Jump to ratings and reviews
Rate this book

অলীক মানুষ

Rate this book

320 pages, Hardcover

First published April 1, 1988

56 people are currently reading
730 people want to read

About the author

Syed Mustafa Siraj

157 books88 followers
Syed Mustafa Siraj (Bengali: সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ) is an eminent Bengali writer. In 1994, he received the Sahitya Akademi award for his novel Aleek Manush (অলীক মানুষ). In 2005, his short story Ranirghater Brittanto (রানীরঘাটের বৃত্তান্ত) was made into the film "Faltu" by Anjan Das.

He was born in a village named Khoshbaspur in the district of Murshidabad in 1930. In his early days, he enjoyed a bohemian life style. Once he joined a folk drama group 'Aalkaap' (আলকাপ) and travelled the districts of Murshidabad, Malda, Burdwan, Birbhum and also performed in Kolkata. In those days, he used to perform whole night and sleep in day time. He used to play flute. He was a teacher of folk dance and drama. But oneday he got tired of this life and felt he had a wider life spreading around him. He turned his face to writing poetry and short stories. Later he came to Kolkata and enter the world of serious writings and immediately became famous for his short stories. Inti pisi o ghatbabu (ইন্তি পিসি ও ঘাটবাবু), Bhalobasa o down train (ভালবাসা ও ডাউন ট্রেন), Hizal Biler Rakhalera (হিজল বিলের রাখালেরা) and Taranginir Chokh (তরঙ্গিনীর চোখ) brought fame for him. He joined one Bengali daily news paper as a journalist and minded in serious and creative writing. He wrote around 150 novels and 300 short stories. His short stories Uro pakhir Chhaya (উড়ো পাখির ছায়া), Manusher Janma (মানুষের জন্ম), Ranabhumi (রণভূমি), Rakter Pratyasha (রক্তের প্রত্যাশা), Maati (মাটি), Goghna (গোঘ্ন), Mrityur Ghora (মৃত্যুর ঘোড়া) immediately attaracted the bengali readers and intellectuals. He got "Ananda Puraskar", "Bankim Puraskar", "Sahitya Akademy Puraskar", "Bhualka Puraskar", "Narsingdas Puraskar" and a lot of awards for his literary excellence.
His first novel is Neel Gharer Nati (নীলঘরের নটী). The other novel Trinabhumi (তৃণভূমি) (and also Kingbadantir nayak (কিংবদন্তীর নায়ক), Aleek Manush (অলীক মানুষ) and Uttar Jahnabi (উত্তর জাহ্ণবী)) was a big success and was translated into all major Indian languages. His short stories "Mrityur Ghora (মৃত্যুর ঘোড়া)", "Rakter Pratyasha (রক্তের প্রত্যাশা)", "Goghna (গোঘ্ন)" and many other stories have been translated in different languages.
He is also a creator of a detective character "Goenda Colonel (গোয়েন্দা কর্নেল)" - Detective Colonel. An ex-Colonel Niladri Sarkar is the hero to find out the culprit or killer. The stories are so interesting that Siraj has got own fan followings. From children to old people, there are huge number of readers who are fond of Colonel Niladri Sarkar.
A retired Colonel – Niladri Sarkar – was the eccentric sleuth in Syed Mustafa Siraj’s stories, narrated by a lazy journalist (Jayanta) who accompanied him on his missions. The colonel was a butterfly collector and ornithologist, smoked pipes and had a Santa beard. He was also jovial and liked quoting Bengali proverbs & nursery rhymes.
Siraj did not start his career writing for children. His reputation was built on writing novels & short stories for adults. He started writing for children to respond the huge demand for that genre in Bengali.

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
223 (65%)
4 stars
87 (25%)
3 stars
23 (6%)
2 stars
5 (1%)
1 star
3 (<1%)
Displaying 1 - 30 of 94 reviews
Profile Image for Aishu Rehman.
1,093 reviews1,079 followers
November 29, 2019
এ এক অসাধারণ উপাখ্যান যা মন্ত্রমুগ্ধের মতো পাঠককে আটকে রাখবে বইয়ের পাতায়। সহজ সরল প্রকৃতির সাবলীল বর্ননা আমাদের টেনে নিয়ে যায় গ্রামে, শেকড়ে, মাটির গন্ধে। মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো আমাদের জীবন নিয়ে ভাবতে শেখায়। বইয়ের প্রথম দিকে গতি বেশি থাকলেও শেষের দিকে গতি কমে গিয়েছিল একটু। দুর্বলতা বলতে এটুকুই।

ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্তিমকাল আর বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের কাহিনী। একশ বছরের সামাজিক ইতিহাস উপন্যাসটিতে। এক সম্ভ্রান্ত পির পরিবারের বিস্তীর্ণ উপাখ্যান। বদিউজ্জামান বা বদি পির আর তার পরিবারের গল্প। তিনি খুব নামকরা পির। চতুর্দিকে তার সুনাম। তার বড় ছেলে নুরুজ্জামান পিতার পথেই হেঁটেছে। সেও বড় মৌলানা। দেওবন্দ থেকে পাশ করা। মেজো ছেলে মনিরুজ্জামান প্রতিবন্ধী। আর ছোটছেলে শফিউজ্জামান।

গল্পগাঁথা এগিয়েছে দুইটি শাখায়। একদিকে বদিউজ্জামান আর অন্যদিকে শফিউজ্জামান। শফিউজ্জামান পিতার বিপরীতে হেঁটেছে। মাদ্রাসার পরিবর্তে ইংরেজি স্কুলে পড়েছে। দেওয়ান সাহেব বারি চৌধুরীর সংস্পর্শে এসে নাস্তিক হয়েছে। পিরজাদার খোলস থেকে বেড়িয়ে এসে নাস্তিক হওয়া বড় বিপ্লবই বটে। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের ছেলের এভাবে নাস্তিক হয়ে ওঠা পাঠককে বিভ্রান্ত করে ফেলে সহসাই। লেখক কি নাস্তিকতা প্রচার করছেন? না! বদিউজ্জামানের ঘটনাবলি আবার সম্পূর্ণ ইসলামকেন্দ্রীক। তার ইবাদত, দার্শনিক চিন্তাচেতনা ইত্যাদি ফুটে উঠেছে সুচারুভাবে। এছাড়া ঘটছে নানারকম অলৌকিক ঘটনা, লোকে যেগুলোকে মোজেজা বা অলৌকিক নিদর্শন হিসাবে জানে। সহচর চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছে জ্বিনরাও। শফি যে সময়ে নাস্তিকতা নিয়ে ভাবছে ঠিক সেই সময়েই পিরসাহেব মোজেজা প্রদর্শন করছেন। একইসাথে দুই ধরনের কাহিনী বিভ্রম সৃষ্টি করে। পাঠক বিভ্রান্ত হয়ে যান। জীবনের বাস্তবতার স্বরূপ পাতায় পাতায়, শব্দে শব্দে। শফি ভালোবেসেছিল দিলরুখ বা রুকুকে। দিলরোজি আর দিলরুখ যমজ বোন। তাদের বিয়ে ঠিক হয় পিরসাহেবের দুই ছেলে নুরুজ্জামান আর শফিউজ্জামানের সাথে। সেসময় শফি দোটানায় ছিল। কি করবে সে! বিয়ে করবে নাকি বারিচাচার পরামর্শ অনুযায়ী আবেগ ভুলে পড়াশোনায় মন দিবে। যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে এতদিন, সেই রুকুকে বিয়ে করতে চেয়েও শেষপর্যন্ত শফি ফিরে এলো। সে সংসারের বন্ধনে আটকানোর নয়। সেই থেকে তার একা পথ চলার শুরু। একসময়ে সে স্বদেশী আন্দোলনে পুরোপুরি জড়িয়ে যায়। পরিচিতি পায় শফিজামান বা ছবিলাল নামে। হুলিয়া জাড়ি হয় তার নামে। নরহত্যায় তার হাত কাঁপে না। সে একদিকে বন্দেমাতরম স্লোগান দিয়ে ইংরেজ হত্যা করছে, বিপরীত দুনিয়ায় তার পিতা পিরসাহেব ফরাজি মতবাদ প্রচার করছেন।

দুই মানুষের মাধ্যমে দুই ধরনের গল্প এগোতে থাকে। গল্প লেখা হয়েছে কখনো বর্ণনার মতো, কখনো তৃতীয় পুরষে, আবার হঠাৎ উত্তম পুরুষ। কখনো বা কথোপকথন। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ রচনা করেছেন
Profile Image for Israt Zaman Disha.
194 reviews621 followers
March 4, 2021
খুব অন্যরকম ছিল। আমার পড়ার পরিধি বেশি না, যতটুকুই পড়েছি তার মধ্যে এমন আর পাইনি। লেখনীর ধাঁচও নতুন, উপন্যাসের বিন্যাসও নতুন। কখনো বদিউজ্জামান কখনো শফি কথক। কখন যে এই রদবদল হচ্ছে খেয়াল না করলে প্রথমে টের পাওয়া শক্ত। আমি কিন্তু এই ধরনটাই খুব উপভোগ করছিলাম। কিছু প্রশ্নের উত্তর আমি পাইনি। আরও একটু বড় করে এই উত্তরগুলো দেয়া যেতে পারত মনে হয়েছে। কোন কিছুর ব্যাখ্যা না পেলে আমার মনে একটা অশান্তি কাজ করে। তাই এক তারা কম দিলাম। অলীক মানুষ বইটার কথা কে প্রথম জানায় বা কার রিভিউ দেখে পড়ার লিস্টে এড করেছি মনে পড়ছে না। মনে না পড়া সেই ব্যাক্তিকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
Profile Image for Shuhan Rizwan.
Author 7 books1,107 followers
September 25, 2015
দুর্দান্ত এক উপন্যাস। সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের অন্য লেখা পড়বার চেয়ে এই উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা একেবারেই স্বতন্ত্র।

বিষয়বস্তু, ভাষা, বলবার কায়দায় দারুণ মুন্সীয়ানা ছিলো। কখনো কাল, কখনো কথক, কখনো বীক্ষণকোণ পালটে নিয়ে বিস্তৃত এক সময়ের গল্প বলে গেছেন সিরাজ। একটি মাত্র আক্ষেপ রয়ে গেছে, গল্পটাই যেহেতু প্রধাণ আকর্ষণ ছিলো পুরো কাহিনি জুড়ে- সেই গল্পের বীক্ষণকোণ বা প্রসঙ্গের বদল বহুবারই মসৃণ ছিলো না। সেসব জায়গায় থমকাতে হয়েছে পাঠককে।

এই আক্ষেপটা বাদ দিলে, আঙ্গিকের আর কাহিনির বিচারে বাংলা সাহিত্যেরই এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন মনে করি অলীক মানুষকে।
Profile Image for Shimin Mushsharat.
Author 1 book369 followers
December 5, 2020
কি অদ্ভুত! কি অদ্ভুত! ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছি। বইটায় সময় সরলরৈখিক না। ন্যারেটরও বদলে যায় হুটহাট। কখন কার কথা পড়ছি সেটা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে মাঝে মাঝে। এতো চোখে আঙ্গুল দিয়ে কিছু বিষয় বইটা দেখিয়ে দেয়, কয়েকবার করে পড়েছি। অবাক হয়েছি। শুরুটা আর শেষটা ভয়ানক স্পেলবাইন্ডিং। চরিত্রগুলো প্রচন্ড রিয়েলিস্টিক। ঠিক বলে বোঝানো সম্ভব না। সবচেয়ে যে লাইনটা মনে দাগ কেটেছে: "আসলে জীবনের অনিবার্য স্পষ্টতাগুলো নিজেকে উঁচুতে তুলে রাখার দরুন ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে।"
Profile Image for Mahmudur Rahman.
Author 13 books356 followers
August 5, 2020
ক.
কর্নেলের গোয়েন্দাগিরির লেখক হিসেবে সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ পরিচিত। টাক-মাথা কর্নেল নিলাদ্রী সরকারের দুটি ছোট অভিযানে সঙ্গী হয়েছিলাম। কিন্তু তাতে সৈয়দ সিরাজের সাথে ভালো করে পরিচয় হয়নি। এরপর কিছু না জেনেই প্রচ্ছদ দেখে হাতে নিলাম তার ‘অলীক মানুষ’।

শফিউজ্জামানকে দিয়ে গল্প শুরু। সর্বোচ্চ দণ্ডের ঘোষণা শুনতেই শফির মনের পর্দায় দুটো মানুষের ছবি ফুটে ওঠে। একজন সাদা, একজন কালো। তবে তারা আসলে মানুষ না। জ্বিন। তার বাবাকে সাহায্য করতে এবং বিপদে ফেলতে যাদের আবির্ভাব। শুরুটাই কেমন যেন অদ্ভুত এই গল্পের। জ্বিনের মতো একটা বিষয় মোহময় হিসেবে উপস্থাপন না করে এমনভাবে এসেছে যেন মনে হচ্ছে এখান থেকেই যুক্তির সূচনা হবে।

শফি, শফিউজ্জামান। পরবর্তীতে ছবিলাল হিসেবে পরিচিত হয়। শফির বাবা বদিউজ্জামান। যিনি বদুপীর নামে সর্বাধিক পরিচিত। হিন্দু মুসলিম সকলের কাছে তার সমান কদর। অথচ, বদিউজ্জামান পীর হতে চাননি। তিনি পীর সংস্কৃতির বিরোধী। কিন্তু ফরায়েজী মতাবলম্বী এই মানুষটি সময়ের পরিক্রমায় পীর বলে পরিচিতি পান। এমনকি কখনও কখনও নিজেই ভুলে যান তিনি আসলে কে! সংসারে তার তিন সন্তানের মধ্যে ছোটটি শফিউজ্জামান।

শফি ছোটবেলা থেকেই একাকী। তার একাকীত্ব থেকে সে অনেক কিছু পেয়েছে। ভাবতে শিখেছে। দেওবন্দে পড়া তার বড় ভাই নুরুজ্জামান তা শিখতে পারেনি। আর মেজো ভাই তো জড়বৎ মানসিক প্রতিবন্ধী। দেওয়ান বারি সাহেব শফির ভেতরে কিছু দেখেছিলেন। তিনি ওকে নিয়ে ভর্তি করলেন ‘ইংরেজি শিক্ষার স্কুলে’। এই শুরু শফির বদলে যাওয়া।
খ.
শফি ভাবতে শিখেছিল। পড়েছিল প্রচুর। জানত, বুঝত অনেক। অথচ, তার মাঝে ছিল একজন খুনি। একজন শ��়তান। কিংবা নিরেট সাধু একটা মানুষ। সেই শফি জড়িয়ে পড়ল ব্রাহ্মদের সঙ্গে। করল স্বদেশী আন্দোলন। সেখানে হত্যা করল এক নীলকর সাহেবকে। মানুষ���র কাছে হয়ে উঠল গল্পের নায়ক।

কিন্তু শফি কি নিজে নিজেই এমন হল? না। তার ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছে সে। তার ভালোবাসার মানুষ রুকু, এখন তার মেজো ভাইয়ের স্ত্রী।

বদুপীর অর্থাৎ, বদিউজ্জামানের ‘মোজেজা’ দেখা যায় মাঝে মাঝেই। সেই সঙ্গে তিনি যে জ্বিনের উপর অধিকার রাখেন, তা গ্রামের সবার জানা। তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। কেবল নিজ গ্রাম না, খ্যাতি ছড়িয়ে পরে সর্বত্র। তাঁকে সবাই সিদ্ধ, সাধু বলে জানে। কিন্তু বদিউজ্জামান মনে মনে নিজের সাথে কথা বলেন। তিনি জানেন, তিনি সামান্য এক মানুষ। বদিউজ্জামান একা একা কাঁদেন। সন্তানের জন্য তার কষ্ট হয়, স্ত্রীকে তিনি ভালোবাসতে চান। সিংহাসন তিনি চাননা। তিনি জানেন তিনি কোন সিদ্ধ পুরুষ নন, একজন সাধারণ মানুষ।

কিন্তু মানুষ চাইলেই সে রকম করে পৃথিবী চলে না। হয়ত ঈশ্বর তার জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন অন্যকিছু। সেভাবেই চলতে থাকে, চলতে হয় মানুষকেও। সেভাবেই চলেন বদিউজ্জামান। নিজের সাথে লড়াই করে। কখনও কখনও কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ান তিনি। তিনি যেন এক একাকী মানুষের মূর্তি।

শফি আসলে তার পিতার প্রতিচ্ছবি। বদিউজ্জামান যেমন একা, তেমনি একা মানুষ শফি। পীর বদিউজ্জামান শুধু তার গণ্ডির পড়াশোনার মাঝে থেমে থাকেন নি। এর বাইরেও পড়েছেন, জ্ঞান অর্জন করেছেন। তিনি যেমন প্রচুর পড়েছেন, শফিও তেমনি। সাধারণ মানুষের কাছে দুজনেই দেবতা তুল্য। একজন ধর্মীয় দিক দিয়ে, অন্যজন সামাজিক-রাজনৈতিক। অর্থাৎ তাদের চলার পথ ভিন্ন। দুজনে ঠিক বিপরীত মানুষ। একজন অপরজনের জন্য ‘অলীক মানুষ’।

গ.
উপন্যাসটি অদ্ভুত। অদ্ভুত, কিংবা অলীক পদ্ধতিতে লিখেছেন সৈয়দ সিরাজ। কখনও উত্তম পুরুষে, কখনও লেখক সর্বদ্রষ্টা হয়ে। কখনও পত্রিকার ছাপা খবর দিয়ে, কখনও ছন্দে। কখনও যুক্তি দিয়ে, কখনও আবেগে ভাসিয়ে। সনাতন বাঙালী লেখকের মতো করে বর্ণনামূলক গল্প যেমন তিনি বলেছেন, তেমনি এই লেখার মধ্যে পাওয়া যাবে ম্যাজিক রিয়ালিজম। ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা, কখনও বর্ণনাভঙ্গির মধ্যে সেই জাদুবাস্তবতা দিয়েছেন লেখক। কেবল তাই নয়, এই লেখা ম্যাজিক রিয়ালিজমের এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে।

মূলত উপন্যাসটি দুইটি চরিত্রকে ঘিরে আবর্তিত এবং রচিত। কিন্তু দুই তিনটি নারী চরিত্র পাঠকের মনে দাগ কাটতে সক্ষম। এই চরিত্রগুলো লেখক একেছেন দারুণ মুনশিয়ানায়। প্রথমত সাইদা চরিত্রটির কথা বলা যায়। বদু পিরের মতো মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন তিনি। আমরা যেন আবার ফিরে যাই মার্কেজের উরসুলা ইগুয়ানার কাছে। দিলরুখ অর্থাৎ রুকুকেও ভোলা যায় না। প্রেমিকের বড় ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়ে এসেছে সে। তার জীবন যেন শাশ্বত এক ট্র্যাজেডি।

সিরাজ সাহেব চমৎকার লেখেন। গল্প, ভাষা, চরিত্রচিত্রণ, সবই অসাধারণ। গ্রামীণ পরিবেশের অসাধারণ বর্ণনার সাথে উপন্যাসে উপস্থাপিত সময়ের একটি স্পষ্ট চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এখানে। ধর্মীয়, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, সকল দিক দিয়েই এ উপন্যাস অনন্য।
Profile Image for Akhi Asma.
230 reviews464 followers
May 29, 2020
সবার পড়া উচিত এরকম একটা বই অলীক মানুষ।

দিশা আপুকে অনেক ধন্যবাদ বইটার পিডিএফ দিয়ে পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
Profile Image for Shuk Pakhi.
512 reviews305 followers
October 26, 2022
আঠারো বা উনিশ শতকের গ্রামবাংলার প্রেক্ষাপটের উপন্যাসে সাধারনত হিন্দু সংস্কৃতিরই দেখা পাওয়া যায়। সেখানে আমজনতা হিসেবে কিছু মুসলমান চরিত্রও মাঝেসাঝে থাকে। তবে মুসলিম ঘরানার উপন্যাস বেস বিরলই বলা চলে। সেই বিরলের মধ্যে এই বইটি স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।
এক ধর্মের সাথে আরেক ধর্মের দ্বন্দ্ব ত রয়েছেই সাথে জুটেছে মুসলমানদের নিজেদের মধ্যকার নানা তরিকার মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদ।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখার সঙ্গে প্রথমবার পরিচয় ঘটলো। প্রথম পরিচয়েই গভীর ভাবনার খোরাক জুগিয়েছেন। খুবই চমৎকার।
Profile Image for Amit Das.
179 reviews117 followers
January 11, 2021
এ যাবৎ আমার পড়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
নতুন বছরটা দারুণভাবে শুরু হলো, বলতেই হয়!
Profile Image for Meem Arafat Manab.
377 reviews256 followers
May 23, 2017
অনেক ভাবলাম পড়ার পরে। এই যে আমরা বলি, আপনিও, টাইম নাই, এটা কী বাংলার জন্য খারাপ?
ওয়াক্ত শব্দটারে কী আমি দ্বার খুলে দেই নাই?
ভেবেটেবে (আমার ভাবনার পরিসীমা ছোটো, অনেক বলতে দুদশ মিনিট) মনে হলো, আপনি ওয়াক্ত বলতে নামাজের
ওয়াক্ত, দিনের একটা অংশ এইসব বুঝান, টাইম বলতে আপনি হুবহু সময়কে বুঝান, শুধু সময়রে বদলে দেন টাইম দিয়ে, ফলে আমার মনে হয়, সময় একদিন নাই হয়ে গেলে বাংলা থেকে?

এই বইখানা কেমন? এম্বিশ্বাস! আমার অবশ্য এরকম মনে হওয়ার কারণ থাকতে পারে, যারেই বলি, এই বইয়ে পীর ঘরানার ব্যাপারস্যাপার আছে, লোকজন বলে, লালসালু? বহিপীর? কিন্তু ব্যাপারটা কী, এইখানে পীর ভালো লোক, খুব সুবিধার কাজ না করলেও লোক ভালো, দেখতে আমার ভালো লাগে। দীর্ঘ সুতা লাগানো বংশলতিকায় আমার পরিবারজুড়ে আছেন পীর, মোল্লা, মুন্সী। ইসলামে বিশ্বাস হারাইলেও তাই আমার আস্থা খোয়া যায় নাই হইত সেরকম।

এই যে, নদী আর পাপ, এই যে বাংলার বাংলা হয়ে উঠা, আমি আসলে আবহমান শাশ্বত বাংলার ধারণবাহনে বিশ্বাস করি না, আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, হয়ত জীনগত কারণে করতে হয়, এই আধখাওয়া দুইটা বাংলা আবহমান কাল ধরে বাংলা হয়ে উঠেছে, এবং যত যাই হোক, বাংলা বাংলাই, আগে পিছে দেশ থাক, না থাক।

এরকম ভালো ছোটোবেলায় লাগছিলো বিষাদ সিন্ধু পড়ে। ভাই রে ভাই, সে কী এক কাহিনী! আর লাগছিলো কিছুটা ইলিয়াসের উপন্যাস দুইটা পড়ে। এর বাইরে এসব নিয়ে এরকম উপন্যাস মনে পড়ে না। এরকম উপন্যাস এম্নিতেও মনে পড়ে না তেমন।

কিছু কাজ শুরুতে ভালো লাগে নাই, যেমন ঊনিশশো সালের মুখে চলিত বুলি তুলে দেয়া। কিন্তুক, মেনে নিছি, কারণ ঐ বয়ানের নকল করে কার সাধ্যি। আমার বরং এখন ইংরেজি অক্ষর জায়গায় জায়গায় দেখে গা জ্বলে গেছে।

এতগুলি সংস্করণের পর গাজিরে হাজি লেখা কী মুদ্রণপ্রমাদ না স্রেফ গাফিলতি ঠাহর করতে পারি না।

কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে না, বরং মাথার ভেতরের অনেক জানা উত্তরের প্রশ্নগুলি মনে করতে পড়ে ফেলান অলীক মানুষ। ষোলো সালে আমার পড়া সবচে অসাধারণ। চোখ বুজে!

দীপ্তির বই।
Profile Image for হামিম কামাল.
79 reviews29 followers
Read
June 23, 2022
অলীক মানুষের মতো গাঢ় একাত্মতা আর ক'টা উপন্যাসের সঙ্গে বোধ করেছি? না, আর করিনি বোধয়। কারণটা ব্যক্তিগত।

শফির এমন পরিণতি চাইনি। তবে এ বিলাপ হঠকারী। আলো দেওয়ার বিপরীতে ক্ষয় স্বীকার না করে উপায় নেই। আর ক্ষয়ের যেটুকু অপচয়, গাঢ় অপচয়, সেটুকুর কাছেও আমাদের ঋণ। কারণ ও-ই তো আমাদের ব্যথায় ধনী করে।

আমাকে এ উপন্যাস পড়িয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান। প্রিয় নোমান ভাই। তাঁর কাছে ঋণী।

আর সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জন্যে অভিমান। অলীক মানুষ, মায়ামৃদঙ্গই তাঁর প�� ছিল। সে পথে না হেঁটে তিনি কোথায় কোথায় বেড়ালেন। বাংলা সাহিত্যের আরেক ট্রাজিক নায়ক।
Profile Image for Ahmed Aziz.
380 reviews69 followers
February 11, 2021
মানুষের মনের চেয়ে বিচিত্র আর কিছুই নেই। প্রকৃতি আর সময়ের স্রোত মানুষের মনে তৈরি করে অলৌকিকতার আবেশ। প্রিয় বন্ধুকে হারানোর পরে হাহাকার শূণ্যতার মাঝে পড়া প্রথম বইটাই তাই শীতের শেষ বিকেলে নিঃসঙ্গতার ছায়া হয়ে থাকে। বইয়ের মানুষগুলো যেন জাদুর মত বাস্তব হয়ে হাওয়ার মত হারিয়ে যায়।
Profile Image for musarboijatra  .
283 reviews350 followers
July 24, 2023
কী পড়লাম এটা!

গ্রামীণ সমাজের ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের চিত্র দিয়ে শুরু (যেখানে 'লাল সালু'র কথা মনে পড়েছিল), ক্রমে পিতা-পুত্রের চরিত্র এবং সম্পর্কের আলোকপাত থেকে, ডমিনেটিং পুরুষ চরিত্রের অধীনে অন্য পুরুষদের বন্দী সত্ত্বার উন্মোচন, সেখান থেকে ধীরে ধীরে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, এবং বঙ্গীয় মুসলিম সমাজের দলাদলি'র রাজনৈতিক ও দার্শনিক স্বরূপ, সেই থেকে আবার ব্যাক্তিগত দর্শন, পর্যবেক্ষণ, মানুষে-মানুষে সম্পর্ক... কেবল ৩২০ পৃষ্ঠার বয়ান, কিন্তু এ মাঝে অমূল্য শিল্প তৈরী করেছেন লেখক!

এবং লেখনশৈলীতে সর্বোপরি প্রচলিত ভাষা ও শব্দের ব্যবহার, অলৌকিকতা, এবং তৎকালীন সংবাদপত্র ও পুঁথি সাহিত্যের স্বাদ টেনে আনা হয়েছে, এটাও আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় ছিল।

সবিস্তারে রিভিউ লিখছি পরে। যদি আমার দ্বারা সম্ভব হয়। অবশ্যপাঠ্য একটা উপন্যাস।
[ ভালো করে বললে বাঙালী সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে বাঙ্গালী মুসলমান সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা মানুষদের জন্য অবশ্যপাঠ্য একটা উপন্যাস। ]
Profile Image for Shaid Zaman.
290 reviews47 followers
November 21, 2023
উদ্ভট ও অদ্ভুত এক উপন্যাস। কখনো এ বর্ণনা করছে তো কখনো ও বর্ণনা করছে। বিশাল একটা টাইম ফ্রেম নিয়ে খেলেছেন লেখক, চারটা জেনারেশন। কিন্তু উপন্যাস চলতে চলতে কখন কোথায় চলে যাচ্ছেন প্রথম প্রথম ধাক্কা খেতে হয়।

তারপরে ও চার তারা! কেন?

এমন অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আমার আগে কখনো হয়নি। এরকম বেখেয়ালি একটি উপন্যাস আমাকে টেনে রেখেছে শেষ পর্যন্ত। না পড়লে এই অভিজ্ঞতা আপনার হবে না, সম্ভব না।
Profile Image for Mahbub Mayukh Rishad.
57 reviews15 followers
May 29, 2021
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অলীক মানুষ আমাদের দেশে সেই অর্থে পরিচিত নাম নন।পশ্চিমবঙ্গের তার সমসাময়িক অন্যান্য সবাই বিপুল পঠিত হলেও মুস্তাফা সিরাজ নন। তার কর্ণেল সমগ্রের পাশে অলীক মানুষের মতো উপন্যাস লিখেছিলেন তা আদৌ কতজন মানুষ জানে, কে জানে। তবে সংখ্যাটি যে বেশি হবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
২০১২ সালে অলীক মানুষ পড়েছিলাম। দৈবাৎ বইটি হাতে এসেছিল। চিটাগাং থেকে ফিরছিলাম ট্রেনে। ট্রেনের কামরায় আমার পাশে নাম না জানা এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। তার হাতে অলীক মানুষ শোভা পাচ্ছে। ফেণীর পর ট্রেন বিকট শব্দ করে নষ্ট হয়ে গেল। লোকটি বই পড়ছিল না। আমি বললাম, দেয়া যাবে? তিনি বললেন নিশ্চয়।
তো প্রায় বার ঘন্টা দীর্ঘ ট্রেন জার্নিতে বইটি পড়া হলো আমার। শুরুর সাদা জিন-কালো জিন থেকে শেষ পর্যন্ত এমন মোহগ্রস্ত আবেশে ডুবে ছিলাম, তা এখনও স্মরণ করতে পারি। কিছুদিন আগে আবার বইটি পড়া হলো। উনিশ-বিশ শতকের একজন মুসলমান ধর্মগুরু বদিউজ্জামান, তার ছেলে শফিউজ্জামান এই উপন্যাসের মূল চলক। গল্প বলার আঙ্গিকে কখনো মিথ, কখনো নাম পুরষ, কখনো উত্তম পুরুষ। বাবা যেখানে পীর, ছেলে সেখানে হয়ে ওঠে ধর্ম বিরোধী। কৈশোরের প্রথম ভালোলাগার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় তার বিকলাঙ্গ ভাইয়ের সাথে। শফি তখন ব্যস্ত আত্ম আবিষ্কারে, প্রকৃতির কাছে নিজেকে সমপর্নে।
মিথিক্যাল এই উপন্যাসটি সাহিত্যের যেকোনো পাঠকের অবশ্য পাঠ্য বলে মনে হয়, মনে করি।

উপন্যাসটি লেখা হয়েছে ১৯৮৮ সালে। অনূদিত হয়েছে এগারোটি ভাষায়।
Profile Image for Mehedi Hassan.
1 review5 followers
August 27, 2017
অলীক মানুষঃ এক অনন্যসাধারণ উপন্যাসের কথকতা
.
‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসের শুরুর বাক্যটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’-এর কর্নেল অরিলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার কথা। যেইভাবে কর্নেল বুয়েন্দিয়া ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে স্মরণ করেছিল অনেক দূর শৈশবে নিজের পিতার সাথে বরফ আবিষ্কারের কথা ঠিক সেই একইভাবে এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র শফিউজ্জামান স্মরণ করে দুজন মানুষ অথবা মানুষ নয় অন্য কিছুর কথা।
.
“দায়রা জজ ফাঁসির হুকুম দিলে আসামি শফিউজ্জামানের একজন কালো আর একজন শাদা মানুষকে মনে পড়ে গিয়েছিল।”
.
আর তারপরে, ঠিক মার্কেজের মতনই, এই বাক্যের সাথে সাথে এক মহাকাব্যের সূচনা করেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। ধীরে ধীরে উন্মোচন করেন উনিশ-বিশ শতকের এক মুসলিম পরিবারের প্রায় শত বছরের উপাখ্যান। আমরা প্রত্যক্ষ করি এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের কথা, উত্থান দেখি পীর-মাজার প্রভৃতি বেশরীয়তী কাজের বিরোধী এক ফরাজি আন্দোলনের নেতার, যে কিনা কালে কালে নিজেই পরিণত হয় পীরে, আমরা শফিউজ্জামানকে চিনতে থাকি, যে কিনা ধীরে ধীরে আমাদের কাছে অচেনা হতে থাকে এবং অত্যন্ত ব্যথিত চিত্তে লক্ষ করি সেই পরিবারের ক্ষয়কে।
.
কিন্তু ‘অলীক মানুষ’ কি কেবলই একটি পরিবারের গল্প? আমার কাছে তা মনে হয় নি। ‘অলীক মানুষ’ যদি নিছকই একটি পরিবারের গল্প হত তাহলে মনে হয় না এই উপন্যাস এতটা জনপ্রিয় হত পাঠক সমাজের কাছে, পেত না এত এত পুরস্কার। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে এই উপন্যাসের মাধ্যমে লেখক উনিশ শতকের প্রারম্ভ্রে থাকা গোটা মুসলিম সমাজকেই চিত্রায়িত করেছেন। লিপিবদ্ধ করেছেন তাদের সংস্কার-কুসংস্কার-আচার-আচরণ-বিশ্বাস-অবিশ্বাস-অন্ধবিশ্বাস সহ। এ উপন্যাস তাই নিছকই এক উপন্যাস হয়ে থাকে নি, লেখকের মুনশিয়ানায় রূপান্তরিত হয়েছে এক নির্মোহ দলিলে।
.
কাহিনী অগ্রসর হয়েছে দুই প্রজন্মের দুই অলীক মানুষকে কেন্দ্র করে। যাদের একজন বদিউজ্জামান, যার প্রকৃত নাম ‘সৈয়দ আবুল কাশেম মুহাম্মদ ওয়াদি-উজ-জামান আল-হুসায়নি আল-খুরসানি’ এত বড় নাম যখন গ্রাম দেশের মানুষ বলতে পারল না, তাই তাঁর নাম সংক্ষেপে হয়ে গেল বদুপির। কিন্তু বদুপির আদতে বদুপির হতে চায় নি। সে ছিল ফরাজি আন্দোলনের সমর্থক, পীর মাজার প্রভৃতির ঘোর বিরোধী, এমনকি সে নিজেও খয়রাডাঙার খোঁড়াপীরের মাজার ভেঙে দিয়ে এসেছে। অথচ তাঁর অনুগামী লোকেরাও কেবল মোজেজা দেখতে চায়। তাই ধীরে ধীরে তাঁর প্রত্যেকটা কর্মকান্ডকে লোকে ব্যাখ্যা দিতে থাকে নানা অলৌকিকতার চাদর জড়িয়ে। সামান্য বাতাসে উড়ে যাওয়া টুপিকে সে ব্যাখ্যা করতে থাকে কালা জিনের কারসাজিতে। এইভাবে, ঠিক এইভাবে বদিউজ্জামান পরিণত হন অলীক মানুষে।
.
কাহিনীর অপর প্রান্তে রয়েছে শফিউজ্জামান। বদিউজ্জামানের ছোট ছেলে। স্বভাবে সে বদিউজ্জামানের মতই। শান্ত, চুপচাপ। কিন্তু সে ঠিক বাবার মতন নয়। একটু আলাদা। শফির জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় এই উপন্যাসের গতি। গতানুগতিক মাদ্রাসায় না পড়ে শফির ইংরেজি স্কুলে পড়তে যাওয়া, সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া, ব্রাহ্ম আশ্রমে যোগদান করে সবার অলক্ষ্যে স্বদেশী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাওয়া, আর তারপর খোকার ভাষায় সেই ‘এনার্কিস্ট”-এ পরিণত হওয়া আর সবশেষে আরেক অলীক মানুষ পরিণত হওয়া সবই ঘটতে থাকে উপন্যাসের পাতায় পাতায়। শফি যে পরবর্তীকালে বদিউজ্জামানের বিপরীত হবে এ কথ�� স্পষ্ট হয়ে যায় যখন শফির কৈশোর পীড়িত হতে থাকে বদিউজ্জামানের পোষা জিনের ভয়ে। শফি যে কাজই করুক না কেন তাঁর মনের মাঝে কাজ করে এই বুঝি তাঁকে দেখে ফেলল বদিউজ্জামানের কোন এক জিন।
.
প্রত্যেক বইয়ের শুরুতে কিছু না কিছু লেখার অভ্যেস ছিল একসময় আমার। এই বইয়ের শুরুতে দেখি লেখা রয়েছে আহমাদ মোস্তফা কামালের একটি উদ্ধৃতি, “যে মানুষের একটি নির্দিষ্ট দর্শন আছে- সেটা ভালো বা খারাপ যাই হোক, সে বুদ্ধিমান ও ভাবুক।” এই বাক্যটি সেদিন কেন এই বইতে লিখেছিলাম আজ আর তা মনে পড়ে না, কিন্তু বইটি পড়তে যেয়ে বিস্মিত হই কতটা প্রাসঙ্গিক এই উদ্ধৃতিটি। বস্তুত এই উদ্ধৃতির মাধ্যমেই বিচার করা যায় শফির চরিত্রকে। পাঠক সে বিচার করতে পারবেন বইটি পড়তে গিয়ে।
.
এ উপন্যাসের পুরোটা জুড়ে যদিও রয়েছে দুইজন শক্তিমান পুরুষ তবুও নারী চরিত্র নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। কারণ জীবনের মতনই এই উপন্যাসের পুরুষের সমস্ত কর্মকাণ্ড নারী দ্বারা পরিবেষ্টিত। প্রথমেই সাইদার কথা বলে নেয়া যাক। যেন মার্কেজের উরসুলা ইগুয়ানার বাঙালী সংস্করণ এই নারী। যেমন তাঁর দৃঢ়তা তেমনি তাঁর অকপট সব কাজ। পীর বদিউজ্জামান যখন মাসাধিককাল পরে নিশুতি রাতে স্ত্রীর সহবাস কামনা করে মসজিদ ছেড়ে বাড়িতে চলে আসে বৃষ্টিতে ভিজে তখন সম্ভবত সাইদার মতন এক নারীই পারে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে। আবার বাঁশি বাজানোর অপরাধে ফজুকে যখন গাছের সাথে বেঁধে রেখে জুতোপেটা করা হয়েছিল তখন এই নারীই পেরেছিল গ্রামের সবার সামনে তাঁকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলতে, “কত বড় বুজুর্গ হয়েছে, কত জিন পোষা আছে, দেখি। সাধ্যি থাকে তোমার জিনেরা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিক।” এ যেন প্রকাশ্য বিদ্রোহ। দিলরুখ বা রুকুর কথা বিশেষভাবে স্মরণীয় কারণ সমগ্র উপন্যাসে সেই একমাত্র নারী চরিত্র যার ট্র্যাজেডি সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায়। ভালোবাসে শফিকে, অথচ বিয়ে করতে হয় এক অর্ধজন্তু-মানবকে, যাকে সে কখনোই স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারে না। সারাটা জীবন শফিকে ভালোবেসে বুঝতে পারে শফির মতন “বেরহম দিল” দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই। একে একে আসতে থাকে ইকরা-আসমা-সিতারা-রত্নময়ী আর স্বাধীনবালার মতন আরও অনেক নারী চরিত্র, যারা উপন্যাসের পাতায় আর অক্ষর হয়ে থাকে না কেবল, হয়ে ওঠে রক্তমাংসের কোন মানুষ, যাদের বেদনা আমাদের ব্যথিত করে আর তাদের হাসি আমাদের করে তোলে বিহ্বল, জাগায় মিঠে মিঠে বিভ্রান্তি।
.
ইংরেজ ঔপন্যাসিক উইল সেলফ সেদিন লিখেছেন, দ্য নভেল ইজ ডেড, দিস টাইম ইট’স ফর রিয়েল। উপন্যাস খুব দ্রুত আবেদন হারাচ্ছে আমাদের এই নাগরিক ব্যস্ত সমাজে। তিনি এও ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, উপন্যাস হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে। কেননা নাগরিক ব্যস্ত সমাজে এতটা দেয়ার মতন সময় আজ আর কারো হাতে নেই। মানুষের হাতে আজ বিনোদনের এত এত অপশন যে উপন্যাসের মতন এত ধীর গতির বিনোদনের পিছে এতটা দীর্ঘ সময় কেউ বরাদ্দ করতে চাইবে না, মানুষ এখন দ্রুত বিনোদিত- আমোদিত হতে চায়। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, না। উপন্যাসের আবেদন কখনো হারাবে না। মানুষকে যেভাবে বিশ্লেষণ করা যায় উপন্যাসে, তা সাহিত্যের আর কোন শাখাতেই করা সম্ভব নয়। আর এই কারণেই উপন্যাস টিকে থাকবে।
.
এই বিশ্লেশনকে আমি ‘তলস্তীয় অন্তর্দৃষ্টি’ নামে অভিহিত করতে চাই। তলস্তয় যেভাবে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রদের মনোবিশ্লেষণ করেন যাতে করে একজন পাঠকের কাছে চরিত্রগুলোকে আর দোষারোপ করার উপায় থাকে না, বরঞ্চ মনে হয় তাদের সমস্ত কাজই ভীষণ রকম মানবিক, কোন ঔপন্যাসিকের বানানো গপ্পো নয়, ঠিক সেই একই দক্ষতায়, একই নিপুনতায়, একই মানবিক সহানুভূতি দিয়ে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ তাঁর চরিত্রগুলোর মনোবিশ্লেষণ পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
.
“রুকু লক্ষ্য করে, রোজির মধ্যে তাঁর মায়ের আদল ফুটে বেরুচ্ছে। প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা তাঁকে ভেতর থেকে তাতিয়ে দেয়। ভাবে, সে যদি ‘জন্তুমানুষটা’র বউ না হত, তাহলে সংসারের ন্যায্য শরিকানটি দখল করত। সেও হয়তো কোমরে আঁচল জড়াত। কিন্তু কী দরকার অত ঝামেলায় নাক গলিয়ে? বেশ তো আছে।
না- সত্যিই সে ভালো নেই। যখন-তখন একটা জন্তুমানুষের কামার্ত আক্রমণ, এমনকি রজস্বলা অবস্থাতেও রেহাই নেই। চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে রুকু অবশ শরীর রেখে পালিয়ে যায়- পালাতেই থাকে, দূরে- বহুদূরে। কিন্তু কোথায় যাবে? কার কাছেই বা তাঁর এই মানসিক সফর? খালি মনে হয়, খোঁড়াপীরের দরগায় ভাঙা ফটকে কাঠমল্লিকার ফুলবতী গাছের কাছে উলটো মুখে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। ভয় পেয়ে পিছু হটে ফিরে আসে নিজের শরীরে। বেইজ্জত শরীরের ভেতর ঘৃণা, ঘৃণা আর ঘৃণা। নিজের ওপর, সবকিছুর ওপর...”
.
ঠিক এইখানেই গল্প হার মেনে যায় উপন্যাসের কাছে। রুকুর মনের এই যে অন্তর্দহন তা ছোট একটা গল্পে কোন গল্পকার ফুটিয়ে তুলতে পারত কি না সন্দেহ। আবার প্রতিটি চরিত্রের দিকে নজর দেয়া, তাদের চরিত্রকে বিশ্লেষণ করা এবং কেন তারা এমন আচরণ করল তার ব্যাখ্যা দেয়ার জন্যে হলেও উপন্যাসের প্রয়োজনীয়তা আছে।
.
অবশ্য ক্ষেত্র বিশেষে লেখক মুস্তাফা সিরাজকে আমার বেশ পিউরিটান মনে হয়েছে। কথার সপক্ষে যুক্তি প্রদান করতে গেলে দুটি ঘটনার কথা এই বেলা উল্লেখ করা যায়। বড়োগাজীর দ্বিতীয় পক্ষের বউ নসুর কাছে বড়োগাজি আদতে কি চায় সেটা ষোল বছরের ছেলে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলেও লেখক সেখানে কেবল অশ্লীল শব্দ লিখে তা ব্র্যাকেটে আঁটকে রেখেই সন্তুষ্টি বোধ করেন। আবার বিকলাঙ্গ এবং মানসিক প্রতিবন্ধী মনিরুজ্জামান যখন বারবার নিজের স্ত্রীর কাছে অপমানিত হয়ে ফিরে আসে তখন জৈবিক তাড়নায় সে স্বমেহনে প্রবৃত্ত হয়। অথচ এইখানে লেখক নিজে এসে আমাদে জানায়, “মনিরুজ্জামান সম্পর্কে একটি ঘৃণ্য বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। পশুর তীব্র যৌনবোধ থেকে এই হতভাগ্য প্রতিবন্ধী নিষ্কৃতি পায় নি। সে স্বমৈথুনে অভ্যস্ত ছিল।” এইখানে লেখক কর্তৃক “ঘৃণ্য বিষয়” শব্দদ্বয় লক্ষণীয়। অবশ্য মুস্তাফা সিরাজের কাছে এমন মন্তব্য আশা করা খুব একটা অসমীচীন হবে না বলে বোধ করি। কেননা শরীর নিয়ে মানিকের পরে এমন তীব্র দ্বেষ নিয়ে উক্তি বোধহয় সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজেরই আছে। এবং তা মনে রাখার মতন... “হায় শরীর। মানুষের হারামাজাদা শরীর। শুয়োরের বাচ্চা শরীর। নেড়ি কুত্তার শরীর।”
.
কিন্তু শব্দ চয়নে যে লেখককে অনেক কসরত করতে হয়েছে তা বেশ বোঝা যায়। কারণ গল্পটা মুসলিম পরিবারকে নিয়ে লেখা হলেও সেটা লেখা হয়েছে হিন্দু আবহ মণ্ডলে। তাই লেখক সম্ভবত তাঁর পাঠক গোষ্ঠীর জন্যে এমন কোন শব্দ নির্বাচন করতে চান নি যাতে করে তাঁর পাঠককুলকে হেনস্থা হতে হয়। এইখানে আমার বেশ খটকা লাগে। একজন মুসলমান সাহিত্যিক বলেই কি তিনি এইভাবে লিখেছেন? হিন্দুরা যখন নিজেদের পুজো আচ্চার অনেক কিছুই সংস্কৃত ভাষায় লেখেন তখন তো সেগুলোর ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। তখন একজন মুসলমান লেখক কেন আরবি ফারসি শব্দ ব্যবহার করার সময় সেগুলোর ব্যাখ্যা দিচ্ছেন? এইখানে কি লেখক ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগছিলেন? এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার কথা। তাঁর কবিতা তো সেই সময়ে হিন্দু-মুসলমান সবার মাঝেই বহুল ভাবে পঠিত ছিল। পঠিত যে ছিল সেটা টের পাওয়া যায় জীবনানন্দের মতন কবি যখন তাঁর কবিতায় মুসাফের, ইলাহা, মোয়াজ্জেন, তখত, তসবি জাতীয় প্রভৃতি আরবি ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন নজরুলের অনুকরণে। তাহলে তখন তো কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে নি, তাহলে এই সময়ে এসে কেন মুস্তাফা সিরাজকে ব্যাখ্যা করতে হয় তসবিহ, ওয়াক্ত, ওজুর মতন সাধারণ টার্ম গুলোর? আমরা তখন চিন্তা করতে পারি সমরেশ মজুমদারের কথা। তিনি বলেছিলেন, “বাংলাদেশের পাঠকেরা যতটা উদারমনা, পশ্চিমবঙ্গের পাঠকেরা ততটা নয়।”
.
তৎকালীন হিন্দু মুসলমানের চালচিত্র বেশ টের পাওয়া যায় কতকগুলো চরিত্রের কতক সংলাপ এবং কার্যাবলীর মাধ্যমে। যেমন শফি দেখতে সুন্দর ফরসা বলে প্রফুল্লবাবুর স্ত্রী বলেন, “চেহারা দেখে মনে হয় বাঙালির ছেলে। মুসলমান বলে চেনাই যায় না।” অর্থাৎ মুসলমান হলে সে বাঙালি নয়, বাঙালী কি কেবল গৌর বর্ণের হিন্দুই? আবার হরিনাথের মতন সামান্য ময়রা দেওয়ান আবদুল বারি চৌধ��রির মতন লোককে যখন মিষ্টি দেয় আধ হাত উপর থেকে-ছোঁয়া বাঁচিয়ে, তখন সাথে সাথেই আমাদের বোঝা হয়ে যায় সেই সময়ে হিন্দু সমাজ কীভাবে দেখত মুসলমানদের। আবার নুরুজ্জামান বাংলায় কথা বলে না, তা হিন্দুর ভাষা বলে, সে কথা বলে উর্দুতে, বলে এটা মুসলমানের জবান। আবার এর ব্যতিক্রমও পরিলক্ষিত হয়। বদুপিরের কাছে মেয়ের ভূত তাড়ানোর জন্যে ধন্না দেয় জমিদার অনন্তনারায়ণ বাবু। বদুপির যেইখানে যায় সেইখানে হিন্দু মুসলমান সকলেই জমায়েত হয়, তাঁর কাছে মানত করে।
.
লেখকের ভাষার এবং চিত্ররুপময়তার শক্তিমত্তা পুরো উপন্যাস জুড়েই প্রতীয়মান, তবুও এই একটি পরিচ্ছদ আমার মনে থাকবে অনেক অনেক দিন।
.
“ওই শীর্ণ বেহুলা নামের স্রোতস্বিনী, যাকে এখন এই শরৎকালে বেহালার টানটান তারের মতো দেখায়- যেন ছুলেই টুং করে বেজে উঠবে, সে কেমন করে সব-ভাসানিয়া স্বভাব আর সাহস পায়?... নদীর দিকে কখনো আলাদা করে তাকাতে জানতাম না তখনও। তখনও কি জানতাম আলাদা করে কিছু- ওটা গাছ, এটা মাঠ, ওটা আকাশ এটা কাশবন? ... কুঠিবাড়ির জঙ্গলে, ওপারে মেহেরুর কুঁড়েঘরের সামনে দাঁড়ানো গাবগাছের ছায়ায় মাচানে বসে এক আদিম পৃথিবীর গল্প শুনতে শুনতে একটি পরাবাস্তবতা আমাকে আবিষ্ট করত। বড়ো স্বাধীনতাময় সেই পরাবাস্তবতা...”
.
আঙ্গিকের দিক থেকেও ‘অলীক মানুষ’ বাংলা সাহিত্যে একমেবাদ্বিতীয়ম। এমন ঢঙে বাংলা সাহিত্যে আর একটি উপন্যাস লেখা হয়েছে কিনা আমার জানা নাই। প্রায় শতবর্ষব্যাপী বিস্তৃত এই উপন্যাস লিপিবদ্ধ হয়েছে কোলাজ রীতিতে। কখনো সাদামাটা ভাবে কাহিনীর বয়ান তো কখনো উত্তম পুরুষে, আবার কখনো চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত ডায়রির পাতা টুকরো টুকরো ভাবে এসে বলে গেছে কাহিনী আবার কখনো শুধুই দুইটি কি তিনটি চরিত্রের সংলাপ আবার কোথাও শুধুই খবরের কাগজের একটি পৃষ্ঠা। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল সময়ের ফ্রেমকে ভেঙে দেয়াটা। অতিত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন এক মজার খেলায় মেতেছিলেন লেখক যে কেবল মাত্র সেই খেলায় শরীক হলেই এর মজাটা টের পাওয়া যাবে। একটা ঘটনা ঘটে গেছে অথচ তাঁর বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও, সেই ঘটনার পরের ঘটনা হয়তো লেখক বর্ণনা করছেন অথচ আমরা জানি এখনও সেই ঘটনা ঘটেই নি। তাহলে কোথায় গেল সেই ঘটনা? এইভাবে লেখক টাইম-ফ্রেম দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে পাঠকের সাথে এক ধরণের মাইন্ডগেমে লিপ্ত হয়েছেন লেখক, মুহূর্তকাল অমনোযোগী হয়েছেন কি কাহিনীর সুতো আপনার হাতের বাইরে চলে যাবে। এ এক অনন্যসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ।
.
পরিশেষে বলতে চাই, কেবল বাক্যেই নয়, ঘটনার পরম্পরায়, ইসলামিক মিথ, লোককাহিনী, উপকথা, যৌনতা, মানুষের অন্ধবিশ্বাস এবং যাবতীয় সকল কিছু মিলিয়েই এই উপন্যাস হয়ে ওঠে মার্কেজের “নিঃসঙ্গতার একশ বছরের” যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী।
.
সবাইকে ধন্যবাদ।
Profile Image for Md Shariful Islam.
258 reviews84 followers
November 28, 2020
কর্নেল সমগ্রের লেখক হিসেবে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের নাম প্রথম শোনা সেই ছোটবেলায় যদিও এখন পর্যন্ত পড়া হয় নি! এরপরে বেশ বড় একটা গ্যাপ, পরেরবার তাঁর নাম চোখের সামনে আসে ( এক রুমমেটের কাছে এই বইটাই দেখেছিলাম) ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে হলে ওঠার পর। আর অবশেষে পরশুদিন যখন আবারও বইটার রিভিউ সামনে আসল, তখন মনে হল আর দেরি করা ঠিক হবে না। যেই ভাবা সেই কাজ, পিডিএফ ডাউনলোড করে পড়া শুরু করলাম তখনি। তো কি পড়ছি আর কাকে পড়ছি সেটা জানার জন্য একটু গুগল করতেই পেলাম বেশ কিছু তথ্য। বইটা একাডেমি পুরস্কারসহ বেশকিছু সম্মানজনক পুরস্কারপ্রাপ্ত একটা বই এবং লেখকের সম্পর্কে দুইটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যও পেলাম দুই বরেণ্য লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। তারাশঙ্কর বলেছেন, ‘ আমার পরেই সিরাজ, সিরাজই আমার পরে অধিষ্ঠান করবে।‘ আর শীর্ষেন্দু বলেছেন লেখকের বহুল পঠিত গোয়েন্দা সিরিজ ( কর্নেল সিরিজ) লিখে তিনি নাকি নিজের প্রতিভার অপচয় করেছেন।

এবার আসি বইটার কাহিনী নিয়ে। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ তিন কালব্যাপী প্রায় একশ বছর সময় নিয়ে বইটা বিস্তৃত যেখানে বিভিন্ন কালের ঘটনাবলী মিশে গিয়েছে একবিন্দুতে। একদিকে রয়েছে ওহাবী মওলানা বদিউজ্জামান, দ্বিতীয় দিকে রয়েছে তার পুত্র স্বদেশী আন্দোলনের কর্মী শফিউজ্জামান এবং অন্যদিকে রয়েছে তার নাতি-নাতনী খোকা ও কচি। মূলত বদিউজ্জামান এবং শফিউজ্জামানের জীবন ও চিন্তার প্রকাশ বইটা যেখানে তৃতীয় দিকটা এসেছে অতীতকে বিচার করার মাধ্যম হিসেবে।

উপন্যাসটা শুরু হয়েছে শফিউজ্জামান বা শফির ফাঁসির হুকুম শোনা দিয়ে। এরপরে লেখক আমাদের নিয়ে গিয়েছেন শফির শৈশবে বা বদিউজ্জামানের (যিনি পরে বদি মওলানা এবং বদিপীর নামে পরিচিত হবেন) সময়ে। সেখানে আমরা দেখতে পাই ওহাবী মতাদর্শে বিশ্বাসী বদিপীর একেক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ঘুরে এক যাযাবরের জীবন কাটাচ্ছেন। কোনো এক গ্রামে তিনি স্থায়ী হলেই গ্রামটা তার আশ্চর্য প্রভাবে ওহাবী মতাদর্শ গ্রহণ করলেও অভ্যাসবশত গ্রামবাসীদের দ্বারা সামান্য বিচ্যুতি ঘটলেই তিনি পাড়ি জমান পরের গ্রামে। এভাবে একের পর এক গ্রামে ঘোরার সময়েই তার সাথে জড়িয়ে পড়ে কিছু বাস্তব, অর্ধ-বাস্তব আর অবাস্তব ঘটনা যা তাকে ধীরে ধীরে পরিণত করে এক অলীক মানুষে যখন তিনি নিজেকে আর সাধারণ মানুষ ভাবতেই পারেন না অথচ তিনি আগাগোড়া এক সাধারণ মানুষ।

এই সময়েই তার কনিষ্ঠ পুত্র শফিউজ্জামান বা শফি তার শৈশব পার করে। ছোট থেকেই বাবার চরিত্র থেকে ভিন্র চরিত্রের অধিকারী শফি বাবার থেকে প্রথম দূরে সরে যায় যখন সে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হয়। একদিকে রুকুর প্রেম তাকে গ্রামের দিকে টানলেও সে আবিষ্কার করে আরও বৃহত্তর কিছু যা তাকে সাধারণ জীবন থেকে সরিয়ে নেয় বহুদূরে। সৈয়দ বংশীয় শফি ধর্মদ্বেষী হয়ে পড়ে, হিন্দুদের কাছাকাছি চলে যায়, ব্রাহ্মদের সাথে মিলে স্বদেশী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আন্দোলনের অংশ ছাড়াও নানা কারণে তার হাতে ঘটতে থাকে একের পর এক খুন যা তাকে সাধারণের কাছে করে তোলে নায়ক আর প্রশাসনের চোখে ভিলেন। সেও হয়ে দাঁড়ায় আরেক অলীক মানুষ যাকে কেউ বুঝতে পারে না, যে নিজেকে বুঝাতে পারে না।

বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে দুই অলীক মানুষের জীবনে। বদিপীর শফির কাছাকাছি হতে চাইলেও শফি যেতে থাকে আরও দূরে। এভাবেই গল্প এগিয়ে যেতে থাকে ক্লাইম্যাক্সের দিকে।

লেখকের মতে বইটার মূল বিষয় হলো ব্যক্তিজীবনের ট্র্যাজেডি। একজন সাধারণ মানুষ যখন মিথে পরিণত হন তখন তিনি সচেতনে হোক আর অবচেতনে হোক নিজেকে হারাতে শুরু করেন আর এক পর্যায়ে অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে তিনি নিজেকেই চিনতে পারেন না। তিনি বারবার চেষ্টা করেন তার প্রকৃত সাধারণ অবস্থায় ফিরতে কিন্তু তাকে ঘিরে রাখা মিথের বাবল তাকে তা করতে দেয় না আর এভাবেই ঘটতে থাকে চূড়ান্ত ট্র্যাজেডি । বইয়ে বদিউজ্জামান আর শফি উভয়েই সাধারণ অবস্থা থেকেই শুরু করে জীবন। কিন্তু একসময় দেখা যায় পীর প্রথা না মানা, পীরের থান ভাঙ্গা বদিউজ্জামান নিজেই পীর হয়ে দাঁড়ায়, তার সমস্ত কাজে জনতা অলৌকিক কিছু প্রত্যাশা করতে থাকে আর অন্যদিকে শফিও পড়াশুনা ফেলে রক্তের নেশায় পড়ে যায়। এভাবে দুইজনই মিথের আড়ালে নিজেদের হারাতে থাকে, দুজনেই কিংবদন্তি হয়ে ওঠে কিন্তু দিনশেষে দুজনেই একা হয়ে পড়ে আর নিজেদের খুঁজতে থাকে। ফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন রাস্তার পথিক হলেও দুজনের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না, অলীক মানুষে পরিণত হয় উভয়েই।

বদিপীর আর শফির কাহিনী হলেও বইটা কিন্তু বিংশ শতকের বাঙালি মুসলিম সমাজের প্রতিফলনও বটে। একদিকে এতদিন ধরে চলতে থাকা ধর্মকে আঁকড়ে থাকা পরিবারের একটা অংশ আর অন্যদিকে নব্য শিক্ষিত তরুণ শক্তি যারা স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ, যাদের রক্ত টগবগ করে ফোটে সবকিছু ভেঙ্গে ফেলতে। এক অংশ যখন ধর্ম-কর্ম নিযেই জীবন কাটাতে ব্যস্ত, অপর অংশ তখন শুনতে পেয়েছে বৃহত্তর জীবনের ডাক যেখানে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছে প্রেম, পরিবার, ধর্মও! হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের একটা দিকও উঠে আসে বইটাতে। সিঙ্গিগিন্নীর শফিকে মুসলমান বলে মনে না করা ( যেন সব মুসলমান আরবদেশীয় চেহারার হতে হবে), ময়রার দেওয়ান সাহেবের স্পর্শ এড়িয়ে চলা, নুরুজ্জামানের উর্দুকেই মুসলমানের ভাষা মনে করা এসব উঠে এসেছে বইটাতে।

বৃহৎ কলেবরের উপন্যাসে লেখক যে সুবিধাটা পান অর্থাৎ চরিত্রকে যথেষ্ঠ সময় দিয়ে গড়ে তোলা সেটার ফায়দা তুলতে ভোলেন নি লেখক। শফির চরিত���রটির দিকে খেয়াল করলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়। তার একাকীত্ব, ভাবনার জগৎ, ইংরেজি স্কুলে যাওয়া, প্রেমে পড়া, পান্নাকে হত্যার মধ্য দিয়ে নতুন জগতে পদার্পণ, স্বদেশী আন্দোলন অংশগ্রহণ ইত্যাদি লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন ধাপে ধাপে সময় নিয়ে। একই কথা প্রযোজ্য বদিউজ্জামানের ক্ষেত্রেও। এভাবে লেখক প্রতিটা চরিত্রকে সময় দিয়েছেন, তাদের আলাদা জীবন-দর্শন নিয়েছেন, আলাদা জগৎ দিয়েছেন। ফলে বদিউজ্জামান, শফি, সাঈদা, রুকু, ইকরা, স্বাধীনবালা ইত্যাদি প্রতিটা চরিত্রেরই আলাদা দর্শন গড়ে উঠেছে। বর্ণনাভঙ্গিতেও লেখক নিরীক্ষা করেছেন। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎকে যেমন মিশিয়ে এক করেছেন তেমনি নাম পুরুষ, উত্তম পুরুষের ব্যবহার বা শুধৃ কথোপকথন বা সংবাদপত্রের কাটিং দিয়ে কাহিনী বর্ণনা করেছেন।

বইটা পড়ার সময় যে ব্যাপারটা একদম প্রথম থেকেই মাথায় এসেছে তা হলো বইটার সাথে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘ নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ বইটার মিল। কাহিনীর শাখা-প্রশাখা বিস্তার আর পরাবাস্তবতার ব্যবহারের দিক দিয়ে ততটা মিল না থাকলেও মিল পাওয়া যায় শুরুর লাইন থেকেই যখন লেখক বইটা শুরু করেন শফির ফাঁসির আদেশ শোনার কথা দিয়ে এবং আমাদের নিয়ে যান ফ্ল্যাশব্যাকে তখনই মনে পড়ে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে অতীত মনে করার কথা। এছাড়া এক পরিবারের কয়েক প্রজন্মের কাহিনী বর্ণনা, কর্নেলের ন্যায় বেপরোয়া শফি, উরসুলার ন্যায় সংসার ধরে রাখা সাঈদা মনে করিয়ে দেয় একশ বছরের কথা।
লেখকের পাঠকসত্তার পরিচয়ে অবাক হতে হয় বইটার প্রতিটা পরতে পরতে। প্রতিটা অধ্যায়ের শুরুতে অধ্যায়টার সারাংশ প্রকাশক কবিতার লাইনগুলো মুগ্ধ করেছে ভীষণভাবে। ইংরেজি থেকে শুরু করে উর্দু, ফারসি, ফরাসি, সংস্কৃত, বাংলা প্রভৃতি ভাষার কবিতার লাইনগুলো মুগ্ধ করার মতোই। সাথে ইসলাম, হিন্দু ও ব্রাহ্ম ধর্মের তত্ত্বকথা, তিন ধর্মের পারস্পরিক সম্পর্ক, নবাবী আমলের ইতিহাস, স্বদেশী আন্দোলনের ইতিহাস লেখকের প্রস্তুতিরই প্রমাণ। ঝোঁকের বশে নয় বরং তিনি যে রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে বইটা লিখেছেন তা বলাই বাহুল্য।

একটা ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয় আর সেটা হলো লেখকের ব্র্যাকেট দিয়ে বিভিন্ন শব্দের অর্থ লিখে দেওয়া। হয়তো বৃহত্তর হিন্দু পাঠকদের জন্য লিখেছেন বলেই আরবি-ফারসি শব্দগুলোর অর্থ দিয়ে দিয়েছেন কিন্তু তাই বলে ওজু, তসবিহ বা খালার মতো বহুল পরিচিত শব্দগুলোরও! আরেকটা ব্যাপার হলো লেখক বেশকিছু বিষয় উন্মুক্ত রেখেছেন পাঠকদের জন্য যার উত্তর তিনি দেন নি। দরিয়াবানুর মৃত্যু, ফরিদুজ্জামানের ফিরে আসা, জুলেখার পরিচয় এসব প্রশ্নের উত্তর মিলতে গিয়েও মেলে না শেষপর্যন্ত।

কিছু কিছু বই আছে যেসব বইকে একটা সময়ের, একটা গোষ্ঠীর দর্পণ বলে মনে হয়, এই বইটা তেমনই একটা বই। ইউনিক বর্ণনাভঙ্গি, বিস্তৃত প্রেক্ষাপট আর ইতিহাসের একটা সময়কে চাক্ষুষ করতে তাই বইটা পড়ার বিকল্প নেই।
Profile Image for Abhishek Saha Joy.
191 reviews56 followers
November 1, 2025
সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। একটা মোহগ্রস্ততা ঘিরে ধরে বইটি পড়ার সময়।
Profile Image for Saiful Sourav.
103 reviews72 followers
July 8, 2024
গল্পটা ঊন এবং বিংশ শতাব্দির, ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনামলের । ধর্ম যখন অন্ধের সময়ের, সমাজ যখন পক্ষাবলম্বীর, মুল্লুক যখন বন্দুকের নলের । জনৈক ধর্মগুরু অলৌকিকতায় আবর্তীত হতে হতে বুজুর্গ পীরের আসনে পদস্হিত হন । তার তিন ছেলের ছোটটি তৎকালে বিদ্যা-শিক্ষা ও উদার সঙ্গী সমাগম পেয়ে সমাজের আর দশ জনের চেয়ে ভিন্ন মতপন্হী হয়ে ওঠে । ইংরেজ বিরোধী স্বদেশী অন্দোলন তাকে ধাবিত করে গেরিলা অভিযানে । এক পর্যায়ে তার বিরুদ্ধে সমন জারি হয় এবং পিতা তাকে বাঁচাবার চেষ্টা থেকে বিরত থাকে ।

বৃটিশ আইনে মৃত্যুদন্ড জারি জানার পর শফির কিশোরকাল থেকে বড় হওয়ার সময়কে নিয়ে তার বয়ানে শুরু হয় উপন্যাস । পিতা বদিউজ্জামানের বয়ানে আসে তার ধার্মিকতা ও সমাজভাবনা । শফির দ্বিতীয় ভাইয়ের নাতনী কচি দীর্ঘদিন পর মৃত্যুর পূর্বে লেখা রচনাগুলো নিয়ে আলাপচারিতা করে তার দাদী রুকুর সাথে । রুকুর সাথে শফির মৃদু ভাব বিনিময় ছিলো এবং বিয়ে হবার কথা ছিলো । কিন্তু পলায়নপর স্বদেশী শফির অনুপস্হিতি ও অপ্রাপ্ত বয়সের জন্য রুকুর বিয়ে হয় দ্বিতীয় ভাইয়ের সাথে যে ছিলো প্রতিবন্ধী ।

উপন্যাসে আসে নানা চিত্র-চরিত্র ও শফির বেড়ে ওঠায় সমাজ ও শিক্ষার তীব্র প্রভাব। ইতিহাসের পট ব্যবহার করে উপন্যাস রচনা সাহিত্যের এক অনমনীয় আইডিয়া । সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এক্ষেত্রে একটা স্বাক্ষর রেখে গেলেন ।
Profile Image for Zihad Saem.
123 reviews7 followers
January 31, 2025
কি দুর্দান্ত, কি অসাধারণ এক উপন্যাস। এই উপন্যাসটা আমার ভীষণ পছন্দের। মনে পড়ে কি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছিলাম বইটা।
Profile Image for Akash Saha.
156 reviews25 followers
July 8, 2021
অসাধারন!!!
বৃহৎ প্রেক্ষাপটে লিখা উপন্যাস, অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করল ।
সামান্য একটু খাপছাড়া লেগেছে, ধরে নিব এটা পাঠকেরই সীমাবদ্ধতা।
Profile Image for NaYeeM.
229 reviews65 followers
December 21, 2023
১//
আমি উপন্যাসটার সাথে বেশ রিলেট করতে পারছিলাম। কারণ গ্রামের এক বিস্তর পরিমাণ মানুষ ছাড়াও আমার আত্মীয়-স্বজনকে দেখেছি এমন হুজুরকে মানতে যিনি কিনা বিভিন্ন অসুখে ফু দেওয়া পানি-পরা থেকে শুরু করে, তাবিজ দিয়ে থাকেন সমস্যার সমাধানের জন্য। অথবা ঐ হুজুরের কাছে নিজের সমস্যা নিয়ে একটু দেখা করার জন্য উনার ভক্তরা লাইন ধরে আছে, যা কিনা একটা ডাক্তারের কাছে রোগী দেখানোর চেয়ে লম্বা কোনো অপেক্ষা।
এছাড়াও তারা এটা বিশ্বাস করে থাকেবে, ঐ হুজুর নাকি জ্বিন প্রতিপালক থেকে শুরু করে অনেকরকম অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। মানুষের বলা গল্পের ধরণ দেখে ঐসব ঘটনা "হতেও পারে" এমনটা বিশ্বাস করা শুরু করবেন, যতই আপনি বলেন না কেন "আরে এমন হয় নাকি"।
এমনও হয়ে থাক��, এইরকম ধরণের হুজুর বা পির শ্রেণীর মানুষ পুরো একটা শহরে বিখ্যাত এবং অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ উনার সাথে দেখা করতে আসেন দূরদূরান্ত থেকে (এমনও শুনা যায়, হুজুরের সাথে দেখা করতে বিদেশ থেকে মানুষ এসেছে বা হুজুর বিদেশ যাচ্ছেন ভক্তের অর্থায়নে)

২//
তো গল্পটা এমনই ৷ এক পির সাহেবের গল্প — যিনি কিনা জীবনে বিভিন্ন গ্রামে থেকেছেন। পরিবার সহ স্থান পরিবর্তন করে নতুন কোনো গ্রামে যেতেন। যেই গ্রামে যাবেন ঐ গ্রামেই বিখ্যাত হয়ে উঠেন। এমনও হয়েছে, কোনো এক দূরবর্তী জায়গা থেকে স্বস্থানে ফিরার সময় পথে পথে ভক্তদের ভিড়, হুজুরকে এক পলক দেখবে বলে, কথা বলবে বলে শত-শত জনতা অধীর অপেক্ষায় আছে।
তাছাড়া অনেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী উনি৷ উনি নিজেই বলে থাকেন " হা এখানে এমন জ্বিন পাঠিয়েছি" বা "এই জ্বিন আমাকে এমনটা জানিয়েছে বলেই জেনেছি"।
তবে হুজুরের ছোট ছেলে নাস্তিকতার দিকে চলে যায় বিভিন্ন ঘটনা, বিভিন্ন স্থান-কাল, বিভিন্ন জ্ঞানার্জন, নিজস্ব চিন্তাভাবনা বা কোনো মানুষের অনুপ্রেরণায় (ঐ যেমনটা হয়, কোনো এক হুজুর খুব ধর্মপরায়ণ, কিন্তু উনার ছেলে অন্যকিছু নিয়ে লেখাপড়া করছে বা শুধু ধর্মের লাইনেই তার বাবার মতে পড়ে থাকবে না)। উনার তিন ছেলে যাদের মধ্যে বড় ছেলে মাদ্রাসায় উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ইসলামের পূরণ দীক্ষা অর্জন করে — এর পরেরটা প্রতিবন্ধী, হাত পা তে বিকলাঙ্গতা, কথা বলতে পারে না — আর ছোট ছেলেটা যার নাম শাফিউজ্জামান(অরূপে শফি) হয়েছে বিদ্রোহী, রাগী, আর গম্ভীর, বিভিন্ন বিষয়ে, বিভিন্ন বিদেশী বইয়ের জ্ঞানার্জন থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছু করেছে, যার মধ্যে মানুষ হত্যা করে কাপড় রাঙা করার মতো ঘটনা আছে। তবে শুধু নিজ পরিবারের মধ্যে চরিত্রের সীমাবদ্ধতা ছিল না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চরিত্র এসেছে, বিভিন্ন চরিত্রের আবার অলৌকিক ঘটনা বা মর্মাহত ঘটনা এসেছে। তবে এখানে আসল চরিত্রগুলোর মধ্যে একটা একাকিত্ব, আর অনেককিছু না পাওয়া নিয়ে কষ্ট লক্ষ্য করা যায়৷ লেখাতে সরাসরি চরিত্রগুলো ঐভাবে একাকিত্ব যাপনের কথা না থাকলেও, তাদের নিজের সাথে কথা বলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অংশে এমন মন বিষাদাক্রান্তে কর্মকাণ্ডে একাকিত্বের স্বাদ পেয়েছি পাঠক হিসেবে। আর চরিত্রগুলোর বাইরের জগতের গল্প থেকে ভেতরের জগতের কথাবার্তা, সবমিলিয়ে পাঠক যেন একাত্ম হয়ে যাবে অনেক অংশে।

৩//
এবার আসি লেখার বিষয়ে।
এই বিষয়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমি প্রথম তিন-চার পৃষ্ঠা পড়েই লেখার সৌন্দর্যে এগিয়ে গিয়েছি অন্ধকারাচ্ছন্ন, অলৌকিকতায় ঘেরা, বিভিন্ন ঘটনায় দিক পরিবর্তন করা এই আখ্যানের দিকে৷ তবে লেখার স্বাদ একেকসময়ে একেকরকম পেয়েছি। লেখার ন্যারেটিভের দিকে লেখক ছিলেন অনবদ্য। আর্টিস্টিক লেখা বলতে হবে অবশ্যই। কিছু শব্দ অপ্রচলিত মনে হয়েছে, তবে এতটুকু ব্যবহার না করলে লেখাতে ঐ আবহটা আসবে না, এমনই ধারণা আমার।
এমনও মনে হয়েছে, অলৌকিক অনেক ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করেছেন যেমনকি এগুলো সত্যি বলেই মনে হবে পাঠকের কাছে, যতই পাঠক শুরুর দিকে ঐসব অনেককিছু নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন।

আর গল্প সাজানোর দিকেও লেখকের ছিলো উচ্চপর্যায়ের কারিগরি। এক অধ্যায়ে ঘটনা লেখক নিজেই বলছেন, আরো কিছু অধ্যায় পর গিয়ে দেখা যাচ্ছে ফার্স্ট পার্সনে কোনো এক চরিত্র নিজে গল্প বলছেন যা হতে পারে ডায়েরিতে লিখে রাখা বা উনার নিজের মধ্যে চলতে থাকা আলাপ। আবার মাঝামাঝি এসে দেখা যাচ্ছে ঐ পীরের ছেলের বউ নাতি-নাতনীদের সাথে গল্প করছেন, যেখানে উনি একজন বৃদ্ধা এবং সময় অনেক আধুনিক।

তবে শেষের একশ পৃষ্ঠায় এসে একটু কঠিন লেগেছে। হঠাৎ কেমন জানি ঘটনা আর লেখা বেশ ঘন হয়ে আসতে থাকে। কারণ তিনভাগের দুইভাগ শেষ হওয়া পর্যন্ত পিরের ছেলের পরিণতির দিকে তেমন যাচ্ছিল না। কারণ, দুই-তৃতীয়াংশ পড়ার অনেক জায়গায় ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল ঐ ছোট ছেলের অনেক কর্মকাণ্ডের কথা (গল্পের শুরুর প্রথম বাক্যটি ছিল এমন "দায়রা জজ ফাঁসির হুকুম দিলে আসামি শাফিউজ্জামানের একজন কালে আর একজন শাদা মানুষকে মনে পড়ে গিয়েছিল)। তাছাড়া শফির জেলখানায় নিজের অগোছালো কথাবার্তা নিয়েও অধ্যায় ছিল।
তো আমি তিনশত-বিশ পৃষ্ঠার এই বইয়ের দুইশ পৃষ্ঠা মতো পড়ার পরও ভাবছিলাম " আর তো অল্প বাকি, এতো কম জায়গায় উনি এতকিছু লেখক আনবে কিভাবে"।
তো, শেষ একশ পৃষ্ঠাতে এসে অনেকরকম ইতিহাস বিষয়ক কথাবার্তা, ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন কথা, হঠাৎ হঠাৎ ঘটনার মোড় ঘুরে যাচ্ছিল। শুরু থেকে যেই ফ্লো ছিল সেই ফ্লো থেকে সরে যাচ্ছিলো। তবে এটা সত্যি, শুরু থেকে এতরকম ঘটনা, এতরকম পরিবর্তন, গল্পটা পাঠককে ধরে রাখতে রাখতে পারবে বেশ ভালভাবে।

৪//
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে ধৈর্য্য রেখে পড়লে তবেই এই বিশাল ক্যানভাসের অমৃত স্বাদটা পাওয়া যাবে, অসাধারণ এক পাঠ-অভিজ্ঞতা হবে একজন পাঠকের কাছে

সবমিলিয়ে যদি বলি, প্রথমেই বলি শেষাংশ নিয়ে যা সমালোচনা করলাম ঐসব আমার নিজস্ব মতামত মাত্র। ঐসব ভেবে এমন অসাধারণ এক শৈল্পিক কর্ম থেকে নিজেকে বাদ রাখা উচিত হবে না। পড়লেই বুঝা যাবে, অনেক পরিকল্পনা নিয়ে, নিজের লেখক অভিজ্ঞতার যথাসম্ভব দিয়ে, পড়াশোনা করে, অনেক গুছিয়ে সময় নিয়ে লেখক কাজটি সম্পন্ন করেছেন।
অবশ্যই, এই বছরের আরেকটা অতুলনীয়, অনন্য পাঠ-অভিজ্ঞতা হলো এই বইটি।
Profile Image for Zahidul.
450 reviews93 followers
March 3, 2022
বিশাল ব্যাপ্তিময় এক আখ্যান। নানা সময়ে, নানা পুরুষের মাধ্যমে লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ গল্পটি চমৎকারভাবে বলে গিয়েছেন, সাথে বোনাস হিসেবে ছিলো অসামান্য লেখনশৈলী। অত্যন্ত ভালো লাগলো বইটা পড়ে।
Profile Image for Riju Ganguly.
Author 37 books1,860 followers
May 20, 2015
এক-আধটা বই আছে, যাদের প্রসঙ্গে একটাই বিশেষণ ব্যবহার করা যায়: অতুলনীয়| এই বিশেষনটা আজ ব্যবহৃত হতে-হতে জীবনানন্দের ভাষায় "শুয়োরের মাংস" হয়ে গেছে, কিন্তু এই উপন্যাসটির ক্ষেত্রে, অনেক মাথা ঘামিয়েও, আমি অন্য কিছু লিখে উঠতে পারলাম না| ব্যাপ্তি, গভীরতা, চিন্তার খোরাক যোগানোর ক্ষমতা, লিখন, আর গল্পের বুনট: এই পাঁচটি মাপকাঠিতেই এই উপন্যাসটি আমার কাছে পাঁচ তারা পাবে| এই উপন্যাস যখন আকাদেমি, বঙ্কিম এবং ভুয়ালকা পুরস্কার পেয়েছিল, সেই সময় গোটা উপ-মহাদেশেই সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে পড়ছিল হু-হু করে| তারই মধ্যে, এমন এক উপন্যাস লিখেছিলেন লেখক যা পড়ে স্তব্ধবাক হয়ে বসে ছিলাম বহুক্ষণ| এই লা-জবাব বইটির প্রসঙ্গে আর কিছু বলার ক্ষমতা নেই, এইটুকু ছাড়া যে, এমন একটি বই পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম বলে নিজেকে আজও ভাগ্যবান মনে করি|
Profile Image for Shotabdi.
818 reviews193 followers
April 22, 2022
জাদুবাস্তবতার সাথে আমার প্রথম পরিচয় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এর কালজয়ী সৃষ্টি নিঃসঙ্গতার একশ বছরের মাধ্যমে। ওই সময় ওই বইটা পড়ে অনেকদিন এক ধরনের মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম। এরপর খোয়াবনামা, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল এর মতো কিছু অবিস্মরণীয় সৃষ্টি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। এবার এই অলীক মানুষ। সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ এর লেখা খুব একটা আগে পড়া হয়নি। টুকটাক কিছু কর্ণেল সিরিজের গল্প পড়েছি। সেগুলোর সাথে লেখার স্টাইল এ���দমই মেলেনা এটাতে। একটা অভিনব লেখনশৈলী এতে সৃষ্টি করেছেন লেখক।
ভাষা, ঐতিহ্য, ইতিহাস সবকিছুর মেলবন্ধন এত চমৎকারভাবে হয়েছে, সাথে কথকদের পরিবর্তন, মনোযোগ রাখতেই হয়। সেটা জোর করে নয়, আবারো একধরনের মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়েই।
অলীক মানুষ এর অলীক মানুষ কে বা কারা? মূল চরিত্র দুজন, দুই পিতা-পুত্র। একজন বদিউজ্জামান, যিনি ফরায়েজী ধ্যানধারণার একনিষ্ঠ সমর্থক থেকে ক্রমে ক্রমে নিজেই হয়ে ওঠেন পীর, যিনি পীরের থান ভেঙেছিলেন এগুলো শরিয়তবিরোধী আচরণ এমন ধারণা থেকে৷ তাঁর ক্ষমতা, ধর্মীয় ভাবনা, জ্ঞান এবং পোষা জিনের ক্ষমতা তাঁকে সাধারণ মানুষ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়, আপাতদৃষ্টিতে উঁচুতে৷ যেখান থেকে স্বাভাবিক জীবনের অনেক স্বাভাবিকতা ভুলে যান তিনি। পৌরুষ বা বলা ভালো স্বাভাবিক যৌন জীবন তাঁকেও পীড়া দেয়, টানে কিন্তু তিনি যে উঁচুতে উঠে গেছেন, তা তিনি ভুলতে চান না। তবুও ইকরা নাম্নী এক যুবতীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্ত্রী সাইদার মাঝে সন্দেহের বীজ বুনে দেয়। পীর হয়ে একটা আধ্যাত্মিক জীবনে এবং সাধারণ জনগণের মাঝে অধিক সময় কাটাতে গিয়ে তিনি একা হয়ে পড়েন, চলে যান পরিবার থেকে দূরে৷ সংঘর্ষ সৃষ্টি হয় পরিবারের সাথে, ছেলেদের সাথে।
একদম কনিষ্ঠ সন্তান হচ্ছে এই উপন্যাস এর আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র৷ শফিউজ্জামান, পীরের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ধীরে ধীরে যে সমস্ত সামাজিক ধ্যানধারণা, ধর্মীয় অভ্যাস এবং বিশ্বাস থেকে যেতে থাকে দূরে। তার বারিচাচার কথা অনুসারে প্রকৃতির খোঁজে, প্রকৃতির কাছে। এক বেপরোয়া চরিত্রের অধিকারী শফিউজ্জামানের জীবনে প্রেম থাকে না, কোন আমিত্ব থাকে না। নানান দর্শন থেকে ব্রাহ্মধর্ম, স্বদেশী আন্দোলন এর মাধ্যমে সে হত্যাকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কোন বাঁধন তাকে কোথাও আটকাতে পারেনা, কোন নারী না, কোন মাতৃত্ব না, কোন পিছুটান না। এভাবে সে নিজেও হয়ে উঠে এক অলীক মানুষ, যারা আসলে প্রচণ্ড একা।
ব্রিটিশ শাসনামল আর ইংরেজদের প্রতি হিন্দু-মুসলিমদের মনোভাব, মুসলিমদের হানাফি আর ফরায়েজী মতবাদের সংঘর্ষ, স্বদেশী আন্দোলন, ব্রাহ্ম ধর্ম, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক, জৈবিক সম্পর্ক সবই উপজীব্য হয়েছে এই উপন্যাসের।
৩২০ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি শুরুতে একটু ধীরলয়ের মনে হলেও পাঠক যখন একাত্ম হতে শুরু করবেন তখন আসলে অলীক মানুষের জগত হারিয়ে যাবেন৷ তিনি অদৃশ্য হয়ে অবলোকন করবেন পীরসাহেবের তিন প্রজন্মকে, বড়োগাজীকে, বারিচাচাকে, স্বাধীনবালাকে, সিতারাকে, ইকরাকে, আরো অনেককে। শফি আর রুকুর সম্পর্কের পরিণতি পাঠককে দুঃখ দেয়, কচির প্রশ্ন পাঠককে কৌতুহলী করে, ভাবায়। ভাবায় ফাঁকে ফাঁকে বলা টুকরো কবিতাগুলো এবং বিখ্যাত সমস্ত দার্শনিক এবং দর্শনশাস্ত্রের সুগভীর বাণীগুলো।
নানান কারণেই বইটি বাংলা সাহিত্যে দখল করে রয়েছে এক সুউচ্চ স্থান। আরো অনেক দিন থাকবে, যতদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে।
Profile Image for Titu Acharjee.
258 reviews34 followers
November 17, 2019
ভালো লেগেছে। বিশাল কলেবরে লেখা। যে সময়কে কেন্দ্র করে লেখা,সেই সময়টা যেন পাতায় পাতায় ফুটে উঠেছিল।
Profile Image for Habiba♡.
352 reviews23 followers
October 7, 2025
বাপ সব পেয়ে একা, ছেলে সব হারিয়ে।।
Profile Image for Kripasindhu  Joy.
542 reviews
July 7, 2024
উপন্যাসের প্রথম লাইনে মার্কেজের 'নিসঙ্গতার একশো বছর' এর পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। এই বইটিও জাদুবাস্তবতা ঘরানার। প্রায় ৩০০ পাতার। গল্প বলার ধরণ ভিন্ন রকম। কাল কখনো সামনে যায় আবার কখনোবা পিছনে আসে। উত্তমপুরুষ ও নামপুরুষ এই দুই ধরন মিশিয়ে গল্প বলা হয়েছে। উন্নতি করার মতো অনেক জায়গা থাকলেও যেমন আছে তা অত্যন্ত সুখপাঠ্য।
Profile Image for Imtiaz Emu.
60 reviews33 followers
July 4, 2021
একবার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশে এলেন। তার সাক্ষাৎকার দেখলাম। তিনি বললেন, বাংলা উপন্যাসের মধ্যে সতিনাথ ভাদুরীর "ঢোঁড়াই চরিত মানস" শ্রেষ্ঠ। আর লেখনীর দিক দিয়ে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের "অলীক মানুষ" শ্রেষ্ঠ। এরপরই আমার এই দুই বইয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মে। এর আগে আমি এই ব্যাক্তির নামও জানতাম না। যাক, দুই বইই পড়া শেষ।
অলীক মানুষ! অদ্ভুত একটা লেখনী। কখনো সাধু ভাষায়, কখনো চলিত। কখনো প্রত্যক্ষ উক্তি, কখনো পরোক্ষ কিংবা কখনো স্বগতোক্তি। পড়তে বসারর পড়ে অনেকক্ষেত্রেই মনে হয়েছে লেখক হয়তো কিছুদূর লিখে ভুলে গেছেন, আবার এসে রচনা শুরু করেছেন। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, ঘটনা তাই! কিন্তু, বিরতিতেও লেখক গল্পটাকে ছেড়ে দেন নি। নিজেকে কাহিনীতে কষে বেঁধেছেন, আপনাকে তারপরে তাতে জড়িয়েছেন। উপন্যাসের মাঝে এসে আপনি একটু হোচঁট খাবেন যখন দেখবেন ৫০ বছর পরের খন্ডচিত্র, কিন্তু সেখানে করা হচ্ছে স্মৃতিচারণ। এই স্মৃতিচারণ গিয়ে মিশে যাচ্ছে ৫০ বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া কাহিনীর সাথে। লেখক যে কখনোই তার গল্পকে কাছ ছাড়া করেননি তার প্রমাণ।
প্রচুর আরবী, ফার্সি শব্দের প্রয়োগ আছে। যেহেতু সময়টা বঙ্গভঙ্গের পূর্বের ঘটনা তাই ধর্মের বেশ জোরালো প্রভাব আছে। মূলত সেটা পূঁজি করেই উপন্যাসের গাঁথুনি। শেষাংশে এসে একের পর এক ঘটনার জোড়াতালি হয়েছে, মাঝখানে স্মৃতিচারণে কিছু ঘটনার মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। একশ বছরের এই লৌকিক-অলৌকিকের আখ্যানটি রচিত হয়েছে কোলাজ রীতিতে। কখনো সহজ বয়ানে, কখনো মিথ ও কিংবদন্তি, আবার কখনো ব্যক্তিগত ডায়েরি, সংবাদপত্রের কাটিং জুড়ে দিয়ে।
কিছু ঘটনার ধারে কাছেও লেখক যান নি। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে প্রচুর চরিত্র তৈরী করেছেন। কিন্তু উপন্যাস শেষে ফোকাস একদিকেই রেখেছেন। মুগ্ধ করার মতো বিষয় হলো, তিনি শুরু করেছেন যে দু'জনকে নিয়ে, ঠিক সে দু'জনকে দিয়েই সমাপ্ত করেছেন। বলা যায়, মূল চরিত্র তারাই, তবে আমি বোধ করি মূল চরিত্র একটাই। বাকিরা কেবল বিক্ষিপ্তভাবে ঘটনাপ্রবাহে ঘুরে বেড়িয়েছে উপন্যাসজুড়ে, মূল চরিত্রটাকে ঢেকে দিতে এক নিশ্ছিদ্র কালিমায়! পিতা বদিউজ্জামান, সন্তান শফিউজ্জামান। পিতা একজন ধর্মগুরু, লোকে তাকে পির হিসেবে জানে, মান‍্য করে। অন‍্যদিকে সন্তান ধর্মদ্রোহী। দুজন দুই দর্শনে বিশ্বাসী। এই মতাদর্শের টানাপোড়নে এই মহাকাব‍্যিক উপন‍্যাস এগিয়ে চলে, সাথে নিয়ে চলে ফরাজি-ওহাবি আন্দোলন, ব্রাহ্ম আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, হিন্দুত্বের পুনরুদ্ধার আন্দোলন এবং প্রেম-ভালোবাসা, লৌকিক-অলৌকিকতা।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এও বলেছিলেন, মুস্তাফা সিরাজের আর কোন বই ই পাঠককে এতোটা আকৃষ্ট করতে পারেনি। আমি তার আর বই পড়িনি, তবে বোধকরি, অলীক মানুষের সমপর্যায়ের বই হয়তো তিনি চাইলেও লিখতে পারতেন না। কারন তিনি বইটা ঝোঁকের বশে নয় বরং তিনি যে রীতিমতো বিস্তর প্রস্তুতি নিয়ে বইটা লিখেছেন তা বলাই বাহুল্য। বইটিতে ব‍্যবহৃত ছড়া, গান, বিখ‍্যাত ব‍্যাক্তিদের উক্তি, শ্লোক, গজল, শায়েরী দিয়ে প্রতিটি অধ‍্যায়কে বিশ্লেষণ অভূতপূর্ব সেটাই নির্দেশ করে। শেষ করি বইতে ব‍্যবহৃত আমার প্রিয় একটা উক্তি দিয়ে -
"অই বৃক্ষ দেখ, যাহা ঋজু, যাহা ছেদিত বা দগ্ধ হয়; কিন্তু স্বেচ্ছায় নত হয় না, যাহা ভূমির জন‍্য কাহাকেও রাজস্ব দেয় না। তোমরা বৃক্ষের নিকট শিখ। আর তোমরা নদীর নিকট শিখ, যাহা গতিশীল। আর তোমরা মেঘের নিকট শিখ, যাহা নিজেকে নিঃশেষিত করিয়া ভূমিকে জীবন দেয়; কিন্তু বক্ষে বজ্র বহন করে এবং গর্জন করে।"
Profile Image for Swajon .
134 reviews76 followers
August 12, 2018
"Man's like the earth, his hair like grasse is grown
His veins the rivers are, his heart the stone."
Profile Image for Jahangir Alam.
115 reviews7 followers
November 2, 2024
বহুদিন পর একটা ভালো পূর্ণাঙ্গ বাংলা ক্ল্যাসিক উপন্যাস পড়লাম।

প্রোটাগনিস্ট শফি এবং তার পিতা পীর বদিউজ্জামানকে কেন্দ্র করে লেখক উনিশ শতকের শেষভাগ এবং বিশ শতকের প্রথমভাগের বাংলার গ্রামের সামাজিক অবস্থাকে তুলে ধরেছেন। ক্ষেত্রবিশেষে তখনকার শহর পুরান ঢাকার বর্ণণাও এসেছে। গ্রামীণ জীবন, নারীর জড়তা, ফরায়েজি - হানাফি দ্বন্ধ, সুফিবিদ্বেষ, শফির পিতা বদিউজ্জামানের মাজারপূজার বিপরীতে গিয়েও শেষমেশ পীর বলে পরিচয়লাভ, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নিউএথিস্ট বারি চৌধুরীদের উত্থান, দেওবন্দি মাদ্রাসাদীক্ষায় দীক্ষিত শফির ভাই নুরুজ্জামানের বাংলায় ইসলামপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, সনাতন থেকে বের হয়ে দেবনারায়ণঠাকুরের ব্রাক্ষসমাজ প্রতিষ্ঠা কিংবা ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী চক্রের দেশকে স্বাধীন করার বাসনা — সবকিছুই উঠে এসেছে। সে সময়ের বাংলার সমাজ ব্যবস্থাকে তুলে ধরতে লেখক সফল।শেষভাগে পরবর্তী প্রজন্মের নাতিপুতিদের কাছে তাদের অগ্রজের জীবনকে মূল্যায়ন উপন্যাসের একটি বিশেষ দিক।

“ Your worst sin is that you have destroyed and betrayed yourself for nothing “

“ Man is sometimes extraordinarily, passionately in love with suffering “

দস্তইয়েফস্কির লেখা এ দুই উক্তিকে ঘিরেই উপন্যাস এগিয়ে চলে, প্রোটাগনিস্ট শফি ঘুরে বেড়ায় আশ্রয়ের খোঁজে। একটা অতি সাধারণ আশ্রয় সে চেয়েছিল — যে নারী আশ্রয় তার কোমলসত্তাকে ঢেকে রাখবে রুক্ষ কঠিন সমাজ থেকে।

আশ্রয় সে পায় না; কখনো রুকু, কখনো সিতারা, কখনো স্বাধীনবালা কি রন্তময়ীর হাতে পড়ে সে হয় পীড়িত, প্রতারিত, বঞ্চিত। সমাজের চাপে বারবার আশ্রয়হারা হতে হয়। একটা সুস্থ সুন্দর জীবনই চাওয়া ছিল তার— না পেয়ে জীবনের উপরেই বিতৃষ্ণা এসে পড়ে। সমাজের শৃঙ্খলকে সে ভেঙে চুরে চুরমার করে দিতে চায়। ফ্রয়েডীয় মন:তত্ত্ব মোতাবেক ব্যক্তি শফির ইড (আদিম প্রবৃত্তি), ইগো (বাস্তবতা বিবেচনা) এবং সুপারইগো (নৈতিকতা) এর দ্বন্ধে ইডই জয়ী হয়। কোনো আদর্শ-স্বাধীনতা-কামনা-বাসনা সে চায়নি, চেয়েছিল কেবল ভালোবাসা। প্রেমের অভাবই তাকে বিদ্রোহী করে তুলে। শেষমেশ নিজেই নিজেকে সারেন্ডার করে ফাঁসিকাঠে ঝুলে তার জীবনাবসান হয়।

অন্যদিকে পিতা পীর বদিউজ্জামান জীবনকে বুঝতে চাইতেন, তার মনে প্রশ্ন ছিল, একটা স্বাভাবিক জীবন প্রত্যাশা ছিল — সমাজের চাপে যা হয়ে উঠতে পারেনি। ভাই সুফিবাদী ফরিদুজ্জামানকে ন্যাড়া করে তাড়িয়ে দিলেও, ফরায়েজি শক্ত নিয়মনীতি দিয়ে সমাজকে কট্টর শাসনে বেঁধে রাখলেও অন্তরে মারফতি চিন্তা তাকে ক্ষতবিক্ষত করে রাখে। প্রকৃতির মাঝেই সে ঈশ্বরকে খুঁজে পায় বিভিন্ন সিম্বলের মাধ্যমে। সেও আশ্রয় খুঁজে, কিন্ত তাকেই হতে হয় আশ্রয়দাতা। শেষজীবনের বিরাট ভুল তার সমগ্রজীবনের কর্মের পূণ্যকে ধূলিসাৎ করে দেয়।

পিতা-পুত্র দুজনকেই অনেকে ভালোবেসেছে, হয়তবা তারা ভিন্ন ভিন্ন শিবিরের তবুও — কিন্ত তারা যে ভালোবাসা চেয়েছিলো তা তারা পায়নি। ভালোবাসার অভাবই তাদের আজন্ম পরিণতি হয়ে থেকে যায়।

উপন্যাসে অনেক চরিত্র ছিল, লেখক প্রতিটি চরিত্রকেই তার স্বরূপে তুলে ধরেছেন। একক শ্রেষ্ঠ কোন চরিত্র ছিল না। ম্যাজিক রিয়েলিজমের ছাপ স্পষ্ট। ব্যক্তির মনোজাগতিক বিশ্লেষণ সফলভাবে হয়েছে। মানুষ মাত্রই যে ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে নয় সে বাস্তবতা প্রকাশিত। দিনশেষে ফ্রয়েড বর্ণিত "যৌনতাই জীবন" যে মানুষের রন্ধ্রে ঢুকে আছে উপন্যাসে বারবার তা উঠে এসেছে। নিজের জীবনের কিছু ভুলের সাথে মেলায়েই বলছি — এ উপন্যাস আরো আগে পড়বার প্রয়োজন ছিল। সব উপন্যাস মেইনস্ট্রিমে আসে না, এ উপন্যাসও হিডেন জেম হয়েই রয়ে যাক।

5/5
Displaying 1 - 30 of 94 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.