দেশ বিভাগ নিয়ে তেমন স্মরণীয় উপন্যাস বাংলাভাষায় লেখা হয়নি। দু-পার বাংলায় ছড়ানো সমান্তরাল বাঙালিজীবন নিয়েও না। সেই অপূর্ণতাকেই দূর করল এই বিশিষ্ট, ব্যতিক্রমী ও বড়-মাপের উপন্যাস। বিশাল ক্যানভাসে চিত্ৰিত এই উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ একইসঙ্গে ছুয়ে আছে। এপার এবং ওপার বাংলা। শুরু সেই পঞ্চাশের মধ্যভাগে। দু-বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের পালাবদলের স্রোত কীভাবে এসে মিশেছে। এই আশির দশকের মোহনায়, এ-উপন্যাস তার এক জীবন্ত দলিল। দুই বাংলার দুই পরিবারকে কেন্দ্র করে রচিত এই উপন্যাসে বিশেষ কোনও চরিত্রকে মূল চরিত্র বলা যাবে না। একই সঙ্গে অনেকগুলি প্রধান চরিত্র। এইসব চরিত্রের কেউ-কেউ আবার পূর্ব বা পশ্চিম বাংলার গণ্ডিতেই আবর্তিত নয়, ইউরোপআমেরিকাতেও গেছে। ফলে, কলকাতার কফি হাউসের পাশাপাশি কখনও আবার আমেরিকার চোখ-ধাঁধানো শহরের কথা এই উপন্যাসে। ‘পূর্ব-পশ্চিম”—এই নামকরণেও যেন নিহিত ত্রিমাত্রিক ব্যঞ্জনা। এ-উপন্যাসে শুধুই পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার কথা নয়। পূর্ব গোলার্ধ ও পশ্চিম গোলার্ধের বৃহত্তর পটভূমিও এর অন্তর্গত। আবার মানুষের জীবন ও মনে যে পূর্ব ও পশ্চিম, তার উচ্চাকাঙক্ষা ও উত্থান-পতন, সূচনা ও দিনাবসান— তাও যেন সূক্ষ্মভাবে প্রতিফলিত এই নামকরণে। “সেই সময়’’’-এর লেখকের কলমে এই সময় নিয়ে লেখা ‘পূর্ব-পশ্চিম” বাঙালি জীবনের আধুনিক গদ্য মহাকাব্য।
Sunil Gangopadhyay (Bengali: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) was a famous Indian poet and novelist. Born in Faridpur, Bangladesh, Gangopadhyay obtained his Master's degree in Bengali from the University of Calcutta, In 1953 he started a Bengali poetry magazine Krittibas. Later he wrote for many different publications.
Ganguly created the Bengali fictional character Kakababu and wrote a series of novels on this character which became significant in Indian children's literature. He received Sahitya Academy award in 1985 for his novel Those Days (সেই সময়). Gangopadhyay used the pen names Nil Lohit, Sanatan Pathak, and Nil Upadhyay.
Works: Author of well over 200 books, Sunil was a prolific writer who has excelled in different genres but declares poetry to be his "first love". His Nikhilesh and Neera series of poems (some of which have been translated as For You, Neera and Murmur in the Woods) have been extremely popular.
As in poetry, Sunil was known for his unique style in prose. His first novel was Atmaprakash (আত্মপ্রকাশ) and it was also the first writing from a new comer in literature published in the prestigious magazine- Desh (1965).The novel had inspiration from ' On the road' by Jack Kerouac. His historical fiction Sei Somoy (translated into English by Aruna Chakravorty as Those Days) received the Indian Sahitya Academy award in 1985. Shei Somoy continues to be a best seller more than two decade after its first publication. The same is true for Prothom Alo (প্রথম আলো, also translated recently by Aruna Chakravorty as First Light), another best selling historical fiction and Purbo-Paschim (পূর্ব-পশ্চিম, translated as East-West) a raw depiction of the partition and its aftermath seen through the eyes of three generations of Bengalis in West Bengal, Bangladesh and elsewhere. He is also the winner of the Bankim Puraskar (1982), and the Ananda Puraskar (twice, in 1972 and 1989).
Sunil wrote in many other genres including travelogues, children's fiction, short stories, features, and essays. Though he wrote all types of children's fiction, one character created by him that stands out above the rest, was Kakababu, the crippled adventurer, accompanied by his Teenager nephew Santu, and his friend Jojo. Since 1974, Sunil Gangopadhyay wrote over 35 novels of this wildly popular series.
Death: Sunil Gangopadhyay died at 2:05 AM on 23 October 2012 at his South Kolkata residence, following a heart attack. He was suffering from prostate cancer for some time and went to Mumbai for treatment. Gangopadhyay's body was cremated on 25 October at Keoratola crematorium, Kolkata.
Awards & Honours: He was honored with Ananda Award (1972, 1979) and Sahitya Academy Award (1984).
ভারত-পাকিস্তান দেশ ভাগ নিয়ে বাংলায় মনে হয় সেরা উপন্যাস সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। শুধুমাত্র ধর্মের দোহায় দিয়ে আর রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য যুগ যুগ ধরে একসাথে মিলে মিশে বাস করা মানুষগুলো একে অপর থেকে আলাদা হয়ে গেল। পূর্ব-পশ্চিম মূলত দুই বাংলার বিভাজন নিয়ে লিখেছেন। যাদের মুখের ভাষা এক, কৃষ্টি কালচার অনেকটাই একই তারপরও আলাদা হতে বাধ্য হলেন ধর্মের জন্য। অনেকেই তাদের বাপ-দাদার ভিটা ছেরে চলে গেলে ওপার বাংলায় আবার কেউ আসলেন ওপার বাংলা থেকে। যাদের পরিচিতজন কেউ নেই তারা হয়ে গেলেন উদ্বাস্তু। হঠাৎ করে ঠিকানা পরিবর্তন করায় অনেকেই হয়ে পরেন গৃহহীন, কর্মহারা। তাছারা সরকারও তাদের সহায়তায় হিমসিম খেয়ে পরেন। পথে পথে অন্নহারা মানুষের হাহাকার। সব মিলিয়ে অত্যন্ত করুণ অবস্থা। এমনই সময়ে দুই বাংলার কয়েকটি পরিবারের কাহীনি নিয়ে উপন্যাস পূর্ব-পশ্চিম।
দেশ বিভাগ নিয়ে তাদের বিড়ম্বনা, আপনজনদের সাথে বিচ্ছেদ সব দারুণ ভাবে উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত নিপুন হাতে। তাছারাও সেই সময়ে আমাদের বাংলায় রাজনীতিতে মাওলানা ভাষানী, বঙ্গবন্ধু সহ দেশবরণ্যে নেতাদের তৎকালীন রাজনীতি সক্রিয় ভুমিকা , ৫২'র ভাষা আন্দোলনের কথাও উঠে এসেছে লেখকের বর্ণনায়। ৯৮৭ পাতার বড় একটি বই হলেও এমন নেশা লাগানো গল্প যে পুরোটা পড়ে শেষ না করা পর্যন্ত ছারা যায় না। সাদা কাগজের উপর কালো কালির লেখা মানুষকে কাদাতেও পারে; উপসংহারটা পড়ে আমারও এই দশা হয়েছিল। এমন একটা বই বার বার পড়লেও কেমন যেন প্রত্যেকবারই নতুন মনে হয়।
ঠিক এই মুহূর্তে আমি যে কী পরিমাণ overwhelmed হয়ে আছি, তা সম্ভবত ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। বইয়ের শেষ পৃষ্ঠাটা আমি যত দ্রুত পড়েছি, অত দ্রুত বোধহয় মানুষের পক্ষে পড়া সম্ভব না। চোখে একগাদা পানি এসে ভীড় জমাচ্ছিলো, পরে এই পানির প্রতিসরণের জন্য লেখা আরো দেখতে পাবো না...তাই এই দ্রুতগতি। আর শেষ করার পর পনের মিনিট হাউমাউ করে কেঁদেছি। শেষে যা ছিলো, তার জন্য কেঁদেছি, নাকি প্রিয় একটা বই শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেজন্য কেঁদেছি, ব্যাপারটা খুব ধোঁয়াটে। আমার আবার বেশি কান্নার অভ্যাস, সেটাও আরেকটা কারণ হতে পারে। বুকের ভেতরটা এত খালি খালি লাগছে! এত এত চরিত্র...কাকে নিয়ে শুরু করবো, বুঝতে পারছি না। Comparatively সবচেয়ে কম পছন্দের চরিত্রের কথা বলি, অতীন। ওকে আমার ভালো লাগে নি। যতটুকু ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট ওর কাছ থেকে আশা করেছিলাম, তার ধারে-কাছেও সে ছিলো না। এই মনে হয় অতীন বদলে যাবে, নিজের রাগ সামলাবে, নিরর্থক জেদ দেখাবে না...কিন্তু তার কোনোটাই হয় না। আর তার ওপর আমার অন্যতম প্রিয় চরিত্র অলিকে কষ্ট দেয়ার কারণে ওর প্রতি একটা বিরক্তি আর অসম্ভব রাগ কাজ করেছে আমার ভেতর। আবার অতীনের প্রতি এত ভালোবাসা দেখানোর কারণে শেষটায় এসে মমতার ওপর আমার খুব রাগ হয়েছে। শর্মিলা একজন অসাধারণ মেয়ে হবার পরেও আমি ওকে ভালোবাসতে পারি নি শুধুমাত্র অতীনের কারণে (এটাকে আমি আমার নিজের অক্ষমতা বলবো)। আমার কাছে অতীন মজুমদারকে একদম ভালো লাগে নি। একেবারে গোঁয়ার, জেদী, রগচটা এবং অন্যান্য মনে হয়েছে। একেক সময় মনে হয়েছে, পিকলু বেঁচে থাকলেই বোধহয় ভালো হতো। জানি, শুনতে খুব হৃদয়হীন মনে হচ্ছে, কিন্তু আমি এমনই। আমার সবচাইতে প্রিয় চরিত্র সম্ভবত প্রতাপ। এমন শক্তিশালী একটা চরিত্র আমি বোধহয় খুব কম পড়েছি। তিনি পরিবারের জন্য এত কিছু করেছেন যে এই লোকটার প্রতি আমার অসম্ভব শ্রদ্ধা কাজ করেছে। তিনি খুব নামীদামী কেউ ছিলেন না। খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা ছিলেন। তার জীবনের সংগ্রামগুলোতে মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছি আমি। নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দেয়ার পরও তিনি মমতার ভালোবাসা পান নি, অভিমান দেখেছেন শেষমেষ...আমার এত কষ্ট লেগেছে সেজন্য! এত রাগ হয়েছে মমতার ওপর! কীভাবে দু'টো মানুষ জীবনের সিংহভাগ একসাথে কাটানোর পরেও একে অপরের কাছে এমন অচেনা রয়ে যায়? প্রতাপের মত আদর্শবান লোকের অস্তিত্ব সম্ভবত ফিকশনের বাইরে নেই। কিন্তু অবাস্তব হলেও, তার সবকিছুই আমার ভালো লেগেছে। তার রাগ, অভিমান, আত্মসম্মানবোধ আমাকে মুগ্ধ করেছে। খুব জলজ্যান্ত মানুষ মনে হয়েছে প্রতাপকে, নিছক ভুলে যাবার মত কোনো চরিত্র মনে হয় নি। এমনকি আমি বেশ খুশি হয়েছি যে উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় দু'টি চরিত্র ছিলো, একজন হলেন প্রতাপ, আরেকজন অলি। এর চেয়ে ভালো শেষ আমি বোধহয় কল্পনা করতে পারতাম না। এবার আসি অলি চৌধুরীর ব্যাপারে। এই মেয়েটাকে আমি এত অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছি যে আমি যদি ছেলে হতাম, অথবা ও যদি বাস্তব হতো, আমি ওকে বিয়ে করে ফেলতাম। ওর শৌণক হতাম, যে কক্ষনো ওকে ছেড়ে যেতো না। কী দৃঢ়তা এই মেয়ের মধ্যে! অথচ কী অমায়িক! আমার মন জয় করেছে অলি। এত নিখুঁত কেন ও? একটু অবাস্তব লাগে। কিন্তু কে বলেছে একটা চরিত্র নিখুঁত হতে পারবে না? থাকুক না কেউ একজন এমন! অতীনকে আমি কক্ষনো ক্ষমা করবো না অলিকে কষ্ট দেয়ার জন্য। আরেক চরিত্র তুতুল। তুতুলকে যে আমার কী ভীষণ পছন্দ! আমি যদি ওর মত হতে পারতাম! এমন অসাধারণ মেয়ে হয় না। তুতুলের স্বামী আলমকেও খুব ভালো লেগেছে। সুপ্রীতিকেও মোটামুটি লেগেছে। মামুনমামা চরিত্রটি বেশ ইউনিক। খুবই ভালো লেগেছে আমার লোকটাকে। মঞ্জুকেও ভালো লেগেছে, কিন্তু ওর ছেলে বড় হয়ে এমন উচ্ছন্নে যাবে, সেটা আমার ভালো লাগে নি। বাবুল চৌধুরীকে প্রথমে বিরক্তিকর লেগেছিলো, যুদ্ধের সময় ভালো লেগেছে, কিন্তু শেষে গিয়ে একদম বাজে লেগেছে। জাহানারা ইমাম আর শহীদ রুমীর প্রতি শ্রদ্ধা কাজ করেছে। সুলেখা অসম্ভব প্রিয় একটা চরিত্র ছিলো। ত্রিদিবকে ভালো লাগে নি। Cowardice আমার পছন্দ না। রাতুলকে বিশ্রী লেগেছে। শাজাহান badass ছিলো। খুব ভালো লেগেছে। হারীত মণ্ডলকে ভালো লেগেছে। সুচরিতকে অসহ্য লেগেছে। ইত্যাদি। কৌশিক আর পমপম আর তপন আমার অন্যতম প্রিয় চরিত্র। আমি কী কান্নাটাই না করেছি পমপম আর কৌশিকের বিয়ের দৃশ্যটা পড়ার সময়! খুব প্রিয় জুটি হয়ে থাকবে ওরা। পিকলু আমার চোখে একটা অসাধারণ চরিত্র হয়ে থাকবে। আমি অনেকবারই ভেবেছি, ও বেঁচে থাকলে উপন্যাসটা কেমন হতো। অনেকটা আঘাত পেয়েছিলাম ওর হারিয়ে যাওয়াতে। বাকি সব চরিত্র মোটামুটি লেগেছে। চরিত্রগুলোর কথা শেষ। এখন আসি কাহিনীতে। সুনীল বরাবরই একজন শক্তিমান গদ্যকার। এবং এখানেও তারই প্রমাণ পেয়েছি। প্রতিটা পৃষ্ঠা আমাকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করেছে। চোখের সামনে সব দেখতে পেতাম, এত ভালো লেখা বইটা! কল্পনা করার জন্য আমাকে তেমন এফোর্টও দিতে হয় নি। বইটা আমার এত ভালো লেগেছে যে এক সময় মনে হয়েছে সুনীলকে জীবিত করে ওর মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে বলি, ২০২২ পর্যন্ত ইতিহাস লিখে ফেলেন, এক্ষণি! কী আসে নি বইটাতে! চাঁদে পা রাখা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, কতকিছু যে জানতে পেরেছি! ইসকনের শুরুও জানতে পেরেছি, খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার! অনেকের লেখায় দেখেছি, পূর্ব-পশ্চিমে নাকি বাংলাদেশের ইতিহাস তেমন একটা আসে নি। আমার কাছে তেমনটা মনে হয় নি। যতটুকু তিনি লিখেছেন, আমার কাছে পুরোটাই বেশ ভালো লেগেছে। আর যুদ্ধের কাহিনীগুলো! দেশের জন্য অনেকদিন পর এভাবে কেঁদেছি সেগুলো পড়তে গিয়ে! কলকাতার ইতিহাস আমার খুব একটা জানা ছিলো না। এই ফাঁকে সে��াও জানা হয়েছে। কী অসাধারণ! উদ্যমী তরুণেরা কত কিছুই না করতে পারে! স্বপ্ন এসে ভর করেছিলো আমার ওপর এসব পড়ার পর। মনে হয়েছে ইশ, আমিও অমন হতাম! দেশবিভাগের পরের যে সেন্টিমেন্ট, সেটাও কী সুন্দর করে লিখেছেন সুনীল! এই বইটাকে ভালো না বেসে পারা যায়? নিজের ওপর রাগ উঠছে, কেন আমি মাঝখানে "All the lights we cannot see" নামক অখাদ্য পড়তে গিয়েছিলাম! কেন "প্রথম আলো" শেষ করেই এটা পড়ি নি? অনেক লিখে ফেললাম। এদিকে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নয়ন আমার কাছে সম্পাদকীয়ের লেখা চাইছে তিন দিন ধরে, ওকে আমি ghost করে যাচ্ছি। এখন উপসংহার টানা উচিত। দেবা, তোমাকে ধন্যবাদ আমাকে এই অসাধারণ একটা বুক ইয়ার উপহার দেয়ার জন্য। আমি পড়বো-পড়বো করে বপ্পির শেলফ থেকে নিয়ে কবে এগুলো পড়তাম, বা আদৌ পড়া হতো কি না, তা আমি জানি না। এদিকে গিফটের বই আমি ফেলে রাখি না, অখাদ্য হলেও সেটার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য পুরোটা পড়ে ফেলি, সেখানে এটা তো একটা মাস্টারপিস! তোমার জন্যই আমার এই অসাধারণ তিনটা বই পড়া হয়েছে। আমার অসংখ্য বোরিং ইভনিং ডিউটির সঙ্গী ছিলো বইগুলো। তোমাকে অনেক, অনেক ধন্যবাদ। আমি মনে হয় না আমি কোনোদিন এই টাইম ট্রিলজির ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারবো। এর চেয়েও ভালো বই হয়? কেউ লিখতে পারে? এমনটা আমার বিশ্বাস হয় না। হয়তো আমি কম বই পড়েছি বলে এমন মনে হচ্ছে। হোক, আমার তাতে কিচ্ছু যায়-আসে না। আমার কাছে এগুলোই পৃথিবীর সেরা কিছু বইয়ের কাতারে থাকবে। এই বইটা ছিলো আমার বন্ধুর মত। সবসময় আমার ব্যাগে থাকতো, যাতে আমার নিজেকে কখনো একা মনে না হয়, যাতে মনে হয় বইয়ের চরিত্রগুলো আমার সাথেই আছে। এখন ব্যাগে জায়গা নেবে অন্য কোনো বই। তাতে কী হয়েছে, মনের ভেতর যে এত্ত বড় জায়গা দখল করে নিলো বইটা? সেটা তো আর কোনোকিছু দিয়ে পূরণ হবার নয়! খুব প্রিয় বন্ধুকে বিদায় জানানোর সময় যে অপার্থিব কষ্টটা কাজ করে, আজ বইটা শেলফে রাখার পর তেমন তীব্র কষ্ট হবে। খুব একা লাগবে নিজেকে। ভেবেই মন ভীষণ খারাপ হচ্ছে। সবাইকে বলতে চাই, প্লিজ বই তিনটা পড়ে ফেলুন! জীবনের অনেক বড় একটা জিনিস মিস হয়ে যাবে না হলে! প্রিয় বন্ধু, বিদায়! তোমার কথা আমার সবসময় মনে থাকবে।
("পূর্ব-পশ্চিম" সম্ভবত আমার সবচেয়ে প্রিয় বই ট্রিলজির মধ্যে। এরপর "সেই সময়।" সবার শেষে থাকবে "প্রথম আলো।")
(বি. দ্র. এখন মতামতের পরিবর্তন হয়েছে। "সেই সময়" এখনও আমার সবচেয়ে প্রিয় বই।)
This entire review has been hidden because of spoilers.
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে সর্ববৈশ্বিক বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন।
বাংলাভাষী এই ভারতীয় সাহিত্যিক একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে অজস্র স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি।
ঐতিহাসিক ও ট্রিলজি হিসেবে সর্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাস
সেই সময় প্রথম আলো পূর্ব-পশ্চিম
ট্রিলজি উপন্যাস এর শেষ পর্বের উপন্যাস "পূর্ব-পশ্চিম"। বিশাল ও বিস্তৃত পরিসরে দেশ বিভাগ নিয়ে লেখা উপন্যাস। এর পটভূমি অবিভক্ত বাংলা এবং বিশাল জনগোষ্ঠী।
আগের দুই উপন্যাসের ভিত্তি ছিল বাংলা সাহিত্য এবং সাহিত্যের বিকাশ কিন্তু এই উপন্যাসে তার উপস্থিতি খুব কম।ভারতের রাজনীতি আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেলেও দেশভাগই ছিল গোটা উপন্যাসের সারাংশ যা গল্পের প্রতিটি পাতায় ফুটে উঠেছে।
বড় কোন উপন্যাস বিশেষ করে ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস পড়তে গেলে মাঝে অনেক ভালো সময় কাটে কিন্তু যে চরিত্রকে ঘিরে পুরো উপন্যাস টি আবর্তিত হয়, যৌবনপর্ব শেষে তা বৃদ্ধ হয়ে যেন আমাদের কাঁদিয়ে চলে যায়।
প্রতাপ, তার মা সুহাসিনী, প্রথম থেকে তারা কলকাতার অধিবাসী হলেও তাদের শৈশব আর কৈশোর কাল কেটেছে পূর্ব বাংলায়। সেই আটচালা বাড়ি, সেই আম গাছ,মাছের পুকুর। অবিভক্ত বাংলাতে সব কিছু ছিলো কলকাতা কেন্দ্রীক। তাই অধিকাংশ মানুষই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া এবং ভালো থাকার জন্য কলকাতাকেই বেছে নিত। তবে দাঙ্গার সময় দুই বাংলার মানুষের অস্তিত্ব দুই ভাগ হয়ে গেল। অনেকের স্মৃতিও কেটে হলো দুভাগ।
দেশ বিভাগের বেশ কিছুদিন পর বাংলাদেশ স্বাধীন হল। বাবুল,মামুন এরা যেন যুদ্ধের স্মৃতি হয়ে রইল। তবে সবকিছুর পরও প্রতাপের মন চাচ্ছিল সেই দেশে ফিরে যেতে যেখানে কেটেছে পুরোটা শৈশব কৈশোর।
দেশভাগ নিয়ে তেমন স্মরণীয় উপন্যাস বাংলাভাষার লেখা হয়নি। দুই বাংলার ছড়ানো সমান্তরাল বাঙালিজীবন নিয়েও না। সেই অপূর্নতাকেই দূর করলো এই বিশিষ্ট, ব্যতিক্রমি ও বড়-মাপের উপন্যাস। বিশাল ক্যানভাসে চিত্রিত এই উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ একইসঙ্গে ছুঁয়ে আছে এপার এবং ওপার বাংলা। শুধু সেই পঞ্চাশের মধ্যভাগে দুই বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের পালাবদলের স্রোত এসে মিশেছে এই আশির দশকের মোহনায়-- এই উপন্যাস তার জীবন্ত দলিল।
অসাধারন যুদ্ধের বর্ননা, সাথে সেই সময়ের বিখ্যাত চরিত্রগুলোকে তুলে এনেছেন লেখক। তাছাড়া রুমি-জাহানারা ঈমাম, সেই নিয়াজী, অনমনীয় ইন্দিরা গান্ধী সবাই তো ইতিহাসের অংশ যা নিখুত ভাবে স্থান পেয়েছে এই উপন্যাসে।
তবে এই উপন্যাসে বিশেষ কোন চরিত্রকে মূল চরিত্র বলা যায় না। একই সঙ্গে অনেক গুলো প্রধান চরিত্র, এই সব চরিত্র আবার শুধু পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাতে নয়, ইউরোপ আমেরিকাতেও গেছে এবং সেখানের কিছু চরিত্র ও এখানে স্থান পেয়েছে একই সাথে কলকাতার কফি হাউসের পাশাপাশি আমেরিকার চোখ-ধাঁধানো শহরের কথাও উঠে এসেছে এই উপন্যাসে।
নামকরণ এর দিক দিয়ে শুধু পূর্ব বাংলা বা পশ্চিম বাংলার এর কথা নয়, পুরো পূর্ব গোলার্ধ ও পশ্চিম গোলার্ধের বৃহত্তর পটভূমি এই উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত। "সেই সময় " এর লেখকের হাতে লেখা এই সময়ের "পূর্ব-পশ্চিম"।
বইয়ের ক্ষেত্রে লেখক সব সময় দায়বদ্ধ থাকেন, এটা হওয়া উচিৎ মনে হয়। কিন্তু আমরা এমনটা অনেক সময় পাই না। এই বিশাল পরিসরের বিখ্যাত বইটা নিয়ে লেখক কিছু দায় না রাখলের পারতেন তবুও তিনি সুন্দর ভাবে এর কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি বা পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর পাঠকের মনের অবস্থা নিজেই স্বীকার করেছেন। তাছাড়া ৪০টি রেফারেন্স বইয়ের নাম দিয়ে বইটাকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন।
বিখ্যাত কিছু বই থাকে যে গুলো নিয়ে বিশেষ ভাবে কিছু বলার থাকে না, "পূর্ব-পশ্চিম" বইটাও তেমনই। বিশেষ ভাবে বলার কিছু নাই।
#এক্কেবারে পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়, gimmik আর hype-এর ডানায় ভর দিয়ে ভেসে থাকা ওভাররেটেড বই
ব���ধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : Overrated মানেই খারাপ না। অনেক সময় বইগুলো cultural বা emotional value-র জন্য বড় হয়ে ওঠে, অথচ সাহিত্যমান হয়তো তেমন উঁচু নয়।
এই বই, যতটা "প্লটনির্ভর", তার চেয়েও ঢের বেশি "ঘটনাপুঞ্জ নির্ভর"। পড়তে পড়তে মনে হয়—সুনীল যেন ইতিহাসের ডায়রিতে পাতা উল্টে চলেছেন, আর তার মাঝে মাঝেই এক-দু'টো চরিত্র ঢুকিয়ে দিয়েছেন যেন পাঠক একটু রিলেট করতে পারে।
কিন্তু চরিত্রেরা কি সত্যিই flesh and blood? না, তারা অনেকটাই একেকটা চেনা রকম stereotype — যে বিপ্লবী, সে "নিষ্পাপ আগুন", যে নারীবাদী, সে “শরীরচর্চার মর্মদর্শী”, যে মুসলমান, তার কপালে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের ���্র্যাজিক ট্যাগ লেগেই থাকে।
বইটিতে Partition, Refugee Crisis, East-West Bangladesh Conflict – সবকিছুর অনুপুঙ্খ বর্ণনা আছে ঠিকই, কিন্তু একটা সাহিত্যিক দায় থেকে নয় – অনেকটা যেন reportage-এর ভেতরে গল্প গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা।
দর্শন বা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া নেই, আছে একরাশ টুকে রাখা ঘটনার ক্যাটালগ। অনেকাংশে লেখাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে "এইটা ঘটেছিল" টাইমলাইন, সাহিত্যিক বিশ্লেষণ নয়।
এই বইয়ে যে যতজন মানুষ এসেছে, তাদের বেশিরভাগই মনে থাকে না। হয় কারণ তারা কেউ ততটা layered না, না হয় কারণ লেখক নিজেই তাদের ঘাড় ধরে পরের ঘটনার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
সুনীল নিজেই কোথাও কোথাও ক্লান্ত – হয়তো এতো বড় গল্প বলার মধ্যে ক্লান্তি আসে, কিন্তু পাঠকের ক্লান্তি আরও আগে এসে পড়ে।
একই ধরনের আবেগ, একই ভাষা, একই conflict বারবার ফিরে আসে। পাঠক হিসেবে একসময় মনে হয় – "এই তো পড়েছি তো পঁচিশ পৃষ্ঠা আগে!"
এ একধরনের emotional recycling, যেটা সুনীলের আরও তীক্ষ্ণ লেখাগুলোর থেকে এই বইকে দূরে সরিয়ে দেয়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মানেই যেটা পাঠক জানে – নারীচরিত্র আসবেই, এবং সেটা হবে ন্যারেটরের কামনা-বাসনার একটা সৌন্দর্যবোধে ভিজে যাওয়া ক্যানভাস।
পূর্ব-পশ্চিম-এও নারীচরিত্র আছে, কিন্তু তাদের agency কোথায়? তারা গল্পের চালক নয়, বরং গ্যাসের চুলোর পাশে রাখা চায়ের কাপ – মাঝে মাঝে দরকার মতো চুমুক দেওয়া হয়।
"পূর্ব-পশ্চিম" এক মহাভারতের ছায়ায় হাঁটার প্রচেষ্টা। কিন্তু অনেকটাই ধুলোমাখা ইতিহাসবর্ণনার ফাঁকা কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া এক সাহিত্যিক সফর।
এই বইকে নিয়ে যত হাইপ – সেটা বহুাংশে তার “সুনীলত্ব” আর বাঙালির “নস্টালজিয়ায় হাবুডুবু” মানসিকতার ফসল। সাহিত্যমান, গল্পের নির্মাণশৈলী, চরিত্রগঠনের দিক থেকে এই বই কেবলমাত্র এক "গুছোনো কোলাজ", উজ্জ্বল সাহিত্য নয়।
প্রায় টানা দুইদিন ১২ ঘন্টার অধিক সময় দিয়েছি। অতীত নিয়ে লিখতে সুনীল আসলেই সেরা। বেশ গুছিয়ে লিখেছেন। শেখ মুজিব সহ দেশীয় নেতাদের মন মানুসিকতা , ইন্দিরা গান্ধীর চিন্তা ভাবনা, পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীদের শোষণ, নিপীড়ন , রুমি আজাদ , শফিদের সাহসিকতা, কাদের সিদ্দিকীর যুদ্ধের বর্ণনা আসলেই প্রশঙ্গসার উর্দ্ধে। তাছাড়া নকশাল আন্দোলন তুলে ধরেছেন ।
সেই সময়, প্রথম আলো, পূর্ব-পশ্চিম --- এই টাইম ট্রিলজিটা একটা জার্নির মতন ছিল।অসম্ভব সুন্দর, আনন্দঘন একটা জার্নি।বাংলা সাহিত্যে এমন কিছু আর পাবো কিনা জানা নেই।ইতিহাস প্রিয় বলে হয়ত বইগুলোর প্রতি ভালোবাসাটা একটু বেশিই থাকবে সবসময়। তবে বাংলা সাহিত্যের গুণমুগ্ধ কিন্তু এই লেখাগুলো পড়া হয়নি- এমন হওয়াটা কারো পক্ষে উচিত হবে বলে মনে হয় না।
অতীনের মতো এতো বিরক্তিকর একটা ক্যারেক্টার ...শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধ, প্রতাপ, মামুন, মমতা, পিকলু,অলি'র জন্য উপন্যাস টা সুন্দর। বুলার আর কথা বলা-ই হলো না! পূর্ব আর পশ্চিমের সুন্দর এক যুগলবন্দী পুরো বই জুড়েই তা কখনো পূর্ব আর পশ্চিম বাংলা বা পূর্ব আর পশ্চিম গোলার্ধ! প্রথম আলো পড়ে যে-ই আনন্দ পেয়েছিলাম, সেটা পূর্ব-পশ্চিমে পাই নি।প্রথম আলো শেষ হতেই একটা শূন্যতা, একটা হাহাকার ছিল! কিন্তু পূর্ব-পশ্চিমে সেই আবেদন ছিল না। কিছু কিছু অপ্রয়োজনীয় শারীরিক বর্ণনা গুলো হয়ত চাইলে বাদ দেওয়া যেত!
My heart feels heavy, and my heart feels full. This story perfectly reflects history through the stories of everyday people who probably "lived" through it and some who probably "survived" it till date. Each and every one of the characters was thought out carefully, and the emotions that ranged through the story arc was cliche, dramatic, sentimental and yet the absolute normal. I could almost see a lot of people in my actual surroundings in these characters, and that truly creeped me out to a bit. But to be fair enough, I think I am overwhelmed by this novel and its naive beauty.
অনুরোধে কোথাও ঘুরে আসা যায় বা একটা দুইটা ম্যুভি দেখে ফেলা যায়। দুই পাচটা গান শুনা যায়। কিন্তু বই পড়ে ফেলা খুবই কঠিন কাজ। বই পড়ার একটা আলাদা মানসিকতা লাগে। আর এতো বই পড়বো পড়বো করে বই এর লিস্ট বড়ই হচ্ছে কিন্তু নানা কারণে ধরে দেখা হচ্ছে না। একদিন দুপুর বেলা আমার এক সহকর্মী উপহার হিসাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইটি আমাকে দিয়েছিলো এ বছরের মার্চে। বেশ মোটাসোটা বই। হাজার-বারোশ পৃষ্ঠা। দেখেই বুঝা যায় এক বেলা পড়ে শেষ করার মতো তো না। কোরোনাতে আক্রান্ত হওয়ার পর, সময় কাটানোর জন্যে তুলে নিলাম দুই সপ্তাহ আগে। বাসায় বন্দি না থাকলে হয়তো ধরাই হতো না।
পূর্ব-পশ্চিম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি তিন পুরুষ বিস্তৃত উপন্যাস। বিশাল পটভূমি, অনেকগুলো চরত্রের সমান্তরালে চলতে থাকে গল্পগুলো এক সুতোয় বাঁধা হয়েছে। আর এইসব চরিত্রের গল্প গুলো থেকে উঠে এসেছে এপার-ওপার বাংলার কাহিনী। উঠে এসেছে ৪৭ এর ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের ঘটনা, নিজের ভিটামাটি ছেড়ে অজানা কোথায় আশ্রয় নেয়ার গল্প। উঠে এসেছে কিভাবে নিজের স্বজাতি হঠাত করে কিভাবে ভিনদেশী হয়ে যায়। উঠে আসে একটা দেশের গনতন্ত্রের পথচলার গল্প। গনতন্ত্রের মূল্য কতটুকু ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষের কাছে? তার সমান্তরালে উঠে আসতে থাকে ধর্মের দোহাই-এ ভাগ হয়ে আলাদা হওয়া আরেকটা দেশের সামরিক শাসনের দুর্বিষহ চিত্র। ধর্ম দিয়ে যে একটা গোটা জাতিকে পৃথক করা যায় না, আবার ধর্মীয় গোঁড়ামিও যে জাতিকে দুটি বিপরীত প্রান্তে ঠেলে দিতে পারে, আবার রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে যা তারা চিরতরে কাল্পনিক সীমান্তে ভাগ হয়ে যায় এক জাতি দুটি ধর্মের নামে। উঠে আসে পূর্ব বাংলার স্বাধীকারের আন্দোলন, পশ্চিম বাংলার নকশাল আন্দোলন, পাক-ভারত-চীন দ্বন্দ্ব। বইয়ের বিশাল ক্যানভাসের জার্নি শেষ হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, বাংলাদেশ, ভারত, ইংল্যান্ড, আমেরিকার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে যাওয়া মানুষগলোর সমান্তরালে চলতে থাকা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন-যুদ্ধ নিয়ে। প্রতাপ, ত্রিদিব, মামুন, সুলেখা, মমতা, শাহজাহান, হারিত, এর সাথে সাথে পিক্লু, তুতুল, আলম, অলি, বাব্লু চৌধুরী, মঞ্জু।
আর তাদের সাথে যুক্ত হয় গান্ধীজী, জিন্নাহ-নেহেরু, আইয়ুব-সোহরাওয়ার্দী-শেরে বাংলা, ভাসানী-মুজিব, ৬ দফার মাতাল হাওয়া, ইন্দিরা গান্ধী, ২-৩টি যুদ্ধ।
দেশভাগের অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আর কোন বিস্তারিত বই আছে কিনা আমি জানিনা, আর থাকলেও ওই তালিকায় এই উপন্যাস থাকবে তা অনায়াসেই বলা যায়। লেখক দেশ-বিভাগটাকে নিজের চোখে দেখা অভিজ্ঞতা উৎসারিত করেছেন চরিত্রগুলোর মাঝে। দেশ-বিভাগ ঐতিহাসিক ব্যাপার, রাজনৈতিক ব্যাপার, কিন্তু দেশ-বিভাগের অভিজ্ঞতা অনেকটাই ব্যক্তিগত বা পরিবারকেন্দ্রিক আর তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় তা অতি নির্মম রূপ ধারণ করে। ব্যক্তিগত জীবনকে যখন দুর্দশা গ্রাস করে, তখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কোন মানে থাকে না ঐ ব্যক্তির কাছে। আন্দোলন, সংগ্রাম, দাঙ্গার হিসাব কষে শুধু দেশবিভাগের মূল্য মাপা যায়না, মানুষের বাস্তুত্যাগের হিসাবের সাথে ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্ক, তৈরী হওয়া দূরত্ব, আর বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বেচে থাকার হিসাবের খাতাটাও ইতিহাসের দায়।
মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের দেশ বিভাগের অভিজ্ঞতার গল্পটি শাখা প্রশাখা ছড়িয়েছে ঐতিহাসিক ঘটনার আবর্তে, সংসারের এক কর্তার পরিবার আর মুখ বজায় রাখার জীবনযুদ্ধে, আবার তা ছড়িয়েছে ভাই বিয়োগের কারণে আরেক ভাই এর মনদংশনের মাঝে। শাখা প্রশাখা ছড়িয়েছে কিছু না বলা, কিছু ব্যর্থ প্রেমের মাঝে। উঠে এসেছে সমাজ ব্যবস্থা তার সাথে প্রতি প্রজন্মে একটু একটু করে পরিবর্তন দৃষ্টিকোণে।
এতো ব্যপ্তির, এতো বিস্তৃতির উপন্যাসের ঘটনার বিবর্তন নাটুকে ছিলোনা, বরং ছিলো বাস্তবতার দমকা হাওয়া। সুনীলের অন্য কোন উপন্যাস না পড়লেও, কিছু কবিতা পড়েছিলাম ছোটবেলায়। আমার সহকর্মী যদি আসলে রেকোমেন্ড না করতো তাহলে চমৎকার উপন্যাসটি পড়াই হতো না।
সব ভালো বলা উপন্যাসে একটু যদি নেতিবাচক সমালোচনা করি, তাহলে বলতে গেলে বলবো, নারী-পুরুষ সম্পর্ক মানেই শুধু যৌনতা হতেই হবে তা কিন্তু না। বড় গল্প উপন্যাসে যৌন আকর্ষন, এবং বিস্তারিত দৈহিক বর্ণনা নতুন কিছু নয়, এটা উপন্যাসেরই অংশ, তবে উপন্যাসের কাহিনী নির্মান যত সাবলীল ছিলো, কিছু বর্ণনা একটু জোড় করে দেয়া বলেই মনে হয়েছে।
"তেলের শিশি ভাংলো বলে খুকুর ওপর রাগ করো তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ কর" ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের মতো অবিবেচক সিদ্ধান্ত দুই বাংলার মানুষকেই ভুগিয়েছে ।১৯৪৭ এবং তার আগের ঘটনা থেকে উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে শুরু আর তার বিস্তৃতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। প্রতাপ চরিত্রের কৈশোর থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত উপন্যাসের বিস্তৃতি। তবে এখানে শুধু প্রতাপ প্রধান চরিত্র না অসংখ্য চরিত্র নিয়েই বইটি ।প্রত্যেকটা পার্শ্ব চরিত্র অনেক যত্ন নিয়ে সৃষ্টি করা। অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের ছেলে প্রতাপ কে কলকাতায় সামান্য জর্জিয়াতি করে করতে হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে দরিদ্র সকল গুণনাশিনী।এই ব্যাপারটা উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে ফুটে উঠেছে । আত্মপ্রত্যয়ী শক্তিশালী প্রতাপ চরিত্র তো অভাবের মধ্য দিয়ে মাথা নত ব্যক্তিত্ব নষ্ট করা জীবন যাপন তার কাছে অসহ্য। ভাগ্নি তুলতুল , বন্ধু বিমান বিহারী তার মেয়ে ওলি রিফিউজি নেতা হরিত মণ্ডল কিংবা সব ছেড়ে হঠাৎ সন্ন্যাসী হওয়া চন্দ্রা, প্রতাপের বন্ধু মামুন ,বুলা ,মঞ্জু,বাবলু,সিরাজুল সহ প্রত্যেকটা চরিত্রের উপন্যাসে অবস্থান এবং ব্যাপ্তি অনেক দৃঢ়। মুক্তিযুদ্ধ ও নাকশাল বিদ্রোহের মত ঘটন উপন্যাসের কাল প্রবাহের স্থান পেয়েছে। ঘটনা বাংলাদেশ-ভারত ছাড়িয়ে পাশ্চাত্যে বিস্তার লাভ করছে।সব মিলিয়ে বইটি বেশ উপভোগ্য ছিল।
উফফ অতীনের মতো বিরক্তিকর ক্যারেক্টার আর হয় না। যেটাই হোক, বইটা খুবিইইই সুন্দর। আমার বরাবর যুদ্ধের সময়কাল বই পড়তে ভালো লাগে। বইটা পড়তে এক ফোঁটাও বিরক্তি আসেনি। ৫ তারকা 🫣
হঠাৎ করেই একদিন শেল্ফ থেকে তুলে নিলাম প্রায় হাজার পৃষ্ঠার এই মোটা উপন্যাসটি। অনেক বছর আগে দুই খন্ডের এই বইটা কিনেছিলাম। কিন্তু পড়া আর হয়ে উঠে না। তারমানে আবার এই না যে সেই সময়,প্রথম আলো আমার পড়া। বেশ অদ্ভুতভাবেই সুনীলের এই টাইম ট্রিলজির তিন নাম্বার বইটাই সবার আগে পড়লাম। এমন প্রমাণ সাইজের বই আমি আমার জীবনে কোনোদিন পড়ি নাই। বড় উপন্যাস পড়ার বা বড় সিরিজ দেখার একটা ভালো দিক হলো চলতে চলতে সেই উপন্যাস বা সিরিজটা নিজের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে যায়। কিন্তু যখন সেই জার্নিটা শেষ হয় তখন সবচেয়ে বেশি শূন্যতা কাজ করে।
লেখক পূর্ব-পশ্চিমের কাহিনী সাজিয়েছে বিশাল পটভূমি নিয়ে। যেখানে ঠাই মিলেছে ৪৭ এর দেশভাগ থেকে শুরু করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী প্রেক্ষাপট। সেই সাথে তখনকার সময়ের পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলন এবং লন্ডন,নিউ ইয়র্ক,বোস্টন এবং তারসাথে জড়িত কিছু পরিবার এবং তাদের জীবন। কিছু বাস্তব চরিত্রের পাশাপাশি লেখক কিছু ফিকশনাল ক্যারেকটারের আবির্ভাব ঘটিয়েছে এবং কি সুনিপুণভাবেই তিনি এই বিশাল উপন্যাসের গাঁথুনি গেঁথেছেন। যেই গল্পের শুরু হয় প্রতাপ মজুমদার এবং সৈয়দ মোজাম্মেল হক ওরফে মামুন এর জীবনকাহিনী এবং তাদের বন্ধুত্ব দিয়ে। ধীরেধীরে উঠে আসে দেশভাগ এবং দুই বন্ধুর আলাদা হয়ে যাওয়া এবং শুরু হয় দুই বন্ধুর দুটো আলাদা জীবন। মাঝখানে তৈরি হয় অসংখ্য চরিত্র। যেখানে অতীন, কৌশিক,পমপমের মত খ্যাপাটে, তিরিক্ষি মেজাজের চরিত্র আছে আবার অলি,তুতুল,শর্মিলার মত শান্ত,শুদ্ধ,নির্মল চরিত্রও আছে। সবগুলা চরিত্রই আমার কাছে মনে হয়েছে জীবন্ত,এদের সাথেই কথা হয়েছে প্রায় প্রতিদিন। এই উপন্যাসের আসলে রিভিউ লিখা সম্ভব না, সেই চেষ্টাও করছি না। কারণ এতএত চরিত্র, এতএত প্রেক্ষাপট যে এদের প্রত্যেককে নিয়েই আলাদাভাবে লিখা সম্ভব। কিন্তু যেই একটা চরিত্র আমার মনে গভীর দাগ কেটে গিয়েছে সে হলো 'অলি'। গল্পের সবচেয়ে শুদ্ধতম চরিত্রও বলতে গেলে এই অলি।
দেশভাগের প্রেক্ষাপট নিয়ে এত বিশদভাবে লিখা একমাত্র সুনীলের পক্ষেই সম্ভব। আমার পছন্দের উপন্যাসের তালিকায় পূর্ব-পশ্চিম টপ ১-২ পজিশনেই থাকবে আজীবন।
গোলার্ধ পর্যন্ত। ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে উপন্যাসের চরিত্ররা। ভারতীয় উপমহাদেশের এই দুঃসময়ে এখানকার প্রতি ইউরোপ-আমেরিকার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও চমৎকারভাবে এসেছে এই উপন্যাসে।
এ উপন্যাসে প্রত্যেকটা চরিত্রের চিত্রায়ণই অসাধারণ।
বিশেষতঃ অলি, বাবলু, তুতুল, সিরাজুল, মামুন, মঞ্জু প্রত্যেকের নাম নিতেই তাদের ছবি ভেসে আসছে চোখের সামনে। এদের প্রত্যেককে ভাল না বেসে কোন উপায় নেই। প্রত্যেকটা পাঠকই এদের প্রেমে পড়বে।
প্রতাপ মজুমদারের যে সততা ও সৎ থেকে নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করে জীবন যাপনের যে সংগ্রাম তা এককথায় অনবদ্য। এটা একেবারেই একজন সৎ বাঙালীর চিত্রায়ণ। বাঙালীর মনন পর্যবেক্ষণে সুনীল তার সর্বোচ্চটা দিয়েছেন এই চরিত্রে।
মমতা, শান্তি, সুপ্রীতি, সুলেখা, চন্দ্রা, ত্রিদিব এমন আরো অনেক অবিস্মরণীয় চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে উপন্যাসে।
এ তো গেলো কাল্পনিক চরিত্রের কথা। ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোও এসেছে উপন্যাসের প্রতিটি প্রাসঙ্গিক ঘটনায়।
নেহেরু, গান্ধী, জিন্নাহ থেকে শুরু বঙ্গবন্ধু, হামিদ খান ভাষানী সহ প্রত্যেকটা ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো এসেছে বইয়ের পাতায় পাতায়। তবে জাহানারা ইমামের পরিবার ও রুমীর কথা এসেছে একেবারেই ইন ডিটেইলস ও বিশেষভাবে।
উপন্যাসটি বাঙালীর ও বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের অস্তিত্ব জানা ও পিছন ফিরে দেখার যে জরুরত তা ব্যাপকভাবে পূরণ করেছে উপন্যাসটি।
উপন্যাস হিশেবে ‘পূর্ব-পশ্চিম’ যে অসামান্য, সেটি নিয়ে আমার অন্তত সংশয় নেই; তবে একে ইতিহাসপাঠ্য হিশেবে নেয়াটা বা এই উপন্যাসটিকে অবলম্বন করে ইতিহাসের সত্যাসত্য যাচাই উচিত নয় বলেই আমি মনে করি। দেশভাগের ক্ষত, উদ্বাস্তু হবার উন্মূল যন্ত্রণা আর সেই সঙ্গে নকশালবাড়ি আন্দোলন আর দেশভাগোত্তর প্রজন্মের ভাবনার এক অপূর্ব কিন্তু বেদনাদগ্ধ মণিকাঞ্চন যোগ তো বটেই, উপন্যাসটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রাক-প্রাথমিক চিত্রও পাওয়া যায়।
One of the best fiction I have ever read, it's written on the historical and political perspectives of Indian subcontinent. From the partition of India to the liberation war of Bangladesh, it covers much of the facts of 1947-1971. Covering all this things, the gigantic novel is truly a story of tragedy, a tragedy of a traditional Indian family.
কখনো কি ভেবে দেখেছেন যদি আজকে আমার নিজের বাড়ি থেকে আমাকে চলে যেতে বাধ্য করা হয় তবে কেমন লাগবে? আমার চোখের সামনে আমার বাড়িঘর ধ্বংস করা হয় কেমন লাগবে? বা ছোটবেলার স্মৃতি বিজড়িত জায়গাগুলোকেই যদি মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয় নিজেরই চোখের সামনে, তবে?
আমাদের ইতিহাসেই কিন্তু এই ব্যাপারগুলো প্রবল ভাবে দৃশ্যমান হয়। ১৯৪৭ এ দেশভাগের সময় লাখ লাখ বাঙ্গালি নিজ ভিটে ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলো আরেক প্রান্তে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে, যেটি হয়ত কিছু ঘন্টা পূর্বেও নিজেরই দেশ ছিলো। কূটনৈতিক চাল ও ধর্মীয় উস্কানি-তে দেশ ছেড়ে আগে যেটা ছিলো নিজেরই দেশ সেখানেই রিফিউজির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তারা। তাদের কেউ চায় না, না চায় ভারত না চায় পাকিস্তান। তবুও তারা মাটি আঁকড়ে পড়ে ছিলো ভারতে। কারণ তারা যে হিন্দু, আর পাকিস্তানের মাটিতে যে তাদের জায়গা নেই! পরবর্তীতে অনেক মুসলিমও ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন শুধু মাত্র তাদের ধর্মের জন্য, কারণ তাদের গায়েও লেগে গেছে পাকিস্তানী চরের ট্যাগ। সেটা অবশ্য ছেষট্টি’র কথা।
দেশ ভাগ নিয়ে বাংলা ভাষায় তেমন কোনো কাজ করা হয়নি। সেই অনেকদিনের আক্ষেপই হয়ত পূরণ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি নিজেও এই দেশভাগের নাটকের সামিল। বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করলেও তাকে বড় হতে হয়েছে কোলকাতায়। সেখানে বসেই হয়ত তিনি নিজের জন্মস্থানকে উপলব্ধি করেছেন, লিখেছেন এক বিরাট আখ্যান- "পূর্ব পশ্চিম"।
"পূর্ব পশ্চিম" উপন্যাসটিতে লেখক তুলে ধরেছেন দুই বাংলার সম্পর্ক, এতে যেমন রয়েছে রাজনৈতিক কূটচাল, তেমনি রয়েছে একে অপরের প্রতি মায়ার সম্পর্ক। একে একে উঠে এসেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনীতি ও সামাজিক পরিবর্তন। তিনি পাশাপাশি ভাবে নকশাল আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা করে গেছেন। নকশালপন্থী কিছু মেধাবী ছাত্রদের ব্যার্থ আন্দোলনের সাথে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মেধাবী ছাত্রদের বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার বাস্তবচিত্র, যা এই দেশকে এনে দিয়েছে বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
দুই বাংলার কিছু পরিবারের গল্পই মূলত এই উপন্যাসটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। প্রতাপ, যে কিশোর বয়সে ভিটে ছাড়া হয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে সেই মূলত উপন্যাসের প্রথম খণ্ডে প্রধান হয়ে উঠেছেন। তার পরিবারে স্ত্রী মমতা, ছেলে পিকলু, বাবলু তাদের সাথে ছিলো মামুন, বাবুল চৌধুরী, মঞ্জুর মতো কিছু কাল্পনিক চরিত্র। চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও এমন চরিত্র আমাদের আশেপাশে প্রতিনিয়তই খুঁজে পাওয়া যায়। এই চরিত্রগুলো একেকটি সময়কে প্রতিনিধিত্ব করে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তাঁদের সাথে ছিলো শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, শহীদ রুমি, শেখ মুজিব, ইন্দিরা গান্ধী, নেহরু, ইয়াহিয়া, আইয়ুব খানের মতো ইতিহাস কাঁপানো চরিত্রগুলো।
পঞ্চাশের দশকের কিছু পর থেকে গল্পটি শুরু হয়। ধীরে ধীরে উঠে আসে ছেষট্টি সালের ইন্দো-পাক যুদ্ধের ভয়াবহতা, ৭০’র উপহাস সৃষ্টিকরা নির্বাচন, ৭১’র স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৭৫’র জাতির জনকের হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত। ছেষট্টি’র যুদ্ধ নিয়ে লেখকের কিছু বর্ণনা নিয়ে একসময় প্রবল আলোচনা ও সমালোচনা হওয়ার পর লেখক সেই বর্ণনার তথ্যসূত্র বইয়ের শেষদিকে প্রকাশ করে প্রমাণ করেছেন যে এসকল বর্ণনা তাঁর কল্পনাপ্রসূত নয়। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, ক্র্যাক প্লাটুনের অসম সাহসী অভিযান, অপারেশন জ্যাকপটের প্রশিক্ষণ ও সফল অভিযান এবং পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের মতো ঐতিহাসিক বর্ণনায় লেখকের একাগ্রতা ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ পাঠক মনকে সেই সময়কার উত্তেজনা অনুভব করায়।
যে সকল বাংলাদেশী যুদ্ধকালীন সময়ে বিদেশে ছিলেন তাদের দেশের প্রতি আকুলতা যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি ফুটে উঠেছে ‘জয় বাংলার’ লোকদের প্রতি কোলকাতার মানুষের আতিথেয়তা। বিদেশে থেকেও তাঁরা দেশের জন্য ফান্ড জোগাড় করতে একবারও পিছপা হয়নি, যে যেভাবে পেরেছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে দেশের কল্যাণে।
উপন্যাসের প্রথম খণ্ড থেকে দ্বিতীয় খণ্ড অনেকটাই দ্রুত এগিয়েছে। তবে এই খণ্ডে এসে প্রতাপ যখন বার্ধ্যক্যের দিকে এগুচ্ছে তখন নকশালপন্থী ছেলে অতীন মজুমদার ওরফে বাবলু, রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে। তার যৌবনকালের বর্ণনায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সাথে ফুঁটে উঠেছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সাথে আমাদের দূরত্ব। ধর্মীয় দূরত্বকে পিছে ফেলে আলম নামের এক বাংলাদেশী ছেলেকে বিয়ে করে তুতুল প্রমাণ করেছে জাত ধর্ম কখনো ভালোবাসার উর্ধ্বে হতে পারে না। শর্মীলার জন্য নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে অলি প্রমাণ করেছে ভালোবাসার জন্য একটি মন প্রয়োজন, ভালোবাসার মানুষটি না থাকলেও চলবে।
মূলত দুই বাংলার প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন, জন্মস্থানের প্রতি আকুতি, ও কিছু মানুষের পাওয়া ও না পাওয়ার আখ্যান “পূর্ব পশ্চিম”। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলার ইতিহাসের একটি আক্ষেপ নিয়ে কাজ করে এই উপন্যাসটিকে একটি অলিখিত ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত করেছেন।
সময়তো আর দর্পনের মতন থেমে থাকেনা,সময় নদীর স্রোতের মতন বয়ে চলে।আর বয়ে চলা 'সেই সময়' স্রোতের টানে এসে শেষ হয় 'পূর্ব-পশ্চিম' এ। সময়ের এ বয়ে চলার মধ্যেই অনেক হাসি,অনেক কান্না, অনেক দুঃখ, দুর্দশা, আর অনেক হৃদয় ভাঙার গল্প হয়ে ছবির মতোই স্থির হয়ে যায় একটি ব্যাপার 'দেশ ভাগ'।
দেশ ভাগের আখ্যানে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টাইম ট্রিলজির শেষ বই 'পূর্ব পশ্চিম' মূলত গল্পচ্ছলে বলা ইতিহাসের এক স্বপ্নভঙের গল্প। দুই বাংলার কেন্দ্রস্থল কলকাতার রিপন কলেজে পড়ুয়া দুই বন্ধু পূর্ববাংলার মালখনগরের মজুমদার বাড়ির প্রতাপ মজুমদার আর কুমিল্লার দাউনকান্দির সৈয়দ মোজাম্মেল হক তথা মামুন এর হাত ধরেই ইতিহাস এগিয়ে চলে ধারাবাহিক ভাবে। প্রায় চল্লিশ ��ছর সময়কে লেখক একটু একটু করে স্পর্শ করেছেন এক হাজার পেইজের এই নাতিদীর্ঘ বইয়ে।ইতিহাসের চরিত্রগুলোকে রক্ত মাংসের জীবন্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে।
১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে সংগঠিত হয় দুঃস্বপ্নের দেশ ভাগ।ভারতের মতো একটি দেশ "যে দেশে শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ কুসংস্কার -তাড়িত,সামান্য বাইরের প্ররোচনাতেই ধর্মের নামে হাতিয়ার তুলে নেয়,কথায় কথায় রক্তের স্রোত বইয়ে দেয়, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে রইলেন এমন একজন, যিনি ব্যাক্তিগত জীবনে ধর্মচর্চাকে অরুচিকর বিবেচনায় আত্মশ্লাঘা বোধ করেন।" মালখনগরের স্মৃতিকে বাচিঁয়ে রেখে প্রতাপ মজুমদার থেকে যান বাংলার পশ্চিমে। উনাকে কেন্দ্র করে উঠে আসে দেশ ভাগ পরবর্তী পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক উত্থান-পতন, রিফিউজিদের মর্মান্তিক করুন জীবন,নকশাল আন্দোলন। তৎকালীন পশ্চিম বাংলার বাঙালি পরিবারগুলোর সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, ও ধর্মীয় দিকগুলোও সমানতালে চলে আসে ইতিহাসের অংশ হিসেবে।
সমান্তরাল ভাবে ১৯৩৭ সালে বাংলার পূর্ব দিকে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে এসেছিল এক নতুন আশা আর উদ্দীপনার জোয়ার।সেই উদ্দীপনায় গা ভাসিয়ে মুসলিমদের জন্য পাওয়া একটা আলাদা রাষ্ট্রের আহ্লাদ নিয়ে মামুন চলে আসে একটা স্বাধীন দেশের মাটিতে।কিন্তু আহ্লাদে আটখানা হওয়া পূর্ববাংলা মুসলিমরা সত্যিকারে�� স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিলো আরো অনেক বছর পরে।এতো স্বাদের পাকিস্তানে এসে মামুন একে একে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭৫ পরবর্তী সময়গুলোর সাক্ষী দিয়ে যান বইয়ের পাতায় পাতায়।
লেখক বাংলার দুই দিক পূর্ব-পশ্চিম ছাড়াও পাঠকদেরকে ঘুরিয়ে এনেছেন ইউরোপ, আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালি পরিবারগুলোর সভ্য জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে।এছাড়াও তুলে এনেছেন তাদের দেশপ্রেম,অর্থনীতি,ও ইস্কনের মতোন ধর্মীয় উন্মাদনার বিষয়গুলো।
তথ্যে ঠাসা ইতিহাস নির্ভর বই পড়তে যারা ভয় পান তাদের জন্য গল্পচ্ছলে বলা এই উপন্যাসটা হাইলি রেকোমেন্ডেড। ইতিহাসের সব তথ্য -উপাত্ত উপন্যাস লেখার খাতিরে হয়তো একটু এদিক সেদিক হয়ে যায়,আবার লেখকের নিজের মতামত, চিন্তাধারা, আদর্শও চলে আসে লেখনির ফাঁক ফুকোরে।এক্ষেত্রে লেখকের ঋণ স্বীকারের কর্তব্যবোধে দেয়া তালিকার ৪০টি বই অবশ্য দ্রষ্টব্য।
“দেশাত্ববোধের অপর নাম ঘৃণা” কথাটা আসলেই সত্য। আপনার ভেতরে অন্য দেশের প্রতি ঘৃণা না থাকলে আর আপনি কিসের দেশ প্রেমিক? আমার দেশ আসলে কোনটা? কাঁটার দিয়ে ঘিরে রাখা একখন্ড ভূমিকে আমি দেশ বলছি! কাল যদি এই ভূমির মধ্যখানে আরো একটি কাঁটাতার পড়ে, তখন আমার দেশ কোনটা হবে? এই সীমিনাটাই কি আমার দেশাত্মবোধ!
‘পূর্ব-পশ্চিম’ বইতে লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এটাই বোঝাতে চেয়েছেন। তিনি ১৯৪৭ থেকে শুরু করে ১৯৭৫ পর্যন্ত এই ভারতবর্ষের দেশ ভাগকে কেন্দ্র করে এই বিশাল দেশের মানুষদের নানা ভাবে অপমানের কথা তুলে ধরেছেন।
যেমন শুরুতেই দেখানো হয় বাংলাদেশের বিক্রমপুরের মালখানগর থেকে প্রতাপ মজুমদার তার সপরিবার নিয়ে বর্তমান ভারতের দেওঘরে উপস্থিত হন একজন রিফিউজি হিসেবে। সেই শুরু, তিনি তার নামের পাশে এই রিফিউজি শব্দটা বাকি জীবন বয়ে বেড়ান। অথচ কিছুদিন আগেও এই পুরো ভারতবর্ষ প্রতাপের দেশ ছিল।
দেশ ভাঙ্গনের সুর সেই অনেক আগে থেকেই শুরু হয়, সেটা আমরা বুঝতে পারি গল্পের প্রতাপ আর তার বন্ধু মামুনের এক কাহিনি থেকে। প্রতাপ তখন স্কুলে পড়ে, তখন কোনো এক কারণে প্রতাপ বেড়াতে যায় বন্ধু মামুনের বাড়িতে। কেবল হিন্দু বলেই প্রতাপ মামুনের বাবার কাছে থেকে অপমানিত হয়। জানা যায় মামুনের দাদাও কোনো এক হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে অপমানিত হয়। এরকম করেই খন্ড খন্ড ঘটনাতে দানা বাঁধে সাম্প্রদায়িকতার। আর এর সুযোগ নেন সরকার প্রধানরা। ফলে ঘটতে থাকে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা। কত শত মানুষ অহেতুক প্রাণ হারান।
দেশ ভাগের পর ভারতে চলে আসা একদল রিফিউজির নেতা হয়ে দাঁড়ান হারিত মন্ডল। পূর্ববঙ্গের সমৃদ্ধশালী হারিত মন্ডল পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে নানানভাবে অত্যাচারিত হতে থাকে একখন্ড থাকার জায়গার জন্য। শেষে তাকে সহ তার দলের যায়গা হয় আন্দামান দীপপুঞ্জে। কি নিদারুণ কষ্টকর সেই জীবন।
সাধারণ এক কাঁটাতারের বেড়া নিজ গোত্রীয় মানুষদেরও এখন অবাঞ্চিত মনে করতে শুরু করেছেন। অথচ কিছুদিন আগেও তারা এক ছিলেন।
এক প্রতাপের পরিবারের মধ্যদিয়ে লেখক এপার থেকে ওপার পর্যন্ত মানুষ পরিবেশ, পরিচয়, পরিনতি, রাজনীতি এবং সেই সকল চরিত্রগুলোকে সেই সময়ের বাস্তব চরিত্রের বিখ্যাত লেখক, কবি, সাহিত্যক, চলচ্চিত্রকার সহ রাজনীতিকদের সংমিশ্রণে অতি চমৎকার এক উপাখ্যান সৃষ্টি করেছেন। এই গল্পের মাধ্যমে যেই সকল পাঠক দেশ ভাগের ইতিহাস পড়তে ইচ্ছা করেন, তাদের জন্য খুব উপাদেয় হবে।
বইটি পড়ে আমি অনেক নতুন কিছু জেনেছি। ভালো লাগার বদলে খুব খারাপ লেগেছে আমার। অতি তুচ্ছ কারনে পুরো এক জাতি বিলিন হয়ে যেতে বসেছিল। কি এক ষড়যন্ত্র ছিলো সেটা। কয়েকটি পরিবারের সুবিধার জন্য এই অখন্ড ভূমি আজ খন্ডিত। বাংলার কঠিন কিছু মানুষের জন্য আজো টিকে আছে এই বাংলা। তবে আর কতদিন এভাবে টিকে থাকার লড়াই করতে পারবো সেটাই বড় কথা।
ভৌগলিক ভাগ একটাসময় গিয়ে মানুষের মানসিক সম্প্রীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু মানুষ মানুষকে ছাড়িয়ে এর উর্ধ্বে উঠার যে প্রয়াস তা কেবলই মেকি রয়ে যায় যখন ধর্ম ও রাজনীতি মানবিক স্থানে হানা দেয়। পূর্ব-পশ্চিমের ভাগাভাগি যারা চেয়েছিল তাদের সিদ্ধন্তের বলয়ে সাধারনের ভাগ্যের ঘুর্নিপাক। গল্পের প্রবাহে এই মনে হয় কখনও লেখকের ব্যাক্তিবোধ সামনে এসে দাড়ায় আবার পর-মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় তার সাবধানী লেখনির জাদুতে। অনেকের অনেক নাম জানা আসল চরিত্রের আগমন ঘটলেও, এর বাইরে কাহিনির শাখা-প্রশাখা বিস্তার শুধু প্রতাপকে ঘিরেই। মাতৃভূমি ত্যাগী মানুষের সংগ্রামে প্রতাপের সাথে হারীতের নাম নিতে হয়। সাতছল্লিশের দেশভাগ আর একাত্তরের বিপর্জয় ছাড়া ইতিহাসের আর কিছু প্রকট আকারে পাওয়া যায় না। তবে গল্পের প্রবাহমান ধারা নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ঘটনা পড়ে নতুন জিজ্ঞাসার আগ্রহ তৈরি হওয়াটা আবশ্যক মনে হয়েছে। তবু কাহিনির বিস্তার মহাকব্যিক হলেও বইটির গুনবিচারে বইটি নিজেই পিছিয়ে। মিড-লাইফ-ক্রাইসিস, প্লাটোনিক লাভ, কাম, উত্তর-আধুনিক উপন্যাসে যা যা দরকার ঘটনা বলতে গিয়ে, সবই আছে। সারাজিবন একই আদর্শ চেপে জীবনকে টেক্কা দেয়া কৌশিক, মাঝে মাঝে না অনেকখানি, বন্ধু বাব্লুকে হার মানিয়ে দেয়। বাব্লুর অতি মানবিকিয়ভাবে জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়া বইয়ের ঘটনা প্রবাহকেও ঘুরে যেতে হয়েছে সবসময়। অবশেষে, ঘুর্নিপাকে বাব্লুর আমেরিকা গিয়ে থিতু হওয়া এবং পুরো কেপিটালিস্ট বনে যাওয়া বাব্লুকে তার অতীতক মনে করিয়ে দিতো। তরুণদের ঘিড়ে নকশালি আন্দোলনে আলাদা মাত্রা নিয়ে আসে পমপম ও অলি। একাত্তরের যুদ্ধের গেরিলা মিশন বর্ণনা, শহীদ রুমির না ফেরা, এক দেশের সীমানা পাড়ি দিয়ে পাশের দেশে প্রবেশ যাদের গায়ে তখনও দেশভাগের ঘাঁ, এসবের দারুণ বর্ণনা আছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা মোটেও উপভোগ্য হবে না এই বইয়ে। শেষে এসে সব মানুষের হার শুধু মানুষের আইডিয়ার কাছেই হয় মনে হয়েছে। বইটি বুঝিয়ে দেয় মানুষ আজীবনই মানুষের কাছে ঋণী থাকে কোন-না-কিছু নিয়ে।
কয়েকদিন আগে ই পড়ে শেষ করলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব পশ্চিম। আমি বরাবরই একটু বড় উপন্যাস পড়তে পছন্দ করি। পড়তে পড়তে উপন্যাসের ঘটনাবলীর মধ্যে ই নিজেকে খুঁজে পাই, চরিত্রগুলোর সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায় 👥 এবং ওদের সাথেই যেন মনে হয় বেশ কিছু দিন ধরে জীবন যাপন করি। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি ✨।
পূর্ব-পশ্চিমের সাথে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল সেপ্টেম্বরের ১ তারিখে 📅 আর শেষ হলো নভেম্বরের ১৬ তারিখে। সময় একটু বেশি লাগলো বটে কিন্তু এটা একটা অসাধারণ যাত্রা 🚶♂️✨। এবং এই যাত্রাপথের অনুভূতি আমি এখানে শেয়ার করছি।
পূর্ব-পশ্চিম পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে এটি এমন একটি উপন্যাস, যা শুধু পড়ার নয়—অভিজ্ঞতা করার 🎭। প্রায় হাজার পৃষ্ঠার বিস্তৃতি নিয়ে এই বইটি দেশভাগ, উদ্বাস্তু জীবন, নকশাল আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং দুই বাংলার রাজনৈতিক ও মানবিক ইতিহাসকে একদৃষ্টিতে দেখার এক অসাধারণ সুযোগ দেয় 🌏🕊️।
উপন্যাসটা পড়ার সময় আমার বারবার মনে হয়েছে যেন আমি আর শুধু একজন পাঠক নই—আমি এই গল্পের ভেতরেই কোথাও দাঁড়িয়ে আছি। কখনও মালখানগরের ভিড়ভাট্টা গ্রামপথে 🚜, কখনও ঢাকার উত্তাল রাজপথে 🔥, কখনও বা লন্ডনের ঠান্ডা রাস্তায় প্রতাপের সঙ্গে হাঁটছি 🇬🇧❄️।
বইটার আয়তন যত বড়, তার ভেতরের অনুভূতিগুলো তার চেয়েও বিস্তৃত 🌌। শুরুটা ধীর—কিন্তু ধীরে ধীরে আমি যেন চরিত্রগুলোর জীবনে ঢুকে পড়েছি। প্রতাপ, মামুন, কৌশিক, পমপম, অতীন, অলি—এরা গল্পের চরিত্রের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে ওঠে। মনে হয়, এদের আমি সত্যিই চিনি, ওরা আমার সাথে থাকত, আমারই শহরে ঘুরে বেড়াত 🏙️, আমার পরিবারের গল্পেও কোথাও যেন তাদের খুঁজে পাই।
যে মুহূর্তে দেশভাগের বর্ণনা আসে—ভূগোলের মানচিত্র আর মানবজীবনের মানচিত্র ভেঙে পড়তে দেখে বুক একটু ঠেলে ওঠে 💔। মনে হয়, কত পরিবার, কত মানুষের ভাঙা ঘর, হারানো সম্পর্ক, চোখের জলে ভেজা স্মৃতিই হলো এই উপন্যাসের অদৃশ্য ভিত্তি 😢। সেই বেদনা পড়তে পড়তে আমিও যেন একটু নীরব হয়ে যাই।
নকশাল আন্দোলনের উন্মাদনা 🔥, উদ্বাস্তুদের জীবনযুদ্ধ 🏚️, মুক্তিযুদ্ধের রক্তমাখা স্মৃতি 🇧🇩—সবকিছু মিলে এই বইটি এমনভাবে আমাকে ঘিরে ধরে যে মাঝে মাঝে বই নামিয়ে রাখি। শ্বাস নিতে হয় 😮💨। ভাবতে হয়। তারপর আবার আকর্ষণে টেনে নিয়ে যায়।
আমাকে সবচেয়ে বেশি ছুঁয়ে গেছে চরিত্র গুলো র সম্পর্কের ক্ষুদ্র মুহূর্তগুলো—অলির সরলতা, তুতুলের নীরব কষ্ট, বাবলুর অদ্ভুত স্বপ্ন, কৌশিকের অস্থিরতা… এগুলো যেন শুধু কাগজের শব্দ নয়—যেন জীবনের গন্ধ আছে 🌿।
বইটা শেষের দিকে এসে যে শূন্যতা তৈরি হয়—তা ব্যাখ্যা করা কঠিন 🕳️। এত লম্বা পথে হেঁটে এসে চরিত্রগুলোকে ছেড়ে দিতে মন চায় না। মনে হয়, আরেকটু থাকো—আরও কিছু বলো… তখনই বোঝা যায়, উপন্যাসটা আমাকে কোথাও গভীরে স্পর্শ করেছে ❤️।
শেষ পাতা বন্ধ করার পর আমার মনে হয়েছে—এ শুধু ইতিহাসের গল্প নয়; এটি বাঙালির মনোজগতের এক অপূর্ব দলিল 📜। আর আমি—একজন পাঠক—এই গল্পের মধ্যেই নিজের অনেকখানি খুঁজে পেলাম 🪞।
সবশেষে বলবো, এটি সময়, স্মৃতি ও মানবিকতার এক দীর্ঘ, গভীর ভ্রমণ 🌠।
সাতচল্লিশের দেশভাগ ও তার প্রেক্ষিতে যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল তাদের মনোবেদনা কিংবা এর যে সামগ্রিক প্রভাব তা নিয়ে ‘পূর্ব-পশ্চিম’ এর মতো এরকম দীর্ঘ পরিসরের বই লিখতে কাউকে তেমন দেখা যায়নি। ক্ষুদ্র পরিসরেও যে খুব একটা লেখা হয়েছে এমন না। যেহেতু দেশভাগের সাথে আছে লেখকের ব্যক্তিগত স্মৃতি ও দুঃখ-ব্যথা, তাই বইটি হয়ে উঠেছে দেশভাগের একটি দালিলিক বই, যেখানে মিশে আছে দুই দেশের বাঙালির আবেগ।
আগেই বলে রাখা ভালো অনেকেই ‘সেই সময়’ ‘প্রথম আলো’ এবং ‘পূর্ব পশ্চিম’ এই তিনটি বইকে সুনীলের ‘টাইম ট্রিলোজি’ বলে আখ্যা দেন। তবে বই তিনিটি তিন ভিন্ন সময়ের হলেও এবং সময়ের ধারাবিহকতা বজায় থাকলেও এরা কোন ট্রিলজির অন্তর্ভুক্ত নয়। এক বইয়ের সাথে নেই আরেক বইয়ের চরিত্রগত কোন সম্পর্ক। ‘সেই সময়’ এর সাথে ‘প্রথম আলো’র পটভূমি গত মিল থাকলেও নেই চরিত্রগত কোন মিল, আবার ‘পূর্ব-পশ্চিম’ এর সাথে ঐ দুই বইয়ের একেবারেই মিল নেই, সেখানে বাস্তব সময়ের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ থাকলেও বাস্তব চরিত্রদেরকে উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র হিসেবে পাওয়া যায় না। তাই এই তিনটি মাস্টারপিস বইয়ের যেকোন বই দিয়েই আপনি আপনার পড়া শুরু করতে পারেন। আবার প্রকাশের কাল বা ঘটনা প্রবাহের কাল অনুসারেও উপরিউক্ত সিরিয়াল মোতাবেক পড়তে পারেন।
বইয়ের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে সদ্য স্বাধীন ও বিভক্ত ভারত, বাংলাদেশের কয়েকটি পরিবারকে নিয়ে, সেই কাহিনী পৌঁছে যায় পশ্চিমা দেশ আমেরিকা এবং ইংল্যাণ্ডেও। ভারতের নকশাল আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সেই সময়ের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভাঙন এবং নতুন দল গঠন থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথাও উঠে আসতে দেখবো। স্বল্প পরিসরে জানবো কীভাবে একজন সাদাসিধা মানুষের জেদের ফলে তৈরী হলো ইসকনের মতো একটা বৃহৎ ধর্মীয় দলের।
দেশভাগের ফল যে একেক পরিবারকে একেক রকম পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয় তার একটা পরিষ্কার চিত্র আমরা এই বই থেকে পাবো। উচ্চবিত্তদের দেশভাগের ফলে দেশ ছাড়তে হলেও আইনসঙ্গত ভাবে তারা নতুন দেশে গিয়ে আগের ন্যায় সম্পদ পেলেও মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের ভাগ্যে তা জোটেনি। তাই প্রতাপের পরিবারকে মালখানগরের বাড়ীর পরিবর্তে আমরা থাকতে দেখবো কলকাতার এক ভাড়া বাড়ীতে, হারীত মণ্ডলদের মতো মানুষদের ভাগ্যে জুটবে উদ্বাস্তু শিবিরের কষ্টের জীবন, যাদের ভাগ্যে জোটেনা ন্যূনতম খাবারও। ঠিক কিছুকাল পরেই বাংলাদশে একদল মানুষ আবার দেখছে স্বাধীনতার স্বপ্ন।
উপন্যাসের পরিসর দীর্ঘ। আছে রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা, কিন্তু কোন অংশই খারাপ লাগে না। ভারতের নকশাল রাজনীতি স্বীকার হয়ে যখন অনেক মেধাবী তরুণ ঝরে পড়ল, উপন্যাসের চরিত্র অতীনের মতো ছাড়তে হয় দেশে, তেমনি বাংলাদেশে অনেক তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়ল যুদ্ধে, আবার নতুন করে আশ্রয়প্রার্থি জরো হতে লাগল ভারতের আশ্রয়শিবিরে। সেই যুদ্ধের আঁচ গিয়ে লাগবে পশ্চিমা দেশেও।
দেশভাগের ফলে কার কতটা লাভ হয় সে হিসেব এখন করাটা অর্থহীন একটা বিষয়। যারা দেশভাগের ব্যাপারে অগ্রগামী ছিল তারা দেশেভাগের সুফল বা কুফল কোনটাই বেশীদিন ভোগ করেনি। তবে এটা সত্য যে বাঙালিদের এর কুফল কিছুটা ভোগ করতেই হয়েছে। বাঙালি হিন্দুরা যেমন পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের কাছ থেকে পায়নি আন্তরিক ব্যবহার, তেমনি মুসলমানদের ভাগ্যেও জোটেনি পশ্চিম পাকিস্তানের বন্ধুসুলভ আচরণ, যার দরুন মুক্তিযুদ্ধের অবতারণা হয়।
ইতিহাস ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত প্রায় হাজার পৃষ্ঠার বইটি সুনীলের এক অমর সৃষ্টি। যেকোন বাঙালির এবং বিশেষ করে বাংলাদেশীদের নিজেদের রাজনীতির বেশ কিছু অজানা দিক এবং ইঙ্গিত জানতে বইটা অবশ্যই পড়া উচিত।
অসাধারণ একটি উপন্যাস পড়লাম বহুদিন পর। পড়ার পর আবারও বাঙালি হিসেবে গর্ব অনুভব করছি। রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্রিটিশদের দেশভাগ নামক যে জঘন্য চক্রান্ত কে সমর্থন করেছিলো তার পরিণাম বছরের পর বছর ধরে সহ্য করতে হয়েছে সাধারণ বাঙালিকে। তবুও বাঙালি হার মানেনি। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসে যেমন বাঙালিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে সেরকমই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসও মনে রাখবে তাদের অসমসাহসী বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের। স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ (বর্তমানে বাংলাদেশ) ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে যে ভীষণ কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তার এক জীবন্ত দলিল এই উপন্যাস। যেহেতু এটি একটি সমকালীন ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস তাই উপন্যাসের প্রয়োজনে বিভিন্ন কাল্পনিক চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বাস্তব চরিত্রও উপন্যাসে স্থান করে নিয়েছে। অবশ্য সুনীল বাবুর কলমের জাদুতে কাল্পনিক বা বাস্তব কোনো চরিত্রকে আলাদা করে বোঝা যায়না। সব চরিত্রই যেন দারুন বাস্তব। উপন্যাস প্রেমী সমস্ত মানুষের পড়া উচিত এই উপন্যাসটি।
A 986-page novel situated in Bengal (both halves) essentially narrating the lives of various families essentially originating in current day Bangladesh, their journey through the events of pre-independence Bengal, partition and post-partition, 1965 & 1971 war, upheavals in current day Bengal and Bangladesh right up to the early 1990’s. The writer has extensively researched the events in both Bengal and Bangladesh and also situated certain characters (Zahanara Imam, Rumi, Jami, Shariful Alam) in the novel which is from real life. The book,to me, apart from providing a storyline as expected from a novel, also provided another perspective on the recent history of both Bengals. This book is written in Bengali language and I would highly recommend this book to someone who can read Bengali and also has an interest about the history and culture of both Bengals.
দেশভাগের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসটির প্রথম খণ্ডটি অসাধারণ ছিল।কিন্তু এরপর থেকেই অকারণে বার বার যৌনতাকে টেনে নিয়ে এসেছেন সুনীল।তবে তিনি দেশভাগের ফলে মধ্যবিত্ত বাংগালরা যেই একটা টানাপোড়নের মধ্যে দিয়ে যায়,তার একটা নির্মম ছবি তুলে ধরেছিলেন।একদিকে জন্মভিটা হারানোর কষ্ট, অন্যদিকে কলকাতায় গিয়ে সেখানকার মানুষদের সাথে মানিয়ে নেওয়া,প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা ।অন্যদিকে ৭১ এ ওপাড় বাংলায় নকশাল,আবার এপাড় বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ এই সময়টাকেও লেখক তুলে ধরেছেন নিবিড়ভাবে। তবে কিছু প্রোপাগান্ডা ও ছিল এই উপন্যাসে। যা উপন্যাসটির মান কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
This book was a cool and new experience for me. Wasn`t really fond of the whole communist movement plot, felt it was quite boring. But the characters of this plot were engaging. As a bengali, the historical context of this book was emotionally binding with me. Really loved Sunil sir`s style of writing and his ideology rants via his characters. This book is a must read for my bengali mates out there. Also, Otin can be really annoying and likeable at the same time. HIs morality also can be questioned in certain cases.
সেই সময়, প্রথম আলো, পূর্ব পশ্চিম; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কালজয়ী ট্রিলজি।
পূর্ব পশ্চিমে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর থেকে ব্যক্তিজীবনে এর প্রভাবের বর্ণনা বেশি। এতে বাদ যায়নি সংস্কৃতিমনা উচ্চবিত্ত, বিধ্বস্ত অর্থনীতির ভার নেওয়া মধ্যবিত্ত থেকে রিফিউজি ও। মেধা পাচার বা নিরাপত্তার খাতিরে পশ্চিমে যাওয়া বাঙ্গালীদের খাপ খাওয়ানোর গল্প ও আছে এতে।
What a great novel! ফ্ল্যাপে লেখা লেখকের কথায় তো যেনো আমার কথা। বিশাল এই উপন্যাসে কতো চরিত্র, যা সারাজীবন মনে থাকার মতোন। কথোপকথন, লেখকের নিজস্ব ব্যাক্তিত্বময় চিন্তাভাবনা। ইতিহাস,যৌবন এর বিপ্লব, উন্মত্ততা, সাথে যেনো স্নেহ-ভালোবাসার ও কমতি নেই। কতো আনন্দ ও বিষাদ.. সবকিছুর রেশ থেকে যাবে অনেক দিন..
Personal favorite among Sunil's best trio. I read this more than 10 times probably. The incidents are based on a time before 20 years of my birth but still I could feel the characters. It's a classic from Sunil.