Jump to ratings and reviews
Rate this book

নিষিদ্ধ লোবান

Rate this book
ফ্ল্যাপে লেখা কিছু কথা
মুহূর্তের ভেতর ব্যস্ত হয়ে পড়ে দুজন। নিঃশব্দে একের পর এক লাশগুলো টেনে এন তারা জড়ো করতে থাকে। সময় অতিক্রান্ত হতে থাকে। চাঁদ আরো সরে আসে। আকাশে আজ মেঘ নেই। চত্বরের ওপর বীভৎস শ্বেতীর মতো ছেঁড়া আলো পড়ে থাকে।

71 pages, Hardcover

First published April 1, 1981

20 people are currently reading
578 people want to read

About the author

Syed Shamsul Haque

191 books98 followers
Syed Shamsul Haque (Bangla: সৈয়দ শামসুল হক) was a Bangladeshi poet and writer. Haq lived alternately in Dhaka and London. He wrote poetry, fiction, plays - mostly in verse and essays. He, the youngest writer to be honored with Bangla Academy Award, achieved it at the age of 29. He was honored with Ekushey Podok in 1984.

(সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মেছিলেন। বর্ণাঢ্য লেখকজীবনের অধিকারী সৈয়দ হক। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, কাব্যনাট্য, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, চলচ্চিত্রের গান – যা লিখেছেন সবকিছুতেই পেয়েছেন জনপ্রিয়তা, সাফল্য।

মাত্র ২৯ বছর বয়সে ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান সৈয়দ হক। এখন পর্যন্ত বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া সর্বকনিষ্ঠ লেখক তিনি।

সৈয়দ হকের লেখালেখির শুরু তাঁর শৈশবেই। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে লিখে ফেলেন দুই শতাধিক কবিতা। ১৯৫১ সালে ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায় ‘উদয়াস্ত’ নামে তাঁর একটি গল্প ছাপা হয়। সেটাই তার প্রথম ছাপা হওয়া লেখা।

সেই বছরই বাড়ি থেকে পালিয়ে বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে গিয়েছিলেন তিনি। কাজ করেন পরিচালকের সহকারী হিসেবে। কয়েক বছর পর দেশে ফিরে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেও লেখাপড়া শেষ করেননি। পুরোপুরি মনোযোগ দেন লেখালেখিতে।

১৯৫০-এর দশকেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। এ সময় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন তিনি। তাঁর লেখা চিত্রনাট্যে নির্মিত হয় ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’। তাঁর উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়।

সৈয়দ শামসুল হক চিত্রনাট্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের জন্য প্রচুর গান লিখেছেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’।

তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘একদা এক রাজ্যে’, ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’, ‘পরানের গহীন ভিতর’, ‘অপর পুরুষ’, ‘অগ্নি ও জলের কবিতা’।

বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’, ‘বারো দিনের জীবন’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’, ‘নির্বাসিতা’।

‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরলদীনের সারা জীবন’ তাঁর বিখ্যাত কাব্যনাট্য। এ ছাড়া অসংখ্য অনুবাদ এবং শিশুসাহিত্যে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন সৈয়দ হক।)

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
151 (25%)
4 stars
263 (44%)
3 stars
153 (25%)
2 stars
24 (4%)
1 star
6 (1%)
Displaying 1 - 30 of 96 reviews
Profile Image for Sneha.
56 reviews96 followers
February 11, 2023
যুদ্ধের সময় খুব সাধারণ মানুষ গুলোর পরিস্থিতিও কতটা ভয়াবহ ছিল! এতো গভীরভাবে আমি কখনোই যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারি নি, কখনোই না। এতো ছোট একটা বই, অথচ কত কিছু ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক এর মধ্যে। কী এক গভীর বিষণ্নতা মনে গেঁথে রইলো!
Profile Image for Ummea Salma.
126 reviews122 followers
September 28, 2020
My teardrops turned into a waterfall after finishing this book! I was sobbing for the last 30 pages or so on that I could barely keep reading.
Profile Image for Chinmoy Biswas.
175 reviews65 followers
March 26, 2022
খুব লজ্জার হলেও, সত্যি যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার পড়াশোনার গন্ডি খুবই ছোট। আমার ইচ্ছে ছিল একেবারে দেশ ভাগ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পড়ব। কিন্তু হাতের কাছে সেরকম বই না থাকার কারণে পড়াটা শুরু করা হয়ে ওঠেনি। তবে একাত্তরের দিনগুলো, আগুনের পরশমনি,অনিল বাগচীর একদিন,ক্রাচের কর্ণেল মতো কয়েকটা বই পড়েছি।

আজকে পড়লাম সৈয়দ হকের "নিষিদ্ধ লোবান"। এই বইটা অনেক দিন থেকে কিনব কিনব করে কেনা হয়নি,শেষ পর্যন্ত পেলাম বই বিনিময় উৎসবে। তারপর আজকে পড়ে শেষ করেছি। বলা ভালো,একটানা পড়েছি। মাত্র ৭০ পৃষ্ঠার একটা বই, অথচ কি দারুণ।

গল্পের যাত্রা শুরু হয় বিলকিসের জলেশ্বরী যাত্রা দিয়ে,সেখানে ঘটনার ঘনঘটায় তার সঙ্গী হয় সিরাজ। দুইটা সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ। অবশ্য যুদ্ধে পরিচিত অপরিচিত ভেদাভেদ থাকে না। তখন সবাই সবার আপন,শুধু শত্রু বাহিনী ছাড়া। এই নিয়ম সিরাজ আর বিলকিসের বেলায় ও সত্যি হয়। তারা হয়ে ওঠে আপন ভাই-বোন। দুইজনেই পরিবার হারা। তবে বিলকিসের বিশ্বাস ছিল তার মা বোন ভাই অন্তত থাকবে গ্রামে, তাই সে ঢাকার মত মৃত্যুপুরী ফেলে জলেশ্বরী এসেছিল পরিবারের কাছে। কিন্তু অমোঘ নিয়তি তাকে নিয়ে অন্য এক প্রান্তরে।

লেখক সৈয়দ শামসুল হকের লেখা খুব বেশি পড়া হয়নি। যা পড়েছি,তা মনে দাগ কেটেছে। আমার এখনো মনে আছে উনার " হে বৃদ্ধ সময় " বইটার কথা,শেষ করার পর স্তম্ভিত হয়ে ছিলাম। এত চমৎকার মানুষ লিখতে পারে। সৈয়দ হকের লেখা পড়ার সবচে মজার দিকটা হলো,এতে একটা শুদ্ধতার ছাপ পাওয়া। খাঁটি সোনা যাকে বলে,এটা আমার মতামত। "নিষিদ্ধ লোবান" ও তার ব্যতিক্রম হয়নি,কি চমৎকার ভাবে যুদ্ধের ভয়াবহতা তিনি আঁকলেন তার লেখায়। চমৎকার।
Profile Image for Aishu Rehman.
1,093 reviews1,079 followers
October 4, 2020
প্রথম অর্ধেক ঠিকঠাকই ছিল কিন্তু দ্বিতীয় অর্ধেক ? আমার কাছে কেমন জানি কিছুটা অতিরঞ্জনের মিশেলে অবাস্তব কল্পকাহিনী বলেই মনে হয়েছে।
Profile Image for Nahar Trina.
Author 13 books60 followers
January 7, 2016
স্পয়লার এ্যালার্ট
------------

একটি দেশের জন্মযুদ্ধের ইতিহাস শুধু গৌরব গাঁথা নিয়ে লেখা হয় না। অশ্রু আর রক্তের অক্ষরেও লেখা হয়। আর সেটি যদি হয় বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্মযুদ্ধের কাহিনি তবে এক নদী রক্ত, লক্ষ মা বোনের অশ্রু উজিয়ে পৌঁছাতে হয় সে ইতিহাসের কাছে। আত্মদানের নিদারুন দুঃখ জাগানিয়া ইতিহাস, বুকভর্তি দ্রোহ নিয়ে আগুন পাখি হয়ে ওঠবার কথা তাই বাংলাদেশের পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের বুক জুড়ে। স্বাভাবতই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আমাদের প্রাত্যহিক জীবন ধারণ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ শিল্প সাহিত্যের নানান শাখায় আপন মহিমায় চলমান থাকবার কথা ছিল । কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের জীবন যাপন কিংবা রাষ্ট্রীয়ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধকে সেভাবে স্হাপনে আমরা চরমভাবে ব্যর্থ। তবে আশার কথা, রাষ্ট্রীয়ভাবে কিংবা প্রাত্যহিক জীবনযাপনে একে সেভাবে ধারণ করতে ব্যর্থ হলেও একদল শিল্পী তাঁদের আপন আপন ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করে গেছেন, যাচ্ছেন। এঁরা কেউ শব্দকারিগর, কেউ রঙের বাজিকর। শিল্প সাহিত্যের নানান শাখায় এইসব শিল্পীরা এঁকে চলেছেন, লিখে চলেছেন, গড়ে চলেছেন। এঁরা আঁকিয়ে, লেখক কিংবা স্হ্যাপত্যকুশীলব।


মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এসব শাখার মধ্যে সবচে' বেশি কাজ হয়েছে সাহিত্যে। গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা ইত্যাদি নানান শাখায় অসংখ্য কাজ হয়েছে। উপন্যাস তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য শাখা। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বেশ কিছু কালোত্তীর্ণ অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন আমাদের ঔপন্যাসিকেরা। নানান পটভূমিকায় রচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক অসংখ্য উপন্যাস। সৈয়দ শামসুল হক রচিত 'নিষিদ্ধ লোবান' তার মধ্যে একটি উল্লেখ করবার মত উপন্যাস। প্রায় চৌষট্টি পৃষ্ঠার এই উপন্যাসের পরিধি খুব বেশি বিস্তৃত হয়ত না। কিন্তু তার দ্রোহ কিংবা যে গভীর বোধের বিষয়টি সৈয়দ হক তাঁর নিপুন লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন, তার রেশটি ভীষণ গভীর, বড়বেশি মানবিক। উপন্যাস গড়িয়েছে মোটামুটি দুই-আড়াই দিন-রাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। একদিকে দানবরূপী পাকিস্তানী বর্বর হানাদার বাহিনি ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার। যাদের অধিকাংশই বিহারী। অন্যদিকে বিলকিস ও সিরাজ। উপন্যাসে জীবিত চরিত্রের চেয়ে লাশ সংখ্যায় যেন বেশি। যে লাশগুলো পড়ে আছে পাকিস্তানীদের বর্বরতার সাক্ষী হয়ে খোলা আকাশের নীচে। ডিক্রি জারি হয়েছে, লাশগুলো ওভাবেই পড়ে থাকবে, শেয়াল -শকুনের খাদ্য হবে। কারণ পাকিস্তানী বাহিনি নিজেদের শৌর্য আর বীর্যের গর্বে এতটাই মাত্রা ছাড়িয়েছে যে নিজেদের বাদে বাকীদের অবলীলায় কুকুর হিসেবে ভাবতে দ্বিধা করেনি। এমন অমানবিক একটা পরিস্হিতির মুখে, বিলকিস সিদ্ধান্ত নেয় সে তার ভাই খোকার লাশকে কবরের মাটি দেবে। একদল অমানবিক মানুষ নামের পশুর বিরুদ্ধে শোকহীন বিলকিস বুকভর্তি দ্রোহ নিয়ে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে এগিয়ে যায়। কারণ 'শোক কখনো এত বড় নয় যে মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।' মনুষ্যত্ববোধই মানুষকে সাহসী করে তোলে, বিলকিস তাই ভয়হীন, মৃত্যুচিন্তাহীন সাহসী।

জলেশ্বরীর মাটিতে সফোক্লিসের পাতা ফুঁড়ে কী নেমে আসে আরেক ভাই হারা বোন আন্তেগনে (Antigone)? যে ঠিক বিলকিসের মত শোকে বিহবল না হয়ে ফুঁসে উঠেছিল থিবস্ অধিপতি ক্রেয়নের ডিক্রির বিরুদ্ধে, তার ভাইয়ের প্রাণহীন দেহ কখনোই খোলা আকাশের নীচে পড়ে থাকবে না। সে আন্তেগনে, ভাই পোলিনিসাসকে যে কোনো মূল্যে কবর দেবে। আশ্চর্যজনকভাবে এখানে এসে কেমন একটা মিল খুঁজে পাই মানুষে মানুষে! মনুষ্যত্ববোধে আক্রান্ত সব কাহিনিতে হয়ত জয় সেভাবে নিশ্চিত হয় না, কিন্তু মানুষ শেষমেশ ঠিক জিতে যায়। 'নিষিদ্ধ লোবান' উপন্যাস আমাদের জিতে যাবার সেই এলিজি শোনায়। ভাইকে কবর দেবার অটল সিদ্ধান্তে হাত মেলায় বিলকিসের সাথে সিরাজ। যে কিনা পাকিস্তানী বাহিনির ধর্মীয় তাণ্ডবের আঁচ থেকে বাঁচতে প্রদীপ নামটি আড়াল করে সিরাজ হয়ে গেছে এক ফাঁকে। কাহিনি গড়িয়ে যায় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্হিতির বর্ণনার হাত ধরে। রাতের অন্ধকার ভেদ করে আলোকময় দু'জন মানুষ স্তূপকৃত লাশের কবর দেবার যুদ্ধে নেমে পড়ে। এ যেন যুদ্ধের ভেতরে আরেক মর্মস্পর্শী যুদ্ধ, মানুষকে সম্মানিত করবার জন্য মানুষের প্রাণপণ যুঁযে যাওয়া। যা পাঠের আবেগ পাঠককে যতটা না ব্যথিত করে তারচে' বেশি করে ক্রুদ্ধ! পাকিস্তানী জানোয়ার বাহিনি কর্তৃক ম��ুষ্যত্বের এমন অপমান প্রকৃতি চোখ মেলে দেখতে লজ্জা পেলেও তার এই দুই সন্তানকে সাহায্য করতেই যেন 'চাঁদ আরো সরে আসে। আকাশে আজ মেঘ নেই। চত্বরের ওপর বীভৎস শ্বেতীর মতো ছেঁড়া আলো পড়ে থাকে।' মেঘহীন আকাশে চাঁদের আলোর ভাবালুতায় ভেসে যেতে প্রকৃতিও দ্বিধাগ্রস্হ বুঝি!

'নিষিদ্ধ লোবান' এর জলেশ্বরী জনপদটি যেন যুদ্ধ আক্রান্ত রণক্ষেত্র, বিলকিস জননী বাংলাদেশ, যে তার মৃত সন্তানকে বুকে টেনে নেবার আয়োজন করে। পাকিস্তানী মেজর তার লালসার রাশ টেনে, নিজেকে নিজেই অসীম ধৈর্য্যের কথা শুনিয়ে তক্কে তক্কে থাকে হিন্দু রমণী ভোগের ক্ষণটির জন্য। সিরাজের শরীর আগুনের মাঝে প্রদীপ হয়ে জ্বলতে শুরু করলে বিলকিস আগুন পাখির মত দু'বাহু বাড়িয়ে মেজরকে টেনে নেয়। যে বীর্যের গর্বে কিছুক্ষণ আগেও মেজর দম্ভভরে বলেছিল "আমি তোমায় সন্তান দিতে পারব। উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খাঁটি মুসলমান হবে, খোদার ওপর ঈমাণ রাখবে, আন্তরিক পাকিস্তানী হবে, চাওনা সেই সন্তান? আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, তোমার মাকে দেব, যারা হিন্দু নয়, বিশ্বাসঘাতক নয়, অবাধ্য নয়, আন্দোলন করে না, শ্লোগান দেয় না, কমিউনিস্ট হয় না। জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি। তোমাদের রক্ত শুদ্ধ করে দিয়ে যাব, তোমাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানী রেখে যাব, ইসলামের নিশানা উড়িয়ে যাব। তোমরা কৃতজ্ঞ থাকবে, তোমরা আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তোমরা আমাদের সুললিত গান শোনাবে।” তার সে দম্ভ চূর্ণ করে শিখা অনিবার্ণের অহংকারের কাছে সঁপে দেয় নিজেকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এমন কত বিলকিসের আগুন পাখি হবার, কত প্রদীপের আলোকময় আত্মা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে, তার সবটা হয়ত আমাদের জানা হয় না। তাই নিষিদ্ধ লোবান আমাদের যে কাহিনি শোনায়, আমরা বড় মমতায় শুনে যাই। কেননা এ কাহিনি আমার-আমাদের কাহিনি। এ কাহিনি মানুষ্যত্বের জয়ের কাহিনি!
Profile Image for Kona Reads.
107 reviews39 followers
January 4, 2023
"আত্মাই মানুষকে লঘু রাখে। যতক্ষন সে জীবিত, পাখির মতো ঊর্ধ্বে উঠে যাবার সম্ভবপরতাও তার থাকে। প্রাণ এবং স্বপ্নের অনুপস্থিতিতে মানুষ বিকট ভারে পরিণত হয়"।

নিষিদ্ধ লোবান সাধারণ মানুষদের সাহসের কাহীনি যাদের নাম ইতিহাসে লেখা নেই। যুদ্ধ কিভাবে সাদামাটা মানুষকেও ইস্পাতদৃড় বানিয়ে তার কাহিনী।
Profile Image for Mila Hossain.
70 reviews2 followers
October 24, 2024
মাত্র ৭০ পৃষ্ঠার বই, তবুও রেশ রয়ে যায় অনেক্ষণ।
Profile Image for Jenia Juthi .
258 reviews64 followers
January 19, 2022
"কেউ ভেঙে পড়ে না, শোক কখনও এত বড় নয় যে, মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।"

এ গল্প বিলকিসের! এ গল্প সিরাজের যে প্রদীপ হয়ে বাঁচতে চেয়েছিলো!
আলতাফ কি বেঁচে ছিলো? বিলকিস তা জেনে যেতে পারে নি। তার মা-বোন, বোনের বাচ্চারা কেমন আছে বিলকিস তা দেখে যেতে পারে নি। বিলকিস খোকাকে কবর দিতে পারে নি!কিন্তু, প্রদীপকে সৎকার করে যেতে পেরেছে।

[মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকলে আমি কী করতাম, এ চিন্তা মাথায় আনতেও আমার ভয় হয়।]
This entire review has been hidden because of spoilers.
Profile Image for Kripasindhu  Joy.
543 reviews
February 10, 2025
মাত্র ৭১ পৃষ্ঠার বই কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী লেখা। পাঠের রেশ দীর্ঘকাল রয়ে যাবে।
Profile Image for Kafil Recherche.
61 reviews2 followers
December 26, 2022
মাত্র ৭১ পৃষ্ঠার একটি গল্প। কিন্তু কি সাংঘাতিক! কি মর্মান্তিক! কি ভয়াবহ! মনে একটি দাগ কেটে যায়, যা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষত হয়ে থাকবে।

গল্পটি মাত্র দুজন মানুষকে নিয়ে লিখা: বিলকিস ও সিরাজ। মাত্র দুটি চরিত্র নিয়ে অসাধারণ একটি গল্প রচনা করা একজন অসাধারণ লেখকের দ্বারাই সম্ভব। কি লেখনশৈলী! সত্যিই অসাধারণ। শব্দচয়ন ও বাক্যগঠনে রয়েছে অসাধারণ কাব্যময়তা। কবিতার মতোই আকর্ষণ করে রাখে পাঠককে।

আমি চেয়েছিলাম পড়ার মাঝে একটি ছোট্ট বিরতি নিতে, কিন্তু পারিনি৷ বইটি শেষ না করা পর্যন্ত উঠতে পারিনি৷

'৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি গল্প নিয়ে রচিত এই বইটিও ৭১ পৃষ্ঠার। মজার না?
Profile Image for Rehan Farhad.
242 reviews12 followers
September 29, 2024
কাহিনি শুরু হয় বিলকিস আর বালক সিরাজের জলেশ্বরী যাত্রার মধ্য দিয়ে। প্রতি অধ্যায়ে একটি করে নতুন চরিত্র আসে। প্রতিটা চরিত্র চলমান ঘটনার আবহ বলতে থাকে, কি নিস্প্রভ-অভিব্যক্তিহীন সেই বর্ননা!
Profile Image for Rafia Rahman.
416 reviews215 followers
May 8, 2022
বইয়ের নাম : নিষিদ্ধ লোবান
লেখক : সৈয়দ শামসুল হক
বইয়ের ধরণ : মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস
প্রচ্ছদ : মাসুক হেলাল
প্রকাশনী : অনন্য
প্রথম প্রকাশ : ১৯৮১
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৭১
মুদ্রিত মূল্য : ১৫০/-

রক্ত ...!!!
চারিদিকে রক্ত ... কেমন হবে তার গন্ধ? নিশ্বাস ভারি হয়ে যাবে? শ্বাস নিতে কষ্ট হবে?
রক্তের গন্ধ কি সবসময় বিকট বলে মনে হয়? নাকি কখনো সুগন্ধি "লোবান" বলেও মনে হয়?

দেশের জন্য যাঁরা নিজেদের অকাতরে বিলিয়ে দেয়, মৃত্যুকে খুশি মুখে আলিঙ্গন করে দেশ ও দেশবাসীর জন্য, নিজের রক্ত দিয়ে যারা লিখে যান স্বাধীনতা ; তাঁদের রক্তের সুবাস কি "লোবান" নয়???

ফ্ল্যাপ:

মুহূর্তের ভেতর ব্যস্ত হয়ে পড়ে দুজন। নিঃশব্দে একের পর এক লাশগুলো টেনে এনে তারা জড়ো করতে থাকে। সময় অতি অতিক্রান্ত হতে থাকে। চাঁদ আরো সরে আসে। আকাশে আজ মেঘ নেই। চত্বরের ওপর বীভৎস শ্বেতীর মতো ছেঁড়া আলো পড়ে থাকে।

কাহিনী সংক্ষেপ:

নিঃশব্দ নবগ্রাম স্টেশন! হবেই বা না কেনো? সময়টা যে ১৯৭১। চারিদিকে যুদ্ধের আগুন জ্বলে, কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। বলা তো যায় না বন্ধুবেশে কখন শত্রু বেড়িয়ে পড়ে!!!

ঢাকা থেকে জলেশ্বরীর উদ্দেশ্য রওনা দেয় বিলকিস। জলেশ্বরীতে যে মা-বোন-ভাই সকলেই আছে, তাদের খবর তার জানা নেয়। কিন্তু নবগ্রামে ট্রেন থামলেই যেন চারিদিকে কেমন নিঃশব্দতা নেমে পড়ে। মনে কুডাক ডাকে, সকলেই ঠিক আছে তো? পাকিস্তানিদের হাতে ভাই খোকা ধরা পড়ে নায় তো? আলতাফের খবরও সে জানে না।

জলেশ্বরী যাওয়ার পথে বিলকিসের সাথী হয় সিরাজ। অচেনা এই ছেলেটি তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। বিলকিস জানতে পারে সিরাজের এক হৃদয়বিদারক অতীত! কী সেই অতীত?

পর্যালোচনা:

মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস "নিষিদ্ধ লোবান"। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে জ্বলছে দেশ, ঢাকা ছেড়ে গ্রামে আসতে বাধ্য হয় বিলকিস। স্বামী আলতাফ জীবিত না মৃত তা সে জানে না। পরিবারের বা��ি সদস্যদের সন্ধানে জলেশ্বরীর দিকে পা বাড়ায় সে। নবগ্রামের পথে অচেনা তরুণ সিরাজের সাথে পরিচয় হয়। সিরাজের মানা করা সত্ত্বেও বিলকিস পরিবারের খোঁজে যেতে চায়। অগত্যা সিরাজ তার সঙ্গী হয়।

জলেশ্বরীতে পা রেখে যেন মনে হয় মৃত্যুপুরী। কেউ কোথাও নেয়। পরিবারের সদস্যদের হন্যে হয়ে খোঁজে বিলকিস। জানতে পারে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে নদীর ওপারে পাড়ি দিয়েছে। বৃটিশ আমলের মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতা আলেফ মোক্তারের কাছ থেকে জানতে পারে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। গ্রামের বাজারে পড়ে আছে অনেক লাশ! লাশের কবর দেওয়া নিষেধ পাকিস্তানি বাহিনীর নির্দেশে। যেন লাশ ছিড়ে খায় শিয়াল-শকুনে। আপনজনদের মৃতদেহের এমন অশ্রদ্ধা বিলকিস মেনে নিতে পারে না। তারা সিদ্ধান্ত নেয় সকল লাশের কবর দিবে দুজনে।

উপন্যাসে বিলকিস-সিরাজের মধ্যে দেখা গেছে ভাইবোনের এক অটুট সম্পর্ক। যারা পাকিস্তানিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে গ্রামবাসীদের লাশ কবর দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে।

বইয়ে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন তৎকালীন সময়ে বাঙালিরা প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও বিলকিস-সিরাজ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি বাহিনীর আদেশ অমান্য করে লাশ করব দেওয়ার মাধ্যমে। যে বিলকিস অন্ধকার ভয় করে আপনজনদের মৃতদেহ তাকে আগ্নেয় মশালে রুপান্তরিত করে। যে মশালের আলোয় আলোকিত হয় যুদ্ধের চেতনা, জ্বলে যায় পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহসের ভিত।

কিছু কথা:

সব্যসাচী লেখক হিসেবে খ্যাত সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশের প্রখ্যাত একজন সাহিত্যিক, যিনি একাধারে কবিতা, ছোটগল্প, নাটক, উপন্যাস, কাব্যনাট্য, প্রবন্ধসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাতেই স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে বাংলা সাহিত্যে রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে লেখক সৈয়দ শামসুল হকের "নিষিদ্ধ লোবান" অন্যতম সেরা। উপন্যাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নারী ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অবস্থান ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাট পাকিস্তানিদের চোখে ছিল সাধারণ ব্যাপার। যার দরুন নির্যাতিত-খুন হয়েছে লাখো বাঙালি। যার রক্তাক্ত দাগ থেকে যাবে সারাজীবন বাঙালির ইতিহাসে ও হৃদয়ে।

"নিষিদ্ধ লোবান" পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎকালীন বাঙালি সমাজের করুন অবস্থা ও বীরত্বগাথা সংগ্রামের সাথে। বাঙালি পাঠক হৃদয় বারংবার সিক্ত হবে বাঙালির আত্মত্যাগের গৌরবে এবং পূরণ হবে ঘৃণায় পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্মমতায়।
Profile Image for Amit Das.
179 reviews117 followers
August 25, 2020
বেশ কয়েক বছর আগে নাসির উদ্দিন ইউসুফের পরিচালনায় একটা সিনেমা দেখেছিলাম, নাম 'গেরিলা'। সিনেমাটিতে 'বিলকিস' চরিত্রে জয়া আহসানের অনবদ্য অভিনয় এখনো যেন চোখে লেগে আছে। 'নিষিদ্ধ লোবান' এই বিলকিস- এরই গল্প। তখনও জানতাম না সৈয়দ শামসুল হক এর এই উপন্যাস অবলম্বনে বানানো হয়েছিল সিনেমাটা। অনেকদিন ধরেই পড়বো পড়বো করেও পড়া হয়ে উঠছিল না, অবশেষে পড়া হলো।
সৈয়দ হকের সম্মোহনী গদ্য শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ ধরে রেখেছে।
Profile Image for Shotabdi.
818 reviews194 followers
June 27, 2020
আমি মাঝে মাঝে গলাবাজি করতাম মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্মালে নিশ্চয়ই আমি যুদ্ধে যেতাম, নিদেনপক্ষে সাহায্য করতাম। বড় হওয়ার সাথে সাথে বুঝেছি ব্যাপারটা এতো সহজ ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ যাই পড়িনা কেন আমার অসহ্য ক্রোধে গা গুলোতে থাকে। দুঃসহ যন্ত্রণায় হৃদয়টা বিদীর্ণ হয়ে যায়৷
সৈয়দ শামসুল হকের বলিষ্ঠ সহজ লেখা আমার ভালো লাগে। বিলকিস, সিরাজ কিংবা প্রদীপ মন তো ছুঁয়েছেই, দুটো মাত্র চরিত্রের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টা উঠে এসেছে সুন্দরভাবে।
ছবিটা দেখিনি। জানিনা দেখতে পারব কিনা।
Profile Image for Tareq Ul.
31 reviews4 followers
December 11, 2020
“তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছো তোমার মানচিত্রের ভেতর”

এ ফিরে আসাটা কখনোই সহজ ছিল না। এ ফিরে আসার পেছনে ছিল লক্ষ প্রাণ, আর্তনাদ, স্বজাতির বিশ্বাসঘাতকতা, ইজ্জত। তবুও বাংলাদেশ ফিরে এসেছে, তার আপন মানচিত্রে। শত বাধা অতিক্রম করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এ দেশ।

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক; সৈয়দ হক নামেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত লাভ করেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ-সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাঁকে সব্যসাচী লেখক বলা হয়। দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে মেধার সাক্ষর রেখে গেছেন। তেমনই একটি অসাধারণ উপন্যাস “নিষিদ্ধ লোবান”।

“নিষিদ্ধ লোবান” উপন্যাসে সৈয়দ হক এক নারীর চোখে পাঠককে দেখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা। তার এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে এগিয়েছে ৭০ পৃষ্ঠার ছোট্ট এ উপন্যাসটি। সে নারীর নাম ‘বিলকিস'। যদিও বিলকিস একা ছিল না, তার সাথে ছিল সিরাজ নামের এক কিশোর। বিলকিস ও কিশোর যোদ্ধা প্রবীর ওরফে সিরাজের সাথে হাঁটতে শুরু করে পাঠক। সময়ের নানা বাধা অতিক্রম করে উপন্যাসটি একটি সময় সমাপ্তিতে পৌঁছায়। এখানে লক্ষণীয় যে, এ উপন্যাসের চরিত্রায়ন করতে গিয়ে সৈয়দ হক কিছুটা বৈচিত্র্য অবলম্বন করেছেন। প্রধান দুই চরিত্রের মধ্যে তিনি দুজন পুরুষও রাখতে পারতেন, কিন্তু তা করেন নি। কারণ এতে তিনি যুদ্ধে নারী ও কিশোরদের অংশগ্রহণ, নারীর ত্যাগ ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না। কাজেই এ কথা বলাই যায় যে উপন্যাসের চরিত্রায়নে সৈয়দ শামসুল হক পুরোপুরিভাবে সফল।

বিলকিসের গন্তব্য জলেশ্বরী গ্রাম। এটি একটি কাল্পনিক গ্রাম। যদিও লেখকের বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন তাঁর জন্মস্থানের ছায়া অবলম্বনেই তিনি জলেশ্বরীর চিত্র আঁকতে চেয়েছেন। বিলকিসের গন্তব্য জলেশ্বরী হলেও তাকে নেমে যেতে হয় নবগ্রাম স্টেশনে। স্টেশনে নামার পর সে দেখতে পায় চারদিকে থমথমে অবস্থা। মূলত তখনকার পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় এমন থমথমে অবস্থার চিত্রায়ন যে আবশ্যিক ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

জলেশ্বরীতে বিলকিসের পরিবারের বসবাস। বিলকিস স্বভাবতই তার পরিবারের জন্য চিন্তিত। পরিবারের কাছে পৌঁছানোর তাগিদে হেঁটেই সে রওনা হয় জলেশ্বরীর দিকে। চলার পথের সঙ্গী সিরাজের মুখেই সে শুনে হানাদার বাহিনীর নির্মমতার কথা। রাজাকার, আলবদর বাহিনীর নৃশংসতার কথা। সৈয়দ হক ছোট ছোট ঘটনার মাধ্যমে পাকিস্তানিদের নৃশংসতার বর্ণনা দিয়ে গেছেন। এমনকি মৃত লাশকে সৎকার না করে তা কুকুর শিয়ালের খাদ্য হিসেবে রাখার মতো ঘৃণ্য কাজের বর্ণনাও লেখক বর্ণনা করেছেন।

এত এত নির্যাতন, আপনজন হারানোর বেদনা প্রকাশ করার মতো শোক আর অবশিষ্ট ছিলো না বাঙ্গালীদের। সেই শোক কে শক্তিতে পরিণত করে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে। সেই শ্রেণিরই প্রতিনিধিত্ব করছে হয়ত বিলকিস। তার ভাই খোকার মৃত্যু সংবাদ শুনে যেন কাঁদতে ভুলে যায় সে। প্রতিজ্ঞা করে, যত বিপদই আসুক মৃতদের লাশ সৎকার সে করবেই। যথারীতি এখানেও সঙ্গী হিসেবে সিরাজ তার পাশে থাকে। কয়েকজনকে কবর দিতে পারলেও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তারা ধরা পড়ে যায়, স্থান হয় পাকবাহিনীর ক্যাম্পে।

উপন্যাসের শেষাংশে মেজর চরিত্রটির উপস্থিতি পাওয়া যায়। তার নির্যাতনের স্বীকার হয় বিলকিস ও সিরাজ। একপর্যায়ে সিরাজ হানাদারদের হাতেই প্রাণ দেয়। সে মূহুর্তে দাঁড়িয়েও বিলকিস তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকে। সে তার এই ভাইয়েরও সৎকার করতে চায়। মেজর বিলকিসকে জয় করার লোভে সিরাজকে সৎকারে রাজি হয়। কিন্তু সিরাজের চিতায় মেজরকে পুড়তে বাধ্য করে বিলকিস, সাথে নিজেও। উপন্যাসের শেষাংশ বর্ণনা করতে গিয়ে সৈয়দ হক বলেছেন-

“ঠিক তখনই বিলকিস তাকে (মেজরকে) আলিঙ���গন করে। সে আলিঙ্গনে বিস্মিত হয়ে যায় মেজর। পর মুহূর্তেই বিস্ফারিত দুই চোখে সে আবিষ্কার করে, রমণী তাকে চিতার ওপর ঠেসে ধরেছে, রমণীর চুল ও পোশাকে আগুন ধরে যাচ্ছে, তার নিজের পিঠ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। রমণীকে সে ঠেলে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু রমণীকে আগুন দিয়ে নির্মিত বলে এখন তার মনে হয়। ...মশালের মতো প্রজ্বলিত সমস্ত শরীর দিয়ে তাকে ঠেসে ধরে রাখে বিলকিস”।

অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে আছে এ বইয়ের পরতে পরতে। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি পেশার ভেদাভেদ ভুলে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্বাধীন হয়েছে এ দেশ। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নির্মমতার চিত্র অনেকাংশেই তুলে ধরে ‘নিষিদ্ধ লোবান’, আর তা উপলব্ধি করার জন্য এ উপন্যাসটি অবশ্যপাঠ্য।
This entire review has been hidden because of spoilers.
Profile Image for Abdul Kaium.
20 reviews3 followers
April 5, 2022
"মুহূর্তের ভেতরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দুজন।নিঃশব্দে একের পর এক লাশগুলো টেনে এনে তারা জড়ো করতে থাকে।সময় অতি দ্রুত অতিক্রান্ত হতে থাকে।চাঁদ আরো সরে আসে।আকাশে আজ মেঘ নেই।চত্বরের ওপর বীভৎস শ্বেতীর মতো ছেঁড়া আলো পড়ে থাকে"

মুক্তিযুদ্ধের পাক সদস্যদের অত্যাচারী মনোভাবের অংশটুকু দিয়ে শুরু হলেও বিলকিসের অস্বাভাবিক সাহসিকতা, নারীত্বই এই উপন্যাসের মূখ্য বিষয়।
অনেকটাই পরিত্যক্ত রেল স্টেশনে বিলকিসের আগমনের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের সূচনা।সেই সাথে নতুন চরিত্রের সূত্রপাত, যার হাত ধরেই সে এগিয়ে যায় পাক সেনাদের আক্রমণে নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজতে। একটা সময় রাতের আঁধারে বের হয়ে হাজারটা লাশের মধ্য থেকে সে মৃত ভাইয়ের লাশ খুঁজে বের করার মতো দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেয়। আর বরাবরের মতোই তার পাশে ছায়া হয়ে থাকে অপরিচিত সেই বালক।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত একাত্তর পৃষ্ঠার এই উপন্যাসে চরিত্রের সংখ্যার তুলনায় ঘটনাপ্রবাহ খুব স্বাভাবিক গতিতে এগিয়েছে।উপন্যাসের সবচেয়ে রোমহষর্ক বর্ণনা শেষাংশে যা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত হলেও স্বস্তিদায়ক।

"মশালের মতো প্রজ্বলিত সমস্ত শরীর দিয়ে তাকে ঠেসে ধরে রাখে বিলকিস"।

" একবার চাই এক চিক্কুর দিবার, দিমু তয়?
জিগাই কিসের সুখে দুঃখ নিয়া করো তুমি ঘর?
আঙিনার পাড়ে ফুলগাছ দিলে কি সোন্দয় হয়,
দুঃখের কুসুম ঘিরা থাকে যার,জীয়ন্তে কবর"
Profile Image for Shahidul Nahid.
Author 5 books141 followers
September 29, 2016
বই: নিষিদ্ধ লোবান
লেখক: সৈয়দ শামসুল হক

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পড়েছি, কিন্তু উনার কোন বই এই প্রথম পড়া হলো। মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নিয়ে বইটা। বেশ সুন্দর, সাবলীল একটা বই।

রিভিউ: ( স্পয়লার এ্যালার্ট)
বিলকিস যুদ্ধের ৬মাসের মাথায় গ্রামে ফিরে আসার জন্যে ট্রেনে উঠে। অর্ধেক পথ যাওয়ার পর গ্রামে গণ্ডগোল এর কারণে ট্রেন আর সামনে যায় না। তখন থেকে তার সংগী হয় সিরাজ উরফে প্রদীপ। যুদ্ধে প্রদীপ নিজের আত্নপরিচয় সহ সবকিছুই হারায়। কাদের স্যারের মেয়ে বিলকিসকে সাহায্য করতে সে সামনে এগিয়ে আসে..বিলকিস তার ভাইয়ের লাশ কবর দিতে গিয়ে ধরা পরে যায়। কিন্তু তবু সে তার ভাইসহ অন্যদের কবর দিবেই বলে মনস্থির করে। এর মধ্যে হানাদারবাহিনীর অত্যাচারে এবং তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে গিয়ে মারা যায় প্রদীপ। হিন্দু কোন মেয়ের ইজ্জতলুট করে নি পাকিস্তানি মেজর এবং সেই বাসনায় সে বিলকিসের শর্ত মেনে নেয়। চিতা সাজাতে সাহায্য করে। কিন্তু চিতায় শুধু প্রদীপই দগ্ব হয় না, বিলকিস নিজেও আত্নাহুতি দেয় এবং মেজরকে জড়িয়ে ধরে মেরে ফেলে..
Profile Image for StellaN.
38 reviews10 followers
November 8, 2023
ইতিহাস প্রেক্ষাপটের লিখা সবসময় ভালো লাগে।কিন্তু এই উপন্যাসটিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত করেছে।
তবে উপন্যাসটি পড়ার আগে 'গেরিলা' ফিল্মটি দেখেছিলাম। কিছুটা পরিবর্তন করে ফিল্মটি হলেও বেশ সুন্দর গোছানো ছিলো।
Profile Image for Fårzâñã Täzrē.
274 reviews19 followers
October 1, 2024
"নারীকে ভেবো না কেউ দুর্বল, অসহায়।
নারীর থেকেই ধংস হতে পারে, নারীর থেকেই জয়।"

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির অহংকার। মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করে বীর বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস। রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধ হোক কিংবা হতে পারে যুদ্ধকালীন সময়ের উত্তাল ঘটনা। প্রতিটি ধাপে ধাপে যেন গায়ে কাঁটা দেবে সেইসব উত্তাল দিনের গল্পগুলো।

নারী পুরুষ এখানে তখন এসব ছিলো না। নারীরাও দেখিয়েছে সাহস। তাঁরাও যুদ্ধ যেমন করেছে, তেমনি পাক হানাদারদের জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিল জীবন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাথা রচিত হয়েছে নানান ঘটনার প্রেক্ষাপটে বহু বইয়ের পাতায়। সেইসব উত্তাল সময়ের গল্পে কিন্তু ছিল না সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ছিল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে শত্রু নিধন।

আজকে এক সাহসীকার গল্প শোনা যাক। যুদ্ধের উত্তাল সময়। বাতাসে ভাসছে যেমন লাশের গন্ধ তেমনি আছে লোবানের ঘ্রাণ। চেনেন তো আতর, লোবান? মুসলমানের মৃত্যুতে লাগে। হিন্দু মরলে কী লাগে? আচ্ছা তখন ওই সময়ে কে হিন্দু, কে মুসলিম এত হিসাব কী সবসময় রাখা যেত?

সারি সারি লাশের স্তুপ! বাতাসে লাশের গন্ধ! হাতে সময় খুব কম তার আগেই সব কাজ সেরে ফেলতে হবে। কিন্তু এতোগুলো লাশ দুজন মিলে নামাবে কী করে কবরে! তাও আবার মেয়েমানুষ। দুজনে মিলে আসলেই সম্ভব নয়।

কিন্তু খোকার লাশটা কোথায়! এখনো যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চারপাশে ভয় আর আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে। নাহ্ আজকে আর কিছুতেই কাজ করা যাবে না। ভোর হয়ে এলে মিলিটারিদের নজরে পড়তে হবে। সময় হাতে অল্প অনেক। তাই বাধ্য হয়ে ওদের ফিরতে হলো। বিলকিস ফিসফিস করে সিরাজকে বললো "সিরাজ ওদের সবাইকে আমি কবর দেবোই"।

ঘটনাটা পেছন থেকে বলা যাক তাহলে। নাহলে হয়তো বোঝা যাবে না কী হচ্ছে। বিলকিস গ্ৰামের বাড়িতে যাচ্ছে জলেশ্বরীতে। স্বামী আলতাফ ঢাকার অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়ার পর থেকেই নিখোঁজ। বিলকিস একাই চলছে মা ভাইবোনদের খোঁজ নিতে। কিন্তু নবগ্ৰামে এসেই ট্রেন থেমে গেল। আর ট্রেন জলেশ্বরীতে যাবে না। কারণ ওখানে মিলিটারিরা ক্যাম্প করেছে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে সব। কিন্তু নাছোড়বান্দা বিলকিস যাবেই সেখানে।

স্টেশন থেকে ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে শুরু করে সে। কিছুদূর যাবার পর সে লক্ষ্য করে তাঁর পেছনে একটা ছেলেও আসছে অনুসরণ করে আসছে। বিলকিস থামতেই ছেলেটা কাছে গিয়ে বলল জলেশ্বরীতে বিপদ। তবে বিলকিস যাবেই দেখে ছেলেটিও বিলকিসের সাথে চলতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটি বললো তাঁর নাম সিরাজ। মিলিটারিরা তাঁর বোনকে মেরে ফেলেছে। তার আগে বিহারিদের হাতে খুন হয় বাবা মা ভাই। এখন সে একদম একা। বিলকিসকে সে বোন ডাকে।

বিলকিসকে নিয়ে যখন ওর বাড়িতে পৌঁছেছে দুজনে, তখন বাড়ি একদম শুনশান নীরবতা। বিলকিস মা বোন ভাইয়ের নাম ধরে ডাকলো কিন্তু কোথাও কেউ নেই। সিরাজ ওকে নিয়ে যায় এক নিরাপদ আশ্রয়ে সেখানে গিয়ে জানতে পারে মিলিটারিরা বাজারে বিলকিসের ভাই খোকাসহ আরো কয়েকজনকে গুলি করে মেরেছে। ওদের লাশ কবর দিতে দেয়া হবে না।

বিলকিস ভা���য়ের লাশ দেখতে চাইলে সিরাজকে নিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে যায় গভীর রাতে। বাজারে এতো এতো লাশ দেখে একসময় বিলকিস আর্তনাদ করে ওঠে। সিরাজকে বলে সে এই লাশগুলো কবর দিতে চায়। কিন্তু পরে ওরা ধরা পড়ে গেলো মিলিটারিদের হাতে!!

সিরাজের আসল পরিচয় পাওয়া গেলো পরে। কিন্তু শেষমেশ ওরা কী বাঁচতে পারবে? লাশগুলোর কী হবে? লাশের গন্ধ ভাসে, লোবানের গন্ধ। মৃত্যুপুরী সাক্ষাৎ এটা। শুধু জীবন নয়, এখানে বাঁচাতে হয় অনেককিছুই। নাহলে পরে বেঁচে থেকেও হয়তোবা প্রানহীন শরীর সেটা।

🔹//পাঠ প্রতিক্রিয়া//🔹

সৈয়দ শামসুল হকের লেখা "নিষিদ্ধ লোবান" চিনিয়েছে আমাকে এক শক্তিশালী নারী চরিত্রকে। বিলকিস আমার চোখে এক শক্তিশালী নারী চরিত্র। এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় এরকম কিছু সাহসী নারী প্রতিরোধ করেছিলো ওইসব হায়নাদের।

এদের চোখে কোমলতা আছে, কঠোরতা আছে। নারী সব পারে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে সে আসতে পারে বিধ্বংসী রুপে।

অনবদ্য লেখনীতে সৈয়দ শামসুল হক হয়তো সম্মুখ যুদ্ধের কথা ফুটিয়ে তোলেননি কিন্তু প্রতি মূহুর্তে আঁচ পাওয়া গেছে যেনো সম্মুখের বিপদের কথা। মনের মধ্যে প্রতি পদক্ষেপে ভয় কাজ করবে, উত্তেজনা কাজ করবে। আমি মনে করি এটাই এই বইয়ের আসল সার্থকতা। সাথে কিন্তু আছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। এই দিকটা এত মানবিক ছিল!

শক্তিশালী চরিত্র হিসেবে বিলকিসের পাশাপাশি ছিল আরেক চরিত্র সিরাজ। এবং এই বই সামগ্ৰিক অর্থে পুরো মুক্তিযুদ্ধ নয় আবার মুক্তিযুদ্ধের সময়কার উত্তাল দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেবে। পরিচয় করিয়ে দেবে সাহসিকতার সঙ্গে। একটা দেশ, দেশের সাধারণ নিরপরাধ মানুষেরা এবং কিছু হায়নার দল। যারা কেড়ে নিতে চায় স্বাধীনতা। কিন্তু যেখানে আছে বিলকিসের মতো সাহসীকারা তাঁদের কীভাবে হারাবে ওরা!

আমার বেশ পছন্দের বইটি এবং বর্ণনাশৈলী এখানকার অসাধারণ সাবলীলভাবে এগিয়েছে।

"মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রান হলো বলিদান"

শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি সেই সকল নিবেদিত প্রানকে। যাদের জন্য পাওয়া এই স্বাধীন দেশ। হয়তো তাঁদের সকলের নাম আমরা জানি না কিন্তু যখন এইসব মানুষদের নিয়ে লেখা বইগুলো পড়া হয় আসলেই গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে ভাবলেই সেসব দিনের কথা। কত নির্মমতার শিকার হয়েছিলেন তাঁরা।

"তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!"

জয়ধ্বনি হোক বীর বাঙালির। যাঁরা এনেছিল স্বাধীনতা এদেশের বুকে।

🗯️বইয়ের নাম: "নিষিদ্ধ লোবান"
🗯️লেখক: সৈয়দ শামসুল হক
🗯️ব্যক্তিগত রেটিং: ৪.৫/৫
Profile Image for Sakib A. Jami.
335 reviews36 followers
September 16, 2024
একটা সময়, যখন মানুষ ঠিক ভুলের ঊর্ধ্বে চলে যায়। ভয়ের সীমা পার করার পর এক সময় আর ভয় লাগে না। সময়টাই এমন। ধ্বংসযজ্ঞ দেখার পর মানুষের মন অন্যরকম এক পাথরে পরিণত নয়। তবুও তো মনে ভয় ধরে। পরিবারের চিন্তায় মন ব্যকুল হয়।

বিলকিস ঢাকা দেখে গ্রামের পথে যাত্রা করেছে পরিবারের উদ্দেশ্যে। দেশের অবস্থা ভালো না। চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল। পাকিস্তান নামক বর্বর হানাদারদের নির্মমতা যেন মাত্র ছড়িয়েছে। পঁচিশে মার্চের সেই রাত্রির পর স্বামী আলতাফ আর বাসায় ফিরেনি। আশায় আছে বিলকিস। কিন্তু সে আশা পূরণ হবে কি না বলতে পারে না। গ্রামের বাড়িতে আছে মা, বোন ও ছোট ভাই। তাদের নিয়ে উৎকণ্ঠার অন্ত নেই। তাই তাদের খুঁজতেই রেল ধরে যাত্রা বিলকিসের।

কিন্তু নবগ্রামে এসে যেন সব ঠাণ্ডা। জলেশ্বরী পর্যন্ত ট্রেন যাবে না কোথায় যেন রেললাইন উপরে ফেলছে হানাদারেরা ব্রিজ গুড়িয়ে দিয়েছে মুক্তিবাহিনী। ফলে সেখানে হানাদারদের এক ধ্বংসযজ্ঞ চলে। উৎকণ্ঠায় কাটানো বিলকিস তাই যে করেই হোক জ্বলেশ্বরীতে যাবেই। সাথে জুটে গেছে সিরাজ নামের এক কিশোর। দেখতে, বয়সে তারই ভাই খোকার মতন।

পায়ে হেঁটে গ্রামে পৌঁছে নিজ বাড়ি খালি দেখলে কেমন অনুভূত হয়? বিলকিস মনে করে সব শেষ। খোকা বেঁচে আছে তো? ভাইকে খুঁজতে তাই তৎপর সে। বাজারের মধ্যে সারি বেঁধে মেরে ফেলে হয়েছে গ্রামের যুবক, কিশোরদের। সেই তালিকায় ছিল না তো খোকা?

লাশের স্তুপের মধ্যে ভাইয়ের খোঁজ চলে। কিন্তু…

এত লাশের যে পরিণতি বরণ করতে হয়েছে! ওরা কি মানুষ? একবার পাকিস্তানের বর্বর হানাদার বাহিনী যার সন্ধান পায়, তাকে ছাড়ে না। সুন্দরী যুবতী হলে তো কথাই নেই। কিন্তু নারীদের শক্তি সম্পর্কে উদাসীন পুরুষ সমাজ। একবার নারীরা জেগে উঠল পুড়ে ছাইভস্ম হয়ে যেতে হয়।

সৈয়দ শামসুল হকের “নিষিদ্ধ লোবান” বইটি খুবই ছোট্ট একটি উপন্যাসিকা। একাত্তরের ভয়াবহ দিনগুলোর একটি কাহিনী অবলম্বনে রচিত এই বইটি দেখিয়েছে পারিবারিক বন্ধন। ভাইয়ের প্রতি বোনের মমতা। যে মমতায় কোনো খাদ নেই। নিখাঁদ এ ভালোবাসার প্রতিফলন যেন বইটি।

মানুষের ভয়ের একটা সীমা পরিসীমা থাকে। যখন এই সীমা অতিক্রম হয়ে যায়, তখন মনের মধ্যে ভয় কাজ করে না। দুঃসাহস তখন অচিরেই জন্ম নেয়। যেকোনো বিপদের মুখোমুখি হতে ভয় হয় না। বিপদ সবার জন্য সমান। একজন বৃদ্ধের প্রতি পাকিস্তানের দোসর বা দালালদের যে দৃশ্য লেখক তুলে ধরেছেন, ঘৃণায় মনটা ভরে ওঠে।

লেখকের লেখা সাবলীল ও গতিশীল। ভাষাশৈলী সাধারণ অথচ মায়া ধরানো। যেন নিজেকে অনুভব করা যায় দৃশ্যগুলোতে। বইটির শেষটা ভালো লেগেছে। একজন নারীর মনে কতটা তীব্র আক্রোশ জন্ম নিলে এমন ভয়ংকর কাণ্ড করতে পারে। পাকিস্তানিদের এই বিভৎসতায় আক্রোশ সবারই ছিল। কেউ সাহসী হতে পারেনি। আবার অনেকেই পেরেছে। তারা নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছে।

পরিশেষে, ছোট্ট এই বইটি নিয়ে বিশেষ কিছু আলোচনা করার নেই। একটি কালজয়ী বই, তীব্র আবেগের। এই আবেগটা বেশ গুরুত্বপুর্ণ। অনেক কিছুই তো ঘটেছে সেই সময়টায়। ছোট ছোট ঘটনা চোখের সামনে এভাবে উপস্থাপন আসলে মুগ্ধতা ছড়ায়। সেই সময়টা তখন মনের মধ্যে তীব্রবেগে জায়গা করে নেয়।

▪️বই : নিষিদ্ধ লোবান
▪️লেখক : সৈয়দ শামসুল হক
▪️ব্যক্তিগত রেটিং : ৪.৫/৫
Profile Image for Sajeed Hridoy.
14 reviews1 follower
March 26, 2025
-অবাস্তব,বানোয়াট,কল্পকাহিনী বলে মনেহয়।
-অবাস্তব! অবাস্তব মনেহয় তোমার কাছে এইসব ঘটনা?
-হ্যাঁ, তাই তো মনে হলো।অতিরঞ্জিত,এমন হতে পারে না।
-হতে পারে না বলছো! তুমি ভালো করেই জানো মুক্তিযুদ্ধ গতকালকের ঘটনা নয়।
-হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধ গতকালের নয়, ৫৪ বছর আগের ঘটনা একথা আমি ভালো করেই জানি। কিন্তু তাই বলে তো আর এইসব অতিরঞ্জিত কাহিনীর বাস্তবতা প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে না।

-৫৪ বছর আগের আগের এক নারী, যার স্বামীর সন্ধান নেই।সে আদৌ বেঁচে আছে কি না জানা নেই তাও। যার বাড়িতে মা-বোনের নিরাপত্তা নেই। যার ছোটভাইয়ের লাশ পড়ে আছে খোলা বাজারে।যাকে দাফন করবার অনুমতি নেই। কুকুরের আবার দাফন কীসের!
যার সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হবার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে মা-বোন হারানো,নিজের পরিচয় হারানো এক ভাইকে। কারণ! কুকুরদের কোনো মা-বোন নেই,তাদের সব সমান। আর বাঙালী কুকুর অপেক্ষা কিছু নয়। যার কানে বাজছে এক হায়েনার কন্ঠস্বর।
“আমি কি তোমাকে আকৃষ্ট করি? আমি তোমোয় সন্তান দিতে পারব। উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খাঁটি মুসলমান হবে, খোদার ওপর ঈমান রাখবে, আন্তরিক পাকিস্তানি হবে, চাও না সেই সন্তান? আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, তোমার মাকে দেব, যারা হিন্দু নয়, বিশ্বাসঘাতক নয়, অবাধ্য নয়, আন্দোলন করে না, শ্লোগান দেয় না, কমিউনিস্ট হয় না। জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি। তোমাদের রক্ত শুদ্ধ করে দিয়ে যাব, তোমাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানি রেখে যাব, ইসলামের নিশান উড়িয়ে যাব। তোমরা কৃতজ্ঞ থাকবে, তোমরা আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তোমরা আমাদের সুললিত গান শোনাবে। আমি শুনেছি, বাঙালিদের গানের গলা আছে। আমি কি তোমাকে আকৃষ্ট করি?”

সেই নারী যখন আপন সংকল্পে পাহাড়ের মত স্থির হয়ে বলে, “আমার মৃত্যুভয় নেই সিরাজ,আমি পারব ওদের হুকুম উপেক্ষা করতে।আমি খোকাকে খুঁজে বের করব।নিজের হাতে মাটি দেব।”
তখন তোমার কাছে তা অবাস্তব মনেহয়!
সেই নারী যখন রক্তমাংসের শরীর বদলে হয়ে ওঠে এক আগুনের নারী, ভস্মীভূত করে দিতে কোনো হায়েনাকে বাড়িয়ে দেয় নিজের দু’বাহু। তোমার কাছে তখন তা অসত্য গালগ্লপ বলে মনে হয়!

আমার কাছে তাদেরকে অবিশ্বাস্য মনেহয়।মাটির জন্য,মায়ের জন্য,বুলির জন্য, স্বাধীনতার জন্য নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে যারা দ্বিতীয়বার ভাবেনি আমার তাদেরকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে,রূপকথা ভেবে ভ্রম হয়, কিন্তু তাদের জীবনক্ষয়ী ত্যাগকে অলীক মনে হয় না।

সেইসব অবিশ্বাস্য মানুষদের প্রতি পরম শ্রদ্ধা এবং তাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত ‘স্বাধীনতা’র শুভেচ্ছা সকলকে।


26.3.2025
Profile Image for Alvi Rahman Shovon.
467 reviews16 followers
November 18, 2025
২০১১ সালে সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র গেরিলা সেই বছর মুক্তির পরপরই হলে গিয়ে দেখে ফেলি। কিছুদিন আগে কেন জানি সেই মুভির একটা ক্লিপ দেখে নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাসটি পড়ার ইচ্ছে জাগলো। অর্ডারও করে ফেলি বইখানা।

মাত্র ৭১ পৃষ্ঠার ছোট্ট একটা বই। অবশ্য চলচ্চিত্রে দৈর্ঘ্য বাড়াতে বইয়ের কাহিনির সাথে অনেক কিছু যুক্ত করা হয়েছে। স্বল্প পরিসরে উপন্যাসটি লেখা হলেও বইটির লেখনীশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি।

উপন্যাসটির কাহিনী আবর্তিত হয় বিলকিস নামের এক নারীকে ঘিরে যে কিনা ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় সাংবাদিক স্বামী নিখোঁজ হবার দুই মাস পর রংপুরের জলেশ্বরীতে নিজের বাপের বাড়ি যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু বাপের বাড়ি গিয়ে নিজের পরিবারের কাউকে না পেয়ে তাদের খুঁজতে বের হয়। সাথে সঙ্গী হয় স্টেশনে পরিচয় হওয়া ভাইতুল্য তরুন সিরাজ। তাদের পুরো দুইদিনের কাহিনী মলাটবন্দী হয় নিষিদ্ধ লোবান বইটিতে।

ভেবেছিলাম যেহেতু গেরিলা চলচ্চিত্রটি দেখা হয়েছে আগে তাই নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাসটি ভালো লাগবে না। অথচ পড়তে শুরু করার পর অন্য রকম এক মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়ে গিয়েছি। শেষটা অন্যরকম ভালো লেগেছে। চলচ্চিত্রের শেষটা যদিও অন্য রকম ছিলো।

এক নজরে:
বইয়ের নাম: নিষিদ্ধ লোবান
লেখক: সৈয়দ শামসুল হক
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশনী: অনন্যা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৭১
মূদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা
Profile Image for Anika Tabassum .
88 reviews17 followers
September 10, 2025
ছোট্ট একটা উপন্যাস, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির উপর নির্মিত।
স্বামী ফিরবে এই আশার জলাঞ্জলি দিয়ে ধলেশ্বরী গ্রামে ফিরতে গিয়ে দুঃসংবাদটা পায় বিলকিস। যুদ্ধের সময় কান্না করতে ভুলে যায় সে, ভুলে যায় ধর্মের ভেদাভেদ। বনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শেয়ালেরাও বুঝে বাজারে থরে থরে সাজানো লাশের মত জীবিত এই মানুষ গুলোও এখন লাশ, তাই তারা আর ভয় পায় না ঘুরে বেড়ায় নির্দ্বিধায় তাদেরই সাথে।
গল্পের শেষে এসেছে যুদ্ধকালীন নারীর লাঞ্ছনার বর্ণনা।
স্বল্প শব্দে লেখক অনেক কিছুই বলেছেন গল্পে।
Profile Image for শৌণক.
112 reviews17 followers
March 27, 2020
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গল্প, মানুষ আর শয়তানের গল্প, বিলকিস আর খোকার গল্প। সিরাজের গল্প যে প্রদীপ হতে পারত।
Profile Image for Klintu.
7 reviews1 follower
March 30, 2019
বই - নিষিদ্ধ লোবান।
লেখক - সৈয়দ শামসুল হক।
ধরন - মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক।
প্রকাশনী - অনন্যা।
পত্রসংখ্যা - একাত্তর।
মূদ্রিত মূল্য - একশত কুড়ি টাকা।
রেটিং - ৪.১/৫।

জলেশ্বরীর হাই স্কুলের একজন সুনামধন্য শিক্ষক কাদের মাষ্টার, গ্রামে একটি কথা প্রচলিত অাছে, ' পুরো গ্রামে কাদের মাষ্টারের চেয়ে ভালো ইংরেজি নাকি কেউ পারে না। ' বিলকিস কাদের মাষ্টারের মেয়ে। সে তার স্বামী অালতাফের সাথে ঢাকা শহরে থাকে। ২৫শে মার্চ ঢাকার বুকে পাশবিক হত্যাকাণ্ড অাছড়ে পড়ার পর থেকে অালতাফ নিঁখোজ। অালতাফের নিঁখোজ হওয়ার পর বিলকিস বাস্তবতার বেড়াজালে পড়ে যায়! তাদের পাঁচ বছরের জীবনে তারা বাচ্চা নেয় নি, তার সুফল এখন বিলকিস পাচ্ছে। বাচ্চা থাকলে এখন বিশাল ঝামেলায় পড়তে হতো। অালতাফ কী বেঁচে নেই?থাকলে সে এখন কোথায়?

বিলকিস দিশেহারা হয়ে ট্রেনযাত্রায় গ্রামের বাড়ি পারি দেয়। জলশ্বরী গ্রামটি বাংলার বুকের অপরূপ নিদর্শন। সেখানে বিলকিসের মা তার ছোট ছেলে খোকা ও বিধবা বড় বোনের ছেলেমেয়ে সহ থাকে। তাদের জন্য মন কেমন জানি করে বিলকিসের,তারা সবাই ভালো অাছে তো?খোকা! খোকা কেমন অাছে? ট্রেনের ঝুকঝুক শব্দ জলেশ্বরীর ঠিক অাগের স্টেশন, নবগ্রামে এসে থেমে যায়। ট্রেন নাকি অার যাবে না! জলেশ্বরীতে নাকি কোন ঝামেলা হয়েছে। মা,দিদির কিছু হয়নি তো? অার খোকা! খোকা ঠিক অাছে তো?

জলেশ্বরী যে নবগ্রাম থেকে অনেকদূর,প্রায় পাঁচ মাইল। ট্রেন ছাড়া যে যাওয়ার অার কোন দ্বিতীয় পথ নেই। তখন পড়ন্ত দুপুর নিভু নিভু করছিলো অাকাশে। এই নির্জন পথে রেললাইন ধরে বিলকিস হন্টন শুরু করে। পথঘাট নির্জন, চারিদিকে পিন পতন নীরবতা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সমগ্র বাঙালী অাতঙ্কে অাছে। পথে ঘাটে মানুষ মরছে! হিন্দুদের দেখা মাত্রই গুলি করা হচ্ছে। হাজার হাজার ফুলকে ধর্ষণ করা হচ্ছে,পথে পথে তারা নির্যাতিত হচ্ছে। অথচ পুরো বাংলাদেশটা যেন বোবা-অন্ধ পাখি! বাংলার মুক্তিবাহিনী তৈরী হচ্ছে এমন ছায়পাশ কথা বাতাসে ভাঁসছে। ভারতে নাকি যুদ্ধের ট্রেনিং হচ্ছে। বিলকিস শুনেছে যে অালতাফও নাকি ইন্ডিয়া গেছে। হাঁটতে হাঁটতে বিলকিস অমাবস্যার চাঁদের মতো একজন ১৭-১৮ বছরের যুবকের সঙ্গ পেল যার পরিবারকে নাকি মিলিটারি পশুর দল নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। নাম তার সিরাজ। ধর্মে হিন্দু। তার কথা শুনে বিলকিস অারো চিন্তিত হয়ে পড়ে। খোকা,খোকা ঠিক অাছে তো? সন্ধ্যে নামলে তারা দুজন জলেশ্বরীর মাটিতে পা রাখে। তাদের মনে হয় এই গ্রামে কোন প্রাণ অবশিষ্ট নেই। অাতঙ্কে জর্জরিত বিলকিস তাদের বাড়িতে পরিচিত কোন মুখ দেখতে পাই না। এমনকি রাস্তাঘাটে কুকুর পর্যন্ত নেই। সমগ্র জলেশ্বরীতে ভর করেছে নিরবতার ঝড়। সিরাজ খবর নিতে যায়। মিলিটারি নাকি এখনো অাছে। তারপর দুজন বেরিয়ে পরে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য। সিরাজের সাবালক অাচরণ দেখে বিলকিস মুগ্ধ হয়। এই ছেলেটা সেই তখন থেকেই তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। পাঁচ মাইল সাথে সাথে এসেছে। খোকাও ঠিক ওর বয়সি হয়েছে। তবে, খোকা কি বেঁচে অাছে?

তারপর তারা গ্রামের প্রথম জীবন্ত মানুষের দেখা পাই,নাম অালেফ মোক্তা��। ৫৪'র সময়ের নাম করা মুসলিমলীগ'র নেতা। তবে এখন সে শারীরিক ভাবে অক্ষম, তার চোখদুটি শকুন চুরি করেছে। তার থেকে খবর পাওয়া যায় গ্রামের সবাই নাকি পালিয়েছে। অাজ বাজারে নাকি তুমুল হত্যাকাণ্ড, লুটপাট হয়েছে। বাজারের মুখে অনেক মৃত বিভৎস লাশ পড়ে অাছে! পাকিস্তানি অমানুষের জাত নাকি বলছে এদের কেউ এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। এরা হবে ক্ষুদার্থ শকুনের পেটভরা অাহার। কথাটি বিলকিস মেনে নিতে পারে না। সে ঘটনাস্থলে গিয়ে তার ভাইয়ের মৃত দেহ অাবিষ্কার করে। ঠিক সেখান থেকে শুরু হয় এক বিপ্লবী সূচনা। কী ছিলো তারপরের নৃশংস সত্য?

নিজের মতামত

বইটি অসাধারণ এবং শেষ ভাগটা দারুণ চমকপ্রদক। যার কারণে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক রচনা সমূহের মধ্যে সবার অাগে এই উপন্যাসের জয়গান গাওয়া হয়। লেখকের হিন্দু সমাজের নির্যাতিত ঘটনা প্রকাশ থেকে শুরু করে পাকিস্তানিদের বাকরুদ্ধকর পাশবিকতা,যা গ্রামকে গ্রাম উজার করে দিচ্ছিলো। সবকিছু বেশ সফল ভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন লেখক। তবে, অামার মতে অারো এক-দুটি ঘটনা বইটিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতো। মুক্তিযুদ্ধের সময়টা অাসলে কেমন ছিলো সেটা অামরা মোটামোটি জানলেও এই বইয়ে তার ব্যতিক্রম প্রদর্শনী অাছে। প্রত্যেক বাঙ্গালীর বইটি পড়া উচিত।
Profile Image for Sumaia Adrita.
30 reviews12 followers
July 7, 2019
মশালের মত প্রজ্জ্বলিত হোক প্রতিটি নারী।ঠিক বিলকিসের মতই!!
Profile Image for Nabonita Pramanik.
Author 1 book20 followers
November 8, 2021
নিষিদ্ধ লোবান : বিক্ষোভের দিনে মুক্তির ঘ্রাণ

“দিন এখন ভীত করে। রাত আশ্বস্ত করে। বাতাস এখনো গন্ধবহ, তবে কুসুমের নয়, মৃত মাংসের। তবু, স্মৃতি বিনষ্ট অথবা নিঃশেষে ধৌত নয়।”

ঢাকার ট্রেন নবগ্রামে বেশিক্ষণ থামে না। বিপত্তি বাঁধে তখন, যখন স্বভাবের বিরোধিতা করে বসে চিরচেনা বাহন। অহেতুক নবগ্রামে এসে দীর্ঘক্ষণ ধরে আটকে থাকে। মুহুর্তেই বেড়ে যায় এক স্টেশন পরের জলেশ্বরীর সামান্য পথের ব্যাপ্তি। শহুরে বিলকিসও আঁচ করতে পারে পরিস্থিতির ভয়াবহতা। তবু মনকে প্রবোধ দেয়, এই বন্ধুর পথ ভাঙতে হবে। যেতে হবে শেষ সীমানায়। জলেশ্বরীতে।

বিলকিস মূলত অস্তিত্বের চরম সংকটের শিকার। স্বামী, আলতাফের নিখোঁজ সংবাদ এ সংকটের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। সে বেঁচে আছে না মরে গেছে, কিছুই জানে না বিলকিস। শুধু জানে, যেভাবেই হোক জলেশ্বরীতে ফিরতে হবে। এই কঠিন অভিযানে পৃথিবীর সব পথ যদি বন্ধ হয়েও যায়, তবে গড়ে তুলতে হবে নতুন একটা পথ। কিন্তু জলেশ্বরীতে ফেরার জন্য কীসের এত তাগিদ বিলকিসের?

আসলে জীবনের যুদ্ধে মানুষকে হারিয়ে দেওয়া খুবই কঠিন। সে যে হার মানতে চায় না সহজে! প্রবল বিপর্যয়ের দিনেও সামান্য খড়কুটো আঁকড়ে ধরে স্বপ্ন দেখে নতুন করে বাঁচার। বিলকিসও বাঁচতে চেয়েছিল। আর জলেশ্বরী ছিল তার টিকে থাকার শেষ সম্বল কিংবা অকৃত্রিম প্রেরণার অফুরন্ত উৎস।

বিলকিস যখন জলেশ্বরীতে ফিরতে চায়, তখন দেশ জুড়ে তুমুল যুদ্ধ। মুক্তির জন্য যুদ্ধ। স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য যুদ্ধ। বিলকিসও যুদ্ধ করত। তবে আর পাঁচটা মুক্তিসেনার তুলনায় তার যুদ্ধটা ছিল একেবারেই আলাদা। ভিন্নধারার এ যুদ্ধটা ছিল সম্ভ্রম রক্ষার। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে আগলে রাখার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্বাধীনতা অর্জনের এই এত দিন পরও বিলকিসদের যুদ্ধটা কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি।

তবে শেষ পর্যন্ত জলেশ্বরীতে ফিরতে পেরেছিল বিলকিস। চেনা পথের বিচিত্র এ যাত্রায় ভীষণ অপ্রত্যাশিতভাবে সঙ্গী হয়েছিল এক সতেরো আঠারো বছরের কিশোর, সিরাজ। কিন্তু সিরাজের গল্পটা কী রকম? সে কেন বিলকিসের সঙ্গ ধরেছিল জলেশ্বরীতে ফেরার জন্য?

বিলকিস জলেশ্বরীতে যেতে চেয়েছে পুরোপুরি নিজের তাগিদে। সেখানে তার মমতাময়ী মা আছে। মাতৃস্বরূপা বড় বোন আছে। স্নেহের ছোট ভাই আছে। অন্যদিকে জলেশ্বরীর সাথে সিরাজের যেটুকু সদ্ভাব ছিল, সেটুকু অনেকদিন আগেই ছিন্ন হয়ে গিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কারণে। উপরন্তু সুন্দর নামের এই স্থান তার কিশোর মনে কুৎসিত কিছু অনুভূতির অবতারণা ঘটায়। তবু- সে ফিরতে চায় জলেশ্বরীতে। আর যে কারণে ফিরতে চায় সিরাজ, যে দুর্দমনীয় স্রোতের টানে দগ্ধ অতীতের পথে পা বাড়ায় বিলকিসের হাত ধরে; সেই শাশ্বত বোধ-ই আলোচিত বইয়ের সারকথা। হ্যাঁ, সেই অব্যর্থ প্রতিশ্রুতি-ই আমরা ধারণ করতে চাই।

“তারপর সেই দৃশ্য দেখা যায়। বাজারের খোলা চত্ত্বরময় ছড়িয়ে আছে লাশ! বেড়াহীন উলঙ্গ দোকানের খুঁটি আঁকড়ে পড়ে আছে লাশ। আলোর দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে যে গলিটা, তার ওপরে উপুড় হয়ে আছে লাশ। লাশের পর লাশ। এক, দুই, তিন, চার, ছয় সারি চোখে পড়ে- বাজারে হয়তো ফল বেচতে এসেছিল গাছের, দুটো বাচ্চা উল্টে থাকা গরুর গাড়ির ছাউনি জড়িয়ে ধরে- লাশ; সমস্ত চত্ত্বর আর খালের ঢালু জুড়ে ইতস্তত বাঁশের গোল গোল ঝাঁকা, কলস, সবজি; আর সমস্ত কিছুর ওপরে স্তব্ধতা, স্থিরতা, প্রত্যাবর্তনের আশাহীন অক্ষমতা।”

কিন্তু জলেশ্বরীতে এসে বিলকিস আবিষ্কার করল, তার প্রাণের খোকা- স্নেহের ছোট ভাইকে মিলিটারিরা নির্মমভাবে গুলি করে মেরেছে। লাশ ফেলে রেখেছে বাজারে। আরোপ করেছে দাফনের নিষেধাজ্ঞা। এ যেন এক নিষিদ্ধ লোবানের আখ্যান! যে সুগন্ধির ঘ্রাণ গায়ে মেখে মৃতেরা পরম আপন, মৃত্তিকার কাছে ফিরে যায়; সেই লোবান আজ বিলকিসের ভাইদের জন্য নিষিদ্ধ! আদৌ কি কোনো বোন মেনে নিতে পারবে এ অন্যায়? বিলকিসও পারেনি।

“কেউ ভেঙ্গে পড়ে না, শোক কখনও এত বড় নয় যে, মানুষ মাথা তুলে দাড়াতে পারে না।”

মানুষের মনোবলকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারবে, শোকের তেমন শক্তি নেই। সময়ের মলম এতখানি গাঢ় যে, পুরোনো ক্ষত অনায়াসে সেরে যায়। নতুন ক্ষত গজিয়ে ওঠার সুযোগ পায় না সহজে। আলতাফের নিখোঁজ সংবাদ যে বিলকিসকে প্রায়শই ভোগায়, ভাইয়ের মৃত্যুতে সেই বিলকিসের চোখে জল আসে না। মানব মনের চিরায়ত এই প্রবৃত্তি বইয়ের পাতায় তুলে ধরেছেন লেখক সৈয়দ শামসুল হক। শব্দে-উপমায় বর্ণনাশৈলীর ব্যাপারটা এত চমৎকার, যার কারণে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়ে যেতে কোনো সমস্যা হয় না।

নিষিদ্ধ লোবান মুক্তিযুদ্ধকে যতখানি ধারণ করে, ঠিক ততখানি লেপ্টে নেয় শাশ্বত মানবতাবোধ। অসাম্প্রদায়িক চেতনা এই বইয়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক, যার মর্মস্পর্শী বাণী ধ্বনিত হয়েছে বিলকিস আর সিরাজের মধ্য দিয়ে। একা নারীর সংগ্রামী এ যাত্রা সম্পর্কে পড়তে গিয়ে এমনিতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। শেষাংশে অপ্রকৃতিস্থ মেজরের কুৎসিত চিন্তাধারার যে অগ্নিদগ্ধ জবাব দেয় বিলকিস, তা খানিকটা বাস্তব-বিবর্জিত হলেও আলোচিত সময়ের ভয়াবহতার সাথে একেবারে প্রাসঙ্গিক।

সৈয়দ শামসুল হকের অসাধারণ নৈপুণ্যে রচিত বই, নিষিদ্ধ লোবান আকারে ছোট হলেও মানের দিক দিয়ে একেবারে সেরা। মুক্তিযুদ্ধের জটিল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আরেকটু কাছ থেকে জানার জন্য সহায়ক হতে পারে এই বই। জয়-পরাজয়ের চিরায়ত গল্পকে ছাপিয়ে নিষিদ্ধ লোবানে ধরা দিয়েছে একাত্তরের দিনগুলোর ভয়াবহতার রূপরেখা। পাকিস্তানি মিলিটারির বর্বরতা ও অত্যাচারের মাত্রা কতখানি বিস্তৃত ছিল, বইখানা পড়ার মধ্য দিয়ে পাঠক সেটা আঁচ করতে পারবেন। স্বাধীনতার জন্য মুক্তিকামী মানুষের ত্যাগ- বিশেষ করে নারী জাতির সুমহান ত্যাগের কথা গুণী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের রচনায় প্রস্ফুটিত হ���়ে উঠেছে বইয়ের পাতায়। পড়ার আমন্ত্রণ রইল।

বই : নিষিদ্ধ লোবান
লেখক : সৈয়দ শামসুল হক
ধরন : মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস
প্রকাশনী : অনন্যা
Profile Image for Mojaffor Hossain.
57 reviews19 followers
April 30, 2021

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখা। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র এক নারী। বিলকিস। ২৬ মার্চ প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা পাক-হানাদার কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পর, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে রংপুর থেকে মিলিটারি ছড়িয়ে পড়ে মফস্বল শহর ও গ্রামগুলোতে। সঙ্গে যুক্ত হয় লুটেরা বিহারিদের ধ্বংসতা-ব। বিলকিসের গন্তব্যস্থল জলেশ্বরী গ্রাম। সেখানে তার মা, কিশোর বয়সী ছোটভাই, বিধবা বড় বোন ও তার দুই ছেলে-মেয়ে আছে। জলেশ্বরীর আগের স্টপেজ নবগ্রাম স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়ে। আর এগুনো সম্ভব না। বিলকিস কোনো বিকল্প পন্থা না পেয়ে একাই পায়ে হাঁটা শুরু করে। খানিক হাঁটার পর টের পায় ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করছে কিশোর বয়সী এক ছেলে। নাম সিরাজ। সিরাজ সামনে এগোতে নিষেধ করলেও বিলকিস হাঁটতে থাকে দৃঢ়ভাবে। শুরু হয় বিলকিসের যুদ্ধমুখী অভিযান।
জলেশ্বরীতে তখন মিলিটারি, বিহারি আর শান্তি কমিটির লোকজনের রাজত্ব। বাঙালিদের ভেতর পড়ে আছে কেকবল অন্ধ অসহায় আলেফ মোক্তার। তার কাছে বিলকিস জানতে পারে, শহরের একপ্রান্তে একদল যুবককে মিলিটারিরা মেরে ফেলে রেখেছে। জানাজা হতে দেয়নি। এই লাশগুলোর মধ্যে বিলকিসের ছোটভাই খোকাও আছে। বিলকিস সব শুনে উঠে পড়ে, সে নিজের হাতে তার ছোটভাই খোকার লাশ মাটি দেবে, এই প্রত্যয় নিয়ে। সিরাজ অদম্য বিলকিসকে থামাতে না পেরে তার যুদ্ধসঙ্গী হয়। মিলিটারিদের নিষেধ উপেক্ষা করে লাশ দাফনের কাজ করা, এ-এক যুদ্ধই বটে। ওরা দুজনে গেরিলা স্টাইলে মধ্যরাতে পড়ে থাকা লাশগুলো একটার পর একটা উল্টিয়ে দেখে। খোকাকে পাওয়া যায় না। অসংখ্য লাশ, সব পরখ করে দেখাও সম্ভব না। ওরা সিদ্ধান্ত নেয়, সবগুলো লাশ দাফন করবে। সে রাতে ছটি লাশের দাফন সম্পন্ন করতে সক্ষম হয় তারা। রাত ফিকে হয়ে এলে তারা রাস্তায় পাশেই এক পাটগুদামে আশ্রয় নেয়। পরের রাতের অপেক্ষা। গুদামে অন্ধকারে নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ করে সিরাজ। তার আসল নাম প্রদীপ। সে ইন্ডিয়া যায়নি, এখানেই মুক্তিবাহিনির সঙ্গে কাজ করছে।
রাত গাঢ়-ঘন হলে আবারো তারা রাস্তায় নামে, লাশ সরানো এবং দাফনের কাজে। এ সময় বিলকিস জানায় যে, সে লাশ দাফনের কাজ শেষ হলে নবগ্রামে মনসুরদার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নিয়োজিত হবে। মা-বোনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেয়ে তার কাছে তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করা। সে একজন নারী, এই পরিচয়ের চেয়ে তখন বড় হয়ে ওঠে--সে একজন মুক্তিকামী যোদ্ধা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে সংগ্রামী ইতিহাস, তার সঙ্গে পুরুষের পাশাপাশি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন লক্ষ-কোটি নারী। তারই এক ধরনের স্বীকৃতি মেলে সৈয়দ হকের এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে।
এক পর্যায়ে খোকার লাশ খুঁজে পায় বিলকিস-সিরাজ। কিন্তু আর বেশিদূর এগোতে পারে না। ধরা পড়ে যায় ওঁৎ পেতে থাকা বিহারী ছোকড়াদের কাছে। তারা তাদের মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সিরাজকে আলাদা ঘরে শারীরিক নিপীড়ন চালিয়ে বিলকিসের ঘরে আসে মেজর। বিলকিসকে বলে, ‘স্বীকারোক্তির জন্যে তোমাকে বাধ্য করবো না।...কোনো কিছুর জন্যেই তোমাকে বাধ্য করব না, এমনকি তোমার দেহের জন্যেও নয়। ... তুমি নিজেই আমার কাছে আসবে।’ অর্থাৎ সেই পরিস্থিতিটা নির্যাতন-নীপিড়নের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি করতে চায় মেজর। মেজর জৈবিকভাবে অক্ষম হলেও, সে একজন ধর্ষক পুরুষ। মেজর অক্ষম। আর তার সেই অক্ষমতায় বিলকিস এবং সিরাজ নামধারী প্রদীপকে দাঁড় করায় আরো নির্দয় বাস্তবতার মুখোমুখি। মেজরের নির্দেশ মতো সিরাজকে নগ্ন করা হয় বিলকিসের সামনে। নগ্ন করা হয় বিলকিসকে। মেজর বলে, ‘আমি এখন কুকুরের সঙ্গে কুকুরের মিলন দেখবো।...বাঙালিরা কুকুরের অধিক নয়। কুকুরের ভাইবোন নেই।’ সিরাজকে নগ্ন করেই প্রহরী চিৎকার করে ওঠে-- ‘স্যার, ইয়ে তো হিন্দু হ্যায়?’ সিরাজ নামধারী প্রদীপ বন্দুক কেড়ে নিতে গেলে তাকে মেরে ফেলা হয়। প্রদীপের বোন জেনে বিলকিসকেও হিন্দু ভেবে তার দেহের প্রতি মেজরের আকর্ষণ আরো বেড়ে যায়। সুযোগটা কাজে লাগায় বিলকিস। সে দেহ থেকে কাপড় সরিয়ে মেজরের সামনে দাঁড়ায়। তার আগে তার কিছু শর্ত আছে। শর্ত হল, প্রদীপের লাশ কাঠের ওপর পোড়াতে হবে। স্থান হতে হবে নদীর তীর। শর্তে রাজি হয় মেজর। নদীর ধারে আগুন দেয়া হয় কাঠে। ভেতরে প্রদীপের মৃতদেহ। আগুনে প্রায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বিলকিস। তাকে মেজর নিয়ে যেতে আসলে ‘বিলকিস তাকে আলিঙ্গন করে।...পর মুহূর্তেই বিস্ফোরিত দুই চোখে সে আবিষ্কার করে, রমণী তাকে চিতার ওপর ঠেসে ধরেছে, রমণীর চুল ও পোশাকে আগুন ধরে যাচ্ছে, তার নিজের পিঠ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। রমণীকে সে ঠেলে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু রমণীকে আগুন নিয়ে নির্মিত বলে এখন তার মনে হয়।...মশালের মতো প্রজ্বলিত সমস্ত শরীর দিয়ে তাকে ঠেসে ধরে রাখে বিলকিস।’
একজন বিলকিসের আত্মত্যাগ, প্রতিশোধের বোধ, প্রতিবাদের ভাষা বলে দেয় বাঙালিদের স্বাধীনতা অনিবার্য। যে জাতির নারীরা এমন শক্তি ভেতরে সঞ্চয় করে রাখে সে জাতির মুক্তি আটকে রাখা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তার প্রমাণ মিলে যায় বিলকিসের আত্মত্যাগের কয়েক মাস পরে--১৭ ডিসম্বরে, মিত্র বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে।
মেজরের আচরণ ও বক্তব্যের রেশ ধরে আমার আলাদা কিন্তু প্রাসঙ্গিক দুটো প্রসঙ্গে কথা বলবার আছে। মেজর ধরে নিয়েছিল তাদের ধর্ষণের ফলে বাঙালি নারীর গর্ভ থেকে যে যে সন্তান জন্ম নেবে সে হবে পাকিস্তানের দোসর। কিন্তু সেটি ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। আর যে সকল যুদ্ধশিশু বাংলাদেশ বা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে তারা পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশকেই আপন করে নিয়েছেন। প্রবাসজীবন থেকে বছর বছর অনেক যুদ্ধশিশু আসে মুক্তিযোদ্ধা মায়ের পরিচয় অন্বেষণ করতে। অর্থাৎ মাতৃপরিচয় এখানে মুখ্য।
আর একটি বিষয় হল--যুদ্ধ বা সংঘাতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে থাকে নারী ও শিশুরা। বিশ্বে আজ অবধি ঘটে যাওয়া প্রতিটি যুদ্ধেই নারী ও শিশুর জন্য অভিন্ন ইতিহাস রচিত হয়ে আসছে। যুদ্ধে বরাবরই নারী ও শিশুরা তৃতীয়পক্ষ ও ক্ষেত্রবিশেষ নিরপেক্ষ থেকেও সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে এদেশের নারী ও শিশু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে নজিরবিহীন অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়। যে কারণে বিলকিসের মতো অসংখ্য সাধারণ স্নেহময়ী নারী বাধ্য হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে সশরীরে অংশ নিতে। নারীর যুদ্ধটা যেমন ছিল দেশ রক্ষার, পরিবার রক্ষার, তেমন ছিল সম্ভ্রম রক্ষার। ব্যথিত হবার বিষয় এই যে, যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে নারীদের যোগ্য মর্যাদা দেয়া হয়নি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে হেয় করে রাখা হয়েছে। কারণ আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের চেয়ে সম্ভ্রমটাই আমাদের কাছে মূখ্য হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানিরা যেভাবে নারীদের একখ- মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছু ভাবেনি। আমরাও শেষ পর্যন্ত তাদের শরীর থেকে আলাদা করে ভাবতে পারিনি। আমরা এই নিচু মানসিকতা দিয়ে আমাদের বীরমুক্তিযোদ্ধা নারীদের বিচার করে চলেছি আজো। যেটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত।
সৈয়দ হকের অল্পকটি চরিত্র দ্বারা নির্মিত ক্ষীণদেহী এই উপন্যাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ অনুষঙ্গ প্রকাশ পেয়েছে। উপন্যাসটির রচয়িতা এখানে চরিত্র, ডায়লগ, আবহ এতটাই কৌশলে এবং সুনিপুণভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, মাত্র দুটি জীবনের তিন-চারদিনের পরিণতি দিয়েই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, নয় মাস স্থায়ী যুদ্ধে বাঙালিদের ওপর পাকস্তানি সেনাবাহিনির যে বর্বর আচরণ, তাদের সাম্প্রদায়িক চেতনা, এবং দেশের স্বার্থে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্বাধীনতাকামী বাঙালির যে আত্মত্যাগ তা প্রকৃতভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। এখানেই তাঁর লেখনীর মুনশিয়ানা।
‘সাইলেন্স ইজ দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল ওয়ার্ড’-- কথাটা এই উপন্যাসে খুবই সত্যি বলে খাটে। উপন্যাসের বিরাট অংশজুড়ে আছে নীরবতার ভাষা। উপন্যাসের অধিকাংশ বক্তব্য এর চরিত্র এবং প্রকৃতি নীরবতার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছে বলেই হয়ত উপন্যাসটিকে এত স্বল্পপরিসরে আটকে রাখা সম্ভব হয়েছে।
Profile Image for Fariana Priya.
47 reviews18 followers
December 29, 2021
"কেউ ভেঙ্গে পড়ে না, শোক কখনও এত বড় নয় যে, মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।"

এই দৃঢ় উচ্চারণ বিলকিসের। স্বামীর বেঁচে থাকার সংশয়, পরিবারের অনিশ্চিত যাত্রা আর মৃত ভাইয়ের সৎকারের চেষ্টার মাঝে এই ঘোষণা এক সাহসী নারীর। বিলকিসের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় যেনো গোটা জাতির এক আজন্ম লালিত স্বপ্নের কথা।

"নিষিদ্ধ লোবান" বিলকিসের গল্প। ঠিক গল্প কী? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা বইগুলোকে গল্প বলতে ইচ্ছে করে না। দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস তো মহাকাব্য হয়ে বেঁচে আছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের এই ক্ষুদ্র উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে "গেরিলা" চলচ্চিত্র। উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে অল্প কিছু দিনের ঘটনা। চরিত্রও হাতে গোনা কয়েকজন। ক্ষুদ্র পরিসরে যুদ্ধের বিভীষিকা আর সংগ্রামের গল্প ধরা সহজ কাজ নয়। কিন্তু সমগ্র ইতিহাসটা কী ধরা সম্ভব?

বিলকিসের মতো এমন অনেক সাহসী নারীর গল্প চাপা পড়ে আছে কালের গর্ভে। সিরাজ ওরফে প্রদীপদের পরিচয় লুকানোর গল্প নতুন নয়। আর খোকাদের আত্মত্যাগ? যার উপর ভর করে আজকের বর্তমান।

আলেফ মোক্তারের অপমান আর লাঞ্ছনা যেনো, বাঙালির প্রতিবাদকে পাকিস্তানি শাসকদের করা ব্যঙ্গের প্রতীক। খোকা গান গাইত বড়ো সুন্দর। আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করতেই হয়তো এই প্রহার। বিহারী আর রাজাকারদের সাহায্য, নারীর প্রতি অকথ্য নির্যাতন, আর গুদামের সেই গুমোট পরিবেশ যুদ্ধের সময়কে তুলে ধরে।

ছোট্ট এই উপন্যাসে লেখক গোটা সংগ্রামের অনেকগুলো দৃশ্যই চিত্রিত করেছেন নিজের কাব্যিক ভাষায়। যুদ্ধের এই ভয়াবহ, অনিশ্চিত সময়ে বিলকিস আর সিরাজ হয়ে ওঠে লাখো শহীদদের ছায়ার মতো। সাধারণ এক নারী হয়ে ওঠে প্রতিরোধের সেই আগুন, যা এক মূহুর্তে পুড়িয়ে ধ্বংস করে সব শত্রুর ঘাঁটি।
Displaying 1 - 30 of 96 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.