যে জাতি উন্নত বিজ্ঞান, দর্শন এবং সংস্কৃতির স্রষ্টা হতে পারে না, অথবা সেগুলোকে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না, তাকে দিয়ে উন্নত রাষ্ট্র সৃষ্টিও সম্ভব নয়। যে নিজের বিষয় নিজে চিন্তা করতে জানে না, নিজের ভাল-মন্দ নিরুপণ করতে অক্ষম, অপরের পরামর্শ এবং শোনা কথায় যার সমস্ত কাজ-কারবার চলে, তাকে খোলা থেকে আগুনে, কিংবা আগুন থেকে খোলায়, এইভাবে পর্যায়ক্রমে লাফ দিতেই হয়। সুবিধার কথা হল নিজের পঙ্গুত্বের জন্য সব সময়েই দায়অ করবার মতো কাউকে না কাউকে পেয়ে যায়। কিন্তু নিজের আসল দুর্বলতার উৎসটির দিকে একবারও দৃষ্টিপাত করে না। বাঙালি মুসলমানদের মন যে এখনও আদিম অবস্থায়, তা বাঙালি হওয়ার জন্যও নয় এবং মুসলমান হওয়ার জন্যও নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুন তার মনের ওপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত হয়ে রয়েছে, সজ্ঞানে তার বাইরে সে আসতে পারে না, তাই এক পা যদি এগিয়ে আসে, তিন পা পিছিয়ে যেতে হয়। মানসিক ভীতিই এই সমাজকে চালিয়ে থাকে। দু’বছরে কিংবা চার বছরে হয়ত এ অবস্থার অবসান ঘটানো যাবে না, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের মনের ধরণ-ধারণ এবং প্রবণতাগুলো নির্মোহভাবে জানার চেষ্টা করলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ হয়ত পাওয়া যেতে পারে। সূচিপত্র: উত্তর ভূমিকা-১১ বাঙালি মুসলমানের মন-১৯ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়েল একটি চরিত্র-৩৯ শিক্ষার দর্শণ-৪৫ রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা-৫০ বার্ট্রান্ড রাসেল-৫৬ ভবিষ্যতের ভাবনা-৬৩ বাংলার ইতিহাস প্রসঙ্গে-৬৯ একুশে ফেব্রুয়ারি উনিশ শ’ বাহাত্তর-৭৩ বাংলার চিত্র-ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা-৮০ দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক-১০৫ দস্তয়েভস্কি-১১৫ একটি প্রাতিস্বিক গ্রন্থ-১১৭
Ahmed Sofa (Bangla: আহমদ ছফা) was a well-known Bangladeshi philosopher, poet, novelist, writer, critic, translator. Sofa was renowned for his intellectual righteousness as well as his holistic approach to the understanding of social dynamics and international politics. His career as a writer began in the 1960s. He never married. On 28 July 2001, Ahmed Sofa died in a hospital in Dhaka. He was buried in Martyred Intellectuals' Graveyard.
Sofa helped establishing Bangladesh Lekhak Shibir (Bangladesh Writers' Camp) in 1970 to organize liberal writers in order to further the cause of the progressive movement.
Ahmed Sofa's outspoken personality and bold self-expression brought him into the limelight. He was never seen hankering after fame in a trivial sense. His fictions were often based on his personal experience. He protested social injustice and tried to portray the hopes and dreams of common people through his writing. Sofa always handled his novels with meticulous thought and planning. The trend of telling mere stories in novels never attracted him; he was innovative in both form and content.
বইয়ের নামটা পড়লেই একটা বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়ে যায় পড়ার জন্য। আমারও হয়েছিল। রীতিমত উন্মুখ হয়েছিলাম আহমদ ছফার বইটি পড়ার জন্য। লেখক আমাকে হতাশ করেন নি।
যুক্তি আর দর্শনের মিশেলে লেখা প্রবন্ধটি বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের সম্পদ। বইটির নাম "বাঙালি মুসলমানের মন" হলেও বইটিতে ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে মোট ১২ টি প্রবন্ধ রয়েছে। আর বইটির ভূমিকাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে পৃথক একটি প্রবন্ধের মর্যাদা দিতে চাইবো।
প্রতিটি প্রবন্ধ কমবেশি আমাদের চিন্তার খোরাক যোগাবার ক্ষমতা রাখে। তবে চারটি প্রবন্ধ আমার বিশেষভাবে ভাল লেগেছে। সেগুলো হলোঃ
বাঙালি মুসলমানের মন শিক্ষার দর্শন সুলতানের সাধনা এবং দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক
♣ বৌদ্ধধর্ম যুগের রাজত্ব অবসানের পরে মুসলিম বিজয়ের সময়ে এদেশের বড় সংখ্যার একটি বৌদ্ধ এবং হিন্দুদের অন্ত্যজ (ডোম, হড্ডি, হরিজন ইত্যাদি) জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। শত বছরের ইতিহাসে রক্তে এসেছে স্রোত। এক রক্ত আরেক রক্তের সাথে মিশে সৃষ্টি করেছে নতুন জনগোষ্ঠী। কিন্তু সেই সুপ্রাচীন সময় থেকে আজ অবধি বাঙলী মুসলমানের চিন্তাধারার মূল কাঠামোটি রয়ে গেছে অপরিবর্তিত। যা বাঙালি মুসলমানদের আধুনিক সময়ে অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়গুলির একটি। ধর্মের প্রতি প্রবাহমান এবং পুঞ্জিভূত আবেগ এখানে অনেকক্ষেত্রে তথ্যের বিকৃতির বিরুদ্ধে আঙুল তুলতে বাঁধা দেয়। আর সেই কথাই লেখক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন নিজস্ব যুক্তি, বিশ্লেষণ আর দর্শনের মধ্য দিয়ে।
♣ শিক্ষার দর্শন প্রবন্ধে একটি নগ্ন সত্য লেখকের লেখায় প্রকটিত হয়েছে। রাষ্ট যন্ত্র প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে কখনোই নিখাদ বলা যায় না। রাষ্ট নিজস্ব প্রয়োজনে শিক্ষার বিষয়বস্তুতে হস্তক্ষেপ করে এমন কি পুরোপুরি সত্য নয় এমন ইতিহাসের আশ্রয় নেয়। যেমন পাকিস্তান তার শিক্ষার ব্যবস্থায় এমন তথ্যকে (সে তথ্য যতই ভ্রান্ত হোক না কেন) পৃষ্ঠপোষকতা করবে যেখানে তাদের পরাজয় হবে গৌরবান্বিত আর বাঙালীর বিজয় হবে তুচ্ছ (লেখক এখানে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের উদাহরণ ব্যবহার করেছিলেন) এমন কাজ শুধু পাকিস্তান নয়, প্রতিটি রাষ্টযন্ত্র কম বেশি করে থাকে
♣ সুলতানের সাধনা, মাত্র ২৫ পৃষ্ঠায় লেখক ভারতবর্ষের চিত্রকলার উত্থান, ইতিহাস, ক্রম বিবর্তন সবকিছু বন্দী করেছেন। কে নেই এখানে? ভারতবর্ষের প্রথম ইউরোপীয় রেনেসাঁর বাইরে নিজস্ব ধারার চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা, তার যোগ্য উত্তর পুরুষ নন্দলাল বসু এবং যামিনী রায়ের কথা। আছে আমাকে চিত্রশিল্প জগতের প্রবাদ পুরুষ জয়নাল আবেদীনের সংগ্রামের স্বীকারোক্তি। আর তারপর শেখ মুহম্মদ সুলতানের কথা। যিনি শুধু তুলি আর ক্যানভাসের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। ইতিহাসের কাছে নিজেকে অমর করে রাখার বন্দনা করেননি, জীবনের কাছে প্রাপ্তির প্রত্যাশা করেন নি। শুধু চেয়েছিলেন ছবি আঁকতে।
আমার কাছে এই প্রবন্ধটিকে সবথেকে বেশি সমৃদ্ধ মনে হয়েছে। এই প্রবন্ধটি পাঠককে চিত্রকলা বুঝতেও হাতেখড়ি দিতে পারে। তবে পাঠকদের উদ্দেশ্য আমার একটা পরামর্শ থাকবে। এই প্রবন্ধটি পড়ার পূর্বে অবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, জয়নুল আবেদীন এবং এস এম সুলতানের আঁকা কিছু ছবি ইন্টারনেটে দেখে নেবার।
♣ দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক প্রবন্ধে লেখক বলেছেন, সমগ্র ভারতের সমগ্র জাতিগুলোর মাঝে বাঙালী সবথেকে বেশি প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক। শুনে তাচ্ছিল্য করার কোন কারণ নেই। এর পিছনে লেখক খুব ভাল একটি যুক্তি দিয়েছেন। একমাত্র বাংলা বাদে হিন্দু মুসলমানের অনেকটা সময় ধরে পাশাপাশি অবস্থানের গৌরব আর কোন জাতির মাঝে ততটা দেখা যায় না।
উদাহরণ স্বরূপ আমরা আজ পাকিস্তানের পাঞ্জাবিদের কথা বলতে পারি যেখানে হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় শূণ্যের কোঠায় আর গুজরাটের কথা বলতে পারি যেখানে ২০০২ সালে মুসলিমের সংখ্যা ৩% এ নেমে এসেছিল। ১৯৪৬ সালের মত দাঙ্গার হবার পরেও এই বাংলার হিন্দু মুসলিম আবার একে অপরের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক নিয়ে বাস করতে পেরেছিলো সেটা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে যেকোন জাতিদের কাছে দৃষ্টান্ত।
তবে এই প্রবন্ধ লেখক বাংলাদেশীদের পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের অন্ধ অনুসরণ আর অনুকরণে ব্যাপারে সর্তক করে দিয়ছেন। তিনি খুব স্পষ্ট করে বলেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব সাহিত্যধারাকে উত্থানপর্বে পৌছে দিতে যে সাহায্যের প্রয়োজন, সেই সাহায্য দেবার ক্ষমতা অন্তত সেই সময় পশ্চিমবাংলার ছিল না।
পরিশেষে আমি বলব, গল্প উপন্যাস আমাদের তৃপ্ত করে, আমাদের অনুভূতিকে সতেজ এবং তীক্ষ্ম করে তুলতে পারে কিন্তু প্রবন্ধ আমাদের যোগায় চিন্তার রসদ। যা আমাকে জ্ঞানকে বিকাশের পথে নিয়ে যায়। প্রগতিশীল চিন্তা অনুশীলনের প্রধান উপাদান হলো প্রবন্ধ এবং আহমদ ছফার প্রবন্ধগুলি চিন্তার অঞ্চলগুলো আলোড়িত করতে, চঞ্চল করে তুলতে প্রচণ্ডভাবে সক্ষম।
এই বইয়ের প্রবন্ধগুলো মোটামুটি ১৯৬৭ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে লেখা। ‘মোটামুটি’ বলছি—কেননা সবকটা প্রবন্ধের তারিখ দেয়া নেই।
অবশ্য এই বইটা লোকের মুখে মুখে ফেরে একটা প্রবন্ধের জন্যই—বাঙালি মুসলমানের মন। এই প্রবন্ধ নিয়ে অতীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, ভবিষ্যতেও না হওয়ার কারণ দেখছি না। যারা আলোচনা করে—তাদের একটা বড় অংশ আমার মত অর্ধশিক্ষিত—কোনোমতে নিজের নামটা সই করতে পারে আরকি। কাজেই ঐ প্রবন্ধ-বিষয়ক আলোচনা করে অর্ধশিক্ষিতদের আলোচনার পাল্লাটা আর ভারী না করি! যদিও এটুকু অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, বাঙালি মুসলমানদের বিকাশের প্রেক্ষাপটটাকে লেখক যেভাবে দেখেছেন সেটা চিন্ত্য ও কৌতূহলোদ্দীপক, এবং প্রকাশকালের কারণে লেখাটা সাহসী।
যাকগেল বইতে প্রায় সবকটা প্রবন্ধের তারিখ দেয়া থাকায় বড় সুবিধা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব ও পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষাপটে আহমদ ছফার বিকাশের ধারাটা বোঝা গেছে। দু-এক ক্ষেত্রে চরম না হলেও, বেশ গরম জাতীয়তাবাদী লেখাও লিখেছেন বটে! একাত্তর বা তার আগের লেখায় ছফা এত বেশি কঠিন শব্দ ব্যবহার করতেন—রীতিমত ক্লান্ত লাগে পড়তে। আমরা স্কুলে থাকতে ভাবসম্প্রসারণ এভাবে লেখার চেষ্টা করতাম। প্রচুর কঠিন শব্দ থাকবে, কিন্তু মূল বক্তব্যটা আসলে খুবই সামান্য। এরও অনেক অনেক আগে মুজতবা আলী ঝরঝরে-চকচকে ভাষায় প্রবন্ধ লিখে গেছেন, কাজেই আহমদ ছফার স্কুল-ভাবসম্প্রসারণ লেখার দায়কে কেবল ‘সিক্সটিজ তো,’ বলে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
সে না যাক। লেখকের ক্ষেত্রে বিকাশটা গুরুত্বপূর্ণ (আসলে সব মানুষের জন্যই সেটা ইম্পর্টেন্ট), এবং আহমদ ছফার পরেরদিকের প্রবন্ধগুলোতে সেটা দেখা গেছে। মেদের পরিমাণ কমতে শুরু করেছে, বক্তব্যও বেড়েছে।
আহমদ ছফা দাবি করেন, আবুল ফজলের মত ঘোর নাস্তিক মানুষকে জিয়া সরকারের আমলে দুম করে আস্তিক হয়ে যেতে দেখে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। এক সকালে নাকি সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের ভেতর আবুল ফজল সাহেব টুপি মাথায় দিয়ে যাচ্ছিলেন। আহমদ ছফার সাথে দেখা হলে বলেন, তিনি সিরাত মাহফিলে যাচ্ছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় আহমদ ছফা অস্থির হয়ে পড়েন, এবং সেই রাতেই বাঙালি মুসলমানের মন নামের প্রবন্ধটা লিখে ফেলেন।
এরপর তার মনে এই নিয়ে অপরাধবোধ জন্ম নেয় যে, তিনি নিজেই বাঙালি মুসলমান, এবং বাঙালি মুসলমানকে স্রেফ বকুনি দিয়ে ছেড়ে দেয়াটা কাজের কথা না। ফলে ১৯৮০ সালে তিনি এস এম সুলতানকে নিয়ে দীর্ঘ একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।
সেই প্রবন্ধও এই বইতে আছে, এবং আমার মতে সেটা এই বইয়ের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ। জানি না এই নিয়ে কেন বেশি আলোচনা হয় না। সম্ভবত নিজেদের গালি দিতে আমরা যতটা ভালোবাসি—ডট কানেক্ট করতে অতখানি না।
এস এম সুলতানকে নিয়ে প্রবন্ধটা প্রায় ৩৫ পৃষ্ঠার—এর মধ্যে প্রথম ২৫ পৃষ্ঠাতেই বাংলার চিত্রকলার ক্রমবিকাশ নিয়ে একটা পর্যালোচনা করা হয়েছে—প্রধানত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকে শুরু করে। ফলে শেষমেষ যে লেখাটা দাঁড়িয়েছে—সেটা আসলে বাংলার চিত্রকলার একশো বছরের একটা ছোট্ট-সংক্ষিপ্ত ইতিহাসই হয়ে গেছে। একেবারে অ-আ-ক-খ জানতে চাইলে কেউ সানন্দে লেখাটা পড়ে ফেলতে পারে।
এই লেখায় শিল্পী এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিসে ভোগা নিয়ে একটা সুন্দর তত্ত্ব আছে আহমদ ছফার। তাঁর মত হল এই যে, শিল্পীর চিন্তাভাবনা সমাজের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকে। যদি সমাজ দ্রুত এগিয়ে তাঁকে ধরতে পারে—তো ভালো। আর যদি না পারে—তখন শিল্পী নিজেকে সমাজ থেকে অনেক বিচ্ছিন্ন অনুভব করতে শুরু করেন। তখনই শুরু হয় তার এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিসে ভোগা।
অবশ্য আহমদ ছফা এটার একটা সুন্দর বাংলা করেছেন। আমরা তো বলি অস্তিত্বের সংকট। উনি বলছেন মানস-সংকট।
সমাজ যখন শিল্পীর পর্যায়ে উঠতে পারে—তদ্দিনে প্রায়ই দেখা যায় শিল্পী আর নাই! আহমদ ছফা রেফারেন্স দিয়েছেন শার্ল বোদলেয়ারের, জীবনানন্দের। আমার কেবল শহীদুল জহিরের কথা মনে পড়ছে। আর পড়ছে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের কথা।
জীবিত একজনের কথাও কেন যেন বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। সৈয়দ জামিল আহমেদ। বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম—একটা সময়ে বুঝি মানুষ এই সৈয়দ জামিল আহমেদের লেভেলটা বুঝবে, আর আমাদের তখন বলতে হবে, জামিল আহমেদ ভদ্রলোককে আমরা জ্যান্ত হেঁটেচলে বেড়াতে, নাটক করতে দেখেছি।
প্রশাখা থেকে সোজা মূল কাণ্ডে চলে আসি। আহমদ ছফা। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক একবার এমন একটা কথা বলেছিলেন, আনিস ছেলেটা (আনিসুজ্জামান স্যার) বেশ ভালো গবেষণা করছে, কিন্তু ছফা করলো না। কথাটার মর্ম বোঝা যায় এই দু ব্যক্তির লেখা পড়লে। আনিসুজ্জামান স্যারের লেখা হয় খুবই নিখুঁত, অসাধারণ, এবং তথ্যসমৃদ্ধ, কিন্তু কী যেন একটা বাকি থেকে যায়। আর আহমদ ছফা হয়তো নিখুঁত লেখেন না, অপূর্ণ যুক্তিও দেন ক্ষেত্রবিশেষে, কিন্তু যা লেখেন সেটা প্রায়ই হৃদয়ের গভীরে পৌঁছাতে পারে।
বইয়ের নাম “বাঙালি মুসলমানের মন”। যেকোনো জ্ঞান পিপাসু পাঠকের জন্য এই নামটিই যথেষ্ট বইটি পড়ার জন্য। আমার শুরু করতে একটু দেরি হয়েছে। শ্রদ্ধেয় বড়ভাইয়ের গিফট না পেলে হয়ত আরো দেরি হত। তখন কি আর বুঝেছি যে কি ফেলে রেখেছি? যাহোক, এটা একটা প্রবন্ধের বই। মূল প্রবন্ধ “বাঙালি মুসলমানের মন” সহ মোট বারোটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে বইটিতে। প্রতিটা প্রবন্ধ পাঠককে গভিরভাবে ভাবতে বাধ্য করবে। কয়েকটি প্রবন্ধ সম্পর্কে না বললেই নয়।
বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধে লেখক দেখিয়েছেন এদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিন্মবর্নের হিন্দু এবং বৌদ্ধদের একটি বিরাট অংশ ইসলাম গ্রহন করে। ধর্মের পরিবর্তন ঘটেছে। সময় গত হয়েছে। সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সেই চিন্তাধারার কাঠামোটি রয়ে গেছে অপরিবর্তনীয়। এই অনাগ্রসারতার কারন ব্যাখ্যা করেছেন লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। সেই সাথে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক অবস্থাও তুলে ধরেছেন দক্ষ হাতে।
এছাড়া আরো উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলো হলো- শিক্ষার দর্শন ভবিষ্যতের ভাবনা বাংলার ইতিহাস প্রসঙ্গে বাংলার চিত্র-ঐতিয্যঃ সুলতানের সাধনা দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক
শিক্ষার দর্শন প্রবন্ধে চমৎকারভাবে বাস্তবকে তুলে ধরেছেন। আমরা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে কখনো সঠিক ইতিহাস জানতে পারবো না। কারন সব জাতি এবং রাষ্ট্র নিজ প্রয়োজনে ইতিহাসকে নিজেদের মত লেখে।
ভবিষ্যতের ভাবনা প্রবন্ধে তিনি এই পৃথিবীর ভবিষ্যত নিতে চিন্তিত। এইযে সভ্যতার চরম উৎকর্ষতা, এর পরিনাম কী? নিজেরই উদ্ভাবনী শক্তির তাপে জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে মানুষ। লেখকের একটি প্রশ্ন সম্ভবত প্রশ্ন হয়েই থেকে যাবে- “সমগ্র জাতির জনসাধারনের কল্পনাকে খাট করে বা জাতিকে উপোস রেখে, হিংসা-প্রতিহিংসার ওমে তা দেয়া যে বোমাগুলো কোটি কোটি মুদ্রা ব্যয় করে তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলোর কি ব্যবহার হবে না? যদি না হয়, অপর্যাপ্ত অর্থ এবং মানুষের এযাবতকালের বস্তুবীক্ষণের সবচাইতে সূক্ষ্ম সিদ্ধী যাতে মিশেছে সে মহামূল্য পারমানবিক বোমা ইত্যাদি দিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রনায়কেরা কি ব্রেকফাস্ট করবেন?” কে দিবে উত্তর!
সুলতানের সাধনা প্রবন্ধে লেখক বাজিমাত করেছেন। পুরো ভারতবর্ষের ইতিহাসকে ছোট্ট একটি প্রবন্ধে বন্দি করেছেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে নন্দলাল বসু হয়ে যামিনী রায়। সেখান থেকে জয়নুল আবেদিন। তারপরে বলেছেন শেখ সুলতানের কথা। যে মানুষটার কোনো খ্যাতি ছিলো না। কোনো লোভ ছিলো না। শুধু তুলি আর ক্যানভাসের কাছেই নিজেকে সমর্পন করেছেন। এই প্রবন্ধ পড়ার পরে স্বাভাবিক ভাবেই চিত্রকলা সম্পর্কে পাঠকের মনে আগ্রহ জাগবে।
প্রতিটা প্রবন্ধ সম্পর্কে ভালোভাবে লিখতে হলে হয়ত আরেকটা বই লেখা সম্ভব। কারন এই বইটা আপনি শুধু পড়বেন আর রেখে দিবেন এমনটা নয়। প্রতিটা প্রবন্ধ আপনাকে ভাবতে সাহায্য করবে। এখানেই প্রবন্ধের আনন্দ। লেখকের লেখা যেখানে শেষ, আপনার ভাবনা সেখান থেকে শুরু। ভাবনার প্রয়োজনেই একটা প্রবন্ধ একাধিকবার পড়তে হয়েছে। প্রতিবার পড়ার পরে লেখকের বক্তব্য আরো ভালোভাবে বোঝা যায়। প্রবন্ধ পড়ে এই যে ভাবনা, এখানেই সাধারন গল্প-উপন্যাসে সাথে এর পার্থক্য। সেখানে বই শেষ হলে কল্পনাও শেষ আর এখানে বই শেষ হওয়ার পরেই কল্পনার শুরু।
While some of the Bangla went right over my head, the book's message is quite clear. Islam in Bengal has always been a sensitive, controversial topic to discuss, and I'm surprised that Sofa did it so daringly so many years back.
Sofa discusses the status of Bengali Muslims, illuminating their need to create "heroes" for their mythology. He points out that the "heroes" may have been Arab characters, but that they were really Bengali inventions in the sense that they were inspired by Hindu gods and goddesses and their actions and motivations were based on Bengali identity rather than their own Arab ones.
Sofa also writes about the sociopolitical nature of Bengali Muslims. It's a known fact that most Bengali Muslims were low-caste Hindu converts. He talks about the ideologies and the cultural baggage they carried over from their previous religion(s) and how it impacted the minds of eventual Bengali Muslims. Another major point of discussion was the whole Bengali tendency towards Iranian and Farsi Islam rather than Arab Islam. This chapter intrigued me as those issues still affect Bangladeshi Muslims quite a lot.
As it stands, it was a highly engaging read. It contains things many "Bengali Muslims" will find offensive since it doesn't necessarily show them in a positive light. But there are a lot of things to learn from here, which makes it one of the must-read books for every Bangladeshi, regardless of their religion.
আহমদ ছফার সঙ্গে হুমাযুন আজাদের বৈসাদৃশ্য হল: দ্বিতীয়জন মৌলবাদী নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষী; অস্বীকার করতে চেয়েছেন অগ্রজ-গোষ্ঠীর ইসলামি পরম্পরা। অথচ সংস্কৃৃতিতে কোনো একক কৌমের অবদান থাকে না। ছফা নাস্তিক কিন্তু, ইসলামি ঐতিহ্য-সংস্কৃতির আবহ বিশ্লেষণ থেকে বিরত থাকেন নি, যে সংস্কৃতি অনিবার্যভাবে আমাদের গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট হোসেন মিয়া চরিত্রের বিশ্লেষণটাও অভিনব; স্বপ্নের ডাক দেয়। ছফার বিশ্লেষণের একটা নিজস্ব ভঙ্গিমা ছিল, যেটা মোহাম্মদ আজম বর্তমানে অনুসরণ করেন বলে আমার ধারণা। এমনভাবে তিনি প্রগতির কথা বলেছেন, যেটা মালুম হতে কষ্ট হয় না একেবারেই।
তবে ছফা তথ্যসূত্র ব্যবহার করেন নি, যেটা চিন্ময় (ননফিকশন) রচনায় অচিন্ত্য।
"বাঙালি মুসলমানের মন" আহমদ ছফার অত্যন্ত বিখ্যাত একটি প্রবন্ধ। ওনার আরেক রচনা "যদ্যপি আমার গুরু" পড়ার পর এটা পড়ার প্রবল আগ্রহ জন্মেছিল।
বইটিতে অনেকগুলো প্রবন্ধ সংকলিত আছে। "বাঙালি মুসলমানের মন" নামপ্রবন্ধটি বইয়ের মূখ্য প্রবন্ধ। সারাটা জীবন নাস্তিকতা প্রচার করে আসা আবুল ফজল যখন ক্ষমতার স্বাদ পেতে না পেতেই মুসলিম পরিচয়ে নিজেকে চিহ্নিত করতে আরম্ভ করলেন, তা আহমদ ছফাকে ভাবিয়ে তুললো। মনের এক উত্তেজিত অবস্থায় একরাতে একটুও না থেমে বাঙালি মুসলমানের মন রচনাটি উনি লিখে শেষ করেন।
প্রবন্ধটিতে উনি 'শহীদে কারবালা'র মতো বিভিন্ন পুঁথি সাহিত্যের বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমান সমাজের মনস্তত্ত্ব ও সামাজিক অবস্থার কিছু বাস্তবতা ও ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। সাহিত্য অবশ্যই একটি সমাজের মনোজগতের প্রতিফলন। বাঙালি মুসলমানের পুঁথিসাহিত্য বিশ্লেষণ করে আহমদ ছফা দেখালেন বাঙালি মুসলমানের আত্মায় জমে থাকা এক প্রাচীন ক্ষোভ। নবদীক্ষিত মুসলমানের বেশিরভাগই ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু ─ তাই প্রকৃত সনাতনী স্পর্শ তারা যেমন পায়নি কোনোদিন, তেমনি ইসলামের অন্তর্নিহিত মহত্ত্বও স্বাতন্ত্র্যের সাথে উপলব্ধি করতে পারেনি কোনোদিন।
আহমদ ছফার বক্তব্য অনুযায়ী, নবাবী আমলে মুসলমান শাসকশ্রেণীর সাথে সাধারণ খেটে খাওয়া মুসলমানের ব্যাবধান রয়ে গিয়েছিল ব্যাপক। ইংরেজ শাসনামলেও মুসলমানেরা নিজেদের মর্যাদা খুঁজে পায়নি সুবিধাভোগী ব্রাহ্মসমাজের সামনে দাঁড়িয়ে। বাঙলার আদিম কৃষিভিত্তিক কৌমসমাজের লোক হিসেবে বাঙালি মুসলমানের মানসিকতায় আদিম সমাজের চিন্তন পদ্ধতির লক্ষণ সুপ্রকট। বাঙালি মুসলিম সমাজের বোধ-বুদ্ধিহীনতা এবং জাতিগত নাবালকত্বের কারণ হিসেবে তিনি 'বাঙালি' হওয়া বা 'মুসলিম' হওয়া কোনোটিকেই দায়ী করছেন না, বরং বলছেন বাঙালি মুসলিম সমাজ সুদীর্ঘকালব্যাপী কিছু ঐতিহাসিক বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করেছে। এখন সময় সেসব ভুলে নিজেকে গুছিয়ে নেবার।
প্রবন্ধটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষণীয়, সেটি হচ্ছে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতার জনক হিসেবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে দেখছেন না, তিনি মনে মনে করেন হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথাই এ উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার আদিমতম উৎস। সমগ্র প্রবন্ধজুড়ে এই অবস্থানটি তাঁর শক্তিশালী।
প্রবন্ধগ্ৰন্থটি প্রকাশ পায় ১৯৮১ সালে। চল্লিশ বছর পেরিয়ে আজ বাঙালি মুসলিম সমাজের চিত্র পাল্টেছে। এখন বাঙালি মুসলমান আর সেই 'অনার্য কৃষাণ' হয়ে মাটি আঁকড়ে পড়ে নেই। বাঙালি মুসলমান আজ দেশের মালিক, মন্ত্রী, আমলা, শিল্পপতি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ফ্রিল্যান্সার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, টিকটকার ─ সবকিছু, সমাজের সকল পর্যায়ে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের অদূরদর্শিতার চিত্র পাল্টেছে কি?
স্বাধীনতা পাওয়ার এতো বছর পর বাংলাদেশের আদিম গ্ৰামীণ সমাজের চিত্রটিকে আর চিরায়ত মনে হয় না। গ্ৰামীণ সমাজের মৌলিক ভিত্তি একান্নবর্তী পরিবারগুলো নতুন স্বাবলম্বী শ্রেণীর উত্থানে ভেঙে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবারের রূপ নিয়েছে। পিতৃপুরুষের পরিচয়ে আর কেউ নিজের identity গড়ে না। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবার পরেও কিছু একটা আজও বাঙালি মুসলিম সমাজের পা বেঁধে রেখেছে। যেকারণে পরিবারগুলো আকারে ক্ষুদ্র হয়ে এলেও অভ্যন্তরীণ সংস্কার থেকে মধ্যযুগীয় সামাজিক প্রথা গুলো হারিয়ে যাচ্ছে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে যদি তাকাই (সৌভাগ্যবশত যেদিকে তাকানোর দূর্ভাগ্য আহমদ ছফার হয়নি) তো দেখতে পাবো 'প্রগতি' আর 'ব্যাক্তিস্বাধীনতা'র মতো শব্দগুলিকে বাঙালি মুসলিম সমাজ কি ভীষণ ঘেন্নার চোখে দেখে। এই প্রতিক্রিয়াশীলতা প্রবন্ধে বর্ণিত ঐতিহাসিক লাঞ্ছনার ফলাফল কতটুকু?
বাস্তবতা হলো বর্তমানের বাঙালি মুসলিম সমাজ ভয় পায় বাইরের পৃথিবীকে। পাশ্চাত্যের যে কোনো ধ্যান ধারণাই এখানে আতঙ্কের নাম। পাশ্চাত্য সভ্যতা চিরকালের দুশমন, বাঙালি মুসলমানের মানসপটে পাশ্চাত্য ঘিরে কেবল ষড়যন্ত্র আর কূটকৌশলের ছায়া। অন্যদিকে প্রাচ্যকেও সে ভালো চোখে দেখতে শেখেনি কোনোদিন। প্রাচ্যে যা ছিল তা বাঙালি মুসলমানের চোখে বর্বর ও পৌত্তলিক নির্বুদ্ধিতা। বাঙালি মুসলমান সবকিছুর মাঝে তাই মোটামুটি একা।
একারণে দ্রুত বদলাতে থাকা পৃথিবীতে বাঙালি মুসলিম সমাজ প্রতিক্রিয়াশীলতায় নিজের identity খুঁজে পায়। মধ্যযুগীয় সামাজিক প্রথা তাকে দেয় মানসিক স্বস্তি, কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতার lifestyle এবং প্রযুক্তি তাকে দিচ্ছে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা। বাঙালি মুসলমান তাই অবচেতনে নিজেকে বানায় আল্লাহ্'র দুনিয়ার নায়ক, আর প্রগতিশীল দুনিয়া তার শত্রু। স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েও ইহজগতে মানবের স্বার্বভৌমত্বের ধারণাটা বাঙালি মুসলিম সমাজে এখনো প্রচলিত হতে পারেনি।
যাক সে কথা। বইয়ে আরো কিছু প্রবন্ধ আছে। "মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র" প্রবন্ধে তিনি হোসেন মিঞার চরিত্রটি সুন্দর করে বিশ্লেষণ করেছেন। লাল-দাড়ি সাদা-টুপি এই চরিত্রটির মধ্যে যে ষোড়শ শতাব্দীর এনলাইটেনমেন্ট মতাদর্শ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে তা পদ্মা নদীর মাঝি পড়বার সময় ভূলেও খেয়াল হয়নি, দূরদূরান্ত অবধি না। প্রবন্ধটা অসাধারণ। মানিকবাবুর উপন্যাস আবার পড়তে হচ্ছে।
এছাড়াও ভালো কিছু প্রবন্ধ : "শিক্ষার দর্শন", বার্ট্রান্ড রাসেল", "বাংলার ইতিহাস প্রসঙ্গে", "দস্তয়েভ্স্কি" ইত্যাদি পড়লে জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃতির পাশাপাশি আহমদ ছফার চিন্তা চেতনার ছোঁয়া পাওয়া যাবে।
তবে প্রত্যেকটা প্রবন্ধ যে খাসা হয়েছে তা-ও বলা যাচ্ছে না। "ভবিষ্যতের ভাবনা", "রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা", "একুশে ফেব্রুয়ারি উনিশশো বাহাত্তর" রচনাগুলো ব্যাতিক্রম। ষাটের-সত্তোরের দশকে প্রবন্ধগুলি কতোটা প্রাসঙ্গিক ছিলো আমি জানি না, কিন্তু আমর মনে হয়েছে উনি সহজ সরল কিছু বিষয়কে কাঠিন্যের রঙ মাখিয়ে জটিল করে উপস্থাপন করছেন। কঠিন কঠিন শব্দ আর প্রগাঢ় purple prose সাঁতরে পেরিয়ে যে সারকথা তুলে আনতে হয় তা আমার কাছে বিশেষ কিছু মনে হয়নি ─ নিতান্ত সাদাসিধে কিছু কথা। রবিঠাকুরের বিশ্বাত্মাবোধ, সভ্যতার ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা, প্রযুক্তির কুপ্রভাবে মানবজীবনে যান্ত্রিকতা ─ এসব জানাশোনা কথা পাঠকমনে তেমন কোনো যুগান্তকারী চিন্তার বা ভাবাবেগের উদ্রেক করবে না।
বইয়ের ��বচেয়ে চমৎকার প্রবন্ধগুলির একটি নিঃসন্দেহে "বাংলার চিত্র-ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা"। বাঙালির, পূর্ববঙ্গের বাঙালির আত্মপরিচয় এই প্রবন্ধের ঢেলে সাজানো। প্রথমে শিল্পী ও শিল্পের সম্বন্ধের সাধারণ সুর, এবং কি করে তা গোটা সমাজে সঞ্চারিত হয়। এরপর অবনীন্দ্রনাথের ঐশ্বরিক অতীতের কুয়াশাচ্ছন্ন স্বর্ণালী রঙ থেকে নেমে আসা নন্দলালের রক্ত-মাংসের দেহের দৈবিক সৌন্দর্যে। অতঃপর যামিনী রায়ের সুকুমার শোভনশালীন গড়ন ভঙ্গির সাথে পরিচয়। তারপর জয়নাল আবেদীনের তুলির নিষ্ঠুর বাস্তবতা ও সংগ্ৰাম। সবশেষে গল্পের নায়কের মতো এস এম সুলতানের অবতরণ। শেখ সুলতানের চিত্রকর্মের যে তফসির আহমদ ছফা দিয়েছেন ─ রূপকথাকেও তা হার মানায়।
আহমদ ছফা দেখিয়েছেন এস এম সুলতানের সার্থকতা কোথায়। যেখানে পূর্ববর্তীদের অপূর্ণতা রয়ে গেছে, পরবর্তী প্রজন্ম সেখানে পূর্ণতা সৃজন করেছে ─ আর এভাবে বিভিন্ন মনিষীর তুলির ছোঁয়ায় পুষ্টিত হয়েছে বাংলার চিত্র-ঐতিহ্য। শেখ মুহাম্মদ সুলতান যেন এই ঐতিহ্যের অবধারিত পরিণাম। অবনীন্দ্রনাথের কিংবা জয়নাল আবেদীনের ব্যার্থতা অপূর্ণতার দিকে ইঙ্গিত করে আহমদ ছফা মোটেও তাদের ছোট করছেন না, বরং তিনি দেখাচ্ছেন সকলে কি করে নিজস্ব প্রতিভায় একটু একটু করে বৃহত্তর এক চিত্রকর্মে নিজের অবদান রেখেছে, এবং সেই বৃহত্তর চিত্রকর্মে এস এম সুলতানের অবদানটা ঠিক কোথায়। ব্যাক্তিগতভাবে আমার কাছে "বাংলার চিত্র-ঐতিহ্য" প্রবন্ধটিকে বইয়ের সেরা প্রবন্ধ মনে হয়েছে, "বাঙালি মুসলমানের মন" এর চেয়েও বেশি।
শেষ প্রবন্ধটি বোধহয় "দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক"। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের সমর্থনের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য প্রদেশবাসীর সমর্থনের পার্থক্য নিয়ে যা বলা হয়েছে তা কতোটা valid/invalid ─ সে বিচারের যোগ্যতা আমার নেই। তবু আহমদ ছফা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়টা ভারতে কাটিয়েছেন, তিনি ভালো জানেন। পশ্চিম বাংলাকে দুধে ধোয়া তুলসী পাতাও তিনি বলছেন না, সেখানকার সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারটাও তিনি উল্লেখ করেছেন। যতো যা-ই হোক, বাঙালি চিরকাল রবীন্দ্রনাথের 'ঠাকুর' আর নজরুলের 'ইসলাম' কোলবালিশের মতো জাপ্টে ধরে বসে থাকবে ─ বিদ্বেষের বেলাতে পূর্ব পশ্চিম কোনো ভেদাভেদ নেই। এতো কিছুর পরেও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে আহমদ ছফার optimism দেখলে দুঃখের মাঝে হাসি পায়।
‘বাঙালি মুসলমানের মন’ আহমদ ছফার একটি আলোচিত প্রবন্ধ৷ এই নামে এটি মূলত একটি প্রবন্ধ ৷ আর বাঙালি মুসলমানের মন বইয়ে ১২ টি প্রবন্ধ আছে। প্রবন্ধগুলো পড়েছি যেগুলো ১৯৮১ সালের পূর্বে লেখা। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে। প্রথম কয়েকটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম মার্চ মাসে তারপর মাঝে মাঝে একটা দুইটা করে আজকে দেখলাম সবগুলোই পড়া শেষ।
আহমদ ছফার লেখনীর তুলনা হয় না। ভাষা একটু কঠিন— সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় পড়তে হয়। প্রবন্ধগুলো ভালো আপনারাও পড়তে পারেন৷
_
বই: বাঙালি মুসলমানের মন লেখক : আহমদ ছফা প্রবন্ধ হাওলাদার প্রকাশনী পৃষ্ঠা ১৬৫ মূল্য ২৫০
'বাঙালি মুসলমানের মন' এটি আহমেদ ছফার একটি আলোচিত, সমালোচিত প্রবন্ধ। বইটি পড়ে অনেকেই ভাবতে পারে মুসলমানকে ছোট করা হয়েছে। আসলে এখানে মুসলমান নয় বরং বাঙালি মুসলমানের কথা বলা হয়েছে। লেখক উল্লেখ করেছেন যে, ইউরোপীয় মুসলমানরা যেমন দর্শন, বিজ্ঞানে পারদর্শীতা ছিল সেটা মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ভারতবর্ষে পৌঁছাতে পারেনি, আর যেটুকু ভারতীয় অঞ্চলে পৌঁছেছে তার সামান্যও পূর্ব বাংলাই পৌঁছাইনি।
'বাঙালি মুসলমানের মন' এটি অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ বই। আমার এই সীমিত মেধা দিয়ে লেখনির গভীরতা নিরুপণ খুবই দুরহ ব্যাপার, তাই বইয়ের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করছি।
যে জাতি উন্নত বিজ্ঞান, দর্শন এবং সংস্কৃতির স্রষ্টা হতে পারে না অথবা সেগুলো উপযুক্ত মূল্য দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না তাকে দিয়ে উন্নত রাষ্ট্র সৃষ্টি সম্ভব নয়। যে নিজের বিষয়ে নিজেই চিন্তা করতে জানে না, নিজের ভালো-মন্দ নিজে নিরুপণ করতে অক্ষম, অপরের পরামর্শ ও শোনা কথায় যার সমস্ত কাজ-কর্ম চলে। তাকে খোলা থেকে আগুনে কিংবা আগুন থেকে খোলায় এই ভাবে পর্যায়ক্রমে লাফ দিতেই হয়। সুবিধার কথা হলো নিজের পঙ্গুত্তের জন্যে দায়ী করবার মত সবসময়ি কাউকে না কাউকে পেয়ে যাই। সে কিন্তু নিজের দুর্বলতার উৎসটির দিকে একবারও দিকপাত করে না।
বাঙালী মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে বেশি ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। সে কিছুই গ্রহণ করে না। মনের গভীরে ভাসাভাসা ভাবে অনেক কিছুই জানার ভান করে সে, আসলে তার জানা-শোনার পরিধি খুবই সংকুচিত। বাঙালি মুসলমানের মন এখনো একেবারেই অপরিণত । সবচেয়ে মজার কথা, একথাটা ভুলে থাকার জন্যেই সে প্রানান্তকর চেষ্টা করতে কসুর করে না।
অনেক কিছুইর সে সংবাদ জানে। কিন্তু কোনো কিছুই চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, মনিষা দিয়ে আপনার করতে জানে না সে। যখনই কোন ব্যবস্থার মধ্যে অসংগতি দেখা দেয়, গোজামিল দিয়েই সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই। এই গোজামিল দিতে পারাটাকে রীতিমত প্রতিভাবানের কর্ম বলে মনে করে।
আমরা সকলেই আহমদ ছফার সাথে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে বাংলা সাহিত্যে আহমদ ছফার মতো স্পষ্টভাষী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লেখক আর নেই। উনারই ১২টি প্রবন্ধ নিয়ে রচিত এই বইটি। যার মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে "বাঙালি মুসলমানের মন" যার নামে নামে বইটির নাম। বইটির প্রবন্ধগুলো ১৯৬৯ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে হয়তো লেখা। সবগুলো প্রবন্ধ একটি থেকে অন্যটি আলাদা বিষয়বস্তুর দিক থেকে। বইটির কয়টি প্রবন্ধ ব্যাপক সমালোচিত পাঠক এবং লেখক সমাজে। . বইটিতে আমার মতে সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য প্রবন্ধগুলো হচ্ছে "বাঙালি মুসলমানের মন", " শিক্ষার দর্শন", "ভবিষ্যতের ভাবনা", " বাংলার চিত্র-ঐতিহ্য" এবং " দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক"। . বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধে লেখক অনেকগুলো কারণ উল্লেখ্য করে বলেছেন যে আমাদের বাংলাদেশের মুসলিমরা কেনো পৃথিবীর বাকি মুসলিমদের থেকে আলাদা। উনার মতে মুসলিমদের উপর জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শনের যে প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তা ইউরোপ এবং মধ্যপাচ্যে দেখা গেলেও ভারতবর্ষের মুসলিমদের মাঝে দেখা যায়নি, আর যদি ভারতবর্ষে দেখা যায় তাহলে বাঙালি মুসমানদের মাঝে দেখা যায়নি। এছাড়াও উনি বাঙালি মুসলিম পুঁথি লেখকদের নিয়ে অনেক মন্তব্য করেছেন প্রবন্ধটিতে। এই প্রবন্ধটি উনার অন্যতম বিতর্কিত, সমালোচিত এবং আলোচিত প্রবন্ধগুলোর মাঝে অন্যতম। . শিক্ষার দর্শন নামক প্রবন্ধে উনি দেখিয়েছেন পাঠ্য বইয়ের শিক্ষা ভুলও হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে উনি দেখিয়েছেন একসময়ের চিরশত্রু ফান্স এবং ব্রিটিশদের। যেখানে দুই দেশের যুদ্ধের ইতিহাস, কারণ এবং ফলাফল দুই দেশে দুইরকমভাবে বইতে লেখা হয়ে থাকে। পুঁথি লেখকরা চাইলেই শুধু বই লিখে একটা জাতিকে অন্য জাতির উপর ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে। . ভবিষ্যতের ভাবনা প্রবন্ধে উনি মূলত পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে উনার চিন্তাগুলো তুলে ধরেছেন। এইযে এতো দেশ পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করছে জনগণকে উপোষ রেখে, এর ফলাফল কি হবে? এই অস্ত্রগুলো কি ব্যবহার করে পৃথিবীকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হবে নাকি শান্তির বাণী শুনিয়ে অস্ত্রগুলো সাজিয়ে রাখা হবে। যদি তা ব্যবহার করা না হয় তাহলে জনগণকে কেনো না খাইয়ে এতো টাকা ব্যয় করে অস্ত্র নির্মাণ করা হলো! . বাংলার চিত্র-ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা প্রবন্ধটিতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, জয়নুল আবেদীন থেকে সময়ের চলমান স্রোতে উনি এস.এম সুলতানের আলোচনা করেছেন। উনার এই শিল্প বিষয়ক প্রবন্ধটি যে কোনো পাঠককে শিল্পের প্রতি আকর্ষিত করবে। . দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক প্রবন্ধে উনি বলেছেন কেনো মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সকল রাজ্য আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সহযোগিতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একইসাথে উনি কারন দেখিয়ে বলেছেন পশ্চিমবঙ্গের লেখক-সাহিত্য থেকে আমাদের দেশের লেখকরা যেনো যতোটুকু প্রয়োজন ততোটুকুই গ্রহণ করে। . এই বইটির প্রতিটি প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কোনো ভালো আলোচনাবিদ হয়তো আলাদা আলাদা বই লিখতে পারবে। বইটি আমি ২০১৯ সালে একবার এবং বর্তমানে একবার পড়েছি৷ তারপরও আমার মনে হয়েছে যে বইটির সকল কিছু বুঝতে হলে বইটি আমার আরও কয়েকবার পড়তে হবে। পরিশেষে সকলকে বলবো বইটি পড়ে দেখবেন৷ উনার প্রতিটি কথা হয়তো আপনার ভালো লাগবেনা, হয়তো উনি ভুল লিখেছেন, উনি তো আর ধর্মগ্রন্থ লিখেননি যে উনার সকল কথাই সত্য হবে এবং আপনার মেনে নিতে হবে।
১. আহমদ ছফা ঘোর নাস্তিক মানুষ আর সেই নাস্তিকার বীজ থেকেই প্রায় সব লেখার উদ্ভব। এবং প্রায় সব প্রবন্ধেই এই গন্ধ ছোয়ানোর চেষ্টা করেছেন।
২. লেখকের লেখা তার ভাবনার প্রতিফলন। "আসত্তি" নিয়ে মাখা ঘামিয়েছেন খুবই কম। বাক্য সাজানোর কষ্ট তিনি করেননি। সব প্রবন্ধ না হলেও কিছু কিছু প্রবন্ধ পড়তে আসলেই বেগ পেতে হয়।
এই প্রবন্ধ ক'টির মাধ্যমে প্রায় অনেক বিষয় নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় থেকে শুরু করে সমাজ ব্যাবস্থা এবং কী হওয়া উচিৎ, কী করা উচিৎ পর্যন্তু। লেখকের লেখা আপাতবিরোধী। নিজের চিন্তা চেতনাকে ঢেলে দেওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন বলেছেন, ভাবেননি ঐ সব ভাবনারাও উল্টা ভাবনার জন্ম দিতে পারে। বা তিনি যেটাতে অন্ধবিশ্বাস করেন আর যেটাকে অন্ধবিশ্বাস বলেন, এই দুইটার মধ্যে তফাৎ বেশি নাই। তফাৎ এতটুকুই, একটার সাথে ধর্মের ট্যাগ লাগানো আর অন্যটার সাথে সাহিত্যের। তিনি সাহিত্যে অন্ধবিশ্বাস করতে রাজি। কিন্তু এরকম বিচক্ষণ মানুষ যখন বুঝতে ব্যার্থ হন যে তার নিজের কথা, নিজের দর্শন সব কিছুই সময়ের সাথে তলিয়ে যাবে তখন ধরে নিতে হয় লেখক রাগী মানুষ অথবা নির্দ্দিষ্ট একটা দিককে তিনি ঘৃনা ভরে দেখেন। আর সেই কারনেই একদিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দিতে গিয়ে আর টেনে হিচড়ে অপরদিককে আলোকিত করতে গিয়ে আপাতবিরোধী কথাগুলোকে পাত্তা দিতে চাননি এবং এও ভাবতে চাননি যে তিনি নিজে যেসব বিষয়ে পরিবর্তন দেখাচ্ছেন তার নিজের লেখা প্রবন্ধগুলোতে, সেসবের নতুন উৎসের প্রতি তিনি কিভাবে জোর করে সাফাই গাইছেন।
উত্তর ভূমিকাতে লেখক তার "নাম প্রবন্ধটি" ( বাঙালি মুসলমানের মন) লেখার প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেছেন। সমাজের বা মানুষের পরিবর্তনের ধারা হিসাবে এই ভূমিকা। কী কী নিয়ামক থাকে যেসব মানুষকে স্থির একটা বিশ্বাসে আবদ্ধ রাখতে ব্যার্থ হয় এবং ডানে বা বায়ে হালতে বাধ্য করে। আবুল ফজল সাহেবের নাস্তিকতা ছেড়ে লম্বা টুপি পরা লেখককে ভাবায় হঠাৎ পরিচয় পাল্টে ফেলার পেছনে কী কী সামাজিক কারণ থাকতে পারে। "বাঙালি মুসলমানের মন" ছাড়াও আরও কিছু প্রবন্ধের প্রেক্ষাপট এবং আলোচনা-সমালোনা নিয়ে লিখেছেন "উত্তর ভূমিকাতে।" সাথে বর্ণনা করেছেন কীভাবে আহমদ ছফার লেখা প্রবন্ধ মানুষের ভাগ্য বদলিয়ে দিয়েছে। এস এম সুলতানের বাংলাদেশে স্বীকৃতি লাভের পেছনেও লেখকের বড় অবদান বলে লেখক মনে করেন এবং সাথে কারনও দেখিয়েছেন।
বাঙালি মুসলমানের মন নাম প্রবন্ধটি লিখেছেন এটা দেখানোর জন্য যে জ্ঞান গরীমাতে কতটা পিছিয়ে সাথে রিজনিং ক্ষমতা কতটা কম বাঙালি মুসলমানের। হয়তো দুঃখবোধ থেকে লিখেছেন। হতেও পারে প্রচন্ড রাগ, বা অভিমান থেকে লিখেছেন। কেন গোঁড়ামি থেকে বের হতে পারেনি বাঙ্গালিরা। কাউন্টার এ্যাটাক বা প্রতিশোধস্পৃহা কেন থাকতেই হবে? কেনই বা শুধু প্রতিশোধ নিতেই লিখতে হবে। লিখলেও কেন মনোরঞ্জনের জন্য লিখতে হবে? কোন রকম বাহ্যিক জ্ঞান আহরণ ছাড়া নিছক প্রতিশোধ নিতে ক্যারেক্টর অবতারণা কেন করতে হবে! জ্ঞান যে ধর্মীও বিষয়েও রাখেনা বাঙালি মুসলমান সে বিষয়টিই দেখাতে চেয়েছেন হয়তো। ধর্মীও জ্ঞান থাকলে হয়তো জানতো সর্বক্ষেত্রে জ্ঞান থাকা কতোটা আবশ্যক। মিথ্যার মোকাবিলা সত্যদিয়ে করা যায় কারন মিথ্যার পরাজয় তো নিশ্চিত।
আপাতবিরোধী লেখার শুরু শিক্ষার দর্শন থেকে। "শিক্ষার দর্শন" প্রবন্ধের কথা বললে দেখা যায় লেখক এমারসনের ধারণার সাথে একমত পোষন করেন। এমারসনের মতে যেমন প্রত্যেক যুগের বই, ইতিহাস, সেই যুগের কিছু না কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হয় তেমনি ছফার বর্ণনায় প্রত্যেক রাষ্ট নিজের নিজের সুবিধার কথা বিবেচনা করে ইতিহাস রচনা করে সেটা পাঠ্যযোগ্য করে শিক্ষাব্যবস্থাতে ঢুকিয়ে দেয়। সাথে আরও দেখিয়েছেন শিক্ষার গুরুত্ব কিভাবে এক শাখা থেকে আরেক শাখাতে স্থানান্তর করে। কিভাবে প্রাচীন সমাজে বিশৃঙ্খল মানুষকে শৃঙ্খলে রাখার জন্য একটা পরমসত্তার আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে যাতে একটা বদ্ধমূল বিশ্বাস নিয়ে মানুষ পরবর্তী জিবনের চিন্তায় চিন্তিত হয়ে নিজেকে সভ্য রাখে। বলেছেন কিভাবে প্রচীন শিক্ষার ভিত নড়ে গেছে রেনেসাঁর ফলে। রেনেসাঁ কিভাবে প্রভুত্বের বন্দনার পরিবর্তে মানুষে মানুষে বন্ধন খোঁজার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে প্রভুত্ববাদের উৎখাত করেছে। লেখক একপর্যায়ে বলেন :
"বস্তুত একজন বিশ্বাসী মানুষ ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে যে ধরনের নির্মল আনন্দ অনুভব করেন, একজন ধর্মবিশ্বাসহীন মানুষ উন্নত সাহিত্য পাঠেও একই ধরনের আনন্দ পেয়ে থাকেন।"
কিন্তু কথা হলো লেখক পরিবর্তনের কথা বলে কিভাবে বলতে পারেন লেখকের নিজের দর্শন এক সময়ে ফিকে পড়বেনা? কিভাবে প্রমাণ করতে পারেন উন্নত সাহিত্য আসলে কোনটা? নাস্তিক যেটাকে পড়ে আনন্দ পান নাকি বিশ্বাসী যেটাকে পড়ে নির্মল আনন্দ পান? লেখক যদি বলেন নাস্তিক(লেখকের ভাষা) যেটা পড়ে আনন্�� পান সেটাই উৎকৃষ্ট লেখনী তাহলে সেটাও কী অন্ধবিশ্বাসের কাতারে পড়েনা? সাহিত্যকে ধর্ম করে নিয়ে সেই সাহিত্য বা লেখকের মতে যেসব উৎকৃষ্ট লেখনী সেই সবের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে এবং কোনোরকম প্রমাণাদি পেশ করা ছাড়া যদি লেখক বলতে পারেন মানুষ নিজের প্রয়োজনে অথবা মানুষকে বসে আনতে পরমসত্তার আবির্ভাব করেছে তাহলে তো বলায় যায় লেখক সাহিত্যের অন্ধভক্ত, সাহিত্যে অন্ধবিশ্বাসী। এই অন্ধবিশ্বাস ঘোচানোর উপায়ন্তর কী? লেখকের রাগান্বিত, ঘৃনাভরা জ্ঞানের গরীমাতে অন্য মতাদর্শ ঢোকার তো কোনো জায়গা নেই।
বার্ট্রান্ড রাসেল সমন্ধের প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে তার জিবন কেটেছে, কিভাবে এক দর্শন থেকে আরেক দর্শনে ধাবিত হয়েছেন রাসেল। কিভাবে ক্রাইস্ট বা আল্লাহ থেকে নিজেকে বাচিয়ে রেখেছেন ধর্মীও পরিবারতন্ত্রের মধ্যে বড় হওয়ার পরও। আহমদ ছফা একটা জিনিস ভুলে গেছিলেন হয়তো যে তিনি নিজে কিভাবে একটা মানুষের জীবনে অনেক কয়েকটা দর্শনকে বাদ দেওয়া দেখিয়েছেন। রাসেলের জীবনে প্রথমে হেগেলের দর্শন আসার পরে কীভাবে তা মলীন হয়ে মার্ক্সের দর্শন আসতে শুরু করে। তারপরও তার মনকে তা শান্ত না করতে পারার কারনে তাকে ভিড় জমাতে হয় গণিতের কাছে। শুধু যে রাসেলের জীবনেই এমনটা ঘটেছে তা কিন্তু নয়। সাথে সাথে পুরো পৃথিবীতেই এসব দর্শন উঠতি সূর্যের মতো তেজ নিয়ে উঠে মধ্যাহ্ন হতে না হতেই ডুবে গিয়েছে। আজও এমনই হয়, হচ্ছে। তারচেয়ে বড় কথা হলো একটা অন্য ধর্মের মানুষের ধর্ম ছাড়ার কারন দিয়ে আরেক ধর্মের বিষয়ে মতবাদ দেওয়া খুব একটা যুক্তিযুক্ত তকরার হতে পারেনা। লেখক নিশ্চয় জ্ঞান রাখেন সেই ধর্মের ধর্মগ্রন্থ কীভাবে যুগে যুগে বিকৃত হয়েছে আর সেই গ্রন্থ যে এক যুগের পর অন্য যুগেও সামঞ্জস্যপূর্ণ হবেনা এটা তো ছফার খুব বেশ করেই জানার কথা। কারন তিনি নিজেই তার পূর্ববর্তী প্রবন্ধ শিক্ষার দর্শনে বলেছেন কীভাবে এক রাষ্ট্র নিজেদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে অপর রাষ্ট্রকে ছোট করে শিক্ষার মান নির্ধারণ করে। এখানে এসে এই বিষয় না বুঝা তো আপাতবিরোধী বিষয় হয়ে যায়।
লেখকের চিন্তাশক্তি ভালো, প্রবন্ধগুলোও ভালো। কিন্তু তিনি নিজের চিন্তাভাবনা খুবই জোরপূর্বক চাপিয়ে দিতে চান যেটা ভালো না। তিনি অনেক বড় বড় সাহিত্যিকদেরও সমালোনা করতে পিছুপা হননি সাথে পিছুপা হননি তাদের ছোট করতেও। ভালো লাগার বিষয় হলো ছফার ক্রিটিকাল মানস। তার প্রবন্ধগুলো পড়লে বুঝা যায় কত গভীর ভাবে পড়েছেন তিনি বই-কে এবং মানুষকে।
অনেকের লাগবে গায়ে হয়ত, কিন্তু খাটি সত্য কথা। প্রগতিশীল বলে এখন রক্ষণশীলতার পরিচয় টাই দেই বাঙালি মুসলমানরা। এ কারণে এ রাষ্ট্রে ধমীয় প্রোপাগান্ডা ছড়ানো সহজ, ধর্মের নামে ব্যবসা করা সহজ। বেশি কিছু না,শুধু মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত ইতিহাস দেখলেই সব চোখে পড়বে। আর এর মূল কারণ শুধু বৃটিশ রা নয়। এর উত্তর ভৌগলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেতে জড়িত। যারা আরো জানতে চান তাদের কে বলবো হূমায়ন কবিরের বাঙলার কাব্য পড়তে পারেন। এছাড়াও বিনয় ঘোষ ও গৌতম ভদ্রের বই আছে।
নাম ভূমিকার রচনা টিই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। এছাড়া সুলতানের সাধনা, পদ্মানদীর মাঝির একটি চরিত্র, দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এমন কিছু প্রবন্ধ মন ছুঁয়েছে। তবে অনেক প্রবন্ধেই 'নাম' গুলো যত আকর্ষণীয়, ভিতরের কথাগুলো ততটাই খটমটে। বাস্তবে অনুভব করা কঠিন। তবে বই এর বাহিরে ছফা সাহেব যেই ভূমিকা লিখেছেন সেটাই কিন্তু বই এর প্রতি সবচেয়ে আকৃষ্ট করেছে।
আহমদ ছফা এর বই পড়লেই মনে হয় অনেক কিছু এখনো জানা বাকি, পড়া বাকি। স্বল্প জ্ঞান নিয়ে উনার বইয়ের পর্যালোচনা করা সম্ভব নয়। বরাবরের মতোই উনার এই বইটিও আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতের ভিন্নতা রয়েছে।
বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধ বাদেও বইটিতে আরো ৮টি বিষয়ে প্রবন্ধ রয়েছে৷ বাঙালি মুসলমানের মন মূলত পুঁথি সাহিত্যে ইসলামের কাহিনি বিকৃতির বিষয়টিকে লেখক তুলে ধরেছেন৷ তাছাড়া একুশে ফেব্রুয়ারি, দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল, রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি, বাংলার ইতিহাস, চিত্রশিল্পী সুলতান-এর সাধনা সম্পর্কেও লেখক বিশ্লেষণ করে মতামত দিয়েছেন।
উপন্যাস, গল্পে আহমদ ছফা যতটা সহজ শব্দের ব্যবহার করেছেন প্রবন্ধে ঠিক ততটাই কঠিন কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ শব্দের ব্যবহার দেখিয়েছেন। যা পড়ে মনে হয়েছে প্রবন্ধ আসলে সবার জন্য নহে
অনেকদিন পর নন-ফিকশন বই পড়লাম। ছফার লেখা আমার সবসময়ই এনগেজিং লাগে, এটাও তার ব্যতিক্রম ছিলনা। যদিও আমার মনে হয়েছে কিছু বিষয় সম্পর্কে আরও জানা থাকলে কিছু প্রবন্ধ আরও ভালভাবে বুঝতে পারতাম। ১২টা প্রবন্ধের মধ্যে আমার সবথেকে ভাল লেগেছে বাঙালি মুসলমানের মন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র, সুলতানের সাধনা এবং দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র প্রবন্ধে লেখক যেভাবে হোসেন মিয়া চরিত্রটি বিশ্লেষণ করেছেন ইটস জাস্ট আমেজিং। সুলতানের সাধনা থেকে বাংলার চিত্রকলার ইতিহাস নিয়ে জানার হাতেখড়ি হয়ে গেল। হাইলি রেকমেন্ডেড।
"বাঙালী মুসলমানের মন যে এখনোও আদিম অবস্থায়, তা বাঙালী হওয়ার জন্যও নয় এবং মুসলমান হওয়ার জন্যও নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুণ তার মনের ওপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত হয়ে রয়েছে, স্বজ্ঞানে তার বাইরে সে আসতে পারে না। তাই, এক পা যদি এগিয়ে আসে, তিন পা পিছিয়ে যেতে হয়। মানসিক ভীতিই এই সমাজকে চালিয়ে থাকে।"- অনেক তথ্যসমৃদ্ধ একটা লেখা। আরোও একাধিকবার পড়তে হবে।
বাঙালী মুসলমান হওয়ার পর তাদের মনোজগতে যে পরিবর্তন তা নিয়ে লেখক গভীর ভাবে আলোচনা করেছেন। বাঙালি মুসলমানের মন টাইটেল প্রবন্ধটি পড়ার জন্য হলেও বইটি সবার পড়া দরকার।
বাঙালি মুসলমান সমাজের সামগ্রিক চিত্র উঠে এসেছে এই বইটিতে। আহমদ ছফা তথাকথিত ও প্রচলিত মতবাদের বাইরে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা ও ঘটনার প্রভাবকগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। বইটি পড়লে বুঝতে পারবেন বাংলাদেশের মানুষ তার পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ(যেমন, ভারত) থেকে এখনো কেন চিন্তা, চেতনা ও মননশীলতার দিক থেকে পিছিয়ে আছে। এর সূত্রপাত বহু পূর্বেই এই অঞ্চলের বাঙালি মুসলমানেরা ঘটিয়েছে নানা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে।
আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধিতা, স্পষ্টবাদিতা, চিন্তাশীলতার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির জন্য লেখক ও বুদ্ধিজীবী মহলে আলোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন জীবদ্দশাকালে। কেন ছিলেন সেটা সম্ভবত এই বইটা পড়লেই পুরোটা উপলব্ধি করা যাবে। বাঙ্গালী মুসলমানদের অতি রক্ষণশীল মন মানসিকতার যে বহি:প্রকাশ তার ৩০/৩৫ বছর আগের লেখায় তুলে ধরেছেন সেটা কী আদৌ পরিবর্তন হয়েছে? নাকি আরো পেছনে ধাবিত হয়েছে? হয়তো নতুন করে কেউ লিখবেন সেসব জীবনের মায়া পকেটে পুরে। সবচেয়ে অবাক হয়েছি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র হোসেনে মিয়ার চরিত্র বয়ানে। এমনটাও যে হতে পারে ভেবে চমকে গিয়েছি। কী অসাধারণ লেখনী! মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেছে ১২ টা ভিন্ন গল্প কিংবা গবেষণাধর্মী বয়ানে।
"প্রবন্ধগ্রন্থ" শুনলেই পাঠকগোষ্ঠীর অনিহা নতুন কিছু নয়। পাঠকগোষ্ঠীর চাই রমরমা গল্প। যা খুঁজতে খুঁজতে বাঙালি নতুন পাঠকেরা নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে যেতে ইদানীং অনাগ্রহী। আমি সেই তালিকার ব্যতিক্রম কেউ নই। অনাগ্রহ বশত বিগত বছরের ডিসেম্বরে শুরু করে বইটি পড়ে শেষ করেছি আজকে, অর্থাৎ পঁচিশের এপ্রিলে। আমি সচরাচর এই দীর্ঘসময় ধরে পড়া বইগুলো মানুষকে সাজেস্ট করি না কারণ মনে হয় তাদেরও ভালো লাগবে না, কিন্তু এই বইটি তার ব্যতিক্রম। বইটি না পড়লে আপনি সাহিত্যজগতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ না পেয়ে, দারুণ কিছু বিষয় থেকে বঞ্চিত হবেন। সবগুলো প্রবন্ধ সম্পর্কে আমি তাই খুচরো আলাপ করেছি, লেখাগুলোর গুরুত্ব এতে কতটুকু আমি আপনাদেরকে বোঝাতে পারবো আমি জানি না, তবে সচেতন সকল পাঠককে এই বইটি পড়তে উৎসাহিত করবো।এইজন্য নয় যে বইটি আমার ভালো লেগেছে বরং এইজন্য যে, এই প্রবন্ধগ্রন্থের প্রতিটি লেখাই আলোচনা সমালোচনার দাবিদার। একেকজনের দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন আলোচনা এই বইটির মূল উদ্দেশ্যকে ফলপ্রসূ করবে।নতুবা লেখাগুলো এমন নিশ্চুপভাবেই পড়ে থেকে ক্ষতি করবে বাঙালি সাহিত্যিক এবং পাঠকগোষ্ঠী উভয়কেই। ছোট ছোট করে প্রবন্ধগুলোর মূল যেটুকু আমি ধরতে পেরেছি সেটুকু আপনাদের জানানো আমার গুরুদায়িত্ব,তা-ই করবো আমি।
⚫উত্তর ভূমিকা
বইটির নাম-প্রবন্ধটি লেখার পেছনের ইতিহাস দিয়েই আহমদ ছফা মূল প্রবন্ধ গ্রন্থটি শুরু করেছেন।সেই সাথে নিজের লেখার ভালো দিক সম্পর্কে নিজেই কিছুটা ধারণা দিয়েছেন। ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও প্রবন্ধপাঠে সেটি আগ্রহ আনতে সাহায্য করেছে।
⚫বাঙালি মুসলমানের মন
মূলত এই প্রবন্ধে তিনি বাঙালি মুসলিম পুঁথি সাহিত্যিকদের সমালোচনা করেছেন কড়া ভাষায়, যা সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত। এক বাক্যও আপনার কাছে যুক্তিহীন মনে হবে না। মূলত সামাজিক প্রতিক্রিয়া কিভাবে সাহিত্যিকদের জ্ঞানভান্ডার থেকেও বেশি প্রাচীন পুঁথিগুলোকে প্রভাবিত করেছে সেই বিষয়ে তিনি লিখেছেন। তার পাশাপাশি ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্মের গোড়াপত্তনের সঠিক কারণ এবং ভারতবর্ষ যে মধ্যমপন্থী হয়ে সবদিক থেকে বিপথগামী হলো, সে বিষয়ক আলোচনা করেছেন তিনি। মানসিক ভীতি কিভাবে সমাজকে পরিচালনা করে সে বিষয়ক চরম সত্য তিনি মুখের উপর বলেছেন। এতো বলিষ্ট আলোচনা আমি ইতিপূর্বে আহমদ ছফা ব্যতীত কারো লেখাতে পড়িনি।
⚫মানিক বন্দোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র
আপনার যদি "পদ্মানদীর মাঝি" উপন্যাসটি পড়া থাকে তবে এই প্রবন্ধ পড়ে আপনি উপভোগ করতে পারবেন।১। ময়নাদ্বীপের মালিক, হোসেন মিয়াকে আমরা সবাই ভিন্নভাবে উপন্যাসে পেলেও, তাকে একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে আহমদ ছফা মূল্যায়ন করেছেন। এই ব্যাপারটিই ছিলো সবচেয়ে চমকপ্রদ। আবার একই সাথে তিনি হোসেন মিয়াকে তুলনা করেছেন গ্রিক মিথলজির জিউসের সাথে যিনি সবকিছুর মূল হয়েও এক প্রকার নির্বিকার ভূমিকা পালন করেন। প্রবন্ধটি পড়লে "পদ্মানদীর মাঝি" উপন্যাসটিকে মাঝিদের দুর্বিষহ জীবনযাত্রা কিংবা ফ্রয়েডীয় প্রেমের বাহিরে গিয়ে অন্যভাবে আপনি আবিষ্কার করতে পারবেন।
⚫রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ছোটবেলা থেকে গণ্যমান্য এক আসনে বসিয়ে, বলতে গেলে, চোখের উপর কালো পর্দা পেঁচিয়েই বেশিরভাগ মানুষ ভক্তি করে আসে। আমাদের প্রজন্মের হাতে গোণা কয়েকজন মানুষ তার সাধনা, তার কাজের বিস্তৃতি এবং সেগুলোর বিস্তৃতি সম্পর্কে জানি। স্বীকার করুন বা নাই করুন, পাঠ্যবইয়ের লেখাগুলো পড়ে কিংবা বাপ-দাদার কাছে প্রসংশা শুনে এবং "নোবেল" প্রাপ্ত লেখক হবার সুবাদেই আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ তাকে বড় একজন সাহিত্যিক হিসেবে মেনে নেই।
এই তেতো সত্য মেনে নিয়েই আপনি যখন আহমদ ছফার এই প্রবন্ধ পড়তে শুরু করবেন, তখনই বুঝবেন রবীন্দ্রনাথ কিভাবে কবিগুরু হয়ে উঠেছিলেন, কিভাবে তার পারিপার্শ্বিকতা তাকে সাহায্য করেছিলো আর পাঁচজন বাঙালির থেকে উঁচু মানের মনন ধারণ করতে। কেবল তার নিজস্ব জ্ঞানভান্ডারই নয়, তার পিতামহ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাবও যে তার সাহিত্য-সংগীতে বড়সড় একটা জায়গা দখল করে আছে, সে বিষয়ে লেখক উক্ত প্রবন্ধে আলোকপাত করেছেন।
⚫শিক্ষার দর্শন
এই প্রবন্ধকে অবশ্যই প্রাথমিক স্তর থেকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা প্রয়োজন।কেবল বাংলাদেশ নয়, সামগ্রিকভাবে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রই কমবেশি নিজেদের স্বার্থে শিক্ষাব্যবস্থাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং কিভাবে রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে সেই দিকটিকে সুক্ষ্মভাবে তিনি এই প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করেছেন। একই সাথে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য নিয়েও তিনি প্রশ্ন রেখেছেন। কোন রাষ্ট্রই যে ধর্মরাজ্য নয়, এবং নিজ প্রয়োজনে সত্যকে বিকৃত করার প্রচলন যে বহু আগে থেকেই চলমান, সে বিষয়ক ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছেন।আর সেই বিকৃত সত্য শিশুকাল থেকে মানুষের মধ্যে প্রবেশ করানোর অন্যতম মাধ্যমও যে বাধ্যতামূলক রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা, সেটিও তিনি উল্লেখ করেছেন সুদূরপ্রসারী আলোচনার মাধ্যমে। আমাদের মধ্যে, স্কুল কলেজের ইতিহাস বিষয়ক বইগুলোকে ইতিহাসের বাইবেল হিসেবে ধরে নেয়ার মানসিকতা কাটাতে, এই প্রবন্ধ বিশেষভাবে সকলের পড়া উচিত৷ আমার মতে এই পুরো বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চমানের প্রবন্ধ ��টি।
⚫বার্ট্রান্ড রাসেল
আচ্ছা, আমাদের মধ্যে ক'জন মানুষ বার্ট্রান্ড রাসেলকে নিয়ে মোটামুটি একটা ধারণা রাখে? আমি অন্তত আমার এতোগুলো বছরের শিক্ষাজীবনে এই মানুষটি সম্পর্কে কোনোদিন বিন্দুমাত্র ভাবিনি, কবে কোথায় ঠিকভাবে তার নাম পড়েছিলাম বলে নেই। হ্যাঁ, মনে আছে মোতাহের হোসেন চৌধুরি তার "সভ্যতা" ও "সুখ" নামে দুটি লেখার অনুবাদ করেছিলেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় এই দুটোর নাম জান প্রাণ দিয়ে মুখস্ত করেছিলাম, আমার জানামতে এখনকার সিলেবাসেও এই নাম দুটোর গুরুত্ব মোতাহের হোসেন চৌধুরীর অনুবাদ হিসেবে অপরিসীম। বিষয়টা একই সাথে হাস্যকর এবং শঙ্কা জনক।
এই প্রবন্ধে আহমদ ছফা মূলত একটি গন্ডির মধ্যে থেকেও কিভাবে রাসেল নিজেকে, নিজের আশেপাশের চিন্তাধারা থেকে নিজেকে মুক্ত করেছেন এবং নিজস্ব দর্শন সৃষ্টি করার মতো সক্ষমতা অর্জন করেছেন সেটির দিকে আলোকপাত করেছেন। ইংরেজদের প্র্যাক্টিকাল মনোভাবকে ছাপিয়ে গিয়ে বনেদী খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণকারী রাসেল পেরেছিলো নতুন ভাবনা ভাবতে। এর পেছনে তার বাবার নাস্তিকতায় বিশ্বাস কোনোভাবে জড়িত কিনা সেই প্রশ্ন ছোড়ার পাশাপাশি জার্মান ক্লাসিকাল দর্শন থেকে তিনি কতোটা ভিন্নধরণের মতবাদ দিয়েছেন সেসকল বিষয়ে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
⚫ভবিষ্যতের ভাবনা
ফেসবুকের কল্যাণে আপনি আমি বসে বসে এখন যেই যুদ্ধ বিগ্রহ নিয়ে হালকা মাথা ঘামাচ্ছি, এই বিষয়টি নিয়ে তিনি আলোচনা করে গেছেন ১৯৬৭ সালে! বিশ্বের সকল যুদ্ধ বিগ্রহের মূল কারণ এবং প্রতিটি সংঘাত কিভাবে ভবিষ্যতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে স্বাগতম জানাচ্ছে এবং কতটা ইন্ধন যোগাচ্ছে সেসব বিষয়ে তিনি সুদূরপ্রসারী আলোচনা করেছেন উক্ত প্রবন্ধে। যা আমি পড়লাম ২০২৫ সালে এসে,অনেকে না পড়েই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলো আর আপনাদের মধ্য থেকে অনেকেই সেটা পড়ে ওঠার সময় করতে পারেননি। এই গোটা তালিকার মধ্যে তাই কিছু মানুষের হিটলারকে মহান পুরুষের আসনে বসিয়ে শ্রদ্ধাভক্তি করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়! এই বিষয়টাও এই প্রবন্ধ পড়ে কিছুটা হলেও আমার বোধগম্য হয়েছে।
⚫বাঙলার ইতিহাস প্রসঙ্গে তুলনামূলকভাবে বেশ ছোট একটি প্রবন্ধ। বাঙলার সর্বস্তরের জনগণের এই ইতিহাসে যে প্রাপ্য স্থান কোন অংশে সমাজের উচ্চশ্রেণির চেয়ে কম নয়, সে বিষয়টিতে মূলত তিনি আলোচনা করেছেন।
⚫একুশে ফেব্রুয়ারি উনিশ শ' বাহাত্তর
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বাঙালি জাতি পেয়েছিলো নিজেদের ভাষার অধিকার, তবুও সে ভাষাকে যথাযথ ভাবে চর্চার প্রয়োজনীয় রসদ তারা একাত্তরের আগে ঠিকঠাক ভাবে পায়নি। কাজেই বাহাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি ছিলো একটি নতুন সূর্যদয়। নিজের ভাষা, নিজের দেশ-আর সেই দেশের জন্য নিজ ভাষায় স্বাধীনভাবে জ্ঞানচর্চার অবাধ সুযোগ। সম্ভাবনার কোন কমতি তখন বাঙালিদের জন্য ছিলো না। তখন বোধহয় জ্ঞানচর্চা কিংবা জাতির অগ্রতির জন্য সবরকম সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাঙালি পিছিয়ে ছিলো বুদ্ধিদীপ্ত মানুষদের অভাবে।যা পাকিস্তানিরা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে করে গিয়েছিলো ১৪ই ডিসেম্বর।তার পাশাপাশি সদ্য স্বাধীন হওয়া নতুন রাষ্ট্রের ভেঙে পড়া অর্থনৈতিক অবস্থা তো ছিলোই। নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে আমাদের দিতে হতো অনেক সময়, পরিচর্যার মূল জায়গা ছিলো নতুন শিশুরা। তাদের দিতে হতো জ্ঞানচর্চার সব রকম সুযোগ। যার মাধ্যমে বাঙালিরা মাথা উঁচু করে তাদের স্বাধীন হয়ে ওঠার সুমিষ্ট ফল বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করতে পারতো।সেই আশার বাণী শুনিয়ে আহমদ ছফা বাহাত্তর থেকে বাঙালিকে জেগে ওঠার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করলেন। পঁচিশে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বার স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে আরেকবার সেই আশার কথা স্মরণ করা জরুরি! আর পেছন দিকে তাকিয়ে ১ম স্বাধীনতা পরবর্তী অপূর্ণতার কথা স্মরণ করার প্রয়োজনীয়তাও অনুধাবন করা জরুরি। আমাদের জন্য আবার আহমদ ছফার মতো দেশ ও জাতির সর্বময় কল্যাণ কামনাকারী মহান ব্যক্তিত্ত্বের পুণর্জাগরণ জরুরি। ভীষণভাবে জরুরি।
⚫বাংলার চিত্র ঐতিহ্য:সুলতানের সাধনা
এস এম সুলতান কেন বাংলার আর পাঁচজন চিত্র শিল্পী থেকে আলাদা এবং তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণ বিশ্লেষণ করে আহমদ ছফা লিখে ফেলেছেন গোটা একটি প্রবন্ধ। মনে পড়ে ক্লাস সেভেন কি এইটে চারুকারু বইয়ে এই বিখ্যাত লোকটির কিছু কাজ সম্পর্কে হালকা পাতলা জেনেছিলাম, আফসোস হয় এই প্রবন্ধটা ওইখানে না পেয়ে, আজ এতো বছর পরে এসে পড়ার জন্য। বাংলার বুকে শিল্পকর্ম সৃষ্টির ইতিহাস থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সময়টা কিভাবে চিত্রশিল্পীদের অনুপ্রাণিত করেছে এবং একই সাথে কেনো হাতেগোণা কয়েকজন সেই তালিকায় টিকে থাকলো আর বাকিরা ঝরে পড়লো, সেসব বিষয়ের চমৎকার বিশ্লেষণ। এটি সবচেয়ে বড় আকারের প্রবন্ধ বলে একটু ঝিমিয়ে গিয়েছিলাম পড়তে পড়তে। তবে শেষপাতে মিষ্টি কিছু খাওয়ার মতোই, শেষাংশে গিয়ে প্রবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিকটি বোধগম্য হওয়ায় এটিকেও অনেক উন্নত মানের লেখা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি।
⚫দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক
পশ্চিমবঙ্গের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে যে রেশারেশি ধর্মের দোহাই দিয়ে চলছে, তার যুক্তিযুক্ত কোন সমাধান কোন লেখকের পক্ষ থেকে এসেছে কিনা সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।তবে আহমদ ছফা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে পশ্চিম বাংলার সহযোগিতার মূল কারণ বিশ্লেষণ করেছেন যুক্তিযুক্ত ভাবেই। দুই বাংলার সাহিত্য নিয়ে তিনি বাঙালি হিসেবে সংশয় প্রকাশ করেছেন। জানতে চেয়েছেন সেই কারণ যার জন্য পশ্চিম বাংলা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হবার পর এতো বছরেও কেনো সাহিত্যাঙ্গনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারেন নি।বাংলাদেশের মুসলমান সমাজ তাদের ধর্মীয় অনুভূতির জন্য বাঙালি হিসেবে বিকশিত না হয়ে মুসলিম রাষ্ট্রের গন্ডিতে বাঁধা পড়ে থেকে পিছিয়ে ছিলো, পশ্চিম বাংলার তো এমন কোন বাঁধা ছিলো না! এই বিষয়কে ঘিরে একটু চমৎকার আলোচনা আছে এই প্রবন্ধে। পাশাপাশি একাত্তরের পর পর পশ্চিমবাংলার সংবাদপত্রগুলোর যে মনোভাব তিনি তুলে ধরেছেন, তা বর্তমান সংবাদ মাধ্যমগুলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সমাধানের উপায় আহমদ ছফা দিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু অবুঝ দুই জাতির সাধারণ জনগণ রাজনৈতিক দ্বন্দের ভীড়ে নিজেদের অস্বিত্ব হারিয়ে ফেলে, ক্রমাগত সংঘাত ছাড়া ভবিষ্যতে কিছু করতে পারবে কিনা, সে বিষয়ে আমি সন্দিহান।
⚫দস্তয়েভ্স্কি এই প্রবন্ধের সমাচলোনা করতে দস্তয়েভস্কি কে আগে জানা প্রয়োজন। সেই যাত্রায় আমি নিজেই বহু পিছিয়ে। দস্তয়েভস্কির লেখার জগত নিয়ে যাবতীয় ধারণা ব্যতীত এই প্রবন্ধের মর্মার্থ উদ্ধার সম্ভব নয়। তবে সাদা চোখে দেখলে, এই প্রবন্ধে টলস্টয় এবং দস্তয়েভস্কি'র মানুষকে চিত্রায়ণের ক্ষেত্রে যে তফাৎ সেটি প্রকাশিত হয়েছে দারুণভাবে। জানিনা "বাঙালি মুসলমানের মন" প্রবন্ধে এই অংশটির সংযুক্তির কারণ। সম্ভবত মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারলে আমার পক্ষে এই বিষয়ক আলোচনা করা সম্ভব হবে। প্রবন্ধটি তোলা থাকুক, একদিন আবার পড়বো আশা করি।
⚫একটি প্রাতিস্বিক গ্রন্থ ফরহাদ মজহারের "প্রস্তাব" গ্রন্থটির সমালোচনা করে এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে। যেহেতু বইটি পড়া নেই তাই ফরহাদ মজহারের মনস্তত্ত্বকে ধরা সম্ভব হয়নি, আহমদ ছফা তার যে আলোচনা করে গিয়েছেন সেটিও তাই আমার জন্য অধরা রয়ে গেলো।
পুরো প্রবন্ধগ্রন্থ পড়ে শেষ করে বুঝলাম, আমার জ্ঞানের পরিধি এখনো বহু সীমিত। আরো এগোতে হবে, জানতে হবে। "বাঙালি মুসলমানের মন" প্রবন্ধের সার্থকতা হলো এর বহুমাত্রিক আলো��না।আপনি বুঝতে পারবেন, আপনার কি কি জানা প্রয়োজন৷ নিঃসন্দেহে এই বইটির গুরুত্ব বাঙালি মুসলমান সমাজের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণধর্মী শ্রেষ্ট গ্রন্থ। হয়তো তার সকল মতামতের সাথে সবাই একমত হবেন না, তবুও আমি বলবো বাঙালি পাঠকগোষ্ঠীর জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ।
বলতে খারাপ শোনালেও সত্যি বাঙালী আজ ধর্মকে ব্যবহার করে। একটা আইডেন্টিটি হিসেবেই ব্যবহার করে মাত্র। মানে আমরা অধিকাংশ বাঙালী মুসলমানরা জাতে মাতাল তালে ঠিক টাইপ। আমরা সব হারাম কাজ করবো কিন্তু অন্য ধর্মের কাউকে পর্ক খায় শুনলে নাক শিটকাবো। আমরা রাস্তাঘাটে মেয়েদের হয়রানি করবো, কিন্তু আমরাই বলবো মেয়ে কেন পোশাক ঠিক পরেনা।
মোট কথা প্রগতিশীল বলে এখন রক্ষণশীলতার পরিচয় টাই দেয় বাঙালি মুসলমানরা।
এ কারণে এ রাষ্ট্রে ধর্মীয় প্রোপাগান্ডা ছড়ানো সহজ, ধর্মের নামে ব্যবসা করা সহজ। বেশি কিছু না,শুধু মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত ইতিহাস দেখলেই সব চোখে পড়বে। আর এর মূল কারণ শুধু ব্রিটিশ রা নয়। এর উত্তর ভৌগলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্র জড়িত।
এটা একটা প্রবন্ধের বই। মূল প্রবন্ধ “বাঙালি মুসলমানের মন” সহ মোট বারোটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে বইটিতে। প্রতিটা প্রবন্ধ পাঠককে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করবে। কয়েকটি প্রবন্ধ সম্পর্কে না বললেই নয়।
বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধে লেখক দেখিয়েছেন এদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিন্মবর্নের হিন্দু এবং বৌদ্ধদের একটি বিরাট অংশ ইসলাম গ্রহন করে। ধর্মের পরিবর্তন ঘটেছে। সময় গত হয়েছে। সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মজার কথা হচ্ছে বাঙালি মুসলমানের সেই চিন্তাধারার কাঠামোটি রয়ে গেছে অপরিবর্তনীয়। এই অনাগ্রসারতার কারন ব্যাখ্যা করেছেন লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। সেই সাথে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক অবস্থাও তুলে ধরেছেন দক্ষ হাতে।
এছাড়া আরো উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলো হলো- শিক্ষার দর্শন ভবিষ্যতের ভাবনা বাংলার ইতিহাস প্রসঙ্গে বাংলার চিত্র-ঐতিহ্য ঃ সুলতানের সাধনা দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক
★ শিক্ষার দর্শন প্রবন্ধে চমৎকারভাবে বাস্তবকে তুলে ধরেছেন। আমরা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে কখনো সঠিক ইতিহাস জানতে পারবো না। কারন সব জাতি এবং রাষ্ট্র নিজ প্রয়োজনে ইতিহাসকে নিজেদের মত লেখে।
★ ভবিষ্যতের ভাবনা প্রবন্ধে তিনি এই পৃথিবীর ভবিষ্যত নিতে চিন্তিত। এইযে সভ্যতার চরম উৎকর্ষতা, এর পরিনাম কী? নিজেরই উদ্ভাবনী শক্তির তাপে জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে মানুষ। লেখকের একটি প্রশ্ন সম্ভবত প্রশ্ন হয়েই থেকে যাবে- . .
“সমগ্র জাতির জনসাধারনের কল্পনাকে খাট করে বা জাতিকে উপোস রেখে, হিংসা-প্রতিহিংসার ওমে তা দেয়া যে বোমাগুলো কোটি কোটি মুদ্রা ব্যয় করে তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলোর কি ব্যবহার হবে না? যদি না হয়, অপর্যাপ্ত অর্থ এবং মানুষের এযাবতকালের বস্তুবীক্ষণের সবচাইতে সূক্ষ্ম সিদ্ধী যাতে মিশেছে সে মহামূল্য পারমানবিক বোমা ইত্যাদি দিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রনায়কেরা কি ব্রেকফাস্ট করবেন?” কে দিবে উত্তর! . .
★ সুলতানের সাধনা প্রবন্ধে পুরো ভারতবর্ষের ইতিহাসকে ছোট্ট একটি প্রবন্ধে বন্দি করেছেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে নন্দলাল বসু হয়ে যামিনী রায়। সেখান থেকে জয়নুল আবেদিন। তারপরে বলেছেন শেখ সুলতানের কথা। যে মানুষটার কোনো খ্যাতি ছিলো না। কোনো লোভ ছিলো না। শুধু তুলি আর ক্যানভাসের কাছেই নিজেকে সমর্পন করেছেন। এই প্রবন্ধ পড়ার পরে স্বাভাবিক ভাবেই চিত্রকলা সম্পর্কে পাঠকের মনে আগ্রহ জাগবে।
যারা আরো জানতে চান তাদের কে বলবো বিনয় ঘোষ ও গৌতম ভদ্রের বই দেখতে পারেন।
যদিও আমার মনে হয়েছে কিছু বিষয় সম্পর্কে আরও জানা থাকলে কিছু প্রবন্ধ আরও ভালভাবে বুঝতে পারতাম। ১২টা প্রবন্ধের মধ্যে আমার সবথেকে ভাল লেগেছে বাঙালি মুসলমানের মন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র, সুলতানের সাধনা এবং দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র প্রবন্ধে লেখক যেভাবে হোসেন মিয়া চরিত্রটি বিশ্লেষণ করেছেন It's Just Amazing .
Apart from the eponymous article “বাঙালি মুসলমানের মন”, the book is simply okay, nothing more. The ideas author explored are neither novel nor revealing in 2021. Most of the articles were written in the seventies, and that could be a reason why they were able to generate quite a stir at that time. Agree with quite a lot of what Sofa explained in his article- বাঙালি মুসলমানের মন. However, from where I am standing today, I feel a lot of the contradictions that Bengali Muslims exhibit, as suggested by Sofa, is more of a reflection of our ethnic fiber.
বইটাতে বাঙালি মুসলমানের মন আর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর সুলতানকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলো আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। সবসময় বলা হয় আহমদ ছফার লেখা সবার জন্য না। উনি যে সবার জন্য লেখেন না তা এ বইটা পড়লে খুব ভালো বুঝা যায়। কিন্তু উনি যাদের জন্য লেখেন, ভালো লেখেন এবং খুব ভালো বুঝার ক্ষমতা নিয়ে লেখেন।