বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস জানার জন্য একটি মূল্যবান বই আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর। এতে আবুল মনসুর আহমদ আজকের বাংলাদেশ নামে পরিচিত ভূখণ্ডটির ১৯২০ থেকে ’৭০ দশক অবধি প্রায় অর্ধশতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাস তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে ও অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। কৌতূহলী পাঠক, গবেষক ও ইতিহাসবিদদের জন্য এ বই পাঠের বিকল্প নেই।
Abul Mansur Ahmed (Bangla: আবুল মনসুর আহমেদ) (1898–1979) was a Bangladeshi politician and journalist. His political career helped him writing political satire. He is the most famous political satirist in Bangla literature.
He was honored with Bangla Academy Award in 1960 and Swadhinota Dibosh Padak (Independence Day Medal) in 1979. Tahmima Anam is his granddaughter.
তিন তারকা!!! জি, হ্যাঁ। আপনি ঠিকই দেখছেন৷ সাহিত্যিক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদের বহুল আলোচিত বইকে তিন তারকার বেশি দিতে পারলাম না -
১. বইটিকে 'কিংবদন্তি' হিসেবে পরোক্ষভাবে আখ্যায়িত করার প্রয়াস একদল পাঠকের আছে। অথচ তাঁরা হয়তো বিবেচনায় আনেননি আবুল মনসুর নিজে পলিটিশিয়ান ছিলেন। পুরো বই একেবারেই ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, দর্শনের ওপর ভিত্তি করে লেখা। ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ অনেকক্ষেত্রেই ব্যক্তির গণ্ডি পেরুতে পারে না।বিশেষকরে যেখানে স্বার্থের সংঘাত থাকে।
২. আবুল মনসুর আহমদ যখন শেরে বাংলার অধীনে রাজনীতি করেছেন, তখন তাঁর নেতার কার্যকলাপকে লাইমলাইটে আনতে চেয়েছেন। অস্বীকার করেছেন ইতিহাসকে৷ বিশেষত, শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা নিয়ে আবুল মনসুরের পক্ষপাত ছিল চোখে লাগার মতো। হক সাহেবের বারবার নীতি পরিবর্তনকে হালকা চালে দেখানোর চেষ্টাও ছিল। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোনো আদর্শ নেই। যখন যার দলে, তখন তার আদর্শে উজ্জীবিত।
৩. যখন তিনি মুসলিম লিগে যোগ দিলেন, তখন নেতা বদলে গেল আবুল মনসুর সাহেবের। সোহরাওয়ার্দী লিডার বনে গেলেন তাঁর। ১৯৩৭ এর নির্বাচনী প্রচার নিয়ে বিস্তর লিখলেন। কিন্তু ১৯৪৬ এর নির্বাচনে শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবের ভূমিকা অনেকখানি এড়িয়েই গেলেন। আবুল মনসুরের চাইতে তখন সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম ঢের বড় নেতা। তবু '৪৬ সালের নির্বাচনে এই দু'জনের ভূমিকা নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য নেই কেন?
৪. কৃষক-প্রজা পার্টির কর্মী আবুল মনসুর। যখনই লিগে যোগ দিলেন, তখন তাঁর কলম যেন প্রজাপার্টির সঙ্গীদের নাম পর্যন্ত 'ভুলে গেলেন' কিন্তু কেন?
৫. বাংলাভাগের রাজনীতিতে একটি বড় জায়গা জুড়ে ছিল কলকাতার পূর্ববঙ্গের ছাত্র,যুবকদের নেতৃত্বের কথা। তাঁদের অন্যতম ছিলেন শেখ মুজিব। অথচ আবুল মনসুর সাহেবের লেখা পড়লে বোঝার কায়দা নেই অবিভক্ত বাংলার ছাত্র রাজনীতিতে শেখের কোনো অংশগ্রহণ কিংবা ঐ নামে কেউ ছিল। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' পড়লে কলকাতায় তরুণ মুজিবের কার্যকলাপ এবং তৎকালীন ছাত্রনেতাদের কথা জানা যায়। হয়তো মুজিব তখনো বড় কেউ হয়নি। তবু তার কথা একদমই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা কেন?
৬.আওয়ামী লীগে আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবের মাঝে নীতিগত বিভেদ ছিল। আগেই আতাউর রহমান খানের পক্ষ নিলেন আবুল মনসুর। অবশ্যই সরাসরি নয়। তাহলে পক্ষ নেওয়ার পর প্রকৃত ইতিহাস কীভাবে লেখা সম্ভব?
৭.আইয়ুবের আমলের ছাত্র আন্দোলনের কথা আসেনিই বলতে গেলে।
৮.. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আগে পারতপক্ষে মুজিবের নাম তিনি পুরো আইয়ুব আমলে নিতে চাননি। অথচ আইয়ুবের আমলেই পূর্ববঙ্গের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে ধীরে ধীরে উত্থান ঘটতে থাকে মুজিবের। ছয়দফার ব্যাখা আবুল মনসুর লিখেছেন বলে দাবি তাঁর। অথচ কে ছয়দফা দিল, কেন দিল, ছয়দফা দেওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া, আইয়ুব সরকারের ভূমিকা এসবই কেন যেন এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন আবুল মনসুর।
মুক্তিযুদ্ধের অংশটি পরে সংযোজন করেন আবুল মনসুর। দেশে এতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। ত্রিশ লাখ লোক প্রাণ দিয়েছে, মা-বোনের ওপর নির্যাতন হয়েছে - এইসবের কোনো চিহ্ন আবুল মনসুরের মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে নাই৷ না থাকাটা অপরাধ নয়। কিন্তু এসব ইতিহাসকে হালকা করে দিখিয়ে, অন্যকিছুকে বড় করে লেখার লক্ষণও ভালো ঠেকেনি আমার কাছে।
আবুল মনসুর অনেক বড় রাজনীতিক ছিলেন হয়তো। কিন্তু ইতিহাস বয়ানে তাঁর ক্ষুদ্র মানসিকতার পরিচয় কম বড় নয়।
অতীতের অনেকগুলো দরজা খুলে দেয় এই বই। কোন দরজা খুলে কতোটা সাবধানে বেরিয়ে আসবেন সেটাই হবে এই বইয়ের পাঠকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
সব আলাপের শুরুতে, এইটা আসলে একটা একক বইয়ের মতো না পড়তে, বরং অনেকগুলি ক্ষুদ্র বইয়ের প্রাক্কলন বলা যাইতে পারে। শুরুতে আছে ভদ্রলোকের একটা বয়স পর্যন্ত স্মৃতিকথা। এরপর মন্ত্রীসাহেবের দিনপঞ্জি। এরপর পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, দুই দফায় (সর্বশেষ কালতামামির ইন্টেরিম রিপোর্ট, পুনশ্চ)। শেষে বাংলাদেশের জন্মের শুলুক, সদ্যভূমিষ্ঠ বাংলাদেশের ছোটোখাট রাজনৈতিক খতিয়ান। লোকটা ইভল্যুশনও শেষ তিন অংশে পরিষ্কার চোখে পড়ে। কীভাবে পাকিস্তানকে তিনি রিডিফাইন করেন, তা বেশ কৌতুকপ্রদ। একবার বললেন এক পাকিস্তান জরুরী, এরপর বলে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা জরুরী, এরপর বলে পাকিস্তান আসলে দুইটা। লে হালুয়া।
আলাপ এক, ভদ্রলোকের রসবোধ তুলনারহিত। এতো প্যাল্লায় সাইজের একটা বইয়ে তিনি আপনাকে বহু কিছু করবেন, কিন্তু কদাপিও বোর করবেন না। প্রথম দুইশ পাতা কমেডির একরকম খনি। যেমন, ""অবস্থা এমন হইল যে, একদিন এক বন্ধু আমার ধর্মমত শুনিয়া বলিলেন : তুমি তা হৈলে নাস্তিক। জবাবে আমি বলিলাম : নাস্তিক হৈলেও আমি মুসলমান নাস্তিক।" (পৃষ্ঠা ১৬৬) স্পষ্টত এসব ঘটনা হুবহুব ঘটে নাই, বইটাকে উদ্দীপক করে তুলতেই প্রচুর ডায়লগ তিনি গড়ে নিছেন। অনেক ভালো ভালো টোটকা পর্যবেক্ষণও আছে। যেমন, এক জায়গায় দেখা যায় জামাতে ইসলামীর নেতারা তাদের পত্রিকার নাম সংগ্রাম রাখতে চায়, নচেত নাকী বাঙালী বলবে, আরবী ফারসী নাম দেয়ার মাধ্যমে বাঙালী সংস্কৃতি ক্ষুণ্ণ করার পায়তারা চলতেছে। বা আরেক জায়গায় দেখা যায়, রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি আর অযোগ্যতার সুযোগে অধিকতর যোগ্য সরকারী চাকরীওলারা নিজেরা একরকম শ্যাডো রাজনীতি করা শুরু করেছেন, এবং দুর্নীতিরে আরো বেশি প্রাতিষ্ঠানিক করে ফেলেছেন। এই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের রেশ বোধ করি যায় নাই। দুই, বইয়ের মাঝের দুইশ পাতা তদানীন্তন পাকিস্তানকে বুঝতে এবং শেষাংশ বাংলাদেশের রাজনীতি কেনো পাকিস্তান হ্যাঙোভার থেকে বের হইতে পারতেছে না তা বুঝতে কাজে দেয়। পাকিস্তানের মন্ত্রীসভার নানাবিধ মারপ্যাঁচ তো কয়েকশ পাতা ধরে আছেই। পাকিস্তান হ্যাঙোভারের মধ্যে আছে দ্বিজাতিতত্ত্ব, আছে ইসলামকে জাতিগত পরিচয় ভাবার একটা ইউজলেস প্রবণতা। আমরা পাকিস্তান পর্যায়ের সমস্যাগুলিকেও উতরাইতে পারি নাই। তখনো ভারত আমাদের পানি দিতো না, এখনো দেয় না। একাত্তরে সাহায্যের হাত বাড়াইছিলো, কিন্তু দিনশেষে আমরা ভিনদেশ। স্বাভাবিক, রামপাল বানাইতে ওদের হাত একচুল কাঁপে না যে জন্যে। তিন, প্রি-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেমন ছিলেন তার কিছু ক্লু পাওয়া যায় এই বইয়ে। ঢালাওভাবে সোহরাওয়ার্দীর অনুগত দাবী করলে তাঁর ভেতরের মানুষটাকে চেনা মুশকিল। এইখানে আতাউর রহমানের (ইনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী/মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, আবার চুরাশি থেকে পঁচাশি তক ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) সাথে তাঁর বিরোধের জের ধরে তাঁর আত্মপ্রীতির যে নমুনা পাওয়া গেলো, তা আর কারো লেখায় অভাবনীয়। শেখ সাহেবের ইভল্যুশন, এবং তার সম্বন্ধে মনসুর সাহেবের দৃষ্টিভঙ্গির ইভল্যুশনও মজার। চার, মূলত আত্মজীবনী হইলেও জায়গায় অজায়গায় বহু কিছু স্পষ্ট না। মনসুর সাহেবের সাথে শেরে বাংলার প্রথম দেখা ঠিক কবে? বোঝা যায় না। যদি তিনি "কংগ্রেস ট্রেইনড" বলিয়াই তাঁকে দিয়ে আন্দোলনের ব্লুপ্রিন্ট তৈয়ার করাইতে হয়, যদি কথায় কথায় সোহরাওয়ার্দীকে গান্ধী তো বটেই, নেহরুর সাথে তুলনা করতে হয়, তাহলে ভারত ভেঙে কি কচুটা হইলো? বোঝা যায় না। পশ্চিম পাকিস্তানে কি আইয়ুব বিরোধী আগুন জ্বলে উঠেছিলো? উল্লেখই নাই। কিন্তু অন্যান্য নথিপত্র��� পাওয়া যায়, এই মাথায় যখন জয় বাংলা রব, ঐ মাথায় তখন রোটি কাপড়া আর মকানের অভাবে কান্না। যাওয়া আসা কম ছিলো নাকী?
শেষ একটা কথা, এতো গুণ সত্ত্বেও এই লোককে আমি নিতে পারতেছি না। কারণটা ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন না। আমাদের প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশ একটা বাস্তবতা, এই দেশে আমাদের জন্মাইতে হইছে, আমরা জন্মের আগে থেকে এই দেশের নাগরিক। তাছাড়া একাত্তরের গণহত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কাছে এই দেশের অস্তিত্বের ঐতিহাসিক কারণ, মানে ঐ দুইটা বাদ দিলে আমরা বাংলাদেশের জন্ম কল্পনা করতে পারি না। কিন্তু মনসুর সাহেবদের কাছে এই মানচিত্র আরো চব্বিশ বছরের বেশি পুরানো, তারা পার্টিশন সাপোর্ট দেয়া লোকজন। তাই নানাভাবে তিনি পাঠকরে বোঝান, কেনো পাকিস্তান ওয়াজ এ নেসেসিটি, কেনো দেশভাগ না করলেই নয়। আমাদের কাছে বাংলাদেশ একটা জুলুমের কারণে সৃষ্টি হওয়া ভূখণ্ড, তাদের কাছে বাংলাদেশের জন্ম লাহোর প্রস্তাবের যথার্থ বাস্তবায়ন। যেই পার্টিশনের কারণে আজকের বাংলাদেশে নদীতে পানি থাকে না, যেই পার্টিশনের কারণে উপমহাদেশে পাক-ভারত লড়াইয়ে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা নষ্ট হয়, যেই পার্টিশনের কারণে বর্তমান ভারতরাষ্ট্রে মুসলমানেরা নাজেহাল হয়, যেই পার্টিশনের কারণে বাংলার হিন্দুদের এখনো দেশান্তরী হইতে হয়, যেই পার্টিশনের ফলে সৃষ্ট দায়বদ্ধতার ভ্যাকুয়াম বাংলাদেশ আর পাকিস্তানে বারবার সেনাশাসনের জন্ম দেয়, সেই পার্টিশনের দামামা বাজানো লোক এনারা। দেশভাগকে বৈধতা দিতে গিয়ে তিনি স্পিরিট অফ পার্টিশন নামে এক আজগুবী ধারণার অবতারণা করছেন, কীভাবে ভারতের মুসলমান ও ভারতের হিন্দু উভয়ের স্বার্থে দেশভাগ করতে হইছে তার ঠিকুজি দেখাইছেন (শিখের কী হবে এক আল্লাহ মালুম), দাবী করছেন যে সাচ্চল্লিশে পঁচিশ ভাগ মুসলমান আর পঁচাত্তর ভাগ হিন্দু ছিলো ভারতবর্ষে, বাকীরা যেনো মাইনরিটিও না। এইসব পড়লে তপন রায়চৌধুরীর মতো বলতে ইচ্ছা করে, এদের কান ধরায়ে দাঁড় করায়ে দেয়া হোক, তারপর তওবা করানো হোক, আর কারো মওতের কারণ হবো না। ফালতু কতগুলান। হিসাব করে বরাবর মনে হইছে, ছোটো ছোটো দেশের বদলে বড় একটা ফেডারেশন, তার ভেতরে শক্তিশালী এবং জনবহুল অনেকগুলা প্রদেশ থাকা সব বিচারে উপকারী। তাহলে সবাই সমুদ্র উপকূল পায়, সবাই বনাঞ্চলগুলিরে আপনা মনে করতে পারে, প্রতিরক্ষায় খরচা কমে, সামরিক শাসনের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। তা না কইরা এনারা যখন নগ্নভাবে দেশভাগকে ডিফেন্ড করেন, আবার একই মুখে পাকিস্তানকে টিকায়ে রাখার সব রকম চেষ্টার কথা অকুণ্ঠে স্মরণ করেন, আমার ইচ্ছা হয় এঁদের পুচ্ছদেশ পার্টিশন করে তাদের দেশভাগ করার যাবতীয় স্পিরিট ডিরেক্ট উপুড় করে দেই। বিষয়টা দুঃখের। কারণ এই লোক লিখে সুন্দর। আমি বইয়ের অনেকখানি সশব্দে পড়েছি, হো হো করে হেসেছি।
৪৭ সালের দেশভাগ। বাংলা ভাগে ইংরেজের অবিচার। শুরু হয় 'কিপ ক্যালকাটা' আন্দোলন। এমন সময় ঢাকাকেন্দ্রিক কিছু নেতা ভয় পায় কলকাতা পূর্ব পাকিস্তানে আসলে রাজধানী ঢাকা থেকে কলকাতা স্থানান্তর হয়ে যেতে পারে। তারা লোভ দেখায় কলকাতা ছেড়ে দিলে নয় কোটি টাকার যে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে তা দিয়ে ঢাকাকে নিউ ইয়র্ক শহরে পরিণত করা যাবে। আন্দোলন এর গতি কমে আসে। কলকাতা হাতছাড়া হয়।
এরপর ক্ষতিপূরণ বাবদ যে নয় কোটি টাকা পাওয়ার কথা তা হারায় পূর্ব পাকিস্তান। কলকাতা ছেড়ে দেয়ার পর হিসাব শুরু হয় কিভাবে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। একদল চায় মার্কেট ভ্যালু বা বাজারদর। অন্যদলের দাবি বুক ভ্যালু। মার্কেট ভ্যালু সম্পর্কে সকলেরই কম বেশি ধারণা আছে। বুক ভ্যালু হিসাবে সম্পদ ভোগের ফলে ডেপ্রিসিয়েশন হয়। এ হিসাবে পঞ্চাশ থেকে ষাট বছরে বহু সম্পত্তির মূল্য শূন্যে নেমে আসে। পূর্ব পাকিস্তানের নয় কোটি টাকা পাওয়ার হিসাব ছিল মার্কেট ভ্যালু। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা চান বুক ভ্যালুতে লেনদেন করে করাচি মাগনা পেয়ে কলকাতা ছেড়ে দিতে। আবারও পূর্ব পাকিস্তানের আশাভঙ্গ হয়। এরপর ক্ষতিপূরণ বাবদ পূর্ব পাকিস্তান ভারতের কাছে তিন কোটি টাকা ঋণী হয়ে যায়। সদ্যগঠিত পূর্বপাকিস্তানের জন্য এ এক মহাসংকট।
৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দী মারা যাওয়ার পরই লেখক মূলত বইটা শেষ করে দেন। তাই এরপর শেখ মুজিব কিভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন তার বর্ণনা পাওয়া যায় না।
তৃতীয় দফায় বই এর নতুন অধ্যায় সংযোজনে বাহাত্তর সালের দালাল আইন এর বিষয়টা চিন্তার বিষয়। আমার মতো অজ্ঞ মানুষ এটাই জানে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে উদারতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। কিন্তু এর আগে দালাল আইনের প্রয়োগে চল্লিশ হাজার মানুষকে বিনা বিচারে জেলবন্দী করে রাখা হয়। লেখকের মতে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রথম যখন প্রত্যাবর্তন করেন তখন দলমত নির্বিশেষে সকলের নেতা হিসেবে ফিরে আসেন। তখন যদি বঙ্গবন্ধু দালাল আইনে আটক না করে ক্ষমা ঘোষণা করতেন তাহলে সকলে তার পিছে এসে দাড়াত। এর কারণ হিসেবে লেখক বলেছেন স্বাধীনতার পূর্বে স্বাধীনতা বিরোধী মত মানুষের রাজনৈতিক মত। এর ফলে কাওকে শাস্তি দেয়া যায় না। স্বাধীনতার পরে দেশপ্রেম ও দেশদ্রোহিতার প্রশ্ন আসে। তাই দুই বছর জেলে আটক রাখার পর যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয় তা উদারতার মাহাত্ম্য হারায়।
লেখকের ব্যাপারে একটা মত প্রচলিত আছে। 'এটাও সত্য ওটাও সত্য'। ওনার লেখা থেকে এরকম ই মনে হয়। ডিপলোম্যাটিক লেখা। গভীর চিন্তাভাবনার সুযোগ আছে।
একজন ব্যক্তি তার এক জীবনে সেই ইংরেজ আমলের খিলাফত আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তান পর্যায় হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত দেখেছেন। এই সময়টায় রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন পঞ্চাশেরও বেশি বছর। জড়িয়েছেন রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনায়। পঞ্চাশ বছর কোনো মুখের কথা নয়, এ এক মহাকাল। তার জীবনটা এমন এক সুইট স্পটে ছিল, যে সময়টায় ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে বড় বড় ঘটনা ঘটছে। আর তিনিও সম্পৃক্ত হতে পেরেছেন সেসবে। তার এই লম্বা সময়ের রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিকথাই হলো এই বই।
আবুল মনসুর আহমদ একজন সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও সাহিত্যিক। এক ফুড কনফারেন্স গল্প দিয়েই সাহিত্য জগতে অমর হয়ে আছেন। তার উপর ছিলেন মেধাবী ছাত্র, সুবক্তা ও সংগঠক। এতগুলো বৈশিষ্ট্য একসাথে যার মধ্যে আছে তার কাজ ও কর্ম ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান হবে তা খুবই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, তিনি বর্তমান ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের পিতা।
যুক্ত ছিলেন ভারতীয় কংগ্রেস আন্দোলনে, সেখানে বাঙালি নিম্নবর্গীয় মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্নে মতের মিল না হওয়ায় কংগ্রেস ছেড়ে তৈরি করেন প্রজা সমিতি আন্দোলন। যা পরে কৃষক-প্রজা সমিতি এবং আরো পরে কৃষক-প্রজা পার্টি হিসেবে কাজ পরিচালনা করে। এ পার্টি পরবর্তীতে এ কে ফজলুল হকের প্রধানমন্ত্রীত্বে নিখিল বাংলায় (পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা) সরকার গঠন করে।
জনমানুষের রাজনৈতিক দাবি বাস্তবায়নে কৃষক-প্রজা পার্টি সরকারের অসফলতায় হতাশ হয়ে পরে যুক্ত হন মুসলিম লিগে। মুসলিম লিগ তখন ভারতবর্ষে মোহাম্মদ আলী জিন্না��র নেতৃত্বে ভারতীয় মুসলমানদের অধিকারের আন্দোলন করছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের ভূমিকায় হতাশ হয়ে যুক্ত হন আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ)-এ। পূর্ব বাংলা প্রদেশে মুসলিম লীগকে হারাতে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কোয়ালিশনে যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব করেন। যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও পরে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি কেন্দ্রের শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় বেশ কিছু দিন ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। তার মন্ত্রীত্বের দায়িত্বকালে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ভারতের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রীসভা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, তাই তিনিও বাংলার উপকারের জন্য বেশিদিন সময় পাননি। (আফসোস, এত বছর পরেও পাকিস্তান স্বাভাবিক হয়নি। আজ অবধি পাকিস্তানের কোনো মন্ত্রীসভা পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। ইমরান খানের মন্ত্রীসভা তার শেষ উদাহরণ।)
তার এই বিস্তৃত রাজনৈতিক জীবনের ঘটনা, স্মৃতিকথা ও মতামত উঠে এসেছে প্রায় সাত শত পৃষ্ঠার এ বইটিতে। বইয়ের নাম 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর' সে হিসেবে খুবই সার্থক।
বইটিকে ইতিহাসও বলা যাবে না, আবার স্মৃতিকথাও বলা যাবে না। ইতিহাস আর স্মৃতিকথার মিশ্রণ। ইতিহাস বলা যাবে না এ কারণে, তার সময়ে এমন অনেক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছে যেগুলোয় তিনি যুক্ত থাকতে পারেননি। যেসবে যুক্ত থাকতে পারেননি যেগুলো তিনি বলেননি। সেসবই বলেছেন যেসবে তিনি যুক্ত ছিলেন। আবার পুরোপুরি স্মৃতিকথাও বলা যাবে না, কারণ এতে তিনি ইচ্ছে করেই নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু এড়িয়ে গিয়েছেন। যেমন তিনি যে আসনে নির্বাচিত হলেন, নিশ্চয় তার জন্য অনেক খাটতে হয়েছে, অনেক ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু সেসবের কিছুই তিনি উল্লেখ করেননি। সেগুলোই উল্লেখ করেছেন যেগুলো ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ব্যক্তির সাথে জড়িত। নিজেকে এক পাশে রেখে এ রকম নির্মোহ লেখা আমার পছন্দ।
এতে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ও এসেছে, তবে সংক্ষেপে। কারণ তিনি ততদিনে বুড়িয়ে গিয়েছেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও মন্থর হয়ে গিয়েছে। তারপরেও ঘটনাবলীর হিসেবে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে যে যে মতামত দিয়েছেন তা ইতিহাসের ও রাজনীতির পাঠকের জন্য অমূল্য।
উনার লেখার ধাঁচটাও দারুণ। শুরুর শ দুয়েক পৃষ্ঠা হাস্যরসে ভরা। এমন রসাত্মক পন্থায় কথাগুলো বলেছেন বা ঘটনাগুলো তুলে এনেছেন, পাঠকের জন্য কোনো চাপই মনে হবে না। এমন করতে করতে কখন যে ঢুকে যেতে হবে পাঠের ম্যারাথন দৌড়ে বোঝাই যাবে না। মোটা বইয়ের পড়ায় একবার মন বসে গেলে তা আর উঠে না। মোটা বই পড়ার এই একটা অন্যরকম মজা।
বইটি সকলের পড়া উচিত। সচেতন পাঠকের জন্য অবশ্যপাঠ্য। আমাদের ইতিহাস বিষয়ে আমাদের পপুলার কালচারে আমরা যা পড়ে এসেছি, যা জেনেছি সেসব থেকে দূরে গিয়ে ভিন্ন এক ডাইমেনশনে নিয়ে যাবে পাঠককে। দায়িত্ববান পাঠকের জন্য যা খুবই দরকার। মনে হবে, আমরা ইতিহাসে যা পড়েছি, যা জেনেছি তা পর্যাপ্ত নয়।
যেহেতু এটা রাজনীতির ইতিহাসের বই, তাই এ বই নিয়ে অনেক পাঠকের অনেক মত-দ্বিমত তৈরি হবে। আসলে হওয়াটাই স্বাভাবিক। রাজনীতি নানা মানুষের নানা মতের জিনিস। দ্বিমত-ভিন্নমত সেখানে নিত্য বিষয়। এ ধরনের বিষয়গুলোতে এডপ্ট করে আমাদের এগিয়ে যাবার ক্ষমতা যত বেশি হবে, পাঠক হিসেবে আমাদের পরিপক্কতাও তত বাড়বে।
ইতিহাস-রাজনীতি আমার পছন্দের বিষয়। তবে নিরেট ইতিহাস কিংবা রাজনীতির বই একটানা পড়তে মাঝে মধ্যেই আমাকে বেগ পেতে হয়।এই বইটা আমার এ যাবত পড়া বইগুলোর ভেতর সবচেয়ে সুপাঠ্য মনে হলো। আবুল মনসুর আহমদের গদ্য অসম্ভব রকমের কমিউনিকেটিভ আর উপাদেয়। আসরে বসে জমিয়ে গল্প বলার মতোই তিনি বিগত ৫০ বছরের রাজনীতি ও ইতিহাসের পট পরিবর্তণের জটিল সব বিষয়বস্তুকে পাঠকের সামনে তুলে এনেছেন জলবৎ-তরলং করে। এই ভূখন্ডের ইতিহাসের শেকড় সন্ধান ও সে বিষয়ে পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে এই বইটা বিশেষ করে এই প্রজন্মের কাছে তুমুল প্রাসঙ্গিক।
আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ ও সাংবাদিক এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্রূপাত্মক রচয়িতা। "আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর" বইটি সর্বপ্রথম ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয়। বইটিতে লেখকের পারিবারিক রাজনৈতিক সম্পৃক্তার ইতিহাস থেকে শুরু করে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত রাজনীতির সাথে লেখকের সম্পর্কের বিবরণ দিয়েছেন। তবে পরবর্তীতে আরো দুই ধাপে বইটি পরিবর্ধিত করে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে । বর্তমান সময়ে "রাজনীতি" শব্দটি শুনলেই কেমন একটা নেতিবাচক মনোভাব চলে আসে। কারণ রাজনীতি তার চরিত্র পাল্টিয়েছে। তখন যেটা ছিল অধিকার আদায়ের রাজনীতি, তা এখন ক্ষমতার রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে। আমরা যখন রাজনৈতিক নিরপেক্ষ ইতিহাস জানতে চাই তখন আমাদের বুঝতে হবে যে এই ইতিহাস রাজনীতিবিদরাই সবচাইতে কাছে থেকে দেখেন। ফলে তাঁরা যখন ইতিহাস লিখেন স্বভাবতই নিজ স্বার্থে আঘাত লাগুক কিংবা নিজ দলের নিন্দা হয় এমন ঘটনা সুকৌশলে এড়িয়ে যান। এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়, তবে মনসুর সাহেব নিজের কিংবা দলের ভুলগুলোকেও যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেছেন।
লেখকের প্রথম জন সভায় বক্তৃতা মাত্র নয় বছর বয়সে। সেখানে তিনি হিন্দু জমিদারদের মুসলিম প্রজাদের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদে যোগ দিয়েছিলেন। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় নেতৃত্ব ছিল লেখকের স্বভাবজাত। তিনি খুব কাছে থেকে হিন্দু-মুসলিম সংঘাত, লাহোর প্রস্তাব, ব্রিটিশ শাসন, দেশভাগ, পাকিস্তানের অপশাসন এবং মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বইটিতে উঠে এসেছে সেসবের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। কংগ্রেস, কৃষক-প্রজা-পার্টি, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ এমনকি স্বাধীনতার পরে একসময় বিএনপিতে থেকেও রাজনীতি করেছেন। রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কথা আদতে হয়না। সকল ঘটনারই বিকল্প ঘটনা থাকে, একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গি একেকরকম। মনসুর সাহেবের এভাবে দলবদলকে অনেকে কটু দৃষ্টিতে দেখলেও আমি মনে করি রাজনীতির প্রয়োজনেই তিনি এই কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন। মানুষের আইডিওলোজি পরিবর্তন হয়, একসময় যেখানে শেরেবাংলার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন, সেখানে মুসলিম লীগে আসার পর তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভক্ত বনে যান। ছিলেন একুশ দফার প্রণেতা, যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেনও। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার শিক্ষামন্ত্রী এবং পরবর্তীতে বাণিজ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা হিসেবে চেয়েছিলেন পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করার পক্ষে। কিন্তু অপশাসনের মাত্রা যখন বেড়ে গেল তখন আর পাকিস্তানের প্রতি ভরসা না রেখে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সমর্থন দিতে থাকেন। রাজনীতি জীবনে নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে একসময় রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও, রাজনীতি তাঁকে অবসর দেয়নি। সকল দলের নেতা-কর্মীরাই তাঁঅর কাছে পরামর্শের জন্য আসতেন এবং তিনি তাদের হাসিমুখে সাহায্য করতেন।
লেখক যুবক বয়স হতেই রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের। কিন্তু দেশবন্ধুর মৃত্যুতে হিন্দু প্রতিনিধিদের মাঝ থেকে বড় কোনো নেতা তেমন আগ্রহ দেখান নি তাই আর সেটি সম্ভব হয়নি। হিন্দু জমিদাররা তখনকার সময়ে মুসলিম প্রজাদের বৈষম্য কিংবা অবহেলার চোখে দেখতেন, তাই তিনি জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। এভাবেই গড়ে তুলেছিলেন কৃষক প্রজা পার্টি। তবে লেখকের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না বলে তখ���কার ঘটনাবলী এড়িয়ে গিয়েছেন। পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে আমাদের ছাত্ররা যে এত বছর সক্রিয় ছিল তার কোনো কথা এখানে নাই। তাছাড়া আইয়ুব সরকারের সামরিক শাসনের ব্যাপারটাও রীতিমতো বাদ দেয়া হয়েছে।অবশ্য তিনি তখন জেলে ছিলেন। সম্ভবত বইটি পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত হওয়ায় লেখক পাকিস্তানের শাসকদের নিয়ে কড়া ভাষায় কিছু বলতে চাননি। কিছু কিছু বড় নেতা-কর্মীর রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নিয়ে যে আলোচনা করা হয়েছে তা আরেকটু বিশ্লেষিত হলে ভালো হতো।কারণ এসব দ্বন্দ্বের কারণেই অনেক ক্ষেত্রে বাঙালী জাতির নেতৃত্বে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। আমাদের এত বড় একটি মুক্তিযুদ্ধ হলো, গণহত্যা চালিয়ে বাংলাদেশকে শ্মশানে পরিণত করলো পাকিস্তানীরা সেটা নিয়ে অন্তত একটি অধ্যায় লেখা দরকার ছিল বলে মনে করি। লেখক সেখানে বলেছেন , মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে সেসব আমাদের জানা। বাধর্ক্যজনিত কারণে নাও লিখতে পারেন ব্যাপারটা। বইটির সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো লেখক নিজেকে নিয়ে রাখঢাক কম করেছেন। নিজের রাজনৈতিক ভুল কিংবা সহকর্মী-বিরোধীদের ভুলগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন, দিয়েছেন নিজস্ব মতামত।
প্রায় সাড়ে ছয়শত পৃষ্ঠার একটি বই। বহু ঘটনা সন্নিবেশিত হয়েছে। আমাদের ইতিহাস, আমাদের সংগ্রাম, আমাদের রাজনৈতিক সংগঠনের অতীত সম্পর্কে জানতে পেরেছি। মনসুর সাহেবের রসবোধ তাঁর বিদ্রুপাত্মক রচনাতে পেয়েছি, এই বইটিতেও তার স্বাদ কিছু কিছু জায়গায় রয়েছে। বইটি ভালো নাকি মন্দ, সেটা নির্ণয়ের দায়িত্ব পাঠকের। কোনো ইতিহাসের বইয়ের ঘটনাকেই পুরোপুরি সত্য বলে ধরে নিলে হবেনা। আর পাঁচটা বইও পড়তে হবে, ঘটনাগুলো পারস্পারিক সম্পর্ক ও দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করেই সঠিক সিদ্ধান্ত ও মতামত দেয়া যেতে পারে। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি আপনাদের যদি বর্তমান বাংলাদেশের গোড়ার রাজনৈতিক ইতিহাস জানতে আগ্রহ থাকে বইটি অবশ্যই পড়বেন। হ্যাপি রিডিং।
আগে বইয়ের ভালোলাগার দিকটা তুলে ধরি। বিশেষত লেখক যখন পাকিস্তানের শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রী ছিলেন সেই সময়টার বিবরণ। ভাল চরিত্রের টেস্টামেন্ট হচ্ছে ক্ষমতায় থাকার সময় দায়িত্বের প্রতি সুবিচার করতে পারা। শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে যে লড়াই করেছেন মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদ, এক কথায় অসাধারণ। তিনি অধিকারবঞ্চিত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থোদ্ধারের জন্য শক্তিশালী পশ্চিমাদের বিরাগভাজন হয়েছেন বহুবার। তিনি যতদিন রাজনীতিতে ছিলেন, সাধারণ মানুষের প্রতি কমিটেড ছিলেন, বই পড়ে তার প্রতি এই বিশ্বাসটা আমার জন্মেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সংসদে বিরোধীদলের উপস্থিতির গুরুত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে যে পরামর্শ তিনি দিয়েছিলেন এবং তাঁর বইয়ে জোর দিয়ে লিখেছেন, সেই পরামর্শের গুরুত্ব বর্তমানে (২০১৮) বাংলাদেশের যেকোন রাজনীতি সচেতন মানুষ প্র্যাকটিকালি অনুধাবন করতে পারছে।
পাকিস্তান পিরিয়ডে বইটা প্রকাশ পেয়েছিল বলেই হয়ত, পাকিস্তানি শাসকদের কড়া ভাষায় সমালোচনা করতে পারেননি। ইস্কান্দার মির্জা- আইয়ুব খান- ইয়াহিয়ার কথা নাই বা বললাম, কায়েদে আজমের স্বার্থপরতার কারণে দেশের সীমানা নির্ধারণে পূর্ব বাংলার মানুষ ঠকেছে। খনিজ সম্পদ হারিয়েছে। অন্তত স্বাধীনতার পরের এডিশনগুলোতে বইটা এডিট করে পাকিস্তানি শাসকদের স্বার্থপরতার কথা বলার দরকার ছিল মনে হয়। বঙ্গবন্ধুর লেখা বইতেও কায়েদে আজমকে 'ভাল মানুষ' বলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে দেখেছিলাম। উনি অবিসংবাদিত নেতা হয়ে পূর্ববাংলার মানুষের স্বার্থ কতটুকু দেখেছিলেন সেই প্রশ্ন আমাদের নেতারা করেন না।
পাকিস্তান ভাগের সময় টিউবারকিউলোসিসে আক্রান্ত ছিলেন জিন্নাহ, হয়ত মৃত্যুর আগে তিনি পাকিস্তানের জাতির জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠত হতে চেয়েছিলেন, তাই দ্রুত দেশভাগাভাগি তার দরকার ছিল, বিশেষত পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগাভাগি ঠিক থাকলেই তার চলত, এবং তিনি সেটাই করেছিলেন। লাহোর প্রস্তাব মেনে ১৯৪৭ সালেই পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দুইটা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হলে বাংলাদেশের হিন্দুরা নিজ বাসভূমি ছেড়ে ভারতে আর ভারতের মুসলিমরা নিজ বাসভূমি ছেড়ে বাংলাদেশে আসার হার কম হতে পারতো। বাপ-দাদার বসতভিটা ছেড়ে কার শখ হয় ভিনদেশে হিজরত করতে? পাকিস্তানের ক্ষেত্রে জিন্নার বিরাট অবদান, কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি তার ইম্প্যাক্টটা ইতিবাচক নয়। লেখক তথাকথিত নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে নরম ভাষায় সমালোচনা যা করেছেন, সেটা ধর্তব্য নয়।
আইউব খানের সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান কিভাবে বাংলার গণমানুষের নেতা হয়ে উঠলেন সেটা একটু সবিস্তারে এই বই থেকে জানতে পারব আশা ছিল, কিন্তু আশাহত হতে হল। লেখকের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের মানসিক দূরত্ব ছিল বলে মনে হয়।
লেখার ভাষা নিয়ে একটা কথা বলতে ইচ্ছে হয়, কেমন কাঠখোট্টা শব্দচয়ন, তাই পড়তে একটু কষ্ট হয়েছে। ধারালো ভাষা পড়তে ভাল লাগে। মিনমিনে ডিপ্লোম্যাটিক ভাষা ভাল লাগে না। তবে রাজনীতিবিদদের ভাষা এমনই হবে, এতে অবাক হবারও কিছু নেই।
নিতান্তই খিটমিটে রাজনৈতিক প্রবন্ধ পড়ার প্রস্তুতি নিয়ে পড়া শুরু করেছিলাম, কিন্তু লেখকের স্টোরিলাইন এমনই চমকপ্রদ লাগতে শুরু করলো, যে দেশভাগের আগ পর্যন্ত অংশটুকু কে মনে হচ্ছিলো টানটান উত্তেজনার কোন ফুটবল ম্যাচ। মার্শাল ল আসার পরে যখন স্বল্প বিরতিতে দুজন জাতীয় নেতা মারা যান তখন এতটা খারাপ লেগেছে, কোন নন-ফিকশনে কারো চলে যাওয়াটা এত গভীর দুঃখ আনতে পারে ধারণা ছিল না। যদিও মূল বইয়ের শেষে পুনশ্চ গুলো পুরোপুরি বিশ্লেষণধর্মী লেখা হওয়ায় একটু মন্থরতা আসে পড়ার সময়, তবে সবমিলিয়ে একে বেশ রোমাঞ্চকর রাজনৈতিক ইতিহাস আখ্যা দেয়া যায়!
বইটার রিভিউ লেখার থেকে লেখকের রিভিউ লেখাটাই উপযুক্ত কারণ বইটি তার আত্মজীবনী। বিরাট কলেবরে লেখা বইটির রিভিউও বিরাট ছাড়া সংক্ষেপ করতে পারলাম না।
লেখক আবুল মনসুর আহমদ এর জন্ম সাম্প্রদায়িক অখণ্ড ভারতবর্ষে যখন আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার অভাবে মুসলিমরা হিন্দুদের থেকে অনেক পিছিয়ে গেছে, দূরে সরিয়ে রেখেছে ইংরেজদের থেকে। কিন্তু এই বিভজন ���ে ইংরেজদেরই সৃষ্টি তা বোঝার ক্ষমতাও বুঝি তাদের লোপ পায়।
লেখক এক তীব্র সাম্প্রদায়িক মনোভাব শিশুকালে পোষণ করিতেন। এটা তার দোষ নয়, বরং ঐ সময়ের দোষ।
এরপর ব্যক্তিজীবন থেকে রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে কংগ্রেস, পরে মুসলিম সমর্থিত প্রজা পার্টি এবং আরো পরে মুসলিম লীগে যোগ দেন। দেশবিভাগের পরে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সহ-সভাপতিও ছিলেন। মানে সব ঘাটেরই জল তিনি খেয়েছেন।
'��৭ এর দেশভাগের সময় তিনি পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, গান্ধীজীর অখণ্ড ভারতের মতাদর্শ তার ছিল না। যদিও শুরুতে কংগ্রেস এর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতেন, তথাপি তিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানের প্রতিনিধি। মনে করতেন মুসলমানের দেশ পাকিস্তান হাসিল হলেই কেবল মুসলমানের মুক্তি মিলবে।
গান্ধীজীর অখণ্ড অসাম্প্রদায়িক ভারত ফেডারেশন এর ধারণা ধারণ করার মত মানুষ খুব কমই ছিল সেসময়। লেখকও তার ব্যতিক্রম নন। গান্ধীজী ছিলেন আদর্শ তাত্ত্বিক দার্শনিক ও শিক্ষকদের মতন, বাস্তব ছিল ভিন্ন।
ভারতবর্ষে এই সাম্প্রদায়িক দেশবিভাগ যে ঔপনিবেশিক শাসকদের সৃষ্টি এবং এর ফল যে আজও আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি সেটা একমাত্র গান্ধীজীই বুঝতে পেরেছিলেন। তথাপি দেশভাগ ছিল ওই সময়ের সাময়িক অবশ্যম্ভাবী কিন্ত অপরিণামদর্শী ঘটনা। এর সাফল্যই পরে নব্য ঔপনিবেশিকদের ধর্মীয় বিভাজন করে মধ্যপ্রাচ্য এবং সারা বিশ্বেই "ভাগ কর, শাসন কর " নীতি বজায় রাখতে সাহস জোগায়। এটা বোঝার মত ক্ষমতা কংগ্রেসি কারো কারো থাকলেও শিক্ষার অভাবে বঞ্চিত মুসলিমদের বোধগম্য ছিলনা, কারণ দূরদর্শিতাই ছিল না তাদের। এজন্যেই বেশিরভাগ মুসলমান দেশভাগ ও পাকিস্তান হওয়ায় যারপরনাই খুশিতে আত্মহারা হন, যাদের মোহ খুব দ্রুতই ভাঙ্গে '৫২ থেকে, '৭১ এ যার পরিণতি।
যা ই হোক, লেখক ছিলেন পাকিস্তান প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের বেশ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, বেশ কয়েকবার। পাকিস্তানপ্রীতি তার অন্তরের গেঁথে যায় যদিও জীবনের শুরুতে অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেসি ছিলেন। (সংখ্যালঘু অসাম্প্রদায়িক আর সংখ্যাগুরু অসাম্প্রদায়িক এর মধ্যে পার্থক্য আছে)
পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিমাদের ধারাবাহিক বিমাতাসুলভ কোন আচরণই লেখক মেনে নেন নি। তিনি এগুলোকে পাকিস্তানের ভুল বলে অভিহিত করেন। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টিই যে বড় ভুল, তা তার মানতে বড় কষ্ট হয়েছে।
'৬৬-'৬৭ তে তিনি ছিলেন সবার রাজনৈতিক অভিভাবক, বয়সে ঋদ্ধ একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিজ্ঞ। মুসলিম লীগের গোলাম আযম, নিজামীরাও তার কাছে পরামর্শ নিতে আসতেন সেটা তিনি বইটিতে লিখেছেন। বামেরাও আসতেন।
মূলত, তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করতেন। কিন্তু এই ভারত-পাক ভাগই যে ভুল ও অপরিণামদর্শী তা প্রমাণিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। এখানেই পাকিস্তান তত্ত্ব যে ব্যর্থ ছিল তা প্রমাণ হয়ে যায়। লেখক তা মনে প্রাণে চাননি। বইতে তিনি বারবার এটাকে আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, পশ্চিমা, পূর্বাদের ভুল হিসেবে লিখেছেন, কখনো পশ্চিমাদের অন্যায় হিসেবে লেখেননি বা তাদের দোষারোপ করেননি। এখানেই বইটির মূল সমালোচনা। কি করলে পাকিস্তান আলাদা হত না সেটাই বারংবার তার লেখায় ফুটে উঠেছে।
'৬৭ তে রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধের সমর্থন যারা করেছিলেন, তাদের একজন লেখক। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়ার আমলে ১৯৭৯ এ তিনি বাংলা একাডেমী, একুশে পদক সহ নানা পদকে অলংকৃত হন।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তার ও তার পরিবারের কোন সংকট ছিল না। ছিলেন ঢাকায় সেফ। বরং যুদ্ধের ৯ মাসের বাঙালীর আত্মত্যাগ তার কাছে অযথা বলে মনে হয়েছে এবং সহজেই এড়ানো যেত বলে তিনি বইটিতে বলেছেন। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে এই বুদ্ধিজীবি সানন্দে গ্রহণ করেননি বলেই বইটি পড়ে তার অভিব্যক্তি বুঝে মনে হয়। লেখকের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রাণের ত্যাগ অনর্থক কষ্ট বলে মনে হয়। অথচ এ যে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মের প্রসববেদনা, যার বীজ বপিত হয় '৫২র ঘটনাতেই তা তার বৃদ্ধ রক্ষণশীল মস্তিষ্কে অনুধাবন হয় নি।
অল্প বয়সে প্রগতিশীল থাকলেও গতানুগতিক বাঙালীর মত বয়সকালে ধার্মিক, রক্ষণশীল হয়ে পড়াটাতো বাঙালীর রক্তজাত বৈশিষ্ট্য।
কেবল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিচারে দেশভাগ যে ভুল তা প্রমাণিত হয় পাকিস্তানের ব্যর্থতায়, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। এটা মেনে নিতে লেখকের মত অনেক পাকিস্তানবাদী ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকদেরই কষ্ট হয়, হওয়াটাই স্বাভাবিক।
'৪৭ এর দেশবিভাগ ছিল ভুল, অপরিণামদর্শী কিন্তু অলঙ্ঘনীয়, অবশ্যম্ভাবী ; এড়ানো অসম্ভব।
সেরকমই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ও ছিল বাস্তবিক, আবশ্যিক ও যুক্তিযুক্ত ; এড়ানো যেত না।
লেখকের লেখায় তার নানা সময়ের এই বিভিন্ন বিচিত্র মনোভাব ফুটে উঠেছে। বইটিতে সবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ৫০ বছরের ঘটনাপঞ্জি তুলে ধরা হয়েছে। পড়লে জ্ঞান প্রসারিত হতে বাধ্য। বিশাল কলেবরে লেখা (৬৮০ পেজ) বইটি পড়তে ধৈর্য প্রয়োজন। এবং এই বইটিকে রেফারেন্স হিসেবে নেয়ার আগে রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কিত আরো বিভিন্ন মতের লেখকদের বিশ্লেষণী বই পড়া উচিত। তবেই তুলনা ও পার্থক্য করতে পারবেন। গান্ধীবাদী, মৌলবাদী, গোঁড়া পাকিস্তানবাদী, বাংলাদেশবাদী, অসাম্প্রদায়িক, বামপন্থি --- এরকম সব মতেরই বই পড়ুন, সঠিক ইতিহাস বুঝতে হলে।
ইতিহাস জানুন নয়, বুঝুন।
কারণ বেশিরভাগ ইতিহাসের বইই বায়াসড। আসল ঘটনা, ও কারণ বোধগম্য হওয়াটাই প্রকৃত ইতিহাসপাঠকের ধর্ম।
বইটা আমি ঠিক যে কারণে অনেকদিন ধরে পড়তে চাচ্ছিলাম ঠিক সেই কারণেই এতদিন ধরে পড়া হচ্ছিল না! অনেকটা প্যারাডক্সের মতো আর কি! যাহোক, উভয় ক্ষেত্রেই কারণটা হলো বইটার শিরোনাম। পঞ্চাশ বছরের রাজনীতি সম্পর্কে জানা যাবে ভেবে যেমন আগ্রহ হচ্ছিল তেমনি পঞ্চাশ বছরের কথা কতটা তথ্যবহুল হবে আর বইটা কতটা দীর্ঘদেহী হবে সেটা ভেবে অনাগ্রহ হচ্ছিল। কিন্তু কিছুদিন আগে লেখকের একটা বই পড়ে মনে হলো লেখকের বই আর যাহোক বোরিং আর খটমটে হতে পারে না। তাইতো দিন পাঁচেক আগে শুরু করি প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার এই বইটা।
লেখকের সাহিত্যিক পরিচয়ের বাইরে তাঁর একটি বড় পরিচয় হলো তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়। বলতে গেলে সব ঘাটের জল খেয়েছেন তিনি; কংগ্রেস থেকে শুরু করে হক সাহেবের কৃষক-প্রজা পার্টি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মুসলিম লীগ, ভাসানী সাহেবের আওয়ামী লীগ, জিয়া সাহেবের বিএনপি পর্যন্ত। আর এই সময়ে তিনি গণপরিষদের সদস্য ছিলেন, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী ছিলেন, ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সংসদ সদস্যও ছিলেন। ফলে রাজনীতি কি জিনিস তিনি যা ভালোভাবেই বুঝতেন, রাজনৈতিক ব্যাপারের খুটিনাটি সহজেই ধরতে পারতেন। আর সাহিত্যিক প্রতিভার জন্য দারুণভাবে উপস্থাপনও করতে পেরেছেন এখানে।
ইতিহাসের একদম নবীন পাঠক আমি। ফলে বইটা আমাকে বলতে গেলে মুগ্ধ-ই করেছে এর তথ্যবহুল আলোচনা দিয়ে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতি থেকে শুরু করে অষ্টম দশকের স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যন্ত তিনি দেখেছেন কখনও নেতা হিসেবে, কখনও সাংবাদিক হিসেবে আবার কখনও অভিজ্ঞ দর্শক হিসেবে। আর সেই দেখাকে ( আসলে পর্যবেক্ষণ) তিনি যখন নিজের সাবলীল ভাষায় প্রকাশ করেছেন তখন তা হয়ে উঠেছে এক রাজনৈতিক দলিল। দেশবন্ধুর বেঙ্গল প্যাক্ট থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন দেশে নির্বাচন – উপমহাদেশের রাজনীতির মোড় ঘুরানো সব ঘটনাবলী যেন দেখতে পাচ্ছিলাম চোখের সামনে। নিজের অজ্ঞানতার দরুন হয়তো লেখকের অনেক সীমাবদ্ধতা আর পক্ষপাত চোখে পড়ে নি কিন্তু যেটুকু লেখক প্রকাশ করেছেন সেটুকু মুগ্ধতার সাথেই পড়েছি। হাই প্রোফাইল সব নেতাদের সাথে সরাসরি সাক্ষাতের বিবরণ থেকে শুরু করে লেখকের বিভিন্ন কালতামামি – নতুন নতুন অনেককিছু জানিয়েছে, অনেক ঘটনার ভিন্ন ব্যাখ্যা সামনে এনেছে। সেই সময়ের মধ্যে বাস করেই লেখক যেভাবে তাঁর সময়কে ব্যাখ্যা করেছেন তা বিস্ময়কর।
তবে কয়েকটা খারাপ দিকও চোখে পড়েছে। তার মধ্যে প্রথমেই আসবে লেখকের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আর হামবড়া ভাবের কথা। অনেক ঘটনাই তিনি এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যেন তার অন্য কোনো ধরনের ব্যাখ্যা থাকতেই পারে না, আত্মপ্রচার করেছেন সামান্যতম সুযোগ পেলেই, নিজেকে সঠিক প্রমাণের চেষ্টা ( দিনশেষে তিনি তো রাজনীতিবিদ-ই!) করেছেন সর্বতোভাবে। নেতা-তোষণের কথাও বলতে হয়, যখন যাঁর দলে ছিলেন তাঁর প্রশংসা করেছেন খোলামেলা ভাবে। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের আন্ডারে শিল্পমন্ত্রী থাকার সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতি বেশ উঠে আসলেও তিনি মিস করে গিয়েছেন পূর্ব অংশের আন্দোলনগুলো। শেখ মুজিব অনেকটাই ব্রাত্য ছিলেন তাঁর আলোচনায়, মুজিবের নেতা হয়ে ওঠা বা তাঁর সংগ্রামগুলোর কোনো উল্লেখ-ই নেই যেন।
বইটা আমার কাছে ইতিহাসের অনেক নতুন জানালা খুলে দিয়েছে সে কথা স্বীকার করতেই হবে, অনেক ঘটনার ভিন্ন ব্যাখ্যাও হাজির করেছে আমার সামনে। কিন্তু আমি অন্তত এটুকু সচেতন ছিলাম যে বইটা লেখকের ‘ দেখা ঘটনাবলীর নিজস্ব বিবরণ ও ব্যাখ্যা'। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোনোকিছুই ফাইনাল না, তবে বইটা যে এই সময়কার ইতিহাসকে জানতে উদ্বুদ্ধ করেছে তা বলতেই হবে। লেখকের আত্মস্মৃতি, গবেষণালব্ধ ইতিহাস নয় – বিষয়টা মাথায় রেখে ঝাপ দেওয়া যেতে পারে বইটাতে।
বিশাল কলেবরের বই, পড়তে পড়তে অনেক সময় ক্লান্ত হয়ে যাওয়া লাগে। আত্মজীবনীমূলক লেখা হলেও পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব হতে বাংলাদেশের আবির্ভাব পর্যন্ত ইতিহাস মোটামুটিভাবে জানার জন্য ভাল বই। ভদ্রলোকের রসবোধ চমৎকার। একটি তারা কম দেওয়ার কারন সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে অথবা নিজে রাজনীতিবিদ হওয়ার কারনেই হয়তো অনেক জায়গায় নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছেন। আরেকটু নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হলে আরো প্রশংসনীয় হত। যদিও প্রকৃতপক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া আসলেই সম্ভবপর নাকি সেই প্রশ্নটি তর্কযোগ্য।
এই বইয়ের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা লেগেছে যে, আবুল মনসুর আহমেদ ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্বের স্বভাব থেকে বের হয়ে লিখতে পারেননি। যেকোনো মানুষের জন্যই যদিও এভাবে লেখাটা কঠিন, কিন্তু, লেখকের মাঝে সেই ইচ্ছারও অভাব দেখতে পেলাম।
‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ নাম শুনলেই বুঝা যায় , বইয়ের বিষয় কত বিশাল । ১৯ শতকের প্রথম দিকের গ্রামের জমিদারি প্রথার বর্ণনা দিয়ে বইয়ের শুরু আর শেষ হয়েছে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম সাধারন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে । আবুল মনসুর আহমদ শুধু একজন সফল রাজনীতিবিদই নন , বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যকও বটে । রাজনৈতিক স্যাটেয়ার লেখায় তার উপরে কেউ যেতে পারে নি । তার লেখা “আদু ভাই” বাংলা ভাষার অংশ হয়ে আছে । দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কৃষক প্রজা পার্টি , কংগ্রেস , মুসলিম লীগ আর আওয়ামীলীগের সদস্য ছিলেন । ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার রচয়িতা তিনি । পরে পাকিস্তানের শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন ।
অনেক বিখ্যাত রাজনীতিবিদের কাছ থেকে দেখেছেন । তাদের কাজকে যেমন প্রশংসা করেছেন , তেমনি দরকার পড়লে সমালোচনা করতেও দ্বিধা করেনি । এই বইটা আসলে এই কারনে অন্য সকল রাজনৈতিক বই থেকে আলাদা । বইটা পড়ে যে কেউ শেরে বাংলা এবং সোহরাওয়ারদিকে নতুন ভাবে চিনবে । বাংলার রাজনীতি যে তাদের কাছে কতভাবে ঋণী , এই বই না পড়লে তা চিন্তা করাও কঠিন ।
দ্বিজাতি তত্ত্ব , লাহোর প্রস্তাব আর দেশভাগ সম্পর্কে জানার জন্য এই বইয়ের কোন বিকল্প নেই । আমাদের সমাজে দেশভাগ নিয়ে যে কত মিথ ছড়িয়ে আছে , তার একটা পর্যালোচনা পাওয়া যাবে । সমাজের পদে পদে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে বিরোধ আর অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে , দেশভাগ ছাড়া যে তা মিটানো সহজ ছিল না , বইয়ে তার অসাধারন বর্ণনা পাওয়া যায় ।
বইয়ের শেষ দিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার যে বিশ্লেষণ , এক কথায় মাস্টারপিস । বিশেষ করে কিছু উৎসাহী মানুষের কারনে যে , বাংলাদেশের সামনে বিপদ আছে , তারও উল্লেখ পাই বইয়ে ।
সত্যি কথা বলতে পঞ্চাশ বছরের রাজনীতির জন্য ৬৮১ পৃষ্ঠার বই কম হয়ে যায় । মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনা বা ব্যাক্তির নাম আসে , যার বর্ণনা হয়তো সাধারন মানুষের জানার বাইরে । বইটা আরও বিশাল হলে মন্দ হত না ।
কিছু কিছু বই আছে যেগুলো সম্পর্কে লেখার প্রয়োজন হয় না, কিংবা লেখার যোগ্যতা সবার হয় না।
আবুল মনসুর আহমদকে এই প্রজন্ম হয়তো তেমন করে চেনে না, কিন্তু তার লেখা অন্তত একটা রম্য গল্প অনেকেরই পড়া। রম্য সাহিত্যে বাংলাদেশে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই বললেই চলে। কিন্তু তিনি মোটেও কেবল রম্য সাহিত্যিক না। তিনি প্রথম জীবনে সাংবাদিক, পরবর্তীতে পাকিস্তানের মন্ত্রী এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের জন্মকালীন সদস্যদের একজন। শুধু তা-ই নয়, সোহরাওয়ার্দির অনুপস্থিতিতে তিনি অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন।
হয়তো শুনতে ততটা আহামরি লাগছে না, মন্ত্রী তো হতেই পারে। কিন্তু কথা হলো আবুল মনসুর ছিলেন তৎকালীন সলিড মানুষদের একজন। শিল্প-বানিজ্য মন্ত্রী হিসেবে সে সময়ে তিনি বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ নেন যা তখন কিংবা এখন কেউ সাহসও করবে না।
এই বইয়ে আবুল মনসুর আহমদ তার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ব্রিটিশ ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস লিখেছেন। একটি কথা বলা প্রয়োজন যে বইটি ওই ��ময়ের রাজনৈতিক ইতিহাসের চুলচেরা বিশ্লেষন নয়। কিন্তু লেখক যা বলেছেন, তা স্পষ্ট করে বলেছেন। কথার মারপ্যাঁচের কাছ দিয়েও যান নি। এখানেই তার স্বার্থকতা।
জমিদারীর শেষ দিনগুলো, প্রজা আন্দোলন, ভারত ভাগ, হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত জানতে যারা ইচ্ছুক, এ বই তাদের সন্তুষ্ট করবে। সেই সঙ্গে জানা যাবে পার্লামেন্ট, মিনিস্ট্রি, আমলাতন্ত্র থেকে রাজনৈতিক দলের অনেক ভেতরের কথাও।
আরেকটি তথ্য, ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম, আবুল মনসুর আহমদের পুত্র।
৬৪০ পৃষ্ঠার এই বিশাল বই বেশ অনেক দিন সময় নিয়ে পড়ে শেষ করলাম। ইদানীং ইতিহাস, রাজনীতি এই ব্যাপারগুলায় আগ্রহ জন্ম নেওয়ায় অনেক আগ্রহ নিয়ে বইটা পড়লাম। বলতে বাধ্য হচ্ছি আশাহত হই নাই। এই বইয়ের যে ব্যাপারটা আমার কাছে অনন্য লেগেছে তা হল, লেখক যা ঘটনা বর্ণ্না করেছেন, সব গুলোর সাথে উনি ব্যাক্তিগতভাবে প্রত্যক্ষ জড়িত ছিলেন। তবে এখানে হয়তো একই ঘটনা প্রকৃত স্বরূপ বিচারের জন্য অন্য কারো একই রূপ লেখা পড়া দরকার। জানি না এমন বিশদ বিবরণ আর কেউ লিখেছেন নাকি। দেশের প্রত্যেক সচেতন ব্যাক্তির এই বইখানা অবশ্য পাঠ্য মনে করি। একটু ঝোঁকের বশেই আবুল মন্সুর আহমদের প্রায় সব বই রকমারি থেকে অর্ডার দিয়ে কিনে ফেলি। এখন বাকি বইগুলা পড়ার পালা।
বইটা অনেকদিন ধরেই আমার অবশ্য-পাঠ্য লিস্টে ছিল। সত্যি বলতে প্রথমে ভেবেছিলাম এই বইটা খুব জটিল হবে। কিন্তু আবুল মনসুর আহমেদের দক্ষ লেখনীতে বইটা বেশ সহজ সরল হয়ে উঠেছে। এই বইতে লেখকের দীর্ঘ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে, অনেকটা আত্মজীবনির মত করে। শুধুমাত্র লেখকের প্রত্যক্ষ করা রাজনৈতিক ঘটনাবলিই না, তার পূর্বের কিছু রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে লেখকের গবেষণা এবং সেসব ঘটনাবলি পরবর্তিতে কি কি রাজনৈতিক প্রভাব ফেলেছিল সেসব বিষয়ও এই বইতে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই বইটার ব্যাপারে আমার সবচেয়ে যে দিকটা ভালো লেগেছে তা হলো এই বইটা একটা ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। একটি রাজনৈতিক ঘটনা শেষে তার সাথে নতুন একটি রাজনৈতিক ঘটনার সূত্রপাত অনেক সুন্দর করে যুক্ত করে দেখানো হয়েছে। আমি মনে করি এই বইটি বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের সকল ছাত্র-ছাত্রীর জন্য অবশ্য-পাঠ্য করা উচিত। আর তরুনদের মধ্যে যারা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত আছেন তাদের জন্য তো এই বইটা একটা দিগ-দর্শনের মত। জাতির এই জীবন্ত রাজনৈতিক দলিল সকলেরই পড়া এবং সংরক্ষণ করা উচিত।
ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, সমাজ সহ আমাদের পারিপার্শ্বিক নানা বিষয়ের নিশেলে গড়ে ওঠে আমাদের জীবন তথা আমাদের জগত সংসার। এগুলো যেমন আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে, তেমনি তারা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এমনই এক বিষয়ের নাম রাজনীতি। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। আরো স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে ইতিহাস, অর্থনীতি ও সমাজের সঙ্গে রাজনীতির নাড়ির সম্পর্ক রয়েছে। এই প্রসঙ্গে Collected works (1965) নামক বইতে উল্লেখিত ভ্লাদিমির ইলিয়াচ লেনিনের উক্তি স্মরণযোগ্য, "রাজনীতি হলো অর্থনীতির সবচেয়ে ঘনীভূত বহিঃপ্রকাশ।" শাব্দিক বিশ্লেষণ করতে গেলে "রাজনীতি" শব্দটির আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় রাজার নীতি। তবে প্রকৃত অর্থে এটি এখন শুধু শাসকের শাসন নীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং এর পরিধি বহুগুণ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ইতিহাসের বর্ণনা করতে গেলে রাজনীতিকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইতিহাসের ন্যায় পাক-ভারত মহাদেশের ইতিহাস কালে কালে অনেকেই অনেকভাবে বর্ণনা করে গিয়েছেন। তবে সেসব ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা রক্ষার বিষয়টি পাঠক হিসেবে খুব কম মানুষের লেখার মধ্যেই পেয়েছি। এই গুটিকয়েক লেখকের নাম বলতে গেলে প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমেদের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হবে। তাঁর লেখা বিভিন্ন বইয়ে তিনি ব্যঙ্গাত্মক সুরে সমাজের নানা অসঙ্গতির চিত্র তুলে ধরেছেন; স্থান-কাল-পাত্র ভেদে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের বিরুদ্ধে চালিয়েছেন মসির লড়াই। তাঁর লেখা এমন একটি ইতিহাস নির্ভর ও তথ্যবহুল বইয়ের নাম "আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর"। এই বইয়ের বিষয়বস্তু কী হতে পারে, তা নাম শুনে সহজেই অনুমেয়। তবে একটি কথা প্রসঙ্গত না বললেই নয়। মুঘল আমলে (সম্রাট আকবরের শাসনামল পর্যন্ত) বাংলার স্বাধীন শাসকদেরকে বারভূঁইয়া নামে অভিহিত করা হলেও তাঁরা সংখ্যাগত দিক দিয়ে মোটেও বারো জন ছিলেন না; বরং আরো অনেক বেশি সংখ্যক ছিলেন। অনুরূপভাবে, বইটির নামানুসারে পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও বাস্তবে ৬০/৭০ বা ততোধিক সময়ের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। ১৮৯৮ সালে জন্মগ্রহণকারী আবুল মনসুর আহমদের ছেলেবেলার গল্প থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও প্রথম নির্বাচিত সরকারের শাসনামলের নানা বিষয় অত্যন্ত সুনিপুণভাবে খুঁটিনাটি তুলে ধরা হয়েছে এই বইটিতে।
বইটির আলোচনা শুরু হয় লেখকের ছেলেবেলার গল্প দিয়ে। তারপর একে একে তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ির গল্প, খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন, বেঙ্গল প্যাক্ট, প্রজা সমিতি গঠন, হক মন্ত্রীসভা, লাহোর প্রস্তাব, অবিভক্ত বাংলায় তিন মুখ্যমন্ত্রীর শাসন, দেশবিভাগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা ও যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করে একুশ দফা দাবি, ঐতিহাসিক মারি প্যাক্ট, শরীফ শিক্ষা কমিশন, পাক-ভারত যুদ্ধ, ছয় দফা দাবি, গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়; এসব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ও পর্দার অন্তরালে থাকা আরো অনেক বিষয় লেখকের লেখায় স্থান পেয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন একজন সফল সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও সাহিত্যিক। বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ে মন্ত্রীত্ব করেছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি ও বিভিন্ন নির্বাচনে মুসলিম লীগ, কৃষক-প্রজা পার্টি, যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের জয়ের পেছনে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শুধু তাই নয়; যুক্তফ্রন্টের বিখ্যাত একুশ দফা রচনার পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের সময় রচিত "পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা- না উর্দু" শীর্ষক বইয়ের অন্যতম রচয়িতার ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। একাধারে এত পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি যখন যে কাজে হাত দিয়েছেন, সে কাজেই সফলতার মুখ দেখেছেন। সে কারণে এই বইটি লেখকের ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা হলেও তার গণ্ডি শুধু নিজের জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। এইদিক বিবেচনায় এই বইটিকে একটি রাজনৈতিক আত্মজীবনী বললে ভুল হবে না; কিংবা এটিকে পাক-ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির অনবদ্য দলিল বললেও খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। উপমহাদেশের ইতিহাস ও তাঁর স্মৃতিকথাকে পৃথকীকরণের অপচেষ্টা করা নিছক বাতুলতা বৈ আর কী-ইবা হতে পারে?
বইটির আলোচিত বিষয়বস্তু নিয়ে তো অনেক কথা হলো। এবার অন্যান্য বিষয়েও আলোকপাত করা যাক। বইটির ভাষারীতির ক্ষেত্রে মূলত সাধুরীতি অনুসরণ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, সাধুরীতির কথা শুনলেই বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশ পাঠকের কাছে তা এক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁদের জন্য আশার বাণী হচ্ছে, সাধুরীতি হলেও তাতে দুর্বোধ্য শব্দ প্রয়োগের নজির খুব একটা চোখে পড়েনি আমার। এছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে আঞ্চলিক শব্দ ও ভাষারীতির প্রয়োগ বইটির সামগ্রিক ভাষারীতিকে আরো ঋদ্ধ করেছে বলে আমার বিশ্বাস। উল্লেখ্য যে, আবুল মনসুর আহমদ লেখনীর মাধ্যমে তাঁর নিজ জেলা, ময়মনসিংহের ভাষারীতিকে বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত করে তুলতে চেয়েছিলেন। এদিক দিয়ে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের সঙ্গে তাঁর তুলনা করা চলে। কারণ তাঁরা দুজনেই সাফল্যের শীর্ষচূড়ায় উঠেও নিজেদের আঞ্চলিক ভাষা তথা কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে ভুলে যাননি কখনো।
পাঠক হিসেবে আমার মতামত জানতে চাওয়া হলে আমি বলবো, বইটি এককথায় এই উপমহাদেশের, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অতুলনীয় দলিল। লেখকের ব্যক্তিগত স্মৃতিকথাকে ছাপিয়ে বইটি ইতিহাসের নানা জানা-অজানা ঘটনা তুলে এনেছে। প্রত্যেক জ্ঞানপিপাসু ও ইতিহাসের অলি-গলির সন্ধানে ছুটে চলা পাঠকের জন্য এই বইটি অবশ্যপাঠ্য। এছাড়া বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের এই বইটি কাজে লাগবে বলে আমার বিশ্বাস। যারা এই বইটি সম্পর্কে জানেন বা পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে আমার সঙ্গে বিনা প্রতিবাদে একমত হবেন। এছাড়া বইটির গঠনশৈলী আমার কাছে যথেষ্ট ভালো লেগেছে। দীর্ঘ ৬৬৪ পৃষ্ঠার বই হবার কারণে হার্ডকাভার ব্যবহৃত হওয়ায় তাতে বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সুদীর্ঘ বই হবার কারণে মাঝে-মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলতে হয়। এছাড়া সাধুভাষা রীতির কিছু কিছু শব্দের অর্থ একটু কঠিন লেগেছে।
সবশেষে বলতে চাই, বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত রম্য রচনাকার সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর "পঞ্চতন্ত্র" গ্রন্থের "বই কেনা" প্রবন্ধে বলেছেন, "বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।" তাঁর কথার সূত্র ধরে বলতে চাই, বইয়ের গ্রন্থিত মূল্য অনেকের কাছে বেশি মনে হওয়াটা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কিংবা সমাজ বাস্তবতায় অযৌক্তিক কিছু নয়। তবে এই বইটি কিনে কেউ যে ঠকবেন না, এইটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি৷ এইক্ষেত্রে পারস্যের বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়ামের উক্তি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি আরেকবার........ "রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা - যদি তেমন বই হয়।"
#এক_নজরে বইয়ের নামঃ আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর লেখকঃ আবুল মনসুর আহমদ বইয়ের ধরনঃ রাজনৈতিক আত্মজীবনী প্রকাশনাঃ খোশরোজ কিতাব মহল প্রথম প্রকাশঃ ১৯৬৮ (পুনর্মুদ্রণঃ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩) মুদ্রিত মূল্যঃ ৬০০ টাকা পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৬৬৪ আই.এস.বি.এন. নম্বরঃ ৯৮৪-৪৩৮-০০০-৬
অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশর প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমেদের আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইটির কথা শুনে এসেছি। পড়ার সাহস হয় নাই। কারণ দুটি, প্রথমত এর কলেবর। বিশাল বই। বড় হবে স্বাভাবিক। উনি এতে ব্রিটিশ পিরিয়ডের সময় থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত পুরো সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহের বর্ণনা দিয়েছেন। শুধু তাইই নয় তা আবার ব্যক্তিগত প্রজ্ঞা দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। পরের কারণ এর জটিলতা। অনেক জায়গা পড়লে মনে হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই পড়ছি। গত একমাস সময় নিয়ে পড়ে শেষ করলাম। এবার বই সম্পর্কে বলি। আবুল মনসুর সাহেব গোটা ভারত উপমহাদেশের সকল প্রখ্যাত রাজনীতিবিদের সাথে রাজনীতি করেছেন। এজন্য প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তিনি তার গ্রহনযোগ্য বর্ণনাও দিতে পেরেছেন। শেরে বাংলা, সুহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাষানী সাহেবের মত দূরদর্শী বাংগালী ব্যক্তির সাথে কাজ করেছেন। যারা আগ্রহী, পড়তে পারেন। আর কোন মতামত দিলাম না।
পুস্তকটির নাম " আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর " এর বদলে " আমার রাজনীতির পঞ্চাশ বছর " রাখা হইলে আরো বেশি যুক্তিযুক্ত হতো। কেননা তৎকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ব্যাখ্যামূলক ভাবে লেখক উপস্থাপন করেন নি। এক্ষেত্রে লেখক নিজের ব্যাক্তিগত পক্ষপাতীত্বের বিষয়গুলো বেশি আলোচনা করেছেন। সমস্ত বইটার শতকরা ৯০ শতাংশ লেখকের নিজস্ব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে লিখা। আর রাজনীতি দেখার ভাগ নিতান্তই অল্প। বইটি সম্পূর্ণরুপে আবুল মন্সুর সারের রাজনৈতিক আত্নজীবনী।
#বুক_রিভিউ বইঃ আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর লেখকঃ আবুল মনসুর আহমদ
প্রথমে লেখকে নিয়ে কিছু বলতে চাই, "আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর" বইটির লেখক আবুল মনসুর আহমদ( ১৮৯৮-১৯৭৯) একাধারে একজন আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।তার এই দীর্ঘ আশি বছরের জীবনে শুধুমাত্র এই ক্ষেত্রগুলোতে নয় তার অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে রয়েছে জমিদারি প্রথা, ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি আমল ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ যুগের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার পর্যবেক্ষণ। তার এই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সবক্ষেত্রেই তিনি রেখেছেন উজ্জ্বল স্বাক্ষর।
"আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর" বইটিকে বলা যেতে পারে লেখককের রাজনৈতিক আত্মজীবনী। তিনি বইটিতে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু হতে শেষ এবং তার নিজের দৃষ্টিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা পর্যালোচনা করেছেন। ছোটবেলায়ই তার মধ্যে প্রতিবাদী মনোভাব প্রকাশ পায় হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে অধিকার আদায় করে নেওয়ার ঘটনায়। এরপর সাম্প্রদায়িক তিক্ততা থেকে প্রজা আন্দোলন ও প্রজা সমিতি প্রতিষ্ঠা, প্রজা সমিতি থেকে কৃষক প্রজা পার্টি গঠন, নির্বাচনে অংশগ্রহন করে জয়লাভ এবং মন্ত্রীসভা গঠন। অতঃপর প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনা যেমন- পাকিস্তান হাসিল, যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা প্রনয়ন, পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন, মুজিবনগর সরকার গঠন, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন সবকিছুর সঙ্গে ওনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন ও পর্যবেক্ষণ করছেন এবং নিজস্ব দর্শন থেকে সমালোচনা করেছেন। এরপর পুনশ্চ ও নয়া অধ্যায় এর মাধ্যমে স্বাধীনতাউত্তর কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার কথাও উল্লেখ আছে।
পাঠ্যানুভূতিঃ পুরো বইটি অনেকগুলো ঐতিহাসিক ঘটনার কথা উল্লেখ রয়েছে। যেগুলো হয়তো আমাদের চিন্তার খোরাক জোগায় কিন্তু লেখক নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করতে গিয়ে ঘটনাগুলোর পরিসর ছোট করে ফেলেছেন যা একজন ক্ষুদ্র পাঠক হিসেবে প্রথমে উপভোগ করলেও শেষে তা আমার কাছে উপভোগ্য হয় নি। নিঃসন্দেহে আবুল মনসুর আহমদ একজন বড় রাজনীতিবিদ ছিলেন। কিন্তু তিনি তার ���ই লেখনীতে কিছু বড় বড় ঘটনা তিনি অতি হালকা ভাবে তুলে ধরেছেন যেমন, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এর কার্যকলাপ, ছাত্র আন্দোলন, ২৫ মার্চ ১৯৭১ (যা আমাদের কাছে শুধু একটা গণহত্যা নয়, এটি একটি কালোরাত যে রাতে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা সেই রাতেই হয়) ইত্যাদি। ইতিহাস একক পর্যবেক্ষণ ও দর্শনে হওয়া উচিত নয়, নিরপেক্ষ ইতিহাসই গ্রহনযোগ্য ও পাঠকনন্দিত হয় বলে আমি মনে করি। ক্ষুদ্র একজন পাঠক হিসেবে আমার অনুভূতি সবার গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে, ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
বইটি তার নামকরণের প্রতিটি শব্দকেই সার্থক করেছে অবশ্যই। আবুল মনসুর আহমদ নিজে যা দেখেছেন সে সম্পর্কেই চিন্তা করার ও মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁকে বা তাঁর মতামতকে ফেরেশতার মত নেয়ার কিছু নেই। তিনি তা বলেনও নাই।
রাজনীতি নিয়ে আলোচনার একটা বড় পরিসর হচ্ছে অর্থনীতি। Political economy নিয়ে অনেক যুক্তিতর্ক উঠে এসেছে বইটিতে।
তবে এটি গোগ্রাসে হজম করার বই না। প্রথম কয়েকটি চ্যাপ্টার কিছুটা আনকমন লাগতে পারে। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝে বুঝে পড়লে ভালো লাগবে। আর পড়ার সময় দাগিয়ে রাখবেন। দাগানো অংশগুলো পুনরায় পড়বেন।
সবচেয়ে ভালো লেগেছে উনি কোন নেতা বা নেতৃত্বকেই বড় করে তোষামোদ কিংবা নিন্দা কোনটিই করেন নি। তবে নিজে যেহেতু সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন সে সময়ের হালচাল বেশ করে তুলে ধরেছেন।
সব নেতাকে সবরকমভাবে ব্যাখ্যা একটা বইয়ের মধ্যে দিয়ে করা সম্ভব না। তবে তুলনামূলক নির্ভেজাল রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে পারবেন।
বইটির চিন্তা থিওরির এর সাথে নীতিনির্ধারকের চেতনার এক মিলিত প্রয়াস। তাই এটি পড়ে কারো প্রতি অন্যায় হয়েছে এটা বলার অযথা কারণ দেখি না।
বড় বই পড়ার একটা বড় সমস্যা হচ্ছে শেষ হয়ে যাওয়ার পর খারাপ লাগে বিশেষ করে বইটা যদি খুব ভালো বই হয়। নিজের অজান্তেই বইয়ের সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়! বইটা পড়া শুরু করি মার্চ ২০১৮ তে আর শেষ করলাম জুলাই ২০২০ এ এসে। এক কথায় বললে বইটি সবারই পড়া উচিৎ! দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্বন্ধে জানার জন্য এটি বেশ ভালো একটি বই! আর লেখক সম্বন্ধে যদি বলতে হয় তাহলে উনার জানার পরিধি আর চিন্তা করার ক্ষমতা সত্যিই অবাক করে!
যারা ভবিষ্যতে বইটি পড়বেন তাদের জন্য উপদেশ থাকবে একটু আস্তে ধীরে সময় নিয়ে পড়ার। অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারবেন। ধন্যবাদ!
প্রায় ১ মাস সময় নিয়ে বইটি পড়লাম। ২০১০ সাল থেকে বইটি পড়ার আশায় ছিলাম কিন্তু এর বিশাল আকার সে পথে সবসময় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশেষে এ বাধা আমি কাটিয়ে বইটি পড়তে সমর্থ হলাম। একটি মাত্র বইয়ে ইংরেজ আমল, পাকিস্তান আমল, বাংলাদেশ তৈরির পটভূমি, সিভিল সার্ভিস, মন্ত্রিপরিষদ, রাজনীতি, ধর্ম সমাজ উঠে আসবে তা ভাবিনি। এ বই না পড়লে আমৃত্যু আফসোস থাকত। এ বই পড়লে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা তৈরি হবে। বাংলাদেশকে বুঝতে চাইলে যে কয়টি বই পড়া দরকার তার তালিকায় প্রথম পাঁচটির মধ্যে এ বই থাকবে তা অবশ্যম্ভাবী।