জননী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ও উপন্যাস। এটি লেখকের প্রথম উপন্যাস যা কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি, গ্রন্থাকারেই প্রথম মুদ্রিত হয়।
Manik Bandopadhyay (Bengali: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়) was an Indian Bengali novelist and is considered one of the leading lights of modern Bangla fiction. During a short lifespan of forty-eight years, plagued simultaneously by illness and financial crisis, he produced 36 novels and 177 short-stories. His important works include Padma Nadir Majhi (The Boatman on The River Padma, 1936) and Putul Nacher Itikatha (The Puppet's Tale, 1936), Shahartali (The Suburbia, 1941) and Chatushkone (The Quadrilateral, 1948).
জননী একজন মায়ের জীবনকথা। সূচনা থেকে পূর্ণতা পর্যন্ত। কাহিনীর শুরুতে আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় এক জননীর সাথে পরিচিত হই, তার নাম শ্যামা। তাকে আমাদের অসহায় মনে হয়, কারণ তার স্বামীটিকে ভরসা করার মত লোক মনে হয় না, যার মাথার নাট-বল্টু ঢিলা। অনেক উত্থান-পতন পেরিয়ে শ্যামা তার সন্তানদের জীবন গড়ে, স্বামীকে মমতা দিয়ে ধরে রাখে।
শ্যামা নিজেই বলে, সে আছে বলেই এই সংসার টিকে আছে, না থাকলে ভেসে যেত। "আমার জন্যই সংসারটা টিকে আছে" কথাটা প্রায় সব বাঙালি গৃহিণীকেই বলতে শোনা যায়। তবে কথাটা সর্বক্ষেত্রে চাপাবাজি নয়, অনেকের ক্ষেত্রেই সঠিক (মিলেনিয়ালদের ক্ষেত্রে আমার মন্তব্য প্রযোজ্য নয়, একুশ শতকে বাঙালি পরিবারে নারী-পুরুষের ভূমিকায় অনেক পরিবর্তন এসেছে)। যত ত্যাগ শিকার করে শ্যামার মত গৃহিণীরা একটা পরিবার আগলে রাখেন, সেটা বিস্ময়কর। তাই শ্যামার জীবনকাহিনী বিংশ শতাব্দীর সকল ত্যাগী বাঙালি জননীর জীবনকাহিনীর প্রতীক, "জননী" বাংলার মায়েদের কিংবদন্তীর কথা।
উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্যামার উপরেই ফোকাস রেখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্যামার স্বামী, সন্তান, অন্যান্য আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদেরকে তিনি দেখিয়েছেন শ্যামার দৃষ্টিকোণ থেকে। পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি রেখে শ্যামা চরিত্রের কত রকমের দিক আমরা পাঠক হিসেবে আবিষ্কার করি। মমতাময়ী মা, রক্ষাকারী গৃহিনী, ত্যাগী স্ত্রী, কখনও অকৃতজ্ঞ, কখনও স্বার্থপর নারী, কখনও কর্কশ, কখনও কোমলহৃদয়, কখনও কুসংস্কারগ্রস্ত, কখনও ঈর্ষাকাতর,..., শ্যামা চরিত্রের কত রকমের শেড মানিক ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর লেখনীতে। মানুষের জটিল সাইকোলজি, যখন-তখন পালটে যাওয়া মেজাজ সবকিছু নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। "জননী"কে একটা লাইফ সাইজ রিয়ালিস্টিক পেইন্টিংয়ের সাথে তুলনা করা যায়, যেখানে শ্যামাকে কেন্দ্রভাগে রেখে বাকিরাও যথাযথ গুরুত্ব নিয়ে অবস্থান করছে। তবে রিয়েলিস্টিক পেইন্টিং অনেক শিল্পীই করতে পারেন, কিন্তু উপন্যাসে বাস্তবতা ধরে রেখে এমন মহান জীবনকাহিনী রচনা করতে পারেন কয়জন? মানিক পারেন, তিনি বিস্ময়কর।
"স্বামী আর আত্মীয়স্বজন শ্যামার সেবা লইয়াছে। সন্তান লইয়াছে সেবা ও স্নেহ। প্রতিদানে সেবা শ্যামা চায় না। আজ শ্যামাকে কেহ একটু স্নেহ দাও?" জননীদের জীবন কত বিচিত্র! কত সহজ চাওয়া! এতোই সহজ চাওয়া যে কেও পূরণ করার প্রয়োজনও বোধকরি খেয়াল করে না ।
দীর্ঘ সাত বছর পাগলপ্রায় স্বামীর সাথে সংসার এবং মাতৃত্বলাভের প্রাণপণ প্রয়াসের ব্যর্থতা শ্যামাকে প্রায় কাবু করে ফেলেছিল। এতো সাধনার পর প্রথম সন্তানের বারোদিনের মাথায় মৃত্যু তাকে আরও গভীর দুঃখে দুঃখী করে তোলে। পরবর্তীতে চারটে সন্তান জন্ম দিলেও প্রথম সন্তান হারানোর শোক তার আজীবন থেকে যায়। আত্মীয় বলতে একমাত্র মামা ছাড়া আর কেও নেই৷ সেই মামাও কোথায় নিরুদ্দেশ কেও জানে না। টাকা চুরির দায়ে তার স্বামী জেলে। জননী শ্যামা তার সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আঁতকে ওঠে। উপায়ান্তর না পেয়ে আত্মীয়তার সূত্র ধরে নিজের ঠাকুরঝির বাড়িতে আশ্রয় নেয় নিজের ছেলে মেয়ের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবারের আশায়। সারাদিনরাত্রি ঝিয়ের মতো খেটে, কোনোরকমে বেঁচে থেকে রাতে শুয়ে শুয়ে বড় ছেলেকে নিয়ে আশা বাঁধে। ছেলে বড় ভালো পড়াশোনায়। একদিন ছেলের হাত ধরেই তার সমস্ত কষ্ট দূর হবে। জীবনের তিনভাগ কেটে গেল শ্যামার, এর মধ্যে একদিনও সে বিশ্রাম পাই নাই। দেহের বিশ্রাম নয়। দেহ তার ভালোই আছে, বিশ্রাম পায় নাই তার মন। এখন তার একটু সুখ, শান্তি ও স্বাধীনতার প্রয়োজন। শুধু পরের আশ্রয় থেকে এবার তাকে মুক্তি দিয়ে ভবিষ্যতকে একটু নিরাপদ করে দাও, আর একটু স্নেহ দাও শ্যামাকে। একটু নিঃস্বার্থ অকারণ মমতা। এইটুকুই চাওয়া। এই তো, এর বেশি একজন জননীর আর কি বা চাওয়ার আছে!
২০০৮ সালের জন্মদিনে বুলবুল মামা মুহম্মদ জাফর ইকবালের রঙিন চশমা বইটা উপহার দিয়েছিলেন। একটা গল্প অসম্ভব ভালো লেগেছিল। একদিন বইয়ের দোকানে ঘুরঘুর করতে গিয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবালের চোখে পড়ে অনেকগুলো ঝকঝকে মোটা মোটা বই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমপ্লিট সাহিত্যকর্ম। পুরো সেটের দাম তিনশ টাকার মতো। তাঁদের কাছে তখন এতোগুলো টাকা দিয়ে বই কেনা অসম্ভব পর্যায়ের ব্যাপার। তবু তিনি বাসায় এসে তাঁর ভাই-বোনদের কাছে বইগুলোর গল্প করেন, শুনে শুনে সবাই তাঁরই মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিকেল বেলা মা কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেন, যা কিনে নিয়ে আয় তোর মানিক গ্রন্থাবলী। তিনি ছুটে বের হয়ে যান, তাঁর শুধু মনে হতে থাকে কোনো বিরাট বড়লোক গাড়ি হাঁকিয়ে বইগুলো নিয়ে চলে যাচ্ছে। তেমন কিছু হয় না, তিনি বইগুলো কিনে আনেন এবং এরপর কিছুদিন সব ভাইবোনের হাতে একটা করে মানিক দেখা যায়!
সেই তখন থেকে মানিক পড়ার ইচ্ছে মাথায় ঢুকে গেছে। কিন্তু লজ্জাজনক ব্যাপার, কলেজে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ ছাড়া মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আর কোনো লেখা পড়িনি। আমার এক বন্ধু প্রায়ই বলেন মানিক পড়তে। রাঙাও বলে। কিন্তু ভালো প্রিন্টের মানিক খুঁজে পাই না, তাই পড়তেও ইচ্ছে করে না। (খুব এলিটিস্ট মার্কা কথা, ভালো প্রিন্টের বই কেনার বিলাসিতাটুকু করার সুযোগ এখন হয়েছে, তাই এটুক করি।) যাহোক, এবার ঈদের শপিং করেছি বই। ঘটনাক্রমে সেদিনই আবারো ‘চতুস্কোণ’ পড়ার সাজেশন পেলাম। বাতিঘরের ওয়েবসাইটে মানিক লিখে সার্চ করতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঁচটি উপন্যাস বইটা চোখে পড়ল। স্টক চেক করে দেখি আছে। তবু বিশ্বাস হচ্ছিল না কিন্তু সত্যিই পেয়ে গেলাম! পাঁচটা উপন্যাস হলো ‘জননী’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ আর ‘চতুষ্কোণ’। পাবলিকেশনের অর্ডারে সাজানো।
আজ ‘জননী’ পড়া হলো। শুরু থেকেই চরিত্রগুলোর চিন্তা-ভাবনা, আচরণ আর সম্পর্ক বিশ্লেষণ পড়ে খুব অবাক হয়েছি। ‘জগতে কারও স্নেহে যে কারও দাবি জন্মে না এটা সে জানিত না।’ কী নির্মম সত্য। আর কত কম কথায় বলে ফেলা! ‘মানুষের জীবনে অভাবের পূরণ আছে ক্ষতির পূরণ নাই’ এই কথাটা কি ভয়ানক। সত্যি তো, একবার ক্ষতি হলে কিছু দিয়েই কি তা ফেরানো সম্ভব? না তো!
শ্যামার মতো অস্নেহে, অপরিচর্যায় সারাজীবন খেটে যাওয়া কতজনকে আমরা জানি? নেহাত কম মানুষ নয়। কিন্তু তাদেরও যে গল্প আছে, তাদেরও যে কথা আছে সেটা কী ভেবেছি? হয়তো। তবে খুব কম সময়ের জন্য। মা শুধু মা বলে তার কোনো ত্রুটিকে তুচ্ছ জ্ঞান না করার বিষয়টি আমার কাছে জননীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে হলো। যদিও উপন্যাসের নাম জননী, একজন মানুষ হিসেবে শ্যামার সবটাই যেভাবে দেখতে পাই, সে-ই সবচেয়ে অসাধারণ। আপাতত আর কিছু বলার নেই। এতদিন পড়িনি বলে এখন ভালো লাগছে, এমন অদ্ভুত সুন্দর ট্রেজার তোলা ছিল! খুব ভালো লাগা কথা : “মানুষের আশা এমন ভঙ্গুর নয় যে একবার ঘা খাইলে চিরদিনের জন্য ভাঙিয়া পড়িবে। তবু আশাতেই আশঙ্কা বাড়ে।”
"......সুবর্ণকে শ্যামা যেন বুকের মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়া একটা দিনের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল, কোথায় গেল ক্ষুদ্র বিদ্বেষ, তুচ্ছ শত্রুতা! সুবর্ণের জীবন লইয়া শ্যামা যেন বাঁচিয়া রহিল। তারপর এক চৈত্র নিশায় এ বাড়ির যে ঘরে শ্যামা একদিন বিধানকে প্রসব করিয়াছিল সে ঘরে সুবর্ণ অচৈতন্য হইয়া গেল, ঘরে রহিল কাঠ কয়লা পুড়িবার গন্ধ, দেয়ালে রহিল শায়িত মানুষের ছায়া, জানালার অল্প একটু ফাঁক দিয়া আকাশের কয়েকটা তারা দেখা গেল আর শ্যামার কোলে স্পন্দিত হতে লাগিল জীবন।"
জন্ম কি শুধুই সন্তানের হয়, নাকি প্রতিটা সন্তানের জন্মের সাথে সাথে জন্ম নেন একজন-দুজন, তিনজন বা আরো বেশি মা? মাতৃত্ব কী শুধুই সন্তানের জন্মের সাথেই জন্ম নেয়, নাকি একটা ক্ষীণ সন্দেহ, ছোটো একটা আশাই জন্ম দেয় মাতৃত্বের? জননী শব্দটা এমনিতেই ভারী। কিন্তু এর ভার কী জননীর অর্থের চেয়েও বেশি?
এই গল্পটা শ্যামার। সন্তানহীন বিপত্নীক শীতলের দ্বিতীয় স্ত্রী শ্যামা। সে নিজেও সন্তানহীন ছিল বিয়ের পরের সাত বছর। তারপর এক সন্তান সে পেল। কিন্তু সেই সন্তান মাত্র বারো দিনের ভ্রমণ শেষে পৃথিবীকে ছেড়ে গেল। এরপর আবারো অপেক্ষা। সেই অপেক্ষার পালা ঘুচিয়ে একদিন এলো বিধান, আর তার পরে আরো কয়েকজন। বধূ শ্যামার তখন জননী শ্যামা।
গল্পটা শেষ হয়নি এখানেও। ফুল ফোটানোতেই কী গাছের কাজ শেষ? সেই ফুল একদিন ফলে পরিণত হবে, তবেই না গাছ তার দায়িত্ব শেষ করে নতুন প্রাণের আহ্বানে স্বীয় সন্তানকে মাটির হাতে সমর্পণ করে? গল্পটাও এগিয়ে গেছে। সন্তানদের বড় করা, তাদের পূর্ণ করার লক্ষ্যে শ্যামার লড়াইয়ের গল্প এটা।
মানিকের লেখনী নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। মানিক যে শুধু নামেই না, কাজেও মানিক ছিলেন তার আরেক প্রমাণ এই বই। মানিকের অন্যান্য লেখার মতই অসাধারণ মনোবিশ্লেষণ আর বাস্তবতা এই লেখাতেও উপস্থিত। এর আগে শওকত ওসমানের জননী পড়েও মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু গ্রামীণ পটভূমিকায় লেখা সেই উপন্যাসকে কিছুতেই নিজের অভিজ্ঞতা ফিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারছিলাম না। শহুরে পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাস আমার দৈনন্দিন ছোটোখাটো সব অভিজ্ঞতাকেও ধরতে পেরেছে। ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে আমার ভালো লাগার মাত্রাটা এই কারণেই বেড়েছে বহুগুণে।
সব মিলিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে ভালো বই, ভালো লাগার মত বই। পড়ে ফেলতে পারেন।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের একদম শুরুর দিকের উপন্যাস এটি। পরের দিকে মানিক তাঁর উদ্ভাবিত নিজস্ব স্টাইলে মানুষের মনের দূরতম অন্দরমহলে গভীর সার্চলাইট ফেলে পর্যবেক্ষণ করতেন, কিংবা প্রচলিত বাংলা উপন্যাসের গঠন থেকে সরে এসে নিজের লেখাতে নিরীক্ষা আর নতুনত্ব নিয়ে আসতেন ; কিন্তু এই উপন্যাসে সেই ট্রেডমার্ক মানিক কিছুটা অনুপস্থিত। তবু একটা দিক দিয়ে এই উপন্যাস আমাকে ভাবিয়েছে, তা হলো মানিকের তীব্র তীক্ষ্ণ রিয়েলিজম।
জননী মানেই তো নিঃস্বার্থ, দরদী, ভালোবাসার অপার আশ্রয়— পৃথিবীর সব মা যেমন হয়ে থাকেন— সাহিত্যে! মানিক এইসব চিরাচরিত রোমান্টিসিজমকে নিজের সাহিত্যজীবনের শুরু থেকেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। 'জননী' উপন্যাসের শ্যামা নামের মুখ্য চরিত্রটি দোষে-গুণে, ক্রোধে-কান্নায়, লাজে-ভয়ে, স্বার্থপরতায়-স্বার্থহীনতায়, আহ্লাদে এবং অভিসম্পাতে, বুদ্ধি এবং নির্বুদ্ধিতায়, চালাকি এবং চতুরতায়, শোকে এবং সাবধানতায়— সব দিক দিয়ে একজন রক্তমাংসের জ্যান্ত মানুষ। নিছক সস্তা বাঙালি সেন্টিমেন্টের ধার ধারেননি মানিক। জীবনের শুরুতেই ঘোষণা করেছেন : আমি এসে গেছি পাঠক, আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুত তো?
আধুনিক "ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যাওয়া" পাঠকদের কাছে ত্রিশের দশকে রচিত এই উপন্যাসের অনেক কিছুই আপত্তিকর মনে হবে। রমণীর অচ্ছেদ্য পতিপ্রেম (তা হোক-না সেই পতিদেব একজন মার্কামারা অপদার্থ এবং শারীরিক অত্যাচারকারী), কিংবা ভাগ্যের হাতে মেয়েদের অসহায় আত্মসমর্পণ, কিংবা সংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষের হৃদয়— এইসব দেখে অনেকে ভয়ানক অপমানিত বোধ করতে পারেন। কিন্তু সমাজ তো তখন এমনই ছিল (এখনও যেন কতো শুধরেছে!)। লেখকের কাজ "আদর্শ সমাজ"-এর রূপরেখা ফুটিয়ে তোলা নয়, সমাজে ঠিক যেমনটা দেখা যায় তেমনটা পাঠকের সামনে তুলে ধরা— উপন্যাসটি পড়ার সময় এটা ভুলে গেলে চলবে না। আমি মাঝেমাঝে ভুলে গিয়ে ভীষণ অপমানিত বোধ করছিলুম, তারপর আবার নিজেকে বোঝাচ্ছিলুম, চিল ব্রো, এটাই তো স্বাভাবিক চিত্র।
বহু বছর আগে পড়েছিলাম এই উপন্যাসটা। সেই অল্প বয়েসে কী যে বুঝেছিলাম কিছুই মনে নেই। এবার আবার পড়তে গিয়ে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের অসামান্য চরিত্র-বিশ্লেষণ দেখে অবাক হলাম। কেমন অন্ধকার গোপন গহীন ফাঁকফোকরে পোকামাকড়ের সূক্ষ্ম নড়াচড়াও খুঁটিয়ে দেখবার নজর ছিল তাঁর! মানুষের মনের পোকামাকড়।
স্বতই বিমর্ষ হয়ে ভদ্রসাধারণ চেয়ে দ্যাখে তবু সেই বিষাদের চেয়ে আরও বেশি কালো-কালো ছায়া লঙ্গরখানার অন্ন খেয়ে মধ্যবিত্ত মানুষের বেদনার নিরাশার হিসাব ডিঙিয়ে নর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজে উঠে নর্দমায় নেমে— ফুটপাথ থেকে দূর নিরুত্তর ফুটপাথে গিয়ে নক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা মরে যেতে জানে। এরা সব এই পথে ওরা সব ওই পথে— তবু মধ্যবিত্তমদির জগতে আমরা বেদনাহীন— অন্তহীন বেদনার পথে।
কত কথা শ্যামার বলিবার ছিল, কত হিসাব কত পরামর্শ কিন্তু এক অসাধারণ নীরবতায় সব চাপা পড়িয়া রহিল ---সারাটি জীবন ধরে শ্যামা, জননী শ্যামার এই যে পরিবর্তন, রূপান্তর কী অসাধারণ এক প্রকাশভঙ্গিই না পেয়েছে। মাতৃত্বের সমস্ত অনুভূতি, মহিমা কী বাঙময়-ই না হয়ে উঠেছে এই আখ্যানে!
প্রকাশকাল অনুযায়ী 'জননী' মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম পূর্নাঙ্গ উপন্যাস। আদ্যোপান্ত শ্যামার জীবনের গল্প। অবশ্য কেবল গল্প বললে এই রচনার খানিকটা অবমাননা করা হয়। 'জননী' এক সদ্য বিবাহিতা বালিকার মা হয়ে ওঠার মহাকাব্যিক উপাখ্যান। পরিণত সংসারের মূল কান্ডারী হওয়া এক মায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। মানিকের সুনিপুণ লেখনীর জোরে স্রোতস্বিনী নদীর ন্যায় কাহিনী এগিয়ে চলে, গড়িয়ে যায় বছরের পর বছর। ঋতুচক্রের গতিময় চালচলনের সাথে পাল্লা দিয়ে, শ্যামার জীবনে আসে সুখের পরশ, আসে ততোধিক কষ্ট, দরিদ্র ও পীড়ার বিষ দংশন।
দিগন্তবিস্তৃত এই রচনার ভাষা সুন্দর ও ভীষণ মায়ামাখা। পূর্বের 'দিবারাত্রির কাব্যের' মতন তাত্ত্বিক বা দার্শনিক না হলেও, মানিকের গদ্যের সচ্ছতা এখানেও উপভোগ্য। বারংবার ভাবতে উদ্যত করে, কিভাবে কেবল পঁচিশ বছর বয়সে লিখলেন এই উপন্যাস। কিভাবে যৌবন ও তারুণ্যে আবেষ্টিত মায়াকাননে বসে, রচলেন এক নারির জীবনের এমন সুচারু প্রতিকৃতি। শ্যামার মমতা, ভালোবাসা, বিদ্বেষকে ক্যানভাসে ধরে, মাতৃত্বের বহুমাত্রিক প্রতিচ্ছবি আঁকলেন মানিক। শ্যামা সেখানে কখনো বাঘিনী ন্যায় হিংস্র, কখনও নিরর্থক খল-পবৃত্তির আবার কখনো বা ভীষন করুণার পাত্রী। জননী শব্দটির প্রকৃত ভার, আর অজস্র জটিল সংজ্ঞা কলমের কালির প্রতিটি আঁচড়ে অমর করে গিয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
শ্যামার মত নিস্বার্থ জননীদের আমরা কি সকলেই চিনি না? আমাদের চারিপাশে চার দেওয়ালের পরিধির মাঝে, এদের কে প্রায়শই যে দেখা যায়। শ্যামারা তাই সকলেই নিজগুণে এক একটি পূর্ণ উপন্যাস। এদের সবাইকে নিরবে নিভৃতে পড়ে দেখবার সময় বা বিলাসিতা কোনোটাই আমাদের থাকে না। 'জননী'র হাত ধরে সেই আশা কিছুটা হলেও পূর্ণতা পেয়েছে।
অসাধারণ। নিত্যকার আটপৌরে জীবনের ছোট বড় সব ঘটনা বিশ্লেষণে মানিকের অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে আলাদা করে কিছু বলবার নেই আর। খুবই ভালো লাগার মত একটা উপন্যাস। এর মধ্য দিয়ে অনেকদিন পর বাংলা ক্লাসিক পড়ায় ফিরলাম। ভালো সিদ্ধান্ত ছিলো।
এক জননীর জীবনকাহিনী। বিয়ের পর হতে শুরু করে সন্তানসন্ততির জন্ম, এবং তাদেরকে লালন-পালন করে বড় করে তুলতে গিয়ে, এক জননীর পরিবার সামলাতে কতটুকু ত্যাগ এবং জীবনযুদ্ধের মধ্যে দৌড়াতে হয় তা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করা যায়। স্বামীর অকাল পঙ্গুত্বের ফলে সুখী পরিবারের যে হাল হয়, তা ছেলে বড় হয়ে চাকরি করে আর্থিক কষ্ট হতে মুক্তিলাভের চিন্তাটুকু ভালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এককথায় অসাধারণ ছিল। জাস্ট রিড।
বই টা যখন পড়ি , আমার বাচ্চা ৬ মাসের এর কম বয়স। আমার বুকে এমন ধাক্কা লেগেছিলো কিভাবে লেখক একজন মা না হয়ে, মায়ের মনের কথা গুলো এত্ত দারুন ভাবে লিখেছেন। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। সারাজীবন মনে থাকবে আমার সেই আতুর ঘরের ঘটনা টা।
আমার কাছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিল এক ভয়ের নাম, পাঠ্য বইয়ে 'পদ্মা নদীর মাঝি' অবশ্য পাঠ্য হওয়ার কারনে। কথাটা কবিগুরু এবং বিদ্রোহী কবির ক্ষেত্রেও খাটে। পরবর্তীতে মানিকের 'পুতুলনাচের ইতিকথা'র মাধ্যমে নিজের ভুল ভাঙে। তখন থেকে মানিক বলতেই পাগল। 'জননী' উপন্যাসের মধ্য দিয়ে খুজে পাই বাংলার চিরায়ত মা সমাজকে। যারা সংসার জীবন শুরু করার পর থেকেই নিজের জীবনের সব কিছু তুচ্ছ করে সংসারকেই নিজের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান মনে করে পার করে দেন একটি সম্পূর্ণ জীবন। সংসার নামক জাঁতাকলের ফলে বুঝতেও পারেননা সময়ের আবর্তনে কোন ফাঁকে তাঁরা কৈশোর-যৌবন পার করে চুলে পাঁক ধরিয়ে ফেলেন। অথচ স্বামী, সন্তান ও সংসারের কথা ভেবে নিজের মনের ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো পর্যন্ত পূরণ করার সুযোগ পাননা। আহা! জননী!
সাত বছর ধরে আধ-পাগলা স্বামী শীতলের ঘরে অনুর্বরা থেকে শ্যামা প্রথম যখন মা হলো তখন একটু অদ্ভুত কৌতূহল আর আহ্লাদে শ্যামা দিশেহারা হয়ে উঠছিলো। কিন্তু বারো দিনের মাথায় শ্যামার সমস্ত স্নেহের ভাষা বোকা হয়ে গেল। ছেলেটি মারা গেল।
অতঃপর শ্যামা আবার মা হলো। প্রথম সন্তানের মৃত্যু তার দ্বিতীয়বার মা হবার উচ্ছ্বাসকে অনেকটাই স্মীত করে দেবার চেষ্টা করলেও তাদের মাতৃসত্ত্বাকে পরাজিত করতে পারলো না। সারারাত সে ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে। নাহ জানি কখনো আবার অন্ধকার এসে তার ছেলেটিকে তার কাছ থেকে গ্রাস করবে। কিন্তু এবার শ্যামার মাতৃত্ব দীর্ঘস্থায়ী হলো। এক এক করে শ্যামা চার সন্তানের জননী হলো। সংসারে অভাব নাহ থাকলেও সন্তানদের ছোট ছোট ইচ্ছা পূরণ করাই শ্যামার বিলাসিতা। ছেড়া শাড়ী পরেও শ্যামার নজর থাকত তার সন্তানের ভাল পোষাকের উপর, আধপেটা খেয়েও তার ইচ্ছে হতো ছেলেমেয়েদের কি করে আর একটু ভাল খাওয়ানো যায়।
এক দিন তার স্বামী শীতল মালিকের টাকা চুরি করে জেলে গেল। শ্যামা তার চারটি সন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে ননদের বাড়িতে আশ্রয় নিলো। জীবনের নতুন মোড়ে শ্যামার অসহায়ত্বের সব সীমা ছাড়িয়ে গেল। সন্তানদের একটু ভাল খাবার মুখে তোলার অভিপ্রায়ে শ্যামা চুরি করতেও পিছপা হলো না, নিজের সবটুকি উজাড় করে শ্যামার সন্তানদের জন্য হার না মানার লড়াই চলতে লাগত। কিন্তু শ্যামা কি পেরেছিলো, তার সন্তানদের এমন এক স্থানে পৌছে দিতে যেখানে ক্ষুধা আর একটু সহানুভূতির জন্য চোখের জল ফেলতে হয় না।
জানতে হলে মাকে নিয়ে লেখা এই অসাধারন উপন্যাসটি আর জানতে হবে এক মায়ের আত্নত্যাগের গল্প
বইটা শেষ করলাম। পড়তে খুব কষ্ট হয়েছিলো কারণ মনমানসিকতা খুব ভালো ছিলোনা। তবে বইটা পড়া শেষ করে এখন ভালো লাগছে। জীবন যে কত বৈচিত্র্যময় তা ভালোভাবে উপলব্ধি করেছি বইটা পড়ে। সুখপাঠ্য ছিলো বলা যায়।
উচ্চ মাধ্যমিকে থাকতে বাধ্য হয়ে “পদ্মা নদীর মাঝি” পড়তে হয়েছিলো বলে খুশি মনে পড়তে পারিনি। উপন্যাসের রসাস্বাদনও তাই করা হয়নি। কিন্তু সেই উপন্যাস দিয়েই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে আমার পরিচয়।
“পদ্মা নদীর মাঝি”কে ব্যবচ্ছেদ করে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখতে হতো বলে মানিকের উপর থেকে মন উঠে গিয়েছিলো। নাম শুনলেই বিরক্ত লাগতো। একই কাণ্ড ঘটেছিলো জহির রায়হান, মুনির চৌধুরী, অদ্বৈত মল্লবর্মণের সাথে। যাদেরই লেখা পাঠ্যবইয়ে ছিলো, তাদের সাথেই একটা বিরক্তির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো আমার। যা হোক, প্রায় ৯ বছর পর হঠাৎ করে মানিকের “পুতুল নাচের ইতিকথা” পড়তে মন চাইলো। কারণ ততদিনে বিরক্তি ভাব অনেকাংশে কমে এসেছে। তাছাড়া অনেক প্রশংসাও শুনেছি উপন্যাসটার। পড়েই দেখি না, কী যাদু আছে!
সেই থেকে শুরু। মজে গেলাম মানিকে। তিনি হয়ে গেলেন “আমার মানিক”। আমার পড়া শ্রেষ্ঠ প্রেমের উপন্যাসের (এখনও পর্যন্ত) একটা হয়ে গেলো “পুতুল নাচের ইতিকথা”। এই উপন্যাস পড়ার পর বেশ কয়েকমাস আমি অন্য প্রেমের উপন্যাস ধরতে পারিনি, এতোটাই হ্যাংওভারে ভুগছিলাম। যা হোক, সম্প্রতি শেষ করলাম মানিকের “জননী” উপন্যাসটি। উচ্চ মাধ্যমিকে থাকতেই আমার এক পড়ুয়া বন্ধু “জননী” পড়তে পড়তে বলেছিলো, “নিঝু, দেখো মানিক কী গভীর একটা ডায়ালগ দিয়েছে! ‘লোকটা স্নেহ করে, কিন্তু স্নেহের প্রত্যাশা মিটায় না’”। বলা বাহুল্য, সে সময় আমি ডায়ালগটার গভীরতা পুরোটা অনুভব করতে পারিনি। কিন্তু আজ দশ বছর পর উপন্যাসটা পড়ে বন্ধুর ব���স্ময়ের কারণটা ধরতে পারি।
“জননী” উপন্যাসের নায়িকা শ্যামাকে আমার লেগেছে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “মানবজমিন” উপন্যাসের নায়িকা তৃষার মত। এক হাতে সামলাতে হচ্ছে সংসারের যাবতীয় বিষয়, হাজব্যান্ড যেন থেকেও নেই। একাকী, নিঃসঙ্গ এক কিশোরী বধূ কখন যে তরুণী, যুবতী কিংবা মধ্যবয়স্ক নারী হয়ে উঠলো, আমরা তার ভাগগুলো টের পাই না। শুধু নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শ্যামার যে একাকীত্ব-নিঃসঙ্গতা, সেটা থেকে পাঠকেরা রেহাই পায় না। জগদ্দল পাথরের মত শ্যামার এই মানসিক কষ্টটা আমরাও বয়ে বেড়াই পুরো উপন্যাসে।
যে সময়ের প্রেক্ষাপটে “জননী” রচিত, সে সময় মফস্বল বা গ্রামের বাঙালি বধূর নির্ভরতার জায়গা ছিলো “স্বামী” নামক ব্যক্তিটি। কিন্তু জননীর শ্যামার সেই নির্ভরতাটুকু কখনই সম্পূর্ণরূপে ছিলো না। কীভাবে সে একলা হাতে শূন্য থেকে শুরু করে পূর্ণ সংসার সাজায়, সেই সংসার মহাকালের চক্রে পড়ে কীভাবে রিক্ত হয়, সেটা এতো চমৎকারভাবে মানিক বাবু ফুটিয়ে তুলেছেন যে, মুগ্ধ হয়ে পাতার পর পাতা গিলতে হয়।
মানুষের জীবন সংগ্রাম বলতে আসলে কী বুঝায়, সেটা জননী পড়লে খুব সহজে বুঝা যায়। যদিও সাধু ভাষায় রচিত, কিন্তু বর্ণনা এতো সহজ সরল যে, পড়তে পড়তে মনে হয়, চলিত ভাষার চেয়ে এই ভাষায়ই বোধহয় সাহিত্য খোলতাই হয় বেশি! এই অনুভূতি আমার তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়েও হয়েছে।
উপন্যাসটা পড়তে গিয়ে “পুতুল নাচের ইতিকথা”র মত গাঁথুনি, বা কাহিনি বর্ণনা পাইনি। পরে দেখলাম, এটা মানিক রচিত প্রথম উপন্যাস। হয়তো এজন্যেই একটু কাঁচা কাঁচা লেগেছে। তবে মানুষের মনস্তত্ত্বের বর্ণনা কি সুন্দরভাবেই না দিয়েছেন লেখক মশাই! অবস্থার উন্নতির সাথে মানুষের চাওয়া পাওয়া কেমন করে বাড়ে, অবনতি হলে আকাঙ্ক্ষা কীভাবে কমে, কোন পরিস্থিতিতে মানুষ কীভাবে ভাবে, কেন ঐভাবে ভাবে – সব এক মোড়কে পাবেন এখানে। As usual Manik things আর কি! তবে উপন্যাসের নাম “জননী” কেন হয়েছে, সেটা বের করার ভার পাঠকের উপরেই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ বলে মনে করি।
বাংলা সাহিত্যের রত্নভান্ডার থেকে যেসকল চিরায়ত গদ্য উপন্যাস এখনও অপাঠ্য রয়ে গেছে তার মধ্যে মানিকবাবুর জননী অন্যতম। দিন কয়েক আগে প্রতিভা বসুর আত্মজীবনী জীবনের জলছবিতে বারংবার মানিকবাবুর সরল শান্ত রূপ পড়তে গিয়ে মনে হলো এবার সেই অপঠনের দায় মেটানো কর্তব্য। সেই সূত্র ধরেই জননী হাতে নিয়ে তাহা পাঠ করে ধন্য হওয়া গেলো!
ত্রি-চরণে স্মরি: প্রথম উপন্যাসেই মানিকবাবু কী সুন্দর এক জীবন আঁকলেন, জননীর জীবন, কিশোরী বউ থেকে প্রথম সন্তান, দ্বিতীয়, তৃতীয় করে জীবন এগোয়। চড়াই-উতরাই বইতে বইতে আচার-আচরণ ধরে রাখতে পারে না নিজের তাল, সন্তানের জন্য খাবার চুরি করতেও বাঁধে না, নিজের স্বাস্থ্য চুলোয় যাক। নতুন বউ এসে ছেলেকে কেড়ে নেবে— এমন ভাবনায় পীড়িত মন, অস্থির মন বিষ নজরে রাখে নতুন বউকে, অথচ যখন সে নতুন বউয়ের মধ্যে দেখা দেয় নতুন প্রাণ— নতুন করে গড়ে ওঠে প্রতিটি সম্পর্ক, সজীব হয় ভালোবাসা।
জননী উপন্যাসটি একজন জননীর কাহিনী , তার বাস্তব জীবনচিত্রের কাহিনী । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসের জননী চরিত্রটিকে স্বর্গীয় বা দৈবিক মহিমায় ভাস্বর করেন নি বরং মধ্যবিত্ত জীবনের এক জননীর সুখ দুঃখ , দৈন্য ক্লেশ বাস্তবতার নিরীখে তুলে ধরেছেন ।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র শ্যামা । স্ত্রী হিসেবে সে ব্যর্থ । সাত বছরের দাম্পত্য জীবনের পর তার জীবনের স্বার্থকতা পায় জননীর ভুমিকায় । তার স্বামী শীতল দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ তাই সংসারের সকল দায়িত্ব তার কাঁধে । শ্যামা তার জীবনের সকলটা নিংড়ে দেয় তার সন্তানদের পরিচর্যায় । শীতল যখন চুরির দায়ে জেল এ যায় তখন শ্যামা কোন উপায় না পেয়ে নন্দাই রাখালের বাড়িতে আশ্রয় নেয় । নিজের সন্তানদের ভালোভাবে মানুষ করতে সে রাখালের বাড়িতে দাসিবৃত্তি করে । আবার শ্যামার কাছে তার জীবন কখনও নীরস অর্থহীন ও মনে হয় । সে বলে " কোথায় ছিল এই চারিটি জীব , কি সম্পর্ক ওদের সঙ্গে তাহার , অসহায়া স্ত্রীলোক সে , মেরুদন্ড বাঁকানো এ ভার তার ঘাড়ে চাপিয়া বসিয়াছে কেন ? কিসের এই অন্ধ মায়া ? আবার তার সন্তান বিধান রাত জেগে পড়ে বলে ঘি, চুরি করে খাওয়াতেও তার দ্বিধাবোধ হয় না । নৈতিকতার চেয়ে মাতৃত্বই সেখানে মুখ্য । শ্যামার জীবনের কিছু চিত্র এভাবে দেখানো হয়েছে " কে আছে শ্যামার ? সারাদিন খাটুনীর পর শরীর শ্রান্ত অবিশ্রান্ত হইয়া আসিয়াছে , মনের মধ্যে একটা দুঃসহ ভাব চাপিয়া আছে , কত যে একা আর অসহায় মনে হইতেছে নিজেকে , সেই শুধু তা জানে , এতটুকু স্বান্তনা দিবার কেহ নাই " । কতগুলো প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি নিয়ে উপন্যাস শেষ হয় । জীবন বয়ে চলে নতুন জীবনের মধ্য দিয়ে ।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর উপন্যাস মানেই চমৎকার কিছু । পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস পড়ে তার প্রতি যে মুগ্ধতা ছিল তা জননী বইটি পড়ে আরো বেড়েছে । সত্যিই চমৎকার একটি উপন্যাস
বাংলা ভাষার একটা মাস্টারপিস উপন্যাস পড়তে চাইলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর “জননী” উপন্যাসটি পড়ুন। বইটির রচনার সময় তার বয়স ছিল ২৫। এ বয়সী একজন তরুণ একজন মায়ের ভিতরকার প্রত্যেকটি অনূভূতি যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা অকল্পনীয়। গল্পটিতে তার নিম্নমধ্যবিত্ত শহুরে চরিত্রগুলি বেশ চেনাই লাগে, তবু তারা সরাসরি যখন আমাদের সামনে আসে, কথা বলে, চিন্তা করে আর নানা আচরণ ও কর্মের ভিতর দিয়ে তাদের ভাবনাগুলির সঙ্গে অন্যান্য বৃত্তি মিশিয়ে নিজেদের প্রকাশ করে, তখন তারা যে আমাদের দেখা, চেনা গতানুগতিক চরিত্রগুলোর মতো মোটেই নয় সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র, সংসারের কেন্দ্রে-থাকা মা। খুবই চেনা, কিন্তু একেবারে শুরু থেকেই একটু অন্যরকম। দীর্ঘদিনের বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়ে প্রথম সন্তানের মৃত্যু থেকে শুরু করে জননী থেকে নানী হবার যে বয়সকালটা জননী শ্যামা পেরিয়ে আসে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণণা এখানে আছে। সাদামাটা, কিন্তু সেইসব আচরণ-ক্রিয়ার পিছনে আবেগ-চিন্তা-অনুভবের, যুক্তি-বিন্যাসের ধরনটা আলাদা, একটু যেন তেরছা, যেন লুকন���-জিনিস বের করে আনার মতো।
সময়ের ব্যাবধানে বদলে যায় সম্পর্ক। সে সম্পর্ক শ্যামার, শ্যামার ননদ মন্দা আর মন্দার স্বামী রাখালের। ধীরলয়ে উপন্যাস শেষ হয়ে আসে, অতীত বর্তমান হয়ে, কেটে যায় এক জীবন। কত আপ্রাপ্তি এ জীবনে, অনেক কিছু নিয়ে তখন আক্ষেপ থাকে না। জীবন বয়ে যায় নতুন জীবনের মধ্য দিয়ে।
'জননী' উপন্যাসে দেখা যায় অফিসে চুরির দায়ে কয়েদী স্বামীর অনুপুস্থিতিতে অকুল পাথারে পতিত হয়েও একজন মা তার সন্তানদের কিভাবে আগলে রাখেন । লেখক হুমায়ুন আহমেদ বলেন শুধুমাত্র 'জননী' উপন্যাসটি লিখতে পারলেই তিনি নিজেকে সার্থক মনে করতেন । এতো শত-শত বইয়ের রচয়িতা কেন মাত্র একটি উপন্যাসের দিকেই এমন নির্দেশ করলেন? একে বলে শিল্পীর অল্টার-ইগো । ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি ছাড়াও 'জননী' উপন্যাসের মায়াময়-ছায়াময় ভাষা ও শৈলী যে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে এই উপন্যাসকে, সেই শিল্পের উচ্চতা ছিল হুমায়ুন আহমেদের অভিপ্সা । দরিদ্রতা, জরাক্লীষ্টতায় পীড়িত মায়ের সংগ্রামের অবর্ণনীয় বর্ণনা উপন্যাসে সংসারের মূল হয়ে কিভাবে ঝড়-ঝাপটায় তার শাখা-প্রশাখাকে ধরে রাখেন তা পাঠককে হৃদয়গ্রাহী করে তোলে ।
মাস্টারপিস। বই শেষ করেছি মার্চ মাসে। রিভিউ লিখবো বলে এতদিন আপডেট দেই নাই। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা আমাকে ক্ষমা করেনি, সময় দেয়নি। লেখা হলোনা। তবে আমার পরবর্তী রিভিউ অবশ্যই এই বই নিয়ে লিখবো।
খুব সংবেদনশীল লেখা। প্রধান চরিত্র শ্যামার জীবনের প্রতিটি বাধা, তার অনুভূতি ও তার নিরন্তর সংগ্রাম যেভাবে লেখক চিত্রিত করেছেন, সেটি বইটিকে মহৎ সাহিত্যের স্থানে নিয়ে গিয়েছে।
তবে ব্যক্তিগতভাবে আবারও এতটা দুঃখের গল্প পড়লে মন ভারাক্রান্ত থাকে কারণ বর্তমানের শ্যামাদের জন্য জীবন ততটা বদলায়নি। তাই পূর্বকালের গল্প নয়, বর্তমানের বাস্তব হিসেবে বইটিকে পড়তে খুব একটা কষ্ট কল্পনা করতে হয়নি।
"পুতুলনাচের ইতিকথা" বইটিতে multiple perspectiveএ লেখার মধ্যে বেশি মুনশিয়ানা ছিল তবে তুলনামূলকভাবে আগের দিকের লেখা এই উপন্যাস single perspective হলেও লেখকের সংবেদনশীলতার গুণে অন্যরকমভাবে স্পর্শ করেছে, একইরকম ভাল লেগেছে।
লেখক আমার কাছে সেই rare pantheon of male writers এর মধ্যে যুক্ত হলেন যারা objectify না করে বা কোন বিজাতীয় প্রজাতি হিসেবে treat না করে মানবিকতার সঙ্গে মহিলা চরিত্র যত্ন নিয়ে relatableভাবে লেখেন। ইংরেজি, বাংলা ও অনুবাদে বিশ্বসাহিত্য যেটুকু পড়ার সুযোগ হয়েছে, তা মিলিয়েই কথাটি মনে হল।
This one kind of delves deeper only into the psyche of main character and so much analysis of one person's thoughts and deeds kind of bored me. It is still a good book tho. His characters are so realistic that it's hard to love them, just how hard it is to love real people. The intricate fantasy lover in me just couldn’t enjoy a ordinary and close to life story that much. And that's not anybody’s fault, this is still a gem.