বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন অস্তিত্ববাদী আলী কেনানের জীবনের উত্থান-পতন, এর সাথে সাথে আইয়ুব খান থেকে শেখ মুজিব-এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রায়-সমান্তরাল গল্প এই উপন্যাস।
Ahmed Sofa (Bangla: আহমদ ছফা) was a well-known Bangladeshi philosopher, poet, novelist, writer, critic, translator. Sofa was renowned for his intellectual righteousness as well as his holistic approach to the understanding of social dynamics and international politics. His career as a writer began in the 1960s. He never married. On 28 July 2001, Ahmed Sofa died in a hospital in Dhaka. He was buried in Martyred Intellectuals' Graveyard.
Sofa helped establishing Bangladesh Lekhak Shibir (Bangladesh Writers' Camp) in 1970 to organize liberal writers in order to further the cause of the progressive movement.
Ahmed Sofa's outspoken personality and bold self-expression brought him into the limelight. He was never seen hankering after fame in a trivial sense. His fictions were often based on his personal experience. He protested social injustice and tried to portray the hopes and dreams of common people through his writing. Sofa always handled his novels with meticulous thought and planning. The trend of telling mere stories in novels never attracted him; he was innovative in both form and content.
পুরো বইটাই আলী কেনানকে নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরকে নৌকাডুবি হইতে বাচাইয়া তাহার অতি আস্থাভাজনে পরিণত হয় কেনান। ঘটনাক্রমে একবছর পরই সেই গভর্নর তাহার পশ্চাৎদেশে লাত্থি মেরে (আহমদ ছফার ভাষায় আর কী) বের করে দেয় অফিস থেকে। এরপর শুরু হয় তার জীবনের উত্থান-পতন। লঞ্চঘাটে একদিন ভিক্ষা চাইতে গিয়ে সে তার ভেতরের এক সুপ্ত ক্ষমতা আবিষ্কার করে। এরপর সে দরবেশ হিসেবে গোড়াপত্তন করে ফুলতলির মাঝারে, জুটে যায় হাজারো ভক্ত। আর তারপর………… বাকিটা জানতে বইখানা পড়তে হবে।
আমি আহমদ ছফার লেখা পড়ি সম্পূর্ণ তার লিবারেলিজম, তৃণমুলের লোকেদের বোধবুদ্ধি, জীবনযাত্রা তুলে ধরতে পারে দেখে। এটাতেও তেমনি ভাবে আমজনতার দরবেশ মুখীতা, দরবেশদের ঐশ্বরিক ক্ষমতার নামে ভণ্ডামি তুলে ধরেছে। বইটায় আলী কেনানের অবস্থা আসলে জিক জ্যাকের মত। একবার ওঠে তো আরেকবার ধসে যায়। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেক্ষাপটের সাথে সমান্তরাল করে এগিয়েছে কাহিনী। চরিত্রটাকে লেখক বেশ শক্তিশালী, ধুর্ত, বাস্তববাদী, আত্মবিশ্বাসী হিসেবে স্থাপন করেছে। বইতে কেনানকে শেখ সাহেবের ভক্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে। যখন শেখ সাহেবের উত্থান হয়, তখন কেনানেরও উত্থান, আর শেখ সাহেবের পতন হলে কেনানেরও পতন। এছাড়া তুলে ধরেছে মাজার নামক ধর্ম ব্যাবসার খুটিনাটি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল ইত্যাদি ইত্যাদি। পুরোটা আহমদ ছফার অসাধারণ লেখনী আর দর্শনে সুন্দর চললেও বইয়ের শেষটা ছিলো অতি নাটকীয়তায় ভরা। এত বুদ্ধিমান, আত্মবিশ্বাসী একজনের এরকম পরিণতি একেবারে খেলো মনে হয়েছে। আর তার জন্যই একতারা কাটলাম।।
প্রথমে শুধু গল্পটা বিচার করি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে সমান্তরাল ভাবে আলী কেনানকে দাঁড় করানো ব্যাপারটা বাদ দিয়ে। জীবনের বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আলী কেনান ভুয়া দরবেশের পেশায় স্থির হয়। আবহাওয়া বুঝে চলা এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন আলী কেনানের প্রতাপশালী দরবেশ হয়ে ওঠার নানা পর্যায় বেশ বাস্তব সম্মত ছিল এবং আহমেদ ছফার বর্ণনা ছিল বরাবরের মতই ধারালো। এই পর্যন্ত এসে আমি বইটিকে দিতাম তিনতারা। গল্পের শেষ অংশ যেখানে এক সুন্দরীকে না পাবার অপ্রাপ্তি আলী কেনানের সমস্ত প্রাপ্তিকে ধসিয়ে দেয়, নিজেকে প্রবল দাপটে নিয়ন্ত্রণ করা আলী কেনান হয়ে পরে নিয়ন্ত্রণহীন। এই নাটকীয়তাটুকু যোগ করে লেখাটিকে খুব সহজে চার তারা দেয়া যায়।
এখন আসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে সমান্তরালভাবে আলী কেনানকে উপস্থাপন করার ব্যাপারটিতে। এটা দিয়ে লেখক কি বোঝাতে চেয়েছেন, ফ্রাংকলি, আমি বুঝতে পারিনি। তাই একটি তারা কেটে নেয়াটা পাঠক হিসেবে আমার অধিকার। তবে উনি যদি এই চতুর, ধোঁকাবাজ আলী কেনানকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সমান্তরালে অবস্থান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান, আমি লেখাটিকে একতারা (মাইনাস তারার অপশন নাই) দিতে কোনো দ্বিধা করবো না। কিন্তু আমি আশা করি উনি সেটা করেননি। তাই আমি এর আগের ধাপেই থেমে গিয়ে লেখাটিকে তিনতারা দিচ্ছি।
'একজন আলী কেনানের উত্থান পতন' উপন্যাসে আহমদ ছফা একটি খোলস তৈরি করেছেন। আর সেই খোলসের ভিতর এবং বাহির দুই আমাদের দেশের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরেছেন। আহমদ ছফা আসলেই এক অনন্য লেখক। এই লেখা পড়ে আশ্চর্য হয়েছিলাম। 'একজন আলী কেনানের উত্থান পতন' পড়ে কেউ যদি ভিতরে রূপক ধরতে নাও পারে, তবুও সে পাঠক হতাশ হবে না। কারণ তার সামনে উপন্যাসের বাহিরেরও এক দারুণ সত্য প্রস্ফুটিত হবে।
ছফার লেখায় কী যেন আছে। যেটুকু সময় পড়া হয়, একদম মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়তে হয়। কিন্তু বন্ধ করে রেখে একবার উঠলেই আর কোন খোঁচাখুঁচি নেই, মোচড়ামুচড়ি নেই। যেন ও বই কখনো পড়িই নি! অথচ পড়তে খারাপ লাগছে, এমন মোটেই না। পরেরবার যখন ধরি আবারও সেই অনুভূতি, কোন জড়তা নেই, কোন আটকে যাওয়া নেই। শব্দের গাঁথুনি আর বিষয়বস্তুর জোরে হারিয়ে ফেলা নিজেকে, কিন্তু হাত থেকে রাখলেই আবার সেই অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার! সূর্য তুমি সাথী , গাভী বিত্তান্ত কিংবা যদ্যপি আমার গুরু, সবগুলোতেই এই ব্যাপারটা ছিল। ব্যতিক্রম হল না মাত্র ৬০ পাতার এই "একজন আলী কেনানের উত্থান পতনে"ও, শেষ করলাম প্রায় সপ্তাহখানেক লাগিয়ে!
কে এই আলী কেনান? সে আমাদের এই অতিআবেগী, অতিসংবেদনশীল, বোকাসোকা বাংগালি জাতির মাথায় কাঠাল ভেঙে খায় যেসব মানুষ তাদের চরিত্রের প্রতিনিধি! অথচ সেই কী না ছফার সাথে পড়ে যে পরিমাণ উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গেলেন তা বলার ভাষা আমার নেই। কেউ একবার বলেছিলো "লাইফ ইজ অ্যা সাইন কার্ভ", আলী কেনানের জীবনী(!) পড়লে কথার সত্যতা আঁচ করা যায় বৈ কী! দিন দিন যতই ছফা পড়ছি, তাঁর পাগলাটে, নির্ভিক লেখার ভক্ত হয়ে যাচ্ছি। কী দুর্দান্ত সাহসই না ছিল এই লোকটার কলমের আগায়! মাজার ব্যবসা এবং ব্যবসায়ীদের স্বরূপ এই বইয়ের সিকিভাগও উন্মোচন করতে পারে, এমন লেখক কি একজনও এখনো আছে এ বাংলায়??
ছফার লেখার গুণগান বিচার করা আমার কাছে ধৃষ্টতা, সেদিকে যাচ্ছি না ভুলেও। শুধু পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে, যদিও মাত্র ৬০ পৃষ্ঠার ছোট্ট একটা বই, তবুও শেষ ৫-৬ পৃষ্ঠা হয়ত অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছে। বইটা ওই পৃষ্ঠাগুলোর আগে শেষ হলেই পাঠক হিসেবে আমি খুশি হতাম! তবে যেই আহমদ ছফা বড় বড় রুই কাতলাদের পুঁছেই কখনো লেখেনি সে পাঠককে পুঁছবে কোন দুক্ষে! পারসোনাল রেটিং ৪.৫/৫
ভাগ্য ভালো হলে মানুষের উত্থান হতে পারে সহজেই। আবার সেখান থেকে দৈব দুর্বিপাকে নিচে পরে যাওয়াও অসম্ভব কিছু না। আলি কেনানের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। ভাগ্যগুণে বাংলার গভর্নরের খাস পিয়ন থেকে তাঁর পদচ্যুতি।
কিন্তু ভাগ্যের সাথে আর কয়েকটি জিনিস থাকলে আমাদের নিজের জীবন আমরা নিজেরা গড়তে পারি। তা হলো আত্মপ্রত্যয়, আত্মবিশ্বাস এবং গুঢ় বাস্তব বুদ্ধি। আলি কেনানের তা সবই ছিল। তাই আলি কেনান থেমে থাকলো না।
এক পরিত্যাক্ত কবরকে কেন্দ্র করে আলি কেনানের দ্বিতীয় উত্থান। ধীরে ধীরে সে 'বাবা' হয়ে উঠলো। ধর্ম, সাধন কোন মার্গেই কোন জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও কেবল বুদ্ধির জোরে তাঁর এই উত্থান। কখনও পতনের প্রান্তে গিয়ে সামলে নিয়েছে।
লেখক খুব চাতুরির সাহায্যে আলি কেনানের সাথে শেখ মুজিবকে সমান্তরালে উপস্থাপন করেছেন। ক্ষেত্র বিশেষে তিনি আলি কেনান এবং মুজিবের মধ্যে ���ক রকম তুলনাই করেছেন। সোহরাওয়ার্দির কাছের মানুষ থেকে মুজিবের যাত্রা এবং পরবর্তীতে এলমেলো সময়ে তাঁর জনপ্রিয় নেতা হয়ে ওঠার সাথে আলি কেনানের সাদৃশ্য দেখা যায়। মুজিবের যেমন কিছু শিষ্য ছিল, তেমন ছিল আলি কেনানের। এমনকি উভয়ের পতনের সময় তাঁরা ছিলেন নিঃসঙ্গ।
মূলত আহমদ ছফার এই উপন্যাস আমাদের ধর্মভিত্তিক মানসিকতা, মাজার সংস্কৃতি, ক্ষমতার লোভ প্রভৃতি বিষয়কে সামনে রেখে একটি র���জনৈতিক ইতিহাসের রুপক পরিস্থিতি তুলে ধরেছে। লেখকের মুনশিয়ানা ঈর্ষাযোগ্য।
...আমাদের বুক ক্লাবের গতমাসের বই ছিল আহমদ ছফার ‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’। গত শুক্রবারেই এই বই নিয়ে জম্পেশ আড্ডা হল। সবাই আলী কেনানের মতো বদ লোকের তেলেসমাতি কাজকারবারে মুগ্ধ। একজনের শুধু মনে হয়েছে যে, সে বাকিদের মতো বইটি নিয়ে মুগ্ধ হতে পারে নি আর গালিগালাজের অংশ তাঁর ভালো লাগে নি। তাঁর কথা শুনে আলী কেনানের চরিত্রের মুখে গালিটাই যে আসলে যুতসই, তা নিয়েও আমরা কথা বলতে গিয়ে আলী কেনানের পেশার মানুষদের ‘গরম’ হওয়ার ঘটনা যে বাস্তবেও ঘটে, সে সংক্রান্ত গল্পও একজন শেয়ার করল। আরো অনেক কথাসহ আমরা একটা সুন্দর ও দীর্ঘ্য আড্ডা দিয়েছি। আহমদ ছফাকে নিয়ে যা বলার আছে তা হল, এই বই আমার পড়া দ্বিতীয় ছফার বই। আমার এর আগে শুধু তাঁর বিখ্যাত ‘পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ’ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। ‘যদ্যপি, আমার গুরু’ পড়া শুরু করেছিলাম কবে মনে নাই, কিন্তু, শেষ করি নি, এটা মনে আছে। ছফার লেখনী নিয়ে বাকিদের সাথে আমিও একমত হয়েছি যে তাঁর গদ্য ঝরঝরে। আমার এও মনে হয়েছে যে এতো সাহসী গদ্য এখন হয়তো আর এতো স্পষ্টভাবে আমরা আর লিখতে পারি না। সেই দোষ পুরোপুরি আমাদের সেটাও আমার মনে হয় না। বারবার আমরা ঘুরে ফিরে এটা নিয়েও কথা বলেছি যে তিনি বেঁচে থাকলে এখন কি হতো? আর সেই কতো বছর আগের একটা বই, পড়ে মনে হল, দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে লিখেছেন! আর কলেবরও তাঁকে কোন পাণ্ডিত্য ফলানোর সুযোগ দেয় নি, বরং সহজে এক শ্রেণীর মানুষের কি গভীর আর নিখুঁত এক চিত্র এঁকেছেন ছফা! মানুষ ছফাকে ‘পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ’ পড়েই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। মুজাইয়ের তাঁকে নিয়ে লেখা ছোট ছোট ঘটনাগুলোতে তাঁর বিশাল মনের পরিচয় পেয়েছি। সেগুলোও তাঁর প্রতি মুগ্ধতা ধরে রাখতে সহায়ক হয়েছে সবসময়ে। আর এই বই পড়ে বুঝলাম যে জীবনযাপনে নয় শুধু, সাহিত্যেও তিনি আসলেই মুজাইয়ের কথামতো একশোভাগ লেখক ছিলেন।...
উপন্যাসের প্লটটা আমার দারুণ লেগেছে। কথায় আছে যে, "কুত্তার লেঙ্গুর কখনো সোজা হয় না"। উপন্যাসটার প্রধান চরিত্র 'আলি কেনান' ও সেইরকমই। যত পীর-ফকিরের তকমাই লাগান না কেন শেষ পর্যন্ত সে একজন রক্তমাংসে গড়া মানুষ, যার ভেতরে কামনা-বাসনা ঘাপটি মেরে বসে থাকে উত্তম সময় আর সুযোগের অপেক্ষায়। এত প্রবল আত্মশক্তি আর আত্মবিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও সব কিছু হারাতে হয়েছে তাকে। আমার কাছে মনে হয়েছে আলি কেনান নিজের ধ্বংসের রাস্তা নিজেই ঠিক করেছিল জাগতিক মোহ আর মানবিক কামনা-বাসনার বশবর্তী হয়ে। সেই বিদেশ ফেরত নারীকে দেখার পরই তার আসল বিদায় ঘন্টা বেজে গিয়েছিল বলে মনে হয়।
অনেকেই শেখ মুজিবের সাথে আলি কেনানের সমান্তরাল প্রবাহকে মানতে পারছেন না। আমি নিজেও পারছি না। জানি না সেই সমান্তরাল প্রবাহের কোন যৌক্তিক কারণ আছে কিনা। কিন্তু আমার কাছে অন্যরকম একটা ব্যাখ্যা ধরা দিচ্ছে যার কোন ভিত্তি থাকতেও পারে নাও থাকতে পারে। সেটা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতা। কাহিনীর প্রবাহটা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পারব যে, আলি কেনান ছিল সেই অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার আর কূপমুন্ডকতায় ভরা ব্যবসার মূল হোতা। তার হাত ধরেই বাকি সব শাগরেদের দল গড়ে উঠেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই শাগরেদরাই তার সর্বনাশটা করে পালিয়ে যায়। যে অর্থ উপার্জন করেছিল ভন্ডামি আর মিথ্যের জোরে সব নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে পালিয়ে গিয়েছিল।
শেখ মুজিবর রহমান যে কিনা বাংলাদেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছে নতুন করে বাঁচতে, লড়াই করে বাঁচতে সেই মানুষটিকেই তাঁর নিজের মানুষদের হাতে নিহত হতে হয়েছিল নির্মমভাবে। যাদের অনেকেই বাংলাদেশের এই রূপকারের সাথে প্রাণ দিয়ে লড়েছিলেন স্বাধীন বাংলার জন্য।
চরম বিশ্বাসঘাতকতার এই মানদন্ডে তুলনা করেছেন কিনা আমি জানি না। তবে এই মানদন্ড ছাড়া এই দুইজনের সমান্তরাল প্রবাহের কোন সংযোগ অন্ততপক্ষে আমার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং যৌক্তিক মনে হয়নি।
ধর্মকে পুঁজি করে কিছু লোক মানুষকে ধোঁকা দিয়ে কি করে হয়ে উঠেছিলো ক্ষমতাশালী ও ধনবান তা আমরা আমাদের পাঠ্যবইয়ের "লালসালু" এবং "বহিপীর" এ দেখে এসেছি। প্রথমদিকে আপনার কাছে আহমদ ছফার এই বইটিও ঠিক তেমনই মনে হতে পারে। কিন্তু না, লেখক যেহেতু ছফা সাহেব, তাহলে ধরে নিতে হবে অবশ্যই গল্পটা স্বকীয়। বরং আমরা উল্লিখিত দুইটা গল্পের থেকেও বৃহৎ একটা পরিসর দেখতে পাই বইটিতে। . বইয়ের প্রথমেই আমরা জানতে পারি আলি কেনান ভিক্ষা চাইছে, নির্দেশের সুরে ভিক্ষা, যার থেকে ভিক্ষা চাইলো সে এই আদেশটা হয়তো উপেক্ষা করতে পারলোনা, এবং সে ভিক্ষাটা পেয়ে যায়। তখন আমরা জানতে পারি আলি কেনানের দিন এমন ছিলোনা, সে গভর্নরের অফিসে কাজ করতো, গভর্নরের ভালোবাসার পাত্র ছিলো, ধরতে গেলে গভর্নর অফিসে সে ছিলো দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি। কিন্তু আইয়ুব খানের কল আসার পরে সে কিছুটা গাফলতি করে, যার জন্য তার ভাগ্যে নেমে আসে প্রচুর দুর্দশা। অতঃপর সে নতুন ফন্দি তৈরি করে, সে একটি মাজারের অলৌকিক ক্ষমতার কথা বলে নতুন নতুন মানুষ তার কাছে এনে জড়ো করে। এই পর্বে এসে আমরা মাজার নিয়ে প্রচলিত যে রাজনীতি ঘটে থাকে তার বিবরণ পেয়ে থাকি। ধীরে ধীরে সকল মানুষ বিশ্বাস করতে থাকে আলি কেনানের আছে অলৌকিক ক্ষমতা, ধনবান এবং ক্ষমতাবানেরাও তার কাছে আসে উপকার পাবার জন্য। সেই সময়টাতে আইয়ুব শাসনামল শেষ হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্বও শেষ হয়ে যায়। ঠিক সেই সময় আলি কেনান নিজেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তুলনা করতে থাকে, যদিও তাদের কখনোই দেখা হয়নি। কিন্তু আমরা তখন আলি কেনানের মনের ভিতরটা জানতে পারি, বাহিরের পৃথিবীতে সে যেমনই ছিলো, যতো শক্তই ছিলো, আমরা জানতে পারি তার ভিতরের সকল গোপনীয় আকাঙ্খা এবং কামনা। আমরা জানতে পারি নারীর মোহ মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে। . বইটি যদিও নানাক্ষেত্রে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, বলা হয়েছে বইটিতে রূপক চরিত্র ব্যবহার করা হয়েছে৷ সেইটা বাদ দিয়েও আপনি আহমদ ছফার এই বইটি পড়তে পারেন। আশা করি আশাহত হবেন না।
দুর্দান্ত একটা প্লট। তুলনাহীন একদমই। বিশেষ করে আলী কেনান এর শক্তিশালী ক্যারেক্টর বিল্ডাপ টা সবচেয়ে বেশি অসাধারণ হয়েছে। পজিটিভ দিক নিয়ে আমি আর লিখলাম না। অনেকেই লিখে ফেলেছেন সেগুলো। আমি বিপরীত মতামত নিয়েই বলি।
দুঃখজনক ভাবে ফিনিশিং টা ভালো লাগে নাই। এত অসাধারণ ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উপন্যাস এর শেষটুকু কেমন যেন Hasty মনে হয়েছে এবং সেইসাথে Unconvincing ও মনে হয়েছে অনেক।
এরকম দোর্দণ্ডপ্রতাপ একটা ঝানু ক্যারেক্টর, যে কাউকে পরোয়াই করে না, যে শেয়ালের চেয়েও ধূর্ত এবং হায়েনার চেয়েও হিংস্র - সে হঠাৎ কোন কথা নাই বার্তা নাই কোথাকার কোন বিদেশফেরত মহিলাকে দেখে এরকম ধুম করে Naive হয়ে গেল, ধুম করে এত দুর্বল হয়ে গেল এবং এভাবে করে সবশেষে নিজের পতন নিজেই ডেকে আনলো - এটা কোন ভাবেই কনভিন্সিং হইলো না। আমি নিতেই পারলাম না এটা।
আর, ওই মহিলার হঠাৎ করে দৃশ্যপটে আগমন আরো বেশি Hasty ছিল। ধুম করে কোত্থেকে উদয় হল আর ওমনি ধুপধাপ করে কাহিনি ও শেষ হয়ে গেল - দেখে মনে হল একরকম জোর করে কাহিনি শে��� করার জন্যই এই ক্যারেক্টর এর আবির্ভাব ঘটেছে।
আলি কেনান যেন আমাদের ভিতরে বসবাস করতে থাকা এক সুপ্ত সত্ত্বা। আলি কেনান এর অদ্ভুত জীবনের উত্থান পতন তাকে চৌকস বানিয়েছে। ব্যাঙ্গাত্মক এই বিশেষ গল্প বাস্তবতার মুখোশ হয়ে সমাজের উচ্চবর্গের বাটপার ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব করে।
আহমদ ছফার লিখনশৈলী কখনই হতাশ করেনি। তবে এটাতে আলী কেনানের সময়ের সাথে শেখ সাহেবের সময়কালের মিল ও তার পরোক্ষ উপস্থিতি সুক্ষ্ম কোন একটা অর্থ রেখেছে যেটা আমি আসলে ধরতে পারিনি।
বই:- একজন আলি কেনানের উত্থান পতন লেখক:- আহমদ ছফা ধরন:- উপন্যাস প্রকাশনী :-খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি পৃষ্ঠা:- ৮০ মুদ্রিত মূল্য:- ১৫০টাকা প্রচ্ছদ :- সমর মজুমদার
আবুল মনসুর আহমদের হজুর কেবলা থেকে শুরু করে হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন উপন্যাসে ধর্ম ব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।আহমদ ছফার একজন আলি কেনানের উত্থান পতন স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এক শ্রেনীর মানুষের মাজারকে কেন্দ্র করে ধর্ম ব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন।এই উপন্যাসে আহমদ ছফা হাস্যরসাত্মবোধ, শব্দচয়ন, বাচনভঙ্গি একজন ভিক্ষুকের দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা একজন ধর্ম ব্যবসায়ীর মনোভাবকে কেন্দ্র করে বিশেষ প্রাঞ্জলতার সৃষ্টি করেন।কেন্দ্রীয় চরিত্র আলী কেনান এবং তার তিন ভাই তৎকালীন পূর্ব বাংলার গভর্নরকে নৌকাডুবির হাত থেকে রক্ষা করে।এতে করে গভর্নর সাহেবের বিশেষ দৃষ্টি পরে আলী কেনানের উপর।আলী কেনান পরিনত হয় গভর্নর সাহেবের খাস ব্যক্তিতে।
গভর্নর সাহেবের বাসভবনে আলী কেনানের বিশেষ অনুমতি ছাড়া কেউ গভর্নর সাহেবের সাথে দেখা করতে পারে না।বিভিন্ন উচ্চপদে আলী কেনান সুযোগ্য লোকদের হটিয়ে তার জ্ঞাতি- গোষ্ঠীদের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করেন।শুরু হয় আলী কেনানের ক্ষমতার অপব্যবহার। সামান্য ভুলের কারনে আলী কেনান গভর্নর সাহেবের বাসভবন থেকে সোজা রাস্তার ভিখিরিতে পরিনত হয়।লজ্জা আর সংকোচের কারনে আলী কেনান তার গ্রামেও ফিরে যেতে পারে না।ভিক্ষাবৃত্তিতে প্রথম প্রথম লজ্জাবোধ হলেও আলী কেনান এখানেও তার কৌশল খাটায়।
আলী কেনান পথচারীদের কাছে" তোর বাপরে একটা টাকা দিয়ে যা" বলে দাপটের সাথে টাকা চাইতো।এতে আলী কেনান একসময় লক্ষ্য করে খুব সহজেই সে অধিক টাকা ইনকাম করছে।কিন্তু আলী কেনানের অর্থবিত্তের প্রতি অপরিসীম লোভ থাকায় শুরু হয় তার মাজার ব্যবসা।কুকুর ছানাকে সে বিশেষ পোষ্য বানিয়ে -মাজারকে হাতিয়ার করে ধর্ম ব্যবসায়ে নেমে পরে।প্রতি বৃহস্পতিবারে মাজারে গান বাজনা হয়।শুরুতে সমাজের নিম্নস্তরের লোকজন আলী কেনানের কাছে আসলেও এক পর্যায়ে বিত্তবান লোকরা আসতে শুরু করে।
শুরু হয় তাবিজ -কবচ।আলী কেনানের প্রতিপত্তি দেখে ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেল আলী কেনানকে নিয়ে ডকুমেন্টারি করে।এতোকিছুর পরেও আলী কেনানের বিধিবাম। ভাগ্য সহায় হয়না।অনিবার্য পতনের মুখোমুখি হয়।তার শেষ পরিনতি কি হয়েছিল জানতে হলে পড়ুন একজন আলি কেনানের উত্থান পতন।
সমাজের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের গল্প, মাজারের আড়ালে যা হয়, এসবের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে এবং পরের গল্প। একটা শিক্ষনীয় উপন্যাস বলা যায় :)
"একজন আলি কেনান এর উত্থান পতন" উপন্যাসে আহমদ ছফা একজন মানুষের ক্ষমতা লাভ ও ক্ষমতা হারানোর চক্রকে অবলম্বন করে সমাজের একটি বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসের প্রথম অংশে দেখা যায়, রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় আলি কেনান নামের এক সাধারণ মানুষ কীভাবে ধীরে ধীরে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। সে তার ধূর্ততা ও সুযোগসন্ধানী মানসিকতা দিয়ে ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে এবং নিজ এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার ও দাম্ভিকতার কারণে সে গভর্নরের আনুকূল্য হারায় এবং গ্রামের মানুষ তার অবস্থার কথা জানতে পারলে তার পরিবারের করুন পরিনতির কথা চিন্তা করে গ্রামে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ঢাকা শহরে আলি কেনান ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করে এবং একপর্যায়ে মাজার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। তার চাতুর্য ও বুদ্ধিমত্তার কারণে সে খুব দ্রুত এলাকায় জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মাজার দখল, শিষ্য বানানো, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলা, উরস-মাহফিলের আয়োজন—এভাবেই সে তার ক্ষমতার জাল বিস্তার করতে থাকে। তার খ্যাতি এতটাই বৃদ্ধি পায় যে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম পর্যন্ত তার গল্প প্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আলি কেনান স্বার্থান্বেষী হিসেবে আন্দোলনে যোগ দেয়। পঁচিশে মার্চের পর তার মাজার জ্বালিয়ে দেওয়া হলে সে আত্মগোপন করে এবং ১৯৭২ সালে আবারো ফিরে আসে। তখন সে শেখ মুজিবকে জয় বাংলার নেতা ও নিজেকে জয় বাংলার দরবেশ বলে দাবি করে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর দিনই আলি কেনানের মাজার লুট হয়ে যায় এবং সে মুহূর্তেই পথের ফকিরে পরিণত হয়। তার শেষ উক্তি—“শেখ মুজিব বাইচ্যা নাই, আমি ঢাকায় তাকুম কেরে? হের সমাজতন্ত্র অইল না, আমি হইলদ্যা পাখিরে হারাইলাম।” যা ক্ষমতার চাকায় পিষ্ট হওয়ার করুণ ইঙ্গিত বহন করে।
উপন্যাসে ছমিরন বিবি ও তার কন্যার মতো কিছু চরিত্র প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে, কিন্তু তাদের পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি। আহমদ ছফা এখানে মাজার ব্যবসার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন এবং ধর্ম ও মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে কিছু মানুষ কীভাবে ক্ষমতার পাহাড় গড়ে তোলে, তা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে চিত্রিত করেছেন।
সব মিলিয়ে "একজন আলি কেনান এর উত্থান পতন" একটি দারুণ উপভোগ্য ও সুখপাঠ্য উপন্যাস। শেষ অংশ কিছুটা দ্রুত সমাপ্ত হলেও লেখকের গভীর বোধ ও শৈলীর জন্য এটি পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী ছাপ রাখে।
"একজন আলী কেনানের উত্থান পতন" যতটা না পড়ে মুগ্ধ হয়েছি তার থেকে বেশি অবাক হয়েছি চরিত্রের মেলবন্ধনের জন্য। গল্প বলার সাবলীল দক্ষতা বইটিকে করেছে অন্যন্য। একই ফ্রেমে মুক্তিযুদ্ধ, কুসংস্কার, মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাকে তুলে ধরা বইটিকে বিন্যস্ত রূপ দান করেছে। একটি গাছের শাখা প্রশাখার মত লেখক পাতার মত করে গড়িয়ে দিয়েছেন তার চরিত্র গুলোকে! আলী কেনান যেন তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার মূর্ত প্রতীক।
চরিত্রের দেহে ভালবাসার সংস্থাপন করতে লেখক ভুলে যাননি। আলী কেনানের হৃদয়ে যে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ধানের আলপথের সরু বাঁকা সেচের পানির ন্যায়। তার বুভুক্ষু দেহে তার নিভৃত হয় ছমিরনের বসন্ত মাখা মুখের বসন্তের সৌন্দর্যের মত। ছমিরন মূর্ত প্রতীক স্বস্তিকা চিহ্ণের। যে যেমন সময়ের প্রতিবাদ তেমনি নিজেকে বাঁচানোর জন্য অন্যের কাছে আত্মসমর্পণ করা চিরায়ত দূর্বল মানুষ।
প্রতিটি গল্পে আবির্ভাব হয় কিছু অবারিত ঝর্ণার। যে মানুষগুলো গল্পকে দেয় পূর্ণতা। যে গল্প বলে যেন বাস্তবতাকে তুলে ধরে। প্রেমিকার শরীরের দেহের মত নিভৃত, গাঙের পায়ে মাছরাঙার মত বাহিত সে সৌন্দর্য যে অসীম।
আলী কেনান সে যুবক যে রুক্ষ মাটির চাষ। যে ভোলা জেলার নদীর মত কর্কশ আর শুকনো। গর্ভনর হাউজে তার প্রভাব প্রতিপত্তি কিংবা মাজারের খাদেম হয়ে সবসব্বা হওয়া তার ক্ষমতার লোভের বহিঃপ্রকাশ। যে মানুষ বুদ্ধি দিয়ে আন্দোলন করে তাকে রুখতে পারে না স্বয়ং প্রকৃতিও। ৭১ সাল থেকে ৭৫ সালের বাংলাদেশের যে পতন তা যেন আলী কেনানের লালসালু মাজারের ঝড়ে পড়া।
একজন আলী কেনান সমাজের চিত্র। এই সমাজে প্রতি দিন একজন আলী কেনান বেড়ে উঠে।
(পাঠ-পর্যালোচনা:একজন আলি কেনানের উত্থান-পতন) ◾ "আমার কাছে যত টাকা আছে, শেখ মুজিবের ব্যাংকেও এত টাকা নাই।" কার কাছে আছে এতবেশী টাকা? যে একসময় সদরঘাটে ভিক্ষা মাগে এই বলে “দে তর বাপরে একটা ট্যাহা!” “ভিখারীরা সাধারণত ভিক্ষাদাতাকেই বাবা বলে ডাকে। আলি কেনান দাবি ছেড়ে বসল সম্পূর্ণ উল্টো। অর্থাৎ সে ভিক্ষাদাতার বাবা...”
“একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন” বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরের সময়কে ঘিরে কিছু বিষয় উপস্থিত হয়। ক্ষমতাচর্চার প্রভাব, গোঁড়ামি, ধর্মের মুখোশ পড়ে করা জমজমাট ব্যাবসা, সে সময়কে কেন্দ্র করে মানুষের উত্থান-পতন, অহংবোধ এবং রাজনীতি সহ অন্যান্য। ছফা ধর্মের নামে অধর্মচর্চার সংস্কৃতিকে উপজীব্য করে গল্পের প্লট সাজিয়েছেন। মাজার সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আলী কেনানের উত্থান পতনের কাহিনী বর্ণনা করেন। আমাদের সমাজের মানুষ গোঁড়ামির ঘোরে ধর্মের নামে অধর্মচর্চায় বেশী করে। একটা বিশেষ ধর্মীয় কাজ টাকা খরচ করে সাধারণ মানুষের অভাব অনটন মিটানোর দিকে কোন দৃষ্টি এদের না থাকলেও ধর্মের নামে অধর্মচর্চার প্রতি এদের আগ্রহের কমতি নাই। আমার দেখা স্বামীহারা একমহিলার কথা বলি, ‘অাগুন লেগে উনার ঘর পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। অবশিষ্ট বলতে উনাদের প্রাণ, শ'কয়েক টাকা এবং মুরগির ঘরে থাকা ছয়টি মুরগী বাকি আছে। তিনি পরের জীবনে কীভাবে উঠে দাঁড়াবেন সে চিন্তা না করে আগুন নিবানোর সাথে সাথেই মুরগীগুলো নিয়ে চলে গেলেন এক দরবারে। তাকে একসময় জিগ্যেস করেছিলাম, আপনি চাইলে ছয়টি মুরগী বিক্রি করে কিছুটা কাজ করতে পারতেন অথবা এগুলো লালন পালন করে বড় করলে সামনের জীবনে উপকৃত হতেন। তিনি আমার দিকে চোখ টকটকে লাল করে তাকিয়ে বললেন, উনাদের হাতেই তো সবকিছু ওদের কৃপা কারবারিতে আমাদের চলাফেরা, জীবনযাপন সব। ওদের খুশি রাখতে পারলেই তো আমরা খুশি থাকি। কী অদ্ভুত চিন্তা!’ উনি উনার জীবনযাপন কেমন হবে এটা অন্যের উপর পরিপূর্ণ ছেড়ে দিলেন। ঐদিকে দরবারী মুরগীগুলো খেয়ে উনার জন্য সামান্য পরিমাণ চিন্তাও করলো কি না জানি না! অতিবাহিত সময়ের বাস্তবতা এটাই সাক্ষ্য দেয় যে এ ব্যাবসায়ীগুলোর মূলত একশ্রেণীর সর্বস্ব শোষণ করার জন্যই উত্থান। ওদের জমজমাট ব্যবসা দেখে আমার যতটুকু না খারাপ লাগে তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগে এ-সবে বিশ্বাসী মানুষগুলোকে দেখলে। ওরা ভালোবাসা মতো পবিত্র, চক্ষুর মতো পরিষ্কার ধর্ম পেয়েও গোঁড়ামির ঘোরে অধর্মচর্চা করে যায়। চুর, জুয়াড়ি, বাটপার, বদমায়েশের সাথে সাথে অনেক মানুষ দেখা যায় উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছে, বর্তমান অর্থব্যবস্থার উপর মোটামুটি জানাশোনা আছে, ইতিহাস থেকে মোটামুটি/পরিপূর্ণ জানে তবুও তারা গোঁড়ামির ঘোর থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। লেখক লিখেছেন, “মাজারে মানুষ আসবেই। মানুষ আসবে কারণ সে দুর্বল অসহায় এবং উচ্চাকাঙ্খী।” “স্বর্গবাসী পুরুষের মুক্ত চেতনার সঙ্গে পৃথিবীর শকুনিদের লোভলালসা এক করে না দেখার আশ্চর্য ক্ষমতা মানুষের আছে। তাই তারা মাজারে আসে।” এদের অসহায়ত্ব ধর্মকে না জানা, এরা দুর্বল ধর্মে মানুষ যতই উচ্চাকাঙ্খা পোষণ করুক যদি সে ধর্মকে ভালোভাবে জানে তবে সে এসব গোঁড়া ভণ্ডামি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। আমাদের অনেকেই মনে করেন, বর্তমান সমাজে প্রচলিত গোঁড়ামি ও ভণ্ডামিকে মুছে দিতে মানুষকে উন্নত সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান নিয়ে জানতে হবে এবং তার শরণাপন্ন হতে হবে। অথচ এরচেয়ে বড় বাস্তবতা এবং সঠিকতা হচ্ছে, এসব গোঁড়ামি ও ভণ্ডামি বন্ধ করতে সবচেয়ে বেশি কার্যকারিতা পাওয়া যাবে মূল ধারার ধর্মে এবং ধর্মীয় দর্শনে। এদেশে ধর্ম নিয়ে ব্যবসার স্বরূপ উন্মোচন করে লেখক সমাজের কিছু অসাধু মানুষের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে মানুষ ধর্মের নামে অধর্ম চর্চা করে। পুঁজিতন্ত্রের বিষাক্ত থাবায় জীর্ণশীর্ণ সমাজে ধর্ম আর মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে ব্যবসা গড়ে তুলে দুর্নীতি ও ভণ্ডামি করতে থাকা ব্যক্তিদের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। উপন্যাসে দেখতে পাই, ধর্ম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ একজন ব্যক্তি ধর্মকে ব্যবহার করে কী করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়ে যায়।
আলী কেনান গ্রামের এক সাধারণ দখলদার ব্যাক্তি। পাকিস্তানি গভর্নরকে মৃত্যুর মুখ হতে বাঁচালে গভর্নর সাহেব তাকে নিয়ে আসে ঢাকায় তার অফিসে এবং নিজের পিয়ন বানিয়ে দেয়। আলী কেনান হয়ে যায় গভর্নর সাহেবের প্রিয় সখা এবং গভর্নর সাহেবের মতো শহরের সবচাইতে সর্বশক্তিমান ব্যাক্তির দ্বিতীয় সত্ত্বা। আলী কেনানের কাজ কারবারিতে পড়ে ক্ষমতাচর্চার চাপ। যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী, প্রশাসন সহ সাধারণ মানুষকে হারে হারে বুঝিয়ে দেয় তার প্রচুর ক্ষমতা সে গভর্নরের প্রিয় লোক। গভর্নরের পরে দেশে যেন তার-ই রাজত্ব। সে সুযোগকে ব্যবহার করে আলী কেনান নিজেদের দখলদারত্বের কাজে, নিজের স্বজনের জন্য এবং নিজের জন্য। বর্তমান সমাজেও আমরা এমন দৃষ্টান্ত দেখতে পায়। মূলত ছফার লেখা জুড়ে যেন মিশানো থাকে ভবিষ্যৎবাণীও। আমরা দেখতে পাই আমাদের সমাজে সরকার দলীয় লোক হলেই তারা সমাজে ক্ষমতাচর্চার প্রভাব বিস্তার করে। এরকম নজিরের বাংলাদেশে অভাব নাই। একবার মিডিয়া মারফতে দেখেছিলাম, দেশের সর্বোচ্চ নেতার এক পিএস প্রশাসনের লোককে হুমকি দিচ্ছিল। আমি অমুকের পিএস বলে। রাজনৈতিক ছাত্র দলের দিকে তাকালেই দেখা যায় এরা সিনিয়র ক্ষমতাশালী নেতাদের নাম নিয়ে যেকোনো কাজ করে যেতে কোন কুণ্ঠাবোধ করে না। এমনই আলী কেনান গভর্নরের পিয়ন হয়ে নিজের ক্ষমতা প্রকাশ করে তার প্রভাব বিস্তার করে যায়। এক মন্ত্রী একবার গভর্নরের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে চাইলে আলি কেনান তাকে অপমানিত করে। কিন্তু অতিরঞ্জিত সবকিছুই মানুষের জীবনে অবনতি ঘটায়। যে গভর্নর একসময় তাকে এত উপরে তোলে সেই একসময় তাকে সর্বহারা করে পথে ছেড়ে দেয়। “এই হল আলি কেনানের স্বর্গ হতে পতনের কাহিনি।”
সর্বহারা আলি কেনান লজ্জার মুখে পড়ে ফিরে যেতে পারে না বাপের বাড়িতে। ঢাকার অলিগলি ঘুরেতে থাকা আলী কেনানকে একসময় সিদ্ধান্ত নিতে ভিক্ষাবৃত্তির। চতুর আলি কেনান চতুরতার সাথে শুরু করে ভিক্ষাবৃত্তি। প্রথমে এক লঞ্চযাত্রীর কাছে টাকা চাইতে গিয়ে সে আবিস্কার করলো তার নিজের নির্দেশ দেবার এক অদ্ভুত ক্ষমতাবল আছে। গভর্নরের পিয়ন থাকায় হয়তো সে ক্ষমতাবলের অর্জন। সে বলে বসে বিনয়ের সুরে নয় বরং প্রায় হুমকির সুরে, “দে তর বাপরে একটা ট্যাহা!” না দিয়ে যেন কোন উপায় আর থাকে না। এই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সে হয়ে ওঠে প্রতাপশালী দরবেশ। লালসালুর মতো সে শুরু করে মাজার ব্যাবসা। দিনে দিনে তার প্রভাব বাড়তে থাকে। নতুন এ ধরনে উন্নতি নিয়ে আলি কেনানের উত্থান হয় নতুন জীবনে। আলি কেনানের প্রভাব-প্রতিপত্তি এতটাই বেড়ে যায় যে, ব্রিটিশ টেলিভিশনের কোনো এক চ্যানেল তাকে নিয়ে তথ্যচিত্রও তৈরি করে। আলি কেনান আবারো ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে। তার প্রভাবে পুরো এলাকার মানুষজন প্রভাবিত হয়। তার দরবারে এখন দেশের সমস্ত ক্ষমতাশালীরা মাথা ঠুকে। সে তার এই জীবন গভর্নরকে দেখাতে চাই। সে এই জীবনটি কিছুর বিনিময়ে খোয়াতে চাই না। এই জীবনটি আলি কেনানের মাঝে তৈরি করে অহংবোধ। তার এই জীবনে অনেকের আগমন ঘটে আসে কুকুর, পথের শিশু, জেলফেরত মাস্তান, দরবেশি শিখতে চাওয়া লোকসহ আরও অনেকে। তার এ জীবনে ছরমিন ও তার মেয়ের আগমন ঘটে। একদিন ছরমিন ও তার মেয়ে কেনানের কাছে আশ্রয় চাইলে সে জিগ্যেস করে “তুই কী সব কাম করতে পারবি?” সেই থেকে ছরমিন কেনানের গৃহ পরিষ্কার, রান্নাবান্না এবং রাতে কেনানের যৌন ক্ষুধা মিটানো সহ সব কাম করে যায়। তার জীবনে ছরমিন ও বিলেতফেরত এক মেয়ের আগমনের মধ্যে আবার বেজে উঠে পতনের সুর!...
প্রতাপশালী ব্যাক্তির প্রতি এদেশের মানুষের মনে প্রোথিত দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আলি কেনানের গভর্নরের পিয়নগিরি যেমন সুবিধা ভোগ করে তেমন এদেশের মানুষের অন্ধবিশ্বাস এবং সত্যসন্ধানী বিমুখ মনোভাবের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আলি কেনানের ভণ্ডামিগিরিও খুব সহজেই ধোঁকা দিয়ে যায়। আলি কেনান খুব সহজেই দোকানদারের কাছে চাঁদাবাজি করে, তাকে চাঁদা দিতে ফুলতলীর দোকানদারদের অন্ধবিশ্বাস যেন বাধ্য। আবার কেনানের দুনো রূপই দেশের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মানুষকে বিপাকে ফেলে। গভর্নরের পিয়ন কেনানের দখলদারিত্বে যেমন অসহায়ত্ব লালন করে কেনানের ভোলার মানুষগুলো, ধর্মের পোষাকে ছদ্মবেশী রূপধারণ করা কেনানের কুচক্রান্তের ও ছলনার শিকারে শিকার হয়ে যায় ফুলতলী মসজিদের ইমামের অর্থনৈতিক দুর্বলতা। এসব চক্রান্তগুলো তারা যেন চিনতে পেরেও চিনতে চাই না। তারা এর সত্যতা জেনেও জানতে চাই না।
যুদ্ধ শুরু হলে সময়ের প্রথমপ্রান্তে আলি কেনান নিজেকে প্রকাশ করে “জয় বাংলার দরবেশ” হিসেবে। কেন সে এ নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে? নিজের ব্যাবসাতে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে? না, গভর্নর তাকে বের করে দিয়েছিল সে ক্ষোভের বশে আলি কেনান পাকিস্তানের বিরোধীতা করে? হয়তো যুদ্ধচলাকালীন সময়ে তাকে সবাই ছেড়ে চলে যাওয়ায় সে একদম অসহায় হয়ে পড়ে তাই এই নতুন পরিচয়ে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করে আবার উত্থিত হতে চাই। না কি শেখ মুজিবের মতো আলী কেনানও জয় বাংলার দরবেশ বলে নিজের আত্মশক্তির পরিচয় দিতে চাই?
চিন্তাবিদ সলিমুল্লাহ খান আলি কেনানকে শেখ মুজিবুর রহমানের রূপক মনে করেন। সাধারণ পাঠক হিসেবে আমাদের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। দ্বিধান্বিত হই। এটা বোধগম্য হয় না যে, এরকম ধূর্ত, ঠকবাজ ও ভণ্ডের সাথে শেখ মুজিবের সাথে লেখক কেমনে? কেন মিল রাখে? তবে আমরা কিছুটা বুঝতে পারি যে, উপন্যাসে লেখক অনেকসময় আলি কেনানকে শেখ মুজিবের সাথে মিল রেখেছে। আমরা দেখতে পাই, শেখ মুজিবের বিপুল পরিমাণে সমর্থক ছিল, যারা শেখ মুজিবের কথায় যুদ্ধে লাফিয়ে পড়ে, নিজের যান মাল সমস্ত কিছু নিয়ে জীবন উৎসর্গ করতে তৈরী হয়ে যায়। এদিকে আলি কেনানের অনেক ভক্ত সাগরেদ তারাও আলি কেনানের জন্য সবসময় যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত ছিল। তবুও দুজনের'ই দুঃসময়ে তারা খুব অল্প মানুষ কাছে পেয়েছিল হয়তো কাউকে পায় নি এবং দুজনকেই খুব কাছের মানুষ সর্ববিনাশের দারে নিয়ে দাড় করেছিল। আলী কেনান এবং শেখ মুজিবের ক্ষমতার দিকেও কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। শেখ মুজিব তার ক্ষমতাবলে যুদ্ধের সময় এবং এর পরের সময়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে। যদিও যুদ্ধের সময়কার এবং এর পরবর্তীকালীন সময়ের পরিস্থিতিতে কিছুটা পার্থক্য আছে। এদিকে আলী কেনানও নিজের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ক্ষমতার ওজনে নিজেকে শেখ মুজিবের সমতুল্য মনে করে আলী কেনান জোর গলায় উচ্চারণ করে, “বাংলাদেশে আমি আর শেখ মুজিব ছাড়া আর কুনু বাঘের বাইচ্চ্যা নাই।” মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দুজনেই নিজের স্থানে অবিচল থাকতে পারে না। শেখ মুজিব এবং আলি কেনান দুজনেরই জীবনে মিল রেখে লেখক "১৯৬৯-১৯৭২" পর্যন্ত সময়ের গল্প টানে। ১৯৭২ সালে যেমন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে নিজের ক্ষমতায় আসীন হয় তেমন আলি কেনানও নিজের মাজারে ফিরে কর্মকাণ্ড চালু করে, “বাবা”র আসনে বসে। দুজনের জীবন চলতে থাকে, তবে এর মধ্যে তাদের জীবনে আর তেমন সাদৃশ্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধুই নিজেদের ক্ষমতার কিছুটা সাদৃশ্যতা পাওয়া যায়। ১৯৭৫! বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে শহীদ করা হয়। বঙ্গবন্ধু পরিবার নিজেদের আপনদের অনেককে খুঁজে পায় না এদিকে আলি কেনানও দুঃসময়ে নিজের আপনজনকে খুঁজে পায় না। বঙ্গবন্ধু হত্যার শিকার হয় নিজের কাছের মানুষের দ্বারা, আলি কেনানের পতনও ঘটে নিজের আপনজনদের দ্বারা। বঙ্গবন্ধু নিহত হলে আলী কেনান চিৎকার দেয়, "শেখ মুজিব বাইচ্যা নাই, আমি ঢাকায় থাকুম কেরে? হের সমাজতন্ত্র অইল না, আমি হইলদ্যা পাখিরে হারাইলাম।"
সমাজবিজ্ঞানী ছফা উপন্যাসে গল্পের আদলে যে সামাজিক বাস্তবতার বর্ণনা দিয়েছেন। দক্ষতার সাথে আমাদের সামনে যে বিষয়াবলি উপস্থাপন করেছেন, পাঠক একটু মনোযোগ দিলেই বুঝতে পারবে আমাদের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় তার অবস্থান এখনো বিদ্যমান। সমাজব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন না আসলে এ সমস্যাগুলোর সমাধানও সম্ভব হবে বলে মনে হয় ন।
ছফা নিজের অন্য উপন্যাস “আলাতচক্র, ওঙ্কার”এর মতো এখানেও বর্ণনা ও বিষয়বস্তুর প্রকাশভঙ্গীতে মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয়। একেবারে সাধারণ ভাষায় অনন্য বৈশিষ্ট, নতুনত্বের স্বাদ, শব্দ ও রচনাশৈলীর দক্ষতা এবং পরিমিতিবোধ নিয়ে ছফা তার অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। দরবেশী কারবারে এটা “লালসালু’, ‘বহিপীর’, অথবা ‘শাহজাদা”এর মতো মনে হলেও পাঠক দৃষ্টিতে গল্পের স্বকীয়তা ধরা দিবে। লেখক উপন্যাসের গল্প খুব সাধারণভাবে সমানতালে বলে যান। অতিনাটকীয় কোন অবস্থা নাই। একদম সাধারণ গল্পের আবহে অসাধারণ একটি উপন্যাস। ▪▪▪ বই: একজন আলি কেনানের উত্থান-পতন লেখক: আহমদ ছফা ধরন: উপন্যাস প্রচ্ছদ: সমর মজুমদার প্রকাশক: খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি মুদ্রিত মূল্য: ৳১৫০ ▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪ —খোবাইব হামদান ১০/০৭/২০২১ | ০১:২৩ রাত
প্রমথ চৌধুরির একটি গল্প ছিলো পাঠ্য বইয়ে ”পাঠকের মৃত্যু নামে”। ছোটবেলায় সেই রচনা মনে তেমন দাগ না কাটলেও বড় হয়ে বুঝেছি কতটা অসাধারণ ছিলো গল্পটি। যতদূর মনে পড়ে লেখাটির বিষয় বস্তু ছিলো একটি বই এর কিছু অংশ পড়ে এক পাঠক মুগ্ধ হয়েছিলো কিন্তু বছর কয়েক পরে সেই একি বই সেই পাঠককে আর মুগ্ধ করতে পারেনি বরং সেই বই হতাশ করে। এমন ঘটনা বেশ কয়েকবার হয়েছে আমার জীবনে। আর যার লেখা দিয়ে এমনটা শুরু হয়েছে তার নাম আহমেদ ছফা। উনার ”অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী ” এক আত্নীয়ের বাসায় বইটি প্রথমবার অর্ধেক পড়ে এত মুগ্ধ হয়েছিলাম যে বইটি শেষ করতে না পারার কারনে কয়েক রাত ঠিক মতো ঘুমাতে পারিনি। পরের দিন সকালে ওই বাসা থেকে চলে যাওয়ার কারনে আর শেষ করা হয়নি, পরে নানান ব্যস্ততায় বইটির কথা ভুলে গিয়েছিলাম। বছর দুই পর বইটি পেলাম ��াতের কাছে আর পড়ে ফেললাম উপন্যাস টি। কিন্তু সেই একি উপন্যাস আমাকে মোটেও মুগ্ধ করতে পারেনি আগের মতো। ফলাফল স্বরুপ বিরুপ একটা ধারনা জন্মালো ছফার উপন্যাসের প্রতি। যার কারনে বাসায় ছফার উপন্যাস সমগ্র থাকার পরও আর পড়িনি।
এই বছর আশাভঙ্গের বেদনাকে ভুলে আবার পড়তে শুরু করেছি ছফার উপন্যাস। শুরুটা করেছি ওঙ্কার দিয়ে, বেশ ছুঁয়ে গেছে লেখাটি। তাই তড়িগড়ি করে পড়া শুরু করলাম আলী কেনান���র উত্থান-পতন। গল্পের বিষয় বস্তু খুব সাধারন, আমাদের চারপাশের হঠাৎ গজিয়ে উঠা সামািজিক শক্তিধর একজন মানুষের গল্প বলেছেন লেখক। তাই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সহ সমাজ ব্যবস্থাটা কে মনে হয়েছে ভীষন পরিচিত। একব্যাক্তি কেন্দ্রিক সরলরৈখিক উপন্যাস বলা যায় একে। একজন দুরন্ধর মানুষ কি করে শত বাধাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যায়, সময়ের নানান হাওয়াকে কি করে কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তার নিপুণ বর্ণনাময় গল্প এটি। ধর্ম ও মাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মানুষের কুসংস্কার আর মাজার ভক্ত মানুষের সরলিপনা কে কাজে লাগানো, মুক্তিযুদ্ধকে নিজের সুবিধামত ব্যবহার করে একজন মানুষ কি করে সমাজের অন্যতম শক্তিতে পরিণত হতে পারে সেই উত্থানের সাবলীল বর্ণনা করে গেছেন লেখক। তাই পড়তে গিয়ে কখনো ক্লান্তি আসেনি, বরং প্রতিটি পৃষ্ঠা আরো বেশি আগ্রহ সৃষ্টি করে গেছে। সেই আগ্রহ ভালোলাগার তৃপ্তি দিয়ে শেষ হয় অালী কেনানে পতন দ্বারা। উপন্যাসটির ব্যাপ্তিকাল বেশ দীর্ঘ, সেই ব্যাপ্তিতে রয়েছে আলী কেনানের জীবনের নানান ছোট বড় ঘটনা, মুক্তিযুদ্ধ, পাওয়া-পাওয়া আর চারিত্রিক দৃঢতার উজ্জল নমুনা। সব কিছু মিলিয়ে উপন্যাসটি বেশ সু-পাঠ্য আর শিক্ষনীয় হয়ে উঠেছে। আমাদের সমাজকে জানতে, ধর্মের কু-ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে সচেতন হতে বইটি বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
ঘটনার শুরু হয় যখন আলি কেনান ধমকের জোরে মানুষের পকেট থেকে আস্ত একটা টাকা বের করে আনতে পারল৷ সেই সময় অর্থাৎ উনিশ শ' ঊনসত্তুর সালে ভিখারিরা মুখে ফেনা তুলে চিৎকার করে মানুষকে বাপ সম্মোধন করেও সিকি পাওয়াকে বিশাল অর্থ ভাবত, সেই যুগে আলী কেনান নিজেকেই ভিক্ষাদাতার বাবা বলে কড়া নির্দেশে টাকা বের করে নেয়৷
মূলত আলী কেনান কে ছিল? গভর্নর সাহেবের একেবারে খাস পিয়ন৷ ভোলা শহরের বিক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে গভর্নর সাহেবের প্রাণ রক্ষায় আলী কেনান পিয়ন পদে চাকরি পায়৷ সামান্য পিয়ন হয়েও নিজেকে গভর্নরের দ্বিতীয় সত্তার দাবীদার আলী কেনানের কেবিনেটের মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ আমলা, দলের নেতা, উপনেতা সবার প্রতিঔদ্ধত্য ব্যবহার ও তেজী মনোভাব ছিল৷ তার অনুমতি ছাড়া কারো পক্ষে গভর্নরের সাক্ষাত পাওয়া অসম্ভব৷
কিন্তু এখন আলী কেনান কে? একজন সাধারণ ভিক্ষুক৷ অতিরিক্ত ক্ষমতার দাপটে একটা ভুলে গর্ভনর হাউজ থেকে তাকে লাথি মেরে পদচ্যুত করা হয়৷ কিন্তু আত্নপ্রত্যয় ও ক্ষুর বুদ্ধির জোরে মানুষের ভয়কে পুঁজি করে আলী কেনান লালসালুর একটা লুঙ্গি এবং একটা আজানুলম্বিত আলখাল্লা বানিয়ে পরিত্যাক্ত কবরে মাজার ব্যবসা শুরু করে। এভাবেই আবার আলী কেনানের উত্থান শুরু হয়৷ পরবর্তীতে মাজার ব্যবসাজনিত নানা ঝামেলা এবং প্রবল অহংকার ও ক্ষমতার ঘূর্ণিপাকে আলী কেনানের জীবনক্রিয়া চলতে থাকে৷
আহমদ ছফা শক্তিশালী লেখক৷ ক্ষমতার বলয়ে আবদ্ধ মানুষ দ্বিধাহীনভাবে নিজের শিকড়কে অস্বীকার করে৷ নিজেকে ভাবতে থাকে অপ্রতিরোধ্যতার মূর্তি৷ কিন্তু ভুলে যায় কত সহজেই না সেই ক্ষমতার বলয় তাকে গ্রাস করে নিঃস্ব করতে পারে৷ আলী কেনানেন জীবনচক্রের মাধ্যমে ছফা সাহেব মানবজীবনের উথান পতনের সেই গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন৷ আবার, একই সাথে সমাজের কিছু অসাধু মানুষের মুখোশ উন্মোচন করেছেন যারা ধর্ম আর মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে মাজার ব্যবসা গড়ে তুলে দুর্নীতি করতে থাকে৷ শেষের দিকে স্বাধীনতার পূর্ব ও উওরকালে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার উত্তাল চিত্র উঠে আসে৷ আলী কেনান ক্ষমতার ওজনে নিজেকে শেখ মুজিবের সমতুল্য ভেবে জোর গলায় বলেছিলো "বাংলাদেশে আমি আর শেখ মুজিব ছাড়া আর কুনু বাঘের বাইচ্চ্যা নাই৷ শেখ সাহেবের কতা যেমন হগলে হুনছে, হেইরকম আমার কতাও হুনন লাগব", স্বধীনতা-উত্তর শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডে আলী কেনান নিজের পতনে হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গে নিঃস্ব অনুভব করে৷ লেখক হয়ত এই সমতুল্যতায় শেখ মুজিবকে সূক্ষভাবে খোঁচা দিতে চেয়েছেন অথবা গল্পের খাতিরে ব্যাপারটা নিতান্তই সমাপতনে সিদ্ধ— সেটা তর্কসাপেক্ষ৷ সর্বোপরি, বইটা পড়ে ভালো লাগলো৷
বইয়ের নামঃ একজন আলি কেনানের উত্থান পতন লেখকঃ আহমেদ ছফা পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৭৯ মুদ্রিত মুল্যঃ ১২০ টাকা প্রকাশনীঃ খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি
আমরা জীবনে নানান রকমের উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যাই। অনেকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন হয়। যেমন কারো হয়তো একটা অবস্থা থেকে কেবল উন্নতিই হচ্ছে অথবা অবনতিই হচ্ছে। ব্যাপারটা যখন ধ্রুব থাকে তখন মানসিক বা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিটা কিছুটা আয়ত্ত্বে থাকে। কিন্তু যখন উত্থান পতনটাই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায় তখনই নানান বিপত্তি দানা বাধতে শুরু করে এবং কোথাও স্থির হতে না পেরে একপর্যায়ে গিয়ে মানুষ অধৈর্য্য হয়েই পড়ে৷
চরাঞ্চলের আলি কেনানও সেই দলেরই মানুষ। কখনো সে ছিলো ক্ষমতাসীন গোছের কেউ আবার কখনো রুপান্তরিত হয় দুস্থ মানুষে। ঘাত-প্রতিঘাত এর মধ্যে দিয়ে অগণিত কুটিল এবং অসৎ কাজের দ্বারা সে প্রতিবারই ভীত শক্ত করতে চায় এবং তা গুড়িয়ে যায়। প্রথমদিকে ক্ষমতা হারিয়ে নিস্পৃহ হয়ে পড়ার পরে কাজে লাগায় ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মবিশ্বাস কে। নিজের সৃষ্টির মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে একপর্যায়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
১৯৬৯ সালের আগের থেকে নিয়ে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্যদিয়ে কাহিনী অগ্রসর হয়েছে। চরিত্রের প্রয়োজনে বেশ কিছু অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ লক্ষনীয় ছিলো। শেষের অংশটুকু তাড়াহুড়ো করে শেষ করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়টা আরেকটু দীর্ঘ হলে সামঞ্জস্বপূর্ণ লাগতো।
এটা কোনো মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস না। সেই সময়ের একজন অসৎ মানুষের উত্থান পতনের কাহিনী মাত্র। শেখ মুজিবের সাথে আলি কেনানের তুলনা মূলতই অপ্রাসঙ্গিক লাগেনি। একদল মুখোশধারী স্বার্থপর মানুষ যাদের বিশ্বাসভাজন বলে আদতে মনে করেছিলো, তারাই পিঠে ছুড়ি মারে। এছাড়া আর কোনো যুক্তিসঙ্গত তুলনা খুজে পাইনি।
আহমেদ ছফার বই জীবনে প্রথম পড়লাম। লেখনী মোটামুটি পছন্দ হয়েছে বইকি। তবে লেখককে জানার জন্য সামনে আরও বেশ কিছু পড়াশোনা করতে হবে।
বলতেই হবে আহমদ ছফা তার প্রথম উপন্যাসেই তার অসাধারণ লেখনীর ছাপ রেখেছেন। আলি কেনানের মত অসাধারণ চরিত্রের সাথে মনে হয় আমরা যে কেউ নিজের মনের অনেক অদম্য স্পৃহার মিল খুজে পাই।
জীবনের জন্য বাচা নাকি বাচার জন্য জীবন। পেছনে না তাকিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলার নাম ই জীবন।
মানুষের জীবন পরিবর্তনশীল কখন কিভাবে পরিবর্তন আসবে কেউ জানে না। বিশেষ ভাবে বলতে হলে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত রং বদলায়। জীবন তার আপন গতিতে এগিয়ে চলে, সেই জীবনকে আপন করে নিতে হয়। হয়ত নদীর স্রোতের মত চলা শুরু হয়ে সাগরে মিশে যায়। আবার কিছু সময় নিজেকে জীবনের সাথে মিশিয়ে নিতে হয়। এভাবেই জীবন নিজের পথ খুজে নেয়।
কেউ কেউ নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নেয়। আবার কেউ কারো দেখানো পথেই হাটে। জীবনের উত্থান পতন ঠিক এখানেই শুরু হয়। হয়ত জীবন যেভাবে পথ তৈরি করে দেয় সেভাবে পথ নাও হতে পারে। আবার কারও জীবন প্রতিটি দিন সংগ্রামের হয়ে ওঠে। অথচ কেউ কেউ বুদ্ধি চতুরতা আর স্বার্থ দিয়ে মানুষকে অন্ধ বানিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে নেয়।
ধর্ম আমাদের জীবনকে সুপথে পরিচালিত করার একটা মাধ্যম। জীবনকে সুন্দর ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করতেই ধর্মের মুল উদ্দেশ্য। কিন্তু কেউ কেউ ধর্মকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। নিজের উন্নতির সিড়ি ও মাধ্যম হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে। যেখানে মানুষকে সত্যের চেয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধার বেশি করে দেখা হয়।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় এবং কিছু ক্ষেত্রে বিতর্কিত লেখক হচ্ছে আহমদ ছফা। মুলত তিনি অকপটে সব বলে দিতেন বলেই তাকে সেভাবে অনেক পছন্দ করত না। তার লেখা "একজন আলি কেনানের উত্থান-পতন" পড়া শেষ করলাম। এই বইটিতে একজন আলি কেনানের জীবনের উত্থান পতন, তার জীবনের শুরু এবং শেষ তুলে ধরেছেন।
বইটি খুব ছোট একটি বই। এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। এখানে বলে রাখা ভাল বইটি পড়ার সময় আপনার অন্য একজন লেখকের বিখ্যাত বইয়ের কথা মনে পরবে। আর সেটি হচ্ছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এর লেখা "লালসালু"। লালসালু প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৪৮ সালে। কাকতালীয় হলেও এর ঠিক ৪০ বছর পর মানে ১৯৮৮ সালে আহমদ ছফা এর লেখা "একজন আলি কেনানের উত্থান-পতন" বইটি প্রথম প্রকাশ পায়।
এই গল্পের মুল চরিত্র হচ্ছে আলি কেনান যে গর্ভনর অফিসে পিয়ন হিসেবে কর্মরত। তবে এই চাকরিও সে অনেক ঘটনাবহুল ভাবেই পেয়েছে। যেহেতু সে গর্ভনর এর পিয়ন তাই সে তার গ্রাম আত্ময়ীস্বজনদের কাছে অনেক সমীহ পায়। তাছাড়া সে আর তার পরিবারে ক্ষমতা বেড়েই চলে। ক্ষমতার দাপটে সে ধরা কে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে।
আবার ঘটনা চক্রে তার এই ক্ষমতার চাকরি চলে যায়। সে যেই পথে ছিল সেই পথেই ফিরে যায়। অবশেষে সে খুজে পায় এক কবর। সে তার চতুরতা আর ধর্মান্ধতার জোরে এক সম্রাজ্য তৈরি করে। যেখানে সেই রাজা, যার ক্ষমতার কাছে সবাই মাথা নোয়ায়। সে হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। ক্ষমতা আর টাকার জোরে সে সবাইকে নিজের বশে নিয়ে নেয়।
তবুও মানুষের পতন আসে। সে পতিত হয় আবারও শুন্যে। যেখানে সে ছিল সেই খানে। গল্পের শেষটা ঠিক এমন ই। শুন্য থেকে শুরু হয়ে শুন্যে ফিরে যাওয়া।
আসলে মানুষ শুন্য থেকে আসে এবং শুন্যে ফিরে যায়। ক্ষমতা লোভ আর টাকা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। আবার মানুষ জ্ঞানের চেয়ে ধর্ম কে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। অথচ ধর্ম কখনও ধর্মান্ধ হতে বলে না। কিন্তু মানুষের বিশ্বাস আর অন্ধ বিশ্বাস কে কাজে লাগিয়ে মানুষ নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে থাকে।
আহমদ ছফা মুলত দেখাতে চেয়েছেন যে একজন মানুষ তার চতুরতা আর স্বার্থ দিয়ে নিজকে কত উচ্চতায় নিতে পারে। আবার জীবনে কোন পর্যায়ে তাকে ফিরে যেতে হয় যেখান থেকে শুরু হয়েছিল ঠিক সেখানে। এভাবে মানুষের জীবন স্রোত বয়ে চলে।
তবে ক্ষমতা আর টাকা কখনই চিরস্থায়ী নয়। সব কিছুর একদিন শেষ আছে। শেষ হবে। সেদিন শুন্যতা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।
আমরা যখন হাটি হাটি পা-পা করে এগিয়ে চলছি যুদ্ধ সময়ের দিকে ঠিক সেই প্রেক্ষাপটে একজন নিরেট মানুষের গল্প এটি ; আলী কেনান, ভোলার চরাঞ্চলের একটি সাদামাটা চরিত্র । ১৯৬৯ সালের কোন এক অস্থির সময়ে পর্শ্চিম পাকিস্তানের এক গভর্নর ভোলায় প্রচারণার কাজে আসেন ,সেখানে আগে থেকেই উৎ পেতে ছিলো বিরোধী দল, সবার আক্রমণে যখন গভর্নরের মর-মর অবস্থা তখনই আলী কেনান ও তার ভাইয়েরা মিলে উদ্ধার করে ঐ গভর্নর কে । প্রতিদানে বেকার আলী কেনানকে নিজের পিয়ন হিসেবে নিয়ে যায় গভর্নর , সেই থেকে দিন পরিবর্তনের পালা শুরু আলী কেনানের ।
গভর্নর হাউসে বসে সে অনধিকার চর্চা করে, গভর্নর কে হাতে রেখে সর্বেসর্বা হয়ে উঠে সব দিক থেকে, এই প্রভাব প্রতিপত্তির ছায়া পড়ে তার চরের পরিবারেও , অঘোষিত প্রভাবের মারফতে গ্রামে তাকে নিয়ে ভয় ছড়িয়ে যায়, তার ভাইয়েরা জোর-জবরদস্তি করে জমি-জমা দখলদারি শুরু করে । সবাই কানাকানি করে - 'আলী কেনানের শত্রুরে আলী কেনান ফাঁসির দড়িতেও ঝুলাইবার ক্ষেমতা আছে' । সাপের চমড়ার মত পুরোনো গায়ের গরীব ঘরের চমড়া ফেলে আলী কেনানও আভিজাত্যের খোলসে যখন নিজেকে ঢাকতে শুরু করেছে ঠিক এই রঙিন মূহুর্তেই ছন্দপতন হয় সবকিছুর , লাথ্থি দিয়ে বের করে দেয় গভর্নর ।
আলী কেনান বুঝতে পারেনা কি করণীয় , তার শিক্ষা নেই আবার বাড়িও যাওয়া যাবেনা, সবাই যদি শোনে তার প্রভাব শেষ তাহলে এতদিনের তিল-তিল করে গড়া সাফল্যের সৌধ নিমিষেই মানুষের প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হবে, এ যেন উভয় সংকট ;সব হারিয়ে অকুল পাথারে এসে পড়ে আলী কেনান ।
দু'চার মাস ভবঘুরে হয়ে ঘুরে ফিরে আলী কেনান শুরু করে ভিক্ষাবৃত্তি তবে ভিন্ন উপায়ে, ঢাকার ফুলতলির এক কবরে লালসালু বেধে দাবী করে -' এইডা গরম বাবা আলী কলন্দের মাজার' । সেই সময়ের মানুষ বরাবরের মতই ধর্মান্ধ , তারা আলী কেনানের টোপ গিলে , এভাবেই তরতর করে নতুন আবরণে জড়িয়ে নেয় আলী কেনান , এরপর তার কত উত্থান পতন।
দেশ স্বাধীন হয়, চারদিকে শেখ মুজিবের জয়জয়কার ,আলী কেনান ঘোষণা করে ,সেও আরেক মুজিব , তারা দুজনেই এক , শুধু কাজ করার তরিকা ভিন্ন । চলতে থাকে আলী কেনানের দিন , সে বুঝতে পারে কৃত্রিমতা নিয়ে বেশীদূর পৌছানো যায়না, নিচে পড়তে হয় সজোরে । পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তাই হয়, যেদিন শেখ মুজিবের হত্যা হয় ঠিক সেদিনই আলী কেনানের সমস্ত টাকা, জস, প্রতিপত্তি ফুরায় শুধু একটি মেয়েগঠিত সমস্যায় , নিঃস্ব আলী কেনান ফিরে চলে তার সূচনায়, তার শূন্যে যেখান থেকে শুরু হয়েছিলো তার সবকিছু , তার আপন গাও য়ে....
পাঠ পতিক্রিয়া -
সল্পদৈর্ঘ্যের উপন্যাসটি চমৎকার , অল্পকথায় রাজ্যের অভিজ্ঞতার সমাহার । একজন ভালো মানুষের জীবন শুনতেই আমরা অভ্যস্ত , সেই প্রেক্ষাপটে একজন কৃত্রিম মানুষের জীবন কেমন হয় তা খুব প্রাঞ্জল ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক, তবে ছফার লেখা বলে কথা, সবসময়ই মনে হয়েছে - ' কোথাও যেন কিছু নেই...আরো কিছু দরকার ছিলো... '
এ উপন্যাস শেখার ছিলো অনেক কিছু..
• সম্মান , প্রতিপত্তি চিরদিনের নয় , সম্পর্কই চিরস্থায়ী আশ্রয়
• পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান আছে, তাকে শুধু খুজে বের করতে হয়
• আপন মাটি, আপন ঘ্রাণ , আপান মানুষ চুরমার করতে পারে পৃথিবীর সবচাইতে বড় দু:খ।
বই - " একজন আলি কেনানের উত্থান পতন " লেখক- আহমদ ছফা প্রথম প্রকাশ -১৯৯৮
'আলোকিত মানুষেরা পাঠকের সাজে, পৃথিবী বাচুক বইয়ের ভাঁজে '
আহমেদ ছফা শুরু করেছিলেন একজন নাখাস্তা মানুষের স্বর্গ থেকে পাতালে পতনের গল্প দিয়ে।তার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে দে বাপেরে এক ট্যাহা আমাদের মনে করিয়ে দেয় পথিমাঝে দেখা পাওয়া ওইসব ভিখিরি দের যারা আমাদের কাছে হাত পাতে যেন তারা আমাদের মানিব্যাগের ওয়ারিশান। তারপর ছফা নাখাস্তা আলি কেনানের উন্থানের গল্প পাড়েন।আলি কেনানের শিষ্যদের মতো আমিও ছফার বর্ণনা মোহিত হয়ে শুনতে থাকি।
ছফা, আলি কেনানের উন্থান-পতনে আমাদের সালুকাপড়ে ঢাকা রহস্যময় মাজারের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন।মাজারের সাথে মূল ইসলামকে জুড়ে দিয়ে তিনি ব্যঙ্গ করেননি। আলি কেনানের গভর্নর হাউজের স্বর্গ থেকে পতনের পর তার ফুলতলী এলাকায় এক প্রাগৈতিহাসিক কবরকে বুল কলন্দর বাবার মাজার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়।ছফা বলেছেন পৃথুসব ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলেও মাজার ব্যবসা কখনোই বন্ধ হবে না কেননা মানুষ এখানে ভাগ্য ফেরাতে আসে। আলি কেনান শরীয়ত জানেন না।তাই মসজিদের ইমামের কাছ থেকে শরীয়ত জানার তার আকাঙ্ক্ষা আমরা দেখতে পাই।এর মানে এটা না যে আলি কেনান অনেক উচুমানের বুজুর্গ হয়ে গিয়েছিলেন পরে কিন্তু ছফা এই সূক্ষ্ম জায়গায় পাঠককে শরীয়ত-মারফতের পার্থক্য টা বুঝিয়ে দিয়েছেন।সচেতন পাঠক তা ধরতে পারার কথা। বৈরাগী হলেই নিজের কামনা থেকে মানুষের নিস্তার নেই।আলি কেনান সালু কাপড়ে ঢাকা মাজারে নিজেকে রহস্যাবৃত করলেও ছমিরনের সাথে তার নিশিযাপন সবার চক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়।তার সাথে মেয়ে মানুষ যে পাগলকেও আরো পাগল করে তোলে তার পরমান আলি কেনান স্বয়ং। উপন্যাসের শেষের দিকে যার বাস্তবতা ছফা অতি দরদের সাথে শাদা জমিনে লিখে গিয়েছেন।
লেখকরা সাধারণত এক উপন্যাসে একি ধারায় লিখতে থাকেন।যদি সমকালীন কোনো উপন্যাস হয় তাহলে সেটা সমকালীন হয়েই শেষ হয় আবার থ্রিলার হলে লেখক পরবর্তী পার্ট কোনো এক সময় আসবে বলে আমাদের জানান দিয়ে রাখেন।এটাও এক থ্রিলার, এক রহস্য। ছফার আলি কেনানের উন্থান-পতনে এই বিষয়টা লক্ষ্য করা যায় না।উপন্যসসের শুরুতে পাঠকের মনে হবে না ছফা তাকে ইতিহাসের কোন দিকটায় নিয়ে যাবে।উপন্যাসে ছফা ৬৯ এর আগে গল্পের কাহিনি বলা শুরু করলেও শেষ করেছে একদম ৭৫ এর ১৫ আগস্ট। যুদ্ধের পর আলি কেনান যেন একখন্ড বঙ্গবন্ধু নিমপারা এলাকায়। এখন যে বিষয়টা বলবো সেটা একান্তই আমার নিজস্ব ভাবনা।ছফা আলি কেনানের তখনকার কার্যকলাপকে ছায়া করে আমাদের যুদ্ধ পরবর্তী সময়কার বিভিন্ন বিষয় জানাতে চেয়েছেন।আলি কেনানের শিষ্যদের সাথে রক্ষীবাহিনি একটা আপেক্ষিক মিল দেখিয়েছেন,বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর কোনো হিতাকাঙ্ক্ষী যে আর বঙ্গবন্ধুর জন্য কোনো মায়া দেখাননি আলি কেনানের ওই একরাতের হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য তছনছের পর তার সাথে হওয়া আকস্মিক ঘটনার সাথে মিলে যায়। আলি কেনান আবারও সেই ভোলার মানুষটি হয়ে যেতে চান কিন্তু কেউ তার ডাকে সাড়া দেয় না!
একটা অতি নাখাস্তা মানুষের স্বর্গ-পতন থেকে পঁচাত্তরের পনের আগস্ট, এককথায় ছফা দূর্দান্ত🫰
শাহরিয়ার ফাহমিদ 9:19 AM
This entire review has been hidden because of spoilers.
উপন্যাসের প্লট একেবারেই ব্যতিক্রমী না হলেও মোটামুটি চিত্তাকর্ষক ছিলো। লালসালুর সাথে তুলনা না করলে বেশ সুখপাঠ্যই বলা যায়। তবে, আলী কেনানের সাথে বঙ্গবন্ধুর যোগসাজশের ব্যাপারটা একটু খাপছাড়া মনে হয়েছে। এ দুজনের মিলবন্ধনটা ছফা সাহেব গোটা উপন্যাসের কোথাও স্পষ্ট করেননি। আচ্ছা, এমনটা ভাবা তো অস্বাভাবিক নয় যে বিলাত ফেরত মহিলাটি আলী কেনানের কাছে যেমন লালসার সামগ্রীতে পরিণত হয়েছিলো ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর কাছে লিপ্সার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিলো বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের ক্ষমতা। আলী কেনান ওই মহিলাটির বিবাহের সংবাদ শুনে পাগলপ্রায় কিবা সংবিৎহারা হয়ে গিয়েছিলো। ফলস্রুতিতে এমন অনেক কিছু করেছিলো যা তার পীরসুলভ আচরণের সাথে একটুও সামঞ্জস্যপূর্ণ না। ঠিক এ কারণেই রাত শেষে সকালে ঘুম থেকে উঠে আলী কেনান দেখে যে তার শিষ্যের দল, মাথা গোঁজার আশ্রয় ও এতদিনের জমানো সহায়-সম্পত্তির কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এর কারণ হিসেবে দায়ি করা যায় আলী কেনানের ওই বিবেক-বুদ্ধিহীন কার্যকলাপকেই। পক্ষান্তরে, কালের পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর কাছে লালসার সামগ্রীতে পরিণত হয় বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের ক্ষমতা। এই ক্ষমতার চিরন্তন স্থায়িত্ব নির্ধারণ করতে গিয়ে তিনি এক পর্যায়ে বাকশালের সূচনা করেন। পরবর্তীতে বাকশাল কেন্দ্রিক তার এই অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণেই তাকে জীবন খোয়াতে হয়। বলাই বাহুল্য যে এছাড়াও বঙ্গবন্ধু হত্যার আরো অনেক কারণই বিদ্যমান।
আমার মনে হচ্ছে যে ছফা সাহেব আলী কেনান ও বঙ্গবন্ধুকে তীব্র লোভ-লালসার দিক থেকে একীভূত করার চেষ্টা করেছেন। আর এই চরম লালসাই দুজনের জীবনেরই অন্তিম বিপর্যয় ডেকে আনে; এ ব্যাপারটা তিনি ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় প্রকাশ করেছেন। যাক্, যা লিখেছি তা পুরোটাই আমার ব্যক্তিগত অভিমত। এই উপন্যাসের প্রেক্ষিতে ছফা সাহেবের প্রকৃত চিন্তা-ভাবনার সাথে তা না-ও মিলতে পারে।
আহমদ ছফার শক্তিশালী উপন্যাস। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এক শ্রেণির মানুষ মাজারকে কেন্দ্র করে যে জমজমাট ব্যবসা করেছে তা নিয়ে লেখা। এতটুকু পড়লে মনে হবে নেতিবাচক কিছু, আদতে এই গল্পে আলি কেনান কে যেন নায়কের ভূমিকায় আনা হয়েছে। চরিত্রায়ণ আর কাহিনি বিস্তৃতিতে এমন মুন্সিয়ানা সচরাচর চোখে পড়ে না। তামাপুকুর গ্রাম থেকে কীভাবে আলি কেনান গভর্নরের সুদৃষ্টিতে এলো, তারপর সব ভেঙ্গে পরার পর জীবনের বাস্তবতায় একটি নতুন পরিচয় সৃষ্টি করল ভাবলে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। যারা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ পড়েছেন তারা খুবই রিলেট করতে পারবেন। ব্যক্তিগতভাবে চরিত্রায়নের ও বাস্তবতার নিরিখে দেখলে লালসালুর মজিদকেও হারিয়ে দেবে আলি কেনানের কর্মকৌশল। তবে উপন্যাসের শেষ অংশে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেললাম। আলি কেনান কেন হঠাৎ করে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল বায়ুতে পাগল হয়ে গেল, তার এত সাধনার চরিত্রকে মাটিচাপা দিল সেটা যুক্তিতে কুলিয়ে ওঠতে পারলাম না। আমার অনুমান হচ্ছে, ছফা তার রচনার আরো শক্তিশালী করার জন্যই আলি কেনানকে এ��� সংগ্রামে আনলেন, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এত বড় মাপের যুদ্ধে আলি কেনানের সেই মাজারের শক্তি বিশ্বাসযোগ্যতা পায় না। আর এত দ্রুত কলেবরে তা করা হয়েছে, মনে হয়েছে ছফা সাহেব বই প্রকাশ করতে তাড়ায় ছিলেন। এটা ছাড়াই উপন্যাসটাকে বেশী ভালো লাগত হয়তো বা।