Nabaneeta Dev Sen is an award-winning Indian poet, novelist and academic. Sen has published more than 80 books in Bengali: poetry, novels, short stories, plays, literary criticism, personal essays, travelogues, humour writing, translations and children’s literature. Her short stories and travelogues are a rare combination of fine humour, deep human concern, and high intellect, which has made her a unique figure in the Bangla literary scene.
She is a well-known children's author in Bengali for her fairy tales and adventure stories, with girls as protagonist. She has also written prize-winning one-act plays.
বইয়ের প্রথম প্রবন্ধেই গাছের সাথে নিজের ছোটবেলার গল্প নবনীতা এমন মায়া দিয়ে লিখেছেন যে শুধু এটার জন্যেই "নটী নবনীতা" পড়া সার্থক মনে হয়েছে। তিন অংশে বিভক্ত এ বইয়ের দ্বিতীয় অংশটুকু তুলনামূলকভাবে দুর্বল কারণ তা প্রত্যক্ষ সমকালীনতাতপ্ত। সময়ের সাথে তার আবেদন কিছুটা হলেও ফিকে হয়ে এসেছে। লেখিকার কবিতা বিষয়ক ভাবনা চিন্তার উদ্রেক করে। তিনি লিখেছেন,
" অনেকের ধারণা হয়েছে আধুনিক কবিতা মানে যা খুশি তাই। মিল চাই না বলে ছন্দও চাই না। চিত্রকল্পও চাই না, ব্যাকরণ চাই না, শিল্প চাই না, রুচি চাই না, সূক্ষ্মতা চাই না, শক্তি চাই না, সাধনা চাই না। চাই কেবল অহং আর ভড়ং। এমনি করলে কবিতার মানহানি হবে না? মূল্যহ্রাস ঘটবে না? হয়েওছে। যখন কোনও কোনও ছোট পত্রিকার তরুণ সম্পাদক বলে ফেলেন— “তা, গদ্য যদি নাই দিতে পারেন তবে কবিতা-টবিতা যা হোক একটা কিছু দিয়ে দিন।' তখন আমার সত্যি সত্যি কান্না পায়। ওরা কি জানে না ‘কবিতা- টবিতা-যা হোক' বলতে নেই? ওরকম বললে মা সরস্বতী বিরূপ হন? ওরা কি জানে না একটি কবিতা লিখতে কত কষ্ট?"
ভেবে দেখার বিষয় বৈকি! নবনীতার আধুনিকতা ও ভাষার ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তার অন্যান্য প্রবন্ধের বই পড়ারও আগ্রহ পেলাম।
ঘটা করে একটা বইয়ের তাক বানিয়ে ফেলেছিলুম এই গুডরিডসেই। মেমোয়া-বায়োগ্রাফি-অটোবায়োগ্রাফি। তার মধ্যে বইপত্র পেটপুরে ঠাসতে শুরুও করেছি, কিছুদিন হল। গোল বেধেছে নটী নবনীতাকে নিয়ে। অধ্যাপক দেবসেনের এ বই দেখছি একটি হচপচ সংকলন বিশেষ। বইখানার তিনটে অংশ। প্রথম পর্ব, ওই অংশের চারটে লেখা, যাকে বলে - নির্জলা স্মৃতিকথা। মানে, যে ধাঁচের লেখাজোখা ঝেড়েবেছে গুছিয়ে রাখার জন্য এত আয়োজন। তৃতীয় তথা শেষভাগের চারটে লেখা কিছুটা তাই-ই, আর অনেকটা তাই নয়। মাঝের, দ্বিতীয় পর্বের পাঁচটি রচনা নিপাট নিবন্ধ।
গুরুত্বের ভারে আত্মকাহিনীগুলি সামনের সারি দখল করলেও, সংখ্যা-গুরুত্বের বিচারে, দেখা যাচ্ছে এ বইকে ঠিক স্মৃতিকথা বলা চলে না।
ওজনদার বাংলা প্রবন্ধ, সচরাচর যেসব ভারী-ভরকম বিষয় নিয়ে হামেশাব্যস্ত থাকে – নিয়েন্ডার্থাল সমাজে নারীর অবস্থান, রবীন্দ্রকাব্যে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার প্রভাব বা মার্ক্সবাদী দৃষ্টিতে কোলেডোকোলিথিয়েসিস; এ নিবন্ধ-কটা সেসবের ধার ঘেঁষেও যায়নি। নেহাতই সাদামাটা, বাজারচলতি কিছু অপ্রিয় প্রসঙ্গ, আর তাদের অপ্রীতিকর কিছু সমাধান খুঁজেই যতি টেনেছেন লেখিকা। সেগুলো খুব যে পাণ্ডিত্যপূর্ন হয়েছে তা বলা যায় না। পন্ডিতি দেখানোর চেষ্টাও অবশ্য নবনীতা সেখানে করেননি।
লেখাগুলো নিয়ে আরও দু-চারটে গদগদ কথা হয়তো বলতাম। বলছি যে না, তার দায় একান্তই বইয়ের নাম-রচনাটির। সে-খানা পড়ে থ শুধু নয়; হৃদয়ের হাত-পা ভেঙে দ হয়ে গেলাম! গদ্য লেখালেখিতে সামান্য হাত চালাতে শুরু করেছি কি করিনি। আর এরই মধ্যে আমার লেখার কায়দা, কৌতুকের মোচড়, শব্দবাছার কেতা (এমনকি – বললে বাহুল্য হবে না – জীবনী অংশটুকুও!) একেবারে হুবহু টুকে নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছেন এই, এই – অত্যন্ত বদ এই মহিলা!
সাধারণের পক্ষে এ শোক সামলে ওঠা দুষ্কর জেনেও বলি, চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না। তবুও, আগামী অন্তত দশ বৎসর, বাংলা সাহিত্য যে এক নবাগত প্রতিভার স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হল, সেকথা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না।
এক-একটা বই পড়তে গেলে মনের মধ্যে হাসি আর কান্না পিঠোপিঠি ভাইবোনের মতো ঝগড়া শুরু করে— কে সামনে আসবে, তাই নিয়ে। স্মৃতির ধুলোমুঠো সেই বইয়ে একান্তই সোনামুঠো হয়ে ওঠে। ক্লিষ্ট বর্তমানও হয়ে ওঠে রোমাঞ্চ ও রোমান্সে ভরা এক সফরনামা। ভীষণ, ভীষণই বিরল হয় তেমন বই। এটি সেই ধারার। রম্যরচনা বা ফিচারের মতো করে একদা প্রকাশিত মোট ষোলোটি লেখা আছে এই বইয়ে। মোট তিনটি পর্যায়ে বিন্যস্ত সেই লেখাদের শিরোনাম তুলে দিলে কোনো লাভ হবে না। বরং নবনীতা'র অনন্য গদ্য ও রসবোধ উপভোগ করার জন্য ছোট্ট বইটিকে আদ্যন্ত পড়ে নেওয়াই যথাযথ হবে। এই লেখারা হাসায়, কাঁদায়, ভাবায়, আর সবশেষে এক হারিয়ে যাওয়া সময় ও নাগরিক মননের কথা মনে করিয়ে দেয় আমাদের। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথা কী জানেন? অমন প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি নিয়েও মানুষটি লেখায় কখনও, কক্ষনও জ্ঞান দেননি আমাদের। বরং নিজেকে নিয়ে যথাসাধ্য রসিকতা করে নবনীতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি অনুপম। এ-বই আসলে এক মনখারাপের ঝাঁপি বুঝলেন। এতে ডুব দিলে একরাশ সুগন্ধ আর ভালো-লাগা মুখে ঝাপটা মারে, তারপর একটু-একটু করে হারিয়ে যায়। থেকে যায় শুধু আমাদের এই মলিন অস্তিত্ব। তবু বলব, বইটা পড়ুন। মাঝে-মাঝে কাঁদলেও তো মন হালকা হয়। সেভাবেই না হয় খুলে বসুন এই মনখারাপের ঝাঁপি— যেখানে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন নটী নবনীতা।
আমি বাঙালী সাহিত্যবোদ্ধাদের এই তুমুল কবিতাপ্রেমের সাথে কখনোই গা ভাসাতে পারি নাই, ইনি যেমনটা করলেন এই বইয়ের একটা বড় অংশ জুড়ে, বাঙালীর সাথে দক্ষিণ ভারতীয়দের টানের গপ্পোও ঢাকায় বসে একরকম বৈদেশীয় আলাপ — যুবরাজ হ্যারির বিবাহের মতো, লিকেনস্টাইন নামক দেশের অস্তিত্বের মতো বৈদেশীয় আলাপ। ওনার লেখায় নতুন কিছুও নাই, লেখার তলে মাংশ অল্প, নাই অলমোষ্ট, কিন্তু সুন্দর গদ্য, চমৎকার গদ্য, আর সব আত্মজীবনীকারের তুলনায় জব্বারীয় বলী খেলা পালোয়ান, যখন তিনি কথা বলেন শৈশবে আর বাদবাকী জীবনে ঘটা একেক ঘটনা নিয়ে। আর তার আগে আর পিছে, বইয়ের দোকানে দাঁড়ায়ে দ্যতিয়েন আধো আধো পড়ে যেই সুখ, বাচ্চালোগের জন্য লেখা অবন ঠাকুরের ওইসমস্ত বই পড়ে যে সুখ (বাগীশ্বরী নয়!), প্রায় সেইরকম একটা সুখ তার গদ্যভাষায়, আরো বেশি সুখ, যখন নবনীতা দেব আমাদেরকে কাকের কথা শোনান, ছোটোবেলার গাছগাছড়ার কথা আর বুড়াবয়সের ছুটিছাটার অভাবের কথা শোনান, এইসব খুবই অল্প, শুধু, বইয়ের শুরুতে আর শেষে, হয়ত গুণে তিরিশ পাতা ছুঁবে না, কিন্তু কী সুন্দর, কী মায়ামাখা, যেভাবে মুরুব্বীরা দুয়াদরূদ পড়ে পানিতে ফুঁ দিতেন, সেইভাবে যেনো কে মায়ার বাতাস বইয়ে দিছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়, কালো অক্ষরের রেলিঙদের গায়ে।
কেউ এই তিরিশ পাতারে করে দিতো আটশো পাতা, কিংবা কে জানে, হয়তো অল্পাতিঅল্পেই শুধু এতো ভালো কিছু হয়। বাইরে ঝড় হয়, বাতাসে কার যেনো আকুতি শোনা যায়।
"গেল বছর এক ঝড়ের রাতে প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হল তার মাথায়৷ সকাল বেলা জানলা দিয়ে দেখতে পেলুম তার জ্বলে-পুড়ে যাওয়া মূর্তি। তারপর এল ভাড়াটে হাড়ি-ডোমেরা, শুইয়ে ফেলল আমার আজন্মের সঙ্গীকে। এখন আমার জানলা দিয়ে রাত্রিবেলা আর কেউ উঁকি দেয় না। কেবল বাড়ি। আকাশ। বাড়ি। ইঁট। পাথর। ইঁট। আমার বিশ্বাস জ্যোতিবাবুর ম��েও দুঃখ রয়েছে বুড়ো নারকোলগাছটার জন্য। ওর ঝাঁকড়া মাথাটা উঁচিয়ে ছিল বলেই তো টিভির এরিয়েলটা ওঁরা সরিয়ে লাগিয়েছিলেন। সব 'জনগণের মানুষ'-এর মধ্যেই একজন করে নির্জন মানুষ তো যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে, সেই মানুষটার সঙ্গে নারকোল গাছটার অনেকদিনের চেনা ছিল।"
জীবনে নানারকম চাওয়া পাওয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকে বহু স্মৃতি, যা মনের মণিকোঠা থেকে একসময় সবাই মিলে উঁকি মারতে চায়৷ বয়সের গাছ পাথর না থাকলেও "গাছ-পাথরের বয়স" সেই হারিয়ে যাওয়া সময়কে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়৷ উপলব্ধি হয় বিভিন্ন "ছন্নপ্রশ্ন" আর "ছিন্নচিন্তার"। আর আমরা, মানে বইপাগল পাঠকরা পেয়ে যাই এক "সোজা কথা সোজাভাবে বলতে পারা" মানুষকে, যাঁর লেখনী গর্জে উঠেছে কালের সাথে, মানুষের সাথে, যাঁর লেখনী স্নিগ্ধ করেছে আমাদের মন, আমাদের চিন্তাভাবনাকে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের পাতায় প্রকাশিত নানারঙের টুকরো লেখা একসঙ্গে বুনে দিয়ে আনন্দ পাবলিশার্স আমাদের সামনে এনে হাজির করেছে আমাদের প্রিয় লেখিকা নবনীতা দেবসেনকে।
বইটির প্রথম প্রকাশ আগস্ট ১৯৮৩ তে। এর সাতাশ বছর পর জুলাই ২০১০ এ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ আসে। সর্বশেষ মুদ্রণ জুন ২০১৭ তে। কলেজ স্ট্রীটে হাতের কাছে দেখতে পেয়ে আর লোভ সামলাতে পারিনি। বইটি আদ্যোপান্ত নন ফিকশন। তিনটি মূল অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে বিষয়বস্তু।
প্রথম অধ্যায়ে আছে লেখিকার বেড়ে ওঠার সাথে তাঁর বসতবাড়ি, পাড়া প্রতিবেশী, গাছ পাথরের বয়সেরও বেড়ে ওঠার গল্প। আছে লেখিকার প্রথম আলাপ কবিতার সাথে, ওনার অভিনেত্রী জীবনের কিছু "যেমন হতে পারত" মুহূর্ত। আর সবশেষে আছে সেই ফোন কল, যার অপরপ্রান্তের গলা বুঝতে না পেরে লেখিকার আচরণ এবং পরবর্তী বিস্ময়।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখিকা পেন রেখে হাতে তুলে নিয়েছেন তলোয়ার। সোজা সাপ্টা মাপা মাপা তীর আছড়ে ফেলেছেন লেখক ও পাঠকের মনে গেঁথে যাওয়া কিছু ভ্রান্ত ধারনার ওপর। চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন "ভালো লেখকরা কেন খারাপ লেখেন।" বাতলে দিয়েছেন "রোগনির্ণয় ও রোগমুক্তির প্রস্তাব।" আর শেষে ফিরে গেছেন জয়ন্ত-মানিক, ব্যোমকেশ-অজিত, শার্লক-ওয়াটসনের ভিড়েও মাথা তুলে দাঁড়ানো ফেলুদা-তোপসে-জটায়ু চরিত্রের প্রাসঙ্গিকতায়।
তৃতীয় অধ্যায় জুড়ে ফুটে উঠেছে কলকাতায় বাঙালিয়ানার আখ্যান। "মনে আর মুখে" আলাদা ভাবনা পোষণ করা বাঙালির পক্ষে হয়তো সুখকর নয় সেই পঠন, কারণ তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে জর্জরিত করেছেন আমাদের মানসিকতাকে। শেষে এসেছে "নাম-ডাক" ও ছুটির আহ্বান।
এই তিন অধ্যায়ের কথা খুব ওপর ওপর বললাম বলে বুঝতে আপনাদের অসুবিধা হল ঠিকই। কিন্তু, বইটি পড়তে গিয়ে আমি কতকিছু যে শিখলাম, তার হিসাব দিতে পারব না। ভিন্ন বিষয়কে একত্রিত করে তৈরি এই সংকলন, কিন্তু সকলেই যেন একসূত্রে বাঁধা। আর সেই সূত্র হল আমাদের মনন৷ পড়তে পড়তে কখন যেন হারিয়ে গেলাম স্বীয় উপলব্ধির মায়াজালে। যখন পড়া শেষ হল, মনে হল আমার একটা ক্লাস নিয়ে গেলেন নবনীতা ম্যাডাম, আর শিখিয়ে দিলেন কিভাবে সাহিত্যরসকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়, কিভাবে হয়ে উঠতে হয় একজন প্রকৃত কবি, সাহিত্যিক বা পাঠক। অদ্ভুত লাগলেও উনি যখন বলেন যে "ক্রেতা মানেই পাঠক নন, আবার পাঠক মানেই তিনি ক্রেতা নন, সংগ্রাহক হতে পারেন", মনে হল সত্যিই তো। বই তো অনেকেই কেনেন, কিন্তু কতজন সত্যিকারের পড়েন বা বিষয়বস্তুকে আহরণ করেন! আবার প্রকৃত পাঠকরা কি বই কেনার জন্য অপেক্ষা করেন? কথায় আছে না "ধনীজনে কেনে বই, গুণীজনে পড়ে।"
"কম মানুষের জীবনেই এমন সুযোগ হয়। আজন্ম একই বাড়িতে বাস। কিন্তু বসতবাড়িটা থাকলেই কি বাড়িটা থাকে?" বড় হওয়ার সাথে বাড়ির মতই আমাদের আশপাশ পরিবর্তিত হতে থাকে। "এখন যেখানে গ্যারেজ, সেখানে ছিল মানকচুর বন, টগরফুলের ঝাড়, আর দুটো নিষ্ফলা পেঁপেগাছ। বদলে গেছে বাড়ির মানুষজনেরাও। বদলায়নি শুধু লেখিকার দৃষ্টিভঙ্গি। আজও তিনি খেয়াল করেন জানলা দিয়ে দেখা যাওয়া সেই বুড়ো নারকোলগাছটাকে। আজও তিনি শুনতে পান পাড়ায় আইসক্রিমওয়ালার ডাক, আজও সন্ধেবেলায় শাঁখ বেজে ওঠে। কিন্তু কেবলই ভয় করে, এমন দিন হয়তো আসবে যেদিন দূরের ওই গাছগুলোও আর থাকবে না, কোকিলরাও আর আসবে না এই পাড়ায়। "সেদিন থেকে আমার বয়সেরও আর গাছ-পাথর থাকবে না।"
"প্রথম প্রত্যয়" প্রবন্ধে লেখিকার কবিতাপ্রীতির কথা জানতে পারি। কবিতা ওনার জীবনে আক্ষরিক অর্থেই সহজ। কিন্তু সাহিত্যের শিক্ষিকা হয়েও উনি মনেপ্রাণে চান যেন ওনাকে কবিতা না পড়াতে হয় ছাত্রদের। কারণ "ও হচ্ছে জ্যান্ত প্রজাপতির পাখনা ছিঁড়ে ছিঁড়ে প্রাণীবিজ্ঞান শেখানোর মত কঠিন কাজ।" কবিতাই ওনার প্রথম প্রত্যয়, কবিতাই ওনার দর্পণ। যেদিন "দেশ" পত্রিকা থেকে নীল খামে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর চিঠি এল যে নবনীতার "চলচ্চিত্ত" কবিতাটি মনোনীত হয়েছে, সেদিন "দেশ বন্দিত কবি" হওয়ার খুশি ভাগ করে নেওয়ার মতো বোধশক্তি ওনার ছিল না। কিন্তু কবিতার স্রোতে অবুঝের মতো গা ভাসিয়ে দেওয়ায় তাঁর প্রবল আপত্তি ছিল, যে চিন্তাভাবনা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর লেখনীতে। "যখন কোনও ছোট পত্রিকার তরুণ সম্পাদক বলে ফেলেন - 'তা, গদ্য যদি নাই দিতে পারেন তবে কবিতা-টবিতা যা হোক একটা কিছু দিয়ে দিন,' তখন আমার সত্যি সত্যি কান্না পায়৷ ওরা কি জানে না 'কবিতা-টবিতা যা হোক' বলতে নেই? ওরকম বললে মা সরস্বতী বিরূপ হন? ওরা কি জানে না একটা কবিতা লিখতে কত কষ্ট?"
"নটী নবনীতা" প্রবন্ধটি হাস্যরসে ভরপুর৷ লেখিকা নিজের অভিনয় জীবনের বিভিন্ন ধাপ যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তাতে উৎফুল্ল হয়ে উঠবেন। হোক না সেটা নিউ এম্পায়ার স্টেজ বা কোনও রঙ্গমঞ্চ, বা ফিচার ফিল্মে এক গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে তোলা হাই, সামান্য সুযোগের সদ্ব্যবহার যে উনি করেছিলেন, তার পরিচয় পাবেন এই গদ্যে৷
"আলাপ" পর্বটি শুরু হয় লেখিকার টেলিফোনে রোজ আসা একটা উড়ো কল নিয়ে। ওনার মেয়েরা ধরলেই অপরপ্রান্ত থেকে জলদগম্ভীর কৃত্রিম স্বরে আজেবাজে কথা বলতে শোনা যায় একজনকে। মেয়েদের নালিশে ব্যতিব্যস্ত হয়ে মাঠে নামেন লেখিকা। পরেরদিন ফোন আসতেই আগেই ধরে শুনিয়ে দেন বাছা বাছা কথা। কিন্তু তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকে বিস্ময় যখন সেদিন অপরপ্রান্তে উপস্থিত ভদ্রলোক একটা প্রশ্ন করে বসেন লেখিকাকে। বাকিটা বলব না, সারপ্রাইজ থাকুক।
আমার ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে মনোগ্রাহী লেখেছে "ভালো লেখকরা কেন খারাপ লেখেন" প্রবন্ধটি। খারাপ লেখা পাঠকরা বেশিদিন সহ্য করেন না। দুদিন রেখে ছুঁড়ে ফেলে দেন প্রিয়তম লেখককেও, আবর্জনার ঝুড়িতে। সময়ের হাতে মেধা নষ্ট হয়। এর প্রতিকার হিসেবে লেখিকা প্রথমে রোগ নির্ণয় ও পরে রোগমুক্তির অনেকগুলি উপায় বলেছেন, যা বর্তমান যুগের লেখকদের কাছে সোনার খনির ন্যায়। যেহেতু অল্পবিস্তর লেখালিখির সাথে যুক্ত আমি, তাই আমার যেন চোখ খুলে দিলেন নবনীতা ম্যাডাম। এই সমাধান উনি বলেছেন দুরকম ক্যাটেগরির জন্যই। এক, লেখাই যাদের একমাত্র পেশা, আর দুই, লেখা যাদের শখ। কত সহজ সরলভাবে উদাহরণ দিয়ে উনি ব্যাখ্যা করেছেন লেখকের জীবনে কোন কাজগুলি তার লেখার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। আজীবন বুকের কাছে রেখে দেব এই অধ্যায়টা। নতুন লেখকদের কাছে এটা অবশ্যপাঠ্য।
"কলকাতা শহরের বাঙালির মহার্ঘ বাঙালিয়ানা, যা নাকি গেল-গেল, তা ঠিক কাকে যে বলে, এটা আর খুব স্পষ্ট নেই এই জগাখিচুড়ি শহরে।" আমাদের বাঙালিয়ানায় পশ্চিমের প্রভাব খুব স্পষ্ট। আর বিভিন্ন প্রাদেশিক খাদ্যাভ্যাস আর আচরণে সেই বাঙালিয়ানার ভিত টলতে শুরু করেছে। লেখিকার "আজ দখিন দুয়ার খোলা" প্রব���্ধে উনি আলোচনা করেছে ১৯৮৩ সালের বাঙালির জীবনযাপনে নানান আঞ্চলিক প্রভাব। পড়তে পড়তে মনে হতে পারে আজও "সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলে আসছে।"
"বালক, যুবক, প্রৌঢ় - তিন বয়সের, তিন রকম চরিত্রের, তিন জীবিকার তিনজন। মানুষের জীবনের প্রায় সবখানি সময় জুড়েই দলটা আছে।" এই কম্বিনেশন আপামর বাঙালির খুবই কাছের। রায়বাবুর অমর সৃষ্টিতে স্থান পাওয়া এই চরিত্র ত্রয়ের অমোঘ আকর্ষণ লেখিকার ছোটবেল��র জয়ন্ত-মানিককেও হার মানিয়ে দিয়েছে। আর তাই সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন ফেলু তোপসে জটায়ুর চারিত্রিক বিশেষত্ব। খুব সঙ্গত কারণেই বইটিও তাই উৎসর্গ করেছেন শ্রী সত্যজিৎ রায় ও শ্রীমতী বিজয়া রায়কে।
আচ্ছা একটু ভাবুন তো। আপনি মনে মনে যেটা ভাবছেন, সেটা যদি আপনার বুকে লাগানো একটা কম্পিউটার স্ক্রিনে সবসময় ভেসে উঠত, তবে কেমন হত ব্যাপারটা! "ধরুন মিনিবাসে বাড়ি যাচ্ছেন, পাশের সিটের সহযাত্রিণীটি মৃদু হেসে একটু সরে বসলেন। তাঁর বুকের স্ক্রিনে ফুটে উঠল - 'উঁঃ! এ লোকটার গায়ে কী বিটকেল গন্ধ রে বাবা!'" বুকের স্ক্রিনে মনের কথা ফুটে উঠলে দুনিয়াটা ঠিক কেমন হত, তার পরিচয় পাবেন লেখিকার কৌতুকাশ্রিত লেখা "মনে আর মুখে"-তে। আসলে তিনি যে অনেক সত্যি কথাই বলে দিলেন এই সূক্ষ্ম হিউমারের আড়ালে, সেটা বুঝতে পারলেই আপনার পাঠক হওয়া সার্থক!
সবমিলিয়ে "নটী নবনীতা" আমাকে ভাবিয়ে দিয়ে গেল। একজন ড্রাইভার হতে গেলে যেমন চোখ কান সবসময় খোলা রাখতে হয়, বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলের দিকে দৃষ্টি রাখতে হয়, ঠিক তেমনই সাহিত্যকে ভালোবাসতে গেলেও হতে হয় একটু সংবেদনশীল, আবার কখনও হতে হয় শকুনের মতো। ভালো জিনিস দেখলেই ছোঁ মেরে তুলে নিতে হবে। খারাপ সৃষ্টির মধ্যেও ধরা থাকে এক অদ্ভুত সুর, যার নির্যাস নিতে পারলেই কেল্লাফতে৷
ধন্যবাদ ও প্রণাম জানাই পদ্মশ্রী শ্রীমতী নবনীতা দেবসেন ও আনন্দ পাবলিশার্সকে এমন একটি রত্ন পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।
সুলিখিতি আত্মজৈবনিক রচনার প্রতি মোর অনুরাগ নতুন না। বিশেষ কইরা পেশাদার সাহিত্যিকদের আত্মজৈবনিক লেখার মধ্যে সাধারণত নানান প্রাসঙ্গিক জিনিস খুঁইজা পাই বইলা ভালই লাগে (পেশাদার শব্দটা কি রূঢ় হইয়া গেল?)। শশী থারুরের বুকলেস ইন বাগদাদ এইরকম কারণেই পড়ে ভালো লাগসিলো। খুশবন্ত সিংয়ের ট্রুথ, লাভ অ্যান্ড এ লিটল ম্যালিস তো আরও দারুণ। সেই একইসূত্রে এই বইটাও আমার ভাল লাগসে। বিশেষ কইরা পাঁচটা লেখা। ছন্নপ্রশ্ন: ছিন্নচিন্তা, ভাল লেখকরা কেন খারাপ লেখেন: রোগনির্ণয় এবং রোগমুক্তির প্রস্তাব, বইমেলা: মেলা বই, গল্পের খোঁজে। অন্য লেখাগুলির মধ্যেও নির্মল আনন্দের পাত পাতা ছিল। বাকিটুক তো যার যার ব্যাপার।
নবনীতা দেবসেনের আরও অনেক বিখ্যাত এবং জোরালো আত্মজৈবনিক রচনা আছে। যেমন, নবনীতার নোটবই। সেগুলির তুলনায় এটা অত্যন্ত ছোট কলেবরের। তবুও আমার ব্যক্তিগত আর্কাইভে বেশ কিছু উপাদান জমা পড়েছে। আমি তাতে যথেষ্টই সন্তুষ্ট।