Jibanananda Das (bn: জীবনানন্দ দাশ) is probably the most popular Bengali poet. He is considered one of the precursors who introduced modernist poetry to Bengali Literature, at a period when it was influenced by Rabindranath Tagore's Romantic poetry. During the later half of the twentieth century, Jibanananda Das emerged as the most popular poet of modern Bengali literature. Popularity apart, Jibanananda Das had distinguished himself as an extraordinary poet presenting a paradigm hitherto unknown. It is a fact that his unfamiliar poetic diction, choice of words and thematic preferences took time to reach the heart of the readers. Towards the later half of the twentieth century the poetry of Jibanananda has become the defining essence of modernism in twentieth century Bengali poetry.
কোথায় ভোরের উত্তরের আকাশে সাতটি তারার উজ্জ্বলতা! আর কবি সাহেব নাম দিলেন সাতটি তারার তিমির। উজ্জ্বলতাকে পরিত্যাগ করে অন্ধকারে আশ্রয় নিলেন! একদমই উলটো। নামের সাথে জীবনযাত্রার ব্যাঙ্গাত্নক আচরণ কিংবা জীবনের সাথে মানুষের ধ্বংসাত্নক কাজের নজিরও এ ব্যাপারে কবিকে উৎসাহ দিয়ে থাকতে পারে। ভাবনার বিষয়।
কবিতার জন্ম ও গতি প্রকৃতি মূলত পারিপার্শ্বিক ঘটনা আর কবির মনের অবস্থার সাথে সমান্তরালে চলতে থাকে। যেহেতু তখন যুদ্ধ চলছিল, ফলে এই কাব্যগ্রন্থের বেশিরভাগ কবিতায় আছে ধ্বংসযজ্ঞের উল্লেখ; ভয়, উদ্বেগ আর মৃত্যুর কথা।
যার ফলে কবি এই বিরূপ অবস্থাকে সরাসরি অন্ধকারের সাথে তুলনা করেছেন -
"চোখের উপরে রাত্রি ঝরে; যে-দিকে তাকাই, কিছু নাই রাত্রি ছাড়া। "
পাশাপাশি কবি বাঁচার আশাও ব্যক্ত করেছেন তিমির হননের গান গেয়ে।
সাতটি তারার তিমির? তারার আবার তিমির হয় নাকি? জানি না। তবে আমি যত বাংলা কবিতার বইয়ের নাম জেনেছি, তারমধ্যে সবচেয়ে পছন্দের নাম সাতটি তারার তিমির। নামটা পড়তে বা শুনতে তো ভালো লাগেই, এরসাথে নামটার মধ্যে একটা দার্শনিক ব্যাপারও আছে; এটা যেন কোন সত্তার গভীরতার সাথে, রহস্যের সাথে, অজানার সাথে যোগস্থাপন করছে।
শুরুটা হয়েছিল সহজ, বিখ্যাত আকাশলীনা কবিতাটা দিয়ে। কুসুম কুসুম প্রেমের এই কবিতা কার না ভালোলাগে? সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি, বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে; ফিরে এসো সুরঞ্জনা: নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে
তারপরের কবিতা ঘোড়া। সেই মহীনের ঘোড়াগুলো! সবাই জানে 'মহীনের ঘোড়াগুলি' নামে একটা বিখ্যাত বাংলা গানের দল ছিল। যাদের গানগুলোর লিরিকও জীবনানন্দের কবিতার মত মায়াবী।
দিলাম দুটো লাইন ধরিয়ে, তারপর আপনি গুনগুন গাইতে থাকেন। ♪কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবুও♪
সমারূঢ় কবিতায় কোন রাখঢাক না রেখে কবি জানিয়ে দিলেন কবিদের যথার্থ মূল্যায়ন না হওয়ার ক্ষোভ। সাহিত্যের অধ্যাপক ক্লাসরুমে কবিতা নিয়ে লেকচার দিয়েই পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক পাচ্ছেন, আর সৃজনশীল কবি অস্বচ্ছলতায় দিনাতিপাত করছেন - এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতা মেনে নিতে পারেননি কবি।
তারপরের কিছু কবিতা মনে হল পূর্বে প্রকাশিত কবিতাগুলোর দুর্বল ছায়া। হেমন্ত, বিষন্নতা, ঘাস, হাঁস - যথারীতি সবকিছুর সাথেই দেখা হয়; কিন্তু একটু যেন একঘেয়েমি লাগে। তারপর শেষার্ধে কবিতাগুলো ধীরে ধীরে দুর্বোধ্য হতে লাগলো; সমুদ্রে যেমন মহীসোপানের পর মহীঢাল আসে, তেমন সাতটি তারার তিমিরের গভীরতা বেড়ে চলল, এরমধ্যে আমার চেতনা কখন নাই হয়ে গেছে, সেটা মনে করতে পারিনা। কবিতা বুঝতে না পারলে জোর করে বোঝার চেষ্টা করা আমার হয়ে ওঠে না, কবিতা তো ধাঁধার সমাধান বের করা নয়, যে বারবার পড়ে বা অন্য বইপত্র ঘেটে অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করবো। কবিতা দুর্বোধ্য হলে পাঠের আনন্দটা হারিয়ে যায়, এক লাইন পড়ার সময় আগের লাইনে কি পড়েছি মনে থাকে না, এক মিনিটে পাঁচ-সাতবার মনঃসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
যারা গভীর জলের মাছ(পাঠক), তারা হয়তো সাতটি তারার তিমির বুঝতে পারবেন।
ইতোপূর্বে প্রকাশিত ধূসর পাণ্ডুলিপি, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থগুলোতে মনে রেখাপাত করার মত বেশ কিছু কবিতা পেয়েছিলাম। এখানে তেমনটা পেলাম না। অল্প কিছু কবিতা বুঝতে পারলাম, উপভোগ করলাম আরও কিছু কম।
জীবনানন্দ দাশ মানুষটা যেমন অদ্ভুত তেমনি তার কবিতাগুলোও অদ্ভুত কিন্তু তবুও কি যেন একটা আছে তার কবিতায়...!এই বইয়ের বেশিরভাগ কবিতাই কঠিন ভাষায় লিখা,জীবনানন্দের জীবন সম্পর্কে ধারণা না থাকলে কবিতাগুলোর অর্থ বুঝা আরও দুরূহ ব্যাপার।মোট চল্লিশটি কবিতার মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে - লঘু মুহূর্ত আর জনান্তিকে কবিতা দুটো!
ফাল্গুন ১৩৬১ সনের 'উত্তরসূরি' পত্রিকায় সাতটি তারার তিমির কাব্যগ্রন্থের নিম্নোক্ত বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল: আধুনিক সভ্যতার সংশয়াচ্ছন্ন অন্ধকারও জীবনানন্দর ভাবমন্ডলে পরম জিজ্ঞাসায় ও বিচিত্র উদ্দীপনায় অঙ্গীভূত। ভিন্নতর স্বাদ ও আশ্চর্য ইঙ্গিতময়তায় 'সাতটি তারার তিমির' একখানি অসামান্য কাব্যগ্রন্থ || আড়াই টাকা ||
সাতটি তারার তিমির কিছুটা ভিন্নধর্মী, অনেকের মতে জীবনানন্দের স্বাভাববিরুদ্ধ একটি কাব্যগ্রন্থ। অশোক মিত্র যেমন বলেছেন, কবিতাগুলোর অর্থব্যাঞ্জনার সাথে সমন্বয়সাধন দুরূহ। প্রতীকে, শব্দযোজনায়, বাক্যপ্রয়োগে যে কোন অর্থের ব্যাপ্তি রয়েছে, তা কবির মোহিনী কুয়াশায় অথবা পাঠকের অস্বস্তিকর ধুম্রজালে আচ্ছন্ন। "পঙক্তির অব্যবধান সত্ত্বেও চিন্তা বহুবিচ্ছিন্ন, এমন কি কোথাও কোথাও বাক্যরচনাও দুর্বল। কী বলতে চাইলে, চিত্তের কোন্ বিভঙ্গের প্রতি বর্তমানে তাঁর পক্ষপাত, কোন প্রতীকিতার অনুজ্ঞা এখন তাঁর মান্য, এই সব প্রশ্ন অন্ধ আক্ষেপে মাথা খুঁড়ে মরে।"
কাব্যগ্রন্থের নামে 'তারা' শব্দটির সাথে জীবনানন্দের জীবন-বোধ জড়িত এবং 'তিমির' শব্দটি তুলে আনে মানবজীবনের অন্ধকার। 'সাতটি তারা' স্পষ্টতই আমাদের মনে নিয়ে আসে সপ্তর্ষিমন্ডলের ভাবানুষঙ্গ, যে সপ্তর্ষি ধ্রুবতারার সাথে মিলে মানুষের চিরকালের পথনির্দেশক হয়ে আসছে, তার আলোক তো দিশাহীনতার দ্যোতক না! তবু কেন প্রতীকী ইঙ্গিতময়তায় পুরো গ্রন্থজুড়ে 'অন্ধকার'ই প্রধান? প্রেক্ষাপট বিচারে তপোধীর ভট্টাচার্যের বক্তব্যে পরিষ্কার হয়: 'সাতটি তারার তিমির'-এর বিভিন্ন কবিতায় জীবনানন্দ যে সংকেতদীপ্ত পরাভাষার অবয়ব গড়ে তুলেছেন, পরাবাস্তববাদের নান্দনিক দর্শন তাকে বুঝতে সাহায্য করে- এই নয় শুধু; দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী রুগ্ন ও আধমরা প্রতীচ্যের সমাজকে যেমন ঘা-মেরে বাঁচাতে চেয়েছিল ঐ বৈপ্লবিক ভাবনা-প্রস্থান, তেমনি বাংলার কবিও নিদানির ঘোরে আচ্ছন্ন এবং অভ্যাসের শেকলে পাকে-পাকে জড়ানো ঔপনিবেশিক সমাজের অন্তেবাসীদের নতুনভাবে নির্ণিত ভাবনা-প্রতিভার ইশারায় জাগাতে চেয়েছিলেব। ['সাতটি তারার তিমির : নতুন পাঠের প্রস্তাবনা']
কাব্যগ্রন্থের নামকরণের গভীরতা উপলব্ধ হয় এখানেই। কবি এখানে সাতটি তারার তিমিরময়তার প্রতীকে জানাতে চেয়েছেন সেসব রীতি, নির্দেশ আর মূল্যবোধের অর্থহীনতার কিথা যা এতকাল মানুষকে তার সভ্যতা থেকে নবসভ্যতায় উত্তরণের যাত্রায় পথ দেখিয়েছে। জীবনানন্দের কাব্যের চিরাচরিত 'অন্ধকার' যেন এই কাব্যগ্রন্থে একটু বেশিই হৃদয়গ্রাহ্য, তার জন্য 'সাতটি তারা'র অবতারণা উপযুক্তই বটে!
আমি “সাতটি তারার তিমির” পড়েছিলাম ১৯৯৮ সালে, যখন পৃথিবীটা একটু বেশিই অস্থির লাগত, আর জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতোই—সবকিছু যেন স্বপ্ন ও বাস্তবের মাঝামাঝি ঝুলে ছিল। সেই প্রথম পাঠের পর থেকে আজও এই বইটি আমার মনে ঠিক যেন কোনো নক্ষত্রপতনের স্মৃতি রেখে গেছে।
"সাতটি তারার তিমির?"
তারা তো জ্বলে, তিমির তো অন্ধকার। দুটো পাশাপাশি কীভাবে? আমি যত বাংলা কাব্যগ্রন্থের নাম শুনেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে প্যাথেটিক্যালি পছন্দের নাম এইটাই। নামটার মধ্যে অদ্ভুত এক পরাবাস্তব আকর্ষণ, যেন কোনো গভীর, দার্শনিক শূন্যতার দিকে টেনে নিয়ে যায়। এটা শুধুমাত্র নাম নয়—একটা আলগা নিঃশ্বাস, এক রাতের দীর্ঘশ্বাস, এক সভ্যতার অনিশ্চয়তাজনিত চিৎকার।
এই কাব্যগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৪৮ সালে। এর রচনাকাল, প্রকাশকাল এবং প্রেক্ষাপট গুরুত্বপূর্ণ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি, নগর জীবনের ক্লান্তি, অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা—সব মিলে এক গভীর বিপন্ন বিস্ময়ের জন্ম। যুদ্ধ, মৃত্যু, স্মৃতি, বিভ্রান্তি, নাগরিক একাকীত্ব—এই কাব্যের মূল সুর।
শুরুটা হয় “আকাশলীনা” কবিতায়—যেখানে প্রেম, নিষেধ, আকাঙ্ক্ষা আর হারানোর আশঙ্কা মিলে এক শ্বাসরুদ্ধকর গীতিকবিতার জন্ম দেয়।
সুরঞ্জনা, ওইখানে যেও নাকো তুমি, বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
আকাশলীনা—এই কবিতাটি দিয়ে শুরু। জীবনানন্দের একটি শ্রেষ্ঠ প্রেমনির্ভর কবিতা, যেখানে প্রেমও নিঃসঙ্গ, এবং রাত্রি জ্বলছে নক্ষত্রের রূপালি আগুনে। কিন্তু সুরঞ্জনাকে তিনি ঠেকান, কারণ সেই যুবকের প্রেম ‘ঘাস হয়ে আসে’। প্রেম এখানে বিপদের মত, অথবা বিপদ প্রেমের ছদ্মবেশে। কুসুম কুসুম প্রেমের মোড়কে অদ্ভুত এক তন্দ্রা।
'ঘোড়া' আর মহীনের ঘোড়াগুলি
পরের কবিতা "ঘোড়া", শুনেই চোখে পড়ে যায় সেই নাম—মহীনের ঘোড়াগুলি। জীবনানন্দের ঘোড়ারা যেভাবে বাংলা কবিতার গহন রাত পেরিয়ে ছুটেছিল, পরে সেসবই তো গিয়ে গান হয়ে গিয়েছে, মঞ্চ হয়ে গেছে। জোছনায় কাশবনে ছুটে যাওয়ার যে longing, তার শিকড়ও এই জীবনানন্দে।
সমারূঢ়: কবির ক্ষোভ
"সমারূঢ়" কবিতায় জীবনানন্দ একেবারে no filter মোডে চলে যান। লেকচার দিচ্ছে ছায়াপিণ্ড (একজন অধ্যাপক), আর কবি শান্ত স্বরে বলছেন—“তুমি নিজেই লেখো না একটি কবিতা।” এই তির্যকতা আজও মজার, এবং খুব বাস্তব। শিল্পচর্চা ও শিল্প-ব্যবসার সংঘাত এখানেই, কবি এখানে ক্লাসিক underdog।
কবিতা... কঠিন হয়ে আসে
কিন্তু এরপর? পরের পর কবিতাগুলো যেন দুর্বোধ্যতার হিমঘরে বন্দি। "হেমন্ত", "ঘাস", "হাঁস"—সবই জীবনানন্দের চিরপরিচিত এলিমেন্ট, কিন্তু একটু যেন হাল্কা, বর্ণনাশক্তিতে ঝিম ধরা। তারপর ক্রমশ শুরু হয় ধোঁয়ার মতো কঠিন কবিতা, বাক্য আর ভাবনায় ফাঁক পড়ে যায়। আমি এক লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি, পরের লাইনে পৌঁছাতে গিয়ে হোঁচট খাই। পাঠ বিভ্রান্ত হয়, মন বিচ্যুত।
কেউ কেউ বলে, কবিতা বুঝতে না পারলে পড়ে যেতে হয় বারবার। আমি বলি, কবিতা তো প্রেম—একবারেই মন বোঝা উচিত। বেশি বোঝাতে গেলে সেই প্রেমেও দম আটকে যায়।
গভীর পাঠের প্রয়োজন: কিন্তু সবার জন্য নয়?
তাই বলি, এই কাব্যগ্রন্থের জন্য পাঠককেও হতে হবে গভীর জলের মাছ। যারা জলজ অন্ধকারে সাঁতরে যেতে পারেন, তারাই বুঝবেন এই তিমিরের তারাদের ভাষা।
যদিও ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’—এগুলিতে জীবনানন্দের ভাষা কঠিন হলেও, অনেক কবিতায় স্পষ্ট হৃদয়ের ভাষা ছিল। কিন্তু ‘সাতটি তারার তিমির’-এ যেন ইচ্ছাকৃতভাবে আরও কুয়াশা জড়ানো।
সময় ও সমাজের পটভূমি
১৯৪৮—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাঁপুনি তখনও থেমে যায়নি। যুদ্ধ, পরাধীনতা, বিভাজন, অভিশাপ সব মিলিয়ে সমাজের মুখ থমথমে। সেই প্রতিফলন আছে এই কবিতাগুলোর শব্দচয়নে—“প্লেন”, “এয়ারড্রোম”, “বোমা”, “নগর”, “সাহসিক বন্দরে”—এগুলি জীবনানন্দের পূর্বতন কবিতাগুলোর থেকে ভিন্ন এক শব্দজগত।
সাহিত্য তো সমাজের প্রতিচ্ছবি—জীবনানন্দ এখানে শুধু শব্দে নয়, প্রতীকে প্রতীকে এক অন্তসত্ত্বা সমাজের গৃহযুদ্ধ তুলে ধরেছেন।
‘তারা’ ও ‘তিমির’: এক প্রতীক-সংঘর্ষ
সপ্তর্ষি মানে দিকনির্দেশক তারা। তারা তো পথ দেখায়, তবু এই বইয়ে তারা অন্ধকারে ঢুকে পড়েছে। কেন? কারণ সেই নির্দেশনাগুলো ব্যর্থ হয়েছে—মানুষ যে সভ্যতা গড়েছে, তা আর মানুষকে বাঁচাতে পারছে না। ‘তিমির’ প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় পুরোনো পথের নিঃশেষতার, সভ্যতার বিপন্নতার।
তপোধীর ভট্টাচার্য সঠিকই বলেছিলেন—এই গ্রন্থ পাঠে পরাবাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি। এটা শুধু কবিতার বই নয়, সভ্যতার বিচারসভা।
অস্পষ্টতা: বাধা না বার্তা?
অশোক মিত্র বলেছিলেন, কবিতাগুলোর চিন্তা বহুবিচ্ছিন্ন, বাক্যরচনা দুর্বল, পাঠক অস্বস্তিতে পড়ে যান। আমি একদম দ্বিমত করবো না, কিন্তু এটাও বলবো—জীবনানন্দ এখানে হয়তো আমাদের পড়ার অভ্যাসটাকেই চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছেন।
এমনকি ‘সাতটি তারার তিমির’-এর প্রচার বিজ্ঞাপনেও ছিল—
“আধুনিক সভ্যতার সংশয়াচ্ছন্ন অন্ধকারও জীবনানন্দর ভাবমণ্ডলে পরম জিজ্ঞাসায় ও বিচিত্র উদ্দীপনায় অঙ্গীভূত।” এই যে ‘পরম জিজ্ঞাসা’—এটাই তো পাঠকের পরীক্ষা।
অনেক পাঠকের কাছে এই কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতাই দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। কিছু কবিতার ভাষা ও প্রতীক এতটাই বিমূর্ত যে পাঠকের মন ছুঁয়ে যাওয়ার আগেই হারিয়ে যায় অর্থের ধোঁয়ায়। কবি হয়তো চেয়েছেন পাঠক যেন ডুব দেন তাঁর কল্পনার অতল জলে, কিন্তু সকলের পক্ষে সে ডুব সইবার নয়। আমি নিজেও প্রথম পাঠে কিছু অংশে সেই “মনঃসংযোগ বিচ্যুতি”-র অভিজ্ঞতা পেয়েছি। তবে প্রতিটি কবিতার আবহ, ভাষা ও ভাবগম্ভীরতা এমন, যা পাঠককে ভোলাতে পারে না সহজে।
এই কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে সুর মেলায় যে সব ইংরেজি কবিতা:
জীবনানন্দের সাতটি তারার তিমির-এ যেসব থিম বারবার ফিরে আসে—নগরজীবনের বিচ্ছিন্নতা, মৃত্যুর অস্তিত্ববাদী উপলব্ধি, সময় ও স্মৃতির দোলাচল, প্রাকৃতিক উপমায় মৃত্যুবোধ, এবং অন্তর্মুখীন কবিসত্তা—এসবই আমাদের নিয়ে যায় ইংরেজি সাহিত্যের আধুনিকতাবাদী কিছু মহাকবিতার দিকে। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য কবিতার তালিকা:
Time, Memory, and Mortality
“The Love Song of J. Alfred Prufrock” – T.S. Eliot"I have measured out my life with coffee spoons..."
“Because I could not stop for Death” – Emily DickinsonA gentle, surreal ride with Death personified.
“Do Not Go Gentle into That Good Night” – Dylan ThomasRage, rage against the dying of the light—এই কবিতা জীবনানন্দের মৃত্যুচিন্তার এক ঝাঁঝালো প্রতিবাদী প্রতিধ্বনি।
“An Irish Airman Foresees His Death” – W.B. Yeatsমৃত্যুর প্রতি উদাসীনতা আর ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ।
“Nothing Gold Can Stay” – Robert Frostক্ষণস্থায়ী সৌন্দর্য ও সময়ের অবশ্যম্ভাবী ক্ষয়।
“One Art” – Elizabeth Bishopক্ষয়, বিচ্যুতি ও হারানোর “শিল্প”।
“I Am” – John Clareমানসিক সংকটে আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান।
“A Postcard from Kashmir” – Agha Shahid Aliস্মৃতি ও স্বদেশের প্রতি কাব্যিক বিষণ্নতা।
উপসংহার:
সাতটি তারার তিমির কেবল একটি কাব্যগ্রন্থ নয়, এটি একটি অস্তিত্ববাদী ডায়েরি। এই বইয়ের প্রতিটি কবিতা যেন নিঃসঙ্গ রাতের অলস অথচ ব্যথাতুর পাণ্ডুলিপি। যুদ্ধ, মৃত্যুচিন্তা, সময়ের অভিঘাত, এবং গভীর বোধ ও ভাবনার অন্বেষণ—এসব নিয়ে জীবনানন্দ আমাদের দাঁড় করান এমন এক দরজার সামনে, যা আমরা প্রতিদিন দেখি, অথচ সেদিকে তাকানোর সাহস পাই না।
১৯৯৮ সালে আমি এই বইটি পড়েছিলাম, তখন আমি এই বিষণ্ন তিমির-আলোয় দাঁড়িয়ে শুধু পড়িনি, নিজের ভেতরেও এক আলো-অন্ধকার খুঁজে পেয়েছিলাম। আজ, এতদিন পর, আবার ফিরে তাকিয়ে বুঝি—এই বই বুঝি কেবল “তিমির” নয়, এ এক তারাভরা রাত, যেখানে তারারা হঠাৎ নিভে যায়… আবার জ্বলে ওঠে, মন চাইলে, স্মৃতি চাইলে।
সাতটি তারার তিমির কবি জীবনানন্দ দাশের লেখা পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে (১৩৫৫ বঙ্গাব্দ) কলকাতা থেকে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এই কাব্যগ্রন্থের বিরুদ্ধে দুবোর্ধ্যতার অভিযোগ ওঠে। কেন এই অভিযোগ তার উত্তর খুঁজতে গেলে কাব্যগ্রন্থের সুধা মন্থনে নামতে হবে। বুঝতে হবে এই কাব্যগ্রন্থ যখন লেখা হয় তখন দ্বিতীয় মহাজুদ্ধ শুরু হচ্ছে বা চলছে। কবিতায় রয়েছে যুদ্ধের অনেক উপাদান যেমন এরোপ্লেন, এয়ারড্রোম এর মত শব্দ। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা বেঁচে থাকা না থাকার কথা। কবি ভীষণ চিন্তিত তার মনে শঙ্কা জাগে তার সমাজ তার স্বপ্ন প্রকাশের বাধা সব কিছু হয়ে পড়ে ভীষণ অনিশ্চিত। কোনা এক বিপদের গভীর বিস্ময় আমাদের ডাকে। পিছে পিছে ঢের লোক আসে। আমরা সবের সাথে ভিড়ে চাপা প'ড়ে--তবু-- বেঁচে নিতে গিয়ে জেনে বা না জেনে ঢের জনতাকে পিষে--ভিড় ক'রে করুণার ছোট-বড় উপকন্ঠে--সাহসিক নগরে বন্দরে সর্বদাই কোনো এক সমুদ্রের দিকে সাগরের প্রায়াণে চলেছি। যে সময় চলে গেছে সে সময় নিয়েও কবি চিন্তিত সেখানে আরো কত কিছু করা যেত সেসব ভাবনার মধ্যে আসে কবির কিশোর কাল। পুরনো সময় সুর ঢের কেটে গেল। যদি বলা যেত: সমুদ্রের পারে কেটে গেছে সোনার বলের মতো সুর্য ছিল পুবের আকাশে– সেই পটভূমিকায় ঢের ফেনশীর্ষ ঢেউ, উড়ন্ত ফেনার মতো অগণন পাখি। রোদের ভিতরে ঘাসে শুয়ে; পুকুরের জল থেকে কিশোরের মতো তৃপ্ত হাতে ঠান্ডা পানিফল, জল ছিড়ে নিতে গিয়ে; চোখের পলকে তবু যুবকের মতো মৃগনাভিঘন বড় নগরে পথে কোনো এক সুর্যের জগতে চোখের নিমেষ পড়েছিল। তারপর আকাশে সব নিয়ম ভেঙ্গে দিয়ে ঈর্ষার ছায়া জেগে ওঠে। কবি মনে তোল পাড়। অস্তিত্ত্ব প্রশ্নের সম্মুখে পৃথিবী, তখন কবির মানস পটে পুরো পৃথিবী সমান উত্তর। এ ছাড়া দিনের কোনো সুর নেই; বসন্তের অন্য সাড়া নেই। প্লেন আছে; অগণন প্লেন অগণ্য এয়োরোড্রাম রয়ে গেছে চারি দিকে উঁচুনিচু অন্তহীন নীড়– হলেও বা হয়ে যেত পাখির মতন কাকলি আনন্দে মুখর;