বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেকদিন পর দেখা হয়ে যায় পুরনো বন্ধুদের, দুই বন্ধু--নৃতাত্ত্বিক মারুফ এবং পত্রিকার ফিচার এডিটর রুমি কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে তাদেরই আরেক বন্ধু পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে ভেন্ট্রিলোকুইজম। কৌতুহলী হয়ে সেটার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ওরা জড়িয়ে পড়ে দারুণ রহস্যময় এক অনুসন্ধানে, বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর আর শিউরে ওঠার মত সব সত্য, সাধারণ মানুষকে কখনই জানতে দেয়া হয় না এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক সম্প্রদায়ের কথা, যার পদে পদে ওদের জন্য ওৎ পেতে আছে মৃত্যু, বিপদ, জড়িয়ে আছে ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষের জীবন। "ভেন্ট্রিলোকুইস্ট" শুধু একটি উপন্যাসই নয়, পাঠকদের জন্য ইতিহাস, স্থাপত্য, গণিত, ধর্মতত্ত্ব আর বিজ্ঞানের এক অভূতপূর্ব যাত্রা।
মাশুদুল হকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। এক দশকের বেশি সময় ধরে লিখছেন থ্রিলার, সায়েন্সফিকশন ও শিশু-কিশোর সাহিত্য, প্রকাশিত হয়েছে নিয়মিত ভাবে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে।
সাহিত্য-পুরস্কার : এইচএসবিসি-কালিওকলম তরুণ কথাসাহিত্যিক পুরস্কার ২০১৩।
Masudul Haque is a contemporary writer from Bangladesh known for his works on thrillers, Sci-Fi, and children's literature. His works have been published in Bangladesh and India regularly for the last 12 years. He was awarded the Kali O Kalam Young Writer Award in 2013.
এক বিয়েবাড়িতে গিয়ে দুই বন্ধু, অধ্যাপক এবং কাহিনির ন্যারেটর মারুফ, ও সাংবাদিক রুমি, তাদের বন্ধু হাসানের কাছে জানতে পারে যে তাদের এক সহপাঠী শওকত, যে একসময় বাকশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছিল, আজ ভেন্ট্রিলোকুইস্ট। কৌতূহলী হয়ে তারা শওকতের সঙ্গে দেখা করে। কিন্তু শওকতের কথাবার্তার মধ্যে এমন কিছু অস্বাভাবিক জিনিস ছিল, যা দুই বন্ধুকে ভাবিয়ে তোলে। অতঃপর শুরু হয় তাদের তদন্ত, যা একে-একে মনস্তত্ত্ব, প্রেতচর্চা, আধুনিক স্থাপত্যের খুঁটিনাটি, বাহাই ধর্মের ইতিহাস, গণিতবিদ্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তাক্ত এবং লুকিয়ে ফেলা কিছু অধ্যায় হয়ে, সাসপেন্স এবং অ্যাকশনের অসামান্য মিশেল দিয়ে, শেষে কাহিনির চরিত্রদের ব্যক্তিগত জীবনের কয়েকটা গোপন অধ্যায়ে মিশে গিয়ে সমাপ্ত হয়। নাকি হয় না? বহু-প্রশংসিত এই উপন্যাসটি পড়ে আমার দুটো কথাই বলার আছেঃ (১) বাংলায় এমন বহুমাত্রিক থ্রিলার যে লেখা যায়, সেটাই আমাদের জানা ছিল না, এবং পড়ার পরেও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। মাশুদুল হক বাংলা ভাষার সম্পদ, এবং জীবদ্দশাতেই তাঁর মস্তিষ্কের সংরক্ষণের ব্যবস্থা হওয়া উচিৎ। (২) ভাষায় কিছু আড়ষ্টতা দেখে আমার মনে হয়েছে যে বিষয়গত জটিলতা এবং ঘনত্বের জন্যেই হয়তো লেখক তাঁর ন্যারেটিভ আগে ইংরেজিতে ভেবেছেন, এবং তারপর সেটি বাংলায় লিখেছেন। কিন্তু লেখাটা ১০০% মৌলিক, এবং যেখানে এটা থেমেছে, সেখানে পাঠকের অবস্থা হয়েছে সেই লোকটির মতো যে সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে পা বাড়িয়েছে বটে, কিন্তু তার পর সমতল আছে, না কি আছে উঁচু বা নিচু ধাপ, সেটা যার জানা নেই।
রকমারি.কম-কে গুচ্ছ পোস্টেজ দিয়ে বইটা হাতে পেয়েছিলাম, কিন্তু পড়ার পর মনে হল সব উশুল হয়ে গেছে। বইটা অবশ্যপাঠ্য, এটাই বলার।
বিদেশী কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে বাংলাভাষায় তথা বাংলাদেশে প্রচুর থ্রিলার লেখা হয়েছে; অনেক থ্রিলারই বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। যদিও সেসব নিয়ে বিতর্ক চালু রয়েছে পাঠক ও সমালোচকদের মধ্যে। অনেক সমালোচকই ধারণা করেছেন যে, বিদেশী সফল থ্রিলারগুলোর মতো সফল থ্রিলার বাংলা ভাষায় লেখার জন্য যে অভিজ্ঞতা প্রয়োজন তা বাংলাভাষী লেখকদের নেই। বক্তব্যটি আংশিক সত্য হলেও থ্রিলার উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে তা বাধা হয়ে দাঁড়াবার কথা নয়। কারণ সব ধরনের থ্রিলার লেখার জন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পড়াশুনা ও গবেষণার মাধ্যমে অভিজ্ঞতার ঘাটতি পেছনে ফেলে দেয়া যায়। মাশুদুল হক এমন এক বিষয় নিয়ে তাঁর উপন্যাসের প্লট সাজিয়েছেন যা সম্পর্কে বইপত্র এবং বিশেষ করে ইন্টারনেট থেকে বিস্তৃত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। ধারণা করি, তাঁর থ্রিলারে ব্যবহৃত সকল তথ্য তিনি বইপত্র ও অন্তর্জাল থেকেই সংগ্রহ করেছেন এবং অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তাঁর প্লটে ব্যবহার করেছেন।
আলোচনা করছি মাশুদুল হক’এর থ্রিলার উপন্যাস “ভেন্ট্রিলোকুইস্ট” নিয়ে। শিরোনাম দেখে হয়তো মনে হবে বইটি ভেন্ট্রিলোকুইজমের উপরে ভিত্তি করে লেখা, যদিও তা পুরোপুরি সত্য নয়। হ্যাঁ, গল্পে একজন ভেন্ট্রিলোকুইস্ট আছে যেটি অন্যতম প্রধান একটি চরিত্র, কিন্তু তা-ই সব নয়। ভেন্ট্রিলোকুইজম দিয়ে রহস্যের সূচনা হলেও ঘটনার ডালপালা নানাদিকে গজিয়েছে।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র চারটি- নৃতাত্ত্বিক মারুফ, দৈনিক পত্রিকার ফিচার লেখক রুমী, ভেন্ট্রিলোকুইস্ট শওকত এবং মনো-গবেষক ডাঃ রুশদী। আরো দুইটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হাসান এবং মিলি। পুরো উপন্যাস বর্ণিত হয়েছে প্রথম পুরুষে, মারুফের জবানিতে। থ্রিলার সাধারণত তৃতীয় পুরুষে লেখা হয়, রহস্য বজায় রাখার স্বার্থে। কিন্তু মাশুদুল হক প্রথম পুরুষে গল্প বলার সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু রহস্যের খাতিরে, মারুফ চরিত্রটিকে বেশিরভাগ সময়েই অন্ধকারের রাখতে বাধ্য হয়েছেন লেখক। মারুফকে প্রায় পুরোটা সময়ই তাঁর বন্ধু রুমীর ছায়ার নিচে কাটাতে হয়েছে। গল্পের প্লটে একজন নৃতাত্ত্বিকের চমক দেখাবার জায়গা থাকলেও পুরোটা সময় চমক দেখিয়ে গেছেন পত্রিকার ফিচার লেখক রুমী। মাশুদুল হক কেন এই সিদ্ধান্তটি নিলেন তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। রুমী এই থ্রিলারের সবজান্তা। সে ধর্ম, বিজ্ঞান, গণিত-সব কিছুই জানে। সে মডার্ন আর্কিটেকচার দেখে বলতে পারে এটা কোন ধরনের মন্দির এবং সেখানে প্রবেশের জন্য যে পাসওয়ার্ড দরকার তাও নিমিষে বের করে ফেলে! রুমী গন্ধ ধুঁকেই অজ্ঞান-কারী গ্যাসের নাম জেনে ফেলে, বিশেষ ধরনের বাক্স দেখে এক ব্যান্ডদলের নামের উৎপত্তির কথা মনে পড়ে এবং তা থেকে ডাঃ রুশদীর প্রতিহিংসার কারণ জেনে ফেলে। অথচ নৃতাত্ত্বিক হিশেবে মারুফ এখানে লিড নিতে পারত। সম্ভবত প্রথম পুরুষে বর্ণিত হবার কারণেই মারুফ চরিত্রটিকে লেখক বেশিরভাগ সময় সম্যক পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞ রেখেছেন। যে কারণে রুমী ‘ভেন্ট্রিলোকুইস্ট’ উপন্যাসের নায়ক চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা মারুফ হলেও হতে পারত। আমার মতে, চরিত্র নির্মাণে আরেকটু সময় নিতে পারতেন লেখক (তবে যা দাঁড়িয়েছে তাও বেশ ভালো)। কারণ থ্রিলার উপন্যাসের চরিত্রের ছোটখাটো দিকও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ বাঁকের উপাদান হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে থ্রিলার লেখার প্রচেষ্টা চালালেও লেখক তাঁর প্লটে আন্তর্জাতিক প্রভাবের বিষয়টি মিশিয়ে দিয়েছেন। এটি থ্রিলার উপন্যাস রচনার একটি কৌশল- অনেকখানি আঞ্চলিকতার সাথে একটুখানি আন্তর্জাতিকতা এবং প্রিয়জনের প্রাণ বাঁচানোর আকুতি। থ্রিলারের প্লট দেখে আন্দাজ করা যায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে লেখকের আগ্রহ এবং পড়াশুনা। লেখক মেডিকেলে পড়েছেন বলেই হয়ত গল্পে মানসিক রোগ, শারীরবিদ্যা, এনথ্রোপলোজি ইত্যাদি বিষয় অনায়াসে ঢুকে পড়েছে। ভিলেন চরিত্রেও রেখেছেন একজন ডাক্তারকে। আবার লেখক মাশুদুল হক একই সাথে পত্রিকায় ফিচার লেখকের কাজও করেছেন। ধারণা করি, উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রুমী, তাঁর সেই কাজের অভিজ্ঞতার নির্যাস থেকে নির্মিত।
“ভেন্ট্রিলোকুইস্ট” লেখকের প্রথম থ্রিলার। তাই তাঁর ওপর কোনো না কোনো লেখকের প্রভাব থাকবেই। আমার মনে হয়েছে, মাশুদুল হক থ্রিলার রচয়িতা ড্যান ব্রাউন দ্বারা বেশ খানিকটা প্রভাবিত। অন্যান্য লেখকের প্রভাবও থাকতে পারে, তবে তাঁর উপন্যাসে ব্রাউনের রচনা-কৌশল উপস্থিত। ব্রাউনের মতোই ধর্ম, বিজ্ঞান, গণিত, স্থাপত্য ইত্যাদি মিশিয়ে রহস্য নির্মাণের চেষ্টা করেছেন তিনি। গল্প বলার কৌশলেও ব্রাউনের ছাপ কিছুটা চোখে পড়েছে। যেমন- ড্যান ব্রাউন তাঁর ‘রবার্ট ল্যাংডন সিরিজে’ প্রায়ই গল্পের কোনো এক পরিস্থিতির সাথে খাপ খায় এমন মুহূর্ত-গুলোয় অতীতে ল্যাংডনের ক্লাসরুমে ফিরিয়ে নিয়ে যান এবং প্রয়োজনীয় তথ্যের যোগান দেয়ার জন্য ছাত্রদের সাথে কথোপকথনের কৌশল ব্যবহার করেছেন। মাশুদুল হক “ভেন্ট্রিলোকুইস্ট”এ এই কৌশলটি ব্যবহার করেছেন। তিনি এমনকি ব্রাউনের ‘দ্য লস্ট সিম্বল’ এ উল্লেখিত আত্মার ওজন পরীক্ষার মতো বিষয়ও নিয়ে এসেছেন আলোচ্য গ্রন্থে।
নামকরণের চাতুর্য্য আমাকে আনন্দিত করেছেন। এই উপন্যাসটি পেশায় ভেন্ট্রিলোকুইস্ট শওকতকে ঘিরে শুরু হলেও পরে বোঝা যায় যে, সে ডাঃ রুশদীর পুতুল মাত্র, সুতোটা তিনিই নিয়ন্ত্রণ করছেন; তিনিই সমস্ত কর্মের উৎস। সেদিক দিয়ে ভাবলে, বৃহ��� প্রেক্ষাপটে উপন্যাসের প্রকৃত ভেন্ট্রিলোকুইস্ট ডাঃ রুশদী। থ্রিলারের নামকরণ একেবারে যথার্থ হয়েছে।
নানান সীমাবদ্ধতা এবং বিদেশী লেখকের সামান্য প্রভাব সত্ত্বেও “ভেন্ট্রিলোকুইস্ট” থ্রিলার হিশেবে দারুণভাবে উৎরে গেছে। লেখক তাঁর গল্পে বিভিন্ন টুইস্ট বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। সবচেয়ে বড়ো বিষয় হলো- থ্রিলার উপন্যাসে যে টানটান ভাষার উপস্থিতি অপরিহার্য তা এই উপন্যাসে বেশ ভালোভাবেই বিদ্যমান। মাশুদুল নবীন লেখক হিশেবে যেটুকু পেরেছেন তা আমাদের উপহার দিয়েছেন। ভবিষ্যতে তাঁর কাছ থেকে আরো জমাট এবং পরিপক্ব থ্রিলার আশা করাই যেতে পারে।
প্রত্যাশার চেয়ে ভাল। যেসব ফ্যাক্টের উপর ভিত্তি করে লেখা, সেগুলো আমরা অনেকেই জানি, কিন্তু সেগুলোকে এক সুতোয় গেঁথে একটা ভাল রহস্য উপন্যাস বানাতে যথেষ্ট দক্ষতা লাগে। মিনি সাইজের গল্প না, আস্ত উপন্যাস, যেখানে গল্পকে টেনে লম্বা করা হয়নি, বরং গল্পের খাতিরেই গল্প এগিয়েছে। শেষদিকের ব্যাখ্যাগুলোও মন্দ না। তবে শেষ এক তৃতীয়াংশ বেশ তাড়াহুড়ো করে লেখা, আরেকটু গুছিয়ে বড় করা যেত। যেহেতু থ্রিলার, উদ্ধারপর্বটা বড় বেশি সহজ হয়ে গিয়েছে, এত সহজে এরকম ঘাপলা থেকে বের হওয়া যায় না। মিলি বা জেরিন যেন প্রায় হাওয়া থেকে আগত, তার অরিজিনটা অনেকটা জোর করে বসানো, এবং খুবই টিপিক্যাল। আর বাক্যবিন্যাস বা লেখার ধরণ অনেক জায়গাতেই বেশ অ্যামেচারিশ, যেটা ভাল একটা এডিটর প্যানেল থাকলে খুব সহজেই ঠিক করে ফেলা যেত। বেশ অনেকগুলো ছাপার ভুল আছে, কিন্তু সেটার দায় লেখকের না। সব মিলিয়ে সাড়ে তিন দেব পাঁচ-এর মাঝে, এবং পরের বই 'মিনিমালিস্ট'-ও অর্ডার করে দেব। বাংলাতে ভাল মৌলিক থ্রিলার লেখা হচ্ছে এটাই সবচেয়ে আনন্দের কথা।
প্রকৃত রেটিং ৩.৭৫ হঠাৎ পুরনো এক বন্ধু শওকত এর ভেন্ট্রিকুইলিজম এর মত একটা পেশা বেছে নেওয়ার খবরে বেশ আগ্রহী হয়েই তার সাথে দেখা করতে যায় রুমি ও মারুফ। কিন্তু বন্ধুর সাথে দেখা করে রীতিমত তার পুরনো ক্ষোভ এর মুখে পড়তে হয়। আর সেই সাথে তারা জানতে পারে এমন কিছু তথ্য যা তাদের নাড়িয়ে রেখে দেয়। কলেজ লাইফেরই পুরনো ক্লাসমেট রুনুর জীবন বাঁচাতে দুজন জড়িয়ে পড়ে অদ্ভুত এক খেলায়, যার সাথে জড়িত আছে প্রাচীন কোনো ইতিহাস, ধর্মীয় বিশ্বাস, ক্রিপ্টোলজি আরোও অনেক কিছু।
মাশুদুল হক এর লেখা এই প্রথম পড়া। সত্যি বলতে খুব যে সুখপাঠ্য লেগেছে তা নয়। লেখনীর মধ্যেও এমন কিছু ছিল না যে পাঠককে আকৃষ্ট করবে। তবে কাহিনী দুর্দান্ত আর এত বেশি ইনফরমেশন এ ভরপুর যে জানার আগ্রহেই পড়া চালিয়ে যাওয়া যায়। বইয়ে মুলত যেই ব্যাপারগুলো উঠে এসেছে যেমন ভেন্ট্রিকুইলিজম, বাহাইজম, বাব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প ইত্যাদির উপর যথেষ্ট সুন্দর ব্যাখ্যা আর ধারণা দেওয়া থাকায় যথেষ্ট উপভোগ্য মনে হয়েছে আমার কাছে। তবে সত্যি বলতে প্লট এর ধরনে আমি কোথাও যেন ড্যান ব্রাউন এর রেশ পাচ্ছিলাম। এছাড়াও বেশ কিছু জায়গায় খুব নড়বড়ে যুক্তি দিয়ে কাহিনী সাজিয়ে গেছেন স্বীকার করতেই হয়। গল্প মেলাতে কাকতালীয় ঘটনাও একটু বেশিই ঘটিয়ে ফেলেছেন।
তবে ওভারঅল লেখককে বেশ প্রমিসিং মনে হয়েছে। মিনিমালিস্ট পড়ে ফেলতে হবে খুব শীঘ্রই।
হুটহাট কাকতালীয় অনেক ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে - এইটা বাদ দিলে বইটা খারাপ না। যেমন : ১. রুশদির হাসপাতালে গিয়েই মারুফ-রুমির আন্ডারকভার নার্সের সাথে আলাপ হওয়া ২. লোকমানের প্রথম খোড়া কবরই রুনুর কবর ৩. মারুফের বোন আবার রুশদির হাসপাতালেই ভর্তি ৪. ডা: হারুনের ছেলেকে ইউকে থেকে সেদিনই বের করে দিলো আর এসেই রুশদির হাতে কিডন্যাপ হয়ে গেল এরকম আরও বেশ কিছু।
ডা: হারুন, মারুফের বোন বিনু, ইউনিট ৭৩১ এই সাইড ঘটনা গুলা পুরা বাদ দিলেও মনে হয় গল্পে তেমন যায় আসত না৷ নাটুকেপনাও বাদ দেয়া যাইত যেমন ফলেন অ্যাঞ্জেলের লিরিক্স শুনে রুশদির কান চেপে ধরা, রুনুর জেদ করে বিষ মেশানো খাবার খাওয়া ইত্যাদি। আর "বাবি"দের সাথে রুশদির কনফারেন্স রুমে নাজিয়ার আত্মার ওজন মাপা রিচ্যুয়ালের ব্যাখ্যা এখনও পরিষ্কার না। একইভাবে রুমির ২য় পাসওয়ার্ড বের করার ব্যাপারটাও নট ভেরি কনভিন্সিং।
তবে "থ্রিলার" অর্থে, হ্যা, পাঠককে যথেষ্টই থ্রিল দেয়ার মত উপাদানে ভরপুর। লেখার স্টাইল আমার কাছে বেশ প্রেজুডিস মুক্ত, ননস্টেরিওটিপিক্যাল মনে হয়েছে৷ আমি এই লেখকের ব্যাপারে আশাবাদী, উনার অন্যান্য লেখা পড়ার আগ্রহ রাখি।
This entire review has been hidden because of spoilers.
এরকম ইতিহাস, চিহ্ন, সংখ্যা, ধর্মতত্ত্ব নিয়ে শেষ পড়েছিলাম ড্যান ব্রাউন সিরিজে। এই বিষয়গুলো পড়তে খুবই মজার লাগে; নতুন নতুন ব্যাপার সব জানা যায়। সে হিসেবে এই বইটাও দারুণ লেগেছে।
শুধু একটা দিকই দুর্বল লাগল– সাংবাদিককে ভিলেনের চেয়ে বড় বেশি চতুর দেখানোটা। ভিলেনকে এরকম ইঁদুরের মতো না দেখিয়ে আরো একটু ঢিশুম-ঢিশুম টাইপ দেখালে জমতো! তবে এভাবেও খারাপ না। শেষটা আমাকে অবাক করে দিয়েছে... 😑 মৌলিক লেখার নিরিখে খুব খুব ভালো।
ঝামেলা, ঝামেলা! থ্রিলার লেখা মহা ঝামেলার কাজ। রহস্য, রোমাঞ্চের সাথে একটু ভয়াল ব্যাপার না মেশাতে পারলে, পুরো ব্যাপারটা ঠিক জমে না।
"ভেন্ট্রিলোকুইস্ট"-এ এই সকল মালমশলা প্রথম পাতা থেকেই বিদ্যমান। বই ধরার ঠিক পরেই ভেবেছিলাম, যে ভাবে গল্প এগুচ্ছে, তাতে বইটা নিয়ে আলোচনা করার সময় হয়তো লিখতে পারব, "জমে ক্ষীর, মশাই", " আনপুটডাউনেবল" ইত্যাদি।
সেইরকম কিছুই হল না। অনেক সাবপ্লট যেন ঝোপঝাড়ের মত গজিয়ে উঠে পুরো ব্যাপারটা ঘেটে দিল। গল্পের শেষটা হলিউডি হয়ে গিয়েও ক্লাইম্যাক্সটা ম্যাড়মেড়ে লাগল। একটু হতাশ লাগছে। আমি আরেকটা "রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি" এক্সপেক্ট করেছিলাম। সেইরকম টানটান কিছু পেলাম না। বরং, গল্পের জট ছাড়ানোর জন্য শেষের কয়েক পাতায় ইনফো-ডাম্পিং দেখতে পেলাম। আরে বাবা, গোল্ডেন রেশিও আর ফিবোনাচ্চি সিরিজ নিয়ে চার পাতার থিসিস পড়ে যদি জানতে পারি, এত কিছু জ্ঞান প্লটের শুধু একটা ছোট্ট ব্যাপারের জন্য লেখা হয়েছে (এইক্ষেত্রে, পরাক্রমশালী নায়ক কী করে পাসওয়ার্ড অনুমান করেছেন, শুধু সেটা), তাহলে অল্প বিরক্ত লাগবে তো বটেই। শেষ দুই পাতার প্লট টুইস্টও গোঁজামিল লাগল, কিন্তু সেটা বোধহয় আমার ব্যক্তিগত মতামত।
আচ্ছা, অনেক গাল দিয়ে দিলাম বোধহয়। এখন ভালো দিকগুলো বলি, কারণ একটা বই ত্রুটিপূর্ণ হলেই, সেটা ছুড়ে ফেলে দেওয়াটা বোকামো।
প্রথমত, গল্পের টোন। কেমন একটা গা শিরশির করা আবহাওয়া রয়েছে প্রত্যেক পাতায়। মাশুদুল হক রহস্যময়তার আবহ তৈরি করতে পারেন, অনেকটা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন আর কৌশিক মজুমদারের মত। সেই উন্মোচিত রহস্য ঠিক কতখানি যুক্তিপূর্ণ বা মশলাদার, সেটা পাঠক-পাঠিকারা নিজে বুঝে নেবে৷ আমি শুধু বলতে চাইছি, মাশুদুল হক গল্পকার হিসাবে অসাধারণ।
দ্বিতীয়ত, মারুফের অতীতের স্মৃতিচারণ আর স্বপ্ন। হ্যাঁ, ভাল লাগার জন্য অদ্ভুত জিনিস বটে। কিন্তু এই অংশগুলোতে সাইকোলজিকাল ইমেজারি (অনেকটাই ফ্রয়েডীয়) রয়েছে বলেই বোধ হয় আমার ভাল লেগেছে। মারুফ লোকটা কেমন, সেটা বুঝতে পেরেছি এইগুলো পড়ে। উপন্যাসে এই অংশগুলোকে নিয়ে আরও এগোনো গেলে ভাল হত।
তৃতীয়ত, বইয়ের ভাষা। থ্রিলারধর্মী উপন্যাস আমরা কেউ বাংলা ভাষার মিষ্টতা বোঝার জন্য পড়ি না। বরং, এইসব উপন্যাসে বেশি নৈসর্গিক-জাতীয় বিবরণ থাকলে গল্পের গতি কমে যায়। এখানে সেইসব কিছু হয় নি। ভয় আর রোমাঞ্চের সাথে সাথে লেখক বিষাদের মত একটা আবেগ টেনে আনত��� পেরেছেন। সভ্যতার মুখোশের পেছনে মানবজাতি যে কতখানি পাশবিক রয়ে গেছে, সেগুলো নিয়ে ভাবার জন্য উপন্যাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার মত সময় দেওয়া হয়েছে। এই "moments of calm" গুলোই আমার সব থেকে বেশি প্রিয়, কারণ এই অংশগুলোতে লেখকের লেখনী ক্ষমতার অল্প পরিচয় পেয়েছি।
এই সিরিজের পরের বইটা হয়তো খুব শীঘ্রই ধরব। আমি এখনও জানি না "ভ্রেন্টিলোকুইস্ট"-এর শেষে যে সমস্ত প্রশ্ন আমার মনে এসে জমা হয়েছে, ঠিক সেইগুলোরই উত্তর আমি পাব কিনা। যদি নাও পাই, আশা করি " মিনিমালিস্ট"-এর নিজস্ব গল্পটা এই বইটির থেকে ভাল হবে।
অনেক ভালো লাগলো বই টা পড়ে, বাংলাদেশের তরুন সমাজ যে কতটা প্রতিভাবান তা এই বই পড়লে বোঝা যায়। "ভেন্ট্রিলোকুইস্ট" মাশুদুল হকের প্রথম মৌলিক থ্রিলার। প্রথম বই হিসেবে সে অসাধারন কাজ করেছে বইয়ে। আর সবচেয়ে যেটা ভালো লেগেছে তা হল লাস্ট পর্যন্ত সাস্পেন্স ধরে রেখেছে বই টা। আমি রাত জেগে পড়েছি কারন বইএর কাহিনী টেনেছে আমাকে। এই বইয়ে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত আছে, বই পড়লে বোঝায় যায় যে লেখককে অনেক পড়াশুনা করতে হয়েছে। আমি সত্যিই ইমপ্রেসড ^_^
যারা বই পড়তে ভালোবাসেন তারা অবশ্যই পড়বেন এই বইটা, ভালো লাগবে আশা করি। :)
To be honest, at first I got really spooked by the supernatural twist. I was all in for an exhilarating ride. But then it all crumbled in the last couple chapters. Why take it to that level only to drop us readers like a freaking rock?
One good thing: The writing was better than mediocre. One bad thing: The plot. So much build up, not enough execution.
সত্যি বলতে,বইটার শুরুর দিকে খানিকটা হতাশই লেগেছিল।প্লটের কিছু অংশ,কিছু সমস্যা যেন খানিকটা গায়ের জোরে তৈরি-এমন মনে হচ্ছিল।ভাবতে লাগলাম কাহিনীর অবস্থা হবে "যত গর্জে তত বর্ষে না"!
না,হঠাৎ করে ধাক্কা খেয়ে কাহিনীর আসল রস বুঝিনি,বরং ধীরে ধীরে কাহিনীর গভীরতা টের পেয়েছি।
কাহিনীটা কেমন? এক কথায়,"ডুবিয়ে দেবার মত"! পাঠক ডুবে যেতে বাধ্য হবেন কাহিনীতে। কাহিনীতে চমৎকার,বুদ্ধিদীপ্ত মোড় পাঠককে টেনে ধরে রাখবে,বাধ্য করবে পৃষ্ঠা উলটে যেতে।আগে যে ফাঁকগুলো আবিস্কার করে হতাশ হয়েছিলাম,সেগুলো এত সুন্দরভাবে পূর্ণ হয়েছে যে মুগ্ধ না হয়ে পারিনি।পাঠকের মনে অনেক প্রশ্ন জাগবে,পাঠককে চিন্তা করতেই হবে ।তবে কাহিনীটার মূল আনন্দ সেখানে যতটা নয়,তার চেয়ে অনেক বেশি অন্যখানে-পাঠকের মনে আসা মোটামুটি সব প্রশ্নের উত্তরই পেয়ে যাবেন এবং পাবেন পরিপূর্ণভাবে।লেখক নিঃসন্দেহে প্রচুর খেটেছেন এবং একেবারে পাঠকদের মনের উপযোগী খোরাক যোগাড় করেছেন। তথ্যবহুল একটি থ্রিলার,অথচ অসামান্য সেই গুণের অধিকারী-স্রেফ গল্পের মত করে অসাধারণ স্বাচ্ছন্দ্য আর সরলতা বজায় রেখে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।সোজা কথায়,পাঠক জানবেন অনেক,অথচ তথ্য ধারণের ক্লান্তি তাকে এতটুকু স্পর্শ করবে না।কাহিনীর মোড়ে মোড়ে ছোট ছোট বহু রহস্য আর প্রশ্ন তৈরি হতে থাকবে।ধর্ম,বিজ্ঞানের নানা শাখা,মনোবিজ্ঞান,ইতিহাস,এমনকি গণিতের নানা বিষয়ের পান্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে যখন এসব রহস্যের সমাধান হতে থাকবে,তখন পাঠক সত্যি অনুভব করবেন,তার আত্মা তৃপ্ত!
আর অবশ্যই,যত গর্জে ততটাই বর্ষাবে,একরত্তিও কম না!..…পড়তে থাকুন,বুঝে যাবেন।
থ্রিলার হিসাবে গল্পটা স্বার্থক। গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে লেখক গল্পের চারপাশে শক্ত ভীত তৈরীর চেষ্টা করেছেন যেটা সত্যিই প্রশংসনীয়৷ তবে মাঝে মাঝেই লেখা এলোমেলো মনে হয়েছে, ইনফরমেশন আর ফিকশনের মিল খাওয়াতে গিয়ে অনেক যায়গাতে খাপছাড়া করে ফেলেছেন। তবে সিরিজের পরবর্তী বই পড়ার দারুন আগ্রহ আগে থেকেই তৈরী হয়ে গেছে।
লেখকের পড়া প্রথম বই। বেশ সুন্দর। কভার দেখে ভালো লাগা। তেমন কিছু না জেনেই পড়া শুরু করেছিলাম।শুরুতে হরর জনরা ভাবলেও গল্প পুরো অবাক করে দিয়েছে। বছরের অন্যতম পড়া সেরা বই ছিলো। লেখকের আরো লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
শুরুটা অনেক আগে, যীশু খ্রিস্টের জন্মেরও কয়েকশ বছর আগে। মিশরীয় বা গ্রীক সভ্যতায়, অন্যায়ের বিচার করতেন স্বয়ং পাথুরে দেবমূর্তি। প্রাণহীন মূর্তির কণ্ঠে গমগমিয়ে উঠতো দৈববাণী। না, দেবতারা আদতে কথা বলতেন না। সেসময় পুরোহিত ও জাদুকরেরা আয়ত্ত করে নিতেন এক বিশেষ চর্চার।
মধ্যযুগে যখন শুরু হলো জাদুকরদের হত্যা করা, তখন প্রাচীন সেই চর্চাকেও কালো জাদুর মতই অশুভ কিছু হিসেবে সনাক্ত করা হয়। এর সাথে জড়িয়ে ছিল নিষিদ্ধ ধর্মীয় আচার। তবু বিদ্যাটা হারিয়ে যায়নি। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করে, ঠোঁট না নাড়িয়ে স্বর ছুঁড়ে দেওয়ার খেলা - মায়াস্বর বা ভেন্ট্রিলোকুইজম।
২০১৩ সাল। কলেজের পুরনো বন্ধু রুমি, মারুফ ও হাসান অনেকদিন পর এক হয়েছে জহিরের বিয়েতে। কথা হচ্ছিলো হারিয়ে যাওয়া বন্ধুরা কে কোথায় আছে, সেই সূত্রেই জানা যায় আরেক বন্ধু শওকত এখন ভেন্ট্রিলোকুইস্ট।
ব্যাপারটা অবাক হওয়ার মতোই বটে। একে তো আমাদের দেশে এই প্র্যাকটিসটার তেমন চল নেই। তার ওপর কলেজে পড়াকালীন টাইফয়েডে বাকশক্তি হারায় শওকত। সেই বোবা শওকত কি করে মায়াস্বরের খেলা দেখায়, এই কৌতুহলে রুমি আর মারুফ হাজির হলো শওকতের শো-তে।
শো দেখে মুগ্ধ দুই বন্ধু গেল শওকতের হোটেলের রুমে দেখা করতে। সেখানেই সব তালগোল পাকিয়ে গেল। অদ্ভুত সব প্রেতসাধনা আর আত্মার কথা বলতে শুরু করলো মায়াস্বরবিদ! জানায় ভেন্ট্রিলোকুইজম কেবল সাধারণ কোনো স্বরের খেলা নয়। যে পুতুলটা নিয়ে সে খেলা দেখায়, সেটা নাকি বহন করছে শওকতের আত্মা! তাদের আরেক পুরনো বান্ধবী রুনুকেই বা কি করেছে সে? কি সেই গোল্ডেন পানিশমেন্ট যা রুনুকে দিয়েছে শওকত?
মানসিক রোগের ডাক্তার রুহান উদ্দীন রুশদীর হাসপাতালে ভয়ংকর কিছু ঘটছে। সজ্ঞানে রেখেই মানুষের উপর অস্ত্রোপচার চালানোর মত পৈশাচিক কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে গোপন কোনো ধর্মপালন, অনেক কিছুর আভাস পাওয়া যাচ্ছে রুশদী হাসপাতালে।
শওকতের সাথে এসবের কি সম্পর্ক? রুনুর আসলে কি পরিণতি হয়েছে? যতই জানতে চায় আরো অশুভ ক��ছুর মধ্যে জড়িয়ে পড়তে লাগলো রুমি আর মারুফ।
মাশুদুল হকের প্রথম হরর থ্রিলার 'ভেন্ট্রিলোকুইস্ট'। গল্পটা মারুফের জবানে হলেও, এর মূল নায়ক তুখোড় সাংবাদিক রুমি। বুদ্ধি আর যুক্তির সাহায্যে সে বিপদসংকুল পরিস্থিতি কেটেও বেরুতে পারে ঠান্ডা মাথায়। সে তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মারুফের চরিত্রটি কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছিল। মূল খলচরিত্র হিসেবে রুশদীর উপস্থিতি ছিল সংক্ষিপ্ত, কেবল গল্পের পটভূমিতে তার ভয়াবহতা আঁচ করা যাচ্ছিলো।
গল্পটিতে দারুনভাবে মিশেছে ধর্ম, বিজ্ঞান, স্থাপত্য, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত, ইতিহাস এর উল্লেখ। সাথে টানটান উত্তেজনা আর রহস্য তো আছেই। অজস্র প্রশ্নের সুতো শেষ পর্যন্ত এনে একসাথে জুড়েছেন লেখক দারুন মুন্সিয়ানার সাথে। কাহিনী এগিয়ে গেছে দ্রুততার সাথে, পাঠক এক নিঃশ্বাসে শেষ করতে বাধ্য হবেন।
বাহাই ধর্ম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জাপানীদের নৃশংস প্রজেক্ট, হর্ষদ সংখ্যা, মায়াস্বরবিদ্যা নানাবিধ বিষয় সম্পর্কে লেখক আলোকপাত করে গেছেন গল্পের মধ্যে মধ্যেই। তবে কিছু ক্ষেত্রে তা খাপছাড়া ছিল। শত্রুর কবল থেকে পালানোর সময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ইতিহাস বর্ণনা করা, বা রেস্তোরাঁয় কাউকে খুন করে সেখানেই খুনের পদ্ধতি ব্যাখা করা ঠিক স্বাভাবিক ছিল না।
বাংলা সাহিত্যে এরকম তথ্যবহুল থ্রিলার বিরল। অনেকরকম তথ্য এবং টুইস্টের সমন্বয়ে লেখা বইটি পাঠকদের জন্য চমৎকার একটি উপহার।
অনেকদিন পর বাংলা নতুন লেখকের কোন বই পড়লাম। এককথাই বইটা ছিল অসাধারণ। বাহাইদের ইতিহাস খুব সুন্দর উপাস্থাপন করেছে লেখক। এমন লিখা আরও চাই। আমি সবাইকে বইটা পড়ে দেখার আহবান জানালাম।
"Azazel is beside you and he's playing the game, Demons are inside you and they're making their play. Watching and they're hiding as they wait for the time For a devil to get ready to take over your mind....."
▪ কাহিনী সংক্ষেপ: অনেকদিন পর পুরোনো এক বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে তিন বন্ধু যাদের একজন সাংবাদিক রুমি, অধ্যাপক হাসান এবং নৃবিজ্ঞানী মারুফের মধ্যে আড্ডা জমে ওঠে। স্মৃতি হাতড়ে নিজেরা অনেক কথা বলতে থাকে এবং আড্ডার এক পর্যায়ে তাদের পুরানো বন্ধু শওকত এর কথা মনে পড়ে তাদের। শওকত এর সাথে যোগাযোগ আগের মত নেই ঠিকই কিন্তু এক বন্ধু তখন বলে যে শওকত বর্তমানে একজন জনপ্রিয় "ভেন্ট্রিলোকুইস্ট"। কিন্তু রুমি একথায় বেশ অবাক হয় কেননা শওকত কলেজে থাকতে একবার অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলো যার জন্য ডাক্তার বলেছিলো শওকত কখনো কথা বলতে পারবেনা যার কারণে অসুস্থতার পর একপ্রকার বোবা হয়ে গিয়েছিলো শওকত। নিজের এই কথা বলতে না পারার জন্য আস্তে আস্তে দূরে সরে গিয়েছিলো সে। কিন্তু তাদের সেই বোবা বন্ধুই যখন একজন ভেন্ট্রিলোকুইস্ট যেখানে তাকে কন্ঠের কারসাজির মাধ্যমে তার কাজ সম্পন্ন করতে হয় নিঁখুতভাবে তখন তারা বেশ অবাক হয়। রুমি আর মারুফ দুজনেই বেশ কৌতুহলী হয়ে উঠলো শওকত এর ব্যাপারে৷ শওকত এর এমন হঠাৎ পরিবর্তনে তারা দুজনে বেশ খোঁজ খবর নেয়া শুরু করে। শওকত এর সাথে দুজনের দেখা হবার পর শওকত কে নিয়ে ওদের দুজনের সন্দেহ আরো দৃঢ় হয়। শওকত এর এমন হঠাৎ পরিবর্তনের রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে দুই বন্ধু খোঁজ পায় এক বিরাট বাহাই টেম্পলের যার আন্ডারগ্রাউন্ড অত্যাধুনিক একটি ল্যাব রয়েছে। এসবের পেছনে ছুটতে গিয়ে তারা মুখোমুখি হয় মৃত্যুর কিন্তু রুমি সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। ধীরে ধীরে ব্যাপার টার সাথে মারুফের পরিবার ও জড়িয়ে যায় সাথে জড়িয়ে যায় বন্ধু হাসান।
▪ পাঠপ্রতিক্রিয়া ও পর্যালোচনা: ১৯১ পৃষ্ঠার একটা বইতে কিভাবে ভেন্ট্রিলোকুইজম, বাহাইজম, বাহাই টেম্পল, বায়োলজিক্যাল উইপন, জরাথ্রুস্টবাদ এর মত ব্যাপার নিয়ে খুব সুন্দরভাবে আলোচনা করা যায় লেখক মাশুদুল হক সেটা দেখিয়েছেন। বইটা শুরু হয়েছিলো একজন ভেন্ট্রিলোকুইস্ট বন্ধু কে নিয়ে কিন্তু সেটা ডালপালা মেলে গিয়ে ঠেকেছে বেশ কিছু জায়গায় তবে সে বিষয়গুলো যতটা অল্প ভাষায় পারা যায় লেখক বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন। বইটাতে মূলত গল্পকথক হচ্ছে মারুফ তাই মারুফের বয়ানেই পুরো কাহিনী আবর্তিত হয়েছে সুন্দরভাবে। সাসপেন্স টুকু বজায় ছিলো শেষ পর্যন্ত। একজন ভিলেন এর ভিলেন হয়ে ওঠার পেছনে কারণসমূহ এই ব্যাপার টাও অল্পের মধ্যেও লেখক প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। অল্প কথায় যদি বলি ত বলবো একটা বইয়ে এতকিছু গুছিয়ে লেখা বেশ কষ্টসাধ্য বটে কিন্তু তবুও লেখক বেশ গুছিয়ে লিখতে পেরেছেন তার প্রথম বই। আর বইটা লেখার পেছনে যে তিনি যথেষ্ট শ্রম দিয়েছেন তার ছাপ প্রতি পৃষ্ঠাতেই রেখেছেন কেননা বইটা শুধু থ্রিলার বললেও ভুল হবে বইটা অনেক তথ্যে ঠাসা একটা বই যার জন্য বেশ আগ্রহ নিয়ে শেষ করেছি বইটা।
▪ বইয়ের চরিত্র: বইয়ের চরিত্র মূলত বন্ধু রুমি, মারুফ, হাসান আর শওকত। তবে মাঝের দিকে শওকত অনুপস্থিত ছিলো। শওকত এর আগমন ঘটেছে শেষ পর্যায়ে। আবার মাঝের দিক থেকেই ছিলো ভিলেন ডা. রুশদি। তাই বলা যায় বইয়ের প্রায় আশি ভাগেই ছিলো রুমি আর মারুফ। রুমি চরিত্র টা বেশ জিনিয়াস একটা চরিত্র তাই পুরো বইতে এই একটা চরিত্র পাঠকের পছন্দ হবার যোগ্য। তবে এছাড়াও জয়নাল,মিলি,রানু,বেনু,লোকমান,রশিদ ছিল যাদের অল্প সময়ের আগমন ঘটলেও লেখক তাদের বেশ ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
▪ লেখকের বর্ণনাভঙ্গি: প্রথম বই হলেও লেখকের বর্ণনাভঙ্গি ছিলো প্রসংশা করার মত। তার লেখায় ড্যান ব্রাউন এর ছাপ পাওয়া যায়। বইটা তিনি বেশ গুছিয়ে লিখেছেন। যেখানে যতটুকু বর্ণনার প্রয়োজন সেখানে তিনি ততটুকু বর্ণনাই করেছেন যেটা ছিলো বইয়ের অন্যতম পজিটিভ দিক। অযথা পেজ বাড়ানো হয়নি। এমনকি বাহাই টেম্পল এর প্রতিটা কোণের বর্ণনাও লেখক এমনভাবে দিয়েছেন যেন মনে হয়েছে প্রজেক্টরের মাধ্যমে কিছু দেখানো হচ্ছে। তবে শেষদিকে এসে গোল্ডেন রেশিও টা আমার কাছে বুঝতে একটু কঠিন লেগেছে এবাদে আর কোনো সমস্যা হয়নি কোথাও।
▪ বইয়ের সমাপ্তি: লেখক বইয়ের শুরুতে কয়েকটা গিট লাগিয়েছিলেন। আর সেই গিট খুলেছেন একদম শেষদিকে এসে আস্তে আস্তে। বইতে টুইস্ট থেকে মূখ্য ব্যাপার ছিলো বইটা বেশ গতিশীল ছিল। আর আমার মতে তথ্যের দিকটা একটু ভারী করতে গিয়ে শেষ দিকে এসে টুইস্ট টা কেমন যেন জমে ওঠেনি ধরনের হয়ে গিয়েছে তবে তা সত্বেও বইটা যথেষ্ট উপভোগ্য।
▪ যে ব্যাপারগুলো ভালো লাগেনি: লেখক বইতে বিভিন্ন কনভারসেশন এ ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করেছেন যেটা আমার কাছে একটু মাত্রাতিরিক্ত লেগেছে, মনে হয়েছে সেখানে ইংরেজি কম ব্যবহার করলে আরো সুখপাঠ্য হতো।
বইটাতে রুমি চরিত্র টা নিঃসন্দেহে জিনিয়াস একটা চরিত্র কিন্তু একদম সব জায়গায় সব বিষয়েই তার যে অঘাদ জ্ঞান সেটা আমার কাছে ভালো লাগেনি। অন্যদিকে মারুফ কে একটু বোকা ভাবে ফুটিয়ে তোলাটাও ভালো লাগেনি। আমার মতে দুজনকেই সমান সমান করলে ভালো লাগত।
▪ বানান, প্রচ্ছদ ও অন্যান্য: বাতিঘরের কিছু বইতে প্রচুর বানান ভুল আবার টাইপিং মিসটেক পেয়েছি তবে সেদিক থেকে ভেন্ট্রিলোকুইস্ট তেমন নয়। বিশেষ করে যুক্তবর্ণ এর জায়গাগুলোতে যুক্তবর্ণ আসে��ি আর 'হ্যাঁ' কে সব জায়গায় 'হ্যা' লেখা হয়েছে। প্রচ্ছদ বর্তমানের টা থেকে আগের এডিশনের টাই বেশি ভালো লেগেছিল। তবে এখন যে এডিশন আছে এটার নামলিপি টা বেশ পছন্দ হয়েছে। বাঁধাই মধ্যম মানের ছিল। বেশি মেলে পড়তে গেলে খুলে যাবার মত অবস্থা ছিল।
সব কথার শেষ কথা ভালো খারাপ নিয়েই একটা বই তবে এ বইতে ভালোর দিকটাই আমার কাছে বেশি। তাই যারা থ্রিলার, এডভেঞ্চার বা একটু তথ্যবহুল বই পছন্দ করেন তাদের ভালো লাগবে আশা করি।
ভেন্ট্রিলোকুইজমের চর্চা ঠিক কখন থেকে শুরু হয়? আচ্ছা সেই প্রশ্ন আপাতত একপাশে সরিয়ে রাখছি। আগে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক ভেন্ট্রিলোকুইজম কী?
আমরা প্রায় দেখি একজন মানুষ (ভেন্ট্রিলোকুইস্ট) একটি পুতুল হাতে নিয়ে কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে বিচিত্র এক খেলা বা অনুষ্ঠানে অভিনয় করে যাচ্ছে। কখনও হাসি-ঠাট্টা, কখনও জীবন দর্শন, কখনও-বা সমাজের হালচাল নিয়ে রচিত হয় কথোপকথনের বিষয়বস্তু। কিন্তু উপস্থাপনা হয় খুবই সূক্ষ্মভাবে; যাতে করে দর্শকদের মাঝে সন্দেহ না হতে পারে যে দুজন একই ব্যক্তি। যিনি এই খেলাটি দেখান তিনি হলেন ‘মায়াস্বরবিদ’ বা ‘ভেন্ট্রিলোকুইস্ট’। আর খেলাটির বাংলা ‘মায়াস্বর’ হলেও ইংরেজি ‘ভেন্ট্রিলোকুইজম’ নামটিই বেশি পরিচিত।
যীশু খ্রিষ্টের জন্মের অনেক আগ থেকে এই ভেন্ট্রিলোকুইজম সক্রিয় ছিল। গ্রিক মিথোলজিতে দেবতাদের পুণ্যভূমি—এথেন্সের ডেলফির মন্দিরে এই ভেন্ট্রিলোকুইজমের ভেল্কি দেখানো হতো। যদিও এই ধারণা অনেকটা কল্পনাপ্রসূত। কারণ ডেলফি ছিল দৈববাণী প্রকাশের মাধ্যম বা জায়গা। তবে প্রাচীনকালের অনেক পুরোহিত ও জাদুকররা সমাজে প্রতিপত্তি বাড়ানোর জন্য এই ভেন্ট্রিলোকুইজম বেছে নিত। এই নিয়ে বিস্তর তথ্য আপনি ❛ভেন্ট্রিলোকুইস্ট❜ বইতে পেয়ে যাবেন। এছাড়া ইন্টারনেট তো আছেই।
লেখক শুধুমাত্র ভেন্ট্রিলোকুইজমের মধ্যে পুরো উপন্যাস বন্দি করে রাখেননি। বাহাই ধর্ম, ইউনিট ৭৩১, ভিভিসেকশন, জাদুবিদ্যা, ভুডু, অনার কিলিং-সহ আরও নানান তত্ত্ব মিশ্রিত গাণিতিক যোগসূত্র নিয়ে তৈরি করেছেন ❛ভেন্ট্রিলোকুইস্ট❜ বইটি। ছোটোখাটো এক গবেষণা করা পুঁথি বললেও ভুল হবে না।
ইতিহাসের নিকৃষ্ট ও রহস্যময় দিকগুলো সম্পর্কে অবগত হতে চাইলে এই বইটি আপনার জন্য উৎকৃষ্ট। একটু ধীরেসুস্থে পড়লে ভালো। তাড়াহুড়ো করতে গেলে, মাথায় প্যাঁচ খাওয়ার কিঞ্চিৎ সম্ভাবনা রয়েছে।
➲ আখ্যান—
বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেকদিন পর দেখা হয়ে যায় পুরোনো বন্ধুদের। দুই বন্ধু—নৃতাত্ত্বিক মারুফ এবং পত্রিকার ফিচার এডিটর রুমি কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে তাদেরই আরেক বন্ধু পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে ভেন্ট্রিলোকুইজম। কৌতূহলী হয়ে সেটার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ওরা জড়িয়ে পড়ে দারুণ রহস্যময় এক অনুসন্ধানে। বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর আর শিউরে ওঠার মত সব সত্য। সাধারণ মানুষকে কখনই জানতে দেওয়া হয় না এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক সম্প্রদায়ের কথা, যার পদে পদে ওদের জন্য ওত পেতে আছে মৃত্যু, বিপদ, জড়িয়ে আছে ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষের জীবন। ❛ভেন্ট্রিলোকুইস্ট❜ শুধু একটি উপন্যাসই নয়, পাঠকদের জন্য ইতিহাস, স্থাপত্য, গণিত, ধর্মতত্ত্ব আর বিজ্ঞানের এক অভূতপূর্ব যাত্রা।
➤ পাঠ প্রতিক্রিয়া ও পর্যালোচনা—
বইটি জ্ঞান অন্বেষণে ইচ্ছুক পাঠকদের জন্য নিঃসন্দেহে দারুণ। তবে লেখকের লেখার গতি ও বইয়ের বিষয়বস্তু এই দুইয়ের সাথে তাল মেলাতে রয়েসয়ে পড়া ভালো। যে-সব বিষয়বস্তু নিয়ে লেখক আলোকপাত করেছেন, চাইলে পড়ার ফাঁকে সেই সম্পর্কে ইন্টারনেট থেকে জেনে নিতে পারেন। তাহলে পড়ায় সুবিধা হবে। প্রথমদিকে বেশ গোছানো মনে হলেও, দুই-তৃতীয়াংশ শেষে কাহিনি কিছুটা দ্রুত গতিতে শেষ হয়েছে। যেহেতু তথ্য দিয়ে ঠাসা তাই সেগুলো গল্পের সাথে কানেক্ট করতে এই উপায় বাতলে দেওয়া।
● সূত্রপাত—
গল্পের শুরুটা একটা বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে। সেইখান থেকে মারুফ, রুমি ও হাসানের বন্ধু শওকতের ভেন্ট্রিলোকুইস্ট হওয়ার গল্প। তারপর তাদের দেখাসাক্ষাৎ। অপার্থিব আলোচনা শেষ হতেই পুরো ঘটনা আবর্তিত হয় শওকতের প্রেমিকা রুনুকে ঘিরে। ঘটনাক্রমে সেই মোড় ঘুরে যায় জয়ন্তপুরে। মূল কাহিনি শুরু তখন থেকে। শওকতের ভেন্ট্রিলোকুইস্ট হওয়ার পেছনের গল্প ও এই গল্পের রচয়িতা কে; সেই উত্তর খুঁজতে মারুফ ও রুমিকে যেতে হয় অদ্ভুত এক হাসপাতালে! কীসের এই হাসপাতাল?
● গল্প বুনট—
লেখক যে ড্যান ব্রাউনের ভক্ত তা ওনার গল্প সাজানোর সাজ-সরঞ্জাম দেখে আন্দাজ করা যায়৷ সিম্বল নিয়ে অ্যাসাইমেন্ট এবং তথ্য-উপাত্ত সাজিয়ে পুরো উপন্যাস লিখতে ভালোই হ্যাপা পোহাতে হয়েছে। তবে আলোচনা-সমালোচনা করার ক্ষেত্রে দুটোই বেশ ভালোই প্রাধান্য পাবে। কারণ যত তত্ত্ব নিয়ে খেলতে চেয়েছেন লেখক; সেগুলো যতটা শক্ত—গল্পে ততটা পোক্ত বা প্রকটভাবে ডানা মেলে উড়তে পারেনি। কিছু যুক্তি অকাট্য লেগেছে, ক্রুশিয়াল মোমেন্টে এসে। যা-ই হোক, এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। সেইদিকে যেতে চাচ্ছি না।
গল্পের সিকোয়েন্স সাজানো ভালো, প্লটও ইন্টারেস্টিং। দেশের গণ্ডিতে এইরকম প্লট নিয়ে লেখার প্রচেষ্টা করার জন্য সাধুবাদ অবশ্যই জানাতে হচ্ছে। শেষটা শুধু আরেকটু ধীরে হলে ভালো হতো, কারণ এত সব যুক্তিতর্ক হজম করার জন্য সময়ের ভীষণ প্রয়োজন। আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, অহেতুক বর্ণনা বা ব্যবচ্ছেদে লেখক জাননি। থিউরি বা তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা যথেষ্ট মার্জিত লেগেছে; শুধু অতিরিক্ত ইংরেজি সংলাপ বাদ দিলে। এই নিয়ে কিছুটা বিরক্তির উদ্রেক ঘটেছে। অন্যদের হয়তো ভালো লাগবে, আমার লাগেনি।
● লেখনশৈলী—
দ্রুত এবং সাবলীল। এক বসায় পড়ার মতো লেখনশৈলী হলেও, সেটা সম্ভব হয়নি নানান বিষয়বস্তুর জন্য। তবে জ্ঞান জাহির বা পাণ্ডিত্যের ছড়ি ঘোরানোর মতো কাজগুলো নেই বলে আরাম লেগেছে। নৃতত্ত্ব নিয়ে আলাপ-আলোচনা সহজ ভাষায় উপস্থাপন করার কারণে গল্পে কোনোপ্রকার বাধা সৃষ্টি হয়নি।
● বর্ণনাশৈলী—
পারিপার্শ্বিক আলোচনা এবং পর্যালোচনা দুটোই সমানুপাতিক। যতটুকু বর্ণনা করার দরকার ততটুকু করা হয়েছে। ইট-পাথরের তৈরি দালানের চিত্র কিংবা গ্রামের কোনো পরিত্যক্ত বাড়ির রহস্য; কোনো কিছুতেই অতৃপ্তি আসেনি৷ তবে উত্তেজনা যতটুকু ক্রিয়েট করার দরকার ছিল, সেটা তাড়াহুড়োর কারণে ফসকে গিয়েছে। আফসোস নেই, অপূরণীয় ক্ষতি অন্যদিকে পূরণ করে দিয়েছেন লেখক।
গাণিতিক হর্ষদ সংখ্যা, ফিবোনাচ্চি সিরিজ—এইসবের ব্যবচ্ছেদ পড়তে গিয়ে মনে হলো নবম-দশম শ্রেণির টাইমলাইনে ফিরে গিয়েছি। বিষয়টি মজাদার আবার একইসাথে কপালে ভ্রু কুঁচকানোর মতোই অবস্থা।
● চরিত্রায়ন—
চরিত্র হাতে গোনা। যেহেতু গল্প উত্তম পুরুষে লেখা, তাই পুরো উপন্যাস মারুফের পার্সপেক্টিভ থেকে দেখানো হয়েছে। তবে রুমি চরিত্র এই গল্পে একাই একশ! নৃতত্ত্ব নিয়ে জ্ঞান যার, সে এই গল্পে নিতান্ত এক ডামি ব্যতীত আর কিচ্ছু নয়। লেখকের উচিত ছিল, মারুফ ও রুমির মধ্যে ব্যালেন্স রাখা। নিক্তিতে মাপামাপি করতে গেলে রুমি কিছুটা সুপার হিউম্যান খেতাব পেয়ে যাবে৷ অ্যান্টানোগিস্ট চরিত্রে যিনি ছিলেন, তার অ্যাপিয়���রেন্স অতটা আকর্ষিত করেও যেন করতে পারেনি। বিশেষ করে গতানুগতিক ধারায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কীর্তিকলাপ স্বীকার করা এবং শেষ পরিণতি। যাহোক, লেখকের মূখ্য উদ্দেশ্য যে চরিত্র নিয়ে ছিল না, তা এই উপন্যাস যারা পড়েছে একটু মাথা খাটালে সেটা বের করতে পারবে। লেখকের মূল বিষয়বস্তু বিভিন্ন টপিক নিয়ে খেলা করে। আর এই টপিকের গিনিপিগ হচ্ছে এইসব চরিত্র। তবে শওকত চরিত্র বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছে।
● অবসান—
সব কিছুর ব্যাখ্যা ও যোগসূত্র লেখক ভালোভাবে টেনেছেন। অতিরঞ্জিত কিছু ছিল না, শুধু শেষ পরিণতি ছাড়া। তবে সেটাকে আমি লাস্ট সাসপেন্স হিসেবে মার্ক করব। পুরো বইতে টুইস্ট আর সাসপেন্সের কোনো কমতি লেখক রাখেননি৷ এত এত সাসপেন্স যে, যারা সাসপেন্স খেয়ে ঘুমাতে পছন্দ করেন তাদের জন্য আদর্শ বটে।
● খুচরা আলাপ—
খুচরা আলাপের প্রয়োজনীয়তা নেই। লেখক দিল খুলে ওনার উপন্যাসে খুচরা আলাপের পসরা সাজিয়ে রেখেছেন। আর বাড়তি গবেষণা করতে হলে ইন্টারনেট তো আছেই। তবে অজানা অনেক টপিক ও সত্য সম্পর্ক অবগত হয়েছি, যা জানার পরিধিকে আরেকটু বৃদ্ধি করেছে। এই বই যে গতানুগতিক কোনো উপন্যাস না—এই হচ্ছে আসল কথা।
➣ লেখক নিয়ে কিছু কথা—
মাশুদুল হকের প্রথম কোনো বই পড়া। সেই হিসেবে লেখক পাঠক আকৃষ্ট করে রাখার কেরামতি দেখিয়ে দিয়েছেন। অন্তত আমার পছন্দের টপিক নিয়ে আলোচনা তো রয়েছে। এ���রকম গবেষণামূলক ফিকশন বই বরাবরই আমার পছন্দের শীর্ষে। ওনার পরবর্তী বইগুলো পড়ার চেষ্টা করব। শুনেছি ‘মিনিমালিস্ট’ এই বইয়ের চেয়েও দারুণ; তাই আর দেরি করা যাবে না।
● সম্পাদনা ও বানান—
বানান নিয়ে কথাবার্তা বাদ দিই। সম্পাদনা ভালো, কিছুক্ষেত্রে আরও ভালো হতে পারত। তবে আমি ২০১৩ সালের প্রথম সংস্করণ পড়েছি; সেই ক্ষেত্রে পরবর্তী সংস্করণে যদি কিছু পরিবর্তন হয়ে থাকে তাহলে ভালোই।
● প্রচ্ছদ, নামলিপি—
দেশিয় বা মূল ভার্সনে দুটো প্রচ্ছদ রয়েছে এই বইয়ের। তবে আমার ‘অভিযান পাবলিশার্স’ থেকে বের হওয়া ছবির প্রচ্ছদটি বেশ ভালো লেগেছে। তাই সেটা দিলাম।
⊙ বই : ভেন্ট্রিলোকুইস্ট | মাশুদুল হক ⊙ জনরা : কনটেমপোরারি ফিকশন, মিস্ট্রি, থ্রিলার ⊙ প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ⊙ প্রচ্ছদ : ডিলান (বাতিঘর প্রকাশনী) ⊙ প্রকাশনা : বাতিঘর প্রকাশনী ⊙ মুদ্রিত মূল্য : ১৮০ টাকা মাত্র ⊙ পৃষ্ঠা : ১৯১
জীবন শুরু করেছিলাম নিজেকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে বসিয়ে। এরপর বয়স বাড়তে লাগলো, অভিজ্ঞতার ক্রসব্যাগখানার পকেট ভরতে লাগলো, আর উপলব্ধি হতে শুরু করলো আসলে জীবনটা নিজের হলেও তাতে পার্শ্বচরিত্র হিসেবে থাকা যায়, এতে কোনো পাপ নেই। কদিন সে চেষ্টাও করেছি, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মজা পাইনি। এরপর হুট করে একদিন মাথায় দূতাদেশের মতন বেজে উঠলো, "নায়াক নেহিইইইইইই, খালনায়াক হু ম্যায়!" মনে হলো, যাসসালা! এইটা তো ভেবেই দেখিনি!
বইটা পড়ার আগে পর্যন্ত এই ধারণা নিয়েই খুশি ছিলাম। তবে বই পড়তে নিয়ে, খলনায়ক রুশদির একটা কাজে আবার দোটানার পুনরাগমন হলো! ঘটনাপ্রবাহের এক পর্যায়ে রুশদি সাহেব গল্পের কেন্দ্রীয় দুজন চরিত্র, মারুফ এবং রুমিকে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় রেখে বেশ খানিক্ষণ সময় ধরে একটা ছোটোখাটো মনোলগ শোনান, সেসব রুশদির জীবনবন্দনাও বলা চলে। মোটামুটি তার জীবনের মহৎ তাৎপর্য এবং বিশ্বাসের আলেখ্য তুলে ধরেন বন্দীদ্বিগের সামনে। জীবনের প্রথম পরিচয়ে নিজ জীবনের এত গোপন তথ্য যে ফাঁস করা যায় থ্রিলার না পড়লে জানতে পারতাম না! দেন ইট হিট মি! পাবলিকরে বাইন্ধে রাখা পর্যন্ত তো ওকে, কিন্তু এরপর তাদের এই বান্ধাবস্থার প্রতি ন্যায়বিচারস্বরূপ তাদের একটা জম্পেশ ব্যাকস্টোরি শুনিয়ে আমার জীবনকর্মের প্রতি বিরূপতার বীজ থেকে তাদের অন্তরে যে মহীরুহের পরিবর্ধন করতে হবে, তা আমি কইত্তে পাবো? এ তো বড়ই কঠিন কাজ! আমার মতো ইন্ট্রোভার্টে দিয়া তো এই কাম হবে না! বড়োজোর একটা ক্যাবলাকান্ত হাসিই দিতে পারি, এইটুকই! আবার এদিকে যে ব্যাকগ্রাউন্ডের হাসির ইফেক্ট দেওয়ার পার্ট নেবো, সেও তো সব পঞ্চাশের দশকের মানুষ নিয়ে বসে আছে! সে দশকে জন্মালে নাহয় নিজের হাসিকে অমর করে রাখার এহেন প্রস্তাবে সম্মতি জানাতে দুবারও ভাবতাম না। তাই ঘুরেফিরে আবার আগের সমস্যাতেই পড়েছি। সেও একেবারে চরিত্র নিয়ে টানাটানি সমস্যা!
যাই হোক। মৌলিক থ্রিলার হিসেবে বেশ ভালো। তবে স্টোরিটেলিং এ খানিকটা ঝামেলা আছে। ঝামেলাও না ঠিক, বইতে তথ্য এসেছে ভুড়ি ভুড়ি—যা কাহিনির মাঝে থেকে টেনে এনে উইকিপিডিয়া পড়ার অনুভূতি জাগাচ্ছিল থেকে থেকে। এখানটায় আরেকটু সাবলীলতা থাকলে পড়তে আরো ভালো লাগতো। থ্রিলের দিক থেকে শেষটা দুর্বল মনে হয়েছে। যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলো, শেষে এসে কোথাও একটা শেষ করতে হবে এমন অবস্থা হয়ে গেছে। তবে সবকিছু সায়েন্টিফিক টার্মে শেষ করানোতে লেখকের প্রতি আমি অনেক কৃতজ্ঞ। এমনটা নাহলে গেছিলো আমার আজ রাতের ঘুম আর কালকের দিনের ধকল!
বাংলায় থ্রিলার, অনেক অনেক দিন পরে। নতুন একজন লেখক। বিষয় আবার ভেন্ট্রিলোকুইজম! বিপদজনক আগ্রহ নিয়ে বইটা পড়া শুরু করলাম।
অতিরিক্ত প্রত্যাশা থাকলে বেশির ভাগ সময়ই সেটা পূরণ হয় না। বরং আশাভঙ্গের বেদনাই পেতে হয়। লেখক মাশুদুল হককে অভিনন্দন, তিনি দারুণভাবে সুবিচার করেছেন প্রত্যাশা পূরণে। শুরুতে কিছুটা ছাড়াছাড়া ভাব ছিলো। গতি থাকলেও লেখনীতে পর্যাপ্ত গাঁথুনী পাচ্ছিলাম না। কিন্তু গল্প যত এগিয়েছে ততই তা আরো মজবুত হয়েছে। পড়তে গিয়ে ড্যান ব্রাউনের কথা মাথায় এসেছে; সেটা হয়ত কেবলমাত্র কাহিনীতে ধর্ম, সিম্বোলিজম আর ইতিহাসের সম্মিলন ঘটেছে বলেই। কিছু বিষয়ের অনেক বেশি ডিটেইলস বর্ণনা বা ব্যাখা দেয়া হয়েছে, আমি তাতে ব্যক্তিগতভাবে বিরক্তবোধ করি নি, অনেক কিছুই তো জানতাম না এই বিষয়গুলোতে, সেগুলো বুঝতে সুবিধা হয়েছে। কাহিনীর মাঝের থেকে পুরো বইটা প্রবল আকর্ষণ নিয়ে একটানা পড়ে গেছি। কিছু অসগতি আছে কিছু চরিত্রে, অন্তত পাঠক হিসেবে সেরকম ঠেকেছে কখনও। কিন্তু পুরোটা শেষ করার পরে সাথে সাথেই যে অনুভূতি হলো, তা হলো, "দারুণ"। এর পরে মন থেকেই লেখকের জন্য শুভকামনা চলে আসে। লেখকের পরের বই-এর পাঠক হয়ে রইলাম এখনই।
A very good thriller with the delicate touch of history and religion by the writer, an young Doctor. I loved the book because I love to know about history and religion. He did it with the flavor of modern technology as well. You will not feel bored for a single second while reading this book. The thing that attracted me most and which actually matters to me most about the worthiness of reading a book - what knowledge do you acquire from it. Believe me, you will learn a lot which you have not probably any idea about. Cheers Masud! Amazing work! Highly recommended!
কয়েকদিন ধরে আমার রাত্রেবেলা কেমন যেন গা ছমছম করে। ৫টা অব্দি জেগে থাকি কারণ "আযান হয়ে গেছে এখন ভয়ের কিছু নাই" এই থিওরি মতাবেক। এইরকম ভাবতে ভাবতেই বুকসেলফে পরে থাকা "ভেন্ট্রিলোকুইস্ট" হাতে নেই রাত্রে কিছুটা ভয়কে জয় করতে। প্রথম কয়েক পাতা পড়ে গা আরো বেশি ছমছম করে, প্রচ্ছদ যেন চোখে না দেখা লাগে- কোম্বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পরি। সকালে আবারো হাতে নেই এরপর এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম। অনেকদিন পর কোন ফাস্টপেস বই পরে মনে হলো এতো দ্রুত সব কনক্লুড না হলেও হতো। পড়তে খারাপ লেগেছে তা বলছি না কিন্তু অনেকবেশি ইনফো যেন গড়গড় করে বলে জানান দেওয়া হয়েছে। প্লটটা খুব ইন্টারেস্টিং যদিও বইয়ের নামকরণের সাথে কাহিনীর সংযোগটা খুব-ই ওয়িক লেগেছে আমার। অনেক নতুন তথ্য জানতে পেড়েছি- it literally shows how much paperwork the author had to go through. Looking forward to read the rest of the series.
এরপর থেকে বাংলা থ্রিলার পড়তে বসলেই একটি শব্দকোষ, Google, এবং অফুরন্ত সময় নিয়ে বসব কারণ এত এত তথ্য এবং twist বোঝার জন্য আমার মত জ্ঞানী (পড়ুন গন্ডর্মূখ) পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করতে প্রাণান্ত চেষ্টা করতে হয়, কিন্তু বইটা আসলেই অনেক ভালো ছিল
এক বন্ধুর বিয়ে খেতে এসে দুই বন্ধু যাদের একজন অধ্যাপক আর আরেকজন সংবাদকর্মী, জানতে পারে তাদের আরেক বন্ধু যে অসুস্থতাজনিত কারণে বাকপ্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছিলো সে বর্তমানে ভেন্ট্রিলোকুইস্ট। কৌতুহলী হয়ে তারা তাদের ভেন্ট্রিলোকুইস্ট বন্ধু শওকতের সাথে দেখা করতে যায়। সেখান থেকেই তারা জড়িয়ে পড়ে ভিন্ন এক রহস্যে। গল্পে ভেন্ট্রিলোকুইসমের চেয়েও ধর্মতত্ত্ব,গণিত, ইতিহাস বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তবে শওকতকে নিয়ে কাহিনী শুরু হলেও গল্পে আসল ভেন্ট্রিলোকুইস্ট তো ড. রুশদি, কেননা আসল সূততো তার হাতেই। এ বছর আমার পড়া বইগুলোর মধ্যে সেরা বইয়ের লিস্টেই এই বই থাকবে। টানটান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে সময় কাটাতে চাইলে আর দেরি কেন? পড়ে ফেলুন মাশুদুল হকের থ্রিলার বইটি।
ভেন্ট্রিলোকুইজম। এই শিল্পের সাথে অনেকেই পরিচিত, অন্তত দর্শক হিসেবে। একজন কমেডিয়ান হাতে একটি পুতুল নিয়ে কথাবার্তা বলছেন। আবার পুতুলটি কৌতুকপূর্ণ উত্তর-প্রতিউত্তর দিচ্ছে। দর্শকের জন্য ব্যাপক বিনোদন।
কমেডি অনেক ক্ষেত্রে ডার্ক একটি বিষয়। কমেডিয়ান হিউমার করার সময় কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে রোস্ট করেন। আবার কখনো কখনো পুতুল এবং কমেডিয়ান একে অপরকে পঁচান। তবে কে জানতো যে ভেন্ট্রিলোকুইজমের পিছনে আছে এক অন্ধকার অধ্যায়।
হরর মুভি / উপন্যাসে পুতুল বা ডামিকে মারাত্মক ভয়ের একটি অনুসঙ্গ হিসেবে দেখানো হয়। মানবসভ্যতায় মূর্তি পূজো যেমন দেয়া হয়েছে আবার একইসাথে ভয়ের চোখেও দেখা হয়েছে। মানবসদৃশ্য অবয়ব যেন বহু রহস্যের আঁধার। মানবমনও প্রচন্ড অন্ধকারাচ্ছন্ন ভয় এবং কম জানা একটি বিষয়।
পত্রিকার সম্পাদক রুমি এবং নৃতাত্ত্বিক মারুফ বন্ধুর বিয়ের সূত্রে বহুবছর পর একত্রিত হয়েছেন। তাদের আরেক অসামাজিক বন্ধু শওকত আজকাল ভেন্ট্রিলোকুইজমের এক দক্ষ শো-ম্যান। ভেন্ট্রিলোকুইস্ট শওকতের শো দেখতে গিয়ে নেমে আসে তাদের জীবনে রাজ্যের বিপত্তি।
প্রায় প্রত্যেকের অন্ধকার অতীত আছে। শওকত, রুমি এবং মারুফ এর ব্যতিক্রম নন। কখনো কখনো এইসকল অতীত একবিন্দুতে এসে যখন ভয়ানক বর্তমানে পরিণত হয় তখন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সবাই। শওকতের তীব্র দূর্দশা থেকে পাল্টে যাওয়া, মারুফের অপরাধবোধ এবং রুমির ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে মুখোমুখি হতে হয় এক ভয়ানক রহস্যের। যা যুগ যুগ ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
ভেন্ট্রিলোকুইজমে শব্দ একদিক থেকে আরেকদিকে ছড়িয়ে দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে দেয়া হয়। দর্শক আনন্দ পায়। তবে এই আখ্যানে এমন বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আছে যে আনন্দ নয় সবাই যেন পৌছে যাচ্ছে এক অমোঘ, নিষ্ঠুর নিয়তির দিকে। ধামাচাপা দিয়ে রাখা সত্য, মানুষের উপর চালানো নিষ্ঠুর সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যার সূচনাকারীদের একজন জার্মানীর সেই কুখ্যাত একনায়ক, বিভিন্ন কাল্টের রিচুয়াল সব মিলেমিশে মারুফ, রুমি, হাসান সাক্ষাত এক দানবের মুখোমুখি হয়ে পড়েন। বিজ্ঞানের সাথে প্রেতচর্চাও চলছে যেখানে।
মাশুদুল হকের প্রথম পাঠ হয়েছিলো "গল্পরথ" সংকলনে তাঁর লিখা "খরগোশকে মারো" গল্পের মাধ্যমে। এই প্রথম তাঁর পূর্নাঙ্গ কোন উপন্যাস পড়ে শেষ করলাম। গল্পের প্লটে অনেক বিষয় আছে। নন-ফিকশনের কিছু বিষয় তিনি ফিকশনে রূপান্তরিত করেছেন। ফলে পাঠক বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং রিলিজিয়াস থিওলজির সাথে পরিচিত হতে পারবেন এই আখ্যানের যাত্রাতেই। রুমির ক্ষুরধার বুদ্ধি, প্রিয়জন বাঁচাতে মারুফের আকুতি এবং শওকতের রহস্যময় গতিবিধি ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি ভালোই। পেশাদারী না হওয়ার পরও মারুফ, হাসান এবং রুমির একদম ভয়ানক গুপ্তসঙ্ঘের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়াটা ভালো লেগেছে। কারণ তাঁরা বন্ধু বা প্রিয়জন রক্ষা করতে যেকোন মূল্য দিতে প্রস্তুত।
গল্পকথনে মাশুদুল হক ভেন্ট্রিলোকুইস্টের মতই ভূমিকা রেখেছেন। কোন জায়গার রহস্য যে কোথায় গিয়ে মিলেছে তা বুঝতে গেলে একধরণের ধাঁধায় পড়ে যাবেন সচেতন পাঠক। লেখক এক জায়গা থেকে আওয়াজ দিয়েছেন পাঠক হয়তো শব্দ পেয়েছেন আরেক জায়গা থেকে। প্রথমদিকে একটু স্লো স্টার্ট হলেও মাঝপথ থেকে আখ্যান ছুটেছে তীব্র গতিতে। তবে যেনামে এই উপন্যাস সেই ভেন্ট্রিলোকুইজম বিষয়ে মাশুদুল হক মনে হয় আরেকটু বিস্তারিত লিখতে পারতেন। তবে গল্পের শেষে এসেও একধরণের অস্বস্তি বোধ করতে পারেন অনেকে। লেখক কিছু বিষয় নিজের হাতে রেখে দিয়েছেন মনে হয়।
এই সমাজে আমরা প্রায় সবাই কারো শিখিয়ে দেয়া কথা ডামির মত বলে চলেছি অথবা কাউকে আমাদের কথা পুতুলের মত বলিয়ে নিচ্ছি।
এক হিসেবে আমরা সবাই ডামি। আবার আমরা সবাই ভেন্ট্রিলোকুইস্ট।
বেশ ভালো লাগলো মাশুদুল হকের প্রথম উপন্যাস ‘ভেন্ট্রিলোকুইস্ট’। ২০১৫ সালে কিনলেও এ কাজ-সে কাজ, ব্যস্ততা-অলসতা এসব মিলে আর পড়া হয়নি। এখন কোর্সের আগে যখন অফুরন্ত অবসর তখন হাতে নিয়ে আর ছাড়তে পারিনি। দারুন তথ্য সমৃদ্ধ আর নিঃসন্দেহে গতিময় বইটি আমাকে প্রথম পাতা থেকেই আটকে ফেলেছিল। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে নাজিম ভাই নতুন লেখকদের নিয়ে মৌলিক থ্রিলারের যে জোয়ার আনতে চেয়েছিলেন তাতে তিনি ১০০% সফল আর তাতে ডাক্তারদের ভূমিকা দেখে সত্যি গর্ব হয়। অনেক সময় কাহিনী আর দৃশ্যপট এতো তারাতারি পরিবর্তিত হচ্ছিল যে ভুলেই গিয়েছিলাম কোন বাংলা মৌলিক পড়ছি।
এবার কাহিনী সংক্ষেপঃ ছোটবেলা থেকেই একটু অন্য রকম শওকত। একবার টাইফয়েডে ওর বাকশক্তি হারিয়ে যায়। স্কুলের বন্ধুদের ক্রমাগত ‘বুলি’র সাথে যোগ হয় প্রিয় বন্ধু আর পছন্দের মেয়েটির চলে যাওয়া। ১০ বছর পর সেই শওকতই যখন ‘ভেন্ট্রিকুইলিজম’ এরমতো শব্দের জাদুকরি নিয়ে মঞ্চে হাজির হয় তখন অবাক না হয়ে পারে না দুই বন্ধু - নৃতাত্বিক মারুফ আর সাংবাদিক রুমি। কৌতুহলী হয়ে সেটার কারন খুঁজতে গিয়ে ওরা জড়িয়ে পরে দারুণ রহস্যময় এক অনুসন্ধানে। ধীরে ধীরে বেড়িয়ে আসে ক্রমবর্ধমান এক ধর্ম, প্রেতচর্চা, গণিতবিদ্যা, হারিয়ে যাওয়া সম্প্রদায়, হিটলারের গোপন গবেষণা আর পৃথিবী বদলে দেয়া এক আবিস্কারের খোঁজ। পরে মারুফ আর রুমি কি পারে সেই রহস্য ভেদ করতে? যার পদে পদে ওদের জন্য ওৎ পেতে আছে মৃত্যু, বিপদ, জড়িত আছে ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষের জীবন।
দুই বন্ধুর এ অভিযানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাসপাতাল গুলোর করুন চিত্র, গুপ্ত সংঘ থেকে শুরু করে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, প্রত্যাখান আর মার্সি কিলিং এর মতো গুরত্বপূর্ণ কিছু বিষয়।
কাহিনীর নতুনত্ব আর গতিময়তাই ‘ভেন্ট্রিলোকুইস্ট’ স্বার্থক করেছে। ভালো লেগেছে নামকরনের স্বার্থকতার করনেও। তবে পশ্চিমা লেখকদের হালকা ছায়া পুরো উপন্যাস জুড়েই ছিল। সিক্রেট, গুপ্তসংঘ, হারানো ধর্ম ইত্যাদি আসলে তাঁদেরই ‘আবিস্কার’ কিনা! তবে একদিক দিয়ে এটা কিন্তু ভালোই। প্লটের বৈচিত্র আর নানান তথ্যের সংযুক্তির কারনে ইদানিং লেখকদের বেশ গবেষণা করে গল্প লেখার মানষিকতা স্পস্টত প্রশংসার দাবি রাখে। সেই সাথে দেশীয় প্রেক্ষাপটে মাশুদুল হক পশ্চিমা রহস্যের ঘনঘটা বেশ সাবলিল ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষ করে বাহাই ধর্ম, তাদের টেম্পল, গোপন সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে অনেক তথ্য রয়েছে বইটিতে। প্রথম পুরুষে লেখার কারনে প্রথমে একটু অন্যরকম লাগলেও পরে মানিয়ে নিয়েছি। গ্রাম্য চরিত্রগুলোর চরিত্রায়ন, ডায়লগ বেশ শক্তিশালী ছিল। অযথা কেউ কোন কথা বলেনি। তবে একজন সপ্তাহিক পত্রিকার ফিচার এডিটর হিসেবে রুমীর প্রায় সব বিষয়ে বিস্তর জ্ঞান কিছুটা অতিনাটকিয়তা মনে হয়েছে! (এমন হয় নাকি? জানিনা কিন্তু) বানান ভুল তেমন চোখে পরেনি তবে কিছু যায়গায় শব্দ পুরো ছাপা হয়নি, এটা পড়ার গতিকে কমিয়ে দিয়েছে। তিন তিনটি এডিশনের পরেও একরম ভুল মেনে নেয়া কষ্টকর। উপন্যাসে এক যায়গায় ‘এক মাস চার্য ধারন সম্পন্ন মোবাইল ফোন’ এর উল্লেখ আছে! এই তথ্যটা একটু কেমন যেন তাই না? ফন্ট, কম্পোজ বেশ পরিচ্ছন্ন; কাগজের মান আর বাঁধাইএ ‘বাতিঘরিয়’ ছাপ স্পস্ট ছিল। প্রচ্ছদ কাহিনীর সাথে মানিয়ে করা তবে ডিটেইল-এ আরো একটু কাজ করা যেত বলে মনে হয়।
পরিশেষে বিশাল পরিসরে এরকম তথ্য সমৃদ্ধ একটি থ্রিলার অবশ্যই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সংযোজন। নতুন নতুন অনেক লেখক তাদের প্রগতিশীল চিন্তাধারায় এ জনরা কে আরো অনেক দূর নিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। মাশুদুল হকের জন্য বিশেষ শুভকামনা থাকবে, ‘আপনি আমাদের ডাক্তার সমাজের অহঙ্কার। আরো অনেক অনেক গল্প পড়তে চাই আপনার।’
রকমারী, বুকস্ট্রিট, বিবিধ, বাতিঘর সহ প্রায় সব অনলাইন বুক স্টোরেই পাবেন ‘ভেন্ট্রিলোকুইস্ট।’ ১৯১ পৃষ্ঠার বইটির গায়ের দাম ২০০ টাকা। তাছাড়া, ছাড় তো থাকছেই। তাই যারা এখনো পড়েননি তারা পড়ে দেখতে পারেন। ভালোই লাগবে আশা করি।
রেটিং এ আমি ১০ এ ৯ দেব।
ভালো থাকবেন সবাই। বই এর আলোয় আলোকিত হোক সবার জীবন।
ভেন্ট্রিলোকুইস্ট " গল্পটি শুরু হয় দুই বন্ধু মারুফ এবং রুমির এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হবার মধ্য দিয়ে। কথায় কথায় জানা যায় তাদের আরেক বন্ধু শওকতের কথা। একসময় কথা বলার প্রব্লেম থাকলেও সে এখন একজন ভেন্ট্রিলোকুইস্ট । তার সাথে দেখা করতে গিয়ে তারা এক অদ্ভুত পরিস্থিতির শিকার হয়। পড়ে শওকতের শোতে গিয়েও তারা এইরকম কান্ড দেখে। এজন্য দুই বন্ধু আগ্রহী হয়ে শওকতের অতীতের ব্যাপারে খোঁজ নিলে ঘটতে থাকে নানা অদ্ভুত ঘটনা। বেরিয়ে আসতে থাকে দেশের ভিতরে থাকা বিভিন্ন গোপন সংঘের নানা কীর্তিকলাপ। এ ধরণের একটি প্লট নিয়েই লেখা হয়েছে মাশুদুল হকের ভেন্ট্রিলোকুইস্ট যা পাতায় পাতায় পাঠকদের মোহাবিষ্ট করে রাখতে সক্ষম। - রেটিং : ৯/১০ (ভেন্ট্রিলোকুইস্ট মূলত একটি হিস্টোরিক্যাল ফিকশন। লেখকের লেখার ভিতরে Dan Brown এর ছায়া পাওয়া যায়। অবশ্য এ দেশের প্রেক্ষাপটে এ রকম লেখার জন্য লেখক বাহবা পেতেই পারেন। কাহিনী বেশিরভাগ সময় মারুফের জবানবন্দিতে বলা হয়েছে যা উপভোগ্য। হিস্টোরিক্যাল ফিকশন হলেও বইতে নানা ধরণের রিলিজিয়াস আর মেডিক্যাল টার্ম ছিল। আর ভেন্ট্রিলোকুইস্ট নাম ও খুব ভাল লেগেছে কারণ আপাত দৃষ্টিতে শওকতকে ভেন্ট্রিলোকুইস্ট মনে হলেও আসলে প্রকৃত ভেন্ট্রিলোকুইস্ট ছিল আরেকজন যার নির্দেশেই বাকিরা পুতুলের মত কাজ করেছে। কাহিনী খুবই ফাস্ট আর শেষে রয়েছে বেশ কয়েকটি দুর্দান্ত টুইস্ট। এই বই প্রকাশ পাওয়ার পরে এর বিরাট সাফল্যের কারণে এ বছর এর সিক্যুয়াল "মিনিমালিস্ট" বের হয়। - এক কথায় , বাংলাদেশের হিস্টোরিক্যাল ফিকশন জনরার একটি মাইলফলক ভেন্ট্রিলোকুইস্ট। যাদের হিস্টোরিক্যাল ফিকশন আর গুপ্তসংঘ সম্পর্কিত বই পড়তে ভালো লাগে তাদের জন্য একটি মাস্ট রিড বই "ভেন্ট্রিলোকুইস্ট " . )