‘বনের খবর’ বাংলা সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রচিত এক অসামান্য স্মৃতিকথা । তাও বন-অরণ্যে ও মরুভূমি-প্রায় অঞ্চলে জরিপকালীন সময়ের । প্রমদারঞ্জন রায়ের সার্ভেয়ার জীবনে দেখা ১৮৯৯ থেকে ১৯২০ সালের কাহিনী রয়েছে এতে ।
রায়বাড়ির মানুষ বলে কথা! প্রমদারঞ্জন রায় ১৮৯৯ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত সার্ভেয়ার হিসেবে কাজ করেছেন বৃটিশ ভারতে। কর্মস্থল ছিলো আসাম, পূর্ববঙ্গ, দেরাদুন, আসামের শান স্টেটসহ বিভিন্ন দুর্গম এলাকা।জল,জঙ্গল, পাহাড়ে কাটতো তার রাত্রি। সঙ্গী হিসেবে প্রায়ই জুটে যেতো হরিণ,হাতি, বাঘ, শুয়োর,ভালুক, গণ্ডার। এসব প্রাণীদের নিয়ে রোমাঞ্চকর সব অভিজ্ঞতা রয়েছে লেখকের। সার্ভেয়ারের কাজ করতে যেয়ে গহীন অরণ্য, দুর্গম পাহাড়, হিংস্র জন্তুদের সাথে লড়াই, ভয়াবহ শীত বা ভয়ংকর ডাকাতদলের সাথে মোলাকাত যেমন রোমাঞ্চের জোগান দেয় তেমনি বাঘ বা হাতির জুজুর ভয়ে লোকজনের কিছু কর্মকাণ্ডের বিবরণ পড়ে হাসি চেপে রাখা মুশকিল। অনেক ক্ষেত্রে চরম বিপদের মুহূর্তের বর্ণনা পড়েও লেখকের প্রখর রসবোধের গুণে হা হা করে হেসে উঠতে হয়। সেই অরণ্য এখন নেই, সেই প্রাণীরা এখন বিলুপ্তপ্রায়, সেই সার্ভেয়াররাও এখন নেই। হারানো একটা সময়ের জীবন্ত দলিল হয়ে আছে "বনের খবর।" কোনোভাবেই এ বই পড়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না।
প্রমদারঞ্জন রায় বিখ্যাত রায় পরিবারের একজন। যে রায় পরিবারের অবদান ছাড়া আমাদের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অকল্পনীয়।প্রখ্যাত উপেন্দ্রকিশোর রায়ের আট সন্তানের অন্যতম একজন অসমসাহসী এই সার্ভেয়ার প্রমদারঞ্জন রায়। রায় পরিবারের সবার লেখার মধ্যেই একটা সরসতা আছে। সহজে সহজ কথা মজা করে বলার গুণটি বোধহয় জিনগত উনাদের।
প্রমদারঞ্জন সার্ভেয়ার হিসেবে ভারতের নানান প্রান্তের বনে-জঙ্গলে ঘুরেছেন। গহীন বনে যেখানে পদে পদে বাঘের ভয়,যেখানে একটু অসাবধানতা মানেই শেরশাহের উদরস্থ হওয়া।সেইসব বনের দুর্ধর্ষ সব গল্প তিনি আমাদের শুনিয়েছে ' বনের খবর' বইতে।
প্রমদারঞ্জন শতবছর আগে এতো আধুনিক চমৎকার বাংলা কিভাবে লিখতেন সেটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার বটে।উনার লেখার মধ্যে সহজাত রসবোধ, ঘটনার প্রাঞ্জল বর্ণনা এবং কৃত্রিম আলংকারিক বাহুল্যহীনতা থাকার কারনে পুরো বইটি ভীষণ উপভোগ্য হয়েছে। বনের খবর' পড়ে বনে যাবার মতো বনেদি শখ জেগে উঠা খুব বিচিত্র কিছু বলে মনে হবেনা।
লেখক প্রমদারঞ্জন রায়ের সার্ভেয়ার জীবনের একটা অংশের গল্প বনের খবর। এই বই যদি আরও ৪-৫ বছর আগে পড়তাম ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে সার্ভেয়ার হতে চাইতাম। কি অ্যাডভেঞ্চারাস জীবন ছিল লেখকের!!! শুনলাম সার্ভেয়ারদের নাকি এখন আর বন জঙ্গলে পাঠায় না। থাক তাহলে, এই পেশা আমার ফ্যান্টাসি হয়ে থাক। যারা অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন তাদের অবশ্যই ভালো লাগবে। সবশেষে, মারুফকে ধন্যবাদ বইটি পড়তে উৎসাহিত করার জন্য।
১৮৯৯ থেকে ১৯২০ সালের মধ্য আসাম, ত্রিপুরা, বার্মার চিন হিলস্, শান স্টেটের বিভিন্ন জঙ্গলে সার্ভেয়ার হিসেবে কাজ করার সময়কালের অনেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক। আরও আছে বেলুচিস্তানে কাজ করার সময় দুর্ধর্ষ আফগান ডাকাতদের কাহিনী।
আমার কাছে আসাম ও বার্মার বিভিন্ন জঙ্গলে বাঘের সাথে মানুষের এনকাউন্টারই এই বইয়ের মূল আকর্ষণ। বাঘ যে কেমন হিংস্র ও দাপুটে জানোয়ার, আর তার ভয়ে যে রাইফেলধারী মানুষেরও প্যান্ট নষ্ট হয়ে দুর্গন্ধযুক্ত পরিস্থিতি (কৌতুকপূর্ণও পরিস্থিতিও বটে, যদি প্রাণে বাঁচা যায়) তৈরি হয়, সে সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় বনের খবরে। আর মানুষ কত অভাবে পড়লে বাঘের ভয় বুকে নিয়ে গহীন জঙ্গলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে - এই ভাবনাও মনে আসে। শুয়োর কেমন গোঁয়ার, ভালুক কেমন ভয়ংকর,... সবকিছুর খবর লেখা আছে এখানে। বোড়া সাপ যে ১১ ফিটের চেয়ে বড় হয় (চন্দ্রবোড়া, Russell’s viper নামেও পরিচিত), আর বাছুর, ছাগলের বাচ্চা গিলে খায় তেমন ধারণা ছিল না। লেখক বোড়ার কথা লিখেছেন, আমার মনে হয় বোড়া না হয়ে অজগর কি হতে পারে না? তখনকার আসামের জঙ্গলে ছিল বাঘ, হাতি, সম্বর, বার্কিং ডিয়ার, শুয়োর, ভালুক, চিতাবাঘ, গণ্ডার, হরিয়াল পাখি,... ইত্যাদি বন্যপ্রাণীতে পরিপূর্ণ। বন্য জানোয়ার তখন মানুষের চোখে ছিল ভিলেন, বাঘ তো নিজের টেরিটোরি ডিফেন্ড করতে চাইবেই- কিন্তু মানুষের চোখে সেটা ছিল অপরাধ, বন্যপ্রাণী শিকার তখন ছিল cool. জানতে আগ্রহ হচ্ছে আসাম, ত্রিপুরা ও বার্মার জঙ্গলের কত শতাংশ মানুষের আক্রমণে উজাড় হয়েছে। তখনকার জঙ্গলের আয়তন এখনকার জঙ্গলের আয়তনের পার্থক্য কেমন, Wildlife sanctuary কী পরিমাণ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করতে পেরেছে, এখন সেখানকার জঙ্গলে বাঘের পরিমাণ কত,হাতি-ভালুক ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর পরিমাণ কত। এসব তথ্য জেনে একসময় রিভিউটা এডিট করে নেবো ইচ্ছা রাখি।
যদিও বন্যপ্রাণীর জীবনধারা মানুষ ব্যাহত করছে ব্যাপারটা ভালো লাগে না। কিন্তু তারপরও বইটা প্রচণ্ড উপভোগ করেছি। বাঘে-মানুষে মোকাবিলার এমন শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী আগে কখনও পড়িনি যে!
সে অনেককাল আগের কথা ধরুন,বিশ শতকের গোড়ার কথা অবিভক্ত ভারতবর্ষে তখন ব্রিটিশ রাজ। সে সময়ে একজন সার্ভেয়ার ছিল, নাম তার প্রমদারঞ্জন রায়।
সেই প্রমদারঞ্জন রায় একনাগাড়ে দুই দশক কাজ করেছেন বার্মা, আসাম, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, উত্তরপ্রদেশের ভয়ংকর জঙ্গুলে পরিবেশে।
সেই সময়ের নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ তার অভিজ্ঞতার ঝুলি।কাজ করতে গিয়ে প্রমদারঞ্জন আর তার সঙ্গীরা কখনও তাবু ফেলেছেন এমন দুর্গম অঞ্চলে যেখানে ছয়-সাতশ' কিলোমিটারের মধ্যে জনবসতি নেই, সার্ভে করতে যেতে হয়েছে এমন গ্রামে যেখানে ভয়ে পরিণত হয়েছে বিরানভূমিতে।সামনে বাঘ আর পেছনে বন্য শুয়োর কিংবা হাতিরপাল। এমনই নানা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সমষ্টি "বনের খবর"।
হ্যা,একটা কথা বলে নিই ;প্রমদারঞ্জন বেশ ভালোই ঘটে যাওয়া ঘটনাকে হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। যা পাঠকমনে অবচেতনভাবেই হাসির খোরাক জোগায়।
আসেন,কিছু নেগেটিভ কথা বলি। প্রমদারঞ্জন নিজের অজান্তেই কিছু ঘটনাকে বারবার একইসুরে লিখে গিয়েছেন যা কিঞ্চিত হতাশার জন্ম দিয়েছে। লেখার প্রচুর মালমসলা থাকা সত্ত্বেও তিনি তার সদ্ব্যবহার কিছুক্ষেত্রে করতে পারেন নি বললে অত্যুক্তি করা হবে না।
উনি হচ্ছে সুচিৎ, লেখকের এক কর্মচারী, বনের মাঝে তাকে ধরার জন্য বাঘ এসেছে টের পেয়ে সুচিৎ, তাবুর মধ্য সেঁধিয়ে ছিল, তখন লেখক সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিলেন এই বলে যে - বাঘকেও সুচিৎকে না খেয়ে ফিরে যেতে হল। এমন বিপদঘন মুহূর্তের কথা এমন প্রাঞ্জল রসঘন ভাবে পড়ে কেন যেন রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখে অজ্ঞান হবার আগমুহূর্ত পর্যন্ত লালমোহন গাঙ্গুলীর বর্ণনা মনে হচ্ছিল। খানিকটা একই রকম রকম ঝরঝরে সুখপাঠ্য ভাষা, রোমাঞ্চঘন, ফেলুদার মত ���নমনিষ্যি না থাকলেও প্রতি পাতার প্রায় সব প্যারাতেই কোন না কোন পশু-পাখি-গাছ এসে হাজির।
বলছিলাম সদ্য পড়ে শেষ করা শত বর্ষ আগে লেখা প্রমদারঞ্জন রায়-এর ”বনের খবর” বইটির কথা। উল্লেখ্য, প্রমদারঞ্জন রায় ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর আপন ভাই, সেই সুবাদে সুকুমার রায়ের কাকা ও সত্যজিতের ঠাকুরদা, তাই তাদের ভাষা রীতির অসামান্য সারল্যে মিল কোন কাকতাল ঘটনা নাও হতে পারে, হয়ত রায় পরিবারের যারা লেখালেখির চেষ্টা করেছেন তাদের রীতিটাই এমন ছিল! ”বনের খবর” প্রথম ছাপাও হয়েছিল সন্দেশ পত্রিকায়। আবার প্রমদারঞ্জন রায় ছিলেন শিশুসাহিত্যের অতি জনপ্রিয় লেখক লীলা মজুদারের বাবা , সন্দেহ নেই শিশু লীলার মনে দূর দেশের অ্যাডভেঞ্চারের ও প্রকৃতির গন্ধ খোঁদাই করে দিয়েছিলেন বাবা প্রমদারঞ্জন।
”বনের খবর” ঠিক বনের বই নয়, শিকার কাহিনী নয়, প্রকৃতির বর্ণনা নয়, জীবনকাহিনী নয়, জীবজন্তু নিয়ে বইও নয়। এটি একজন জরিপকারক ( সার্ভেয়ার)-এর দূরদেশে শ্বাপদসংকুল পরিবেশে চলার কাহিনীর, ১৮৯৯-১৯২০ এই বছরগুলোতে প্রমদারঞ্জন রায় সরকারি জরিপে দুর্গম ব্রহ্মদেশ, লুশাই পাহাড়, শানরাজ্য এমনকি চট্টগ্রাম এবং সিলেট ( শ্রীহট্ট) কিভাবে টিকে ছিলেন সেই বাঘ-ভালুক-অজগর- গণ্ডারের রাজ্যে তারই এক মুনমুগ্ধকর আয়না, যা হাতে নিলে চলে যেতে হয় মন্ত্রমুগ্ধের মত সেই বনজ লতা-ঘাসের জগতে, যেখানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আছে বুনো জন্তু, তাদের সাথে মানুষের যুদ্ধের এবং সহাবস্থানের কথা। সেই সাথে মরুময় বেলুচিস্তান অঞ্চলের ১৯০৪-১৯০৫ সালের অভিজ্ঞতা আছে বোনাস হিসেবে।
যেখানে লেখক অবলীলায় বলেছেন, যারা জরিপের কাজ করে, তাদের মধ্যে অনেককে ভারি ভয়ঙ্কর সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। সেই সব জায়গায় হাতি, মহিষ, বাঘ, ভাল্লুক আর গণ্ডার চলাফেরা করে, আবার যেখানে সেই-সব নেই, সেখানে তাদের চেয়েও হিংস্র আর ভয়ানক মানুষ থাকে। প্রায় কুড়ি-বাইশ বছর এইসব জায়গায় ঘুরে কত ভয়ই পেয়েছি, কত তামাশাই দেখেছি।
সরকারি জরিপের কাজে অনেক লোককে দলে দলে নানা জায়গায় যেতে হয়। এক -একজন কর্মচারীর উপর এক -একটা দলের ভার পড়ে। তাঁর সঙ্গে জিনিসপত্র বইবার জন্য , হাতি, গোরু, ঘোড়া, খচ্চর ও উট, আর জরিপ করবার জন্য সার্ভেয়ার, আমিন, খালাসি ও চাকর-বাকর বিস্তর থাকে। বনের মধ্যে থাকতে হয় তাঁবুতে। লোকজনের বাড়ির কাছে থাকা প্রায়ই ঘটে ওঠে না, এক-এক সময় এমনও হয় যে চারদিকে কুড়ি-পঁচিশ মাইলের মধ্যে আর লোকালয় নেই। বন এমনই ঘন আর অন্ধকার যে তার ভিতর অনেক সময় সূর্যের আলো প্রবেশ করে না; চলবার পথ, জঙ্গল কেটে তৈরি করে নিতে হয়, তবে অগ্রসর হওয়া যায়। যদি জানোয়ারের রাস্তা, বিশেষত হাতির রাস্তা , পাওয়া গেল তো বিশেষ সুবিধার কথা বলতে হবে।
এমনি বিশ্রী জায়গা!প্রথম-প্রথম এইসব জায়গায় সহজেই ভয় হত। আমার মনে আছে প্রথম বছর যখন শান স্টেটে যাই, আমার তাঁবুর সামনে বসে একটা বাঘ ফোঁস-ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছিল, আমি তো শুনে বড়োই ব্যস্ত হয়েছিলাম। তারপর, এর চেয়েও কত বড়ো-বড়ো ঘটনায় পড়েছি কিন্তু তেমন ব্যস্ত কখনো হইনি।
”বনের খবর”-এ সবচেয়ে বেশী খবর দেওয়া হয়েছে বাঘের। মানে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মানুষ শিকারের, আবার মানুষের বাঘ শিকারের, বার্মার বাঘ ধরার ফাঁদের নিটোল বর্ণনা, বাঘ দেখে জনৈক ফুলবাবুর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সময় করা মলত্যাগের কারণে উৎসরিত দুর্গন্ধের গল্প, আবার কুলিদের কারো হরিণ কারো বা কচ্ছপের ডাক শুনে বাঘ বলে ভয় পাওয়ার হাসিময় বর্ণনা, কিন্তু অধিকাংশ সময়ে লেখক যখন না জেনেই বাঘকে অনুসরণ করেছেন বা ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা বাঘ লাফ দিয়ে পড়েছে কুলির উপরে, কোন সর্দারজী আবার বাঘের মাথায় বাঁশ দিয়ে আঘাত করে উদ্ধার করেছেন আক্রান্ত সুহৃদকে, তখন গা ছমছমের সাথে সাথে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে যেন।
আছে অনেক অনেক হাতির গল্প, বুনো হাতি, পোষা হাতি, মত্ত হাতি, খুনি হাতি, তাদের দলের বর্ণনা, একজায়গায় লেখক স্বয়ং বলেছেন, অনেক রাত্রে খচ্চরগুলোর ছুটোছুটিতে সকলের ঘুম ভেঙে গেছে। ব্যাপারখানা কী? এই ভেবে যেমন একজন খালাসি তাবুর দরজা ফাঁক করে গলা বের করেছে, আর অমনি দেখে- ওরে বাবারে, এয়া বড়ো দাঁতওয়ালা হাতি, তার পিছনে আরও হাতি। সে আস্তে আস্তে সকলকে সাবধান করে দিয়ে যেমন তাঁবুর পিছন দিয়ে বেরোতে যাবে অমনি হাতিও তাবুর ওপর এসে পড়ল। তখন সকলে গড়িযে গড়িয়ে খাদের ভিতর ঢুকে কোনো রকমে প্রাণ বাঁচাল, আর হাতিগুলো সেই রাস্তায় চলে কাল । তাঁবু-টাবু যা কিছু তাদের সামনে পড়েছিল, সব তারা শুঁড় দিয়ে ছুড়ে ছুড়ে খাদের মধ্যে ফেলে দিয়ে গেল। খচ্চরগুলোও রাস্তার উপর বাঁধা ছিল তারা সকলে দড়ি-টড়ি ছিঁড়ে পালাল, শুধু একটা খচ্চর মজবুত নতুন দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল, সে বেচারা পালাতে পারেনি। হাতিরা সেটাক পা দিযে মাড়িয়ে একেবারে পিষে দিয়ে গেল।
ভালুকের গুহায় না জেনে চলে গেছেন লেখক জরিপ করার সময়, কখনো মুখোমুখি হয়েছেন ভীম গণ্ডারের, হনুমান মাতা-র সন্তান প্রেম দেখে হয়েছেন আপ্লুত, খাদ্যের প্রয়োজনে করেছেন হরিণ শিকার, অজগরের মুখ থেকে টেনে বের করতে দেখেছেন শিকার হয়ে যাওয়া হনুমানকে। সবকিছুর উপরে স্থান দিতে হয় তাঁর সরল বর্ণনাকে, বুনো শূকরের আক্রমণের ভয়াবহতা বোঝাতে বলেছেন- এমন একরোখা গোঁয়ার জন্তু বুঝি আর নেই, তাই লোকে বলে শুয়োরের গোঁ। যেমন মেজাজ, তেমনি তেজ আর তেমনিই তাঁর শক্তি, যতক্ষণ তাঁর শরীরে প্রাণ থাকে ততক্ষণ ওই সর্বনেশে গোঁ সে ছাড়ে না। আমাদের দেশে বলে ”বাঘ-শিকারির ভাত রেঁধো। শুয়োর-শিকারির রেঁধো না।” সে যে ফিরে আসবে তাঁর কোন নিশ্চয়তাই নেই! অথচ এই বইতেই অন্তত এক ডজন মানুষের বাঘের পেটে যাবার ঘটনা লিপিবদ্ধ করা আছে।
প্রমদারঞ্জনের দিনলিপি থেকে বাদ যায় নি মানুষও, নানা দেশের হরেক কিসিমের মানুষ, কেউ কেউ আবার মানুষখেকো, এক জায়গায় বার্মার শান কুলিদের রান্না নিয়ে লিখেছেন -কী করে রান্না করে? একটা লম্বা কাঁচা বাঁশের চোঙার একটি বাদে সমস্ত গাঁটগুলিকে ফুটো করে, সেটাকে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে, তাতে আবশ্যক মতো চাল পুরে, জল ভরে, ঘাস-পাতা দিয়ে মুখটা বন্ধ করে একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে দেয়। তিন-চার ঘণ্টা অমনি থাকে, তারপর ওই চোঙাটা ধুনির আগুনে ঝলসায়। চারদিকে বেশ ঝলসানো হলে চোঙাটি জায়গায়-জায়গায় পুড়ে যায়- সেটাকে ধুনি থেকে বার করে রেখে দেয়। ঠান্ডা হলে পর দা দিয়ে আস্তে আস্তে বাঁশটাকে চিরে ফেলে আর তার ভিতর থেকে দিব্যি একটা ভাতের পাশ বালিশ বার হয়ে আসে। সেটা চাকা-চাকা করে কেটে সকলে ভাগ করে নেয়, আর নুন, লঙ্কা, শুকনো মাছ বা মাংস উপকরণ দিয়ে খায়। গরমের দিনে কখনো বা ঝিঁঝি পোকা ধরে, আগুনে পুড়িয়ে তার চাটনি করে খায়। ঝিঁঝি পোকা নাকি অতি উপাদেয়!
পাখি শিকারের বর্ণনা আছে অল্প, বরং ঢের বেশী আছে পাখির বর্ণনা। গগনবেড়ের (পেলিক্যান) মাংসের স্বাদ যে অতি অখাদ্য চামড়ার মত সেটি তাঁর বর্ণনাতেই পাই। তবে মনের আনন্দে শিকারের উল্লেখ তিনি করেন নি, একমাত্র কুলিদের খাবারের সরবরাহ মেটাতে মাঝেসাঝে, এবং মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে গুলি চালিয়েছেন। আর মনে রাখতে হবে সেই সময়ে সারা বিশ্বেই বুনো জীবদের কী চোখে দেখা হত।
বইটা পড়া শুরু করেছিলাম কাল রাতে, শেষ করার আগ পর্যন্ত নামিয়ে রাখতে পারি নি। পটলের সমান জোঁকের বর্ণনায় যেমন মুখ কুচকেছি, হেসে ফেলেছি উল্লুকের বাঁদরামিতে, বাঘের ডোরার আভাসে হয়েছি রোমাঞ্চিত, তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশী হয়েছি ব্যথিত, সেই সবুজ ভরা অতীতের গল্পে। এগুলো আজ শুধুই গল্প, সেই বন নেই, নেই কোন জন্তু, আজ সবখানেই মানুষের রাজ্য। তারপরও জিম করবেটেরও বেশ আগে এমন স্বাদু রো���ন্থন জানিয়ে দেয় আমাদের প্রাচুর্যময় অতীত নিয়ে, আর তার জন্য সকল ধন্যবাদ প্রাপ্য অকুতোভয় প্রমদারঞ্জন রায়ের যিনি বইয়ের শেষ লাইন শেষ করেছেন এই বলে - এর পরের বছর আমি কলকাতায় বদলি হয়ে গেলাম আর জঙ্গলের কাজের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ সম্পর্ক ঘুচে গেল। সুতরাং আমার বক্তব্যও এখানে শেষ হয়ে গেল।
কিন্তু শেষ হইয়াও হইল না শেষ। শত বছর আগে লেখা অসামান্য কাহিনীতে আমাদের মনে বুনে দিয়ে গেছেন তিনি প্রকৃতি সম্ভোগের উদাত্ত আহ্বান, বনের প্রতি ভালবাসা, অজানার প্রতি পা বাড়ানোর উৎসাহ। এমন বই বাংলায় আর দুটি আছে কিনা জানা নেই। ”বনের খবর” একটি অবশ্যপাঠ্য জীবনকাহিনী।
প্রমদারঞ্জন রায়ের ”বনের খবর”-এর কথা প্রথম জানতে পারি বন্ধু রনি ভাইয়ের কাছে, উনিই আমার অতি উৎসাহ লক্ষ্য করে এর বাংলাদেশী সংস্করণটি ( অ্যাডর্ণ প্রকাশনীর) উপহার দেন। পরে কাঁটাবনের ”মধ্যমা” বইয়ের দোকানে যেয়ে ভারতীয় সংস্করণ, যা লালমাটি প্রকাশন থেকে ছাপা দেখে মুগ্ধ হয়ে সেটিও কিনে ফেলি যার মলাটে জ্বলজ্বল করছে সত্যজিৎ রায়ের আঁকা রয়েল বেঙ্গলের মুখ।
আর বইটির অন্যতম প্রাণ অবশ্যই ভিতরে ব্যবহৃত শ্যামলকৃষ্ণ বসুর স্কেচ এবং স্বয়ং প্রমদারঞ্জনের আঁকা ড্রয়িং। অদ্ভুতভাবে লালমাটির সংস্করণটি ছাপা, হার্ড-কভার বাঁধাই, আকৃতি সব দিক থেকেই অনেক গুণ শ্রেয়তর হলেও দাম বেশ কম অন্যটির তুলনায় ! নিজে পড়ুন, কিশোর-কিশোরীদের উপহার দিন এই অসাধারণ বইটি।
পুরো বই জুড়েই জঙ্গলের আদিম ও অকৃত্রিম বুনো ঘ্রাণের সাথে যোগ হয়েছিল রসগোল্লা টাইপ লেখনী। বেশ লাগছিল পড়তে। এতো অল্পতে শেষ হয়ে যাওয়ায় কিঞ্চিৎ খারাপ লেগেছে।
রায় পরিবারের সবার লেখায় একটা অদ্ভুত মাদকতা আছে। প্রমদারঞ্জন রায়ের লেখায় সেটার ষোল আনাই আছে। বইটা পড়ার আগে শুধু জানতাম, ভদ্রলোক লীলা মজুমদারের বাবা ও উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ভাই। বইটা পড়ার পর মনে হচ্ছে, ভদ্রলোকের এসব পরিচয় আসলে বাহুল্য, তাকে চেনা উচিত নিজের নামেই। পেশায় তিনি ছিলেন সার্ভেয়ার, ঘুরে বেরিয়েছেন বাংলা-আসাম-মায়ানমারের গহীন অরণ্যে। এখনকার নিরীহ উজাড় হয়ে যাওয়া ম্যাদামারা বন নয়, শ্বাপদসংকুল বলতে যা বোঝায় সেটাই। আসামে গহীন পাহাড়ে পথ চলতে চলতে কখনও পথ হারিয়ে ফেলেছেন, দুয়েকবার ভুল করে বাঘের সামনেও পড়ে গিয়েছিলেন। আর হাতির উপদ্রব তো ওসব অঞ্চলে অহর্নিশ লেগেই আছে। অবাক হয়ে ভাবি, কতটা রোমাঞ্চকর সে জীবন। কয়েকজন কুলি-কামলা, খালাসি নিয়ে জরিপের কাজ করে যাওয়া। খাওয়ার কষ্ট যেমন-তেমন, পানির কষ্ট ছিল ভয়ানক। খাড়া সব পাহাড়ের কোন কহর অলিন্দে পানি লিকিয়ে আছে সেটা বের করতে হতে হতো জেরবার। তবে ভদ্রলোকের যেটা সবচেয়ে বেশি টেনেছে, লেখার প্রসাদগুণ। এমন সহজ-সাবলীল ভাষা। বোধহয় বনে থাকতে থাকতেই লেখার মধ্যে একটা সহজাত স্নিগ্ধতা চলে এসেছিল প্রমদারঞ্জনের। কোনো আলগা ভাবালুতা নেই, বিশেষণের বাড়াবাড়ি নেই। পড়লে আসলেই থামা যায় না। যারা পড়েননি, তারা পড়ে ফেলতে পারেন।
বাবারে!! খালি বাঘ আর বাঘ!! এই বই পড়ে আবারো জঙ্গলে বসবাসের খায়েশ জেগেছে। বিবাহ করার ইচ্ছা যদি কখনো আসলেই জাগ্রত হয় তো ভাবছি কোন ফরেস্ট অফিসার টফিসার ধরে করে ফেলবো! :p
মোট আঠেরোটি ছোটো-বড়ো লেখা জুড়ে তৈরি হয়েছে এই প্রবাদপ্রতিম বইটি। একদা সন্দেশ-এ ধারাবাহিক আকারে প্রকাশিত লেখাগুলো গ্রন্থাকারে সংকলিত হয় ১৯৫৬ সালে। কিন্তু লেখাগুলো পড়ার পর দারুণ চমক লাগে। প্রায় সত্তর বছর পুরোনো হলেও এই লেখারা এমন টাটকা আর তাজা রইল কীভাবে? দুর্গম পাহাড় আর জঙ্গলের মাঝে সার্ভে করতে-করতে নানা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকেরই হয়েছে। কিন্তু তাকে এমন সরস ভঙ্গিতেই বা ক'জন বলেছেন? লেখকের কন্যা, আমাদের সবার প্রাতঃস্মরণীয়া লীলা মজুমদার বলেছেন, তিন ধরনের গল্প শোনার (এক্ষেত্রে পড়ার) জন্য সবাই একপায়ে খাড়া থাকে। সেই তিনটি ধরন হল~ চোরের গল্প (ইদানীং খবরের কাগজে আর টিভিতেই এত বেশি চোর-ডাকাতের সচিত্র গল্প থাকে যে ওটির আবেদন কমে গেছে), ভূতের গল্প, আর বাঘের গল্প! এই বইকে স্পেশাল করে দিয়েছে শেষের অংশটিই। এতে এত বাঘা-বাঘা বাঘের উপাখ্যান আছে যে বাইরে গাছপালা আর অন্ধকার বেশি হলেই পড়ার পর মনে হবে, ওই বুঝি এল সে! তারই সঙ্গে আছে তাঁবুর জীবন, জোঁকের উপদ্রব, খরস্রোতা নদীর ওপর বিপজ্জনক পুল পেরোনো, হাতির মুখোমুখি হওয়া ইত্যাদি নানান ঘটনার ঘনঘটা। আছে উত্তর-পূর্ব ভারতের একদা ভয়ংকর সৌন্দর্যের একচিলতে হদিস। আর আছে ছোটোবেলায় ফেরার আনন্দ। লালমাটি এই বইটি চমৎকার করে বানিয়েছে। একটা মোটাসোটা ডায়েরি আকারের বইয়ে আছে শ্যামলকৃষ্ণ বসু'র আঁকা প্রচুর ছবি। আর আছে রায়সাহেবের আঁকা প্রচ্ছদ! এখনও পড়েননি বুঝি? বড্ড ভালো জিনিস মিস করে গেছেন কিন্তু। শিগগির পড়ে ফেলুন।
রাজ-রাজাদের গল্প যখন পড়ি,একটা শব্দ চোখে পড়ে। মৃগয়া। পরে অভিধান ঘেঁটে বের করলাম অর্থ। মৃগয়া শব্দের অর্থ বন্য পশুপাখি শিকার।
তখনকার দিনের রাজারা মৃগয়ায় যেতেন,তাদের মন ভালো করতে,নিজের অবসর সময় কাটাতে। প্রথম প্রথম ব্যাপার টা এত আমলে নিতাম না,পরে কেন জানি এই মৃগয়া জিনিস আমার খুব অপছন্দ হতে শুরু করল। মানে ব্যাপার টা কেমন জানি,আমার ভালো লাগছে না,যাই একটা কয়েকটা অবলা "হরিণ" মারি! স্রেফ আমোদের জন্য অবলা প্রাণী হত্যা,এটা যে কত বড় হিংস্রতা।
আমি ছাগলের মাংস পাইলে দিন দুনিয়া ভুলে খেতে থাকি,মুরগী খাই,মাছ ধরতে পছন্দ করি। ঐ হিংস্রদের তালিকায় আমিও আছি।
এই "মৃগয়া" শব্দ টা দিয়ে শুরু করে,এত গুলো কথা বলার অর্থ হচ্ছে, সম্প্রতি যে বই টা আমি পড়ে শেষ করেছি,সেটার নাম "বনের খবর"। লেখক প্রমদারঞ্জন রায়। এই বইয়েও লেখক কারণে অকারণে অবলা প্রাণী হত্যা করেছিলে এবং সেটা অবলীলায় বলেও গেছেন,পড়তে গিয়ে এই জিনিস টা বড্ড চোখে লেগেছে।
লেখক ছিলেন একজন সার্ভেয়ার। ফলত উনার অনেক পাহাড়ে,দুর্গম জঙ্গলে যেতে হতো জরিপের কাজে। সেসব পাহাড়,দুর্গম জায়গায় কিভাবে তিনি এবং তাঁর সঙ্গী সাথীরা সাথে নিয়ে দিন গুজরান করেছেন,তার রোমহষর্ক এবং চমকপ্রদ বর্ননা লেখক করেছেন তাঁর " বনের খবর" বইয়ে। চমৎকার ভাষায় লেখা, প্রত্যকটি ঘটনা এত নিপুণ ভাবে বিবৃত করেছেন লেখক,মনে হচ্ছে প্রতিটা পাতা যেন জীবন্ত। অনবদ্য।
আমার জীবনে দুইটা পাহাড় আমি দেখেছি,"সীতাকুণ্ড পাহাড়" আর "বান্দরবান "। এই দুইটা ছাড়া প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য অবলোকন করার জন্য আর কোন পাহাড়ে যাওয়ার সুযোগ আমার ঘটে নি। লেখক এই বইয়ে এত দুর্গম সব জঙ্গল আর পাহাড়ের বর্ননা দিয়েছেন, ইচ্ছে করছে পাড়ি দিতে। আমার সবচে ভালো লেগেছে, বন্য পশু পাখির গল্পগুলো, বিশেষ করে বাঘ আর হাতি। এত বাঘ জঙ্গলে ছিল,এটা এই শতাব্দীতে কল্পনাও করা যায় কিনা সন্দেহ! " বনের খবর" পড়া মানে,দারুণ একটা এডভেঞ্চার করা। একটা দুঃখ ও অবশ্য হবে,সেই গহীন অরণ্য আর অগুণতি নানা জাতে জীব এখন নেই বললেই চলে। বাঘের কথা তো বাদ ই দিলাম।
পাহাড়ি ঝর্ণার মতোই তরতর করে বয়ে চলা লেখা। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বৃটিশ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বনে জরিপের কাজে বেরিয়ে দেখা বন, বনবাসী মানুষ, আর সে বনে ক্ষণিকের জন্যে হাজির হওয়া সরকারি কর্তা-কর্মীদের গল্প, ব্যতিক্রম হিসেবে পশ্চিমে বেলুচিস্তানের দুয়েকটি অভিজ্ঞতাও যোগ করা হয়েছ��। তখনও বনের ছোটোবড় প্রাণীর ওপর অভিভাবকত্ব আসেনি কর্তৃপক্ষের মাঝে, হয়তো সঙ্গত কারণেই। বইটা পড়তে গিয়ে দু'জায়গায় থমকে গিয়েছি। একটা ভালুককে গুলি করে মারতে গিয়ে আহত করে লেখক মাঝপথে শিকারে ক্ষান্ত হয়েছেন, আর একটি বাঘশাবককে খামোকা নিধন করার মতো পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিলো, হাতে বন্দুক না থাকার কারণে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়েছেন তিনি। অবশ্য আরেকটু পরিণত হয়ে তিনি বনকে শিকারীর পাশাপাশি অভিভাবকের চোখেও দেখেছেন, সে দৃষ্টান্তও আছে। জরিপের কাজে বনে ঢুকে বনের নিজস্ব জীবনবৃত্ত নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ তাঁর ছিলো না, প্রতিটি শ্বাপদই তাই তাঁর লেখায় আপদ হিসেবে হাজির হয়েছে। কিন্তু সবকিছুর পরও বইটা ভারি মসৃণ, এক বসায় পড়ে শেষ করার মতো, ছোটো ছোটো চমক ছড়ানো, উইটের খামতি নেই কোথাও।
হিমাঞ্চলীয় বৃক্ষের নাম বাংলায় সঙ্গত কারণে সুলভ নয়। কিন্তু সংস্কৃতের প্রভাববলয় যেহেতু হিমালয় ঘিরে, তাই এ গাছগুলোর তৎসম নাম আছে, সেইসাথে বাংলার নিকটবর্তী ভাষাগুলোয় (নেপালি ও হিন্দি) নামগুলো সুলভ। পাইনকে যেমন চীর লিখেছেন প্রমদারঞ্জন। হয়তো বন নিয়ে বাঙালি লেখকরা আরেকটু সক্রিয় হলে বাংলাভাষী অঞ্চলে বিরল কিন্তু হিমাঞ্চলীয় অঞ্চলে সুলভ গাছপালা-পশুপাখি-পতঙ্গ-ফুলের পরিভাষা আরো জোরালো হতো।
সহপাঠকদের জন্যে নোট: জন হান্টারের লেখার অনুবাদে সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত "হান্টার" বইটি পড়েও আনন্দ পাবেন, যদি এ বইটি ভালো লেগে থাকে।
কি অসাধারণ একটা বই! প্রতিটা অধ্যায় যে লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ভাবতেও অবাক লাগে। সার্ভেয়ার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে কত রকম বন, জঙ্গল, বাঘ, ভাল্লুক, হাতি, সাপ এমনকি জোঁকের পাল্লায় পড়েছেন। বাঘ এসে তাবুর বাইরে নিশ্বাস ফেলেছে। এমন এমন সব ঘটনা যে পড়তে পড়তে গায়ের রোম খাড়া হতে বাধ্য। তার উপর আবার লেখকের হাস্যরস ও লেখার ধরন। মারাত্বক।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক পড়েছেন? পাথুরিয়াঘাটা এস্টেটের ম্যানেজার হয়ে লবটুলিয়া, নাড়া ও ফুলকিয়া বইহার, ইসমাইলপুর আজমাবাদ অঞ্চলের জঙ্গলমহল ও তদানীন্তন বাঙালি - আদিবাসী জনজীবন নিয়ে সুন্দর এক উপন্যাস। এ ধরনের লেখা পড়লে প্রথম মাথায় আসে গহীন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার মতলব। এই বইটাও একই রকম। উপন্যাস না হয়ে জার্নাল/স্মৃতিকথামূলক জবানিতে বা ডায়েরি লেখার ছলে বাঙালি সার্ভেয়ার প্রমদারঞ্জন রায় লিখে গেছেন বার্মা ও ভারতের সেভেন সিস্টার্স এর অন্তর্গত পাহাড়ি বনাঞ্চলের দিনলিপি। লেখার ভঙ্গি খুবই সরল। সরল সাবলীল লেখা সম্ভবত runs in the blood of রায় পরিবার। (লেখক উপেন্দ্রকিশোর রায়ের ভাই। আবার উনার মেয়ে হচ্ছেন লীলা মজুমদার)
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পাহাড়ি বনাঞ্চলের নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থার মাঝে শ্বাপদসংকুল পরিবেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জরিপকাজ করার কথা লিখেছেন রায়সাহেব। আরো লিখেছেন মানুষখেকো বাঘ, বুনো হাতি, ভাল্লুক ইত্যাদি নানাবিধ ভয়ানক প্রাণীর শিকার কাহিনী, তাদের দৌরাত্ম্যে জর্জরিত পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন ও আরো অনেক অজানা ইতিহাস। অব্যশই পড়বার আমন্ত্রণ রইল। খুব সুন্দর বইটা।
জমি কেনাবেচা করতে গিয়ে দলিলের সাথে জমির চৌহদ্দির পরিমাণ জানতে আমরা নকশার সাহায্য নিই। এই নকশাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো যে নকশা তাকে 'সিএস নকশা' হিসেবেই চিনি। ব্রিটিশ আমলে এই অঞ্চলে প্রথম আনুষ্ঠানিক ভূমি জরিপ হয়। সেই জরিপের তথ্যগুলোই 'সিএস' নকশাগুলোতে পাওয়া যায়। এর পরেও আরো দুইটি জরিপ হয়েছে কিন্তু প্রথম জরিপ করতে গিয়ে সার্ভেয়ারদের ঝক্কি-ঝামেলা বেশি পোহাতে হয়েছিল। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল, বিপদসংকুল বনাঞ্চল, নদী-নালার মধ্যে দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এমনকি কর্মকর্তাদের জীবনের বিনিময়েও এই জরিপ করেছিল ব্রিটিশ সরকার।
লেখক ও সার্ভেয়ার প্রমদারঞ্জন রায় কলেজ ছেড়ে চাকরির প্রশিক্ষণ নিতে দেরাদুন গিয়েছিলেন। বয়স তখন অল্প। আগ্রহ উদ্দীপনার সাথে কাজ শিখে যখন মাঠ পর্যায় কাজে নেমে পড়লেন তখনই জরিপের আসল অর্থ খুঁজে পেলেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ব্রহ্মদেশের (বর্তমান মায়ানমার) শান স্টেটের পাহাড়ি বনাঞ্চলে কাজ করতে যেতে হয়। তখন চলাচলের জন্য মোটরগাড়ি ছিল না; তার উপর পাহাড়ি এলাকায় ত এসবের প্রশ্নই আসে না। ঘোড়া, গাধা কিংবা হাতি; ক্ষেত্রবিশেষে কুলিদের সাহায্যে মালপত্র বহনের কাজ করতে হয়েছে। জঙ্গলে একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল বাঘের হানা। স্থানীয় মানুষেরা এই বাঘের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে বনের ভেতরের দিকে যেত না। কিন্তু জরিপের কাজে ত বাধ্য হয়েই সেখানে যেতেই হবে। সেই সময়ে বাঘের মুখোমুখিও হতে হয়। বাঘের থাবায় অনেকসময় কুলি কিংবা সার্ভেয়ারদের জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে। প্রমদারঞ্জন রায়ের বর্ননায় উঠে এসেছে এইসব বিপদসংকুল জায়গায় এডভেঞ্চারের রোমাঞ্চকর বিবরণ।
বনের আলাদা একটি নীতি থাকে। সভ্য পরিবেশের নীতি এখানে খাটে না। রীতিমতো অস্ত্রসজ্জিত মানুষও এখানে বুকে বল নিয়ে চলতে গিয়ে হোঁচট খায়। কখন না কোন হিংস্র প্রাণী গায়ের উপর এসে পড়ে। পাহাড়ি বা বনাঞ্চল এলাকার দরিদ্র বাসিন্দারা কোনোরকম বন-জঙ্গলের জায়গা থেকেই উপার্জনের পথ বের করে নিতো। সার্ভেয়াররা এদের কুলি অথবা পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজে নিতেন। অনেক সময় দেখা যেত বাঘের ভয়ে এরা তাবু ছেড়ে পালিয়ে যেতেন; বাঘের থাবায় প্রাণও গিয়েছে অনেকের। একবার দুই কুলি সারারাত গাছের ডালে উঠে বসে ছিল বাঘের ভয়ে। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বাঘের সে কি গর্জন! পারলে ত গাছ থেকেই এদের টেনে নামায়। সকাল হলে তখন লোকজন আসলে তবেই না তারা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তাবুতে আগুন লাগা, বাঘের হামলা, কুলিদের পালিয়ে যাওয়া এসব নানারকম ঝামেলা পোহাতে হয়েছে সার্ভেয়ারদের। তবুও তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সৈয়দ মুজতবা আলীর 'দেশে বিদেশে' গ্রন্থে বলেছিলেন, 'দিনের বেলা আফগানিস্তানের রাস্তা ব্রিটিশদের আর রাতের বেলা পাঠানদের।' প্রমদারঞ্জন রায় যখন আফগান অঞ্চলে জরিপের কাজ করতে যান তখন এমনই এক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। জরিপের কাজে একটু ঝামেলা হওয়াতে ডাকাতদল তাদের আক্রমণ করে বসে। অবশ্য তেমন কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে পাঠান ডাকাতরা বুঝিয়ে দিয়েছে তাদের এলাকায় ব্রিটিশরা পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেনি।
প্রমদারঞ্জন রায় বইটিতে নিজ অভিজ্ঞতার বর্ননা করেছেন। একইসাথে কর্মক্ষেত্রে প্রতিকূলতার ঘটনা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। কিছু কিছু জায়গায় নিখাদ হাস্যকর ঘটনাগুলো উদ্বেলিত করেছে। লেখকের সাথে পাঠকেরা হারিয়ে যাবে আসাম বা শান স্টেটের গহীন অরণ্যে। তখন তাদেরও ইচ্ছা হবে, যাই ঘুরে আসি অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে। তবে সেই বনাঞ্চল আজ অনেকটাই কমে গিয়েছে। বনের প্রাণীরাও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। শত বছর আগের এডভেঞ্চারে হারিয়ে যেতে হাতে তুলে নিন 'বনের খবর '। হ্যাপি রিডিং।
Promodaranjan Ray এর সার্ভেয়ার জীবনের একটা অংশ নিয়ে লেখা গল্প বনের খবর। সরস ভঙ্গিতে লেখক বর্ণনা করে গেছেন তাঁর ঘটনাবহুল কর্মজীবনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা। তাঁর পাবর্ত্য চট্টগ্রা���, দেরাদুন, বার্মা আর আসামের নিবিড় অরণ্যে বাঘ, হাতি, হরিণ, শুয়োর, ভালুক শিকারের দুর্ধর্ষ গল্প শুনে যেমন শিহরণ জাগে তেমনি প্রখর রসবোধের কথা পড়তে গিয়ে হেসে ফেলতে হয়!
ভদ্রলোক ছিলেন রায় পরিবারের মানুষ। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন প্রমদারঞ্জনের দাদা আর আমাদের সকলের আদরের লীলা পিসি হলো তাঁর কন্যা। বলা বাহুল্য রায় পরিবারের ঝরঝরে গল্প বলার ঢং প্রমদারঞ্জনের লেখনীতে প্রাণ পেয়েছে!
যার বলার গল্প আছে তাকে বাজে বকতে হয় না আরকি। এই বই পড়ে কেরানীগিরির ফ্রাস্ট্রেশন আরও বেড়ে গেছে। শ খানেক বছর আগের সার্ভেয়ার হওয়া এর চাইতে ঢের ভাল ছিল। "Sometimes I can hear my bones straining under the weight of all the lives I'm not living" and etc...
বইটা পড়ে শেষ করেছি বেশ কিছুদিন হলো। আলসেমি নামের একটা রোগ আমার শরীরে প্রবল বিদ্যমান। সেকারণেই বইটা নিয়ে দু লাইন লিখতে দুদন্ড দেরী।
বইয়ের শুরু থেকেই বনের গন্ধ যেন নাকে লেগে গেছে। চারিদিকে মাটি, গাছ গাছালি, নিবিড় বন বাদাড়, দুর্গম পাহাড় এসব পরতে পরতে মিশে আছে। এরচেয়ে যেটা সবচেয়ে বেশি আছে, তা হল আতঙ্ক। কখন কোনদিক থেকে হলুদ কালো ডোরাকাটা আতঙ্ক ঘাড়ে এসে পড়বে ধরতে পারবেন না।
বনের খবরের চেয়ে বাঘের খবর কিংবা বনের আতঙ্ক বইয়ের নাম হলেই বুঝি বেশি জুতসই হতো। বলা নেই কওয়া নেই, উত্তর দক্ষিণ ঠিক নেই, হালুম হালুম শব্দ হচ্ছে। আত্মারাম খাচাছাড়া ডাক শুনতে না পাই, লেখকের লেখনীর গুণে তা মানসপটে ভেসে উঠছে বারবার।
শুধুই কি বাঘ, বুনোহাতি, ভাল্লুক আর ময়াল সাপও যে রীতিমতো রাজত্ব করে বইয়ে, তা বলাই বাহুল্য। বইটিকে বিশদ বিশ্লেষণে যাওয়ার মতো ক্ষমতা আমার নেই। তবে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বন ভালোবাসেন, সবুজ ভালোবাসেন এমন পাঠকের জন্য বইটি অবশ্যপাঠ্য।
লেখকের আর কোন বই আছে কিনা আমার জানা নেই। এই লেখাটি পড়ছেন এমন কারো যদি জানা থাকে, জানানোর অনুরোধ রইল।
"বনের খবর" লেখক প্রমদারঞ্জন রায়-এর লেখা আত্মজীবনী অথব পাঠক চাইলে ভ্রমণকাহিনীও বলতে পারেন। যিনি ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত রায় পরিবারের একজন, আরো সহজভাবে বলতে গেলে লেখিকা লীলা মজুমদারের বাবা। সচারাচর রায় পরিবারের লেখকদের লেখনীতে যেমন সহজসরল ভাষার ব্যাবহার দেখা যায়। এই বইয়েও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ভেবে অবাক হতে হয় সে সময়ের বাংলা সাহিত্যের বিচারে উনার লেখা এই বইটা অনেক বেশি আধুনিক ছিল। বিশ শতকের গোড়ার দিকে (১৮৯৯-১৯২০) প্রমদারঞ্জন রায় তৎকালীন বৃটিশ সরকারের একজন সার্ভেয়ার ছিলেন। সেই সূত্রে তাঁকে ভারতবর্ষে গহীন ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে বছরের পর বছর। সেসব দিনের অরণ্যের সুখ দুঃখ হাসিকান্নার এক গল্প শুনিয়েছেন লেখক প্রমদারঞ্জন রায়। বইয়ে বার্মা অঞ্চলের অরণ্যের কথা যেমন উঠে এসেছে তার সাথে আফগান-ভারত সীমান্ত অঞ্চলের কথাও এসেছে। লেখক তার সাধারণ দৃষ্টিতে যেমন সবকিছু দেখেছেন নিজের মতো করে বিচার বিবেচনা করেছেন। ঠিক তেমনটা করেই পাঠকের সামনে সেসব উপস্থাপন করেছেন। এতে করে পাঠক যে শুধু বই পড়েই তৃপ্ত হচ্ছে তা না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মনে হবে চোখের সাথেই সব ঘটে গেলো। লেখকের লেখার এমনই নৈপুণ্য ছিল এই বইয়ে।
টাইম মেশিনে করে সাঁই সাঁই করে চলুন চলে যাই আজ থেকে ১০০ বছর আগের ভারতবর্ষে। লেখক প্রমদারঞ্জন রায় পেশায় ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের সার্ভেয়ার। ভারতবর্ষ তখন বিরাট সীমানা নিয়ে রাজত্ব করছে—পুবে ব্রহ্মদেশ, পশ্চিমে বন্নু উপত্যকা। জরিপের কাজে ১৮৯৯ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত এই ২২ বছরে লেখককে ঘুরতে হয় পূর্ববঙ্গ, আসাম, দেরাদুন, বেলুচিস্তান, বার্মার শান স্টেট, কেং টুং রাজ্যের দুর্গম অঞ্চল। এক বছর অতি দুর্গম চিন হিল্স তো আর বছর লুশাই কিংবা জৈন্তিয়া পাহাড়ে, তার পরের বছর বন্নু আর টর্চি উপত্যকায়। এসব দুর্গম এলাকার ৩০০-৪০০ বর্গমাইলের মধ্যে কোন জনবসতি নেই। এমনও এলাকায় যেতে হয়েছে যেখানে গ্রীষ্মের নিদাঘে ঝলসে যায় দেহ, কিংবা শীতে কম্বলে-ঢাকা বালতির জলও জমে হয়ে যায় বরফ। এই জরিপ কাজের সূত্রেই লেখককে মুখোমুখি হতে হয়েছে বাঘ, ভালুক, হাতি, গণ্ডার, সাপ, বুনো মোষ—এবং এমনকি নরখাদক নাত্ আদিবাসীদেরও। জরিপের কাজ করতে লেখককে যেতে হয়েছে জনশূন্য কিন্তু বুনো জীবজন্তুতে ঠাসা বনে, গাছপালার জন্য আকাশ অদৃশ্য এমন বনে। বনজঙ্গলে তাঁবুতে রাত কাটানোর সময় শিকার হয়েছেন বাঘ আর হাতির আক্রমণের। পদে পদে বাঘের ভয় এসব এলাকায়। মাঝে মাঝে এমনও হতো, দলবেঁধে জঙ্গলে হাঁটার সময়ও পেছন থেকে টুপ করে একজনকে তুলে নিয়ে যেত মানুষখেকো বাঘ। লেখক মৃত্যুর মুখ থেকে বহুবার ফিরে এসেছেন নেহাতই কপালগুণে। 'বনের খবর' বইটি আকৃতিতে নাতিদীর্ঘ হলেও এর ব্যাপ্তি এতই বিশাল যে অল্প কথায় এ বইয়ের মধ্যে কী রোমাঞ্চ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তা বোঝানো সম্ভব। বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে রোমাঞ্চকর, মজাদার, ভয়াবহ সব ঘটনার বর্ণনা। প্রমদারঞ্জন রায় এমন সব ঘটনার সাক্ষী, এমন সব ঘটনার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ, আটপৌরে বাঙালি জীবনে যা সচরাচর ঘটে না। বিখ্যাত শিকারি জিম করবেটেরও বহু আগে এ-ধরনের বই বাংলায় লেখা হয়েছে—এ-কথা বাঙালিদের জন্য একটু হলেও গর্বের বটে। প্রমদারঞ্জন রায় যে বর্ণিল সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন তেমন সব ঘটনা সচরাসর ঘটে তো না-ই, ঘটলেও সেগুলো মার্জিত রূপে সাহিত্যগুণ নিয়ে লিপিবদ্ধও হয় না তেমন। এ-ক্ষেত্রে প্রমদারঞ্জন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। দারুণ সরস লেখা এগিয়েছে তরতর করে। এক পৃষ্ঠা পড়তে বসলে পরের পৃষ্ঠা না উল্টে থাকা যায় না—এমনই প্রাঞ্জল, উইটি তার লেখা। অবশ্য, তিনি যে পরিবারের লোক, সেই পরিবারের রক্তেই যে লেখালিখি মিশে আছে! বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় রায় পরিবারই তো বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছে উপেন্দ্রকিশোর রায়, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদারদের মতো লেখকদের। সেই পরিবারের একজন প্রমদারঞ্জনের লেখনী যে অমন সরস হবে তাতে আর আশ্চর্য কী! পুরো বইয়ে জঙ্গলের খবর দিতে গিয়ে লেখক একটুও বাড়তি রোমান্টিকতার আশ্রয় নেননি, জঙ্গল সম্পর্কে বাড়িয়ে বলেননি একফোঁটাও। অথচ তাতেও একবিন্দু রসের ঘাটতি হয়নি বইয়ের কোথাও।
বনে সন্ধে হবেই, সকালও হবে, রাতও হবে। সেই ঘুটঘুঁটে রাতের আঁধারে, বনে বাদাড়ে একনিষ্ঠ শাসক বাঘের বিচরণ। সঙ্গে আছে আরও হরেক বিপদজনক জন্তুর সমাগম। সেখান থেকে পালানো চলবে না, কেননা তার মধ্যে থেকে সার্ভে করে ভূমির মানচিত্র এবং গতিপ্রকৃতি সন্ধান করাই প্রধান কাজ। সেই কাজ ব্রিটিশ সরকারের অধীনে, তাই সাময়িক পলায়ন করলেও আখেরে ফিরে আসতে হবে ঠিকই। কাজ শেষ না হলে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ব্যক্তিমুণ্ডুর পরোয়া না করে স্রেফ চাকরি থেকে ঘচাং ফুঁ করবেন মাত্র দু-সেকেন্ডে।
প্রমদারঞ্জন রায়, এক অকুতোভয় সার্ভেয়ার। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জঙ্গলের গহীনে তার বিচরণ। কাজে অবিচল, দায়িত্বে পাক্কা; হাত যেমন বন্দুকে পাকা, মস্তিষ্ক তেমন বিচারবোধে বিচক্ষণ। তিনিই বইয়ের লেখক। তার অপর পরিচয় সুপরিচিত রায় পরিবারের (উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়, লীলা রায়[বিবাহ পরবর্তীতে লীলা মজুমদার]) জাতক তিনি। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোট ভাই- প্রমদারঞ্জন রায়। সুতরাং, তাঁর সহজাত ভাষাশৈলী বংশানুক্রমে প্রাপ্ত, এবং বনের খবর রচনায় সেই গুণ উপযুক্ত উপায়ে কাজে এসেছে।
বনের খবরে উঠে এসেছে লেখকের অভিজ্ঞতাপ্রসূত ঘটনাবলির সমাহার। আছে বহুবার বাঘের খপ্পরে পড়ার ঘটনা, এবং তার থেকে পরিত্রাণের গল্প। কখনও বা বুনো শুয়োর, হাতির কবলে পড়ে নাস্তানাবুদ হবার কাহিনী। আরও আছে নানান বিপত্তি ও বাঁধার বিবরণ। আছে চুরি ছ্যাঁচড়ামির মতো ঘটনা, দলে খুচরো হিংসা বিদ্বেষ থেকে শুরু করে খুনোখুনি পর্যন্ত অঘটন। সময়কাল হিসেব করে এক একটি অভিযানের আলোকে লেখক বলে গেছেন সেসব কথা। কখনও শিকারি বাঘ এসে হানা দিয়েছে তাদের তাঁবুতে, গুঁড়িয়ে দিয়েছে সবকিছু। কখনও বা মাচা বেঁধে তারা সক্রিয় হয়েছেন বাঘ শিকারে। হিংস্র জন্তুর ভয়ে কখনও তারা আধমরা, আবার কখনও শিকারি জন্তু লেজ গুটিয়ে পালানোর পথ খুঁজে পায় না। বনের মানুষদের জীবনধারা, জুম চাষ পদ্ধতি, ইত্যাদি দেখা গেছে স্পষ্ট ভাবে। আছে জোঁকের উপদ্রব, সাপের ফোঁসফোঁসানি, লড়াই, বড়াই, হুঙ্কার, ঝঙ্কার, গুড়ুম-গুড়ুম, আর 'ছেঁড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি' পরিস্থিতি। সবথেকে মজা পেয়েছি অভিযাত্রীদের ভাতের প্রতি আকর্ষণ দেখে। মরুক কিংবা লড়ুক, ভাত এক মুঠো চাইই চাই। প্রায়শই চাল বয়ে এনেছে বিভিন্ন কর্মী/কুলি। হাতির পিঠে করে বহন করা হয়েছে সেগুলো, ওসব পৌঁছার জন্য অপেক্ষাও করা হয়েছে যথেষ্ট। দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাক, ভাত খেয়ে তারপর অন্য কথা।
বইয়ের লেখনী যথেষ্ট ভাল। বিশেষ করে ওই শতবর্ষ আগেও কী করে এতটা সমসাময়িক ভাষায় বইটি লেখা হয়েছে ভেবে অবাক হতে হয়! যারা গহীন অরন্যের ঘটনা পড়তে ভালবাসেন, পুরনো রোমাঞ্চকর কিংবা রসময় অভিজ্ঞতা শুনতে পছন্দ করেন তাদের জন্য 'বনের খবর' বইটি হতে পারে চমৎকার পছন্দ। আমার বেশ লেগেছে। যদিও প্রায়শই বাঘ এসেছে দেখে একটু বিরক্ত হয়েছি বটে! কিন্তু, অভিজ্ঞতা তো অভিজ্ঞতাই, তাতে রঙ চড়ানোর বিশেষ সুযোগ নেই। লেখক অন্তত রঙ চড়াননি। অতএব জঙ্গলে গেলে বাঘ আসবেই। শুরুতেই তো বললাম- যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে... ^.^
বাংলা সাহিত্যে অবদানের ক্ষেত্রে বিখ্যাত রায় পরিবারের অবদান অসামান্য। সাহিত্যে তাঁরা মজবুত একটা জায়গা দখল করে রেখেছেন, শিশু সাহিত্যে তো বটেই। লেখক উপেন্দ্রকিশোর রায়ের ছেলে প্রমদারঞ্জন রায়। তিনি পেশায় একজন সার্ভেয়ার ছিলেন। অসীম সাহসী একজন মানুষ, কাজের ক্ষেত্রে তা বারবার তিনি প্রমাণ রেখে গেছেন।
প্রকৃতির টানে বনে-জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়া এক দারুণ ব্যাপার, তবে পেশা হিসেবে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো ভয়ঙ্কর এক ব্যাপার। সার্ভেয়ার হিসেবে ভারতের গহীন বনে-জঙ্গলে ঘুরেছেন লেখক। প্রথমেই তিনি সার্ভেয়ার পেশাতে ছিলেন না, অনেক দিন নানা জায়গাতে কাজ শেখার জন্য থেকেছেন। ঘুরেছেন গহীন বনে, যেখানে পদে পদে সম্মুখীন হয়েছেন বিপদের। মাঘ, সাপ, ভাল্লুক, হাতি সহ হিংস্র সব পশুদের মুখোমুখি হয়ে নিজের সাহস আর বুদ্ধি দিয়ে বেঁচে ফিরেছেন। যার সবটাই তিনি লিখেছেন এই বইয়ে।আজ থেকে ১২৪ বছর আগের কাহিনি দিয়ে শুরু করেছেন। তারপর ধারাবাহিক ভাবে তিনি যে সব জায়গাতে গেছেন সবটা তুলে এনেছেন " বনের খবর" বইটাতে।
প্রমদারঞ্জন রায় প্রথাগত লেখক ছিলেন না। তাছাড়া তিনি যে পেশায় ছিলেন তাতে জীবনের বেশীরভাগ সময়টা কাটিয়েছেন গহীন বনে-জঙ্গলে। তবে বইটাতে কোন জটিলতা নাই, আধুনিক সাবলীল এক রচনা। সহজবোধ্য ও চমৎকার বর্ণনা, পড়তে কখনও মনে হয়নি এতো আগের একটা বই পড়ছি। বইটা পড়ার আগে মনে হয়েছিল বাচ্চাদের বই, ছোটদের জন্য চমৎকার একটা বই তবে বড়দেরও খারাপ লাগবে না।
“A mind needs books as a sword needs a whetstone, if it is to keep its edge.”
-Game Of Thrones. George R.R. Martin.
এইটা শখের বসে করা কোনো অ্যাডভেঞ্চার না। কর্মসূত্রে করা ভয়ংকর রিয়েল লাইফ অ্যাডভেঞ্চার।
বনের খবর মিয়ানমারের শান স্টেট, চিন হিলস, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান,ত্রিপুরা,আসাম,জৈন্তিয়ার বনে একজন সার্ভেয়ারের কর্মজীবনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরে। যেখানে প্রত্যেকটা বনে মানুষখেকো বাঘের আস্তানা, এছাড়া সাম্বার,চিতা,হাতি,গন্ডার, উল্লুক,হনুমানে সমৃদ্ধ ছিলো বনগুলো।উঁচু উঁচু পাহাড়,কঠিন রাস্তা কিছু জায়গায় একদমই পথ নেই ।জায়গাগুলো এমনই ভয়ংকর ছিলো যে সেখানে প্রতি পদে পদে মৃত্যু ঝুঁকি আর কাজ করা ছিলো অনেক বেশি কঠিন । বনের আশেপাশের গ্রামগুলোতে মানুষের থাকা অনেক মুশকিল ছিলো ।কিছু গ্রাম একেবারে শূন্য হয়ে পড়েছিলো বাঘের আক্রমণে।শিকারীরাও মাঝে মাঝে পরিণত হতো শিকারে।
বনের খবরের লেখক সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ প্রমদারঞ্জন রায়। তার দারুণ লেখনীর মাধ্যমে তার জীবনের এইসব দুর্ধর্ষ রোমাঞ্চকর ঘটনাগুলো আমাদের শুনিয়েছেন।
আমাদের 'অভিযাত্রী'র "অ-তে অভিযানে"র এক পাঠচক্রে দেয়া হয়েছিল প্রমদারঞ্জন রায়ের এই বইটি। বন-জঙ্গল-অরণ্যের প্রতি আগ্রহ আমার ছোটকাল থেকেই। সেই সূত্র ধরে ফরেস্ট অফিসার হিসেবে যারা কাজ করেন তাদের রীতিমতো ঈর্ষা করি আমি। স্যাপ গ্রিন কালারের পেপারব্যাগটি পড়ে গহীন অরণ্যে বেরিয়ে পড়ার স্বপ্ন আরো বেড়ে গেছে। ১৮৯৯ থেকে ১৯২০ প্রমোদারঞ্জন রায়ের সার্ভেয়ার জীবনের নানা ঘটনাই দুই মলাটে লিপিবদ্ধ। নিজের জীবন থেকেই বাংলা সাহিত্যে রূপকথার মত এক গভীর অরণ্যের কথা তুলে ধরেছেন লেখক। কিন্তু যে অরণ্য নিয়ে এমন অসাধারণ লেখনী এসেছে, মাত্র একশো বছরেই সেই অরণ্য মানুষের হাতেই ধ্বংস হয়ে গেছে।
বিপ্রদাশ বড়ুয়া বইটার সুন্দর একটা ভূমিকা লেখছেন তাই আমি আর কিছুই বললাম না। তবে বন তো আমাদের মনে আপন কেউ হিসেবেই থাকে। সেটা ওই রোমান্টিক পাতা ঝর�� ঝরঝরে সবুজ কিংবা তামাটে শুকনো বনের খবর। তবে এই বইটা অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের মতো গা ছমছমে সুন্দর বনের অভিজ্ঞতা। এই বইটা কিনতে উৎসাহিত করছিলেন কামরুল ইসলাম পাভেল ভাই। তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
যে প্রক্রিয়া বা কৌশলের মাধ্যমে ভূ-উপরস্থ বা ভূ-নিম্নস্থ বিভিন্ন বস্তু বা বিন্দুর আপেক্ষিক অবস্থান নির্ণয় করে নকশা বা ম্যাপ প্রণয়ন করা হয় তাত্ত্বিক ভাষায় তাকেই বলে সার্ভেয়িং। বাংলায় বলা চলে জরিপ। ব্রিটিশরা এই অপরিচিত দেশকে ভালোভাবে চেনার জন্য দরকার পড়ে এই ভূমির নিঁখুত নকশার। তাদের হাত ধরেই এদেশে গড়ে ওঠে সার্ভেয়িং এর চর্চা। প্রমদারঞ্জন রায় জন্মসূত্রে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভাই। কর্মসূত্রে ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের একজন সার্ভেয়ার। ১৮৯৯ সাল৷ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত তার কর্মক্ষেত্র ছিল বনজঙ্গলে। তার এই সময়কার লব্ধ অভিজ্ঞতার ঠাঁই হয়েছে বনের খবর এ ছাপার অক্ষরে। দেরাদুন, আসাম (ভারত), শান ও কেংটুং রাজ্য (মায়ানমার), উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বেলুচিস্তান) জুড়ে ছিল তার কর্মক্ষেত্র। একশো বছর আগে এসব এলাকা ছিল শ্বাপদসংকুল দূর্গম অরণ্যানী। পথ তৈরি করে নেয়া হতো জঙ্গল কেটে। কোন কোন জরিপ এলাকায় পৌঁছাতে নিকটস্থ লোকবসতি থেকে ২০-২৫ দিন একনাগাড়ে হাঁটতে হতো। ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ছিল নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ। বেলুচিস্তানে ছিল ডাকাত আর শীতের ভয়, ব্রহ্মদেশের (মায়ানমার) বনজঙ্গলে ছিল বাঘের দৌরাত্ম্য, স্থানীয়দের মাঝে ছিল নাট (অপদেবতার) ভীতি, আবার আসামের লুসাই উপত্যকা ছিল বুনো হাতিদের দাপট, নাগা পাহাড়ের কাছে মানুষখেকো বাঘের রাজত্ব। বনগুলোয় আরো দেখা মিলতো বার্কিং ডিয়ার, গন্ডার, বুনো শুয়োর, ভাল্লুক, বুনো কুকুর, ফেজেন্ট, ময়ূরের। সব মিলিয়ে বইটা যেন জঙ্গলের ডাইরেক্টরি। বইয়ে এগারোফুট লম্বা অজগর দেখায় হিংস্রতা, এক-আধজন খালাসি বা কুলিকে নিঃশব্দে খাদ্যে পরিণত করে বাঘ, বুনো কুকুরের দল ঝাঁপিয়ে খাওয়া শুরু করে জ্যান্ত হরিণ, মরা হাতির গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত বেরিয়েও আসে দুয়েকবার। শুধু বন্যপ্রাণীই না এসেছে বনে বেঁচে থাকা মানুষের গল্পও। বাংলা সাহিত্যে বনজঙ্গল নিয়ে মৌলিক লেখা হাতে গোণা। যারা বন জঙ্গল ভালোবাসেন তাদের জন্যই বনের খবর। এতে শিকারের নৃশংসতা খুব অল্প। বরং আছে জরিপ কাজের গল্প, বাঘের হাত থেকে নিরস্ত্র বেঁচে আসার গল্প, হনুমানকে হাতি ভেবে দৌড়ে পালানোর বর্ণনা। শ'বছর আগের লেখা হলেও এর ভাষা সাবলীল, মেদহীন। রায় পরিবারের যোগ্য সদস্য হিসেবে তার লেখাতেও ছিল চমৎকার সরসতা। একশো বছরে এসব বন হারিয়েছে অনেকটাই। নেই বন্যপ্রাণী ও। এ দেশে গন্ডার বিলুপ্ত, সুন্দরবনের বাইরে বাঘের দেখা মিলে না, হাতি কমছে আশংকাজনক হারে। হুট করে সময়যন্ত্রে চেপে একশোবছর আগেকার সময়ে জঙ্গলে ঘুরে আসার যেন এক উপায় বইটা। খুব বেশি ভাষার জৌলুশ নেই, আছে শুধু অভিজ্ঞতার বর্ণনা। তাতেই এই বই আশ্চর্য সুন্দর।
আমার নানাজান সার্ভেয়ার ছিলেন, সেই তরূন বয়সে চষে বেড়িয়েছিলেন লুসাই পাহাড়, মিজোরাম, জৈন্তিয়া পাহাড়, আসাম, কানুট, ত্রিপুরার দুর্গম সব পাহাড় আর জঙ্গল। ছোটবেলায় নানার কাছে সেই আদিম অরণ্য আর অরণ্যের সন্তানদের বিচিত্র সব গল্প শুনতে রাতভোর হয়ে যেতো। হুট করে এককোনায় বইটার কপি খুঁজে পেয়েছিলাম, কেন জানি থানচি-পদ্মঝিরি-অমিয়াকুম-জিনাপাড়া-নাফাকুম-রেমাক্রি-তিন্দু হাঁটা দেবার আগের দিন পড়লাম বেশ খানিকটুকু। এক অবসরে বাকিটুকু শেষ করলাম।
পাহাড়ে গিয়ে তিনদিন হেঁটেই আমরা কত্ত না থ্রিল আর মানসিক শক্তির পরীক্ষা নেই অথচ প্রমদারঞ্জন রায় অকপটে সরল ভাষায় বলে গেছেন তার শান, বর্মা, আফগান,চট্টলা, ত্রিপুরা,আসাম এইসব জায়গায় জরিপ আর বন-কাহিনী। বাঘ, ভাল্লুক, হাতি, গন্ডার, জোঁক, খাড়া পাহাড়, দাঁতাল শূয়োর কি পার হননি, কল্পনাকে ও হার মানায় সেসব। হাঁটাপথে প্রতিদিন বাঘ তাড়িয়ে যেতে হতো জরিপে, নদীর উপরে পোল ধরে ঝুলে ঝুলে - এমনভাবে লিখেছেন , মনে হয় - যাই , একটু হাওয়া খেয়ে আসি পার্কে !
বেশী কিছু লেখার কি আছে, বইটা জোগাড় করে সোজাসাপ্টা পড়া দিন।পচাব্দী গাজী বা জিম করবেট এর পরে অনেকদিন বনের খবর ভুখা পাঠকের জন্য বৃষ্টি হয়ে এসেছে।