্য কেমন কঙ্কালের মতো লালায়িত জাহাজি মানুষ।'
শহীদুল্লা কায়সার তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী। সারেং বৌ তখনকার লেখা। লেখক সক্রিয় ছিলেন বামপন্থী রাজনীতিতে। কিন্তু তাঁর লেখায় তখনকার সমাজ রাষ্ট্র ব্যবস্থার ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময়ের কথা তুলে আননি। তুলে এনেছেন সমুদ্রের কোল ঘেঁষে বাস করা নবিতুন, সারেং এর মতে হাজারো মানুষের আশা, ভয়, দীর্ঘশ্বাস এবং নবজন্ম।
এসব বই পড়ার পর বুকের ভেতরটায় আশ্চর্য রকম শূন্যতার সৃষ্টি হয়। শূন্যতাটা আঁকড়ে ধরে রাখা যায় না এমনকি ছুঁড়েও ফেলা যায়। অসাধারণ!
বামনছাড়ির সারেং বৌ নবিতুন। কুটনার কুমন্ত্রণা, বালাখানার প্রলোভনের মুখে যে ছিলো শক্তিমতি নারী। শত বাধা বিপত্তিকে অগ্রাহ্য করে, নিজের অস্তিত্ব প্রতিকূলতার মধ্যে না বিলীয়ে কীভাবে নিজের ঋজুভাব ধরে রাখা যায়, তার সেরা প্রতিফলন নবিতুনের মধ্যে দিয়েই যেনও লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। এত সাহসী নারী চরিত্র, আমি দ্বিতীয়টি দেখি নি। নিশ্চিত ধর্ষণের হাত থেকেও নিজের প্রত্যুৎপন্নমতির জোরে কীভাবে নিজেকে বের করে আনা যায়, এও এক আশ্চর্যের প্রতিফল ঘটিয়েছে লেখক, নবিতুনের মধ্যে দিয়ে। স্বামীর তিতিক্ষায় অনন্তকাল কাটিয়ে দিলেও বোধহয়, এই নারীসত্ত্বা নিজেকে অন্যের কাছে অস্তিত্ব সংকট নিরসণের জন্য বিকিয়ে দিত না, বরং যোদ্ধার মত নিজের উপায় নিজেই জোগাড় করে নিয়েছে।
সকল পুরুষই হয়তো, তার স্ত্রীর / প্রিয়তমার মাঝে নবিতুনের প্রগাঢ় চরিত্র বারংবার খুঁজতে চাইবে। কারণ ইহাই ভালোবাসার ও মায়া মমতার এক চূড়ান্ত আত্মিক বন্ধনের প্রতিফলন।
কদম সারেং এর মাধ্যমে লেখক একাধারে সৎ, সজ্জন কিন্তু পরকথায় স্ত্রীর প্রতি বিরাগী ও নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয়ে থাকবে আজীবন। 🧡
অসাধারণ, ১৯৭১ এর যুদ্ধে দেশের সকল বুদ্ধিজীবীরাই শেষ হয়ে গেলেন। এতো প্রতিভাবান কেউ কিভাবে হয়?🙂উনার সংসপ্তক পড়েও একবার মোহ তে পড়েছিলাম, সারেং বৌ পড়েও এতো ভালো লাগলো বলার মত না।
বড্ড বেশি সময় নিয়ে নিলাম পড়তে। বইটা শেষ করার সাথে সাথেই শহীদুল্লা কায়সার নামের মানুষটিকে অসময়ে হারিয়ে ফেলার এক বিশাল দুঃখ গ্রাস করে বসেছে।
বইটা নিয়ে খুব বেশি কিছু বলবো না। এ বই নিয়ে মন্তব্য করার পরিপক্বতা সম্ভবত এখনো হয় নাই! শহীদুল্লা কায়সারের বই এই প্রথম পড়েছি, তাঁর লেখার ধরণ প্রথম দিকে কিছুটা অপরিচিত মনে হলেও সহজেই পরিচিত হয়ে গিয়েছি এবং খুব দ্রুত তাতে ডুবে গিয়েছি। অসাধারণ একটি বই। অসাধারণ।
কি এক কারণে বইপড়া বহুদিন আটকে থাকলো। তারপরে পড়া প্রথম বই সারেং বৌ। পড়ার পর থেকে মনের ভেতরটায় অনেক রকম অনুভূতি এলোপাতাড়ি তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে! আর সবার চোখে কদম সারেং কেমন জানিনা, তবে আমার চোখে ভীষন অবহেলা বয়ে বেড়ানো একজন মানুষ তিনি! তিনি দরিয়ার বুকে পরিবারের কথা ভেবে উদাস হন অথচ পরিবারে থিতু হন না, পরিবারকে ভালোবাসেন কিন্তু পরিবারে থাকতে ভালোবাসেন না। গ্রামের পোস্ট মাস্টার ও লুন্দর শেখের যোগ সাজসে অল্পেই নেমে আসে কদম-নবিতুন দম্পতির সংসারে অশান্তি। ঘটনার আকস্মিকতায় গর্ভবতী নবিতুনকে আঘাত করে বসেন সারেং। সে ব্যাথায় কাতরালেও চেয়ে দেখেননি, মৃত সন্তানকে ভাসিয়ে দিতে চান অকূল সমুদ্রে! সারেং এর প্রতি আমার যে চরম বিরূপ মনোভাব তৈরী হয়েছে সেখানেই লেখকের অন্যতম সার্থকতা বিরাজ করছে।
অথচ নবিতুন! বাবার ঘরে আদরে মানুষ হলেও সংসারে কি সহ্য করতে হয়নি তাকে! দারিদ্র, গঞ্জনা, পাড়ার লোকের কুদৃষ্টি সহ কতো কি! তবুও সে মাথা নোয়ায়নি। স্রোতে হারিয়ে যায়নি। দশ বছরের মেয়ে আককি কে নতুন শাড়ী কিনে দিতে দ্রুত হতে জাল বুনেছে। দু বেলার অন্ন জোগাড় করতে চৌধুরী বাড়িতে নিয়েছে ঝি এর কাজ, বিক্রি করেছে প্রাণপ্রিয় সংসারের খুঁটিনাটি! দাস-দাসী, গহনা, টাকাপয়সার আতিশয্যের লোভ দেখিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত গায়ের জোরেও তাকে ভোগ করতে পারেনি উপন্যাসের কুট চরিত্র লুন্দর শেখ। সে শুধুই আশায় পথ চেয়ে থাকে, কবে আসবে সারেং? তার কদম সারেং।
প্রবল তুফানের মুখে পড়ে পুরো গ্রাম যেখানে ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়; এখানে ওখানে ভেসে বেড়ায় মৃত ও বিকলাঙ্গ গৃহপালিত পশুপাখির সাথে বিবস্ত্র মানুষের লাশ সেখানে মাথা তুলে আবার দাঁড়িয়েছে নবিতুন। বাঁচিয়েছে তার মৃতপ্রায় সারেং এর জীবন! উপন্যাসের এই অংশে লেখক অবতারণা করেছেন এক অতি আশ্চর্য ঘটনার, যা বর্তমান আধুনিক সমাজেও সহজে মেনে নিতে কুণ্ঠাবোধ হয়।
লেখক এক লাইনে প্রাত্যহিক জীবনের এক দুর্দমনীয় সত্য তুলে ধরেছেন গ্রামবাসীদের মাধ্যমে। সারেং চার বছর বাদে বাড়িতে আসার পর খুশিতে ঝলমলে নবিতুন নতুন শাড়ী পরে চুড়িতে সুর তুলে যখন গৃহস্থালীর কাজ করে বেড়ায় তখন গ্রামের প্রতিবেশীরা আসে একে একে। যারা কখোনোই নবিতুনের দুঃসময়ে পাশে আসেনি উল্টো প্রতিনিয়ত তার উদ্দেশ্য ছুড়ে গেছে কুবাক্যবাণ। তারা এসে অবাক চোখে পরখ করে নবিতুনকে। এই পর্যায়ে লেখক বলেছেন, "নবিতুনের সুখ দেখে যেনো ওদের নিজেদের দুঃখের কথা মনে পড়ে যায়।"
এই উপন্যাসে আরো আছে গভীর সমুদ্রে জাহাজবাসীর জীবনের বর্ণনা। যার রঙিন ও সাদাকালো দু দিক ই সমান সুন্দরভাবে ভেসে ওঠে মনে। আছে ম্যাপ, নেভিগেশনের টুকিটাকি। আরো আছে ভাস্কো দ্যা গামার ভারত আবিষ্কারের কথা। মোদ্দাকথা, এই উপন্যাস পাওয়া যাবে চিরায়ত বাংলার দৃশ্য, সাগরে ভেসে বেড়ানোর টুকটাক কিন্তু স্পষ্ট ছবি এবং জীবনে এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা। The Survivors❤️
This entire review has been hidden because of spoilers.
বইঃ সারেং বউ লেখকঃ শহীদুল্লা কায়সার ধারনঃ চিরায়ত উপন্যাস প্রকাশনীঃ ণওরোজ সাহিত্য সম্ভার পেজঃ ১৪৯ মুল্যঃ ১৫০ টাকা
নারী শুধু ইঙ্গিত, সে প্রকাশ নয়। নারীকে আমরা দেখি, বেলাভূমে দাঁড়িয়ে – মহাসিন্ধু দেখার মতো। তীরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের যতটুকু দেখা যায়, আমরা নারীকে দেখি ততটুকু। সমুদ্রের জলে আমরা যতটুকু নামতে পারি, নারীর মাঝেও ডুবি ততটুকুই।… সে সর্বদা রহস্যের পর রহস্য-জাল দিয়ে নিজেকে গোপন করছে – এই তার স্বভাব। শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ - যাই হোক না কেন নারীকে লড়ে যেতে হয় সব খানে, সব সময়। তবু নারীই পারে সব সংস্কারকে পায়ে দলে জীবনের জয় ঘোষণা করতে।পুরুষশাসিত সমাজে নারীর এই বেঁচে থাকার এবং নতুন সমাজ গড়ার পথে এগিয়ে যাওয়ার গল্প বলে ‘সারেং বউ’।
নোয়াখালির উপকূলীয় অঞ্চলের এক নারীর জীবনযুদ্ধের দলিল 'সারেং বউ'। বামনছড়ি গ্রামের এমনি এক নাবিক বাড়ী, ওরা বলে সারেং বাড়ী। সারেং বাড়ীর সারেং বউ নাম তার নবীতুন। উপকূলীয় এক গ্রামের সহজ সরল মেয়ে নবিতুন। এক বৃদ্ধ সারেংয়ের মেয়ে সে। নবীতুনের স্বামী সারেং কদম।
নবিতুন চায় জাহাজের চাকরি ছেড়ে গ্রামেই কৃষিকাজ করুক কদম। কিন্তু নাবিকের রক্ত বইছে কদমের ধমণীতে। সমুদ্র তাকে ডাকে। সেই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারে না কদম। নতুন বউ ফেলে জাহাজের চাকরিতে চলে যায় সে। যাবার আগে বাড়ির আঙিনায় সে একটি বড়ই গাছের চারা লাগিয়ে রেখে যায়। সেই গাছটি বড় হতে থাকে। সেই গাছের দিকে তাকিয়ে স্বামীর ফেরার পথ চেয়ে থাকে সারেং বাড়ির বউ নবিতুন। জন্ম হয় তাদের মেয়ের। বাবার স্নেহ ছাড়াই বড় হয়ে উঠতে থাকে মেয়েটি।
বিদেশ থেকে কয়েক মাস টাকা ও চিঠি পাঠায় কদম। গ্রামের মোড়ল লন্দুর চোখ পড়ে সুন্দরী নবিতুনের দিকে। নবিতুন তাকে পাত্তা দেয় না। বরং অপমান করে। কুপ্রস্তাব দিয়ে এক ‘গুজা বুড়ি’কে বারে বারে পাঠায় মোড়ল। তাকে তাড়িয়ে দেয় নবিতুন। পোস্টমাস্টারকে হাত করে কদমের পাঠানো টাকা ও চিঠি লুকিয়ে ফেলতে থাকে মোড়ল। চরম অভাবে পড়ে নবিতুন। মোড়ল মনে করে দরিদ্র নবিতুন এবার হয়তো তার কুপ্রস্তাবে রাজী হবে। সত্যি কি রাজি হবে নবীতুন? নাকি সংগ্রাম করে টিকে থাকবে?
প্রতিনিয়ত কুটনীর কুমন্ত্রণার সঙ্গে, ক্ষুধার সঙ্গে, দারিদ্র্যের সঙ্গে, অনিশ্চয়তা আর প্রলোভনের সঙ্গে যুদ্ধ করে। গ্রামের নির্জন অন্ধকার পথে লুন্দর যখন নবিতুনকে পাট ক্ষেতে নিয়ে লালসার শিকারে পরিণত করতে চায়, তখনও সে সাহস বা উপস্থিত বুদ্ধি কোনোটাই হারায় না। জ্বলে উঠে স্ফুলিঙ্গের মতো, সে আগুনের কাছে পরাজিত লুন্দর মার খাওয়া পশুর মতো পালিয়ে যায়।
জাহাজের অনেক নাবিক নানা রকম অপরাধের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে চোরাচালানী করে অনেকেই ধনী হয়, অনেকে ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কদম সৎ মানুষ। সে এসব অপরাধের সঙ্গে জড়ায় না। তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী, বাবার বন্ধু মন্টু সারেং অবৈধ পাচারের সঙ্গে জড়িত। গোপনে সে কদমের পকেটে অবৈধ দ্রব্য রেখে দেয়। যাতে তার মাধ্যমে বন্দরের বাইরে জিনিষটি পাচার করতে পারে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নিরপরাধ কদম। বিদেশের জেলে বন্দি হয় সে।
দীর্ঘদিন ধরে কদম বিদেশে। তাকে মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়। সারেং বাড়ির বউ হয়ে নবিতুন চৌধুরি বাড়িতে বাঁদীর কাজ করে। এতে পরিবারের মানসম্মান নষ্ট হচ্ছে। তাই চাচা শ্বশুর ও লন্দু মোড়ল সালিশ বসায়। গ্রামের পারিবারিক বৈঠকে স্থির হয় কদমের চাচাতো ভাই কোরবানের সঙ্গে বিয়ে হবে নবিতুনের। এই প্রস্তাবে রাজি না হলেও তার উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। লন্দু মোড়ল কোরবানকে গোপনে বোঝায় বিয়ের পর সে শুধু একবার নবিতুনকে তালাক দেবে। কিন্তু কেন লন্দু মোড়ল কোরবানকে এবং কিসের বিনিময়ে নবীতুনকে বিয়ের পর তালাক দিতে বাধ্য করবে?
নবিতুনের আপত্তি কেউ শোনে না। বিয়ের দিন স্থির হয়। সেই সময় গ্রামে ফেরে কদম। নবিতুন নতুন সুখের সম্ভাবনা দেখে। কিন্তু গ্রামের মোড়ল ও কুচক্রী মানুষ কদমের কানে কুমন্ত্রণা দেয়। তাকে বলে নবি��ুনের গর্ভে যে সন্তান তা অন্য মানুষের, কদমের নয়। সন্দেহের বিষে জ্বলে ওঠে কদম। তারপর ঘটে যায় খারাপ কিছু ঘটনা।
এদিকে প্রকৃতিও যেন আঘাত হানতে উদ্যত হয় জনপদের ওপর। সাইক্লোন ধেয়ে আসে উপকূলে। ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষের গড়া সভ্যতার চিহ্ন। প্রবল ঝড়ে ও বানে ভেসে যায় কদম ও নবিতুন। ভেসে যায় গ্রামের সব পাপ, পূন্য, জঞ্জাল সব।
সারা রাতের সাইক্লোনের পর শান্ত হয় প্রকৃতির রুদ্র রোষ। নবিতুন নিজেকে আবিষ্কার করে এক চরের মধ্যে। কাঁদার ভিতর সে পড়ে আছে। বানের পানিতে ভেসে এসেছে সে এখানে। চারিদিকে মানুষ ও পশুর লাশ। একটু পরে সে শোনে কাঁদায় পড়ে পানি পানি করে আর্তনাদ করছে মৃতপ্রায় একজন পুরুষ। নবিতুন তাকে জলপান করালে সাগরের লোনা পানি থুথু করে ফেলে দেয় সে। খাবার পানির সন্ধানে এদিক ওদিক খোঁজে সে। কিন্তু কোথায় পাবে। শেষ পর্যন্ত স্তনদুগ্ধ দিয়ে পুরুষের তৃষ্ণা মেটায় সে, তার প্রাণ বাঁচায়। চেতনা ফিরে পেয়ে হাহাকার করে ওঠে সেই পুরুষ। এবার বলিষ্ঠ কণ্ঠে নবিতুন বলে জান বাঁচানো ফরজ। সে ভেঙে ফেলে প্রচলিত ঘুণে ধরা সংস্কারের বেড়াজাল। নতুন চরের বুকে নতুন সূর্য ওঠে। নতুন জীবনের, নতুন সমাজের ইশারা নিয়ে আসে সেই সূর্য। অতীতের সব জঞ্জাল ও কদর্য স্মৃতি মুছে ফেলে নবিতুন ও সেই পুরুষ এগিয়ে চলে নতুন সমাজ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় বুকে নিযে। কে ছিল সেই পুরুষ? আপনাদের কি জানতে ইচ্ছা করে না। তাহলে পড়ে ফেলুন কালজয়ী উপন্যাস সারেং বউ।
পাঠ পর্যালোচনাঃ 'সারেং বৌ' সিনেমাটি যখন দেখি তখন এটিকে কেবল একটি জনপদের দুর্যোগ কবলিত মানুষের উপাখ্যান হিসেবে ভাল সিনেমার তৃপ্তি নিয়ে দেখেছিলাম। কিন্তু বইটা পড়া হয়ে ওঠে নি। হাতে পেয়ে একটু সময় পেয়ে পড়ে ফেললাম এবং মনে হয়েছে বইটা না পড়ে এতোদিন ভুল করেছি। শহীদুল্লাহ কায়সারের লেখক জীবনের যে দুটো শ্রেষ্ঠ কীর্তি তার মধ্যে 'সারেং বৌ' অন্যতম। কতটা মেধাবী আর প্রতিভাধর লেখক হলে জেলখানার মতো কঠিন জায়গায় বসে এরকম কালজয়ী একটা উপন্যাস লেখা যায় বইটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সাগরের মাঝির আজীবনের ঘর ছেড়ে সাগর পাড়ি দেয়ার নেশা আর ঘরের জন্য আকুল করা মন। আর উল্টোদিকে ডাঙায় বেঁচে থাকা আর বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামে তার বৌয়ের প্রাণপণ লড়াই। ভোরবেলা কেবিনের জানালা খুলে হুহু হাওয়ায় দেশের কথা মনে পড়া। সারেং-এর আশার অপেক্ষায় তার বউয়ের আকুল পথচাওয়া। রাতের আঁধারে সুযোগ নিতে আসা লল্পটের অণ্ডকোষ ছিঁড়ে নিতে চাওয়ার সাহসী বর্ণনা। বাংলার মেয়ে অবলা বুঝি?
সারেং বউ’ উপন্যাস মাধ্যমে উঠে আসে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে নারীর সংগ্রামের বহুমুখী চিত্র। আবার নারীর পাশে দাঁড়ানো অন্য নারীর সহমর্মিতার ছবিও দেখা যায়। চৌধুরি বাড়ির ছোট বউ ধনী ঘরের হলেও সে নির্যাতিত এবং নিরুপায়। তবু শরবতি ও ছোটবউ দাঁড়ায় নবিতুনের পাশে। অন্যদিকে পুরুষশাসিত সমাজ নারীকে নিষ্পেশন করে বিভিন্ন কৌশলে। তাকে উপার্জন ও চলাচলের স্বাধীনতা দেয় না, তাকে রাখতে চায় নিজের নিয়ন্ত্রণে। নারীর মতও কেউ গ্রাহ্য করে না। যখন তাকে সে মুঠোয় পুরতে পারে না তখন তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এমনকি প্রিয় পুরুষটিও তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তবু নারী পরাজিত হয় না। নারী পৃথিবীতে নিয়ে আসে নতুন জীবন, গড়ে তোলে নতুন সমাজ। জয় হোক সকল নারী স্বাধীনতার!
বার্তাঃ এ উপন্যাস অবলম্বনে সারেং বৌ ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। ছবিটি পরিচালনা করছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আবদুল্লাহ আল মামুন। এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্হায় নির্মিত এই ছবিটিতে আবদুল জব্বার এর কণ্ঠে গাওয়া ওরে নীল দরিয়া আমায় দেরে দে ছাড়িয়া গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রামের গল্পে নির্মিত এই ছবিটিতে অভিনয় করেছেন ফারুক, কবরী, আরিফুল হক, জহিরুল হক, বিলকিস, বুলবুল ইসলাম, ডলি চৌধুরী সহ আরো অনেকে। উপন্যাস টি পড়ার পর সিনেমাটি দেখতে পারেন।
নবিতুন আর আককির সাথে আমরা বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষা জনসমাজে ঘুরে বেড়াই, আমাদের পরিচয় হয় অসীম মায়াময় শরবতির সাথে, চৌধুরি বাড়ির ছোটবৌ এর সাথে। আমরা দেখি লম্পট লুন্দর শেখের ভয়াল থাবা, দেখি কামিজ বুড়োর গরকি। সমুদ্রে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে আমরা দেখা পাই কদম সারেং, মন্তু সারেং, ক্যাপ্টেন হিকস সাহেবকে। দেখি সারেং বাড়ির ছোট হিস্যা নবিতুনের টিকে থাকা।
গল্পের সময়টা ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ যখন কেবল জেগে উঠছে নতুন প্রাণ পেয়ে, সেই সময়টায়। শহীদুল্লাহ কায়সারের পড়া প্রথম বই আমার জন্য। মনে হয়েছে, শহুরে ছোঁয়ায় গ্রামের ইতিকথা লিখতে গেলে সম্ভবত এমনই হয়। গল্পটা সুন্দর, কিন্তু অগোছাল৷ চরিত্রগুলোর রূপরেখা সুন্দর, কিন্তু গল্পজুড়ে বদল আসেনাই কোন। অনেকগুলো খন্ড খন্ড ছবি অনেকটা জোর করেই যেন জুড়ে দেয়া একসাথে।
সারেং বৌ আসলে প্রতিক্ষা আর সংগ্রামের গল্প। সে অপেক্ষা হতে পারে এক গ্রাম্য বধুর, তার মেয়েকে নিয়ে স্বামীর জন্য অথবা বিশাল সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো এক জাহাজি সারেং এর যে কিনা ফিরতে চায় নিজ গৃহে অাপনজনের কাছে।
শহীদুল্লাহ কায়সার এবং উনার ভাই জহির রায়হানের প্রতি এমনিতেই ভাললাগা কাজ করে। লেখকের লেখনির ধরনও বেশ ভালো লেগেছে।
অনেকদিন ধরে পড়বো পড়বো করেই "নীল দরিয়া" খ্যাত "সারেং বৌ "পড়া হচ্ছিল না। শেষে আজকে পড়ে ফেললাম। ভালো লেগেছে, তবে ততোটা নয়। শেষটা অতি নাটকীয়!
কাহিনী সংক্ষেপঃ জাহাজের কাজ করে কদম। তাই বাড়ির নাম সারেং বাড়ি। বিয়ে করা বৌ নবিতনকে রেখে সাগরে পাড়ি জমায় কদম। টাকা পাঠায় আর সাথে থাকে চিঠি। ছুটি পেলে বছর দুই তিন পরে আসে। দিনকাল ভালোই চলছিল তাদের। মেয়ে আককি , আর প্রিয়তমা নবিতনকে নিয়ে দিন ভালই যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কি যে হল! কদম সারেং আর বাড়ি ফেরে না। অতি কষ্টে বছর তিনটি চলে গেছে। মাথার উপর দিয়ে কম ঝড় যায় নি নবিতনের। একদিকে যেমন অর্থ কষ্ট অন্যদিকে নিরাপত্তার বড়ই অভাব। স্বামী ছাড়া বাড়িতে রাত অনেকটা কালরাতের মতো কাটে নবতনের, অনেকেরই লোলুপ দৃষ্টি দেখে কেপে ওঠে নবিতন। সারেং কেন আসে না!!!! অনেকেই বলে যে হয়তো কারো পাল্লায় পড়েছে বিদেশ গিয়ে, হয়তো আর আসবে না।কিন্তু সে তা ভাবতে পারে না। অপেক্ষায় থাকে কদমের। ওদিকে কদমও দিন গুনে কবে ফিরবে দেশে। একে একে কেটে গেছে অনেক দিন, সাজা হয়েছিল তার। হাজতে ছিল সে এই তিন বছর। পরিবারের কথা মনে হতেই বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করে ওঠে কদমের। কিন্তু এখান থেকে ছাড়া পেয়েই কি আর খালি হাতে যাওয়া যাবে দেশে। মেয়ে বৌয়ের জন্য কিছু তো নিতে হবে! ছাড়া পেয়ে আবারও কাজে লাগে কদম । আর এদিকে লুন্দর শেখের জ্বালায় অতিষ্ঠ নবিতন, বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় সগির মা বুড়িকে দিয়ে। বিয়ে না করলে সে যেন রাতের বেলায় ঘরের দ্বার খোলা রাখে। নবিতন আতঙ্কে থাকে। চৌধুরি বাড়িতে কাজ করে সে। ছোটবাবুর নজরও সুবিধার মনে হয় না। একদিন কাজ করে ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে যায় তার। ভয়ে ভয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় নবিতন। কিন্তু পাটের জঙ্গলের দিকে পা বাড়াতেই একা মেয়েটির উপড় হামলে পরে লুন্দর শেখ ।নিজেকে বাচানোর চেষ্টায় সফল হয় নবিতন, প্রাণ নিয়ে পালায় জানোয়ারটা। একদিন ফিরে আসে কদম। প্রাণ ফিরে পায় নবিতন।মেয়ে আককি আর বৌকে নিয়ে কিছু সুখের দিন কাটতে থাকে কদমের।কিছুদিন পর ছেলের মুখ দেখবে তারা। কিন্তু পরেই সন্দেহ দানা বাধে নবিতনকে নিয়ে, সবই লুন্দর শেখ আর ছোট চৌধুরির প্ল্যান। এদিকে জন্মের পরই মারা যায় নবিতনের ছেলেটি। ঝামেলা হয় কদম আর সারেং বৌর। অবশেষে সত্য উদঘাটিত হয়। কদম লুন্দর আর ছোট চৌধুরির কথা জানতে পারে। কিন্তু এদিকে প্রকৃতি মেতেছে ধংস খেলায়। বন্যা আর ঝড়!! সবাই বাড়ি ছেড়ে পানিতে নামে বাচার আশায়। কিন্তু আশান্ত প্রকৃতি সারেং আর সারেং বৌ কে রেখে নিয়ে গেছে বাকি সবার প্রাণ!!!!!
This entire review has been hidden because of spoilers.
সারেং মানে নাবিক। যারা সাধারণত পরিবার থেকে দূরে জাহাজে করে বিভিন্ন দেশের বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়ায়। উপন্যাসে এমনই একটি চরিত্র কদম সারেং। যে পেশায় সারেং। সেও তার স্ত্রী নবিতুন, মেয়ে আককিতে ছেড়ে জাহাজে করে বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়ায় । সেখান থেকে নিয়মিত টাকা এবং চিঠি পাঠায়। কিন্তু এবার তিন বছর হয়ে গেলেও টাকা চিঠি কিছুই পাঠাচ্ছে না। এদিকে মেয়ে আককিকে নিয়ে নবিতুনের বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলতে থাকে। বারা বানা, জাল বুনা এবং চৌধুরী বাড়িতে কাজ করে মা-মেয়ের খাবার জোগায় নবিতুন। গুণ্ডা বদমাশের কুপ্রস্তাব থেকেও রেহায় পায় না নবিতুন। এমনই একজন লুন্দর শেখ৷ সগীর মা গুজাবুড়ীর মাধ্যমে বিয়ে প্রস্তাব পাঠায়, এমনকি অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলারও। নবিতুন পথ চেয়ে থাকে কদম সারেং এর জন্য। একদিন ফিরে আসবে কদম সারেং। কিন্তু আসলেই কী ফিরে আসে??
চরিত্র - ★ নবিতুন - যার চরিত্রে প্রচুর স্বামী ভক্তি ফুটে উঠেছে। স্বামী কাছে নেই বলে জীবনসংগ্রাম করে কিভাবে বেঁচে থাকে... সমাজের লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষার যে চেষ্টা সেটিই গভীরভাবে লক্ষনীয়। অবশ্য নবিতুনের অতিরিক্ত স্বামী ভক্তি বিরক্তির কারণ হয়েছে।
★ কদম সারেং - যে বাবার ওয়াদা রক্ষার জন্য সৎ থাকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পরিপূর্ণ সৎ নয়। ভন্ডামি আছে। নবিতুনের বিশ্বাস রাখার চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু শেষে পোস্টমাস্টার আর লুন্দর শেখের কথায় নবিতুনকে অবিশ্বাস করার ব্যাপারটা দৃষ্টিকুটু৷ অবশ্য আমাদের সমাজে এমনটা দেখা যায়, অন্যদের কথা শুনে নিজেরকে বউকে অবিশ্বাস, অথচ সেই বিষয়ে স্পষ্টভাবে জানার চেষ্টা করে না। অবশ্য কদম সারেং জানার চেষ্টা করেছিল।
★ লুন্দর শেখ - সমাজের টাকাওয়ালা ব্যক্তি। নারীদের প্রতি বিশেষ লোভ। পাঁচজন বউ আছে তাও নবিতুনকে বিয়ে করতে চায়। বিয়েতে রাজি না হওয়ায় ধর্ষণের চেষ্টাও করে।
★ মন্ত সারেং - রুতুন্দা জাহাজের বড় সারেং৷ অবৈধ মালামাল যাতায়াত করে টাকা পয়সা কামিয়েছে অনেক।
এই উপন্যাসের শেষ পরিনতির সাথে আমি ‘লালসালু’ উপন্যাসের মিল পাই। শহীদুল্লাহ্ কায়সার এই উপন্যাসটি জেলে থাকা অবস্থায় লিখেছিলেন৷ যিনি জহির রায়হানের ভাই এবং অভিনেত্রী শমী কায়সারের বাবা। ‘সারেং বৌ’ নামে ১৯৭৮ সালে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। আর ‘ওরে নীল দরিয়া’ এই চলচ্চিত্রের ই গান।
আমার কাছে ভালো লেগেছে।কিছু আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার দেখে অবাকই হয়েছি৷ সহজ সরল ভাষায় লিখিত চমৎকার উপন্যাস। __
বই : সারেং বৌ লেখক : শহীদুল্লা কায়সার জোনাকি প্রকাশনী পৃষ্ঠা ১২৬ মূল্য ১৮০৳
'আইয়ুব খান জেলে পাঠিয়েছিলেন, তাই আমি সাহিত্যিক হতে পেরেছি' এই উক্তিটি যিনি করেছেন তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসেই লিখেছেন 'সারেং বৌ' নামের বিখ্যাত সেই উপন্যাসটি। যেটির জন্য তাঁকে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়। আর এই 'সারেং বউ' উপন্যাসটির স্রষ্টা শহীদুল্লা কায়সার। যিনি তিন পর্যায়ে আট বছর জেলে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন এবং জেল জীবনের এই দীর্ঘ সময়ে তিনি পড়াশুনা ও সাহিত্য চর্চা করেছেন নিবিষ্টমনে। 'সারেং বউ' ছাড়াও কারাগারে বসেই তিনি অধিকাংশ গল্প- উপন্যাস রচনা করেছেন।
সারেং বৌ উপন্যাসে বাংলাদেশের সমুদ্র-উপকূলবর্তী জনপদের বিশ্বস্ত চিত্র আছে।কদম সারেং সৎ বলে সহকর্মীদের মত বাড়ি ও দালান করতে পারে নি।স্ত্রী নবিতুনকে নিয়ে আর্থিক কষ্টের মধ্যেও সে সুখে থাকে।প্রকৃতির বিরুদ্ধতায় সারেং যখন দীর্ঘদিন নিখোঁজ,সেই সময় যুবতী নবিতুনের উপর দারিদ্র্য ও লোলুপ সমাজপতিদের লোলুপতা নেমে আসে।দাম্পত্য আদর্শনিষ্ঠ বলে নবিতুন সবকিছুকে পরাজিত করতে পারে।সারেং কদম যখন ফিরে আসে তখন সাগরের বুকে সে তখন চরম মাত্রায় পিপাসিত।এ অবস্থায় ধর্মীয় বিধি লংঘন করে নবিতুন স্তন্যদুগ্ধ পান করিয়ে স্বামীকে বাঁচতে সাহায্য করে।এই উপন্যাসে সব সংস্কার তুচ্ছ করে মানুষকে জয়ী দেখানো হয়েছে।
This entire review has been hidden because of spoilers.
থেকে থেকে বুকের ভেতর কেমন শূন্যতা জাগে। বাতাস, বৃষ্টি, প্রকৃতির রুপ রঙ মাখা সারেংবাড়ির আঙিনায় এক অদ্ভুত গুমোট নিস্তব্ধতা। একমাত্র মেয়েটাকে বুকে নিয়ে আর কতদিন পথ চেয়ে থাকতে হবে? আর কতদিন চলবে জীবন এভাবে! জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সব রঙ। আজকাল বড্ড ফিকে লাগে সবকিছু। তবুও বাঁচতে হয়, তবুও দূরের ধানক্ষেতের আইলে দৃষ্টি থাকে, যদি সে পথ ধরে সারেং ফিরে আসে আবার!
নবীতুন কিছু ভাবতে পারে না মাঝে মাঝে। বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক চাপা অভিমান লুকিয়ে থাকে। এতগুলো বছর হয়ে গেল। তিনটে বছর তো কম নয়, বাড়ির কথা কী একবারও মনে পড়ে না সারেং এর? নবীতুন না হোক মেয়ে আককি যে বাপকে খুঁজে বেড়ায়। বাপ থাকতেও মেয়েটার শখ আহ্লাদ পূরণ করতে পারে না নবীতুন। মেয়ে মানুষের কপাল আর বান্দীর কপাল সমান। একদিন আককিকেও তো বিয়ে দিতে হবে! মেয়েটা মুখ ফুটে সাহস করে মায়ের কাছে কিছু চাইতেও পারে না সংসারের অবস্থা দেখে।
সংসার যেমন চলছে বোঝা গেল কিন্তু নবীতুন সবচেয়ে বড় যে সমস্যায় আছে তা হলো লুন���দর শেখ নামক ইতর প্রাণীটিকে নিয়ে। গ্ৰামের মাতব্বর গোছের এই লোকের নজর পড়েছে নবীতুনের উপর। গ্ৰামের গুঁজাবুড়িকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় নবীতুনকে। অবশ্য তাঁর ঘরে আরো বউ আছে। তাতে কী! নবীতুনের মতো জোয়ান শরীর পাওয়া যায় নাকি সহজে। গুঁজাবুড়িকে নবীতুন ঝাড়ু মেরে গালিগালাজ করে তাড়িয়ে দেয় প্রতিবার। তবুও বুড়ি প্রায়শই আসে যদি নবীতুনের মন গলে। সারেং কবে আসবে কে জানে!
গুঁজাবুড়ি অবশ্য নবীতুনকে আরেকটি ভয়ানক প্রস্তাব দিয়েছে রাতে যেন দরজা খোলা রাখে, লুন্দর শেখ রাত কাটিয়ে যাবে মাঝে মধ্যে। ছিঃ ছিঃ কী সাংঘাতিক সাহস এই বুড়ির! নবীতুন আবারো মারমুখী হয়। বুড়িকে খুনই করে ফেলবে। এতবড় জঘন্য প্রস্তাব সে কেন দিলো ওই বদমাইশের পক্ষে!
~ নীল দরিয়ার কদম সারেং ~
"ওরে নীল দরিয়া,
আমায় দে রে দে ছাড়িয়া
বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি হায় রে
কান্দে রইয়া রইয়া।"
জাহাজের মধ্যে শুয়ে ঘুমের ঘোরে নবীতুনকে আজকাল কদম সারেং খুব বেশি দেখতে পারে না আজকাল। কী আশ্চর্য! আগে তো এমন হয়নি। অবশ্য শেষ কবে নবীতুন আর আককির সাথে দেখা করে বেরিয়েছিল কদম সেটা এখন মনকে ভারাক্রান্ত করে। কবে আবার দেখা হবে কে জানে!
কদম বাড়ি ফিরতে চায়। ফিরতে চায় তাঁর বউ নবীতুনের কাছে। একদিন নিজে পছন্দ করে সারেং বাড়িতে বৌ করে নিয়ে এসেছিল নবীতুনকে। বড্ড ভালোবাসে এই মেয়েটাকে।
আজকাল এই জলডাঙার খেলা ভালো লাগে না কদমের। নবীতুন না জানি কত কষ্টে সংসার চালাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে কদমের বুক মোচড় দিয়ে ওঠে। এই জাহাজ এবার তাঁকে ছেড়ে দিক। সব ঝামেলা শেষ হোক তাড়াতাড়ি। যা তাঁকে বাড়ি ফিরতে দেয়নি আগে।
কী সেই ঝামেলা? একজন সারেং এবং সমুদ্রের গল্প গুলো হয় রহস্যময়। জানতে হবে ধৈর্য্য ধরে। যেমনটা নবীতুন অপেক্ষা করে আছে পথের দিকে চেয়ে, তাঁর সারেং ফিরবে একদিন।
~চরিত্রায়ন~
লেখক চরিত্রগুলোকে বেশ ভালো ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষ করে সামাজিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের আনাগোনা পরিলক্ষিত হয়। সমাজে যেমন আছে লুন্দর শেখদের মতো মাতব্বর গোছের লোক তেমনি আছে দরিদ্র নবীতুনদের কথা।
নবীতুনের মাঝে লেখক যা চারিত্রিক দৃঢ়তা তুলে ধরেছেন ব্যক্তিগত ভাবে আমার পছন্দের চরিত্র এই নবীতুন। একজন নারীর সমাজের সাথে কীভাবে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়, বিশেষ করে যখন সে হতদরিদ্র এবং একা। নবীতুন এই ক্ষেত্রে দারুন স্বাধীনতাচেতা এবং প্রতিবাদী চরিত্র হিসেবে পরিচিতি পেল। বাকিদের কাজ নিজ নিজ অবস্থানে কিন্তু নবীতুন ছাপিয়ে গেছে সব চরিত্রের বাইরে।
~পাঠ প্রতিক্রিয়া ~
শহীদুল্লা কায়সার। একাত্তরের এই শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক ছিলেন তেমনি করেছেন সাহিত্যচর্চা। যার প্রমাণ তাঁর লেখা বইগুলো। "সারেং বৌ" গ্ৰামবাংলার জনপদকে প্রতিনিধিত্বকারী সামাজিক উপন্যাস। এবং পড়তে আমার কাছে ভালোই লেগেছে।
গল্পের শুরু থেকেই আঁচ ছিলো জীবনযুদ্ধে এক সংগ্ৰামী নারী নবীতুনের। যে অপেক্ষায় আছে স্বামীর ঘরে ফেরার। স্বামী জাহাজের সারেং এর কাজ করে। এদিকে স্বামীর সম্মান, সারেং বৌ হয়ে সংসার বাঁচাতে পরের বাড়ীতে কাজ করার লজ্জা। অন্যদিকে একা মেয়েমানুষ হিসেবে নিজের ইজ্জত বাঁচাতে লড়াই। শহীদুল্লা কায়সার শিল্পীর তুলিতে আঁচড় দিয়ে সাজিয়েছেন এই দুই বিষয়কে নবীতুনের মাঝে এক করে। এইদিকটা বেশ ভালো লেগেছে।
এই গল্পটা যেহেতু গ্ৰামীন পরিবেশের ওইসব মানুষের তাই গল্পে প্রচুর পরিমাণে গালিগালাজ আছে। এবং আছে বেশ কয়েক জায়গায় ১৮+ দৃশ্য। এগুলো বাদ দিলে বইটি একদম খারাপ লাগবে না। কারণ শহীদুল্লা কায়সারের লেখনী ভালো। গল্পের প্রধান যে বক্তব্য কিংবা চরিত্রগুলোকে বেশ ভালো ভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তিনি।
সারেং বৌ নবীতুনের অপেক্ষা, ছোট্ট আককির বাবাকে খুঁজে বেড়ানো, লম্পট লুন্দর শেখদের লালায়িত দৃষ্টি কিংবা জীবনযুদ্ধে দারিদ্র্যের সাথে লড়াই। সারেং বৌ শোনাবে সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি এবং জীবনবোধের গল্প। সাথে আছে ভালোবাসা। যে ভালোবাসা গোপনে জমে থাকে বুকের বা পাশে। সারেং বৌ এর মনের ভালোবাসা তাঁর দূর দেশে কাজ করা সারেং স্বামীর জন্য।