দেশের জ্ঞানী-গুণী মানুষ যখন বিলাপে, স্মৃতিচারণে, কৃতিত্বের রোমন্থনে কিংবা চাটুকারিতায় নিরত, অথবা প্রাণভয়ে বিব্রত, তখন আহমদ ছফা 'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস', চিন্তায় নিষ্ঠ। সংগ্রামোত্তর দলিত জীবনে প্রাণশক্তির উন্মেষ ও ঋদ্ধির এবং মনন বিকাশের আবশ্যিকতা এমনি করে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আর কেউ ভাবেনি।
আহমদ ছফা বয়সে কাঁচা, মনে পাকা, সঙ্কল্পে অটল। দৃষ্টি তার স্বচ্ছ, বাক্য তার ঋজু, বক্তব্য স্পষ্ট, উদ্দেশ্য তার সাধু। মাটি এবং মানুষের প্রতি প্রীতিই তার কল্যাণকামিতা ও কর্ম্প্রেরণার উৎস এবং তার প্রাণ শক্তির আকর। এজন্যই ক্ষতির ঝুঁকি নিয়ে সে সত্য কথা বলার সৎসাহস রাখে। এবং গুণই তাকে আজকের লিখিয়ে-বলিয়েদের সমাজে অনন্য করেছে। লিখিয়ে হিসেবে সেও শেলীর মত বলতে পারে - fall upon the thorns of life, I bleed, অথবা, নজরুলের মত সেও যদি বলে,
তবে অত্যুক্তি হয় না। সুবিধাবাদির Life is a compromise তত্ত্বে ছফার আস্থা নেই। আজকের বাংলাদেশে এমনি স্পষ্ট ও অপ্রিয়ভাষী আরও কয়েকজন ছফা যদি আমরা পেতাম, তাহলে শ্রেয়সেয় পথ স্পষ্ট হয়ে উঠত।
মানববাদী ছফার 'সূর্য তুমি সাথী', 'নিহত নক্ষত্র', 'ওঙ্কার', 'জাগ্রত বাংলাদেশ' যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা 'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' - এর তাৎপর্য ও গোড়ার কথা সহজেই বুঝবেন এবং সংস্কৃতি-প্রাণ, মানবদরদী ছফাকে উগপ্রগতিবাদী বলে ভুল করবেন না। হিতচেতনাদানই এ গ্রন্থের লক্ষ্য, যা ছফা বা যে-কোন সৎলিখিয়ের কর্তব্য।
ডক্টর আহমদ শরীফ বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিসেম্বর, ১৯৭২
Ahmed Sofa (Bangla: আহমদ ছফা) was a well-known Bangladeshi philosopher, poet, novelist, writer, critic, translator. Sofa was renowned for his intellectual righteousness as well as his holistic approach to the understanding of social dynamics and international politics. His career as a writer began in the 1960s. He never married. On 28 July 2001, Ahmed Sofa died in a hospital in Dhaka. He was buried in Martyred Intellectuals' Graveyard.
Sofa helped establishing Bangladesh Lekhak Shibir (Bangladesh Writers' Camp) in 1970 to organize liberal writers in order to further the cause of the progressive movement.
Ahmed Sofa's outspoken personality and bold self-expression brought him into the limelight. He was never seen hankering after fame in a trivial sense. His fictions were often based on his personal experience. He protested social injustice and tried to portray the hopes and dreams of common people through his writing. Sofa always handled his novels with meticulous thought and planning. The trend of telling mere stories in novels never attracted him; he was innovative in both form and content.
ছফা "সাম্প্রতিক বিবেচনা" এবং "বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস" প্রবন্ধে স্বাধীনতা পরবর্তী বুদ্ধিজীবি ও সংস্কৃতিকর্মীদের বিরুদ্ধে সুবিধাবাদিতার ও চাটুকারিতার অভিযোগ এনেছেন, কিন্তু কেইস স্টাডি পেশ করে অভিযোগগুলোকে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারেননি। তাঁর সাধারণীকৃ্ত সমালোচনামূলক বিবৃতিগুলো সেই সময়ে স্বচক্ষে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা পাঠকদের কাছে হয়ত বোধগম্য ঠেকবে, কিন্তু আমার মত বহু পরে জন্মানো পাঠকের কাছে সেগুলো স্রেফ কিছু বিমূর্ত বাক্য ছাড়া কিছু না। উদাহরণ পেশ করে সেখান থেকে কিছু সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারলে আমার দৃষ্টিতে সেটা উৎকৃষ্ট সমালোচনা-সাহিত্য হয়ে উঠে না।
শেষ করলাম আহমদ ছফার সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস। এর আগে আমি মানুষের কাছে শুনেছি বই মানুষকে ভাবায়। চিন্তার উদ্রেক করে। এই বইটা পড়ে আমি এই কথাগুলো আজ নিজে অনুভব করলাম। সত্যি করেই বইটা পড়তে পড়তে আমার বারবার থামতে হয়েছে। নিজের মনে চিন্তা করতে হয়েছে। বইটা আমার নিজের চিন্তাভাবনাকেও আঘাত করেছে। এক সময় বাস্তবতা ভেবে হতাশাচ্ছন্ন হয়েছি। মনে হয়েছে এই আবেগ আর কতোক্ষণ থাকবে। বইটা পড়ার পর হয়তো এক ঘন্টা অথবা দুই ঘন্টা। এরপর আবার দৈনন্দিন ব্যস্ততার মধ্যে সব আগের মতো হয়ে যাবে। এমনটাই আসলে হবে। তাই এখনই নিজের কিছু অনুভূতি শেয়ার করে রাখি।
এই ৫০ পৃষ্ঠার বইটা নিজেই একটা রিভিউ। বই এর বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব না। বই পড়তে পড়তে বারবার থেমে থেমে যে চিন্তাগুলো করতে হয়েছে সেগুলো যদি নোট করে রাখতাম হয়তো গুছিয়ে কিছু বলতে পারতাম। কিন্তু এভাবে বই পড়ার মজাটা হয়তো সেভাবে পাওয়া যাবে না।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ যে নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতির সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিলো, সে সম্ভাবনা স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই পরিণত হয় ফাঁকা বুলিতে। এ দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতি আজ পর্যন্ত শক্ত একটা ভিত্তি পেলো না। ছফার ঠিক স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই লেখা এই বইতে আমাদের দেশের বুদ্ধিবৃত্তির এই দৈন্যতার একটা সাধারণীকৃত সূত্রনির্দেশ পাওয়া যায়। তিনি এদেশে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা যারা করেন, তাদের মৌল চারিত্র্য যথাযথভাবে ধরতে পেরেছেন বলেই মনে করি। তাছাড়া, তাদের এই চারিত্র্যের পেছনের কার্যকারণকে তিনি স্পষ্টভাবে চিনতে পেরেছেন। স্পষ্ট কোন সমাধান তার বইতে আমরা পাই না; তবে সমস্যার মূল চিহ্নিতকরণের মধ্যেই সমস্যার সমাধানের ইঙ্গিত থাকে বলে যদি আমরা মেনে নেই, তাহলে এই বই পড়ে এটুকু বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা না যে, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় পাপেটের মতো ফাঁকা বুলি ক্রমাগতভাবে বলে যাওয়ার অভ্যেস ছেড়ে যে জল-হাওয়া-প্রকৃতির মধ্যে আমাদের বেড়ে ওঠা আর যেখানে আমাদের পরিণতি, এদের সাথে যখন থেকে আমরা আমাদের যাবতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের সুরসঙ্গতি করতে পারবো, সেই শুভক্ষণ থেকেই আমাদের প্রকৃত ও অর্থপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন শুরু হবে।
১৯৭২ সালে লেখা এ বই আজও আমাদের জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তির জড়তা নিরসনে এক ইশতেহারের ভূমিকা পালন করতে পারে।
আটাশ বছর বয়সী একজন তরুণ যুবা সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস লেখাটি পড়ে কতটুকু অনুধাবন করতে পারবে বা বোধগম্যতা অতিক্রম করতে পারবে সে প্রশ্ন যখন থেকে যায় তখন এটা ভেবে অবাক হতে হয় আটাশ বছর বয়সের এক নব্য তরুণ লেখক কতটা প্রাজ্ঞ হলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এরকম একটি মৌলিক চিন্তাধারার একটি লেখা লিখতে পারে যে লেখা কিনা দেশের ইতিহাস এবং রাজনীতি নিয়ে পরবর্তী সময়ে লেখা অনেক প্রবন্ধের মগজ বলে আমি মনে করি।
আহমদ ছফা সেই লেখক যিনি সময়কে কলমে ধরতে গিয়ে কোন 'ইজম' এর বৃত্তে থাকেননি এবং কোন মতাদর্শকেই ধ্রুব মনে করেননি।
মুক্তিযুদ্ধের পরের বছর বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস লেখাটি প্রকাশ হলেও প্রকাশকের অনুরোধক্রমে ১৯৯৭ সালে সিক্যুয়েল হিসেবে সাম্প্রতিক বিবেচনা নামে আরেকটি লেখা লিখেন। ২৫ বছর ব্যবধানে লেখা দুটি প্রবন্ধকে মানদণ্ড এমনকি সত্যাসত্যের বিবেচনায় এক সুতোয় ফেলাই যায়।
সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস বইটি পড়ে পাঠকমাত্র দেশের ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে অনেক মৌলিক চিন্তার খোরাক পাবেন। বইটি ইতিহাসপ্রিয় ও রাজনীতি সচেতন পাঠকের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিৎ।
৫১ পৃষ্ঠা জুড়ে Ranting করে যাওয়া ২৮ বছর বয়স্ক ছফা'র পক্ষেই সম্ভব।
কিছু কোটেশন মনে রাখার মতো। এছাড়া এ বইয়ের সার হলো - ১. বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা অসৎ, তোষামুদে, সুবিধাবাদী এবং ভীতু (যা আমরা জানি, কিন্তু কিছু করবো না)। ২. দেশে স্বকীয়তার চর্চা নেই, সবাই পরানুকরণেই ব্যস্ত (যা আমরা জানি, কিন্তু কিছু করবো না)। ৩. স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কাঙ্খিত সমাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো বিনির্মানে যথাযথ উদ্যোগ পরীলক্ষিত হচ্ছে না (যা আমরা জানি, কিন্তু কিছু করবো না)।
.... এই বইয়ে যেন নতুন কিছু নেই। আমাদের সর্বজনবিদিত জাতীয় চরিত্রর যে চিত্র এখানে তালগোল পাকানো কামানের গোলা ছুঁড়ে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন তার প্রকাশে ৪/৫ পাতার প্রবন্ধই যথেষ্ট ছিলো।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে যে নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, কতিপয় লোভী ও স্বার্থপর বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর কারণে স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই তা পরিণত হয় চাটুকারিতায়। তাঁদের বিরুদ্ধে আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১) কলম ধরেন। একটি দৈনিক পত্রিকায় লেখাগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে আহমদ ছফা লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশ করেন। বইয়ের নাম দেন 'সাম্প্রতিক বিবেচনাঃ বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস'। ১৯৭২ সালে লেখা এ বইটির প্রাসঙ্গিকতা আজও সচেতন পাঠক অনুভব করতে পারবেন।
Ahmed Sofa's "সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (Samprotik Bibecona: Buddhibrittik Notun Binnyas/ Contemporary Considerations: New Arrangement of Intellectualism)" isn't just literature—it's an intellectual Molotov cocktail. Written when Bangladesh was still bandaging its liberation war wounds, Sofa's dual essays (1972 and 1997) expose a scary truth: our "thinking class" didn't evolve in 25 years. 53 years ago, a 28-year-old writer called out Bangladesh's intellectuals for being opportunists, and the crazy part is, his words are still painfully relevant today. This isn't just a book—it's a wake-up call.
With forensic brutality, he dissects professors, writers, and journalists who swapped "Pakistan Zindabad" for "Joi Bangla" overnight. Each and every line from this book could be used as a relevant quote or reference, but the one that resonates most accurately with his accusations is: "আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়—প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন—সেও ঠেলায় পড়ে।" ("First Pakistani out of convenience, now Bengali under pressure."). His surgical strikes hit harder today, as he brands poets "the filthiest people" or mocks elites who worship foreign degrees while villages drown. Yes, he's extreme—his blanket dismissal of Western education is, in my personal opinion, shortsighted, and his fear of global books feels antiquated. But his core indictment terrifies: "If we'd listened to intellectuals, Bangladesh wouldn't exist. If we listen now, nothing will change." This is more than criticism; it's a call to root our intellect in Bangladesh's soil, not in empty slogans. 53 years later, as we scroll through performative activism online, Sofa's question still feels relevant: Have we traded colonial masters for intellectual laziness? This timeless critique of Bangladesh's post-independence intellectual class is a must-read for students, young readers, and adults, digging into the book's lasting relevance in Dhaka and beyond.
⁉️ 𝐐𝐎𝐓𝐃: Do intellectuals truly lead social change, or do they simply follow the prevailing currents of power and public opinion?
📌 Save if you appreciate fearless social commentary, want to explore the history of Bangladesh's intellectual landscape, or seek non-fiction that remains profoundly relevant decades after its publication.
🔔 𝐅𝐨𝐥𝐥𝐨𝐰 𝐦𝐞 for more bookish ramblings, reviews, and recommendations. 🔗 𝑮𝑶𝑶𝑫𝑹𝑬𝑨𝑫𝑺: Nazmus Sadat → goodreads.com/dsony7 📸 𝑰𝑵𝑺𝐓𝑨𝑮𝑹𝑨𝑴: @dSHADOWcatREADS
"আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়— প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন—সেও ঠেলায় পড়ে।" স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, কতিপয় কিছু সার্থপর ও লোভী বুদ্ধিজীবির কারণে কয়েক বছরের মধ্যেই তা পরিণত হয় চাটুকারিতায়।
নাম দেখেই বুঝা যায় বইটি দুই অংশে বিভক্ত। বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস রচিত হয় ১৯৭২ সালে।বইয়ের পরের অংশ সাম্প্রতিক বিবেচনা লেখা হয় ১৯৯৭ সালে। সেসময় একেবারেই তরুণ আহমদ ছফা। বাংলাদেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে।আহমদ ছফা থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনিবাসে। নিজের মতো করে যাচাই করলেন রাষ্ট্রকে। বিশেষ করে সেসকল ভন্ড বা সুবিধাবাদীদের যারা দেশের পরিস্থিতি মোতাবেক নিজেদের ভোল পাল্টে দেশপ্রেমিক প্রমাণ করতে চাইছেন, তাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল আহমদ ছফা'র কলম।
'বুদ্ধিজীবিরা কিছুটা সুবিধাবাদি' এই কথাতে ছফার প্রবল আপত্তি। তাঁর মতে বুদ্ধিজীবিরাপুরোপুরিই সুবিধাবাদি। অর্থাৎ যেখানে যখন সুবিধা সেখানেই তখন বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। তিনি বুদ্ধিজীবীদের নগ্ন রুপ উন্মোচন করেন এবং বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার দায়িত্বের স্বরুপ বর্ণনা করে, বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে তা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
গ্রন্থের প্রথম ভাগটিতে রাজনৈতিক দলের মধ্যে মুসলিমলীগ, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামপন্থী, জাসদ ইত্যাদি কোনটাই বাদ যায় নি সমালোচনা থেকে। বইটির পরের অংশে সাহিত্যিকদের সম্পর্কে সরাসরি বলে দিয়েছেন, " আমাদের কবি সাহিত্যিকেরা এদেশের সবচেয়ে নোংরা মানুষ। তারা দেশকে যেভাবে ফাঁকি দিয়েছেন, কোন কালাবাজারির সঙ্গে তার তুলনা হয় না।"
একটি জাতির বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, দেশের মাথা শ্রেণীর মানুষের যদি অধঃপতন হয় তাহলে সেই জাতির শিক্ষা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা কোথায় নামতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। হয়েছেও ঠিক তাই। স্বাধীনতার এক বছর পর অর্থাৎ ৭২ সালে দেশের অবস্থা যেমন খারাপ ছিলো, স্বাধীনতার ২৬ বছর পর, ৯৭ সালেও তেমন খারাপ, বিশৃঙ্খল অবস্থা! স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও এর অবস্থানের কি কোন পরিবর্তন হয়েছে?
বাংলাদেশে মৌলবাদ এর উত্তান। মৌলবাদ কিভাবে এদেশে প্রবলভাবে ছেয়ে গেছে? যে দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল অস্প্রদায়িকতার, সেখানে সাম্প্রদায়িকতার বীজ অঙ্কুরিত হয়ে কিভাবে মহীরুহ ধারণ করেছে? একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে এখনও মৌলবাদের ভয়ে শিঠিয়ে থাকতে হয় কেন! সংবিধানে গণতন্ত্র থাকলেও ব্যক্তিজীবনে কেন ইহার ছোঁয়া পায় না? এ প্রশ্নগুলোর কিছু উত্তর পাওয়া এই গ্রন্থে।
ছফা বলেন,আমাদের মন-মানস এতো দীর্ঘকাল ধরে দাসত্ব করেছে যে, তার হদিস আমরা নিজেরাও জানিনে। আমরা জানিনে জ্ঞানকে কতদূর সার্বজনীন করব, প্রযুক্তিবিদ্যার কি পরিমাণ প্রসার ঘটাব এবং বিজ্ঞানের ফলিত প্রয়োগ কতদূর নিশ্চিত করব । কোনটা আমাদের জন্য উপযুক্ত, কোনটা অনুপযুক্ত, কোনটা প্রয়োজন, কোনটা অপ্রয়োজন, কোনটা খেলে ভালো হবে, কোনটা খেলে খারাপ হবে, কোনটা করা উচিত, কোনটা করা উচিত নয় সে ব্যাপারে আমাদের শক্তিও নষ্ট হয়ে গেছে।
এখনো আমরা সেই গুনে ধরা, মরিচা পড়া কলুষিত সমাজ, সরকার আর লেজুড় বৃত্তির গোলকধাঁধা থেকে বের হতে পেরেছি কি? আহমদ ছফা বেঁচে থাকলে আর কোন পরিবর্ধিত সংস্করণ যোগ করতেন? কেমন ছিল ছফা'র বাংলাদেশের রূপরেখা, বাংলাদেশ কি সেখানে পৌঁছাতে পেরেছে? না আরও বেশি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে! তাঁর কথিত সেই "চিন্তা প্রকাশের অনুকূল পরিবেশ" কি সৃষ্টি করতে পেরেছে এই রাষ্ট্র? দেশের বুদ্ধিজীবিরা কি তাদের প্রকৃত অবস্থান থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে দেশ, সমাজ সংস্কারে মনোযোগী? না-কি চাটুকারিতায় নিরত! দেশের মানুষ কি আগের চেয়ে সংস্কৃতিবান হয়েছে? নাকি দিনদিন আরও গাঁড়লে পরিণত হচ্ছে?
বই - সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস লেখক - আহমদ ছফা
১৯৯৭ সালে আহমদ ছফা এ বইটির ২৫ তম সংস্করণ উপলক্ষে একটি দীর্ঘ ভূমিকা রচনা করেন যার শিরোনাম হল "পরিবর্ধিত সংস্করণের ভূমিকাঃ সাম্প্রতিক বিবেচনা। "। মজার বিষয় হচ্ছে বইয়ের ৯১ পাতার মধ্যে ৪১ পাতা জুড়ে রয়েছে সেই দীর্ঘ ফিরিস্তি।
অনেকগুলো কারণেই বইটা ভাল লাগলো। লেখক বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে কেন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প এখোনো বিদ্যমান এবং তাতে বুদ্ধিজীবি, সংস্কৃতিকর্মী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের দায় কোথায় সেটা একেবারে চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়েছেন। আজ এত বছর পরে এসেও সেই দায় থেকে তাদের রেহাই দেয়া যাচ্ছেনা। "আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণ নয়, প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন, তাও ঠেলায় পড়ে।" এই উক্তিটিকে চ্যালেঞ্জ করবার মত কেউ কী আছেন? স্বাধীনতার পরে সমাজতন্ত্র বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতিতে থাকলেও সেটা কেন কাজ করলোনা তার পেছনে বামপন্থীদের দায়গুলো কীরকম তার যৌক্তিক অনেকগুলো পয়েন্ট তুলে ধরেছেন। খুব ভাল লেগেছে 'আইয়ুব খান'কে ধুয়ে দিয়ে 'জঙ্গীলাট' উপাধি দেয়ায়। এর চেয়ে পরিশীলিত, শুদ্ধভাষায় গালি দেয়া মনে হয় আর সম্ভব না। স্বাধীনতা পরবর্তীতে জঙ্গীলাটের নীল নকশায় বোনা সামাজিক কাঠামো থেকে কেন আমরা বের হতে পারিনি, কেন মৌলবাদ অক্টোপাসের মত ক্রমাগতভাবে আমাদের সমাজের চারপাশে বেষ্টন করে ফেলেছে, কীভাবে সুবিধাবাদই বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল সেটাই তিনি তুলে ধরেছেন তার চিরচেনা স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে।
কিছু কারণে রেটিং কম দিতে হল। প্রথম কারণ যেসকল বুদ্ধিজীবি ও সংস্কৃতিকর্মীদের বিরুদ্ধে সুবিধাবাদিতার ও চাটুকারিতার অভিযোগ এনেছেন তাদের নাম, ধাম প্রকাশ না করে অভিযোগ তোলা। যদিও পরে অন্যত্র তথ্য পেলাম "দৈনিক গণকন্ঠ " নামক পত্রিকায় এই গ্রন্থটি ১৭ টি কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীতে, লেখাগুলোকে বইয়ের পাতায় আবদ্ধ করা হয় এবং পত্রিকায় উল্লেখিত তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের নাম পরিচয় মুছে বইটি প্রকাশ করা হয়। ঝামেলা হচ্ছে এতবছর পরে এসে সেই নামগুলো খুঁজে বের করা। আদমজি পুরস্কার কারা গ্রহণ করেছেন সে লিস্ট দেখে মাথা ঘুরান্টি দিল। যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই ৭১ এ শহীদ হয়েছেন। তাই অভিযুক্ত ব্যাক্তিগণকে বের করাটা দুরুহ হয়ে গেল। আর পুরস্কার পাওয়া মানেই তোষামদকারী সেটিও আসলে কতটুকু সত্যি সেটাও ভাবার বিষয়! দ্বিতীয় কারণ হার্ভার্ড কিংবা ক্যমাব্রিজ থেকে পড়ে আসলে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা যাবেনা সেটিও আসলে যুক্তি হিসেবে জোড়ালো নয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে দেশে এসে মানুষ সেখনকার তাত্ত্বিক জ্ঞান দেশে সরাসরি বাস্তবায়ন করবার কথা না। কারণ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হয় একেক দেশ বা অঞ্চলের সামাজিক কাঠামো বিশ্লেষণ করে সেখানে কী ভাল হবে সেটা নির্বাচন করার উপায়, যুক্তি খন্ডন কীভাবে করতে হয় সেসব। আরেকটা বিষয়, লোকরঞ্জনের জন্য বিদেশি (হোক তা পশ্চিমবঙ্গ কি আমেরিকা বা রাশিয়ান) বই বা পত্রিকা দেশে আসলে আর সেসব বই জনগণ বেশি পড়লে 'চেতনা থিতিয়ে যাবে'এইসব যুক্তির সাথে একমত নই মোটেই। বিশ্বায়নের এই যুগে যখন কিন্ডল, ইপাবসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম মানুষের হাতের নাগালে সেসময় এসব বইয়ের প্রসার নিয়ে তিনি কী বলতেন তা বড্ড জানতে ইচ্ছে হল!
এসব কিছু বাদ দিলে মুক্তভাবে চিন্তা করলে এটা অবশ্যই দারুন লেখা। জং পড়া মস্তিষ্কে শান দেবার জন্য পড়ে নেয়াই উচিৎ। অন্তত যুক্তিগুলো খন্ডাতে চাইলেও বইটা পড়তে হবে।
চমৎকার... কিন্তু "অসুংকুচে আমাদের সংস্কৃতির কতিপয় প্রখ্যাত মানুষের নাম-সাকিন উল্লেখ করতে পেরেছিলাম। কুৎসার প্রতি মানব সাধারণের মমতা তো সুবেধিত। বই আকারে বের করার সময় নাম গুলো ছেটে দিলাম।" এই কথা ভুমিকায় বলে নাম উল্লেখ করার দায়িত্ব প্রত্যাখ্যানকে লেখকের কপটতা বলে আমার মনে হয়েছে। নাম এবং রেফারেন্স গুলো অবশ্যই উল্লেখ করা উচিৎ ছিল। এমনি হাওয়ার উপর মানুষের সমালোচনা অনেকেই করতে পারে। প্রমাণ ধরে ধরে নাম উল্লেখ করে বলতে পারাটাকে বলে সাহসিকতা। যদিও যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন তাঁর জুড়ি মিলাই ভার এই বাংলায়।
একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে শেষ করলাম ঝরঝরে গদ্যে ছফার তীক্ষ্ম প্রবন্ধ সংকলন “সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস” সদ্যজাত রাষ্ট্রযন্ত্র তখনো প্রসববেদনায় কাতর যখন ছফা তার এই প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, ফার্মের মুরগির মতন নাদুসনুদুস বুদ্ধিজীবীদের ঝিঁমুনিতে দুলছিল একটি জাতির ভবিষ্যৎ। ভোল পাল্টে নতুন পতাকার নিচে আসলেও সেই বুদ্ধিজীবীদের মানসপটে থেকে যায় স্বৈরাচারীর দগদগে স্মৃতি। ভাতের ফেন নিয়ে কাড়াকাড়িতে যখন মত্ত জনগণ তখন নতুন নতুন গাড়ি হাঁকিয়ে টাকার পাহাড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে সুবিধাবাদী সম্প্রদায়। বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতা-অসাম্প্রদায়িকতা আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয় দেশ। তরুণ ছফা তার এই প্রবন্ধ রচনা করে সেই সুবিধাবাদীদের চক্ষুশূলে উন্নত হন, আজীবন তার চিন্তাযুদ্ধ চালিয়ে যান এদের বিরুদ্ধে। কয়েক দশক আগে রচিত এই গ্রন্থ আজও বিচ্ছিরি রকমের প্রাসঙ্গিক।
বইটার প্রত্যেকটা বাক্য কোট করার মত! হুমায়ুন আজাদ ছাড়া তার মতো এতো ধীমান লেখক কি স্বাধীন বাংলাদেশে ছিলেন? এতো চমৎকার গোছালো চিন্তাভাবনা! প্রবন্ধ প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৭২ সালে, অথচ এখনো কতটাই না প্রাসংগিক!
মুক্তিযুদ্ধের পর পর ১৯৭২ সালে বইটি বেরিয়েছিল। বাংলাদেশের ভেকধারী বুদ্ধিজীবীদের কোমরের লুঙ্গি একটানে খুলে দিয়েছিল বইটি। সমালোচনা, হতাশা, ক্রোধ পেরিয়ে, মুক্তবুদ্ধি ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে আধুনিক, গবেষণা ও উন্নয়নধর্মী দেশ গঠনের কিছু রূপরেখা তরুণ আহমেদ ছফা ঝড়ের গতিতে লিখে গেছেন।
এই ২০২৫ সালে এসে প্রবন্ধটি পড়ে মনে হলো তিনি গতকাল লেখাটি শেষ করেছেন। সবকিছু এখনও একইভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রতিটা লাইন, খাপের খাপ মিলে যায় আজকের সময়ের সাথে।
মনে হচ্ছে, অর্ধ শতাব্দীতে আমরা যেটুকু এগিয়েছি তার প্রায় পুরোটাই জনগণের স্বীয় মেধা ও স্বেচ্ছাশ্রমের কারণে এগিয়েছি। প্রাতিষ্ঠানিক, বুদ্ধীবৃত্তিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক সামগ্রিক আয়োজনের অবস্থার উন্নয়ন শূন্য। কিছুই আগায়নি। ছফা সাহেব বুদ্ধিজীবী সমাজ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা, গবেষণা, বিদেশের লেজুড়বৃত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে যে হতাশা ঝেড়েছেন বইতে, এখনের অবস্থা একদম একই রকম।
গত বছরের অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীদের গবেষণাটি এখানে ধর্তব্য, উনারা একটা দেশের সাফল্য এবং পতনের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। উনাদের গবেষণা বলে, একটা দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূপ্রাকৃতিক অবস্থা, মাটির উপরে-নিচে সম্পদের পরিমাণের সাথে সেই দেশের সাফল্যের সম্পর্ক কম। বরং তাঁদের মতে, কোনো দেশের উন্নতি বা পতন প্রধানত নির্ভর করে সেই দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপর। রাষ্ট্রযন্ত্রের এবং তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা শক্তিশালী ও পারদর্শী তার উপরে সব কিছু নির্ভর করে। যেমন, সুইজারল্যান্ডের বিশাল খনিজ সম্পদ বা সমুদ্রবন্দর না থাকলেও, দেশটির উন্নতির কারণ হলো দক্ষ প্রশাসন, শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান, গবেষণা ও উদ্ভাবন-ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা, এবং সাংস্কৃতিক বিনিয়োগ।
ছফা সাহেব ঠিক এই জায়গাটাতে ফোকাস করেছিলেন চুয়ান্ন বছর আগে লেখা বইটিতে।
সমাজে বিদ্যা, বুদ্ধি, বিজ্ঞান, সংস্কৃতী, রাজনীতির ভূমিকা কী সে বিষয়ে নিবিড়ভাবে চিন্তা-ভাবনা করেন, এরকম আধা ডজন মানুষও আমাদের দেশে নেই। এই না থাকাটা যে কতটুকু না থাকা; আহমেদ ছফার এই বইটাতে সেটাই তিনি ধারাবর্ণনা করার মত করে বলে গেছেন। বইটি অনেকের চিন্তাশূন্যতায় অভ্যস্ত মস্তিস্কে প্রবল ধাক্কার মত লাগতে পারে।
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রথম বই। ঐসময়কার সরকার, সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, শিক্ষক, ও সাংবাদিকদের সমালোচনা করা হয়েছে এই বইয়ে। সরাসরি নাম না নিলেও অনেক ক্ষেত্রেই আঁচ করা যায় তিঁনি কাদের নিয়ে লিখেছেন। আর সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো, লেখকের কথাগুলি আজকের সমাজেও এই তিন শ্রেণীর পেশাজীবি মানুষদের সাথে হুবহু মিলে যায়। কোন অধ্যায়/পর্ব/ভাগ আর ধারাবাহিকতা ছাড়া টার্গেটেড শ্রেণীর টানা সমালোচনা আমাকে হতাশ করেছিলো। ঋণাত্মকতার এক আঁকড় হচ্ছে এই বই। কিছু জায়গায় মনে হচ্ছিলো লেখক একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করছিলেন। লেখক তাঁর ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকেই লিখেছেন, এবং এর জন্য তাঁর আলাদা গবেষণার প্রয়োজন হয়নি - এটা তিনি গ্রন্থের শুরুতে নিজেই বলে দিয়েছেন। তবে ঐসময়কার আমাদের রাষ্ট্রের ও সমাজের যে প্রতিচ্ছবি তিনি আঁকতে পেরেছেন তার জন্য এই বইটাকে যথেষ্ট ভালো বলাই যায়।
Sofa roasting intellectuals is my new favourite genre আহমেদ ছফা তার সাম্প্রতিক বিবেচনায় যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী দেশের প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিজীবী সমাজের ভূমিকার ব্যাখা করেছেন। ১৯৭২ সালে তার রচিত বইটির সিংহভাগ বিষয়বস্তু অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে যাবার পরেও বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। মনে হচ্ছিলো ৭১ না চব্বিশের আন্দোলন ও পরবর্তী পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবী সমাজের চিরাচরিত চাটুকারিতা, কান্ডজ্ঞানহীনতা ও স্বার্থপরতা সম্বন্ধে ছফার উত্তাপিত কণ্ঠস্বর এটি। বইটির প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসে এলিট শ্রেণী ও বুদ্ধিজীবীদের হঠকারিতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ওরফে বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিকদের তুলোধুনো করে ফেলেছেন এই বইয়ে। এদের বিভিন্ন কার্যক্রম আমার-আপনার কাছে হয়তো খুব কম ইফেক্টিভ মনে হয়, এজন্য তাদের নিয়ে সমাজে উচ্চবাচ্চ কমই হয়। কিন্তু ছফা তার এই বইতে দেখিয়ে দিয়েছেন যে কিভাবে, এই ধরনের লোকজনের কাজ আমাদের সমাজে ইফেক্ট করে৷ বিভিন্ন সময়ে তাদের চুপ থাকা, সরকারের কথামত চলা এবং অবৈধ সুযোগ সুবিধার কাছে নিজেদের বিকিয়ে দেয়া, এগুলা যে আমাদেরকে শতবছর পিছিয়ে দিচ্ছে এবং ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাড় করাচ্ছে তার একেবারে খুল্লাম খুল্লাম বিবরণ উঠে এসেছে এখানে।
সকল বাঙালি-বাংলাদেশি, বিশেষ করে আমাদের পাঠক সমাজ, লেখক সমাজ, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সকলের বইটি পড়া উচিত। লেখক যে সব সমস্যার উল্লেখ করেছেন সৎ চিত্তে আর বিনা দ্বিধায়, পাঠক হিসেবে শুধু মনে হয় দেশে আরও কিছু ছফার বড্ড প্রয়োজন ছিল। ৫/৫ রেটিং দিলুম বটে , কিন্তু আমার মতে এ ধরণের বইকে কখনো রেটিং এ বাধা যায় না।
বার বার পড়বার মতন। যদিও লেখক যখন লেখেন প্রবন্ধটি তখন বয়সে কাঁচা, নিতান্তই তরুন। কিন্তু চিন্তার স্বচ্ছতা, দৃঢ় ও নির্ভীক লেখনি খোরাক যোগায় চিন্তা এবং প্রশ্নের। নির্লজ্জ সত্যগুলো সেই সমাজে যা ছিল, এই সময়ের সমাজেও ঠিক একইভাবে পরিলক্ষিত। বরং একটু বেশিই যেন বেড়ে গিয়েছে, মেরুদণ্ডহীন ভেড়ার ছাল গায়ে নেকড়েরুপী পোষা প্রগতিশীল ব্যাক্তিবর্গের সংখ্যা।
প্রবন্ধকার হিসেবে আহমদ সফা যে সেরা তার কোন সন্দেহ নেই। তাই বরাবরের মতই এই বইটিও ভালো লেগেছে। বইটি আমি অডিও হিসাবে শুনেছি, পাঠকের বচনভঙ্গি ভালো হওয়ায় বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু অডিও শুনে অভ্যস্ত না থাকায় মন ভরেনি। তাই পরবর্তীরে পড়ার ইচ্ছা আছে।